কখনো ছোটো, সহজ ব্যাপারগুলোও
এত জটিল হয়ে ওঠে। মনের ভেতরকার নানারকম সন্দেহ যেতেই চায় না।
সব্জিবাগের রাস্তা
পেরিয়ে লঙ্গরটুলির মুখে পড়েছে কিশোর। মার্চের রাত, তাই সাইকেল নিয়ে হেঁটে যেতে কোনো
কষ্ট হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু দুহাত দিয়ে হ্যান্ডেলটা ধরতে পারছে না। ডানহাত দিয়েও
না, বাঁহাত দিয়ে ধরে হাঁটছে। ডান হাতে শক্ত করে ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে রক্তের থলেটা।
তার নিজেরই রক্ত।
কাজেই বেশ একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতিও হচ্ছে। যতদূর অব্দি রাস্তা এবড়ো খেবড়ো, ততদূর হেঁটে
যাবে। যাতে পড়ে না যায় বা কোথাও খোঁচা না লাগে। রাস্তা মসৃণ হলে, ফাঁকা আর সোজা হলে
নাহয় সাইকেলে চাপবে, যাতে বাঁহাতে হ্যান্ডেল ধরে চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে। আবার নামবে
লেভেলক্রসিংএর কাছে।
রাস্তাটাও তো খুব
কম নয়। পিএমসিএইচকে গঙ্গার তীর ধরলে কঙ্কড়বাগের পুরোনো শেষ প্রান্ত, কিশোরের মনে পড়ে
গেল ছোটোবেলায় স্কুলে পড়াঃ পাটনা শহর লম্বায় আট মাইল, চওড়ায় দুই মাইল। অর্থাৎ মোটামুটি
দু’মাইল, আঁকাবাঁকা পথে একটু বেশিই হবে। রাজেন্দ্রনগর
স্টেডিয়াম হয়ে, বাহাদুরপুর গুমটি পেরিয়ে, মুন্নাচক পেরিয়ে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়। তার
পিছনে খানিকটা আরো গিয়ে সেই মেটারনিটি হাসপাতাল। বৌ ভর্তি আছে। সিজারিয়ান হবে, দ্বিতীয়
সিজারিয়ান, আগেরটাও সিজারিয়ান ছিল। তার আগে তাকে রক্ত দিতে হবে।
কম্পাউন্ডার বলেছিল
‘বি-পজিটিভ’, এক বোতল, মানে ২০০ এমএল জোগাড় করুন। ডোনার আছে? তাহলে নিয়ে যান
পিএমসিএইচএ। তিওয়ারিজি আছেন, আমার নাম বলবেন, তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করে দেবেন।
- আচ্ছা শর্মাজি, আমারও তো বি-পজিটিভ, আমি দিতে
পারি? আমার হেমোগ্লোবিন পার্সেন্টেজও ভালো।
- হ্যাঁ, কেন দিতে পারবেন না?
- কোনো প্রব্লেম হবে না তো? মানে শুনেছি যে একই
পরিবারের মধ্যে রক্ত দেওয়া-নেওয়া হলে একটা অসুখ হয় সেটা ঐ রক্তেরই … কী যেন বলে কনস্যাঙ্গুইন ব্লাড …
- সেসব আমি জানি না, ঐ ব্লাডব্যাঙ্কেই জিজ্ঞেস
করে নেবেন।
ব্লাড ব্যাঙ্কে তিওয়ারিজিকে
জিজ্ঞেস করল। তিওয়ারিজি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “আপনি আর আপনার
বৌ কি একই পরিবারের, জ্ঞাতিগুষ্ঠি, একই ব্লাডলাইন …?”
- না। একদম না।
- তাহলে? চিন্তা করছেন কেন? কী, দেবেন তো?
- হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
- এখানে সময় লাগবে। চলুন।
পিএমসিএইচ থেকে বেরিয়ে
সব্জিবাগের কাছাকাছি, তিওয়ারিজির পরিচিত একটা প্রাইভেট
ব্লাডব্যাঙ্কে যাওয়া
হল। সাইকেলটা নিচে তালা লাগিয়ে রেখে দোতলায় উঠে রক্ত দিল।
- পাঁচ মিনিট রেস্ট নিয়ে নিন। আর বাইরে গিয়ে
চা-বিস্কুট অন্ততঃ খেয়ে নেবেন।
রক্ত পরীক্ষা, বার
করে দেওয়ার কাজ আর পাউচের দাম চুকিয়ে নিচে নেমে দেখল চায়ের কোনো দোকানই খোলা নেই আশেপাশে।
তারপর হাঁটতে হাঁটতে
এই লঙ্গরটোলি অব্দি চলে এসেছে। কটা বাজে? হাতে ঘড়ি নেই। সাড়ে আটটা-পৌনে নটা হবে। তিওয়ারিজি
নিশ্চিন্ত করলেও মনের ভিতরটা খচখচ করছে। কিছু ভুল করছে না তো? রত্নার বডি এ্যাক্সেপ্ট
করবে তো? আর বাচ্চাটা?
স্টেডিয়াম পেরিয়ে
যখন বাহাদুরপুরে পৌঁছোলো, দেখলো গুমটিটা খোলা, অনেকক্ষণ অন্ধকারের পর, সোডিয়াম ভেপারের
আলোয় ভরা একটা চত্বর। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ … পাঁচটা রেললাইন। বন্ধ থাকলে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। এক হাতে তো আর সাইকেল
মাথায় উঠিয়ে ঘোরানো গেটটা পার হওয়া যেত না। রেললাইনগুলো পেরিয়ে শেষ সোডিয়াম-ভেপারটার
নিচে গিয়ে দাঁড়ালো এক মিনিট। … ‘নাঃ, সিগরেট ধরানো ঠিক হবে না। আগুনের ফুলকি গিয়ে যদি পড়ে থলেটায়?
অন্ধকারে খেয়াল করেনি। এখন তীব্র সোনালি আলোয় দেখল, ভিতরের পাউচ আর তার বাইরের থলে
ভেদ করে রক্তের রঙটা বোঝা যাচ্ছে, কালচে লাল!
এসব দিকে শহর এখনও
ঠিক মত তৈরিই হয় নি। কোথাও জমজমাট কোনো চৌরাস্তা, রাত অব্দি খোলা চায়ের দোকান, কিচ্ছু
নেই। অথচ জাংশনের কাছে গেলে, বা ঐ পি.এম.সি.এইচ.এরই সার্জিকালের সামনের গলিতে তো রাতভর
চায়ের দোকান খোলা থাকে।
যাক, প্রায় পৌঁছেই
তো গেছে। আর কোথাও দাঁড়াবারও দরকার নেই। ডানহাতে ঝোলানো থলেটা কখনো কখনো ঘুরে গিয়ে
আঙুলের উল্টো দিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। নিজেরই রক্ত, প্রথমদিকে যতটা গরম লাগছিল, এখন আর লাগছে
না।
হাসপাতালে পৌঁছে
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। কম্পাউন্ডারসাহেবের হাতে থলেটা দিয়ে নিশ্চিন্ত হল। বাইরে
বসে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অনেকক্ষণ, কে জানে কতক্ষণ, পরে ঘুম ভাঙল। নার্স ডাকছে। “অভিনন্দন, মেয়ে হয়েছে। হ্যাঁ, একদম ভালো আছে। একটু আন্ডারওয়েট। মা-ও
ভালো আছে। আসুন!”
ভয়ে ভয়ে বেডের কাছে
গেল কিশোর। রক্তের কোনো দোষ যায় নি তো শরীরে? এনাস্থেসিয়ার প্রভাবে ঝিমিয়ে আছে রত্না।
বাচ্চাটা পাশে, তোয়ালে লপটানো। ঘুমিয়ে আছে। কোলে নেওয়ার সাহস হল না কিশোরের। একটা চেয়ার
টেনে বসে চেয়ে রইল।
ভোরের দিকে বৌয়ের
চোখ খুলল। কাছে গিয়ে দেখল ফর্সা মুখটা কালচে হয়ে আছে। কপালে ছোঁয়ালো হাতের উল্টোপিঠ।
নাঃ, গরম নয়, বরং ঠাণ্ডা, কিন্তু ঘামে ভেজা। গালে, গলায় ছুঁইয়ে সরিয়ে নিল হাতটা। চাদরের
ওপর এলিয়ে পড়ে থাকা ডান হাতের আঙুলগুলো ধরল মুঠোয়। ঠাণ্ডা নয়। পায়ের পাতা দুটো চাদরের
বাইরে বেরিয়ে ছিল, চাদরের প্রান্তটা টেনে ঢুকিয়ে দিল ভিতরে।
“কী হয়েছে?” রত্না ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন করল।
- না, কিছু না। তুমি ঠিক আছো?
- হ্যাঁ! কী হবে আমার?
- কেমন কালো হয়ে গেছে তোমার মুখটা! জ্বর জ্বর
লাগছে না তো?
- ও, ঐ জন্য ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছ, পায়ের পাতা ঢেকে
দিচ্ছ?
- না, মানে …
মাথার ওপরে খাটের
লোহার রেলিং ধরে থাকা কিশোরের বাঁহাতটা ধরে টেনে নিজের গালের নিচে চেপে ধরল রত্না,
“কী হয়েছে বলো তো? কিছু ভাবছ?” বলে হাতটায় টান দিল। রত্নার চোখের দিকে তাকিয়ে ডাকটা বুঝল কিশোর।
নিজের মুখের বাঁপাশটা নামিয়ে এনে আলতো করে চাপ দিল রত্নার মাথার ওপর। ঘরের দরজা খোলা,
এর বেশি জড়িয়ে ধরা যাবে না ভাবতে ভাবতেও ডানহাতটা নিজে থেকেই রত্নার কাঁধের নিচে চলে
গেল। আঃ, মনটা হাল্কা হচ্ছে ধীরে ধীরে। বৌয়ের শরীরের উষ্ণতা শুশ্রুষার মত ছড়িয়ে পড়ছে।
- কিছু ভাবছি না। তোমার মুখটা কালো লাগল তাই
ভাবছিলাম হয়তো জ্বর আছে শরীরে। বা …
হাসিটা কানের কাছে
ফিসফিসিয়ে উঠল, “জ্বর-টর নয়। তোমার রক্ত গেছে যে শরীরে। তুমি
তো কালো! যেদিন প্রথম এসেছিলে আমাদের বাড়িতে, ছোটো বলেছিল, ঐ দ্যাখ দিদি, আবলুস কাঠের
ছোটো আলমারি আসছে একটা!”
No comments:
Post a Comment