মাসটা ছিল জুলাই। কিন্তু বৃষ্টি ছিল না। আর না থাকলে যা হয়, আবহাওয়া ভ্যাপসা আর গরম – রুমালটা ভিজতে মুখ পোছার দরকার হয় না, জাংএর ঘামে পকেটে এমনিই ভিজে যায়। আর সেই আবহাওয়ায় পাঁচ ফুট লম্বা লাল ঝান্ডার ওপর...। সেও আবার অর্জুনবাবু বললেন, সাদা রঙ চড়াবেন না, শুকোতে আরো দেরি হবে। সিলভার চড়ান্। সেই সিলভারের কাস্তে-হাতুড়ি, পাঁচ ফুট বাই তিন ফুট শালুতে ছড়িয়ে। স্কুটারের পিছনে বসে – কখনো মাথায় সেঁটে যাচ্ছে, কখনো মুখে সেঁটে যাচ্ছে রঙ। ...
বারো তারিখ বেলা নটা নাগাদ সোমনাথ ফোন পেল বিরাজদার,
“আহমদসাহেব আর নেই। কার্ডিওলজিতে চলে আসুন।”
সাইকেলে যাওয়ার প্রশ্ন থাকতে পারে না। হাসপাতাল থেকে
আহমদসাহেবের বাড়ি যেতে হলে শববাহী গাড়িতেই যেতে হবে। বা, পরিবারের লোক বেশি থাকলে
বিরাজদার সাথে রিক্সায় ...।
সে সময় দ্বারভাঙ্গা কালিবাড়ির গলিতে ঢুকলে বাঁদিকে পিএমসিএইচ
এর উত্তরবর্ত্তী গেটটা খোলা পাওয়া যেত। ঢুকতেই ডানদিকে ইন্দিরা গান্ধী ইন্সটিট্যুট
অফ কার্ডিওলজি।
দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে সোমনাথ দেখল বিরাজদা দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
দৃষ্টি তাঁর পিছনে বাঁ ঘেঁসে যেতেই দেখা গেল দেয়ালে লাগান একটা স্ট্রেচার। তাতে
কুঁকড়েমুকড়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে আহমদসাহেবের শরীর। সেই পরিচিত আকাশি নীল শার্ট, আর ধুসর
নীল প্যান্ট। কিন্তু মৃত্যুর পর কত ছোটো হয়ে যায় শরীরটা।
ঠিক পরে পরেই সুকান্ত এসে ঢুকল। হাতে স্কুটারের চাবি।
বিরাজদা ওই চাবির দিকে চোখ রেখেই বললেন, “স্কুটার এনেছিস তো?”
-
কোথায়, আহমদসাহেব?
-
(পিছনে ইশারা করে) একবার দেখে নে।
তারপর কাজ আছে।
-
(সোমনাথকে) পকেটে কত টাকা আছে?
আচ্ছা থাক। (পকেট থেকে তিনশো বার করে) এই নিন। সুকান্ত আর আপনি স্কুটারে করে
বেরিয়ে যান। এক্ষুণি আহমদসাহেবের পরিবারের লোকেরা এসে পৌঁছোবে। গাড়িতে বডি প্রথমে
নিয়ে যাবে ওনার এখানকার বাসায়, গার্ডেনার রোডে। সেখান থেকে গ্রামে নিয়ে যাবে। শিগগির
যান, একটা বড়, গা ঢাকা যায় এতটা বড় লাল শালু কিনে তাতে কাস্তে-হাতুড়ি আঁকিয়ে নিয়ে
গার্ডেনার রোডে পৌঁছোন। এক ঘন্টায় হয়ে যাবে তো?
-
শুকোবে কী করে? তাও এই ভ্যাপসা আবহাওয়ায়।
বৃষ্টি হলে তো আর কথাই নেই।
-
যান! দেখুন! ওনার পরিবারের তরফ থেকে
তো আর দেবে না। এটা আমাদের সেন্টিমেন্ট, আমাদের গরজ। আমাদের নেতা ছিলেন উনি।
শিবম আর্টস অবশ্য সকালেই খুলে যায়। কাজ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু
অর্জুনবাবু নিজে তো আসেন দেরি করে। আর উনি নিজে না বললে দোকানের কর্মচারিরা কি শুনবে?
সুকান্ত স্কুটার চালায় জোরে। কিন্তু একটু জার্কি। এই স্পীড,
এই ব্রেক। বার বার সোমনাথের থুতনিটা গিয়ে ওর হেলমেটে ঠোক্কর খাচ্ছিল। যাহোক, পৌঁছেই
একটু অনাবশ্যক জোরে সোমনাথ হাঁকল কর্মচারিদের, “কোথায় তোমাদের অর্জুনবাবু? আসেননি এখনো? সিনিয়ার পেন্টার
ইব্রাহিম সোমনাথকে চিনত। হেসে উল্টো দিকে পানের দোকানে দেখাল।
পানের দোকানেই সোমনাথ পাকড়াও করল অর্জুন প্রসাদকে। পান খাওয়ার
প্রস্তাব অস্বীকার করে পুরো পরিস্থিতিটা বলল। ডেডবডি গ্রামে যাওয়ার আগে কমরেডের শরীর
লালঝান্ডা দিয়ে ঢাকতে হবে। মালা চড়বে তারপর। আমাদের অল ইন্ডিয়া লিডার। কাজ না হলে
ইজ্জতের ব্যাপার হবে।
অর্জুন প্রসাদ বুঝদার লোক। এই সব নিয়েই তো ওর ব্যবসা। হঠাৎ ব্যানার
বা ঝান্ডার প্রয়োজন তো হতেই থাকে বাজারে। আর এনারা সব পরিচিত গ্রাহক।
-
চলুন।
-
লাল শালু কিনতে হবে তো।
-
চলুন, বসে চা খান। আমি আনিয়ে নিচ্ছি। লাল একরঙ্গা তো? সাটিন তো নয়?
-
হ্যাঁ, ভালো একরঙ্গা, তার ওপর হোয়াইট
পেন্ট দিয়ে...
-
শুকোবে না অত তাড়াতাড়ি, এই
আবহাওয়ায়। সিলভার দিয়ে করান।
-
সিলভার তো ঝরে ঝরে পড়তে থাকে।
-
এখন পড়বে না। শুকোনোর পর ভাঁজ
করলে পড়ে। এখন তো আপনি কাঁচা নিয়ে যাবেন মাথার ওপর মেলে।
দুই পরত রঙ চড়িয়ে বড় কাস্তে আর হাতুড়ি আঁকতে ইব্রাহিমের
পঁচিশ মিনিট লেগেই গেল। আরো পাঁচ মিনিট সময় নিলো চা খেতে খেতে। বোর্ডের ওপর ছড়ানো
অবস্থায় যতটা পারে শুকোক।
পয়সা মিটিয়ে সোমনাথ নতুন রঙে ভেজা ঝান্ডাটা মাথার ওপর মেলে
বাইরে বেরুল। সুকান্ত স্কুটার স্টার্ট করে দাঁড়িয়েছিল। সোমনাথ পিছনে বসতেই স্পীড
নিল। ভীড়ের রাস্তা। দুহাত ছড়িয়ে ভালো করে মাথা আর পিঠের ওপর মেলাও যাচ্ছে না। আর দুটো
গাড়ির মাঝখান দিয়ে স্কুটার বার করতে যেই হাতদুটোকে নিচে নামাচ্ছে, মাথায়, কপালে, কাপড়ের
পিছন দিকে উপচে আসা তেলতেলে সিলভারের গুঁড়ো লেগে যাচ্ছে।
একটু কল্পনামনস্ক হয়ে সোমনাথ নিজেদেরকে দুপাশের দোকানপাট থেকে
দেখতে লাগল। রাস্তার মাঝখান দিয়ে, গাড়ি, রিক্সার পাশ কাটিয়ে একটা স্কুটার দৌড়োচ্ছে।
চালাচ্ছে বেঁটে মত একটি লোক, সে সমানে কথা বলে যাচ্ছে পিছনের জনকে উদ্দেশ্য করে।
আর পিছনের জন, একটু মোটা, দশাসই, দুহাতে মাথার ওপর লাল ঝান্ডা মেলে বসে আছে। ঝাঁকানিতে
ঝান্ডার কোনাটা লেপটে যাচ্ছে মুখে। কোথায় যাচ্ছে এরা? কোনো মিছিল আছে? ... বড় ঝান্ডা।
বড় মিছিল হতে পারে। ... ‘অ্যাই,
বিকেলে কোনো কাজ নেই তো ডাকবাংলো মোড়ের দিকে?’ ... সোমনাথ হাসে, ওদের প্রথম চিন্তা তো এটাই, ট্র্যাফিক
জ্যাম না হয় আবার!
গার্ডেনার রোডের বাড়িটার সামনে আজ শোয়ানো থাকবে আহমদসাহেবের
শরীর। তিরিশ বছর ধরে শহরের রাস্তায়, অফিস-কাছারির গেটে, ডাকবাংলো বা স্টেশন চৌরাস্তায়,
রেডিও স্টেশনের সামনের চত্বরটায় ...সব রকম জমায়েতে শেষ সুরটা ধরতেন তাদের স্টার
বক্তা কমরেড আহমদ। আহমদসাহেব!
য়ুঁ হী
উলঝতী রহী হ্যয় জুল্ম সে খল্ক
ন উনকী রস্ম
নঈ হ্যয় ন অপনী রীত নঈ
য়ুঁ হী খিলায়ে
হ্যঁয় হমনে আগ মেঁ ফুল
ন উনকী
হার নঈ হ্যয় ন অপনী জীত নঈ।।
প্রথম লাইনের শেষে ‘খল্ক’এর মানেটাও ধরিয়ে দিতেন – জনতা।
আবার কখনো বলতেনঃ
ম্যয় অকেলে হী চলা থা জানিব-এ-মঞ্জিল মগর
দোস্ত কুছ মিলতে গয়ে কারবাঁ বনতা গয়া।।
আর, আজ কী বলবেন?
জমানা বড়ে শওক সে সুন রহা থা
হমীঁ সো গয়ে দাস্তাঁ কহতে কহতে।।
ডাকবাংলোর পর আর ভীড় নেই। পাঁচ
মিনিটে সোমনাথরা ঢুকে গেল গার্ডেনার রোডের বড় ক্যাম্পাসটার ভিতরে। আহমদসাহেবের শরীর
এসে গেছে। গায়ের ওপর ওদের ইস্লামী নিয়ম মত চাদর ঢাকা দেওয়া। বিরাজদা, বিন্দেশ্বরজী
ও আরো কয়েকজন পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের স্কুটারটা ঢুকতে দেখে বিরাজদার মুখ থেকে
চিন্তার ভাঁজটা সরে গেল।
-
দেরি হয়
নি তো?
-
নাঃ, এই
পৌঁছেছে ওরা। ওই ঝান্ডা দিয়ে ঢেকে দিন কমরেড আহমদকে।
সোমনাথ এক পা এগোবার আগেই, যেন কে দেবে,
কী দেবে, এখন কেন ... এই সব জল্পনা রুখে দিতে বিরাজদা স্লোগান তুললেন,
“কমরেড আহমদ, লাল সলাম! কমরেড আহমদ, অমর রহে!”
হাসপাতালে ভালো করে দেখতে পারেনি
মুখটা। এখন ঝান্ডার ওপরের দুই কোনা কাঁধের দুপাশে চেপে হাত দিয়ে সমান করতে করতে ভালো
করে দেখল মুখটা। সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লেন গল্প বলতে বলতে। সেবারে সোমনাথের অফিসে এসে মহাভারতের
যে নীতিকথাটা শুরু করেছিলেন, শেষ করতে পারেননি। সেদিনও এই আকাশি নীল শার্টটা ছিল
পরনে।
সবাই এক এক করে মালা দিয়ে আসছিল। সুকান্ত
ওদিকে দেয়ালের কাছে স্কুটার দাঁড় করিয়ে ফিরে আসতে আসতে সোমনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, “মুখটা মুছে
নিন, পুরো সিলভার, সিলভার হয়ে আছে।”
সোমনাথ চোখ নামিয়ে নিজের হনুর হাড়টা
দেখার চেষ্টা করল।
ভাবল বলে, “বলছ কি সুকান্ত?
সিলভার কোথায়? আহমদসাহেবকে লালঝান্ডা দিয়ে ঢাকলাম! বিকেলের আলোয় গোল্ডেন হয়ে
যাওয়ার কথা তো ...!” ভেবেই আহমদসাহেবের শরীর ঢাকা ঝান্ডার দিকে তাকাল, ‘ধ্যাৎ,
বিরাজদাও ভূল আন্দাজ করেছিলেন। সাড়ে পাঁচ ফুট হলে ঠিক হত। পায়ের পাতাটা বেরিয়ে আছে
সবুজ চাদর সুদ্ধু। তবে কাস্তে হাতুড়িটা সত্যিই সোনালি দেখাচ্ছে বিকেলের আলোয়’।
২৯.৭.১৯
No comments:
Post a Comment