ডিবে খুলে ওষুধের পাতাটা হাতে নিয়ে দীপক ধর অবাক হয়ে গেলেন। এরকম কেন? তুবড়ে, মুচড়ে, মুড়ে রাখা? তখন মনে
পড়ল রাতে ভুল করে পাতা ছিঁড়ে এই ওষুধটা বার করে ফেলেছিলেন। এটা তো সকালের ওষুধ! তাই
ছেঁড়া খোপে ঢুকিয়ে পুরো পাতাটা আষ্টেপৃষ্ঠে লপটে দিয়েছিলেন যাতে পড়ে না যায়। … এখন আবার হাতে নিতে গিয়ে সত্যিই ফস্কে পড়ে গেল মেঝেয়। দূর! এক জ্বালা!
যাহোক, খাটের তলায় গড়ায় নি, সামনে পড়ে আছে। মেঝেটা পরিষ্কার, তুলে, বেসিনে গিয়ে একবার
জলে ধুয়ে মুখে পুরে দিলেন। বাঁ হাতের বোতল থেকে মুখে জল নিয়ে গিলে ফেললেন। এবার দ্বিতীয়
ও তৃতীয় ওষুধদুটো। না পড়ে গেলে, তিনটেই বার করে একবারে গিলতেন, যা প্রতিদিন করেন।
ফোনটা বেজে উঠল।
পুনা থেকে বাচ্চু। পুরোনো বন্ধু। আজকাল প্রায় রোজই ফোন করে এইসময়।
- গুডমর্নিং। কী করছিস? বাজার থেকে ফিরলি?
- হুঁ।
- কী মাছ?
- আরে দূর! তোদের মত হাইফাই বাঙালিয়ানা নেই আমার,
যে রোজ মাছ খেতে হবে। আর বাড়িতে সবার মাছ নিয়ে অত লাফানি নেই। রেলগেটের বাজারে যাই,
একটু সব্জি নিয়ে আসি।
- কী আনলি?
- ভাদ্র মাস। এক তো মাত্র কয়েকটি সব্জি, তার
ওপর দাম! ছোটোবেলায় জানতাম ভাদ্রমাসে লাউ খায় না। আজকাল আর সেসব কথা অচল। ট্রাকের পর
ট্রাক ভরে চালান আসে, দিব্যি বিক্রি হয়ে যায়। অবশ্য সেটা রামদেব-বাবারও কল্যাণে। কেউ
রস খাচ্ছে, কেউ কাঁচা চিবোচ্ছে …।
- লাউ খেতে ভাল্লাগে তোর?
- হ্যাঁ ভাই, ভালো লাগে, তবে রেঁধে। এখন, মায়ের
হাতের লাউ-মুগ আর কোথায় পাবো? আর মাসির হাতের, দুধের ছিটে দিয়ে কালোজিরে ফোড়ন, ফর্সা
লাউ? তবু যা হয়।
- কাল গিয়েছিলি? কোথায় বলেছিলি যাবি? ব্রাহ্মসমাজে
না কোথায় …? ধম্মোকম্মো শুরু করেছিস নাকি শেষ বয়সে? … ভালো ভালো!
পরশু রাতে রাতভর বৃষ্টি হয়েছিল। কাল দিনেও সেটা চলেছে সন্ধ্যা অব্দি।
রাতটা তাই ঠাণ্ডা ছিল আর মশা কম। এখন কড়কড়ে জ্বালাধরানো রোদ্দুর উঠেছে। ভাদ্রোৎসবের
একটা নিমন্ত্রণ ছিল গতকাল। একবার ভেবেছিলেন যাবেন। ব্রাহ্মসমাজ স্থাপিত হয়েছিল এই দিনে।
সে সুবাদে রামমোহন বিষয়ে কিছু বলবেন। কিন্তু পরে আর ইচ্ছে হল না। সেই পুরোহিত বসবে,
বেদ পাঠ হবে, পুরোপুরি ধার্মিক অনুষ্ঠান টাইপের ব্যাপার, সেখানে ‘একেশ্বরবাদ’ যে ‘নিরীশ্বরবাদ’এর আগের ধাপ, আর
রামমোহন যে আধুনিক ভারতের প্রাক্কালে ধর্মের প্রথম সমালোচক, এবং ধর্মের সমালোচনা যে
সব সমালোচনার প্রারম্ভ … এসব কথা বলার পরিবেশ
থাকবে না।
আর যাওয়া মানেও তো অনেকটা পথ ঠেঙিয়ে। একটা অটো ধরে রাজেন্দ্রনগর
পুলের পাশে পায়েহাঁটা পুলের নিচে নামো, পুল পেরিয়ে আবার ওদিকে একটা টোটো ধরো, মছুয়াটোলি
নামো, তারপর জলকাদায় হেঁটে যাও স্কুল অব্দি। সেখানেই অনুষ্ঠান। পুল পেরোবার পর পুরোটা
রাস্তা এত বেশি স্মৃতিভারাক্রান্ত যে কেমন অসাড় হয়ে পড়ে ইন্দ্রিয়গুলো। পুরোনো মানুষগুলো
কেউ নেই। নতুন যারা আছে, তাদের পুরোনোর সঙ্গে যোগ ক্ষীণ। তার জন্য তারা দায়ীও নয়। সময়টাই
বদলে গেছে। স্মৃতির চাপও কি কোনো ধরণের ডিসফাংশনাল এ্যাট্রফি তৈরি করে চেতনায়?
ফোনে বললেন, “না, যাই নি।”
- ভালো করেছিস। এই বয়সে বেশি ঘোরাঘুরি করিস না।
নিজের লেখালিখি নিয়ে থাকনা বাপু!
- হ্যাঁরে শালা, তাই করি। আমাকে জ্ঞান দেয়। নিজে
কটা নাটক নামাতে পারলি ওখানে একবছরে?
- করছি, করছি, কাজ চলছে … সময় মত খবর পাবি।
-
রাখছি ফোনটা।
ভালো থাকিস সবাই।
সেদিনও বলেছিলেন একটা সভায়। “উই হ্যাভ নট ওনলি লস্ট দ্য ন্যারেটিভ-ওয়ার, উই আর লুজিং দ্য ন্যারেটিভ
ইটসেলফ!” আমরা শুধু আখ্যান-যুদ্ধ হারি নি, আখ্যানটাও
হারিয়ে ফেলছি। এখন বলবে, হারিয়ে ফেলছি মানে কী? হারিয়ে ফেলছি মানে একটা অবিশ্বাসী যান্ত্রিকতায়
মনে রাখছি আর তোতাপাখির মত আওড়াচ্ছি। অথচ জীবনযাপনে তার চিহ্নগুলোও ধীরে ধীরে মুছে
যাচ্ছে।
এমন নয় যে আমি একাই এটা ভাবছি। অনেকেই ভাবছে আর তাই তো লড়াইটা এগোচ্ছে
সারা দেশে। এক একটা বিষয় নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চালাচ্ছে সাথীরা। কোথাও কোনো ছাড়ান
নেই। নৈরাশ্যেরও কোনো জায়গা নেই, নৈরাজ্যেরও কোনো জায়গা নেই। নতুন নতুন মুখ এগিয়ে আসছে।
তাদেরকে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আখ্যানটার পুনর্নির্মাণের চেষ্টা চলছে। যান্ত্রিকতা থেকে
মুক্ত করার চেষ্টা চলছে।
স্নানে যেতে যেতে মাথায় ঝিলিক দিয়ে গেল পুরোনো দিনের একটা ছবি। এভাবেই
আসতে থাকে আর হারিয়ে যেতে থাকে। না, তারা বাস্তব হয়ে ওঠে না কখনো। হয়তো কিছু দিন পরে
তাও হবে! প্রযুক্তি যেভাবে এগোচ্ছে, বা বলা উচিৎ, পৃথিবীর শাসনে ধনপশুদের আধিপত্যে
যেদিকে এগোচ্ছে, কাল হয়তো সর্বোচ্চ মুনাফা সেই শিল্প দেবে, যেটি তোমার মৃত স্ত্রীকে
আভাসি জীবন দিয়ে বসিয়ে দেবে তোমার সামনে সন্ধ্যায়; তুমি তার সঙ্গে বসে চা খাবে, কথায়-গানে
মাতবে কিছুক্ষণ, হয়তো আভাসি সম্ভোগে কাটাবে রাত – ভোর রাতে সে অদৃশ্য হয়ে যাবে! কোথায় যাবে? ওই স্মৃতিঘন অনস্তিত্বের
সমুদ্রে, যেমন ‘সোলারিস’এ দেখিয়েছিলেন লেখক ও পরে চিত্রপরিচালক!
ইতিমধ্যে একটি সংস্কৃতি তো এসেই গেছে। পরিবারের মৃত বয়স্য, বাবা,
মা বা তেমনই প্রিয় কোনো মানুষের লাইফ-সাইজ প্রতিমা বসিয়ে রাখা হচ্ছে ঘরে। কাল স্ত্রী
বা স্বামীর প্রতিমাও রাখা যেতে পারে, তাও আবার প্রস্থেটিক সামগ্রী দিয়ে তৈরি! মার্কোয়েজের
উপন্যাসে বুয়েন্দিয়া পরিবারের একজন সদস্য, কী নাম যেন? উন্মাদ বলে বসিয়ে রাখা হতো ঘরের
বাইরে … বাঁধা থাকতো বোধহয় … আর সারাক্ষণ সে মৃত কোনো বয়স্যের সঙ্গে কথা বলতো। বাংলায় তো অনেক
আগেই একটা বই লেখা হয়েছিল ‘মৃতের কথোপকথন’।
‘কে যেন লিখেছিলেন?’ খালি গায়ে কাঁধে গামছা ফেলে স্নানঘরের দিকে যেতে যেতে দীপক থেমে
গেলেন। এক্ষুনি না জানলে যেন স্নান করা যাবে না! – এটাও প্রযুক্তি-জনিত রোগ। অর্থাৎ ওষুধ আবিষ্কারের পরে সংক্রামক
হয়ে ওঠা রোগ। মার্ক্স বলেছিলেন না, আমাদের মাথায় সেই সমস্যাটাই জাগে যার সমাধান বর্তমান!
…? এটা তারও বেশি! সমাধান-প্রসূত সমস্যা! … স্নানঘর থেকে বেরিয়ে ঘরে ফিরে গেলেন, মোবাইলটা হাতে নিয়ে গুগল সার্চে
লিখলেন, ‘মৃতের কথোপকথন’। উইকিসোর্সে দেখলেন, ‘নলিনীকান্ত
গুপ্ত’।
বস্তুতঃ স্মৃতিকে মুক্ত করাও একটা কাজ, শাওয়ারের নিচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে
শরীরে জলধারার স্পর্শ উপভোগ করতে করতে ভাবলেন দীপক। আখ্যান-যুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ
অংশ স্মৃতিকে রক্ষা করা। স্মৃতির ওপর আক্রমণ প্রতিহত করা। স্মৃতি যদি শুধু অতীতে আটকে
থাকে তাহলেই বাঁধন হয়ে যায়। সামাজিক স্মৃতি, গণস্মৃতিকে মুক্ত করার কাজ তো লোকে করে।
রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র, আম্বেদকর প্রত্যেকের
ওপর প্রতিনিয়ত আক্রমণ চলছে, সূক্ষ্ম আক্রমণ, হোয়াটসঅ্যাাপে, ফেসবুকে … সে আক্রমণ প্রতিহত করতে সবাইকে দেশের বর্তমানের প্রাসঙ্গিকতায়,
চর্চায় রাখা জরুরি! এমনকি, ছবিতে মালাপরানো, সামনে ধুপ জ্বালানোও জরুরি; সব মানুষ তো
আর বুদ্ধিজীবী নয়! এ পথেই গণস্মৃতিকে রক্ষা করা যায়, আক্রমণ প্রতিহত করা যায়।
… ব্যক্তিগত
স্মৃতিগুলোকে কি নিয়ে আসা যায় – এই যেমন অতীতে জীবনে
আসা মানুষগুলোকে জীবনের আজকের প্রাসঙ্গিকতায়? না আনতে পারলে যে নিজের বিষয়ে মাঝে মধ্যেই
মনে হতে থাকবে নিছক ফাউ বেঁচে আছি আরো কিছু দিন, মৃত্যুর অপেক্ষায়? হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে,
রোজ নয়। কাজে, আন্দোলনে, সভায়, মানুষের প্রয়োজনে যতক্ষণ তিনি ব্যস্ত থাকেন, বর্তমানের
অংশ হয়ে থাকেন। কিন্তু সে ব্যস্ততা কমে গেছে অনেক। প্রথমতঃ স্বেচ্ছায়, তারপর এদিকে
কিছুটা কোভিডের দৌলতে আর অবশ্যই কিছুটা বয়সের কারণে। সেভাবে এখন আর দীপক আগেকার মত
উৎসাহের সঙ্গে কোনো সাংগঠনিক দায়িত্ব বহন করতে চান না। সেসব কারণেই, নিজের ব্যক্তিগত
দিনচর্যায় ফিরে এলেই বন্দি স্মৃতিগুলো চিৎকার করতে থাকে ভিতরে, ‘মুক্ত করো!’… সুখস্মৃতির একরকম চিৎকার, দুখস্মৃতির আরেকরকম।
এগারোটার মধ্যে হলে
পৌঁছোনোর কথা। একটা জয়েন্ট ট্রেড ইউনিয়ন কনভেনশন। এখন আর তিনি কোনো সংগঠনে কোনো দায়িত্বে
নেই, নিছক প্রাক্তনী। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু খেয়ে
যাবে না?
- একটু আগেই তো জলখাবার খেলাম।
- তাও, স্নান করে কিছু মুখে দিয়ে যাওয়া ভালো।
- একটু চা থাকলে দিয়ে দাও।
- ওষুধ খেয়েছ?
-
হ্যাঁ, ওষুধ
খেয়েছি, জলের বোতল, মোবাইল আর পয়সা, তিনটেই নিয়েছি।
এক অটোতে সোজা স্টেশন। আরেক অটোতে গান্ধী ময়দান। হলে ঢুকে পেছনে
বসতে যাচ্ছিলেন, মাইকে প্রকাশকে তাঁর নাম ধরে বলতে শুনলেন, “অনুরোধ করছি তিনি মঞ্চে আসুন।” একটি ছেলে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এল। হাত ধরতে যাচ্ছিল, হাত
মিলিয়ে ছাড়িয়ে নিলেন; এতটাও বুড়ো আর অক্ষম হয়ে যান নি। বরং জোর কদমেই মঞ্চের বাঁদিকে
পৌঁছে তিন ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠে পিছনের সারির চেয়ারগুলোর একটায় বসে পড়লেন। আশেপাশে সবাই
পরিচিত, অনেকে অভিবাদন করলেন, তিনিও অভিবাদন করলেন অনেককে। দুজন এসে ব্যাজ পরিয়ে হাতে
একটা ফাইল দিয়ে গেল। চেয়ারের পাশে একটা ছোটো জলের বোতল রেখে গেল।
হল পুরো না ভরলেও উপস্থিতি মোটামুটি ঠিক আছে। ‘আশা’, ‘আঙ্গনবাড়ি’ কর্মীদের জমায়েতটুকু
বাদ দিলে, মহিলাদের সংখ্যা এখনো খুব কম। এ ধরণের জয়েন্ট কনভেনশন না হয়ে কোনো একটি সংস্থার
কর্মচারিদের সাংগঠনিক আয়োজন যদি হয় তাহলে অনুপাতে বেশি থাকে সেখানকার মহিলা কর্মচারিদের
উপস্থিতি। ১৯৯১এর পরের যুগটায় সমাজের সবক্ষেত্রে মহিলাদের এগিয়ে আসাকে ‘নব-উদারবাদ’, তাদের হাত ধরে আসা
প্রযুক্তি ও নতুন অর্থনীতির কৃতিত্ব বলে দাবি করে। সত্যিই কী তাই? আর বাস্তবে কতটা
বেড়েছে? …
হাতে মোবাইল থাকলেই হাতটা নিশপিশ করে। টাইপ করলেন, ফিমেল ওয়র্কফোর্স
পার্টিসিপেশন ইন নাইন্টিন নাইন্টিজ – যাঃ, বাড়া
দূরের কথা, এআই তো বলছে প্রথম দশ বছরে কমে গিয়েছিল! নাঃ, ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে
হবে। এখানে বসে হবে না। তবে কিছুটা বেড়েছে নিশ্চয়ই। তার সবচেয়ে বড়ো পরিমাপ তো তাদের
ওপর বাড়তে থাকা হিংসা! সেটাও কি ক্রমবিকাশমান উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে পুরোনো উৎপাদন
সম্পর্কের সংঘাতের অংশ নয়? … আবার হলের দিকে
তাকালেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রে সংগঠন তৈরির কাজ এখনো কত পিছিয়ে আছে এখানে! কত ধরণের শ্রমিক-কর্মচারি
এখানে জাস্ট ‘নেই’!
প্রধান বক্তার সুর ধরে প্রায় সবাই নিজের নিজের সেক্টরের সমস্যা দিয়ে
শুরু করে চলে আসছিল চারটে লেবার কোড প্রসঙ্গে। কয়েকজন, যারা একটু বিশদে জানে, লেবার
কোডের কয়েকটি নিয়ম বা ধারার সঙ্গে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার কয়েকটি ধারার বিপজ্জনক পারস্পরিক
সম্পর্কটাও দেখাচ্ছিল। কিভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করার, হড়তালে যাওয়ার, এমনকি দ্বিপাক্ষিক
বার্তায় বসার, এতদিনকার চেনা অধিকারগুলোরই কন্ঠরোধ করা হচ্ছে সেকথা বলছিল। লেবার কোড
এখনো বলবৎ করে নি সরকার … সে ফাইল খুলে ভিতরে
দেওয়া ছাপা ঘোষণাপত্রটা পড়তে লাগল।
মাইকে তখন একজন বলছে যে লেবার কোড বলবৎ হলে আমরা মালিক আর কর্তৃপক্ষের
গোলাম হয়ে যাবো। আরে দূর! হ্যাঁ, বল্ যে শিকলগুলো কষে যাবে! দশকের পর দশক লড়াই করে
যে অধিকারগুলো হাসিল করেছি, সেগুলো সব ছিনিয়ে নেওয়া হবে। সব মালিককে মনে করা হবে সৎ,
– শ্রমিকেরাও তাদের দিকে আঙুল তুলতে পারবে না,
সরকারের নজরদারিও আর থাকবে না। যত পাহারা থাকবে শ্রমিকের ওপর! … তাবলে কি আমরা এখনো গোলাম নই? শুধু আর্থিক সম্পর্কের আক্ষরিক অর্থে
নয় ভাবার্থেও! মনের গোলামিটাই যে এখনো কাটিয়ে উঠতে পারি নি! দেশের বিশাল জনসমষ্টি,
শ্রমিক-কৃষক, আপামর শ্রমজীবী মানুষ, শাসকশ্রেণীর সাংস্কৃতিক আধিপত্যে প্রভাবিত গোলাম
না হলে কি এমন একটা সরকার গঠিত হতে পারত যে এধরণের লেবার কোড, এধরণের ন্যায় সংহিতার
কথা ভাবতে পারে? সংসদে আনতে পারে এবং সেটা গৃহীত করাতে পারে? … শিকল তো একটাই। মজুরির গোলামির। তাতে নানান রঙ চড়িয়ে এমন ভেদের
রাজনীতি চালাচ্ছে শাসকেরা যে সবাই নিজের নিজের শিকলের রঙের বাহারেই মত্ত! … এখন সেই শেকলে – লেবার কোডের
নামে আর যা কিছু হবে সেসব নিজের জায়গায়।
আসল ফাঁদটা থাকবে যে … ঐ যে আজকাল
স্মার্ট ঘড়ি বেরিয়েছে! পরলে হৃদপিন্ডের গতি, রক্ত চলাচল, কয় কদম হাঁটলাম সব বলে দেয়!
তেমনই একটি ঘড়ি হবে লেবার কোডের কয়েকটি ধারা আর সম্পর্কিত ন্যায়সংহিতার ধারা। একজোট
হয়ে কোনো সঙ্গত পাওনা বা অধিকারের কথা বলার উদ্যোগ নিচ্ছে শ্রমিকেরা এমন সিগন্যাল ঘড়িটা
পাঠালেই সেটা গুঁড়িয়ে দিতে তক্ষুনি একত্রে প্রস্তুত হতে পারবে শ্রমমন্ত্রকের সংস্থাগুলো,
পুলিস, আর বিচারব্যবস্থার শ্রেণীগত আঁতাত! বস্তুতঃ লেবার কোডের সবচেয়ে সাংঘাতিক ফলশ্রুতি
হবে ঐ আঁতাতটা। এখনও আছে, তবে লুকিয়ে চুরিয়ে। কোড বলবৎ হলে ঐ আঁতাতটাই হবে নিয়ম।
যা হোক … । বহুক্ষণ হয়ে গেছে।
ধার্য সময় ছাড়িয়ে সবাই দীর্ঘ বক্তব্য রাখছে। পাশে বসা খুর্শিদজি তার হাঁটুতে হাত ছুঁইয়ে
দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। “কী হল?” খুর্শিদজি সামনের সারির একটা চেয়ারের দিকে ইশারা করলেন। দীপক দেখলেন,
প্রধান বক্তা ঘাড় ঘুরিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করছেন, “কেমন আছেন?” প্রধান বক্তা কমরেড
নিয়োগী তাঁর যথেষ্ট পরিচিত এবং তাঁর চেয়ে বয়সেও যথেষ্ট বড়। তবে এখনো পুরোদস্তুর সক্রিয়।
সুস্থতা ধরে রেখেছেন। উঠে গিয়ে হাত মিলিয়ে এলেন, বললেন “ভালো আছি”। সুস্থ তো তিনি
নিজেও, কিন্তু বেশি বয়স অব্দি প্রধান নেতৃত্বে থাকার প্রবল বিরোধী। বস্তুতঃ, সঙ্গে
চলা কোনো বড় নেতাকে পদ ছাড়তে আগ্রহী না করাতে পেরেই দীপক ঈষৎ ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের সব
পদ স্বেচ্ছায় ছেড়ে, বলা যায় জোর করে নতুনকে বসিয়ে সরে গিয়েছিলেন। তার জন্য তাঁকে কথাও
শুনতে হয়েছিল। কিন্তু, আখেরে তাঁর বিচারবুদ্ধি ফল দিয়েছে। ঐ নতুনের নেতৃত্বেই সবার
চোখের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে তাঁর সংগঠনটা – আরো অনেক বলিষ্ঠ আর প্রসারিত হয়েছে।
হলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন আদ্ধেক হল খালি, সবাই খেতে চলে গেছে। যাওয়ারই
কথা, অনেকেই দূর দূর থেকে এসেছে। আর সুযোগ বুঝে আগে খেয়ে বাইকে স্টার্ট দেওয়া মানুষগুলো
কয়েকজন তো থাকেই। এবার খুর্শিদজিকে বলতে ডাকা হল; মার্কেন্টাইলের পুরোনো নেতা। তাঁর
পাশ থেকে উঠে গেলেন। সামান্যই বললেন। কতজন বাকি আছে আর? দীপক ফাইলটা পড়ায় মশগুল ছিলেন,
খেয়ালও রাখেন নি। খুর্শিদজি মাইক ছেড়ে আসার পরেই শুনলেন, সভাপতি রায়জি তার নাম ধরে
বলছেন, “ … আজকের কনভেনশনের
শেষ বক্তা ধর-দা, আমাদের বরিষ্ঠ নেতাদের একজন। তাঁকে ডাকার আগে আমি এই ডিক্লেয়ারেশন,
বিবৃতিটা সম্পর্কে, শুরুতেই এটা পড়া হয়েছিল, আপনাদের রায় জানতে চাইছি, সবাই সমর্থনে
আছেন তো? যে যে সমর্থনে আছেন, হাত তুলুন।”
দীপকও হাত তুললেন। “হাত নামান।
কেউ বিরুদ্ধে আছেন? হাত তুলুন।” একটাও হাত উঠল না।
“সর্বসম্মতিক্রমে এই বিবৃতি গৃহীত হল। এবার” (সভাপতি তাঁকে ইশারা করলেন মাইকের সামনে যেতে) “শেষ বক্তা, কমরেড দীপক ধর। অনেকেই খেতে চলে গেছেন দেখতে পাচ্ছি। যাঁরা
আছেন, দুমিনিট ধৈর্য ধরে বসুন। বক্তাকে অনুরোধ করছি, সংক্ষেপে নিজের শুভেচ্ছা জানিয়ে
বক্তব্য শেষ করুন।”
কথাটা চাড়াক দিয়ে লাগল ভিতরে। কথাটা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কানে কানেও
বলতে পারতেন। বা আগে থেকেই সবাইকে বক্তব্য সংক্ষেপ করতে বলতে পারতেন। শুধু তার বেলাতেই
‘সংক্ষেপে শুভেচ্ছা?” এই রায়জির উদাহরণ দিয়েই রাজ্যের অন্যান্য অনেক কর্মচারি নেতা অবসর
নেওয়ার পরেও বছরের পর বছর পদ আঁকড়ে বসে আছে। … মাইকে হিন্দিতে
গুনে তিনটে লাইন বললঃ এক, সম্বোধন – সভাপতি মহোদয়,
মঞ্চে উপবিষ্ট প্রধান অতিথি এবং অন্যান্য বিশিষ্ট অতিথিগণ, বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ব
এবং সমবেত সাথীগণ; দুই, আজকের এই কনভেনশনের পূর্ণ সফলতা কামনা করি এবং আপনাদেরকে অভিনন্দন
ও লালসেলাম জানাই; আর তিন, ইনকলাব জিন্দাবাদ, শ্রমজীবী ঐক্য জিন্দাবাদ।
সমাপ্তি ঘোষণার পর আর দাঁড়ান নি। সোজা খাওয়ার জায়গায় চলে এসেছিলেন।
না খেয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। কেউ না কেউ দেখে নেবে আর ধরে ফিরিয়ে আনবে। লাইনে দাঁড়িয়ে
কিছুক্ষণে নিজের খাবারটা নিয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে খাচ্ছিলেন। হঠাৎ মুখ তুলে দেখলেন সামনে
কমরেড নিয়োগী আর রায়জি। “আপনি তো আগেই দেখছি
এসে শুরু করে দিয়েছেন!” রায়জি ফোড়ন কাটলেন।
তিনিও ছাড়লেন না, “কী করব কমরেড? শেষ বক্তা বলে কি শেষ ভোক্তাও
হব? তবে এখানে আপনার সভাপতিত্ব চলবে না, এই দেখুন, সংক্ষেপে সারছি না, পাপড়টাও ডবল
নিয়েছি। … নিয়োগীদা, আপনার স্বাস্থ্য ভালো আছে তো?”
- দেখে কেমন মনে হচ্ছে?
নিয়োগীদার দু’আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগরেটটার দিকে ইশারা করে বললেন, “সিগরেটটা চালিয়ে যাচ্ছেন!”
- কেন? আপনি ছেড়ে দিয়েছেন?
- হ্যাঁ।
- স্বাস্থ্যচিন্তা?
- বলতে পারেন। তবে ক্যান্সার-চিন্তা নয়। দেখলাম
নিশ্বাস-প্রশ্বাস ভালো থাকে আর তাতে সারাদিনে কাজ করার ক্ষমতা, মানে আমি সবার কথা জানি
না, নিজের ক্ষেত্রে অনুভব করি যে কাজ করার ক্ষমতা বেড়ে যায়। তাই।
- তা কী করছেন আজকাল?
-
ব্যস, মেইনলি
পড়াশুনো, লেখালেখি। মাঝে মধ্যে এধরণের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ।
হলের পিছনে খাবার
জায়গা। সামনে বারান্দা। বারান্দার এক পাশে অফিস। একাউন্টেন্ট সাহেব বসে কাজ করছ্রন।
সামনে একটা টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে বুড়ো মিসিরজি এবং আরো কয়েকজন। দীপক মিসিরজির দিকে
এগিয়ে গেলেন, “কি মিসিরজি, চিনতে পারছেন?” মিসিরজি আগের মতই উদাসীন, নিস্পৃহ গলায় বললেন, “রোজই তো একশোখানা মানুষ আসছে, কাকে কাকে চিনে রাখবো, বলুন?” বলতে বলতেও তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঘুরল দীপকের মুখের ওপর।
- হুম, চিনছি …, বিজয়বাবুর সঙ্গে আসতেন হল বুকিং করাতে।
- হ্যাঁ, নিয়মিত এসেছি কুড়ি বছর! এদিকে আসা হয়
নি, রিটায়ার করে গেছি যে।
-
আমিও আজকাল
আর বসি না। আমার বয়স তো আপনাদের চেয়ে অনেক বেশি। আর পোষায় না। … আজকাল আমার ভাগ্নে দেখে, এই যে …
বলে সামনে দাঁড়িয়ে
থাকা একটি ছোকরাকে হাঁক দিলেন।
- এর নাম চুন্নু, চুন্নুজি। এর মোবাইল নম্বরটা
লিখে নিন। আজকাল তো সবকিছু ঐ মোবাইল আর হোয়াটস্যাপেই হয়। ফোন করলে জানিয়ে দেবে হল খালি
পাওয়া যাবে কিনা। বা, কবে খালি আছে। এডভান্সও ঐ ফোনে ফোনেই পেমেন্ট করে দিতে পারবেন,
এই যে কিউআর কোড।
বলে, টেবিলে রাখা রেজিস্টারের নিচে চাপা পড়া প্লাস্টিকের স্ট্যান্ডটা
খাড়া করে রাখলেন মিসিরজি। দীপক আর বললেন না যে হল বুকিংএর দরকার তাঁর আর পড়ে না। খোঁজ
রাখারও দরকার পড়ে না, শহরের হলগুলোর কোনটার ভাড়া এখন কত, কন্ট্যাক্ট নম্বরটা কী, কোনটার
কত ক্যাপাসিটি, খাওয়ার জায়গা ঠিক মতো আছে কি নেই। … অবশ্য শহরটারই খোঁজ রাখার আর দরকার পড়ে না! একদিকে ঝাঁচকচকে হয়ে
উঠতে চাইছে অন্যদিকে আরো বেশি করে ঘাড় গুঁজছে গাদিপচা গন্ধের তীব্রতায়। … “ও মা, তাই নাকি!
বাঃ, দিন চুন্নুজি” বলে নিজের মোবাইলটা বার করে চুন্নু নামে ছেলেটির
মোবাইল নম্বর সেভ করে নিলেন।
গেটের কাছে হঠাৎ
পিছন থেকে ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন দীপক। খেয়ালই ছিল না তাঁর ফাইলটা চেয়ারে ছেড়ে গেছে।
সেটাই এখন একজন উদ্ভিন্ন যুবক নিয়ে আসছে জোর কদমে। কাছে এসে ফাইলটা দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি তো কঙ্কড়বাগেই থাকেন! না?
- আরেকটু এগিয়ে? আপনি?
- হাউজিং কলোনিতে। আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না।
-
ঠিক আছে।
… বাঃ তাহলে তো খুব দূরে নয়।
ছেলেটির ফিরে যাওয়ার
দিকে অন্যমনস্ক চেয়ে থাকতে থাকতে দীপকের আবার মনে পড়ল সকালে ভাবতে থাকা কথাটা। ন্যারেটিভ
ওয়ার – চলতি আখ্যান-যুদ্ধটার কথা। ডাকলেন ছেলেটিকে।
- তোমার নাম কী?
- সুজিত। সুজিত কুমার।
- হেল্থে, রাজ্য সরকার …
- ট্রেড ইউনিয়ন করো? পুরোদমে?
- আপনাদের সময়টা তো আর নেই। যেটুকু পারি করি!
- ভালো লাগে?
- হুঁ, হকের লড়াইয়ের কাজ, ঐক্যের জন্য কাজ … ভালো লাগালাগির ব্যাপার তো নয়! প্রতিদিনকার দরকার।
- বাঃ, ফোন নম্বরটা বল তো তোমার!
ছেলেটি বলছিল, দীপক
নিজের মোবাইলে টিপছিলেন। রিং করলেন। ছেলেটির পকেট বেজে উঠল।
- সেভ করে নাও। আমিও সেভ করে নিলাম। এস বাড়িতে
একদিন। একসঙ্গে বসে চা খাবো, গল্প করব। আপত্তি নেই তো?
- এতে আপত্তি কেন থাকবে? নিশ্চয়ই আসব।
বলে, হেসে চলে যাচ্ছিল ছেলেটি। দীপক পিছন থেকে আবার হাঁক দিলেন, “এস কিন্তু!”
২৮.৮.২৫
No comments:
Post a Comment