সকাল সকাল সুমন্ত ফোন করল রাজীবকে।
-
কী করছিস?
-
বাণী রান্না করছে সকাল থেকে আর আমি মোবাইলে
খারাপ ভিডিও দেখছি!
“হ্যাঁ, সুমন্তদা”, রান্নার দিক থেকে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে, ফোনের
ওপারের মানুষটাকে শোনাবার জন্য জোরে বলে উঠল বাণী, “আমাকে তো ঝুলিয়ে দিয়েছে দুটো বাচ্চা বার করে”, ফোনে মুখ এনে বাকিটা শোনাল, “এখন ওই ভিডিও দেখে সুখ পাচ্ছে!”
ফোনটা কেটে দিল রাজীব, “কিছু মুখে আটকায়না না? আর ঝুলিয়ে দিয়েছ, ঝুলিয়ে
দিয়েছ কী বলো? কতোবার তো বলেছি সন্ধ্যের দিকে গিয়ে একটু জিম করো। পাশেই আছে। বেশি পয়সাও
নেয় না।”
-
আমি চললাম। কয়েকটা জিনিষ কিনবো। তুমি যতক্ষণে
উঠবে বাদলদা দোকান বন্ধ করে চলে যাবে বাড়ি। ভাত চাপিয়ে দিয়েছি, দুটো সিটি মারলে বন্ধ
করে দিও।
-
তুমি সুমন্তদাকে যেভাবে বললে …
রাজীবের কন্ঠস্বরটা একটু ক্ষুব্ধ শোনালো। কিন্তু
বাণী একই রকম ফাজিল মেজাজে বললঃ
-
তোমার করতে আটকায় নি আর এখন আমার বলতে আটকাবে?
এবার সত্যিই কালো হয়ে উঠল রাজীবের মুখ। ধাক্কাটা
সামলে নিয়ে বললঃ
-
তুমি বলতে চাও তুমি চাও নি? আমি জোর করেছি?
ম্যারিটাল রেপ করেছি তোমায়?
-
আরে ধ্যাৎ! কোথায় নিয়ে গেলে কথাটা? আমি বাচ্চার
কথা বলছি।
-
বাচ্চা তুমি চাও নি?
-
তাতেও তোমার কোনো দোষ হয়তো ছিল না। বিয়ে হয়েছে,
দুজনেই সুখ করেছি। বাচ্চা হয়েছে। তবে হ্যাঁ, আজকাল যেমন সবাই একটু প্ল্যানিং করে, কখন হলে ভালো হয়, সেসব মাথাতেই ছিল না।
-
থাকলে?
-
হয়তো দু-তিন বছর সময় নিতাম!
-
বলো নি কেন?
-
বললাম তো, আমি ভাবিই নি। তুমিও ভাবোনি। দোষ
নিচ্ছ কেন ঘাড়ে? সিম্পলি আমার বলার উদ্দেশ্য যে দু-তিন বছর আমরা একটু নিশ্চিন্তে আনন্দ
করতে পারতাম! সেই বয়সটা তো আর ফিরবে না। যাক, আসছি আমি।
-
তবু, সুমন্তকে ওভাবে বলা …
-
সুমন্তদার সঙ্গে কথা বলে যে আরাম পাওয়া যায়
সে তো এই জন্যই। যা ইচ্ছে বলা যায়।
বাণী দরজাটা আবজে বেরিয়ে গেল।
এই সময় বাণী একাই থাকে। আড়াইটে নাগাদ বেরোয়,
বাচ্চাদের স্কুলবাসটা আসার সময় হলে। আজ রাজীবের ছুটি। তাই বাড়িতে।
সন্ধ্যের দিকে সুমন্ত এল। হাতে একটা পলিথিন
ব্যাগে তিনটে খাবারের বাক্সো।
-
ওগুলো আবার কী?
-
তোর জন্য তো নয়! বাণী আর বাচ্চাদের জন্য।
-
কী?
-
পাপড়ি চাট। ওদের ভালো লাগে। এ্যাই দুজন! কোথায়
তোরা? এগুলো নিয়ে যা তো! মাকে দে।
দুই ছেলে মেয়ে এসে, নিয়ে লাফাতে লাফাতে চলে
গেল।
-
এবার বল্। একটা
ছুটির দিন ঘরে বসেই কাটিয়ে দিলি?
-
কোথায় যেতাম? বাচ্চাদের
তো স্কুল ছিল।
-
ওদের স্কুলে পাঠিয়ে
দু’ঘন্টার জন্য কোথাও ঘুরে আসতিস।
বাণী সেই তিনটে বাক্সোসুদ্ধু পলিথিন আর দুটো প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকল।
-
হ্যাঁ, তোর প্রস্তাবটা
বাণীর খুব ভালো লাগত। ওর খুব বেড়ানোর শখ (একটু তাকিয়ে, সময় নিয়ে) … ছিল।
-
ছিল কেন? এখনো আছে।
তবে এখন নয়। আর বাচ্চাদের না নিয়ে দুজনে তো একেবারেই নয়।
-
কেন তুমিই তো দুপুরে
প্ল্যানিংএর কথা বলছিলে।
-
(বাণী তীক্ষ্ণ চোখে
তাকালো) বলছি। খাবারটা দিয়ে নিই।
-
তোমাদের তিনজনের
জন্যই তো এনেছিলাম!
-
সে এনেছিলেন। আমি
তো পাঁচ ভাগ না করে খাবো না।
-
খুব কম দিও আমায়।
-
কমই দিচ্ছি। মিকি,
ঝিল! তোদের দুটো নিয়ে যা। হ্যাঁ, এবার বলো, কী বলছিলে। (বাচ্চাদুটো এসে নিয়ে যাওয়ার
পর) প্ল্যানিং! … অবশ্যই। যে কোনো কাজ প্ল্যানমাফিক করলে ভালো হয়। মা হওয়া তো
একটা বিরাট কিছু নয়, পরে হতাম। কিন্তু হয়েছি। হয়েছি যখন, মা-ই থাকব।
সুমন্তর মুখটা একটু গম্ভীর দেখালো।
-
সরি, আমি ঢুকব কথায়?
-
ঢুকবে না তো খালি
শুনে মজা নেবে নাকি? বলো।
-
তুমি যে বললে ‘মা হওয়া বিরাট কিছু নয়’, এর মানে কী? কতো মেয়ে মা হতে পারে না, কষ্ট
হয়, চিকিৎসা করাতে গিয়ে ভুল চিকিৎসার শিকারও হয় …
-
সেরকম আমার সঙ্গে
হলে আমিও তেমনই কষ্ট পেতাম, আমিও চিকিৎসার চেষ্টা করতাম। আমার সঙ্গেও ভুল চিকিৎসা হতে
পারত। কিন্তু ঐ যে তোমার আশ্চর্য লাগল একটা মেয়ে কেন এমন কথা বলছে, ওর মধ্যেই আছে তোমার
সমস্যা।
-
আমার সমস্যা?
-
হ্যাঁ, মা হওয়াটাকে
আইডলাইজ করে রেখেছ! … একটা প্রজাতিগত বাস্তবতা। নারীরা মা হয়, পুরুষেরা পিতা হয়। মানুষের
বংশবৃদ্ধি হয়। সেই প্রসেসে আমরা দুজনে একটু দেরিতে ঢুকতে পারতাম! এটুকুই তো কথা! সময়
মতো বুঝি নি। বুঝি নি যখন, তার দায় তো ওদের (বাচ্চাদের দেখিয়ে) নয়? যখন আমরা মা, বাবা
হয়েই গেছি, ওদেরকে নিয়েই এখন যা কিছু ভাবব! কেন আমার একটা ছোট্টো কথা নিয়ে সকাল থেকে
তোমার বন্ধু ভুল বুঝছে জানি না।
-
তুমিই তো বলছ ওরা
আছে বলে তোমরা আলাদা করে একটু আনন্দ করবে না, কোথাও বেড়াতে যাবে না।
-
সেটা সত্যি। ওরা
বড়ো হোক। নিজেরা একা একা ঘুরে বেড়াতে শিখুক। তখন আমরাও যাব।
-
তখন তো এই দিনগুলো
আর থাকবে না।
-
তাহলে এই দিনগুলো,
মানে যৌবনের দিনগুলোর, যেটুকু বাকি আছে, আলাদা একটা মাধুর্য আছে, তাই তো বলছ? তার আনন্দ
উপভোগ করতে হলে সন্তানদের আড়ালেই করতে হবে।
-
হ্যাঁ। কিছুটা তাই।
-
আমিও তো তাই বলছি।
আগেই সেই মাধুর্যটা আরেকটু উপভোগ করে নিতাম দু-তিন বছর। প্রথম বছরেই বাস্তবে পরীক্ষা
করে নেওয়ার কী দরকার ছিল যে মেয়েটা মা হতে পারবে কিনা, বা ছেলেটা বাবা হতে পারবে কিনা?
অনেক কিছুই তো তখনো পাওয়া যেত! … আর তেমন হলে দুপক্ষই মেডিক্যাল পরীক্ষা করিয়ে
রিপোর্ট অদল বদল করে নিতাম। আজকাল তো শুনেছি তাও হচ্ছে।
-
তা, সেটা কি আমার
একার দোষ?
-
বার বার দোষ বলছ
কেন? অজ্ঞতা, এবং সেটা দুজনেরই। দুজনেরই সিদ্ধান্ত ছিল মিলন, কোনো কিছু ব্যবহার করার
কথা ভাবি নি। আর … তার ফলে সন্তান। তবে হ্যাঁ। মা হওয়ার একটা বড়ো শারীরিক ধকল আছে,
যেটা নারীকেই সইতে হয়। শরীর বিকৃত হয়। বিদঘুটে দেখতে হয়।
-
বিকৃত? বিদঘুটে?
আজকাল হিরোইনরা পেট বার করে ছবি পোস্ট করছে দেখেছ?
-
তোমাদের সুন্দর লাগে?
সত্যি বলবে। সুন্দর লাগে না একটা ভ্যাল্যুকে ইউলোজাইজ কর।
-
ঐ রকম পেট বার করে
হয়তো সুন্দর লাগে না। ওটা আমাদের বোধের সঙ্গে খাপ খায় না। তবে গর্ভবতী নারীর শাড়ি পরা
কমনীয় ছবি তো ভালো লাগেই!
-
একটি নবজাতের জন্মের
সম্ভাবনার সূচক হিসেবে, না নারীটিরই শারীরিক সুষমার দিক থেকে।
-
দুই হিসেবেই।
-
তা, ঐ রূপটা যদি সুন্দর হয়, তাহলে আমার ভুঁড়িটাও
সুন্দর। ঢিলে গা-ও সুন্দর। পেটে ছিল তো জন্মের সম্ভাবনা ধারণ করতাম, এখন এই শরীর সন্তানদের
বিকাশের সম্ভাবনা ধারণ করে! এর মধ্যেই শারীরিক সুষমা খুঁজুক পুরুষ! পায় না তো! তাদের
তো বিকৃত-দেহ হতে হয় না, কোনো শারীরিক উপসর্গ পোহাতে হয় না। তাই মহিমান্বিত মাতৃত্বে
সাফল্যলাভের পরে পরেই, আমাদের জিমে গিয়ে, পেট সিঁটিয়ে, গা টাইট রেখে কুমারীরূপটাও ফিরিয়ে
আনার কথা শুনতে হয়।
-
কিন্তু সেটা তো তোমাদের
শরীরের পক্ষেও ভালো!
-
হোক। আমি পারব না।
আমি এখন মা, ফুল মা। মনের সুখে মোটা হবো। দুজনে বেড়াতে যাবো ফুল বুড়োবুড়ি হয়ে। কারুর
কোনো আপত্তি আছে? আপত্তি থাকে, শুয়ে শুয়ে ভিডিও দেখুক। আমিও, দরকার পড়লে দেখব। ঠিক?
সুমন্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারল না বাণী যে আজ ফুল ফর্মে আছে তার কারণ কি কোনো ক্ষোভ?
২১.৪.২৫
No comments:
Post a Comment