আমার এক বন্ধু। অন্য শহরে থাকেন। বছরখানেক আগে অব্দি নাজেহাল হচ্ছিলেন মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্রের খোঁজে। দিল্লী, কলকাতা, ভিলাই, মুম্বই। মেয়ে তখন মেডিক্যালে – শেষ বছর। স্বাভাবিক ভাবে পরিবারের মত যে পাত্র ডাক্তার হতে হবে। নিজের জাতের যে হবে সেটা তো বলার কোনো কথাই নয়। ডাক্তার পরিবার হলে আরো ভালো হয়। বন্ধু নাজেহাল হচ্ছিলেন বস্তুতঃ ভালো পাত্রের খোঁজে নয়, পণের খাঁই দেখে। সর্বস্ব বিকিয়েও যে পার পাওয়া যাচ্ছে না! …
মিটিং ছিল সেই শহরে। রাত বন্ধুর সাথেই কাটল।
পুকুরধারে হাঁটছিলাম – বন্ধু বললেন, “মেয়েদেরই এগোতে হবে ভাই। নইলে বড় মুশকিল!” বন্ধুর
মুখের দিকে তাকালাম। স্ট্রিট লাইটের আলোয় একটা তীব্র কষ্ট দেখলাম তার মুখে। পণের খাঁই
মেটানোর নয়। গভীরতর। কেননা পরিবারের দিক থেকে বন্ধুও খুব গরীব নন। বরং শহরের প্রতিষ্ঠিত
পরিবার। বড় চৌহদ্দিতে সাবেকি তিন তলা বাড়ি। গ্রামে খেতখামার।
হঠাৎ খেয়াল হল, বন্ধুর মানসিকতা যে ভিন্ন।
ভুলেই গিয়েছিলাম। সমাজ-সংস্কারক। সক্রিয় কর্মী। কষ্টটা পণের খাঁই মেটানোর নয়, পণ ব্যাপারটাকে
মানতে বাধ্য হওয়ার। মেয়ের বাপ কি বলতে পারে পণ দেব না? যদি মেয়ের কোনো আপত্তি না থাকে?
আর মেয়ে তো জানে যে পণটাই একমাত্র প্যাঁচ, পৈত্রিক বা পারিবারিক সম্পত্তিতে তার ভাগ
দিতে বাধ্য করার। পরে তো আর কিছু দাবি করার অবস্থাতেই থাকবে না। ছাড়ার বোকামি কেউ করে?
ডাক্তারি করতেও, পূঁজি চাই না? আর বাবার ওই মূল্যবোধ-টোধ, ওসব বাবার ফ্যাকড়া!
তাই হল। মেডিক্যালে পড়া মেয়ে অম্লানবদনে পণের
ধনের সাথে পা দিল শ্বশুরবাড়ি। এখন ডাক্তার বর আর ডাক্তার বৌ নতুন নার্সিংহোমে পার্টনার।
গুপ্তাজির বড় ছেলে চান্স পেল খড়গপুর আই.আই.টি.তে।
ইলেকট্রনিক। অথচ প্রথম সেমেস্টারে রেজাল্ট খারাপ হতেই চেলে গেল ডিপ্রেশনে। বাড়িতে হুলুস্থুলু।
গুপ্তাজি ছেলেকে নিয়ে এলেন। গেলেন বিখ্যাত কয়েকজন নিউরোফিজিশিয়ান এবং অবশ্যই সাইকিয়াট্রিস্টের
দরবারে। ওষুধ চলতে লাগল। ওদিকে আই.আই.টি.তে চিঠি লিখে সময় নেওয়ার, পরের সেমেস্টারের
জন্য অনুমতি নিয়ে রাখার ব্যাপারটাও সামলাতে হচ্ছে। গুপ্তাজিরও ডিপ্রেশনে যাওয়ার মত
অবস্থা। গুপ্তাজি ছেলেকে নিয়ে গেলেন নিজের গুরুদেবের কাছে। গুরুদেব কিছু মন্ত্র-টন্ত্র
দিলেন। কিছু ধ্যান-ট্যান করতে বললেন। ওদিকে গুপ্তাজির স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে গেলেন এক
জ্যোতিষীর কাছে। তাঁর উপদেশ মত কিছু আংটি, তাবিজ গড়িয়ে দিলেন। … তারপর স্বামীকে বললেন,
“আমি খড়গপুরে থাকব”। “কোথায়?” “বাইরে। আমি খোঁজখবর নিয়েছি। অনেক মায়েরা থাকে শহরে,
ক্যাম্পাসের বাইরে। ছেলেরা ভরসা পায়”। …
ছেলে এখন ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করে। আইটি ফার্ম।
ভালো প্যাকেজ। তার মনে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই যে সে কিসে ভালো হল। ওষুধে, মন্ত্রে,
তাবিজে না কি মায়ের খড়গপুরে গয়ে থাকায়। …”ইউ কান্ট সে! কত রকমের এনার্জি যে আমাদের
জীবনে কাজ করে!” ইদানিং আরো কয়েকটা আংটি বেড়েছে তার আঙুলে। কেন না তার রুমমেট দুম করে
একটা বড় ওপেনিং পেয়ে গেল। সে পাচ্ছে না।
ঝাজি আমার দিকে তাকিয়ে মাথাটা নাড়লেন। “কী
মুশকিলে যে পড়েছি, কী বলব। … পুরো ফ্যামিলি আমাকে তুলোধোনা করে ছেড়ে দিচ্ছে। আর আমাদের
ফ্যামিলি বলতে বোঝেন তো! বলতে গেলে এ হোল ভিলেজ! পুরো কুনবা!”
ব্যাপারটা এই যে ঝাজির ছেলে আমেরিকায়, একটা
ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। এখান থেকে ফিজিক্সে এম.এসসি. করে চলে গিয়েছিল। সেখানেই পছন্দ
করেছে এক তামিল সহকর্মিনীকে। বাড়ির লোকের তীব্র বিরোধ যে এক তো মেয়েটি তামিল। তায় ব্রাহ্মণ
নয়। দহেজ নাহয় বাদ দেওয়া যায় কেন না মেয়ে কমাউঁ!
ঝাজি পুরোনো কম্যুনিস্ট। আক্ষেপ করলেন, “এত
বোঝাচ্ছি দাদা! আরে বাবা ব্রাহ্মণ নয় তো কী হয়েছে? কোনো ছোটো জাতের মেয়ে তো আর নয়?
হ্যাঁ, তামিল। তা সে আর কী করা যাবে?...”
যা হোক, ঝাজির ‘ভাবধারাগত সংগ্রামে’ কাজ হল।
কুনবা বুঝল যে তাদের জাত আর মেয়ের জাত ভিন্ন হলেও শূদ্রদমনে সমান অধিকারের উত্তরাধিকারী।
ধূমধামে বিয়ে হল।
ঝাজির ছেলে আরেক ধাপ এগিয়ে। বলল, “চাচাজি,
এমেরিকায় থাকি বলে কি সংস্কার ভুলে গেছি? ফাইন্যালি এটা একটা স্যাক্রেড রিলেশন বলে
কথা। জাত-ধর্ম ভুলে তো আর ঝাঁপিয়ে পড়া যায় না?”
আমার এক পুরোনো ইয়ার কুন্তল চ্যাট্যার্জি।
ম্যাট্রিকের পর বি.কম.টা করেছিল সেকেন্ড ক্লাসে। সারা জীবন ছোট ছোট চাকরি ধরতে আর ছাড়তে
রয়ে গেল। গুছিয়ে বসতে পারল না কোনোদিন। বৌ, ছেলেমেয়ের ভোগান্তি।
ম্যাট্রিকের পর লম্বা ছুটিটায় আমরা নরক গুলজার
করতাম খোকনের বাড়িতে। সদস্যতার শর্ত ছিল বামুন হলে পৈতে ছিঁড়ে ঢুকতে হবে। কুন্তল শুধু
ছেঁড়েই নি, আরো কিছু করেছিল তা আর বলা যাবে না। … আর পরেনি পৈতে।
মাঝে মধ্যে শহরে আসে। রাস্তার ওপার থেকে ষাঁড়ের
মত ডাকে। বদমায়েসির হাসি ছাড়ে একটা। দিলখোলা মানুষ।
আসলে এই ধারণাটাই ভুল যে বিজ্ঞান পড়লে বা বিজ্ঞান
চর্চা করলে জীবনের প্রতি, সমাজের প্রতি মনোভাবে বৈজ্ঞানিক শুচিতা আসবে। জীবিকা ও বৃত্তি
হিসেবে বিজ্ঞান আর কর্ম ও মননের ভিত্তি হিসেবে বিজ্ঞান হয়ত একে অন্যের থেকে এত তফাতে
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ছিল না। আর তাই আমরা গত দুই দশকে যখন বিশাল সংখ্যায় ভারতীয়
যুবকে প্রযুক্তির দিকে যেতে দেখলাম, আশা জেগেছিল যে তাদের কর্মে ও মননেও বুঝি বা ভিত্তি
দেবে বিজ্ঞান। জাগবে বিদ্রোহ। ভাঙবে অনেক অচলায়তন।
কিন্তু উল্টোটাই হচ্ছে।
তবে কি হতাশায় ডুবে আক্ষেপ করা ছাড়া কিছু করার
নেই?
………………………
আগে ছিল শিক্ষা, দীক্ষা। শিক্ষা দিত বস্তুচেতনা,
জীবনচেতনা, সমাজচেতনা। এক্ষুনি জানি একজন গর্জে উঠবেন, ‘কেন? ধর্মচেতনা নয় কেন?’ …
হ্যাঁ ভাই, ধর্মচেতনাও। ওই সমাজচেতনার মধ্যেই ছিল সংস্কৃতিচেতনা, ধর্মচেতনা। ঠিক আছে?
…… আর দীক্ষা দিত কর্মচেতনা।
তখনকার যাঁরা শিক্ষাগুরু ছিলেন তাঁরা জানতেন,
শিক্ষার পর দীক্ষারও পর প্রয়োজন। নইলে জীবন হয় নেতির দর্প, আত্মক্ষয়।
তখনকার যাঁরা দীক্ষাগুরু ছিলেন তাঁরাও জানতেন,
দীক্ষার নিচে শিক্ষার ভিতটা জরুরি। নইলে জীবন হয় যন্ত্রবৎ।
মানুষের মানুষ হয়ে ওঠায় খামতিগুলো তাঁরা পুষিয়ে
দিতেন। শিক্ষাগুরুও প্রয়োজনে দীক্ষা দিতেন। দীক্ষাগুরুও প্রয়োজনে শিক্ষা দিতেন।
পঁচিশ বছর আগে এল মানব সম্পদ বিকাশ/উন্নয়ন।
কথাটা খুব সুন্দর। প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে যে মানবিক সম্পদ আছে, তার স্বীকৃতি এবং
তার বিকাশসাধন। যেন বা ‘ওপর থেকে শিক্ষা’র ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার কাটিয়ে ‘নিচ থেকে,
মানুষের প্রত্যন্ত জীবনধারণ থেকে জীবনমূল্যগুলির আবিষ্কার এবং তাদের সংহতিসাধন’।
কিন্তু হল একেবারেই ভিন্ন একটা ব্যাপার। মানুষ,
জ্বলজ্যান্ত মানুষটাই পরিগণিত হল, ধনতন্ত্রের প্রয়োজনে, সম্পদ হিসেবে। যেমন খনিজ সম্পদ,
কৃষিসম্পদ, তেমনই মানবসম্পদ। যেমন মেশিনারি, মেটিরিয়াল তেমনই লেবার। মুনাফার প্রয়োজনে
ওই লেবারের অর্থাৎ লেবার-পাওয়ারের, শ্রমশক্তির উন্নতিসাধন, মেধাশ্রমশক্তির বিকাশ এসবই
হয়ে গেল সরকারি বিভাগটির মূলমন্ত্র। এমনকি, চাহিদা না থাকলে যেমন খনিতে খনিজসম্পদ থাকলেও
তা হয়ে ওঠে পরিত্যক্ত জঙ্গল, রোজগারের অভাবে মানবসম্পদও হয়ে উঠতে লাগল পরিত্যক্ত সামাজিক
জঙ্গল।
বাচ্চাদের আর কী দোষ? তাদের মুনাফার যন্ত্রে
আখ হিসেবে মাড়াই করার জন্য করানো হল ক্যাম্পাস, প্লেসমেন্ট, প্যাকেজের দৌড়। মানসিক
চাপে, অবসাদে তারা খড়কুটো খোঁজে, চেপে ধরে। …
তথ্য বলছে, প্রযুক্তির বিপ্লবে জীবিকার পাঠ
নিতে গিয়ে, অর্থাৎ ফলিত বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে, এমনকি তত্ত্বগত প্রকৃতিবিজ্ঞানের পাঠটাও
চুলোয় যেতে বসেছে। প্রকৃতিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণায় বিশ্বমঞ্চে ভারতের যে স্থান
ছিল তা গত পঁচিশ বছরে কমে এসেছে ক্রমাগত। লক্ষণীয় ভাবে বেড়েছে চৌর্যবৃত্তির, অন্যের
গবেষণাকে নিজের বলে চালাবার প্রচেষ্টার সংখ্যা।
দোষটা প্রযুক্তি-বিপ্লবের নয়। দোষটা ধনতন্ত্রের।
বিশেষকরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা তথাকথিত ‘অবাধ’ বাজারভিত্তিক অর্থনীতির। পূঁজির
বিশ্বায়নের। … যেহেতু নতুন প্রযুক্তি এদেশে এই অর্থনীতির হাত ধরে এসেছে তাই মাথায় গুলিয়ে
যায় ব্যাপারটা। দেখতে পাই না যে প্রযুক্তিকে বিজ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে এই বিশ্বায়ন।
কেননা তাদের অর্থনীতির মানচিত্রে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার জন্য কিছু দেশ চিহ্নিত। আর প্রযুক্তি
নিয়ে কাজের জন্য অন্য কিছু দেশ চিহ্নিত। এই তফাৎটা না থাকলে তো মুনাফার মার্জিনটাই
বিপন্ন হওয়ার ভয় থাকবে! আর মুনাফার দর বাড়াতে না পারলে বিশ্বায়নের কাজ কী? আর তাহলে,
প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত সম্পর্ক? সেটা কুক্ষিগত আছে বহুজাতিক
কম্পানিগুলোর ‘আর এন্ড ডি’ চিহ্নিত ক্যাম্পাসগুলোর গবেষণাগারে।
বস্তুতঃ, এই ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটাই প্রযুক্তির
কাছে নিয়ে আসবে বিজ্ঞানকে। আর জীবিকা হিসেবে বিজ্ঞানের কাছে নিয়ে আসবে কর্ম ও মননের
ভিত্তি হিসেবে বিজ্ঞানকে। প্রকৃতিবিজ্ঞানের কাছে নিয়ে আসবে সমাজবিজ্ঞানকে। যে শিক্ষিত,
সে দীক্ষিত হবে। যে দীক্ষিত, সে শিক্ষিত হবে।
মানছি তাতে দেরি আছে এখন অনেক। কিন্তু শিক্ষাগুরু
এবং দীক্ষাগুরুরা মন দিয়ে দেখুন। আপনাদের নতুন প্রজন্ম নিজেদের কাজ ঠিকমত না করা সত্ত্বেও
জীবন কিন্তু থেমে থাকে নি।
হয়ত বাঞ্ছনীয়ও নয় অনেক সময়, তবু নতুন নতুন
অভাবিত পথে মানবসম্পদ বিকশিত হচ্ছে প্রতিদিন। তার ত্বরিত ধারাগুলি রোদ্দুরে ঝিলিক দিয়ে
উঠছে মাঝে মধ্যেই।
এমনকি, এও দেখা যাচ্ছে যে যাদের বিজ্ঞান বা
প্রযুক্তির পাঠের সুযোগ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই এ জীবনে, তাদেরই কর্মে ও মননে ভিত
যোগাচ্ছে বিজ্ঞানচেতনা। বিস্ময়! নয় কি?
[দশ বারো বছর আগে বিহার এস.সি.ই.আর.টি.র ত্রিভাষী পত্রিকায় প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment