স্বাধীনতা দিবস তো সারা দেশেই উদ্যাপিত হয়। প্রতিটি রাজ্যে একটি করে সরকারী অনুষ্ঠানও হয়। কিন্তু জাতীয় অনুষ্ঠান বলতে একটাই বুঝি, যেটা ওই দিল্লীর লালচকে না বিজয়চকে, কোথায় যেন হয়; দেশের প্রধানমন্ত্রী পতাকা উত্তোলন করেন।
কিন্তু এবারে তাতে একটা
সন্দেহের রেশ থেকে গেল। ১৫ই আগস্ট ২০১৬য় স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের জাতীয় অনুষ্ঠানটা কোথায় হল?
দিল্লীতে? যেখানে সামনের
সারিগুলোয় বসে থাকা কয়েক হাজার (অধিকাংশ) পরাধীনতাকামী দর্শকের মাঝে উঁচু
মুক্তাকাশ মঞ্চে আঠেরো টন এয়ার কন্ডিশনারের হাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পতাকা
উত্তোলন করলেন এবং জাতির উদ্দেশে আবার একপ্রস্থ মিথ্যে পরিবেশন করলেন?
নাকি, গুজরাটের উনায়? যেখানে
‘আজাদি কুন’ (স্বাধীনতা মার্চ) এ ৩৫০ কিলোমিটার অব্দি পথ চলে আসা লক্ষাধিক
স্বাধীনতাকামী মানুষের ভীড়, জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে, জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে ঘোষণা
করলো যে মরা গবাদি পশুকে রাস্তার ওপর থেকে সরানো, সেসব পশুর চামড়া কাটা, খাটা
পায়খানা থেকে মাথায় করে হোক বা গাড়িতে করে হোক, পায়খানা নিয়ে যাওয়াকে তারা আর
তাদের ‘জাতের’ পেশা হিসেবে স্বীকার করবে না। পায়খানায় মল জমে ভেসে যাক, রাস্তায়
গবাদি পশু মরে দুর্গন্ধ ছড়াক, এসব কাজ আর বাবাবাছা করেও তাদের মাথায় চাপিয়ে দিতে পারবে না প্রশাসন। জোর
জবর্দস্তি তাদের দিয়ে এসব কাজ করাতে যে অত্যাচার চলছে তাদের ওপর সে অত্যাচার তারা
সইবে না।
আমার এই লেখাটা মূলতঃ বিহারে
দলিত উৎপীড়ন বেড়ে চলার একটা হিসেবে সীমিত থাকার কথা। তা সত্ত্বেও স্বাধীনতা দিবস
উদ্যাপন ও সে প্রসঙ্গে উনার ঘটনাটার উল্লেখ করলাম তার একটা কারণ আছে। বর্তমান
কেন্দ্রীয় সরকার, কর্পোরেট মিডিয়া এবং সরকারের গুরুমা আর∙এস∙এস∙ ‘রাষ্ট্রবাদ’ বা বাংলায় ‘জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে একটা বিতর্ক শুরু করেছে।
শব্দটা ইতিহাসে বেশির ভাগ সময় বিপজ্জনক রূপ নিয়েই দেখা দিয়েছে, এবং আজও দেশে একটা
বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করার জন্যই শব্দটা নিয়ে খেলানো শুরু হয়েছে। তবু, ধরে
নেওয়া যাক যে শব্দটার একটা ইতিবাচক দিক আছে, তাহলে তো সেটা ভারতীয় জাতির উৎকর্ষ
সাধন এবং সে উদ্দেশ্যে ভারতের প্রজাতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করার জন্য! তার লড়াইটা
দেশের সীমায় হতে পারেনা কেননা সীমায় কোনো এমন দেশ নেই যেটা ভারতকে সামরিক ভাবে তো
বটেই, রাজনৈতিক ভাবেও গিলে ফেলতে পারে (যেমন নাকি, শুনেছি, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে
রূশ!) আর তার বিরুদ্ধে লড়তে জাতীয়তাবাদের প্রয়োজন হয়! সামরিক বাহিনীকে সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ
করার প্রয়োজন হয়! তাহলে উৎকর্ষ সাধনের লড়াইটা ভেতরে, সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক
বৈষম্য, শোষণ ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধেই হতে পারে! এবং তাই উনার সমাবেশ আজ স্বাধীনতা
দিবস উদ্যাপনের জাতীয় অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে।
এবার আসি বিহারের কথায়।
৭ই
মার্চ ২০১৬ ছিল মহা শিবরাত্রি। সেদিন রাতে নওয়াদা জেলার কছিয়া গ্রামে মহাদলিতদের
কয়েকশো কুঁড়েঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল। ২৪শে মার্চ, হোলি। মুজফ্ফরপুর জেলার
সাংগোপট্টি গ্রামে দলিত বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল, একটি দলিত বাচ্চা মেয়েও
তাতে পুড়ে মারা গেল।
এখানে
বলে রাখা প্রয়োজন যে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নেতৃত্বাধীন বিহার সরকারের
সিদ্ধান্ত এবং পরবর্তী সংশোধনসমূহ অনুযায়ী প্রায় দুই ডজন জাতকে দলিত থেকে মহাদলিত
করা হয়েছে, কথিত আছে যে তারা নানা রকম সুযোগসুবিধে অনেক বেশী করে পায়। জাতের
নামগুলো এখানে বলা অর্থহীন, মিছিমিছি জায়গা নেবে অথচ কেউ বুঝতেও পারবেনা। তবে
এটুকু বলা যায় যে সচরাচর মিডিয়া মহলের বিহার-চর্চায় যে দলিত জাতের নামগুলো শোনা
যায় – মুসহর, পাসী, ডোম, মেহতর, চামার, নট ইত্যাদি – সব মহাদলিতেরই অংশ। আরো একটা
কথা বলা যেতে পারে যে জাতের এই সূচী ধর্মনিরপেক্ষ অর্থাৎ হিন্দু, মুসলমান দুই ধর্মেরই
জাতের উল্লেখ আছে এতে।
যাই
হোক, যে পরিস্থিতির কথা বলছিলাম। হোলির দুদিন পর বেগুসরাইয়ের বলিয়া দিয়ারায় দুইজন
দলিত যুবককে গুলি করে হত্যা করা হল। ফেব্রুয়ারী মাসে সাহারসা জেলার নওহট্টা
বরিয়ারী এবং ববুনিয়া গ্রামে সরকারী জমিতে অনেক বছর ধরে বাস করা কয়েকশো দলিত
পরিবারকে জমি থেকে উৎখাত করার জন্য হামলা চালানো হয়েছিল। নওয়াদা জেলার খাঁটারি
গ্রামেও এধরণের হামলা হয়েছিল।
২০০৫
থেকেই দলিত উৎপীড়নের সংখ্যা বেড়ে চলেছিল। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে ১৯শে অক্টোবর ২০১৪এ
প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে সাংবাদিক সন্তোষ সিং লিখছেন যে নীতীশ কুমারের
মুখ্যমন্ত্রীত্বের প্রথম পাঁচ বছরে (২০০৫ - ১০) দলিত উৎপীড়নের ১০৭৯৮টা মামলা রুজু
করা হয় যখন নাকি পরবর্তী চার বছরেরও কম সময়ে (২০১১ – আগস্ট ২০১৪) রুজু মামলার
সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯০৯৭। নভেম্বর ২০১৫এ রাজদ+জদ(য়ু)+কংগ্রেসের মহাগঠবন্ধন সরকার
ক্ষমতায় আসার পর সেই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকদিন আগেই দৈনিক সংবাদপত্র
হিন্দুতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে তপশীলী জাতির বিরুদ্ধে অপরাধের
সংখ্যায় উত্তর প্রদেশ প্রথম এবং বিহার দ্বিতীয়। বিহারের জনসংখ্যার ১৫∙৯% দলিত, কিন্তু রুজু মামলার ৪০-৪৭% দলিতদের বিরুদ্ধে।
এর
থেকে স্বাভাবিকভাবেই একটা ধারণা জন্মায় যে সরকারী তপশীলে পশ্চাৎপদ জাত হিসেবে
চিহ্নিত মানুষেরা বর্ণহিন্দুদের থেকেও বেশি দলিত বিরোধী। এবং পাটনার বুদ্ধিজীবী
মহলে (তাতে কিছু দলিত বুদ্ধিজীবীও আছেন) এই ধারণাটা বেশ চাউর হয়ে গেছে। আর, এটা তো
তথ্য যে বিহার এবং উত্তর প্রদেশ, দু রাজ্যেই মুখ্যমন্ত্রী পশ্চাৎপদ জাতের মানুষ।
তাদের দলগুলোও পশ্চাৎপদ জাতের বলে পরিচিত। তাই কথাটায় কিছুটা সত্য নিশ্চয়ই আছে।
জাতপ্রথার সামাজিক অসুখটা তো পশ্চাৎপদ জাতগুলোর মধ্যেও রয়েছে।
তবে
অন্ততঃ বিহারের ক্ষেত্রে আরো বড় কয়েকটি ব্যাপার কাজ করছে। তার একটা হল পশ্চাৎপদ
জাতের উঠতি ধনিকদের সাথে রাজ্যের ভুস্বামী সম্প্রদায়ের (যার অধিকাংশ বর্ণহিন্দু)
বোঝাপড়া। এই বোঝাপড়াটা বাঁচিয়ে রাখতেই নীতীশ-জমানার প্রথম দিকে সেই অদ্ভুত ঘটনাটা
ঘটেছিল। সরকার নিজেই ভূমিসংস্কারের প্রশ্নে ডি∙বন্দোপাধ্যায় কমিশন বসালো অথচ সেই কমিশনের প্রতিবেদন ও সুপারিশ বিধানসভায়
পেশ করতে আর পারলো না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লালুজমানার প্রথম দিকেও এমনই এক ঘটনা
ঘটেছিল। সরকার ভুস্বামীদের বিরুদ্ধে অনেক হম্বিতম্বি করল। বিধানসভায় ২৯জন সবচেয়ে
বড় ভুস্বামীর নামের এবং তাদের জমির আয়তনের লিস্টি পেশ করলেন খোদ লালু প্রসাদ...
ব্যাস! চুপ!
নীতীশজমানার
এই বোঝাপড়া খেল দেখিয়েছিল রাজধানীর রাস্তায়, রণবীর সেনার প্রধান ব্রহ্মেশ্বর
মুখিয়া নিহত হওয়ার পর। মুখিয়ার সমর্থকেরা গাড়ীর কনভয়ে আরা থেকে পাটনা এসে ঠিক
পুলিস সদর দপ্তরের সামনে গাড়ীতে আগুন লাগালো, খোলা তরোয়াল নিয়ে সারা শহরে তান্ডব
চালালো ঘন্টাখানেক, ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখলো মানুষজনকে আর পুলিশ চুপ করে বসে রইল।
পুলিস প্রধান বললেন, বাধা দিতে গেলে আরো বড় কিছু একটা হয়ে যেত!
দ্বিতীয়
ব্যাপারটা হল চাকরীর অভাব। বিশ্বায়নের পর থেকে সরকারি-আধাসরকারি সংস্থায় আর বিভাগে
নিয়োগ কমে গেছে। রোস্টারের ব্যাকলগ সত্ত্বেও, সংরক্ষণের সুবিধেটা তো শেষ অব্দি
ওইটুকুতেই। বাকি তো প্রাইভেট চাকরি! সংরক্ষণ নেই। সেদিন একটি ছেলে একটা সেমিনারে
তাদের করা শর্ট সার্ভে রিপোর্ট থেকে বলল, পাটনার মিডিয়া হাউজগুলোয় জার্নালিস্টের
সংখ্যা ২৯০। তার মধ্যে দলিত একজন!... এই একই প্যাটার্ন তো সব জায়গায়। ছোটো ছোটো
ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। স্বাভাবিকভাবেই দলিতদের মধ্যে তথাকথিত উন্নয়নী
অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাবটাই বেশি। এই নেতিবাচক প্রভাবটা এগিয়ে গিয়ে শিশুদের
স্কুলশিক্ষা এবং উচ্চতর শিক্ষার ওপরেও পড়ে। অত্যাচারী সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার
আরো নরম লক্ষ্য হয়ে ওঠে তারা, তাদের ঘরের মহিলারা।
তৃতীয়
ব্যাপারটা হল গ্রাম থেকে পলায়ন। বা বহির্গমন। চাষের কাজে, চাষসংক্রান্ত কাজে, শহরে
বাড়ি-রাস্তা-সেতু তৈরির কাজে হাজারে হাজারে মানুষ বিহারের গ্রাম থেকে যায় পশ্চিমের
দিকে। তাদের অধিকাংশ পশ্চাৎপদ জাত এবং দলিত জাতের গরীব। গ্রাম কে গ্রাম খালি হয়ে
যায়। অথচ গ্রামের বর্ণহিন্দু ধনিকের বাড়ির অনেক কাজ এমন থাকে যা তারা নিজেরা
করবেনা। তখন দলিত টোলায় তারা হানা দেয়। যে কজন আছে তারা কাজ না করতে চাইলে হামলা।
একটা
কথা শেষে বলার। একটা গল্প আছে যে উন্নয়নী অর্থনীতির প্রভাবে দলিতদের মধ্যেও কিছু
কিছু আর্থিক সশক্তিকরণ ঘটেছে। তাই তারা আগের থেকে বেশি প্রতিবাদ করতে সক্ষম। আর
তাই তাদের ওপর হামলার হিংস্রতা বেড়েছে। এটা নিছক গল্প। প্রযুক্তির একটা প্রভাব
হয়তো আছে। কারোর ঘরে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড টিভি, হাতে একটা মোবাইল। হয়ত তাই, কেউ
সজোরে বলে উঠতে সাহস দেখায়, “করবো না!” সেই প্রবৃত্তিও নতুন নয়। একশো বছর ধরে
ইতিহাসের পাতায় মাঝে মধ্যেই দেখা গেছে। কিন্তু তা বলে আর্থিক উন্নয়ন! একেবারেই না।
বরং আরো তলিয়ে গেছে তারা। আর তাই বেড়েছে কথায় কথায় হামলা।
No comments:
Post a Comment