Sunday, November 29, 2020

ঘুষি

দুহাজার পাঁচের দিল্লিতে
যুবমিছিল আটকানো ব্যারিকেডের মাথায় চড়ে নাচা সেই
সাধুর কথা মনে আছে সাথী?
শীর্ণকায়, দীর্ঘশশ্রুমন্ডিত, কাষায় বস্ত্র পরিহিত ...
জলকামানের মুখে দাঁড়িয়ে বলছিল,
দেশ ছেড়ে নাকি চলে যাবে!
 
পারল না।
যা সব দেশ ছাড়িয়েদের রকমসকম!
আবার সাধুদের রকম দেখে
সাধুত্বও ছেড়ে দিল।
 
আজকাল পাজামা-কামিজে পালোয়ান!
শুনেছি এই পনেরো বছরে আরো যোয়ান হতে
আস্ত গিলে খেয়েছে একটা কাস্তে আর একটা হাতুড়ি...
 
কাল দেখলাম ওকে!
কী তাকত গায়ে!
এক ঘুষিতে ব্যারিকেড সরিয়ে
হাইওয়ে কাঁপিয়ে জারি রাখল মার্চ

-      ঘুষিতে?
-      হ্যাঁ, ঘুষিতে।
কাছে গিয়ে আঙুলগুলো দেখতে চাইতে মেলে ধরল।
দেখি তেলোয় এক চুটকি মাটি।
কোন দেশের, তা নিশ্চয়ই বলতে হবে না!  

ব্যাঙ্গালোর
২৭.১১.২০




ঢিঠ

বিহার কঠিন ঠাঁই, সাহেব, কারোর ছাড়ান নেই।
রাজা হয়েছেন, হন, ভীড়ে কাপড় তো ছিঁড়বেই।

আছে সবই, যেগুলো চান
বড়োলোকামি, জাতের ভড়ং, ধর্মজিগির সব!
বলতে, জখম না দিয়ে কোনো, যায় না উৎসব।
তবু কিছু আছে হাওয়ায়, চেতনালীন নোনায়,
মহান হওয়ার শখ নেই তাও, প্রশ্ন ঠিক ওঠায়।

এখনো ঘাসে জ্বলছে ছাত, ভাঙা চুলোর ইঁট,
মাফিয়ারাজের গুলি, পুলিস, ভাঙতে পারেনি জিদ
সকাল থেকেই ক্ষোভে, কান্নায় নাস্তানাবুদ ব্লক,
মারবে মারো, দেখিয়ে ছাড়ব রক্ষকই ভক্ষক।

তাই বলছি, যতই ছাড়ুন বুড়ো তক্ষক-হাসি,
আঁতের পচন এমন খুলব, থামবে না আর কাশি।
(আসলে) সিংহদুয়ার পূবের;  
তরাই থেকে সাগর অব্দি প্রাচীন রোল সাহেব!
বুঝবেন না, পাথর নেই, জলে ক্ষয়ের লেপ।

ধরণখানা সাবেক কাদায় কাঁকড়ার চিটপিট; 
গণতন্ত্রের জন্মভূমি, প্রশ্নে সদাই ঢিঠ।    

ব্যাঙ্গালোর
২৫.১১.২০




এখানেই আছি

এই আমি এখানেই আছি;
একচুলও নড়ব না, বিশ্বাস রেখ।
এখানে আকাশ খুব ছোটো,
রোদ শুধু ঘন্টা দুয়েক, তবু দেখ,

বিপর্যস্ত হব কত?
রোজকারে পিঠটা যে ঠেকল দেয়ালে!
এক পা যুঝতে আমি এক,
রাস্তায় হব এক কোটি, হড়তালে।

ক্ষতি কেউ চাই না আমরা,
ক্ষতি হল মুনাফাখাদকদের নখে।
রুজির জোয়ালে জুতি কাঁধ
মরি ক্ষোভে, গড়ি দেশ, খায় তঞ্চকে।

শ্রমিক কৃষক তো সৈন্য!
মেহনতে দেশের সমূহ উন্নতি!
অথচ যা চালাচ্ছে ওরা,
আমাদের যত, দেশটারও বরবাদী!

ধর্মের ঘটটাই রাখি,
সাহেবেরা! তোমাদের তন্ত্রের মাঝে।
সংহতির গর্ভজল
দালালের পাগুলো পোড়াবে সমাজে।

বেরিয়েছি মিছিল ধরতে,
সকালের আলো নিখাদ ম্যানিফেস্টো!
সারাদিনে হড়তালি আমি,
যাই করি, নিঃশ্বাসে ফেরাই দেশ তো! 

ব্যাঙ্গালোর
২৪.১১.২০




দিদারগঞ্জের যক্ষী

ছবি তোর সহজ আজ,
আভাসি রূপকথা
              মুঠোফোনেই ঘোরে!
সেখান থেকেই তোকে নিয়ে
দুপুরে পৌঁছোই,
দীর্ঘ এক অশ্বত্থের
                      পাতার মর্মরে।
 
কেমন আছিস, ভালো?
তোকে প্রথম দেখার সময়
জানতামও না আগে
জানতে হত নিগড় তোর,
ঘাঁটতে হত সভ্যতার
                ব্যথার জল, কালো।  
 
জল অর্থে ছিল তো ঐ
আশৈশব ডোবা,
যাওয়াআসায় ভরা;
তারই চোখে আকাশ হত
               মর্ত্য সসাগরা!
জাদুঘরে অবাক দেখে 
উদ্ধত স্তন, ঘেমো চিবুক,
            অনির্দ্দিষ্ট চোখ,
ভাবি নি তোর নগ্নতা এক রোখ,
শাণিত ঐ দ্যুতি গোপন পথ,
ধুলো যার গোন্ডোয়ানা,
                  হড়প্পা, মগধ।  
 
কুহক ছিল গর্বিত তোর মুখ;
মায় যেন করলি তোর
শাপিত শুশুক
                নেমেছি সন্ধে,
সিন্ধু-মোহানায়, অনেক
                 দক্ষ দাঁড়ের গন্ধে ...
 
আজও সে সন্ধে আছে বুকে
ইচ্ছে হয় সাথে বসে
দুহাজার বছর, 
              কথা বলি সুখে!
 
পুনর্লিখন, ব্যাঙ্গালোর
২২.১১.২০
   
পুনর্লিখন, ব্যাঙ্গালোর
২২.১১.২০




কার্বাইডের আলো

সকালবেলা দুধ আনতাম।
বিসমিল্লার সানাই সেদিন
দূর থেকে পাঠাল এক
হৃদয়ভাঙা ডাক
দৌড়ে পাথর, ঝোপ ডিঙিয়ে
শুনতে গেলাম প্রণয়িনীর
অগুরু চন্দনের চিতায়
দহনের সংরাগ।
রেললাইনের দেয়ালখানা
ভাঙা ছিল, তাই তো!

সরকার মেনেও ছিল
দেয়ালের ফাটলটাকে
বাঁধাই খিড়কি করে দিল;
তখন আমরা পাড়ায় নেই।
বার বার কেউ না কেউ
ভেঙে দিতাম তাই তো?

রেললাইনে পেরেক রেখে
ছুরি পাওয়ার খেলায় রেলের
চাকার সাথে দোস্তি হল
বেহায়ার জঙ্গলে
পাহারার পুলিশগুলো
থই পেত না, তাই তো!

আমাদের বড় হওয়ার
মধ্যেই জড়িয়ে গেল
বেআইন, বেলাইন,
দেয়াল ভাঙার ফের।
জেলের নয়, নিঃশ্বাসের
নেশার পথের।

আভাসি ঝলমলে,
ডালায় বাদাম, নুন  
কার্বাইডের বাতি নিয়ে
ঢুকছি বাদামওলা।
বাদাম বেচা ছার!
কার্বাইডের আলোয়,
বাবার মুখে শোনা সেই
ঢাকার রমনার
পাটনায় পৌঁছোনোই
তুন করে বলা।
 
ব্যাঙ্গালোর
২১.১১.২০




অমিল

মিলে নয় অমিলেই সেজে ওঠে গান।
অমিল বাড়ায় তানে স্বরের বিতান।
মিল লাগে রণে, ভালোবাসায় অমিল।
কী বল? আকাশ? এক? অনিশেষ নীল?
ওখানে তো মেঘ! দেখ আছে কালো করে!
এখানে শুভ্র দেখ, হাসে আলো করে

সাদার মাঝের গাঢ় নীল দেবে কালো?
সূর্য এক? নাঃ, কিভাবে তা বল?
ঘড়ি দেখো গোধূলিতে, কখন কে যায়!
আর এই রোদগুলো ভিন্ন ব্যথায়
ধরে ফেরিওলাদের ডাক আর ছাতে
পায়রা। পৃথিবীগুলো দূরে হয় রাতে।

সবার নিজের চাঁদ, নদীদের টানে।
গলির মাতাল ওড়ে নিজ ভাষাযানে।
বিজ্ঞান? তার চাই বল্গার রাশ।
আমার তো চাই ওর চামড়ার ডাঁশ।

 

ব্যাঙ্গালোর

১৯/২০.১১.২০

 

 

 

 


 

 

ঘরামি

ঝান্ডা হাতে হলেও
লড়াই শুধু ঝান্ডা বা তার
রঙ নিয়ে তো নয়।
বেলায় সামনাসামনি হয়
নিজেরই দুই হুঁশ
কী হব আমরা?
নিজের ঘরটা ভালো মত
ছাওয়ার ঘরামি, না
গুন্ডাদলের দখলদারির
তরজায় আর লুটতরাজে
নিজেরি ঘরে
আগুন হওয়া তুষ?
 
ঘর ছাইতে এক হওয়াই
ঘরামির ইয়ারি।  
রঙে কি দেখাব রংদারি?
না ছাওয়া ঘরটা বরং হোক
সবার হুঁশিয়ারি।
 
সবসময় যে
বলি, দেখ রুশ!
সেও ভেবেছিল
জোঁকতন্ত্রের
তোপের গোলা হবে?
সহায়হীন,
ক্ষুধার জীব নাকি,
শান্তি, রুটি, জমির
ডিক্রি করা মানুষ। 

ব্যাঙ্গালোর
১৫.১১.২০




Thursday, November 12, 2020

রেলগেট

 বেলা একটু বাড়তে এত উত্তপ্ত নির্জন হত রেলগেট যেন ছায়াও শুষে নেবে পরোপকারীর। অদূরে গাছ ভরে নীল হত আম ... একটা ট্রেনের অপেক্ষায় কত মুহূর্তকাল লোহার ওপর লোহা ঘষ্টানোর, জোড়গুলো লচকে ওঠার, গতির ধূসর আচ্ছন্নতায় থাকার, কিছুক্ষণ। বেলা একটু বাড়তে এরকমই এক রেলগেটের ঘরে প্রথম শৈশবের যৌন বিকৃতবিষ্ময়। এত সামান্য সমতল জমাট, সিমেন্টে ইস্পাতে এত দূরত্ব, এত প্রহার, মনে হত ডেকে উঠত তুষার পোস্টমর্টেমের পর চিতায়, সেলাই করা বুক ...

যেকটা ব্যস্ত রেলগেট সব উড়ালপথ হয়ে যাচ্ছে। এখন ক্রসিং পেরিয়ে ডানদিকে সার-বীজের

দোকানটার সামনে আর বলবনা দেখা করতে কাউকে। এলে, দোকানের পাশ দিয়ে তাকে নিয়ে পিছনে প্রায় অদৃশ্য মাংসভাতের চালাটায় তা সে ঝাল হোক না যতই মনে রাখার

যাব না। কার পোষাবে টাউন হলে পৌঁছোতে, পুল পেরিয়ে ঘুরে গিয়ে খাওয়ার অত হ্যাপা; সময় কম, সভা শুরুও করতে হবে তাড়াতাড়ি শেষও করতে হবে চারটে চল্লিশের আগে।

ঘুরেফিরে তবুও যাই একা একা। নিচের ঢাকা পড়া বাজারপথে লেবু, কচু, পানবাহার ছুঁয়ে অথবা ওপর দিয়ে গিয়ে সিঁড়ির কাছে অটো ছাড়ি। বা হেঁটেও পৌঁছে, দেখতে দেখতে নামি।

রেলের তোলা দেয়াল, লোহার রেলিংএর এদিক ওদিক সন্ধান করি কোথাও কেউ গড়েছে কিনা ধাপ, ভেঙেছে কিনা ইঁট, বেঁকিয়েছে কিনা পাত, কারো পাঁচিল বেয়ে হয়েছে কিনা রাস্তা। টপকে গিয়ে দাঁড়াই লাইনগুলোর মাঝখানে ... একা নই, আরো অনেক থাকে আশেপাশে আমারই মত ছিটেল। বেআইনে থাকে ঝুড়ি পেতে খুচরো বাজার, ট্রেন আসার বা পুলিশের তাড়া খাওয়া অব্দি এভাবেই বাঁচা অভ্যাস হয়ে গেছে আমাদের।  




Wednesday, November 11, 2020

ব্রেখ্‌ট

খেলা দিয়েই খেলা ভেঙে
ভাঙছে দেখ ভাঙার ভয়
খোশগল্পের চায়ের কাপে
ফাটল ধরায় দুঃসময়।

কাটা কাটা বেবাক ছবির
স্পন্দে বাঁধা তিন দেয়াল
ভাবুক সোনার উদাস গালে
পাঞ্জা বোলায় খ্যাঁকশেয়াল।

পাড়ার গেঁতো বেকার ছেলে
সরাইখানা মাত করে,
রাত দুপুরে শিষ বাজিয়ে
ইতিহাসের ভূল ধরে।

আমলা-শামলা-পেটমোটাদের
মানুষ চোষার আইনি প্যাঁচ,
ভুরূ কুঁচকে শোনে বাড়ছে
শহরতলীর গানের আঁচ।

দর্শক আর কুশীলবের
মেলায় বেচে খেলার সাজ,
দুখিনী মা সুদূর পানে
চেয়ে হাঁকে, পক্ষীরাজ!

সবাই বলে, পক্ষীরাজ?
তাহলে তার ডানা কই?
বলতে পাঁখের ব্যথায় ধীর
সমুদ্রটি জাগে অথৈ!

১১.২.১৯৯৭




ভিখনাপাহাড়ি

কখনো হয়নি, ভিখনাপাহাড়ি ভিক্ষে দেয়নি ভালো।
পাহাড় পেরোতে হয়নি, শাক্যপুত্র দিয়েছে আলো।

পাঁচমাথার এই মোড় থেকে যায় পাঁচ দিকে রাস্তা,
কোথাও না গেলে পাঁচ সমাজের পাঁতে খাও নাস্তা
মোড়ের পুরোনো ঢাকা সুইট্‌সের সিঙাড়া চায়ের ভুখ,
বাঙালি, কোইরি, মিয়াঁ, রাজপুত, কুর্মি সবার সুখ। 

তেমন মাতালও দিন ছিল, চাঁইটোলায় গাইত রাণা,
রাতে লালবাগে দেয়াল লিখতে কারোর শুনিনি মানা।
পোস্টারে খুঁড়ে উঠিয়ে দেশের হৃদয় ছড়ানো মণি
সামনের ভাঙা পাঁচিলে সাজিয়েছিলাম প্রদর্শনী।

পূবে ভাটি, হাট, পুরোনো শহর, দক্ষিণে রেলপথ,
নদী উত্তরে, নতুন শহর পশ্চিমে বাঁধা গৎ
ভাঙল হঠাৎ, লড়াই সামনে দেখল দিন কঠিন,
টাকা, জাত, আর ধর্মভাগাড়ে চেনা মুখ হল অচিন!

আমায় তো আরো বহু কিছুতেই জড়িয়েছে এ হদিশ!
বাংলায় দিয়ে বন্ধুত্বের বিহারিয়ানার শিষ,
ভালোবেসেছি, নীড় বেঁধেছি, কাঁধে সন্তান নিয়ে,
উঠেছি অমৃতে, কুটিল আঁধারে নিজের বিষ ছাপিয়ে।

টোটো ছেড়ে ঢুকি সন্ধ্যায় সেই খাপরা-চালের ঘরে,
পাঁচ সমাজের মৌতাতে পাই জোর কন্ঠস্বরে। 

ব্যাঙ্গালোর
৭.১১.২০




Wednesday, November 4, 2020

কনক

তুমি আজ সকাল থেকে হাসছ।
শাড়ি ছেড়ে
ছোটো বোনের সালোয়ার-কামিজখানা পরে
ফল্‌স লাগিয়ে লম্বা বেণী ঝুলিয়েছ।
মেয়েকে ঘুম থেকে তুললে,
ফুল তুলতে বেরুলে
আজ বৃহস্পতিবার,
পুজো-আচ্চা নিয়ে আমাদের
সাপ্তাহিক ঝগড়ার দিন।
 
আমিও বেরুলাম, পিছন পিছন।
মাঠ পেরিয়ে কোথায় যে চলেছ আজ!
ভাঙা, জনশূন্য বাড়িটার ভিতর নিঝুম বাগানে
তাও মেয়েকে নিয়ে,
আমি না থাকলে তোমার সাহস হত না!
 
মানুষ নেই তবু জল রয়েছে কলে।
ওতেই ধুয়ে নিলাম চোখমুখ।
তোমায় পেড়ে দিলাম টগর, করবী;
বললামঃ
কনকগুলো মাটি থেকেই তোলো,
গাছের নিচ অপবিত্র হয় না বোকা!
শিউলি তোলোনি কখনো?
 
বেরিয়ে
বেলগাছের সামনে এসে বললেঃ
কেউ না দেখলে নিজেই চড়ে যেতাম।
 
হুঁঃ, পাগল! কাঁটাগাছে চড়বেন!
আমি ও মেয়ে অবাক হয়ে দেখছি তোমার
এত সহজে নিজেকে ও সবাইকে
ফিরে পাওয়ার ক্ষমতা।
কে বলবে, নিছক আমারই দোষে
কি কষ্টে কাল রাত কেটেছিল তোমার!
 
একটু পরেই
স্কুল-কলেজ-অফিসের তাড়ায়
তালগোল পাকিয়ে যাবে সময়;
মে মাসের বেলা,
সকালেই চড়চড়িয়ে আগুন হয়ে উঠছে।

১৬.৫.১৯৯৬



Tuesday, November 3, 2020

প্রান্তিকের সেই স্টেশন মাস্টার

তখন খোয়াই অন্য রকম ছিল। কোপাইও তো অন্য রকম ছিল। প্রান্তিকে বাড়িঘর, অন্ততঃ স্টেশনটার আধমাইলের মধ্যে হয়নি। মানে, শান্তিনিকেতনও অন্যরকম আর আমার তো কথাই নেই। মাথায় শান্তিনিকেতনের স্ট্যাটাসটা এ্যাই গরু, সর না থেকে একটু এগিয়েছে জাস্ট।

সদ্য ঘুরে এসেছি বিদিশা। বনলতা সেনের সাথে কোনো সম্পর্ক টের পাইনি। তবে ওই উদয়গিরি না কি নাম ছিল শিল্পিত গুহা দেখে ফেরার পথে দাঁড়িয়ে পড়েছি চাকার মেলায়! হ্যাঁ, চাকারই মেলা বটে, বিভিন্ন ধরণের চাকা মাঠ ভর্তি সাজানো!... হঠাৎ বুড়োটে দেখতে একটা লোক পথ আটকাল। কোথা থেকে আসছেন? পুলিশি জেরার মত। কোথায় উঠেছেন? দুটোই বললাম। কেন এসেছেন?

ঘুরতেই বলেছিলাম, বিদিশার নিশা দেখতে বা বনলতা সেনের সাথে সম্পর্ক খুঁজতে বলিনি। কঠোর আদেশ পেলাম, বারো ঘন্টার মধ্যে বিদিশা ছেড়ে দেবেন। ট্রেন থাকবে তবে তো! পেয়ে যাবেন। যাঃ স্‌সালা। এখানেও নকশাল আছে নাকি? দাড়িওলা বাঙালি যুবককে এছাড়া আর কিছু তো ভাবতে পারে না এখানকার পুলিশ!

উনিশশো ছিয়াত্তর ছিল সালটা। এক বছরও হয়নি পাটনা ফিরেছি। পঁচাত্তরের বন্যা পুহিয়ে একটু ঘুরছি এদিক ওদিক, কাছে, দূরে, একটু নিসর্গ, একটু ইতিহাস দেখছি ...কবিতার মুখ খুঁজছি নতুন বন্ধুদের সাথে কথোপথনে, তাই মনে হল, কেউ যদি বরোব্বর চেটে নেয়? ওমা!, শান্তিনিকেতন যাওনি?

সত্যি বলতে, বিদিশার নিশায় যেমন বনলতা সেনকে পাইনি, হোটেলের পাশের ঘর থেকে জুয়ার হাল্লা আর মদের গন্ধ পেয়েছিলাম, শান্তিনিকেতনেও রবিঠাকুরকে ঠিক সেভাবে পাইনি। ব্যস, বসের বাড়ি, ঘোরার চান্স পেয়েছি ঘুরে নিই, এই ছিল মনের ভাব।

বসেও ছিলাম অনেকক্ষণ ওই মাটির বাড়িটার ভিতর (কি যেন নাম?) কিন্তু পেটের ভিতরে কিছু নেইই তো জাগবে কী? গোনাগুনতি শোনা-পড়া চার পাঁচটা গান আর কবিতা। আর বিশেষ ফিলিংও জাগত না সেসব শুনে। শুধু মার কন্ঠস্বরটা রান্নাঘর থেকে শুনতে পেতাম, ভালো লাগত। অবশ্য ফিলিং একেবারেই কখনো জাগেনি বললে ভুল হবে। ছোটোবেলায় রান্নাঘরে বসে মা যখন শোনাত, আমি বনেই যাব চলে হাতপাখার ডাঁটির বাড়ি খাওয়ার মত ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে নয় হাপুস নয়নে কাঁদতাম।

 

বোলপুরে নেমেছিলাম সন্ধ্যেবেলায়। সকালে উঠেই মনে হল, এখানকার লোকেরা বেশ সচেতন যে এটা ট্যুরিস্টদের জায়গা, তাদের ভালো লাগাতে হবে পরিবেশটা। তবেই রুজি জুটবে। নইলে সকালে, চা দেবে কিনা জিজ্ঞেস করার জন্য ছেলেটি এত মিষ্টি বাঁশির সুরে ঘুম ভাঙাত না। আর সে শুধু আমার ঘরে নয়, সব ঘরের জানলার কাছে গিয়ে। এত পরিচিত সুর! প্রচলিত সুর, তবে আমি শুনেছিলাম বাবার গলায়, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে গানটির সাথে। নাঃ, মনটা সিরিয়াসলি ভালো করে দিল ছেলেটি।

তৈরি হয়ে খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বোধহয় ছুটি ছিল সে সময়। মার্চ-এপ্রিলে কিসের ছুটি? নাকি রবিবার ছিল হয়ত। যত লোক সব বেড়াতেই এসেছে। রবিঠাকুরের দেখা তো কোত্থাও পেলাম না। তবে আরেকজনের দেখা পেলাম রামকিঙ্কর!

ইদানিং তো গিয়ে দেখেছি সব ঘেরাটোপে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখন খোলা ছিল। সুজাতাকে পেয়েছিলাম বনপথে। মাঠে পেয়েছিলাম সাঁওতাল দম্পতিকে। আর কলের বাঁশি। ওফ্‌, হাত দিয়ে, পিঠ দিয়ে, মাথার পিছনটা চেপে চেপে নিয়েছিলাম কংক্রিট হয়ে থাকা ওই পাথরকুচিগুলোর ছোঁওয়া, বা বলব খোঁচা। হ্যাঁ, রামকিঙ্করকে পাওয়ার মত করে পেয়েছিলাম। আটত্রিশ বছর পরে যখন পড়ছি দেখি নাই ফিরে, তখন ওই খোঁচাগুলো কাজে লেগেছিল।

 

বললাম না, খোয়াই অন্যরকম ছিল! আজকের মত সাজানো গোছানো ছিল না, সামাজিক বনসৃজনের দীর্ঘ শালগাছের সারি ছিল না, ছিল না ভিডিও শুটিংএর জন্য তৈরি বসে থাকা এথনিক, এক্সকুইসাইট ঝোলামালা সুদ্ধু বাউলেররা। বন্য উজাড় ছিল লাল মাটির, মাঝে মাঝে গভীর খাতগুলো নিয়ে যেন কারো একাকীত্বের ক্ষতের মত। যেই নামবে পুরো প্রান্তরটা তার একাকীত্ব হয়ে যাবে। আমারও হয়ে গেল। জামাপ্যান্ট খুলে অনেকক্ষণ মার্চের রোদ্দুর পোহালাম ওই গভীর খাতে শুয়ে। বা, নিজের একাকীত্বের গভীরে শুয়ে। বুড়োটা, মানে রবিবস্‌ হাসছিলেন কিনা জানি না।

তারপর হাঁটতে হাঁটতে কোপাইয়ের ধারে পৌঁছোলাম।

পরে সে কোপাইকে আর খুঁজেই পাইনি।

 

নদী দেখলেই নেমে চান করার একটা লোভ জাগে আমার, কিন্তু জুতো পরে ছিলাম বলে আর সেটা করলাম না। জেলেদের মাছ ধরা আর ধোপাদের কাপড় কাচা দেখতে দেখতে আস্তে আস্তে এগোতে শুরু করলাম। আসলে খিদে পেয়েছিল। তাই ডানদিকে, দূরে একটা ট্রেনের পথ অনুসরণ করে দেখলাম স্টেশন দেখা যাচ্ছে, ওদিকেই রওনা দিলাম।

কী স্টেশন! কিচ্ছু নেই। চায়ের দোকানও নেই। খালি বেঞ্চ দেখে শুয়ে পড়লাম।

 

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ একটা গানের সুর শুনে চোখ তুলে তাকালাম। স্টেশন মাস্টারই হবেন, গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ব্লেড দিয়ে একটা পেন্সিল ছুলতে ছুলতে। আর মুখে একটা গান। কী সুন্দর গলা ভদ্রলোকের! আর কী গান এটা? গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল যেন। তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়...!

-----

অনেক পরে জেনেছিলাম ওটা নজরুলের গান।

বুড়ো! নিজে দেখা দিল না অথচ নজরুলের হাত ধরিয়ে দিয়ে গেল সেদিন!

সিলভার

মাসটা ছিল জুলাই। কিন্তু বৃষ্টি ছিল না। আর না থাকলে যা হয়, আবহাওয়া ভ্যাপসা আর গরম রুমালটা ভিজতে মুখ পোছার দরকার হয় না, জাংএর ঘামে পকেটে এমনিই ভিজে যায়। আর সেই আবহাওয়ায় পাঁচ ফুট লম্বা লাল ঝান্ডার ওপর...। সেও আবার অর্জুনবাবু বললেন, সাদা রঙ চড়াবেন না, শুকোতে আরো দেরি হবে। সিলভার চড়ান্‌। সেই সিলভারের কাস্তে-হাতুড়ি, পাঁচ ফুট বাই তিন ফুট শালুতে ছড়িয়ে। স্কুটারের পিছনে বসে কখনো মাথায় সেঁটে যাচ্ছে, কখনো মুখে সেঁটে যাচ্ছে রঙ। ...

 

বারো তারিখ বেলা নটা নাগাদ সোমনাথ ফোন পেল বিরাজদা, আহমদসাহেব আর নেই। কার্ডিওলজিতে চলে আসুন

সাইকেলে যাওয়ার প্রশ্ন থাকতে পারে না। হাসপাতাল থেকে আহমদসাহেবের বাড়ি যেতে হলে শববাহী গাড়িতেই যেতে হবে। বা, পরিবারের লোক বেশি থাকলে বিরাজদার সাথে রিক্সায় ...।

সে সময় দ্বারভাঙ্গা কালিবাড়ির গলিতে ঢুকলে বাঁদিকে পিএমসিএইচ এর উত্তরবর্ত্তী গেটটা খোলা পাওয়া যেত। ঢুকতেই ডানদিকে ইন্দিরা গান্ধী ইন্সটিট্যুট অফ কার্ডিওলজি।

দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে সোমনাথ দেখল বিরাজদা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দৃষ্টি তাঁর পিছনে বাঁ ঘেঁসে যেতেই দেখা গেল দেয়ালে লাগান একটা স্ট্রেচার। তাতে কুঁকড়েমুকড়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে আহমদসাহেবের শরীর। সেই পরিচিত আকাশি নীল শার্ট, আর ধুসর নীল প্যান্ট। কিন্তু মৃত্যুর পর কত ছোটো হয়ে যায় শরীরটা।

ঠিক পরে পরেই সুকান্ত এসে ঢুকল। হাতে স্কুটারের চাবি। বিরাজদা ওই চাবির দিকে চোখ রেখেই বললেন, স্কুটার এনেছিস তো?

-       কোথায়, আহমদসাহেব?

-       (পিছনে ইশারা করে) একবার দেখে নে। তারপর কাজ আছে।

-       (সোমনাথকে) পকেটে কত টাকা আছে? আচ্ছা থাক। (পকেট থেকে তিনশো বার করে) এই নিন। সুকান্ত আর আপনি স্কুটারে করে বেরিয়ে যান। এক্ষুণি আহমদসাহেবের পরিবারের লোকেরা এসে পৌঁছোবে। গাড়িতে বডি প্রথমে নিয়ে যাবে ওনার এখানকার বাসায়, গার্ডেনার রোডে। সেখান থেকে গ্রামে নিয়ে যাবে। শিগগির যান, একটা বড়, গা ঢাকা যায় এতটা বড় লাল শালু কিনে তাতে কাস্তে-হাতুড়ি আঁকিয়ে নিয়ে গার্ডেনার রোডে পৌঁছোন। এক ঘন্টায় হয়ে যাবে তো?

-       শুকোবে কী করে? তাও এই ভ্যাপসা আবহাওয়ায়। বৃষ্টি হলে তো আর কথাই নেই।

-       যান! দেখুন! ওনার পরিবারের তরফ থেকে তো আর দেবে না। এটা আমাদের সেন্টিমেন্ট, আমাদের গরজ। আমাদের নেতা ছিলেন উনি।

 

শিবম আর্টস অবশ্য সকালেই খুলে যায়। কাজ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু অর্জুনবাবু নিজে তো আসেন দেরি করে। আর উনি নিজে না বললে দোকানের কর্মচারিরা কি শুনবে?

সুকান্ত স্কুটার চালায় জোরে। কিন্তু একটু জার্কি। এই স্পীড, এই ব্রেক। বার বার সোমনাথের থুতনিটা গিয়ে ওর হেলমেটে ঠোক্কর খাচ্ছিল। যাহোক, পৌঁছেই একটু অনাবশ্যক জোরে সোমনাথ হাঁকল কর্মচারিদের, কোথায় তোমাদের অর্জুনবাবু? আসেননি এখনো? সিনিয়ার পেন্টার ইব্রাহিম সোমনাথকে চিনত। হেসে উল্টো দিকে পানের দোকানে দেখাল।

পানের দোকানেই সোমনাথ পাকড়াও করল অর্জুন প্রসাদকে। পান খাওয়ার প্রস্তাব অস্বীকার করে পুরো পরিস্থিতিটা বলল। ডেডবডি গ্রামে যাওয়ার আগে কমরেডের শরীর লালঝান্ডা দিয়ে ঢাকতে হবে। মালা চড়বে তারপর। আমাদের অল ইন্ডিয়া লিডার। কাজ না হলে ইজ্জতের ব্যাপার হবে।

অর্জুন প্রসাদ বুঝদার লোক। এই সব নিয়েই তো ওর ব্যবসা। হঠাৎ ব্যানার বা ঝান্ডার প্রয়োজন তো হতেই থাকে বাজারে। আর এনারা সব পরিচিত গ্রাহক।

-       চলুন।

-       লাল শালু কিনতে হবে তো।

-       চলুন, বসে চা খান। আমি আনিয়ে নিচ্ছি। লাল একরঙ্গা তো? সাটিন তো নয়?

-       হ্যাঁ, ভালো একরঙ্গা, তার ওপর হোয়াইট পেন্ট দিয়ে...

-       শুকোবে না অত তাড়াতাড়ি, এই আবহাওয়ায়। সিলভার দিয়ে করান।

-       সিলভার তো ঝরে ঝরে পড়তে থাকে।

-       এখন পড়বে না। শুকোনোর পর ভাঁজ করলে পড়ে। এখন তো আপনি কাঁচা নিয়ে যাবেন মাথার ওপর মেলে।

 

দুই পরত রঙ চড়িয়ে বড় কাস্তে আর হাতুড়ি আঁকতে ইব্রাহিমের পঁচিশ মিনিট লেগেই গেল। আরো পাঁচ মিনিট সময় নিলো চা খেতে খেতে। বোর্ডের ওপর ছড়ানো অবস্থায় যতটা পারে শুকোক।

পয়সা মিটিয়ে সোমনাথ নতুন রঙে ভেজা ঝান্ডাটা মাথার ওপর মেলে বাইরে বেরুল। সুকান্ত স্কুটার স্টার্ট করে দাঁড়িয়েছিল। সোমনাথ পিছনে বসতেই স্পীড নিল। ভীড়ের রাস্তা। দুহাত ছড়িয়ে ভালো করে মাথা আর পিঠের ওপর মেলাও যাচ্ছে না। আর দুটো গাড়ির মাঝখান দিয়ে স্কুটার বার করতে যেই হাতদুটোকে নিচে নামাচ্ছে, মাথায়, কপালে, কাপড়ের পিছন দিকে উপচে আসা তেলতেলে সিলভারের গুঁড়ো লেগে যাচ্ছে।

 

একটু কল্পনামনস্ক হয়ে সোমনাথ নিজেদেরকে দুপাশের দোকানপাট থেকে দেখতে লাগল। রাস্তার মাঝখান দিয়ে, গাড়ি, রিক্সার পাশ কাটিয়ে একটা স্কুটার দৌড়োচ্ছে। চালাচ্ছে বেঁটে মত একটি লোক, সে সমানে কথা বলে যাচ্ছে পিছনের জনকে উদ্দেশ্য করে। আর পিছনের জন, একটু মোটা, দশাসই, দুহাতে মাথার ওপর লাল ঝান্ডা মেলে বসে আছে। ঝাঁকানিতে ঝান্ডার কোনাটা লেপটে যাচ্ছে মুখে। কোথায় যাচ্ছে এরা? কোনো মিছিল আছে? ... বড় ঝান্ডা। বড় মিছিল হতে পারে। ... অ্যাই, বিকেলে কোনো কাজ নেই তো ডাকবাংলো মোড়ের দিকে? ... সোমনাথ হাসে, ওদের প্রথম চিন্তা তো এটাই, ট্র্যাফিক জ্যাম না হয় আবার!

 

গার্ডেনার রোডের বাড়িটার সামনে আজ শোয়ানো থাকবে আহমদসাহেবের শরীর। তিরিশ বছর ধরে শহরের রাস্তায়, অফিস-কাছারির গেটে, ডাকবাংলো বা স্টেশন চৌরাস্তায়, রেডিও স্টেশনের সামনের চত্বরটায় ...সব রকম জমায়েতে শেষ সুরটা ধরতেন তাদের স্টার বক্তা কমরেড আহমদ। আহমদসাহেব!

য়ুঁ হী উলঝতী রহী হ্যয় জুল্ম সে খল্ক

ন উনকী রস্ম নঈ হ্যয় ন অপনী রীত নঈ

য়ুঁ হী খিলায়ে হ্যঁয় হমনে আগ মেঁ ফুল

ন উনকী হার নঈ হ্যয় ন অপনী জীত নঈ।।

প্রথম লাইনের শেষে খল্কএর মানেটাও ধরিয়ে দিতেন জনতা।

আবার কখনো বলতেনঃ

ম্যয় অকেলে হী চলা থা জানিব-এ-মঞ্জিল মগর

দোস্ত কুছ মিলতে গয়ে কারবাঁ বনতা গয়া।।

আর, আজ কী বলবেন?

জমানা বড়ে শওক সে সুন রহা থা

হমীঁ সো গয়ে দাস্তাঁ কহতে কহতে।।

 

ডাকবাংলোর পর আর ভীড় নেই। পাঁচ মিনিটে সোমনাথরা ঢুকে গেল গার্ডেনার রোডের বড় ক্যাম্পাসটার ভিতরে। আহমদসাহেবের শরীর এসে গেছে। গায়ের ওপর ওদের ইস্লামী নিয়ম মত চাদর ঢাকা দেওয়া। বিরাজদা, বিন্দেশ্বরজী ও আরো কয়েকজন পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের স্কুটারটা ঢুকতে দেখে বিরাজদার মুখ থেকে চিন্তার ভাঁজটা সরে গেল।

-       দেরি হয় নি তো?

-       নাঃ, এই পৌঁছেছে ওরা। ওই ঝান্ডা দিয়ে ঢেকে দিন কমরেড আহমদকে।

সোমনাথ এক পা এগোবার আগেই, যেন কে দেবে, কী দেবে, এখন কেন ... এই সব জল্পনা রুখে দিতে বিরাজদা স্লোগান তুললেন,

কমরেড আহমদ, লাল সলাম! কমরেড আহমদ, অমর রহে!

 

হাসপাতালে ভালো করে দেখতে পারেনি মুখটা। এখন ঝান্ডার ওপরের দুই কোনা কাঁধের দুপাশে চেপে হাত দিয়ে সমান করতে করতে ভালো করে দেখল মুখটা। সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লেন গল্প বলতে বলতে। সেবারে সোমনাথের অফিসে এসে মহাভারতের যে নীতিকথাটা শুরু করেছিলেন, শেষ করতে পারেননি। সেদিনও এই আকাশি নীল শার্টটা ছিল পরনে।

সবাই এক এক করে মালা দিয়ে আসছিল। সুকান্ত ওদিকে দেয়ালের কাছে স্কুটার দাঁড় করিয়ে ফিরে আসতে আসতে সোমনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, মুখটা মুছে নিন, পুরো সিলভার, সিলভার হয়ে আছে।  

সোমনাথ চোখ নামিয়ে নিজের হনুর হাড়টা দেখার চেষ্টা করল।

ভাবল বলে, বলছ কি সুকান্ত? সিলভার কোথায়? আহমদসাহেবকে লালঝান্ডা দিয়ে ঢাকলাম! বিকেলের আলোয় গোল্ডেন হয়ে যাওয়ার কথা তো ...! ভেবেই আহমদসাহেবের শরীর ঢাকা ঝান্ডার দিকে তাকাল, ধ্যাৎ, বিরাজদাও ভূল আন্দাজ করেছিলেন। সাড়ে পাঁচ ফুট হলে ঠিক হত। পায়ের পাতাটা বেরিয়ে আছে সবুজ চাদর সুদ্ধু। তবে কাস্তে হাতুড়িটা সত্যিই সোনালি দেখাচ্ছে বিকেলের আলোয়

 

২৯.৭.১৯