আজকাল পাড়ায় পাড়ায় সকালে বর্জ্য নেওয়ার গাড়িগুলো ঘোরে। একটা গান বাজে গাড়িতে বসানো মাইকে। এমনকিছু শ্রুতিমধুর নয়, কিন্তু মজার। বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার আওয়াজে চমকে ওঠা গলির গৃহস্থেরা পলিথিনের থলেয় বর্জ্য ভরে প্রস্তুত হওয়া শুরু করবে।
সেদিন রাতে হাওড়া স্টেশনে দেখা হয়েছিল মাসুদের সাথে। বলছিল নিউজিল্যান্ডে
নাকি তিন রঙের ডিবে থাকে রাস্তায়, তিন ধরণের বর্জ্য ফেলার। হয়তো ভারতেরও বড় শহরগুলোতে
আছে। এক শহরেও তো পাড়ায় পাড়ায় ভেদ থাকে। চারকোনা বসার জায়গাটার ভিতরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ
ধরে কথা বলছিলাম। বার বার চোখ যাচ্ছিল পিছনে ওর বেগমের দিকে – কিছু একটা বলতে চাইছে বার বার। শেষে আর পারল না, বলেই ফেলল, “তখন থেকে শুধু কথাই বলে চলেছেন, আমাদের তরফ থেকে ভাইসাহবকে চা খাওয়াবেন
তো অন্ততঃ!” তখন ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ করে গেল চা আনতে। আমার হাসি পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কিছু বললাম না।
ওর বিয়ের সময় বরযাত্রী গিয়েছিলাম। কত ভালো খাবার খাইয়েছিল মেয়েপক্ষ! আর এ শালা নবাব
খানদান, খাওয়ানোর বেলায় ছিল কঞ্জুস। আজও তাই, বউকে মনে করাতে হয়। টিফিনে যখন একসঙ্গে
বসতাম ও পোদ্দারকে টিটিকিরি দিত, “ক্যা রে,
আবার সেই কদ্দু-ফদ্দু এনেছিস?” পোদ্দারও শোনাতো,
“সালা কুঁজড়া” (কুঁজড়া একটি জাতি যারা তরিতরকারি বেচে) “নিজেকে নবাব খানদান বলে আর আনে কী? শুকনো রুটি আর আলুসেদ্ধ।” তবে সবচেয়ে আগে মাসুদ হাতে রুটির টুকরো নিয়ে পোদ্দারের ডিবেতেই হাত
ডোবাতো আর পোদ্দারও মাসুদের আলুসেদ্ধয়।
খাওয়ানোর ব্যাপারে রাজা ছিল সলিমুদ্দিন। ব্রাঞ্চ ভিজিটে গেছি, জবর্দস্তি
বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পরোটা মাংস। রোহতাসে কমিটি মিটিং করালো পুরো দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে।
বৌকে দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করালো সবার জন্য। মনে আছে আমার সদ্য বিয়ে হয়েছিল। তখনই সম্মেলন;
নেতারা আসবেন। ভোরবেলা পৌঁছেছি স্টেশনে। একটু পরে কাঁধে লালঝান্ডা সলিমুদ্দিনের নেতৃত্বে
বাকিরা হাজির। দূর থেকে ধমকে উঠল আমায়, “চান করে এসেছেন
তো? নইলে কিন্তু হাত মেলাবো না। … মরে গেল হঠাৎ। তখন
আবার ওর বেগমের কম্প্যাশনেট এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে পড়তে হল। মোবারকের শ্বশুরবাড়ি এসে
ঝামেলা করতে লাগল, ওদের হিস্যা – সলিমুদ্দিনের ছোটো
ভাইটা বেকার, তার হয়ে গেলে সবার কল্যাণ, মোবারককে তারাই দেখবে। আমার ব্রাঞ্চের ব্যাপার,
ম্যানেজার ডেকে পাঠালেন। আমি বুঝিয়ে বললাম, দেখুন চাকরিটা তো বেগমেরই হবে, অন্য কারো
নয়। পিএফ ইত্যাদি নিয়ে যদি দাবি থাকে, কোর্টে গিয়ে নিষ্পত্তি করে নিন। এখানে তো তার
নিষ্পত্তি হবে না। চাকরি হল। তখন থেকেই মোবারক আমাদের কমরেড। কখনো কোনো মিছিলে, সমাবেশে,
সভায় পিছিয়ে থাকে নি। একবারই ইফতারে ওর বাপের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কী এলাহি ব্যাপার!
ইফতার বলতে মনে পড়ে গেল ছোটোবেলায় ঈদের আগের সন্ধ্যায় জাহির, জামিরদের
বাড়ির ছাতে সব ভাইবোনেদের জমায়েৎ। আমিও আছি তাদের মধ্যে। চাঁদের ক্ষীণ রেখাটা খুঁজছি
আকাশে। কেউ খুঁজে পেলাম না। পেলেন ওদের মা। দেখালেন, “ওই দ্যাখ্!” ভাবিই নি যে অত
ক্ষীণ একটা রেখা চাঁদ হতে পারে। জাহির বড় হয়ে দর্জির দোকান দিয়েছিল।আর জামিরের ইচ্ছে
ছিল পুলিশে যাওয়ার, পুলিশেই গিয়েছিল।
স্কুলে খুব কাছের মুসলমান বন্ধু কেউ ছিল না। পুলিশের বড় সাহেব বাবার
ছেলে মাজিদ সারা দিন ফাঁটবাজিই করত। তবে তখনকার ফ্যাশনে, ‘দোস্তি’ সিনেমা দেখে সেও
কিনেছিল মাউথঅর্গান। তার বাজানোতেই প্রথম সুরটা শুনেছিলাম। পরে মাইকে। এক ছিল রিজওয়ান,
ভালো ছেলে, কিন্তু নিজের মত থাকত। পনেরই আগস্ট,ছাব্বিশে জানুয়ারি, সরস্বতী পুজো বা
হাউজের প্রোগ্রামে একক অভিনয়ে একটা নাটিকা পেশ করত। ভালো করত। আর ছিল, ফকরু মিয়াঁ,
নাম ছিল পরবর্তীকালের রাষ্ট্রপতির, ফকরুদ্দিন আলি আহমদ। আশ্চর্য, নতুন কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়,
দিল্লি আর মেরঠ থেকে আসা সব বাঘা বাঘা শিক্ষক … তাদের একজনও
কিন্তু মুসলমান ছিল না, আর বেশির ভাগ ছিল ব্রাহ্মণ। এক তিওয়ারিস্যারকে পছন্দ করতাম,
ইংরেজি পড়াতেন, বাজখাঁই গলায় বকে সামনের পোর্টিকোর জটলাটা খালি করাতেন কিন্তু বাড়িতে
ডাকতেন ফ্রি টিউটোরিয়ালে, সবাইকে কফি খাওয়াতেন বাগানে। জোরে আবৃত্তি করতেন, “ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন …!”
কলেজেও। মানে আমাদের ক্লাসগুলোয় কোনো মুসলমান শিক্ষকও ছিলেন না আর
ছাত্রদের মধ্যে মুসলমান থাকলেও আমার বন্ধু কেউ ছিল না।
বন্ধু হল চাকরিতে ঢোকার পর। প্রথম তো ধানবাদে, শাহাব, ওকে আমাদেরই
মেসে নিয়ে এলাম। তবে থাকল না বেশিদিন। অঙ্কে ভালো পোস্টগ্র্যাজুএট, ওর ছিল প্রফেসর
হওয়ার ইচ্ছে। চাকরি ছেড়ে চলে গেল। শবেবারাতের পর বাড়ি থেকে ডিমের হালুয়া (নামেই হালুয়া,
আসলে বর্ফি) এনে খাইয়েছিল।
তারপর পাটনায়। সারাদিনের
বন্ধু হয়ে উঠল ওয়ারিস। অফিস থেকে ফাঁক পেলেই ছুটে যাই রাস্তার উল্টোদিকের স্টুডিওটাতে।
ওয়ারিস ফটোগ্রাফার ছিল, তবে মাস-মাইনেতে, স্টুডিও হাদি সাহেবের। বছরের পর বছর ওয়ারিসের
সঙ্গে বসে গল্প করেছি। আমারও নেশা যেহেতু ছবি তোলা, তাই ওর কাছেই ফিল্ম ধুতে দিতাম,
ডার্করুমে বসে দেখাতাম কোন ছবিটা কিভাবে ডেভেলাপ করবে, ওর কাছে তার টেকনিকটা শিখতাম।
পরে তো ওর মাধ্যমেই প্রথম এসএলআর ক্যামেরা কিনলাম, ফ্ল্যাশ, তারপর এনলার্জার …। সাদাকালো গেল, রঙীন এল আর ওর দিনও গেল। তবে তত দিনে ওর মেয়ে বড়
হয়ে গেছে, শিক্ষিকা হয়ে গেছে, মা পর্দানশীন কিন্তু সে আমার অফিসে এসে নিজে হাত বাড়িয়ে
মেলালো, “হুমাইরা ওয়ারিস”, মিষ্টি করে হাসল, বাঁদিকের দাঁতটা দাঁতের ওপরে, উঁচু। জিজ্ঞেস
করলাম “তোর বাড়িতে গিয়েছিলাম, মনে আছে?”
- কেন থাকবে না, ছাতে গিয়ে অতক্ষণ আপনার সঙ্গে
বকবক করলাম যে?
- তোর বাবাকে বকেছিলাম, জানিস?
- না তো, কেন?
- তোর মায়ের সঙ্গে দেখা করায় নি বলে। অদ্ভুত!
তিনিই রেঁধে খাওয়াচ্ছেন, অথচ একবার তোর বাবা বাইরের ঘরে ডেকে আনল না যে শুক্রিয়া আদা
করি। নাহয় পর্দা করেই থাকত। তাই তোকে দেখে ভালো লাগছে।
- পর্দা তো করতেই হয় আঙ্কলজি। দেখবেন না! পাড়া
থেকে বেরুচ্ছে বুর্কা পরে, কলেজের কাছে এসে খুলে ব্যাগে রেখে নিল। আবার পাড়ায় ঢোকার
আগে চড়িয়ে নিল।
- তুইও করিস?
-
নাঃ। তবে
ব্যাগে রাখি।
আফরোজের বৌ কিন্তু একেবারেই পর্দানশীন ছিল না। বেঁটে, কালো, কিন্তু
মুখটা দারুণ মিষ্টি আর একেবারে ঘরের মেয়ে। বিয়ের সময় আফরোজের কী সন্দেহ! নিজে লম্বা,
ঢ্যাঙা, বার বার এসে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, “ওকে দেখেছেন?
আমার সঙ্গে মানাবে তো?” আরে হ্যঁ, ভাই মানাবে।
এই করতে করতে শক খেল প্রথমবার। নিকাহ যেখানে হবে, গর্দানিবাগের সেই কোয়ার্টারের দরজাটা
ছোটো। টুনি বাল্বের সিরিজ দিয়ে সাজানো হয়েছে। তারের জয়েন্টগুলো খোলাই থাকে সচরাচর।
আফরোজের গায়ের ঝলমলে পোষাকটায় জরির কাজগুলো বোধহয় কোনো বিদ্যুৎবাহী ধাতুর ছিল। ঢুকতে
গিয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে আর জোরে ঝটকা। তিন বার হল। তারপর ব্যাপারটা বুঝে আমি এগিয়ে গেলাম।
দুদিকের আলোর মালার ওপর সাবধানে হাত দিয়ে জায়গা করলাম ওর ভিতরে ঢোকার। বললাম মাথাটা
একটু নুইয়ে ঢুকতে। … আফরোজ ভাষাটা বলত টিপিক্যাল ওদের পাড়ার, মানে
আরা শহরের মিল্কি মোহল্লার – গইস, খাইস, কহিস
… ।
ভাষা বলতে মনে পড়ে গেল নাহিদ আর করিমের কথা। দুজনে একসঙ্গে থাকত
আর সাহিত্য বিষয়ে রুচি ছিল। সেই সূত্রে আমার বন্ধু হিন্দি কবির মাধ্যমে আলাপ। পরে সেটা
ঘনিষ্ঠতা হল। যদিও ওদের বাড়িতে কখনও যাই নি। তা সেই নাহিদ, ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে একটা
মজার গল্প শোনাতো। রমনা রোডে যেখানে ও আগে থাকত, ঘরে ঢোকার চার ধাপ সিঁড়িটা সামনে থেকে
না হয়ে ডান পাশ থেকে ছিল আর সামনেটা সোজা খাড়া। সেখানেই এক পা রেখে সাইকেলারোহী এক
বন্ধু, দরজার সামনে দাঁড়ানো নাহিদের সঙ্গে কথা বলছিল। হঠাৎ টাল সামলাতে না পেরে ছেলেটা
সাইকেল সুদ্ধু পড়ে গেল। ওপর থেকেই দুহাত বাড়িয়ে নাহিদ বলে উঠল, “আরে, চোট লগা?” তারপর কিছু ভেবে
আবার বলে উঠল, “ওহ্ সরি, চোট লগি?” বন্ধুটা ততক্ষণে নিচে থেকে উঠে এসে নাহিদের ঘাড়ে আর পাছায় দুই থাপ্পড়
লাগিয়েছে, “শালা, বন্ধু পড়ে গেছে, কোথায় লাফিয়ে নেমে তুলবি,
না ওখানে দাঁড়িয়ে ক্রিয়াপদের শুদ্ধতা ভাবছিস? ‘লগা’ না ‘লগি’?”
নাহিদ কবিতার লোক ছিল না, দিল্লিতে গিয়ে একটা পত্রিকায় চাকরি আর
নাটক করা শুরু করেছিল। একটি বাঙালি হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছিল। তবে করিম, বিশেষ করে
বাবরি মসজিদের ঘটনার পর কবিতা লেখা শুরু করেছিল। ওর সেই উর্দু কবিতার বইটা আমাকে দিয়েছিল।
আমারই ঘরে বসে রাতে শুনিয়েছিল প্রথম কবিতাটা। ওর এক বিধবা বৌদি ছিলেন। তখন সঙ্গেই থাকতেন
এক ছেলেকে নিয়ে, পরে নিজের মফস্বল শহরে চলে যান। সেই বৌদির হাতের ডালভাত খেয়েছিলাম
দিল্লিতে। করিম নিজেও চাকরিসূত্রে পরে মুম্বই চলে যায়। বিয়ে করে।
চাকরির ক্ষেত্রে আরো বেশ কয়েকজন আমার বন্ধু ছিল, তবে বয়সে আমার চেয়ে
অনেক ছোটো বলে চেলা বা ভক্তই বলা হত। তার মধ্যে দানিশটা খুব কম বয়সে মারা গেল। ইউনিয়নের
পাক্কা সাথী। শীতের সকালে ওর মঞ্জিলে (শবযাত্রায়) গিয়েছিলাম একটা মাঠ পেরিয়ে। শিশিরে
পা ভিজে যাচ্ছিল।
২৪.৮.২৫
No comments:
Post a Comment