এতে কোনো সন্দেহ নেই যে অন্ততঃ একটিবার তার সাথে ঘর বাঁধার কথা ভেবেছিলাম। সেদিন দুপুরে, দিনেশবাবুর সঙ্গে যখন তার জিনিষপত্র ছড়ানো ঘরটায় প্রথম গিয়েছি, তার তিনটে সন্তান ঘরে খেলছিল। স্বামী ব্যাঙ্কের যে গ্রামীণ শাখায় কাজ করতেন, স্বাভাবিক ভাবে সেখানেই সে ছিল এতদিন। কেননা স্বামীর মৃত্যুর পর বকেয়া টাকা পয়সা পাওয়া, অনুকম্পামূলক নিয়োগের জন্য আবেদন, অপেক্ষা; … অন্য কোথাও চলে গেলেও বার বার আসতেই হয় শাখায়। তারপর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও থাকে। কোথায় শেষ অব্দি গিয়ে থাকতে হবে নিশ্চিত না হয়ে হুট করে স্কুল ছাড়ানো যায় না।
মৃদুলাও সেভাবেই
প্রায় দেড় বছর কোশি অঞ্চলের সেই গঞ্জ-শহরে, স্বামীর ভাড়া নেওয়া ঘরদুটোয় থেকে অবশেষে
যখন নিশ্চিত খবর পেল যে তার চাকরি হয়ে গেছে, রাজধানীতে বড় একটা শাখায় যোগ দিতে হবে,
তখন সেখানকার পাট চুকিয়ে চলে এল। তার পৈত্রিক পরিবারে বিশেষ দেখাশোনা করার কেউ ছিল
না, স্বামীর দিকের পরিবারেও – যেহেতু চাকরিটা
স্ত্রীই পাবে, ভাইয়েরা পাবে না – মৃতের বিধবার বাঁচামরা
নিয়ে কারোর বিশেষ দুশ্চিন্তা ছিল না। তাছাড়া দিনেশবাবু তাদেরই জাতের আস্থাভাজন মানুষ,
সেই ব্যাঙ্কেই ইউনিয়নের নেতা যেখানে চাকরি করার, মৃত স্বামীরও বন্ধুস্থানীয়, কাজেই
সেভাবে সঙ্গে থেকে সাহায্য করার মতো অন্য কারোর প্রয়োজনও ছিল না।
এহেন পরিস্থিতিতে
দিনেশবাবু আমাকে যে কেন সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেটাই আমি আজ অব্দি বুঝতে পারি নি।
অবশ্য পারি নি বললে মিথ্যে বলা হবে, কেননা নেতা হই আর না হই, সবার নজরে আমিও একজন আস্থাভাজন
কর্মী হয়ে উঠেছিলাম – অবশ্যই জাতের না;
ইউনিয়নের। আর যেটা বিহারে হয়, যেখানে ‘আস্থাভাজন’ তায় আবার, জাতের সঙ্গে জাতের কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট এসে পড়ে, সেখানে
বাঙালি প্রথম পছন্দ হয়ে ওঠে। দিনেশবাবু ইউনিয়নের নেতা হিসেবে আমার চেয়ে বেশি যাকে নিতে
পারতেন, সে তার সমস্ত কর্মতৎপরতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা সত্ত্বেও দিনেশবাবুর জাতের, অর্থাৎ
বানিয়া ছিল না। তার ওপর আবার বানিয়া পশ্চাৎপদ জাত, আর সে অগড়ি, তাও আবার কুখ্যাত, লালা।
কিন্তু যেটা ভাবায়
আজও, দিনেশবাবুর মনেও এমন কোনো সম্ভাবনা উঁকি দেয় নি তো, যে অবিবাহিত যুবক, অল্পবয়সী
বিধবার সঙ্গে ঘর বাঁধলে ক্ষতি কী? জাত-ফাত আজকাল আর কে অত দেখে? মেয়েটা নির্ভরযোগ্য
আশ্রয় পেয়ে যাবে! …
জানি না। দিনেশবাবুও
আর নেই, মৃদুলাও আর নেই। কিন্তু এটা ঠিক যে সারা জীবন, মানে যদ্দিন ও বেঁচে ছিল, আমাকে
সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু মনে করত। দাঁত দেখাতে যাবে, আমারই স্কুটারের পিছনে বসে। আমিই
ওকে দেখিয়ে নিয়ে আসব। জমি কিনল বাড়ি করার জন্য, আগে আমাকে গিয়ে দেখে আসতে হল। … ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে, ওদের পড়াশুনো, চাকরি, বিয়ে সব ও নিজের হাতে
করেছে একে একে। কিন্তু প্রত্যেকটা ধাপে আমার ডাক পড়েছে। ও অমুক জায়গায় পড়তে যাচ্ছে
– যাবে তো? ওর ওই চাকরি থেকে ডাক এসেছে – যাবে তো? মেয়ের বিয়ের কার্ডটা দেখে যান না – ঠিক আছে কিনা!। তখন আর ওর ব্রাঞ্চটায় কাজও করি না, দূরে ট্রান্সফার
হয়ে গেছে, তবু টেলিফোনে ডাক পড়ত, আর আমিও এক ডাকে চলেও যেতাম। এমনকি ছেলে মেয়েকে বলে
রেখেছিল – ‘আমি না থাকি,
কোনো প্রয়োজন হলে মানসবাবুকে ডাকবি’।
মৃদুলা আর নেই, সারল্যে
ভরা ওর চোখদুটো, ভরা কালো মুখ আর ঠোঁট … ভীষণভাবে
মনে পড়ে। ঠিক সেভাবে ওর শরীরের দিকে কখনো তাকাতামও না, যেন ওর বাৎসল্যে ভাগ পাওয়াটাই
আমার পাওয়া হতো আর বুকের খুব কাছে পেতাম ওর ছোট্টো নিঃশ্বাসগুলো। কখনো কোনো কষ্টের
কথায় টস টস করে জল পড়তো চোখ থেকে। না সিনেমার মতো রুমাল বার করে দিই নি, বুকেও টানিনি
কিন্তু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতাম শাড়ির খুঁটটা চাপা দিচ্ছে চোখে।
ভাগ্যিস ওর মৃত্যুর দিন ছিলাম না শহরে।
১.৫.২০২৫
No comments:
Post a Comment