আমার জীবনে আমি ‘প্রবাসী’ শব্দটার কোনোদিন কোনো অর্থ খুঁজে পাইনি। যদি কোনোদিন ভেবেও থাকি যে ‘মূলবাসে’ যাবো একদিন, সেটা ‘ফিরে যাওয়া’ হিসেবে, ‘দেশের বাড়িতে ফিরে যাওয়া’ হিসেবে আসেনি, পশ্চিমবঙ্গে কোথাও একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করে থাকবো কিছুদিন, সারাদিনরাত রাস্তায়, বাজারে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার সুখে বুঁদ হয়ে থাকবো, এই স্বপ্ন হিসেবে এসেছে।
‘প্রবাসী’ শব্দটা
অর্থবহ সামাজিক পরিভাষা হিসেবে ১৯৪৭ অব্দি, বা আরো কিছুদিন টেনে দ্বিতীয়
পঞ্চবার্ষিক যোজনা বাস্তবায়িত হওয়ার কাল অব্দি টানা যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই
অর্থনৈতিক সংকটের চাপে বেশ কিছু সংখ্যক প্রবাসী বাঙালীর দ্বিতীয় প্রজন্ম আর
প্রবাসী থাকেনি। দেশ (এবং বাংলা) ভাগ ‘দেশে ফেরার’ মানসিকতাটাকে আদ্ধেকের বেশি
প্রবাসী বাঙালীর জন্য অপ্রাসঙ্গিক করে দিল। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক যোজনায় প্রস্তাবিত
শিল্পায়ন, সরকারি বা ‘গণ’স্বামিত্বের সংস্থাগুলিকে নেতৃত্বকারী স্থান দেওয়ার
প্রস্তাব এবং ফলতঃ সরকারী বিভাগগুলির প্রসার, স্থায়ী সরকারী চাকরীর সুযোগে বৃদ্ধি
ইত্যাদি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির একটা বড় অংশকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, সবরকম
বাস্তব প্রয়োজনে স্থানীয় করে দিল। তারপরে প্রবাসীত্বের যা বাকি রইলো তা ওই,
কোন্নগরে সরকারি ফ্ল্যাট বুক করে স্বপ্ন দেখা যে অবসরগ্রহণের পর বাংলার মাটিতে
থাকবো, রাজারহাট, নিউটাউন অথবা উত্তর বা দক্ষিণবঙ্গের কোনো শহরে কোনো এক সময়ে
দাদার সাথে কিনে ফেলা জমিতে একটা বাড়ি করে চলে যাওয়া ইত্যাদি। এগুলো প্রবাসীত্বের
হ্যাঙোভার, আর নিজের ভাষাভুমির প্রতি স্বাভাবিক টান।
আর সত্যি কথা বলতে,
নিজ ভাষাভূমির বাইরে অন্যান্য রাজ্যে কখনো সখনো যে (সুপরিকল্পিত) ‘অপরিচিত
বিজাতীয়তা’র অতর্কিত আক্রমণে উপরোক্ত প্রবণতাটা, নিজের ভাষাভূমিতে গিয়ে থাকার
ইচ্ছেটা জোর পায়, আজ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের যুগে নিজ ভাষাভূমিতেও কি
ব্যক্তিমানুষকে সেই অপরিচিত বিজাতীয়তার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না?
এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমি বিহারবাসী বাঙালিদের বা বাংলাভাষী বিহারীদের দেখতে চাই। বাঙলার বাইরে বাঙালী মানেই এক শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক শহরবাসী বাঙালী সম্প্রদায় যাঁরা অচেনা জায়গায় একসাথে হয়ে পুজোপার্বণ, নাটক, বিচিত্রানুষ্ঠান, ক্লাব, খেলাধুলো, সাহিত্যচর্চা এবং আরো এগোলে, বিদ্যালয় স্থাপন, সস্তায় চিকিৎসার ব্যবস্থা ইত্যাদির একটা উজ্জ্বল ইতিহাস গড়ে তুলেছিলেন একসময়। বিহার যেমন বদলেছে, বিহারে সেই বাঙালিরও একটা বিবর্তন ঘটে গেছে।
বিবর্তনের বাহ্য কারক
চারটে। প্রথম, ১৯৭৪এর আন্দোলন থেকে রূপ নিতে থাকা বিহারী যুব-চেতনার (সে চেতনায়
যাকিছু দুর্বলতা থাকুক) প্রেক্ষিতে বাঙালী যুবর (বা তৎকালীন যুবপ্রজন্মের) বহুখন্ডিত
এবং প্রায় অনির্দিষ্ট অবস্থান। বাঙালীর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তখন থেকেই কম হতে শুরু
করেছে।
দ্বিতীয়,
সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক আক্রমণ। নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই
আক্রমণ সারা দেশেই বিপন্ন করে তুলেছে মানুষের ভাষিক-সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব। ত্বরান্বিত
করেছে সমাজের সবকটি ক্ষয়িষ্ণু প্রবৃত্তির বাড়। বিহারবাসী একটি ভাষাগত সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়ের জীবন তার ব্যতিক্রম হবে কেন?
তৃতীয়, বিহার থেকে
ঝারখন্ড নামে এক নতুন রাজ্যের সৃজন। সংখ্যাগত অনুপাতে বিহারে বাংলাভাষী হঠাৎ
দুর্বল হয়ে পড়ায় তার প্রভাব তাদের মানসিকতার ওপরও পড়েছে। (এত ‘দুর্বল’ যে কয়েক বছর
আগে রাজ্যের বাংলাভাষীদের কিছু প্রতিনিধি সমস্যাদি নিয়ে কথা বলতে গেলে বিহার
সরকারের ভারপ্রাপ্ত সরকারী আধিকারিক চমকে ওঠেন, “বিহারে বাঙালী! আছে কোথায়? সব তো
ঝারখন্ডে চলে গেছে!”)
আর চতুর্থ, উপরোক্ত
তিনটের ফলশ্রুতি হিসেবে, সামুদায়িক সাংস্কৃতিক জীবনের ক্ষয়। যার ভুরি ভুরি
দৃষ্টান্ত সাধারণভাবে, বহির্বঙ্গে বাঙালীদের অবস্থা নিয়ে সাম্প্রতিক সব কটি লেখায়
পাওয়া যায়। যথা, ক্লাব ও নাট্যদলগুলির লোপ, পুজোপার্বণে বিশেষকরে বারোয়ারি পুজোয়
বাঙালী পুজোকমিটিগুলোরও অবাঙালী এবং অনেকাংশে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় টিঁকে থাকা,
গ্রন্থাগারগুলির অবলুপ্তি, সংখ্যালঘু বিদ্যালয়গুলোর সংখ্যালঘু পরিচয়ের ওপর আক্রমণ এবং
এমনই আরো অনেক কিছু।
বিবর্তনের আভ্যন্তরীন কারকগুলি সম্পর্কে কিছু বলার আগে ঈষৎ প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া দরকার।
বাঙালীদের ভোট বয়কট!
শুনেছেন অন্য কোনো প্রদেশে? কিন্তু বিহারে ডাক দিয়েছিল বিহার বাঙালী সমিতি। আসলে
উপরোক্ত চারটে বাহ্য কারকের চাপে সম্পূর্ণ অসংগঠিত ও বিচূর্ণ হয়ে পড়া বাঙালী
জাতভিত্তিক রাজনৈতিক সংখ্যাবিন্যাসে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল। জাতভিত্তিক
পালোয়ানির উত্থান, শহরে জমিজমার ব্যাবসার রমরমা ও আইনশৃংখলার সামগ্রিক অবনতি, এই
সব কিছুর কারণে উঠতি প্রমোটার, অপহরণকারী, ছিনতাইবাজ ইত্যাদি সবরকমের দুর্বৃত্তের
প্রধান লক্ষ্য (সফ্ট টার্গেট), বিশেষ করে বাঙালী-অধ্যুষিত শহরগুলোয় হয়ে দাঁড়ালো
বাঙালী মধ্যবিত্ত। এই রকম পরিস্থিতিতে বিহার বাঙালী সমিতির কুশল নেতৃত্ব ধীরে ধীরে
সংগঠনে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করল। উত্তর বিহারের বিভিন্ন জেলায় গ্রামাঞ্চলে
কলোনী গড়ে বসবাসকারী প্রায় পাঁচলক্ষ এককালীন উদ্বাস্তু বাঙালী জনসমুদায় নিজেদের যে
আন্দোলন চালাচ্ছিল, তাদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এল সমিতির ব্যানারে।
পাটনার রাস্তায় বেরুলো মিছিল। জেলায় জেলায় রিলে ধর্না। সমিতির সদস্যতার শ্রেণীগঠন,
দাবীসমূহ এবং তা আদায় করার ধরণধারণ সব কিছু গেল বদলে। গণআন্দোলন একটা নিয়মিত
ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গেল।
কিছুদিন আগে বিহার বাঙালি সমিতির এই দীর্ঘ আন্দোলনের চাপে বিহার সরকার বিহারবাসী বাঙালিদের একটা সার্ভে করিয়েছিল। অবশ্যই সার্ভে করানোর উদ্দেশ্য ছিল বিহারের বিভিন্ন জেলায় গ্রামাঞ্চলে এককালীন পূর্ব পাকিস্তান বা পরবর্ত্তী বাংলাদেশ থেকে আসা যে লক্ষ লক্ষ বাঙালীর বাস, তাদের প্রকৃত অবস্থাটা তুলে ধরা। যথা, তারা কেউ আর উদ্বাস্তু নয়, ছিন্নমূলও নয়, বিহার তাদের থাকার ও চাষবাষ করার জমি দিয়েছে, দুই দশক আগের কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশে সে জমিতে তারা মালিকানাস্বত্বও পেয়েছে, অথচ সেই মালিকানার কাগজ তারা পাচ্ছেনা। তারা বেশির ভাগ দলিত, সরকারি পরিভাষায় তপশীলী জাতির, অথচ জাতি প্রমাণপত্র তারা পাচ্ছে না। স্বাভাবিক ভাবেই, এসবের অভাবে তারা মনরেগার জবকার্ডও পাচ্ছে না, বিপিএল কার্ড পাচ্ছে না ইত্যাদি। আর মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থার অভাব, যেটুকু ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল গত এক শতকেরও বেশী সময় ধরে তার চূড়ান্ত অবনতি ও সমূহ ধ্বংস… এসব তো সার্বিক সমস্যা, এসব নিয়েও সার্ভের কিছু অবজার্ভেশন ছিল।
যেহেতু সার্ভেটা মূলতঃ এককালীন উদ্বাস্তুকেন্দ্রিক কাজেই সেটার বিশদ উল্লেখ পাঠককে খুব বেশি হয়ত উৎসাহিত করবে না। কিন্তু এই সার্ভে অব্দি পৌঁছোনোর যে পথ, সেটি অতিক্রান্ত, এবং এই অতিক্রান্ত পথের প্রভাব পড়েছে বিহারের বাঙালী সমাজের বিবর্তনের আভ্যন্তরীণ কারকগুলো তৈরি করতে।
ফিরে যাই বিবর্তনের কথায়। শহরবাসী শিক্ষিত বাঙালী জনসমুদায়ের যে নেতৃস্থানীয় অংশ ছিলেন, অর্থাৎ অন্নসংস্থানের নিত্তনৈমিত্তিক টানাপোড়েন সামলেও যাঁরা সকাল-সন্ধ্যায় হয়ে উঠতেন সাহসিক সংস্কৃতি-চেতনার পাওয়ার হাউজ, ঠিক সেই রেনেশাঁ-মাপের না হলেও আজও তাঁরা আছেন। তাঁরা আছেন বলেই আজ বিহারে বাঙালী, শহর গ্রাম মিলিয়ে তার বৃহত্তর একতা ও ভাষিক দায়বদ্ধতার পরিচয় পেয়েছে। তাঁরাই আজও সদর্থক নেতৃত্বে আছেন।
সেই বাঙালীর দ্বিতীয়
অংশ ছিলেন একটু নিজের মধ্যে মশগুল। ডাকলে শামিল হতেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজকর্মে,
নিজেরা নেতৃত্ব দিতেন না সেভাবে। এঁদের মধ্যে তাই ‘প্রবাসী’ হ্যাঙোভারটা সবচেয়ে
বেশী ছিল। সুযোগও ছিল। শক্ত আর্থিক বনিয়াদে দাঁড়িয়ে তাঁরা সবসময় ভাবতে পারতেন, ‘যে
কোনো দিন চলে যেতে পারি’। এই দ্বিতীয় অংশের বেশ কিছু পরিবার আজ পশ্চিমবঙ্গে চলে
গেছেন। অথবা নতুন অর্থনীতিতে এগিয়েছেন দিল্লী, মুম্বাই, পুণে, ব্যাঙ্গালোরের দিকে।
তাঁদেরকে বাদ দিলেও অনেকে এখনও আছেন, বিহারের বাঙালীদের আন্দোলনের খবরাখবর শুনে যাঁদের
বাঙালী হওয়ার নতুন মানে শিখতে হচ্ছে একটু একটু করে।
তৃতীয় অংশ ছিলেন ঈষৎ
নিম্নবিত্ত। সে কারণে তাঁদের পক্ষে নিজেদের প্রবাসী ভাবা সম্ভব ছিলো না খুব বেশী
দিন। আগের প্যারায় যে দিনগুলোর কথা বলা হল সে দিনগুলোয় তাঁদের দ্বিতীয় তৃতীয়
প্রজন্মের বাঙালিয়ানা হারিয়ে যেতে লাগলো। বাবার হয়তো কষ্ট হচ্ছে নিজের মাতৃভাষার
কথা ভেবে, ছেলে শুনিয়ে দিত, “রাখো তো! আজ বাদে কাল এখানেও যদি ‘বাঙালী-খেদাও’ শুরু
হয় কোথায় পালিয়ে বাঁচবে?” ভাগলপুরের কিছু গ্রামবাসী রাঢ়ীকায়স্থরা যেমন আর কোনো
ভাবেই বাঙালী নয়, তারাও নিজেদের স্বপরিচয় হারিয়ে ফেলতে লাগলো বেঁচে থাকার তাগিদে
বা ভয়ে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ায় তারা বিহার বাঙালী সমিতির সাংগঠনিক
গতিবিধি এবং আন্দোলনের নতুন পর্যায়ে আগে থেকে বেশী করে যোগ দিচ্ছে।
এরপর আছে চতুর্থ অংশ
যাকে অংশ বলা উচিৎ নয়। কেন না তাঁরা আগে বিহারে ছিলেন না। চাকরী, ব্যাবসা ইত্যাদির
সুত্রে নতুন এসেছেন। আসার পর কিছুদিন অব্দি চেষ্টা করেছেন চাকরী বদলে বা
ট্রান্সফার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যাওয়ার। সবার পক্ষে সে সুদিন আনা সম্ভব হয় নি।
একটা সময়ের পর তাঁরা বুঝতে শুরু করেছেন যে বিয়ে করতে হবে, সংসার করতে হবে
বিহারবাসী হিসেবেই, কাজেই ব্যাংক থেকে লোন-টোন নিয়ে ফ্ল্যাট বা বাড়ি যা হোক, তৈরি
করার চেষ্টা করতে হবে এখানেই। পরে কী হবে সে পরে দেখা যাবে। এঁদের মধ্যে বেশীর ভাগ
মানুষ ভাষার সংকটের সম্মুখীন এখনো হননি, বিহার বাঙালী সমিতির নাম সেভাবে বিশেষ
শোনেন নি, বাঙালীর আন্দোলন! সে আবার কী! গোছের ভাব। তবু, এদের মধ্যে থেকেও
বিবেকবান যুবকেরা একটু একটু করে বুঝছেন বিহারে বাঙালী হওয়ার মানে, বাঙালী হওয়ার
উত্তরদায়িত্ব।
শেষ করছি।
No comments:
Post a Comment