Tuesday, November 3, 2020

স্ট্যাটিস্টিক্স

 

ইউনিভার্সিটির বেতন দেওয়া হয় বলে ব্যাঙ্কটায় প্রত্যেক মাসের প্রথম সপ্তাহে ভীড় গিজগিজ করে।

কাউন্টারের সামনে অন্য অনেকের সাথে প্রফেসর গিরধর রায়ও ধ্বস্তাধ্বস্তি করছেন। তাঁর সতীর্থদের মধ্যে অনেকেই এটা করেন না। তাঁরা একটু ইতিউতি চেয়ে পরিচিত কোনো চেহারা খুঁজে না পেলে ভারিক্কীভাবে ম্যানেজারের চেম্বারে যান। জাতীয়কৃত ব্যাঙ্কে কাজকর্মে ক্রমবর্দ্ধমান অবনতি সংক্রান্ত জনপ্রিয় আক্ষেপগুলো উচ্চারণ করেন, অসহায় ম্যানেজারের প্রশংসা করেন, তারপর আস্তে করে টোকেনটা এগিয়ে বলেন কোনো চাপরাশিকে দিয়ে টাকাটা আনিয়ে দিতে। অবশ্য এতটার দরকারও সবসময় হয়না। কর্মচারিরা সবাই মুখচেনা। তাছাড়া তাদের মধ্যে বেশির ভাগ অথবা তাদের সন্তানেরা এই ইউনিভার্সিটি থেকেই পাশ করে বেরিয়েছে অথবা পড়ছে।

সিনিয়র প্রফেসর বা বিভাগীয় প্রধান বা উচ্চ আধিকারিকেরা অনেকেই আবার চাপরাশিকে পাঠিয়ে চেক ভাঙিয়ে নেন।

কিন্তু গিরধর রায় একটু অভিমানী প্রকৃতির মানুষ। আবার বেশ কড়া ধাঁচের শিক্ষক বলে ছাত্রসমাজে সুনাম দুর্নাম দুটোই আছে। কথাবার্তায় সাধারণভাবে খুব অমায়িক, আবার অধৈর্যে রগচটাও। বয়স পঞ্চাশ। দাড়িগোঁফ নিখুঁত কামানো, চোখে কালো ব্যাকেলাইট ফ্রেমের চশমা, ঈষৎ খুঁড়িয়ে হাঁটেন। একদিকে দেখান যে তিনি নিজের কাজ নিজে করা পছন্দ করেন। কিন্তু আবার অপেক্ষাও করেন যে কেউ তাঁকে দেখে নিজে যেচে এসে বলুক, দিন স্যার, আমি করে দিচ্ছি...।

তাই গলদঘর্ম হয়ে তিনি কাউন্টারের জালটার কাছে পৌঁছোবার চেষ্টা করতে থাকেন জুনিয়র লেকচারার আর তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিদের মাঝে।

বিকেল তিনটে বাজে। পাবলিক আওয়ার শেষ হয়ে গেছে তবু পেমেন্ট চলছে। এখনও কাউন্টারের সামনে, বাইরে সিঁড়ির ওপর শোরগোল। হঠাৎ সব স্বর ছাপিয়ে পর্য্যুদস্ত ও ক্ষিপ্ত একটা কন্ঠস্বর ক্যাশিয়ারকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠল, আপনি এখনো বলছেন সাতশো বারো নম্বর টোকেন এখনো আসেনি?

ক্যাশিয়ার সদ্য ব্যাঙ্কে ঢোকা সুপুরুষ যুবক। তবু ধৈর্যের সাথে জবাব দিল, এখানে আপনার চেক নেই, দেখতে পাচ্ছি না তো কী বলব বলুন?

গিরধর রায় এবার বোমাটা ফাটান, শালা মিয়াঁ, তুই বাইরে আয়, তোকে বুঝিয়ে দেব তুই কার সাথে কথা বলছিস।

উচ্চতমগ্রামের এ জাতীয় তর্জন-গর্জন, হুমকি, বচসা প্রায় প্রতিদিনই দুএকবার হয়। কিন্তু বচসা থেকে বেশি, শালা মিঁয়া বলে গালাগালটা এত অপ্রত্যাশিত ছিল যে সবাই তাড়াতাড়ি ছুটে গেল, কী হল? কী হল?

গিরধর রায়, যে কোনো মানুষের মতই, নিজের অপ্রত্যাশিত ব্যবহারের ন্যায্যতা বজায় রাখতে সচেতনভাবে ক্ষিপ্ততর হন, এই হারামজাদা মিঁয়াটা দুপুর থেকে পরেশান করছে আমায়। সাড়ে বারোটা থেকে দাঁড়িয়ে আছি, এখনও বলছে চেক আসেনি!

এরপর যা হয় তাই হল। সবাই মিলে ক্ষুব্ধ সম্মানিত গ্রাহককে ধরে নিয়ে এসে ম্যানেজারের চেম্বারে বসিয়ে শান্ত করল। একজন গিয়ে পেমেন্টটা খুঁজে বার করে নিয়ে এল। এই নিন স্যার! ক্যাশিয়ার বেচারার কোনো দোষ নেই। আপনার এডভাইস ক্রেডিট হয়নি বলে চেকটা আটকে গিয়েছিল। দু তিন বার ডাকাও হয়েছিল টোকেন নম্বরটা, আপনি শুনতে পান নি। যাক, এখন যে শেষ লটটা এসেছে, তা থেকে খুঁজে নিয়ে ক্রেডিট করে দিয়েছি।

এই মুহুর্তে রাগটাকে বিব্রত হাসিতে বদলে দেওয়া তাঁর প্রেস্টিজের বিরুদ্ধে যাবে। কাজেই, ঈষৎ রাগত ভাব বজায় রেখে থ্যাঙ্ক ইউ বলে গিরধর রায় বেরিয়ে গেলেন।

ক্ষুব্ধ গ্রাহককে ঠান্ডা করার তাড়াহুড়োয় কারোর মনেই রইল না জিজ্ঞেস করতে যে তিনি হঠাত মিয়াঁ শব্দটা ব্যবহার করলেন কেন। আর ক্যাশিয়ার তো মিয়াঁই নয়। তাহলে?

ক্যাশিয়ার ছেলেটি অর্থাৎ সুনীল যে সবচেয়ে চটপটে আর হাসিমুখ ক্যাশিয়ার সেটা গ্রাহকেরাও জানে। যেহেতু সে মুসলমান নয় তাই বিশেষ গায়ে মাখল না গালাগালটা। যদিও আশেপাশের গ্রাহকেরা সবাই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। একি অভদ্র, নোংরা ব্যবহার! আর তাও আবার ধর্ম তুলে!...

গিরিধর রায়ের ছেলে সুনীলের পরিচিত ছিল। বন্ধুর বন্ধু। তাই তার মনে হল ভুল বোঝাবুঝিটা নিজের তরফ থেকেই ঠিক করে নেওয়া ভালো। প্রভাবশালী প্রফেসর। কে জানে কখন কোন দরকার পড়ে যায়। ... তাই প্রফেসরসাহেবের বাড়ি গেল এক দিন।

ছেলের সাথেই দেখা হল। সুনীল কথাটা পাড়ার আগে সে নিজেই বলে উঠল, বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত মাস্তানসুলভ ভ্রু কেঁচকে, কী ভাই! শুনলাম তোমাদের ব্যাঙ্কে কয়েকজন স্টাফ বাবাকে হেনস্থা করেছে? নাম বল তো সব কটার!

বাপের হেনস্থায় ছেলে বিপূলের বিশেষ উত্তেজিত হওয়ার কথা নয়। বলতে গেলে সবচেয়ে বেশি হেনস্থা সে নিজেই তার বাপকে করে। অবশ্য প্রকাশ্যে নয়, মনে মনে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রফেসর সাহেবের একটা সুনাম আছে। সৎ ও পন্ডিত ব্যক্তি তিনি। তার ওপর বামপন্থী ঘেঁষা। আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংঘে বামপন্থীদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। ছেলে ভিতরে দক্ষিণপন্থী্‌, বাপের এই তিনটে গুণেরই প্রতিক্রিয়ায়। এখনও সে একটা মারুতি বুক করাতে পারেনি বাবাকে দিয়ে যখন নাকি প্রথম লটটা বাজারে এল বলে। নিজের কোনো একটা বড় দাঁও লাগা অব্দি তাই সে আপাততঃ ক্ষুব্ধ বামপন্থী।

তবে বাবাকে সে মাঝে মাঝে করুণা ও অনুকম্পার চোখেও দেখে। মনে হয় সততা, পান্ডিত্য, বামপন্থা ইত্যাদি কথিত মহৎ গুণগুলোর চক্করে বাবা ফেঁসে গেছেন, বন্দি হয়ে পড়েছেন। এখন আর চাইলেও বেরুতে পারেন না। গুণগুলো উদ্দেশ্য নয় সাধন। উদ্দেশ্য হল ইমেজটাকে বাঁচিয়ে রাখা। আর সেটা ধরা পড়ে বাবার কিপটেমিতে। মা বেশি খর্চা করে দিলে বকাবকিতে। নাকি লুকিয়ে মারুতি বুক করে ছেলে আর বৌকে সারপ্রাইজ দেওয়ার চেষ্টায় আছেন?

সুনীল চালাক ছেলে। বিপূলের হুমকি ভরা অভিযোগটা এক্ষুণি উল্টে দিলে হিতে বিপরীত হবে। তাই ঘুরিয়ে বলল, ভাই, আপনার বাবার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আমার সাথেই ঘটেছিল ঘটনাটা।

এবার প্রফেসর সাহেবের ছেলের ভ্রু বাস্তবিক বিস্ময়ে কোঁচকায়, তোমার সাথে? তুমি বাবাকে চিনতে পার নি?

-       চিনব কী? দেখতেই তো পাইনি!

-       তার মানে?

সুনীল পুরো ঘটনাটা, মাঝে মাঝে ওনার তো কোনো দোষ ছিল না... ওই ভীড়ে... ইত্যাদি স্নেহপদার্থ লাগিয়ে বলল। শেষ চীৎকারের দৃশ্যটা হাসতে হাসতে বলে যোগ করল, সত্যি সত্যি কোনো মিঁয়া থাকলে অন্যরকম হয়ে যেত।

বিপূলও এতক্ষণে নরম হয়ে গেছে। হাসতে হাসতে সেও বলে উঠল, আরে, বাবাকে কত মানা করি যে বয়স হয়েছে, নিজে যেওনা পেমেন্ট নিতে শুনবেই না!

হাসিটা মুখে ছড়িয়ে রেখেই সুনীল পরের কথাটা পাড়ল, পরে কখনো বাবাকে জিজ্ঞেস করবেন তো যে উনি আমায় মিঁয়া কেন ভাবলেন!

-       জিজ্ঞেস আবার কী করব? ভাবাভাবির কিছু ছিল না ওতে। আমি তো জানি পুরো ব্যাপারটা। শুধু, লোকটি যে তুমি তা বুঝিনি। আমি নিজে ভাবলাম যে নামটা জেনে নিয়ে একবার শাসিয়ে এলে হাওয়া অন্যদিকে ঘুরে যাবে। বাবা তো ফিরে এসেই বলেছিলেন।

-       ও, তাই বলুন, কী বলেছিলেন?

-       বাবা তো বললেনই, যে এমন কিছু করতে চাইছিলেন যাতে হাওয়াটা থমথমে হয়ে যায়, সবার চোখ ঘুরে যায় তাঁর দিকে। এখন, মা-বোন তুলে গালাগাল দিলে পাবলিক সিমপ্যাথি ক্যাশিয়ারের দিকে যাবে। তাই মিঁয়া! বাবার বুদ্ধি আছে বলতে হবে।

সুনীল অপমানের ছায়াটা এবারও মুখ থেকে সরিয়ে ফেলে, কিন্তু বস, সত্যি যদি ক্যাশিয়ার মুসলমান হত? আর আশে পাশেও আরো অনেক মুসলমান কাস্টমার ...

-       ফুঃ, সেও জিজ্ঞেস করেছিলাম বাবাকে।

-       কী বললেন?

-       নতুন কিছু না। এ তো সবাই জানে, শালা মিঁয়া বললে এদেশে আট জায়গার মধ্যে এক জায়গায় হয়ত ফলস পজিশন হতে পারে ... তাও এলাকা চিনে বললে মার টার খেতে হবে না। আর কোনো মিঁয়া শালা হিন্দু বললে আট জায়গার মধ্যে সাত জায়গায় মার খাবে, বাকি এক জায়গায় নিজেদের লোকেরই ঝাড় খাবে। এ তো ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স ভাই পুরোপুরি!

হো হো করে হেসে উঠল বিপূল, বুড়ো ওস্তাদ আছে এসব খেলায়!

ফেরার সময় সুনীলের স্কুটারটা স্টার্ট নিচ্ছিল না। ডান দিকে বার তিনেক কাত করে কিক দিতে দিতে ভাবল, শালা, প্রফেসরের বাচ্চা। গালাগালটা তাহলে মা-বোনেরই ছিল।     

No comments:

Post a Comment