জায়গাটার নাম বলায় দুবার ভুরু
কুঁচকে অটো ড্রাইভার অন্যদিকে তাকিয়ে ভাড়া বলল। বোঝালো যাওয়ার খুব বেশি ইচ্ছে নেই,
তবে ওইরকম মোটা ভাড়া পেলে যেতে পারে। কিন্তু সুমনের যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। মানে দরকার ছিল।
আর জায়গাটা পুরোপুরি অচেনা। কাজেই, দরদাম করার স্কোপ খুব বেশি ছিল না।
রাস্তায় ইয়েলাহাঙ্কা নামে
একটা জায়গা পড়ে; নামটা বহুবার সে শুনেছে, গুগল ম্যাপে দেখেওছে তাই মনে আছে – তারপর?
ইয়েলাহাঙ্কা ছাড়িয়ে ক্ষেত,
বনবাদাড় কব্জা করে তৈরি হতে থাকা নতুন এলাকায় বহুক্ষণ ঘুরতে ঘুরতে শেষে পেল জায়গাটা।
কর্মচারি আন্দোলন, ওদের ভাষায় ইউনিয়নবাজিকে শায়েস্তা করতে আজকাল এটা চল হয়েছে, প্রশাসনিক
ভবনের নতুন এক্সটেনশন এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা স্টাফ কলেজগুলোকে শহরের কেন্দ্রে না
রেখে দূরে, একেবারে বাইরে নিয়ে যাওয়া। তা’বলে এতটা বাইরে!
তাও ব্যাঙ্গালোরের মত শহরে! যেখানকার ইউনিয়নবাজি যেমনই হোক, কলকাতা আর পাটনার মত নয়
নিশ্চয়ই।
তাও ভাগ্যিস ঠিক সময় মত পৌঁছেছিল।
ভেবেছিল, পৌঁছে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে, রাস্তায় চা-টা খাবে তারপর ছুটি হলে সবাই যখন
বেরিয়ে আসবে, গেটের মুখে ধরবে। এক তো অচেনা জায়গা, তায় অচেনা ভাষা, তার ওপর কলেজটাও
তার নিজের ব্যাঙ্কের নয়, অন্য ব্যাঙ্কের, নতুন রিক্রুটদের ইন্ডাকশন করানোর ঠিকা নিয়েছে।
কাজেই ভিতরে ঢোকা বুদ্ধির কাজ হবে না। কিন্তু পৌঁছে অটোওয়ালাকে পয়সা দিয়ে ফিরতি সফরের
টোপ দিতে দিতেই দেখল সবাই বেরিয়ে পড়েছে, এমনকি অনেকে হেঁটে এগিয়েও গেছে কিছুদূর।
যাহোক, দেখল গেটের মুখে জমা
ভীড়টার ভাষা হিন্দি। কাজেই সবার সাথে আলাপ করতে একেবারে এগ্রেসিভ মোডে নিজের পরিচয়
দিয়ে হাত বাড়ালো। কাজও হল। সবাই হাত মেলালো। কথাবার্তা এগোল। একসময় সবাইকে ইউনিয়নে
যোগ দেওয়ার আহবান জানালো। একটি ছেলে সোজাসুজি ফর্ম চাইল। তাকে একসাথে পাঁচটা ফর্ম এবং
আরো দু’একজনকে একেকটা করে ফর্ম দিল সুমন। জানত এই সন্ধ্যারাতে নির্জন জায়গায়
কেউ এখন দল বেঁধে চায়ের দোকান খুঁজতে আর গিয়ে আড্ডা দিতে উৎসাহিত হবে না। সে কথাটাই
মুখে বললও, “এখানে তোমাদের সঙ্গে কোনো দোকানে বসে একসাথে চা খাবো সে পরিস্থিতিও
নেই আর তোমরাও রেস্ট নিতে চাইবে সারাদিনের ক্লাসের পর। পরে তো দেখা হবেই – পাটনায়। হ্যাঁ, আমি চাকরিতে আর নেই, রিটায়ার করেছি তবে কাজেকর্মে
তো আছিই। মিটিং, সিটিংএ দেখা হবে। তখন নাহয় আমরা একসাথে চা খাবো – আজকেরটা বাকি রইল।”
বিদায় নিয়ে অন্ধকারে ফিরছিল
ইয়েলাহাঙ্কার দিকে। নতুন রিক্রুটদের একেবারে গোড়ায় ধরা প্রথম থেকেই ইউনিয়নবাজির একটা
গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ভাবতে পারত ‘সংগঠন গড়ে তোলার’, তবে কলকাতার
লোক তো সে নয়। অত গম্ভীর, সাংবিধানিক শব্দ বিহারে চলে না। বিহারের শ্রেণীগুলোর গঠনে
যেমন, ভাষাতেও গ্রাম্য অবিচ্ছিন্নতা – ইউনিয়ন একটা বিলিতি হুজুগ যেন, তাই ইউনিয়নবাজি।
নতুন রিক্রুট ফস্কে যাওয়াতে বহুবার বকুনি খেতে হয়েছে। ইউনিয়নগত প্রতিযোগিতা আছে, এবং
যেহেতু সংখ্যালঘু ইউনিয়ন, কর্তৃপক্ষের পেটোয়া ইউনিয়নের সাথে একটা লড়াইয়ে থাকে সব সময়
তাই নতুন রিক্রুটদের মধ্যে কতজন এদিকে এল সেটা বড় নেতাদের কাছে কাজের বড় পরীক্ষা। পেটোয়া
ইউনিয়নের লোক আছে এস্ট্যাব্লিশমেন্টে। নতুন রিক্রুটদের লিস্টটা মায় ঠিকানা সহ, তাদেরই
কোনো সদস্য টাইপিস্ট টাইপ করে অথবা ফ্যাক্স রিসিভ করে; কর্তৃপক্ষ যতই ড্যাম-সিরিয়াস
মুখ দেখিয়ে না-না করুক, পাঁচ মিনিটের মধ্যে খুব সহজে একটা কপি পৌঁছে যায় তাদের নেতাদের
টেবিলে।
“আর আমরা? কতরকম প্যাঁচপয়জার কসতে হয়!” একটা পুরোনো ঘটনা মনে পড়ল সুমনের। ইউনিয়ন তৈরি হওয়ার পরে পরেই নতুন
রিক্রুটমেন্ট হয়েছিল বি.এস.আর.বি.র আর হেড অফিস থেকে বিহারের লিস্টটা আসার অপেক্ষা
শুরু হয়ে গিয়েছিল দুদিন ধরে।
যেদিন ফ্যাক্স পৌঁছোল, রাজীব
খবর দিল। বিকেলে সে পৌঁছে গেল পার্সোনেল ম্যানেজারের টেবিলের সামনে। কিন্তু কিছুক্ষণ
পরে দেখল, যা চ্যাঁচামেচি সে-ই করছে, রাজীবের গলাটা কেমন নরম। এরকম তো হয়না। কাজেই
কিছুক্ষণ “এটা অন্যায়! আপনারা মুখেই শুধু বলেন আপনাদের কাছে সব ইউনিয়ন এক।
সামান্য একটা জিনিষ, কাল যারা এই ব্যাঙ্কেই জয়েন করবে তাদের লিস্ট, যাতে আমরাও তাদের
গ্রিটিংস পাঠাতে পারি, আমাদের দেবেন না। অথচ ওরা পেয়ে গেছে …” এসব নীতিপ্রসঙ্গ কপচে রাজীবের হাত ধরে টেনে বেরিয়ে এল। সুইং ডোরটা
বন্ধ হতে হতে শুনল পার্সোনেলের “বিশ্বাস করুন ভাই, আমার এই টেবিল থেকে কারোর কাছে কোনো লিস্ট
যায় নি …” ।
বাইরে এসে কিছু বলার আগেই
রাজীব আশ্বস্ত করল, “ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমাকে মুজফফরপুর পৌঁছোতে হবে আজ রাতেই।
কাজেই আপনিও স্টিমার ধরুন। ওখানেই বলব গল্পটা।
হ্যাঁ। তখন মুজফফরপুর মানে
তো স্টিমার। পহলেজা ঘাট। এক অন্য যুগ। এখন তো পুল তৈরি হয়ে গেছে পঁচিশ বছর হল। দ্বিতীয়
পুলটাও তৈরি হচ্ছে – তাতে আবার রেললাইনও থাকবে।
পরে রাজীবের মুখে যে গল্পটা
শুনেছিল সেটা জোনাল অফিসের টাইপিস্টদের মধ্যেকার। … জোনাল অফিসে
টাইপিস্ট দুজন। সুহৈল হিন্দি, কিন্তু ইংরিজিও জানে। চাকলাদার ইংরেজি কিন্তু আবার স্টেনোও।
মেজরিটি ইউনিয়নের খাস লোক। সুহৈল কথায় বার্তায় একটু বদমেজাজি কিন্তু আমাদের ইউনিয়নের
ছেলেদের সাথে বেশি বন্ধুত্ব। রাজ্যের পাস করা ক্যান্ডিডেটদের লিস্টটা চাকলাদার টাইপ
করবে। টাইপ মানে সেই পাতলা কাগজে সাত কপি, তার কার্বনও পাতলা – একবারের পর দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা যায় না। রাজীবের সাথে হওয়া কথা
মত সুহৈল একটা পার্সোনাল কাজের কথা বলে চাকলাদারকে, ইংরেজির। চাকলাদার লিস্টটা টাইপ
করেই শেষ কপিটা নিয়ে ছুটবে ইউনিয়নের ঘরে তাই অস্বীকার করে আর সুহৈলকে নিজেই করে নিতে
বলে। সুহৈলের কাজটা ফেক, ফালতু – ডকুমেন্টগুলো ছড়িয়ে টাইপরাইটারে কাগজ চড়িয়ে খুটখাট করে যায়
আর আড়চোখে চাকলাদারকে দেখতে থাকে। টাইপ করে, পার্সোনেল অফিসারকে সাতটা কপি আর অরিজিনাল
ফ্যাক্সটা দিয়ে চাকলাদার, টাইপে লাগানো আট নম্বর কপিটা নিয়ে যেই ছুটল ইউনিয়ন অফিসে,
সুহৈল গিয়ে চাকলাদারের টাইপরাইটারে ঝুলে থাকা সাতটা কার্বন থেকে মাঝের দ্বিতীয়টা সরিয়ে
একটা নতুন ওই রকমই কার্বন ফিট করে দিল। তারপর নিচে গিয়ে রাজীবকে খুঁজে আস্তে করে পকেটে
গুঁজে দিল ভাঁজ করা কার্বনটা।
মুজফফরপুর রাজীবের শ্বশুরবাড়ি।
আর সুমনেরও মুজফফরপুরে আসা হয়েই যায় – কেন না ছোট জ্যাঠামশায়ের বাড়ি। কিন্তু
রাজীবের শ্বশুরবাড়িতে কখনো সে যায় নি। তবে দেখল রাজীবের শালীই এসে দরজা খুলছে। ওকে
সে চেনে। গিয়ে বসে রইল দু’ঘন্টা। মশার কামড় খেল এন্তার আর চা খেল দু’বার। জলখাবার ফিরিয়ে দিল; রাজীব এলে একসঙ্গে খাবে। রাজীব এল রাত
ন’টায় তাই জলখাবার আর হল না। আগে দু’জনে রাতের খাওয়া
সারল। আলোর সাশ্রয় ব্যাপারটার খুব চলন ছিল সেসময় এসব শহরগুলোয়। পুরোনো পনেরো ওয়াটের
টাংস্টেন বাল্ব মানে কালি-মোছা লন্ঠন। সেই আলোয় কার্বনটা মেলে ধরে পাঠোদ্ধার করতে করতে
একে একে সবকটা নাম ঠিকানা কাগজে লিখে নিল দুজনে মিলে। … পরের দিন পাটনায়।
আর কি! রাজা! পাড়া ধরে ধরে পাঁচ’ছটা গ্রুপ করল সবাই মিলে – কঙ্কড়বাগ এলাকার
ঠিকানা, বোরিং রোড এলাকার ঠিকানা (কুর্জি, দীঘা ইনক্লুডেড), মহেন্দ্রু-সুলতানগঞ্জ।
একেকজন একেক এলাকার দায়িত্ব নিল। চার দিন পর পেটোয়া ইউনিয়ন মুখ চুন করে দেখল তেইশ জনের
মধ্যে এই ইউনিয়নের ঝুলিতেও এসেছে ছ’জন। ততদিনে সুহৈলেরই যে কোন কারসাজি আন্দাজ পাওয়া গেছে। ওরা
ডিজিএমকে বলে জবরদস্তি বেচারাকে সুপারনিউমেরারি পোস্টিংএ ঠেলে দিল একটা ব্রাঞ্চে। সেটা
অবশ্য পরে বদলাতে পেরেছিল সুমনেরাও। লাভের মধ্যে, সুহৈল পাকাপাকি তাদের মেম্বার হয়ে
গিয়েছিল।
হঠাৎ খুব তাড়াতাড়ি মারা গিয়েছিল
সুহৈল। ওর কথা মনে পড়লেই সুমনের মন খারাপ হয়ে যায়। তাদের ইউনিয়নের মেম্বার হওয়ার পর
তার ওপর কতো আক্রমণ, হেনস্থা। তার ওপর সেও শালা রগচটা, ঝগড়া করতে করতে অফিসারদের মধ্যে
কে বন্ধু কে শত্রু তাও গুলিয়ে ফেলে। … বৃষ্টির মেঘলা দিন ছিল। ফুলওয়ারিশরিফের
একটা পাড়ায়, মঞ্জিলের সঙ্গে গোরস্তান অব্দি পৌঁছেছিল। … জোনাল অফিসে
কতোবার ওর টিফিন থেকে ভাগ নিয়ে খেয়েছে! … যাহোক, পরে ওর বৌটার চাকরি করাতে পেরেছিল
কম্প্যাসোনেটে।
২
পাটনায় ফিরে এসে একদিন সাপ্তাহিক
বৈঠকে মেন ব্রাঞ্চে গেছে সুমন। এখন আর সে অবস্থা নেই। তাদের ইউনিয়ন সংখ্যাগরিষ্ঠতার
দিকে এগোচ্ছে। দু’বছর আগের রিক্রুট দেবেশের গল্প শুনে সে নিজেই সিঙাড়া আর মিষ্টি
আনিয়েছে সবার জন্য। দেবেশ মানে সেই ছেলেটা যার সাথে ব্যাঙ্গালোরে, মানে ইয়ালাহাঙ্কা
থেকে আরো মাইলখানেক গিয়ে তাদের ট্রেনিং সেন্টারে দেখা করেছিল। দেবেশই পাঁচটা ফর্ম চেয়ে
নিয়েছিল তার কাছ থেকে। …
সেই দেবেশ নিজে উদ্যোগ নিয়ে
সদ্য গিয়েছিল, রাঁচি। রাঁচি আবার পেটোয়া ইউনিয়নের ঘাঁটি। অথচ তারই মধ্যে গিয়ে দেবেশ
ওখানকার জোনাল অফিসে নতুন ব্যাচের রিক্রুটদের সঙ্গে দেখা করে সবাইকে ফর্ম দিয়েছে, নিজেদের
ইউনিয়নের বক্তব্য রেখেছে। অন্য ইউনিয়নের লোকেরা মারপিটের হুমকি দিতে শুরু করলেও জায়গা
ছাড়েনি। শেষে ম্যানেজমেন্টের কয়েকজন কর্তা এসে হাতজোড় করায় বেরিয়ে এসেছে।
মিটিংএ বেশ কয়েকটি নতুন মুখ।
কয়েকটি মেয়েও আছে। ওদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে সুমন, আর বেশিদিন নেই তার বা তার বয়সের
বন্ধুদের ইউনিয়নবাজির। নতুন ছেলেমেয়েদের হাতে দায়িত্ব দেওয়ার সময় ওই ছেঁদো প্রশ্নটা
তুললে হবেনা, ওরা এখনো দায়িত্ব নিতে যোগ্য কিনা। প্রকৃতির নিয়ম অস্বীকার করে কোনো বদল
আনা যায় না, এই সত্যটা মানতে হবে।
বক্তব্য রাখতে উঠে সুমন সেই দুটো রাতেরই গল্প শোনালো। মনে মনে আঁক কষছিল – ফেসবুকে দেবেশ তার ফ্রেন্ড; মাঝেমধ্যে ওর টাইমলাইনে গিয়ে লক্ষ্য রাখে – প্রতিবাদী স্টেটমেন্টগুলো ধরে ঠিকই ছেলেটা, কিন্তু! একটা আত্মকেন্দ্রিকতা আছে কি? ১৯৯০এর আগের পৃথিবীটা যে আর নেই! অবশ্য ও বয়সে তরুণ। বিয়ে করবে আজ নয় তো কাল। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় রীচ বাড়ানোর তো আর কোনো উপায় নেই একটু ‘আত্মকেন্দ্রিক’, ‘আত্মমুগ্ধ’ হওয়া ছাড়া। সেল্ফি শব্দটাই তো এ যুগের! … দেবেশের মতো ছেলেমেয়েদের যতো শিগগির সম্ভব ঠেলে দিতে হবে জলে, পেঙ্গুইন শিশুদের মতো।
১৭.৪.২২
No comments:
Post a Comment