শহরে কিছু কিছু দপ্তর এমন থাকে যেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ । প্রহরীকে নির্দেশ দেওয়া থাকে, কেউ ঢুকতে চাইলে ইন্টারকমে জিজ্ঞেস করতে হবে । খুব বেশি হলে প্রহরী থেকে এগিয়ে রিসেপশনের কাউন্টার বা অভ্যর্থনাকক্ষের বসার জায়গা অব্দি পৌঁছোনো যায় । আবার কিছু কিছু দপ্তর থাকে পাব্লিক-অফিস, জনতা-দপ্তর – প্রহরী লক্ষ্য রাখে কে ঢুকছে, সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে প্রশ্নও করে কী কাজ, কার সাথে দেখা করতে চায়, এক্কেবারে দলিদ্দর বা ভিখিরি মনে হলে ঘাড়ধাক্কাও দেয়... আবার রিসেপশনিস্ট বা এনকোয়্যারি, আগন্তুককে চাইলে সাহায্যও করে, কিন্তু সাধারণভাবে কারও ঢোকার বারণ নেই; দপ্তরের কাজটাই এমন যে থাকতে পারে না । হয়ত এই বিশেষত্বটা প্রজাতান্ত্রিক প্রশাসন প্রণালীর সাথে সম্পর্কিত তবে সে বিচার গভীরতর জল । আপাততঃ যে দপ্তরটির কথা বলছি সেটা ব্যাঙ্ক তবে ব্যাঙ্কের জায়গায় কালেক্টারিয়েট বা সেশন্স কোর্টও হতে পারত । যে সময়ের কথা বলব সেটা কম্পিউটার, মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদি আসার অনেক আগের তবে আসার পরেরও হতে পারত । শুধু দপ্তরের কর্মচারী ও আধিকারিকদের কাছে পৌঁছোবার পথটা জনতার জন্য খোলা থাকা প্রয়োজন । যে ছেলেটির কথা বলব সে ছেলের জায়গায় মেয়েও হতে পারত; তখন অবশ্য একটু অতিরিক্ত আহা উহু এবং শরীরের দিকে চোরা চাউনি যোগ হত ।
যা হোক ।
বেলা দশটা সাড়ে দশটা থেকে রোদ নরম হওয়ার একটু আগে অব্দি এই
নাতিবৃহৎ হলঘরটা জনাপঞ্চাশেক কর্মচারী, আধিকারিক আর কাজেকর্মে আসা লোকজনের ভীড়ে
গিজগিজ করে । দরজা থেকে সবচেয়ে দূরের কোনাটায় যে বসে, দরজা দিয়ে ঢুকে অনেক বাঁক,
টেবিলের খোঁচা, টুলের ধাক্কা, পড়ে থাকা জাবদা লেজার বা ফাইলের হোঁচট এবং প্রশ্ন ও ধ্যাঁতানির
ঝাড়াই খেয়ে তার কাছে পৌঁছোতে হয়।
ছেলেটি বোধহয় তাই তার কাছেই সোজা এসেছিল। যার কাছে পৌঁছোনো যত বেশি দুরূহ তিনি তত উচ্চতর পদে
আসীন, এই সহজ নিয়মটা সে আক্ষরিক অর্থে পালন করেছিল। এসে তাঁর দিকে একটি খাতাসুদ্ধু
হাত বাড়িয়ে দিল। তিনি খাতাটা না দেখে ছেলেটির মুখের দিকে তাকালেন। গোল মুখ। ছোটো
করে ছাঁটা চুল। ময়লা, খড়ি ওঠা গালের চামড়া। তবে খুব বেশি কালো নয়। গায়ের সাদা
জামাটা নোংরা আর চোখ দুটো বয়সের তুলনায় বড় বেশি স্থির। বয়স হবে, এই বারো বছর। “লেখাপড়া
করার জন্য সাহায্য দিন” – ছেলেটার কন্ঠস্বর অদ্ভুত নির্লিপ্ত,
নির্বিকার অথচ অস্থির।
দপ্তরের অনেক নিয়ম থাকে। তার মধ্যে
একটা এই যে আভ্যন্তরীণ বস্তু ও ব্যক্তি ছাড়া বাইরের যা কিছু – বস্তু কিম্বা
ব্যক্তি – সব বড় সাহেবের ঘরের দিকে প্রথমে যাবে। এর মধ্যে নিয়মিত
কাজকর্মে আসা লোকজনেরা পড়েনা। তারা জানে কোন টেবিলে কী কাজ হয় এবং সেই হিসেবে সোজা
পৌঁছে যায়। কিন্তু এছাড়া যা কিছু বা যে কেউ, সবাই বড় প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকে ডান দিকে
বা বাঁদিকে বড় সাহেবের ঘরের দিকে যাবে। সবাইকে ভিতরে যেতে হবে না। বেশ কিছু বস্তু
বা ব্যক্তিকে বাইরে বসে থাকা চাপরাশিই যথাস্থানে পাঠিয়ে দেবে। বাকির ফয়সালা বড়
সাহেব খোদ করবেন। এ নিয়ে তিনি স্বভাবতই গত কয়েক বছর ধরে বিরক্ত। এমন নয় যে তাঁর
নিচে মেজসাহেব, সেজসাহেব, ছোটোসাহেব নেই, কিন্তু তাঁদের চেম্বার নেই। ছোটো চেম্বার,
বা ঘেরা জায়গা,... তাহলে এই ঝক্কিটা ওদের ঘাড়ে চাপানো যেত। কবে থেকে ওপরে আবেদন,
নিবেদন করছেন... ঠিকেদারের সাথে কমিশনের দরটাই এখনো অব্দি ওরা ঠিক করতে পারল না।
চেম্বার নেই, আলাদা জায়গা নেই, কাজেই ওরাও যেন ঝাড়া হাত-পা, সাধারণ কর্মচারিদের সাথে
কাজ করছে, গল্প করছে, এক সাথে টিফিন খাচ্ছে! একটা রিসেপশন বা এনকোয়্যারি গোছেরও কিছু
নেই, আছে শুধু পর্দার ওধারে টুলে বসা বুড়ো চাপরাশি, চোখে ছানি, মাথায় ছানি।
যাহোক, সেই নিয়মের দিক থেকে দেখলে এই
ছেলেটির এভাবে এই একটেরে কোনায় পৌঁছে যাওয়াটা শিশুসুলভভাবে দুর্বোধ্য। অর্থাৎ শিশুদের
আচরণে যে দুর্বোধ্যতা পাওয়া যায় তারই নজীর। কিন্তু এই কোনায় যিনি বসে আছেন তিনিও
আবার ছেলেটিকে সোজাসুজি বড় সাহেবের ঘরের দিকে পাঠাতে পারেন না, কেননা তাঁর ওপরে
বড়বাবু, বড়বাবুর ওপরে ছোটোসাহেব, তারপর সেজ, মেজ, সবশেষে বড়।
একবার বড়সাহেবের দিকে চলে গেলে কোনো
কালে আর দায়িত্ব ঘাড়ে নেওয়ার ব্যাপারটা থাকে না। ওই চিঠি কিম্বা দলিল কিম্বা ভাউচারের
ওপরদিকে এক কোনায় বড়সাহেবের কলমের খোঁচাটা ... খোঁচা নাকি সোনার মাছিটা! এখানে অবশ্য
মাছিটা নিচের দিকে বসবে, ছেলেটির খাতায়, টাকার অঙ্কের সাথে – ব্যস, তাহলেই
অঙ্কটা মেজ, সেজ, ছোটোর হাতে নামতে নামতে সবাইকে বলে দেবে, কত দেবে কে। কিন্তু তা তো
সোজা পথে হবে না।
তিনি তাই ছেলেটিকে বড়বাবুর কাছে পাঠালেন।
মনে ভাবলেনঃ ততক্ষণে এটাও ভেবে দেখা যাবে যে ছেলেটিকে কত দেওয়া যায় বা আদৌ কিছু না
দিলেও চলে কিনা।
না তাকিয়েও তিনি নির্ধারিতভাবে শুনতে
পেলেন যে বড়বাবু ছেলেটিকে ছোটোসাহেব, না ছোটো নয় সেজও নয় সোজা মেজসাহেবের কাছে পাঠালেন
– এটা বড়বাবুই পারতেন। কিন্তু মেজসাহেবের দিকে চোখ উঠিয়ে দেখা
গেল তিনিও ছেলেটিকে আঙুল দিয়ে বড়সাহেবের ঘর দেখিয়ে দিচ্ছেন।
কোনার মানুষটা দেখলেন, বিন্দুমাত্র
দ্বিধা না করে ছেলেটা পর্দা সরিয়ে বড়সাহেবের ঘরে ঢুকে গেল। ইস্স্স্! পর্দার পাশের
টুলটা খালি, চাপরাশি কোথায়? ছেলেটা বকুনি খাবে না তো? এক্ষুণি না বাইরে বেরিয়ে এসে
বড়সাহেব জিজ্ঞেস করেন ছেলেটিকে তাঁর কাছে কে পাঠিয়েছে! তবুও স্বস্তি যে মেজসাহেব
পাঠিয়েছেন। মেজসাহেবকে বড়বাবু। আর তিনি, নিছক বড়বাবুকে।
ঘন্টি বাজল। চাপরাশির ডাক পড়ল। কিছুক্ষণ
পর ছেলেটাকে দেখা গেল বেরিয়ে আসছে চাপরাশির সাথে। তখনই কোনার মানুষটার মনে প্রশ্নটা
জাগল – ছেলেটা এবার কার কাছে যাবে?
বস্তু বা ব্যক্তি বড়সাহেবের নির্দেশে
সংশ্লিষ্ট বিভাগের অধিকারী বা কর্মচারির কাছে যাবে, এটাই নিয়ম। ছেলেটির সংশ্লিষ্ট
কে?
দপ্তরটির সাথে যারা কাজেকর্মে জড়িত
তারা প্রতিদিনই আসে, বিশেষ বিশেষ টেবিলে বা কাউন্টারে যায়। ডাকপিওন যে বড়সাহেবের
চাপরাশিকে চিঠির বান্ডিল ধরিয়ে চলে যায়, মানিঅর্ডার কিম্বা রেজিস্ট্রি থাকলে বিশেষ
লোকটির কাছে যায়...। আবার কারো কারো আত্মীয়বন্ধু, তারাও বিশেষ লোকটির কাছেই যায়; ছেলেটা
তো সেসব কেউ না। যদিও কাজেই এসেছে কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগ তো নেই। আবার বিভাগের
টেবিল বা আলমারিতে রাখা কাগজপত্রের সাথে নয়, সেই লোকটির কাজের সাথেও নয়, সেই
লোকটির মনের সাথে তার কাজ।
আবার মনেরও সবটুকুর সাথে নয়, শুধু অর্থদান
করার সহৃদয়তার সাথে। এখানে সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। ছেলেটিকে সকাল থেকে অভুক্ত মনে
হচ্ছে বলে কি বাইরে নিয়ে গিয়ে কেউ ওকে খাইয়ে দিতে পারে? না। সে শুধু দুটো টাকা
দিতে পারে। অবশ্য তার একটা উপায় আছে। চা’ওলা লোকটি ভিতরে ঢুকলে তার হাতে
পয়সা দিয়ে বলা যেতে পারে যে একে একটু খাইয়ে দিও। বা যদি বড়সাহেব কোনো চাপরাশিকে
নির্দেশ দেন! তা তো তিনি দিলেন না। আবার যদি কেউ একে বইখাতা কিনে দিতে চায়! ...
বিকেলে, ছুটির পর দেখা করতে বলতে হবে। আর তাছাড়া সহৃদয়তা আর টাকা এক জিনিষ নয়।
একবার যদি বড়সাহেবের ঠাপ্পা লেগে যেত ওর খাতাটায় তাহলে সবাইকেই খসাতে হত কিছু মাল,
সহৃদয়তা থাক আর না থাক। কিন্তু, চাপরাশির সাথে ছেলেটির চলন দেখে, তা হয়েছে বলে মনে
হচ্ছে না।
ওদিকে আবার আত্মীয়বন্ধুর বাড়ি থেকে
ফেরার সময় তাদের বাচ্চা মেয়েটার হাতে দুটো টাকা দিতে হয়, মিষ্টি খাওয়ার (মেয়েটির
মা এই বলে নিজের কাছে রেখে নেন যে পরে কিনে দেবেন কিন্তু টাকাটা অসহায়ভাবে সংসারের
কাজে অজান্তেই খরচ হয়ে যায়)। সেটা আবার সহৃদয়তাও নয়, সাহায্যও নয়, সামাজিক আচার, আত্মীয়তার
দস্তুর। অথচ ছেলেটি আত্মীয় নয়, বন্ধু নয়। তাহলে কি শত্রু? যাঃ, শত্রু কেন হবে?
নিছক অপরিচিত। এবং নিয়ম এই যে
অপরিচিতদের বিশ্বাস করতে নেই। অবশ্য অনেক অপরিচিতকে তিনি বিশ্বাস করতে বাধ্য। আবার
নিজেও, বহু জায়গায় অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বাস যাচঞা করেন, এবং পান। কিন্তু ছেলেটাকে
বিশ্বাস করার সেরকম কোনো বাধ্যতা নেই। অতএব বিশ্বাস করেন না। এক মুহুর্তের ভগ্নাংশের
জন্য তিনি নিশ্চিন্ত হলেন।
কিন্তু বিশ্বাস তো ভিখিরিকেও করেন
না, ছিনতাইকারীকেও না। অথচ টাকা পয়সা দিতেই হয়। আর তাছাড়া, তাতে ব্যাপারটার কোনো
সুরাহা হচ্ছে না যে ছেলেটি কী এবং কার কাছে যাবে। তাই তিনি এবার অন্য খাতে ভাবতে শুরু
করলেন।
ছেলেটা একটি টেলিগ্রাম। তিনি মুগ্ধ
হলেন হঠাৎ মাথায় আসা অভিব্যক্তিটায়। ঠিক! ঠিক! সাধারাণতঃ বড়সাহেব টেলিগ্রামটা
নিজেই প্রাপ্তিস্বীকার করে চাপরাশিকে দিয়ে পাঠান। পিওনকে হয়রানির হাত থেকে কিছুটা
বাঁচাতে আর কিছুটা কর্মচারিদের প্রতি নিজের বাৎসল্যের পরিচয় দিতে। চাপরাশি ফেরত
এলে তাকে জিজ্ঞেস করেন যে টেলিগ্রামে কী ছিল আর তেমন প্রয়োজন হলে কর্মচারি বা আধিকারিকটির
পাশে গিয়ে দাঁড়ান। পিঠে সহানুভুতি কিম্বা অভিনন্দনের হাত-টাত রাখেন।
কিন্তু টেলিগ্রাম তো একজনের জন্য! তাহলে?
সার্কুলার টেলিগ্রাম? ... বাঃ। অবশ্য এখনো অব্দি সার্কুলার টেলিগ্রাম বলে কোনো
জিনিষ জানা ছিল না। তাতে কী? এতক্ষণে তিনি ছেলেটির পরিচয় ও সংশ্লিষ্টতা পরিভাষিত
করতে পারলেন। কোনো জিনিষকে পরিভাষিত, মানে খোপ মত বসাতে পারলে তার প্রতি আমাদের
প্রতিক্রিয়াটা কী হবে, তা নিয়ে সহজে সিদ্ধান্তে আসা যায়।
কী ধরণের সার্কুলার টেলিগ্রাম?
আনন্দের না দুঃখের? অ্যাপীল, অ্যাপীল ... নিজের ছেঁড়া জামাকাপড়, ফ্যাকাশে মুখে
একটা অ্যাপীলের টেলিগ্রাম!
কিন্তু অ্যাপীল, আবেদন, অনুরোধ কি
এত নির্লিপ্ত, নির্বিকার ও অস্থির হয়? ‘লেখাপড়া করার জন্য সাহায্য দিন’...! এত
নির্লিপ্ত! এত নির্বিকার! এত অস্থির!
তাছাড়া সার্কুলার তো সকলের কাছে ঘুরে
ফাইলে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই ছেলেটা বাইরে যাবে – এই দপ্তরের
বাইরে, সারা শহরে ... মানে যদ্দূর ও যেতে পারে!
ছেলেটা ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট – মানে বড়সাহেব
যাকে সংশ্লিষ্ট মনে করে চাপরাশিকে নির্দেশ দিয়ে থাকবেন, সেই সংশ্লিষ্ট আধিকারিক,
অর্থাৎ এক্ষেত্রে ছোটোসাহেবের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। চাপরাশি তাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে
গিয়েছিল। ছোটোসাহেব তাকে আবার বড়বাবুর কাছে পাঠালেন। এবং বড়বাবু তাকে পাঠিয়ে দিলেন
এই কোনার মানুষটির পাশে উপবিষ্ট আরেকজন কেরানির কাছে। কেরানির মুখ তুলবার ফুরসৎ
নেই। অথবা টাকা দেওয়ার ভয়ে ফুরসৎ আনতে চাইছে না। ছেলেটা ঠায় সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার
দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
কী যেন ভাবছিলেন তিনি?
হ্যাঁ, সার্কুলার টেলিগ্রাম।
কিন্তু সার্কুলারকে আমরা টাকাপয়সা দিই না। মাইনে থেকে কোনো খাতে কিছু কাটলে টাকাটা
সংস্থার কাছে যায়, সার্কুলারের কাছে নয়। কিন্তু ছেলেটি এখানে নিজেই নিজেকে দেখাচ্ছে
আর পয়সা নিচ্ছে। ফুটপাথে মাঝে মধ্যে একটি মেয়ে তার মায়ের সাথে আসে। দু’হাত তুলে
নাচে। তারপর ঘাগরা বা দুপট্টা ছড়িয়ে পয়সা নেয় জমায়েতের কাছ থেকে। মেয়েটি ওখানে বিক্রেতা।
অনুকম্পা ও লালসার এক বিচিত্র রস ভীড়ের শরীরে নিঃসৃত করাতে ওর নাচের প্রয়োজন হয়।
অনুকম্পা ও লালসার ওই সংমিশ্রণ ভীড়ের দ্বৈতাচারী দৈনন্দিনটাকে সুখকর করে তোলে।
বস্তুতঃ ভীড়ের অহমিকা, স্বীয় অস্তিত্বের বোধ শুধু ঈশ্বর কিম্বা শয়তানের বোধে
সম্পূর্ণ হতে পারে না। সম্ভব হয় এক মাত্র অর্ধঈশ্বর ও অর্ধশয়তানের মিলিত কিম্ভূতে।
যাকে অর্ধশয়তানেশ্বর বলা যেতে পারে।
এধরণের আরো বহু বিক্রেতা আছে। তারা
আলাদা আলাদা ভাবে কেউ ঈশ্বরের নামে কেউ শয়তানের নামে পয়সা চায়। তারা বহুবিধ আয়না
রাখে ভীড়ের অহমিকাকে প্রতিফলিত করে চোখ ধাঁধাবার। বহুবিধ দ্বৈতাচার – দয়া ও ভয়,
করূণা ও ব্যাভিচার, পূণ্য ও নিষ্ঠুরতা, জীবে প্রেম ও স্বার্থপরতা – কে তারা
তুষ্ট করে। তাহলে ওই ছেলেটি বিক্রেতা? কিসের বিক্রেতা?
এতক্ষণে তাঁর বাঁপাশের কেরানিটি
একবারও চোখ তোলেন নি। তিনি ছেলেটার মুখের দিকে তাকালেন। ক্রমশঃ অস্থিরতা বাড়ছে।
সমানে সে ডান পা দিয়ে বাঁ পা, কখনো বাঁ পা দিয়ে ডান পা ঘষছে। চোখদুটো একবার ওদিক,
একবার এদিক ঘুরে আবার কেরানিটির নিচু করা মাথার ওপর ফিরে আসছে। বাঁ হাত দিয়ে সে
একবার ডানহাতের কব্জিটা ঘষল।
কোনার মানুষটির খারাপ লাগতে শুরু
করল। ছেলেটা গত আধঘন্টা ধরে নাহক ঘুরছে আর পরেশান হচ্ছে। ফল শূন্য। ওইটুকু ছেলের মধ্যে
অবিশ্বাসের পরিবেশ আর তৈরি হতে দেওয়া উচিৎ নয়। পাশের সহকর্মীটির এতক্ষণ মাথা গুঁজে
এড়িয়ে থাকার ভাণে তাঁর বিরক্তি হচ্ছিল। ছেলেটার মধ্যে শুধু তাঁর প্রতি তো নয়, সবার
প্রতিই অবিশ্বাস জন্মাচ্ছে। তিনিও সেই শ্রেণিতে শামিল। ছেলেটা বাইরে বেরিয়ে যদি থু
থু ফেলে এই ব্যবহারে, সেটা তাঁর গায়েও ছিটবে। এই ছিটল বলে!...
আর থাকতে না পেরে উঠে তিনি ছেলেটার
হাত থেকে খাতাটা নিয়ে নিলেন। খাতায় অনেকের নাম, টাকার পরিমাণ ও স্বাক্ষর। অর্থাৎ
এই দপ্তরে ঢোকার আগে আরো অনেকে ওকে সাহায্য করেছে। কিন্তু তারা অপরিচিত। তাদের বিশ্বাস
করার কোনো কারণ নেই। তারা যদি ঠকে থাকে এই দপ্তরেও সবাই ঠকবে নাকি?
এবং এটাই কারণ যে এখন অব্দি এই
দপ্তরে কেউ ওকে টাকা দেয়নি। যে ওকে প্রথম টাকা দেবে, ব্যাপারটা ধোঁকাবাজি হলে তার
ওপর দোষারোপ হবে। হোক! তাবলে কি তিনি আর সবায়ের মত? দিলেন, নাম লিখলেন, টাকার অঙ্কটা
উল্লেখ করলেন, স্বাক্ষর করলেন। আড়চোখে দেখলেন পাশের কেরানিটি ইতিমধ্যে পকেটে হাত ঢুকিয়েছে।
এক এক করে প্রায় সবাই ছেলেটাকে
সাহায্য করল। একজন যে কৃপণ সে চার আনার বেশি দিল না। একজন যার জীবনে গোয়েন্দা
হওয়ার ইচ্ছে ছিল, সে তুখোড় জেরা চালাল কিছুক্ষণ, সিনেমার মত। ছেলেটা ততোধিক
প্রস্তুত ভাবে সে জেরার জবাব দিয়ে গেল, শুধু মুখের নির্লিপ্ত, নির্বিকার ভাবটা
গেলনা। একজন জাত জিজ্ঞেস করে তার স্বজাত জেনে খুশি হল, অন্যান্য স্বজাতদের বলল ছেলেটাকে
দিতে। একজন যার নেওয়ার হাত উদার ও শিশুর মত সরল, ছেলেটাকে সবচেয়ে বেশি দিল। শেষ
অব্দি বড়বাবু, ছোটোসাহেব, সেজসাহেব, মেজসাহেব, বড়সাহেবরাও দিলেন।
ছেলেটা নিজের বেচবার জিনিষ বেচে
চলে গেল। কোনার মানুষটিও এবার উঠে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন সিগারেট কিনতে। দেখলেন, ছেলেটা
খালি পা, ঢলঢলে প্যান্ট পরে দোকানের সারির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
রাস্তায় দুপুরের ভীড়। ছেলেটা সেই ভীড়ে
মিশে গেল।
সিগারেট কিনতে তিনি দোকানের সামনে
দাঁড়ালেন। দোকানের আয়নায় তাঁর চেহারা, তার পিছনে আরেকটি চেহারা দেখলেন। ফুটপাথের ধারে
এক ভিখিরি ভিক্ষে চাইছে। তিনি সিগারেট ধরিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই ভিখিরি তাঁর দিকে তাকিয়ে
চাইতে শুরু করল।
এই ভিখিরিও বিক্রেতা। অথবা ওই ছেলেটাও
ভিখিরি। তবু তফাৎ আছে বোধহয়। ভিখিরি যেমন আছে, তার স্থিতাবস্থাটাই সম্পদ। সেই ভিখু
আর পাঁচির গল্পের মত। কিন্তু এই ছেলেটা নিজেকে লেখাপড়া শেখাবে। নিজেতে একটা ভিন্নতর
মূল্য সংযোজন করবে। অর্থাৎ অবস্থা বেচবার অবস্থা থেকে শ্রম, মানে কায়িক তো এখনও
করতে পারত, হয়ত মেধাগত শ্রম বেচবার অবস্থায় পৌঁছোবার জন্য তার লেখাপড়া শেখা। লেখাপড়া
শিখে সেও কি কেরানি হবে?
দারিদ্র্য! দারিদ্র্য কি ওই ভিখিরি
বা ওই ছেলেটার পূঁজি? কিন্তু, সেই পূঁজি, তিনি বা অন্য সবাই কিছু না দিলেই বরং বাড়ছে
এবং বাড়তে বাড়তে তাদের শেষ করে দিচ্ছে।
অবশ্য ছেলেটাকে শেষ করছে না। সে খাবার
জন্য সাহায্য চাইছে না, পড়বার জন্য চাইছে। তাঁর বড়দার ছোটো ছেলের মত। বড়দা কাজ
করেন একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে, মাইনে কম। খোরাকটুকু জুটে যায়। কিন্তু ছেলেমেয়েদের
পড়াশোনার খাতে কম পড়ে যায়। তিনি মাসে মাসে দাদাকে কিছু সাহায্য করেন, এমনভাবে যাতে
চোখে না লাগে। একটা চক্ষুলজ্জা বলে আছে তো!
ছেলেটির কোনো চক্ষুলজ্জা নেই। সে
কি তাঁদের সামূহিক সন্তান?
তিনি মাইনে পান সাড়ে পাঁচশো টাকা।
যদি ধরেও নেওয়া যায় যে কম পান না (যদিও সেটা ঠিক নয় কেননা বড় ঘর থেকে ছোটো ঘর, ছোটো
পাড়া থেকে বড় মহল্লা, দৈনিক বাজারের হিসেব
... এবং মাইনে বাড়াবার লড়াই, এসোসিয়েশন ইত্যাদি) তবু একটা ব্যাপার এখানে আসছে।
এই ছেলেটা এই শহরেই থাকে। এই প্রদেশে, এই দেশে অর্থাৎ এই সমাজে। সমাজ বাধ্য করেছে ছেলেটাকে,
ফুটপাথের ভিখিরিটাকে ও আরো অনেককে টাকার জন্য তাঁর কাছে আসতে। অর্থাৎ এই ব্যবস্থা
টাকাটা এভাবে নিয়ে নিচ্ছে তাঁর পকেটা থেকে। তিনি চান বা না চান তাঁর মাসিক
প্রয়োজনের বাজেটের মধ্যে ধরে রাখা রয়েছে ওই ছেলেটাকে দেওয়া দু’টাকা যা
দিয়ে দু প্যাকেট সিগারেট কিম্বা দেড় কিলো গম কেনা যেতে পারত। অথবা পারত না। পারার
প্রশ্নই আসে না। কেননা যেমন সিগারেট কিম্বা গম, তেমনই ওই ছেলেটার বিক্রি করা
বস্তুটি তাঁর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের অঙ্গ!
কী সেই বস্তুটি?
ছেলেটা যে পথে ভীড়ে মিশে গিয়েছিল
সে পথটার দিকে একবার চোখ তুলে তাকালেন। নাঃ, ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবও নয়। ... “লেখাপড়া
করার জন্য সাহায্য দিন” – কী নির্লিপ্ত, নির্বিকার আর অস্থির
ছিল তার কন্ঠস্বর!
No comments:
Post a Comment