Tuesday, November 23, 2021

সাইকেল - রবীন দত্ত

এখন আমি আপনাদের সাইকেলের কথা বলব,
নেহাতই মামুলি সাইকেলের কথা ভাইসব!
সেই সাইকেল যার গতি বা গতরে নেই আভিজাত্য,
নেই জৌলুষ, নেই কোনও কুলুজি বা আত্মম্ভরিতার
দাম্ভিকভাব !!
যে যানটি উদ্ভাবন থেকে এখনও ছিমছাম
আবর্তনে বন্‌বন করে ঘুরে যাওয়া দুটো চাকা,
ধাতব ফাঁকা টিউবের শরীর, লোহার চেন, আর হ্যাঁ
বসার জন্য চামড়ার সীট একটা; ব্যাস, ঝাঁ চকচকে
গাড়ী তৈরী, ভাইসব, আসুন, বসুন, পিছুটান ভাবনা ভুলে,
সিটি মারতে মারতে চলে যান সামনের রাস্তা ধরে
নিকট কিম্বা দূর !!
কিন্তু আমি জানি, এবং মুখ দেখেই বুঝতে পারছি
ব্যাপারটা আপনাদের আদপে পছন্দ নয়, বাস, ট্যাক্সি,
ট্রাম, মেট্রোরেল, ভলভো বা এস্ট্রা ওপেলের পাশে
ছন্দপতনের মতন পছন্দ হচ্ছে না দূরন্ত এ শব্দভেদী
গতির যুগে যুগপৎ মন্দগতি এই মামুলি ছ্যাঁকড়া
সাইকেলের কথা !!

যখন ইদানিং তূর্যনিনাদ কংকর্ড, বোয়িং, হোভার ক্র্যাফট
বা দূর্দ্দান্ত ভয়েজার, একদা-অনন্ত অন্তরীক্ষ ও
মহাশূণ্য মেপে শূণ্যে ফেলে দিচ্ছে প্রতিদিন;
যখন গতির প্রচন্ড দাপট, সপাটে জলস্থল,
আভূমি হিমালয়কে ঘাড়ে ধরে পাশাপাশি এনে
দূরকে করে ফেলছে নিকট, তখন আমার একান্ত
আপন ভাইসব, আপনারা কেন শুনবেন মামুলি
এই সাইকেলের কথা ?

আমি জানি, দুয়ে দুয়ে চারের মতন আপনাদের
আকাট যুক্তির খন্ডন, কি দারুণ কঠিন, কিন্তু তবু
একটু ভাববেন দুটো দুর্বল হাড় হাভাতে দুই মিলে
পুরো চার হতে পারে না, যেমন ক্ষণজন্মা কিছু
লোক একাই একশোর মতন এসব আপনারা
ভালোই জানেন আমি শুধু ঝালিয়ে দিলাম !!

আমি জানি, আপনারাও দেখুন প্রগতিবাদী
গতিভক্তেরা মুখ চাওয়াচায়ি করে বিভক্ত
হয়ে গেলেন ভাইসব আপনি, আপনি,
আপনি এবং আপনিও !! তাইলেই বুঝুন
কেন আমি ধীরগতি মামুলি সাইকেলের
কথা বলবো

কারণ, ধুন্ধুমার গতির এই গতিময় যুগে
যুগপৎ গতির এখন চরম দুর্গতি এবং
পরম বৈপরীত্যের এই যুগে গতির সঙ্গে
বেগতিক এক অবস্থা ব্যাবস্থায় অনাস্থা এনে
রাস্তা মাপছে চল্লিশ হাত অন্তর হাম্প, বাম্প,
বা স্পীডব্রেকারে !!

গতির মেলগাড়ি অগতির মালগাড়িতে সেঁধিয়ে,
বেসামাল ঝারসুগোড়ায় কিম্বা বাত্তিকালোয়ায়,
যাত্রীসাধারণের যতিসাধনে ব্রতী হচ্ছে অনন্তর;

কিম্বা, আরো গতিশীল বিমান বা অন্তরীক্ষযান
টুপটাপ খসে পড়লে ভালো করে লক্ষ্য করবেন,
বিবদমান ইউক্রেনিয়ান বাইলোরুশ, প্যালেস্টিনীয়
ইজরায়েলী, রুশ, আমেরিকান, বা নেহাতই পাতি
পাকিস্তানি হিন্দুস্তানী যাত্রীগণ কিরকম জড়াজড়ি
করে তালেগোলে জাতি-সমস্যার আন্তর্জাতিক সমাধান
করে নিচ্ছেন গতিপ্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে, ভাইসব !!

এখন এই দারুণ সুসময়ে আমরা হিঁদী ও আমাদের
দেশ হিঁদোস্তান সপ্রমাণে মনের আনন্দে স্রেফ
সাইকেল চালানোও, আহা কি আনন্দের, তাই না ?
এখন ঐ ডি.ডি. ও টিভির যুগপৎ সংক্রমণে
বুদ্ধিজীবিদের মেট্রো চ্যানেলে, স্নায়ু ও শীষ্ণদেশের
নিয়ত চাগাড়ে, খবরের ভাগাড়ে ব্যবস্থার
থাম্‌স আপ, তুফানি ডান্ডা ভারতের রাজ্যে রাজ্যে
জলকামান, কাঁদানে গ্যাস ও বুলেট ১৪৪ ভান্ডাফোড়
রলে সংবিধান ও সি.আর.পি.সি.র শক্ত হাতে
ধরা রক্তধারায়, বাঁশের ব্যালান্সে সোজা সাইকেল
চালিয়ে দেখবেন লাশঘরে আঃ কি ঠান্ডা, কি মজা !!

কিম্বা ঐ এহি হ্যায় রাইট চয়েস বেবে এবং
আহাঃ ওই উদোম-কামদো চিত্ত-জড় বেবীদের
স্ট্রীটক্যাট সাইকেলে চড়লেই দেখতে পাবেন
রাষ্ট্রশক্তির বুমবুম শ্যাকাল্যাকা বুমবুম বোমার
ধোঁয়ায় হাড়কাটা গলি থেকে ট্যাংড়া, মেটিয়াব্রুজ
বা অক্রুর দত্ত লেন থেকে রাষ্ট্রপিতার ক্রূর শ্যেণদৃষ্টি,
বাবরি মস্তক এবং ইস্তক কপালের জয় শ্রীরাম টীকা
ও অনতিদূরের মিলিটারি অপারেশন বজরং পর্য্যন্ত !!

আর ঐ আহা-উহু-ইয়াহুর ফুরফুরে বি.এস.এ.
ইলু, সাইকেলে, আই লাভ ইয় বলতে বলতে
আই.এস.এফ,, আর.সি.এফ., আর.এ.এফ.,
শিবসেনা, কমান্ডো, ভূমিসেনা, মায় ব্যবস্থার
মানবশৃংখল, ধর্মনিরপেক্ষ মধ্য, দক্ষিণ, আবাম
সুপারহিট সিটিবাইকে শ্রমজীবিদের সুপারহাইক
করে যাচ্ছে ডিংডং দাঙ্গার কিংকং অগ্নিযুগে, ভাইসব !!

এবং এই কলিউশ্যন, পলিউশ্যন, ইলিউশ্যন এর
গতিময় শ্যন শ্যন শব্দ, শনৈঃ শনৈঃ আরো,
বহুবিধ সাইকেল বিপরীত বদ্ধতায় ফেলে দিচ্ছে, ভাইসব ।

এখন এই বিত্তব্যাবস্থার ক্যাশ সাইকেল, মুদ্রা-মাল-মুদ্রার
মনমোহন খোলাবাজারে মালামাল হতে গিয়ে,
বেগতিক ক্র্যাশ-সাইকেলে ফেঁসে যাচ্ছে বারবার !!

এখন ঐ ধনবর্দ্ধন মধ্যবিত্তের, হর্ষবর্দ্ধন ফাটকার
ক্রমবর্দ্ধমান সাইকেল শেয়ারের ষাঁড়ের ধাক্কায়
ভোগ, সুখ ও হার্টের অসুখে টেঁসে যাচ্ছে বেবাগ্‌ !!

এখন ঐ আবহাওয়ার অম্লযান সাইকেল ডিজেলে,
পেট্রোলে, কাটা ও গোটা তেলে, যবক্ষার-এর যৌগিকে
কার্বন-সাইকেলের পর্দা ফাঁসিয়ে দিচ্ছে বারবার !!

এখন ঐ দ্যুতিময় গতির এমনি অবস্থা যে
ব্যবস্থার ভেতরঘরে, ভাইসব, এসেছে নধর সুখী
সাইকেল, বাবু ও বিবিদের তেল ঝরার কাজে

যা বহুক্ষণ চালালেও এত্তোটুকুন চলে না,
যার বাঁকানো হাতল ঘুরিয়ে নৌকোর দাঁড় বাওয়ার,
দাঁড়ের প্যাডেল ঘুরিয়ে ঘামের দাম পাওয়ার,
গতরের চর্বি গলিয়ে কোমরের ঢাল বাড়ার
এবং শেষমেশ মনের বেদম দোটানায় শমেদম
রক্তের গুণটানার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে আকছার !!

আর ঐ বেকার পরজীবি আজব সাইকেলের বিপরীতে
রয়েছে সারিসারি হাড্ডিসার মেহনতী সাইকেল
যা দিনরাত একাকার করে কাজে ভরে গায়েগতরে,
বাঁচিয়ে রেখেছে গাঁঘর, শহরতলি, মহানগর ও বন্দর !!

আছে, উধাওরাতের খবরভরা কাগজভরা
                   ফুর্তিবাজ, ঝড়ঝড়ে সাইকেল
আছে, ভোরের আলোর দুধের ভারে দোরেদোরে
                   ঘুরে যাওয়া ঢক্‌ঢকে সাইকেল

আছে, সকালবেলার টিনের পেটির দরাজহাঁকা
                   ডবলরুটির নড়বড়ে সাইকেল
 
আছে, দুপুরবেলার সেইসব সাইকেল
          যা পুরানো কাগজ, শিশি-বোতল, প্লাস্টিক
                   বা জঞ্জাল রিসাইকেলে দুষণের হাওয়া
                             বদলে দিতে চাইছে সুষম আবহাওয়ায়;

আছে, রিক্সার তিনচাকা সাইকেল
          যা কোল্‌জের হাপরে সাঁইসাঁই শব্দ তুলে
                   বাউ, বিবি, দাদা, দিদিদের পৌঁছে দিচ্ছে
                             গলি থেকে গতিময় বড় রাস্তায়;

আছে, চোরাচালের বেদমভারী বস্তাবওয়া
গভীর রাতের কঙ্কালসার সাইকেল
আছে আরো অনেকরকম, ভাইসব,
                                      কিন্তু থাক্‌
 
আমি শেষমেশ, সেই দুঃখী সাইকেলের কথা বলব
যা গ্রামেগঞ্জে শহরের পার্কে পার্কে লাগাতার,
একশো আটাত্তর, একশো চুরাশি বা একশো নব্বই ঘন্টা

চালিয়েও বেগতিক শুষে নেওয়া ঘাম, ঘুম ও শ্রমের
পর দিব্যি বুক, পেট, মগজ খালি রেখে নিরন্তর
ভাত ও ভূত হয়ে যাওয়ার সূক্ষ্ম ব্যালান্সেও
ফ্রিলান্স নাগরিক হয়ে বেঁচে থাক্‌তে সক্ষম !!!

                   অতঃপর,
বিশাল প্রাচুর্যের মধ্যে নিদারুণ অনটনের
এই সাইকেলটাও, দেখতে ভুলবেন না, ভাইসব !!!
 
৩.১০.১৯৯২    



No comments:

Post a Comment