মায়ের ছবিটা বাঁধিয়ে নিয়ে এসেছে ভাই।
ফ্ল্যাটে ঢুকে প্যাসেজটা পেরিয়ে প্রথমে বাঁদিকে
খাওয়ার টেবিল, চেয়ার। ডানদিকে বসার ঘরের দরজা। প্রথম নজরটা বসার ঘরের দেয়ালে পড়ে
না। বাঁদিকের জায়গাটা যেহেতু খোলা, সেদিকেরই দেয়ালে পড়ে।
এ বিষয়ে ভাই বোন এক মত হল। ভাই একটা পেরেক
আর হাতুড়ি নিয়ে উঠল খাওয়ার টেবিলের ওপর। রুমু একবার দেখে নিল, ‘নাঃ, নড়বড়ে নয়, ধরার দরকার
নেই, পড়বে না’। তারপর
বসার ঘরের সোফায় ফিরে খবরের কাগজটা হাতে নিল। যে বিজ্ঞাপনটা কলমের দাগ দিয়ে ঘিরবে ভেবেছিল
সেটা খুঁজল আবার। ঘিরল। সোফার ডানদিকে ঘেষটে গিয়ে টেলিফোনটাকে নাগালে নিল। ডায়াল
করল বিজ্ঞাপনের নম্বরটা।
“তোর মা
মরার আগে তোর বিয়ের সমস্ত কিছু ঠিক করে দিয়ে গেছে। এক বছর পরের যে প্রথম লগ্নটা ঠাকুর
মশাই বলবেন, সেদিনই তোর বিয়ে দেব ভেবেছিলাম” রুমুর ছোটোমামা রাগত স্বরে বলছিলেন, “তোর বাবার সাথে সমস্ত কথা
হয়ে আছে – হল, রান্নার
লোক সবকিছুর জন্য প্রাথমিকভাবে কথা
বলা হয়ে গেছে – আর এখন তুই নিজের বাবার বিয়ে নিয়ে পড়েছিস! আশ্চর্য! আর
রমেনদারও বলিহারি। দ্বিতীয়, তৃতীয় বিয়ে কি লোকে আজ থেকে করছে? কর! একা থাকার বিরাট
অসুবিধে এই বয়সে, আমরা বুঝিনা? কোনো ভালো পরিবারের মেয়ে দ্যাখ যার বিয়ে হয় নি,
পারিবারিক অসুবিধেয় ... হাজারে হাজারে মেয়ে পাবি তেমন ... না, সমবয়সী চাই, বিধবা
চাই, সঙ্গে তার সন্তান থাকলে আরো ভালো ... সব
সমাজ-সংস্কারক এখানেই জুটেছে। ...
“পঞ্চাশের
কাছাকাছি বয়স হল লোকটার! তুই আছিস। বাবু আছে।... তোর কি বুদ্ধি লোপ পেয়েছে?... কে
আসবে, তোদের প্রতি তার কী এ্যাটিচ্যুড হবে... শান্তির সংসারে নিজে যেচে কেউ আগুন লাগানোর
...”
“তোমাদের থেকে
অনেক অনেক বেশি আমি আমার বাবাকে চিনি”, রুমু নিজের ব্যাগটা চেয়ারের
পিঠে ঝুলিয়ে পাখাটা চালালো। তারপর এসে বসল, “এত গরম! পাখা না চালিয়ে বসে থাকো
কী করে? ...উনি তো কিছু বলবেন না। সব সময় ঠান্ডা মাথা, সব সময় হাসিমুখ, সব সময়
হাতে কাজের নোটবুক। আমি জানি কতদূর একা হয়ে গেছে ভিতরে ভিতরে মানুষটা। এরপর আমি
চলে যাব। বাবু থাকবে নিজের চাকরির জায়গায়। বাবার সাথে থাকবে কে? ওই নোটবুক? ও আমি
হতে দেব না। বলার সময় বড় বড় কথা বলবে তোমরা, লাইফ কত এডভান্সড হয়ে গেছে আর একটা
একা হয়ে যাওয়া মানুষের আবার বিয়ের কথা উঠলে তোমাদের মনে হচ্ছে ঘরে আগুন লাগার কথা?
লাগলে লাগবে। আমাকে সেই নতুন মা না দেখতে চাইলে দেখবে না! বাবুকে দেখবে না! আমরা
কেউই তো আর সাথে থাকতে যাচ্ছি না। বাবাকে দেখলেই হল। ... এই বিয়ে আগে হবে, তারপর
আমি বিয়ে করব।”
রুমুর মামার বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়।
হেঁটেও যাওয়া আসা যায়। কিন্তু ও পারেনা। বিশেষ করে এই শ্রাবণের দমবন্ধ রোদে তো একেবারেই
নয়। রিক্সাওয়ালা বেশি পয়সা চাইছিল। তাই মিটিয়ে ও বাকি পয়সা ফেরত নেওয়ার জন্য হাত
পেতে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখটা ছিল মামার বাড়ির পরের বাড়িটার দিকে। ওটা অপর্ণাদের বাড়ি।
অপর্ণা বিয়ের পর আসানসোলে। তবু আশা নিয়ে তাকিয়েছিল যদি এসে থাকে কোনো কারণে। আর,
দ্যাখো কান্ড! ওই তো অপর্ণা!
- কবে এলি? জানাস নি তো!
- আজকেই তো এলাম সকালে। হঠাৎ।
- আসছি আমি। আগে মামাদের সাথে দেখা করে নিই।... যাবি না তো কোথাও?
কথা আছে।
- আয় না।
মামাদের বাড়িতে কাজ সেরে অপর্ণাদের বাড়িতে
ঢুকল রুমু। অপর্ণাদের বাড়িতেও অপর্ণা না থাকলে এখন শুধু ওর মা, একা। বাবা মারা গেছেন
বেশ কয়েক বছর হল। তবু এত কাছে থাকা মানুষদের নিয়ে চিন্তা করার সাহস হয় নি রুমুর। তাছাড়া
মাসিমার বয়সও বাবার থেকে বেশি। শরীরটাও অসুস্থ থাকে আজকাল। অথচ অপর্ণা চলে গেলে তাঁরও
তো সারাটা দিনরাত একা। অপর্ণা ভাবে নি কখনো? রুমু জিজ্ঞেসও করেনি কথাটা।
- বললি, কথা আছে!
- বলছি, আগে বল, তুই হঠাৎ এলি কেন? সব ঠিক আছে তো?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ। আরে, বাবার পেনশন, মানে ফ্যামিলি পেনশনের
কাগজটা ট্রেজারিতে জমা দিতে হবে। বছরকার লাইফ সার্টিফিকেট তো মা একাই গিয়ে দিয়ে
আসে। পাড়ার একজন রিক্সাওয়ালা আছে, সেই নিয়ে যায়। কিন্তু এটা অন্যধরণের কাজ। তাই
দুদিনের জন্য আসা ... (রুমুর দিকটা শোনার জন্য উৎসুক ভাবে তাকালো অপর্ণা)
- আসানসোলে রাধানগর নামে কোনো জায়গা আছে?
- হ্যাঁ, আছেই তো। কেন?
- তুই গেছিস ওদিকে?
- নাঃ।
- আচ্ছা, তুই ফিরবি কবে?
- পরশু।
- ঠিক আছে। দেখা হবে তোর সাথে। আসছি আমি।
- মানে? কেন?
- (চকিতে অপর্ণার মায়ের দিকে চেয়ে নিল রুমু) বলব, পরে। এখন আসি।
কেন
যে অপর্ণাকে রাধানগর জিজ্ঞেস করেছিল। একঘন্টা ধরে রিক্সাটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে রুমু টের
পেল, দোমোহানি বাজারের সাথে রাধানগরের কোনো সম্পর্কই নেই। বিজ্ঞাপনেও লেখা ছিল না, ফোনে যখন কথা হয়েছিল
পাত্রীপক্ষও রাধানগরের নাম নেয় নি। কিন্তু কিভাবে জানি ওর মাথায় ঢুকে গিয়েছিল রাধানগর।
বাগানওয়ালা একতলা পুরোনো বাড়ি। আগের দোকানটায়
জিজ্ঞেস করে নিশ্চিন্ত হল রুমু, তারপর রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে গেট খুলে ভিতরে ঢুকল।
মোটামুটি তাদেরই মত, একই আর্থিক সঙ্গতির পরিবার
মনে হল। বাড়ির মেয়ে বিধবা হওয়ার পর ছেলেকে নিয়ে ফিরে এসেছে, সেটা একটা বাড়তি আর্থিক
এবং মানসিক চাপ।
- পাত্র, মানে রমেনবাবু নিজে একবার আসবেন না?
- আসবে। নিশ্চয়ই আসবে। তবে, এটা তো সেই বিলিতি টাইপের, কোনো রেস্টুরেন্টে
বয়স্ক পাত্র আর পাত্রীর নিজেদের মধ্যে দেখাসাক্ষাতের ব্যাপার নয়! পারিবারিক ব্যাপার।
আর বাবার পরিবার বলতে তো এখন আমি আর আমার ভাই। তাই প্রাথমিকভাবে আমরা দুজনেই আসতে পারতাম।
কিন্তু … ও এসব ব্যাপারে
লাজুক … লাজুকই বা কেন বলি
… একটু … মানে, ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি বাবার জীবনের
শূণ্যতাটা। ছেলেরা তো কিছুটা এইরকমই!
বলে, সামনে বসে থাকা পাত্রীর দিকে তাকিয়ে হেসে,
সম্মতি নিতে চাইল রুমু। পাত্রী, সুলগ্না দেব (আগের বৈবাহিকে রায়) আড়ষ্টভাবে চোখ নামাল।
এর বেশি সম্মতি জানানর মত অবস্থায় সে ছিল না।
- আপনার ছেলে কই?
“ওই তো ও ঘরে হোমটাস্ক
করছে”, সুলগ্নার মা বললেন,
“সুলগ্নাই করিয়ে দিচ্ছিল
এতক্ষণ।”
- ওকে ডাকুন একটু, দেখি! বন্ধুত্ব করি! ও তো আমার ভাই হবে!
রাস্তায় বেরিয়ে রিকশাস্ট্যান্ড অব্দি হেঁটে
যাওয়ার ছিল। যদিও সুলগ্নার বাবা বলেছিলেন রিকশা ডেকে দেওয়ার কথা। কিন্তু রুমু রাজ হয়নি,
“এইটুকু তো রাস্তা!
হেঁটে গল্প করতে করতে যাব। কী সায়ন? পৌঁছে দেবে না আমায়?”
কান টানলে মাথা আসে কিনা দেখার ছিল। তাই হল।
ছেলের সাথে মা, সুলগ্নাও সঙ্গী হল। ভালো লাগল রুমুর এই সপ্রতিভতা। রোদ্দুরে আড়চোখে
ঝটিতি একবার তাকাল সুলগ্নার মুখের দিকে। মোটামুটি উনচল্লিশ, চল্লিশ মত বয়স হবে। বাবার
বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। খুব বেমানান হবে না। আর ছেলেটাকে পেয়ে তো বাবা আহ্লাদে আটখানা
হবে। এত ভালোবাসে বাচ্চা। অথচ আমরা তো আর বাচ্চা নই।
রিকশাস্ট্যান্ড অব্দি পথটুকু সুলগ্নার সাথে
কথা বলতে বলতে ভালোই কাটল। একটু এড়িয়ে চলছিল সম্বোধনটা, কেননা সুলগ্না তো আর বলা যায়
না! আর যাকে কাল মা বলবে (যদি বলতে হয়, বাবা এসে দেখে যাওয়ার পর ফাইন্যাল হবে) তাকে
এখন দিদি বলতে কেমন যেন লাগবে! … তবুও মুখ ফস্কে একবার বেরুলো “দিদি”।
- সরি!
- সরি কেন?
- না, এমনিই… মানে …
এবার সুলগ্না হাসল, প্রথমবার, মন খুলে। ভালো
লাগল হাসি মুখ। নইলে চোখের নিচে কালির দাগটা বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছিল বাপের বাড়িতে, পাড়ায়
একা জীবন কাটানোর সমস্যাগুলো। ভালো লাগল কথাটাও।
- তোমার মা না হতে পারলে কি দিদিও থাকব না?
- তুমি যে স্কুলের কাজটা ধরেছ সেটা তো ছাড়তে হবে।
- সেটা এমনিতেও ছাড়তে হবে ছেলে আরেকটু বড় হলে। নাইনের পর তো পড়াটা
শক্ত করে ধরতে হবে। আর কোনো এমন সরকারি চাকরিও নয়।
বিয়েটা হয়েই গেল। আসানসোলেই হল রেজিস্ট্রেশন।
একমাত্র রুমু আর রুমুর বাবা ছাড়া বিয়েতে যারা এসেছিল কলকাতা থেকেই এসেছিল।
রুমু ভাইকে আর ছোটমামাকে পই পই করে বলে গিয়েছিল
কাকে কাকে ডেকে রাখতেই হবে বাড়িতে যাতে ওদের বাড়ি ফেরার সময় কিছু লোকজন থাকে। বাবার
আগের পক্ষের মানে রুমুর মায়ের বাড়ি থেকে এক তার ছোটমামা আর মাসি ছাড়া আর কেউ আসার নেই।
বাবার দু’একজন বন্ধুবান্ধব
যাদের রুমু চিনত, তাদেরও বলা হয়েছিল। আশেপাশের ফ্ল্যাটের মহিলারা, বাঙালি-অবাঙালি,
তারাও কয়েকজন ছিলেন।
স্টেশনে নেমে বাবা আর নতুন মা সামনের রিকশায়
উঠল। পিছনের রিকশায় রুমু আর সায়ন। রিকশা বাড়ির কাছে পৌঁছোতেই সায়নের হাত ধরে লাফিয়ে
নামল রুমু। বাবাকে আর নতুন মাকে শাসাতে শাসাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল, “ধীরে সুস্থে এস!” ওপরে তিনতলার দিকে তাকিয়ে হাঁক দিল, “ছোটমামা! বরণডালা কে রেডি করছে?” শুনতে পেল, “আয় না তোরা! সব রেডি আছে। বাবাঃ, মেয়ে না যেন
পাগলা ঘোড়া!”
ততক্ষণে সায়নের হাত ধরে ওপরে উঠে এসেছে রুমু,
“কই শাঁখ কই? কে বাজাচ্ছে?” সত্যিই কেউ ছিল না। বরণডালাটা মনে হয় ছোটমামাই
সাজিয়ে লিপির (ভাইয়ের হবু বৌ) হাতে দিয়েছিল। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে রুমু বুঝতে পারল সবাই
একটু ইতস্ততঃ ভাবে রয়েছে। এসেছে বটে, সামাজিকতার খাতিরে, কিন্তু এর বেশি কী করা উচিৎ
তারা বুঝে উঠতে পারছে না।
রুমুই শাঁখটা নিয়ে বাজান শুরু করল। তারই মধ্যে
উঠে এল তার বাবা আর নতুন মা। সুলগ্নাকে দাঁড় করিয়ে রুমু বরণডালা হাতে নিয়ে প্রথা মত
বরণ করল। “কেউ উলু দেওয়ার নেই” বলতে বলতে সাকুল্যে একটা ক্ষীণ উলুর আওয়াজ
ভেসে এল পিছন থেকে। রুমু অবাক হয়ে দেখল অপর্ণা। “নাঃ, ও তো দিচ্ছে না উলু! কে?”
বাবা আর নতুন মা সায়নকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেছে।
ভীড়ের মধ্যেই ভাইকে মনে করিয়ে দিল রুমু, “প্যাকেট এনে রেখেছিস? মিষ্টির? সবাইকে দে হাতে হাতে। লিপিকে সঙ্গে
নিয়ে নে!”
ওদিকে অপর্ণাকে দেখে এগিয়ে গেল। “তুই কি করে এলি? তুই তো ফিরে গিয়েছিলি আসানসোলে!
তোকে ওখানেই এক্সপেক্ট করেছিলাম। বলেওছিলাম। এলি না তুই!”
- কিছু কাজ ছিল। তাই এখানে এসে পড়েছিলাম। এসেই মনে হল তুই যেমন একটা
কাজের কাজ করছিস, আমিও একটা কাজের কাজ করি।
- !!!
- মা’কে জোর করে ধরে রিকশায়
বসিয়ে নিয়ে এলাম এখানে। বলে তো, এসব ব্যাপারে নাকি বিধবাদের সামনে থাকতে নেই। তা তুই
যখন বাবার বিয়ে দিচ্ছিস বিধবার সাথে, আমিও আমার মা'কে ওখানে নিয়ে যাই।
- কোথায় মাসীমা?
- ওদিকের ব্যালকনিতে বসিয়ে দিয়েছি। অসুস্থ শরীর তো, হাঁপাচ্ছিল।
রুমু গেল বাইরের ব্যালকনিতে। পায়ে হাত দিয়ে
প্রণাম করল মাসীমাকে। পিছন থেকে আওয়াজ পেল অপর্ণার, “আসল মজাটা তো জানিস না। তোর শাঁখের সাথে উলু
দিল কে?”
- হ্যাঁ, আমি তখন থেকে ভাবছি, কে দিল উলু! সামনে তো কাউকেই দেখলাম
না। কে দিচ্ছিল?
- মা! তুই যখন বললি, কেউ উলু দেওয়ার নেই! কেউ দিচ্ছে না দেখে মা’ই ওই দুর্বল গলায় উলু দিল কিছুক্ষণ!
No comments:
Post a Comment