ছোটো বেলায় প্রথম যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম সে স্কুলে সকালে প্রার্থনার ব্যাপারটা ছিল না। তারপর যে স্কুলে গেলাম সেখানে প্রার্থনা দেখলাম প্রথম। খুব শিগগির জেনে গেলাম, সামনে কড়া নজরে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকা প্রথান শিক্ষক ও শিক্ষক/শিক্ষিকারা বস্তুতঃ আমাদের দেখতে পাচ্ছেন না। জেনে গেলাম, ‘প্রেয়ার’ ক্লাসের এটা সাধারণ নিয়ম যে সামনের কজন গায়, তার পেছনের দল ঠোঁট মেলায়। আর আমাদের দল, অর্থাৎ সবচে’ পেছনেরটার কাজ ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়ে শেষ হওয়ার অপেক্ষা করা। মাঝে মধ্যে একে অন্যকে ভেংচি কাটা। প্রার্থনায় প্রধান স্বর থাকত সঙ্গীত শিক্ষক/ শিক্ষিকার।
একটু বড় হয়ে যে স্কুলে গেলাম সেখানে দেখলাম
‘হাউজ’। টেগোর হাউজ, রমণ হাউজ … । এখানে, অন্ততঃ আমি যে হাউজে গেলাম তাতে সুরেলা কন্ঠী,
গান জানা এক ছাত্রী থাকাতে প্রার্থনায় প্রধান স্বর তারই হত – আমাদের হাউজের নামে ধার্য
হপ্তাগুলোতে। অবশ্য অন্য হাউজের বেলাতেও, সুরেলা কন্ঠ থাক বা নার=থাক, প্রিন্সিপ্যাল
সাহেবের কড়া নির্দেশ ছিল যে হাউজ-লীডারকে তার হাউজের সদস্যদের মধ্যে থেকেই খাড়া করতে
হবে প্রেয়ার-টীম।
তারপর স্কুল শেষ হয়ে গেল। কলেজে প্রার্থনার
বালাই নেই। আজকাল (খুব দামী স্কুলে কী হয় জানা নেই) সাধারণতঃ প্রার্থনার পিরিয়ডে, যদি
সঙ্গীত শিক্ষক/শিক্ষিকা না থাকে, দুরকম ব্যাপার ঘটে মনে হয়। হয় একটা বেসুরো শোরগোলে,
প্রার্থনায় আদৌ কোনো সুর আছে কিনা বা সেটা ধরে কেউ গাইছে কিনা বোঝাই যায় না। আর নয়ত,
জনপ্রিয় ফিল্মী প্রার্থনা-গীতটা ক্যাসেটে বা অন্য, আধুনিকতর কোনো যন্ত্রে বাজতে থাকে।
এমপ্লিফায়ারে তার সুর, কন্ঠ ও যন্ত্রানুসঙ্গ এত জোরালো থাকে যে ছাত্রদের বেসুরো কোরাসটা
চাপাই পড়ে যায়। এই দুরকম ব্যাপার হয় বলছি কেননা নিজের শহরে বা আশেপাশের মফস্বলে যেতে-আসতে
এই দুরকমই দেখতে পাই। কাজেই এটাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে অনেক স্কুলেই সঙ্গীত শিক্ষক বা
শিক্ষিকা বলে কেউ নেই। থাকলে খুব স্বাভাবিকভাবেই, সামনে টেবিলে হারমোনিয়াম বা কীবোর্ড
নিয়ে তিনিই দাঁড়াতেন এবং তাঁর কন্ঠস্বর, মাইকে হোক বা মাইক-ছাড়া, শোনা যেত। এবং সঙ্গীত
শিক্ষক/শিক্ষিকা থাকলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যি তিনি একটা সুন্দর দলও গড়ে নিতে পারতেন।
ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সবাই যে বেসুরো, তা তো আর নয়।
কুড়ি বছরে কত বদলে গেছে গানের দুনিয়া। কুড়িও
নয়। বড়জোর গত পনের বছরে। বৈদ্যুতিন সম্প্রচার মাধ্যমের চমকপ্রদ উন্নতি, বিনোদনশিল্পে
হাজার হাজার কোটি টাকা লগ্নী … গান গাওয়া, সিঙ্গার হওয়া একটা ‘কুল করিয়র’। এক একটা
রিয়্যালিটি শো’এর, প্রতিযোগিতার অডিশনে দেশের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার প্রতিযোগী অপেক্ষমান।
গান আর শোনা হয়না, দেখা হয়। পারফর্মেন্সের প্রয়োজনে সুরের কত কঠিন কঠিন খেলা এমনকি
শিশু প্রতিযোগীরাও অনায়াসে খেলছে। শচিন তেন্ডুলকর যেমন ‘রানমেশিন’, এরাও যেন তৈরি হতে
থাকা ‘গান-মেশিন’!
সে হোক মেশিন! মনটা ভরে যায় টিভির দিকে তাকালে।
গান তো গাইছে শিশু, যুবশক্তি! – কিন্তু …! একটা ‘কিন্তু’ খচখচ করে। কিছু প্রশ্ন দানা
বাঁধতে শুরু করে ভিতরে। সত্যিই কি গান গাইতে পারা মানুষের অনুপাত এক ভগ্নাংশও বেড়েছে
মোট জনসংখ্যায়? বেসুরো, বেতালা (আক্ষরিক অর্থে, ভাবার্থে নয়) লোকের অনুপাত কি দেশের
জনসংখ্যায় এক ভগ্নাংশও কমেছে? শুধু এটুকু হয়েছে প্রযুক্তির কল্যাণে আর বিনোদন শিল্পে
কিছু নতুন দিক খুলে যাওয়ায় যে সঙ্গীত শিক্ষার্থী এবং উচ্চাভিলাষী তরুণ গায়ক-গায়িকাদের
আমরা দেখতে পাচ্ছি। আর হয়েছে যে বিনোদন শিল্পের প্রয়োজনে তাদের প্রফেশনালিজম অভাবনীয়
ভাবে বেড়ে গেছে।
এটা কি মানার মত কথা যে মায়ের পেট থেকেই কেউ
কেউ সুর, ছন্দের প্রতিভা নিয়ে জন্মায় আর কেউ কেউ হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও বেসুরো, নিছন্দ
থাকার বা বেসুরো, বেতালা থাকার অভিশাপ নিয়ে জন্মায়?
আমি মনে করি এটা মানার মত কথা নয়। কেউ কেউ
শিশুবয়স থেকেই নিশ্চয়ই বিলক্ষণ সঙ্গীত-প্রতিভার পরিচয় দেয় – যেমন কিছু শিশু অঙ্কে,
বিজ্ঞানে আবার কিছু শিশু অন্য কিছুতে চাইল্ড-জিনিয়াস বা চাইল্ড-প্রডিজি বলে প্রচারিত
হয়ে থাকে। কিন্তু এটা যেমন মানার মত কথা নয় যে দেশের কিছু লোক সারাজীবন নিরক্ষর থাকার
অভিশাপ নিয়ে জন্মায় – অর্থাৎ রাষ্ট, সমাজ যতই চেষ্টা করুক না কেন, কিছু লোক নিরক্ষর
থেকে যাবেই; তাদের মগজটাই এমন যে হাজার চেষ্টা করেও তাদের সাক্ষর করে তোলা যাবে না
– চেষ্টা সত্ত্বেও বেসুরো, বেতালা থেকে যাওয়ার কথাটাও ততখানিই মানার অযোগ্য।
দুটোই আমাদের (অর্থাৎ রাষ্ট্রের, সমাজের) পাপ,
অপরাধ। নিরক্ষরতা যেমন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামাজিক ইচ্ছাশক্তির অভাবজনিত, সুর তালের
নিরক্ষরতাও ঠিক তাই। আর নিরক্ষরতা যেমন দেশের উন্নতির পক্ষে ক্ষতিকর, সুর-তালের নিরক্ষরতাও
তাই। ক্ষতিকর। দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ মানবসম্পদ। সেই সম্পদের অব্যবহারজনিত অপচয়।
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ সুর-তাল ধরতে পারে যদি
তাকে সুর-তালের সাক্ষরতা দেওয়া হয়। অবশ্য এই বাক্যের গঠনটাই শহুরে, বিচ্ছিন্ন মানুষের
কথা ধরে করা। প্রাচীন কৌমসমাজে বা আজকেও গ্রামীণ আদিবাসী সমাজে এটা কোনো প্রশ্নই নয়।
সুর-তাল সাক্ষরতা কেন, নৃত্যভাষায় সাক্ষরতাও কোনো প্রশ্ন নয়। কৌমের যে পার্বণী নৃত্য,
পার্বণী গীত, তা সবাই নাচতে পারে, গাইতে পারে। কিন্তু আজকের একশো তিরিশ কোটির দেশে
তেমন মানুষ কত লক্ষ? তাই সাক্ষরতা-কর্মসূচির মত করে সুর-তাল ধরিয়ে দেওয়ার কথাটা, আপাত
দৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হলেও বলতে বাহ্য হচ্ছি।
যদি একটা বেসুরো বেতালা মানুষের সুর-তাল সাক্ষরতা
হয়ে যায়, অর্থাৎ সা ধরিয়ে দিলে রে গা নিজে থেকে ধরে উঠতে পারে, নামতে গিয়ে দুই স্বরের
ফাঁকে পিছলে না যায়; পাছায় থাপ্পড় মেরেই হোক, তাল রাখতে পারে, তাহলে যে তার কত লাভ
হবে সে নিজে সেটা জানে না। (কিন্তু রাষ্ট্রও কি জানে না?)। তাকে তো জানানোও হয় না কোনোদিন!
গান শেখা, নাচ শেখা, ছবি আঁকা, খেলা, হাতের কাজ জানা … সবই এক্সট্রাকারিকুলার। কারিকুলামের
বাইরে, না করলেও চলে। এগ্রিগেটে যোগ হলে নম্বর বাড়ে ঠিকই কিন্তু তার জন্য তো দিদিমণি,
মিস বা স্যার, মাস্টারমশাই আছেনই। পরীক্ষা করে হবে কী, কে কী শিখল? ডিপার্টমেন্ট থাকে
কিনা, ‘আমরা থাকি কিনা’, তারই ঠিক নেই – কেউ আসতেও চায় না – নম্বর দেখে, মার্ক্স দেখে
অন্ততঃ লোভ তো হবে কিছু ছাত্র-ছাত্রীর! ‘দিয়ে দাও পাইকারি হারে ৯০ থেকে ১০০’!
সুর ধরতে পারা, তাল রাখতে পারা মানুষ মাথার
ওপর অনেক বেশি চাপ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার, নিঃসঙ্গতাবোধে
বিপজ্জনকভাবে ডুবে যাওয়ার প্রবণতা তার কমে যায়। নাচ শেখার ব্যাপারটা পরে ধরা যাবে।
সমস্যার ধাঁচটা একই তবে কিছু বাড়তি প্রসঙ্গ আছে ওতে।
সমাজ পরিবর্তন-টরিবর্তন টাইপের বড় কথার অবতারণাও
করতে চাইছি না। তাই, যে শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না তাদের কথাও বাদ দিচ্ছি আর যাদের
স্কুলে যাওয়ার বয়স পেরিয়ে গেছে তাদের কথাও বাদ দিচ্ছি। চোখের সামনে রাখছি একটা সাধারণ
সরকারি, আধাসরকারি বা বেসরকারি স্কুলের দৃশ্যা। আর রাখছি কিছু প্রস্তাব।
১ – স্কুলে সকালে প্রার্থনার, বা আরো ভালো
হয়, দেশাত্মবোধক সঙ্কল্প-গীতের একটা ব্যবস্থা থাকুক। প্রার্থনা ব্যাপারটা ধর্মনিরপেক্ষ
নয়, অনেক সময় বদমাইসিও করে কিছু কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষ তাই দেশ-নির্মাণ, মানব-কল্যাণমূলক
সঙ্কল্পগীত রাখাটাই উচিৎ হবে। পারম্পরিক বা আধুনিক ফিল্মী, যে কোনো একটা। একটু সহজ
ও শুদ্ধস্বর-ভিত্তিক সুর দেখে।
২ – সঙ্গীত শিক্ষক/শিক্ষিকা থাকলে ভালো না
হলে যেমন কন্ট্র্যাক্টের ভিত্তিতে আনানো যায় অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষক তেমনই আনানো হোক।
৩ – সঙ্গীত যারা শিখতে চায় তাদের যা ক্লাসের
ব্যবস্থা করার তা করা হোক। কিন্তু তা বাদে, প্রতিটি ক্লাসে সপ্তাহে একটা বা দুটো পিরিয়ড
এয়াখা হোক সঙ্গীতশিক্ষক/শিক্ষিকার গাইডেন্সে সঙ্কল্প-গীতটা গাইতে শেখার। সকালে সবাইকে
একসাথে ওই গীতটা গাইতে হবে।
৪ – সঙ্গীত শিক্ষার চিরাচরিত পদ্ধতি অর্থাৎ
সরগম ধরে শেখানোতে অসুবিধে হলে সোজাসুজি গানটা ধরে , গলার সাথে গলা মিলিয়ে শেখানো যেতে
পারে – যেমন্ন রেডিও, ক্যাসেট, সিডি, টিভির সাথে গলা মিলিয়ে আমরা বাথরুম-সিঙ্গার হয়ে
উঠি। কিন্তু একজনও যেন চুপ থেকে ঠোঁট না নাড়ে। শেষ বেঞ্চ অব্দি যেন সবাই গায়।
৫ – স্কেলের সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। সেখানে
তিন বা চার ধরণের কন্ঠস্বরে ছাত্র/ছাত্রীদের ভাগ করে আলাদা আলাদা সা এর ওপর কাজ করা
যেতে পারে।
ব্যাস, এইটুকুই। করে দেখুন না, প্রিন্সিপালসাহিবা! সেক্রেটারিসাহেব!
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনাদের স্কুল আগের থেকে ভালো ফল করবে। আজ থেকে বিশ বছর বাদে আপনাদের
স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র/ছাত্রীরা নিজেদের দুঃখকষ্টের মুহূর্তে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ
করবে সুরে-তালে সাক্ষর হয়ে ওঠার এই পিরিয়ডগুলো।
[কখনো কোনো এক বছর বিহার এস সি ই আর টি র ত্রিভাষী পত্রিকায় প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment