Thursday, August 28, 2025

বড় জামাইবাবু

জ্যোৎস্না সন্ধ্যায় তারা বেরিয়েছে। কাজল রাস্তা দেখিয়ে জামাইবাবুকে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল রেললাইনের ওপারে। যেমন নিজে শর্টকাটটা ব্যবহার করে রোজ। কিন্তু জামাইবাবু যেমন ধীর, শান্ত, সবার জন্য হাসিমুখ তেমনি ভিতরেও প্রসাদচিত্ত। বললেন, ছাড়ো ওসব শর্টকাট। কী সুন্দর সন্ধ্যা। চলো, এখান থেকেই রিকশা করে নিই।

সওয়ারি বলতে এক সাইকেল-রিকশাই ছিল সেসময়। গলি ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠে লেভেল ক্রসিং। সেটা পেরিয়ে ডানদিকে এগোলে আরো একটা ছোটো, সবসময় খোলা লেভেলক্রসিং পেরিয়ে তবে তেরাস্তা। তারপরেই ম্যাংগ্‌ল্‌স রোড। এমএলএ, এমএলসিদের বাড়ি, সার্কিট হাউজ, পাটনা ক্লাব, মিলার স্কুল, রবীন্দ্রভবন। সুন্দর, চওড়া পরিচ্ছন্ন রাস্তা। কোনো লোকজন নেই।

রিকশাওয়ালা জামাইবাবুকে বোঝাচ্ছিল কেন পূর্বদিকের লেভেলক্রসিংএর দিকে না গিয়ে ঘুরপথটা নিল। প্রচন্ড ভিড় থাকে ওদিকে, আর সবসময় বন্ধ।

কাজল মনে বলল, হুঁঃ, আর ভাড়াটাও বেশি পাওয়া যাবে। এখন সোজা অতটা দূরে গিয়ে আবার ডান দিকে যাবে সেই পূর্বদিকের লেভেলক্রসিং থেকে বেরুনো সোজা রাস্তাটায়। …” জামাইবাবু ওদিকে রিকশাওয়ালাকে তার মগহী-মেশানো ভাষায় সায় দিচ্ছিলেন, ঠিক করেছ। এই তো ভালো, বেশ শহরটা ঘুরতে ঘুরতে যাচ্ছি। ঘুরব বলেই তো বেরিয়েছি!

দুধারে বড় বড় গাছের কালচে-সবুজ উঁচুতে ওঠা ছড়ানের ফাঁক দিয়ে নদীর মত এপার ওপার দেখা যাচ্ছিল আলোয় ভরা আকাশ। হ্যাঁ, এখন সে এসব ব্যাপার দেখার লায়েক হয়ে উঠেছে আর সেই প্রসঙ্গেই তো জামাইবাবু তাকে নিয়ে বেরিয়েছে।

 

তবে অনেক বছর আগে সে যখন ছোটো, তার জ্যাঠতুতো তিন দাদা এসেছিল কলকাতা থেকে, মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে। তখন সে তাদেরকে তার নিজের মত করে শহরটা ঘুরিয়েছিল। এই একই পথে তারা এসেছিল, কিন্তু হেঁটে হেঁটে। হাঁটতে তার চিরকালই ভালো লাগে। তার মতে, না হাঁটলে ঘোরা হয় না, চেনাও যায় না কিছু। সেটাও এমনই জ্যোৎস্নায় ভরা সন্ধ্যা ছিল। আর দূর থেকে ভেসে আসছিল মিষ্টি স্বপ্নের মত একটা গান, কোথাও মাইকে বাজছিল তেরা মেরা প্যার অমর, ফির কিঁউ মুঝকো লগতা হ্যয় ডর। গানটা যেন সেঁটে রয়ে গেছে এমন সন্ধ্যার সঙ্গে। ম্যাংগ্‌ল্‌স রোডে ঢুকতেই মনে পড়ে গেল।

এবার জামাইবাবু মূলকথায় এলেন। বস্তুতঃ এই কথোপকথনটা সম্ভব করানোর জন্যই বাবা অথবা বাবা-মা দুজনেই বড় জামাইবাবুকে কলকাতা থেকে ডেকে আনিয়েছেন। কেননা বড় জামাইবাবু তার ভ্রাতৃস্থানীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বড়। বয়সেও, শিক্ষাতেও এবং পদমর্য্যাদাতেও। সবাই তাঁকে সম্মান আর শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। অথচ একফোঁটা গুমোর কখনো দেখেনি কেউ তাঁর চোখেমুখে। সদাহাস্যমুখ, সদালাপী। অবশ্য তার সেই পিস্তুতো দিদিও তেমনই বড় আর বিদ্বান অধ্যাপক। সেই দিদিকেও সবাই খুব সম্মান ও শ্রদ্ধা করে।

আর শুধু শ্রদ্ধা তো নয়, সবচেয়ে বেশি ভরসার মানুষ। কোনো কথায় বাবা-ছেলেতে বা মা-ছেলেতে মতবিরোধ হল, ব্যস, ডাকো তো গিরীশকে! ওই বোঝাতে পারবে।

এবারও সেভাবেই আসা। অথচ এত যে ভরসার মানুষটা, সে কিন্তু বাঙালি নয়। পিস্তুতো দিদির লাভ ম্যারেজ, মানুষটি হিন্দিভাষী, নাঃ, মৈথিলীভাষী। অথচ বাঙালি ঘরের আচার অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা পরিবার হয়তো এক হয়েছে কোথাও, কলকাতায়, পাটনায়, মুজফফরপুরে, গোলযোগ লেগেছে কী হবে না হবে, কিসের পরে কী হবে, ডাকো তো গিরীশকে? কোথায় গিরীশ?

 

এবার বল কাজল”, জামাইবাবু কথা শুরু করলেন, আচ্ছা দাঁড়াও, আগে বল কাছাকাছি কোনো সিনেমাহল আছে?

-       কেন?

-       আহা, বলই না।

-       হ্যাঁ, এই তো ডানদিকে গিয়ে পরপর দুটো সিনেমা হল। অশোক, পার্ল।

-       ভালো কোনটা?

-       ভালো তো অশোক।

-       আর সেটাই বেশি কাছে, তাই তো?

 -  হ্যাঁ।

-       ব্যস, তাহলে আমরা এখন সিনেমা দেখব।

-       এমা, অশোকে তো বাজে সিনেমা চলছে একটা।

-       কী চলছে?

-       গোমতী কে কিনারে

-       বাঃ, সে তো মীনা কুমারীর শেষ ফিল্ম, বাজে কেন হবে? দেখেছ?

-       নাঃ, এমনিতেও এসব ফিল্ম আমার ভালো লাগে না। আর তার ওপর, বন্ধুরা যারা দেখেছে, তারাও বলেছে, বোরিং।

-       চল না, দেখেই নিই। আপত্তি নেই তো?

-       না, চলুন।

-       আচ্ছা এবার বল, তুমি তো আজকাল চুটিয়ে লেখালিখি শুরু করেছ শুনলাম। পত্রিকাও নাকি বার কর। কী নাম পত্রিকার?

-       উন্মেষ

-       বাঃ, উন্মেষ, যথাযথ নাম। সাহিত্য ভালো লাগে?

-       হ্যাঁ যেটুকু পড়েছি বা পড়ি।

-       কী লেখ?

-       কবিতা, গল্প

-       বাঃ, খুব ভালো। কিন্তু, জীবনটা চালাতে হলে অন্য কিছুও করতে হবে তো। শুধু সাহিত্য করেও জীবন চলে, চলে না তা নয়। বড় বড় লেখকেরা অনেকেই সাহিত্য করে নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণ করেছেন। বিদেশে পথটা সুগম, এদেশে দুর্গম। তারপর, তুমি তো বাড়ির এক ছেলে। বাকি দুই বোন। পুরো সংসারটা তোমার বাবার ওপর।

-       অন্য কিছু করব না তা তো কখনো বলিনি! চাকরি তো খুঁজছিই। কয়েক জায়গায় আবেদনও দিয়েছি। টিউশনি করতাম। আবার করতে পারি।

-       তুমি ল ক্লাসে যাওয়া ছেড়ে দিলে। অডিট ফার্মে যাও কিন্তু অনিয়মিত। আর্টিক্লশিপ না কী বলে, সেটা করতে গেলে তো তৈরি হতে হবে, পরীক্ষার জন্য প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে।

-       ওসব আমার হবে না। ল-য়ের ইভনিং ক্লাসে স্টুডেন্টও ঘুমোয়, টিচারও ঝিমোয়। আর কমার্সের কোনো বিষয় আর পড়তে আমার ইচ্ছে করে না।

-       কমার্স তো তোমার সাবজেক্ট! আর তুমি তো ফার্স্ট ক্লাসে পাশ করেছ।

-       সে তো

 

গোলচত্বরটা এসে গিয়েছিল। হেঁকে রিকশাওয়ালাকে ডানদিকে যেতে বলল কাজল, অশোক সিনেমা জানা হ্যয়।

-       হ্যাঁ, কী বলছিলে?

-       নাঃ, কিছু না। কমার্স ভালো লাগে না আমার। আমি তো সাইন্সেই থাকতে চেয়েছিলাম। হয়েও গিয়েছিল। বাবা বলল অন্য ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া চলবে না

-       আচ্ছা, সেসব তো হয়ে গেছে। ঠিক আছে, ল করবে না, কোরো না। অডিটলাইনে যাবে না, যেও না। কিন্তু একটা কোনো দিকে এগোতে তো হবে!

-       আমার স্পষ্ট কথা, একটা চাকরি আমি নিশ্চয়ই করব। কিন্তু ব্যস, ঐ পর্য্যন্ত। তারপরে যেন তাড়া না আসে, ক্লার্ক কেন, অফিসার হ, ম্যানেজার হ । মোটামুটি নিজের, পরিবারের ভাতটুকু জোটাবো আর সাহিত্য করব। সত্যি যদি তেমন ভালো আর অনেক অনেক লিখতে পারি, তা থেকে আয় করতে পারি, তখন চাকরিটাও ছেড়ে দেব।

-       পরে আপশোষ হবে না তো?

-       না।

কিছুক্ষণের নীরবতা। রাস্তাটাও এমন, শান্ত, স্বল্পালোক! আকাশে জ্যোৎস্না। যেন ধমকাচ্ছে, আহ্‌, হচ্ছেটা কি? একটু চুপ করে থাকতে পারো না? নিঃশ্বাস নিতে পারো না জোরে জোরে, পরিষ্কার হাওয়ায়?

কাজল বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল অনেকক্ষণ। জামাইবাবুও নিচ্ছিলেন কিনা সে বুঝতে পারল না।

 

শো শুরু হয়ে গিয়েছিল। কাজলের বন্ধুরা ঠিকই খবর দিয়েছিল; হল ভরে নি। টিকিট কেটে দুজনে ঢুকে পড়ল। বিজ্ঞাপন আর খবর ইত্যাদির পর মনে হয় এক্ষুনি শুরু হয়েছে ফিল্মটা। মনে রাখার মত ফিল্ম নয়। আর সত্যি বলতে কি, তখনো অব্দি কাজল মীনা কুমারীর এক মেরে আপনে দেখেছে, আপনজনএর ছায়া দেবীর তুলনায় কিছুই নয়। আর পাকীজা দেখেছে, যাও বা মীনা কুমারীকে দেখত আর মনে রাখত, মাঝে মধ্যেই রাজকুমার এসে নিজের দেখনাই অভিনয় আর ডায়লগ ডেলিভারি দিয়ে কিছু মনে রাখাই অসহ্য করে দিয়েছে। সাহেব-বিবি-গোলাম টোলাম দেখেছে অনেক পরে। জামাইবাবু কী দেখলেন কে জানে, কাজল মুখ ভেটকে পড়ে রইল নিজের সীটে।

ফেরার সময়, ঐ একই পথে রিকশায় মিলার স্কুলের মাঠটা পেরোবার সময় জামাইবাবু ধীর গলায় বললেন, একটা কথা তোমায় দিতে হবে কাজলবাবু।

-       কী?

-       তুমি সিম্পলি একটা চাকরি করবে, প্রমোশন-টমোশন নেবে না, কোনো কেরিয়ার তৈরি করবে না, শুধু লেখালিখি, সাহিত্যচর্চা নিয়ে থাকবে

-       সেটাই আরো বাড়াবার চেষ্টা করব

-       হ্যাঁ । আরো গভীরভাবে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করবে যাতে একদিন চাকরিটাও ছাড়তে পারো। তাই তো?

-       হ্যাঁ।

-       কিন্তু কথা দিতে হবে, যে ঐ পথে তুমি সফল হও বা না হও আশীর্বাদ করি তুমি সফল হবে কিন্তু যদি কোনো কারণে সফল নাও হও

ঘুরে তাকালেন কাজলের দিকে।

-       কোনো দিন পিছন ফিরে তাকিয়ে আপশোষ করবে না। যে ঐ রকম করলেই ভালো হত, সেই রকম করলেই ভালো হত আপশোষ করবে না, আক্ষেপ করবে না। কিছুতেই না। কথা দিচ্ছ?

-       দিচ্ছি।

-       সত্যি?

-       একদম।

-       খুব তাড়াতাড়ি কথা দিয়ে ফেলছ কিন্তু, একটুও না ভেবে।

-       আসলে চাইলেই তো অনেক ভাবা যায় না! তবে নিজেকে যতটা বুঝি, কখনো কোনো কিছু নিয়েই আমি আপশোষ করি না। এটা নিয়ে তো করবই না।

-       তা, পাড়ার বা কলেজের কোনো মেয়ের সঙ্গে তোমার কখনো ভাবসাব হয় নি?

কাজল চমকে গেল। হঠাৎ করে এ আবার কী প্রশ্ন? ভালোবেসেছে নাকি কাউকে? মাথাটা কেমন যেন পাজল্‌ড হয়ে গেল। আছে কি একটা চিনচিন কষ্ট ভীষণভাবে নিজের একটা মুখ জিভের একটা জড়তা !

-       না।

-       ভালোবাসো। ভালোবাসাটাও যে দরকার। যাহোক, কথা যখন দিলে

হাত বাড়িয়ে কাজলের হাতটা নিলেন।

-       হাত মেলাও!

জামাইবাবুর হাতের তেলোটা বড়। শরীরটাও লম্বাচওড়া। দেখতে দারুণ সুপুরুষ।

 

-       আজকের সন্ধ্যেটা বড় সুন্দর কাটল, কাজলবাবু। ওই দেখ, ওই বাগানটা কেমন ছায়াসবুজ আভায় ভরে উঠেছে চাঁদের আলোয়। কী পার্ক যেন?

-       হার্ডিঞ্জ পার্ক।

কাজলের আবার মনে পড়ল, তেরা মেরা প্যার অমর। অনেক পরে দেখে জেনেছিল, ফিল্মটা তার প্রিয় হিরো দেবানন্দেরই ফিল্ম। গানটায় ঠোঁট দিয়েছে সাধনা।

-       আপনি কার্নেশন ফুল দেখেছেন জামাইবাবু?

-       না তো! কেমন হয়?

-       হাল্কা সোনালি। আর ছোট্টো গাছটায় খুব সুন্দরভাবে হয়। এই হার্ডিঞ্জ পার্কেরই এক বুড়ো মালি চিনিয়েছিল। একটা ইংরেজি গল্পে প্রথম পড়েছিল কার্নেশন নামটা। কেউ কাউকে উপহার দিচ্ছে এক গুচ্ছ কার্নেশন। তাই জানতে চাইছিলাম কেমন দেখতে। কী যেন নাম ছিল পত্রিকাটার? ভুলে যাচ্ছি। ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে বসে পড়েছিলাম।  

-       সিনেমার নামটা মনে রেখ। যখন বুড়ো হবে

-       বুড়ো হব?

-       বলেছি তো তোমার আয়ু আছে। হাত দেখে বলি নি? বাহাত্তর বছর আয়ু দেখাচ্ছে তোমার হাতের রেখা। যাহোক, তখনও মনে রাখবে যে মীনা কুমারীর শেষ ফিল্ম গোমতী কে কিনারে দেখে ফিরে আসার সময়, তুমি তোমার জামাইবাবুকে কথা দিয়েছিলে। জীবনে আক্ষেপ করবে না।


ইয়ারপুরের লেভেলক্রসিং বন্ধ ছিল। অনেকক্ষণ রিকশায় বসে থাকার পর জানলার আলো ঝলমলিয়ে হুড়মুড় করে আপ লাইনে কোন ট্রেনটা গেল বুঝতে পারল না। একটু পরে ডাউনে গেল চেনা ট্রেন, পার্সেল এক্সপ্রেস। আরএমএস থেকে চিঠি তুলবে। অদ্ভুত ট্রেনটা, কোনো জানলা নেই, বা খোলা নেই। মানুষ দেখা যায় না বলে ভুতুড়ে, রহস্যময় মনে হল, আজও।  

 

২০.৮.২৫     

শেষ বক্তা

ডিবে খুলে ওষুধের পাতাটা হাতে নিয়ে দীপক ধর অবাক হয়ে গেলেন। এরকম কেন? তুবড়ে, মুচড়ে, মুড়ে রাখা? তখন মনে পড়ল রাতে ভুল করে পাতা ছিঁড়ে এই ওষুধটা বার করে ফেলেছিলেন। এটা তো সকালের ওষুধ! তাই ছেঁড়া খোপে ঢুকিয়ে পুরো পাতাটা আষ্টেপৃষ্ঠে লপটে দিয়েছিলেন যাতে পড়ে না যায়। এখন আবার হাতে নিতে গিয়ে সত্যিই ফস্কে পড়ে গেল মেঝেয়। দূর! এক জ্বালা! যাহোক, খাটের তলায় গড়ায় নি, সামনে পড়ে আছে। মেঝেটা পরিষ্কার, তুলে, বেসিনে গিয়ে একবার জলে ধুয়ে মুখে পুরে দিলেন। বাঁ হাতের বোতল থেকে মুখে জল নিয়ে গিলে ফেললেন। এবার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওষুধদুটো। না পড়ে গেলে, তিনটেই বার করে একবারে গিলতেন, যা প্রতিদিন করেন।  

ফোনটা বেজে উঠল। পুনা থেকে বাচ্চু। পুরোনো বন্ধু। আজকাল প্রায় রোজই ফোন করে এইসময়।

-       গুডমর্নিং। কী করছিস? বাজার থেকে ফিরলি?

-       হুঁ।

-       কী মাছ?

-       আরে দূর! তোদের মত হাইফাই বাঙালিয়ানা নেই আমার, যে রোজ মাছ খেতে হবে। আর বাড়িতে সবার মাছ নিয়ে অত লাফানি নেই। রেলগেটের বাজারে যাই, একটু সব্জি নিয়ে আসি।

-       কী আনলি?

-       ভাদ্র মাস। এক তো মাত্র কয়েকটি সব্জি, তার ওপর দাম! ছোটোবেলায় জানতাম ভাদ্রমাসে লাউ খায় না। আজকাল আর সেসব কথা অচল। ট্রাকের পর ট্রাক ভরে চালান আসে, দিব্যি বিক্রি হয়ে যায়। অবশ্য সেটা রামদেব-বাবারও কল্যাণে। কেউ রস খাচ্ছে, কেউ কাঁচা চিবোচ্ছে

-       লাউ খেতে ভাল্লাগে তোর?

-       হ্যাঁ ভাই, ভালো লাগে, তবে রেঁধে। এখন, মায়ের হাতের লাউ-মুগ আর কোথায় পাবো? আর মাসির হাতের, দুধের ছিটে দিয়ে কালোজিরে ফোড়ন, ফর্সা লাউ? তবু যা হয়।

-       কাল গিয়েছিলি? কোথায় বলেছিলি যাবি? ব্রাহ্মসমাজে না কোথায় ? ধম্মোকম্মো শুরু করেছিস নাকি শেষ বয়সে? ভালো ভালো!

 

পরশু রাতে রাতভর বৃষ্টি হয়েছিল। কাল দিনেও সেটা চলেছে সন্ধ্যা অব্দি। রাতটা তাই ঠাণ্ডা ছিল আর মশা কম। এখন কড়কড়ে জ্বালাধরানো রোদ্দুর উঠেছে। ভাদ্রোৎসবের একটা নিমন্ত্রণ ছিল গতকাল। একবার ভেবেছিলেন যাবেন। ব্রাহ্মসমাজ স্থাপিত হয়েছিল এই দিনে। সে সুবাদে রামমোহন বিষয়ে কিছু বলবেন। কিন্তু পরে আর ইচ্ছে হল না। সেই পুরোহিত বসবে, বেদ পাঠ হবে, পুরোপুরি ধার্মিক অনুষ্ঠান টাইপের ব্যাপার, সেখানে একেশ্বরবাদ যে নিরীশ্বরবাদএর আগের ধাপ, আর রামমোহন যে আধুনিক ভারতের প্রাক্কালে ধর্মের প্রথম সমালোচক, এবং ধর্মের সমালোচনা যে সব সমালোচনার প্রারম্ভ এসব কথা বলার পরিবেশ থাকবে না।

আর যাওয়া মানেও তো অনেকটা পথ ঠেঙিয়ে। একটা অটো ধরে রাজেন্দ্রনগর পুলের পাশে পায়েহাঁটা পুলের নিচে নামো, পুল পেরিয়ে আবার ওদিকে একটা টোটো ধরো, মছুয়াটোলি নামো, তারপর জলকাদায় হেঁটে যাও স্কুল অব্দি। সেখানেই অনুষ্ঠান। পুল পেরোবার পর পুরোটা রাস্তা এত বেশি স্মৃতিভারাক্রান্ত যে কেমন অসাড় হয়ে পড়ে ইন্দ্রিয়গুলো। পুরোনো মানুষগুলো কেউ নেই। নতুন যারা আছে, তাদের পুরোনোর সঙ্গে যোগ ক্ষীণ। তার জন্য তারা দায়ীও নয়। সময়টাই বদলে গেছে। স্মৃতির চাপও কি কোনো ধরণের ডিসফাংশনাল এ্যাট্রফি তৈরি করে চেতনায়?

ফোনে বললেন, না, যাই নি।

-       ভালো করেছিস। এই বয়সে বেশি ঘোরাঘুরি করিস না। নিজের লেখালিখি নিয়ে থাকনা বাপু!

-       হ্যাঁরে শালা, তাই করি। আমাকে জ্ঞান দেয়। নিজে কটা নাটক নামাতে পারলি ওখানে একবছরে?

-       করছি, করছি, কাজ চলছে সময় মত খবর পাবি।

-       রাখছি ফোনটা। ভালো থাকিস সবাই।

সেদিনও বলেছিলেন একটা সভায়। উই হ্যাভ নট ওনলি লস্ট দ্য ন্যারেটিভ-ওয়ার, উই আর লুজিং দ্য ন্যারেটিভ ইটসেলফ! আমরা শুধু আখ্যান-যুদ্ধ হারি নি, আখ্যানটাও হারিয়ে ফেলছি। এখন বলবে, হারিয়ে ফেলছি মানে কী? হারিয়ে ফেলছি মানে একটা অবিশ্বাসী যান্ত্রিকতায় মনে রাখছি আর তোতাপাখির মত আওড়াচ্ছি। অথচ জীবনযাপনে তার চিহ্নগুলোও ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে।

এমন নয় যে আমি একাই এটা ভাবছি। অনেকেই ভাবছে আর তাই তো লড়াইটা এগোচ্ছে সারা দেশে। এক একটা বিষয় নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চালাচ্ছে সাথীরা। কোথাও কোনো ছাড়ান নেই। নৈরাশ্যেরও কোনো জায়গা নেই, নৈরাজ্যেরও কোনো জায়গা নেই। নতুন নতুন মুখ এগিয়ে আসছে। তাদেরকে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আখ্যানটার পুনর্নির্মাণের চেষ্টা চলছে। যান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা চলছে।

স্নানে যেতে যেতে মাথায় ঝিলিক দিয়ে গেল পুরোনো দিনের একটা ছবি। এভাবেই আসতে থাকে আর হারিয়ে যেতে থাকে। না, তারা বাস্তব হয়ে ওঠে না কখনো। হয়তো কিছু দিন পরে তাও হবে! প্রযুক্তি যেভাবে এগোচ্ছে, বা বলা উচিৎ, পৃথিবীর শাসনে ধনপশুদের আধিপত্যে যেদিকে এগোচ্ছে, কাল হয়তো সর্বোচ্চ মুনাফা সেই শিল্প দেবে, যেটি তোমার মৃত স্ত্রীকে আভাসি জীবন দিয়ে বসিয়ে দেবে তোমার সামনে সন্ধ্যায়; তুমি তার সঙ্গে বসে চা খাবে, কথায়-গানে মাতবে কিছুক্ষণ, হয়তো আভাসি সম্ভোগে কাটাবে রাত ভোর রাতে সে অদৃশ্য হয়ে যাবে! কোথায় যাবে? ওই স্মৃতিঘন অনস্তিত্বের সমুদ্রে, যেমন সোলারিসএ দেখিয়েছিলেন লেখক ও পরে চিত্রপরিচালক!

ইতিমধ্যে একটি সংস্কৃতি তো এসেই গেছে। পরিবারের মৃত বয়স্য, বাবা, মা বা তেমনই প্রিয় কোনো মানুষের লাইফ-সাইজ প্রতিমা বসিয়ে রাখা হচ্ছে ঘরে। কাল স্ত্রী বা স্বামীর প্রতিমাও রাখা যেতে পারে, তাও আবার প্রস্থেটিক সামগ্রী দিয়ে তৈরি! মার্কোয়েজের উপন্যাসে বুয়েন্দিয়া পরিবারের একজন সদস্য, কী নাম যেন? উন্মাদ বলে বসিয়ে রাখা হতো ঘরের বাইরে বাঁধা থাকতো বোধহয় আর সারাক্ষণ সে মৃত কোনো বয়স্যের সঙ্গে কথা বলতো। বাংলায় তো অনেক আগেই একটা বই লেখা হয়েছিল মৃতের কথোপকথন

কে যেন লিখেছিলেন? খালি গায়ে কাঁধে গামছা ফেলে স্নানঘরের দিকে যেতে যেতে দীপক থেমে গেলেন। এক্ষুনি না জানলে যেন স্নান করা যাবে না! এটাও প্রযুক্তি-জনিত রোগ। অর্থাৎ ওষুধ আবিষ্কারের পরে সংক্রামক হয়ে ওঠা রোগ। মার্ক্স বলেছিলেন না, আমাদের মাথায় সেই সমস্যাটাই জাগে যার সমাধান বর্তমান! ? এটা তারও বেশি! সমাধান-প্রসূত সমস্যা! স্নানঘর থেকে বেরিয়ে ঘরে ফিরে গেলেন, মোবাইলটা হাতে নিয়ে গুগল সার্চে লিখলেন, মৃতের কথোপকথন। উইকিসোর্সে দেখলেন, নলিনীকান্ত গুপ্ত

বস্তুতঃ স্মৃতিকে মুক্ত করাও একটা কাজ, শাওয়ারের নিচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে শরীরে জলধারার স্পর্শ উপভোগ করতে করতে ভাবলেন দীপক। আখ্যান-যুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ স্মৃতিকে রক্ষা করা। স্মৃতির ওপর আক্রমণ প্রতিহত করা। স্মৃতি যদি শুধু অতীতে আটকে থাকে তাহলেই বাঁধন হয়ে যায়। সামাজিক স্মৃতি, গণস্মৃতিকে মুক্ত করার কাজ তো লোকে করে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র, আম্বেদকর প্রত্যেকের ওপর প্রতিনিয়ত আক্রমণ চলছে, সূক্ষ্ম আক্রমণ, হোয়াটসঅ্যাাপে, ফেসবুকে সে আক্রমণ প্রতিহত করতে সবাইকে দেশের বর্তমানের প্রাসঙ্গিকতায়, চর্চায় রাখা জরুরি! এমনকি, ছবিতে মালাপরানো, সামনে ধুপ জ্বালানোও জরুরি; সব মানুষ তো আর বুদ্ধিজীবী নয়! এ পথেই গণস্মৃতিকে রক্ষা করা যায়, আক্রমণ প্রতিহত করা যায়।

ব্যক্তিগত স্মৃতিগুলোকে কি নিয়ে আসা যায় এই যেমন অতীতে জীবনে আসা মানুষগুলোকে জীবনের আজকের প্রাসঙ্গিকতায়? না আনতে পারলে যে নিজের বিষয়ে মাঝে মধ্যেই মনে হতে থাকবে নিছক ফাউ বেঁচে আছি আরো কিছু দিন, মৃত্যুর অপেক্ষায়? হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে, রোজ নয়। কাজে, আন্দোলনে, সভায়, মানুষের প্রয়োজনে যতক্ষণ তিনি ব্যস্ত থাকেন, বর্তমানের অংশ হয়ে থাকেন। কিন্তু সে ব্যস্ততা কমে গেছে অনেক। প্রথমতঃ স্বেচ্ছায়, তারপর এদিকে কিছুটা কোভিডের দৌলতে আর অবশ্যই কিছুটা বয়সের কারণে। সেভাবে এখন আর দীপক আগেকার মত উৎসাহের সঙ্গে কোনো সাংগঠনিক দায়িত্ব বহন করতে চান না। সেসব কারণেই, নিজের ব্যক্তিগত দিনচর্যায় ফিরে এলেই বন্দি স্মৃতিগুলো চিৎকার করতে থাকে ভিতরে, মুক্ত করো! সুখস্মৃতির একরকম চিৎকার, দুখস্মৃতির আরেকরকম।

এগারোটার মধ্যে হলে পৌঁছোনোর কথা। একটা জয়েন্ট ট্রেড ইউনিয়ন কনভেনশন। এখন আর তিনি কোনো সংগঠনে কোনো দায়িত্বে নেই, নিছক প্রাক্তনী। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, কিছু খেয়ে যাবে না?

-       একটু আগেই তো জলখাবার খেলাম।

-       তাও, স্নান করে কিছু মুখে দিয়ে যাওয়া ভালো।

-       একটু চা থাকলে দিয়ে দাও।

-       ওষুধ খেয়েছ?

-       হ্যাঁ, ওষুধ খেয়েছি, জলের বোতল, মোবাইল আর পয়সা, তিনটেই নিয়েছি।

এক অটোতে সোজা স্টেশন। আরেক অটোতে গান্ধী ময়দান। হলে ঢুকে পেছনে বসতে যাচ্ছিলেন, মাইকে প্রকাশকে তাঁর নাম ধরে বলতে শুনলেন, অনুরোধ করছি তিনি মঞ্চে আসুন। একটি ছেলে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এল। হাত ধরতে যাচ্ছিল, হাত মিলিয়ে ছাড়িয়ে নিলেন; এতটাও বুড়ো আর অক্ষম হয়ে যান নি। বরং জোর কদমেই মঞ্চের বাঁদিকে পৌঁছে তিন ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠে পিছনের সারির চেয়ারগুলোর একটায় বসে পড়লেন। আশেপাশে সবাই পরিচিত, অনেকে অভিবাদন করলেন, তিনিও অভিবাদন করলেন অনেককে। দুজন এসে ব্যাজ পরিয়ে হাতে একটা ফাইল দিয়ে গেল। চেয়ারের পাশে একটা ছোটো জলের বোতল রেখে গেল।

হল পুরো না ভরলেও উপস্থিতি মোটামুটি ঠিক আছে। আশা, আঙ্গনবাড়ি কর্মীদের জমায়েতটুকু বাদ দিলে, মহিলাদের সংখ্যা এখনো খুব কম। এ ধরণের জয়েন্ট কনভেনশন না হয়ে কোনো একটি সংস্থার কর্মচারিদের সাংগঠনিক আয়োজন যদি হয় তাহলে অনুপাতে বেশি থাকে সেখানকার মহিলা কর্মচারিদের উপস্থিতি। ১৯৯১এর পরের যুগটায় সমাজের সবক্ষেত্রে মহিলাদের এগিয়ে আসাকে নব-উদারবাদ’, তাদের হাত ধরে আসা প্রযুক্তি ও নতুন অর্থনীতির কৃতিত্ব বলে দাবি করে। সত্যিই কী তাই? আর বাস্তবে কতটা বেড়েছে?

হাতে মোবাইল থাকলেই হাতটা নিশপিশ করে। টাইপ করলেন, ফিমেল ওয়র্কফোর্স পার্টিসিপেশন ইন নাইন্টিন নাইন্টিজ যাঃ, বাড়া দূরের কথা, এআই তো বলছে প্রথম দশ বছরে কমে গিয়েছিল! নাঃ, ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে হবে। এখানে বসে হবে না। তবে কিছুটা বেড়েছে নিশ্চয়ই। তার সবচেয়ে বড়ো পরিমাপ তো তাদের ওপর বাড়তে থাকা হিংসা! সেটাও কি ক্রমবিকাশমান উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে পুরোনো উৎপাদন সম্পর্কের সংঘাতের অংশ নয়? আবার হলের দিকে তাকালেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রে সংগঠন তৈরির কাজ এখনো কত পিছিয়ে আছে এখানে! কত ধরণের শ্রমিক-কর্মচারি এখানে জাস্ট নেই!

প্রধান বক্তার সুর ধরে প্রায় সবাই নিজের নিজের সেক্টরের সমস্যা দিয়ে শুরু করে চলে আসছিল চারটে লেবার কোড প্রসঙ্গে। কয়েকজন, যারা একটু বিশদে জানে, লেবার কোডের কয়েকটি নিয়ম বা ধারার সঙ্গে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার কয়েকটি ধারার বিপজ্জনক পারস্পরিক সম্পর্কটাও দেখাচ্ছিল। কিভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করার, হড়তালে যাওয়ার, এমনকি দ্বিপাক্ষিক বার্তায় বসার, এতদিনকার চেনা অধিকারগুলোরই কন্ঠরোধ করা হচ্ছে সেকথা বলছিল। লেবার কোড এখনো বলবৎ করে নি সরকার সে ফাইল খুলে ভিতরে দেওয়া ছাপা ঘোষণাপত্রটা পড়তে লাগল।

মাইকে তখন একজন বলছে যে লেবার কোড বলবৎ হলে আমরা মালিক আর কর্তৃপক্ষের গোলাম হয়ে যাবো। আরে দূর! হ্যাঁ, বল্‌ যে শিকলগুলো কষে যাবে! দশকের পর দশক লড়াই করে যে অধিকারগুলো হাসিল করেছি, সেগুলো সব ছিনিয়ে নেওয়া হবে। সব মালিককে মনে করা হবে সৎ, শ্রমিকেরাও তাদের দিকে আঙুল তুলতে পারবে না, সরকারের নজরদারিও আর থাকবে না। যত পাহারা থাকবে শ্রমিকের ওপর! তাবলে কি আমরা এখনো গোলাম নই? শুধু আর্থিক সম্পর্কের আক্ষরিক অর্থে নয় ভাবার্থেও! মনের গোলামিটাই যে এখনো কাটিয়ে উঠতে পারি নি! দেশের বিশাল জনসমষ্টি, শ্রমিক-কৃষক, আপামর শ্রমজীবী মানুষ, শাসকশ্রেণীর সাংস্কৃতিক আধিপত্যে প্রভাবিত গোলাম না হলে কি এমন একটা সরকার গঠিত হতে পারত যে এধরণের লেবার কোড, এধরণের ন্যায় সংহিতার কথা ভাবতে পারে? সংসদে আনতে পারে এবং সেটা গৃহীত করাতে পারে? শিকল তো একটাই। মজুরির গোলামির। তাতে নানান রঙ চড়িয়ে এমন ভেদের রাজনীতি চালাচ্ছে শাসকেরা যে সবাই নিজের নিজের শিকলের রঙের বাহারেই মত্ত! এখন সেই শেকলে লেবার কোডের নামে আর যা কিছু হবে সেসব নিজের জায়গায়।

আসল ফাঁদটা থাকবে যে ঐ যে আজকাল স্মার্ট ঘড়ি বেরিয়েছে! পরলে হৃদপিন্ডের গতি, রক্ত চলাচল, কয় কদম হাঁটলাম সব বলে দেয়! তেমনই একটি ঘড়ি হবে লেবার কোডের কয়েকটি ধারা আর সম্পর্কিত ন্যায়সংহিতার ধারা। একজোট হয়ে কোনো সঙ্গত পাওনা বা অধিকারের কথা বলার উদ্যোগ নিচ্ছে শ্রমিকেরা এমন সিগন্যাল ঘড়িটা পাঠালেই সেটা গুঁড়িয়ে দিতে তক্ষুনি একত্রে প্রস্তুত হতে পারবে শ্রমমন্ত্রকের সংস্থাগুলো, পুলিস, আর বিচারব্যবস্থার শ্রেণীগত আঁতাত! বস্তুতঃ লেবার কোডের সবচেয়ে সাংঘাতিক ফলশ্রুতি হবে ঐ আঁতাতটা। এখনও আছে, তবে লুকিয়ে চুরিয়ে। কোড বলবৎ হলে ঐ আঁতাতটাই হবে নিয়ম।

যা হোক । বহুক্ষণ হয়ে গেছে। ধার্য সময় ছাড়িয়ে সবাই দীর্ঘ বক্তব্য রাখছে। পাশে বসা খুর্শিদজি তার হাঁটুতে হাত ছুঁইয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। কী হল? খুর্শিদজি সামনের সারির একটা চেয়ারের দিকে ইশারা করলেন। দীপক দেখলেন, প্রধান বক্তা ঘাড় ঘুরিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করছেন, কেমন আছেন? প্রধান বক্তা কমরেড নিয়োগী তাঁর যথেষ্ট পরিচিত এবং তাঁর চেয়ে বয়সেও যথেষ্ট বড়। তবে এখনো পুরোদস্তুর সক্রিয়। সুস্থতা ধরে রেখেছেন। উঠে গিয়ে হাত মিলিয়ে এলেন, বললেন ভালো আছি। সুস্থ তো তিনি নিজেও, কিন্তু বেশি বয়স অব্দি প্রধান নেতৃত্বে থাকার প্রবল বিরোধী। বস্তুতঃ, সঙ্গে চলা কোনো বড় নেতাকে পদ ছাড়তে আগ্রহী না করাতে পেরেই দীপক ঈষৎ ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের সব পদ স্বেচ্ছায় ছেড়ে, বলা যায় জোর করে নতুনকে বসিয়ে সরে গিয়েছিলেন। তার জন্য তাঁকে কথাও শুনতে হয়েছিল। কিন্তু, আখেরে তাঁর বিচারবুদ্ধি ফল দিয়েছে। ঐ নতুনের নেতৃত্বেই সবার চোখের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে তাঁর সংগঠনটা আরো অনেক বলিষ্ঠ আর প্রসারিত হয়েছে।

হলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন আদ্ধেক হল খালি, সবাই খেতে চলে গেছে। যাওয়ারই কথা, অনেকেই দূর দূর থেকে এসেছে। আর সুযোগ বুঝে আগে খেয়ে বাইকে স্টার্ট দেওয়া মানুষগুলো কয়েকজন তো থাকেই। এবার খুর্শিদজিকে বলতে ডাকা হল; মার্কেন্টাইলের পুরোনো নেতা। তাঁর পাশ থেকে উঠে গেলেন। সামান্যই বললেন। কতজন বাকি আছে আর? দীপক ফাইলটা পড়ায় মশগুল ছিলেন, খেয়ালও রাখেন নি। খুর্শিদজি মাইক ছেড়ে আসার পরেই শুনলেন, সভাপতি রায়জি তার নাম ধরে বলছেন, আজকের কনভেনশনের শেষ বক্তা ধর-দা, আমাদের বরিষ্ঠ নেতাদের একজন। তাঁকে ডাকার আগে আমি এই ডিক্লেয়ারেশন, বিবৃতিটা সম্পর্কে, শুরুতেই এটা পড়া হয়েছিল, আপনাদের রায় জানতে চাইছি, সবাই সমর্থনে আছেন তো? যে যে সমর্থনে আছেন, হাত তুলুন।

দীপকও হাত তুললেন। হাত নামান। কেউ বিরুদ্ধে আছেন? হাত তুলুন। একটাও হাত উঠল না। সর্বসম্মতিক্রমে এই বিবৃতি গৃহীত হল। এবার (সভাপতি তাঁকে ইশারা করলেন মাইকের সামনে যেতে) শেষ বক্তা, কমরেড দীপক ধর। অনেকেই খেতে চলে গেছেন দেখতে পাচ্ছি। যাঁরা আছেন, দুমিনিট ধৈর্য ধরে বসুন। বক্তাকে অনুরোধ করছি, সংক্ষেপে নিজের শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য শেষ করুন।

কথাটা চাড়াক দিয়ে লাগল ভিতরে। কথাটা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কানে কানেও বলতে পারতেন। বা আগে থেকেই সবাইকে বক্তব্য সংক্ষেপ করতে বলতে পারতেন। শুধু তার বেলাতেই সংক্ষেপে শুভেচ্ছা? এই রায়জির উদাহরণ দিয়েই রাজ্যের অন্যান্য অনেক কর্মচারি নেতা অবসর নেওয়ার পরেও বছরের পর বছর পদ আঁকড়ে বসে আছে। মাইকে হিন্দিতে গুনে তিনটে লাইন বললঃ এক, সম্বোধন সভাপতি মহোদয়, মঞ্চে উপবিষ্ট প্রধান অতিথি এবং অন্যান্য বিশিষ্ট অতিথিগণ, বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ব এবং সমবেত সাথীগণ; দুই, আজকের এই কনভেনশনের পূর্ণ সফলতা কামনা করি এবং আপনাদেরকে অভিনন্দন ও লালসেলাম জানাই; আর তিন, ইনকলাব জিন্দাবাদ, শ্রমজীবী ঐক্য জিন্দাবাদ। 

সমাপ্তি ঘোষণার পর আর দাঁড়ান নি। সোজা খাওয়ার জায়গায় চলে এসেছিলেন। না খেয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। কেউ না কেউ দেখে নেবে আর ধরে ফিরিয়ে আনবে। লাইনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণে নিজের খাবারটা নিয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে খাচ্ছিলেন। হঠাৎ মুখ তুলে দেখলেন সামনে কমরেড নিয়োগী আর রায়জি। আপনি তো আগেই দেখছি এসে শুরু করে দিয়েছেন! রায়জি ফোড়ন কাটলেন। তিনিও ছাড়লেন না, কী করব কমরেড? শেষ বক্তা বলে কি শেষ ভোক্তাও হব? তবে এখানে আপনার সভাপতিত্ব চলবে না, এই দেখুন, সংক্ষেপে সারছি না, পাপড়টাও ডবল নিয়েছি। নিয়োগীদা, আপনার স্বাস্থ্য ভালো আছে তো?

-       দেখে কেমন মনে হচ্ছে?

নিয়োগীদার দুআঙুলের ফাঁকে ধরা সিগরেটটার দিকে ইশারা করে বললেন, সিগরেটটা চালিয়ে যাচ্ছেন!

-       কেন? আপনি ছেড়ে দিয়েছেন?

-       হ্যাঁ।

-       স্বাস্থ্যচিন্তা?

-       বলতে পারেন। তবে ক্যান্সার-চিন্তা নয়। দেখলাম নিশ্বাস-প্রশ্বাস ভালো থাকে আর তাতে সারাদিনে কাজ করার ক্ষমতা, মানে আমি সবার কথা জানি না, নিজের ক্ষেত্রে অনুভব করি যে কাজ করার ক্ষমতা বেড়ে যায়। তাই।

-       তা কী করছেন আজকাল?

-       ব্যস, মেইনলি পড়াশুনো, লেখালেখি। মাঝে মধ্যে এধরণের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ।

হলের পিছনে খাবার জায়গা। সামনে বারান্দা। বারান্দার এক পাশে অফিস। একাউন্টেন্ট সাহেব বসে কাজ করছ্রন। সামনে একটা টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে বুড়ো মিসিরজি এবং আরো কয়েকজন। দীপক মিসিরজির দিকে এগিয়ে গেলেন, কি মিসিরজি, চিনতে পারছেন? মিসিরজি আগের মতই উদাসীন, নিস্পৃহ গলায় বললেন, রোজই তো একশোখানা মানুষ আসছে, কাকে কাকে চিনে রাখবো, বলুন? বলতে বলতেও তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঘুরল দীপকের মুখের ওপর।

-       হুম, চিনছি , বিজয়বাবুর সঙ্গে আসতেন হল বুকিং করাতে।

-       হ্যাঁ, নিয়মিত এসেছি কুড়ি বছর! এদিকে আসা হয় নি, রিটায়ার করে গেছি যে।

-       আমিও আজকাল আর বসি না। আমার বয়স তো আপনাদের চেয়ে অনেক বেশি। আর পোষায় না। আজকাল আমার ভাগ্নে দেখে, এই যে

বলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছোকরাকে হাঁক দিলেন।

-       এর নাম চুন্নু, চুন্নুজি। এর মোবাইল নম্বরটা লিখে নিন। আজকাল তো সবকিছু ঐ মোবাইল আর হোয়াটস্যাপেই হয়। ফোন করলে জানিয়ে দেবে হল খালি পাওয়া যাবে কিনা। বা, কবে খালি আছে। এডভান্সও ঐ ফোনে ফোনেই পেমেন্ট করে দিতে পারবেন, এই যে কিউআর কোড।

বলে, টেবিলে রাখা রেজিস্টারের নিচে চাপা পড়া প্লাস্টিকের স্ট্যান্ডটা খাড়া করে রাখলেন মিসিরজি। দীপক আর বললেন না যে হল বুকিংএর দরকার তাঁর আর পড়ে না। খোঁজ রাখারও দরকার পড়ে না, শহরের হলগুলোর কোনটার ভাড়া এখন কত, কন্ট্যাক্ট নম্বরটা কী, কোনটার কত ক্যাপাসিটি, খাওয়ার জায়গা ঠিক মতো আছে কি নেই। অবশ্য শহরটারই খোঁজ রাখার আর দরকার পড়ে না! একদিকে ঝাঁচকচকে হয়ে উঠতে চাইছে অন্যদিকে আরো বেশি করে ঘাড় গুঁজছে গাদিপচা গন্ধের তীব্রতায়। ও মা, তাই নাকি! বাঃ, দিন চুন্নুজি বলে নিজের মোবাইলটা বার করে চুন্নু নামে ছেলেটির মোবাইল নম্বর সেভ করে নিলেন।

গেটের কাছে হঠাৎ পিছন থেকে ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন দীপক। খেয়ালই ছিল না তাঁর ফাইলটা চেয়ারে ছেড়ে গেছে। সেটাই এখন একজন উদ্ভিন্ন যুবক নিয়ে আসছে জোর কদমে। কাছে এসে ফাইলটা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি তো কঙ্কড়বাগেই থাকেন! না?

-       আরেকটু এগিয়ে? আপনি?

-       হাউজিং কলোনিতে। আমাকে আপনি বলবেন না।

-       ঠিক আছে। বাঃ তাহলে তো খুব দূরে নয়।

ছেলেটির ফিরে যাওয়ার দিকে অন্যমনস্ক চেয়ে থাকতে থাকতে দীপকের আবার মনে পড়ল সকালে ভাবতে থাকা কথাটা। ন্যারেটিভ ওয়ার চলতি আখ্যান-যুদ্ধটার কথা। ডাকলেন ছেলেটিকে।

-       তোমার নাম কী?

-       সুজিত। সুজিত কুমার।

-       কিসে আছো?

-       হেল্‌থে, রাজ্য সরকার  

-       ট্রেড ইউনিয়ন করো? পুরোদমে?

-       আপনাদের সময়টা তো আর নেই। যেটুকু পারি করি!

-       ভালো লাগে?

-       হুঁ, হকের লড়াইয়ের কাজ, ঐক্যের জন্য কাজ  ভালো লাগালাগির ব্যাপার তো নয়! প্রতিদিনকার দরকার।

-       বাঃ, ফোন নম্বরটা বল তো তোমার!

 

ছেলেটি বলছিল, দীপক নিজের মোবাইলে টিপছিলেন। রিং করলেন। ছেলেটির পকেট বেজে উঠল।

-       সেভ করে নাও। আমিও সেভ করে নিলাম। এস বাড়িতে একদিন। একসঙ্গে বসে চা খাবো, গল্প করব। আপত্তি নেই তো?

-       এতে আপত্তি কেন থাকবে? নিশ্চয়ই আসব।  

বলে, হেসে চলে যাচ্ছিল ছেলেটি। দীপক পিছন থেকে আবার হাঁক দিলেন, এস কিন্তু!

২৮.৮.২৫