ভূমিকা
পরের পৃষ্ঠাগুলোয় কৃষক সভার স্মৃতি-সম্বলিত যে সঙ্কলনটি
পাবেন সেটি লেখা হয়েছিল হাজারিবাগ কারাগারের চারদেয়ালের ভিতর। ১৯৪০ সালের দীর্ঘ কারাগারবাসের
আগেই বন্ধু এবং সাথীরা বার বার অনুরোধ করেছিল যে আমি যেন এই স্মৃতিচারণ অবশ্যই
লিপিবদ্ধ করি। ধরা হয়েছিল যে আমিই এ বিষয়ে লেখার অধিকারী কেননা কৃষক সভার সাথে
আমার কুড়ি বছরের অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক। এটাও সত্যি যে এ বিষয়ে নানা ধরণের অভিজ্ঞতা
সবচেয়ে বেশি আমারই হয়েছে। সেসব অভিজ্ঞতা যে বেশ মজার সেটা এই সঙ্কলন পড়লে বোঝা
যাবে। কাজেই, অভিজ্ঞতাগুলো কাগজে-কলমে বন্দী করতে আমিও আনন্দ পেয়েছি। কারাগারের
বাইরে সময়ের অভাব। তাই কারাগারে বসেই বন্ধুদের ইচ্ছা পুরো করতে হল।
জমিদারদের খবরের কাগজগুলো মাঝে মাঝে আমায় জ্ঞান দেওয়ার
চেষ্টা করেছে। দীর্ঘ উপদেশ বর্ষণ করেছে যে রাজনীতি করা সন্ন্যাসির কাজ নয়। এতে
পাপের পুনরাবৃত্তি হয়। কৃষক সভার কাজে প্রতিদিন হতে থাকা আমার ঝটিকা-সফরগুলোকে ব্যঙ্গ
করে ওরা নাম দিয়েছে ‘খুশির সফর’ (Pleasure Trips) আর অবাক ভাব দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছে যে এই সব সফরের খরচ আমায় কে দেয়? ওরা
জানেই না এসব সফরের গরজটা যাদের, যারা অস্থির হয় এই সফরগুলোর জন্য, তারাই খরচটাও
দেয় – এবং তারাই এই সব খবরের কাগজের মালিকদের প্রাসাদগুলোও সাজায়। এই সঙ্কলন এটাও
বলবে যে এই সফরগুলো খুশির সফর না কষ্টিপাথর।
সেই ১৯৪১এ, কারাগারে বসেই এ স্মৃতিকথা লেখা হয়েছিল,
কিন্তু পরিস্থিতি বশতঃ প্রকাশনে দেরি হল অনেক। তবুও এর গুরুত্ব একটুও কমে নি। ভাবলাম
যে যেই কৃষক সভার সাথে আমার সম্পর্কের এ স্মৃতিচারণ, তার ইতিহাস যদি এর সাথে না থাকে
তাহলে এক প্রকারের এটা অপূর্ণ থেকে যাবে। পাঠক এই স্মৃতিচারণ পড়ে সন্তুষ্টও হবেন
না আর উপভোগও করতে পারবেন না।। তাই, ভূমিকা হিসেবে কৃষক সভার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং
সে ইতিহাস নিয়ে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা এই স্মৃতিকথার সাথে যোগ করা হল। এভাবে
একটা পুরো জিনিষ তৈরি হল আর কি।
কোথাও কোথাও পৃষ্ঠার ধারে যে সংখ্যা দেওয়া আছে সেগুলো
সূচক, যে কবে কতটা, কারাগারে বসে লেখা হয়েছিল।
বিহটা, পাটনা স্বামী
সহজানন্দ সরস্বতী
১০.২.১৯৪৭
ভারতে কৃষক-আন্দোলন
[ক]
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
অনেকেই ভাবেন যে আমাদের দেশে কৃষক আন্দোলন একেবারে নতুন
এবং কিছু দুষ্টবুদ্ধি মানুষের মস্তিষ্কপ্রসুত মাত্র। তাঁরা মানেন যে এই আন্দোলন নিছক
কয়েকটি শিক্ষিত বদমায়েসের পেশা আর তাদের নেতাগিরির জায়গা। তাঁরা এটাই জানেন যে
সাদাসিধা কৃষকদের ফুসলে-ফাসলে কিছু ভদ্রলোক কিন্তু গরীব বাবুরা নিজেদের কাজ গুছোচ্ছে।
তাই কৃষক সভা এবং কৃষক আন্দোলনের এই বেয়াদপি-তুফান উঠেছে আর তার অন্যায় কাজকর্ম চলছে।
এমনও নয় যে শুধু স্বার্থপর আর সরলমতি জমিদার-মালগুজারি জমিদার অথবা তাদের পৃষ্ঠপোষকেরাই
এমন কথা বলেন। কংগ্রেসের কিছু শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং দেশের পথপ্রদর্শকেরাও এমন ভাবেন।
তাঁরা কৃষক সভার প্রয়োজনটাই অনুভব করতে পারেন না। তাঁরা কৃষক আন্দোলনকে জাতীয় স্বাধীনতা
সংগ্রামের পথের বাধা মনে করেন। ফলতঃ, প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ রূপে তাঁরা এর বিরোধ
করেন।
কিন্তু এমন ধারণা ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন। ভারতীয় কৃষকের আন্দোলন
প্রাচীন; অনেক পুরোনো। আসলে এই আন্দোলনের লিখিত বিবরণের অভাব একটি বড় ত্রুটি।
এক-সোয়া শ’ বছরের আগের সময়টা যদি দেখি তাহলে এই আন্দোলনের কোনো লিখিত চর্চা পাওয়াও
কঠিন হবে। এর অনেক কারণ; যা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ এখানে নেই। যখন ইওরোপীয় দেশগুলোর
কৃষক আন্দোলন পুরোনো, এ দেশেও তেমন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আজ থেকে পঞ্চাশ বা একশ
বছর আগে কৃষকের অবস্থা সর্বত্র একই রকম ছিল। জমিদার এবং সুদখোরেরা সবখানেই কৃষকদের
ওপর তীব্র উৎপীড়ন চালিয়েছে এবং সরকারও ওই উৎপীড়নকারীদেরই সঙ্গ দিয়েছে। ফলে কৃষক
বিদ্রোহ সর্বত্র হয়েছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে – ১৮৫০ সালে – শোষিত জনতার
মুক্তিদাতা ফ্রেডরিক এঙ্গেলস একটি বই লেখেন, “জার্মানিতে কৃষক যুদ্ধ” (দি
পিজ্যান্ট ওয়ার ইন জার্মানি)। বইটিতে পনের এবং ষোল শতকের সন্ধিকালে জার্মানির কৃষক
বিদ্রোহের বর্ণনার সাথে সাথে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি এবং অন্যান্য দেশেরও অনুরূপ
বিদ্রোহের উল্লেখ রয়েছে। তার আগে জার্মান বিদ্বান উইলহেল্ম জিমারম্যান লিখিত, “মহান
কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস” (দি হিস্ট্রী অফ দি গ্রেট পিজ্যান্ট ওয়ার) বইটিতেও এই বর্ণনা
আছে। এ বই লেখা হয়েছিল ১৮৪১ সালে। ফ্রান্সের দক্ষিনভাগে ১২-১৩ শতকে হওয়া কৃষক
বিদ্রোহ প্রসিদ্ধ। ইংলন্ডে ১৩৮১তে হওয়া কৃষক বিদ্রোহও প্রসিদ্ধ, যার নেতা ছিলেন জন
বোল। হাঙ্গেরিতেও ১৬ শতকে কৃষকেরা বিদ্রোহ করেছিলেন।
এভাবেই সামন্ত ও জমিদারদের অত্যাচার, করের বোঝা আর
গোলামির বিরুদ্ধে লাগাতার হয়েছে সমস্ত সংগ্রাম ও বিস্ফোরণ, আর এগুলো ভারতেও ছিল। এ
দেশ তো পিছিয়েও ছিল অন্য দেশের তুলনায়। তাহলে এখানেও তো উৎপীড়ন না হওয়ার কথা নয় আর
তার বিরুদ্ধে কৃষক সংগ্রামও না হওয়ার কথা নয়। এখানে তো আজও, এই ব্রিটিশ ভারতেও, আর
বিশেষ করে দেশীয় রাজ্যগুলোতে সেই একই যন্ত্রণা ভোগ করছে কৃষকেরা।
তাহলে কি ভারতীয় কৃষকেরা যেমন তেমন চোখ বন্ধ করে
সমস্তরকম কষ্ট গাধা-বলদের মত চুপচাপ সহ্য করে এসেছে? তার বিরুদ্ধে মাথা ওঠায় নি? এ
কথাটা মেনে নেওয়ার মত নয়। মানলাম যে আজকের জমিদারশ্রেণী দেড়শ বছরের আগে ছিলনা।
কিন্তু সরকার তো ছিল। সুদখোর, বানিয়া, মহাজন তো ছিল। জাগিরদার আর সামন্তেরা তো ছিল।
তার মানে করের বোঝা, গোলামি আর তীব্র সুদখোরিও ছিল। কারা রুখত এদের? আর এদের
বিরুদ্ধে কৃষকসমাজ চুপ করে থাকতে পারত কি করে? ভারতীয় কৃষক ব্যতিক্রম তো হতে পারে
না বিশ্বের কৃষক সমাজে? তবুও যদি এঁদের আন্দোলন ও বিদ্রোহের কোনো বিধিসম্মত লিখিত
ইতিহাস পাওয়া না যায়, তার মানে এটা মোটেই নয় যে আন্দোলন হয়েই নি – হয়েছে, নিশ্চয়ই
হয়েছে – হাজার বছর ধরে লাগাতার হয়ে চলেছে। নইলে হঠাৎ, একশ দেড়শ বছর আগে (যার বিষয়ে
লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায়) কি করে হল? আর যদি সম্প্রতি তাঁরা সংগ্রাম করতে শুরু করে থাকেন
তাহলে আগেও নিশ্চয়ই করেছেন।
এটাও ভাবার, যে কাগজে-কলমে এবং সভা-সমিতির মাধ্যমে,
প্রদর্শন এবং মিছিলের মাধ্যমে হয়ত হতে পারত না কিন্তু ব্যবহারিক ভাবে তো হতই, হতেই
পারত আর সেটাই ছিল আসল আন্দোলন। কেননা, “বলে শোনাব” থেকে “করে দেখাব” কে হামেশাই
বেশি মূর্ত এবং কার্যকর মনে করা হয় আর এদিকে, ১৮৩৬ থেকে ১৯৪৬এর মধ্যে, শুরুর প্রায়
একশ বছর ধরে, কথা বা লেখার মাধ্যমে আন্দোলন বলতে গেলে হয়েই নি, বরং ব্যবহারিক ও ফলিতই
হয়েছে। তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পরে দেওয়া হয়েছে। সেই তথ্য দেখেও এটা মানতেই হয় যে
আগেও এধরণের ব্যবহারিক আন্দোলন ও ফলিত বিরোধ কৃষক-বিশ্বের তরফ থেকে হামেশাই হয়ে
এসেছে। কৃষক তো সর্বদাই মূক প্রাণী। এদের মুখে বাণী দেওয়ার প্রয়াস প্রথমে কে কবে
করল? কর্ম, ভাগ্য, ভগবান, ললাটের লিখন আর পরলোকের নামে সদাই চুপচাপ কষ্ট সওয়ার,
সন্তুষ্ট থাকার আর পশুজীবন কাটানোর উপদেশই এদেরকে দেওয়া হয়েছে সব সময়। এও বলা হয়েছে
যে রাজা আর শাসক তো ভগবানের অংশাবতার। তাই ওঁদের আজ্ঞা নীরবে শিরোধার্য্য করাতেই
কল্যাণ। এই কল্যাণের দাওয়াই তো আরো বেশি করে বিষের কাজ করেছে আর ওদের বোবা করে
দিয়েছে। ফলে, কখনো কখনো বিরক্ত হয়ে ওরা ফলিত আন্দোলনই করেছে এবং সেটা সফলও হয়েছে। তাতে
তাদের কষ্টেরও লাঘব ঘটেছে।
এ কথাটা সত্যি যে এদিকে অসহযোগ যুগের পর যে কৃষক আন্দোলনগুলো
হয়েছে সেগুলো সংগঠিত রূপে হয়েছে। সংগঠনের জন্মও তখন থেকেই হয়েছে। জন্মের পর ক্রমশঃ
এর দৃঢ়তা বেড়েছে এবং আজ তো এ সংগঠন যথেষ্ট শক্তিশালী, যদিও দুর্বলতাও অনেক। কিন্তু
অসংগঠিত রূপে এই আন্দোলন অসহযোগ যুগের আগেও ছিল। সংগঠিত শব্দটিতে আমার আশয়
সদস্যতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কৃষক সভা ও কৃষক পঞ্চায়েত, যার দপ্তর নিয়মিত কাজ করে এবং
নিয়ত সময়ে সমিতিগুলো হতে থাকে। কাগজের ঘোড়দৌড়ও চলতে থাকে। এ ব্যাপারটা আগে ছিল না।
এদিক থেকে পূর্ববর্তী আন্দোলনগুলোকে অসংগঠিত বলছি। নইলে বিদ্রোহগুলোর, সেই সময়ের
প্রেক্ষিতে সফল হওয়ার জন্য কোনো না কোনো ভাবে সংগঠিত হওয়া তো অনিবার্য ছিল। ‘পাঁতি’
জারি করার রেওয়াজ অত্যন্ত প্রাচীন। মনে হয়, আগে দু’চারটে অক্ষর বা সংকেতের মাধ্যমেই
সংগঠনের মহামন্ত্র উচ্চারণ করা হত। যদিও যাতায়াতের ব্যবস্থার অভাবে আজকের দিনের সফলতা
বা বিস্তৃতি জুটত না। তবুও আমরা দেখি যে যে আন্দোলন এবং সংগ্রামগুলোর উল্লেখ পরের
পৃষ্ঠাগুলোয় রয়েছে সেগুলো কথায় কথায় আগুনের মত ছড়িয়েছে এবং বহূ দূর অব্দি প্রসারিত
হয়েছে। সাঁওতাল বিদ্রোহে লক্ষ বিদ্রোহীর একত্র হওয়ার কথা খোদ ইংরেজ আধিকারিকেরাই
লিখেছে। এসব দেখে এটা তো মানতেই হবে যে ওই সময়ের বিদ্রোহগুলোও যথেষ্ট সংগঠিত ছিল,
যদিও আজকের দৃঢ়তা, আজকের স্থায়িত্ব ছিল না। হতই বা কেমন করে? সেই দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব
আনার সরঞ্জামগুলো থাকত তবে তো?
যেমন আগেই বলেছি, আজ থেকে এক’শ-সোয়া’শ বছর আগের কৃষক-সংগ্রাম
এবং আন্দোলনের বর্ণনা পাওয়া যায়। তাই সেখান থেকেই শুরু করি। সবচেয়ে পুরোনো
মালাবারের মোপলা কৃষকদের বিদ্রোহ; শুরু হয়েছিল ১৮৩৬ সালে। লোকে বলে যে মোপলারা
গোঁড়া মুসলমান, তাই নানা ধার্মিক কারণেই আন্দোলন করেছেন আগেও। অসহযোগ-জমানায় তাঁদের
বিদ্রোহের ব্যাপারে স্পষ্ট ভাবেই এ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এমন সব কথা বলা বা বিশ্বাস
করা আধিকারিক এবং জমিদার-মালদারদের রচনা ও বয়ান থেকেই প্রমাণিত হয়ে যায় যে কথাটা ভুল;
আর্থিক ও সামাজিক উৎপীড়নই এই বিদ্রোহের আসল কারণ। ধার্মিক রঙটা চড়েছে কার্য-কারণে,
প্রাসঙ্গিকতায়। ১৯২০ ও ১৯২১ সালের বিদ্রোহকে তো সবাই, এমনকি মহাত্মা গান্ধিও ধার্মিক
মেনেছেন। কিন্তু ওই বিদ্রোহের ব্যাপারে মালাবারের ব্রাহ্মণদের পত্রিকা ‘যোগক্ষেমম্’এর
১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারি সংখ্যার শীর্ষ-প্রবন্ধে লেখা ছিল যে “শুধু ধনী ও জমিদারদের
ওপরই এই বিদ্রোহীরা অত্যাচার করে, গরীব কৃষকদের ওপর না ...” (only the rich and
the landlords are suffering in the hands of the rebels, not the poor peasants.”)
যদি ধার্মিক ব্যাপার হত তাহলে ধনী ও গরীবের মধ্যে বিভেদ
কেন করত বিদ্রোহীরা? একই ভাবে, ৫.২.১৯২১ তারিখে দক্ষিণ মালাবারের কালেক্টর ১৪৪ ধারার
অন্তর্গত যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল তাতে কারণ হিসেবে লেখা ছিল “সাদাসিধে মোপলাদের শুধু
সরকারের বিরুদ্ধেই নয়, হিন্দু জন্মী (জমিদার) দের বিরুদ্ধেও উস্কে দেওয়া হবে” (“The
feeling of the ignorant Moplahs will be inflamed against not only the
government but also against the Hindu Jenmies (landlords) of the district.”)।
এতেও স্পষ্ট যে বিদ্রোহের কারণ ছিল আর্থিক। নইলে শুধু জমিদার এবং সরকারের বিরুদ্ধে
উস্কে দেওয়ার কথা কেন উঠত?
আসল কথা এই যে মালাবারের জমিদারেরা মোটামুটি সবাই
ব্রাহ্মণ। উত্তর মালাবারের বোধহয় দু’একজন মোপলা জমিদারও আছে। অন্য দিকে মোপলারা
গরীব কৃষক। সচ্ছল ঘর বলতে নেইই। জমির ওপর এই কৃষকদের কোনো অধিকার কখনও ছিল না আর কলহের
আসল ভিতটা এখানে, আগেও এখানেই ছিল। এসব পুরোনো ব্যাপার। যেহেতু শোষক জমিদারেরা
হিন্দু (ব্রাহ্মণ) তাই কলহটার ওপর ধার্মিক রঙ চড়ে যায়। না, তাও নয়, ইচ্ছে করে চড়ান
হয়। ১৮৮০ সালের বিদ্রোহে মোপলারা দুজন জমিদারের ওপর চড়াও হয়েছিল। সে সময় তারা তৎকালীন
গভর্নর লর্ড বাকিংহামকে বেনামী চিঠি লিখে জমিদারদের অত্যাচারের বিষয়ে জানিয়েছিল এবং
প্রার্থনা করেছিল যেন এ অত্যাচার বন্ধ করা হয়, নইলে আগুন ধরবে। গভর্নর মালাবারের
কালেক্টর এবং জজকে নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করে তদন্ত করিয়েছিল। তদন্তে রিপোর্ট এল যে
ঝড়ঝাপটার মূলে সেই কৃষকের সমস্যাবলী। সঙ্গে এ কথাও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বেরিয়ে এল
যে জমিদাররা কৃষকদের কিভাবে লোটে এবং জমি থেকে বেদখল করে। তার জন্যই তো ১৮৮৭ সালের
প্রজাস্বত্ব আইন তৈর হল।
১৯২১ সালে এবং তার পরবর্তি বছরগুলোয় মওলানা ইয়াকুব হাসান
মালাবারের কংগ্রেসি এবং গান্ধিবাদী নেতা ছিলেন। তবুও, গান্ধিজিকে লেখা ওনার চিঠিতেও
ছিল যে, “অধিকাংশ মোপলা ছোটো ছোটো জমিদারের জমি নিয়ে চষে এবং জমিদার প্রায় সবাই হিন্দু।
মোপলাদের এটা পুরোনো অভিযোগ যে এই সব কুখ্যাত জমিদারেরা ওদের লোটে, অত্যাচার করে;
এই অভিযোগের কখনই কোনো নিষ্পত্তি হয়নি” (“Most
of the Moplahs were cultivating lands under the petty landlords who are almost
all Hindus. The oppression of the Jenmies (landlords) is a matter of notoriety
and a long-standing grievance of the Moplahs that has never been redressed.”)
এর পর তো আর সন্দেহ থাকে না যে মোপলা বিদ্রোহ বাস্তবে কৃষক
বিদ্রোহই ছিল।
১৮৩৬ থেকে ১৮৫৩ অব্দি সময়ে মোপলারা বিশ বার বিদ্রোহ করে।
সব কটাই জমিদারদের বিরুদ্ধে। কোথাও কোথাও ধর্মের কথা প্রসঙ্গক্রমে এসেছিল অবশ্যই।
কিন্তু বিদ্রোহের আসল চরিত্র ছিল কৃষক। ১৮৪১এর বিদ্রোহ তো শ্রী তৈরুম পহত্রী
নাম্বুদ্রি নামে এক ক্রুর জমিদারের বিরুদ্ধে ছিল যে কৃষকদের পাট্টায় দেওয়া জমি
জবরদস্তি ছিনিয়ে নিয়েছিল। ১৮৪৩ সালেও দুটো সংগ্রাম হয়েছিল – একটা গাঁয়ের মুখিয়ার
বিরুদ্ধে আর দ্বিতীয়টা ব্রাহ্মণ জমিদারের বিরুদ্ধে। ১৮৫১ সালে উত্তর মালাবারে এক
জমিদারের বংশই শেষ করে দেওয়া হল। ১৮৮০র কথা তো বলাই হয়েছে। ১৮৯৮ সালেও একই ভাবে এক
জমিদার নিহত হল। ১৯১৯ সালে মনকট্টা পহত্রী পুরম্এ এক ব্রাহ্মণ জমিদার এবং তার
লোকজনকে চেকাজি নামে এক মোপলা কৃষকের দল খতম করে দিল আর লুটপাট চালাল। কেননা ওই
জমিদার চেকাজির বিরুদ্ধে মামলার রায়ে (বাকি পড়া ভূমিকর সম্পর্কিত) সন্তুষ্ট না হয়ে
তার ছেলের বিয়ে আটকে দিয়েছিল।
১৯২০ সালের অক্টোবরে কালিকটে প্রজাস্বত্ব আইনে সংস্কারের
যে আন্দোলন শুরু হল, তারই পরিণতি হল ১৯২১ সালের বিদ্রোহ। জমিদারেরা ইচ্ছেমত ভূমিকর
বাড়াত আর যখনতখন প্রজাদের জমি থেকে বেদখল করত। এর বিরুদ্ধে শ’য়ে শ’য়ে সভা হল।
জায়গায় জায়গায় কৃষক সভা তৈরি হল, কালিকটের রাজার জমিদারিতে একটা “টেন্যান্ট রিলীফ
এসোসিয়েশন” প্রতিষ্ঠিত হল আর মাঞ্জেরিতে বড় সম্মেলন হল যেখানে জোরালো সমর্থন পেল কৃষকদের
দাবীগুলো। এরই সাথে যুক্ত হল খিলাফত আন্দোলন। কিন্তু সত্যটা তো অন্যরকম ছিল। এভাবে
আমরা দেখতে পাই যে শতাধিক বছর আগে থেকে বিশুদ্ধ কৃষক আন্দোলন কৃষকদের অধিকারের
জন্য চলল এবং ১৯২০ সালে পৌঁছে সে আন্দোলন কোথাও কোথাও সংগঠনের রূপ নেওয়ারও চেষ্টা
করল।
ঠিক আছে, এবার মালাবারের, মানে দক্ষিণের কৃষক আন্দোলন থেকে
দৃষ্টি সরিয়ে উত্তরে – বম্বে প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত মহারাষ্ট্র, খান্দেশ এবং
গুজরাতের দিকে তাকাই। ওদিকেও ১৮৪৫ থেকে ১৮৭৫ সালের মধ্যে কৃষকদের বড় বড় অভ্যুত্থান
ঘটেছিল। কোলি, কুর্মি, ভীল, ব্রাহ্মণ এবং অন্য জাতের মানুষেরা – সবাই এ বিদ্রোহে শরিক
ছিল। ১৮৪৫ সালে ভীলদের নেতা রঘুভঙ্গারিনের দল মহাজনদের ওপর লুটপাট চালাল। পুনা আর থানা
জেলার কোলিরাও মাঝে মধ্যে এমনই লুটপাট আর মারকাট চালাল। এ ব্যাপারে ১৮৫২ সালে
স্যার জী উইংগেট (Sir G. Wingate) বোম্বাই সরকারকে লিখেছিল, “বোম্বাই
প্রেসিডেন্সির দুই সুদূর প্রান্তে খাতকেরা যে দুজন মহাজনকে মেরে ফেলেছে, সেটা এমনই
হয়নি, কোনো বা কোনো ভাবে মহাজনদেরই অত্যাচারের ফলশ্রুতি। কিন্তু আমার ভয় যে একদিকে
কৃষক ও অন্যদিকে সুদখোর বানিয়াদের মধ্যে সাধারণভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা উত্তেজনার
এ দুটো উদাহরণ মাত্র। আর যদি তাই হয়, তাহলে এই ঘটনাদুটোই বলে যে একদিকে কতটা ভয়ানক
শোষণ-উৎপীড়ন চলছে আর অন্যদিকে কতটা বেশি কষ্ট সহ্য করছে জীবন” (“These two cases
of village-money-lenders murdered by their debtors almost at the opposite
extremities of our presidency must, I apprehend, be viewed not as the results
of isolated instances of oppression on the part of the creditors, but as
examples in an aggravated form of the general relations subsisting between the
class of money-lenders and our agricultural population, and if so, what an amount
of dire oppression on the one hand, and of suffering on the other, do they
reveal to us?”)
একই রকম ভাবে ১৮৭১ থেকে ১৮৭৫ এর মাঝে খেড়া (গুজরাত),
আহমদনগর, পুনা, রত্নগিরি, সাতারা, শোলাপুর আর আহমদাবাদ (গুজরাত) জেলাতেও গুজর, সুদখোর,
মারওয়াড়ি, অন্যান্য বানিয়া এবং অত্যাচারিদের বিরুদ্ধে জেহাদের ডাক দেওয়া হয়েছিল,
যার বিবরণ “দক্ষিণী কৃষক দাঙ্গা-তদন্ত কমিশন”এর রিপোর্টে দেওয়া হয়েছে। ১৮৫৫ থেকে
১৮৭১এর মাঝের সময়টাও অস্থিরতার সময় ছিল। ১৮৬৫ সালে এমেরিকার গৃহযুদ্ধের প্রভাবে ভারতীয়
তুলোর দাম বাড়ল। ফলে কৃষকেরা কর্জ নিল অনেক। কিন্তু ১৮৭০ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হতেই হঠাৎ
পড়ে গেল তুলোর দাম, যাতে ১৯২৯এর মতই অনেক কৃষক সর্বনাশের মুখে পড়ল। তারই মধ্যে
আবার ১৮৬৫ সালের আগেই মাঝেমধ্যে সার্ভে করিয়ে সরকার ভূমিকর বাড়িয়ে দিয়েছিল। যখন সে
বর্দ্ধিত ভূমিকর কৃষকেরা দিতে পারল না তখন তাদের জমি পাইকারি হারে মহাজনদের হাতে
যাওয়া শুরু হল। ফলে বিদ্রোহ করল কৃষকেরা। বিদ্রোহের প্রভাবে সরকারি তদন্ত কমিশন গঠিত
হল এবং তার রিপোর্টের ভিত্তিতে দক্ষিণের কৃষকদের কিছু সুযোগসুবিধা দেওয়ার আইন তৈরি
হল। এতে স্পষ্ট হয় যে কৃষকেরা সরকার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে গেল কেননা তাদের জমি ছিনিয়ে
নেওয়া হচ্ছিল।
বলা হয় যে বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে জমিদারি প্রথাই নেই,
কাজেই জমিদারও নেই। রাইয়তওয়ারি প্রথা থাকার ফলে ওখানে কৃষকই জমির মালিক। কিন্তু
বাস্তবে একথাটা আর প্রযোজ্য নয়। ওখানেও মহাজন-জমিদারেরা কায়েম হয়ে বসেছে আর আসল কৃষক
ওদের গোলামে পরিণত হয়েছে। এই মহাজনি-জমিদারি ১৮৪৫ সালেই শুরু হয়েছিল, যখন কর্জ উশুল
করার নামে মহাজনেরা কৃষকদের জমি ছিনিয়ে নেওয়া শুরু করেছিল। কৃষকদের বিদ্রোহও এই
জমি ছিনিয়ে নেওয়া রুখতেই হত। আজ তো এসবেরই কারণে রাইয়তওয়ারি এলাকার কৃষক জমিদারি
এলাকার কৃষকদের থেকেও বেশি দুখী। কেননা সে কোনো অধিকার অর্জন করতে পারেনি, যখন
নাকি জমিদারি এলাকার কৃষকেরা লড়াই করে অনেককিছু অধিকার অর্জন করেছে। এইজন্য দক্ষিণের
বিদ্রোহের তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে মিস্টার অকল্যান্ড কোলভিন লিখেছে, “তথাকথিত
রাইয়তওয়ারি প্রথায় ধীরে ধীরে এমন অবস্থা হয়ে চলেছে যে রাইয়ত টেন্যান্ট হয়ে গেছে আর
মাড়োয়ারি (মহাজন) হয়ে গেছে জমিদার (মালিক)। এ তো সেই জমিদারি প্রথাই হল। তফাৎ এটাই
যে উত্তর ভারতে জমিদারি প্রথায় কৃষকদের রক্ষার্থে যে কথাগুলো আইনে রয়েছে তার একটাও
এখানে নেই। মালিক দায়িত্বজ্ঞানহীন আর কৃষকদের তো কোনো রক্ষাকবচই নেই। ফলে
রাইয়তওয়ারি না হয়ে এই প্রথা মাড়োয়ারি (মহাজনি) প্রথা হওয়ার দিকে এগোচ্ছে” (“Under
so-called ryotwari system it is gradually coming to this, that the ryot is the
tenant and the Marwari is the proprietor. It is a zamindari settlement; but it
is a zamindari settlement stripped of all the safeguards which under such a
settlement in Upper India are thought indispensable to the tenant. the
proprietor is irresponsible, the tenant unprotected. It promises to become not
a ryotwari but a Marwari settlement.”)
উত্তর ভারতে,
বিহার-বাংলা সীমান্তের দুদিকেই যে সাঁওতাল আন্দোলন ১৮৫৫ সালের ৭ জুলাই শুরু হয়েছিল,
সেটাও কৃষক আন্দোলনই ছিল। ভীল নেতাদের অঙ্গরক্ষীদের সংখ্যাই ছিল তিরিশ হাজার। বাকিদের
তো কথাই নেই। সাঁওতালদের ঘী, দুধ আর আনাজপাতি জলের দামে কিনে নিত বানিয়ারা আর খুব
বেশি দামে বিক্রি করত নুন আর কাপড়। এই ভাবে ওদের সমস্ত জমি, বাসন আর নারীদের লোহার
গয়না অব্দি বানিয়ারা লুটে নিত, ঠকিয়ে নিয়ে নিত। মিস্টার হান্টার এর বিশদ, কিন্তু হৃদয়দ্রাবী
বর্ণনা করেছেন “গ্রামীণ বাংলার ইতিহাস” বইটিতে। তারপর যখন পুলিসেরাও বানিয়াদের কাছে
ঘুস খেয়ে ওদের পক্ষ নিতে শুরু করল তখন অত্যাচারিত সাঁওতালদের জন্য একটাই অস্ত্র
রইল – বিদ্রোহ। তাই তারা ওই পথে গেল। এভাবে আমরা ১৮৩৬ থেকে চলা শুরু করে ১৮৭৫
অব্দি পৌঁছে যাই আর এরই মধ্যে সাঁওতালদের কৃষক আন্দোলনও চলে আসে। এর সাথে,
মালাবারের ১৯২০র বিদ্রোহকে যোগ করলে আমরা অসহযোগ-যুগের আগে অব্দি চলে আসি।
একটা কথা আরও। ধীরে
ধীরে এই আন্দোলন সংগঠিত রূপের দিকে অগ্রসর হয়। মোপলাদের ১৯২০র সংগঠনের উল্লেখ আগেই
হয়ে গেছে। দক্ষিণী বিদ্রোহতেও ১৮৩৬-৫৬র মোপলা বিদ্রোহের তুলনায় সুষম একটা সংগঠনের
আভাস পাওয়া যায় যার ফলে ওরা আগুনের মত বোম্বাই প্রেসিডেন্সির এক প্রান্ত থেকে আরেক
প্রান্তে খুব দ্রুত পৌঁছে যায়। এ দিকটার ওপর স্যার উইংগেট ছাড়া অন্যেরাও লিখেছে।
কিন্তু ১৮৭৫এর পরে এই সংগঠন ধীরে ধীরে সভার রূপ নেয় ১৯২০র মালাবারে; যদিও স্থায়ী হতে
পারেনা সে সংগঠন।
উত্তর এবং পূর্ব
বাংলার নীল চাষ করা কৃষকদের বিদ্রোহও এই কালখন্ডেই ঘটে। বিহারের ছোটনাগপুরের টানা ভগত
আন্দোলনও ঠিক অসহযোগ যুগের আগে শুরু হয়েছিল। ১৯১৭য় চম্পারণে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে
গান্ধিজির কৃষক-আন্দোলন চলল এবং তাৎকালিক উদ্দেশ্যে সফল হল। গুজরাতের খেড়া জেলাতেও
উনি আগেই সে বছর কৃষক আন্দোলন চালিয়েছিলেন। কিন্তু অনেকাংশে সেটা অসফল হয়েছিল। অওয়ধে
অসহযোগের আগে ১৯২০ সালে বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে চলা কৃষক আন্দোলন ওখানকার তালুকদারদের
বিরুদ্ধে ছিল; তাতে লুটপাটও হয়েছিল। এ ধরণের আন্দোলন সারা দেশে আরো অনেক জায়গায়
হয়েছিল। কিন্তু তার ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করার সুযোগ এখানে নেই।
এই সমস্ত আন্দোলনের
সারমর্ম, বিশেষত্ব
অসহযোগ যুগের
আগের আন্দোলনগুলোর বিশেষত্ব, প্রথমতঃ এই ছিল যে সেগুলো অধিকাংশ অসংগঠিত ছিল।
দ্বিতীয়তঃ নেতৃত্বে লেখা পড়া জানা লোকেরা ছিল না। অওয়ধের আন্দোলনেও এই একই ব্যাপার
ছিল। তৃতীয়তঃ এই সব আন্দোলনে মার-কাটও হয়েছিল। তখন কে আর জানত গণআন্দোলনের রহস্য!
এটাও একটা বিশেষত্ব ছিল যে এই বিদ্রোহ ও আন্দোলনগুলো আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে করা
হয় নি। যখন কৃষকদের ওপর হতে থাকা অত্যাচার অসহ্য হয়ে যেত এবং তার থেকে পরিত্রাণ
পাওয়ার অন্য কোনো পথ দেখা যেত না তখন একবারে তারা ফেটে পড়ত। কাজেই মার-কাটও হত অনিবার্যভাবেই।
পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করত, বা বলা যায় জমিদার ও শোষকদের তীব্র অত্যাচার তাদেরকে
হিংসার পথে যেতে বাধ্য করত। এটাই তাদের দুর্বলতা ছিল। এবং এই দুর্বলতার কারণেই তাদের
দমন করা সম্ভব হল; তারা অসফল হল। যদিও, সবাই স্বীকার করবে যে শেষ অব্দি এই সমস্ত আন্দোলনের
সুন্দর পরিণতি হল কৃষকদের জন্য। কৃষক-স্বার্থরক্ষায় কত আইন তৈরি হল এর প্রভাবে।
এটা ঠিক যে
কয়েকটি আন্দোলনে লেখাপড়া জানা মানুষেরাও নেতৃত্বে ছিল। দৃষ্টান্ত স্বরূপ ১৯২০র
মোপলা আন্দোলন ধরুন। কিন্তু সেখানেও ছোটোখাটো হিংসামূলক কার্যকলাপের কারণে বিরাট ক্ষতি
সহ্য করতে হল। খিলাফত এবং পাঞ্জাবের ঘটনার ঠিক পরেই হওয়ার জন্য আর প্রশাসন কর্তৃক ঘটনাগুলোকে
একসুত্রে গেঁথে দেখার কারণে ওই আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হল। ফলে নিষ্ফল গেল
ওই আন্দোলন। বলা যায় যে অহিংসার প্রচন্ড ঢেউয়ের যুগ হওয়ার জন্য তা প্রভাবেই ওই আন্দোলনটা
ডুবল।
কিন্তু খেড়া,
চম্পারণ এবং পন্ডিত নেহেরু সঞ্চালিত যুক্ত প্রদেশের আন্দোলন শান্তিপূর্ণও ছিল এবং
উদারপন্থী নেতাদের হাতে ছিল; যদিও সংগঠিত রূপ ওই আন্দোলনগুলোকেও দেওয়া যায়নি। তা সত্বেও,
গণআন্দোলনের শান্তিপূর্ণ রূপ পরিগ্রহণ করার এবং লেখাপড়া জানা নেতৃত্বের অধীন থাকার
ফলশ্রুতিতে এই আন্দোলনগুলো কমবেশি প্রত্যক্ষ সফলতা পেয়েছিল। আন্দোলনগুলোর ক্ষেত্র
এবং উদ্দেশ্য যতটা সঙ্কুচিত বা ব্যাপক ছিল আর যতটা শক্তি ছিল তাদের ভিতরে সেই মতই
কম বা বেশি সফলতা পেয়েছিল তারা। খেড়ার আন্দোলন তো পুরো জেলা জুড়ে ছিল, সোজা
সরকারের বিরুদ্ধে। তাই ততটা সফলতা পেল না। চম্পারণের আন্দোলন ছিল কিছু বিশেষ এলাকার,
শুধু নীলকর সাহেবদের নৃশংসতা, যদৃচ্ছ অত্যাচারের বিরুদ্ধে। ফলে ওটা সম্পূর্ণ সফল
হল। অওয়ধের আন্দোলন ছিল একটা বড় এলাকা জুড়ে, যাতে বেশ কয়েকটি জেলা চলে আসে। সাধারণভাবে
যুক্তপ্রদেশের প্রশ্নও উঠল ওই আন্দোলনে। তাই খুব ধীরগতিতে শুরু হল সাফল্যপ্রাপ্তি
এবং এখনও পুরোটা পাওয়া যায়নি।
অসহযোগের আগে কৃষক
আন্দোলন যে দৃঢ়তা পায়নি এবং পূর্ণ সংগঠিত রূপে বিকশিত হতে পারেনি তার দুটো কারণ ছিল
যার উল্লেখ এখনও অব্দি করিনি। প্রথমতঃ, কৃষক জনতার ভিতরে আত্মবিশ্বাস ছিলনা। বহু শতাব্দীকাল
ধরে নিষ্পেষিত কৃষক আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। তাই ভরসার সাথে একজোট হয়ে খুঁটি ঠুকে
নিজেদের উৎপীড়কদের বিরুদ্ধে তারা লড়তে পারত না। ফলে একবার পিছলে গেলে সাহস হারিয়ে ফেলত
আর গুম হয়ে বসে যেত। তাহলে সংগঠন আর কি করে হত? দ্বিতীয়তঃ, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার
জন্য বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষিত কর্মী এবং নেতাও ছিল না – এমন নেতা ও কর্মী যাদের মধ্যে
আত্মবিশ্বাস থাকবে এবং একনিষ্ঠ হবে এমন যে লক্ষ্যে পৌঁছেই ছাড়বে।
এই দুটো মূলভূত দুর্বলতা
অসহযোগ আন্দোলন দূর করে দিল। ১৯২১এ বিরাট, শক্তিশালী এবং অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত
সরকারকে নিরস্ত্র কৃষকেরা কাঁপিয়ে দিল, নাড়িয়ে দিল। ফলে তারা আভাস পেল তাদের নিজের
ভিতরের অন্তর্নিহিত শক্তির। তাদের আত্মবিশ্বাস জন্মাল যে যদি এত বড় সরকারকে নাড়িয়ে
দিতে পারি তাহলে জমিদার, তালুকদার আর মহাজন কোন ছার? ওদের নাক ধরা তো বাঁ হাতের খেলা।
অসহযোগ আন্দোলন কয়েক হাজার ধনী কর্মীও দিল যারা ওপরে চলে এল – লড়াইয়ের মাঠে চলে
এল। অসহযোগের সফলতার প্রধান ভিত্তি তো ছিল কৃষকেরাই, যারা প্রথমবার সামুহিক ভাবে কংগ্রেসে
এসেছিল। তাই তারা নিজেরা এবং তাদের জন্য কর্মীরা – দু’দলই আত্মবিশ্বাস অর্জন করে এগোল।
যদিও এসব একটু
দেরিতে হল। কেননা আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়সংকল্পের জন্য সময় এবং ভাবনার প্রয়োজন হয়। তবুও
হল অবশ্যই। আর তাই, এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ফলশ্রুতিতেও কৃষকসভার রূপে কৃষক আন্দোলন
১৯২৬-২৭ সালে বিহারে এবং অন্যত্র শুরু হল। এটুকু দেরি এমন কিছু ব্যাপার নয়। ১৯২৮ সালের
বারদৌলি আন্দোলনও এরই পরিণতিতে হল, এবং সফলও হল।
এভাবে আমরা আধুনিক
সংগঠিত কৃষক আন্দোলনের যুগে প্রবেশ করি। অসহযোগ আন্দোলন আমাদের এবং সারা দেশটাকে
গণআন্দোলন সম্পর্কে যে ব্যবহারিক শিক্ষা দিল এবং তার অসীম শক্তি টের পাওয়াল, তার ফলে
পরবর্তিতে কৃষক-আন্দোলনও গণআন্দোলনের রূপ নিল, এটা সবচেয়ে বড় পাওনা।
অসহযোগ চলতে থাকার
জন্য কংগ্রেসিরা প্রাদেশিক কাউন্সিলের বাইরে রইল। ফলে ম্যাড্রাস, বোম্বাই ইত্যাদি
জায়গায় মন্ত্রী হল অব্রাহ্মণ দলের প্রতিনিধিরা এবং তারা প্রভুত্ব কায়েম করল। সেই
প্রভুত্ব কায়েম রাখার জন্য ওরাই অন্ধ্রপ্রদেশে অন্ধ্র-প্রাদেশিক রাইয়ত এসোসিয়েশন
নামে একটি কিসান সভা সে সময়, অর্থাৎ ১৯২৩-২৪ সালে তৈরি করল; এমনটা বলা হয়ে থাকে।
কিন্তু সে সভার বিশেষ কোনো সক্রিয়তা দেখা গেল না। হ্যাঁ, বিহারে বর্তমান লেখক
নিজের কংগ্রেসি সাথীদের সহযোগে ১৯২৭ সালে, নিয়মিত রূপে, সদস্যতার ভিত্তিতে, পাটনা
জেলায় কৃষক সভা স্থাপন করল এবং ধীরে ধীরে ১৯২৯ সালে তাকে বিহার প্রাদেশিক কৃষক সভার
রূপ দিল। সে সময় বিহারের কাউন্সিলে কৃষক-স্বার্থ-বিরোধী একটি বিল সরকারের তরফ থেকে
পেশ হয়েছিল এবং কৃষকদের তরফ থেকে তার সংগঠিত প্রতিরোধ করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। তাই কংগ্রেসি
নেতারা বিহার প্রাদেশিক কৃষক সভার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল এবং তাই তার জন্ম হল।
স্বর্গীয় ব্রজকিশোরবাবু ছাড়া ওতে বাকি সব কংগ্রেসি লিডার শামিল ছিলেন। ওই সভার
কাজ, বর্তমান লেখকের সভাপতিত্বে বেশ ভালো ভাবে চলল এবং শেষে সরকারকে সেই বিল প্রত্যাহার
করতে হল। অর্থাৎ জন্মের সাথে সাথেই অভূতপূর্ব সফলতা পেল সভা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী
বাবু শ্রীকৃষ্ণ সিং সে সময় কৃষক সভার সচিব ছিলেন। পরের দিনগুলোয় সভাকে আরো অনেক সংগ্রাম
করতে হল। এভাবে সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই এই কৃষক সভা পুষ্পিত হল, ফলবান হল এবং
প্রাপ্তবয়স্ক হল।
১৯১৮-১৯ সালেই
এলাহাবাদে শ্রী পুরুষোত্তমদাসজী টন্ডনএর দেখাশোনায় কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং তাতে
কিছু কাজও হয়েছিল। তারপর, অসহযোগের শেষে, কংগ্রেসিরা আরো বেশি করে এই কাজে জুটল,
এমনকি ১৯৩২এর সত্যাগ্রহের আগে ওখানকার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিই একটি কৃষকসমিতির
মাধ্যমে কৃষকদের মাঝে আন্দোলন চালিয়ে গেল এবং প্রয়োজনে খাজনা না দেওয়ার জন্যও ওদের
তৈরি করতে থাকল। ফলে ১৯৩২এ কংগ্রেসের সংগ্রামে ওখানকার কৃষকেরা খাজনা না দেওয়ার ডাকে
বড় ভাবে সাড়া দিল। শ্রী টন্ডনজীই তার পর প্রয়াগে “কেন্দ্রীয় কৃষক সঙ্ঘ” স্থাপন
করলেন। এই সংগঠনই ভবিষ্যতের অখিল ভারতীয় কৃষক সভার সূত্ররূপ ছিল। পন্ডিত নেহেরু,
টন্ডনজী প্রভৃতি কংগ্রেসি নেতারা সব সময় অনুভব করতেন যে কৃষক সংগঠন কংগ্রেস থেকে
আলাদা থাকাই ভালো। সেই জন্য ইয়ু.পি. তে আগে কৃষক সমিতি তৈরি হল তারপর কেন্দ্রীয় কৃষক
সঙ্ঘের জন্ম হল।
পরে, কংগ্রেসের লখনউ
অধিবেশনের সময় ১৯৩৬ সালে অখিল ভারতীয় কৃষক সভা আনুষ্ঠানিক ভাবে স্থাপিত হল। প্রথম
অধিবেশন ওখানেই বর্তমান লেখকের সভাপতিত্বে হল। এ কথাটা অনুভূত হচ্ছিল সংগঠিত কৃষক আন্দোলনকে
সর্বভারতীয় রূপ না দিতে পারলে কাজ চলবে না। তাই হল। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৩ অব্দি সংগঠনের
কাজ চলল এবং কোথাও কোনো ঝামেলা হল না। ১৯৩৬, ১৯৩৮ এবং ১৯৪৩এ বর্তমান লেখক এর সভাপতি
এবং বাকি বছরগুলোয় সাধারণ সম্পাদক ছিল। ১৯৩৭ সালে প্রফেসর রঙ্গা, ১৯৩৯এ আচার্য
নরেন্দ্রদেব, ১৯৪০এ বাবা সোহন সিং ভাখনা এবং ১৯৪২এ শ্রী ইন্দুলাল যাগ্নিক সভাপতি ছিলেন।
তার পর
কম্যুনিস্টদের নীতি এমন পরিস্থিতি তৈরি করল যে ওরা একা থেকে গেল এবং বাকি সমস্ত
প্রগতিশীল ভাবধারায় ভাবিত বামপন্থীরা ওদের থেকে আলাদা হয়ে গেল। কিছু দিন এমনই
কাটল। এরই মধ্যে ১৯৪২এর রাজবন্দীরা জেল থেকে বাইরে আসতে লাগল। ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝি
সময় থেকে অল ইন্ডিয়া কিসান সভাকে আবার থেকে সংগঠিত করা শুরু করেন টন্ডনজী এবং এই
বর্তমান লেখক। অক্লান্ত উদ্যমের ফলে ৯ই জুলাই ১৯৪৬ সালে বোম্বাইয়ে “হিন্দ কিসান সভা”
নামে সংগঠনটি পুনর্স্থাপিত হয়েছে। সভাপতি হয়েছেন শ্রী পুরুষোত্তম দাসজী টন্ডন এবং
সংগঠন সচিব এই লেখক। অন্যান্য সচিব এবং সদস্যদের নিয়ে একটা কমিটি তৈরি হয়েছে; ২৫
জনের এই কমিটিতে চার সদস্য এখনো নির্বাচিত হয়নি।
সংক্ষেপে ভারতীয় কৃষক আন্দোলনের ক্রমবদ্ধ বিকাশের রূপরেখা এই। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এর শাখা আছে, কিছু সক্রিয় এবং কিছু ঢিলেঢালা।কিন্তু সব ক’টি শাখাকে পুরোপুরি সক্রিয় করার দায়ভার সংগঠন সচিবকে দেওয়া হয়েছে। সংগঠন সচিব এই কাজে পুরোপুরি নিয়োজিত। আজ ভারতের কোনায় কোনায় কৃষক সংগঠনের ডাক রয়েছে, গলার জোর রয়েছে এবং এটা শুভ লক্ষণ।
(ব)
কৃষক সভা কৃষকদের
শ্রেণী সংগঠন। শ্রেণী অর্থে আর্থিক শ্রেণী, ধার্মিক বা জাতীয় নয়। এই সভার উদ্দেশ্য
কৃষক শ্রেণীর শত্রু, জমিদার-মালদারদের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করা এবং সংগঠিত
প্রয়াসের মাধ্যমে কৃষকদের অধিকারগুলো হাসিল করা। যত দিন সব রকমের আর্থিক, রাজনৈতিক
এবং সামাজিক শোষণের অবসান ঘটিয়ে শ্রেণিহীন সমাজ তৈরি না হয় এই লক্ষ্য পূরণ হবে না।
ফলে, এই ধ্যেয়, এই লক্ষ্য এবং এই অভিষ্টের সিদ্ধি সেই শ্রেণিহীন সমাজেই হতে পারে
যেখানে মানুষের শোষণ মানুষ করতে পারবে না, সবাই নিজেদের পূর্ণতম বিকাশের সুযোগ
পাবেন এবং এভাবে যে কোনো মানুষের সমস্ত রকম প্রয়োজনের পূর্তি নির্বাধ হতে থাকবে।
তাই সব জাতি, ধর্ম
ও সম্প্রদায়ের সেই মানুষদের এই সংস্থা যাদের চাষ করতে হয়, যারা চাষি এবং প্রধানতঃ
চাষকাজ না করলে যাদের জীবিকা চলেনা। এভাবে, খেতমজুরদেরও সংস্থা এই কৃষক সভা। খেতমজুররাও
কৃষকের মধ্যে পড়ে। তারা যথার্থই কৃষক, জমি চষে-বোনে (tillers of the soil)। তাহলে
ওরা কৃষকদের থেকে আলাদা কিভাবে থাকবে? এমনও নয় যে খেতমজুরেরা হরিজন, অছুত বা কোনো
বিশেষ ধার্মিক সম্প্রদায়ের। আজ পরিস্থিতি এমন যে প্রতি বছর নয় লক্ষের থেকে বেশি কৃষক
নিজেদের চাষজমি হারিয়ে, ভূমিহীন বা বলুন খেতমজুর হয়ে চলেছে এবং তারা সমস্ত ধর্ম এবং
জাতের। তাদের মধ্যে থেকে মাত্র কয়েকজন অন্য কোনো রোজগার খুঁজে পায়। অধিকাংশ খেতমজুরই হয় – বাধ্য হয়ে হতে হয়।
ধর্মের ও জাতের ভিত্তিতে করা শ্রেণিবিভাজন মিথ্যে, ভূল
এবং মানুষকে প্রতারণা করে। আইনের নজরে টেন্যান্ট বা কৃষকের অধিকার সমান, তা সে কৃষক
মুসলমান, হিন্দু, ব্রাহ্মণ, শূদ্র, শেখ, পাঠান ইত্যাদি যাই হোক না কেন। জমিদারের অধিকারের
প্রশ্নও একই রকম। নিজের নিজের অধিকারের লড়াই এই দৃষ্টি থেকেই হয়। জমিদার হিন্দু
বলে হিন্দু কৃষককে, বা মুসলমান বলে মুসলমান কৃষককে রেয়াত করে না। কৃষক যে কোনো ধর্মের হোক, তার বিরুদ্ধে সব
হিন্দু-মুসলমান জমিদার এক হয়ে যায়, একই সুরে গলা চড়ায়। জমিদারদের বিরুদ্ধে সব ধর্ম,
জাতি এবং সম্প্রদায়ের কৃষকদেরও এমনই করা উচিৎ, এমনই করতে হবে। এভাবেই এক পক্ষে সংগঠিত
হয়ে নিজেদের কন্ঠস্বর শক্তিশালী করতে হবে এবং নিজেদের অধিকারের জন্য মিলেমিশে লড়তে
হবে। শ্রেণি সংস্থার মানে এটাই এবং এই সংগঠনই হল কৃষক সভা। যতক্ষণ কৃষকেরা এক
সূত্রে বাঁধা পড়ে না, সংগঠিত হয়না, ততক্ষণ নিজেদের শ্রেণির শত্রুদের বিরুদ্ধে যা
কিছু চ্যাঁচামেচি করুক, সেসব শুধুই আন্দোলন। কিন্তু যেই তারা এক সূত্রে নিজেদের
বেঁধে এই কাজই করে তখনই তার নাম হয় কৃষক সভা। এক সূত্রে নিজেদের এই বাঁধন যত দৃঢ় হয়
ততই শক্তিশালী হয় কৃষক সভা। আর তাহলে এতে ওদের শ্রেণিশত্রুদের এবং শ্রেণিশত্রুর মদতগার
সাথিদের কোনো জায়গা থাকবেনা। কেননা তা যদি না হয় তাহলে এটা শ্রেণি সংস্থা কি ভাবে থাকবে?
সংস্থা মানে তো দুর্গ! তাহলে তাতে শ্রেণিশত্রু বা তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা কি ভাবে ঢুকতে
পাবে? ঢুকলে তো ওই দুর্গটাই শত্রুদের হয়ে যাবে আর যে কাজের জন্য ঐ দুর্গ তৈরি হল
সে কাজটাই আর হতে পারবে না।
যেমন ইঁদুর আর
বেড়ালের দুটো পরস্পরবিরোধী শ্রেণি আছে এবং এক শ্রেণি অন্য শ্রেণিকে দেখতে চায় না,
ইঁদুর বেড়ালকে আর বেড়াল ইঁদুরকে শেষ করে দিতে চায়, ঠিক তেমনই সম্পর্ক জমিদার ও কৃষকদের
মধ্যেকার। ওরা একে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চায়। কৃষক পরিবার খিদেয় মরে যাক, ওষুধ
আর জামাকাপড়ের অভাবে কোঁকাতে থাকুক, তবুও ওদের পয়সায় ফুর্তি লুটতে থাকা জমিদার কখনো
ওদের রেয়াত করার জন্য একটু নরম হবে না, খাজনার বা পাওনার একটা কড়িও ছাড়তে চাইবে
না। বন্যা বা খরায় ফসল শেষ হয়ে যায় আর মহাজনের কাছ থেকে কর্জ নিয়ে করা কৃষকের
সমস্ত খরচ জলে চলে যায়। তবুও জমিদার নিজের খাজনা পাই-পাই উশুল করেই নেয়। আদালতও তাকেই
সাহায্য করে। কৃষকের ফরিয়াদ কেউ শোনেনা। এর বিপরীতে, যদি কৃষকের কাছে টাকাপয়সা থাকেও, তবুও সে, যদি ব্যাপারটা তার বশে থাকে, জমিদারকে
এক কানাকড়িও দিতে চায় না। যদি দেয় সেটা নিরুপায় হয়েই দেয়, আইন আর লাঠির ভয়ে। সে ভিতর
থেকে চায় যে জমিদার নামের জীবটা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। জমিদারও কৃষকের কাছ
থেকে শুধু খাজনা চায় না, বরং তার সমস্ত জমি যেন-তেন-প্রকারেণ ছিনিয়ে নিয়ে তাকে
রাইয়ত বা প্রজাসত্বধারী বানিয়ে নিজের কব্জায় রাখতে চায়। এর চেয়ে বেশি শ্রেণিশত্রুতা
আর কী হতে পারে? ফলে, যেমন জমিদারেরা নিজের স্বার্থরক্ষার্থে বিভিন্ন নামে জমিদার
সভা তৈরি করে রেখেছে এক কাল থেকে আর ওই সভাগুলোর মাধ্যমেই নিজেদের অধিকারের জন্য
লড়াই করে, ঠিক তেমনই কৃষকের শ্রেণিস্বার্থরক্ষার্থে কৃষক সভা আছে, কৃষকসভার
প্রয়োজন আছে, কৃষক সভা চাই। তবেই কৃষকের নিস্তার। জমিদার তো পয়সাওয়ালা আর ধূর্ত, তাই
সভা ছাড়াও নিজের স্বার্থরক্ষা করতে পারে। চালাকি করে অন্য সভায় ঢুকে বা তার ওপর নিজের
প্রভাব বিস্তার করেও নিজের কাজ হাসিল করতে পারে। টাকা-পয়সা, বুদ্ধি আর সামাজিক প্রতিপত্তিতে
কি না হয়? কিন্তু কৃষকের কাছে তো এসব কিছু নেই। তাই কৃষক সভার প্রয়োজন।
বলা হয় যে যখন ইংরেজদের
সাথে লড়ার জন্য আর তাদের কাবু করার জন্য কংগ্রেস আছেই এবং তার ৯০ প্রতিশত সদস্যই কৃষক,
তাহলে আলাদা করে কৃষকসভা গঠনের কি দরকার? এমনও নয় যে কংগ্রেস কৃষকদের জন্য কখনো
লড়ে না। ফৈজপুরে গৃহীত ওদের কৃষক কর্মসূচি (Agrarian programme) আর এদিককার,
জমিদারী উচ্ছেদ করার ওদের সংকল্প, জ্বলন্ত প্রমাণ যে কংগ্রেস কৃষকদের নিজের সংস্থা।
যদি ওতে জমিদার বা তাদের মদতগারও থাকে তাহলেই বা কি? ওরা চিন্তা তো করে কৃষকদের
জন্য। যদ কেউ বলে যে কংগ্রেস কমিটিগুলো বেশির ভাগ কব্জা করে প্রভুত্ব বিস্তার করে
রাখে পয়সাওয়ালারা, তবুও এটা কোনো কথা নয়। এ তো কৃষকদের ভুল, ওদের অনভিজ্ঞতা যে নির্বাচনের
সময় ওরা পিছিয়ে যায়। যখন ওরাই কংগ্রেস-সদস্যের অধিকাংশ, তখন সজাগ থেকে নির্বাচনে
লড়ুক আর সবকটা কমিটি কব্জা করুক। যখন দেশের জন্য লড়াই করা, মৃত্যু বরণ করা অধিকাংশ
কংগ্রেসিই কৃষক, তখন কংগ্রেস ওদের নয় তো আর কাদের, কাদের হতে পারে? তাই মানতেই হবে
যে কংগ্রেসই সবচেয়ে এগিয়ে থাকা কৃষক-সংগঠন, কিসান সভা – Congress is the Kisan
organisation par excellence.
ওপর ওপর দেখলে কথাগুলো
এমনই মনে হয়। সত্যি কথা যে কংগ্রেস জমিদারি উচ্ছেদ করার সংকল্প নিয়েছে। তার আগে কৃষক-স্বার্থ
সম্পর্কিত কর্মসূচিও ওরা তৈরি করেছে। এটাও নির্বিবাদ যে ভবিষ্যতেও ওরা এমনটি করবে।
এও স্বীকার করি যে কংগ্রেস প্রগতিশীল সংস্থা। তবেই তো প্রতিদিন বদলাতে থাকা
দুনিয়ায় সে টিকে থাকতে পারবে এবং স্বাধীনতার জন্য সফল সংগ্রাম সঞ্চালিত করতে
পারবে। তাই কৃষক যদি ওই কংগ্রেসে ভেড়ে, ততদিন ভিড়ে থাকা উচিৎ যতদিন স্বাধীনতার
যুদ্ধ জারি থাকে এবং আমরা স্বাধীন না হই। কংগ্রেস দুর্বল হলেই স্বাধীনতার আশা শেষ
হয়ে যাবে। গোলামির বিরুদ্ধে পুরো জাতির বিদ্রোহের প্রতীক ও প্রতিমূর্তিটাই কংগ্রেস।
স্বাধীনতার জন্য সারা দেশের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং অস্থিরতার বহির্গত বা মূর্ত রূপই হল
কংগ্রেস। জাতীয়তা আমাদের প্রত্যেকের শিরায় প্রবেশ করেছে, আমাদের রক্তে ওতপ্রোত হয়ে
আছে। শিরায়-উপশিরায় ছড়িয়ে আছে। এই জাতীয়তা যত ব্যাপক এবং সংগ্রামের জন্য আকুলভাবে
আগ্রহী (militant) হবে, ততই সত্বর পাবো আমরা স্বাধীনতা। তাই প্রতিটি কৃষকের এই
জাতীয়তার ভাবনায় ওতপ্রোত হওয়া এবং কংগ্রেসি হওয়াই উচিৎ যাতে আমাদের দেশ তাড়াতাড়ি
পুরো স্বাধীন হয়। গোলাম ভারতে কৃষক-রাজ বা সমাজবাদের আশা করা নিতান্ত বোকামি।
এই ভাবে যখন কৃষকেরা
ইংরেজদের বিরুদ্ধে সোজা লড়াইয়ের মাধ্যমে আর নির্বাচনে বেশি করে ভোট দিয়ে কংগ্রেসকে
শক্তিশালী করে তুলবে, তার বদলে কংগ্রেসকেও ওদের খেয়াল রাখতে হবে। ওদের অধিকারের
জন্য মাঝেমধ্যে লড়তে হবে। কৃষক-অধিকার সম্পর্কিত কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং জমিদারি
উচ্ছেদের দাবি স্বীকার করে কংগ্রেস তাই করছেও। কংরেসি নেতারা খুব ভালো করে বোঝে যে
যদি তারা এমন না করে এবং জমিদারি উচ্ছেদ না করে, তাহলে ওরা নিজেরাই উচ্ছেদ হয়ে
যাবে, নেতাগিরি চলে যাবে আর কংগ্রেসও শেষ হয়ে যাবে। এটা কঠিন সত্য। জাতীয়তা খুব
উপাদেয় এবং সুন্দর, কিন্তু শুধু ভাবুক হওয়া যায়, অনুভূতি আর মাথার জিনিষ, কাল্পনিক
পদার্থ। বস্তুগত কোনো পদার্থ নয়, ঠিক যেমন ধর্ম, ঈশ্বর, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি।
ওগুলোও নিছক কাল্পনিক। তাই মাঝেমধ্যে বস্তুগত পদার্থ – ধনসম্পদ, বৌ আর জমির সামনে
এসব টিঁকতে পারেনা। এসবের অবহেলা হয় আর লোকে জমি-জায়গার জন্য গঙ্গা-তুলসি, কুরান-পুরাণ
ইত্যাদি উঠিয়ে মিথ্যে কসম খায়। সেভাবেই, অনবরত বস্তুগত স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে
এই জাতীয়তা টিঁকতে পারে না, মুছে যায়। সেই কারণেই কংগ্রেসি লিডাররা সময়ের হিসেবে কৃষকদের
বস্তুগত স্বার্থের কথা বলতে থাকেন। অনুভূতিসর্বস্ব নিছক জাতীয়তা বস্তুগত স্বার্থগুলোকে
সঙ্গে নিয়েই টিঁকতে পারে, উদ্দেশ্য-সিদ্ধিতে সফল হতে পারে। যদি এই ভৌতিক স্বার্থগুলো
ছেড়ে দেয় বা এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে জাতীয়তা নিশ্চয়ই বড় রকমের বিপদে পড়বে।
মৃত্যু খুব খারাপ,
বড় বিপজ্জনক। তার তুলনায় জুতোর পেরেক ফোটা কোনো ব্যাপারই নয়। তবু সাধারণতঃ, মৃত্যু
থেকে বাঁচার জন্য চিন্তান্বিত হতে কাউকে দেখা যায় না। কিন্তু পেরেকের কষ্ট থেকে
বাঁচার চেষ্টা সবাই করে। এটাই কঠিন সত্য আর এটা ভুললে আমরা প্রতারিত হব। ঠিক
সেরকমই জাতীয়তাও ধাক্কা খাবে যদি সে কৃষকদের তাৎক্ষণিক দাবি এবং কষ্টের দিকে নজর
দিয়ে নিজের কর্মসূচি স্থির না করে। জাতীয়তাকে ব্যবহারিক ও কার্যকরী হতে হবে এবং বস্তুগত
জগতটা দেখে চলতে হবে। তাহলেই পূর্ণ স্বাধীনতার যুদ্ধে সফলতা আসবে। এটাই কারণ যে
জাতীয় নেতারা জমিদারি উচ্ছেদের কথা বলেন আর জমিদারদের রাগের মুখোমুখি হন। এতে ওদের
চালাকি এবং বিচক্ষণতা টের পাওয়া যায়।
এটাও ভুললে
চলবেনা যে ফ্রান্সে জমিদারি উচ্ছেদ করেছিল নেপোলিয়নের মত সাম্রাজ্যবাদী। কেই বলতে
পারবে না যে ওর কৃষকের মনোবৃত্তি ছিল বা তার সংস্থাটি কৃষক সভার মত ছিল।
নেপোলিয়নের সরকার অত্যন্ত গোঁড়া কিন্তু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিল। সে দেখল যে ফ্রান্সের
প্রাচীন রাজঘরানার লোকেরা, জমিদারশ্রেণির এবং মধ্যমশ্রেণি, বুর্জোয়া অথবা কলকারখানাদারদের
সমর্থক, দু দলে ভাগ হয়ে আছে। কৃষকের দিকে কেউ নেই দেখে সে জমিদারি উচ্ছেদ করে তাদের
নিজের দিকে করল এবং সৈন্যবাহিনীতে কৃষক যুবকদের ভর্তি করে বড় বড় যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে
সাম্রাজ্যবিস্তার করল। এতে তার বিচক্ষণতা এবং দূরদৃষ্টি ছিল, অন্য কিছু নয়। সে কৃষকও
ছিল না এবং কৃষকের মনোবৃত্তিও ছিল না তার; আর এক সময়ের পর এই সত্যটা কৃষকেরাও জেনে
গেল, পুরো দুনিয়াও জেনে গেল যে তারই তৈরি ‘নেপোলিয়নি আইন’এ ওই কৃষকদের জমি ঝটপট ব্যাঙ্ক
এবং মহাজনদের হাতে চলে গেছে। যুক্তরাজ্য আমেরিকার সরকার তো ওই দেশে জমিদারি প্রথা
হতেই দিল না আর বেশির ভাগ কৃষককে, বিশেষ করে দেশের পশ্চিম অংশে, বিনামূল্যে জমি
দিল। এ কথা লেনিনের রচনা-সঙ্কলনের ইংরেজি সংস্করণের দ্বাদশ ভাগে পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৯৪এ
স্পষ্ট লেখা আছে। অন্যান্য দেশেও গোঁড়া এবং পুরোনোপন্থী দলগুলোই জমিদারি উচ্ছেদ
করেছে।
আসলে দেশে দেশে শিল্পোদ্যোগের অবাধ প্রগতির জন্য যে
কাঁচা মালের প্রয়োজন তার উৎপাদনে বাধা হয় জমিদারি প্রথা। মানা হয় যে ভূমির উৎপাদন শক্তিকে
শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে জমিদারি প্রথা। ফলে মধ্যশ্রেণির ধনীরাই এদের উছেদ করে। ভারতেও
“বোম্বাই যোজনা” (Bombay Plan)এর প্রচারক এবং প্রস্তুতকারক টাটা, বিড়লা ইত্যাদি
কোটিপতিরা জমিদারি উচ্ছেদের পক্ষে আওয়াজ তুলেছিল – সেই গত মহাযুদ্ধের জমানাতেই। তাদের
পিছনে পিছনে কংগ্রেসের নেতারাও সেটা মেনে নিয়েছে। আর সবাই জানে যে টাটা বিড়লার সংগঠন
কোনো কৃষক সভা নয়। কাজেই, জমিদারি উচ্ছেদের কথা কোনো প্রমাণ নয় যে কংগ্রেস কৃষক সভা
হয়ে গেছে। হ্যাঁ, যদি বৈপ্লবিক ধরণে জমিদারি উচ্ছেদের কথা বলত কংগ্রেস এবং সেভাবেই
কাজ করত যেমন সোভিয়েত রুশে হয়েছিল, তাহলে একটা কথা ছিল। তখন সেরকম কিছু ভাবা যেতে
পারত, যদিও ফ্রান্সে বৈপ্লবিক ধরণে হওয়া সত্ত্বেও, যারা করাল তারা কৃষক-বিরোধীই
প্রমাণিত হল। বৈপ্লবিক ধরণের মানেই হল জবরদস্তি জমিদারদের জমি এবং সম্স্ত
সম্পত্তি ছিনিয়ে নেওয়া আর ওদের পথের ভিখিরি বানিয়ে দেওয়া বা মহা প্রস্থানের পথে
যাত্রায় পাঠিয়ে দেওয়া।
এটাও ভাবা উচিৎ
যে কংগ্রেস তো ১৯৩৬-৩৭ সালের নির্বাচনেও লড়েছিল। তখনই ওরা ফৈজপুরের একটি অত্যন্ত ঢিলেঢালা
কর্মসূচিও জমিদারি উন্মুলনের নামে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেই কর্মসূচিও, কংগ্রেসি
মন্ত্রিমন্ডলগুলো তৈরি হওয়ার পর সর্বত্র তাকে তোলা রইল। উল্টে, ওই মন্ত্রীরাই
যুক্ত প্রদেশে এমন প্রজাসত্ব আইন তৈরি করল যে মহাযুদ্ধের জমানায়, সরকারি বয়ান
অনুসারেই, পুরো দশ লক্ষ একড় জমি কৃষকদের কাছ থেকে জমিদারেরা ছিনিয়ে নিল আর কৃষকদের
মাঝে হাহাকার পড়ে গেল। তারই প্রায়শ্চিত্ত এবার ওখানে কংগ্রেসের মন্ত্রীদের করতে
হচ্ছে। বিহারেও এমনই কিছু একটা হতে যাচ্ছিল। কিন্তু এখানে কৃষক সভার সচেতনতা এবং
প্রবল আন্দোলনে সেটা অনেক দূর অব্দি আটকান গেল। তবুও অনেক অনর্থ হল। যদি কংগ্রেসই
কৃষক সভা হত, তাহলে কি এমনটা হতে পারত? উল্টে বিহারের কৃষক সভাকে কংগ্রেসি মন্ত্রী
আর লিডাররা এই বলে দুষল যে এই সভা কংগ্রেস-বিরোধী। কিন্তু প্রশ্ন যে একটা নির্জীব
এবং ঢিলেঢালা কৃষক-কর্মসূচির বদলে কংগ্রেস তখনই জমিদারি উচ্ছেদের কর্মসূচি কেন
গ্রহণ করেনি? কংগ্রেস কি কাল অন্য কিছু ছিল আর আজ বদলে গেল?
আসলে সে সময় কৃষক
সভা এত শক্তিশালী ছিল না এবং সে সভাও জমিদারি উচ্ছেদের প্রশ্নটাকে এতটা জোরদার করে
তুলতে পারেনি যাতে কংগ্রেস চাপে পড়ে এবং মানতে বাধ্য হয়। তখন জমিদারির বিরুদ্ধে
হাওয়া এত বিরূপ ছিল না। কংগ্রেসের প্রধান স্তম্ভ কৃষকসমাজ জমিদারি উচ্ছেদের প্রশ্নে
আজকের মত এত লড়াকু মনোভাব নেয় নি। জমিদারির বিরুদ্ধে আজকের মত এত রোষ-ক্ষোভ তাদের
মধ্যে ছিল না। ফলে ওদের উচ্ছেদের প্রশ্ন না তুলেও কংগ্রেস সে সময় কৃষকদের নিজের পক্ষে
টানতে পারত। আজ উচ্ছেদের প্রশ্ন না তুলে কংগ্রেসের টেঁকা বা কৃষকদের সঙ্গে রাখা
অসম্ভব। তাই, পুরো দশ বছর পরে কংগ্রেস জমিদারি উচ্ছেদের কথা বলছে। তাও ক্ষতিপূরণ
বা দাম দিয়ে।
এতে কয়েকটি কথা
প্রমাণ হয়। কংগ্রেস নিজের ইচ্ছেয় এটা না করে কৃষক সভা, কৃষক আন্দোলন এবং কৃষকের
চাপেই করছে, অথবা বলতে পারেন হাওয়ার দিকবদলটা চিনছে। এতে কংগ্রেসের বা কংগ্রেসের
নেতাদের সুবিধেবাদ প্রমাণিত হয়, নিশ্চয়ই তা কৃষক সভা বা কৃষক নেতা হওয়ার লক্ষণ নয়।
কৃষকদের স্বার্থ তো ১৯৩৬-৩৭ সালেই জমিদারি উচ্ছেদের ডাক দিয়েছিল।
এতে কৃষক সভা এবং
কংগ্রেসের মাঝের মৌলিক ও বুনিয়াদি প্রভেদটাও প্রমাণিত হয়ে যায়। যেখানে কৃষক সভা অর্থনীতি
এবং আর্থিক কর্মসূচিকে রাজনীতির নজরে দেখে, রাজনীতিকে উপায় এবং আর্থিক ব্যাপারগুলোকে,
অর্থনীতিকে উদ্দেশ্য মনে করে, আর তাই রাজনৈতিক জয়-পরাজয়ের বিশেষ পরোয়া না করে সর্বদা
কৃষকের আর্থিক ব্যাপারগুলোর দিকেই লক্ষ্য রাখে এবং তেমনই কর্মসূচি চায়, কংগ্রেস
রাজনীতিকেই অর্থনীতির দিক থেকে, সেই আয়নায় দেখে। ফলে কংগ্রেসের জন্য আর্থিক
ব্যাপারগুলো বা কর্মসূচি উপায় এবং রাজনীতি উদ্দেশ্য। এটাই কারণ যখন ১৯৩৬-৩৭এ সাধারণ
আর্থিক কর্মসূচি দিয়েই রাজনৈতিক নির্বাচনে জয়লাভ সম্ভব ছিল তখন তেমন কর্মসূচি তৈরি
করল। কিন্তু এবার যখন দেখল যে সেটা সম্ভব নয় তো জমিদারি উচ্ছেদের কথা ওঠাল।
সার অর্থ, যে
কোনো পরিস্থিতিতে তাকে কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতিতে সফল হতে হবে। তাই কৃষকস্বার্থ
কংগ্রেসি নেতাদের উদ্দেশ্য নয় উপায় মাত্র। কৃষকস্বার্থ নিয়ে কথা বলে বা সে অনুসারে
কাজ করে তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়। এই জিনিষটা কৃষক নেতা এবং কৃষক সভার
মধ্যে থাকতে পারে না। তাদের তো কাজই কৃষকস্বার্থকে নিজেদের চরম উদ্দেশ্য করা, সেই
পথে এগোনো এবং কোনো এক দিন সেই পথেই রাজনীতিতেও জয়লাভ করা।
দ্বিতীয় কথা যে
যদি কংগ্রেস থেকে আলাদা স্বতন্ত্র কোনো কৃষক আন্দোলন এবং কৃষক সভা না থাকে তাহলে কংগ্রেসের
ওপর চাপটা কে দেবে? আজ যে কংগ্রেসকে প্রগতিশীল মনে করা হয় সেটা তো এই জন্যই যে সে সময়ের
সাথে তাল মিলিয়ে চলে? এটাই কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব যে তার মধ্যে এই সম্ভাবনা
রয়েছে, এটাই তার প্রাণ ও স্পর্ধার জন্য সবচেয়ে জরুরি জিনিষ। কিন্তু যদি চাপ না থেকে?
তখন তো সে পুরোনোপন্থীই হয়ে যাবে, তার প্রগতি হারিয়ে যেতে থাকবে আর সে নির্জীব হয়ে
পড়বে, যেমন নরম দলের সংস্থাগুলো হয়ে পড়েছে। সে পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার সংগ্রামে
পূর্ণ সফলতা পাওয়ার আশাই আর থাকবে না। তাই কংগ্রেসের প্রগতিশীলতা এবং উদ্দেশ্যের
সাফল্যের জন্য কৃষকদের তরফ থেকে যে চাপটা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি, তার জন্য
স্বতন্ত্র কৃষক সভা থাকা একান্ত প্রয়োজন। কেননা তবেই কৃষকস্বার্থ দৃষ্টিতে রেখে
স্বতন্ত্র আন্দোলন করে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যেতে পারে যার প্রভাব কংগ্রেসের ওপর
পড়বে এবং কংগ্রেস প্রগতিশীল কর্মসূচি তৈরি করে কৃষক সমুদায়কে নিজের দিকে টানবে। এর
অভাবে নরমদলী আর লিবারালদের মত নির্জীব প্রোগ্রাম বানিয়ে কংগ্রেস শেষ অব্দি কৃষকদের
নিজের সংগে নিয়ে চলতে সক্ষম হবেনা, এটা ধ্রুব সত্য।
যদি কৃষক সভা
স্বতন্ত্র না হয়ে কংগ্রেসের অঙ্গ বা একটি বিভাগ হয় তাহলে সে কৃষক সভা স্বতন্ত্র আন্দোলনও
করতে পারবে না আর তেমন ঝোড়ো আবহাওয়া তৈরি করতে পারবে না যেটা কংগ্রেসের ওপর চাপ দিয়ে
তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং প্রগতিশীল করবে। কেননা তেমন কৃষক সভা কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের
অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকবে এবং অনুশাসনের তাগিদে সে অনুসারেই চলবে। স্বতন্ত্র ভাবে
কোনো কাজ বা আন্দোলন করতে পারবে না।
আর এই ক্ষতিপূরণই
বা কিসের? এতে কি কৃষকের লাভ আছে? এটা কি কৃষকস্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে দেওয়া
হবে? স্পষ্ট ভাবে বলা যায় যে এই প্রস্তাব কৃষকদের ভবিষ্যত আগে থেকেই ডুবিয়ে দেওয়ার।
তাদের ভবিষ্যতের পথে আগে থেকেই বাধার সৃষ্টি করার। ভবিষ্যতে এই ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা
কৃষকদের জন্য বড় বাধা প্রমাণিত হবে। শেষ মেষ এই টাকা তো কৃষকদের কাছ থেকেই উশুল
করা হবে। যা কিছু টাকা ঋণ নিয়ে বা সরকারি ভাঁড়ার থেকে দেওয়া হবে তা যদি কৃষকদের
স্বার্থে ব্যয়িত হয় তাহলে কত এগিয়ে যায় কৃষকেরা? ওই টাকা যদি কৃষকদের শিক্ষা,
স্বাস্থ্য-সংস্কার, গ্রামীণ পথনির্মাণ, সেচ, ক্ষেতের উন্নতি, মার্কেটিং ইত্যাদির
ব্যবস্থায় খরচ হয় তাহলে বাস্তবিকই কৃষক প্রগতির পথে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোবে। এই
কারণেই কৃষক সভা এই ক্ষতিপূরণের তীব্র বিরোধ করে।
বলা হয় যে কৃষক সভা
১৯৩৭ সালের কংগ্রেসি মন্ত্রীসভাগুলোকে বড় নাজেহাল করেছিল আর দুর্নাম দিয়েছিল। কিন্তু এটাই তো কথা
বলার কুৎসিত ধরণ। বিরোধকে স্বাগত জানাতে হয় সব সময়। যতক্ষণ বিরোধ না হয়, কেউ সঠিক
রাস্তায় চলে না। বিরোধীরাই অধিকারপ্রাপ্ত দলের দুর্বলতাগুলো বলে তাদের সামলে
নেওয়ার সুযোগ দেয়। যদি মোটর আর ইঞ্জিনে ব্রেক না থাকে তাহলে মোটরগাড়ি আর ট্রেন কোথায়
গিয়ে পড়বে কে জানে। আর এই ব্রেক জিনিষটা কি – বিরোধ, বাধা বা ‘অপোজিশন’ই তো? ওই
দিনগুলোয় কি কৃষক সভা কংগ্রেসি মন্ত্রীদের টেনে নামাতে বা পদচ্যুত করতে চাইছিল? কোনো
প্রমাণ আছে এর? কৃষক সভা তো শুধু বিপদ আর ত্রুটি দেখিয়ে মন্ত্রীদের মাঝে মধ্যে
সজাগ করছিল যেন তারা সামলে কাজ করে, জমিদারদের মায়াজালে আর ফাঁদে পড়ে পথভ্রষ্ট না
হয়। ফলে মন্ত্রীরা নিজেদের অবশ্যই সামলে নিল আর নিজেদের পক্ষে কৃষকদের রাখতে পারল।
কৃষকদের চোখে সব সময়ের জন্য কলুর বলদের মত ঠুলি পরিয়ে তো রাখা যেত না। কখনো না কখনো
তো খুলতো আর সেটা কংগ্রেসের জন্য খারাপ হত। যদি নিজে থেকে খুলত বা যদি কংগ্রেসের শত্রু
খুলে দিত তাহলে তো ভীষণ বিপদ হত। কৃষক সভা এই দুটো বিপদের হাত থেকেই কংগ্রেসকে রক্ষা
করল। তার জন্য কোথায় কৃতজ্ঞ হবে, তা নয়, বকুনি আর রাগ? সে বন্ধুর কাজ করল। তবুও এই
গোঁসা?
এটাও একটা কথা যে
জাতীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে কংগ্রেস সব শ্রেণির প্রতিষ্ঠান। সব শ্রেণি কংগ্রেসে শরিক
এবং কংগ্রেস সব দল ও শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। কংগ্রেস দাবিও করে তাই। আর তার
হওয়াও উচিৎ তেমনই। তাহলেই সব শ্রেণ্রির মানুষেরা তার সাথে থাকবে, তাকে নিজের প্রতিষ্ঠান
মনে করবে এবং ফলে তাকে মজবুত করার চেষ্টা করবে। এমন পরিস্থিতিতে সে কৃষকদের প্রতিষ্ঠান
বা সভা কি করে হতে পারে? সে কেবল একটি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব কিভাবে করতে পারে?
এটাই তো তার দুর্বলতার সবচেয়ে বড় কারণ হবে, কেননা তখন জমিদার, মালদার ইত্যাদি অন্যান্য
শ্রেণিরা তার সঙ্গে তো থাকবেই না উল্টে ঘোর শত্রু হয়ে যাবে। জমিদারি উচ্ছেদের প্রশ্নটা
যে ক্ষতিপূরণের প্রস্তাবের সাথে ওঠান হয়েছে, তারও তাৎপর্য্য ওখানেই। যুগ পাল্টাচ্ছে।
ক্ষতিপূরণে বিরাট ধনসম্পত্তি জুটিয়ে জমিদাররা সেসব শিল্পে-ব্যবসায় খাটাবে আর মালামাল
হবে। জমি থেকে হওয়া একটা বাঁধা আয়ের জায়গায় কলকারখানা থেকে লাগাতার বাড়তে থাকা আয়
হবে এই জমিদারগুলোর, আর কি চাই? তাহলে আর জমিদার শত্রু কেন হবে কংগ্রেসের? এর পরেও
তারা যদি কংগ্রেসের বিরোধ করে তাহলে সেটা হয় তাদের সরলমতি নয়ত তাদের চালবাজি। বিরোধ
না করলে এমনও হতে পারত যে কৃষকদের চাপে
পড়ে কংগ্রেস ওদের ক্ষতিপূরণ দিতই না! কংগ্রেস দলটায় বেশির ভাগই তো জমিদার-মালদার আর
তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ। কটা এমএলএ কৃষক মানসিকতা রাখে? আর এরাই জমিদারি উচ্ছেদের কথার
এই রূপে সমর্থন করে। তার মানে কী – ওরা কি পাগল?
এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসও
কৃষকের মত একটি শ্রেণির প্রতিষ্ঠান হতে পারে না আর কৃষক সভাও কংগ্রেসের অধীনে বা তার
নেতৃত্বে থাকতে পারে না; রাখাও যেতে পারে না। দুটো কথা পরস্পর-বিরোধী। যখনই কৃষক সভা
কৃষকস্বার্থে জমিদারদের সাথে লড়তে চাইবে, কংগ্রেসের অনুশাসনের খোলা তরোয়াল তার ওপর
নেমে আসবে। প্রতি মুহূর্তে তাকে কংগ্রেসের মতি বুঝেই চলতে হবে। কংগ্রেসের প্রধান
কাজ বিভিন্ন শ্রেণির স্বার্থের মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করা আর সেভাবেই এগিয়ে চলা। সে
তো চায় না যে এক শ্রেণি অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করুক, চাইবেও না। হলে সেটা হবে শ্রেণি-যুদ্ধ
বা শ্রেণিসংগ্রাম আর সেটা হলে কোনো এক শ্রেণির পক্ষে কংগ্রেসকে দাঁড়াতেই হবে। ফলে তার
জাতীয় চরিত্রে স্খলন ঘটবে। যে শ্রেণির বিপরীতে গিয়ে অন্যের পক্ষে দাঁড়াবে সে শ্রেণি
কংগ্রেস থেকে সরে যাবে। আর এই সরে যাওয়ার ঘটনা মাঝে মধ্যে হতেই থাকবে কেননা শ্রেণিসংগ্রাম
একবার নয় বার বার হবে। তখন তার জাতীয়তা বাঁচবে কিভাবে আর কিভাবে সে দাবি করবে যে
সে সকল শ্রেণির প্রতিষ্ঠান? তাই, শ্রেণি-সামঞ্জস্যের পথে চলতেই হবে তাকে। আর সেপথেই
চলছে সে। তাই তার অধীনে কৃষক সভা বা তার কৃষক-বিভাগকেও তাই করতে হবে। তাদেরকেও শ্রেণি-সামঞ্জস্যের
মালা জপতে হবে। যদি মুক্তভাবে কৃষক সভা কৃষকস্বার্থে সংগ্রাম না করতে পারে, করার
স্বাধীনতা না থেকে তার, তার পরেও তাকে কৃষক সভা বলা মানে ঠাট্টা করা।
বলা যেতে পারে যে
শ্রেণি-সামঞ্জস্যের এই নীতির ফলে জমিদার শ্রেণিরও স্বার্থহানি হতে পারে। কেন না তাদের
জন্যেও তো কংগ্রেস কখনো সংগ্রাম করবে না। তাহলে এত দুশ্চিন্তা কেন? কথাটা ওপর ওপর ঠিক
বলেই মনে হয়। কিন্তু বাস্তবিকতা ভিন্ন। কখনো কেউ দেখেনি বা শোনেনি যে কংগ্রেস
জমিদার সভাকেও নিজের অধীনে রাখছে বা একটা জমিদার-ডিপার্টমেন্ট খুলেছে। তার সমস্ত
চিন্তা তো শুধু কৃষক সভা নিয়ে, যাতে সেটা হয় জন্মই না নেয় অথবা জন্ম নিলেও তার অধীনে
থাকে। শ্রমিক-সভার এবং জমিদার সভার স্বাধীন সত্ত্বা সে স্বীকার করে। পূঁজিপতি সভার
বিষয়ে তো কিছু বলারই নেই। বরং সত্যি এটাই পূঁজিপতি আর জমিদারদের সভাগুলো কংগ্রেসের
পরোয়াই করেনা। ওরা স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজ করে যায়। তাই কংগ্রেসের শ্রেণি-সামঞ্জস্যের
নীতিতে ওদের ক্ষতি হয় না, হতেই পারে না। ওদের প্রতিষ্ঠানগুলো অনবরত লড়াইয়ের মধ্যে থাকে।
ব্যস, সবরকম বিপত্তি কৃষকদেরই ওপর এসে পড়ে, ভবিষ্যতে আসবেও। কেননা কংগ্রেসের নেতারা
চিন্তায় থাকে যেন কৃষকদের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান না থাকে আর তাই কৃষক সভাকে বাড়তে দেয়
না। তাহলে কৃষকদের স্বার্থের বারোটা বাজা ছাড়া আর কি হবে? যদি সবধরণের শ্রেণিগত
প্রতিষ্ঠানগুলোকে ওরা না বাড়তে দিত তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু তা তো হয়না। এই দশায়
কংগ্রেসের অধীনে কৃষক সভার কাঠামো দাঁড় করান নিছক প্রবঞ্চনা। আসলে কংগ্রেসে
জমিদারদের প্রভুত্ব আর ওরা এভাবেই কৃষকদের উত্থানটা আটকায়। এটা ওদের চক্রান্ত যে
প্রতিষ্ঠানে অনেক শ্রেণি একসাথে আছে তার অধীনে রেখে কৃষক সভাকে সব সময় পঙ্গু করে
রাখবে। আগে তো কৃষক সভার নামেই ভুরু কোঁচকাত। কিন্তু তাতে কিছু হচ্ছেনা দেখে এখন
নতুন তর্কজাল বিস্তার করা হচ্ছে।
বলা যেতে পারে যে
কংগ্রেসে অন্যান্য শ্রেণি – জমিদার, পূঁজিপতি ও শ্রমিক – নগণ্য, ফলে তারা নিজেদের
আলাদা আলাদা সভা তৈরি করেও কংগ্রেসের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না যতক্ষণ কৃষকেরা কংগ্রেসের
সাথে আছে। হ্যাঁ, যদি কৃষকও আলাদা হয়ে যায় তাহলে ভারি বিপদ হবে এবং যদি ওদের স্বাধীন
প্রতিষ্ঠান – কৃষক সভা – তৈরি হয়ে যায় তাহলে তার নিশ্চিত সম্ভাবনা। কৃষকেরা যদি কংগ্রেসকে
ছেড়ে দেয় তাহলে কংগ্রেসের শিকড়টাই কেটে যাবে।
কিন্তু এটা কোনো
যুক্তি নয় যে কৃষক সভার সঞ্চালন যদি কংগ্রেসের লোকেরাই করে তাহলে কি ক্ষতি? তাহলে তাদের
বিরুদ্ধে চলার পথ কৃষকদের কে শেখাবে? সেই কংগ্রেসিই? এতো বড় বিচিত্র কথা। তাই যদি
হয় তাহলে ভাগ্যের লিখন কে পাল্টাবে? কৃষকদের সব সময়ের জন্য কংগ্রেসের লেজের সাথে
বেঁধে রাখা অসম্ভব। এটা কঠোর সত্য যে শ্রেণিগত প্রতিষ্ঠান দুনিয়াতেও আছে আর ভারতেও
আছে। তাই কৃষক তার ছোঁয়া থেকে বেঁচে থাকবে, শ্রেণি-প্রতিষ্ঠানের হাওয়া তাদের গায়ে
লাগবেনা, এটা সম্ভব নয়। তাই পরিণাম হবে এটাই যে এখন তো কংগ্রেসের লোকেরা এই শ্রেণি-প্রতিষ্ঠান
তৈরি করতে পারবে, করবে। কিন্তু পরে সে প্রতিষ্ঠান কংগ্রেস-বিরোধীই হয়ে ছাড়বে আর তখন
কংগ্রেসি লীডাররা কিচ্ছু করতে পারবে না। ফলে, কৃষক সভার ওপর কংগ্রেস-বিরোধীদের প্রভুত্ব
যেন না হয়, এই দেখভালটা কংগ্রেসের তরফ থেকে অন্ততঃ ততদিন নিশ্চয়ই করা উচিৎ যতদিন
স্বাধীনতার সংগ্রাম চলছে আর দেশ স্বাধীন না হচ্ছে। এই দেখভাল থেকে বেশি এগোনো
অনুচিত কাজ এবং অনধিকার চেষ্টা হবে। জমিদার হাজারভাবে কৃষকদের উত্যক্ত করতে থাকে আর
আপনারা কিছুই করতে পারেননা কিন্তু যেই কৃষকেরা নিজেদের সংঘশক্তি কাজে লাগিয়ে সংগঠিত
রূপে জমিদারদের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নেয় এবং সে উদ্দেশ্যে কৃষক সভা তৈরি করে,
আপনারা ‘সব গেল’ ‘সব গেল’, রব তুলতে থাকেন। এ কথাটা এখন কৃষকরাও বুঝতে পারছে আর
সেটা কংগ্রেসের পক্ষে ভালো নয়।
যদি কৃষক সভা কংগ্রেসের লেজ না হয়, যদি সেটা কৃষক সভার জন্য বিপজ্জনক হয় আর তাই স্বাধীন কৃষক সভা তৈরি হওয়া অনিবার্য হয়, তাহলে সে অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং পার্টিরও লেজ হবে না। যদি তার কাছে কংগ্রেসি লিডারদের খবরদারি অসহ্য মনে হয় তাহলে পার্টি লিডারদের শিলমোহরের কি প্রয়োজন? দু ভাবেই তার স্বাধীনতার বারোটা বাজে আর ফলে মজবুত হতে পারে না। আমরা তাকে বলশালী শ্রেণিপ্রতিষ্ঠান বানাতে চাই, আর সেটা করতে যদি কংগ্রেস বাধক হয় তো এই পার্টিগুলোও কম বাধক নয়। বিগত পনের বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা এই কথা বলতে বাধ্য। পার্টিগুলোর প্রথম চেষ্টা এই হয় যে কৃষক সভা বা শ্রমিক সভা তাদের লেজ হোক, তাদের প্রভুত্ব যেন থাকে এবং তাদের ছাপ পড়ে সভাগুলোর ওপর। যদি সেটা হয়, তাহলে সভা তৈরি হোক, নইলে জাহান্নমে যাক। যদি অনেক পার্টি হয় – আর আমাদের দেশে দুর্ভাগ্যবশতঃ সোশ্যালিস্ট, কম্যুনিস্ট, ফরোয়ার্ড ব্লকিস্ট, বিপ্লবী সোশ্যালিস্ট, বলশেভিক ইত্যাদি আলাদা আলাদা পার্টি আছে – তাহলে কৃষক সভা ওদের পারস্পরিক মহাভারতের আখড়া হয়ে যায়। ওদের পারস্পরিক টানা-হ্যাঁচড়ায় সেটা ভালো ভাবে বিকশিত হতে পারে না, তাগড়া ও শক্তিশালী হতে পারে না। প্রত্যেক পার্টির নিজের নিজের বক্তব্য থাকে। সে বক্তব্য ভালো হোক বা খারাপ হোক, তা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু সেগুলো পরস্পরবিরোধী তো হয়ই। ওপর ওপর দেখা না গেলেও বা তারা স্বীকার না করলেও, ভিতরে ভিতরে অবশ্যই হয়। এটা কঠোর সত্য। যদি বক্তব্যে পরস্পর বিরোধ না থাকে তাহলে ঝগড়া কিসের? পার্টিগুলো একে অন্যের সাথে মিলে যায় না কেন? আর কিছু না হোক নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ তো থাকেই। প্রত্যেকটি পার্টি নিজের নেতৃত্ব চায় আর সেটা আরও খারাপ। এমন পরিস্থিতিতে বেচারা কৃষক সভা এদের পারস্পরিক ঝগড়ার আখড়া কেন হবে, কেন হতে দেওয়া হবে? আর যদি ছলে বলে কৌশলে কোনো পার্টি সভায় নিজের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কায়েম করতে চায়, সেটা তাদেরকে কেন করতে দেওয়া হবে? এদের তো নিজেদের লিডারির অসুখ। কৃষক আর তাদের সভা গোল্লায় যাক। কৃষক আর তাদের সভার নাম যদি এরা কখনো নিয়ে থাকে তাহলে শুধু নেতাগিরির জন্যে। নাম চাই, কাজ হোক বা না হোক। গোপনে বসে এসব পার্টি লিডার কিছু সিদ্ধান্ত নেবে, কোনো বক্তব্য স্থির করবে, আর কৃষক সভায় এসে সভার ওপর সেটা চাপিয়ে দেবে, এ খারাপ, অসহ্য ব্যাপার। সভায় বসেই তারা বক্তব্য স্থির করে না কেন? তাহলে বোধহয় তাদের লিডারি থাকবে না। কিন্তু কৃষক সভা তো থাকবে আর ভালো ভাবে থাকবে। যদি এই পার্টি লিডাররা সাচ্চা হন তাহলে তাদের এমনটাই করা উচিৎ। নইলে কৃষক সভাকে রেহাই দেওয়া উচিৎ।
আরেকটা কথা। এই
সমস্ত পার্টিগুলো দাবি করে যে তারা শ্রমিকদের পার্টি। কম্যুনিস্ট পার্টির তো এটাই
দাবি। লেনিনের কম্যুনিস্টা পার্টির নামকরণ বা জন্ম রুশে অক্টোবর ১৯১৭র বিপ্লবের সফলতার
পর বলশেভিক পার্টি থেকেই হয়েছিল। আর এই বলশেভিক পার্টি গঠিত হয়েছিল রুশের সোশ্যাল
ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টিরই সংখ্যাগরিষ্ঠতায়। সেই লেবার বা শ্রমিক পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ
অংশ যে সিদ্ধান্ত নিল সেটা সংখ্যালঘুরা মানল না এবং আলাদা হয়ে গেল। এভাবে এটা স্পষ্ট
যে আজকের কম্যুনিস্ট পার্টি শ্রমিকদেরই পার্টি। লেনিনের লেখায় সর্বত্র এ কথাটা
পাওয়া যায়। মার্ক্স এবং এংগেলসও প্রথম দিকে ভিন্ন ভিন্ন নামে পার্টিটাকে শ্রমিক
পার্টি রূপেই গঠন করেছিলেন। তাহলে কৃষকদের শ্রেণি-প্রতিষ্ঠান ওই শ্রমিক পার্টির ছত্রছায়ায়
কিম্বা নেতৃত্বে কিভাবে গঠিত হতে পারে এবং বলশালী হতে পারে? শ্রমিক পার্টির অধীনে
কৃষক সভা কৃষকদের বাস্তবিক স্বাধীন শ্রেণিগত প্রতিষ্ঠান হবে কি করে? আর যদি
কম্যুনিস্ট পার্টি এই কঠোর সত্যটা এড়িয়ে দাবি করে যে সে কৃষক ও শ্রমিক, দুশ্রেণিরই
পার্টি, তাহলে প্রশ্ন ওঠে যে অনেক শ্রেণির প্রতিষ্ঠান হয়ে সে কৃষকদের শ্রেণিগত
প্রতিষ্ঠানকে নিজের অধীনে কি করে রাখবে এবং তার সাথে ন্যায় করবে? কৃষক সভার একটা
নকল অবশ্য সে দাঁড় করাতে পারে। কিন্তু আসল ও শক্তিশালী কৃষক সভা সে কখনই তৈরি হতে
দেবেনা। বহুশ্রেণিগত প্রতিষ্ঠান হওয়ার সুবাদে যদি কংগ্রেসের নেতৃত্বে কৃষক সভা গঠিত
হতে না পারে তাহলে কম্যুনিস্ট পার্টির লেজ কেন হবে কৃষক সভা?
বলা যেতে পারে যে
কংগ্রেসের ভিতরে থাকা শ্রেণিগুলো পরস্পর-বিরোধী। উদাহরণস্বরূপ জমিদারদের বিরোধ কৃষকদের
সাথে। ফলে তাদের নেতৃত্বে কৃষক সভা গঠিত হতে পারে না। কিন্তু কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে
তো তাদের নিজেদের স্বার্থের কোনো বিরোধ নেই, কৃষক ও শ্রমিক পরষ্পরবিরোধী শ্রেণিও
নয় সে কারণেই। তাহলে এই দু’শ্রেণিরই প্রতিষ্ঠান হিসেবে কম্যুনিস্ট পার্টির অধীনে কৃষক
সভা হবে না কেন?
কিন্তু এ
যুক্তিটা দুর্বল। শেষ অব্দি এই দুই শ্রেণির স্বার্থ মিলে যায়, সমাজবাদ বা
সাম্যবাদের প্রেক্ষিতে এদের পরস্পরে বিরোধ থাকে না এটা সত্যি। কিন্তু প্রশ্ন তো বর্তমান
প্রেক্ষিত ও সময়টার, এবং আজ দু’শ্রেণির স্বার্থে বিরোধ স্পষ্ট। যদি আনাজপাতি, শাকসব্জি
এবং ফল-ফুল বেশি দামে বিক্রি হয় তাহলে কৃষক সুখী হবে এবং আনন্দে থাকবে, কিন্তু কারখানার
শ্রমিক দুরবস্থার মুখোমুখি হবে এবং ক্ষুব্ধ হবে। বিপরীতে, যদি কারখানায় তৈরি মাল –
কাপড় ইত্যাদি – বেশি দামে বিক্রি হয় এবং কারখানাদারদের বেশি লাভ হয়, তাহলে শ্রমিকদের
বেতন বাড়বে, তারা বোনাস এবং অন্যান্য কিছু সুবিধা পাবে। কিন্তু কৃষকেরা এতে দুরবস্থায়
পড়বে। তার উৎপন্ন সমস্ত জিনিষের দাম যদি কাপড় ইত্যাদি কিনতেই বেরিয়ে যায় তাহলে সে
কষ্ট ভোগ করবে। যদি শ্রমিক নিজের দাবি আদায় করার জন্য মাসাধিক কাল হড়তাল করে তাহলে
পরে মিল-মালিক তাদের সামনে নত হয়। কিন্তু তাহলে মিলের কাপড় ইত্যাদির দাম বাড়ে আর কৃষকদের
বেশির ভাগ পয়সা এসব কিনতেই বেরিয়ে যায়। ফলে কৃষকেরা শ্রমিকদের হড়তাল পছন্দ করে না।
এধরণেরই শ’খানেক ব্যাপার হতে পারে যাতে দু’শ্রেণির তাৎক্ষণিক স্বার্থের পারষ্পরিক
বিরোধ স্পষ্ট আর এই তাৎক্ষণিক স্বার্থই তাদের দৃষ্টিকে কোনো এক পথে নিয়ে যায়।
এগুলো বস্তুগত স্বার্থ, প্রত্যক্ষ, চোখের সামনে থাকে। এই স্বার্থের তুলনায় সমাজবাদ
ও সাম্যবাদ ততটাই অপ্রত্যক্ষ, ভাবনাময়, মেধাগত যতটা স্বাধিনতা ও স্বতন্ত্রতা। যেমন
তাৎক্ষণিক স্বার্থ ভুলে আমরা এদের স্বরাজের সংগ্রামে সামূহিক ভাবে আকর্ষণ করতে
পারি না, ঠিক তেমনই এদের পরষ্পরবিরোধী তাৎক্ষণিক স্বার্থগুলোকে দূরে সরিয়ে রেখে, তার
চিন্তা না করে আমরা কৃষকদের বা শ্রমিকদের সামূহিক ভাবে নিজেদের সভায় আকর্ষণ করতে
পারব না। তাহলে আবার সমাজবাদের জন্য এদের প্রস্তুত কি করে করা হবে? ফলে ন্যায়, সততা,
দূরদৃষ্টি এবং ব্যবহারিকতার দিক থেকে এদের সভাগুলো একে অন্যের থেকে স্বতন্ত্র হওয়া
উচিৎ এবং কোনো পার্টির নিয়ন্ত্রণ সেই সভাগুলোর ওপর না থাকা উচিৎ। তবেই তাদের ভিতরে
শক্তি আসবে। অন্ততঃ কৃষক সভা তো তাহলেই সবল ও সজীব হবে আর পরে শ্রমিক সভার সহযোগিতায়
সাম্যবাদ স্থাপন করবে।
আর একটা কথা। মার্ক্সবাদিরা
কৃষকদের মধ্যবর্ত্তি বা বুর্জোয়া শ্রেণির অঙ্গীভূত করেছে এবং প্রতিক্রিয়াশীল বলেছে।
এটা ঠিক যে পরিস্থিতি-বিশেষে এই বুর্জোয়া শ্রেণিও বিপ্লবী এবং আমূল পরিবর্তনবাদী (Revolutionaty
and Radical) হয়। এই কথা কৃষকদের ওপরও বর্তায়। এই একই কথা লেনিন তাঁর রচনা-সঙ্কলনের
ইংরেজি সংস্করণের দ্বাদশ খন্ডের শেষে লিখেছেন যে “In Russia we have a ‘radical
bourgeois’. that radical bourgeois is the Russian peasant”, কিন্তু শ্রমিকদেরকে তো সবাই বিপ্লবী বলে
স্বীকার করেছে। সে পরিস্থিতিতে এই দুই শ্রেণি যে পরষ্পর-বিরোধী তা নিজেই প্রমাণিত
হয়। তাহলে আবার এদের এক পার্টি কিরকম? বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতিতে এরা স্পষ্টভাবে
দুই পরষ্পরবিরোধী দিকের যাত্রী। ফলে এদের স্বতন্ত্র সংগঠন গড়েই ধীরে ধীরে এদের পথে
আনতে হবে।
কম্যুনিস্ট পার্টির বিষয়ে যে কথাগুলো এক্ষুনি বলা হল অক্ষরে অক্ষরে
সেই কথাগুলো সোশ্যালিস্ট পার্টি, ফরোয়ার্ড ব্লক ইত্যাদি পার্টিগুলোর ওপরও প্রযোজ্য।
কেননা ওদেওও দাবি কম্যুনিস্ট পার্টির মতই। যদি এদের মধ্যে থেকে কেউ দাবি করে যে ওদের
মধ্যে খাস্তাহাল বাবুদের শ্রেণিও চলে আসে বা মধ্যবিত্ত শ্রেণিও শামিল হয়ে যায়, তাহলে
পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যায়। ফলে সাচ্চা এবং স্বাধীন কৃষক সভা গঠন করার ওদেরও দাবি
ততটাই ভুল যতটা কম্যুনিস্টদের। কম্যুনিস্ট এবং রায়বাদীদের [এম এন রায়ের অনুসরণকারী
– অনু] আরো একটি বৈশিষ্ট আছে যে তারা ভারতের ব্যাপক, লেলিহান, এবং সর্বত্র ওতপ্রোত
হয়ে ‘যুদ্ধং দেহি’র আহবান করা জাতীয়তার অপমান এবং উপেক্ষা করেও কায়েম থাকতে চায়। তারা
নিজেদের আন্তর্জাতিকতার কাঠামোয় এই জাতীয়তাকে দেখার বড়রকমের ভুল করে। বাকি দলগুলো তেমন
নয়। তারা এমন ভুলও করে না এবং জাতীয়তার উপেক্ষাও করেনা। তারা জাতীয়তাকে সমুচিত মর্যাদা
দেয়। তবুও কৃষক সভার স্বাধীনতা, শক্তি ও যাথার্থ্যের দিক থেকে সবার স্থান এক রকম। পার্টিগুলো
কৃষক সভার জন্য পবিত্র ষাঁড়, পূজনীয়; কিন্তু কৃষকদের তো লাঙল টানার বলদ চাই।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে। শেষ অব্দি বিপ্লব তো করে কৃষক
আর শ্রমিকই। তাই, ওদের শ্রেণি-প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত জরুরি, কারণ সেই শ্রেণি-প্রতিষ্ঠানই
তাদের সংগঠিত ও প্রস্তুত করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো না থাকলে কৃষক এবং শ্রমিকদের সামূহিক
ভাবে প্রস্তুত করা যায় না। সব বিপ্লবীরাই এ কথাটা মানে, কাজেই রাজনৈতিক দল ও পার্টির
দরকারটা কি? ওদের দুটো সভার কার্যনির্বাহী সমিতিই একে অন্যের সাথে সহযোগিতা করে বিপ্লবের
সঞ্চালনও করতে পারে এবং নেতৃত্বও দিতে পারে। শুধু দুটো সভার মধ্যে সহযোগিতার ব্যবস্থা
থাকা জরুরি এবং সেটা, পার্টিগুলো না থাকলেও, ওরা নিজেরাই করতে পারে। একটা সময় ছিল যখন
রাজনৈতিক ধ্যানধারণাগুলো পূর্ণতায় বিকশিত না
হওয়ার কারণে পার্টিগুলোকে জরুরি মনে করা হত যাতে শ্রেণি-প্রতিষ্ঠানগুলো পথভ্রষ্ট না
হয়ে পড়ে এবং ভুল নেতৃত্বের হাতে না পড়ে। কিন্তু তার সাথে এটাও জরুরি মনে করা হত যে
সমস্ত দেশের এই পার্টিগুলোর একটা আন্তর্জাতিক (International) পার্টিও হোক, যে সবাইকে
এক সূত্রে বেঁধে উচিৎ নেতৃত্ব দেবে, সঠিক পথে নিয়ে চলবে। যাতায়াত এবং সংবাদ মাধ্যমগুলো
পুরোপুরি বিকশিত ছিল না বলেও পথভ্রষ্ট হওয়ার বিপদ ছিল। একে অন্যের সাথে সোজাসুজি সম্পর্ক
রাখা প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু আজ তো আর সেরকম কিছুই নেই। রাজনীতির বিকাশ চরম পর্যায়ে
পৌঁছেছে, , যাতায়াতের সাধন অত্যন্ত দ্রুত এবং সুলভ, ফোন, টেলিগ্রাম ও রেডিও সংবাদের
জগতে বিপ্লব এনে দিয়েছে আর মুদ্রণশিল্পের উন্নতি তো এমন হয়েছে যে তা কিছু বলার অপেক্ষা
রাখে না। এসবের কারণে রাজনীতির অন্দর-বাহির নিয়ে এত বিশ্লেষণ হয়েছে যে আর ভ্রান্তির
কোনো সুযোগ নেই, কোনো পার্টির নেতৃত্বের প্রয়োজন নেই। যে সাধনগুলো বর্তমানে আছে তার
সাহায্যে কৃষক এবং শ্রমিকদের প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের কর্তব্যের নিয়মিত নির্ধারণ ভালো
ভাবে করতে পারে।
তাই আন্তর্জাতিকের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক এবং সূত্রধার স্তালিন কত
বছর আগেই ঘোষণা করে দিয়েছেন যে এ ধরণের প্রতিষ্ঠান বা পার্টির আর প্রয়োজন নেই । যে
তৃতীয় আন্তর্জাতিকের দেখাদেখি অন্য আন্য আন্তর্জাতিকগুলো তৈরি হল, সেটাই যখন নিষ্ক্রিয়,
তো এসব পার্টির কি প্রয়োজন? সোশ্যালিস্ট পার্টি, ফরোয়ার্ডব্লক আর বিপ্লবী সোশ্যালিস্ট
পার্টির আন্তর্জাতিকের সাথে কোনো সম্পর্কও নেই। এই পরিস্থিতিতে এক কদম আরো নিচে নেমে
কেন না এই সব পার্টিগুলোকেও শেষ করে দেওয়া হোক? এদের আর কী প্রয়োজন? যখন কম্যুনিস্ট
পার্টির সূত্রধার তৃতীয় আন্তর্জাতিকই রইল না ত্তো পার্টিটা মিছিমিছি থাকে কেন? যদি
শুধু চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যাওয়া, বামপন্থীদের খন্ডখন্ড করা, নেতাগিরির সাহস পুরো করা
এবং সবক’টি শ্রেণি-প্রতিষ্ঠানের মাঝে ঝগড়া আর জুতো ছোঁড়াছুঁড়ি লাগানোই উদ্দেশ্য হয়
তাহলে আলাদা ব্যাপার। এখন তো পাrরটিগুলোর ভিতরেও নিজেদের মধ্যেই নেতাগিরির ঝগড়া হওয়া
শুরু হয়েছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে।
বিপ্লবী রাজনীতি ও মার্ক্সবাদের যথার্থ জ্ঞান এবং সে অনুসারে তার
ক্রিয়ান্বয়নের ঠিকেদারি এই পার্টিগুলোই পেয়েছে, এমন দাবি কপোলকল্পিত এবং বিংশশতকের
মাঝামাঝি পৌঁছেও দুনিয়াকে বোকা ভাবার অনধিকার চেষ্টা। আর এটাই যদি কথা হয় তাহলে সে
ঠিকেটা কোন পার্টি পেয়েছে, কেমনভাবে পেয়েছে, কোত্থেকে পেয়েছে সেটাও প্রশ্ন। কেননা এই
ঠিকেদারির লড়াইই তো এরা নিজেদের মধ্যে করছে। তাহলে সিদ্ধান্ত কি করে হবে যে অমুক পার্টির
কাছেই সেই ঠিকেটা আছে?
কৃষক সভা এবং শ্রমিক সভা নিজেরা মিলেমিশে যদি দুটি সভার পারষ্পরিক
সহযোগিতার জন্য একটি যুক্ত কমিটির প্রয়োজন মনে করে তাহলে তারও নির্বাচন তারা নিজেদের
মধ্যে পরামর্শ করে করতে পারে। যেমন এই সব সভার কমিটিগুলো নিচে থেকে ওপর অব্দি নির্বাচনের
মাধ্যমে গঠিত হয় তেমনই দুটি সভার, বা আরো এমনই সভা শামিল করে সবার একটি মিলিত কমিটি
নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হতে পারে। সেই কমিটিকেই যদি পার্টি বলতে চান বলুন, কিন্তু
এই বাইরে থেকে এদের ওপর চড়ে বসা, চড়িয়ে দেওয়া পার্টি কোন আপদ? আমরা এর থেকেই রেহাই
চাইছি।
বলা হয় যে যখন কংগ্রেসের ৯০ প্রতিশত সদস্য এবং লড়াকু সদস্য কৃষক,
তখন নির্বাচনের মাধ্যমে তার সবক’টি কমিটির ওপর তারা সহজেই প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে,
আর যদি তারা সেটা না করে তাহলে সেটা তাদের ভুল। সব দিক থেকে বিচার করলে এটাই প্রমাণিত
হয় যে কৃষক সভার স্বাধীন সংগঠন অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু অভিজ্ঞতা অন্যরকম। ইতিহাসও সেইরকমই
বলে। কংগ্রেস মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিষ্ঠান বলার অর্থ যে এতে ওদেরই প্রাধান্য রয়েছে,
প্রভুত্ব রয়েছে এবং ওদেরই পরামর্শে প্রতিষ্ঠানটি চলে, ওদেরই নেতৃত্ব রয়েছে। পৃথিবীতে
স্বাধীনতার জন্য লড়তে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো এমনই হয়, এখনও অব্দি এমনটাই দেখা গেছে। এমনকি
সবচেয়ে টাটকা যে রুশের উদাহরণ, সেখানেও জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য
লড়তে থাকা সোভিয়েত নামক প্রতিষ্ঠানটি মালদার এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির কব্জাতেই ছিল, যদিও
তার সদস্যেরা ছিল কৃষক, শ্রমিক এবং সৈনিক, এবং তিনটেই সমুদায় পুরোপুরি শোষিত ছিল। এই
কারণেই ১৯১৭র মার্চের বিপ্লবের ফলে জারতন্ত্রের সমাপ্ত হয়ে রুশে গণতন্ত্রের নামে ধনিকেরই
শাসন কায়েম হল, যার বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখে লেনিনকে অক্টোবরের বিপ্লবটা করতে হল এবং
তার ফলশ্রুতিতে কৃষক-শ্রমিকের শাসন ওখানে প্রতিষ্ঠিত হল। লেনিনের মত মহাপুরুষ এবং বিপ্লবী
থাকা সত্ত্বেও যখন সোভিয়েতের ওপর কৃষক-শ্রমিকের প্রাধান্য ও নেতৃত্ব হতে পারল না, যখন
নাকি তার সদস্যেরা ধনী ছিল না, তখন আমাদের মত মানুষদের কি ক্ষমতা আছে যে কংগ্রেসের
ওপর প্রাধান্য বিস্তার করব, যখন নাকি ওতে ধনী এবং তাদের পোষক সদস্যেরা সংখ্যায় প্রচুর?
সোভিয়েতের নিয়মকানুন চারানির মেম্বারিওয়ালা বা তেমন ধরণের ছিল না যাতে জালিয়াতি হতে
পারে এবং জাল সদস্য তৈরি করে কমিটিগুলোর ওপর কব্জা করা যেতে পারে। তার সদস্য ছিল শুধু
প্রাপ্তবয়স্ক কৃষক, শ্রমিক এবং সৈনিক। ফলে নকল মেম্বার হওয়ার বা তৈরি করার সুযোগ ওখানে
ছিল না। কিন্তু কংগ্রেসে এন্তার আছে আর এটা রোজ দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল
যখন লেনিন অসফল হলেন তখন সফলতার আশা কে করতে পারে? এই নির্বাচনগুলোয় হাজার রকম লোভ
দেখিয়ে , জালিয়াতি করে, চাপ দিয়ে ধনীরাই সাধারনতঃ জয়ী হতে পারে, হয়। এটাই তিক্ত ও কঠোর
সত্য আর এটা কোনো নতুন কথা নয়। কংগ্রেসে কৃষকের নেতৃত্ব আর প্রাধান্যের কথা, এমত পরিস্থিতিতে
নিছক পাগলামি আর ধোঁকা। ফলে কৃষক সভার স্বাধীন সংগঠন হওয়াই উচিৎ।
যখন করাচি আর ফৈজপুরে কংগ্রেস স্বাধীন কৃষক সংগঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করে নিয়েছে তখন তার বিরোধ হচ্ছে কেন? যদি কৃষক সভাকে কংগ্রেসের কমিটিগুলোর অধীন বা
কংগ্রেসের অঙ্গ হিসেবে গঠন করার চিন্তা মাথায় না থাকত, তাহলে কংগ্রেস কর্তৃক স্বীকৃত
হওয়ার কথা কেন উঠত? অধীন কমিটিগুলোর স্বীকৃত হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ফৈজপুরের
কৃষক প্রোগ্রামের শেষ, ত্রয়োদশ ধারা এটাই যে কৃষক সংগঠনগুলোকে কংগ্রেস স্বীকৃতি দেবে
– “Peasant unions should be recognised.”
বলা হয় যে কৃষক সভার এখন প্রয়োজন কি? এখনো
তো ইংরেজ সরকার হটেনি আর স্বরাজও আসেনি, তাহলে মাঝখানে এই বেসুরো আলাপ কেন? বিদেশি
সরকার যাওয়ার পরই নাহয় প্রশ্ন উঠুক কার রাষ্ট্র হবে? কৃষকের? শ্রমিকের? না কি অন্য
কারো? তার আগেই এই অসভ্যতার ঝড় কেন? এ তো সেই মুসলিম লীগের মত কথা হয়ে গেল যে আগে ভাগ
করে দাও, ইংরেজ শাসন থাকতেই আমাদের অংশ দিয়ে দাও। নিজেদের মধ্যে এই ঝগড়ায় তো তাহলে
স্বরাজ আর হবে না। তাহলে এখন এই ওটা আমাদের হোক, আমাদের হোক, এমন হোক, তেমন হোক, এসব
প্রস্তুতি কেন? এই শ্রেণিসংগ্রাম আর শ্রেণিযুদ্ধ তো স্বরাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে?
তাহলে তদর্থক কৃষক সভার এই হো-হাল্লা আর বিরাট উদ্যোগ কিসের জন্য?
কিন্তু যদি এসব প্রশ্নের গভীরে ঢুকে দেখা
যায় তাহলে কৃষক সভার বাস্তবিকতা, গুরুত্ব আর প্রয়োজন স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আসলে স্বরাজের
দুটো দিক – বিদেশি শাসনের সমাপ্তি আর নিজেদের শাসন – নিজেদের রাজ, ‘স্ব-রাজ’এর প্রতিষ্ঠা।
এর প্রথমটা নিষেধাত্মক ও দ্বিতীয়টা বিধানাত্মক বা নির্মাণস্বরূপ। ‘স্বরাজ’ বলতেই তার
নির্মাণাত্মক দিকটার প্রতিই প্রথমে দৃষ্টি যায় আর অবশ্যই সেটাই প্রধান, মুখ্য, আসল।
নির্মাণ ছাড়া কিছুই হতে পারে না। কিন্তু নির্মাণের আগে ধ্বংস জরুরি, আবর্জনা ও রাস্তার
পাথরগুলো সরানো জরুরি। ভিত খুঁড়লে পরেই মজবুত প্রাসাদ দাঁড়ায়। ভিতের জায়গায় পড়ে থাকা
মাটি প্রাসাদের নির্মাণে বাধক হয়। তাই খুঁড়ে সেটা সরাতে হয়। বিদেশি শাসনও আপন শাসনের
নির্মানে বাধক। তাই সেটাকেও সরানো জরুরি হয়ে যায় আর স্বরাজের প্রশ্নের ভিতর সেটা অর্থবিস্তারে
ঢুকে পড়ে। তাই সেটা গৌণ, অপ্রধান।
কিন্তু আমাদের কংগ্রেসি নেতারা সেটার ওপরই
বেশি জোর দেন, যদিও জোর দেওয়া উচিৎ নির্মাণাত্মক দিকটার ওপর। এটাই ওদের বড় ভুল। বিদেশি
শাসন গেলে শেষে কোনো শাসন আসবে, নাকি অরাজকতাই জায়গা নেবে তার? “নিজের নিজের ঢোল, নিজের
নিজের গান” চলবে কি? তা তো কেউ চায় না। কাজেই বিদেশি শাসন সরাবার চেষ্টার মধ্যেই নিজেদের
কোনো না কোনো একটা শাসন তৈরি করতেই হবে, কোনো সরকার দাঁড় করাতে হবেই। তবেই সহজ ভাবে
এবং সাফল্যের সাথে বিদেশি শাসনকে আমরা শেষ করতে পারব। সে সরকারকে সমান্তরাল সরকার বলা
হয় রাজনীতির ভাষায়। পরে গিয়ে সেই সরকারকেই শক্তিশালী করি, এসব মূলভূত কথা।
এখন প্রশ্ন ওঠে যে সরকার কার হবে? কেমন
হবে, কোন ধরণের হবে? এগুলো বড় প্রশ্ন এবং গুরুত্বপূর্ণ। এ বললে তো চলবে না যে সরকার
ভারতীয়দের হবে! ভারতীয় তো চল্লিশ কোটি! তার মধ্যে কাদের হবে? এই চল্লিশ কোটি বিভাজিত
হয়ে আছে জমিদার, কৃষক, পূঁজিপতি, শ্রমিক ইত্যাদি পরষ্পর-বিরোধী শ্রেণিতে, তার মধ্যে
কোন শ্রেণির হবে? জমিদারদের? পূঁজিপতিদের? তাহলে কৃষক বা শ্রমিক সেই স্বরাজের সরকারটিকে
প্রতিষ্ঠা করার জন্য, সেই স্বরাজের জন্য কেন লড়বে? সেই সরকার আর বিদেশি সরকারে তো তফাৎ
হবে নাম কে ওয়াস্তে! বাস্তবে তো প্রায় একই রকম হবে। কৃষক-শ্রমিকের কামানো পয়সার লুট
তো সেসময়েও জারি থাকবে। তফাৎ শুধু এটুকুই হবে যে এখন যে লুটের মাল যাচ্ছে ল্যাঙ্কাশায়ার,
ম্যাঞ্চেস্টার বা ইংল্যান্ডে, সে লুটের মাল তখন যাবে বোম্বাই, আহমদাবাদ, কানপুর, ছাতারি
আর দারভাঙ্গা। রোজগেরে কৃষক-শ্রমিক কী পাবে? এ প্রশ্নগুলো স্বাভাবিক এবং সারা দুনিয়ায়
উঠেছে। কৃষক-শ্রমিককে তার সর্বশক্তি নিয়োজিত করে, প্রাণপণে স্বরাজের যুদ্ধে আকৃষ্ট
করার জন্য তাদেরকে, এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তর দেওয়া জরুরী। কৃষক সভা এই প্রশ্নগুলোরই
মূর্ত উত্তর।
মুসলিম লীগের কথা ভিন্ন। তারা লড়তে চায়
না, বা যথাশক্তি বাধা দিতে চায় এবং শেষে কিছু না করেই আদ্ধেক হিস্যা নিতে চায় … তাই
এখন থেকেই বিভাজন চাইছে। কিন্তু কৃষকেরা লড়বে এবং জোরদার লড়াই চালাবে। সেই লড়াই প্রাণপণে
চালানোর জন্য তারা এখন থেকেই হিসেব কষে নিতে চায় যে লড়াইয়ের ফল তাদের জন্য কি হবে।
তাই দুদলে অনেক তফাৎ, এটা স্পষ্ট। দুদলের দুটো পথ। এক দলের উদ্দেশ্য লড়া আর অন্যের
উদ্দেশ্য বাধা দেওয়া।
যদি উত্তর দিই যে কংগ্রেসের রাজ হবে তাহলে মনে হবে যে কংগ্রেসে মালদারদের প্রভুত্ব থাকার কারণে রাজ প্রকারান্তরে সেই মালদারদেরই হবে। যদি বলা হয় যে কৃষক এবং শ্রমিকের রাজ হবে তাহলে প্রশ্ন আসবে যে কোথাও কি এটা এখনো অব্দি হয়েছে? ফ্রান্স, জার্মানি, এমেরিকা, ইংল্যান্ড্, রুশ, ইটালি ইত্যাদি সমস্ত দেশে স্বাধীনতার লড়াইয়ের নেতারা এই কথাই বলতেন যে কৃষক-শ্রমিকদের হাতে শাসন আসবে। এমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডের শাসন হটানোর সময় এমনই বলা হত, যেমন এখানে বলা হয়। কিন্তু ওখানে মালদারদেরই রাজ হল আর কৃষক-শ্রমিক দুঃখেই থেকে গেল – সর্বত্র এই হল। এমনকি রুশেও এই হয়েছিল, পরে কৃষক-শ্রমিকদের আবার থেকে লড়ে শাসনের শক্তি ওদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে হল। বাকি দেশগুলোয় তারা অসফল রইল। কেন? তার কারণ আমাদের খুঁজতে হবে আর সেটা রুশের দৃষ্টান্তেই পাওয়া যাবে। অন্যান্য দেশে স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় কৃষকেরা জাতীয় নেতাদের প্রতিজ্ঞাগুলোয় ভরসা করে নিজেদের আলাদা প্রস্তুতি করেনি, নিজেদের স্বাধীন সংগঠন তৈরি করেনি। ফলে শেষে তারা প্রতারিত হল, মুখ চেয়ে বসে থাকতে হল। এর বিপরীত, রুশে লেনিন শ্রমিকদের এবং কৃষকদেরও স্বাধীন সংগঠন তৈরি করল। এমেরিকা ইত্যাদি থেকে সে এটাই শিখেছিল। ওখানে এ সংগঠনের অভাবেই প্রতারিত করা সম্ভব হয়েছিল, তাই রুশে সে অভাব লেনিন মেটাল। এমনকি কৃষকদের সংগঠন গড়তে সাফল্য না পাওয়ার কারণে সে কৃষকসভাবাদী বামপন্থী সোশ্যাল রিভল্যুশনারি পার্টিকে নিজের সাথে মেলাল এবং অক্টোবর বিপ্লবের পর নিজের যে সরকার গড়ল, ওই দলটিকেও সেই সরকারে জায়গা দিল। এটাই তার সাফল্যের চাবি ছিল।
সোশ্যাল রিভল্যুশনারি পার্টিকে সাথে নেওয়ায় এটাও প্রমাণিত হয় যে
বলশেভিক এবং কম্যুনিস্ট পার্টি কৃষকদের পার্টি ছিল না, হতেও পারে না। লেনিন যখন সফল
ভাবে কৃষক সভা তৈরি করতে পারল না তো আজকের কম্যুনিস্টরা কোন হরিদাস পাল? হ্যাঁ, কর্তৃত্ব
পেলে পর হয়তো গঠন করবে, কিন্তু আগে নয়, এটা ধ্রুব সত্য।
ভারতেও আমাদের তাই করার, আমরা তাই করি। কৃষকদের স্বাধীন সংগঠন সেই
প্রস্তুতি যা লেনিন নিয়েছিল। যদি সে সোভিয়েতের নেতাদের প্রতিজ্ঞা, প্রস্তাব আর ঘোষণায়
বিশ্বাস করে বসত যে জারতন্ত্র শেষ হলে কৃষক-শ্রমিক রাজ বা কৃষক-শ্রমিক-প্রজা রাজ প্রতিষ্ঠিত
হবেই, যেমন আমাদের এখানেও কিছু কৃষক নেতা বলতে থাকেন, তাহলে সে প্রতারিত হত এবং আপশোষ
করে মরত। রাজনীতিতে কোনো প্রতিষ্ঠানের, বিশেষ করে স্বাধীনতার সংগ্রামে রত কোনো জাতীয়
প্রতিষ্ঠানের নিছক প্রতিজ্ঞা, প্রস্তাব, ঘোষণা এবং ওই প্রতিষ্ঠানের কিছু প্রগতিশীল
নেতার উদাত্ত চিন্তাভাবনা ও তার বহিঃপ্রকাশের ওপর বিশ্বাস করে বসে যাওয়া সবচেয়ে বড়
বোকামি। সময় এলে এই সব প্রতিজ্ঞা, ঘোষণা এবং প্রস্তাবের ভাবোচ্ছাস যারা করেছিল তারা
নিজেরাই ভুলে যায় অথবা না ভুললে তাদের বাধ্য ও সামর্থ্যহীন করে দেওয়া হয় যাতে কিছুই
তারা না করতে পারে। পরিস্থিতি এবং মালদারদের ষড়যন্ত্র তাদের বেকার এবং পঙ্গু করে দেয়।
এমেরিকা প্রভৃতি দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম আমাদের এই শিখিয়েছে। স্বাধীনতা পাওয়ার পরেও,
আবার আমাদের নিজেদেরই মালদার ভাই এবং তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে যুদ্ধ
করতে হবেই, রক্তের নদী সাঁতরে পার করতেই হবে। তবেই কৃষকের রাজ আসবে, তার হাতে শাসনক্ষমতা
আসবে। মহাত্মা গান্ধী বা পন্ডিত নেহেরুর কথায় বা কংগ্রেসের প্রস্তাবে আসবে না। ঠিক
সময়ে সেই কথন বা প্রস্তাব ক্রিয়ান্বিত করার জন্য আমাদের নিজেদের শক্তি চাই, প্রস্তুতি
চাই, আর স্বাধীন কৃষক সভা সেও প্রস্তুতি, সেই শক্তির এখন থেকে সঞ্চয়। কেননা সুযোগ এসেছে
বলেই হঠাত করে নিজে থেকে শক্তি চলে আসে না। যে কুস্তিগির আগে থেকে আখড়ায় লড়ার অনুশীলন
চালায় নি, সে এক দিনে হঠাত অন্য কুস্তিগিরকে পরাজিত করতে পারে না। স্বাধীন কৃষকসভা
কৃষকদের মল্লযুদ্ধ, অনুশীলন এবং প্রস্তুতির আখড়া।
কংগ্রেসও এভাবেই শক্তিশালী হবে। কৃষক সভার মাধ্যমে কৃষকদের অধিকারের
জন্য একজোট হয়ে লড়ে আমরা কৃষকদের পূর্ণ বিশ্বাস অর্জন করব এবং এভাবে তাদের পুরো কৃষক
সমুদায়কে কৃষক সভার দিকে আকৃষ্ট করব। যে শ্রেণিসংগ্রাম কংগ্রেস করতে পারে না, যেটা
করতে ওর অসুবিধা, আগেই বলেছি, সেই শ্রেণিসংগ্রাম কৃষক সভার মাধ্যমে করে আমরা কংগ্রেসিরা
কৃষকদের হৃদয় ও মস্তিষ্ক জয় করব। কেননা বস্তুগত স্বার্থসিদ্ধির টান তাদের আমাদের সাথে
আসতে বাধ্য করবে। এটাই মানুষের স্বভাব। তারপর বিদেশি সরকারের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ
সংগ্রামের সময় দেশের রাজনৈতিক প্রশ্নে আমরা সহজ ভাবে এই কৃষক সভার মাধ্যমে কৃষ সমূদায়কে
কংগ্রেসের বন্ধু, ভক্ত এবং অনুযায়ী করে নেব। এভাবে দেখলে, সংগঠিত ও শক্তিশালী কৃষক
সভা শক্তিশালী কংগ্রেসের ভিত্তি, তার জন্য অনিবার্য ভাবে জরুরি।
যারা কৃষক সভার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে দাঁড়িয়ে থেকেও কংগ্রেস-কংগ্রেস
চেল্লায়, তাদের একটা মূলভূত কথা মনে রাখতে হবে। সেদিকে আমরা আগেও ইংগিত করেছি। এখন
একটু বিশদে যাওয়া প্রয়োজন। অসহযোগ-যুগের পরেই আমরা কৃষক সভার দেখা পাই। কেন? এ প্রশ্নটা
অনুধাবনীয়। তার আগে যেমন দেশে, তেমনই কৃষকদের ভিতরেও এই আত্মবিশ্বাস ছিলনা যে নিজের
শত্রুদের বিরুদ্ধে কোনো সংগ্রাম আমরা সাফল্যের সাথে চালাতে পারি; সংগঠিত গণআন্দোলনের
গুরুত্বও তারা জানত না। ১৮৫৭র অসফল বিদ্রোহের পর মানুষের মাঝে যে ভয়ঙ্কর রকমের পরাজয়বোধ
ও হতাশা এসেছিল সেটা দিনের পর দিন আরো গভীর হয়ে চলেছিল। দেশে সবচেয়ে বেশি সংক ছিল কংগ্রেস,
কিন্তু সে কেবল ‘ভিক্ষাং দেহি’র মন্ত্র জপত। তার দাবিগুলোর পিছনে কোনো শক্তি ছিল না।
বিদেশি শাসন জৈষ্ঠ মাসের দুপুরের সূর্যের মত জ্বলত। লাল পাগড়ি আর সাদা চামড়া দেখে লোকেদের
আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যেত। অন্ধকার ছিল চারদিক। রাওলাট আইন আর পাঞ্জাবের মার্শাল
ল’এর পর শাসকদের রোয়াব আরো বেড়ে গিয়েছিল। তুর্কীদের অঙ্গ-ভঙ্গ রুখতে অসমর্থ ছিল মুসলমান
সমাজ। আমাদের সবচেয়ে ন্যায়্সঙ্গত দাবিগুলোর ওপরও বর্ষিত হত আমাদের শাসকদের ঘৃণা আর
অপমানের হাসি। তখন অব্দি আমরা এটুকুই শিখেছিলাম যে খবরের কাগজ আর সভা করে লেখাপড়া জানা
শহরী লোকেরা একমাত্র কিছু করতে পারে। কিন্তু তারাও যে কিছু করছে, এমন দেখা যেত না।
জালিয়াঁওয়ালা বাগের পর হান্টার কমিটির মিথ্যার প্রলেপ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েছিল।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিল সারা দেশ।
ঠিক সেই সময় মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে
নাগপুরে গ্রামের দিকে মুখ ঘোরাল আর শান্তিপূর্ণ সোজা লড়াইয়ের পথ ধরল। নেতারা বলল আমরা
নিরস্ত্র ভারতীয়রা যদি চাই তাহলে এক বছরের ভিতর ইংরেজ সাম্রাজ্যকে ভাগিয়ে নিজেদের সরকার
গড়ে নেব। অদ্ভুত দাবি ছিল এটা, আফিমখোরের মেজাজের মত। কিন্তু বার বার বলতে থাকায় দেশ
শুনল আর সত্যিই সরকারের আসন টলে উঠল। বৃটিশ সরকার যেন কেঁপে উঠল। সম্রাটের প্রতিনিধি
লর্ড রীডিং ১৯২১এর ডিসেম্বরে কলকাতায় বলল, “আমি হতবুদ্ধি এবং হতবাক” (“I am puzzled
and perplexed”)। যে দেশ দমে ছিল, কয়েক শতাব্দি ধরে মৃতবৎ পড়েছিল, সে হঠাৎ আড়মোড়া ভেঙে
উঠে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে গেল। একবার সে নিজের অন্তর্নিহিত অপার শক্তির প্রত্যক্ষ
আভাস পেল। এটা কংগ্রেসের বড় জয় ছিল যে নিরস্ত্র জনতা জেল, জরিমানা আর ফাঁসির ভয় থেকে
বেরিয়ে এল। দেশের সুপ্ত আত্মা জেগে উঠল। যে পালোয়ান সাধারণ পুরুষকেও ভয় পেত সে সবচেয়ে
বড় মল্লযোদ্ধাকে আছাড় দিয়ে নিজের অসীম শক্তিটা অনুভব করতে পারল।
এর অনিবার্য পরিণাম এমন হল যা কেই স্বপ্নেও ভাবেনি। যখন ভারতীয় কৃষকেরা
একবার বৃটিশ সিংহকে চেপে ধরল তখন স্বাভাবিক ভাবেই সে ভাবল যে এই রাজা-মহারাজা, জমিদার
আর সাহুকার যারা ওরই তৈরি আর ওরই ছত্রছায়ায় পালিত-পোষিত হচ্ছে, এরা তো তার সামনে ইঁদুর-বেড়াল
থেকেও অধম। তা সত্ত্বেও এদের এত সাহস যে আমরা লুন্ঠিত হচ্ছি? “অবলওঁ নসানী তো অব না
নসয়হওঁ” [“এখন অব্দি তো ব্যর্থ হল (এই আয়ু), আর নষ্ট হতে দেব না” – গোস্বামী তুলসিদাস]
অনুসারে সে ভাবল যে এতদিন আমরা ঘুমিয়েছিলাম এবং আমাদের সুপ্ত শক্তিটাকে চিনিনি, তাই
এরা আমাদের লুন্ঠন করল, আমাদের ওপর অত্যাচার করল। কিন্তু আর এমন কিছুতেই হতে দেব না।
যখন এদের দেবতাকে আমরা নিরস্ত্রেরা পরাজিত করেছি তো এরা কোন ছার? ব্যস, সেই অসহযোগ
আন্দোলনের বিরাট জয়ের এই প্রতিক্রিয়া হল কৃষক জনতার মনে; এবং সেটা অনবরত দৃঢ় হয়ে চলল।
তারই ফলশ্রুতি এবং ব্যবহারিক রূপ এই কৃষক সভা। আর যদি আমাদের লিডাররা এই কৃষক সভা দেখে
উদ্বিগ্ন হয় তাহলে সেটা অর্থহীন। একথা তো আগেই ভাবার ছিল যখন কৃষকদের ইংরেজ সাম্রাজ্যের
বিরুদ্ধে লড়বার জন্য তারা উস্কেছিল। ব্যভিচারিণী নারী গর্ভবতী হলে আপশোষ করে ঠিকই,
কিন্তু এটা তার মুর্খতা। ব্যভিচারের সময়েই তার এই পরিণাম ভেবে নেওয়া উচিৎ ছিল।
কথাটা আসলে এই যে নিহিত স্বার্থের সম্পত্তিজীবীরা গণআন্দোলনে ততক্ষণ উদ্বিগ্ন হয়না যতক্ষণ তাদের স্বার্থে আঘাত লাগার আশঙ্কা না থাকে। বরং স্বার্থসিদ্ধির জন্য গণআন্দোলন এমনকি বিপ্লবী সংগ্রামকেও উৎসাহিত করে নিজেদের কাজ হাসিল করে। ফ্রান্স, রুশ ইত্যাদি বিপ্লব এর জ্বলন্ত প্রমাণ। জনগণ সোজাসুজি লড়াইয়ে না নামলে মালদাররা, শিল্পোদ্যোগের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়ে মাল কামাবার, তাদের পুরো অধিকার পায়না। তাই তারা উৎসাহিত করে গণআন্দোলন। তখন তো তারা শুধু লাভই দেখতে পায়। এটা ১৯২১এর এবং পরের কংগ্রেসি সংগ্রামে হল। নেতারা খুশি হয়ে জনগণকে যুদ্ধে আহবান করল, ওস্কাল। তখন তো তারা কোনো বিপদ দেখতে পায়নি। কিন্তু এখন যখন জনগণ নিজের শক্তি টের পেয়ে তাদের সাথেও লড়াইটা সেরে নেওয়ার সঙ্কল্প করেছে তখন শুরু হয়ে গেল তাদের এদিক ওদিক তাকান আর টালবাহানা। এখন ওরা নিজেদের বিপদ দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু এখন তো ওরাও অসহায়। তীর তো বেরিয়ে গেছে। আর আপশোষ করে হবে কি? চ্যাঁচামেচি করলেই বা কি? বরং ধ্রুব সত্য এটাই যে যত ওরা এর বিরোধ করবে কৃষক সভা তত দ্রুতগতিতে হবে। দুঃখের সাথে এটাও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে মানুষজনকে কংগ্রেসের সাথে রাখার জন্য বাস্তবিকতা এবং ব্যবহারিকতার আশ্রয় না নিয়ে অনুশাসনের তলোয়ারের সাহায্য নেওয়া শ্রেয় মনে করা হচ্ছে। যদি কংগ্রেসের বিশেষত্ব, তার অন্তর্নিহিত গুণ এবং তার ঐতিহাসিক প্রয়োজন আমাদের তার দিকে আকৃষ্ট করতে না পারে, এসবের কারণে তার প্রতি জন্মান আমাদের ভক্তি যদি তার পঁচিশ বছরের টানাপোড়েনের পরও অপর্যাপ্ত হয়, তাহলে অনুশাসনের খাপখোলা তরোয়াল সে খামতি কখনো পূরন করতে পারবে না। তাহলে তো বলতেই হবে যে কংগ্রেসের নেতারা নিজেদের হৃদয়-মন্থন করুক আর খুঁজুক যে ওদের তপস্যায় আর কংগ্রেসের কর্মসূচিতে কী সে বড়রকমের খামতি আছে যার কারণে এই বিপদ তৈরি হয়েছে যে মানুষ তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ, বিচলিত হয়ে পড়ে। কোনো প্রতিষ্ঠানের আসল শক্তি তার আভ্যন্তরীণ বিশেষত্ব এবং ঐতিহাসিক প্রয়োজন। তারই জন্য সে শক্তিশালী হয় এবং এই ব্যাপারটা কংগ্রেসে আছে। তাহলে কথায় কথায় এমন আশঙ্কা কেন? কংগ্রেস তো কোনো লজ্জাবতী লতা নয়। সে ইস্পাতের তৈরি। কৃষক সভারও ঐতিহাসিক প্রয়োজন আছে, যেমন আগেই বলেছি।
প্রশ্ন করা যেতে পারে যদি কংগ্রেসের সফল
অসহযোগ আন্দোলন এবং সংগ্রামের পরিণামই যদি কৃষক সভা হয় তাহলে ১৯২২-২৩এর পর তৎক্ষণাৎ
তার প্রতিষ্ঠা না হয়ে ১৯২৭-২৮ বা ২৯এ হল কেন? এত দেরি হল কেন? উত্তর এটুকুই যে চিন্তাভাবনাগুলো
পরিণত এবং স্থায়ী হতে যে সময়টা লাগে সেই নিয়মেই এখানেও দেরি হল। প্রতিক্রিয়া তো হল,
কিন্তু তাকে কার্যকরী রূপ দেওয়ার আগে ভাবনাটায় স্থিরতা আনার দরকার ছিল, পরষ্পর আলোচনার
দরকার ছিল, ভাবনাটার পরিণত হওয়ার দরকার ছিল। সময়েরও দরকার ছিল। একদিনে এসব হয়ে যায়
না। এছাড়া কৃষক সভা চালাবার জন্য যে হাজারখানেক কৃষক-সন্তান এবং লেখাপড়া জানা লোকের
দরকার ছিল তারা অসহযোগের মাধ্যমে বেরিয়ে এল, ওপরে উঠে এল ঠিকই, কিন্তু তাদের পারষ্পরিক
ভাব-বিনিময়টাও তো দরকার ছিল কাজটা শুরু করার জন্য। রাজনৈতিক পরিস্থিতির ডামাডোল, পরিবর্তনবাদ
বনাম অপরিবর্তনবাদের সে সময়কার কলহ এবং সত্যাগ্রহ অনুসন্ধান কমিটির কাজকর্ম ইত্যাদির
জন্য অনেক ঝামেলা হল আর কাজে দেরি হল। ফলে যদি দু-চার বছর এই টানাপোড়েনে লেগেও গিয়ে
থাকে সেটা কোনো ব্যাপার নয়। এতে বরং কাজে দৃঢ়তা এল। কম সে কম বিহারে কংগ্রেসের সমস্ত
নেতা শুরুতে কৃষক সভার দিকে আকর্ষিত হয়েছিল এবং তাদের কাছ হেকে যথেষ্ট প্রেরণাও পেয়েছিল
কৃষক সভা; এটাও প্রমাণ যে কৃষক সভার কার্যকারণগত অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে কংগ্রেসের
সাথে। কংগ্রেসের সংগ্রামের স্বাভাবিক পরিণতি কৃষক সভা। অতএব এখন এর বিরোধ করা মানে
পাথরে মাথা ঠোকা। অনেক দেরি হয়ে গেছে এখন। আর গত বছর যখন পুরুষোত্তমদাস টন্ডনএর সভাপতিত্বে
হিন্দ-কিসান-সভা স্পষ্ট ঘোষণা করে দিল যে স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কিত রাজনৈতিক প্রশ্নে
কৃষক সভার প্রত্যেক সদস্য সাধারণ ভাবে কংগ্রেস থেকেই প্রেরণা ও নেতৃত্ব গ্রহণ করবে,
তখন হায় হায় করার কারণ কী রইল?
একটাই কথা, খুব জরুরি কথা, থেকে যায়। বড়
বড় নেতারাও বলে ফেলেন যে যখনই কংগ্রেসের মন্ত্রীসভা তৈরি হয় তখনই প্রজাসত্বের লড়াই
শুরু করে এই কৃষক সভাবাদী শুধু তাঁদেরই নাজেহাল করে। যখন মন্ত্রীসভা থাকেনা তখন সংগ্রাম
হয় না। এতে এই সভার অসদুদ্দেশ্য প্রমাণিত হয়। তাই এই সভাকে থাকতে দেওয়া মানে কংগ্রেসের
পথের পাথরগুলোকে জিইয়ে রাখা।
কিন্তু কথাটা ভুল। বিহারেই এই প্রজাসত্বের
লড়াই বেশি হয় আর এখানে এই লড়াইয়ের প্রারম্ভ মুঙ্গের জেলার বড়হিয়া টালে ১৯৩৬ সালেই হয়েছিল;
তখন এই সব মন্ত্রীরা কেউ ছিলও না, এসেম্বলির নির্বাচনও মধ্যপথে ছিল। নির্বাচনের পর
কংগ্রেসি মন্ত্রী না হয়ে যখন অন্য কিছু লোক কয়েক মাস গদিতে রইল, তখন এই সংগ্রাম যথেষ্ট
তীব্র ছিল। কৃষক-নারী-পুরুষ এবং সেবকদের ওপর ঘোড়সওয়ারেরা ঘোড়দৌড় করিয়েছিল সে সময়। এটা
কঠোর ঐতিহাসিক তথ্য, যাকে অস্বীকার করা যায় না। এভাবেই ১৯৪১এ এবং ১৯৪২এর শুরুতে ডুমরাওঁয়ে
যে বীজ রোয়ার লড়াই কৃষক সভার নেতৃত্বে চলল এবং যে জঙ্গল সত্যাগ্রহ চলতে থাকল, তখনও
কংগ্রেসি মন্ত্রীরা ছিল না। তাহলে এই ডাহা মিথ্যেটা কেন বলা হয়?
এটা ঠিক যে কংগ্রেসি মন্ত্রীদের সময় এই
লড়াই বেশি করে হয় আর সেটা হওয়াই উচিৎ। যখন এই মন্ত্রীদের ভোট দিয়ে কৃষকরাই গদিতে বসায়
তখন এই মন্ত্রীদের আপন ভেবে কৃষকদের সাহস বাড়া স্বাভাবিক আর তারই ফলে এই সংগ্রাম হয়।
কৃষকরা ভাবে যে আমরা যাদের মন্ত্রী বানিয়েছি তারা আমাদের সাহায্য করবে। আমলাতান্ত্রিক
সরকারের কাছে এই আশা তো তারা করতে পারে না, তাই সে সময় সংগ্রাম করা কঠিন হয়ে পড়ে আর
কম হয়। আর যখন জনপ্রিয় সরকার তৈরি হয় তখন জনগণের স্বাধীনতা স্বাভাবিকভাবেই বেশি হয়।
তারা নিজের হাত পা ছড়ায়, ছড়াতে চেষ্টা করে। বুকের পাথরটা একটু সরেছে মনে হয়, হাত-পায়ের
শিকলগুলো একটু ঢিলে একটু ভাঙা মনে হয়। তাহলে হাত-পা ছড়াবে না কেন? আর এইসব সংগ্রাম
ওই হাত-পা ছড়ানোরই অভিব্যক্তি, সেটা দেখে এত রাগ কেন? এদের জন্য তিরস্কার বা অভিযোগ
কেন? এই সংগ্রাম কংগ্রেসি মন্ত্রীদের নাজেহাল করার প্রমাণ নয়, বরং কংগ্রেস এবং তার
মন্ত্রীদের ওপর জনগণের অগাধ বিশ্বাসের প্রমাণ।
অবশেষে বলার যে কংগ্রেসের আসল শক্তি অনুশাসনের
তরোয়াল নয়। তার কমিটিগুলো বা চারআনি-সদস্য আর প্রতিনিধিরাও নয়। তার আসল শক্তি হল তার
ওপর অপার জনসমূহের অসীম ভক্তি – সেই ভারতীয় জনসমূহের ভক্তি, যে চারআনি সদস্যও নয়, কিন্তু
যে তাকে নির্বাচনে জেতায় এবং সংগ্রামে বিজয়ী করে। ভালো হয় যদি কংগ্রেসের কর্ণধার এ
না হয় সে না হয়, কৃষক সভা না হয়, শ্রমিক ইউনয়ন না হয় আর যদি হয় তো কংগ্রেসের নেতৃত্বে
হয় … এসব ফালতু কথা বাদ দিয়ে সেই বিশাল জনগণের কষ্টগুলো আমরা বুঝি আর সে কষ্ট দূর করতে
চেষ্টায় কোনো খামতি না রাখি। তখন দেখব যে কংগ্রেস অজেয়। আর যদি এমন না হয়, তাহলে ওই
দুর্গ গুঁড়িয়ে যাবে, এটা কটু সত্য।
স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী
বিহটা, পাটনা,
বসন্ত পঞ্চমী, ২৭.১.১৯৪৭
No comments:
Post a Comment