Monday, November 21, 2022

আমাদের, মানে লালঝান্ডাওয়ালাদের স্বামীজি

স্বামীজি তো হাজারে হাজারে আছেন। কিন্তু স্বামীজি বলতেই যে একজনের ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে সেটি বিবেকানন্দের। সেটাই স্বাভাবিক। তাঁর ধারে কাছে তো আর একজনও নেই যিনি আধ্যাত্মিক আলোয় দেশকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাস্তবিক ভারতবর্ষের জ্বালাময় সামাজিক দ্বন্দ্বগুলোকে চাপা দিতে চান নি, এড়িয়ে যেতে চান নি, আধ্যাত্মক পথে সমাধানের কথা বলেন নি বরং যখনই প্রয়োজন বুঝেছেন, আধ্যাত্মিক ভাষা থেকে সরে এসে কঠোর বস্তুবাদীদের মত সেই দ্বন্দ্বগুলোকে সামনে তুলে ধরেছেন এবং আধ্যাত্মিক আলোর মায়ায় হারিয়ে যেতে চাওয়া আধুনিক কুলীনদের থেকে অনেক বেশি প্রভাবিত করেছেন সেই তরুণ প্রজন্মদের, যারা ওই দ্বন্দ্বগুলোর বাস্তবিক সমাধানের জন্য সচেষ্ট হয়েছে।

তবুও সেটা একটি গতিপথ বা আবক্রপথ। একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত থেকে আরেকটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে পৌঁছোবার। উনবিংশ শতকের সমাজসংস্কার থেকে, অথবা উনবিংশ শতকের ব্রাহ্ম আন্দোলন থেকে, অথবা উনবিংশ শতকের ভক্তি-অধ্যাত্ম থেকে বিংশ শতকের জাতীয়তাবাদ – একটি গতিপথ। জাতীয়তাবাদ থেকে শ্রেণী সংগ্রাম – দ্বিতীয় গতিপথ; দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় ঐতিহাসিক মুহূর্তে পৌঁছোবার। 

বিবেকানন্দ একজন হলেও প্রথম গতিপথের পথিক বেশ কয়েকজন ছিলেন। তাঁর আগে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীও ছিলেন, আবার জালিয়াঁওয়ালা বাগের দিনগুলোয় বিস্ময় জাগিয়ে তোলা স্বামী প্রজ্ঞানন্দও ছিলেন। আবার উল্টো গতিপথে যাওয়া – জাতীয়তাবাদ থেকে অধ্যাত্ম – মানুষেরাও ছিলেন। এক জীবনে দুটো গতিপথ পেরুন – অধ্যাত্ম থেকে জাতীয়তাবাদে পৌঁছে আবার জাতীয়তাবাদ থেকে শ্রেণীসংগ্রামে পৌঁছোন – মানুষ একজনই ছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের ছাব্বিশ বছর পর পূর্ব উত্তরপ্রদেশে জন্ম হলেও তাঁর সম্পূর্ণ কর্মজীবন কেটেছে বিহারে। তিনি সারা ভারত কিসান সভার সংস্থাপক সভাপতি স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী। 

বিভিন্ন বাংলা খবরের কাগজের বিহার সংবাদদাতারা এবং মাঝে মধ্যে চাকরিসূত্রে বিহারে কিছু বছর কাটিয়ে যাওয়া বামপন্থী খবরাখবর রাখা বাঙালিরা নাক সিঁটকে বলতে পারেন – স্বামী সহজানন্দ? সেই যিনি ভুমিহার আন্দোলনের নেতা ছিলেন? ওনাদের জন্যই তো বিহারের সবকটা বামপন্থী পার্টির নেতৃত্বে ভুমিহারদের বোলবালা! … 

হ্যাঁ স্যার, সেই সহজানন্দ! ভূমিহার উত্থানের তথাকথিত সূত্রধার। 

স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর জন্মতারিখ উইকিপিডিয়ায় পাবেন ২২শে ফেব্রুয়ারি ১৮৮৯। সে বছর সেদিনই নাকি মহাশিবরাত্রি ছিল এবং গ্রামীণ রীতি অনুসারে শিশুটির কানে বার বার একথাটিই যেত যে মহাশিবরাত্রিতে তার জন্ম। কাজেই স্বামীজি নিজেও ঐ দিনটাকেই নিজের জন্মদিন মানতেন। এখনও তাঁর অনুযায়ী এবং বামপন্থী কৃষক সংগঠনেরও একাংশ, ঐ দিনটাকেই তাঁর জন্মদিন হিসেবে পালন করে, সেটা যে বছর যে তারিখেই পড়ুক। পূর্ব উত্তর প্রদেশের সেই এলাকায় তাঁর জন্ম হয়েছিল যেটা এখনও ভূমিহার অধ্যুষিত – জেলা গাজিপুর। তার ওপর সহজানন্দের ভিতরে ছিল ব্রাহ্মণত্বের অহঙ্কার, কেননা অধিকাংশ জাত্যাভিমানী ভুমিহার আজও নিজেদের ব্রাহ্মণ ভাবে। তা ছাড়া তাঁর প্রতিপালনও সেভাবেই হয়েছিল। তিনি নিজেই পরে লিখেছেন, “ … পুজো এবং পুজারি শিক্ষকদের সংসর্গে থাকার কারণে বলুন আর গ্রামবাসীদের প্রবৃত্তির প্রভাবে বলুন, আমি চিরকাল সনাতনী থেকেছি। এর গভীর প্রভাব যে সে সময় মনের ওপর পড়েছিল তা মোছেনি। যদিও আগের মত গোঁড়ামি আর নেই এবং পরে আমি ধর্মের শুধু সেই সব কথাগুলো সবসময় মেনেছি, যেগুলো বুদ্ধি দিয়ে মানতে পেরেছি। এটা সত্যি যে এখনো অব্দি সেই সনাতনপন্থার কিছু না কিছু প্রভাব রয়ে গেছে।”

পরিবারের কিছুটা জমিদারিও ছিল কিন্তু তাতে খাইখর্চা মিটত না, তাই প্রজাস্বত্বে জমি নিয়ে চাষও করতে হত। সহজানন্দের মা মারা যান তার তিন চার বছর বয়সে। তিনি মায়ের শেষ সন্তান। মায়ের ওপরে তাঁর এক বোন ছিল এবং তাঁদের দুজনের বিয়ে হয়েছিল সহজানন্দের বাবা ও জ্যাঠামশাইয়ের সাথেই। কাজেই শিশুটি মাসির কাছেই মানুষ হয়েছিল। সন্ন্যাস গ্রহণের আগে অব্দি, জন্মসূত্রে তাঁর নাম ছিল নওরঙ রায়।  

শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে বৈরাগ্যের একটা ভাব ছিল। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন যে গ্রামের বুড়িরা তাঁর বিষয়ে বলত – ছেলেটার হৃদয় যেন পাথর; মা মরল, সবাই কাঁদছে আর এ? বলে কিনা, মা তো মরেই গেছে, কেঁদেকেটে কি আপনারাও মরে যাবেন? খেলাধুলো বা দুষ্টুমিতেও বালক নওরঙের মন বসত না। যা হোক, ছেলেটি বুদ্ধিমান দেখে তাকে স্কুলে ভর্তি করা দেওয়া হল। ভালোভাবে পড়াশুনো করছিলেন। কিন্তু কোনো কোনো শিক্ষকের প্রভাবে পুজোপাঠও বেড়েই চলেছিল। ছেলের অবস্থা দেখে পনের বছর বয়সেই পরিবারের লোকেরা ধরে বেঁধে তাঁর বিয়ে দিয়ে দিল। অবশ্য তিনি নিজেই বলছেন যে মনে বৈরাগ্যের ভাব থাকলেও যে বিয়েতে তাঁর অনিচ্ছে ছিল এমন নয়। তেমন হলে তিনি নিশ্চয়ই বিরুদ্ধে যেতেন। কিন্তু যাননি। অথচ ভাগ্যের পরিহাস, যে দু’বছরের মধ্যে সে স্ত্রীর মৃত্যু হল। তাঁর মনে হল এটাই প্রশস্ত সময়। স্ত্রী বেঁচে থাকলে সন্ন্যাস নিতে পারতেন না, কেননা স্ত্রী-সন্তানের দায়িত্ব ভুলে সন্ন্যাস নেওয়া মহাপাপ, তিনি জানতেন।

১৯০৬ সালের গরমের ছুটির পর গাজিপুরের স্কুলে ফিরলেন (তখন পড়াশুনোর জন্য গাজিপুরেই একটি শিবমন্দিরে থাকতেন) আর একদিন, বেনারসের টিকিট কেটে ট্রেনে চাপলেন। জুলাইয়ের শুরু। তিনি জানতেন চাতুর্মাস্যে সন্ন্যাসগ্রহণে বাধা, কাজেই শিগগির, কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। বেনারস থেকে হরিদ্বারের টিকিট পেলেন না। তখন লখনউএর টিকিট কেটে এগোলেন। লখনউ থেকে হরিদ্বারের টিকিট কেটে ট্রেনে চাপলেন কিন্তু সকালের নিত্যকর্মাদি সারতে কাকোরিতে নেমে পড়লেন। ভাবলেন পরের ট্রেন ধরে যাবেন। কিন্তু সেখানেই মনে ভয় জন্মাল। যদি চাতুর্মাস্য এসে গেছে বলে সন্ন্যাস না নিতে পারেন আর বাড়ি না ফিরলে সাড়া পড়ে যায় যে ছেলে সন্ন্যাস নিতে পালিয়েছে? তখন তাঁকে আর বাড়ি ছেড়ে একা বেরুতে দেওয়া হবে না। সব পন্ড হবে। 

ফিরে এলেন। ম্যাট্রিকের পরীক্ষা আসছে। স্কুলে শিক্ষকেরা সবাই ভাবছিলেন, ব্যস ইংরিজিটা আরেকটু ভালো করে নিলে, ছেলেটির যা মেধা আছে, ও ম্যাট্রিকে ফার্স্ট হবেই হবে। ওদিকে নওরঙ দেখছিলেন আগের বৌয়ের ছোটবোনের সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ের তোড়জোড় চলছে বাড়িতে। কাজেই, ঠিক পরীক্ষার আগে, ১৯০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাশীতে একটি মঠে গিয়ে সন্ন্যাস নিয়ে নিলেন। নাম হল সহজানন্দ। 

তারপর যা হয়, হল। সাড়া পড়ে গেল। খবর পৌঁছোল গ্রামে। পরিবারের লোকেরা এসে তাঁকে অনেক অনুরোধ-উপরোধ করে গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। কান্নার রোল পড়ে গেল বাড়িতে। সবাই ভাবছিল বুদ্ধিমান, লেখাপড়া শেখা ছেলে, ভালো চাকরি করে সবার দৈন্য ঘোচাবে – সে সব আশা জলে গেল। লুকিয়ে লুকিয়ে পরিকল্পনা করা হল জবরদস্তি গেরুয়া খুলিয়ে সন্ন্যাস ভেঙে দেওয়া হবে, নষ্ট করে দেওয়া হবে – হল না। পরিবারের হিসেবে পন্ডিত, শাস্ত্রজ্ঞানী ব্যক্তিদের নিয়োজিত করা হল, তারা যুক্তি দিয়ে বোঝাবে – পারল না। সহজানন্দ বাড়ি ছেড়ে চলেই গেলেন আবার।

এরপরের ঘটনাগুলো সংক্ষেপে সারছি। কেউ জানতে চাইলে তাঁর আত্মজীবনীর বাংলা অনুবাদ ‘আমার জীবনসংগ্রাম’ পড়তে পারেন, আমিই করেছি, আমার ব্লগে আছে। 

সন্ন্যাস নেওয়ার কিছুদিন পর উনি ভ্রমণে বেরিয়ে গেলেন। কখনো এক সন্ন্যাসী বন্ধুর সাথে, কখনো একা উনি হরিদ্বার, হৃষীকেশ, কেদার, বদ্রী থেকে মধ্যভারতে উজ্জৈন অব্দি নানা জায়গা পদব্রজে বা ট্রেনে চষে বেড়ালেন। উদ্দেশ্য ছিল কোনো গুরুর কাছে ভালো করে প্রাণায়াম ও যোগাভ্যাস শেখা। সাংসারিক কাজের প্রতি তীব্র অনীহায় যোগাভ্যাস, ধ্যান, সমাধি, বেদান্তচিন্তন … এসবকেই আসল কাজ ভাবতেন। মাঝে মধ্যে কিছুদিন কোথাও, কোনো মঠে, কোনো আচার্য্যের কাছে অধ্যয়নে ব্যাপৃত হতেন। এক সময় দন্ডগ্রহণ করার অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে দন্ডী হলেন। দিনের পর দিন মাধুকরীর পথে ঘরে ঘরে ভিক্ষে চেয়ে অন্ন জোটাতেন এবং সেই অন্নই দিনে একবার, স্বপাকে গ্রহণ করতেন। কিছু দিন মঠে অধ্যয়ন আর বিশ্রামে কাটিয়ে, আবার সঙ্গী পেয়ে চলে গেলেন গুজরাত। ফিরে এসে গেলেন মিথিলা। সাত বছর এই সন্ন্যাস জীবনে কেটে গেল।

কাশীতেই ছিলেন যখন কয়েকজন সন্ন্যাসী তাঁকে বালিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য ভুমিহার ব্রাহ্মণ মহাসভায় যেতে রাজি করালেন। সেখানেই তিনি প্রথম দেখলেন ও জানলেন যে তিনি নিজে যদিও আশৈশব ভূমিহার ব্রাহ্মণ শব্দজোটটাকে ঠিক তেমনই ভেবে এসেছেন যেমন কনৌজিয়া ব্রাহ্মণ, সরযুপারি ব্রাহ্মণ, মৈথিল ব্রাহ্মণ ইত্যাদি, সাধারণভাবে এখানে ভুমিহার ব্রাহ্মণ অর্থ ‘পতিত’ ব্রাহ্মণ। এবং তাঁর অবাক লাগল যে দুস্থ, গরীব ভুমিহার নিজেদের নানারকম সামাজিক ও ধার্মিক ক্রিয়াকর্মে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের খাইখর্চা মেটাতে নিজেদের সর্বস্বান্ত করে দেয়। এর আগেই সন্ন্যাসী হয়ে, স্থানে স্থানে ঘুরে তিনি গুরুবাদের ভন্ডামি দেখেছেন, শাস্ত্রার্থের নামে ভন্ডামি দেখেছেন, যোগীদের ভন্ডামি দেখেছেন … এখানে ভুমিহারসভায় গরীব ভুমিহারদের অবস্থা দেখে শুরু করলেন ভুমিহারদের পুরোহিত হওয়ার অধিকারের আন্দোলন। এটাই তাঁর জীবনে তোলা প্রথম সামাজিক আন্দোলনের আহ্বান এবং তাতে অংশগ্রহণের ঘটনা ছিল। তিনি বললেন যে যেকোনো গৃহী ভুমিহার নিজেদের সামাজিক ও ধার্মিক ক্রিয়াকর্মে নিজেরাই পুরোহিত হতে পারে। কাউকে ডাকার দরকার নেই। শুধু সেই সভাতেই নয় অন্যত্র ঘুরে ঘুরেও কথাটা প্রচার করলেন। এও বললেন যে ব্রাহ্মণদেরও পুরোহিতই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তারা চাষবাসও করতে পারে; শাস্ত্রে কোথাও কোনো বাধা নেই। এসব নিয়ে বই লেখাও শুরু করলেন, ছাপল, এবং প্রচারিত হল সেসব।

অজান্তেই উনি মৌচাকে ঢিল ছুঁড়ছিলেন। একসঙ্গে দু’তিন জায়গায়। প্রথমতঃ পুরোহিত হওয়ার একচ্ছত্র অধিকারকে চ্যালেঞ্জ জানানর অর্থ হল জাতিপ্রথা ও ব্রাহ্মণবাদের ওপর হামলা। এটা প্রথম। কিন্তু এ থেকে বড় হল স্থিতাবস্থার সমর্থকদের ওপর হামলা। ওই মহাসভায় গরীব, দুস্থ ভুমিহারদের ভীড় থাকলেও নেতৃত্বে তো ছিল বড়, ধনাঢ্য জমিদার, অধিপতি রাজা ও রাজন্যেরা। তাদের টনক নড়ল। স্থিতাবস্থায় হামলা হলে তাদের শাসনের সমীকরণ বিপন্ন হবে। তারা নড়ে চড়ে বসল। তৃতীয় মৌচাকটা সহজানন্দের ভিতরেই ছিল। সন্ন্যাসে জ্ঞান ও ঈশ্বরপ্রাপ্তির সাধনা। সামাজিক আন্দোলনে বড় ভাবে অংশগ্রহণ করার কারণে তার বহিরাবরণটা সরে গেল। 

তিন-চার বছর ভুমিহার ব্রাহ্মণ আন্দোলনের সঙ্গে বিভিন্ন ভূমিকায় থেকে (এবং তাঁর নিজের কথায়, ধনাঢ্য ভুমিহারদের খপ্পরে পড়ে শেষের তিন বছর নষ্ট করে) বন্ধুবান্ধবদের অনুরোধে উনি ইংরেজি পড়া শুরু করলেন আবার। ভিতটা পোক্ত হল। নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তে শুরু করলেন। ১৯২০র জুলাইয়ে বাল গঙ্গাধর তিলকের মৃত্যু তাঁকেও আঘাত করল। খিলাফত আন্দোলনের ক্রমে অসহযোগের প্রশ্নে মতবিরোধে তাঁর গান্ধিজি কে ঠিক আর মালবীয় ও অন্যান্যদের ভুল মনে হল। সে বছরই পাটনায় ডিসেম্বরে এলেন গান্ধিজি এবং কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারা। 

স্বামীজি লিখছেন জালিয়াঁওয়ালা বাগের ঘটনার বিরুদ্ধে অসহযোগের ডাক দিতে। এতে বোঝা যায় সেই ঘটনার প্রভাব স্বামিজির মনেও পড়েছিল। সভায় নিয়মিত গিয়ে সব নেতাদের ভাষণ শুনলেন। এবং শেষে সিদ্ধান্ত করলেন যে গান্ধিজির সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলা দরকার। সে সুযোগও এল। কথা বললেন। সন্ন্যাস নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, গীতা প্রসঙ্গে … অনেকক্ষণ। বার্তালাপ শেষে তাঁর মনে হল এক্ষুণি রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিৎ। আত্মজীবনীতে উনি লিখছেন, “এজন্য নয় যে দেশের উপকার হবে। বরং একন্য যে তাহলেই আমি সাচ্চা সন্ন্যাসী হতে পারব। এখন তো আমি কাঁচা।” এবং কিছুদিনের মধ্যেই সহজানন্দ রাজনীতিতে যোগ দিলেন। নাগপুর কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করার পর বিহারকেই নিজের কার্যক্ষেত্র করলেন। প্রথম অসহযোগ সংগঠিত করলেন বক্সারে। জেলে গেলেন বেশ কয়েক বার। জনগণের প্রশ্নে সোচ্চার হতে পত্রিকার প্রকাশন শুরু করলেন। 

প্রথম বার ভুমিহার আন্দোলনের সাথে সংযোগ তাঁকে কংগ্রেসের রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিল। তিনি স্বদেশী দেশসেবক হয়ে উঠেছিলেন। দ্বিতীয়বার ভুমিহার আন্দোলনের সাথে সংযোগ তাঁকে শ্রমজীবী আন্দোলনের দিকে টেনে নিয়ে গেল। 

দুটো ঘটনা ঘটল আগে পরে। প্রথমতঃ, বিহারে স্বাধীনতা সংগ্রামী জননেতা হিসেবে কাজকরা এক সন্ন্যাসী হিসেবে তাঁর নামডাকে প্রভাবিত হয়ে এক সন্ন্যাসী মহন্ত সীতারামদাস মারা যাওয়ার আগে তাঁর বিহটার মঠ ও জমিজমা সহজানন্দকে দিয়ে গেলেন। সহজানন্দ সেখানেই শুরু করলেন ভুমিহার বালকদের সংস্কৃত পড়ানর পাঠশালা। কিন্তু সেখানে থাকার সুবাদে বিহটার কৃষকদের ওপর হওয়া জমিদারের শোষণও খুব কাছ থেকে দেখা শুরু করলেন। শুধু জমিদারের শোষণ নয়। বিহটায় চিনি মিল ছিল। তাই আখচাষিদের প্রকৃত অবস্থা এবং মিলমালিক ও জমিদারদের যুক্ত অত্যাচার প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন।      

দ্বিতীয়তঃ, আবার তাঁর ডাক এল ভুমিহার ব্রাহ্মণ মহাসভার তরফ থেকে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন ধনী ভুমিহারদের মাঝে তিনি অবাঞ্ছিত। কেননা তিনি কংগ্রেসি, দেশসেবক আর জমিদারেরা ইংরেজশাসনের লেজুড়। তাঁকে শুনতেও হল বাঁকা কথা – আপনি তো সন্ন্যাসী, হিমালয়ে যান, এখানে কী করছেন?

এসবেরই প্রভাবে স্বামীজি আরো বেশি করে গরীব জনসাধারণের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করলেন এবং কৃষক আন্দোলন শুরু করলেন নিজের এলাকায়। ৪ঠা মার্চ ১৯২৮ সালে স্থাপিত হল দেশের প্রথম কিসান সভা – পশ্চিম পাটনা কিসান সভা। কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করতে সারা বিহার চষে বেড়ালেন। ভারতবর্ষ চষে বেড়ালেন। যখন সারা ভারত কিসান সভা সংগঠিত হল, তিনি হলেন তার সর্বমান্য সংস্থাপক সভাপতি।  

এরপর স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী কৃষক নেতা, সংগ্রামী শ্রমজীবীর বন্ধু, এক অসামান্য বিপ্লবী চিন্তানায়ক। সে জীবনের সংক্ষিপ্তিকরণের কোন প্রয়োজন নেই। যেটুকু লেখা আছে, তার বিশদে গিয়ে আরো আবিষ্কারের প্রয়োজন আছে। 

২১.১১.২২




No comments:

Post a Comment