বিশ শতকের হিন্দি কবিতার পৃষ্ঠভূমিতে রয়েছে উনিশ শতকের উত্তরার্ধের হিন্দি কবিতা। এই কালটিকে আমরা ভারতেন্দু-যুগ বলে জানি। ভারতেন্দু-যুগের কবিতা এবং তার পরবর্তী যুগগুলোর কবিতায়, মাধ্যমের একটা বড় ফারাক রয়েছে। আগের যুগের কবিতা ব্রজভাষায় রচিত। পরের যুগগুলোর কবিতা, খড়িবোলিতে। অবশ্যই এ কথাটা প্রধান ধারাটির কথা মনে রেখে বলা হচ্ছে, নইলে আগের যুগেও খড়িবোলিতে কবিতা রচনার প্রয়াস করা হয়েছে এবং পরবর্তী, দ্বিবেদী১ যুগেও বেশ কিছুদিন অব্দি ব্রজভাষায় কাব্যরচনা খড়িবোলির সমানে সমানে চলেছে। কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে কবিরা একই সাথে ব্রজভাষায় এবং খড়িবোলিতে কাব্য রচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, যে কবি হিন্দিতে কাব্য রচনার মাধ্যম হিসেবে ব্রজভষাকে সরিয়ে খড়িবোলিকে স্থাপিত করার জন্য ইতিহাসে প্রসিদ্ধ, তিনি নিজেও ব্রজভাষার সাথে সম্পর্কে পুরোপুরি ছেদ টানেন নি, এবং প্রয়োজনে ব্রজভাষা প্রয়োগ করে নিজের কবিতার রসসমৃদ্ধি বাড়িয়েছেন। দ্বিতীয় কথাটি এই যে, যখন কবিতায় খড়িবোলি প্রতিষ্ঠিত হল তখনও কবিগণ ব্রজভাষা-কাব্যের পরম্পরা ও সংস্কারই শুধু নিজেদের কবিতায় উপযোগে আনেন নি, ছন্দ ও শব্দ-যোজনাতেও অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের কবিতায় নতুন লয় এবং মধুর সংগীতের সৃজন সম্ভব করেছেন। আমার স্পষ্ট ইংগিত ছায়াবাদের দিকে। প্রসাদ২ তো ব্রজভাষাতেই কাব্য রচনা করেছিলেন, নিরালার৩ মুক্তছন্দও ব্রজভাষার কবিত্ত ছন্দের দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং সুমিত্রানন্দন পন্থের শব্দ-মাধুরীর পিছনেও নির্বিবাদ ভাবে ব্রজভাষা-কবিতার মাধুর্য্য উপস্থিত। এমত পরিস্থিতিতে ভারতেন্দুযুগের কবিতার সংক্ষিপ্ত চর্চা আবশ্যক।
ভারতেন্দুযুগটিকে ভারতীয় পুনর্জাগরণের সাথে
যোগ করে দেখা হয়ে থাকে। হিন্দি নবজাগরণের ধারণাটি ডাঃ রামবিলাস শর্মা কর্তৃক প্রতিপাদিত
এবং এটিকে তিনি বাংলার পুনর্জাগরণ থেকে কিঞ্চিত বিশিষ্ট বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে,
আঠেরোশো সাতান্নর বিদ্রোহ হিন্দি নবজাগরণের প্রথম চরণ, ভারতেন্দু-যুগ দ্বিতীয় চরণ এবং
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তৃতীয় চরণ। এভাবে দেখলে ভারতেন্দু-যুগের সাহিত্যের সোজা সম্পর্ক
রয়েছে সাতান্নর বিদ্রোহের সাথে। কিন্তু হিন্দির অন্যান্য অন্যান্য বিদ্বানেরা রয়েছেন,
উদাহরণার্থে ডঃ নামওয়র সিং, যিনি ভারতেন্দু-যুগের সাহিত্যে সাতান্নর বিদ্রোহের কোনো
স্পষ্ট চিহ্ন না পেয়ে বলেন যে কথিত হিন্দি নবজাগরণের সম্পর্ক বিদ্রোহের চেয়ে বেশি তো
ভক্তি আন্দোলনের সাথে। নিঃসন্দেহে নামওয়রজির কথার ভিত্তি রয়েছে। কিন্তু আচার্য রামচন্দ্র
শুক্ল থেকে শুরু করে নামওয়রজি অব্দি একটা অন্য কথাও বলেন। সেটা এই, যে ভারতেন্দু-যুগে
নবজাগরণের চেতনা যে রূপে গদ্য সাহিত্যে প্রকটিত হয়েছে সে রূপে কবিতায় হয় নি। আচার্য
শুক্লের এই কথনটি বিখ্যাত যে ভারতেন্দুর কবিতাবলির বিস্তীর্ণ সংগ্রহে ‘আধুনিকতা’ কমই
পাওয়া যাবে। নামওয়রজিও হিন্দি গদ্যকেই হিন্দি নবজাগরণের সবচেয়ে বড় অবদান বলেছেন। এখানে
প্রশ্ন ওঠে, ভারতেন্দু-যুগের গদ্য ও পদ্যসাহিত্যের মাঝের বিভাজন-রেখাটি কি সত্যিই অলঙ্ঘনীয়?
আর এই যুগের গদ্যসাহিত্য যেখানে নবচেতনার অবদান, পদ্যসাহিত্য কি পতনোন্মুখ সামন্তবাদী
সংস্কৃতির অবদান?
এখানে কিছু তথ্যের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা
প্রয়োজন। ভারতেন্দু-যুগের কবিরা, সে স্বয়ং ভারতেন্দু হ’ন অথবা প্রেমঘন অথবা প্রতাপনারায়ণ,
যে ব্রজভাষার প্রয়োগ করেছেন সেটা রীতিকাব্যের ব্রজভাষা নয়, কথ্যরূপের দিকে চলতে থাকা
ব্রজভাষা। এখানে গণকবি ভারতেন্দুর উদ্দেশে গণকবি নাগার্জুনের দুটি পংক্তি স্মরণীয়ঃ
‘হিন্দী কী হ্যয় অসলী রীঢ় গঁওয়ারু বোলী / য়হ উত্তম ভাওনা তুমহী নে হমমে ঘোলী’ [হিন্দির
আসল মেরুদন্ড গাঁইয়া বুলি / এই উত্তম ভাবনাটি তুমিই আমাদের ভিতরে ছড়ালে]। প্রতাপনারায়ণের
কাব্যভাষায় বৈসবাড়ি৪র গভীর ছাপ রয়েছে। লোকভাষা ও লোকজীবনের প্রতি আকর্ষণই
ভারতেন্দু-যুগের কবিদের লোককাব্যের নানা রূপের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, যার পরিণামে
তাঁরা খোলা মনে লাওণি, কজলি, খেয়াল ও হোলি রচনা করেছিলেন। এটাও উল্লেখ্য যে ওই কবিদের
ধর্মচিন্তা ভারতের প্রাচীন ধর্মচিন্তা না হয়ে মধ্যযুগের ধর্মচিন্তা ছিল। মধ্যযুগের
ধর্মচিন্তা কট্টরপন্থী নয়, বৈষ্ণব ও সূফী উদারতাযুক্ত এবং তাতে প্রেমেরই প্রাধান্য।
এটি মধ্যযুগের সেই মিশ্র সংস্কৃতির অবদান যা আমাদের আধুনিক চেতনার অঙ্গ। ভারতেন্দু-যুগের
কবিতায় পুনরুত্থানের তত্ত্বও ছিল অবশ্যই, কিন্তু এটাও স্মরণীয় যে এ যুগের কবিরা দয়ানন্দের
বৈদিক চেতনার বদলে সেই পৌরাণিক চেতনাকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন যে পৌরাণিক চেতনাকে দয়ানন্দ
তীব্র প্রহার করেছিলেন। লক্ষ্য করার বিষয় এটাও যে এ কবিরা ভক্তির কবিতা লিখুন বা শৃঙ্গারের,
সব কবিতাতেই কম বেশি কবি-ব্যাক্তিত্বের অভিব্যক্তি পাওয়া যায়। এতে অনেক জায়গায় কবিদের
সৌন্দর্য-চিন্তা নতুন হয়ে উঠেছে। শুধু ভাষা পুরোনো বলে এই তথ্যটিকে উপেক্ষা করা ভুল
হবে। এ কথাটি সর্ববিদিত যে এ যুগের কবিরা প্রচুর সংখ্যায় সামাজিক ও জাতীয় কবিতাও রচনা
করেছিলেন। আচার্য শুক্ল এই কবিতাবলির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং লক্ষ্য করেছেন যে এই
কবিতাবলিতে সবচেয়ে উঁচু গ্রামে ছিল দেশভক্তির বাণী। এই কবিতাবলিতে ইতিবৃত্তধর্মিতা
ছিল, কিন্তু রসসংপৃক্ত ছিল সেই ইতিবৃত্তধর্মিতা। অকারণ নয় যে হিন্দিতে জাতীয় কবিতার
শুরু যে ভারতেন্দু-যুগে সেটা সবাই মানে এবং ভারতেন্দুর ‘হায় পঞ্চনদ, হা পানিপত’ ধরণের
জাতীয়তার স্বর অনেক দশক ভেদ করে দিনকরের মত জাতীয় কবির কবিতাতে শোনা যায়। শ্লেষ ও পরিহাসও
এই যুগের কবিদের একটি বিশেষত্ব, যার সাথে নাগার্জুনের মত পরবর্তী কবিদের গভীর সম্পর্ক
রয়েছে। একটি বিশেষ ব্যাপার হল যে এই যুগের যে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ কবি, তাঁরা সকলেই
খড়িবোলিতে কাব্যরচনার প্রয়াস করেছেন, যদিও সে রচনাগুলি ভাব ও ভাষার দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তির
স্তরে পৌঁছোতে পারেনি। অজ্ঞেয় লিখেছেন যে ভারতেন্দু-যুগের কবিতায় নতুন কোপানো মাটির
সুগন্ধ রয়েছে। এই উক্তি যে ওই কবিতাবলি সম্পর্কে নানা বদ্ধমূল ধারণাকে সঠিকভাবে নির্মূল
করে তা আলাদা করে বলা নিরর্থক।
দ্বিবেদি-যুগে, বিশ শতকের প্রথম দুই দশক যার
সময়কাল, তিনটি কাব্যধারা প্রবহমান দেখা যায় – কখনো একে অন্যের সমান্তরাল, কখনো একে
অন্যকে ধাক্কা দিতে থাকা আবার কখনো একে অন্যের ওপর ক্রিয়াশীল। প্রথম কাব্যধারা ভারতেন্দু-যুগের,
যাতে মাধ্যম রূপে কেবল ব্রজভাষা স্বীকৃত। দ্বিবেদি-যুগের দুইজন গুরুত্বপূর্ণ কবি –
বাবু জগন্নাথদাস রত্নাকর এবং সত্যনারায়ণ কবিরত্ন – বিশুদ্ধ ব্রজভাষার কবি। এঁদের মধ্যে
রত্নাকরজির রুচি ক্লাসিকীয়, কবিরত্নের রুচি স্বচ্ছন্দতাবাদী। দুজনেই কৃষ্ণকাব্যের রচয়িতা,
কিন্তু প্রথমজন শৃঙ্গারিক, দ্বিতীয়জন ভক্ত। রত্নাকরজির সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতি উদ্ধব-শতক;
একশ আঠারটি কবিত্তের৫ সংগ্রহ। এই সংগ্রহের বলে তিনি বিশ শতকের ব্রজভাষার
কবি হিসেবেই শুধু স্বীকৃত নন, রীতিকালের শ্রেষ্ঠ কবিদের তুলনাতেও তিনি বহুবার বিলক্ষণ
প্রমাণিত হন। তাঁর কাব্যকলা ও কাব্যগত অন্তর্দৃষ্টির কারণে, যুগ বদলে যাওয়ার পরেও,
দ্বিবেদিযুগের কবিদের মধ্যে তিনি অনেক উচ্চ স্থলাভিষিক্ত। কবিরত্ন রত্নাকরজির মত কাব্যকলাবিদ
ছিলেন না, কিন্তু তাঁর ভাব ও ভাষা, দুই স্তরেই এক ধরণের টাটকা রোমান্টিকতা আছে। দ্বিতীয়তঃ,
রত্নাকরজির বিপরীতে, প্রখর জাতীয় চেতনা সম্পন্ন কবি ছিলেন তিনি। এই দুই কবির পর ব্রজভাষায়
কাব্য রচনাকারী এই সব কবিরা আসেন যাঁদেরকে আচার্য শুক্ল ‘দুরঙা’ কবি বলেন। এই কবিরা
ব্রজভাষা ও খড়িবোলি, দুয়েতেই কবিতা লিখতেন, কিন্তু দু’ধরণের। ব্রজভাষার কবিতা হত শৃঙ্গারিক
আর খড়িবোলির কবিতা হত সামাজিক ও জাতীয়। এঁদের মধ্যে তিনজন ছিলেন প্রধান – নাথুরাম শঙ্কর
শর্মা, রায় দেবীপ্রসাদ পূর্ণ, এবং গয়াপ্রসাদ শুক্ল সনেহী। কিছুদিন পর সনেহী-স্কুলের
কবি হলেন জগদম্বাপ্রসাদ মিশ্র হিতৈষী যিনি নিজের ভাষাটা রাখলেন খড়িবোলি কিন্তু কবিতায়
প্রধানতঃ রীতিকাব্যের পরম্পরা অনুসরণ করলেন। তাঁর সওয়ইয়া৬ ও কবিত্তের অসাধারণ
সঙ্কলন ‘কল্লোলিনী’। সেই মত জনপ্রিয়তাও তিনি পেয়েছিলেন। হরিঅওধের৭ মত কবিও
এখানে উল্লেখ্য, যিনি কাব্যরচনা শুরু করেছিলেন ব্রজভাষায়, কিন্তু পরে খড়িবোলিতে চলে
আসেন। ব্রজভাষায় রচিত তাঁর নয় দশটি কৃতি, যার মধ্যে রস-কলস’ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
এটি বস্তুতঃ রসসিদ্ধান্তের ওপর লিখিত একটি রীতিগ্রন্থ।
এই যুগের প্রতিনিধি কাব্যধারা দ্বিতীয় কাব্যধারা,
যার নির্মাতাদের মধ্যে প্রধান হরিঅওধ, মৈথিলীশরণ গুপ্ত এবং রামনরেশ ত্রিপাঠি। সামাজিক
ও জাতীয় চেতনার এই কাব্যধারাটি অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসেবে খড়িবোলিকে শুধু স্বীকারই
করেনি, ব্রজভাষাকে স্থানচ্যুত করতে তীব্র সংগ্রামও চালিয়েছে। নিঃসন্দেহে এই ধারাটির
নেতৃত্বের শ্রেয় গুপ্তজিই পেয়ে থাকেন। যদিও নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবন্ধাত্মক কাব্য ’সাকেত’কেও
তিনি ব্রজভাষার প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেন নি। প্রমাণ হিসেবে বলতে পারি যে
কাব্যে শুধু ঊর্মিলার বিরহের প্রসঙ্গটুকুই রীতিকাব্যের ধরণ দ্বারা প্রভাবিত নয়। রীতিকাব্যে
প্রযুক্ত অনেক ছন্দও সাকেতএ ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি সোজাসুজি ব্রজভাষার প্রয়োগ, যেমন
‘আচ্ছা, ইয়ে পওধে কহো ফলেঙ্গে কব লওঁ’ অথবা ‘তো বরসো, সরসৈ, রহে ন ভূমি জলী
সী’ ইত্যাদিও পাওয়া যায়। ভারতেন্দু-যুগে মুক্তক রচনার প্রাধান্য ছিল। ব্যতিক্রম হিসেবেই
প্রেমঘনের মত কবি কখনো জীর্ণ জনপদ এর মত প্রবন্ধাত্মক কাব্য সৃজন করেছেন। কিন্তু
দ্বিবেদি-যুগে প্রবন্ধ রচনারই প্রাধান্য। হরিঅওধ যদিও স্ফূর্ত কবিতা কম লেখেন নি, কিন্তু
তাঁর খ্যাতির ভিত্তি প্রিয়প্রবাস নামে প্রবন্ধকাব্য। কৃষ্ণের মথুরাগমনকে বিষয়
করে এই কাব্য রচনা করা হয়েছে, কিন্তু এর নায়িকা রাধা নতুন যুগের নারী-চরিত্র, সামাজিক
চেতনায় ভরপুর। দ্বিতীয়তঃ, পুরো কাব্যটা বর্ণিক ছন্দে রচিত, যার জন্য ভাষা অনেক স্থানে
অত্যন্ত সংস্কৃতঘেঁষা। এ সত্ত্বেও দ্বিমত নেই যে তন্ময়ভাবে রচিত এই কাব্য কাব্যসৌন্দর্যে
এমন পূর্ণ যে পুষ্প, পল্লব ও ফলের প্রাচুর্যময় বৃক্ষের অঙ্গেই শুধু তুলনীয়। হরিঅওধজিরই
অন্য একটি কাব্য বৈদেহী-বনবাস, মাত্রিক ছন্দে এবং অপেক্ষাকৃত সহজ ভাষায় রচিত
হওয়া সত্ত্বেও কাব্যগুণে প্রিয়প্রবাস এর সামনে টেঁকে না। চোখে চৌপদে, চুভতে
চৌপদে এবং বোলচাল ইত্যাদি রচনায়
সংকলিত কবিতাগুলোয় উনি ঠেঠ হিন্দির প্রয়োগ করেছেন, কিন্তু এগুলোকে আমরা তাঁর কোনো উল্লেখযোগ্য
অবদান মানতে পারি না।
গুপ্তজিও প্রবন্ধ-কবি হিসেবেই অধিক মান্য,
যদিও তাঁর খ্যাতি সর্বপ্রথম তাঁর ভারত-ভারতী নামের কৃতিটির জন্য হল। কৃতিটি
‘পদ্যমূলক নিবন্ধ’এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর প্রবন্ধমূলক ছোট বড় কৃতিগুলির মধ্যে সাকেত
ছাড়া উল্লেখ্য জয়দ্রথ-বধ, শকুন্তলা, পঞ্চবটি, যশোধরা এবং বিষ্ণুপ্রিয়া
। মুক্তকেরও কবি ছিলেন তিনি, অবশ্যই। স্বদেশ-সংগীত, ঝঙ্কার এবং মঙ্গলঘট
তাঁর মুক্তকের উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ। প্রবন্ধ
রচনার ক্ষেত্রে তিনি নানা ধরণের প্রয়োগ করেছেন, তার মধ্যে একটি হল মুক্তক বা প্রগীতগুলোকে
গুম্ফিত করে প্রবন্ধের রূপ দেওয়া। এই দৃষ্টি থেকে তাঁর দুটো কাব্যের নাম নেওয়া যায়
– দ্বাপর এবং কুণালগীত । এর মধ্যে দ্বাপর তাঁর সর্বাধিক সুন্দর সৃষ্টি। গুপ্তজির সবচেয়ে বড়
বিশেষত্ব তাঁর কাব্য-সংবেদনার আধুনিকতা ও গতিশীলতা। হিন্দির জাতীয়তাবাদী কবি হিসেবে
তাঁর প্রসিদ্ধি। সর্বপ্রথম মহাত্মা গান্ধী তাঁকে ‘জাতীয় কবি’র শিরোপায় ভূষিত করেছিলেন
এবং হিন্দিভাষী জনতা এতে ব্যাপক সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু বস্তুতঃ গুপ্তজি নিজের কবিতায়
ভারতীয় সংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্যগুলির প্রবক্তাই শুধু নন, হিন্দি কবিতায় আসা সবকটি
আধুনিক মূল্যবোধের প্রথম সংবাহকও বটে। রামনরেশ ত্রিপাঠিও মূলতঃ প্রবন্ধকবি। মিলন,
পথিক ও স্বপ্ন নামে তিনটি খন্ডকাব্য তিনি রচনা করেছিলেন যার প্রধান
অন্তর্বস্তু ছিল গান্ধীবাদ প্রভাবিত জাতীয়তা। হরিঅওধজি বা গুপ্তজির মত পৌরাণিক কাহিনীকে
আশ্রয় না করে কল্পনাপ্রসূত কাহিনীকে আশ্রয় করা তাঁর খন্ডকাব্যগুলোর বিশেষত্ব। এছাড়া,
গুপ্তজির কাব্যভাষা পন্ডিত মহাবীর প্রসাদ দ্বিবেদির গদ্য-প্রভাবিত, যখন নাকি ত্রিপাঠিজির
কাব্যভাষা প্রাঞ্জলতর তো বটেই, ভাষার বিন্যাসও গুপ্তজির থেকে ভিন্ন।
দ্বিবেদি-যুগের তৃতীয় কাব্যধারাটির চর্চা ইতিহাসে
স্বতন্ত্র কাব্যধারা রূপে হয়ে থাকে, যদিও এই কাব্যধারায় দ্বিবেদি-যুগের বেশ কয়েকজন
প্রতিনিধি কবির সাথে সাথে ছায়াবাদেরও দু’একজন কবি শামিল হয়ে থাকেন। সত্যি বলতে গেলে,
এটি দ্বিবেদি-যুগেরই একটি নতুন কাব্যধারা যার, অন্যান্য কাব্যধারার মতই গভীর সম্পর্ক
রয়েছে ভারতেন্দু-যুগের সাথে। আচার্য শুক্ল এই ধারাটিকে ‘স্বচ্ছন্দ-ধারা’ নাম দিয়েছেন
এবং পন্ডিত শ্রীধর পাঠককে এই ধারার প্রবর্তক বলেছেন। জ্ঞাতব্য যে শ্রীধর পাঠক ভারতেন্দু-যুগের
শেষ পর্যায়ের কবি। উনি ইংরেজি রোমান্টিক কবিদের পূর্ববর্তী কবি গোল্ডস্মিথের তিনটি
প্রবন্ধকাব্যের হিন্দিতে অনুবাদ করেছেন, একান্তবাসী যোগী, উজড় গাম এবং শ্রান্ত পথিক নামে। তিনটে অনুবাদই উনবিংশ শতকের শেষ বছরগুলোয় প্রকাশিত
হয়েছিল। যে অনুবাদটি সবচেয়ে সুন্দর, সেটি হল উজড় গাম, কেননা ব্রজভাষায় কৃত,
বাকি দুটোর অনুবাদ খড়িবোলিতে। পাঠকজি অনেকদিন অব্দি খড়িবোলি এবং ব্রজভাষা, দুয়েতেই
কবিতা লিখে গেছেন। তাঁর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাব্যসংগ্রহ ভারত-গীত, যাতে দু’ভাষাতেই
কবিতা রয়েছে। স্বদেশ-প্রেম ও সমাজ-সংস্কারের ভাবনায় ভাবিত কবি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মূল
চেতনা স্বচ্ছন্দতাবাদী ছিল। তাই নিজের কবিতায় যেমন তিনি প্রকৃতিপ্রেমকে বেশি স্থান
দিয়েছেন তেমনই নিজের সমগ্র কাব্যে চিত্র ও সঙ্গীতযুক্ত এবং অনেক সময় কথ্য, যেমনতেমন
চলতে পারা ভাষার প্রয়োগ করেছেন। মৈথিলীশরণ গুপ্তকে একেবারেই প্রবন্ধকার কবি এবং ইতিবৃত্তমূলক
শৈলীর কবি মানা হয়। স্মরণীয় যে আচার্য শুক্লের মতেই উনি শ্রীধর পাঠক প্রবর্তিত স্বচ্ছন্দ-ধারার
প্রধানতম কবি। নিঃসন্দেহে তাঁর সাথে রামনরেশ ত্রিপাঠি, মুকুটধর পান্ডে এবং বদরিনাথ
ভট্টেরও উল্লেখ করা হয়। এঁরা সবাই দ্বিবেদি-যুগের কবি, কিন্তু ভাব, ভাষা এবং শৈলীর
দিক থেকে নিজেদের যুগের ছাপ থেকে ভিন্ন। গুপ্তজি প্রচুর সংখ্যায় স্ফূর্ত কবিতাও লিখেছেন
যার সংগ্রহের মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ ওপরে করা হয়েছে। ঝঙ্কার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দি জগতে এটা প্রচারিত যে
গুপ্তজি ছায়াবাদের প্রভাবে ঝঙ্কার এর গীতগুলি রচনা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তব
এটাই যে এই গীতগুলি ছায়াবাদী চেতনা থেকে ভিন্ন স্বচ্ছন্দ-চেতনার অবদান, যে চেতনার নিজস্ব
বিশেষত্ব আছে। এই দৃষ্টি থেকে আমি তাঁর আরেকটি সংগ্রহের নাম নিতে চাই – উচ্ছাস –
যেটি তাঁর আত্ম-অভিব্যক্তির সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ। এভাবে, গুপ্তজির কাব্য-ব্যক্তিত্ব
প্রবন্ধকার এবং মুক্তককার, দুয়েরই মিলন। ভব্যতায় এই ব্যক্তিত্ব অতুলনীয়।
হিন্দি জগতে গুপ্তজির পরে যে কবিরা এলেন – মাখনলাল – মাখনলাল চতুর্বেদি, সিয়ারাম শরণ গুপ্ত, বালকৃষ্ণ শর্মা নবীন এবং সুভদ্রাকুমারি চৌহান – তাঁদেরকে নিয়ে একটা সমস্যা আছে। তাঁদের পুরোপুরি দ্বিবেদিযুগের কবিও মানা হয় না আবার পুরোপুরি ছায়াবাদি কবিও মানা হয় না। তাই তাঁদের জন্য আলাদা একটি কাব্যধারা – জাতীয়তাবাদি – কল্পনা করা হয়েছে , যখন নাকি ওই ধারায় ওই কবিদের কারোরই সমগ্র কৃতি শামিল করা যায় না। কেননা ওই কবিরা জাতি-প্রেমের সাথে সাথে মানব-প্রেম এবং ঈশ্বর-প্রেমেরও কবি। এটা ঠিক যে তাঁদের রচনাশৈলীতে দ্বিবেদিযুগীন সোজাসাপ্টা ইতিবৃত্তমূলকতাও নেই আবার ছায়াবাদী ধাঁচের অতিশয় বিষয়ীকেন্দ্রিকতাও নেই। বস্তুতঃ তাঁরা স্বচ্ছন্দ-ধারার কবি। দ্বিবেদিযুগীন কবিতা এবং ছায়াবাদী কবিতা, দুয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও নিজেদের এক স্বতন্ত্র পথ খুঁজে নিয়ে চলেন এবং বলা উচিৎ ওই দুই ধারার কবিতার ওপর কিছুটা নিজেদের প্রভাবও বিস্তার করেন। এই ধারাটিই পরবর্তী কালে ভগবতীচরণ বর্মা, হরিবংশরায় বচ্চন, রামধারী সিং দিনকর, নরেন্দ্র শর্মা, রামেশ্বর শুক্ল অঞ্চল এবং শিবমঙ্গল সিং সুমনের মত কবিদের মধ্যে বিকশিত হয়। হিন্দি জগতে এই কবিদের উত্তর-ছায়াবাদী বলা হয়। কালের দিক থেকে এই অভিধা ঠিক, কিন্তু এঁদের কবিতার বিষয়বস্তুর দিক থেকে ঠিক নয়। এই কবিরা মূলতঃ স্বচ্ছন্দ-ধারার কবি। পূর্ববর্তী কাব্যধারা এঁদের প্রভাবিত করে নিশ্চয়ই, কিন্তু স্বতন্ত্র পথে এঁরা এগিয়ে চলেন। এঁদের মধ্যে যে আনন্দবিভোর এক ভাব এবং আউলবাউলপনা রয়েছে, তার উৎস শ্রীধর পাঠক থেকে শুরু করে মাখনলাল এবং নবীন অব্দি। এঁরা কবিতাকে আকাশ থেকে নামিয়ে মাটিতে দাঁড় করালেন এবং তাকে জাতি-প্রেম থেকে ব্যক্তিগত প্রেম অব্দি সমস্ত কিছুর বাহক করলেন। জ্ঞাতব্য যে এঁদের মধ্যেকার বেশ কয়েকজন কবি শুধু উগ্র জাতীয়-চেতনারই নয় ফাসিস্টবিরোধী চেতনারও কবি ছিলেন। অকারণ নয় যে এঁদের কবিতা অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা পেল। এমন কবিতাকে যদি বিজয়দেব নারায়ণ শাহির মত কবি লঘুতার অবদান বলেন তাহলে সেটা স্পষ্টতঃই কবিতা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার পরিণাম। মাখনলালের হিমকিরিটিনী, নবীনের কুঙ্কুম, বচ্চনের মধুশালা এবং দিনকরের কুরুক্ষেত্র নির্বিবাদে হিন্দি কবিতার পরবর্তী স্বচ্ছন্দ-ধারার মূল্যবান ফসল। এই কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে বাকিগুলো স্ফূর্ত কবিতার সংগ্রহ হলেও কুরুক্ষেত্র নতুন ধরণের প্রবন্ধ-কাব্য যাতে কবিত্ত ও সওয়ইয়ার মত, ব্রজভাষার পুরোনো ছন্দগুলোর অত্যন্ত সুন্দর প্রয়োগ হয়েছে। দিনকর পরেও ঊর্বশী র মত প্রবন্ধকাব্য লিখেছেন, কিন্তু সেটা কুরুক্ষেত্র র মত গুরুত্ব পায়নি।
বিশ শতকের তৃতীয় দশকে হিন্দি কবিতায় এক নতুন
ভঙ্গী দেখা যায়। এই নতুন কবিতা বিদ্রোহের কবিতা, যাকে ইতিহাসে ছায়াবাদী কবিতা নাম দেওয়া
হয়েছে। বিদ্বানদের মতে এটি পূর্বোক্ত শ্রীধর পাঠক প্রবর্তিত স্বচ্ছন্দতাবাদী কবিতারই
বিকশিত রূপ। জ্ঞাতব্য এই যে আচার্য শুক্ল এই কবিতাকে স্বচ্ছন্দবাদী কবিতার পথের বাধা
বলে মনে করেন। তাঁর বক্তব্য যে স্বচ্ছন্দতাবাদ হিন্দি কবিতায় স্বাভাবিকভাবে বিকশিত
হচ্ছিল এমন সময় রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে ;ছায়াবাদ’ নামে এক নতুন বাদ উঠে দাঁড়াল যাতে
পশ্চিমী ধাঁচের রহস্যবাদের প্রাধান্য ছিল এবং যার শৈলী বিষয়ীকেন্দ্রিক হতে হতে দুর্বোধ্য
হয়ে উঠল। কথাটার তাৎপর্য এই যে স্বচ্ছন্দতাবাদ ছিল দেশী, আর ছায়াবাদ বেংলার মাধ্যমে
এলেও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত। বাস্তব এটাই যে ছায়াবাদ স্বচ্ছন্দতাবাদের অগ্রগতিও নয়,
পুরোপুরি বিদেশি বস্তুও নয়। স্বচ্ছন্দতাবাদ এবং ছায়াবাদ দুটোই এক ব্যাপকতর স্বচ্ছন্দতাবাদের
অঙ্গ। মজার ব্যাপার যে হিন্দি কবিতায় দুটোই একে অন্যকে প্রভাবিত করতে থেকেও সমান্তরাল
ভাবে চলেছে। একদিকে যদি প্রসাদ, নিরালা ও পন্থকে দেখতে পাই তো অন্যদিকে মাখনলাল, সিয়ারামশরণ
ও নবীনকে দেখতে পাই। যদি বিদেশিপনার কথা ওঠে, তাহলে বলতে হয় যে স্বচ্ছন্দতাবাদও নিতান্ত
দেশী ছিল না, কেননা তার পিছনে পাঠকজির অনুদিত গোল্ডস্মিথের রোমান্টিক কাব্যের প্রেরণা
ছিল। ছায়াবাদের ব্যাপারে এট সত্য যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল, কিন্তু খুব শিগগির ছায়াবাদ
হিন্দির পরম্পরার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। যদি পুরোনো বিদ্বানদের বহিরাগত মনে হয়ে থাকে,
তার কারণ হল স্বচ্ছন্দতাবাদ যেখানে সাধারণ চালে চলছিল, ছায়াবাদ সেখানে হিন্দি কবিতায়
একটা লাভ ছিল। ছায়াবাদকে সবচেয়ে ভালোভাবে আচার্য হাজারিপ্রসাদ দ্বিবেদি পরিভাষিত করেছেন।
তিনি বলেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নব্যশিক্ষিত যুবকদের সামনে সাম্রাজ্যবাদের বিধ্বংসী
রূপ পূর্ণতঃ প্রকট হয়ে পড়ল, ফলস্বরূপ তাদের
ভিতরে জেগে উঠল উপনিবেশ-বিরোধী চেতনার প্রবল তরঙ্গ। ছায়াবাদ এই ‘বন্ধনমুক্ত চিত্তের’
কবিতা। এই স্বতন্ত্র চেতনা কবিতাকে ব্যক্তির কেন্দ্রে স্থাপিত করল, ব্যাপক অর্থে কবির
আত্মঅভিব্যক্তি হয়ে উঠল কবিতা। দ্বিবেদিযুগীন কবিতার মত ছায়াবাদী কবিতাও স্বাধীনতা
আন্দোলনেরি অবদান ছিল। তাও ওই আন্দোলনের উগ্রতম পর্যায়ের। কিন্তু কবিরা সমাজ ও জাতি
থেকে শুরু করে বিশ্ব অব্দি সমস্তকিছুর উদ্দেশে নিজের প্রতিক্রিয়াকে অন্তর্গত রূপে অভিব্যক্তি
দিল, যাতে গভীর অনুভূতি যেমন ছিল, কল্পনার সুউচ্চ উড়ালও ছিল। আশ্চর্য নয় যে হিন্দি
কবিতা দেখতে দেখতে গীতিকবিতামূলক হয়ে উঠল, ভাষা রাঙিয়ে উঠল প্রজাপতির পাখার রঙে এবং
চিত্রের সাথে সাথে সঙ্গীতময়তা সম্ভব হয়ে উঠল। আচার্য শুক্ল এই ক্রমোন্নতি খুব ভালো
ভাবে লক্ষ্য করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ছায়াবাদকে তিনি একটি প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণ করলেন
এবং নিজের পুরোনো মতটাকে সংশোধন করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোলেন যে ছায়াবাদ শুধু রহস্যবাদ
নয়, বিষয়ীমূলক শৈলীতে রচিত কাব্য সবই ছায়াবাদের অন্তর্ভুক্ত।
ছায়াবাদের উপলব্ধিগুলো মূল্যবান। যদিও গীতিকবিতারই
এতে প্রাধান্য, প্রসাদ থেকে শুরু করে মহাদেবী
অব্দি সবাই অসংখ্য গীতিকবিতা রচনা করেছেন এই ধারায়, কিন্তু প্রবন্ধকাব্যেরও
কিছু প্রয়াস দেখতে পাওয়া যায়। এটা আলাদা ব্যাপার যে প্রয়াসটা কখনো বড় মাপের আবার কখনো
ছোট মাপের। ছায়াবাদে প্রবন্ধকাব্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান কামায়নী । কামায়নী
নতুন ধরণের প্রবন্ধকাব্য তো বটেই, এর সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব যে এটি বস্তুতঃ গীতিকবিতামূলক
প্রবন্ধকাব্য। এই কাব্যের যে সর্বাধিক শ্রেষ্ঠ ও আধুনিক সর্গটি, ‘ইড়া’, সেটি প্রথম
থেকে শেষ অব্দি গীতিকবিতায় নিবদ্ধ। বলার প্রয়োজন নেই যে এই কাব্য আধুনিক যুগের ভাবধারাগত
সংগ্রামের দলিল। ছায়াবাদী কবিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলা হয়, কিন্তু এই কাব্যে কবি-কন্ঠস্বর
সংকটাপন্ন বিশ্বমানবতার চিন্তায় উদ্বেলিত। ছায়াবাদের ভাষা প্রবন্ধকাব্য রচনার উদ্দেশ্যে
নির্মিত হয়নি, কিন্তু প্রসাদজি সেই ভাষার ব্যবহার মহাকাব্য রচনার জন্য করলেন। অবশ্যই
এতে ভাষাটি ক্ষতবিক্ষত হল, কিন্তু তাতে এই ভাষাটিতে একটি অদ্ভত ঝিলিকও এল। এখানে মনে
করান দরকার যে প্রসাদজি ‘প্রলয় কী ছায়া’ নামেও প্রবন্ধমূলক কাব্য লিখেছেন, যেটি ওনার
অত্যন্ত বিশিষ্ট কৃতি। এর বিশেষত্ব এই যে এটি মুক্তছন্দে লিখিত। আশ্চর্য নয় যে আচার্য
শুক্ল এই সব কবিতার মাধ্যমে ছায়াবাদের কাব্যভূমি বিস্তৃত হতে দেখলেন। প্রসাদজির আরেকটি
রমণীয় কাব্যরচনা আঁসু, যার প্রত্যেকটি ছন্দ অমূল্য। নিরালাও তুলসীদাস নামে লঘু প্রবন্ধকাব্যের সৃজন করেছেন, যার তুলনা
বোধহয় কোনো ভাষাতেই নেই। এর একেকটি ছন্দ কুঁদে গড়া এবং স্থাপত্য এত দৃঢ় যে একটি ইঁটও
নড়ান যাবে না। নিরালার কবিত্বে এই উৎকর্ষ আর কখনো আসেনি। কামায়নী এবং তুলসীদাস দুটো কাব্যেরই বিশেষত্ব এই যে যতখানি এরা আমাদের
মনের গভীরে যাত্রা করায় ততখানি বহির্জগতেরও। তুলসীদাস এর পর নিরালা দুটি দীর্ঘ
ও মহান কাব্য রচনা করেছেন – ‘সরোজ-স্মৃতি’ এবং ‘রাম কী শক্তিপূজা’। ‘সরোজ-স্মৃতি’তেও
একটি কাহিনী রয়েছে, কবিকন্যার জন্ম থেকে শুরু করে তার মৃত্যু অব্দি, কিন্তু সেই কাহিনী
চিরাচরিত গল্প বলার ঢঙে না বলে চিন্তনের ঢঙে বলা হয়েছে। ‘শক্তি-পূজা’ সুস্পষ্টভাবে
প্রবন্ধকাব্য, যাতে রামের মানবিক রূপটিকে আধুনিক সংবেদনা-সম্পন্ন করে অতি উদাত্ত স্তরে
গঠন করা হয়েছে। বিদ্বানগন এই কবিতাটিকে আধুনিক রামচরিতমানস অভিধা দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে
হিন্দিতে এটি বিশ শতকের শ্রেষ্ঠতম কবিতা। পরিমল, অনামিকা অথবাগীতিকা, নিরালার সবকটি কাব্যসঙ্কলন খড়িবোলির
নবোদ্ভূত কবিতাকে অনেকটা দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। যত বড় কবি ছিলেন, ততটাই বড় গীতিকার ছিলেন
নিরালা। শব্দব্যবহার থেকে ভাবের অভিব্যক্তি অব্দি, তাঁর গীতির তুলনা শুধু তুলসীদাসের
পদের সাথে করা যায়।
প্রসাদ ব্রজভাষায় কাব্য রচনা করতে করতে ঝরণা
র গীতি অব্দি পৌঁছেছিলেন। ঝরণা র গীতিতে ছায়াবাদের প্রথম উন্মেষ দেখা গিয়েছিল।
নিরালা পদ্মাকরের মত রীতিকালীন কবিদের হৃদয়ঙ্গম করে ‘জুহী কী কলি’ পর্য্যন্ত এলেন এবং কবিত্তের লয়কে ভিত্তি করে মুক্তছন্দের প্রবর্তন
করলেন। পন্থের বিশেষত্ব এই যে পল্লব এর ভূমিকায় ব্রজভাষা-কাব্যের ওপর কঠোর প্রহার
করেও, ব্রজভাষা-কাব্যের কথা মনে রেখেই খড়িবোলিতে এমন কাব্যভাষা রচনা করলেন যা তার সঙ্গীত-মাধুর্যে
কোনোভাবেই কম নয়। তাঁর প্রকৃতি, প্রেম ও রহস্যবিষয়ক কবিতাগুলি হিন্দি কবিতার সামনে
এক নতুন জগত খুলে দিল যার সৌন্দর্য ছিল অতুলনীয়। এ ব্যাপারটাও গুরুত্বপূর্ণ যে পন্থজি
নিজের অন্তরে একজন চিন্তাশীল কবি ছিলেন তাই তাঁর কবিতা শুরু থেকে শেষ পর্য্যন্ত চিন্তনের
পথে এক অস্থির সত্ত্বার আবিষ্কারময় অভিযান মনে হয়। উনি খড়িবোলির সর্বাধিক সৃজনশীল কবি,
যিনি হিন্দি কবিতার পরবর্তী সব ক’টি পর্যায়ে নিরন্তর সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ
ফসল ছায়াবাদ-পর্যায়ের পল্লব, গুঞ্জন এবং যুগান্ত এর কবিতাগুলি, যাতে
অভিব্যক্তি আরো গভীর হয়েছে, চিত্র আরো স্পষ্ট হয়েছে এবং সঙ্গীত আরো দীপ্ত হয়েছে। ‘প্রথম
রশ্মি’, ‘মৌন নিমন্ত্রণ’, ‘পরিবর্তন’, ‘এক তারা’, ‘নৌকাবিহার’ ইত্যাদি তাঁর অমর কবিতা,
যাতে হিন্দি কবিতা মাধুর্য এবং ঔদাত্তের এক নতুন স্তরে সঞ্চরণ করে। পরবর্তীকালে উনি
যে অনেক কাব্য-রূপক এবং লোকায়তন এর মত বড় প্রবন্ধ-কাব্য রচনা করেন, তার উৎস
বোধহয় ছায়াবাদের একেবারে শুরুতে রচিত তাঁর খন্ডকাব্য গ্রন্থি, একটি প্রেমকাহিনী।
মহাদেবীজি ছায়াবাদে আসেন তৃতীয় দশকের প্রায় শেষে, কিন্তু রহস্য-ভাবনার এক মোহময় গীতিমূলক
কন্ঠস্বর নিয়ে। তাঁর আরম্ভের সমস্ত গীতি ইয়ামা তে সঙ্কলিত। পরবর্তী গীতিগুলি
দীপশিখা তে। মহাদেবীজি ছায়াবাদের এমন একজন কবি যিনি রহস্যবাদের বাইরে খুব কম
পা বাড়িয়েছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাঁর কবিতার জগতটা অত্যন্ত সীমিত। ভক্তি যুগের
কবিরা যেমন নিজের সময়ের সমস্ত প্রশ্ন ভক্তির মাধ্যমেই ধরেছিলেন, মহাদেবীজিও নিজের সময়ের
সম্পূর্ণ চেতনাকে রহস্যের মাধ্যমেই প্রতিধ্বনিত করেছিলেন তা সে আধুনিক নারী-সম্পর্কিত
হোক, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত ভারতীয় নাগরিক-সম্পর্কিত হোক অথবা জড়বাদের আধিপত্যে
সন্ত্রস্ত বিশ্বমানবতা-সম্পর্কিত হোক। সামাজিক বাস্তবতার প্রতি উনি কতটা সজাগ ছিলেন
ত শৃংখলা কী কড়িয়াঁ নামে ওনার বইয়ের
নিবন্ধগুলো পড়লে বোঝা যায়। ওনার সমাজ-ভাবনার সাথে ওনার কবিতার সম্পর্কের অন্তর্সূত্রগুলো
আবিষ্কার করতে পারলে হিন্দি কাব্য-সমালোচনা কৃতার্থ হবে। এটা খুবই সন্তোষের কথা যে হিন্দির বিদ্বানেরা সমৃদ্ধির দিক থেকে ছায়াবাদী
কাব্যকে ভক্তিকাব্যের সঙ্গে তুলনীয় মানেন। নিরালা ছায়াবাদেরই অবদান, যিনি হিন্দি কবিতায়
শ্রেষ্ঠতার উদাহরণ হয়ে দাঁড়ালেন।
২
ছায়াবাদের পর হিন্দি কবিতা এক নতুন যুগে প্রবেশ
করে। এটি বাস্তববাদের যুগ। এমন নয় যে দ্বিবেদিযুগীন এবং ছায়াবাদী কবিতায় বাস্তবতার
গুণ ছিল না। দ্বিবেদিযুগীন কবিতায় সামাজিক এবং জাতীয় জীবনের বাস্তব খুব ভালো ভাবেই
প্রকট হয়েছে, কিন্তু তা বেশির ভাগই গদ্যমূলক। তাতে পাঠককে প্রভাবিত করার গুণ আছে নিশ্চয়ই,
কিন্তু অনুভূতিচালিত করার গুণ নেই। ছায়াবাদে বাস্তব এক ভিন্ন মেরুতে গিয়ে প্রকট হল।
এতে তার রূপ এত কাল্পনিক হয়ে গেল যে তাকে চেনাই কঠিন হয়ে উঠল। খুব স্বাভাবিক যে ছায়াবাদের
পর হিন্দি কবিতায় চারদিক থেকে বাস্তবতার দাবি উঠতে লাগল। ততদিনে পরিস্থিতিও অনেকখানি
পাল্টে গেছে। দেশে কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়েছে, স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের নেতৃত্বের
প্রতি মোহভঙ্গ হতে শুরু করেছে জনতার, গান্ধীবাদ প্রশ্নের জালে জড়িয়ে পড়েছে, বুদ্ধিজীবীদের
মধ্যে অগ্রগামী অংশে সমাজবাদী ভাবধারা প্রসারিত হচ্ছে এবং ইয়োরোপে ফ্যাসিবাদের উদয়
হয়ে গেছে। এসবেরই পরিণাম ছিল ইংলন্ডের জমিতে ইংরেজি শিক্ষাপ্রাপ্ত কয়েকজন ভারতীয় যুবকের
ভিতরে মার্ক্সবাদের প্রেরণায় প্রগতিশীলতার যে চেতনা জন্ম নিয়েছিল তা ভারতে পৌঁছে একটি
সংগঠনের গতিবিধির মাধ্যমে এখানকার মাটিতে শিকড় ধরল এবং শুধু হিন্দি নয় সম্পূর্ণ ভারতীয়
সাহিত্যে নির্ণায়ক প্রভাব ফেলল। কিন্তু এই ব্যাপারটির বিশদে যাওয়ার আগে হিন্দি কবিতার
স্বাভাবিক গতিতে বদলাতে থাকা দৃশ্যপটটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
ডঃ রামবিলাস শর্মা বলেন, যে জিনিষটার বিরোধ
করা উদ্দেশ্য তাকে বিদেশী ঘোষণা করে দেওয়া এখানকার প্রতিক্রিয়াশীলদের পুরোনো খেলা।
কথাটা ঠিক, যদিও ডঃ শর্মা নিজেই অজ্ঞেয় থেকে মুক্তিবোধ অব্দি নানান কাব্যপ্রবৃত্তির
বিরোধ করার জন্য এই খেলাটা খেলেছেন। এটা সত্যি যে ছায়াবাদ থেকে প্রগতিবাদ অব্দি প্রেরণাটা
প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে অনেকাংশে বিদেশ থেকেই এসেছিল কিন্তু সে তো আধুনিক বিশ্বে বিকাশের
স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। দেখার কথা এটাই যে বাইরে থেকে আসা ভাবধারাটি এখানকার পরিস্থিতির
সঙ্গে মিলেমিশে কী রূপ নিয়েছে এবং সে রূপ কতটা আমাদের আপন হতে পেরেছে বা কতটা আমাদের
জন্য উপযোগী হয়েছে। প্রগতিবাদী আন্দোলন শুরু হওয়ার ঠিক আগের হিন্দি কবিতার অবস্থার
দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখব যে সে কবিতা নিজেই ওই দিকে এগোচ্ছিল যেদিকে এই
আন্দোলন তাকে জোর করে ঠেলল। ডঃ শর্মা এটাও বলেন যে প্রগতিবাদ হিন্দি কবিতার স্বাভাবিক
বিকাশ। উনি দ্বিবেদিযুগ থেকে উদাহরণের পর উদাহরণ দিয়ে কথাটা প্রমাণিত করেছেন। আমি শুধু
ছায়াবাদের শেষদিনগুলোর কথা বলছি। উনিশশো ছত্রিশে প্রসাদের কামায়নী প্রকাশিত হল। এর ‘ইড়া’ সর্গটি আমাদের পূঁজিবাদের
ভয়াবহ দুষ্পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করে, ঠিক যেমন ‘চিন্তা’ সর্গটি আমাদের সামন্তবাদের
পতনশীল রূপের সাথে পরিচয় ঘটায়। উনিশশো পঁয়ত্রিশেই নিরালা ‘সরোজস্মৃতি’ নামে কবিতাটি
রচনা করে ফেলেছিলেন; কবিতাটি, কল্পনা ও বাস্তবের মাঝে যে দ্বন্দ্ব ছায়াবাদে ছিল তাকে
অনেক গভীরে নিয়ে যায়। এই দ্বন্দ্বটি উনিশশো ছত্রিশে রচিত তাঁর কবিতা, ‘রাম কী শক্তিপূজা’য়
অত্যন্ত শিল্পগত কুশলতায় যেন নির্ণায়ক বিন্দুতে পৌঁছে দেয়। সেখান থেকেই ‘বন-বেলা’ হয়ে
নিরালা ‘কুকুরমুত্তা’র দিকে বাঁক নেন, যার পরম নিষ্পত্তি হয় নয়ে পত্তে র কবিতায়।
মজার কথা এই যে ‘কুকুরমুত্তা’ থেকে নয়ে পত্তে অব্দিকার কবিতায় নিরালা প্রগতিবাদের সংকীর্ণতাবাদী
প্রবৃত্তি এবং ভড়ংএর বিরুদ্ধে লড়ে হিন্দি কবিতাকে সঠিক প্রগতিশীল এবং বাস্তববাদী পথে
এগিয়ে নিয়ে যান। পন্থজিযুগান্ত (১৯৩৫) এ ছায়াবাদের এই সমাপ্তির খবর দিয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৩৮এ উনি কালাকাঁকর থেকে ‘রুপাভ’ নামের পত্রিকা প্রকাশ করেন; অঘোষিত ভাবে পত্রিকাটি
প্রগতিশীল আন্দোলনের মুখপত্র ছিল। এই পত্রিকারই সম্পাদকীয়তে উনি ছায়াবাদের প্রতি নিজের
গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে আজকের কবিতার লালনপালন স্বপ্নজগতে হতে পারে না,
তাই সে বাধ্য হচ্ছে কঠোর পৃথিবীর আশ্রয় নিতে। তাঁর এই সম্পাদকীয়টিকে প্রগতিবাদের ঘোষণাপত্র
মনে করা হয়। কী অদ্ভুত বিড়ম্বনা যে যে কবি পল্লব এর ভূমিকা-ছলে ছায়াবাদের ঘোষণাপত্র
লিখেছিলেন, তিনিই ছায়াবাদের বিরোধ করে প্রগতিবাদেরও ঘোষণাপত্র লিখলেন। ১৯৩৯-৪০এ পন্থজির
যুগবাণী এবং গ্রাম্যা নামক বিখ্যাত কবিতাসংগ্রহ প্রকাশিত হল। আজ বিচার
করা উচিৎ যে এ দুটি সংগ্রহ কতখানি প্রগতিবাদী আন্দোলনের অবদান এবং কতখানি পন্থজির ভিতরে
জন্ম নেওয়া স্বাভাবিক প্রগতিশীল প্রবৃত্তির। জ্ঞাতব্য যে দুটো সংগ্রহেই সংকীর্ণ জড়বাদীদের
সমালোচনামূলক এবং মহাত্মা গান্ধীর স্তবে লিখিত অনেকগুলি কবিতা আছে। স্পষ্টভাবেই এই
কন্ঠস্বর প্রগতিশীল আন্দোলনের বিসংবাদী। যাঁদের উত্তর-ছায়াবাদী বলা হয়, তাদের মধ্যেও
নরেন্দ্র শর্মা এবং শিবমঙ্গল সিং সুমনের মত কবি প্রগতিশীল আন্দোলনের শরিক হয়েছেন এবং
তার প্রভাবে যথেষ্ট মুখর কবিতা রচনা করেছেন। এই ঘটনাগুলিও এটাই প্রমাণ করে যে প্রগতিবাদ
হিন্দি কবিতার জন্য ততটা বহিরাগত ছিল না, যতটা বোঝা এবং বোঝান গিয়েছিল। যদি একেবারেই
বহিরাগত জিনিষ হত, তাহলে নিরালা থেকে শুরু করে সুমন পর্য্যন্ত পুরোনো ধারার কবিদের
নিয়ে প্রগতিবাদের প্রথম সারি তৈরি হত না।
১৯৩৬এ লক্ষ্ণৌএ প্রেমচন্দের সভাপতিত্বে প্রগতিশীল
লেখক সঙ্ঘের স্থাপনা সম্মেলন সম্পন্ন হল। তার পর থেকে সচেতন ভাবে প্রগতিশীল আন্দোলনের
প্রসার শুরু হল। এই আন্দোলন নিজের কবিদের যে প্রথম প্রজন্ম তৈরি করল তাতে এলেন শমশের,
কেদারনাথ অগরওয়াল, নাগার্জুন, ত্রিলোচন এবং মুক্তিবোধ। এতে যদি কারো নাম যোগ করতে হয়
তাহলে সেটা হবে রামবিলাস শর্মা, যিনি পরের দিকে সিরিয়াস কবিকর্ম ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই
কবিরা সবাই, প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত তো ছিলেনই, প্রায় সবাই ভারতের
কম্যুনিস্ট পার্টিরও সদস্য ছিলেন। ভাগ্যের কথা এই যে এই কবিদের আদ্ধেক, কবিতায় সঙ্ঘ
বা পার্টির নির্দেশের অন্ধ অনুসরণ করেন নি এবং যাঁরা করেছিলেন, তাঁরাও নানান ধরণের
কবিতা লেখার জন্য নিজেদের সৃজনধর্মী ব্যক্তিত্বকে খোলা রেখেছিলেন। নির্দেশ মোতাবেক
কবিতা লিখনেওয়ালা কবি ছিলেন কেদার, নাগার্জুন এবং রামবিলাস। অবাক কান্ড নয় যে এঁরা
ভালোসংখ্যক আন্দোলনধর্মী কবিতা লিখেছিলেন যেগুলোকে সামনে রেখে, প্রগতি-বিরোধী শিবিরের
বিদ্বানেরা প্রগতিশীল কবিতার পুরো ধারাটিকেই খাটো করবার চেষ্টা করলেন। তাঁরা এই কবিদের
সিরিয়াস সাহিত্য, ভালো কবিতাগুলো দেখলেনই না অথবা দেখেও না দেখার ভান করলেন। এই কবিদের
কবিতায় নিঃসন্দেহে এক নতুন বাস্তব পুরোপুরি টাটকাভাবে প্রকাশ পাচ্ছিল। এমত পরিস্থিতিতে
আশা করা যে ওই বিদ্বানেরা নাগার্জুনের মত কবির আন্দোলনধর্মী কবিতায়ও যে একটা উঁচু জাতের
শৈল্পিক বক্রতা রয়েছে সেটা লক্ষ্য করবেন, দুরাশা হত মাত্র। কেদারের কাব্যসংগ্রহ যুগ
কী গঙ্গা, নাগার্জুনের কাব্যসংগ্রহ যুগধারা এবং রামবিলাসের কাব্যসংগ্রহ রূপতরঙ্গ আজও প্রমাণস্বরূপ যে এঁদের মাধ্যমে হিন্দি কবিতায়
কেমন করে বাস্তবের নতুন একটা ভিত্তিভূমি উঠে আসছিল। অজ্ঞেয় প্রগতিশীল কবিতার কঠোর সমালোচনা
করে বলেছেন যে প্রগতিশীল কবিতা ও ছায়াবাদী কবিতার রচনা-প্রক্রিয়ায় কোনো তফাৎ নেই, অর্থাৎ
দুটোই ভাব-প্রধান। তাঁর কথায়, প্রগতিবাদে এসে কবিতা বদলায়নি শুধু তার প্রতীক-পুরুষ
পাল্টে গেছে। এটা সত্যি নয়। এটা সত্যি যে কেদার, নাগার্জুন আর রামবিলাসের মত কবিদের
সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তব একটি বিশেষ ধাঁচের বাস্তব, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেটা ততটা সীমিত
আর অনমনীয় নয়, যতটা বলে হিন্দি কবিতার অগ্রগতিতে তার গুরুত্ব কম করার চেষ্টা করা হয়।
এই সামাজিক বাস্তব, শুধু ছায়াবাদী কেন দ্বিবেদিযুগ থেকেও ভিন্ন, কেননা এতে ছায়াবাদী
কাল্পনিকতা যেমন নেই, দ্বিবেদিযুগীন গদ্যমূলকতাও নেই। যেটা নতুন জিনিষ সেটা হল যে এই
বাস্তব, একটি রোমান্টিক যুগ পার করে চিত্রিত হতে থাকা বাস্তব, যাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই
গদ্যকবিতার গুণের সাথে যোগ হয়ে গেছে।
শমশের, ত্রিলোচন আর মুক্তিবোধের কথা যদি ধরি,
এই তিনজন প্রগতিশীলতার বৃহত্তর পটভূমিতে কাব্য-সৃজনকারী কবি ছিলেন। তার ফলে এঁদের কবিতায়
চিত্রিত বাস্তব সঙ্কীর্ণ প্রগতিশীলতার সমস্ত সীমা ভেঙে চলে এবং এঁদের শৈলীও অনমনীয়
নয়, নিজস্ব। রাজনৈতিক চেতনার কিছু কবিতা শমশেরও লিখেছেন কিন্তু সেগুলি তাঁর দুর্বলতম
কবিতা। যদি ওনার এধরণের কবিতাগুলোর মধ্যে কোনো ব্যতিক্রম থাকে তাহলে সেটি ‘অম্ন কা
রাগ’, সদর্থে মহান কবিতা। বস্তুতঃ তিনি প্রেম ও সৌন্দর্যের বিলক্ষণ গায়ক ছিলেন এবং
নিজের যুগের সমস্যাদিতে উদ্বেলিত হয়ে কবিতায় প্রেম ও সৌন্দর্যেরই মাধ্যমে উদাত্তরূপে
মানবিক মূল্যবোধগুলি স্থাপিত করেন। তাঁর শাব্দিক মিতব্যয়ীতা, সুক্ষ্ম লয়-বোধ এবং ভব্য
চিত্রকল্প হিন্দি কবিতার প্রাপ্তি। তাঁর প্রথম দুটো কাব্যসংগ্রহে – কুছ কবিতায়েঁ
এবং কুছ অউর কবিতায়েঁ – এর প্রমাণ
পাওয়া যায়। ত্রিলোচন অওয়ধের লোকজীবনের অসাধারণ চিত্রশিল্পী। ধরতী এবং তাপ কে তায়ে হুয়ে দিন, এ দুটো সঙ্কলনেই
তাঁর নানা ধরণের কবিতা সংগৃহীত রয়েছে, কিন্তু হিন্দি কবিতায় তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান তাঁর
সনেট-সংগ্রহ, দিগন্ত । সনেট একটি বিদেশী কাব্যরূপ, কিন্তু হিন্দির সুপরিচিত
রোলা ছন্দে সনেট রচনা করে ত্রিলোচন এই রূপটিকে হিন্দির আপন করে নিয়েছেন। ত্রিলোচন মূলতঃ
সামাজিক চেতনাসম্পন্ন কবি। কবিতায় অন্তর্বস্তুর মত তার রূপটিকেও তিনি গুরুত্ব দেন।
তাঁর বিপরীতে মুক্তিবোধ মূলতঃ রাজনৈতিক কবি, কিন্তু কবিতায় স্লোগান ও কুচকাওয়াজের গান
থেকে দূরে থাকেন। রূপ-সচেতন কবির মত ‘ফর্ম’কে তিনি গুরুত্ব দেন নি, কিন্তু ফ্যান্টাসির
সাহায্যে তিনি কবিতার যে নতুন কাঠামো তৈরি করলেন তা সম্পূর্ণ হিন্দি কবিতায় এক যুগান্তর
এনে উপস্থিত করল। মুক্তিবোধ রাজনীতিকে প্রতিদিনকার রাজনীতির মত করে নেন নি, তাকে আধুনিক
মানুষের নিয়তির সমার্থক প্রতিশব্দ করে নিয়েছেন এবং বৈপ্লবিক রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন
অত্যন্ত শক্তিশালী কবিতা লিখেছেন। দু’তরফা ছিল তাঁর সংগ্রাম। একদিকে তিনি অস্তিত্ববাদ-প্রভাবিত
নতুন কবিতার সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্যদিকে সংগ্রাম চলছিল প্রগতিশীল কবিতার
সঙ্কীর্ণতাবাদী প্রবৃত্তির সাথে। অবাক হওয়ার মত কিছু নয় যে শমশের এবং ত্রিলোচনের সঙ্গে
তিনিও উপেক্ষিত রইলেন প্রগতিশীল সমালোচনায়, এবং যতদিন জীবিত ছিলেন, তাঁকে খাঁটি প্রগতিশীল
কবি হিসেবে স্বীকার করা হয়নি। কিন্তু এটা ঐতিহাসিক সত্য যে ১৯৬৪তে তাঁর মৃত্যুর পর
যখন তাঁর প্রথম কাব্যসংগ্রহ চাঁদ কা মুঁহ টেঢ়া হ্যায় এবং তাতে সংগৃহীত মহান কবিতা ‘আন্ধেরে মে’ প্রকাশিত
হল, তখন নই কবিতার প্রাসাদ তো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলই, প্রগতিশীল কবিতাও আর তা রইল না
যা আগে ছিল।
বিশ শতকের হিন্দি কবিতার ইতিহাসে তারসপ্তক
এর প্রকাশন একটি ঘটনা। এই কাব্যসঙ্কলনটি ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এর পরিকল্পনার
বিষয়ে এতে সঙ্কলিত কবিরা বিগত বছরগুলোতে অনেক কথা বলেছেন। তাতে যে তথ্য উঠে এসেছে,
তা হল যে তারসপ্তক বস্তুতঃ হিন্দির
প্রগতিশীল কবিদের আয়োজন ছিল। যেহেতু সে সময় অজ্ঞেয় নিজেও প্রগতিশীল শিবিরেই ছিলেন তাই
তাঁকে সম্পাদক করা হল। কিন্তু তিনি সঙ্কলনটির ভূমিকায় এবং নিজের বক্তব্যে এমন কিছু
কথা বললেন যে সঙ্কলনটি তার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে একটি প্রগতি-বিরোধী প্রকাশনে
পরিণত হয়েছে এমন মনে করা হল। উদাহরণস্বরূপ, দু’একটি কথা দেখা যাক। অজ্ঞেয় লিখলেন, সঙ্কলিত
কবিরা ‘পথের অন্বেষক’ অথবা লিখলেন যে ‘আধুনিক যুগের সাধারণ ব্যক্তিমানুষ যৌন নিষেধাবলির
পুঞ্জ’। তারসপ্তক এ সঙ্কলিত সাতজন কবির মধ্যে চারজন – মুক্তিবোধ, নেমিচন্দ্র
জৈন, ভারতভূষণ আগরওয়াল এবং রামবিলাস শর্মা – ঘোষিত মার্ক্সবাদী ছিলেন এবং দুজন – প্রভাকর
মাচওয়ে ও গিরিজা কুমার – ঘনিষ্ঠভাবে প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। তা সত্ত্বেও সম্পাদক
কর্তৃক ভুল জায়গায় জোর দেওয়ার কারণে সঙ্কলনটি প্রগতিশীলতা থেকে ভিন্ন কোনো দিকের সন্ধানী
প্রতিপন্ন হল। প্রশ্ন করা যেতে পারে যে যখন উপরুল্লিখিত কবিরা প্রগতিশীলই ছিলেন তখন
আলাদা করে এই আয়োজনের প্রয়োজন কী ছিল। এ বিষয়ে জ্ঞাতব্য যে এঁরা এমন প্রগতিশীল কবি
ছিলেন, প্রগতিশীল কবিতার নির্ধারিত কাঠামোটি নিয়ে যাঁদের অসন্তোষ ছিল এবং কন্টেন্ট
ও ফর্ম, দুই ক্ষেত্রেই নতুন মাটি কোপাতে চাইছিলেন। সামাজিকতায় তাঁদের আগ্রহ ছিল কিন্তু
কবিতায় ব্যক্তিত্বের নিষেধকে ভুল মনে করতেন। তারসপ্তক কে প্রগতিবিরোধো মনে করা
বিদ্বানেরা শুধু এটিকে ব্যক্তিবাদী কবিতার সঙ্কলন বলেই থামলেন না, পটভূমি থেকেও বিচ্ছিন্ন
করে দেখলেন সঙ্কলনটিকে। আজ এ কথাটি বলার প্রয়োজন, বোধহয় আর নেই যে মুক্তিবোধ তারসপ্তকীয়
প্রগতিশীল কবিতারই অবদান। মুক্তিবোধ থেকে শুরু করে ডঃ শর্মা অব্দি নিজেদের সমালোচনামূলক
লেখায় ন্যায়সঙ্গত আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকলেন যে তারসপ্তককে প্রগতিশীল কবিতার সঙ্কলন
স্বীকার করা হোক এবং আধুনিকতাবাদী কবিতার প্রস্থানবিন্দু রূপে যেন এটিকে চিহ্নিত না
করা হয়। ১৯৫১য় যখন দূসরা সপ্তক প্রকাশিত
হল, যাতে গীতিকবিতার প্রাধান্য ছিল, তখন মুক্তিবোধ এবং ডঃ শর্মা দুজনেই ক্ষোভ প্রকাশ
করলেন যে তার সপ্তক এর ধারাটিকে ভুল দিকে চালিত করা হয়েছে। সে হয়ে থাকুক অথবা
না হয়ে থাকুক, এটা তথ্য যে দূসরা সপ্তক
স্বাধীনতার পর হিন্দি কবিদের প্রথম অভিব্যক্তি। বাস্তববাদ এই সঙ্কলনে চাপা,
কিন্তু লুপ্ত নয় এবং গীতিকবিতার প্রাধান্য সত্ত্বেও বলিষ্ঠ সঙ্কেত রয়েছে যে হিন্দি
কবিতার বিকাশ আধুনিকতাবাদ থেকে ভিন্ন দিকেও সম্ভব। দূসরা সপ্তক এর কবিরা হলেন
ভবানীপ্রসাদ মিশ্র, শকুন্ত মাথুর, হরিনারায়ণ ব্যাস, শমশের, নরেশ মেহতা, রঘুবীর সহায়
এবং ধর্মবীর ভারতী। আধুনিকতাবাদী এদের মধ্যে কেউ নয় এবং ব্যাসজী, শমশের, নরেশ মেহতা
এবং রঘুবীর সহায় তো প্রত্যক্ষভাবে প্রগতিশীল। অন্যান্য কবিরাও কেউ প্রগতি-বিরোধী নয়।
এটা ঠিক যে শমশের হন বা রঘুবীর সহায়, এঁরা কেউ প্রগতিশীলতার বাঁধাধরা পথে চলার লোক
নন। দুই কবিই পরবর্তী কালে যেভাবে নিজেদের কাব্য বিকশিত করলেন তা হিন্দি কবিতার গৌরব।
নরেশ মেহতাও নিজের কাব্য স্বতন্ত্র ঢঙে বিকশিত করলেন এবং ধর্মবীর ভারতীও, যাঁর অন্ধাযুগ
এবং কনুপ্রিয়া আধুনিক হিন্দি কবিতার পরম প্রাপ্তি। ভবানী মিশ্র
হিন্দি কবিতাকে কথোপকথনের ভাষার ঢঙ দিলেন এবং হাল্কা চালে গভীর কথা বলবার শিল্পও। এসব
কিছু দেখার পর দূসরা সপ্তক এর উদ্দেশে ব্যক্ত, মুক্তিবোধ এবং ডঃ শর্মার ক্ষোভ
খুব একটা ন্যায়সঙ্গত মনে হয় না। হতে পারে যে গীতিকবিতামূলক কন্ঠস্বর অথবা মোহজনিত উল্লাসের
কন্ঠস্বর জীবন ও সমাজের কঠোর বাস্তবের সাথে সম্পর্কহীন, কিন্তু কী এমন জরুরী যে কবিতা
সরল রেখাতেই এগোবে এবং কবিরা একদিকে চলেই লক্ষ্য অব্দি পৌঁছোবে?
এখানে দুটো শব্দের ব্যাখ্যা করা জরুরী – ‘প্রয়োগবাদ’
এবং ‘নই কবিতা’। এই দুটো শব্দের প্রচলনের পিছনে কোনো না কোনো ভাবে সপ্তকদুটোর সম্পাদক
অজ্ঞেয়ই রয়েছেন। তার সপ্তক এর ভূমিকায় সঙ্কলিত কবিদের বিষয়ে তিনি বলেছিলেন যে
তাঁরা কবিতাকে ‘প্রয়োগ’ [পরীক্ষা নিরিক্ষা] এর বিষয় মনে করেন। সঙ্কলনটি প্রকাশিত হওয়ার
দু’তিন বছর অব্দি এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন আলোচনা হওয়া শুরু
করল, তখন বিদ্বানেরা ‘প্রয়োগ’ শব্দটিকে ধরে নিলেন এবং তার সপ্তক এর কবিতাগুলোকে
তাঁরা প্রয়োগবাদী বলতে শুরু করলেন। দূসরা সপ্তক এর প্রকাশনার পর অজ্ঞেয় একটি
রেডিও ইন্টারভিউতে সপ্তকীয় কবিতাগুলির জন্য ‘নই কবিতা’ নাম প্রস্তাবিত করলেন। এই কথায়
অনুপ্রেরিত হয়ে এলাহাবাদ থেকে জগদীশ গুপ্ত প্রভৃতি বিদ্বানেরা ‘নই কবিতা’ নামে একটি
পুস্তক-পত্রিকা প্রকাশ করলেন, নতুন লেখালিখির জগতে যার ব্যাপক প্রচার হল। তারপর থেকেই
বিদ্বানেরা ‘প্রয়োগবাদ’ এবং ‘নই কবিতা’ নিয়ে চিন্তাভাবনা করে আসছেন। কয়েকজন বিদ্বান
‘নই কবিতা’কে ‘প্রয়োগবাদ’এরই ক্রমোন্নতি মনে করেন আবার কয়েকজন ‘নই কবিতা’কে ‘প্রয়োগবাদ’
থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বলেছেন। যে বিদ্বানেরা দুটোকে আলাদা মনে করেন, তাঁরা ‘নই কবিতা’কে
বাস্তববাদ-প্রভাবিত মনে করেন আর ‘প্রয়োগবাদ’কে বাস্তববাদ-বিরোধী অস্তিত্ববাদ-প্রভাবিত
মনে করেন। যদি বাস্তববাদ অর্থে তাঁরা প্রগতিশীল বা সমাজবাদী বাস্তববাদ বোঝাতে চান এবং
অস্তিত্ববাদকে সবদিক থেকে বাস্তববাদ-বিরোধীই মনে করেন তাহলে বলতে হবে দু’জায়গাতেই তাঁরা
চরমপন্থা অবলম্বন করছেন। সত্য এটাই যে ‘নই কবিতা’ ‘প্রয়োগবাদ’এর সাথে সম্পর্কিতও আবার
আলাদাও। এভাবে এ দুটোই ছায়াবাদোত্তর হিন্দি কবিতার কিছুটা জটিল অগ্রগতির দিকে ইংগিত
করে, এর বেশি কিছু নয়। অকারণ নয় যে তার সপ্তক এর মাচওয়ে, গিরিজাকুমার এবং অজ্ঞেয়র
মত কবিরা ষাট-সত্তরের দশকেও যথেষ্ট সক্রিয় থাকেন এবং তারও পরে নিজেদের কাব্য-প্রতিভার
শীর্ষে পৌঁছোন। মাচওয়ের নন-সিরিয়াস কবিতা এবং গিরিজাকুমারের গীতিমূলক পরীক্ষানিরীক্ষা
নিঃসন্দেহে হিন্দি কবিতারই প্রাপ্তি। কিন্তু তার সপ্তক এর আসল অবদান মুক্তিবোধের
সঙ্গে অজ্ঞেয়। মুক্তিবোধের বিষয়ে ওপরে বলা হয়েছে। কবি হিসেবে অজ্ঞেয়র ক্রমবিকাশের পুরো
কালটাতার সপ্তক এর প্রকাশনার পর। পঞ্চাশের দশকের শেষ বছরগুলোয় তাঁর যুগান্তকারী
কাব্যসংগ্রহ হরী ঘাস পর ক্ষণ ভর প্রকাশিত
হয়। এই সঙ্কলনটি হিন্দি কবিতার ভাষাকে উচ্চতর স্তরে নিয়ে গেল এবং সংবেদনাকে আধুনিক
রূপ দিল। তাঁর বাকি তিনটি কাব্যসংগ্রহ – বাওরা অহেরী, ইন্দ্রধনু রওন্দে হুয়ে থে
এবং অরী ও করুণা প্রভাময় – ষাটের
দশকের অবদান, যে দশকটি ‘নই কবিতা’র উৎকর্ষের কাল এবং যার গভীর প্রভাব রয়েছে অজ্ঞেয়র
ওপর। ১৯৬১তে তাঁর শেষ গুরুত্বপূর্ণ কাব্যসঙ্কলন আঙ্গন কে পার দ্বার প্রকাশিত হল যাতে তাঁর দীর্ঘ কবিতা ‘অসাধ্য বীণা’
সঙ্কলিত রয়েছে। অজ্ঞেয় মুক্তিবোধের 'এ্যান্টি-থিসিস’, কেননা তাঁর কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতির
প্রাধান্যই শুধু নেই, ধীরে ধীরে তাঁর কবিতা মিস্টিক হয়ে চলেছে। কিন্তু তার মানে এ নয়
যে তাঁর কবিতায় আধুনিক জীবনের বাস্তব উন্মোচিত হয় নি। বাস্তব কোনো সীমিত জিনিষ নয়,
তার রূপও এক নয়। অজ্ঞেয় নিঃসন্দেহে নিজের বিপুল কাব্যে আধুনিক জীবনের বাস্তবতার সংবেদনাকে
অনেক রূপে এবং স্তরে উন্মোচিত করেছেন। হিন্দির পূর্ববর্তী কবিতায় যে গুরুত্ব মৈথিলীশরণ
গুপ্ত এবং নিরালার, ছায়াবাদোত্তর হিন্দি কবিতায় অনেকটা সেরকমই গুরুত্ব মুক্তিবোধ এবং
অজ্ঞেয়র।
১৯৫৯ সালে তীসরা সপ্তক প্রকাশিত হল। একে দূসরা সপ্তক এর প্রসার মানতে কোনো ক্ষতি নেই, কেননা এতেও সেই জাতেরই গীতিময়তা রয়েছে এবং চিত্রকল্পে সেই তাজা ভাব বজায় রয়েছে। এই সঙ্কলনের উল্লেখযোগ্য কবি কেদারনাথ সিং, কুঁঅর নারায়ণ, বিজয়দেব নারায়ণ সাহী এবং সর্বেশ্বরদয়াল সক্সেনা। এই কবিরা পরবর্তী বছরগুলোয় নিজেদের কাব্যের বিকাশ-পথ সন্ধান করেছেন। কেদারনাথ সিংকে নিয়ে আলোচনা পরে করব। বাকি তিনজন কবির বিষয়ে টিপ্পনী করা এখানে আবশ্যক। কুঁঅর নারায়ণ এবং সর্বেশ্বরদয়াল দুজনেই অস্তিত্ববাদ-প্রভাবিত ছিলেন কিন্তু দুজনেরই সম্মুখে নিজেদের সৃজনাত্মক সংগ্রামটাও ছিল। কুঁঅর নারায়ণ ব্যক্তির সাথে সমাজের সামঞ্জস্য বিধান চাইতেন আর সর্বেশ্বর ব্যক্তির সাথে লোক-এর। কুঁঅর নারায়ণ আত্মজয়ী র মত প্রবন্ধ-মূলক কৃতি দিলেন এবং ধীরে ধীরে অস্তিত্ববাদের প্রভাব থেকে ছাড়া পেয়ে কবিতায় সমগ্র জীবন-বাস্তবতা চিত্রিত করার প্রয়াসী হলেন। সর্বেশ্বরের ক্রমবিকাশও কিছুটা এই পথেই হল। তাঁর অস্তিত্ব-চেতনায় শেষ পর্য্যন্ত লোক-চেতনা আধিপত্য বিস্তার করল এবং কাব্যরচনার শেষ পর্য্যায়ে নকশালপন্থী কবি রূপে পরিচিত হলেন। সাহী প্রথম থেকেই ‘নই কবিতা’য় অস্তিত্ববাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত রইলেন এবং অন্যদিকে প্রগতিশীলতারও সুনিশ্চিত ধারণার বিরুদ্ধে রইলেন। তাঁর কবিতা সঙ্কলন মছলীঘর থেকে সাখী অব্দি তাঁর ক্রমবিকাশ খুবই পরিণত কবি হিসেবে হল। এই সমস্ত কবিরা ব্যাপ্ত বাস্তবতার আলাদা আলাদা দিকের আলাদা আলাদা ঢঙে ছবি এঁকে সদর্থে হিন্দি কবিতায় বাস্তববাদী যুগের প্রসার ঘটালেন।
১৯৬০এর পর হিন্দি কবিতার দৃশ্যপট আবার একবার
বদলায়। ‘নই কবিতা’ শেষ কথায় মূল্যবাদী কবিতা ছিল। আধুনিক যুগের মূল্যবোধগত সঙ্কটের
বোধ ছিল নিশ্চয়ই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টাও ছিল। তীসরা
সপ্তক এর প্রকাশনের সাথ ‘নই কবিতা’ যেন নিজের চরম উৎকর্ষে পৌঁছে তেজী ভাবটা হারিয়ে
ফেলে। ভাষা, চিত্রকল্প, ছন্দ-লয় এবং সংবেদনা পুরোনো হতে থাকে। ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতিতেও
সে সময় পরিবর্তনের চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল। ১৯৬২তে চীনের আক্রমণের পর নেহরু-যুগের বিরুদ্ধে
মোহ-মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হল। পরিণতি দেখা গেল ১৯৬৭র সাধারণ নির্বাচনে, যখন উত্তর
ভারতের আট ন’টি রাজ্যে কংগ্রেসের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটল এবং মেলজোলের সরকার গড়ার নতুন
যুগ শুরু হল। এই সরকারগুলির বিরুদ্ধে মোহ-মুক্তি ঘটতেও দেরি হল না। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও
ভীষণ উত্তেজনার পরিবেশ ছিল। একদিকে ভিয়েতনামের মাটিতে ভিয়েতনামী জনতা নিজেদের স্বাধীনতার
জন্য আমেরিকার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে লড়ছিল। অন্যদিকে চীন আর সোভিয়েত সঙ্ঘের সম্পর্কে
ফাটল ধরছিল। ভারতে পশ্চিমবঙ্গে ১৯৬৭র পর নকশালপন্থার অভ্যুদয় ঘটেছিল, মাওবাদ জুটিয়েছিল
তাদের প্রেরণা। এই পরিবেশ হিন্দি কবিতাকেও প্রভাবিত করল এবং সেখানেও শুরু হল ভাঙচুর।
রঘুবীর সহায়, কেদারনাথ সিং এবং শ্রীকান্ত বর্মা ‘নই কবিতা’র কবি ছিলেন, কিন্তু এই যুগেই
তাঁরা নিজেদের বিকশিত করলেন। ‘নই কবিতা’র সময়কালেও রঘুবীর সহায় অস্তিত্ববাদী ধারার
বিরুদ্ধে ছিলেন, যে কারণে ‘নই কবিতা’র তাত্ত্বিক লক্ষ্মীকান্ত বর্মা তাঁকে ‘নয়া কবি’
মানতে অস্বীকার করেন। ষাট-পরবর্তী দশকে নিজের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তিনি ছাড়লেন না,
কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে সুবিধাবাদ ও দুর্নীতি যে মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে উঠেছিল, নিজের
কবিতায় তাকে উলঙ্গ করে ছাড়লেন। সাংবাদিক ছিলেন তিনি, তাই ভাষাটা খবরের কাগজের ছিল,
কিন্তু তাতে যে ব্যঙ্গ-বক্রতা থাকত তার শিল্পগুণ অসাধারণ। সব মিলিয়ে তাঁর ভঙ্গী ছিল
আক্রমণাত্মক, যা তাঁকে ষাট-পরবর্তী কবিতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবির স্থান দিল। তাঁর
কাব্যসঙ্কলন আত্মহত্যা কে বিরুদ্ধ এই যুগের কবিতার নিদর্শন। রঘুবীর সহায়ের তুলনায়
শ্রীকান্ত বর্মার মোহমুক্তি আক্রোশের সীমায় পৌঁছোল, যার ফলে শুধু আক্রমণাত্মকই নয়,
নিষেধ আর সিনিসিজ্মের চরমে গিয়ে তিনি কবিতা লিখলেন। তাঁর এমনই কবিতার সঙ্কলন মায়াদর্পণ
। জ্ঞাতব্য যে শ্রীকান্ত এখানেই থেমে গেলেন না। নিজের সৃজনকর্মের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে
মগধ এর মত কাব্যগ্রন্থ উপহার দিলেন যাতে ইতিহাসের মাধ্যমে সমকালীন রাজনীতিক
এবং সামাজিক বাস্তবতার ওপর বিলক্ষণ মন্তব্য রয়েছে। কেদারজি ‘নই কবিতা’র লোকচেতনা-সম্পন্ন
কবি ছিলেন, কিন্তু তাঁর একটি অন্য প্রবৃত্তিও ছিল – শহুরে এবং আধুনিক। সত্তরের দশকে
তাঁর এই প্রবৃত্তিতে উৎকর্ষ এল, সম্ভব করল তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কলন জমীন
পক রহী হ্যায় এর কবিতাগুলি। পরের বছরগুলোতে তিনি ‘বাঘ’ নাম দিয়ে একটি নতুন ধরণের
দীর্ঘ কবিতা লিখলেন। তারপর উত্তর কবীর নামেও একটি কবিতা লিখলেন। ডঃ নামওয়র সিং
সত্তরের দশকের এই কবিতাটিকে ‘যুবা কবিতা’র অভিধা দিলেন, কেননা এসব কবিতা সেই কবিরা
লিখলিছেন যাঁরা গভীরভাবে সত্য ও সততার প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন; মিথ্যা, স্বার্থপরতা এবং
ছলনায় ভরা দুনিয়াদারির শিকার হয়ে পড়েন নি।
যুব কবিতার আপন কবি অবশ্য অন্যেরা ছিলেন যাঁদের
মধ্যে ধুমিল এবং রাজকমল চৌধুরি বিশেষভাবে উল্লেখ্য। ধুমিল ‘নই কবিতা’র ভাষা এবং মূল্যবোধ
ছিন্নভিন্ন করে এক পরিবর্তিত ভঙ্গীতে আক্রোশের এমন কবিতা লিখলেন যা যুব কবির মনের অবস্থার
অনুরূপ ছিল। ওই ভঙ্গীতে একটা মেঠো ভাব ছিল একদিকে, অন্যদিকে অত্যন্ত শিল্প-সমৃদ্ধ ইডিয়ম
রচনার ক্ষমতা। আশ্চর্যের কিছু নেই যে ধুমিলের শব্দবন্ধগুলো হিন্দি এলাকায় কবিতার নতুন
পাঠকদের মধ্যে সুত্রবচনের মত চাউর হয়ে গেল। এই সময় অন্য কবিতাগুলির সাথে তাঁর ‘পটকথা’
নামের দীর্ঘ কবিতা প্রকাশিত হল এবং অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেল। কিন্তু এসব কিছুর পরেও ধুমিল
দৃঢ় সামাজিক চেতনার কবি ছিলেন যিনি পরবর্তী দিনে উগ্র বামপন্থার দিকে গেলেও নিষেধ ও
সিনিসিজ্মের দিকে গেলেন না। মূলতঃ প্রগতিশীল কবি ছিলেন উনি, যিনি প্রগতিশীল কবিতার
সমস্ত প্রথাকে ধ্বংস করলেন এবং এক ভিন্ন ধরণের বিপ্লবী কবিতার নির্মাণ করলেন। তাঁর
বিপরীতে রাজকমল আমেরিকার বীট ও বাংলার হাংরি জেনারেশনের কবিতার প্রভাবে ছিলেন; তাঁর
স্বাধীনতার ধারণা অনেকটাই নৈরাজ্যবাদী ছিল। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দিতে ‘অকবিতা’র যে আন্দোলন
চলেছিল, তারই সমগোত্রীয় কবি ছিলেন রাজকমল। তাতে মূল্যহীনতাকেই মূল্য মেনে নেওয়ার প্রবৃত্তি
তো আছেই, অশ্লীলতাও আছে। কিন্তু এতে দ্বিমত হবে না কারো যে রাজকমল মুক্তিপ্রসঙ্গ
নামে যে দীর্ঘ কবিতাটি লিখলেন সেটি এত
শক্তিশালী যে কানে সাইরেনের মত বাজতে থাকে। এতে কবি নিজেকে কেন্দ্রে রেখে সম্পূর্ণ
বিশ্বের পরিক্রমা করেছেন। বিদ্যুৎ-চমকে অনাবৃত করেছেন বিশ্বের অসঙ্গত ও অমানবিক বাস্তবতা।
‘যুবা কবিতা’র অন্য কবিরা হলেন কুমারেন্দ্র পারসনাথ সিং, কমলেশ, জগদীশ চতুর্বেদি, সৌমিত্র
মোহন, কৈলাশ বাজপেয়ী, লীলাধর জগুড়ি এবং চন্দ্রকান্ত দেবতালে। এঁদের মধ্যে কৈলাশ বাজপেয়ী,
জগুড়ি এবং দেবতালে পরে স্বতন্ত্র পথে নিজেদের বিকশিত করেছেন।
আশি-নব্বইয়ের দশকে আবার এক নতুন কবি প্রজন্ম
সামনে চলে আসে যাতে শামিল থাকেন বিজেন্দ্র, ঋতুরাজ, কুমার বিকল, বেণুগোপাল, আলোকধন্বা
থেকে শুরু করে রাজেশ জোশি, অরুণ কমল, উদয় প্রকাশ অব্দি। এই কবিদের বিশেষত্ব যে এঁরা
সবাই বামপন্থী। এই প্রজন্মটি আসার পিছনে ছিল কিছু পরিস্থিতিজনিত কারণ। তার মধ্যে কয়েকটির
উল্লেখ করা আবশ্যক। সেগুলো হল – স্বাধীনতার সংগ্রামে ভিয়েতনামের চুড়ান্ত জয়, মাওবাদের
ব্যাপক প্রচার, ভারতীয় রাজনীতিতে কম্যুনিস্টদের বাড়তে থাকা ভূমিকা, প্রগতিশীল লেখক
সঙ্ঘের পুনর্গঠন, মুক্তিবোধ রচনাবলীর প্রকাশন এবং আন্দোলনের মত করে প্রেমচন্দের জন্মশতাব্দীবর্ষ
উদযাপন। উপরুল্লিখিত কবিদের মধ্যে প্রথমে কুমার বিকল, বেণুগোপাল এবং আলোকধন্বা নতুন
সৃজনীশক্তি নিয়ে এসেছিলেন। এঁদের মধ্যে ঈর্ষণীয় বাগ্মিতা-শিল্প এবং নাটকীয়তা ছিল, তাই
তিনজনেই ভালো জনপ্রিয়তা পেলেন। কিন্তু এদের মধ্যে একমাত্র আলোকধন্বা নিজেকে সঠিক পথে
চালিত করলেন, যদিও এখন অব্দি তাঁর একটিই কাব্য সঙ্কলন পকাশিত – দুনিয়া রোজ বনতী
হ্যায় । কবি ধীরে ধীরে নিজের কবিতাকে অতিরিক্ত বৈপ্লবিকতা ও নাটকীয়তা থেকে মুক্ত
করলেন এবং এক গভীর ও সুক্ষ্মদর্শী মানবিক কন্ঠস্বর দিলেন। কিছুদিন পর রাজেশ যোশি, অরুণ
কমল এবং উদয় প্রকাশ কবিতায় অত্যন্ত সরল ও আটপৌরে কন্ঠস্বর নিয়ে এলেন যেটা ধুমিলের প্যাঁচালো
ইডিয়মের পর খুবই কাছের মনে হল। পরের বছরগুলোয় রাজেশ এবং উদয়ের ক্রমবিকাশের স্পষ্ট চিহ্ন
দৃষ্টিগোচর হয়, একজনের মেজাজ রোমান্টিক, অন্যজনের বাস্তবতাবাদী। হিন্দি কবিতায় এই সমস্ত
কবিদের বিরাট বড় অবদান যে ‘অকবিতা’র যুগটাকে এঁরা শুধু শেষই করলেন না, কবিতায় প্রগতিশীল
মূল্যবোধ আবার প্রতিষ্ঠিত করলেন। কিন্তু এই প্রসঙ্গে এটাও উল্লেখ্য যে এঁদের প্রগতিশীলতা
যথাসম্ভব প্রথামুক্ত ছিলএবং কবিতায় এঁরা সমাজকে গুরুত্ব দিলেন, রাজনীতিকে নয়। এটা দেখে
একজন লেখক ন্যায়সঙ্গতভাবে এঁদের কবিতাকে ‘নবপ্রগতিবাদ’এর অবদান বলেছেন।
এই কবিদের সমান্তরাল একটি অন্য কবি-প্রজন্মও
হিন্দিতে সক্রিয় ছিল যার সদস্য হলেন বিনোদ কুমার শুক্ল, বিষ্ণু খরে, মঙ্গলেশ ডবরাল,
গিরিধর রাঠি, অসদ জৈদি এবং বিষ্ণু নাগর। এঁরাও সবাই প্রগতিশীল ও বামপন্থী মূল্যবোধেই
আস্থাবান কিন্তু কবিতায় কোনো পূর্বনির্ধারিত কাঠামো মেনে চলতে চান না। ভাবধারা, কবিতার
অন্তর্বস্তু এবং কাঠামো – সবদিক থেকেই এঁরা স্বতন্ত্র। একটি বিশেষ ব্যাপার এই যে হিন্দির,
পূর্ববর্তী প্রগতিশীল কাব্যধারার সাথে আপাতদৃষ্টিতে এঁদের কোনো সম্পর্ক দেখা যায় না।
এমনকি একটা দূরত্ব অব্দি এঁদের মধ্যে “অর্থবহুলতা, অস্থির মনের প্রভাবের চিত্রণ এবং
অস্পষ্ট ব্যাঞ্জনার প্রতি আগ্রহ”ও দেখা যায়, যে কারণে কিছুটা ভিন্ন অর্থে এঁদের ‘আভাঁগার্দ’
কবিও বলা যায়। প্রসন্নতার কথা যে ধীরে ধীরে এঁদের মধ্যে স্পষ্টতা আসতে শুরু করেছে,
ফলস্বরূপ এঁরা আজ বেশি কমিউনিকেটিভ হয়ে উঠেছেন। এঁদের মধ্যে বিনোদ কুমার শুক্ল এবং
বিষ্ণু খরের কবিতার আকর্ষণ বিলক্ষণ। বিনোদ কুমার শুক্লের কবিতার আকর্ষণ তৈরি করে তাঁর
শিল্পের বৈশিষ্ট। বিষ্ণু খরের কবিতাকে আকর্ষক করে তোলে তাঁর নিখুঁত লক্ষ্যভেদী বর্ণনামূলকতা।
এখানেই আমাদের জ্ঞানেন্দ্র পতির মত কবিরও উল্লেখ করে দেওয়া উচিৎ, যিদিও প্রথম থেকেই
উনি স্পষ্ট এবং কমিউনিকেব্ল। এই সব কবিদের সাথে তাঁকে রাখার কারণ এই যে তিনিও নিজের
চিন্তাধারার ওপর কারো নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করেন না এবং একই সঙ্গে তৎসম ও তদ্ভব শব্দে
তৈরি তাঁর কাব্যভাষাটি বিশিষ্ট। এ ধরণের ভাষায় গতিময়তা কম কিন্তু সৃজনশক্তি ভরপুর।
জ্ঞানেন্দ্রের দায়বদ্ধতা শুধুই সাধারণ মানুষের প্রতি, আর কারো প্রতি নয়। আমার বলতে
দ্বিধা নেই যে আলোকধন্বাকে বাদ দিলে, সমকালীন জীবনের সংশ্লিষ্ট বাস্তবতাটিকে এই তথাকথিত
‘আভাঁগার্দ’ কবিরা নিজেদের কবিতায় বেশি ভালো ভাবে তুলে ধরেছে। আশি-নব্বইয়ের দশকে উঠে
আসা সব কবির সঙ্কলন প্রকাশিত। আমার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে ওই সঙ্কলনগুলোর তুলনামূলক
অধ্যয়ন উপযোগী হবে।
শেষে আমি সেই কবি-প্রজন্মটিরও উল্লেখ আবশ্যক মনে করি যেটি বিশ শতকের শেষ দুই দশকে অস্তিত্বে এসেছে। এই কবিরাও কমবেশি বামপন্থী প্রবণতা রাখেন কিন্তু এঁদের কন্ঠস্বর কোনোভাবেই রাজনৈতিক নয়। এঁদের কবিতার পৃষ্ঠভূমি এবং পার্শ্বভূমিতে সমকালীন বিশ্বে এবং দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি রয়েছে, যার মধ্যে তিনটে প্রধান – সোভিয়েত সঙ্ঘের পতন, একমেরু-বিশ্বের আবির্ভাব, বিশ্বায়নের নামে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর বাজারের ওপর এগিয়ে থাকা দেশগুলোর আক্রমণ। এই ঘটনাবলী নবীনতম প্রজন্মের কবিদের ভাবতে বাধ্য করেছে। ফলে তাঁদের কবিতায় বাস্তবতার তীব্র রূপ তো এসেছে কিন্তু প্রগতিশীল কবিদের কন্ঠস্বরে যে একটা চুড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলকতা থাকত, সেটা শেষ হয়ে গেছে। এঁরা কবিতায় কোনো একটি কাঠামো স্বীকার করেন নি। বাস্তবতাবাদ এবং ফ্যান্টাসি মিলিয়ে এঁরা নানা ধরণের কবিতা লিখেছেন – প্রচুর টাটকাভাব আছে সেসব কবিতায়। কুমার অম্বুজ, বদ্রী নারায়ণ, দেবীপ্রসাদ মিশ্র, বোধিসত্ত্ব, একান্ত শ্রীবাস্তব, নিলয় উপাধ্যায়, সঞ্জয় কুন্দন এবং প্রেমরঞ্জন অনিমেষ এই প্রজন্মের প্রতিনিধি কবি। এই কবিদেরও কাব্য সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায় এঁরা এখনও ক্রমবিকাশের পর্য্যায়ে।
৩
বিশ শতকের হিন্দি কবিতা সম্পর্কে জানার কথা
এই যে একটি যুগ বা জমানা সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে সেই যুগ বা জমানার কবিতা ফুরিয়ে যায়
নি। পূর্ববর্তী যুগের কবিরা পরবর্তী যুগেও সক্রিয় থেকেছেন এবং অনেকবার এমন হয়েছে যে
কবির সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিটি তাঁর যুগ পেরিয়ে যাওয়ার পর রচিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, দ্বিবেদিযুগের
শ্রেষ্ঠতম কৃতি সাকেত এর প্রকাশনার বছর ১৯৩১, যেটা ছায়াবাদের উৎকর্ষের সময় আর
কামায়নী র প্রকাশনার বছর ১৯৩৬, প্রগতিবাদের উদয়ের সময়।
তেমনই মুক্তিবোধের যুগান্তকারী কাব্যসঙ্কলন চাঁদ কা মুঁহ টেঢ়া হ্যায় প্রকাশিত হল ১৯৬৪তে, প্রগতিবাদের জমানা শেষ হয়ে যাওয়ার পর। পন্থ, দিনকর, নাগার্জুন, অজ্ঞেয়, রঘুবীর সহায় এবং কেদারনাথ সিংও লাগাতার সক্রিয় থেকেছেন। বিপুল কাব্যসম্ভার সৃজন করেছেন তাঁরা এবং হিন্দি কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। এঁদের মধ্যেকার কিছু কবি দৃশ্যপটে ব্যাপ্ত হয়ে থেকেছেন, যেমন নাগার্জুন, অজ্ঞেয় এবং রঘুবীর সহায়। এমনও দেখা গেছে যে এক যুগের কবি অন্য যুগের কবিতার নিয়তির নির্মাণে চুড়ান্ত ভূমিকা পালন করেছেন। নিরালা এবং পন্থ মূলতঃ ছায়াবাদী ছিলেন, কিন্তু প্রগতিবাদের বিকাশে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ যোগদান রয়েছে। এভাবেই অজ্ঞেয় মূলতঃ উত্তর-ছায়াবাদী হয়েও ‘নই কবিতা’কে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মুক্তিবোধের বিষয়েও কথাটা ঠিক। উনি মূলতঃ প্রগতিবাদী ছিলেন কিন্তু ‘যুবা কবিতা’ ওনাকেই নিজেদের নায়ক করে নিল। তৃতীয় কথা এই যে বিশ শতকের হিন্দি কবিতা বাস্তবতার দিকে অনেক ঘুরপথে এগিয়েছে। পথের এই বক্রতা আমরা তখন বুঝতে পারব যখন এই বিকাশ-যাত্রাটিকে দ্বিবেদি-যুগীন গদ্যমূলকতা থেকে পরবর্তী কবিত্তের দিকে যাত্রা হিসেবেই শুধু নয়, ছায়াবাদী কল্পনাশীলতা থেকে পরবর্তী বাস্তবিকতার দিকে যাত্রা হিসেবেও দেখব।
No comments:
Post a Comment