নয় ক্লাসে ওঠার পরীক্ষার ঠিক আগেই আমার গুটিবসন্ত হয়েছিল বিচ্ছিরি
রকমের। সে অসুখ থেকে সারিয়ে তুলেছিল মা। সারাদিনরাত মায়ের করে দেওয়া শুকনো নিমপাতার
পুঁটলি থুপ থুপ করে দিতাম দগদগে গুটিগুলোর ওপর, মশারি টাঙানো আলাদা একটা বিছানায় শুয়ে
থাকতাম দিনের পর দিন।
আর, সেরে ওঠার কিছুদিন পর, পাড়ায় একে ওকে জিজ্ঞেস করে, যোগাযোগ করে
একজনকে গৃহশিক্ষক হিসেবে বাড়িতে এনেছিল বাবা। কেননা অঙ্কে ঠিক সে সময়টাতেই নতুন নতুন
জিনিষ। ত্রিকোণমিতি, স্থানাঙ্ক জ্যামিতি (এখন লিখছি, তখন কোঅর্ডিনেট জিওমেট্রি নামেই
জানতাম)। বীজগণিত আগে থেকে ছিল কিনা মনে নেই কিন্তু কঠিন হয়ে উঠছিল মনে আছে। এমনকি
এতদিনকার অঙ্কটা কোণঠাসা হয়েও অঙ্কগণিত নামে কিছু কঠিন অধ্যায় নিয়ে আসছিল। পাঠ্যক্রমও নতুন,
কেননা সদ্য আমাদের স্কুলটা বিহার বোর্ড থেকে সেন্ট্রাল বোর্ডে গিয়েছিল – আমরাই ছিলাম প্রথম ব্যাচ।
স্কুলে বেশির ভাগ টিচার মায় প্রিন্সিপ্যাল নতুন, আর সব দিল্লী, মেরঠ
আর ঝাঁসির দিকের। ওদের হিন্দি এদিককার ছিল না, ট্যাঁশ টাইপের লাগত। এতদিন যে হিন্দিতে
বুঁদ হয়ে থাকতাম সেটা অন্য রকম। আর নতুন অঙ্কের টিচার তো কথাই নেই। আমাদেরকে দিয়েই
পালা করে খেজুরের ছড়ি কাটিয়ে আনতেন পাশের বনবাদাড় থেকে আর আমাদেরকেই পেটাতেন শপাং শপাং।
শুনেছিলাম বাড়িতে গেলে নাকি গরম হালুয়া খাওয়াতেন। আমি কখনো যাই নি। উল্টে একবার একটা
অঙ্ক সবচেয়ে আগে ঠিক করার পরও পুরস্কার হিসেবে ‘শাবাশ’ আর তাঁর প্রশংসাসূচক
একটা ছড়ির ঘা পেয়েছিলাম পিঠে। সেটা আবার সেদিন, পালা ছিল বলে আমারই কেটে আনা।
এহেন অবস্থায় মানুষটি এলেন এক সন্ধ্যায়। বাবা পরিচয় করিয়ে দিলেন।
প্রথম দিনের আড়ষ্টতা দ্বিতীয় দিনেই কেটে গেল। কেননা উনি হাতে করে নিয়ে এলেন একটা গল্পের
বই। দেব সাহিত্য কুটিরের বই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো বিদেশি গল্প যাতে সাবমেরিনের
প্রসঙ্গ ছিল। গল্পের বই পড়ার নেশা আর বোধহয় ছোটোবেলার যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার নেশাটা প্রথম
দিনেই কথায় কথায় জেনে নিয়েছিলেন। শর্ত দিলেন পড়ে দুদিনেই ফেরত দিতে হবে, কিন্তু নিলেন
না।
কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় তাঁর শরীর খারাপ হওয়ার খবর পেলাম। আমার ওপর
নির্দেশ এল যে তাঁর বাড়িতে গিয়ে পড়ে আসতে হবে। আমাদের বাড়ির গলির পরের গলিটা ছেড়ে তার
পরের গলিতে ছিল সেসময় তাঁদের বাড়ি। প্রায় শেষ অংশে যেখানে গলিটা সরু হয়ে গেছে সেখানে
একটা অন্ধকার, ইঁটের পাঁজা বেরুনো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই যেন কত দিনকার চেনা মানুষেরা
ঘিরে নিল আমায়। বাঁদিকের এক চিলতে জায়গায় তাঁর মা তোলা উনুনে রুটি সেঁকছেন। পাশে ঈষৎ
শান্ত একটি মেয়ে, পরে জেনেছিলাম মেজ বোন। ডানদিকে একটা ছোটো ঘর জুড়ে দুটো খাট আর খাটের
সাথে লাগানো বড় একটা টেবিল। তাতে পড়ার জায়গা, পড়ার বই খাতা আর স্তুপাকৃতি গল্পের বই।
কে কোথায় আছে জানার আগেই ঘরটা কলর কলর শব্দে ভরে উঠল। আমার নতুন শিক্ষক দাদা কিছু বলার
আগেই তাঁর ছোটো ভাই, তারপরের বোন আর সবচেয়ে ছোটো বোনটি আমার বসার জন্য জায়গা করে দিতে,
যেন আমাকে আপন করে নিতে ব্যস্ত। ওদিকে মা’ও কিছু বলছেন,
মেজবোনও কিছু বলছে। বেশ একটু পর, প্রণাম করতে গিয়ে দেখতে পেলাম যে ঘরের ডানদিকে, মানে
রাস্তার দিকে একটা ছোট অন্ধকার ব্যালকনি আছে। সেখানেই একটা তক্তাপোশে শিক্ষক দাদার
বাবা শুয়ে ছিলেন।
সেদিন পুরো পরিবারটাই আপন হয়ে উঠল। গল্পের বইটা ফেরত দিতে হাতে করে
নিয়ে গিয়েছিলাম। অন্য একটা গল্পের বই হাতে করে বাড়ি ফিরলাম রাত্তিরবেলায়।
সত্যি বলতে ওনার পড়ানোর ধরণে টেরও পাইনি কখন এবং কিকরে পরীক্ষা পাশ
করার মত বাইনোমিয়াল থিয়োরেমও শিখলাম, কোয়াড্রেটিক ইকুয়েশনও শিখলাম, কস থিটা ট্যান থিটাও
শিখলাম।
গৃহশিক্ষক হিসেবে তাঁর কাজ শেষ হয়ে গেল। তারই মাঝে এটাও জেনে গেলাম
যে উনি কাউকে ভালোবাসেন। যাকে ভালোবাসেন তার নামে একটা চিঠিও পাঠালেন এক সন্ধ্যায়,
আমারই হাত দিয়ে। সুতরাং তাকেও চিনে গেলাম। একটা আলাদা দায়িত্বও চলে এল। আমাদের লাইন
মারার লক্ষ্যগুলো থেকে তাকে আলাদা করে রাখা, কেউ ফালতু কোনো মন্তব্য করলে তাকে সাবধান
করে দেওয়া। নিজের এমএসসি শেষ করে উনি চাকরিতে ঢুকে গেলেন। একটু বড় হতে যখন পাড়ায় চ্যাংড়ামি
করার দলে ভিড়লাম, তখন তাঁরই ছোটো ভাই হলেন বস। বড়, মেজ, ছোট বোনের সাথে মাঝে মধ্যে
দেখা হত রাস্তায় বা বাড়িতে। আমার শিক্ষক দাদার শিক্ষকতা কিন্তু গেল না। একটা প্রচ্ছন্ন
ছায়ার মত থাকত আমার সব কাজে, ঘোরাফেরায়।
কলেজে ঢুকলাম, তবে কমার্সে। বুক কিপিং আর একাউন্টেন্সি ছাড়া অঙ্ক
বলতে আর রইল না। তারই মাঝে কোনো গ্রীষ্ম দুপুরে, উড়িষ্যার খনি অঞ্চলের উধাও রাস্তায়
কবিতায় পেল আমায়। বাড়ি ফিরে রীতিমত খেরোর খাতার মত খাতা বেঁধে লেখালিখি শুরু করলাম।
সেই সূত্রেই কিছু নতুন বন্ধু হল, একটি হাতেলেখা পত্রিকার সঙ্গে জড়ালাম, সে পত্রিকার
ছাপাই সংস্করণ প্রকাশনের উদ্যোগ নিলাম আর সেই উদ্যোগে প্রশ্রয়দাতা দাদাদের মধ্যে অন্যতম
ছিলেন শিক্ষক দাদা।
পত্রিকা বেরুচ্ছে, বিক্রি হচ্ছে পাড়ায়, শিক্ষক দাদা নিজেই উৎসাহ
নিয়ে সে পত্রিকার কপি বিক্রি করছেন (গছিয়ে দিচ্ছেন নিজের বন্ধুবান্ধবদের হাতে), লেখক-কবিদের
সাথে আমার বন্ধুত্ব হচ্ছে, ভাবনাচিন্তাতেও একটু আধটু স্মার্টনেস দেখাচ্ছি, এমন সময়
একটু হাওয়া লাগতে শুরু করল। দু’একজন বন্ধুর প্ররোচনায়
এবং বাংলাদেশের (তখন সদ্য স্বাধীন; আমাদের পত্রিকার শেষ হাতে-লেখা সংস্করণ স্বাধীন
বাংলাদেশের অভিনন্দনে বেরিয়েছিল) একটি ফালতু পত্রিকায় ছাপানোর লোভে রসালো গল্প লিখতে
লাগলাম দু’একটা। সেই পত্রিকায় তো বেরোলোই, একটা আমাদের
পত্রিকাতেও ছেপে দিলাম। সেদিন নিয়োগীদের বাড়ির গলির মুখ থেকে শিক্ষক দাদা নাম ধরে চেঁচিয়ে
ডাকলেন, “ … , ভালো করছ না। এসব কী লিখছ তুমি?” ব্যাস, সেই যে হাত থামল, আর ওদিকে যায় নি।
বি-কম পাশ করার পর চাকরি। চাকরি ছেড়ে আবার চাকরি – চলে গেলাম ধানবাদ। মাঝে কলকাতায় গিয়ে কেনা লেনিনের বই নিয়ে ফিরে
এলাম সোয়া বছর পর। অন্য পাড়ায়, অন্য বাড়িতে। পুরোনো পাড়ায় গেলাম। মুখে বড় বড় কথা। শিক্ষক
দাদা আমাকেই শিক্ষক করে দিলেন একটা অধ্যয়নচক্র গড়ে। প্রতি সপ্তাহে সাইকেলে করে যেতাম
পুরোনো পাড়ায়। ছাত্র হতেন তিনি এবং তাঁর কয়েকজন সহকর্মী। একদিন ইয়ারপুরে নিয়ে গিয়ে
সে সময়কার বামপন্থী দাদাদের গুরু বলে পরিচিত একজনের বাড়িতেও নিয়ে গেলেন। তবে তিনি গুরু
হতে পারলেন না। শিক্ষক দাদাই রইলেন আমার গুরু বা শিক্ষক বা অগ্রজ। অধ্যয়নচক্র অবশ্য
চলল না বেশী দিন। পঁচাত্তর সালের বন্যা এসে গেল। দু’সপ্তাহ বাড়ির ছাতে শুয়ে কাটালাম পুরো পরিবার। সেই সুবাদে ভিন্ন পাড়ার
কিছু নতুন বন্ধুর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল। বন্যার পর নতুন বন্ধুত্বে, নতুন রাজনৈতিক পরিসরে
ঢুকলাম। লেখালিখিরও একটা নতুন জগত শুরু হয়ে গেল। পুরোনো পাড়ায় যাওয়া বলতে ছেড়েই গেল।
শিক্ষক দাদার বোনেদের মধ্যে একমাত্র ছোটোই তখন পাটনায়, চাকরি করছে। ওর সাথে দেখা হয়ে
যেত।
নিজের কাজের জায়গায় পুরোনো পেটোয়া ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে নতুন ইউনিয়ন
গড়ার তোড়জোড়। কাজের লোক বলতে দুজন, আমার এক বন্ধু ও আমি। অফিসে অফিসে আমরা রাম-লক্ষ্মণের
জুটি বলে পরিচিত হয়ে গেছি। ইউনিয়নের সার্কুলার ইত্যাদির জন্য টাইপিস্ট চাই। সে স্টেনসিল
কাটলে তবে তো সে স্টেনসিল চড়বে মেশিনে, রোলারে কালি পড়বে, ছাপা হবে? বন্ধু বলল চলুন
আমার বড় ভাইয়ের অফিসে যাই। উনি বলেছেন সাহায্য করবেন। গেলাম। গিয়ে দেখি সেই ভাইয়ার
পাশেই আমার শিক্ষক দাদাও। আর কি, অনেক দিন অব্দি সেই অফিস বিল্ডিংএর পাঁচতলার স্ট্যাটিস্টিক্স
ডিপার্টমেন্টের পুরো ঘরটাই আমাদের ভাইয়াদের ঘর হয়ে গেল আর জায়গাটা কার্যতঃ আমাদের ইউনিয়নের
সার্কুলার ছাপাইয়ের জায়গা হয়ে গেল।
কয়েক বছর পর আমি কিছুটা অতিবাম থেকে সরে এসে যুক্ত হলাম রাজনীতির
সেই ধারায় যাতে শিক্ষক দাদা যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তত দিনে, তিনি আর তাঁর পুরোনো বন্ধুরা
চলে গেছেন বিচ্ছিন্ন ধারায়। কর্মক্ষেত্রের সংগঠনও দুজনের শুধু আলাদাই নয়, শীর্ষস্তরে
প্রতিদ্বন্দ্বী। শুধু স্বস্তি যে প্রতিষ্ঠান ভিন্ন আর তাই কর্মচারী সংগঠন ভিন্ন। রাজনৈতিক
মতবিরোধ মনোমালিন্য আনে। এক্ষেত্রে, সংগঠন, লড়াইয়ের প্রেক্ষিত ভিন্ন বলে সেটা হয় নি।
তবু একটু দূরে দূরে হয়ে গেলাম বেশ কয়েক বছর। মাঝে মধ্যে দেখা হত সংযুক্ত জনসভায়, মিছিলে।
তেমনই স্নেহমাখা হাসি ছড়িয়ে নিজের জায়গা থেকেই জিজ্ঞেস করতেন, “ভালো আছ?” আমি ঘাড় নাড়তাম।
ওনার দলের পরিচিত অন্য কয়েকজনের সঙ্গে বেশ গরম গরম তর্ক করেছি, রণনীতি, কার্যনীতি নিয়ে
কথা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষক দাদার সঙ্গে করতে পারি নি। অবশ্যই ভয়ে, কিন্তু অন্য কোনো
ভয় নয়, প্রশ্রয়মাখা হাসিটা কম না হয়ে যায় সেই ভয়ে। বা হয়ত দুর্বলতায়! হতেই তো পারে
যে হয়ত ভিতরে তেমন বিশ্বাস ছিল না যে তর্কে ওনাকে হারিয়ে দিতে পারব। আর না হারাতে পারলে
রাগের মাথায় চ্যাঁচামেচি করব আর দূরত্ব বেড়ে যাবে। আমার বৃহত্তর পরিবারে আমার যারা
দাদা, তারা দূরের মানুষ, কেউ এ শহরে থাকে না, তাই হয়ত একজন এত ভালো দাদাকে হারাতে চাইনি
কোনো দিন!
ওই তো সেবার! শিক্ষক দাদা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন, সে প্রতিষ্ঠানের
প্রধান কর্মচারী সংগঠনের আভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে (পেটোয়া সংগঠন ভেঙে নতুন সংগঠন গড়ার) জড়িয়ে
পড়লাম। ঝঞ্ঝাট হল, মারপিট … বেদম মার খেলাম,
আহত হলাম। শিক্ষক দাদারা সেই সংগঠনের নন, তাই সামনে ছিলেনও না। খবর পেলেন পরের দিন।
সবচে’ আগে ফোন করলেন, তাঁর বন্ধু ডাক্তারের ঠিকানা
দিয়ে, আসতে বললেন। নিজেই দেখিয়ে দিলেন ডাক্তারকে। এবং আশ্চর্য, একবারও প্রশ্ন করলেন
না, ‘কেন গিয়েছিলে’, ‘কী দরকার ছিল’ … বা (যা সত্যি) ‘ওরা সব লুম্পেন এলিমেন্ট’, ‘আরো সিরিয়াস হতে পারতো’ ! কিচ্ছু
না। এটাই তো পারস্পরিক সম্মানের ভাবনা। এটাও তো শিক্ষা!
এসবেরই মধ্যে সোভিয়েত সঙ্ঘ ভাঙল, পূর্ব ইয়োরোপে ধ্বস নামল, নতুন
অর্থনীতি, তার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হল। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুরাও সে সময়েই এক এক করে
দূরে চলে গেল। ওদিকে খবর পেলাম, শিক্ষক দাদাও নিজের সংগঠনে প্রধান কোনো পদে না থেকে
শুধু কোঅপারেটিভ সোসাইটিটা সামলাচ্ছেন। বিপজ্জনক জায়গা। টাকাপয়সার হেরফের। তিনি, তিনি
না হলে ভেবেই নিতাম বদলে গেছেন। হবি তো হ, ওই কোঅপারেটিভেই আমার এক স্নেহভাজন চাকরি
করতে শুরু করল। ওদের মাইনেপত্র বাড়ে না …। রোজ এসে
আমাকে হাজার রকম বলে ওখানকার আধিকারিক হিসেবে কার্যরত নেতাদের সম্পর্কে। ব্যাস, শিক্ষক
দাদার নাম এলেই থামিয়ে দিতাম, ওনার বিষয়ে বোলো না। হ্যাঁ, লড়াইয়ে তোমাদের দিকেই আছি,
তোমাদের তো মানুষ কে কেমন সে নিয়ে কাজ নেই। মাইনে বাড়া নিয়ে কথা। মাঝেমধ্যে শিক্ষক দাদার সঙ্গে দেখা হলে বোঝাতেন ওদের মাইনে বাড়ানোর
সমস্যা। তাঁকেও বলতাম একই কথা যে লড়াইয়ে আমি ওদের সাথেই থাকব। উনি বলতেন, সে তুমি থাকো।
থাকবেই তো। অন্যায় তো কিছু চাইছে না। তবে পাগলামি করছে, একগুঁয়েমি করছে।
নতুন সহস্রাব্দি এল। নব্বইয়ের পর থেকে এক এক করে সব কাছের বন্ধুরা
শহর ছেড়ে চলে যাওয়ায় এমন অবস্থা হল যে বাংলায় দুটো কথা বলার, সাহিত্যের বা রাজনীতির
বা সংগঠনের বা যেকোনো বিষয়ে কথা বলার কোনো বন্ধুই নেই বলতে গেলে। দু’একজন যাঁরা আছেন তাঁরা বয়সে সিনিয়র এবং একটু বেশি সিরিয়াস সব সময়।
এখন বুঝি যে এই মানসিক চাপেই আমি, অন্যান্য সংগঠনের কাজের যথেষ্ট চাপ থাকা সত্ত্বেও,
বাংলায় দুটো কথা বলার সামাজিক পরিসর পাওয়ার লোভে একটু বেশি করে বাঙালিদের সমিতির কাজে
অংশগ্রহণ করতে শুরু করলাম।
আর এখানেই আমার শিক্ষক দাদার সাথে কিছটা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ
হল। বিহার ঝাড়খন্ড আলাদা হয়ে গেছে। সমিতি তখন ভাগ্যক্রমে নতুন আর দৃঢ়গতি এক সভাপতি
পেয়েছে। ঝাড়খন্ড বেরিয়ে যাওয়ায় বিহারের বাঙালিরা যে সংখ্যাদৌর্বল্যে হতাশ হচ্ছে, আত্মপরিচয়ের
সঙ্কটে ভুগছে, বহু জায়গায় উপেক্ষা, বঞ্চনা এমনকি গুন্ডামির শিকার হচ্ছে তার বিরুদ্ধে
লড়াই গড়ার নেতৃত্ব হাতে নিয়েছেন সেই সভাপতি। আমার শিক্ষকদাদা তাঁর ছোটবেলার বন্ধু;
এক স্কুলে এক ক্লাসে সহপাঠি। তাই তাঁকে এ লড়াইয়ে টানতে তিনি সক্ষম হলেন। শিক্ষক দাদা
সঙ্গে করে আনলেন নিজের ট্রেড ইউনিয়ন আর বামপন্থী রাজনীতি করা সাংগঠনিক মেজাজ, প্রত্যেকটা
ধাপে হোমওয়ার্ক করে নেওয়ার পদ্ধতি আর কোঅপারেটিভের অভিজ্ঞতায় শেখা হিসেবিপনা।
কিন্তু কয়েক বছর মাত্র!
হঠাৎ একদিন তাঁর মাড়ির ব্যথা থেকে ক্যান্সার ধরা পড়ল। দ্রুত অবনতির
দিকে যেতে শুরু করল শরীর। হায়দ্রাবাদ, পাটনা, অপারেশন, আবার অপারেশন …
সমিতি-সম্পর্কিত কোনো একটা ফেসবুক পেজ হবে বোধহয়। এডমিন হিসেবে শিক্ষক
দাদারই নাম রেখেছিলাম। কারোর নাম যোগ করার ছিল মডারেটরে বা এডিটরে। রাত ন’টা নাগাদ ফোনে জিজ্ঞেস করলাম তাঁর আইডি আর পাসওয়ার্ড। ফোনটা উঠিয়েছিলেন
বৌদি। দাদা সঙ্গে সঙ্গে হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কী ব্যাপার। আমি জানতে চাইলে স্পষ্ট
কন্ঠস্বরে ধরে ধরে লিখিয়ে দিলেন।
পরের দিন জানতে পারলাম সে সময় ওনাকে গাড়িতে করে দ্রুত নিয়ে যাওয়া
হচ্ছিল অন্য হাসপাতালে আরেকটা অপারেশনের জন্য। তার ধকল নিতে পারেনি শরীর। মারা গেছেন।
শিক্ষক বটে। শেষ মুহূর্ত অব্দি সতেজ থেকে কিভাবে মরতে হয় তাও শিখিয়ে
দিয়ে গেলেন।
৩.১০.২২
৩.১০.২০২২
No comments:
Post a Comment