দেবতা আর রাতে মন্দিরে তাঁর বিগ্রহে থাকেন না আজকাল। ভিড় বাড়ছে প্রতিদিন – সারাদিন পুজো নেওয়ার চাপ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের জন্য জানলা-ঘুলঘুলি বন্ধ করে দেওয়ায় রাতে গর্ভগৃহে দমবন্ধ ভাব, তারপর সারাদিনের পুজোর পচাফুল, পোড়া তেল, ঘি, কর্পুর ইত্যাদির গন্ধ। তাই পূজারী বাইরে থেকে মন্দিরে তালা লাগালেই ভিতর থেকে তিনিও ফুরুৎ - দেবলোকে। আবার পরের সকালে পূজারী এসে দরজা খুলে, যতক্ষণে মেঝে-টেঝে পরিষ্কার করান, ততক্ষণে দেবতা অদৃশ্যে আবার এসে বিগ্রহে ঢুকে পড়েন, অধিষ্ঠিত হয়ে বিগ্রহ-স্বরূপ হয়ে যান।
কিন্তু বিগ্রহটি অস্থির হয়ে উঠল। প্রাণহীন হয়ে পড়লেও সে যে প্রতিমা,
তার অঙ্গে অঙ্গে প্রাণকে পাওয়ার ডাক! দেবতা সে ডাককে উপেক্ষা করলেও শিল্পী উপেক্ষা
করতে পারলেন না। এমনিতেও, রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমোবার অভ্যাস তাঁর নেই, কর্মশালায় কাজ করতে
করতে হঠাৎ অস্থিরতা অনুভব করলেন। একটা প্রবল আকর্ষণ। প্রায় নিশির ডাকে পাওয়া মানুষের
মতো তিনি পথে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বন্ধ মন্দিরের কাছে পৌঁছে গেলেন।
তবে তিনি তো আর দেবতা নন। অরূপ বা সূক্ষ্মরূপ, কোনোটাই হওয়ার ক্ষমতা
তাঁর নেই। মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়েই তিনি অনুভব করলেন, ভিতরে বিগ্রহে দেবতা নেই! হতবাক
হয়ে মন্দিরের সিঁড়িতে বসে পড়লেন। ভোর হল। পূজারী মন্দিরে এসে দেখলেন সিঁড়িতে শিল্পী
বসে আছেন। সারারাত অস্থির থেকেছেন, জেগে কাটিয়েছেন। পূজারী মন্দিরের দরজার তালা খুলতে
খুলতে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে। শিল্পী বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। ততক্ষণে, মন্দিরের
ভিতরে তাকিয়ে তিনি বুঝলেন, দেবতা অধিষ্ঠিত হয়েছেন বিগ্রহে। কিচ্ছু না, বলে তিনি নিজের
বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন।
এভাবে দ্বিতীয় দিন ভোর, তৃতীয় দিন ভোর। চতুর্থ দিন পূজারী শিল্পীর
পাশে এসে স্নেহপরবশ কন্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে বলো তো? কোনো কষ্ট আছে মনে?
বাড়িতে কোনো সমস্যা? এস! মন্দিরের ভিতরে এস! দেবতাকে বলো নিজের কষ্টের কথা। মন হাল্কা
হবে। কষ্ট দূর করবেন তিনি।
শিল্পী বললেন, না
এখন ঠিক আছে। সুস্থ বোধ করছি। তিনি এসে গেছেন।
- কে এসে গেছেন?
- আজ্ঞে, মন্দিরের দেবতা। বিগ্রহে ফিরে এসেছেন।
-
মানে?
হঠাৎ শিল্পীর খেয়াল হল যে কথাটা বলা সমীচীন হবে না। “না, মানে মন্দির বন্ধ ছিল তো, ভিতরে একটা দমবন্ধ ভাব। …” পূজারী মন্দিরের ভিতরটা দেখে বললেন, “তা মানছি। রাতেই মন্দির পরিষ্কার করে তবে বন্ধ করা উচিৎ। অনাচার
হয়ে যাচ্ছে। কী করব? একটা লোক পাই না। আমার বয়স হয়েছে, রাতে একা একা সবকিছু পরিষ্কার
পরিচ্ছন্ন করে যাওয়া সম্ভব হয় না। … যাহোক, বুঝলাম।
ঠাট্টা করে বলছ যে ফিরে এসেছেন, কেননা দরজা খোলা হল, মন্দির পরিষ্কার করা হবে। আমি
তো চমকে উঠেছিলাম।”
ওদিকে কিছুদিন পর দেবতারও টনক নড়ল, যে তিনি মন্দির থেকে বেরিয়ে আসার
পর শিল্পী মন্দিরের সিঁড়িতে বসে থাকে সারারাত। সে কি কিছু চায়? আমার কাছে? এক রাতে
তিনি দেবলোক থেকে নেমে ভিতরের প্রতিমারই আদলে রূপ নিয়ে শিল্পীর সামনে এসে দাঁড়ালেন,
“কী চাও তুমি বৎস!”
শিল্পী উঠে দাঁড়ালেন।
প্রণাম করে বললেন, “কিছু চাই না। আপনি রাতে নিজের বিগ্রহ ছেড়ে
চলে যান, বিগ্রহটির শূন্যতার হাহাকারে আমি অস্থির হয়ে উঠি, তাই নিজের কাজ ছেড়ে ছুটে
চলে আসি এখানে!”
- বিগ্রহ আমার, আর সে তোমাকে অস্থির করে তোলে?
কই, আমাকে তো করে না!
- (করজোড়ে) আমিই যে তৈরি করেছি ঐ প্রতিমা, প্রভু।
ওর পাথরের শরীরের এক একটি কণায় আমার স্পর্শ আছে। ওকে প্রাণবান রাখার দায়ও যে আমার।
তাই হয়তো ডাকে আমায়।
- তাই যদি হয়, এত রাত ধরে আসছ, কই আমাকে তো ডাকো
নি, ফিরে আসতে বলো নি।
-
প্রতিদিন
দেখছি, সকালে মন্দিরের দরজা খুলতেই আপনি ফিরে আসছেন। তাই আর ডেকে বিব্রত করি নি।
যে রাতে শিল্পী আর
দেবতার মধ্যে এসব কথাগুলো হচ্ছিল, সে রাতে পূজারীও নিজের ঘর থেকে, ঘুম আসছে না বলে
বেরিয়ে মন্দিরের দিকে আসছিল। কিছুটা কাছে এসে এই কথোপকথন শুনে চমকে উঠল। আড়ালে দাঁড়িয়ে
শুনতে থাকল।
- তুমি তো আশ্চর্য মানুষ? কিছু চাইছ না। আবার
অহঙ্কার এত বেশি … যে দেবতার অভাব পুরো করতে চাইছ রাত ভর মন্দিরের
সিঁড়িতে বসে!
- আপনার অভাব পুরো করার ধৃষ্টতা করছি না দেবতা!
রাত ভর ঐ বিগ্রহটায় আপনার অভাবে কষ্ট পাচ্ছি শুধু। কেননা আপনার অধিষ্ঠানের জন্যই তো
তাকে তৈরি করেছিলাম, গ্রামের মানুষের কথায়!
-
যদি আমি ভেঙে
ফেলি ঐ বিগ্রহ? … নাও, ভেঙে দিলাম!
কথার সঙ্গে সঙ্গে
আকাশ থেকে একটা ছোটো উল্কাপিন্ড সোজা মন্দিরের চুড়োয় এসে আঘাত করল। মন্দির ধ্বংস হল।
ভিতরের বিগ্রহ খান খান হয়ে গেল।
- এবার কী করবে?
শিল্পী সভয়ে আগুনের
বিস্ফোরণটা দেখে। “এ কী করলেন দেবতা?”
-
তোমার তৈরি
বিগ্রহ ভেঙে ফেললাম! আর তোমায় তার জন্য কষ্ট পেতে হবে না।
সকাল হতে হতেই ভিড়
এসে জমা হয়েছে মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের সামনে। অনেকে হাহাকার করছে, কী অভিশাপ নেমে এল
আমাদের জীবনে! মন্দির ধ্বংস হল, দেবতার বিগ্রহ ভেঙে গেল। পূজারী ঐ ধোঁয়া উঠতে থাকা
ইঁটপাথরের ভিতরে ঢুকে নিজের গামছা দিয়ে ধরে তুলে আনলেন ছোট্টো, তখনও গরম উল্কাপিন্ডটি।
বাইরে এনে মাটিতে রাখলেন। সবাই প্রশ্ন করল, জিনিষটা কী।
-
মন্দির ভেঙেছে,
সেটাকে অভিশাপ ভেব না। আমি দেবতার সঙ্গে শিল্পীর কথাবার্তা শুনেছি। শিল্পীর তৈরি বিগ্রহ
দেবতার পছন্দ ছিল না। দেবতা থাকতে পারছিলেন না মন্দিরে। তাই নিজে আমাদের এ উপহার দিয়েছেন।
এটাই তাঁর নতুন বিগ্রহ। এ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমরা নতুন করে একটি মন্দির নির্মাণ
করব।
কয়েকজন চিৎকার করে
উঠল, “তাহলে তো শিল্পীকে ডেকে জবাবদিহি করতে হবে।
কেন এমন বিগ্রহ তৈরি করল যা দেবতার পছন্দ হল না? অপবিত্র মনে বা অপবিত্র হাতে তৈরি
করেছিল নিশ্চয়ই!”
“না, তেমন
কিছু নয়। ঐ বিগ্রহেই দোষ এসে গিয়েছিল। দেবতার বদলে সে শিল্পীকেই ডাকত বার বার। কোনো
শিল্পীর তৈরি বিগ্রহ হলেই তাতে এ দোষ থাকবে।” উল্কাপিন্ডটা
দেখিয়ে বলেন, “এটা তো কোনো শিল্পীর তৈরি নয়! দৈব!”
অদূরে, গ্রামের রাস্তায় নিজের বাড়ির দিকে যেতে যেতে শিল্পী আকাশের
দিকে তাকিয়ে হাসল, “এবার বুঝুন দেবতা। ঐ পিন্ডাকৃতি হবেন আপনি।
যান! অধিষ্ঠিত হন! আমি বরং যাই, নিশ্চিন্তে একটি নতুন প্রতিমা পুরো করি। তার শরীরে
প্রাণের প্রতীক্ষা থাকবে। পাবেও, যদি মানুষ তাকে ভালোবাসে। কিন্তু আপনার প্রতীক্ষা
থাকবে না।”
পিছনে ফিরে তাকালো। ধোঁয়া ওঠা ধ্বংসস্তূপটা দেখতে দেখতে ভাবল, ভাঙা
বিগ্রহের টুকরোগুলো নিয়ে আসবে পরে গিয়ে। কাজে লেগে যাবে।
২৩.৩.২৫
No comments:
Post a Comment