ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন ১৮৪১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সংস্কৃত বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দিলেন তখন তিনি নিজের মাতৃভাষা বাংলা ছাড়া সংস্কৃত জানতেন। সে ভাষার বিদ্বানই ছিলেন, তাই তো একুশ বছর বয়সে বিভাগীয় প্রধান হলেন! কলেজের সেক্রেটারি জি. টি. মার্শাল তাঁর পান্ডিত্যে প্রভাবিত হয়ে তাঁকে ইংরেজি আর হিন্দিটাও শিখে নিতে বললেন। চট করে দুটোই শিখে নিলেন তিনি। সে সময় ফোর্ট উইলিয়ামে বাংলায় হিতোপদেশ পড়ানো হত। সে বইয়ের, বিদ্যাসাগর নিজেই বলছেন, “রচনা অতি কদর্য্য” [বেতালপঞ্চবিংশতির প্রথম সংস্করণের বিজ্ঞাপন]। হয়ত মার্শাল সাহেবও তাই ভাবতেন। হতে পারে বিদ্যাসাগর তাঁকে বলেছিলেন। কিন্তু দুজনেই একমত হলেন যে আরেকটি বই থাকা উচিৎ ছাত্রদের পড়ানোর জন্য। “তৎপরিবর্ত্তে পুস্তকান্তর প্রচলিত করা উচিৎ ও আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, উক্ত বিদ্যালয়ের মহামতি শ্রীযুত মেজর জি. টি. মার্শল মহোদয় কোনও নূতন পুস্তক প্রস্তুত করিতে আদেশ দেন।” [ওই] তখন বিদ্যাসাগর কী করেন? সদ্য শেখা হিন্দি ভাষায় লেখা বৈতালপচীসী নামের বইটা পড়ে, ১৮৪৭ সালে বাংলায় লেখেন বেতালপঞ্চবিংশতি – “তদনুসারে আমি, বৈতালপচীসী নামক প্রসিদ্ধ হিন্দী পুস্তক অবলম্বন করিয়া, এই গ্রন্থ লিখিয়াছিলাম।” [ওই] কেন “হিন্দী পুস্তক”? তার উত্তর দিয়েছেন তিনি ১৮৫২ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হিন্দী বৈতালপচীসীর ইংরেজি মুখবন্ধে : “The Original of these tales is to be found in the Katha Sarit Sagara, an ancient and voluminous Collection of Tales ans Legends in Sanskrit verse, by Somadeva Bhatta, under the title of Betalapanchavinshatika. There exists also under the same title, a Sanskrit prose version.
“In the reign of Muhammad Shaha, Surat Kabishwar, by order of Raja Jye Singh, translated the work from Sanskrit into Braj Bhakha. This version was translated, by direction of Dr. Gilchrist, in the time of Marquis Wellesley, into Hindoostanee by Muzhar Ali Khan, whose poetical name was Vila, aided by Lallu Lal Kab, the elegant writer of Premsagar, both Moonshees of the College of Fort William. This translation …… was printed in 1805 …… .
“A Bengalee version of this translation was made, by the Editor of the present edition, in the year 1947, by directions of Major G. T. Marshall …”
যদিও বইটার অনুবাদের ইতিহাসে পরবর্ত্তীকালে হিন্দীসাহিত্যের সুবিখ্যাত বিদ্বান রামবিলাস শর্মা নিজের ‘ভারতেন্দু যুগ’ বইটিতে একটি সংশোধন আনেন। উনি বলেন যে সুরাট কবিশ্বর নিজেই বইটা হিন্দীতে অনুবাদ করেছিলেন এবং তা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখান যে কথিত ভাবে লাল্লু লালের যে অনুবাদ, সেটা ওই অনুবাদেরই ফেরবদল। সে যাই হোক, ওটা প্রসঙ্গান্তর। মোদ্দা কথা হল, বেতালপঞ্চবিংশতি রচনা করার সময় তিনি হিন্দি বা হিন্দুস্তানি নিছক একটি ভাষা হিসেবেই জানতেন না, জানতেন জনতার সাহিত্যবোধের বিকাশের বাহক রূপে – যেমন বাংলা তেমনই হিন্দি। ভাষার ইতিহাস ভুগোল দুইই তাঁর গোচরে ছিল। তাই সংস্কৃত কথাসরিৎসাগর সামনে থাকা সত্ত্বেও ওই কলেজেরই শিক্ষক লাল্লু লালের হিন্দি বইটা তুলে নিলেন। এবং হিন্দি যে তিনি কতটা গভীরভাবে জানেন তার প্রমাণ দিলেন পাঁচ বছর পর, সেই হিন্দি বইটার নতুন সংস্করণের সম্পাদনা করে। এবং সে সম্পাদনায় তিনি হিন্দি বইটারও দুটো সংস্করণের তুলনামূলক অধ্যয়ন করলেন, “In bringing outh the edition now presented to the public, the Original text of 1805 and the Agra Edition of 1843, have been carefully collated.”
‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থে লেখক ইন্দ্রমিত্র একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন।
“একদিন একজন হিন্দুস্থানী পন্ডিত বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। হিন্দুস্থানী পন্ডিতজী সংস্কৃতে কথা বলতে লাগলেন। আর বিদ্যাসাগর সব কথার জবাব দিতে থাকলেন হিন্দীতে।
“ভুল সংস্কৃত বলছেন কিন্তু পন্ডিতজী। পাশেই বসে ছিলেন কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য। পন্ডিতজীর সঙ্গে কথা কইতে-কইতে একফাঁকে বিদ্যাসাগর কৃষ্ণকমলকে বললেন – এদিকে কথায়-কথায় কোষ্ঠশুদ্ধি হচ্ছে, তবুও হিন্দী বলা হবে না।” [করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ – ৩৮২; প্রমাণপঞ্জীতে সূত্র দেওয়া আছে – বিপিনবিহারী গুপ্ত, পুরাতন প্রসঙ্গ, প্রথম পর্যায়, (কলকাতা, ১৩২০), পৃ ৪৯]
ভারতেন্দু হরিশচন্দ্রকে আধুনিক হিন্দী সাহিত্যের পিতামহ বলা হয়। তিনি কলকাতায় আসতেন, এবং সেসময়কার কলকাতার অনেক নবজাগরণী ব্যক্তিত্বের সাথেই তাঁর সম্পর্ক ছিল। সুবল চন্দ্র মিত্র বিদ্যাসাগরের যে ইংরেজী জীবনী লিখেছেন তার অধ্যায় ৩১শে এশিয়াটিক সোসাইটির ঘটনাটার বর্ণনা রয়েছে – কিভাবে চটিজুতো পরে থাকার জন্য বিদ্যাসাগরকে ঢুকতে দেওয়া হয় নি। পরে ক্ষমা-টমা চাওয়া, বিদ্যাসাগরের সেই এশিয়াটিক সোসাইটিরই তত্ত্বাবধানে গ্রন্থসম্পাদনা ভার নিতে রাজি হওয়া সেসব অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে ছিলেন ভারতেন্দু হরিশচন্দ্র। তরুণ হরিশচন্দ্র কলকাতায় এলেই সব নতুন চিন্তাভাবনা করা মানুষদের সান্নিধ্য পেতে চাইতেন। বিদ্যাসাগরের সান্নিধ্য বিশেষভাবে চাইতেন। আর উনিশ শতকের সত্তরের দশকে বিদ্যাসাগরও বার বার বেনারস যাচ্ছিলেন বাবাকে দেখতে এবং আনুসঙ্গিক নানা কাজকর্ম সারতে। তখনও ভারতেন্দুর সাথে দেখা হত। ভারতেন্দুর পিতার বড় সংগ্রহ ছিল সংস্কৃত পূঁথির। সেসব ঘেঁটে দেখার এবং প্রয়োজনে ব্যবহার করার অবাধ অধিকার ছিল বিদ্যাসাগরের। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে বিদ্যাসাগরের ভূমিকার কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতবর্ষে। হরিশচন্দ্র যখন আমির খুসরু প্রবর্তিত একটি বিশেষ ছন্দ ও বয়ানের রীতি প্রয়োগ করে নতুন কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন তখন লিখলেন –
“সুন্দর বাণী কহি সমুঝাবৈ।
বিধবাগন সোঁ নেহ বঢ়াবৈ।
দয়ানিধান পরম গুণ-আগর।
সখি সজ্জন, নহিঁ বিদ্যাসাগর।।”
এ প্রসঙ্গের অবতারণা এজন্য করলাম না যে বিদ্যাসাগর হরিশ্চন্দ্রের সাথে হিন্দীতে কথা বলতেন। না, তার প্রয়োজন একেবারেই হত না হয়ত কেন না হরিশচন্দ্র খুবই ভালো বাংলা জানতেন।
কিন্তু বিদ্যাসাগরের হিন্দী জ্ঞানের প্রয়োজন যে হরিশচন্দ্রের পড়ত তার একটা প্রমাণ আছে অন্য জায়গায়। হরিশ্চন্দ্র সারা জীবনে অনেক পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করেন। একটি পত্রিকার নাম ছিল ‘হরিশ্চন্দ্র ম্যাগাজিন’ যেটির নাম ১৮৭৪এর জুন মাস থেকে হয় ‘হরিশ্চন্দ্র চন্দ্রিকা’। বাবু শিবনন্দন সহায় রচিত এবং উত্তরপ্রদেশ সরকারের অধীন হিন্দী সমিতি কর্তৃক ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত (১৯০৫ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের পুনঃপ্রকাশ) ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্রের একটি জীবনী লিখছে যে ‘হরিশ্চন্দ্র চন্দ্রিকা’র “সহায়ক সম্পাদক (contributors) ছিলেন শ্রী বাবু ঐশ্বর্যনারায়ণ সিং, শ্রী পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর …” এবং অন্যান্যরা।
শেষমেশ।
আজকাল হিন্দী-আধিপত্যবাদীদের আক্রমণে নাজেহাল অনেককেই বলতে দেখি যে আমরা দেবনাগরী লিপিতে সংস্কৃত কেন লিখব (বা ‘কেন সইব’)। আগে তো বাংলা লিপিতে সংস্কৃত লেখার পরম্পরা ছিল। একশোবার লিখুন। তবে বিদ্যাসাগর যে দেবনাগরীতে লিপিতে সংস্কৃত দিব্যি শুধু পড়তেনই না, ভাবধারাগত লড়াইয়ের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তার প্রয়োজনটাও ভালো মত বুঝতেন তার প্রমাণ আমরা পাই যখন মাধবাচার্য বিরচিত’সর্বদর্শনসংগ্রহ’ সম্পাদনার কাজ হাতে নেন। উনি বুঝছিলেন বইটার প্রয়োজনীয়তা। ভারতীয় দর্শন নিয়ে তখন অব্দি আবিষ্কৃত প্রথম আকর-গ্রন্থ। বিদ্যাসাগরের সম্পাদনায় প্রকাশিত হওয়ার পর যে গ্রন্থ পড়ে সব ক’জন ভারতবিদ চার্বাক দর্শনের একটা ঝলক দেখতে পেয়েছেন এবং সবিস্ময়ে পেয়েছেন যে যে ভারতের ভাববাদ নিয়ে এত সাতকাহন, তার ষড়দর্শনের সাড়েতিনখানাই তো নিরীশ্বরবাদী। আর চার্বাকের তো কথাই নেই। সবার চক্ষুশূল, (হয়ত সত্যিই পুড়িয়ে মারা হয়েছিল) চাঁচাছোলা বস্তুবাদী!
মুখবন্ধে লিখছেন, কলকাতায় পাওয়া দুটো পূঁথিতে বড় বেশি রকমের প্রভেদ দেখতে পেয়ে বেনারস চলে গেলেন। সেখানে পাওয়া পূঁথিটা মনঃপূত হল। কোত্থেকে উদ্ধার করলেন লেখেন নি – বেনারসের সংস্কৃত কলেজ থেকে, ভারতেন্দুর বাবার সংগ্রহ থেকে না অন্য কোনো পন্ডিতের কাছ থেকে। কিন্তু সম্পাদিত সংস্করণ তৈরি করলেন দেবনাগরী লিপিতে – জানতেন বলে শুধু নয়, একটি বহুল-প্রচারিত লিপিতে ভারতের পরবর্তী প্রজন্মের হাতে ভাবধারাগত যুদ্ধের অস্ত্র যোগানোর ছিল।
৩১.১০.২২
No comments:
Post a Comment