যদ্দুর বইয়ে দেখতে পাচ্ছি, ১৮১০ সালে ‘কাল্পনিক সমাজবাদী’নামে খ্যাতদের একজন, রবার্ট ওয়েন আট ঘন্টা শ্রমদিনের প্রশ্ন তোলেন এবং নিউ ল্যানার্কে নিজের সমাজবাদী উদ্যমে সময়টা বলবৎ করেন। ১৮১৭ সালে তিনি এই শ্রমদিনকে সমাজের লক্ষ্য হিসেবে প্রস্তাবিত করেন এবং এর যৌক্তিকতা বোঝাতে স্লোগান গড়ে তোলেন, “আট ঘন্টা শ্রম, আট ঘন্টা বিনোদন, আট ঘন্টা বিশ্রাম।”
কিন্তু তখন নবোদ্ভূত শ্রমিকশ্রেণীর সচেতন শ্রেণী হয়ে ওঠা শুরু হয় নি। উৎপাদনের নতুন নতুন যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাগটা প্রকাশ পাচ্ছিল ভাঙচুরে, লুড্ডাইট আন্দোলনে এবং যেখানে সেখানে পূঁজিপতিদের বিরুদ্ধে ছোট খাটো হিংসা এমনকি সশস্ত্র বিদ্রোহের স্ফূরণে। সে সময় সংগঠিত হওয়ার আইনি অধিকারটুকুও তারা পায় নি। ইংলন্ডেও না আমেরিকাতেও না। আমেরিকার নাম নিলাম এজন্য বাঙালি পাঠকদের পড়ার জন্য একটা জনপ্রিয় গল্পের বই আছে, আর্থার কোনান ডয়েলের “ভ্যালি অফ ফিয়ার।” তাতে বিপরীত অর্থাৎ পাতি-বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা এক অসাধারণ বর্ণনা আছে আমেরিকার শ্রমিক অধ্যুষিত শিল্প অঞ্চলের।
ইংলন্ডে শ্রমিক শ্রেণীর প্রথম সংঘবদ্ধ আত্মপ্রকাশ চার্টিস্ট আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হয়। ১৮৩৫ সালের প্রথম চার্টারে যদিও দাবিগুলো শুধু রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে প্রসারিত করার দাবি ছিল, কিছুদিনের মধ্যেই শ্রেণীগত দাবিগুলো তাতে উঠে আসে। ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত “১৮৪৪ সালে ইংলন্ডে শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা” বইটিতে তরুণ ফ্রেডরিক এঙ্গেলস লিখছেন, “যেহেতু শ্রমিকেরা আইনকে সম্মান করে না, নিছক তার শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে কেননা বদলাতে তারা অক্ষম, খুব স্বাভাবিক যে তারা অন্ততঃ কিছু কিছু বদল প্রস্তাব করবে, চাইবে যে বুর্জোয়া আইনি বুনটের জায়গায় একটা সর্বহারা আইন আসুক। সেই প্রস্তাবিত আইন হল ‘পিপলস চার্টার’ [গণদাবিপত্র] যার রূপটা বিশুদ্ধভাবে রাজনৈতিক … । ইউনিয়নে এবং সমাবেশে বিরোধটা সব সময় বিছিন্ন ছিল একজন বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে একজন শ্রমিক বা তাদের একটি অংশ। যদি লড়াইটা সাধারণ হয়েও উঠত, সেটা শ্রমিকদের ইচ্ছেয় হত না। আর একান্তই যদি ইচ্ছেয় হত, তাহলে তার তলায় চার্টিজম থাকত। বস্তুতঃ চার্টিজমেই পুরো শ্রমিকশ্রেণি পূঁজিবাদিদের [‘বুর্জোয়াজি’ শব্দটার বাংলা করলাম] বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ায় এবং সবচেয়ে আগে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে আক্রমণ করে, সেই আইন-প্রণয়নকারি দুর্গপ্রাকারটাকে, যেটা দিয়ে পূঁজিবাদিরা নিজেদের চারদিকে ঘিরে রেখেছে। … চার্টিজম ১৮৩৫ সালে তার শুরুআত থেকেই প্রধানতঃ শ্রমিকশ্রেণির ভিতরকার আন্দোলন ছিল, যদিও স্পষ্টভাবে পূঁজিবাদিদের থেকে নিজেকে আলাদা করে নি।”
মার্ক্স আর এঙ্গেলসের প্রথম দেখা হয় ১৮৪২ সালে। কোলোনে, রাইনিশে জাইটুংএর দপ্তরে। বিশেষ কথাবার্তা হয় নি। তার পর যখন দেখা হওয়ার মত করে দেখা হয় প্যারিসে, ততদিনে মার্ক্সের হাতে ছিল “হেগেলের বিধিদর্শনের সমালোচনা”র পান্ডুলিপির পর “১৮৪৪এর আর্থিক ও দার্শনিক পান্ডুলিপি” যার প্রথমটি শুরুই হচ্ছে ‘শ্রমের মজুরি’ শিরোনামে একটি অধ্যায় দিয়ে। তাতে আলাদা করে শ্রমদিবসের প্রশ্ন সোজাসুজি উত্থাপিত হয় নি। বরং উনি লিখছেন, “না বললেও স্পষ্ট যে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র সর্বহারাকে, অর্থাৎ এমন একটি মানুষকে যার কাছে পূঁজি এবং ভাড়া না থাকার ফলে শুধু শ্রম দিয়ে জীবনধারণ করে, তাও একতরফা, বিমূর্ত শ্রম দিয়ে, শুধুই শ্রমিক মনে করে। রাজনৈতিক অর্থ শাস্ত্র তাই প্রস্তাব করতে পারে যে সর্বহারার, যে কোনো ঘোড়ার মত, সেটুকু পাওয়া উচিৎ যেটুকু তাকে কর্মক্ষম রাখতে পারে। যখন সে কাজ করে না, তখন, অর্থাৎ একজন মানুষ হিসেবে, রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র তাকে হিসেবের মধ্যে আনে না; ছেড়ে দেয় ফৌজদারি আইন, ডাক্তার, ধর্ম, পরিসংখ্যানের সারণী, রাজনীতি এবং দরিদ্র-ভবনের তত্ত্বাবধায়কের হাতে।”
অন্যদিকে এঙ্গেলসের হাতে সে সময় ছিল তাঁর সুবিখ্যাত কৃতি, “১৮৪৪ সালে ইংলন্ডে শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা”র খসড়া পান্ডুলিপি। যদিও তার আগে তাঁর একটি বড় লেখা “রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের সমালোচনার রূপরেখা” ড্যুশ ফ্রাঞ্জোইশ জাহ্রবুখেরে প্রকাশিত হয়েছে এবং মার্ক্স সে লেখা পড়েছেন (পরে বলেছেন যে ওই লেখাটিই তাঁকে অর্থশাস্ত্রের গভীর অধ্যয়নের দিকে টেনে নিয়ে গেছে; সব জায়গায় গুরুত্ব দিয়েছেন সে লেখাটিকে)। সে লেখায় শ্রম শিরোনামে একটি অনুচ্ছেদে আছে, “শ্রম – উৎপাদনের প্রধান কারক, “সম্পদের উৎস”, মুক্ত মানব সক্রিয়তা – অর্থশাস্ত্রীদের কাছে খারাপ অর্থে আসে।” এও আছে, “যদি ব্যক্তিগত সম্পত্তি শেষ করতে পারি তাহলে এই অস্বাভাবিক বিচ্ছেদ [পূঁজি আর শ্রমের, শ্রমের উৎপত্তি আর মজুরির] অদৃশ্য হয়ে যাবে …” ইত্যাদি। আর “১৮৪৪ সালে ইংলন্ডে শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা”তে?
চব্বিশ বছর বয়সে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ম্যাঞ্চেস্টারের শ্রমিকবস্তিতে ঘর নিয়ে থেকে, তথ্যাদি যোগাড় করে লেখেন তাঁর সুবিখ্যাত কৃতি, “১৮৪৪ সালে ইংলন্ডে শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা।” সে বইয়ে তিনি, ১৮৩৮ সালে দুই লক্ষ শ্রমিকের চার্টিস্ট জমায়েতে এক মেথডিস্ট পাদ্রির দেওয়া ভাষণ থেকে উদ্ধৃত করেন, “চার্টিজম এমন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয় বন্ধুগণ, যাতে আপনাদের ব্যালটের অধিকার পাওয়াটাই প্রধান উদ্দেশ্য হবে। চার্টিজম ছুরি আর কাঁটার [পেটের ভাতের অর্থে] প্রশ্ন; চার্টার মানে একটা ভালো বাসস্থান, ভালো আহার ও পান, উন্নতি এবং ছোট শ্রম-প্রহর।” [শব্দে জোর বর্তমান লেখকের] এঙ্গেলস তারপর নিজের ভাষ্যে ফিরে আসেন, “নতুন দরিদ্র আইনের বিরুদ্ধে এবং দশ ঘন্টার বিলের পক্ষে আন্দোলন আগে থেকেই চার্টিজমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতম ভাবে সম্পর্কিত ছিল।”
১৮৪৭ সালে ইংলন্ডের সংসদে কারখানা আইন প্রণীত হয়। বার বছর ধরে চলতে থাকা আন্দোলনের জন্য বিলটার চলতি নামই হয়ে গিয়েছিল ১০ ঘন্টার বিল এবং পরে, ১০ ঘন্টার আইন। এর আগে অব্দি শ্রমসময়ের প্রশ্ন এলেও। যে আইনগুলো প্রণীত হয়েছিল সেগুলো প্রধানতঃ শিশুশ্রম নিবারক ছিল এবং বয়স্কদের শ্রমসময় সম্পর্কে ধারা থাকলেও দেশের রাজনৈতিক অবস্থা এমনই ছিল যে সেগুলো বলবৎ করা যায় নি।
উনিশ বছর পর, ১৮৬৬ সালের আগস্ট মাসে, আমেরিকার বাল্টিমোরের ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। তাতে বলা হয়, “পূঁজিবাদি দাসত্ব থেকে শ্রমকে মুক্ত করার পথে বর্তমান সময়ের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ, এমন একটি আইন প্রণয়ন যার দ্বারা পুরো এমেরিকী সঙ্ঘের সবক’টি রাজ্যে স্বাভাবিক শ্রমদিন হবে আট ঘন্টা। সংকল্প নিচ্ছি, এই মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে আমরা আমাদের সর্বশক্তি নিয়োজিত করব।”
তার কিছুদিনের মধ্যেই, সেপ্টেম্বর ১৮৬৬র ৩ থেকে ৮ তারিখ অব্দি জেনেভায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ওয়র্কিংমেন্স এসোসিয়েশন (ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনাল) এর কংগ্রেসে আটঘন্টা শ্রমদিনের দাবি তোলা হল। ঘোষিত হল, “শ্রমদিনের আইনগত সীমিতকরণ প্রারম্ভিক শর্ত। এটি না হলে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থার উন্নতিসাধন এবং মুক্তির সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।” এবং, “শ্রমদিনের আইনগত সীমা আট ঘন্টা প্রস্তাব করছে কংগ্রেস।”
এটা সবাই জানে যে প্রথম আন্তর্জাতিকের দস্তাবেজগুলোর বেশির ভাগই মার্ক্স নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন অথবা তাঁর নির্দেশে তৈরি হয়েছিল। আগস্ট ১৮৬৬তে জেনেভা কংগ্রেসের প্রস্তুতি হিসেবে তিনি কিছু নোট তৈরি করেছিলেন। সেই নোটের একাংশ পাওয়া গিয়েছিল এবং পরে পল লাফার্গ সেই নোট ফরাসিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। ‘রোজকার দরকার’ শিরোনামে সেই নোটের ষষ্ঠ অংশের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ ছিল নিম্নরূপঃ
“শ্রমদিনের সীমিতকরণ
“আমাদের প্রস্তাবে শ্রমদিনের আইনগত সীমা হোক ৮ ঘন্টা। সাধারণভাবে এই সীমিতকরণ যুক্তরাজ্য আমেরিকার শ্রমজীবীদের দাবি, কংগ্রেসের ভোট দাবিটাকে সারা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণীর সর্বজনীন কর্মপন্থা করে তুলবে।”
এর পর, কেন এই দাবি জরুরি তা নিয়ে কিছু সাবধানবাণী এবং দাবীর কিছু বিশদ, যেমন টিফিনের সময়, রাতের ডিউটি, নারীদের শ্রমসময়, শিশুশ্রম ইত্যাদি নিয়ে কথা ছিল ওই নোটে।
১৮৬৭ সালে মার্ক্সের মহাগ্রন্থ ‘পূঁজি’র প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়। এগ্রন্থে শ্রম দিন নিয়ে পুরো একটি অধ্যায় (তৃতীয় ভাগের অধ্যায় সংখ্যা ১০) রয়েছে। সাতটা পরিচ্ছেদে শ্রমদিন কী, উদ্বৃত্ত মূল্য বৃদ্ধির জন্য পূঁজিপতির লালসা, তার বিভিন্ন উপায় এবং অপর দিকে ন্যায্য (ইংরেজি ‘নর্মাল’ শব্দটির অনুবাদ অনুবাদক পীযুষ দাশগুপ্ত ‘ন্যায্য’ করেছেন) শ্রমদিনের জয় শ্রমিকদের সংগ্রাম, ব্রিটেনে ও অন্যত্র কারখানা আইন প্রণয়নের ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছেন মার্ক্স। সেগুলো মূলত রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের দিক থেকে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। আট ঘন্টার জন্য লড়াই এই গ্রন্থ প্রকাশনের আগে শুরু হয়ে গেছে এবং মার্ক্স-এঙ্গেলস সে লড়াইয়ের সাংগঠনিক নেতৃত্বে রয়েছেন। তবু প্রথম পরিচ্ছেদের দুটো গুরুত্বপূর্ণ অংশ উদ্ধৃত করছি কেননা সূত্র হিসেবে এদুটো সব সময় মাথায় রাখতে হয়।
১ – “শ্রম-দিবস একটি স্থির রাশি নয় বরং একটি পরিবর্তনীয় রাশি। তার একটি অংশ নিশ্চয়ই নির্ধারিত হয় স্বয়ং শ্রমিকের শ্রম-শক্তির পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের দ্বারা। কিন্তু তার মোট পরিমাণ পরিবর্তিত হয় উদ্বৃত্ত-শ্রমের মেয়াদের সঙ্গে। সুতরাং শ্রম-দিবস নির্ধারণযোগ্য কিন্তু আপাততঃ অনির্ধারিত।”
২ – “দুটি সমান অধিকারের মধ্যে এই সংঘাত শক্তির দ্বারা মীমাংসিত হয়। এই কারণেই, যাকে বলা হয় শ্রম-দিবস, তার নির্ধারণের ঘটনাটি ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ইতিহাসে আত্মপ্রকাশ করে একটি সংগ্রামের পরিণতি হিসাবে – যৌথ মূলধন অর্থাৎ ধনিক-শ্রেণী এবং যৌথ শ্রম অর্থাৎ শ্রমিক-শ্রেণীর মধ্যে সংগ্রাম হিসাবে।”
প্রথম আন্তর্জাতিকে প্রস্তাব গৃহীত হলেও এবং সারা ইওরোপে, আমেরিকায় এবং রাশিয়ায় তার বার্তা ছড়িয়ে গেলেও কোথায় কোথায় কী কী কাজ হচ্ছে তার সবটা খবর তো আর সে সময় পৌঁছোত না। তার ওপর প্রথম আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যে ফ্রান্সে প্যারি কম্যুনের মত ঘটনা ঘটে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশের শাসকশ্রেণী প্রায় বিক্ষিপ্তের মত প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। প্রথম আন্তর্জাতিকের সবক’টি শাখার ওপর নেমে আসে শাসকশ্রেণী, পুলিস ও মিডিয়ার আক্রমণ। ১৮৮৩ সালে মার্ক্স মারা যান। মার্ক্সের মারা যাওয়ার পর এঙ্গেলসও নিজের বাকি সমস্ত কাজ সরিয়ে রেখে ‘পূঁজি’র দ্বিতীয় খন্ডের অন্তিম পান্ডুলিপি এবং প্রেসকপি তৈরি করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এক বছর তাতে লেগে যায়। তারপর শুরু করেন মার্ক্সের খসড়া মিলিয়ে মিলিয়ে পাঠোদ্ধার করে ‘পূঁজি’র তৃতীয় খন্ড নির্মাণের কাজ। তাতে দশ বছর লেগে যায়। তবু, তারই মধ্যে ১৮৮৬ সালের ২৯শে এপ্রিল আট ঘন্টা শ্রমদিনের লড়াই প্রসঙ্গে আমেরিকায় ফ্রেডরিক এডলফ সোর্জকে চিঠিতে লেখেন এঙ্গেলস, “এতদসত্ত্বেও আমেরিকায় জোর কদমে লড়াইটা এগিয়ে চলেছে। ইংরেজি-ভাষী জনতার মধ্যে প্রথমবার বাস্তবিক গণআন্দোলন শুরু হয়েছে। এটা অনিবার্য যে পথ না জানা থাকার কারণে খাপছাড়া ভাবে, আনাড়িভাবে সে আন্দোলনকে এগোতে হচ্ছে। সেসব ঠিক হয়ে যাবে। নিজের ভুল থেকে শিখে এ আন্দোলন অবশ্যই এগোবে। যুব জাতিগুলোর সাধারণ বিশেষত্ব তাত্ত্বিক অজ্ঞানতা, কিন্তু বেগবান ব্যবহারিক বিকাশও তাদের তেমনই সাধারণ বিশেষত্ব।” এবং দেখা করতে আসা সবাইকে, আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণী আর আটঘন্টার লড়াইয়ের কথা বলছেন। ভিতরে ভিতরে আনন্দিত হয়ে উঠছেন যে আন্তর্জাতিকে মার্ক্সের দেওয়া লাইন এগুচ্ছে পৃথিবীতে।
সে বছরই মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শিকাগোর হে-মার্কেটে ঐতিহাসিক ঘটনাবলি ঘটে যায়। হে-মার্কেটের ঘটনার পিছনে পুলিস ও ম্যাককর্মিক কারখানার মালিকদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কথা অনেক বছর অব্দি চাপা ছিল। সব জায়গায় এখবরটাই গিয়েছিল যে নৈরাজ্যবাদীরা বোমা ফেলেছে ইত্যাদি। কাজেই এঙ্গেলস নিজের দুশ্চিন্তার কথা লিখতে শুরু করেন। ১২ই মে, উইলিয়াম লিবনেখটকে লেখেন যে এমেরিকা এখন শিল্পোদ্যমী জাতি; অহেতুক উচ্ছৃংখলতার পথ থেকে তাদের সরে আসা উচিৎ। আবার ২২শে মে বার্নস্টাইনকে লিখছেন যে আমেরিকানদের ভুলটাও হয়ত লাভজনক হতে পারে; বেশি মজুরি এবং ছোট শ্রমদিন পেতে পারে তারা, কিন্তু তাদের ভাবনাচিন্তা পূঁজিবাদী। কাজেই চট করে জিত হয়ে গেলে তাদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়নবাদ অযৌক্তিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। এক মাস পর ৩রা জুন, এফ কেলি-উইশ্নেওয়েস্কিকেও একই কথা লিখছেন।
১৮৮৯ সালে প্যারিসে ইন্টারন্যাশন্যাল সোশ্যালিস্ট কংগ্রেস হয়। বলতে গেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে এঙ্গেলস ওই কংগ্রেসে মার্ক্সবাদপন্থী বা শ্রমিকবিপ্লবপন্থী বা শ্রেণীসমঝোতাবিরোধী শক্তিগুলোকে একজোট করে তাদের জন্য জায়গা তৈরি করেন। নিজে সে কংগ্রেসে যান নি কিন্তু লাফার্গ ও অন্যান্যদের নির্দেশ দিয়ে দিয়ে নিজেদের ভাবনাচিন্তাগুলোকে কংগ্রেসে প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই কংগ্রেসেই সিদ্ধান্ত হয় যে ১৮৮৬ সালে শিকাগোর ঘটনাবলীর স্মৃতিতে প্রতি বছর পয়লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উদযাপিত হবে।
১৬ই এপ্রিল ১৮৯০ এঙ্গেলস লরা লাফার্গকে লিখলেনঃ
“কংগ্রেসের সবচেয়ে ভালো ঘটনা হল পয়লা মে’র প্রস্তাব। … সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে ১৮৯০ সালের ১ মে, আট ঘন্টা শ্রম দিন এবং শ্রম-আইনের দাবিতে বিশ্বের সব দেশে বিক্ষোভ-প্রদর্শন এবং সভা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হবে।”
২
শিল্প-শ্রমিকের সংখ্যা ইংলন্ডে সে সময় অনেক। তাই কারখানা বা মিলের গেটে পিকেটিং ছাড়া লন্ডনের হাইড পার্কে বড় সভা ইত্যাদি রবিবারেই হত। ১৮৯০ সালের মে দিবসও তাই ৪ঠা মে তারিখে হবে স্থির হল।
এখানে একটা গল্প আছে। ইলিয়ানর (টুসি, মার্ক্সের ছোট মেয়ে) এবং তার স্বামী এডোয়ার্ড লন্ডনে গ্যাস ও অন্যান্য শ্রমিকদের মধ্যে লড়াকু ইউনিয়ন তৈরি করে সমাজবাদী প্রচারপ্রসারের কাজ করছিলেন। ইলিয়ানর তো এত জনপ্রিয় নেত্রী হয়ে উঠেছিলেন যে তাঁকে শ্রমিকেরা মা বলে সম্বোধন করতে শুরু করেছিল। এবার যখন সিদ্ধান্ত হল যে লন্ডনে মে দিবস এক তারিখে নয়, চার তারিখে বড় সভা করে হবে সে সিদ্ধান্তের বড় অংশীদার ছিল সংস্কারপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলো। তারা আগেভাগে পৌরসভার দপ্তরে গিয়ে বেশির ভাগ জায়গার দখল নিয়ে নিল। ওখানে, এবং আমেরিকাতেও তখন মঞ্চ গড়ে সভা হত না। বড় চাকাওয়ালা উঁচু টানা-গাড়ি থাকত, ওয়াগনকার্ট বলা হত, সেগুলো জায়গা মত দাঁড় করিয়ে দেওয়া হত। বেশির ভাগ জায়গা মানে, ওয়াগনকার্ট লাগানো সভাস্থল সংরক্ষিত করে নিল সংস্কারপন্থীরা। ইলিয়ানর এবং অন্যান্যদের নেতৃত্বে লড়াকু ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা গিয়ে দেখলেন সব আগেই সংরক্ষিত। অনেক ঝগড়াঝাঁটি হল। কিছু করার ছিল না। বাকি থাকা কিছুটা জায়গায় ওয়াগনকার্ট লাগানোর ব্যবস্থা করে তাঁরা নিজেদের নামে সংরক্ষিত করালেন। ৩০শে এপ্রিল ১৮৯০ এঙ্গেলস সোর্জকে লিখলেন, “একমাত্র টুসি আর এভেলিংএর দৌলতে আসছে রোববার, লন্ডনে আট ঘন্টা শ্রম-দিনের দাবীতে বিশাল প্রদর্শন-সমাবেশ হবে।”
৪ঠা মে সকাল থেকেই এঙ্গেলস আনন্দে মাতোয়ারা ছিলেন। মার্ক্সের স্বপ্ন সফল হচ্ছে। যে স্লোগান তাঁরা কম্যুনিস্ট লীগ গঠন করার সময় তৈরি করেছিলেন, ঘোষণাপত্রের মাথায় যে স্লোগান লেখা হল, “দুনিয়ার শ্রমিক এক হও!” – আট ঘন্টা শ্রম-দিনের দাবীতে পয়লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উদযাপনের মধ্যে দিয়ে সে স্লোগান প্রথম রূপায়িত হচ্ছে। সভায় যাওয়ার জন্য অনেক আগে থেকেই তৈরি হলেন। বরং ওনার মুখেই শুনি সেদিনকার কথা। ৯ই মে অগাস্ট বেবেলকে উনি লিখলেনঃ
“পূঁজিবাদী প্রেসকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে এখানে ৪ঠা মে’র প্রদর্শন একেবারে অভিভূত করে দেওয়ার মত ছিল। আমি ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে (একটা ভারি মালগাড়ি) ছিলাম এবং ভীড়ের মাত্র একটা অংশই – পাঁচ ভাগের বা ধর আট ভাগের এক ভাগ – দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু যদ্দূর চোখ যাচ্ছিল, এক বিশাল সমুদ্র ছিল মানুষের মুখের। আড়াই লক্ষ থেকে তিন লক্ষ লোক, তার চার ভাগের তিন ভাগই প্রদর্শনকারী শ্রমিক। এভেলিং, লাফার্গ আর স্তেপন্যাক আমার প্ল্যাটফর্ম থেকে বলল। আমি নিজে শুধু দর্শক ছিলাম। লাফার্গ, ফরাসি ধাঁচে বলা তার সুন্দর ইংরেজি আর দখিনা উদ্দীপনার জন্য প্রচুর তালি কুড়োল। তালি কুড়োল স্তেপন্যাকও। ওদিকে এডকে, যে টুসির প্ল্যাটফর্মে ছিল দারুণভাবে স্বাগত জানাল জমায়েত।
“সাতটা প্ল্যাটফর্মের প্রত্যেকটা একে অন্যের থেকে ১৫০ মিটার দূরত্বে ছিল। শেষেরগুলো পার্কের কিনার থেকে ১৫০ মিটার জায়গা ছেড়ে ছল। কাজেই আমাদের সভার (আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন করে আট ঘন্টার শ্রম-দিন বলবৎ করার পক্ষে) মোট জায়গা ছিল লম্বায় ১২০০ মিটার আর চওড়ায় ৪০০-৫০০ মিটার। পুরো জায়গাটা ঠাসাঠাসিভাবে ভরা ছিল। তার পরে ছিল ট্রেডস কাউন্সিলের ছ’টা প্ল্যাটফর্ম আর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশনের দুটো প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু শ্রোতাদের সংখ্যা আমাদের আদ্ধেকও ছিল না।
“সব কথার শেষ কথা, এখানে আজ অব্দি আয়োজিত সবচেয়ে বড় সভা ছিল এটা। তার ওপর, বিশেষ করে আমাদের বিরাট জয় নিহিত ছিল এ সভায়। তুমি ভোক্সব্লাটএ এডের রিপোর্টে পড়ে থাকবে। ট্রেডস কাউন্সিল আর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশন ভেবেছিল এদিন আমাদের পার্ক থেকে বাইরে রাখবে, করেও ফেলেছিল তেমনটাই। কিন্তু তারা ধোঁকা খেয়ে গেল। এভেলিং কমিশনার অফ পাব্লিক ওয়র্ক্সকে বাধ্য করল আমাদেরকেও সাতটা প্ল্যাটফর্ম দিতে। যদিও সেটা নিয়মবিরুদ্ধ। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ টোরিরা ক্ষমতায় ছিল এবং এভেলিং ওদের ভয় দেখাতে সফল হল যে জায়গা না দিলে আমাদের লোকেরা অন্যদের প্ল্যাটফর্মে জবরদস্তি ঢুকে পড়বে। আর শেষ অব্দি, আমাদের সভাটাই হল সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে সংগঠিত আর সবচেয়ে বেশি উৎসাহে ভরা। জমায়েতের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আট ঘন্টার শ্রমদিনের পক্ষে। এভেলিং, এবং তার থেকেও বেশি টুসি পুরো ব্যাপারটা সংগঠিত করেছে। আন্দোলনে ওদের জায়গা এখন আগের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। গ্যাসশ্রমিক এবং সাধারণ শ্রমিকদের ইউনিয়ন, নতুন ধরণের কাজের শ্রমসঙ্ঘগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো। ওরা এ দুজনকে সমর্থন করে এবং ওদের ছাড়া আজকের ব্যাপারটা হত না। এবার আমাদের দায়িত্ব হবে আমাদের আজকের সভা সংগঠিত করা কমিটিটাকে – ট্রেড ইউনিয়ন এবং র্যাডিক্যাল ও সোশ্যালিস্ট ক্লাবের প্রতিনিধিদের – একজোট রাখা এবং এদেরকে নিয়েই এখানে আন্দোলনের কেন্দ্র গড়ে তোলা।”
চিঠির শেষে লিখলেন, “মার্ক্সকে এই জাগরণ দেখাতে আমি আমার সমস্ত কিছু ত্যাগ করতে পারতাম! … ওই পুরোন মালগাড়িটা থেকে নামার সময় আমার মাথা দু’ইঞ্চি উঁচু হয়ে গিয়েছিল।”
৪ঠা মে’র প্রদর্শন নিয়ে এঙ্গেলস একটি রিপোর্ট লিখলেন আর্বেইটার জাইটুংএ। প্রথমেই লিখলেন, "মে দিবসের আয়োজন করে সর্বহারা এক নতুন যুগের নির্মাণ করেছে। শুধু এ কারণে নয় যে এ দিনটার চরিত্র বিশ্বজনীন। এ কারণেও শুধু নয় যে এই আয়োজন লড়াকু শ্রমিক শ্রেণীর প্রথম আন্তর্জাতিক সক্রিয়তা ছিল। বরং এ কারণে যে বিভিন্ন দেশকে এক এক করে দেখলে বোঝা যায় [মে দিবসের আয়োজন সেখানকার শ্রমিক আন্দোলনে] গুরুত্বপূর্ণ প্রগতিকে চিহ্নিত করছে।”
তার পরের বছর মে দিবস হয়েছিল ৩রা মে। এঙ্গেলস গিয়েছিলেন। তাঁকে জার্মান খবরের কাগজ নিউ জেইট-এর প্রতিনিধি হিসেবে প্রেসকার্ড দিয়ে মঞ্চে বসান হয়েছিল। প্রেসকার্ডটা এখনো সংরক্ষিত রয়েছে। ওপরে লেখা আছে, “লিগাল এইট আওয়ার্স ডেমন্সট্রেশন, হাইড পার্ক, মে ৩র্ড, ১৮৯১।” নিচে জর্জ শিপটন এবং এডোয়ার্ড এভেলিংএর স্বাক্ষর।
১৬.১১.২০২২
No comments:
Post a Comment