Thursday, October 6, 2022

লালি গুড়াঁস

ছোট ঘাসজমির ওপারে, পঞ্চাশ গজ দূরত্বে বেড়ার লাগোয়া গাছটাকে কোনো অচেনা ফুলের গাছ ভাবা গিয়েছিল। আশ্চর্যও হওয়া গিয়েছিল যে এত বড় বড় সাদা ফুলও তাহলে এত ছোট গাছ ভরে হয়। অবশ্য পাহাড়ে অনেক কিছুই হয়। কিন্তু রাজকিশোরজি হাজার হোক, গ্রামেরই মানুষ। এত সরল, সৌন্দর্যনির্ভর প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হওয়ার নন। তিনি বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে হঠাৎ বলগাছুট হাসিতে সবাইকে চমকে দিলেন।

বিকাশের সেজদা আর সেজবৌদি চার বছর যাবত কাঠমান্ডুতে আছেন। বৌদির বরং গাইড হওয়ার কথা, কিন্তু তিনিও আজ অব্দি ব্যাপারটার অবিশ্বাস্যতার দিকে নজর দেন নি। চা দিতে এসে তিনিও সবার সাথে জানলায় এসে দাঁড়ালেন।

-                ওমা! তাই? লক্ষ্মীপ্যাঁচা? অত্তোগুলো? ওভাবে স্থির হয়ে একটা গাছে বসে আছে?

-                উড়বে কী করে? দিনের বেলায় চোখ তো অন্ধ!

অনুপম অবাক চোখে দেখতে দেখতে বলল, সত্যি অদ্ভুত। আর জীবনানন্দ পড়া না থাকলেও এমন দৃশ্যে প্যাঁচার সাথে বন্ধুত্ব করা যায়!

রাজকিশোরজি ফোড়ন কাটলেন, বাংলাভাষার কথাই আলাদা। আমাদের কথায় বলে, হর শাখ পে উল্লু ব্যয়ঠা হ্যয়, অঞ্জাম-এ গুলিস্তাঁ ক্যা হোগা (প্রত্যেক ডালে প্যাঁচা বসে আছে, বাগিচার অবস্থা কী হবে )!

তবে যাই বলুন বিকাশ অন্যমনস্ক ভাবে বলল, প্যাঁচা সত্যিই খুব সুন্দর। খুব কাছ থেকে দেখলে এমন মায়া পড়বে না?

বৌদি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় দেখলে?

-                সে আমি যখন ক্রিশ্চান হাসপাতালে কাজ করতাম। ক্যাশিয়ার সাহেব কে জানে কোন গাছ থেকে ধরে এনে কাউন্টারে বসিয়ে রেখেছিলেন। লক্ষ্মীপ্যাঁচা। কী অপরূপ দেখতে লাগছিল। শেষে কী জানলাম জানো?

-                কী?

-                মেরে মাংস খাবে। প্যাঁচার মাংস নাকি খুব সুস্বাদু!

-                এঃ! ক্যাশিয়ারের নাম কী?

-                নাম তো ক্রিশ্চান হিসেবে কিছু ছিল। তবে বেসিকালি ছিলেন উত্তর বিহারের মানুষ, বেতিয়ার দিকের।

রাজকিশোরজি শুনছিলেন। বললেন, খায়ই তো! কতকিছুই খেয়ে বেঁচে থাকে মানুষ! মুসহররা ইঁদুর খায়। আমরা পারব, খেতে? পুরো নেপাল তো মোষ খায়!  

-                ছাড়ুন! দরকার পড়লে দেখা যাবে কী খেতে পারি আর না পারি।

হ্যাঁ, তুমি তো কাঁচা মুরগিও খেয়েছ! অনুপম ফুট কাটল।

-                কাঁচা মুরগি নয় কাঁচা পাঠা। সেও মাত্র একটুকরো খেয়ে দেখেছিলাম। হ্যাঁ, মুরগি নিজের হাতে ব্লেড দিয়ে গলা কেটে, একদম পাকা হাতে, মুঠোয় গলাটা চেপে ধরে রেখে, যাতে রক্ত না বেরিয়ে যায় পুরোটা, ধরে থেকেছি। ছটফট করছে, মরেছে! তারপর রান্না হলে সেটা খেয়েওছি।

ছি! কী বলছ তুমি! বৌদি শিউরে উঠলেন পিছনে, কেন মেরেছিলে?

-                বাঃ, দেখতে! অন্যেরা মারবে, আর আমরা ছি বলে দিব্যি রান্না করে খাব? পারলে পাঁঠাও কাটতাম। সেটা হল না। ভোরবেলায় যেতাম ছোটবেলায় মাংসের দোকানে, নিজের চোখে কাটা দেখে সহ্য করব বলে। আর মুরগি তো এই কয়েক বছর আগে, ধানবাদে। তিতিরের বাড়িতে। কাটার লোক আসেনি, তাই সুযোগ পেয়ে গেলাম।

ওস্তাদি মারার শখ আছে ওর বৌদি, অনুপম ফুট কাটল, বলছে দেখুন না কিভাবে, যেন বিরাট কিছু একটা করেছে!

 

অনুপম আর বিকাশ অতঃপর কবিতায় সৌন্দর্যবোধের বিকাশঃ প্রসঙ্গ বাংলা কবিতা বিষয়ে আলোচনায় জুটে গেল। ভাষাটা প্রধানত হিন্দি রাখল যাতে রাজকিশোরজি বুঝতে পারেন এবং প্রয়োজনে ঢুকতে পারেন। চাটাও জুড়িয়ে যাচ্ছিল।

বিকাশের সেজবৌদির পরোক্ষ ও প্রায় নীরব সমর্থন সত্ত্বেও আলোচনাটা বিষয়ানুবর্ত্তী হয়ে এগোল না। এবারকার সফরের সব আলোচনার মত এটাও, সৌন্দর্যবোধের শ্রেণীচরিত্র, বিষয়-বিষয়ী সম্পর্কের ধাপে ধাপে পথচ্যুত হয়ে এসে দাঁড়ালো বস্তুবাদের বিবেচনায়।

 

নেপাল ভারতবর্ষের যতই প্রতিবেশী হোক, এবং যখনকার কথা তখন যাওয়া-আসা যতই সহজ হয়ে থাকুক, একটা বোধ এনেই দেয় যে ওরা বিদেশের মাটিতে পা ফেলে হাঁটছে। ঠান্ডা আবহাওয়া, হিমালয়ের নিসর্গ, উপত্যকার প্রেক্ষিত, নানা দেশের মানুষের ভীড় বোধটাকে আরো নিবিড় করে দেয়। যে দেশগুলোয় ওদের কোনোদিন যাওয়া হবে না সে সব দেশগুলোর স্বাদ কিছুটা চেখে নেওয়া যায়। যেমন ওদের আস্তানা থেকে বেরিয়ে পুতলি-সড়কে উঠে আসার গলিটায় ভেজা ভেজা পাঁচটি পপলারের সারি যতবার পেরোয় ডাক্তারসাহেবের পাঠানো স্ট্র্যাটফোর্ড অন এ্যাভনের ছবিটার কথা বার বার মনে পড়ে যায় বিকাশ আর অনুপম দুজনেরই। নই সড়কের ধারে কোনো একটা দোকানের সিঁড়িতে বসে বিকাশ মনে করতেই পারে যে সুজয় সেই কবে আমস্টারডামের সন্ধ্যায় একটি ফরাসি মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব পাতাবার গল্প করেছিল।

আর তিনজনের জন্যই সবচেয়ে রোমাঞ্চকর এই বোধটা যে হাত বাড়ালেই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ - সমাজতন্ত্র! গণপ্রজাতন্ত্রী চীন!

বিকাশের দাদা বললেন, কদিন থাকবে তার ওপর। আমার পরিচিত লোক আছে, সে ব্যবস্থা করে দেবে বর্ডারটা দেখে আসার। ব্রীজের ওপারেই দেখবে চাইনিজ সোলজার, চাইনিজ চেকপোস্ট। বৌদি দেখালেন চীনের পটারি, পর্দার কাপড় । তবে এ তো আর চীন দেখা নয়। চীনের কাপড়, ক্যামেরা, ট্রাঞ্জিস্টর এসব তো ছোটবেলা থেকে দেখছে বিকাশ। আরো ছোটোবেলায়, সেই বাষট্টিতে, গলি গলি মে শোর হ্যয়, চৌ এন লাই চোর হ্যয় শুনেছে। চীন এখন ওদের কাছে একটা অধরা স্বপ্ন। সেটা তো আর চীন দেখে পুরো হবে না। নিজেদের দেশেই পুরো করতে হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী ভারত গড়ে । আপাততঃ যেখানে, বিহারে নেতারা জেলে, বাংলায় আধাফ্যাসিস্ট রাজ, সোভিয়েত সমর্থন পাচ্ছে ইন্দিরা গান্ধী আর জয়প্রকাশ নারায়ণ, স্বঘোষিত কম্যুনিস্ট-বিরোধী, সম্পূর্ণ ক্রান্তি আন্দোলনের নায়ক! আভ্যন্তরীণ আপাতকাল, জরুরী অবস্থা!     

আর নেপাল আবার গণপ্রজাতন্ত্রী কেন, প্রজাতন্ত্রীও নয়। পুরোদস্তুর রাজতন্ত্র। সেদিন বেলা করে পুতলি সড়ক দিয়ে হেঁটে রাণী রত্না পার্কের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ শশব্যস্ত হয়ে একজন পুলিস অফিসার রাস্তা আটকালো। তবে বেশ সম্মানের সঙ্গে। বলল, স্যার, আপনারা প্লিজ এই ভিতরের গলিটায় ঢুকে যান। 

-                কেন?

-                এক্ষুনি আমাদের রাজা যাবেন এদিক দিয়ে। এখানকার নিয়ম মত রাস্তার দুধারে সবাইকে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাতে হবে।

-                কেন, মাথা নোয়াতে হবে কেন?

-                আপনারা ইন্ডিয়ান। বুঝতে পারছি, আপনাদের অসুবিধে হবে। তাই রিকোয়েস্ট করছি, প্লিজ এই গলিটায় ঢুকে পড়ুন। ওদিক দিয়েও যেতে পারবেন রত্না পার্কে বা নই সড়কে।

বিদেশে ঝামেলা পাকানোর ইচ্ছে কারোরই ছিল না। তাই তিনজনে ঢুকে পড়ল গলিটায়। 

 

ওদের আস্তানার, অর্থাৎ বিকাশের সেজদার বন্ধুর বাড়ির আর ওদের খাওয়ার জায়গার, অর্থাৎ সেজদাদের বসার ঘরটার, জানলাদুটো দিয়ে যা কিছু দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতম দ্রষ্টব্য, অনতিদূরের নির্মীয়মান বাড়িটা। সরকারি গ্রন্থাগার ভবন, চীন তৈরি করে দিচ্ছে।

ওরা প্রায় স্বর্গীয় দৃশ্য দেখার মত করে চীনের শ্রমিকদের কাজ করা দেখতে থাকে, তাদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তার টুকরোগুলো শুনতে থাকে, নীল উর্দি পরা শ্রমিকদের কাজ করার যে ঢংটা চোখে পড়ে তার ছোট ছোট ডিটেলস দেখে ভাবে এরকম সমাজতন্ত্রেই হতে পারে, মাও-সে-তুংএর দেশে হতে পারে।

বালাজু যাওয়ার পথে রাস্তায় বসা একঝাঁক চড়ুই উড়ে গেল। চড়ুইগুলো একটু ছোট ছোট। স্কাইলার্ক? কে জানে, বিকাশ ভাবল!

এখানে ও-ই গাইড। আগে দুবার এসেছে সেই সুবাদে। জলে বড় বড় মহাশোল মাছগুলো আবার দেখল, দেখালো। নালন্দার কাছে পাওয়াপুরিতেও সরোবরটা এমনই মাছে ভর্তি কিন্তু এখানকার মাছগুলো খুব বড় আর পুরোনো।

অনুপম রাজকিশোরজিকে সকালের কথার খেই ধরাল, কিন্তু তাহলে বস্তু শেষ বিচারে কী? একটা ধারণাগত সত্ত্বা? তাই তো? তাহলে দাঁড়াচ্ছে যে ম্যাটার নিজেই একটা আইডিয়া! ম্যাটার না বলে যদি বলি ব্রহ্ম সর্বব্যাপী সত্ত্বা, তাহলে তফাতটা কোথায়?

-                আইডিয়া আর আইডিয়ালিজম তো এক নয়! তাছাড়া এই বস্তুজগত, বা জগত সোজা কথায়, কোনোভাবেই ওই একটি স্থির ধারণাগত সত্ত্বার উৎপত্তিও নয়, ক্রমবিকাশও নয়, প্রসারও নয় সেলফ-এক্সটার্নালাইজেশনও নয়। অর্থাৎ আমরা সুপ্রীম বিইংএর আইডিয়াটাকে তো পরিত্যাগ করছিই, প্রিমেভ্যাল ম্যাটার থেকে সংসারের উৎপত্তির পুরোনো ধারণা, ইলিয়াটিক দর্শন বা ভারতীয় সাংখ্যের প্রকৃতির ধারণাকেও পরিত্যাগ করছি

-                সেসবও পরিত্যাগ করছি? সেসবই তো আমাদের বস্তুবাদী দর্শনের উত্তরাধিকার!

-                আঃ পরিত্যাগ মানে বলতে চাইছি আমাদের বস্তুবাদ আরো স্পষ্ট, সংলগ্ন। আমরা বলছি অণু, পরমাণুতে ভাঙতে ভাঙতে বস্তুর রূপ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা বিজ্ঞানের প্রশ্ন। দার্শনিক বিচারে অন্টোলজির আগে আমরা উত্থাপন করছি এপিস্টেমোলজির প্রশ্ন। সৃষ্টির রহস্য জানার প্রশ্ন এক সময় পুরোপুরি দর্শনের এক্তিয়ার ছিল বটে। কিন্তু আজ তার অনেকখানিই বিজ্ঞানের প্রশ্ন। আর বিজ্ঞান সে প্রশ্নের যতদূর সমাধান করেছে তার ওপর ভিত্তি করে আমরা রাখছি জ্ঞানের স্বরূপের প্রশ্নটা। থিওরি অফ নলেজ। এবং সেখানে, থিংকিং আর বিইংএর মধ্যে বিইং প্রাইমারি, চিন্তা ও জগতের মধ্যে জগত প্রাথমিক। এটা পৃথিবী ও প্রাণীজগতের বিকাশের দিক থেকে বলছি না, যদিও সেটা প্রমাণিত এবং আজ শিশুরাও স্কুলে পড়ে। আমরা বলছি জ্ঞানের মুহূর্তটির পরিভাষার প্রসঙ্গে। আগে মানো যে যে বস্তুকে তুমি তোমার চিন্তার বিষয় করছ সেটা তোমার চিন্তা থেকে স্বতন্ত্র, ইচ্ছা থেকে স্বতন্ত্র। এবং এই অবস্থান থেকে বস্তুজগতকে সাধারণভাবে পরিভাষিত করতে গেলে যখন বিজ্ঞানেরই দোহাই দিয়ে শোরগোল তোলা হচ্ছে, ম্যাটার তো আর দেখা যাচ্ছে না, শেষ হয়ে গেল তখন প্রশ্নটাকে স্বস্থানে ফিরিয়ে আনার জন্য বলছি বস্তু বা পদার্থ বা জড়ত্ব একটা ধারণাগত সত্ত্বা। ধারণা এই যে সেটা তোমার চিন্তা, তোমার ইচ্ছা থেকে স্বতন্ত্র, স্বয়ংভূত, এবং সেটাই প্রাথমিক

বিকাশ একটু আলাদা হয়ে গিয়েছিল ওদের কথাবার্তা থেকে। সকালের সেই প্যাঁচার সূত্র ধরে মনে পড়ছিল ক্রিশ্চান হাসপাতালে কাজের দিনগুলো। বেসরকারি কাজ, মাইনের বাড় নেই আর শেষ পর্য্যন্ত এ্যাডমিনিস্ট্রেটরের সাথে বচসা করে নিল বলে। নইলে কাজের জায়গা হিসেবে এখনো সে ভালোবাসে হাসপাতালটাকে। আর কাজও করত কতরকমের।

 

লালি গুঁড়াস। এই সিগারেটটা বেশ ভালোই লাগছে। রাজকিশোরজি সিগারেট খান না। বিকাশ আর অনুপমের সিগারেট খাওয়া তত্ত্বআলোচনার সময় বেড়ে যায়। ট্রলিবাস ছাড়ে ত্রিভুবন স্টেডিয়ামের কোণা থেকে। আগে একটা দোকানে চা খেল। পেটে কিছু যাওয়া দরকার ছিল। কিছু নিমকি আর আনারসা খেল চায়ের সাথে।  তারপর ট্রলিবাস ধরল ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন্য। বা বলা যায় ইউনিভার্সিটি যাওয়ার টিকিট কাটল সুদৃশ্য ট্রলিবাসে চাপার জন্য। অনুপম মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে বলল, এরকমও বাস হয়? হয় তো নিশ্চয়ই। আর এগুলোও চীনে তৈরি।  তাই প্রশ্নটা জাগা স্বাভাবিক আমরা কি এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাচ্ছি? না, এক সময় থেকে আরেক সময়ে যাচ্ছি?

রাজকিশোরজি সুযোগটা ছাড়লেন না। তার মানে, দেশ ও কাল বস্তুর গতিরই সাধারণ মাত্রা, একথাটা বোঝার জন্য আমাদের ট্রলিবাসে চড়তে হল! অনুপম আর বিকাশ কোনো জবাব দিল না। কেননা বাসের ভিতরের আলো আর বাইরে গোধুলির আলো মিলে মিশে অনুপম আর বিকাশের ভিতরে একটা নীরব প্রতিযোগিতা তৈরি করছিল যে কে আগে একটি স্বকীয় কাব্যিক অভিব্যক্তি অব্দি পৌঁছোবে! এবং অবশ্যই সে পংক্তিতে শ্রমজীবী মানুষের আত্মিক ঐশ্বর্যের কিছু ইংগিত থাকবে। কিন্তু দুজনের কেউই কিছু বলতে পারল না। বিকাশ নিজেরটুকু জানে মুগ্ধ আর লুব্ধ দৃষ্টিতে ভালোবাসতে রয়ে গেল বাসের ভিতরের সময়টাকে। তারই মধ্যে, হয়ত একটু জোর করে সেই আপ্লুত চৈতন্যে ঢোকানো, শ্রমজীবী মানুষের বিশ্বঐক্যের প্রস্তাবের মত, বাসে উঠে আসা গরীব নেপালি গ্রামীণেরা, শিশু ও মহিলারা ছিল, তেমনই জোর করে তাতে সে নেপালি রাজতন্ত্রের কাঁটা ফোটাচ্ছিল।

 

বেশ বুঝতে পারছে ওরা, বৌদি হাঁপিয়ে উঠেছেন। বৌদি তো বিকাশেরই বয়সের। হয়ত একটু ছোটোও হতে পারেন। দেওর তার বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে এসেছে, কোথায় হাসিখুশি থাকবে, ঘুরবে আর হাল্কা মেজাজের কথাবার্তায় সময় কাটাবে, তা নয় দিন রাত শুধু গুরুগম্ভীর আলোচনা।

বুদ্ধি করে অন্ততঃ খাওয়ার সময়টুকুতে, মানে যেটুকু সময় বিকাশের দাদা বা বৌদির সাথে দেখা হত, বিষয় বদলে ফেললে পারত। অনেকবার দাদা-বৌদিই বদলে দিতেন বিষয়টা। কিন্তু ওদের ভূমিকা সেসব বিষয়ে হুঁ হাঁ অব্দি সীমিত থাকত। কী করবে, নতুন নতুন দার্শনিক হয়েছে তিনজন! শেষে দাদা হাল ছেড়ে দিলেন। বৌদি তো আগেই মেনে নিয়েছিলেন এরা শোধনের অযোগ্য।

 

একদিন ভাড়ায় তিনটে সাইকেল নিয়ে তিনজনে গেল ললিতপুর। চাইনিজ সেমি-রেসিং। বেশ সস্তায় ভাড়া পাওয়া যায়। পৌঁছোল চিড়িয়াখানা। সোনা-হলুদ ক্যানারি পাখি দেখে বিকাশের হিকমতের কবিতা মনে এল। রাস্তায় দেখল সূর্যমুখি, ভ্যানগগের সূর্যমুখি, মুখ বাড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে ললিতপুরের পাথর-বসানো গলিতে ঢুকে চা খেল। বিকাশের ছোটবেলায়, লজ্জায় আর অভিমানে হাঁটতে হাঁটতে ললিতপুর আসা মনে পড়ে গেল। অপরাধ তো করেইছিল, কেননা এমন কিছু ছোটোও ছিল না সে, ক্লাস সেভেন পাশ করে এসেছিল।

বিরাট বাবর মহলের দোতলায় একদিকের বারান্দায় তাদের থাকার ঘর আর অন্যদিকের বারান্দায় বাবার অফিস। ডাকটিকিট জমানোর শখ ছিল তার, তাই রোজ ভোরবেলায় ঝাড়ুদার আসার আগেই কাঠের পাটাতন বসিয়ে তৈরি মসৃণ বারান্দা পেরিয়ে চুপিচুপি বাবার অফিসে ঢুকে পড়ত। বড় সাহেবের টেবিলের পাশে রাখা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটটা হাঁটকালেই পাওয়া যেত দেশবিদেশ থেকে আসা খাম, ছেঁড়া। তাথেকে ভালো ভালো টিকিটগুলো বার করে পকেটে পুরত নিশ্চিন্তমনে। সেদিন কী মতি হল, দেখল দেরাজটা খোলা। টেনে দেখল ভিতরেও দুটো খাম রাখা আছে, হয়তো দেরি করে এসেছে কাল, খোলা হয় নি। সে ওদুটো খামেরও টিকিট বার করে নিল। একটু পরে বেলায় অফিসে হইচই। বড় সাহেবের দেরাজে কে হাত দিয়েছে। বাবা কাঁচুমাচু মুখটা ঘরে ঢুকে তাকে দেখেই ক্রুদ্ধ আর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল।

আর সে দাঁড়ায়? বাবা ঘরে ঢুকে মায়ের কাছে যেতেই সে বেরিয়ে, সিঁড়ি ধরে নেমে গেল। বাইরে বাঁদিকের ছোট্টো বাড়িটায় বাহাদুরজিও ছিলেন না। সে রাস্তায় এসে বাঁদিকে না গিয়ে ধরল অপরিচিত ডান দিক। ভাবখানা এমন, যেদিকে দুচোখ যায়। ললিতপুর অব্দি গিয়ে এমন খিদে পেল যে ফিরে এল মায়ের কাছে, তিন ঘন্টা পর। এসে দেখল বড় সাহেবের খানসামা তার জন্য আর বোনেদের জন্য পুরো একটা মুরগির ইংলিশ রোস্ট দিয়ে গেছে, আর সঙ্গে আলুর ফ্রেঞ্চ ফিঙ্গারস। জীবনে প্রথম নামগুলো জেনেছিল সে। টিকিট চুরি নিয়ে কেউ একটা কথাও তাকে আর বলে নি। তবে নিজেই সে বুঝতে পেরেছিল, দেরাজ খুলে খাম বার করাটা ভুল ছিল।

………… 

 

তখন বাগমতিতে জল কই? এতদিন পর এবারে বর্ষাকালে এসেছে কাজেই বাগমতির ধারায় সেই আগে দেখা শীর্ণ রূপ আর নেই, বৃষ্টির জলে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

রাত্তিরে তুমুল বৃষ্টি। ঘুমের মধ্যে খেয়ালই নেই ঘরের কী অবস্থা। হঠাৎ পেচ্ছাপ করতে উঠে রাজকিশোরজির পা ডুবে গেল হাঁটুর ওপর অব্দি জলে। বাকি দুজনকে ডেকে ওঠালেন। তিনজনে উঠতেই ডানলপিলোর বিরাট গদিটা খাট থেকে দু ইঞ্চি ওপরে ভেসে উঠল জলে। তখন খেয়াল হল তিনজনেরই পিঠ ভেজা।

বাড়িটা বিকাশের সেজদার এক বন্ধুর। ওদেরকে একতলার গেস্টরুমে থাকতে দিয়েছিলেন। ইচ্ছে ছিল না তবুও দোতলায় গিয়ে তাঁকে ডাকতে হল। বাকি সময়টা তিনজনে দোতলার ডাইনিং হলে বসে কাটালো। ভদ্রলোকও রীতিমত অপ্রস্তুত। সঙ্গে বসে রইলেন। যাই হোক, পাহাড়ি বৃষ্টি। সকালেই বেরিয়ে গেল জল।

 

আরেকদিন দুপুরে ওরা গেল নই সড়কের পেছনের বাজারটায়। চীনে আর নেপালী প্রকাশনায় মার্ক্সবাদী, বামপন্থী বইয়ের দোকানে। রাজকিশোরজি অনেক কথা বললেন বইয়ের দোকানের লোকটির সাথে, বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে। কিছু মার্ক্সবাদী বই কিনল বিকাশ, চীনে প্রকাশিত।

একদিন রাজকিশোরজিই বললেন, এটা কিরকম ঘোরা হচ্ছে?

-                মানে?

-                সাধারণ মানুষ যে জায়গাগুলো দেখতে কাঠমান্ডু আসে সেগুলো দেখব না?

-                সে তো পশুপতিনাথের মন্দির, স্বয়ম্ভু, দক্ষিণকালী

-                একজ্যাক্টলি। ওসব জায়গাগুলো একবার দেখে তো নিই।

অগত্যা বিকাশের নেতৃত্বে হল পশুপতিনাথ, স্বয়ম্ভু। স্বয়ম্ভুর পিছনে নিয়ে গিয়ে দেখাল পাহাড়ের ঢালটা, যেখান দিয়ে দৌড় দিয়েছিল সে ছোটোবেলায়, আর খাদের আগে একটা গাছের বড় শিকড়ে হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়ে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল।

  আর ভালো লাগছে না। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে। ঠিক বাড়ি ফেরাও নয়, নিজের দেশে ফিরতে ইচ্ছে করছিল। বিশ্বজগত যতই এক হোক, তোমার দেশ, তোমার বসত, তোমার গলি, বাড়ি, তোমার রোজকার মানবিক সম্পর্কগুলো ওসব নিয়েই তো তোমার অস্তিত্বের ভরকেন্দ্র! এই সুখের অতিথি-জীবন ভার হয়ে উঠছে। ছদিনের মাথায় দাদা, বৌদি, তাঁদের বন্ধু সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বাসে চেপে বসল। বিকাশের মনে আরেকটা ভার ছিল। এবারে যে এল, সেই ছোটোবেলার বাবরমহলেও যাওয়া হল না।

আট বছর পর যখন একবার একদিনের জন্য বাবার একটা কাজে এসেছিল, বাবরমহলের পাশের ছোটো বাড়িটায় থাকা বাহাদুরজির বাড়িতে গিয়েছিল। তাঁর ছেলে ছোট্ট বিবাডুর (নিজের বীরবাহাদুর নামটা ওভাবেই বলত ছেলেটা) দেখাও হল না। কত বড় হয়ে গিয়ে থাকবে।

কত স্মৃতি আছে জানো? অনুপমকে বলল বিকাশ, সেই ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় যখন এসেছিলাম, আমাদের পাশের ঘরটায় একটা ফ্যামিলি থাকতেন। মাঝেমধ্যে তাঁদের ঘরে যেতাম বিকেলে চা খেতে। ব্যাস, বসলাম আর সেই কাকিমা জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সামনের পিচ গাছটা থেকে পিচ ফল পাড়তেন আর কেটে খেতে দিতেন আমায়। কাঠের ঘরে বসে দেখতাম পিচ গাছটায় সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে। পরে যখন চেখভের নাটকে সন্ধ্যার দৃশ্য পড়ছি, সেই আলো-আঁধারিটাই খেলা করছে চোখে!   

 

যাওয়ার সময় কী বিস্ময়কর লেগেছিল মেঘের ঘনঘটা! ওপরে, সামনে, পেছনে, বাঁদিকে, ডানদিকে, নিচে শুধু মেঘ আর মেঘ। হাত বাড়িয়ে এক আঁজলা মেঘ নিয়ে যেন কুলকুচো করা যায়। বাসের জানলা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ছে, গাছের গুঁড়ি ঘেঁষে দৌড়োচ্ছে, নিচের মাঠে পড়ে আছে এক পুঞ্জ। শিউভঞ্জকের চুড়োয় উঠবার একটু আগে যখন ভেজা ভেজা দেবদারু গাছের নিচে চায়ের দোকানটায় চা খাচ্ছিল, একজন দেখালো সামনের আকাশে মেঘের স্তুপের ভিতরে কী যেন একটা চিকচিক করছে, ঝিলিক দিচ্ছে অপসৃয়মান বিন্দুর মত। অবশ্যই সূর্যের আলোয়, কিন্তু সে সূর্য ওদের আকাশের বাইরে অন্য কোথাও ছিল। ওদের আকাশ, পৃথিবী সবই তখন ছিল সৃষ্টির আদিম মেঘপুঞ্জ।

-                বলুন তো, ওটা কী?

-                এরোপ্লেন?

-                হাঃ হাঃ, ওই মেঘের স্তুপটাই তো শিউভঞ্জক, আর চিকচিক করছে আমাদের আগে বেরিয়ে যাওয়া বাসটা।

বিকাশ আরো বেশি অবাক হচ্ছিল। কেননা আগের দুবার ও বাসে আসেনি, এরোপ্লেনে বেরিয়ে গেছে। হ্যাঁ, মনে আছে প্রথমবার বাবা কথা বলে ওকে নিয়ে গিয়েছিলেন ককপিটের পিছনে। সামনের জানালা দিয়ে দেখেছিল দামন অবজারভেটরি, শিউভঞ্জকের চুড়ো তারপর সিমরা পাস তারপর সীটে বসে নেমেছিল কাঠমান্ডু উপত্যকায়। এও মনে আছে প্লেনটা ছিল রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইন্সের ডাকোটা। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স হলে হত ফকার ফ্রেন্ডশিপ। দুপাশ দিয়ে প্রায় গায়ে ঘসে মেঘ বেরিয়ে যাচ্ছে। হাত পাতলে ভিজিয়ে দিছে তালু। সে হাতেই চায়ের কাপে চুমুক দিল বিকাশ।

 

ফেরার সময় যতই চেষ্টা কর না কেন, ফেরার তাড়াটা গ্রাস করে নেয়। বীরগঞ্জে বাস থেকে নেমে বিকাশ দেখল রাজকিশোরজি এদিক ওদিক তাকিয়ে বাসস্ট্যান্ডে কী যেন খুঁজছেন। বলল, পাবেন না।

-                কী, বল তো?

-                কলাওয়ালাকে।

-                হ্যাঁ, মনে হচ্ছে দেখা হবে না।

আসলে, যাওয়ার সময় বাসে কলা বিক্রি করতে থাকা একটি যুবক রাজকিশোরজির পরিচিত বেরিয়ে গিয়েছিল। পরে রাজকিশোরজি বলেছিলেন, যুবকটি নকশাল কোনো গ্রুপের কর্মী। দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হওয়ার পর, গ্রেপ্তারী এড়াতে চলে এসেছে এদিকে, নাম-পরিচয় লুকিয়ে আছে। গ্রামে থাকতে চাষ ছিল। এখানে কিছু তো করতেও হবে, পেটের তাগিদে তাই কলাবেচা।

 

বীরগঞ্জ বাজার থেকে হেঁটে এসে এবার ওরা সীমান্তের চেকপোস্ট পেরোবে। রাজকিশোরজি বললেন, বইগুলো কেন কিনলে? এখন ফেলতে হবে। অনুপম, তুমিও কিনেছ?অনুপম মাথা নাড়ল। বিকাশ পাল্টা প্রশ্ন করল, কেন ফেলব?

-                ফেলতেই হবে। কোনোরকম রিস্ক নিতে চাই না।

-                ঠিক আছে।

চেকপোস্টের বাঁদিকে রাস্তা থেকে নেমে একটা গাছের আড়ালে পেচ্ছাপ করতে যাওয়ার অছিলায় বইগুলো ফেলে দিয়ে এল। কষ্ট হল। কাউকে দেখানোর জন্যও রইল না যে দেখ্‌, কাঠমান্ডুর দোকানের স্ট্যাম্প মারা, ওখান থেকেই কেনা। গাছের পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দেখল বিকাশ যে কয়েকজন কাঁধের ব্যাগ মাটিতে রেখে টেনে বার করছে টেরিলিনের থান, প্যান্টের কাপড়। পরে থাকা প্যান্টের ওপর দিয়েই লুঙ্গির মত করে পেঁচিয়ে নিচ্ছে তিন-চারটে করে থান। কেননা চেকপোস্টের নিয়ম অনুযায়ী, গায়ে বা পরনে যা থাকবে তার হিসেব হবে না, ট্যাক্স লাগবে না। এমনকি দুই কব্জিতে দুটো ঘড়ি, বা কাঁধে ঝোলান দুখানা ট্রাঞ্জিস্টর রেডিও থাকলেও না। শুধু ব্যাগ চেকিং হবে। বস্তুতঃ, এসব ছেলেদের অধিকাংশ, রক্সৌল থেকে সীতামঢ়ি এমনকি মুজফফরপুর অব্দি কাপড়ের ব্যবসাদারদের এজেন্ট। রোজ যায়। ফিরে আসে জিনিষপত্তর নিয়ে। হাঃ, যদি বইগুলোও ওভাবে গায়ে পায়ে পরে নেওয়া যেত!

চেকপোস্ট পেরোতেই শহরটা রক্সৌল। রক্সৌল থেকে মুজফফরপুর, মুজফফরপুর থেকে পহলেজা ঘাট।

 

স্টিমারের সামনের ডেকে দাঁড়িয়ে আছে তিনজনে। হাওয়ায় চুল ওলটপালট করে দিচ্ছে।

বিকাশ চাকরি করে। যদিও বি.কম. পাশ তবে একসময় বিজ্ঞান পড়ার ইচ্ছে রাখত। অনুপম ফিজিক্স অনার্স, ফিজিক্সেই এম.এস.সি.। তবে ওদের দুজনেরই প্রিয় বিষয় দর্শন ও কবিতা। রাজকিশোরজি লপাশ। কিন্তু পুরো সময়ের রাজনৈতিক কর্মী থাকার ইচ্ছে। গ্রামে কিছু জমিজমা আছে। উনিই এই টিমের আইডিওলজিকাল নেতা।

সামনে নিজেদের শহর। দেশে জরুরি অবস্থা। মেটে জলের ঢেউয়ে ঢেউয়ে শহরের পশ্চিম প্রান্তটা ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসছে।

ভালোই হল আমাদের জার্নিটা, তাই না? রাজকিশোরজি হাত রাখলেন অনুপম আর বিকাশের কাঁধে। অনুপম সিগরেটের ছাইটা জলে ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, বিকাশের দাদা আর বৌদিকে ধন্যবাদ দিন। কী অসাধারণ মানুষ দুজনে! ভাবা যায় না।

বিকাশ ভাবছিল বৌদির বিষয়েই। সেভাবে দেখতে গেলে নিজেরও নয়, জ্যাঠতুতো। কিন্তু এর থেকে বেশি কে নিজের হবে? বিয়ের পরপরই বিকাশের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কী সহজে সবার আপন হয়ে উঠেছিল বৌদি। তারপর কলকাতা থেকে সোজা চলে গেল কাঠমান্ডু। এবারের এই প্রোগ্রামটা না হলে বৌদির সাথে দেখাও হত না এখন। আর দেশে এমার্জেন্সি না হলে প্রোগ্রামটাও হত না।

-                চীনে বইগুলোর দাম দেখলে অনুপম? সোভিয়েত বই থেকে কিন্তু একটু বেশি। আর কাগজ ভালো বটে কিন্তু সব পেপারব্যাক। সোভিয়েত বই বেশির ভাগই হার্ডবাউন্ড। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে বইগুলো ফেলে আসার জন্য।

-                না ফেললে কী করতে?

-                মাইরি বলছি, তোমরা যদি না থাকতে, আমি সঙ্গে নিয়েই চেকপোস্ট পেরুতে চাইতাম।

আর ইন্ডিয়ান পুলিসের হাতে যদি ওরা তোমায় হ্যান্ডোভার করত, রাজকিশোরজি ভুরু কুঁচকে বললেন, জেলে যেতে। তোমার কাছ থেকে নাম বার করত আমাদের সবার।

-                হুঁ। সেসবই তো ভাবলাম। একটু দুরেই জঙ্গল ছিল। একা থাকলে জঙ্গলেই ঢুকে পড়তাম।

এর না! সবেতেই বোকার মত জোর ফলানো!, অনুপম রাজকিশোরজির দিকে তাকিয়ে হাসল, এতই ইচ্ছে ছিল বইগুলো নিয়ে আসার তো বীরগঞ্জ বাজার থেকে এক ঝুড়ি কলা কিনতে বরং ওই কমরেডের মত। বা অন্য কোনো ফলমূল। বেচতে বেচতে চলে আসতে! কটাকার বই ছিল?

-                টাকার জন্য তো নয়! দুষ্প্রাপ্য বইও কিছু নয়। এমনকি ফরেন ল্যাঙ্গোয়েজ, পিকিংএর বই পাটনাতেও পাওয়া যায়। কিন্তু এই, না দেখেই, সামনাসামনি নাহয়ে আগেই দমে যাওয়া ভালো লাগে না। আগেই দমে গেলে এই ট্যুরটাও হত না। এ সময় কাঠমান্ডু যাবো। কোথায় কেমন চেকিং হবে। ছাড়ো, একটা সিগরেট খাই। শেষ লালি গুড়াঁস।  আগে না দমে গেলে আমি কার্সিয়াংএর মেয়েকে বিয়ে করে ফেলতাম। গুছিয়ে ঘর করতাম।

 

স্টিমার জেটিতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। গ্যাংওয়ে ধরে নামতে নামতে বিকাশ শুনল অনুপম পিছন থেকে জিজ্ঞেস করছে, কাকে?

হবে কেউ!”, বলে দুই তালু জড়ো করে প্যাকেটের শেষ লালি গুড়াঁস সিগরেটটা ধরালো। তারপর প্যাকেটটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে নিল, এটাই থাক, হিমালয়ের উপত্যকার স্মৃতি! রডোডেনড্রনের ছবিটাও আছে!

-                যদিও দেখতে পেলাম না সেই ফুল। কেউ চিনিয়েও দেয় নি।

রাজকিশোরজি জিজ্ঞেস করলেন, কী?

-                রডোডেনড্রন! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় আছে।

-                তোমরাও তো জানতে চাও নি কারোর কাছে! নিজের দাদা-বৌদিকে জিজ্ঞেস করলেও তো পারতে!

-                হ্যাঁ, মাথায় ছিল না। দার্জিলিং, কালিম্পং আর কাঠমান্ডু তো এক নয়।

-                তাছাড়া আমরা দেশের বাইরে ছিলাম, ফরেনে

-                গেরেমভারি জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত

-                আরে দূর! এখন বীরগঞ্জের রাস্তায় সিগরেটের প্যাকেটে লালি গুঁড়াস দেখে ইচ্ছে হলো জানতে, তখন দোকানে জিজ্ঞেস করে জানলাম। আর তখন মনে এল রডোডেনড্রন গুচ্ছের কথা। প্যাকেটটাও তাই কিনলাম।

-                সিগরেটটা বড় কড়া! আর একটু ঘেসো।

-                ঘেসো ব্যাপারটা পাকিস্তানি উইলস ফিল্টারেও আছে।

-                সেটা আবার কখন খেলে?

-                কাঠমান্ডুতেই। সেই এসেছিলাম না একদিনের জন্য? পুতলি সড়কের হোটেলে কিনেছিলাম।

-                লোকে খায় কিকরে কে জানে।

-                যা পাবে তাই খাবে। ভালো না লাগলে বিড়ি আছে। আমার জন্য আপাততঃ ঘেসোই ভালো। বইগুলো ফেলে আসার বিস্বাদটা কাটাবে! আর সবচেয়ে বড় কথা নামটা, লালি গুঁড়াস। ইয়ো বিশুদ্ধ নেপালি হো।

ছিয়াত্তরের জুলাই। মাথায় বেলা এগারোটার চড়া রোদ্দুর। অশোক রাজপথে এসে রাজকিশোরজি আর অনুপমের বাঁদিকে যাওয়ার, বিকাশের ডানদিকে। রাজকিশোরজি দুজনকেই জিজ্ঞেস করলেন, বিকেলে দেখা হবে তো?

অনুপম বলল, ওকেই জিজ্ঞেস করুন। আসতে হবে অদ্দুর থেকে। কী, আসবে?

বিকাশের মাথায় ঘুরছিল লক্ষ্মীপ্যাঁচা, ট্রলিবাস, ক্যানারি, বাগমতি, বৌদি, দাদা, দাদার বন্ধু, ভোররাতে ঘরে জল, তিনটে পপলার, ক্যানারি, সূর্যমুখী, গাছের নিচে ফেলে আসা বই, ম্যাটার, আইডিয়া, আরো অনেককিছু। মনে পড়ছিল ছোটোবেলায় একদিন বাবাদের অফিসের কর্মচারী বাজেকাকা (ব্রাহ্মণকে বাজে ডাকা হয়, হয়তো বাবাজির বিকৃত রূপ) তাকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। কাঠের দোতলা বাড়ি, দোতলার জানলা খুলতেই দেখা গেল ওপরে ওঠা সবুজ প্রান্তর, মাঝখানে একটা গাছ। সন্ধ্যা নামতেই কাকিমা নিয়ে এলেন পরোটা আর ডিমের ঝোল। মনের কোথাও বিবাডু চোখ কুঁচকে হাসতে হাসতে চ্যাঁচালো লালি গুঁড়াস, লালি গুঁড়াস

বলল, দেখি।  

অনুপম হেসে উঠল, বলল, আসবে না, দেখছেন না, ওর মাথায় এখন অন্য কিছু ঘুরছে! লেখ, লেখ!

 

●●●●●●

No comments:

Post a Comment