এই দেশের অনেক ভাষায়, রঙ্গমঞ্চ আজ যথেষ্ট বিকশিত। শ্রেন্ঠপ্রয়োগগুলোকে একজায়গায় করলে, বিশ্বমানের কাজ যে কিছু কম হয়নি, নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই সমস্ত কাজের প্রস্তুতির দীর্ঘ ইতিহাসে ব্রেখটের নাম ও তাঁর নাট্যচিন্তার অভিনবত্ব, এক প্রধান প্রবর্তক ও প্রেরকশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
শুরুতে আশানুরূপ হয়নি ফল। দর্শককে অংশীদার. করার কেতাবী টেকনিকগুলো টেকনিকের চমক ও জৌলুষে দর্শককে বরং আরো আড়ষ্ট, বিভ্রান্ত অথবা (একাংশকে) ‘বোদ্ধা’ ভাবাপ্লুত করেছে। কিন্তু যেমন যেমন দেশের মাটিতে, জলহাওয়ায়, আবহমান নাট্যধারায় ওই টেকনিকগুলো জারিয়ে নতুন রূপে ফেরত নেওয়া হয়েছে, মঞ্চ ও প্রেক্ষণের দুটো আলাদা দুনিয়াকে মূল প্রস্তাব মত, আন্তঃক্রিয়ায় এক করে নিতে পেরেছে সাহসী নাট্যকর্মীরা। এবং ওই পথে দেখাতে পেরেছে যে দুনিয়া মূলতঃ একটাই। তার ভেতর থেকেই সাড়া জাগে অন্য দুনিয়া গড়ে তোলার – কুশীলবেরা যায়, গড়ে তোলে, প্রয়োজনমত ভাঙচুর করে, প্রসারিত আত্মপরিচয়ের তাগিদে। সেটা পেতেই নানান টেকনিক অথবা টেকনিকহীনতাও
দুনিয়া গড়ার কাজে নিষ্ঠাটা কিন্তু প্রাথমিক শর্ত। দুনিয়া গড়তে না জানলে, ভাঙচুরের তাড়া ছন্দ না জেনে ছন্দমুক্তির প্রস্তাবের মত।. এবং এই দুনিয়া গড়ার মূল অনুশাসনে ব্রেখ্ট এবং তাঁর পুর্বসুরী স্টানিস্লাভস্কিতে কোনো বিরোধ নেই। বরং এদিক থেকে বলা যয স্টানিস্লাভস্কি অব্দি আগে পৌছোলে তবেই ব্রেখ্টকে পাওয়া যাবে। বিশ্বনাট্যধারার এক পরিণতিতেই ব্রেখ্টীয় ভাবনার প্রয়োজন হবে।
দুনিয়া গড়ার কাজে নিষ্ঠার বিভিন্ন উপাদানে যেমন আছে শ্রেষ্ঠ আলেখ্য, শ্রেষ্ঠ অভিনয়, শ্রেষ্ঠ মঞ্চসাজ (জাঁকজমক নয়, শূন্যমঞ্চও শ্রেষ্ঠ মঞ্চসাজ হতে পারে) ইত্যাদি, তেমনই আছে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলেখ্য অংশ – কবিতা। শ্রেষ্ঠ আলেখ্য পাওয়ার তাগিদে যেমন ব্রেখ্টকে দেখি ‘করিওলেনাস’ আঠেরোবার লিখতে – বার বার শুরু করেও সন্তষ্ট হতে পারছেননা – শ্রেষ্ঠ কবিতা পাওয়ার তাগিদে ব্রেখ্টকে এই শতাব্দীর এক মহানতম কবি হয়ে উঠতে দেখি। এমন এক কবি, জীবনের দ্বান্দ্বিকতাই যাঁর কাছে জীবনের সৌন্দর্য, শিল্পের নন্দনতত্ত্ব।
ব্রেখ্টের নাটক ও কবিতা আলাদা নয়। দুই পরিপূরক সত্তার, পরিপূরক সৃজনকর্মও নয়। ব্রেখ্টের সমস্ত কবিতা নাটকেরই কবিতা। কিছু রচিত ও অভিনীত আলেখ্যের, কিছু অরচিত আলেখ্যের।
এত গভীর বোধের পংক্তিগুলির এত সফল নাটকীয় ব্যবহার কিন্তু ভারতবর্ষে আমরা আমাদের বিভিন্ন ভাষার রঙ্গমঞ্চে বিশেষ দেখতে পাইনা। অথচ কবিতাই শ্রেষ্ঠ সৃজনধর্মী negation হয়ে উঠতে পারে নাট্যঅভিঘাতের প্রতিটি পর্যায়ে এবং উত্তরণে। দর্শক ও কুশীলবদের একাত্ম উপলব্ধির পথে নিয়ে যেতে পারে। মঞ্চে গড়ে ওঠা দুনিয়াটায় আনতে পারে সার্থক ভাঙচুর। কেননা কবিতা thinking in images। গান, নয়।
ব্রেখ্ট দেখেছিলেন বিপ্লবী জার্মানির, সময়ানুগ সিদ্ধান্ত নিতে অসফলতা, সিদ্ধান্ত নিতে চাওয়া সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দের, সরকার কর্তৃক দমন ও হত্যা, সমাজবাদী-গণতান্ত্রিক (তৎকালীন সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক) শক্তির দুর্বলতা ও সাতবার খোড়-বড়ি-খাড়া সরকার্ গঠন, নাৎসি শক্তির উদয়, ‘অন্যায়পূর্ণ শান্তি চুক্তি’র বিরুদ্ধে ভাবালুতা জাগিয়ে জাতিশ্রেষ্ঠতাবাদ ও যুদ্ধপ্রস্ততিকে জনপ্রিয় করে তোলা, আর্থিক মন্দার বছরগুলো, হিটলারের শাসনক্ষমতায় আসা ও চ্যান্সেলারী ভঙ্গ করা, কমিউনিষ্টদের ব্যাপক দমন, ষাট লক্ষ ইহুদির সংহারযজ্ঞ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার শেষ – এবং এই সমস্তকিছুর পাশাপাশি সমাজবাদী সোভিয়েত রাশিয়ার অভূতপূর্ব প্রগতি, প্রস্তুতি এবং শেষ অঙ্কে নাৎসিশক্তিকে তাড়া করতে করতে, একের পর এক ইওরোপীয় দেশগুলিতে মুক্তির পতাকা উড়িয়ে এসে হিটলার ও তার দলবলকে খতম করে দেওয়া (এমেরিকার দ্বিতীয় মোর্চা তখন বার্লিন থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিল)।
ব্রেখটের সামনে ছিল ইতিহাসচক্রের এক চূড়ান্ত পর্যায়। কৌম সমাজে শ্রেণী বিভাজন, রাষ্ট্রের উৎপত্তি, ক্রীতদাস প্রথা শুরু হওয়ার পর্ব এবং তৎকালীন ভাবধারাগত সংগ্রাম এখনো মানুষের জাতিস্মৃতিতে বিস্ময়কর যৌথ প্রজ্ঞার (collective wisdom) যুগ হিসেবে, বিপুল ও বহুমুখী সাংস্কৃতিক উৎপাদনের পর্ব হিসেবে রয়েছে। মহাকাব্যিক এই যুগকে মার্ক্স তাঁর সুপরিচিত দ্বান্দ্বিক ভাষায় মানুষের তেজীয়ান শৈশব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । করেছেন গ্রীসের প্রসঙ্গে, কিন্ত ভারতবর্ষেও এই সংক্রমণ কালের দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক ফসল ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের উতলা করে তোলে।
অর্থাৎ শ্রেণীবিভাজিত সমাজের উদয় ও আদিম সাম্যবাদের বিরুদ্ধে তার যুগান্তকারী সংগ্রাম ছিল একটি 'এপিক পিরিয়ড'।
দ্বিতীয় 'এপিক পিরিয়ড' এল ব্রেখ্টের সামনে, যাতে শ্রেণী বিভাজনের ভিত্তিতে গঠিত সমাজের সমাপ্তি ঘোষণা করছিল, আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রত, শ্রেণীহীন, শোষণহীন নতুন সমাজবাদী সমাজ।
এই দ্বিতীয় এপিক পিরিয়ডের এপিক ডায়মেন্সন্স্ ব্রেখ্ট উপলব্ধি করেছিলেন এবং নিজের নাটক, কবিতা ও বিশেষ করে নাট্যচিন্তাগুলিতে নিজের উপলব্ধি স্পষ্ট করার জন্য যুঝেছিলেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন সত্তেও এটা আমাদের শতাব্দীর প্রধান সত্য যে আমরা সেই এপিক পিরিয়ডে বাঁচছি। সমাজবাদী শিবিরের এক বিরাট অংশের ভাঙন, এক-মেরুপ্রবণ দুনিয়ার জিগির, সাম্রাজ্যবাদ ও বিত্তপূঁজির প্রভুতু, মার্কসের বিজ্ঞানসম্মত সমাজ-বিশ্লেষণকে আরো প্রমাণিত করেছে, প্রাসঙ্গিক করেছে।
ফ্যাসিবাদের শিকড় থাকে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের ভিতরেই। বরং বলা যায় ফ্যাসিবাদের সবক’টি প্রবৃত্তির বর্দ্ধিত ক্রিয়াশীলতার ওপর পূঁজিবাদী গণতন্ত্র উত্তরোত্তর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে থাকে। মূলতঃ ওই প্রবৃত্তিগুলোর জন্ম হয় গভীর ও সর্বাঙ্গীণ সামাজিক সঙ্কটের ফলশ্রুতি হিসেবে, জমির কাজ করে ব্যক্তি ও তার সমুদায়ের দ্রুত পতনশীলতা (প্রকারান্তরে বহুবিধ পতনশীল সমূদায়ের গড়ে ওঠা)।
ফ্যাসিবাদের সবক’টি প্রবৃত্তি পূঁজিবাদী গণতন্ত্রের ভিতরে বহুপার্শ্বিক ধাঁচে বেড়ে উঠতে থাকে। এক বিশেষ পরিস্থিতিতে সবকটি অথবা প্রধান কয়েকটি প্রবৃত্তি মিলেমিশে এক রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহণ করে। এটা হওয়ার জন্য প্রয়োজন ক্রমাগত বাড়তে থাকা জনসমর্থন। ফ্যাসিবাদ তা পেয়েও যায় কেননা (1) অস্তিত্বের সর্বা্ঙ্গীণ সঙ্কট (2) আত্মপরিচয়ের হ্রাস, এবং (3) মূল্যের পতন দ্রুত গতিতে হতে থাকে পুঁজিবাদী সমাজে।
কি ভাবে এর বিরুদ্ধে দাড়াবে মানুষ? বিশেষ করে সেই মানুষ যার সামাজিক অবস্থান সহজাত ভাবে এর বিরুদ্ধে ? কি ভাবে সে চিনবে তার ঐতিহাসিক দায়?
কথার বলে recognition of necessity is freedom। কি হবে এই recognitionএর দ্বান্দিক প্রক্রিয়া ? বিশেষ করে শিল্পে? আরো বিশেষ করে নাট্যশিল্পে? কবিতায়? বিষয়ের সাথে বিষয়ীর আন্তঃক্রিয়া কতদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে?
প্রাথমিক তো নাটক করা, কবিতা লেখা। আন্তঃক্রিয়া শুরু হয় এখানেই। কিন্তু recognition অব্দি কি পৌঁছোয়? কিভাবে করব নাটক? কী হবে কবিতার স্বরূপ?
বিষয়ের পরতে পরতে অনেক জটিলতা। আগে থেকে পাওয়া ব্যাখ্যাগুলোর ভ্রান্তি, গড়ে ওঠা বিশ্বাসের তর্জনী, বিষয়ীও জীবনধারণে ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত, লড়াইয়ের মুক্ত মুহুর্তগুলোতেও টানাপোড়েনে জর্জর। তাহলে?
তাহলে গড়ে তোলো হাজারো প্রশ্নের প্রাণবন্ত পরিমন্ডল। বিষয়ের ব্যাখ্যায় বেশী চোখা করো প্রশ্নসূচক দিকগুলো, অবিশ্বাসের অবস্থানগুলো, ভাবনার অসঙ্গতিগুলো। বিষয়ীকে কাছে টানো, অন্তর্ভূক্ত করো প্রশ্নের সুত্র ধরে। ফিরিয়ে আনো তার মূল্যবোধ, আত্মপরিচয়, অস্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ সঙ্কটকে দ্বন্দ্বে আহ্বান জানানোর মেজাজ ও তেজ। সমাধান, বাইরে, জীবনে খুঁজে নেওয়া যাবে।
ব্রেখ্টের সমস্ত নাট্যচিন্তা, কাব্যমনন ও কর্মময় জীবনধারণ প্রশ্নের ওই প্রাণবন্ত পরিমন্ডল গড়ে তোলার অনুসন্ধিৎসায় সমর্পিত।
সমস্ত আপাত চমকপ্রদ টেকনিকের সার্থকতাও ওই, ওতেই।
ব্রেখ্টীয় হয়ে ওঠা মানে প্রশ্নের ওই প্রাণবন্ত পরিমন্ডল গড়ে তোলার কাজকে চরম নান্দনিক উত্তরণ হিসেবে চিহ্নিত করা।
[ঈক্ষণ, বৈশাখ ১৪০৫ সংখ্যায় প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment