Tuesday, October 5, 2021

নিদো তানিয়ার প্রসঙ্গক্রমে - উদয় প্রকাশ*

মাত্র উনিশ বছরের রোগাপাতলা ছেলে ছিল নিদো তানিয়া। বেসরকারী একটি পেশা সম্পর্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র – ওর সামনে ছিল বৃত্তিগত উন্নতির দীর্ঘ পথ এবং বহু বছরের ভবিষ্যৎ, যা ২৯শে জানুয়ারিতে হঠাৎ পিটিয়ে পিটিয়ে শেষ করে দিল দিল্লীর বাণিজ্যিক বাজার অঞ্চল লাজপতনগরের আটজন দোকানদার। তার হত্যাকারীদের মধ্যে দুজন ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক, ঠিক যেমন ‘নির্ভয়া’ বাস-ধর্ষণের ঘটনায় সবচেয়ে জঘন্য ধর্ষণকারীটি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। এটা স্পষ্ট যে যতদিন না বর্তমান আইনে সংশোধন করা যাচ্ছে ততদিন ওই ছেলেটিকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া যাবেনা। ‘নির্ভয়া’ ঘটনার ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ দোষীকেও মাত্র তিন বছরের জন্য শিশু-সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে। এখনো আমাদের বিচারব্যবস্থা এই নতুন, পরিবর্তিত সমাজ-বাস্তবটা বুঝতে পারছেনা যাতে বাচ্চারা আর অপ্রাপ্তবয়স্ক নয়, বয়স্ক। তারা ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, লুট আর হত্যা করা শুরু করেছে। কিছুদিন আগে ঘটিত, দিল্লীর সবচেয়ে বড় লুটের (সাত কোটি টাকা) মাস্টারমাইন্ডও একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। 

নিদো তানিয়া পাঁচটি ভুল করেছিল। প্রথম ভূল যে সে আজকালকার যুবদের মত চুলে রঙ লাগিয়ে রেখেছিল। দ্বিতীয় ভূল যে সে দিল্লীর একটি পনীরের দোকানে, পনীর বা মাখন ক্রীম ইত্যাদি কিনতে নয়, নিজের এক বন্ধুর ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল। অর্থাৎ সে ‘কাস্টমার’ ছিল না। মির্জা গালিবের কথায়, যাচ্ছিল সে বাজারের পথেই, কিন্তু খদ্দের ছিল না। আজকাল আমাদের মহানগরগুলো এমনই হয়ে পড়েছে যেখানে প্রত্যেকেই, হয় কিছু বেচে অথবা কেনে, অর্থাৎ পুরো শহরটাই এক বড়সড় শপিং মল। নিদো তানিয়ার তৃতীয় ভূল ছিল যে সে অরুণাচল প্রদেশ থেকে এসেছিল। সেই অরুণাচল প্রদেশ যেখানকার মানুষজনের চেহারাগুলো দিল্লী বা উত্তরভারতের মানুষের থেকে ভিন্ন। সেই অরুণাচল প্রদেশ, যেটাকে চীন বেশ কিছু বছর ধরে নিজের মানচিত্রে শামিল করছে, কিন্তু প্রদেশটি আজও ভারতের অংশ কেননা সেখানকার জনতা নিজেদের ভারতীয় গণতন্ত্রের অংশ মনে করে।

নিদো তানিয়ার চতুর্থ ভূল ছিল যে সে তার দিকে ছোঁড়া মন্তব্যে ক্রুদ্ধ হয়ে দোকানটির কাঁচ ভেঙে দিয়েছিল। সে হোক না কেন যে সে কাঁচ ভাঙার অপরাধে দশ হাজার টাকার জরিমানা দিয়ে দিয়েছিল এবং নিজের হত্যাকারীদের সাথে ‘সমঝোতা’ করে নিয়েছিল। তার পঞ্চম ভূল ছিল যে সে মেনে নিয়েছিল যে দেশের রাজধানী দিল্লী একটি বিকশিত আধুনিক মহানগর এবং এখানে যেকোনো ভারতবাসী নির্ভয়ে স্বাতন্ত্র্য এবং বৈধ নাগরিক অধিকারে বসবাস করতে পারে।

হতে পারে ছেলেটি ভেবেছিল যে তার পিতা নিদো পবিত্র সেই রাজনৈতিক দলের বিধায়ক এবং পরিবার তথা স্বাস্থ্যকল্যাণ বিভাগের সংসদীয় সচিব যে রাজনৈতিক দলের সরকার এখনো কেন্দ্রে শাসন করছে। হতে পারে তার ভিতরে ভ্রান্তি তৈরি করেছিল এই তথ্য যে দেশের প্রধানমন্ত্রীকেও সেই উত্তর-পূর্বের, অর্থাৎ আসামের জনগণ সংসদে নির্বাচিত করে পাঠিয়েছে যে উত্তর-পূর্বের সে নিজেও একজন বাসিন্দা। আসাম উত্তর-পূর্বের সাত বোনের এক বোন, যেমন সাতটি নদীর মিলনে তৈরি হয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ।

নিদো তানিয়া ভেবেছিল হয়ত যে যদি সাতটি আলাদা আলাদা নদীর মিলনে এক ব্রহ্মপুত্রের জন্ম হতে পারে, তাহলে অসংখ্য বর্ণ, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা আর সমুদায়ের মিলনে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রেরও জন্ম হয়ে গিয়ে হবে। মাত্র চার দিন আগেই তো এই দিল্লীর রাজপথে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং রাজধানীর সব ভিআইপি গণ্যমান্যদের উপস্থিতিতে প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করা হয়েছিল, যাতে ভারতের বিবিধতার মন্ত্রমুগ্ধকারী ট্যাবলো পেশ করা হয়েছিল। নিদো তানিয়ার হত্যার চার দিন আগের তারিখ ২৬শে জানুয়ারির এই প্রজাতন্ত্র দিবস ১৯৫০ সালে জারি হওয়া সেই সংবিধানের স্মৃতিতে উদযাপিত হয় যেটি এই প্রজাতন্ত্রে বসবাসকারী প্রত্যেকটি নাগরিককে সমান অধিকার এবং স্বাতন্ত্র্যের গ্যারান্টি দেয়। কিন্তু সেটা তানিয়ার ভ্রান্তি ছিল। অবাস্তব ছিল তার চিন্তাভাবনা, একটা স্বপ্নে বাঁচছিল সে, যে স্বপ্নে আমরা সবাই, বারবার নিরাশ হয়েও একটা জেদবশতঃ বেঁচে থাকি। 

নিদো তানিয়ার হত্যা বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন খাড়া করে। এটি কোনো সাধারণ অপরাধের ঘটনা নয়, এক প্রজাতন্ত্রের অসফল হয়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সংকেত – একটি ‘এমার্জেন্সি এলার্ম’। কিছুদিন আগেই এমেরিকার নামকরা খবরের কাগজ ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর একটি সার্ভে দুনিয়ার সেই প্রধানতম দেশগুলোর মধ্যে ভারতকে শীর্ষস্থানে পেয়েছে যেখানে বর্ণভিত্তিক, লিঙ্গভিত্তিক, সামুদায়িক এবং জাতিগত অসহিষ্ণুতা সবচেয়ে বেশি। এশিয়ার অর্থনৈতিক ‘সুপার পাওয়ার’, চাঁদে আর মঙ্গলে উপগ্রহ পাঠানো, পরমাণু ক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, মিসাইল টেকনোলজিতে বিশ্বকে আশ্চর্যচকিত করা এই দেশটি নিজের মূলগত চরিত্রে কী করে এত পশ্চাৎপদ, প্রাক-আধুনিক, মধ্যযুগীন সমাজের একটি গোঁড়া হিংসাপরায়ণ দেশ হয়ে চলেছে? ভাববার প্রশ্ন।

কোনো শহরের ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ বদলে সেটিকে ইওরোপের বড় শহরগুলোর মত বানিয়ে দিলে, আধুনিকতম ভোগ্যপণ্যের টেকনোলজি বাজারে ভরে দিলে, প্রত্যেকের হাতে স্মার্ট ফোন আর ল্যাপটপ দিয়ে দিলে, সব জায়গায় সবক’টি সফটড্রিংক আর জাংকফুডের দোকান খুলে দিলে, ইওরোপকেও ম্লান করে দেওয়া বড় বড় মল তৈরি করে দিলে, মেট্রো রেল, মনোরেল চালিয়ে দিলে আর ছয়-আট লেনওয়ালা চওড়া সড়ক তৈরি করে দিলে অথবা কমনওয়েলথ গেমস আর এশিয়ান গেমসের দারুণ সমারোহ সফল করে এবার অলিম্পিক করানোর দাবী করলে কি কোনো মহানগর এবং তাতে বসবাসকারী সমাজ ‘আধুনিক’ হয়ে যায়? সংবিধান, লোকসভা আর বিধানসভার প্রতিষ্ঠা করে দিলে এবং ভোট করিয়ে দিলেই কি সত্যিই আধুনিক ও সভ্য গণতন্ত্রের নির্মাণ সম্পন্ন হয়? বিল্ডার আর কর্পোরেট ঘরানার ঠিকেদারেরাই কি আধুনিক গণতন্ত্রের নির্মাতা? যারা মল-মেট্রো আর আকাশচুম্বী অট্টালিকা বানিয়েছে তারা গণতন্ত্রও বানাতে পারে? গণতান্ত্রিক সমাজ হওয়ার প্রাথমিক ও মৌলিক শর্ত কী কী? এমন অনেক প্রশ্ন আছে, যেগুলো হঠাৎ উঠতে শুরু করেছে।

নিদো তানিয়ার হত্যার কিছুদিন আগে দক্ষিণ-দিল্লীর ওই অঞ্চলেই, বেড়াতে বেরুনো দুই মণিপুরী মেয়ের জুতোয় দুই যুবক নিজেদের পোষা কুকুরের বেল্ট বেঁধে দিয়েছিল আর যখন ভয় পেয়ে মেয়েরা চেঁচাতে শুরু করল, যুবকেরা হাসতে লাগল। যখন একটি মেয়ে কুকুরটাকে দূরে সরাতে পা দিয়ে ঠেলা দিল তখন যুবকেরা মেয়েটির চুল ধরে টানতে টানতে তাকে ‘চিংকি’, ‘ঝিংগা লা লা’, চাউমিন’ বলে গালিগালাজ করল। মেয়েদের বাঁচাতে এগিয়ে আসা উত্তর-পূর্বের দুই যুবককে ওরা মারধর করল। নালিশ করা সত্ত্বেও পুলিস এফআইআর নিলনা।

কিছুকাল আগে দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় মহিলা আয়োগের যুক্তভাবে করা সার্ভেতে এই তথ্য সামনে এসেছে যে দেশের মহানগরগুলোয় উত্তর-পূর্ব থেকে আসা নারীদের ৬০% বর্ণগত ভেদাভেদ, অপমান এবং উৎপীড়নের শিকার। এই মহানগরগুলোর শীর্ষস্থানে আছে দেশের রাজধানী দিল্লী, যেখানে ৮১% নারীরা এই ভেদাভেদ এবং অপমানের দংশন সহ্য করে চলেছেন। চিংকি, নেপালী, চিনে, চাউমিন সম্বোধন তো চলেই, তার সাথে এটাও জিজ্ঞেস করা হয় আকছার, “তোমরা কি কুকুর আর সাপ খাও?” গুরুত্বপূর্ণ এটাও যে পুলিস এবং প্রশাসনিক কর্তাদের মনেও এসব ধারণা বদ্ধমূল। পাঠকদের মনে আছে হয়ত যে এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান সম্মানীয় অতিথি ছিলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিঞ্জো আবে। সেদিনের এই গল্পটি কম চিত্তাকর্ষক নয় যে সুরক্ষার সাথে জড়িত এবং অন্যান্য সরকারী আধিকারিকেরা মণিপুর আর মিজোরামের কিছু দর্শকের কাছে এসে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, “আপনারা কি জাপানী ডেলিগেশনের সদস্য?” আগ্রায় তাজমহল দেখার টিকিট কিনতে পৌঁছনো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষদের কাছে পাসপোর্ট চাওয়া তো প্রতিদিনকার ব্যাপার।

এটা স্পষ্ট যে আমাদের শিক্ষাসংস্থাগুলোয় নিজেদের দেশটার বিষয়ে যে শিক্ষা ছাত্রদের দেওয়া হয়েছে তাতে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাব রয়েছে। বিশেষ করে ১৯৯০এর পর যে নতুন শিক্ষা যেভাবে তিন প্রজন্মকে শিক্ষিত করেছে, তার ফলশ্রুতি এই যে তারা সে দেশ আর সমাজটাকেই জানে না যাতে তারা থাকে। তারা বাণিজ্যিক কম্পানিগুলোর পরিচালন ও মার্কেটিংএর জন্য উপযোগী হতে পারে, কলসেন্টারে কাজ করতে পারে, হাইটেক মজুর হয়ে বিদেশ যেতে পারে এবং রোজগার করতে পারে কিন্তু তারা নিজেদের ভূমি থেকে কর্তিত, নিজেদের পরিবারের জন্য পর আর সমাজের জন্য অনুপযোগী।

এই কারণেই নিদো তানিয়ার হত্যার প্রতিবাদে আসা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাজার হাজার ছাত্র ও যুবদের একটা দাবী এও ছিল যে এনসিইআরটি স্কুলের জন্য এমন পাঠ্যক্রম তৈরি করুক যার মাধ্যমে ছাত্ররা এই দেশের বিবিধতার পূর্ণ তথ্য পেতে পারে। মনে পড়ে যে কখনো রামাস্বামী পেরিয়ার বলেছিলেন, হিন্দী-হিন্দু-হিন্দুস্তানওয়ালা জাতিবাদের সবচেয়ে বড় সংকীর্ণতা যে তারা পুরো দক্ষিণ ভারতটাকে ভুলে যায়। জেনে অবাক হতে হয়না যে আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীও বিন্ধ্য পর্বতের উপরের অংশটিকেই ভারত বলে মানতেন। তাঁর জাতীয় কল্পনির্মাণে দক্ষিণ ভারতই ছিলনা, উত্তর-পূর্বাঞ্চল থাকার তো কথাই ওঠেনা।

শিক্ষা বাদ দিয়ে কোনো সমাজ বা জাতিরাষ্ট্রের নাগরিক তৈরি করা যেতে পারেনা। যদিও মনোবৈজ্ঞানিকেরা বলেন যে শিশুদের আসল ও প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয় হয় তাদের পরিবার। যদি আমাদের পরিবারগুলো নাগরিক নয়, কম্পানির কর্মচারি তৈরি করা কিন্ডারগার্টেন হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে নাগরিক কোথা থেকে আসবে; ভীড়ই জন্ম নেবে আর সে ভীড় নিজের থেকে ভিন্ন কাউকে দেখে তেমনই হিংসাপরায়ণ আচরণ করবে যেমন তানিয়ার সাথে করল।

দিল্লী যদি দেশের সবচেয়ে আধুনিক আর বিকশিত মহানগর হওয়ার বদলে ধর্ষণ, জাতগত গোঁড়ামি আর বর্ণহিংসার রাজধানী হয়ে চলেছে, তাহলে তার কারণগুলো গভীরে গিয়ে খুঁজতে হবে। ভোলা উচিৎ নয় যে ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি এই দিল্লীতেই মহাত্মা গান্ধীর হত্যা করেছিল এক সাম্প্রদায়িক উন্মাদ আর ২০১৪ সালের ৩০শে জানুয়ারিতে নিদো তানিয়ার হত্যা করল সেই দিল্লীর সমাজে বাড়তে থাকা বর্ণভিত্তিক হিংসা। কিছু মানুষ এখনও ঘটনাটিকে খুব হাল্কা ভাবে, সাধারণ অঘটনের মত করে দেখছেন। এটা তাঁদের ‘উটপাখিবাদ’, যা ভবিষ্যতে ঘনিয়ে আসা ঝড়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের মাথা বালিতে গুঁজে নেয়।

*উদয় প্রকাশ হিন্দীর লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যিক
হিন্দী থেকে বাংলায় অনুবাদঃ বিদ্যুৎ পাল
[ছবি ও মূল রচনাটির জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ প্রভাত খবর (দৈনিক), পাটনা এডিশন, ৯ই ফেব্রুয়ারী ২০১৪]



No comments:

Post a Comment