আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে
আমিই জানি আর জানে সেই মেয়ে।
ঘন মেঘে আঁধার হয়ে আসা প্রান্তরে ওই দেখাটুকুর
মধ্যে আপন্ন হয়ে পড়ছে আমার নশ্বরতায় চিরকাল।
রবিঠাকুরের সাথে আমার সম্পর্কের ব্যাপারটাও
ওই রকমই। আমার পানে চেয়ে দেখলেন কিনা একটিবার তা তিনিই জানেন আর আমার জানাটাকে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের
দোলায় রেখে দেন।
১
প্রথম যখন এসেছিলেন তখন আমি রান্নাঘরের চৌকাঠে
বসেছিলাম। চৌকাঠে বসা নাকি মানা, তাই মা ধ্যাঁতানি দিয়ে দরজার বাইরে বসালেন। রান্না
করতে করতে বা হাতে বই ধরে পড়তে শুরু করলেন ‘আমি যদি হতেম কুকুরছানা’ আর আমি হাপুস চোখে
কান্না জুড়ে দিলাম। চেষ্টা করে থাকলাম মায়ের কোলের কাছে ঘেঁষবার।
তিনি এসেছিলেন মানে ঝিরিঝিরি ছিলেন উঠোনের
বাইরে জামগাছটির ছায়ার মত। তখন তো আর জানতাম না কবিতা মানুষে লেখে! জানতাম এগুলো মায়ের
হাতে অস্ত্র, হাতপাখার ডাঁটির মত, যাতে আমি দুষ্টুমি না করি।
রাতে মায়ের বুকের কাছে গুটিসুটি আমি রাজপুত্র!
মা শোনাতেন ‘মনে কর যেন বিদেশ ঘুরে’। রবিঠাকুর হারুদের মাঠটায় থাকতেন জ্যোৎস্না হয়ে।
২
তখন তাচ্ছিল্যের বয়স। তায় পাটনা শহরে। কলকাতা
রেডিওকে ব্যঙ্গ করতে বলতাম ‘আকাশবাণী কলতলা’। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ঘোষণা হলেই বলতাম ‘শুরু
হল বেড়ালের ম্যাঁও ম্যাঁও।’ (এখনও অনেকের গান বেড়ালের ম্যাঁও ম্যাঁওই মনে হয়)। তবু,
এই জোরদার মাথা ঝাঁকানির মধ্যেও বুড়ো একটুখানি জায়গা ধরে রেখেছিল পঙ্কজ মল্লিকের গলায়
ভর দিয়ে। রোববার বেলা দশটায় ‘খর বায়ু বয় বেগে’র খরতা খারিজ করতে পারতাম না কিছুতেই।
এ সময়ে পাড়ায় এলেন কলকাতিয়া জামাইবাবু। বললেন
পঁচিশে বৈশাখ হবে এবার – বাচ্চুদের ভিতর বারান্দায়। দুই ভাড়াটিয়া আর এক বাড়িওয়ালার
হেঁসেল বন্ধ রেখে। যে কটার পেছনে লাইন দিতাম পাড়ায় সব সেজেগুজে পরি হয়ে গেল। জামাইবাবুর
কাছে কেনা হয়ে গেলাম যে আমাকেও রিহার্সালে স্লট দিলেন। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ’।
বুড়ো নিশ্চয়ই মিচকে হাসছিল।
৩
তারপর অনেকটা পথ খুব তাড়াতাড়ি চলা। সাইকেলে
কন্যাকুমারী যাওয়া, ফিরে এসে চলে যাওয়া কোলিয়ারিতে কাজ করতে, প্রথম কবিতা লিখতে শুরু
করা, কলেজ পাশ, চাকরি, পত্রিকা, কবিতার জগৎটি বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে ঘুরে ঘুরে দেখা
– ‘হেঃ, কোথায় লাগেন রবীন্দ্রনাথ’ … এরকমই একটা জায়গায় ছিলাম। আদতে কেরানি, বড় সাহেবদের
অশ্রদ্ধা করতে শিখিনি, কাজেই পেন্নামটা ঠুকে দিতাম। কিন্তু হৃদয়ের সম্রাট ছিলেন জীবনানন্দ;
মানে বাংলা কবিতায়। ছিলেন সুকান্তও। সমর সেন, কিছু কবিতায় সুভাষ। আরো অনেকে। বাট নো
রবীন্দ্রনাথ।
দীপনের বাড়িতে সন্ধ্যায় আড্ডা বসতো। একদিন
ভিতর ঘর থেকে ভেসে এল ‘আমি চঞ্চল হে …’।
- কার গলা?
- দেবব্রত বিশ্বাস।
আমি হতবাক। এটা গান? না ভয়েজারের গায়ে লেখা,
অন্য গ্যালাক্সির জন্য আত্মপরিচয়! ‘আমি সুদূরের পিয়াসী’ … ।
আর ওটা গলা? রবীন্দ্রসঙ্গীতের? নাকি পাহাড়ের
বাঁকে বেজে ওঠা চেলো আর স্যাক্সোফোন!
যাই হোক, ওই একটি গান আমাকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের
জগতে ঢুকিয়ে তবে ছাড়ল।
বুড়ো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
৪
এভাবেই এর কিছুদিন পর বুড়োর কবিতার কাছে যেতে
বাধ্য করল দীপন আর পূর্ণেন্দুদা। এক দুপুরে দীপন শোনাল ‘ঢালি মধুরে মধুর, বধুরে আমার
হারাই বুঝি।’ ওই কবিতার হাত ধরে আমি ছন্দের বহিরঙ্গ থেকে অন্তরঙ্গে প্রবেশ করতে শিখলাম।
এটা ওই কবিতার বিশেষ গুণ নাও হতে পারে। হয়ত আমার ওটাই টেম্ (Time) ছিল!
আরেক দুপুরে পাটনা কলেজের গঙ্গার ধারে পূর্ণেন্দুদা
শোনালেন ‘খোলো, খোলো হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা’। এই কবিতাটির হাত ধরে আমি রবিঠাকুরের
ছবিগুলোর দিকে ফিরে তাকালাম। সেটাও হয়ত ওই টেম্-এর ব্যাপার।
৫
আমার রবীন্দ্রচর্চা খুবই দুর্বল। তাই বিশেষ
কথা বাড়াবো না। ওই যে শুরুতেই বললাম! উনি আমায় দেখলেন কিনা উনিই জানেন আর আমার জানাটাকে
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় রেখে দেন।
রবিঠাকুরের গল্পে আজকের সমাজ, শ্রেণীদ্বন্দ্বের
তীব্রতা ইত্যাদি কত বিলক্ষণভাবে আছে, তাঁর বিভিন্ন সংস্কার প্রকল্পনা, শিক্ষা-ভাবনা,
বিজ্ঞান-ভাবনা, কৃষি-ভাবনা ইত্যাদি আজ কত ব্যাপক প্রয়োগে প্রতিফলিত এসব বিষয়ে কিছু
বলার আমার ক্ষমতাই নেই।
আমি শুধু জানি ওঁকে বাদ দিয়ে প্রেয়সীকে (থুড়ি,
বৌকে) আজও তেমন করে ভালোবাসা যায় না, ওঁকে বাদ দিয়ে ছেলেমেয়ের সাথে বসে একসাথে গান
গাওয়া যায় না, ওনাকে বাদ দিয়ে দিদার চোখের জ্যোতি নিভে আসে। জীবন-সমুদ্রই হয়ে ওঠে দেবতার
গ্রাস।
আমার বাঁ জঙ্ঘায় তুলসী পাতার মত একটা দাগ আছে।
মা বলেছিলেন জন্মদাগ; সবার থাকে। ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলে বলতাম, ছবির নিচে যেমন ছবিকারের,
চিত্রকরের স্বাক্ষর – আমরা তো ঈশ্বরের সৃজন, তাই গায়ে ঈশ্বরের স্বাক্ষর ওই জন্মদাগ!
রবিঠাকুর আমাদের সাংস্কৃতিক জন্মদাগ। শুধু
বাঙালি নয়, একদিন বিশ্বের এই অনন্য প্রজাতান্ত্রিক সঙ্ঘের নবতর উত্তরণের সাংস্কৃতিক
জন্মদাগ হিসেবে চিহ্নিত হবেন রবিঠাকুর।
মনে হয় হাইপারবোল দিচ্ছি না। ভারতবর্ষ একভাষিক
মহাদেশ নয়, বহুভাষিক দেশ। তবু* দিন বদলের প্রেক্ষিতে আমাদের পরম সাথী রবীন্দ্রনাথ।
*পুরো ল্যাটিন এমেরিকায় যেমন হোসে মার্তি [মুদ্রিত
লেখায় বাদ]
২০১১ সালে শব্দহরিণ পত্রিকায় প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment