সিগারেটের প্যাকেটে যেমন আজকাল “ধুমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর” লেখা আইনতঃ বাধ্যতামূলক, বেবিফুডের কৌটোতেও তেমনই “মাতৃদুগ্ধ শিশুর পক্ষে সর্বোত্তম” লেখা বাধ্যতামূলক। এই আইনটা পেতে মানুষকে অনেক লড়তে হয়েছে। আর আইনটা হওয়ার আগে বহু বছর অব্দি বেবিফুড প্রস্তুতকারক বহুজাতিক সংস্থাগুলি প্রচার চালিয়েছে যে তাদের মালটা মায়ের দুধের থেকেও ভালো। আবার এই বিষ্ময়কর গুণকারিতা নাকি গবেষণাগারে প্রমাণিত! বহু বছরের উদ্ভাবনী প্রয়াসের ফল! খুব স্বাভাবিক ভাবেই দিনের পর দিন অনেক, বিশেষ করে লেখাপড়া জানা এবং দাম দিয়ে বেবিফুড কিনতে পারা মায়েরা তাঁদের নবজাত সন্তানদের নিজেদের বুকের দুধ থেকে বঞ্চিত করেছেন। স্বাস্থ্যগত কারণে বুকে দুধ না হলে অন্য কারো দুধা খাওয়ানো থেকে বাজারের বেবিফুড কিনে নেওয়া বেশি পছন্দ করেছেন। শিশুদের পিতারা, ঘরের অভিভাবকেরা এবং ডাক্তারেরাও তাই করতে বলেছেন। অনেক সৌন্দর্যসচেতন মা যাঁদের আয়া রাখার ক্ষমতা নেই কিন্তু বেবিফুড কেনার ক্ষমতা আছে, হাতে চাঁদ পেয়েছেন – কেননা স্তনের সুডৌলতা বজায় থাকবে! বহুজাতক সংস্থাগুলির বিজ্ঞাপনের প্রভাব সর্ববিদিত। আজ অব্দি কেউ হিসেব করেন নি যে কয়েক প্রজন্ম ধরে নবজাত শিশুদের বেবিফুড খাইয়ে পোষণ, তাদের শরীর ও মস্তিষ্কের বিকাশে কী কী ক্ষতি করেছিল সে সময়, কোন কোন জিনিষের অভাব ঘটিয়েছিল।
ঠিক এই ব্যাপারটাই ভাষার বিষয়েও বলতে চাইছি। বহু বছর হয়ে গেল,
শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা করার জন্য সংগ্রাম চলছে। সংগ্রামটা শুধু নতুন কোনো আইনের জন্য
নয়। আইন, সরকারি নির্দেশাবলি ইত্যাদি তো নানা রকমের আছে এবং হচ্ছে। নানারকম মধ্যপন্থাও
খুঁজে বার করা হচ্ছে – ঠিক আছে, পুরো শিক্ষা না হোক, প্রাথমিক হবে মাতৃভাষায়! তাও না
পারা গেলে স্থানীয় ভাষায়! বিবাদও চলেছে – ওই তো বামফ্রন্ট সরকারও তো শেষ অব্দি ইংরেজি
… কর্ণাটকের স্কুলগুলো তো কন্নড় আটকাতে সুপ্রিম কোর্টে … ! অভিভাবকেরা লেখাবেই না যে
তাদের সন্তান বাংলাভাষী! কে ঝামেলা পোহাবে? … ভাষা শিখে হবে টা কী? … এমত পরিস্থিতিতে
খুব বেশি হলে আর একটাই নতুন আইন হতে পারে – ইংরেজি ভাষায় ছাপা পাঠ্যপুস্তকের ওপর সতর্কতাবাণী
দেওয়া থাকবে, “মাতৃভাষায় পাঠ ছাত্রদের পক্ষে অধিক হিতকর”! সংগ্রামটা সচেতনতা বাড়াবার।
কেননা আমাদের কাছে সত্যিই কোনো উপকরণ নেই জানবার যে যদি গত সত্তর বছরে শিক্ষাটা মাতৃভাষায়
দেওয়ার ব্যবস্থা হত, তাহলে সেটার ইতিবাচক প্রভাব বিভিন্ন মানব উন্নয়ন সূচকে কতটা পড়ত
এবং শেষ বিচারে (কেননা এটাই আজকের বিকাশভাবনায় শেষ বিচার) মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)
কতটা আরো বাড়ত। তবে বাড়ত যে, সে ব্যাপারে আমি নিঃসংশয়।
তিনটে ক্ষতির কথা এ মুহুর্তে আমি ভাবতে পারছি। আপনাদের ভাগ দিলাম
আমার ভাবনার। পড়ে দেখুন, কোনো যুক্তি আছে, নাকি উদ্ভট তর্ক-বাগীশী! তিনটে ক্ষতিই সমাজের
মনের দশা এবং ফলতঃ, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত। কাজেই যাঁরা মনোবৈজ্ঞানিক, তাঁদেরকে
আহ্বানও করছি, তাঁরা চাইলে বিষয়টার ওপর আরো বেশি আলো ফেলতে পারেন।
জ্ঞান ও সামাজিক অনুশীলনের বিযুক্তি
ব্যাপারটা এমন কিছু নতুন নয়। ধনতান্ত্রিক সমাজের এবং সাধারণভাবে
শ্রেণিবিভক্ত সমাজের অন্যতম লক্ষণ এই বিযুক্তি। সত্যি বলতে গেলে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে
মাতৃভাষার বিযুক্তিও ওই শ্রেণিবিভাজনেরই লক্ষণ। ভারতের উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজে এই বিযুক্তি
যথার্থ সামাজিক অগ্রগতির পথে অন্তরায়। আজকাল তো নলেজ-ক্যাপিটালের কথা বলা হয়। যদি নলেজ,
জ্ঞান সত্যি সত্যি সোশ্যাল ক্যাপিটাল, সামাজিক পূঁজি হয় তাহলে অনেক বড় কাজ তা দিয়ে
সম্পন্ন হতে পারে। কিন্তু নলেজ, জ্ঞান আহ প্রাইভেট ক্যাপিটাল, ব্যক্তিগত পূঁজি। ব্যক্তিগত
পূঁজিও অনেক সময়ে নানান কারণে বহুবিধ সামাজিক সংস্কারের কাজে মেতে ওঠে। এখানেই প্রাথমিক
শিক্ষায় মাতৃভাষা বা জ্ঞানের নবজাত স্তরে মাতৃস্পর্শের, মাতৃদুগ্ধের অভাব মানুষকে তার
মূল, শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি, নানান ধরণের মানুষজন তার
চারপাশে, যারা শিক্ষার আলো এখনো পায়নি কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতার আলোয় নিজেদের পথটুকু
চিনে চলে আসছে আবহমান কাল ধরে; তাদের ওই অভিজ্ঞতার আলোর সাথে নিজের শিক্ষার আলোর মিলন
ঘটাবার কোনো পথ তার জানা থাকে না। বস্তুতঃ সে জানতে চায়ও না। অভিজ্ঞতাকে সে হেয় করে।
শিক্ষা তার কাছে শুধু রোজগারের হাতিয়ার হয়ে থাকে। কখনো কখনো এই বিযুক্তি এত ধারালো
হয়ে ওঠে যে প্রত্যক্ষভাবে শ্রেণিগত বিদ্বেষ ও হিংসায় অভিব্যক্তি খুঁজতে শুরু করে দেয়।
ভাষিক-দ্বিখন্ডন
এটি একটি মানসিক অবস্থান। এই সমাজে আমরা নানা ভাবে এই অসুখটায়
ভুগি। বিশেষ করে লক্ষ্য করুন, যখন বহুদিন যাবৎ বিহারের অধিবাসী কোনো বাংলাভাষী বাজারে-হাটে
হিন্দি বলে। বা ভোজপুরি, মগহি, মৈথিলি ইত্যাদি ভাষায় ঠাট্টামস্করা করে বন্ধুদের সাথে।
দেখবেন নিজের স্থানীয়তা বোঝাতে উচ্চারণগুলো একটু গাটারাল (gutteral) হয়। আবার সে যখন
বাংলাভাষীদের কোনো সভাসমিতি বা পুজো কমিটির বৈঠকে কথা বলতে ওঠে এবং বিশুদ্ধ বাংলা বলার
আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও বুঝতে পারে যে ধাঁচটা বিহার-ঘেঁষা হয়ে যাচ্ছে তখন কিছু কলোকোয়াল
(colloqual) শব্দ বা বাগধারা সে ওই গাটারাল উচ্চারণে ছুঁড়ে দেয় নিজের হীনতাবোধটা লুকিয়ে
আক্রমণাত্মক ভঙ্গী নিতে। এই অসুখটা আরো গভীর হয় যখন দ্বিখন্ডনটা তার মাতৃভাষা আর ধাত্রীভাষার
মধ্যে না হয়ে তৃতীয় কোনো শিক্ষাভাষার (যেমন ইংরেজি) সাথে হয়। ভাষিক-দ্বিখন্ডন এত গভীর
হয় যে একটা মানুষ যখন ইংরেজি বলে তখন তাকে একধরণের মূল্যবোধের বাহক মনে হয় আবার যখন
মাতৃভাষা বলে তখন তাকে ভিন্নধরণের মূল্যবোধের বাহক মনে হয়। একই শরীরে অবস্থান করে একজন
র্যাডিকাল ডেমোক্র্যাট ও একজন ফিউডাল, একজন লুম্পেন ও একজন সজ্জন। শেষ বিচারে অবশ্য
এই অসুখটারও মূল শ্রেণিসমাজে, ব্যক্তির দ্বিখন্ডনে – ভাষিক দ্বিখন্ডন তার অভিব্যক্তি
ও অবলম্বন।
ভাষাশিক্ষায় সাধারণ অবনতি
সত্যি করে যাচিয়ে নিন তো! আমাদের বাপঠাকুরদারা যখন বাংলায় পড়াশুনো
করে ইংরেজি শিখেছিলেন, যখন তাঁরা মনে মনে অনুবাদ বা রিফ্লেক্সিভ ট্রান্সলেশনের মাধ্যমে
ইংরেজি শব্দটাকে বাংলা প্রতিশব্দে অনুধাবন করতেন, তখন তাঁদের ইংরেজি জ্ঞানের যে গভীরতা
ছিল, আজ ইংরেজি মাধ্যমে পঠনপাঠনের যুগে তা আছে কী? নেই। থাকতেও পারে না। তখন একেকজন
(প্রতিভাধরও নয়, সাধারণ) মানুষ যেমন দিনচারণের মধ্যে দিয়ে নানা ভাষা ও বুলি বেশ ভালো
করে আয়ত্ত করতেন। এখনও অনেকে করেন, কিন্তু তাঁরাই যাদের মাতৃভাষার বনিয়াদটা মজবুত –
হয় প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে অথবা সে সুযোগ না ঘটলে পরবর্তীকালে ব্যক্তিগত চেষ্টায়।
অর্থাৎ, মাতৃভাষার বনিয়াদটা না থাকলে, যে ভাষাশিক্ষা নিয়ে এত মাতামাতি, তারও গুণগত
মান ও উৎকর্ষে অবনতি ঘটে, আর ভিন্ন ভাষা শিখে নেওয়ার প্রবণতা হ্রাস পায়। গূঢ়ার্থে,
নানান ধরণের মানুষকে জানার, বোঝার, সাথে নিয়ে চলার মানবিক অনুপ্রেরণাটাই হয়ে আসে সঙ্কুচিত।
শেষে একটা প্রসঙ্গান্তরে না গিয়ে পারছি না। মাতৃভাষার সাথে শিক্ষাভাষার
এই যে বিযুক্তি এবং এর ফলশ্রুতি, মাতৃভাষার প্রতি যে হীনভাব, সেটা তাদের মধ্যেও সংক্রামিত
হয় যারা হয়ত মাতৃভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা জানেই না। ওদিকে ধনতান্ত্রিক সমাজের সাধারণ
নিয়মে জেলায়, ব্লকে দুর্নীতি, জাত-গত আধিপত্য, দুর্বৃত্ত-তোষণ, অনুন্নতি বেড়ে চলে।
মানুষের মধ্যে তাদেরই ভাষা, বুলি বলে মিশে থাকা সরকারি আমলারা এন্তার চুরি করে বাড়িয়ে
তোলে সাধারণ জনতার দুরবস্থা। এহেন অবস্থায় হঠাৎ একজন ভিন্নভাষী তরুণ আই এ এস অফিসার
সেখানে কালেক্টর হয়ে পৌঁছে কয়েক বছরের জন্য অনেকটা বদলে দেয় প্রশাসনের কর্মসংস্কৃতি।
মানুষ তার জয়জয়কার করে। করাও ন্যায্য। ব্যাপারটার ভাষার সাথে কোনো সম্পর্কই নেই। তবু
নিজ মাতৃভাষার প্রতি হীনভাব থেকে পুষ্ট হয় এই বিপজ্জনক ধারণা যে মুক্তিদাতা বাইরে থেকেই
আসে, আসবে। Alien saviour এর syndrome টাকে বাড়িয়ে তোলে মাতৃভাষার প্রতি হীনভাব। এদিক
থেকে দেখতে গেলে মানুষের, জীবনটাকে বদলাবার সামুহিক সক্রিয়তাকে পক্ষাঘাত-গ্রস্ত করে
যে নিয়তিবাদী বা গোলাম মানসিকতা, তাকে বাড়িয়ে তোলে মাতৃভাষা ও শিক্ষাভাষার বিযুক্তি,
শিক্ষায় মাতৃভাষার অনুপস্থিতি ও আনুসঙ্গিক উপসর্গগুলি।
বস্তুতঃ সব অসুখই শ্রেণিবিভক্ত, ধনতান্ত্রিক, আধিপত্যবাদী সমাজের
অসুখ। মাতৃভাষার অভাব, ভাষার অসুখ সেগুলিকে বাড়িয়ে তোলে, গভীরতর করে, নতুন ধরণের কিছু
বিকৃতির পথ করে দেয়। আজ না হোক কাল, শিক্ষার আবশ্যক মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠিত
হবেই। হয় সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সুমতি হিসেবে অথবা ‘ছদ্ম-জ্ঞান’
(pseudo-knowledge) ও মেধাগত বা অর্থগত দুর্নীতিপরায়ণ বুদ্ধিজীবিতার বিরুদ্ধে ব্যাপক
গণ-বিদ্বেষের ফলশ্রুতি হিসেবে। দ্বিতীয়টা হলে আবার নতুন কিছু সমস্যার জন্ম হবে। তাই
প্রথমটাই কাম্য।
[কোনো এক সময়ে বিহার ‘এসসিইআরটি’র ত্রিভাষী পত্রিকায় প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment