Sunday, January 13, 2019

নদীর রোদ-ঝিলিক


[শ্মশান । এমন সাজানো যেতে পারে যে মঞ্চের পিছন দিকে, মাঝের বাঁপাশে একটা কাঠের চৌকি । চৌকির গায়ে কাট আউট করে তৈরি একটা গাছ । গাছের নিচে, চৌকির ওপর, শেষকৃত্য ও দাহকর্মের প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের একটি দোকান সাজানো । চৌকির ডানদিকে, অর্থাৎ মঞ্চের পিছন ঘেঁষে মাঝবরাবর, কাঠের তৈরি তিন ধাপ সিঁড়ি এদিক দিয়ে উঠে ওদিকে নেমে গেছে । আভাসটা এই যে বর্ষার জলস্তর রোখার জন্য চার ফুটের বাঁধ পেরিয়ে নদীর ঘাট ।
সামনে একটি মৃতদেহ । পাশে বসে এক প্রৌঢ় । তার সামনে পুরোহিত । পুঁটলি থেকে সামগ্রী বার করছে । অদূরে বসে দুজন শ্মশানসঙ্গী । পাহারায় রত দুজন পুলিশ । চৌকির ওপর বসে দাহকর্মের জিনিষপত্রের দোকানটা সামলাচ্ছেন এক স্ত্রীলোক ।
সময় সন্ধ্যা ।]

(একজন ফোটোগ্রাফার, যেমন শ্মশানে ঘুরফির করে ছবি তুলে দেওয়ার জন্য, তৃতীয় শ্মশানসঙ্গীর পিছুপিছু প্রবেশ করে ।)

ফটোগ্রাফার - একটু তুলে ধরুন মাথাটা ।
                   (সঙ্গে আসা শ্মশানসঙ্গী এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে দুহাত দিয়ে শবদেহের মাথা আর কাঁধটা তুলে ধরে । তাতে দেখা যায় শবদেহটি দশ-বারো বছরের ছেলের । কাপড়টা নিচে খসে যাওয়াতে গলার নিচ থেকে পোস্টমর্টেমের সেলাই দেখা যায় । একটা ছবি তোলা হয় ফ্ল্যাশ ঝলকায় ।)
তৃতীয় শ্ম..-  (প্রৌঢ়কে) আপনি আসুন পাহুনজী, একবার পাশে এসে বসুন । (প্রৌঢ় মাথা ঝাঁকান । শ্মশানসঙ্গীরা স্নেহভরে জোর করে তাঁকে শবদেহের পিছনে বসিয়ে দেয় । বাঁহাতে দেহের নিচের দিকে ঠেক দেওয়ায় ও অন্য হাতে মাথায় ঠেক দেওয়ায় । কিন্তু প্রৌঢ়ের নিজের মাথা আর সোজা হয় না । ওই অবস্থাতেই আরেকটা ছবি তোলা হয় ।
১ম শ্ম.. -    আর দেরি কোরো না তোমরা । পোস্টমর্টেম করিয়ে বডি দিতেই বিকেল করে দিল । বাড়ি ফিরব কখন ? কীভাবে ফিরব ?
ফটোগ্রা. -      কী, হয়েছিল কী ?
                   (শ্মশানসঙ্গীরা একে অন্যের মুখের দিকে চায় । অর্থাৎ বলার ইচ্ছে নেই । দুই পুলিশের মধ্যে অপেক্ষাকৃত যে তরুণ, সে ফটোগ্রাফারকে ধমকের সুরে প্রশ্ন করে)
১ম পুলিশ -    ছবি তোলা হয়ে গেছে আপনার ?
ফটোগ্রা. -      হ্যাঁ ! সে তো দেখতেই পেলেন আপনারা !
১ম পুলিশ -    তাহলে যান ।
ফটোগ্রা. -      না, মানে এত ছোটো একটা বাচ্চার লাশ, তাও পোস্টমর্টেম করানো ...
২য় পুলিশ -    (ইনি একটু বয়স্ক) গ্রামের ঘরে ঘরে আগুন জ্বলছে ফটোগ্রাফরবাবু ! জমি নিয়ে, জাত নিয়ে, ধরম নিয়ে । তারপর নক্সলী উৎপাত । আর কিছু না পেলে ... গোতিয়ারঝগড়া । জোরু নিয়ে টানাটানি ! কিছু বাকি আছে ? কত কত খবর রাখবেন? বড় কাউকে পেলোনা তো বাচ্চাটাকেই ধরে শেষ করে দিল !
৩য় শ্ম.. -    আরে কাজিয়া, লড়াই, হাঙ্গামা, ফ্যাসাদ তো তবু বোঝা যায় । ভুল হোক আর ঠিক হোক, জমিজিরেত নিয়ে, জাত নিয়ে, হকহুকুক নিয়ে বয়স্কদের মধ্যে দুশমনি লাগতেই পারে । ওই নিয়েই জীবন । ... আমি তোকে মারলাম । তুই আমায় মারলি । এইই দিনকাল । ... কিন্তু বাচ্চাটা কার শত্রু ছিল ভাই ? কাকে মেরেছিল ? কার গোলার ধানে আগুন দিয়েছিল ? কার ঘরে ঢুকে বাড়ির অওরতের সাথে মুখ কালো করেছিল ? দশ বছরের একটা বাচ্চা ?
                   (এরই মধ্যে পিছন থেকে এক বৃদ্ধ প্রবেশ করে । তার আগল-পাগল বা নেশাগ্রস্ত চলনে শবদেহের কাছে আসার ধরণ দেখে সবাই চুপ করে যায় । ফটোগ্রাফার ওই যে, এসে গেছে বলে বেরিয়ে যায় ।
পুরোহিত -     এ এখনো বেঁচে আছে ? ছিল কোথায় ? দেখতাম না তো ?
প্রৌঢ় -          লোকটা কে, পন্ডিতমশাই ?
                   (পুরোহিত জবাব দেওয়ার আগেই বৃদ্ধ শবের মুখটা ভালো করে দেখে হেসে ওঠে)
বৃদ্ধ -            এসে গেলি ? আবার ফিরে এলি ? এত শিগ্‌গির ?
৩য় শ্ম.. -    বলে কি বুড়ো ! আবার ফিরে এলি মানে ?
বৃদ্ধ -            (তার দিকে তাকিয়ে তার কাছে এসে) বাঃ, ফিরে ফিরে আসছে আমার চোখের সামনে, পোড়ানো হচ্ছে বার বার ... বলব না ?
১ম শ্ম.. -    কী বলছে বুড়ো যা তা ! সরা ওকে এখান থেকে ! কে ও ?
দোকানি -      (অদূরে তার দোকান থেকেই) ওই বুড়োই তো এই শ্মশানঘাটের রাজা ছিল । রাজা হরিশ্চন্দ্র, কলিযুগের ! এখন আর হাত পা চলে না । মাথাও বিগড়েছে । তাই ছেলে ধরেছে কাজ ।
২য় শ্ম.. -    ঠিকই বলছে দোকানি । ওই আগে হাতে ধরিয়ে দিত আগুনের আঁটি । ঘাটছাড়ানি নিয়ে আমি নিজেও বেশ কয়েকবার দরদাম করেছি ওর সাথে পাঁচ বছর আগে অব্দি । এদিকে দেখতে পেতাম না । ভেবেছিলাম মরে গেছে । (বলে নদীর দিকে নেমে যায়)
১ম শ্ম.. -    এত সহজে মরে শালা চিমড়ে বুড়ো ! মাল টেনে দিব্যি মস্ত্‌ আছে, দেখছিস না !
বৃদ্ধ -            (তার কাছে এগিয়ে এসে) ঠিক বলেছিস ।  মাল টেনে, বুকে পেটে, মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিব্যি বেঁচে আছি । নদীর তারা গুনছি আর আকাশের ঢেউ গুনছি । কেন জানিস ?
৩য় শ্ম.. -    জেনে কাজ নেই । মাল খাওয়ার যোগাড় যখন আছে তার মানে পেটের ভাতটাও সময় মত জুটছে । নদীর তারা আর আকাশের ঢেউই তো গুনবে । স্‌সালা ।
বৃদ্ধ -            (নিজের মনে) আমরা তো হলাম, ওই যাকে বলে যমের, মানে উপরের ডোমটার অরুচি । যেতে চাইলেও নেয় না । ফিরিয়ে দিল দুদুবার । ... আর এই যে দেখছিস শুয়ে আছে যমের মাংসলুচি । কচি পাঁঠার মাংস । গপগপিয়ে খাবে । (হাসতে হাসতে নিজের দিকে আর শবদেহের দিকে আঙুল দেখিয়ে দেখিয়ে বলতে থাকে, অরুচি মাংসলুচি ... অরুচি মাংসলুচি ...)
১ম শ্ম.. -    তা এই বাচ্চার লাশটা দেখে আবার ফিরে এলি বলার মানে কী ?
বৃদ্ধ -            বাঃ, বার বার আসবে, ফিরে ফিরে আসবে ... বলব না ? সেদিন এল । কী, না দাঙ্গায় মরেছে । আবার এল । কী না নৌকো ডুবেছে । এবার ? শুনছি জমি জিরেতের কাজিয়া । মাঝে মধ্যেই আসে অসুখে মরে । না খেয়ে । আগুনে পুড়ে । ফিরে ফিরে আসে এখানে । বলব না ?
৩য় শ্ম.. -    বাঃ, পাগলের কথা শুনুন । জ্ঞানবাক্য । কাব্য । দুনিয়ার যত বাচ্চা মরছে সব একটাই বাচ্চা । যত যোয়ান মরছে সব এক যোয়ান । যত মেয়ে মরছে ... বুড়োও তবে যে কটা মরছে সব এক ! মানে ও নিজেই । বুড়ো সমাজের ভুত । শালা মাল খেয়ে টইটুম্বুর । ফিলজফি আওড়াচ্ছে । মানবতার মৃত্যু ।
বৃদ্ধ -            ও তুই বুঝবি না । বুঝবি না । বড়দের মরা আর এর এই শ্মশানে আসা বারবার (শবদেহের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে )... এক হয় কখনো ? বড়রা তো দুনিয়াদারীর ভাগিদার । দুনিয়াদারীতেই বাঁচছে, মরছে । নিজেদের কর্মে তৈরি করছে নিজেদের জীবন । নিজেদের মৃত্যু । ... এরা তো ঢোকেইনি সেই দুনিয়াদারীতে । জন্মই নেয়নি । মানুষের এক জন্ম মায়ের পেট থেকে । দ্বিতীয় জন্ম দুনিয়াদারীর ছকে নিজের খোপটায় গিয়ে দাঁড়ানোর পর । নিজের হিস্‌সার কর্ম করতে । ... মাঝখানের বয়সটা ? (একটা চাওয়ালা বাচ্চা ছেলে, প্রায় একই বয়সের, হাতে খালি গেলাস বসান তারের জালি নিয়ে দোকানি স্ত্রীলোকের কাছে যায় । বৃদ্ধ তার দিকে তাকিয়ে থাকে ।) মাঝখানের বয়সটা । হাঁটা শেখার সময় থেকে চলা শেখার সময় অব্দি ভগবানের বয়স । ... ভগবান দুটো হয় ? ওই এক । ভগবান । সময়ের ফুল । ফল হওয়ার আগেই এভাবে মেরে ফেলি আমরা । আর তিনি ফিরে ফিরে আসেন শ্মশানে ।
চাওয়ালা -     (দোকানি স্ত্রীলোকের সামনে দাঁড়িয়ে) গেলাসটা কোথায় রেখেছ ? দোকানি চৌকির নিচে ইশারা করতে ঝুঁকে ছেলেটি গেলাস তুলে নেয়) এখনকারটা মিলিয়ে নটাকা হল । 
দোকানি -      পরে নিয়ে যাস ।
চাওয়ালা -     এখনই দাও না । শেষে আমাকে কথা শুনতে হয় । আগের রেজিস্ট্রিবাবুর এভাবেই ছত্রিশ টাকা বাকি পড়ে গিয়েছিল । ট্রান্সফার হয়ে গেল । টাকা পেলাম না । আমার মাহিনা থেকে কেটে নিল মালিক ।
দোকানি -      তোর মালিক তো চশনখোর ।
চাওয়ালা -     (কথা এড়িয়ে যেতে) টাকাটা দিয়ে দিলেই তো ফুরিয়ে যায় । কেন কথা বাড়াচ্ছ ?
দোকানি -      আচ্ছা নিয়ে যা । (পয়সা দিয়ে বৃদ্ধকে চেঁচিয়ে শোনায়) এই যে দেখ, তোমার কেষ্টঠাকুর ! হাতে পায়ে হাজা ধরে নিল রাত বারোটা অব্দি এঁটো বাসন মাজতে মাজতে । একটু বল এর কথাও !
বৃদ্ধ -            (দাড়ির ফাঁকে ফোকলা দাঁতে খানিক হেসে নিয়ে) ও তো আমাদের দলের বোড়ে । এগিয়ে চলেছে । এগিয়ে চলেছে । কবে মালিকদের লাইনে ঢুকে তোর ঘোড়া বাঁচিয়ে দেবে, আমার হাতি বাঁচিয়ে দেবে, নাকি মন্ত্রী হয়ে যাবে ... দেখতে রয়ে যাবি ।
দোকানি -      এ তো আর দাবা খেলা নয় ! ... হয়তো দেখবে মালিকদেরই ঘোড়া হয়ে এসে তোমার পাঁজর গুঁড়িয়ে দিল । সময়ের আগেই ধরে নিয়েছে ছক । কীই বা বোঝে ও এই ছকের । লেখাপড়া করাবে, না নেশাখোর বাপ জুতে দিয়েছে কাজে ।  (একজন মোটাসোটা যুবক ঢোকে)
যুবক -          (বৃদ্ধকে ধরে নিয়ে যেতে যেতে) তোমাকে বলি ওদিকে থাক । কাজের সময় এসে বাগড়া দেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে তোমার ।
দোকানি -      হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিয়ে যা তোর বাপকে ! যতক্ষণ থাকবে এই সমস্ত পাগলামি চলবে । সিপাহিজীরা ভাববে নিশ্চয়ই কোনো ব্যাপার আছে । রেজিস্ট্রিবাবুকে তো আলবাৎ ধরবে । একটা মড়ার ডবল রেজিস্ট্রি ... ।
                   (ছেলেটি বৃদ্ধকে টানতে টানতে নদীর দিকে নেমে যায় । ওদিক থেকেই উঠে আসে দ্বিতীয় শ্মশানসঙ্গী)
২য় শ্ম.. -    এদিকের কাজ শেষ হয়ে গিয়ে থাকলে এবার চল । ওদিকে সবকিছু রেডি ।
                   (শবদেহ উঠিয়ে নদীর দিকে নেমে যায় মৃত বালকের পিতা, শ্মশানসঙ্গীরা এবং পুরোহিত । চাওয়ালা বাচ্চা ছেলেটি দাঁড়িয়ে পড়েছিল বৃদ্ধ ও তার ছেলের টানাটানি দেখতে । এবার গেলাসসুদ্ধু জালিটা পায়ে বাজিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই দুই সিপাই নড়ে চড়ে)
১ম পুলিশ -    (যে অপেক্ষাকৃত তরুণ) কী সাহেবজী, একটু চা পেলে কেমন হয় ?
২য় পুলিশ -    মন্দ নয় । এ্যাই চাইল্ড-লেবার । দুটো চা দিয়ে যা তো । আলাদা করে বানিয়ে আনবি ।
চাওয়ালা -     স্পেশাল তিন টাকা ।
২য় পুলিশ -    ডবল ?
চাওয়ালা -     পাঁচ ।
২য় পুলিশ -    ওই ! দুটো ডবল হাফ ।
চাওয়ালা -     পয়সা ?
১ম পুলিশ -    আরে নিয়ে আয় না ! না দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি না ।
২য় পুলিশ -    (পয়সা বার করে) না, নিয়ে যা পয়সা । নইলে আবার ঝাড় খাবি মালিকের কাছে । কিন্তু চা যেন ভালো হয় । আর (নদীর দিকে ইশারা করে) ওই দিকে যাচ্ছি আমরাও । পৌঁছে দিবি । ... শালা কী নিয়মকানুন এই জমানার । বাচ্চারা টিভিতে গান গেয়ে, নেচে, এ্যাক্টিং করে পয়সা কামাচ্ছে । বাপমায়ের স্বপ্ন পুরো করার কথা বলছে । তো সে হল ট্যালেন্ট কা কমাল । আর দোকানে, কারখানায়, রাস্তায় কাজ করে পরিবার চালাচ্ছে, পেট পালছে, এমনকি লেখাপড়া শেখার জন্য খাটছে তো সে হল চাইল্ড-লেবার ! বেআইনি ! ...
                   (ততক্ষণে চাওয়ালা বাচ্চাটা পয়সা নিয়ে চলে যায় । সিপাই দুজনও নদীর দিকে নেমে যায় । দোকানি মেয়েলোকটি হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে ওঠে । কাট-আউট গাছটা সিঁড়ির ডানদিকে নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে বাঁধের ওপাশে দাঁড় করায় । চৌকিটা টানতে টানতে নিয়ে নাট্যস্থলের বাইরে চলে যায় । অর্থাৎ, ঘটনাস্থল নদীর দিক । ...
গভীর রাত । মঞ্চ ঈষৎ অন্ধকার । যে ছেলেটি শবদেহ হয়েছিল সে ডানদিক থেকে ঢুকে ডানঘেঁষেই মাটিতে শুয়ে পড়ে । নিভন্ত চিতা বোঝাতে একটা লাল আলো ফেলা যেতে পারে তার ওপর ।
                   বাঁদিক থেকে বৃদ্ধ একটা মদের বোতল আর একটা পুঁটুলি হাতে নিয়ে ঢুকে বাঁ ঘেঁষে বসে পড়ে । ধপ করে বসতে গিয়ে বেসামাল হয়ে চিৎপটাং হয় । আবার উঠে বসে । মদ খায় ।
                   একেবারে সামনে বাঁদিকে তিন বালক/বালিকা, মাথায় মুখে কালো কাপড় বাঁধা, কাঁধে বন্দুক ... প্রবেশ করে । তাদের সাথে একজন দলনেতা যুবক বা মধ্যবয়সী মাথায় মুখে কাপড় বাঁধা বলে বোঝা যায় না ।)
দলনেতা -      সব কথা মনে রেখেছ তো তোমরা ? এটাই কিন্তু তোমাদের প্রথম অপারেশন, তোমাদের পরীক্ষা । আমি আর রাঘবদা রাস্তার ধারে থাকব । তোমাদের সিগন্যাল পেলেই বাইকে স্টার্ট দেব । ঠিক আছে, কমরেডস !
                   (দলনেতা চলে যায়)
১ম (বালি.) - কুশলের ছোটকা যদি না আসে শেষ অব্দি ?
২য় (বাল.) -   আসবেই । ওর আদরের ভাইপো, ওরই জন্য জীবনটা দিল ! পারলে লাশের সঙ্গেই আসত । কিন্তু পুলিশের ভয় । এখন আসবে । ভাইপোর চিতার কাছে । আসবেই ।
বালিকা -       একা আসবে ?
বালক -         একা নাও হতে পারে । দুজন । তিনজন । তবে দল বেঁধে এখান অব্দি আসার সম্ভাবনা কম ।
বালিকা -       দুজন তিনজন হলে চিনতে অসুবিধা হবে না ? কাপড়ে চোখমুখ ঢাকা থাকলে ...
বালক -         মিটিংএর সময় ঘুমোচ্ছিলি ?... চিতার কাছে আসবে । বসবে । ফিসফিসিয়ে কাঁদবে, গর্জাবে ...। অসুবিধা হবে চিনতে ?
৩য় (বালক) - চুপ । কেউ আসছে ।
                   (ওরা চুপ করে যায় । কিন্তু কেউ আসেনা । সিঁড়ির ওধার থেকে একজন শ্মশানসঙ্গী উঁকি মেরে চিতাটা দেখে । স্বগতোক্তি করে নেভেনি । এখনও ঘন্টাখানেক লাগবে । বলে অদৃশ্য হয়ে যায় ।)
সত্যি বলতে কুশলটা বেচারা বেঘোরে মরল । ... অনেক আগে খতম করে দেওয়া উচিৎ ছিল ওর ছোটকাকে । রামস্বরূপ সিংএর ডান হাত ভেঙে যেত । আমাদের টোলায় গত দুবছরে পাঁচটা হামলার মধ্যে তিনটে লীড করেছে ও । বাকি দুটোর সময় বম্বে গিয়েছিল মালিকের কাজে । শালা কুত্তা । সেদিনও দিদির ওপর ... (বলতে গিয়ে গলা ভেঙে আসে, বাকি দুজন ওর কাঁধে হাত চাপড়ে প্রবোধ দেয় । চুপ থাকে তিনজনেই । একটু পরে অন্যদিক থেকে চুপিসাড়ে, মাথায় মুখে কাপড় বাঁধা, বন্দুক কাঁধে দুজন লোক প্রবেশ করে । একজন চিতার কাছে এগিয়ে যায়। হাঁটু গেড়ে বসে । তিনজন বালক বালিকা ক্ষিপ্রতার সাথে পজিশন নেয় ।)
ছোটকা -       তোকে মারার বদলা তো আমি নেব কুশল । এমন বদলা নেব যে ... ! এত হিম্মত হয়ে গেছে ওই হারামিগুলোর ! পুরো টোলা ওদের ছারখার করে দেব এবার । শাবল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আগুনে পোড়াব। দেখব কোন মসীহা আর কোন পার্টি ওদের বাঁচাতে আসে । ... আমাকে ওরা চেনেনি এখনও, যে চাইলে ...
                   (গুলি চলে । এক বালক ছোটকাকে তাগ্‌ করে । বাকি দুজন ছোটকার সঙ্গীকে ব্যস্ত রাখে । মোক্ষম গুলিতে ছোটকা লুটিয়ে পড়ে । তার সঙ্গী আড়াল খোঁজে । তখনই একজন বালক একটা বোমা ছোঁড়ে । ধোঁয়া, আগুন । তিন জন বালক-বালিকা পালিয়ে যায় । নেপথ্যে বাইকের আওয়াজ । মিলিয়ে যায় । ছোটকার সঙ্গী দ্রুত উঠে এসে রক্তাক্ত ছোটকার শরীর টানতে টানতে নেপথ্যে নিয়ে যায় । কিছু চাপা শোরগোল হয় পিছন দিকে । হন্তদন্ত হয়ে পুলিশ দুজন এবং শবসঙ্গীরা সিঁড়ির ওপর উঠে দাঁড়ায়, খানিক নেমে আসে । কাছে আসতে ভয় পায় । ওখান থেকেই অন্ধকারে ঠাহর করে ।)
কুশ. পিতা -   (সবচেয়ে পিছন থেকে) ছোট এসেছিল নির্ঘাৎ ।
১ম পুলিশ -    আর কে এসেছিল ?
২য় শ্ম.সঙ্গী -  কেউ তো এসেছিল পাল্টা তরফেরও । নইলে গুলি বোমা চলল কী করে ?
২য় পুলিশ -    পিছু হটুন আপনারা । এদিকেই থাকুন । ফোর্স আসা দরকার । থানায় খবর দিতে হবে (প্রথম পুলিশকে) এদের নিয়ে এখানে থাক । আমি থানায় খবর দেওয়ার ব্যবস্থা করি । (সবাই আবার ওদিকে চলে যায় ।)  
                   (এতক্ষণ গুলির আওয়াজ, হাঙ্গামার মধ্যে কাটিয়েও মধুর পিতা অর্থাৎ বৃদ্ধের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই । মদ খেয়ে যেমন ঝিমোচ্ছিল তেমনই ঝিমোতে থাকে । ... চিতার ওপর লাল আলো নিভে যায় । অলৌকিক এক ফিকে আলো ছড়িয়ে পড়ে সামনের দিকের সবটা জুড়ে । বৃদ্ধ হঠাৎ টেনে তোলে নিজেকে । মঞ্চের নিচে থেকে অর্থাৎ নদী থেকে উঠে আসে এক সাদা নরম কাপড় জড়ান স্ত্রীলোক । বসে পড়ে বৃদ্ধের একটু দূরে । বৃদ্ধ খেয়াল করেনা । ওদিকে চিতার ছাই থেকে উঠে বসে মৃত বালক, কুশল । বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে আসে ।)
কুশল -          এসে গেছি ধর্মরাজা ! (বৃদ্ধের পুঁটুলির ভিতরে হাত ঢুকিয়ে একটা মুকুট বার করে বৃদ্ধকে পরিয়ে দেয় । বৃদ্ধ চমক ভেঙে কুশলকে দেখে । তার পর অদূরে বসে থাকা স্ত্রীলোকটিকে দেখে । কিছু একটা অস্বীকার করার ভঙ্গীতে মাথাটা দুলিয়ে দুলিয়ে নাড়ে ।)
বৃদ্ধ -            কেউ শালা মানতেই চায় না । কেন মানতে চায় না? ফিরে ফিরে আসছে সেই ভগবান । ফিরে ফিরে আসছে আকাশ-জল-মাটি-বাতাস আর আগুন দিয়ে তৈরি শক্তি । সময়ের ফুল । তারই মধ্যে তো প্রতিষ্ঠিত হন ভগবান । আর তোরা তাকে বানাচ্ছিস লাশ । ফিরে ফিরে আসছে লাশ । প্রতিদিন । ... অথচ কেউ মানতেই চায় না ।
স্ত্রীলোক -       আমি মানি । (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) আমি যে নিজেই বয়ে বেড়াচ্ছি এক জগদ্দল । লাশের বাড়া লাশ । প্রতিটি প্রহর ।
বৃদ্ধ -            তুই আবার কে রে । (ঠাহর করে দেখে) ও বাবা, এ তো মেয়েলোক । এই অন্ধকারে এখানে কী করছিস ?
কুশল -          ও কি ধর্মরাজা, নিজের বোনকে চিনতে পারছ না ? নদী । তুমি যম, ও যমুনা ।
বৃদ্ধ -            (অনিশ্চিত ভাবে) ওঃ, তা ... কী ? এখানে ? এখন ? কেন ?
স্ত্রীলোক -       তোমার ব্যথার টানে উঠে এলাম । তোমার দীর্ঘনিঃশ্বাসে উঠে এলাম । আমিও যে নিষ্কৃতি পাই না কিছুতেই । অথচ নিঃশ্বাস বন্দ হয়ে আসে । গতি রুদ্ধ হয়ে যায় ।
কুশল -          আমি কি দাঁড়িয়ে থাকব ধর্মরাজা ? এখানেই ? আমাকে নিয়ে যাবে না?
বৃদ্ধ -            কোথায় নিয়ে যাব তোকে ? কোথায় নিয়ে যাব বল তো যমুনা ? স্বর্গে ? নরকে ? কোথায় এর পাপ আর পূণ্যের হিসেব ?
স্ত্রীলোক -       আমায় দিয়ে দাও ।
বৃদ্ধ -            তুই নিয়ে যাবি ? তোকে দিয়ে দেব ? জানি না । ... কিন্তু তুই তো আবার বললি যে তোর নিঃশ্বাস বন্দ হয়ে আসে । কি  যেন এক জগদ্দল ... ।
স্ত্রীলোক -       সে তো ওই পাপপূণ্যের আবর্জনা । দুনিয়ার মানুষের । বেড়েই চলেছে আমার শরীরে । (কুশলের মাথায় হাত রেখে) এ তো আমার গতি, আমার ঢেউ । আমার রোদ-ঝিলিক । একে দিয়ে দাও আমার ভাগে ।
বৃদ্ধ -            তাহলে চল্‌, আমিই একে তোর ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসি ।
                   (ছেলেটির হাত ধরে বৃদ্ধ । পাশে স্ত্রীলোক । বৃদ্ধের মাথায় মুকুট । মাঝখানে কুশল চলতে থাকে ।)
                   (ছেলেটির উদ্দেশে) এবারে কী হয়েছিল তোর ? কিসের খুনোখুনি ? না কি অসুখবিসুখ ?
কুশল -          (চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর) রাতে শুয়েছিলাম । বাবা ছিল । মা ছিল । দিদিরা ছিল । হামলার ভয় তো ছিলই । তাই ছোটকা ছিল না বাড়িতে । আর আমরাও ঘুমোইনি কেউ । পালাবার জন্য তৈরি ছিলাম । কিন্তু ভোরের ঠিক আগে হামলা শুরু হতে যেই খিড়কি দিয়ে পালাতে গেলাম, পা হড়কে পড়ে গেলাম কলাবনের কাছে । বাবা পিছু ফিরে দৌড়ে আসছিল । কিন্তু ততক্ষণে একটা প্রচন্ড ঘা পড়ল আমার ঘাড়ে । আর আমি কিছু জানি না । শুধু শুনতে পেলাম কেউ বলছে, ছাড়বি না এই হারামির বাচ্চাটাকে, এও সেদিন ছিল ছোটর দলবলের সাথে...
স্ত্রীলোক -       সেদিন মানে ? কোন দিন ? কী হয়েছিল ?
(কুশল দুজনের দিকে অনিশ্চিত ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে কিছু ভাবে)
কুশল -          আচ্ছা, তোমরা সংস্কার বোঝ ? ছোটকা বলে সংস্কারহীন হয়ে যাচ্ছে দুনিয়া । ছোটরা বড়দের মানছে না, মুখে মুখে কথা বলছে । যারা শূদ্র তারা মুখ লাগাচ্ছে উঁচু জাতের । রামস্বরূপজি এত করেছেন গ্রামের উন্নতির জন্য । তার বিরুদ্ধে জমায়েত হচ্ছে মুসহরটোলায় আর কোথায় কোথায় । ... তো সেই জন্যই তিনচার সপ্তাহ আগে এক রাতে ছোটকাদের দল গিয়েছিল ওদের টোলায় । আমাকে বলল, চল, তুইও আজ মরদ হয়ে আসবি । টোলার একেবারে শেষের দিকে ভীমজীর ঘর । সবাই ধরা পড়ে গেল । বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল । ... ভীমজীর মেয়ে আমারই ছোড়দির বয়সী । ছোটকা ওকে (ইতস্তত করে) যেমন সিনেমায় থাকে না ? খারাপ সীন । ছোটকা, তার দলের তার জন । তারপর হাসতে হাসতে আমাকে উঠিয়ে ওই ভাবে শুইয়ে দিল ওর গায়ের ওপর । ... আমার কেমন গা ঘিন ঘিন করে উঠল । অন্ধকার, নরম গা, রক্ত । আমি ওদের পায়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পালিয়ে গেলাম । হাঁপাতে হাঁপাতে নিজের বাড়ির কাছে এসে পিছনে দেখলাম । দাউ দাউ করে জ্বলছিল ঘরটা ...
                   (বৃদ্ধ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে । স্ত্রীলোকটি কুশলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে । বৃদ্ধ মুকুটটা মাথা থেকে উপড়ে ছুঁড়ে ফেলে চিতার ওপর । তারপর কোঁচড় থেকে একটা বিড়ি বার করে চিতা থেকে নিভু একটা অঙ্গার খুঁজে তাতে ধরায় । টানতে টানতে গিয়ে বসে পড়ে সিঁড়ির ওপর ।)

[নাটকের মঞ্চ-নির্দেশাদি নিছক মাথায় ঘুরতে থাকা ছবিটা স্পষ্ট করতে চাওয়া । প্রয়োজনে ওগুলো অপ্রয়োজনীয় বলে বাদ দেওয়া যেতে পারে। ]           
__________
জামাইবাবু  
জ্ঞাতি

[২০০৯, ২০১০ বা ২০১১র সঞ্চিতা, সাহিত্য সংখ্যায় প্রকাশিত]

No comments:

Post a Comment