Tuesday, November 3, 2020

কালপ্রিট

 ঙ্গার ধারে সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষকদের কিছু কোয়ার্টার। বিকেল হতে না হতেই প্রায় সবার গাড়িগুলো বেরিয়ে যায়। বেশির ভাগ নতুন। নতুন প্রধানমন্ত্রী পদভার গ্রহণ করে নতুন আর্থিক নীতিসমুহ জারি করার পর থেকেই হঠাৎ বাজারে গাড়ি কেনার ধুম পড়ে গেছে। গাড়িও বেরুচ্ছে প্রতিদিন নতুন নতুন রকমের। জাপানি টেকনলজির ব্যাপারটা তো আছেই। চতুর্দিকে আশু লক্ষ্মীলাভের একটা আবহাওয়াও আছে। তবে সবচেয়ে বড় বোধহয় মনোজগতের দিকটা। যুবক প্রধানমন্ত্রীর সদাসপ্রতিভ মুখশ্রীতে আর চলনে বলনে কেমন একটা বরাভয় আছে, সময় নষ্ট কোরো না। কিছু করে গুছিয়ে নেওয়ার এই কটা দিন; বিশ্বাস রাখতে পার, আমি কোনো কিছুতেই বিচলিত হব না।

আপাততঃ যে ব্যাপারটার দৌলতে এই গাড়ির সৌভাগ্য এসেছে শিক্ষকদের ঘরে, সেইদিকেই বিকেলে যায় গাড়িগুলো শহরে নতুন গজানো বিভিন্ন কোচিং ইন্সটিট্যুটে।

আড্ডার সময় আর আজকাল থাকেই না বলতে গেলে। সকালে, বিকেলে এমনকি রোববারেও একবেলা কোচিং চলে। এছাড়া কলেজের দুচারটে ক্লাস। বাড়ি তৈরি হচ্ছে তার তদারকি, বা বিজনেস, বা বই লেখা। দম ফেলার ফুরসৎ নেই। তবু সন্ধ্যের পর আড্ডা জমে কোথাও কোথাও, কোনোদিন। এর ওর তার বাড়ি। কয়েকটি বাড়ি অবশ্য একটু বিশেষ নামধন্য। ঈষৎ স্বল্পালোকে বিভিন্ন ধরণের কিছু মানুষজন আসে যায়। মাঝে মাঝে পুলিসের রেইডও হয়। কিন্তু নিজের নিজের জাতের মহলে ওই শিক্ষকদের অভেদ্য জনপ্রিয়তা পুলিস-রেইড ভেদ করতে পারে না। রাজনৈতিক রঙ চড়ে গেলে তো কথাই নেই। এমনিতেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে তারা একেকটি স্তম্ভ।

বাকিরা সাধারণ জীবনে উদারপন্থী। এদেরই একজন জনপ্রিয় উদারপন্থী এইচ.বি.কুঁঅর। তাঁর বাড়ির আড্ডাটা সাধারণতঃ খুব ঘরোয়া ধরণের এবং সম্ভ্রান্ত। মদ্যপান যে যার বাড়িতে করে আসতে পারে, কিন্তু এখানে তার মাতলামোও চলবে না আর পান তো চলবেই না। কেননা বাড়ির মহিলারাও সে আড্ডায় বসেন। শিশুরা এলেও কাউকে গলা খাটো করতে হয় না। তবে নিজেই আসেনা শিশুরা, বোর হবে বলে। ভিডিও গেমস বা ভিসিআর অনেক বেশি উপভোগ্য তাদের জন্য।

সেদিন সন্ধ্যায় কুঁঅর সাহেব, প্রাক্তন প্রতিবেশী জে.মোহন, সুরেন্দ্র কুমার ও তাঁর স্ত্রী (তিনিও লেকচারার) দিপিকারানী এবং দেবদত্ত সরকার বসেছিলেন। চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। রোজকার মত, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে আলোচনাটা একটু এগোবার পর, নিজেদের প্রয়াসে একটা প্রাইভেট কলেজ খুলবার প্ল্যানিংএ বদলে গিয়েছিল। কিন্তু, তাতে উদ্যোগ নেওয়ার মত উদ্যমী কারো অভাব থেকে যাওয়ায় হঠাৎ সবার মনে হচ্ছিল যে রাত বাড়ছে।

এমন সময়ে কুঁঅর সাহেবের ছেলে সুধাংশু উদভ্রান্ত মুখে গেট দিয়ে ঢুকে সোজা ভিতর দিকে চলে গেল। একটু পরে কুঁঅর সাহেবের স্ত্রী ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এলেন আড্ডার মাঝে, তুমি আগেই রেগে মেগে কিছু বলে বোসো না, ভয়ে কাঠ হয়ে আছে ছেলেটাআচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে, কী হয়েছে ...

ইত্যাকার বাক্যাংশসমূহের বিনিময়ে বোঝা গেল যে ছেলেটি নিজের বুলেট চালিয়ে ফতুহার দিকে গিয়েছিল। পিছনে ছিল ওর বন্ধু সঞ্জয়, মিসেস নাথের ছেলে। সেখান থেকে ফেরার সময় একটা বাজার এলাকায় ওদের গাড়ি একটা বাচ্চা ছেলেকে ধাক্কা মারে। ছেলেটা চায়ের দোকান থেকে তারের জালিতে ভরা চায়ের গেলাস নিয়ে রাস্তার উল্টো দিকে কাপড়ের দোকানে যাচ্ছিল। ... লোকজন বাইকচালক ও তার বন্ধুকে ঘিরে ধরে বেসামাল করে দেয়। ওরা পড়ে যায়। মার খেতে খেতেই সে, মানে সুধাংশু, কোনো রকমে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে পালায়। সঞ্জয় পালাতে পারেনি। গাড়িটা ওখানেই পড়ে আছে।

বাচ্চা ছেলেটা? মরেনি তো? সবাই একসাথে প্রশ্ন করে উঠল। জানিনা, সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল সুধাংশু। মনে হয় না মরবে জে.মোহন নিজের মনে চিন্তা করতে করতে বললেন, শুনে যা মনে হচ্ছে বাঁসাইডে ধাক্কা লেগেছে ছেলেটার। পড়েছে ডানদিকে। মাথার সামনের দিকে ডানদিকটা ফেটে রক্ত বেরুচ্ছিল বলল সুধাংশু।

কাঁচের গেলাসের টুকরোগুলো পেটে ঢুকে গেছে বলল, মাথা ঝাঁকিয়ে শিউরে উঠলেন দীপিকারানী।

এবার ছাড়ুন এসব। আগে কিছু করার কথা ভাবুন। একটা ছেলে ওখানে আটকা পড়ে রয়েছে। মিসেস নাথ এখনো বোধহয় জানেন না। দেবদত্ত সরকার ওঠার উপক্রম করাতে জে.মোহন হাত দিয়ে বসার ইঙ্গিত করলেন, অধীর হয়ে লাভ নেই। কী করণীয় ভেবে নিন।

করণীয় তো চারটে কাজ দেবদত্ত সরকার হাতে গুনলেন, এক, ওই ছেলেটির হাল তবিয়ৎ জেনে ওকে ফেরত পাওয়া, দুই, মটোরসাইকেলটা পাওয়া, তিন, বাচ্চা ছেলেটার আত্মীয়স্বজনের দিক থেকে দাবী এলে ক্ষতিপূরণটা দরাদরি করে স্থির করা আর শেষ, কিন্তু জরুরি কাজ, পুলিশের ঝামেলাটা সামাল দেওয়া।

জে.মোহন দেবদত্ত সরকারের সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে সিগারেট বার করতে করতে বললেন, অত সোজা নয়। যেভাবে আঙুল গুনছেন। ওই চারটে মিলে একটা কাজ (হাতের চেটো দুটো দুকানের দুপাশে মেলে) ঝঞ্ঝাটমুক্ত হওয়া।

সুরেন্দ্র কুমার চাগিয়ে ওঠেন এতক্ষণে। বয়স অপেক্ষাকৃত কম। চল্লিশের একটু ওপরে। বুদ্ধিদীপ্ত, স্মার্ট আর স্ত্রীকে সাথে নিয়ে মেড-ফর-ইচ-আদারের মত জুটিতে ঘুরে বেড়ান। আমার মনে হয় আমাদের আর বসে থাকা শোভা পাচ্ছে না। কম সে কম ছেলেটিকে ছাড়িয়ে আনার ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হবে। বাকি সব তো সামাল দেওয়া যাবে... বলতে বলতে মুখটা উদাসীন হয়ে ওঠে তাঁর। মনে মুচড়ে ওঠে, ...হৃদয় সাক্ষী যে আমি ওদেরই লোক... ওই যারা এখন রক্তাক্ত বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে হয়ত হাসপাতালে...। হঠাৎ তাঁর স্ত্রী দীপিকা অস্ফুট স্বরে ককিয়ে ওঠেন, ইস্‌স্‌, আমি ভুলতে পারছি না! সুরেন্দ্র কুমার ধমক দেন উদাসীন স্বরেই, ভাবুক হয়ো না। তুমি কিছু করতে পারো না এখানে বসে। এখন এই ছেলেটিকে বাঁচানোর প্রশ্ন। এরকম মোমেন্টে মব্‌এর তো আর জ্ঞান থাকে না! কিছু একটা হয়ে গেলে...!

সুধাংশুর বাবা এইচ.বি.কুঁঅর অনেকদিন হল ছেলেকে বকেন নি। তিনি অনুভব করলেন যে সবার মুখ তাঁর দিকে ঘুরে গেছে। তিনিই এবার কিছু সিদ্ধান্ত নেবেন, কোথাও যাবেন বা যাওয়ার কথা বলবেন, বা অন্যদের মতামত চাইবেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, প্রয়োজনীয় জিনিষটা, অর্থাৎ টাকাটা বার করবেন। বিভাগের অধ্যক্ষ তিনি, পিতৃত্ব জাহির করার এই সুযোগ তিনি হারালেন না। ক্ষুব্ধ ভারী গলায় বলে উঠলেন, মুখ উজ্জ্বল করেছ ইউনিভার্সিটি কলোনির (পিতার বলতে সাহস যোগাল না, ছেলেকে বিশ্বাস নেই), একটা হত্যা করে এসেছ, বন্ধুকে ছেড়ে দিয়ে এসেছ মরবার জন্য! নতুন বুলেট মটোরবাইকের দামটা মনে করাতে গেলে আবার তাল কেটে যাবে, তাই বললেন না, কী, চাও কী? টাকা চাও, এই তো? ... নিয়ে যাও! লোটাও! ... মুখ বন্ধ কর, কার কার মুখ বন্ধ করতে চাও!...

অতি আবেগসমৃদ্ধ ভাষার একটা নিজস্ব শক্তি আছে। আচমকা হলেও, মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তার আমেজটা বেশ কিছুক্ষণের জন্য নেশার মত বুঁদ করে দেয়। হটাৎ মাটিতেও নেমে আসা যায় না। যতটা ওঠা গেছে আবেগে ভর করে, তার ওপরে আর ওঠাও যায় না। একটা নিরালম্ব ভাব। অন্য কারোর সাহায্যের দরকার হয় সে সময়। হাততালি বা এনকোরের সময় এটা ছিল না তাই, সেই সাহায্যটাই অন্যভাবে করলেন জে.মোহন। নিজের চশমা খুলে পরিষ্কার করতে করতে বলে উঠলেন, রাতও অনেক হতে চলল।

কথাটা পুলিশের গাড়ির হুটারের কাজ করল। কুঁঅর উঠে গেলেন ভিতরের বারান্দায়। ফোনটা ওঠালেন। তারপর ফোন রেখে ফিরে এসে বললেন, নাঃ, এসব ফোনে হয় না। মিঃ সরকার, চলুন, আপনার গাড়িতেই যাওয়া যাক। কিছু ক্যাশও রেখে নেওয়া ভালো। আমি আসছি ভিতর থেকে, তৈরি হয়ে, আপনি ততক্ষণ গাড়িটা বার করুন। মানে ... বেশি অসুবিধে করে দিচ্ছি না তো?

দেবদত্ত সরকার আহত কন্ঠস্বরে কথা কেড়ে নেন, আহ, এখন কি ফর্মালিটি করার সময়? চলুন! অল অফ আস আর অ্যাঙ্কশাস টু সী দ্য থিংস সেট্‌ল্ড। সবাই যাব আমরা, গাড়িতে যথেষ্ট জায়গা আছে। শেষ কথাটা দেবদত্ত সরকারের রিফ্লেক্স বলিয়ে দিল, কেননা তাঁর গাড়িটা সস্তা হলেও সদ্য কেনা ছাই-নীল রঙের মারুতি ওমনি

সুরেন্দ্র কুমারের স্ত্রী দীপিকারও রিফ্লেক্স বলিয়ে দিল সঙ্গে সঙ্গে, তাড়াতাড়ি পৌঁছোতেও হবে! কন্ঠস্বরে দুশ্চিন্তা আনলেন তিনি। তাঁদেরটা প্রিমিয়ার ১১৮ এন ই।

কী বলব! আমাদের গাড়িটা এত ট্রাবল দিচ্ছে! আবার তো গ্যারেজে গেছে। নইলে সরকারবাবুকে কষ্ট দিতাম না। অ্যাম্ব্যাসাডার মার্ক টু এর মালকিন শ্রীমতী কুঁঅর বলে উঠলেন।

জে.মোহন কৃপণ। তাঁর নেশা বাড়ি, আর কোঅপারেটিভের মারফৎ জমির ব্যবসা। পঁচিশ তিরিশ ঘর ভাড়া পান তিনি শহরের দুটো পুরোনো বাড়ি আর একটা নতুন, ফ্ল্যাটের ধরণে তৈরি করা বাড়ি থেকে। সিগারেট, ফোকটে পেলে যথেষ্ট খান এবং নিজেই সেটা ভাঁড়ামো করে বলেন যাতে অন্য কেউ আর বলতে না পারে। কলেজ যান ভাইপোর স্কুটারে বসে। বা অন্য কোনো ছাত্রের। তিনিই প্রবোধ দিলেন, যতই ট্রাবল দিক মিসেস কুঁঅর, ও হল সোনা! অ্যাম্ব্যাসাডার এখনো ইন্ডিয়ান রোড কন্ডিশনে বেস্ট গাড়ি।

তা অবশ্য ঠিক! সবাই সমস্বরে শ্রীমতি কুঁঅরকে সান্ত্বনা দিতে জে.মোহনের কথায় সায় দিলেন।

 

মহিলাদের যাওয়া হচ্ছিল না। বাবার কথা শোনার পর সুধাংশু নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছিল বহুক্ষণ আগে। বাকিরা যাওয়ার জন্য দেবদত্ত সরকারের গাড়িতে বসেছিলেন এমন সনয় বুলেটের সিংহনাদ। এগিয়ে এল মোটরবাইকটা। সবাই সবিস্ময়ে দেখলেন সুধাংশুর সেই বন্ধু সঞ্জয়, সঞ্জয় নাথ। ঠোঁটে একটা কাটা দাগ আর সোয়েটারটা কাঁধের কাছে ছেঁড়া। বাকি সব কিছুই বাইরে থেকে অক্ষত মনে হল।

সকলের হতচকিত অবস্থা ভেঙে কথাটা ছুঁড়ল সেই, কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?

-       ডিএম ইকবাল আহমেদের বাড়ি। কিন্তু তুমি!...

কথাটা আর শেষ করতে পারেন না এইচ.বি.কুঁঅর।

শক্ত পোড়খাওয়া ছেলের ভঙ্গিতে অর্থাৎ টাফ গাই স্টাইলে কাঁধ ঝাঁকাল সঞ্জয়। ততক্ষণে সুধাংশু এসে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল।

আহ বেচারা তখন থেকে কাঁদছে তোমার কথা ভেবে শ্রীমতি কুঁঅর সঞ্জয়ের উদ্দেশে কথাটা বললেন ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে। তারপর গাড়ি থেকে নামতে থাকা পুরুষদের বললেন, ওকে এখন আটকাবেন না। কী হয়েছিল পরে জানলেও চলবে। আগে ঘরে গিয়ে চোখমুখ ধুয়ে ও একটু বিশ্রাম নিক। সুধাংশু, নিয়ে যাও সঞ্জয়কে। নিজের ঘরে নিয়ে যাও।

 

*                       *                       *                       *                       *

রাত এগারটায় এইচ.বি.কুঁঅরের কোয়ার্টার জমজমাট।  

আজকাল এও এক ফ্যাচাং হয়েছে। দেখে শুনে রাস্তা পেরোবে না, বাচ্চাকাচ্চা দেখেশুনে রাখবে না আর ব্যাস্‌ ... যেই ধাক্কা লাগল ... মার, মার, মার, গাড়ি ভাঙ ... ক্ষতিপূরণ দাবি কর! যেন তাতেই সব সুরাহা হয়ে যাবে। রাস্তার কী অবস্থা দেখবি না? কই, তার জন্য তো সরকারকে ধরিস না? ... দেবদত্ত সরকার কথাগুলো বলে সুরেন্দ্র কুমারের দিকে মতামতের জন্য তাকান।

জে.মোহন অভিজ্ঞ লোকের মত বলে ওঠেন, গাড়িও অত জোরে চালান উচিৎ নয়। জান যখন যে পাব্লিক মানে পাব্লিক!

-       বাঃ, এটা একটা কথা হল বটে! অ্যাক্সিডেন্ট ইস অ্যাক্সিডেন্ট! তাতে কারো কোনো হাত নেই!

-       মানুষ তো মরে?

ম্যালথাসের থিওরি প্রমাণিত হয় শ্লেষের সুরে বললেন সুরেন্দ্র প্রসাদ যদিও বোঝা গেল না কাকে লক্ষ্য করে। কত অমূল্য প্রাণ এ দেশের মানুষের! ... মুখটাকে একটু গম্ভীর ও কষ্টকন্টকিত করে বললেন, আমার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল জানেন? সেই স্টুডেন্টলাইফে। রাঁচি থেকে ফেরার পথে রজৌলি থেকে একটু এগিয়ে এসে। বাবার সেই ল্যান্ডমাস্টারটায়। আমরা চার বন্ধু ছিলাম। ড্রাইভ করছিলাম আমিই। দুতিন রাত হুল্লোড়বাজির ধকল, ফ্যাটিগ ... । হঠাৎ বুড়িটা সামনে পড়ে গেল। কোনো রকমে পাশ কাটিয়েও বুঝতে পারলাম পুরোটা কাটাতে পারিনি। আর্তনাদ শুনতে পাওয়াটা এত অব্‌ভিয়াস ছিল যে সেটাও আর আলাদা করে মনে করতে পারি না। পিছনে একটা সম্মিলিত শোরগোল আর পাশে তিওয়ারির চাপা চিৎকার, ব্রেক নিবি না, ইডিয়েট, সামনের দিকে তাকা, স্পীড নে!পিছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছিলাম একটা ভিড় চারদিক থেকে সাঁড়াশির মত এগিয়ে আসছে। ওঃ, এখনও আতঙ্ক হয়। ধরা পড়লে ...

দীপিকা আহতস্বরে অভিযোগ করলেন, তুমি তো কখনো বল নি আমায়! শ্রীমতি কুঁঅর কাহিনীর পরের অংশটা জানতে চাইলেন।

-       আমি আর আজ অব্দি ও রাস্তা দিয়ে কার নিয়ে যাইনি। ট্রেনে নয় তো বাসে গেছি। ... রাত ছিল, রাস্তায় আলো ছিল না, তাই গাড়ির নম্বরটম্বর কেউ দেখেছিল মনে হয় না। কেননা কোনো কিছুই হয় নি তারপর। খবরকাগজের মাঝের পাতাগুলোতেও চোখ বুলিয়েছিলাম দিন কয়েক। কিছুই বেরোয় নি।

তখন আর এসবের কভারেজ ছিল কোথায়। পুলিসে আদৌ খবর পৌঁছেছিল কিনা তাও তো বলা যায় না! বলেই দেবদত্ত সরকারের মনে হল লাগসই হল না। তাই স্তোক দিলেন, আর ধাক্কাটা যে ধরণের বলছেন তাতে কিছু হয়েছিল বলে মনে হয় না। ওদের বুড়ো হাড়ে যথেষ্ট জোর থাকে।

আমি তো এই জন্য ওনাকে বলেছিলাম ড্রাইভারকে না ছাড়াতে, একটা ড্রাইভার থাকলে কত সুবিধে হয়! শ্রীমতি কুঁঅর বললেন, আমি তো শুনেছি অনেক এ্যাক্সিডেন্ট কেসে ড্রাইভার গাড়ি না চালালেও স্বীকার করে নেয় যে সেই চালাচ্ছিল। শাস্তিটা সেই ভোগ করে; শুধু তার পরিবারের একটা মাসিক খোরপোষের ব্যবস্থা করতে হয়!

সেটা কথা নয় এইচ.বি.কুঁঅর ধমকে উঠলেন, পাব্লিক ফেরোশাস হয়ে উঠলে কটা হাড় ভাঙল তাও গুনে দেখে না আর দোষ তোমার না ড্রাইভারের, তাতেও কান দেয় না। ক্ষতিপূরণ কতই বা দেবে?

শ্রীমতি কুঁঅর স্নেহশীলা গৃহকর্ত্রী, আমার তো মনে হয় যা চায় তা দিয়ে, বরং একটু বেশি দিয়েও হ্যাঙ্গামটা শেষ করে দেওয়া উচিৎ।

ক্ষতিপূরণের গল্প শুনবেন? জে.মোহন অভিজ্ঞ লোকের শেষ কথা শুরু করলেন, তাহলে আমার ভাইপোর গল্প বলি শুনুন।

দীপিকারানি দাবড়ে দিলেন, ও গল্প অনেকবার শুনেছি। ওরকম সবার ক্ষেত্রে হয় না। সব মানুষকে অত লোভী ভাবা উচিৎ নয়।

কী গল্প? শ্রীমতি কুঁঅর জানতে চান।

-       আরে, ওনার সেই পেটেন্ট গল্প। এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল ওনার ভাইপোর। একটা ছেলের হাতের ওপর দিয়ে স্কুটার চালিয়ে দিয়েছিলেন গুণধর। তারপর সেই ছেলেটির বাবা আর ভাই নাকি রোজ হানা দিতে শুরু করে ওনার বাড়িতে। আজ ভাঙা হাড় জুড়ছে না, পরশু হাত কেটে বাদ দিতে হবে, তরশু গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছে ... মানে পয়সা ছাড় আরো, নইলে পুলিসে লেখাব। শেষে উনি নাকি মাস্তান লাগিয়ে আর ওই গ্রামের মুখিয়ার হাত গরম করে ব্যাপারটা ঠান্ডা করেন।

-       তা, আমি কি বানিয়ে বলি?

একশোবার! দীপিকারানি হঠাৎ স্বাতন্ত্র্যবোধসম্পন্ন নারী ও শিক্ষিকা হয়ে ওঠেন জে.মোহনের দুর্বলতায় খোঁচা মেরে, আপনার নিজের যা ফিলসফি! কৃপণের মত শুধু পয়সা ধরে রাখা। স্টুডেন্টের স্কুটারে চড়ে ক্লাস নিতে যান। আর... ওই ফিলসফির সাপোর্টিভ কিছু এনেক্‌ডোট জুটিয়ে রেখেছেন। তাও মিস্যান্থ্রোপিক টাইপের।

জে.মোহন বুদ্ধিমান। বোঝেন যে প্রতিপক্ষ নারী আর এই মুহুর্তে তার ধমকটা বেশ মিষ্টি ধরণের। কাজেই কথাগুলো বিনা প্রতিবাদে হজম করে দেবদত্ত সরকারকে বললেন, দিন সরকারবাবু, আরেকটা ফোকটের সিগারেট খাই। বদনাম তো হয়েই আছি।

শ্রীমতি কুঁঅর ওঠার তোড়জোড় করেন, আপনারা শুধু কথাই বলবেন? ছেলে দুটো সেই দুপুর থেকে কিচ্ছু খায় নি। আমি যাই, ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করি। মিসেস নাথ যখন কিছু জানেন না তো আর জানাবারও দরকার নেই। আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি যে সঞ্জয় আমাদের কাছে আছে।

 

তখনই একটা পুরোনো ভক্সহল ভিতরে ঢুকল। রসিক মেজাজ মি.সিন্‌হা। ভদ্রলোক এইচ.বি.কুঁঅরের বড় শালা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বোদ্ধা, বড় বড় কয়েকটা কম্পানির শেয়ার হোল্ডার, কেন্দ্রীয় বিহার কয়েকটা বড় জোতএর মালিক ও তৎসমীপবর্তী জঙ্গল ও নদীতীরের পাখিগুলোর উৎসাহী শিকারি। এছাড়া আরো কিছু পরিচয় আগে ছিল, এখন আর নেই।

সবাই তাঁকে ওয়েলকাম করল। মি.সিন্‌হা নামক মানুষটি তাঁর নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অনুরূপ ভারী ধরণের পদক্ষেপ ফেলে এগিয়ে এসে সবচেয়ে আগে জিজ্ঞেস করলেন, কই, ওরা কোথায়?

শ্রীমতি কুঁঅর উঠলেন, বোসো, আমি ওদের ডেকে নিয়ে আসছি।

কেউ কোনো কথা শুরু করবে তার আগেই ওরা দুজনে মানে সুধাংশু আর সঞ্জয় বেরিয়ে এল। এত তাড়াতাড়ি, এক ডাকেই বেরিয়ে এল কারণ বড় মামাকে ওরা যে কারণেই হোক, বেশ শ্রদ্ধার আসনে রাখে। মি.সিন্‌হা উঠে গিয়ে আগে সঞ্জয়কে জড়িয়ে ধরলেন। একসাথে সবাই আশ্চর্য হল, উনি জানলেন কী করে যে আজকের ঘটনায় সঞ্জয়ই হিরো? কিন্তু কেউ বলল না কিছু। মি.সিন্‌হা তারপর হাত রাখলেন সুধাংশুর কাঁধে, ভীষণ চিন্তিত ছিলাম খবরটা শুনে। তা সঞ্জয়ও ফিরে এসেছে সেটা দময়ন্তী বলল না তো!

এই যাঃ শ্রীমতি কুঁঅর জিভ কাটলেন, ওকে তখন ফোন করে জানিয়েছিলাম ঘটনাটা, পরে সঞ্জয়ের ফিরে আসার কথাটা বলতে ভুলে গেছি। প্লীজ বলে দিও নমিতাকে যে আমি সত্যিই ভুলে গেছি, সরি!

মি.সিন্‌হা একটা চেয়ার টেনে বসে ছেলেদুটির দিকে তাকিয়ে জুলজুল করে হাসেন। মদের গন্ধ ছড়ান, তারপর? শেষ অব্দি হলটা কী? গাড়িটা কোথায়?

বলে দাও সঞ্জয়! তুমিই তো আজকের হিরো! বাঙালি দেবদত্ত, বিহারের পুরোনো বনেদী মি.সিন্‌হার সাথে একটা নৈকট্য অনুভব করেন সর্বদাই। বোধহয় কালচার্ড বলে।

সঞ্জয় কনভেন্টি ইংরেজি মেশান হিন্দীতে মি.সিন্‌হা, মানে মামাজিকে বলে যায় আনুপূর্বিক, যেন কিছুই হয় নি এভাবে কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে, শ খানেক পাব্লিক ছিল। অন্ধকারও ছিল। একটা ছেলে প্রথমেই ঘুঁষি মেরেছিল, ঠোঁটে তার রক্ত আর জ্বালা জ্বালা ভাব ছিল। ভয়ও। পাঁচ-ছ জন পিছন থেকে পিঠে আর ঘাড়ে মারছিল তবে সেটা খুব বেশি লাগছিল না। ওদিকে বাচ্চার মাটাও দৌড়ে এসে গিয়েছিল। বুকের কাছের জামাটা টেনে গালি দিচ্ছিল। সুধাংশু আদৌ পালিয়ে যেতে পেরেছে নাকি ওরা সামনে কোথাও ওকে ধরে ... সে চিন্তাও ছিল। ...

দেখ! হী নেভার থট ইল এবাউট হিম! হোয়াট এ ব্রেভ ল্যাড! এইচ.বি.কুঁঅর এই প্রশংসাটুকু করা কর্তব্য মনে করলেন, আহা, ওর মা যখন নাকি জানেনও না এখনো। সঞ্জয়ের বাবা মারা গেছেন আগেই। মা রীডার, আর গার্লস হস্টেলের ইনচার্জ।

ওরই মাঝে দেখলাম সঞ্জয় বলছিল, বাচ্চাটাকে দুচারজন ঠেলায় তুলে নিয়ে যেতে লাগল কোনো ডিস্পেন্সারির দিকে...

প্রচুর রক্ত ছিল? দীপিকা প্রশ্ন করলেন।

-       ওঃ, ইট ওয়জ হরিব্‌ল। (মাথা নিচু করল সুধাংশু)

-       তারপর?

-       তারপর কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। আমি কথা বাড়াই নি। আর গাড়িটা আমি চালাচ্ছিলাম না তাই বুড়োদের কথায় আমাকে না মেরে বেশির ভাগ ছেলে দৌড়ে চলে গিয়েছিল সুধাংশুকে ধরতে। আমিও সেটা নিয়েই আতঙ্কে ছিলাম। ... হঠাৎ থানার ওসি এসে পৌঁছোলেন মোবাইল টিমের সাথে। দেখি ...আঃ, এ তো পাপার এক সময়কার বন্ধু ভগত আঙ্কল। তিনিও অবস্থা বুঝে তক্ষুনি শক্ত হাতে ভিড় সরালেন। আমার সাথে পরিচয়টা বুঝতে দিলেন না পাব্লিককে। কষে ধমক টমক দিয়ে বসিয়ে দিলেন ভ্যানে। গাড়িটাও উঠিয়ে নিলেন কনস্টেবলকে দিয়ে। আমার কাছে তো টাকাও ছিল না। ওখানকারই লোকাল এক ঢাবা মালিকের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার দেওয়ালেন ভগত আঙ্কলই। আরো দশ হাজার টাকা দেওয়ার কথা আমাকে দিয়ে কবুল করালেন। ... তারপর আর কী? থানা থেকে মোটরসাইকেলটা চালিয়েই চলে এলাম এখানে।

টাকাটা ঠিক হাতে পৌঁছেছে তো? সুরেন্দ্র কুমার জানতে চান, আজকাল তো লোকাল চ্যাংড়াগুলোই গার্জেন আর রিলেটিভ সেজে দাঁড়িয়ে যায় পয়সা হাতাবার লোভে।

-       জানিনা। ভগত আঙ্কল তো ওই মাটার হাতেই দিলেন।

-       ওর হাতে কি আর থাকবে?

এইচ.বি.কুঁঅর উঠতে উঠতে পনের হাজারের ঝাল ঝাড়েন, সুধাংশুর শেখা উচিৎ। আজ বন্ধুর জন্য ওর প্রাণ বাঁচল। ওরই দেওয়া উচিৎ ওই টাকাটা, আমার নয়, মনে মনে ভাবলেন, পরে ভগতের সঙ্গে দেখা করে টাকার পরিমাণটা কমান যায় কিনা দেখবেন।

মি.সিনহা প্রশ্ন করেন, তোমার মাকে জানিয়েছ?

-       না, আর মা তো জামশেদপুরে। বাড়িতে আমি একা।

সবাই শিউরে ওঠেন যে কিছু একটা হলে মিসেস নাথকে কী জবাব দিতেন তাঁরা!

জে.মোহন স্বস্তির কথাটা বললেন, এফ.আই.আর হয়নি এটা একটা ভালো কথা।

সুরেন্দ্র কুমার জীবনের তিক্ততায় অভিজ্ঞ লোকের মত বলে ওঠেন, এফ.আই.আর হলেও কিছু হতনা অবশ্য। হতে দিতাম না কি আমরা? ঘরের ছেলেরা বলে কথা! প্রয়োজনে এখানে কালপ্রিট ভাড়ায় পাওয়া যায় ভাই!    

 

      

No comments:

Post a Comment