- দেখেছিস? দ্যাখ। দ্যাখ, আমার পাশে কে! কার সাথে এই ছবিটা আমার!
-
আরে! এ তো কপিল দেব!
-
হুঁঃ হুঁ ...
-
কোথায় তোলা এই ছবিটা?
-
মুম্বই এয়ারপোর্টে। হঠাৎ দেখতে
পেলাম লাউঞ্জে, ইউএস যাওয়ার সময়। দৌড়োতে তো আর পারি না এই ভারী শরীর নিয়ে। কোনো
রকমে তাড়াতাড়ি পৌঁছোলাম ওর কাছে। বললাম একসঙ্গে ছবি তুলব। খুশি মনে রাজি হয়ে গেল। তখন,
অন্য এক প্যাসেঞ্জারকে ছবি তুলে দেওয়ার রিকোয়েস্ট করে হাতের মোবাইলটা দিলাম। ভালোই
তুলেছে, না রে? ... আমি তো মোবাইল থেকে পাঠাতেও জানি না।...
আমার নজর ছিল আশাদির ঠোঁটের সিগরেটটার ওপর। আদ্ধেকটা খেয়েছেন।
এবার নেওয়া যায়। আমি ঠোঁটে লাগানো সিগরেটটার ওপর দুটো আঙুল রেখে টানলাম, “আদ্ধেকটা খেয়েছেন, এবার দিন।”
-
ম্মঃ !
ওই বিরক্তিসূচক আওয়াজটা বার করতে গিয়েই ঠোঁটটা ঢিলে হয়ে
গেল, আর আমার ঠোঁটে চলে এল সিগরেটটা।
-
মানা করেছি না? আমার মুখেরটা নিবি
না! ওই তো রাখা আছে টেবিলে।
-
এখন এই আদ্ধেকটাই খাবো। ... ছাড়ুন।
হ্যাঁ, কী করে বার করলেন মোবাইল থেকে।
বললাম না যে ওনার মুখের আদ্ধেকটা খাওয়াই আমার উদ্দেশ্য ছিল।
তার ওপর যদি ঠাট্টাচ্ছলে ‘প্রসাদ’ শব্দটা ব্যবহার করতাম তাহলে তো হয়েই যেত। শ্রাদ্ধ
করে ছাড়তেন আমার।
-
ইউএসএ পৌঁছে রবিকে বললাম। ও বার
করে একটা প্রিন্ট করিয়ে দিল আমাকে। আর এখানে সুব্বুর কাছে ইমেল করে পাঠিয়েও দিল।
-
কী কথা হল?
-
কথা আবার কী হবে! কপিলও জানে যে
ওর সাথে কেউ একসাথে ছবি কেন তোলাতে চায়।
-
আপনাকে বলেছিলাম না, অনেক আগে, যখন
গঙ্গাব্রিজ সদ্য তৈরি হয়েছে, সাইকেলে এপার ওপার হতাম। তখনই দেখেছিলাম রেলিংএর নিচের
দিকে সিমেন্টে লেখা ‘কপিল দেব’। কাঁচা সিমেন্টে কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে লিখেছিল মিস্তিরিদের
কেউ, পরে শুকিয়ে খোদাই হয়ে গেছে। সে সময়ই তো ওয়র্ল্ড কাপ জিতেছিল ভারত।
আশাদির হাতের কলম আর টেবিলের ওপর রাখা খাতাটার দিকে তাকিয়ে
জিজ্ঞেস করলাম, কী লিখছেন।
-
লিখছি না। কারেকশন করছি। বিদ্যুৎলতা।
নরেন্দ্রনাথ মিত্র।
-
হয়ে গেছে ট্রান্সলেশন?
-
কাল বিকেলেই শেষ করেছিলাম।
-
কী অসাধারণ গল্প না?
-
সত্যিই। তবে এখন আর নরেন্দ্রনাথ
মিত্র নয়। আমাকে অন্য কাজে হাত দিতে হবে। সোনু ওরা এসে রিকোয়েস্ট করে গেছে।
আশাদি মানে আশা মিশ্র আবার ‘করুণা’দিও। আমি বলি, আমাদের বন্ধুদের মাঝে কারোর ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায়’ আপনিই আসেন। আশাদি চশমার ওপর দিয়ে ধারালো ভাবে তাকিয়ে একটা
সিগরেট উপহার দেন। ... সেন্ট ম্যাথিউসে শিক্ষিকা ছিলেন। ছেড়ে দিয়েছেন। ছেলেদুটোর
চাকরি হয়নি, খুঁজে নেবে। বড় তো হয়ে গেছে। লেখাপড়াও বড়টার শেষ, ছোটোটারও শেষের মুখে।
বাপ, মানে জগদীশ মিশ্রর সম্পত্তিও মোটামুটি আছে।
আশাদি জগদীশ মিশ্রর তৃতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী রহস্যজনক
পরিস্থিতিতে মারা গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়েছিলেন সন্তান দিতে পারেননি
বলে। তবুও আশাদির বাড়ির লোকজন এই লোকটির সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন কেননা আশাদি নাকি দেখতে
সুন্দর আর ফর্সা ছিলেন না। যদিও আমাদের চোখে অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন আশাদি। মাথায়
রুপোলি চুলের ধারা, বাইফোকালের পিছনে তীক্ষ্ণ দুই চোখ, বুদ্ধিদীপ্ত কথা, সহজ বন্ধুত্বের
মানসিকতা ...। আমাদেরই মত সিগরেটখোর, মাঝে মধ্যে মদেও মানা নেই আর লেখালিখি, কবিতা
আর গানে ভরা জগতের শরিক। ভাগ্যিস, দুটো ছেলেও দিতে পেরেছিলেন তিজবরকে, নইলে হয়ত
ওনারও রহস্যজনক মৃত্যু হয়ে যেত।...
যাক। কথা হল, তাহলে আর চাকরি কেন করবেন? লেখাপড়া জানেন, সেধরণেরই
কিছু করবেন!
বলতে গেলে সিদ্ধান্তটা উনি আমাদের বন্ধু হিসেবে পাওয়ার পরেই
নিয়েছিলেন। আমরা পাঁচ-ছ’জন বন্ধু
হিন্দি, বাংলা, উর্দু মিলিয়ে লেখালিখির জগতেই আছি, একজন প্রতিষ্ঠিত, বাকিরা উঠতি অথবা
শিক্ষানবিশ। আশাদি আমাদের সবার থেকে বয়সে বেশ খানিকটা বড়। তবুও চাকরি ছেড়ে বাংলা শিখলেন,
বাংলা থেকে হিন্দিতে অনুবাদ করা শুরু করলেন, তারপর রুশি শিখলেন...। রুশিতে বড়
অনুবাদ অবশ্য ধরেননি। আমাদের সাথে উনিও বামপন্থী রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশীদার
হলেন। নারী সংগঠনের নেত্রী হয়ে উঠলেন। যেমন হিল্লি-দিল্লি করলেন তেমন গ্রামে
গ্রামেও গেলেন। অন্ততঃ আমার থেকে তো ঢের বেশি চৌখস ছিলেন এ ব্যাপারে কেননা আমি
নিজে তো কখনো গ্রামে থাকিনি। আমার তো দস্তুরমত অবাক লাগত। এই এমেরিকা যাচ্ছেন
দিদির ছেলের ডাকে, আবার এই বৈশালীর গ্রামে যাচ্ছেন সংগঠনের ডাকে!
আরো কত গল্প ছিল! ...
তারপর? রইলাম আমি আর আশাদি। না, মানে এমন নয় যে সবাই চলে গিয়েছিল
এই শহর ছেড়ে। কবিজি ছিলেন। কিন্তু কবিজিকে আশাদির বাড়ির লোকেরা পছন্দ করত না। আর বয়সের
ভারে আশাদির চলার ক্ষমতা একটু একটু করে কমে আসছিল। তাছাড়া আমি একটু ভক্তভাবের মানুষ।
বৌ, ছেলেমেয়ে আমারও আছে, তবু বন্ধুদের খোঁজ খবর রাখতে আমিই সবার বাড়িতে যেতাম। কখনো
জানিয়ে, কখনো না জানিয়ে। আমার বাড়ির
লোকেরাও আমার এই বন্ধুজগত অনেকটা চিনে গিয়েছিল।
-
কী রে, আসবি না?
-
আসবো, আজকেই আসবো আশাদি!
গেলাম।
-
শরীর ঝিমিয়ে থাকে রে। এত ওষুধ। শুধু
ব্যাথা আর ব্যাথা। পায়খানায় যেতে কষ্ট। চান করতে কষ্ট। শুধু মনটাকে ঝিমিয়ে পড়তে দিই না।
ছেলের বৌ চা’টা দিয়ে গ্রল। একটা সিগরেট ধরালেন।
-
তুই এই বাংলা বইগুলো নিয়ে যা। নরেন্দ্রনাথ
মিত্র, সোমেন চন্দ ...
-
আপনি কাজ করছেন তো!
-
আর পারি না। বসতেই পারি না।
-
তাহলে পড়ুন! শুয়ে শুয়ে পড়ুন। নিয়ে
যাব কেন?
-
পড়াও হচ্ছে না। আর সেরকম পড়ার ইচ্ছে
হলে কিছু বই, পত্রপত্রিকা তো আছেই।
-
আর আপনার করা অনুবাদগুলো?
-
সব ফাইলে বেঁধে রেখে দিয়েছি তোর
জন্য।
-
সেগুলোই বরং দিন। ছাপার ব্যবস্থা
করব।
-
ওই তো! রাখা আছে। আগে চাটা খা। তারপর
আমাকে নিয়ে বেরো।
-
কোথায়?
-
কেন? ব্ল্যাক কুর্যান্ট খাওয়াবি
না।
ব্ল্যাক কুর্যান্ট আমার ছেলে মেয়েরা জানত। আমি জানতাম না।
প্রথম আশাদিই চিনিয়েছিলেন বেগুনি-নীল রঙের আইসক্রিমটা। তারপর থেকে আমি একা বা অন্য
কারো সাথে খেলেও ব্ল্যাক কুর্যান্টই খেতাম।
আশাদির করা অনুবাদের পান্ডুলিপিগুলো নিয়ে এসেছি। এন্ট্রি
করতে দিয়েছি। এরই মধ্যে একদিন ডাক এল। যেতে
পারলাম না। বেশ কয়েকদিন যেতে পারলাম না। তারপর একদিন সকালে ফোন করল ওনার ছেলের বৌ।
খবর দিল আশাদি মারা গেছেন। গেলাম, দেখে চিনতে পারলাম না। এমন শরীর হয়ে গিয়েছিল ফুলে
ফুলে। আর মুখটাও কেমন মঙ্গোল ধাঁচের মনে হচ্ছিল।
নারী সংগঠনের তরফ থেকে শোকসভা হবে।
আশ্চর্য, একটাও ছবি খুঁজে পাওয়া গেল না সময় মত। শেষে ওই, কপিল দেবের সাথে ছবিটা। ভাগ্যিস
এক কপি আমার ল্যাপটপেও ছিল। তার থেকেই ওনার আবক্ষ মুখ কেটে বার করে পেনড্রাইভে
দিলাম প্রিন্টের জন্য। আর তা করতে গিয়ে ভুল করে মূল ছবিটাই রিপ্লেস করে দিলাম।
কপিল দেব আর রইলেনই না আমার ল্যাপটপে।
-
আশাদি,
আপনি রাগ করে আছেন, সেদিন আসতে পারিনি বলে? তাহলে তো আপনারই শোনানো মেহদি হাসান
সাহেবের গানের সুরে বলতে হয়, “রঞ্জিশ হি সহি, দিল দুখানে কে লিয়ে
আ...”
আমার স্ত্রীর খুব গাছের শখ। দু’একবার ওর
সাথে আশাদির বাড়ি গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য আরো অনেক দেখা হয়েছে ওদের, সভায়, সমিতিতে।
আশাদিও একবার আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। ... সেই প্রথম দেখায় আশাদি একটা গাছ উপহার দিয়েছিলেন
স্ত্রীকে। ফলফুল নয়, পাতাবাহারের গাছ, সঙ্গে ভারী সিমেন্টের বড় টবটাও দিয়ে দিয়েছিলেন।
সেই গাছটা আর নেই। টবে অন্য গাছ লাগানো হয়েছে। ও যত্ন করে রাখে ওই টবটা। কতবার কতজনে
বলেছে যে এইটুকু আড়াই কামরার ফ্ল্যাটে এক তো বাগান করাই দুষ্কর, তার ওপর অত বড়
একটা টব রাখার কোনো মানেই হয় না। আসতে যেতে ঘষা লাগে, পা ছড়ে যায়। তবু ও সরাবে না।
ওকে সেদিন বললাম। যেদিন সন্ধ্যায় ওর
সাথে আমার বিয়ে হবার এবং আমি – ঠিক করছি তো, না কি ঠিক করছি না ...
নিয়ে একটা টানাপোড়েন থেকে মুক্ত হতে পারছিলাম না, দুপুরে আশাদির কাছে গিয়েছিলাম। আশাদির
দুই হাত ধরে উঠিয়ে চেটোদুটো নিজের মুখের ওপর ঘষে ঘষে ভিতরে ভরসা বাড়িয়েছিলাম।
-
কেমন
লেগেছিল? মুখটা ঘষতে?
-
কেমন
আবার লাগবে! হলদেটে আঙুলের সিগরেটের গন্ধে মুখটা ম ম করছিল।
৬.৮.১৯
No comments:
Post a Comment