Thursday, August 28, 2025

বড় জামাইবাবু

জ্যোৎস্না সন্ধ্যায় তারা বেরিয়েছে। কাজল রাস্তা দেখিয়ে জামাইবাবুকে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল রেললাইনের ওপারে। যেমন নিজে শর্টকাটটা ব্যবহার করে রোজ। কিন্তু জামাইবাবু যেমন ধীর, শান্ত, সবার জন্য হাসিমুখ তেমনি ভিতরেও প্রসাদচিত্ত। বললেন, ছাড়ো ওসব শর্টকাট। কী সুন্দর সন্ধ্যা। চলো, এখান থেকেই রিকশা করে নিই।

সওয়ারি বলতে এক সাইকেল-রিকশাই ছিল সেসময়। গলি ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠে লেভেল ক্রসিং। সেটা পেরিয়ে ডানদিকে এগোলে আরো একটা ছোটো, সবসময় খোলা লেভেলক্রসিং পেরিয়ে তবে তেরাস্তা। তারপরেই ম্যাংগ্‌ল্‌স রোড। এমএলএ, এমএলসিদের বাড়ি, সার্কিট হাউজ, পাটনা ক্লাব, মিলার স্কুল, রবীন্দ্রভবন। সুন্দর, চওড়া পরিচ্ছন্ন রাস্তা। কোনো লোকজন নেই।

রিকশাওয়ালা জামাইবাবুকে বোঝাচ্ছিল কেন পূর্বদিকের লেভেলক্রসিংএর দিকে না গিয়ে ঘুরপথটা নিল। প্রচন্ড ভিড় থাকে ওদিকে, আর সবসময় বন্ধ।

কাজল মনে বলল, হুঁঃ, আর ভাড়াটাও বেশি পাওয়া যাবে। এখন সোজা অতটা দূরে গিয়ে আবার ডান দিকে যাবে সেই পূর্বদিকের লেভেলক্রসিং থেকে বেরুনো সোজা রাস্তাটায়। …” জামাইবাবু ওদিকে রিকশাওয়ালাকে তার মগহী-মেশানো ভাষায় সায় দিচ্ছিলেন, ঠিক করেছ। এই তো ভালো, বেশ শহরটা ঘুরতে ঘুরতে যাচ্ছি। ঘুরব বলেই তো বেরিয়েছি!

দুধারে বড় বড় গাছের কালচে-সবুজ উঁচুতে ওঠা ছড়ানের ফাঁক দিয়ে নদীর মত এপার ওপার দেখা যাচ্ছিল আলোয় ভরা আকাশ। হ্যাঁ, এখন সে এসব ব্যাপার দেখার লায়েক হয়ে উঠেছে আর সেই প্রসঙ্গেই তো জামাইবাবু তাকে নিয়ে বেরিয়েছে।

 

তবে অনেক বছর আগে সে যখন ছোটো, তার জ্যাঠতুতো তিন দাদা এসেছিল কলকাতা থেকে, মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে। তখন সে তাদেরকে তার নিজের মত করে শহরটা ঘুরিয়েছিল। এই একই পথে তারা এসেছিল, কিন্তু হেঁটে হেঁটে। হাঁটতে তার চিরকালই ভালো লাগে। তার মতে, না হাঁটলে ঘোরা হয় না, চেনাও যায় না কিছু। সেটাও এমনই জ্যোৎস্নায় ভরা সন্ধ্যা ছিল। আর দূর থেকে ভেসে আসছিল মিষ্টি স্বপ্নের মত একটা গান, কোথাও মাইকে বাজছিল তেরা মেরা প্যার অমর, ফির কিঁউ মুঝকো লগতা হ্যয় ডর। গানটা যেন সেঁটে রয়ে গেছে এমন সন্ধ্যার সঙ্গে। ম্যাংগ্‌ল্‌স রোডে ঢুকতেই মনে পড়ে গেল।

এবার জামাইবাবু মূলকথায় এলেন। বস্তুতঃ এই কথোপকথনটা সম্ভব করানোর জন্যই বাবা অথবা বাবা-মা দুজনেই বড় জামাইবাবুকে কলকাতা থেকে ডেকে আনিয়েছেন। কেননা বড় জামাইবাবু তার ভ্রাতৃস্থানীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বড়। বয়সেও, শিক্ষাতেও এবং পদমর্য্যাদাতেও। সবাই তাঁকে সম্মান আর শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। অথচ একফোঁটা গুমোর কখনো দেখেনি কেউ তাঁর চোখেমুখে। সদাহাস্যমুখ, সদালাপী। অবশ্য তার সেই পিস্তুতো দিদিও তেমনই বড় আর বিদ্বান অধ্যাপক। সেই দিদিকেও সবাই খুব সম্মান ও শ্রদ্ধা করে।

আর শুধু শ্রদ্ধা তো নয়, সবচেয়ে বেশি ভরসার মানুষ। কোনো কথায় বাবা-ছেলেতে বা মা-ছেলেতে মতবিরোধ হল, ব্যস, ডাকো তো গিরীশকে! ওই বোঝাতে পারবে।

এবারও সেভাবেই আসা। অথচ এত যে ভরসার মানুষটা, সে কিন্তু বাঙালি নয়। পিস্তুতো দিদির লাভ ম্যারেজ, মানুষটি হিন্দিভাষী, নাঃ, মৈথিলীভাষী। অথচ বাঙালি ঘরের আচার অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা পরিবার হয়তো এক হয়েছে কোথাও, কলকাতায়, পাটনায়, মুজফফরপুরে, গোলযোগ লেগেছে কী হবে না হবে, কিসের পরে কী হবে, ডাকো তো গিরীশকে? কোথায় গিরীশ?

 

এবার বল কাজল”, জামাইবাবু কথা শুরু করলেন, আচ্ছা দাঁড়াও, আগে বল কাছাকাছি কোনো সিনেমাহল আছে?

-       কেন?

-       আহা, বলই না।

-       হ্যাঁ, এই তো ডানদিকে গিয়ে পরপর দুটো সিনেমা হল। অশোক, পার্ল।

-       ভালো কোনটা?

-       ভালো তো অশোক।

-       আর সেটাই বেশি কাছে, তাই তো?

 -  হ্যাঁ।

-       ব্যস, তাহলে আমরা এখন সিনেমা দেখব।

-       এমা, অশোকে তো বাজে সিনেমা চলছে একটা।

-       কী চলছে?

-       গোমতী কে কিনারে

-       বাঃ, সে তো মীনা কুমারীর শেষ ফিল্ম, বাজে কেন হবে? দেখেছ?

-       নাঃ, এমনিতেও এসব ফিল্ম আমার ভালো লাগে না। আর তার ওপর, বন্ধুরা যারা দেখেছে, তারাও বলেছে, বোরিং।

-       চল না, দেখেই নিই। আপত্তি নেই তো?

-       না, চলুন।

-       আচ্ছা এবার বল, তুমি তো আজকাল চুটিয়ে লেখালিখি শুরু করেছ শুনলাম। পত্রিকাও নাকি বার কর। কী নাম পত্রিকার?

-       উন্মেষ

-       বাঃ, উন্মেষ, যথাযথ নাম। সাহিত্য ভালো লাগে?

-       হ্যাঁ যেটুকু পড়েছি বা পড়ি।

-       কী লেখ?

-       কবিতা, গল্প

-       বাঃ, খুব ভালো। কিন্তু, জীবনটা চালাতে হলে অন্য কিছুও করতে হবে তো। শুধু সাহিত্য করেও জীবন চলে, চলে না তা নয়। বড় বড় লেখকেরা অনেকেই সাহিত্য করে নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণ করেছেন। বিদেশে পথটা সুগম, এদেশে দুর্গম। তারপর, তুমি তো বাড়ির এক ছেলে। বাকি দুই বোন। পুরো সংসারটা তোমার বাবার ওপর।

-       অন্য কিছু করব না তা তো কখনো বলিনি! চাকরি তো খুঁজছিই। কয়েক জায়গায় আবেদনও দিয়েছি। টিউশনি করতাম। আবার করতে পারি।

-       তুমি ল ক্লাসে যাওয়া ছেড়ে দিলে। অডিট ফার্মে যাও কিন্তু অনিয়মিত। আর্টিক্লশিপ না কী বলে, সেটা করতে গেলে তো তৈরি হতে হবে, পরীক্ষার জন্য প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে।

-       ওসব আমার হবে না। ল-য়ের ইভনিং ক্লাসে স্টুডেন্টও ঘুমোয়, টিচারও ঝিমোয়। আর কমার্সের কোনো বিষয় আর পড়তে আমার ইচ্ছে করে না।

-       কমার্স তো তোমার সাবজেক্ট! আর তুমি তো ফার্স্ট ক্লাসে পাশ করেছ।

-       সে তো

 

গোলচত্বরটা এসে গিয়েছিল। হেঁকে রিকশাওয়ালাকে ডানদিকে যেতে বলল কাজল, অশোক সিনেমা জানা হ্যয়।

-       হ্যাঁ, কী বলছিলে?

-       নাঃ, কিছু না। কমার্স ভালো লাগে না আমার। আমি তো সাইন্সেই থাকতে চেয়েছিলাম। হয়েও গিয়েছিল। বাবা বলল অন্য ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া চলবে না

-       আচ্ছা, সেসব তো হয়ে গেছে। ঠিক আছে, ল করবে না, কোরো না। অডিটলাইনে যাবে না, যেও না। কিন্তু একটা কোনো দিকে এগোতে তো হবে!

-       আমার স্পষ্ট কথা, একটা চাকরি আমি নিশ্চয়ই করব। কিন্তু ব্যস, ঐ পর্য্যন্ত। তারপরে যেন তাড়া না আসে, ক্লার্ক কেন, অফিসার হ, ম্যানেজার হ । মোটামুটি নিজের, পরিবারের ভাতটুকু জোটাবো আর সাহিত্য করব। সত্যি যদি তেমন ভালো আর অনেক অনেক লিখতে পারি, তা থেকে আয় করতে পারি, তখন চাকরিটাও ছেড়ে দেব।

-       পরে আপশোষ হবে না তো?

-       না।

কিছুক্ষণের নীরবতা। রাস্তাটাও এমন, শান্ত, স্বল্পালোক! আকাশে জ্যোৎস্না। যেন ধমকাচ্ছে, আহ্‌, হচ্ছেটা কি? একটু চুপ করে থাকতে পারো না? নিঃশ্বাস নিতে পারো না জোরে জোরে, পরিষ্কার হাওয়ায়?

কাজল বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল অনেকক্ষণ। জামাইবাবুও নিচ্ছিলেন কিনা সে বুঝতে পারল না।

 

শো শুরু হয়ে গিয়েছিল। কাজলের বন্ধুরা ঠিকই খবর দিয়েছিল; হল ভরে নি। টিকিট কেটে দুজনে ঢুকে পড়ল। বিজ্ঞাপন আর খবর ইত্যাদির পর মনে হয় এক্ষুনি শুরু হয়েছে ফিল্মটা। মনে রাখার মত ফিল্ম নয়। আর সত্যি বলতে কি, তখনো অব্দি কাজল মীনা কুমারীর এক মেরে আপনে দেখেছে, আপনজনএর ছায়া দেবীর তুলনায় কিছুই নয়। আর পাকীজা দেখেছে, যাও বা মীনা কুমারীকে দেখত আর মনে রাখত, মাঝে মধ্যেই রাজকুমার এসে নিজের দেখনাই অভিনয় আর ডায়লগ ডেলিভারি দিয়ে কিছু মনে রাখাই অসহ্য করে দিয়েছে। সাহেব-বিবি-গোলাম টোলাম দেখেছে অনেক পরে। জামাইবাবু কী দেখলেন কে জানে, কাজল মুখ ভেটকে পড়ে রইল নিজের সীটে।

ফেরার সময়, ঐ একই পথে রিকশায় মিলার স্কুলের মাঠটা পেরোবার সময় জামাইবাবু ধীর গলায় বললেন, একটা কথা তোমায় দিতে হবে কাজলবাবু।

-       কী?

-       তুমি সিম্পলি একটা চাকরি করবে, প্রমোশন-টমোশন নেবে না, কোনো কেরিয়ার তৈরি করবে না, শুধু লেখালিখি, সাহিত্যচর্চা নিয়ে থাকবে

-       সেটাই আরো বাড়াবার চেষ্টা করব

-       হ্যাঁ । আরো গভীরভাবে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করবে যাতে একদিন চাকরিটাও ছাড়তে পারো। তাই তো?

-       হ্যাঁ।

-       কিন্তু কথা দিতে হবে, যে ঐ পথে তুমি সফল হও বা না হও আশীর্বাদ করি তুমি সফল হবে কিন্তু যদি কোনো কারণে সফল নাও হও

ঘুরে তাকালেন কাজলের দিকে।

-       কোনো দিন পিছন ফিরে তাকিয়ে আপশোষ করবে না। যে ঐ রকম করলেই ভালো হত, সেই রকম করলেই ভালো হত আপশোষ করবে না, আক্ষেপ করবে না। কিছুতেই না। কথা দিচ্ছ?

-       দিচ্ছি।

-       সত্যি?

-       একদম।

-       খুব তাড়াতাড়ি কথা দিয়ে ফেলছ কিন্তু, একটুও না ভেবে।

-       আসলে চাইলেই তো অনেক ভাবা যায় না! তবে নিজেকে যতটা বুঝি, কখনো কোনো কিছু নিয়েই আমি আপশোষ করি না। এটা নিয়ে তো করবই না।

-       তা, পাড়ার বা কলেজের কোনো মেয়ের সঙ্গে তোমার কখনো ভাবসাব হয় নি?

কাজল চমকে গেল। হঠাৎ করে এ আবার কী প্রশ্ন? ভালোবেসেছে নাকি কাউকে? মাথাটা কেমন যেন পাজল্‌ড হয়ে গেল। আছে কি একটা চিনচিন কষ্ট ভীষণভাবে নিজের একটা মুখ জিভের একটা জড়তা !

-       না।

-       ভালোবাসো। ভালোবাসাটাও যে দরকার। যাহোক, কথা যখন দিলে

হাত বাড়িয়ে কাজলের হাতটা নিলেন।

-       হাত মেলাও!

জামাইবাবুর হাতের তেলোটা বড়। শরীরটাও লম্বাচওড়া। দেখতে দারুণ সুপুরুষ।

 

-       আজকের সন্ধ্যেটা বড় সুন্দর কাটল, কাজলবাবু। ওই দেখ, ওই বাগানটা কেমন ছায়াসবুজ আভায় ভরে উঠেছে চাঁদের আলোয়। কী পার্ক যেন?

-       হার্ডিঞ্জ পার্ক।

কাজলের আবার মনে পড়ল, তেরা মেরা প্যার অমর। অনেক পরে দেখে জেনেছিল, ফিল্মটা তার প্রিয় হিরো দেবানন্দেরই ফিল্ম। গানটায় ঠোঁট দিয়েছে সাধনা।

-       আপনি কার্নেশন ফুল দেখেছেন জামাইবাবু?

-       না তো! কেমন হয়?

-       হাল্কা সোনালি। আর ছোট্টো গাছটায় খুব সুন্দরভাবে হয়। এই হার্ডিঞ্জ পার্কেরই এক বুড়ো মালি চিনিয়েছিল। একটা ইংরেজি গল্পে প্রথম পড়েছিল কার্নেশন নামটা। কেউ কাউকে উপহার দিচ্ছে এক গুচ্ছ কার্নেশন। তাই জানতে চাইছিলাম কেমন দেখতে। কী যেন নাম ছিল পত্রিকাটার? ভুলে যাচ্ছি। ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে বসে পড়েছিলাম।  

-       সিনেমার নামটা মনে রেখ। যখন বুড়ো হবে

-       বুড়ো হব?

-       বলেছি তো তোমার আয়ু আছে। হাত দেখে বলি নি? বাহাত্তর বছর আয়ু দেখাচ্ছে তোমার হাতের রেখা। যাহোক, তখনও মনে রাখবে যে মীনা কুমারীর শেষ ফিল্ম গোমতী কে কিনারে দেখে ফিরে আসার সময়, তুমি তোমার জামাইবাবুকে কথা দিয়েছিলে। জীবনে আক্ষেপ করবে না।


ইয়ারপুরের লেভেলক্রসিং বন্ধ ছিল। অনেকক্ষণ রিকশায় বসে থাকার পর জানলার আলো ঝলমলিয়ে হুড়মুড় করে আপ লাইনে কোন ট্রেনটা গেল বুঝতে পারল না। একটু পরে ডাউনে গেল চেনা ট্রেন, পার্সেল এক্সপ্রেস। আরএমএস থেকে চিঠি তুলবে। অদ্ভুত ট্রেনটা, কোনো জানলা নেই, বা খোলা নেই। মানুষ দেখা যায় না বলে ভুতুড়ে, রহস্যময় মনে হল, আজও।  

 

২০.৮.২৫     

No comments:

Post a Comment