ফেব্রুয়ারির শেষ।
১৯৭৬ সাল। উঁচু উঁচু গাছের ফাঁকে, শীশমের স্বচ্ছ পাতার বুকে, শিমূলের আনন্দে দিশেহারা
পুষ্পিত শাখায় বিকেলের রোদ। শহরের সূর্যাস্ত কখন যে হয় বোঝাই যায় না। কেউ কি নদীতীরে
যায়? শহরের সীমান্তে দৌড়ে যায়? চোখের ওপর হাত রেখে তাকায় পশ্চিমে? কাজে ব্যস্ত শহর
সূর্যাস্তকেও ছুটির দিনের জন্য রেখে দেয়।
রাস্তা তৈরি হচ্ছে।
ঠিক বড় রাস্তা নয়, তবে পাড়ার প্রধান রাস্তাটা। যারা তৈরি করছে তাদের পায়ে জুতো নেই।
গরম আলকাতরা থেকে বাঁচবার জন্য শীতের দিনে পায়ে চট জড়িয়ে কাজ করে। এখন শীত পড়ে এসেছে।
তাই গরম আলকাতরা আর পাথরকুচির ঘন মিশ্রণ একটু ঠান্ডা করে পায়ের নিচে জুতোহীন সুকতলার
মত লাগিয়ে নিয়েছে। অথবা সইতে সইতে লেগে গেছে। সেটাই সারাদিন গরম তরল আলকাতরা থেকে পা’টাকে বাঁচায়। রাতে পরিষ্কার করার সময়? সাবধানে না ছাড়ালে পায়ের চামড়াও
খসিয়ে নেমে যাবে। বা হয়ত তেল লাগিয়ে ছাড়ায়। ঠিকেদার তেল দেয়? বা হয়ত ছাড়াবেই না। পরের
দিনও তো আবার একই ভাবে পাটাকে বাঁচাতে হবে! আবার চড়াতে হবে পায়ের তলায় নতুন পরত। আবর্জনা
আর পুরোনো কাগজকুড়ানিদের শুনেছি সন্ধ্যেবেলায় এক দলা করে গুড় দেওয়া হয় যাতে সারাদিন
ধরে গলায় জমা হওয়া বিষাক্ত ধুলো পেটে নেমে যায়।
মোড়ে দাঁড়িয়ে বড়
বড় বাড়িগুলোর পিছনে সূর্যটাকে নেমে যেতে দেখছি। পিছনে একটা ডাকবাক্স। পিওন শেষ ডাক
নেওয়ার জন্য সেটাকে খুলে বস্তায় ভরছে। শেষ ডাকে কার কার চিঠি নিয়ে গেল? একটা চিঠি দিয়ে
দিলে হত, দুলাইন পোস্টকার্ডে লিখে। পোস্টকার্ড দু’একটা ঝোলায় মজুত রাখি সব সময়। কিন্তু কাকে লিখব?
প্রতীক্ষায় ভেজা
চোখের মত সূর্য ডুবছে সকলের চোখের আড়ালে। রাস্তায় গাড়ি, রিকশা … এক দল ছেলে সাইকেলে চলে গেল। চকারম থেকে মজুররা কাজ করে ফিরছে।
একদল ছেলে দু’সারি বাড়ি ও গাছের মাঝের রাস্তা থেকে বেরিয়ে
দৌড়ে বেঁকে গেল। খেলছে। ওরা ধীরে ধীরে বড় হবে। ওদের যুবক করে এই শতাব্দী শেষ হবে। তখন
কি দেশে নতুন গঠনের শঙ্খ শোনা যাবে? অথবা যুদ্ধের ছায়ায় ক্লান্ত হবে? যারা রাস্তা তৈরি
করছে তারা কি সূর্যাস্ত দেখার সময় পাবে তখন?
ওই দুটো ছেলে। বড়
জন বার বছরের হবে। একটা পা ছোট। লাঠি নিয়ে চলছে। আরেকটা ছেলে ছ’সাত বছরের। কিম্বা তার চেয়ে ছোটই হবে। গরীবের ছেলেরা তাড়াতাড়ি বড়
হয়। দুজনের পরনেই এক একটা ছেঁড়া কালচিটে পাতলা কাপড়ের হাফপ্যান্ট আর এক একটা কোমরের
ওপর অব্দি জামা। খালি পা, খড়ি ওঠা চামড়া, সদ্য ন্যাড়া মাথায় চুল গজিয়েছে বলে টিকি দেখা
যাচ্ছে! চোখ ঘোলাটে। ওরাও একটা খেলা খেলছে।
ছোট ছেলেটার হাতে
একটা ছোট নারকোলের আঁচি। নারকোল এ প্রদেশে হয় না। তবে বাজারে আসে, পুজোয় লাগে, সমান
সমান খন্ডে কেটে টুকরো টুকরো নারকোল ডালায় সাজিয়ে ‘গড়ি, নারিয়ল’ বলে বিক্রি হয় খুব।
ওই ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকেই যোগাড় করেছে মনে হয়। রাস্তা দিয়ে যত গাড়ি, রিকশা, সাইকেল
যাচ্ছে ও আঁচিটাকে টিপ করে সেগুলোর সামনে ছুঁড়ে ফেলছে। কখনো কখনো চাকার নিচে আসছেই
না। কখনো কখনো চাকার পাশটায় লেগে ছিটকে শব্দ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। দুজনে হাত তুলে হো
হো করে হেসে উঠছে। আঁচিটা দৌড়ে কুড়িয়ে এনে দেখছে এক চিলতেও ভাঙে নি। এভাবে ওরা এগিয়ে
যাচ্ছে।
একটু জোরে হেঁটে
আমি ওদের সঙ্গে হয়ে গেলাম। চাকায় না লাগলে ছোটটা ধ্যাত্তেরি বলে চলে যাওয়া গাড়িটার
দিকে তাকিয়ে অনুকম্পার হাসি হাসছে। আর বড়টা বলছে, “তুই পারবি না, আমাকে দে এবার।” ছোটটা দেবে না কিছুতেই। ও জানে, বড়জন নিজের পায়ের ওপর ততটা শক্ত
নয় যতটা ও নিজে। তাই দ্বিগুণ উদ্যমে চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে সাহস বাড়ছে তার। এবার একটা
রিকশা দেখে, প্রায় বলতে গেলে চাকার নিচে হাত দিয়ে রেখে দিল। চিট শব্দ করে ছিটকে গেল
আঁচিটা। ছেলেটা হেসে দৌড়ে গিয়ে উঠিয়ে আনল। একটুখানি ভেঙে গেছে। “একটুখানি, ফুঃ” বলে আবার একটা সাইকেলের
সামনে ছুঁড়ে দিল। সাইকেল চালক যুবকটি ভড়কে, রেগে তাকাল ওদের দিকে। ওরা হেসে ফেলল।
এবার একটা গাড়ি আসছে।
ছোটটা তৈরি হল। গাড়িটা খুব কাছে চলে আসতে, একেবারে চাকার নিচে আঁচি ঠেলে কোনোরকমে সরে
এল। কট কট শব্দে ভেঙে গেল আঁচিটা। ড্রাইভার সাহেব দুটো গালাগাল দিল রেগে তাকিয়ে। ছেলেদুটোর
ভ্রুক্ষেপ নেই। গাড়িটা চলে যেতে দৌড়ে গিয়ে কুড়িয়ে আনল। টুকরো টুকরো হয়ে গেছে আঁচিটা।
দুজনে হাসতে হাসতে গুনল। সদ্য সদ্য শেখা ইংরেজিতে। ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর, ফাইভ, সিক্স,
সেভেন …। বড়টা গুনে থেমে গেল। ছোটটা শিখবার আনন্দে
সুর করে বলতে থাকল – এইট, নাইন, টেন, ইলেভেন, থার্টিন …
ভাবলাম আঁচিটা ভেঙে
গেছে বলে দমে যাবে। কিন্তু কোথায়? আঁচি ভাঙলে কী? ওরা ভাঙলে তবে তো? এখনো পনের মিনিট
খানেক বাকি আছে অন্ধকার নামতে। ওদের যৎসামান্য শৈশবের মহামূল্য ক্ষণ! দুদিন পরেই তো
কাজের ময়দানে নামতে হবে।
পকেট থেকে আরেকটা
আঁচি বার করল। সেটা একটা রিকশার চাপে একবারেই ভেঙে গেল। দমবার প্রশ্নই আসে না। আঁচি
আর নেই দেখে ইঁটের টুকরো তুলে নিল। ছোটটা মাথা ঘুরিয়ে পিছনে দেখল, একটা গাড়ি আসছে।
তৈরি হয়ে রইল।
যদিও মজাই লাগছিল।
আমরাও স্কুলে পড়ার সময় রেললাইনে গিয়ে পেরেক রেখে ট্রেন আসার অপেক্ষা করেছি। পরে ছুরি
পেয়ে অবাকও হয়েছি আনন্দও পেয়েছি। আমরাও লাইন্সম্যানের ধ্যাঁতানি খেয়ে পালিয়েছি। তবু,
বা সেই অধিকারেই বোধহয়, এবার ধমক দিলাম, “এ্যাই … কী হচ্ছে? ধাক্কা লাগবে না?” তখন বড়টাও আমাকে একবার দেখে ওকে ধমক দিল, “ধাক্কা লাগলে সাফ হয়ে যাবি একেবারে, হাওয়া হয়ে যাবি, চল চল, অন্ধকার
হয়ে পড়ছে!” ছেলেটা তবু নিজেকে রুখতে পারল না। ইঁটের টুকরোটা
ছুঁড়েই দিল গাড়ীর নিচে। তারপর হাত ঝাড়তে ঝাড়তে, লাফিয়ে লাফিয়ে দুজনে এগিয়ে গেল।
একটু দূর থেকে ওদের
গান শোনা যাচ্ছে। আমি বাড়িতে ঢুকলাম।
পাশের বাড়িতে শিশমের
একটা দীর্ঘ তির্যক গাছ জঙ্গল করছে বলে মুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। ওতে নতুন পাতা গজিয়েছে আবার।
রঙিন ফাল্গুনের হাওয়ায় ফর ফর করছে পাতাগুলো।
ইতিমধ্যে একটা পাখি
ওতে বাসাও বেঁধে নিয়েছে।
হুড় হুড় করে বাড়ে গাছগুলো। হাজার অযত্নেও তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে। আমার জানলার পাশের বোগেনভিলিয়ার লতাটা? কত বার ছেঁটেছি। ঠিক আবার একটা ডাল জানলা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাতে আবার ফুলও হয়!
২৮.২.১৯৭৬
No comments:
Post a Comment