পকেটমারি
নিঃসন্দেহে একটা শিল্প । কী নিপূণ শল্যচিকিৎসা ! পকেটের ভিতর ঠিক যে ফোলা জায়গাটার
কথা ভেবে ভেবে আপনি ট্রেনের কামরায় দিব্যি হাওয়া খেতে খেতেও শুয়ে ঘুমোতে পারছেন
না, ফোঁড়ার মত টিস দিচ্ছে বার বার, আপনার হৃদয় ও মস্তিষ্ককে বন্দী করে রেখেছে ...
আপনি কিছু বুঝতে পারার আগেই সেই ফোলা জায়গাটা গায়েব, আপনি মুক্ত । কিছুক্ষণ পকেটের
কাটা ফাঁকটায় বোকার মত হাত ঢুকিয়ে, যন্ত্রণায় হায় হায় করে নেওয়ার পর আপনি
নিশ্চিন্তে, মানে চিন্তা করেও যখন লাভ নেই, ঘুমোতে পারেন – সত্যি বলতে কি, না চাইলেও ঘুমিয়েই পড়েন ক্লান্তিতে ।
বর্ধমান
স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়াতেই সাধারণ কামরায় গেটের মুখে ঢুকবার জন্য ধ্বস্তাধ্বস্তি ।
হঠাৎ সব কোলাহল ছাপিয়ে একটা গালাগালের নির্ঝর প্রবাহিত হল আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে
সকলকে ঠেলে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল একটা রোগা দড়ি পাকান লোক । সাদা প্যান্ট, সাদা
পাঞ্জাবী, গলায় বজরঙ্গবলীর সুতো আর কদমছাঁট চুল । পাতলা গোঁফ । হাতে একটা ছোট্টো
ফোমের হাতব্যাগ – যা তখনকার অফিসবাবুদের মধ্যে প্রচলিত ছিল ।
বিহার অঞ্চলের বহুভাতে বা রিসেপশনে সন্ধ্যেবেলায় বরের বাবা বা কাকা, মানে যাঁরা
ফান্ড ইঞ্চার্জ হতেন, তাঁরাও রাখতেন । এক খোপ থেকে রান্নার দেখনদারকে হঠাৎ জরুরি
হওয়া অতিরিক্ত চালের দাম দিতেন, অন্য খোপে নিমন্ত্রিত অনেকের দেওয়া গিফ্ট এনভেলপ
গুঁজে রাখতেন ।
লোকটি
সিট খোঁজার জন্য এগিয়ে এল না । বিপরীত দিকের বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেল এবং আশে
পাশে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা – বিশেষ করে সেই সব লোকেদের সাথে যারা নিজেদের জামাকাপড়ে, চেহারায় প্রতিফলিত
শ্রেণীদোষে ধ্যাঁতানি খাওয়ার থেকে পেচ্ছাপখানার ধারে শুয়ে পড়া শ্রেয়ষ্কর মনে করে – ঠিক তেমনই আত্মবিশ্বাসী হাসিঠাট্টা আরম্ভ করল যেমন
ঠিকেদারের দালাল ঠিকেদারের ‘জন’দের সাথে করে ।
বাইরে মে
মাসের রাত । ট্রেনটা ভারতের তদানীন্তন কুড়ি হাজার মাইল বাতিল রেলপথের মাত্র কয়েকশো
মাইলে, গতি কম হাল্লা বেশির রীতি অনুসরণ করে ‘ম্যাটার ইন মোশন’এর উচ্চকিত জানান দিতে দিতে চলছিল ।
লোকটি মস্করা জারি রেখেছিল বার বার ঘুমিয়ে পড়া এক বৃদ্ধের
সাথে । বিবাহকেন্দ্রিক রসিকতা, যা এমত অবস্থায় কথার পিঠে কথা জাগিয়ে রাখার জন্য
হয়ে থাকে । হঠাৎ তার চোখ পড়ল ছেলেটির ওপর । পড়তেই তার চোখদুটো, ওস্তাদ জহুরির মত,
মুক্তোর মালার মাঝে একটা নকল পূঁতি দেখে ফেলার মত কুঁচকে উঠল , “তুই এখানে কোত্থেকে ? তোকে আগে দেখেছি মনে হচ্ছে !” ছেলেটি নিরীহ চোখ তুলে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল ।
-
কোত্থেকে উঠেছিস ?
-
আজ্ঞে, হাওড়া থেকে ।
-
যাবি কোথায় ?
-
আজ্ঞে, পাটনায় ।
-
কলকাতায় কোথায় থাকিস ? (ছেলেটি
একটা জায়গার নাম বলে) বুঝেছি ।
লোকটি
প্রজ্ঞার গভীর স্তরে কিছু একটা সংকেত পাওয়ার মত মুখভঙ্গি করে আমাদের দিকে, অর্থাৎ
সিটে, বাঙ্কে, দুটোর মাঝখানে গাদাগাদি হয়ে থাকা সমবেত ভদ্র ও আধাভদ্র মন্ডলির দিকে
মুখ ফেরাল ।
-
ভাই, আপনারা সবাই একটু সামলে
চলবেন । এ মালকে আমি চিনি । এরা একলা ওঠে না । মনে হচ্ছে পুরো গ্যাংটাই এই
ট্রেনটায় উঠেছে । নিজেদের পকেট, জিনিষপত্র ইত্যাদি সামলে রাখবেন ।
বলে,
ঘুরে তাকাল ছেলেটির দিকে, “দেখি তোর টিকিটটা দেখি !” টিকিটটা নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে ফিরিয়ে দিল । একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
স্বগতোক্তি গোছের করল, “চল ! বোঝা
যাচ্ছে সারারাত তুই কাউকে ঘুমোতে দিবি না ।“
আমি ওদের
কথার ফাঁকে ফাঁকে ছেলেটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম । বেঁটে, কালো, মজবুত গড়ন ।
কদমছাঁট চুল, ভোঁতা নাক, মোটা ঠোঁটে হাওড়া স্টেশনে খাওয়া পানের লালচে রেখা । এই
দুঃসহ গরমেও ওর জমকালো শার্টের নিচে ততোধিক জমকালো একটা কলারওয়ালা পলিয়েস্টার
গেঞ্জি । গলায় জোড়া খুকরির লকেট ঝোলানো কালো সুতো । জংঘার কাছে উত্তেজকভাবে আঁটসাট
একটা ধুসর সবুজ প্যান্ট । কোমরে ৭৮৬ মার্কা বাক্লসের বেল্ট । পায়ে জমকালো চটি,
সাধারণতঃ যে ধরণের চটি মুসলমান গরীব ছেলেরা ধান্দায় দুপয়সা কামালে পরে । দেখে
পকেটমার মনে হয় না । কিন্তু একটা ইংগিত আছে চেহারায় । বিশেষ করে জংঘাদুটোয়, নাক আর
ঠোঁটে । চোখদুটোর অভিব্যক্তিশূন্যতায় । অর্থাৎ, সিনেমায় ব্ল্যাক করা, মদ খেয়ে
ফুর্ত্তি করা, দল বেঁধে নিষিদ্ধপল্লিতে যাওয়া, মারপিট করা ... ছেলেটি সেই যে প্রথম
প্রশ্নের সাথে উঠে দাঁড়িয়েছিল তারপর আর বসে নি । মুখে একটা বিনীত বাধ্য ভাব, যদিও
শরীরের পেশীগুলো জানলা দিয়ে আসা হাওয়ার চাপে দুর্বিনীত ভাবে ফুটে উঠছিল । শেষে
লোকটির এক ধ্যাঁতানি খেয়ে বসে পড়ল ছেলেটি ।
হয়ত ঘুমে
ঢুলছিলাম । ট্রেন কখন দুর্গাপুরে ইন করেছিল জানি না। ঢুলুনি ভাঙল একটা কর্কশ
চিৎকারে । চোখ খুলে দেখলাম লোকটি ছেলেটিকে জাগাচ্ছে রুক্ষ স্বরে, “এ্যাই, ওঠ শালা !”
চোখ
কচলাতে কচলাতে উঠে দাঁড়াল ছেলেটি । লোকটি ওর গায়ে কোথাও হাত না লাগাল না । ওর
সামনাসামনি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে হিসহিসিয়ে উঠল, “ভালো চাস তো ব্যাগটা দিয়ে দে !”
তখনও
ঘুমে ঢুলছিল । লোকটি ওর মাথাটা সজোরে দেয়ালে ঠুকল, “ভালো চাস তো দিয়ে দে বলছি ব্যাগটা । আমি একটুও মারব না তোকে
।“
যেন
এতক্ষণে বুঝতে পারল প্রশ্নটা । মুখ তুলে তাকিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মত করে প্রশ্ন
করল, “কোন ব্যাগ ?”
-
ও, তুই এখন ব্যাগটা চিনিসও না !
একটু
ক্ষণ তাকিয়ে ওর মুখ ঠাহর করল লোকটি । তারপর হঠাৎ বেদম জোরে একটা ঘুষি চালাল ওর
বুকে । ছেলেটি বুকে হাত চেপে ডুকরে উঠল ।
ব্যাপারটার
ইশ্বরীয় রসিকতায় সকলেই নড়ে চড়ে উঠে বসেছিল ততক্ষণে । আড়ালে হাতের স্পর্শে নিজেদের
পকেট ও মালপত্রের ঠাহর নিতে নিতে তারা সমাজের বিবেকের মত চারদিক থেকে মুখ
বাড়িয়েছিল, “কী হল ? হলটা কী ? যে ওর টুপি চেনাল তাকেই ও টুপি
পরাল ? যাস্সালা !”...
লোকটি তখন পাশের জনকে প্রশ্ন করছিল যে মাঝে ছেলেটি কোথাও
গিয়েছিল কিনা । পাশের জন দুর্গাপুর স্টেশনে ছেলেটির একটুক্ষণের জন্য নামার কথা
জানাল । লোকটি আবার ঘুরল ছেলেটির দিকে ।
-
কোথায় গিয়েছিলি ?
-
খাবার খেতে ।
-
কী কী খেলি ?
-
দুটাকার পুরি-তরকারি ।
-
কত টাকা ছিল তোর পকেটে ?
-
দশ টাকা ।
লোকটি ওর পকেটে হাত ঢোকাল । একটা পাঁচ টাকার নোট ।
-
শালা, দশ টাকা থেকে দুটাকার খেলে
পাঁচ টাকা থাকে ?
-
দুটাকা কোথায় ? দুটাকার আমি আর
দুটাকার আমার বন্ধু ।
-
বন্ধু ? বন্ধু কোথায় ?
-
অন্য কম্পার্টমেন্টে বসেছিল ।
দুর্গাপুরে নামার ছিল, নেমে খেয়ে চলে গেল ।
-
ও, তাই না ? তাহলেও যে ছটাকা থাকে
!
-
ওই তো, চার আনার বিড়ি কিনলাম আর
বাকি পঁচাত্তর পয়সা ...।
বলে বিড়ি আর পঁচাত্তর পয়সা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে উঠল ছেলেটি ।
বোধহয় সময় নিচ্ছিল । তখনও ফোঁপানি বন্ধ হয় নি ।
-
মিছি মিছি আমি মার খাচ্ছি । আমি
কোনো ব্যাগ দেখিনি, নিইও নি, আমি জাতিতে চামার, আমার ঘর পাটনায়, সেখানে নথুনি
চামার মিঠাপুর ঘুমটির ধারে বসে, সে আমার বাবা ... এই তো, এই দেখুন !
যেন
বিরাট একটা প্রমাণ বার করে এনেছে নিজের নির্দোষিতার, সেভাবে কান্না থামিয়ে এক মুঠো
বিড়ি আর পঁচাত্তর পয়সা ছেলেটি ভিতরের গেঞ্জির পকেট এবং প্যান্টের পিছ-পকেট থেকে
বার করে আনল ।
হিন্দী
সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক অমরকান্তের একটা গল্পে নায়ক চুরির মিথ্যা অভিযোগে মার
খায় আর চ্যাঁচায়, “আমি বঢ়ই, আমি বঢ়ই” । বঢ়ই অর্থাৎ ছুতোর মিস্ত্রী । অমরকান্ত বলেন যে লোকটি নিজের
জাতির পরিচয় এমন ভাবে দেয় যেন দুনিয়ায় আর যে যা ইচ্ছা করুক, বঢ়ই জাতির লোক চুরি করতে
পারে না ।
তবে এই
ছেলেটি ‘আমি জাতিতে চামার’ সেই অর্থে আওড়াচ্ছে বলে মনে হল না । বরং ভাবটা এমন ছিল যেন
ও জানে যে আশেপাশের লোকেরা প্রায় সবাই উঁচু জাতের, আর তাই এটা ওর নিয়তি যে চুরি করুক
আর না করুক, মার খাবেই, তবু ! যদি কারো দয়া হয় ...!
এক্কেবারে
সেন্টুতে ঘা লাগান রাজনীতি । স্পষ্ট দেখলাম আশেপাশের সবার মুখে এক মুহুর্তের জন্য
কথাটার প্রভাব পড়ল ।
লোকটি
স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল । তারপর শেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার মত
করে দাঁতে দাঁত চাপে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করল, “শেষবার তোকে জিজ্ঞেস করছি, ব্যাগটা তুই দিবি কিনা ?”
-
আমি ব্যাগটা নিই নি বল...
হঠাৎ বেধড়ক
ঘুষি আর কনুইয়ের গুঁতো চালাতে শুরু করল লোকটা, ছেলেটির শরীরের মোক্ষম জায়গাগুলোয় – পেটে, পাখনার হাড়ের খাঁজটায়, বুকের একটু নিচের দিকে,
কাঁধে, পিঠে, আর নাকে তো বটেই ।
এক ঝোঁক
চলার পর লোকটি হাঁপিয়ে উঠল । ছেলেটি ডুকরে কাঁদছিল কিন্তু আশ্চর্য, অজ্ঞান হওয়া তো
দুরের কথা, পড়েও গেল না মাটিতে । বসলও না, ঠায় দাঁড়িয়ে রইল । যেন জানান দিচ্ছিল যে
আমি ছোটো জাতের, আপনাদের সামনে বসা, তা সে যত মারই খাই না কেন, পড়ে যাওয়ার আগে
অব্দি আমার কি সাজে ?
জানান
দিতে থাকা এই জন্য বললাম যে ছেলেটি যদি পকেটমার নাও হয়, তাহলেও, কলকাতায় কাজ করা
আর ফূর্ত্তি করা সৌখিন ছেলের চেতনার এই স্তর থাকতে পারে না যে ট্রেনে উঁচু জাতের
লোকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ।
এবার
সমাজের বিবেকদের হস্তক্ষেপ করার পর্যায় । এক এক করে প্রশ্ন উঠতে আরম্ভ করল, “কী ব্যাপার”, “কখন হয়েছে”, “ব্যাগটায় কী কী ছিল” ...। মাঝে
মাঝে শ্মশ্রুশোভিত স্বগতোক্তি, “যা অবস্থা হয়েছে দেশের”, “কী দিনকাল পড়েছে”, “কাউকে বিশ্বাস করা যায় না” ইত্যাদি । এরই মাঝে ছেলেটি এক্কেবারে মোক্ষম বিষাদ কবিতার সুরে ডুকরে ওঠা শুরু
করল ।
লোকটি এদিকে পুরো ঘটনাটা পঞ্চপরমেশ্বরকে শোনাল । বলল, যে সে
ছেলেটিকে আগেই ভালোভাবে চিনেছিল ।
-
কী রে, কলকাতায় কোথায় থাকিস তুই ?
-
ওই তো, ...পট্টির দিকে,
...ব্যাপারির দোকানে কাজ করি ।
-
হুঁ, হুঁ, বেশ বুঝেছি তুই কেমন
কাজ করিস ।
এবং আবার সে পঞ্চপরমেশ্বরের মুখোমুখি হল ... যে তার ব্যাগে
টাকা এমন কিছু ছিল না । মাত্র দেড়শো টাকা, তা যদি ও ফেরৎ নাও দেয় তাহলেও সে কিছু
বলবে না । কিন্তু তাছাড়া তার ব্যাগে ছিল পঞ্চাশটা আবেদন পত্র । ট্রান্সফারের ।
কলকাতা থেকে মোকামা এবং আশেপাশের অঞ্চলে । মোকামায় নেমে, আবেদনগুলো নেতাকে দিয়ে
রেকমেন্ড করিয়ে তার দিল্লী যাওয়ার ছিল পরের ট্রেন ধরে । সেখান থেকে ওগুলো স্যাংশন
করিয়ে আনার ভার ছিল তারই ওপর । লোকটি দুহাত তুলে রাজসিক আলস্য এবং নিশিন্ততার
ভঙ্গী করল ।
-
যা হোক, তাও কোনো ব্য্যাপার নয় ।
খামোখা একটু দেরি আর ঝুঠ ঝামেলা, এই আর কি । এখন মোকামায় নেমে সবচেয়ে আগে এই খবরটা
অফিসে দিতে হবে । তারপর জীপ নিয়ে বেরিয়ে ... মোকামায় এদের একটা দল আছে, সেই দলটার
কাছে যেতে হবে । ব্যাগ তো আমি ফেরৎ পাবই । হ্যাঁ, আবেদনগুলো বাজে কাগজ হিসেবে ফেলে
দিয়ে থাকলে আবার কলকাতায় গিয়ে সবাইকে দিয়ে লিখিয়ে ডিপার্টমেন্টে ফরোয়ার্ড করাতে
হবে । দেরি হবে একটা দিন । (ছেলেটির দিকে তাকিয়ে) তোকে আমি বুঝিয়ে দেব তুই কার
হাতে পড়েছিস । হাত পা ভেঙে চিরজীবনের জন্য অকেজো করে রেখে দেব । সোজা কথায় তুই
দিলি না । ফের বলছি দিয়ে দে । এখনও বুঝিস নি তোর এবার কী হতে চলেছে ।
ছেলেটি
আবার ডুকরে উঠে বিড়বিড় করল, “আমি নিই নি বলছি ব্যাগটা ...” ।
“তবে রে !” হঠাৎ লোকটি ছেলেটির গালদুটো দুহাত দিয়ে দুদিকে সাঁড়াশির মত টেনে মোচড়াতে শুরু
করল । একটু পরেই ঠোঁটের কষ বেয়ে দর দর করে রক্ত বেরিয়ে এল । আর ফেনা ।
রক্তের
একটা নিজস্ব প্রভাব আছে । চার পাশের লোকেরা একটা নৈতিক ভীতিতে বিড়বিড় করতে শুরু
করল, “ছেলেটা পকেটমার নাও তো হতে পারে ! শুধু
আন্দাজের ওপর এত মারা উচিৎ নয় । যদি কিছু হয়ে যায় ?”
আমার
সামনে বসা ছাত্রটি শেষের কথাটা শুনে ফেলল । ওর বাথরুম যাওয়ার ছিল । নিচে নেমে,
ঢিলে করে নেওয়া প্যান্টটা বোতাম লাগিয়ে টাইট করতে করতে জবাব দিল, “কিছু হয়ে যাবে ! আপনারা সেই ভ্রমেই থাকুন । ওর কিচ্ছু হবে
না । এর দশ গুণ মার সহ্য করার ক্ষমতা ওদের থাকে ।“
বাথরুম থেকে ফিরে সেও ছেলেটির চুলের মুঠি ধরে দু’চারটা ঘুষি ছাড়ল । জুলপি উল্টো দিকে ঘষল । গালাগাল দিল দু’চারটে ।
-
ওঃ, আবার কান্না হচ্ছে ! দেখি !
বলে ওর
চোখে হাত ছোঁয়াল তারপর চুল ধরে আচমকা হ্যাঁচকা টানে মাথাটা ওঠাল । সমবেত
ভদ্রমন্ডলীর দিকে চেয়ে বলল, “দেখুন, দেখুন কেমন কান্না ওর । একফোঁটা জল নেই চোখে ।“
হাত ও
মুখের সুখ হয়ে যেতে ছাত্রটি গর্বিত ভাবে হাত ঝাড়ল নিজের, যেন নোংরা কিছু পরিষ্কার
করার সামাজিক কার্য ও নিজে যেচে করেছে । তার পর আবার চড়ে বসল বাঙ্কের ওপর ।
নিচে
জানলার ধারের সিঙ্গল সিটে একজন শিক্ষক গোছের মানুষ বসে ছিলেন । ধুতি, ছাই রঙের
পাঞ্জাবি, কাঁধে চাদর । চুল বেশির ভাগ পাকা । তাঁর সৌম্যতা দেখে তাঁর সিটে কেউ
দ্বিতীয়জন আধপাছা বসতে আব্দার করেনি, তিনিও কাউকে জায়গা ছাড়েন নি । এটুকু তো তাঁর
প্রাপ্যই !
তিনি
উদাসীন স্বরে দুচার বার বললেন, “দিয়েই দে না ব্যাগটা ! কেন পড়ে পড়ে মার খাচ্ছিস ?”
ছেলেটি
ব্যালেন্সিং ফোর্সের আভাস পেয়ে হঠাৎ এগিয়ে এল নিজের জায়গা ছেড়ে । হাত জোড় করে
শিক্ষকের কাছে নিজের নির্দোষিতার কথা বলতে যাবে তখনই ওর কষের রক্ত টপ করে পড়ল নিচে
বসা মানুষটির পায়ের ধারে ।
মানুষটি
বেঁটেখাটো । কোনোকিছুর ব্যাপারী । সাথে পরিবার, মালপত্র । এতক্ষণ সে সম্পূর্ণ
নিস্পৃহভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই করে নি । রক্তের
ফোঁটাটা টপ করে পড়ার সাথে সাথে সে বেমক্কা চেঁচিয়ে উঠল, “এ্যাই, এ্যাই, খবরদার ! এগোবি না । শালা, সকলের জামাকাপড়
নোংরা করে দেওয়ার মতলব !”
আসানসোল
এল । চলে গেল । চিত্তরঞ্জন । মধুপুর । জসিডি । শিমুলতলা । জমুই । ঝাঝা । একটু পরে
ভোর ফুটতে শুরু করল ।
ব্যাপারীর
চ্যাঁচ্যানি শুনে ব্যাগ-হারান লোকটি কাঁধ চেপে বসিয়ে দেওয়ার পর সেই যে ছেলেটি ঝিম
মেরে বসেছিল তারপর আর একবারও ওঠেনি । নড়েও নি । শুধু দাঁত ঠোঁট চেপে রক্ত আর
গাঁজটা মাঝে মাঝে বার করে দিচ্ছিল মুখ থেকে । সেটা গড়িয়ে পড়ছিল কিছুটা ওর জামায়,
কিছুটা মেঝেতে ।
ঝাঝার
একটু পরে একটা ছোট্টো স্টেশনে এসে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে গেল অন্য একটা ট্রেনকে বেরিয়ে
যাওয়ার রাস্তা দিতে । যাত্রীরা, বিশেষ করে পুরুষ যাত্রীরা প্রায় সকলে বাইরে এসে
প্ল্যাটফর্মে ও লাগোয়া দেয়ালে বসে পড়ল । ভোরের আবছা আলোয় ছেলেটিকেও নামিয়ে আনল
লোকটি ।
বাকি
সকলে দেয়ালে চড়ে বসল, ছেলেটি নিচে বসল হাঁটু মুড়ে । আস্তে আস্তে সকালের আলো বেড়ে
উঠল । স্টেশন থেকে বাইরে গিয়ে একটু নেমে ছোট্টো দু’একটা জলাজমি । ট্রেনটা বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াবে শুনে অনেকে
প্রাতঃকৃত্য সারতে গেল জলার পাশের ঝোপগুলোতে ।
একটু পরে
ট্রেনের পিছনের কামরাগুলোর দিক থেকে দুজন জিআরপি একটি ছেলেকে ধরে এগিয়ে এল ।
ফর্সা, লম্বা, ছিপছিপে শরীরের ছেলে ।
-
কী ব্যাপার ? চুরি করতে গিয়ে ধরা
পড়েছে ।
“বলছিলাম না, এদের পুরো গ্যাংটা এক সাথে ওঠে”, লোকটি নিশ্চিন্ত ভাব দেখায়, “আরো কয়েকটা হবে, এদিক ওদিকের কামরায় ।“
ফর্সা
ছেলেটি আমাদের ছেলেটির পাশ দিয়ে চলে গেল । দুজনের কেউই একে অন্যের দিকে তাকাল না ।
হঠাৎ
আমাদের ছেলেটির পাশে মজা-দেখতে-সেঁটে-থাকা এক বালক উল্লসিত হয়ে ঘোষণা করে, “বলছে পায়খানা পেয়েছে ! নিশ্চয়ই পালাবার মতলব !”
লোকটি
দুহাত দূরে বসেছিল । ওকে ঘিরেছিল কয়েকজন যেন নায়ককে ঘিরে রেখেছে । লোকটি দেয়াল
থেকে পা নামিয়ে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল । তারপর এগিয়ে এল ।
-
কী রে, পায়খানা পেয়েছে ? না,
পালাবার মতলব ?
ছেলেটি
করূণ চোখ তুলে তাকাল । তারপর আবার চোখ নামিয়ে ফোঁপাতে থাকল ।
-
যা যা ! এখানে হেগে প্যান্ট নোংরা
করতে হবে না । যা পায়খানা করে আয় গিয়ে ।
ছেলেটি
তবু উঠল না ।
-
যা বলছি !
ছেলেটি
এবার উঠল । কিন্তু দাঁড়িয়ে রইল ।
-
কী হল ?
-
কেউ সাথে ...
-
কোনো দরকার নেই । পালিয়ে তুই যাবি
কোথায় ?
ছেলেটি
মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে এগোল কামরার দিকে । ফচকে বালকটি নিজে থেকেই ওর সঙ্গ নিল
।
একটু পরে
বালকটি কামরার দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ঘোষণা করল, “পায়খানাতেই গেছে !”
ব্যাগ-হারান
লোকটি এদিক থেকে স্নেহশীল ধমক দিল, “এ্যাই, নিচে নাম ! ও কোথাও যাবে না । তোর সাথে থাকার কোনো দরকার নেই ।“
বালকটি
তবুও নামল না। ওখানেই দরজায় দাঁড়িয়ে হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে থাকল । মাঝে মধ্যে ভিতরে
গিয়ে দেখে আসছিল ।
সূর্য
উঠতে রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়েছিল । হঠাৎ বালকটি উত্তেজিত ভাবে এল দরজার কাছে, “নেই ! পালিয়ে গেছে !”
বাকি
সকলে উত্তেজিত । কিছু করবে এই আশায় ঘুরে তাকাল লোকটির দিকে । কিন্তু লোকটি
নিশ্চিন্ত ভাবে যেমন কান খোঁচাচ্ছিল দেশলাই কাঠি দিয়ে তেমনই খোঁচাতে থাকল ।
-
ও কোথাও যেতে পারবে না । মোকামা
থেকে কলকাতার মাঝে কোথাও ওর লুকোবার জায়গা নেই । ও বুঝে গেছে কার খপ্পরে পড়েছে ।
সকাল ছটা
। ট্রেনটা চলছিল দুদিকের টাল (বর্ষায় জলডোবা প্রান্তর) পিছনে ফেলে । ছেলেটি আর
ফিরে আসে নি । কেউ তার টিকিরও দেখা পায় নি ।
আমি বাঢ়
স্টেশনে নেমে চা খাচ্ছিলাম । কামরার দিকে চোখ ওঠাতে লোকটিকে দেখলাম দাঁতন করছে ।
হঠাৎ ওর মুখটা মনে হল শীর্ণ, একটা কিছুর ভয়ে সন্ত্রস্ত আর সতর্ক, চিন্তিত ।দাঁতন
সরিয়ে থুথু ফেলে ও কিছুক্ষণ নিরুদ্দিষ্ট ভাবে পাথরের নুড়ির ওপর পড়া থুথুটার দিকে
তাকিয়ে রইল ।
ট্রেনটা
স্টার্ট নিচ্ছিল । আমি চড়তে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, বেশ কয়েকজনের কাঁধের ধাক্কা খাওয়া
সত্ত্বেও ও নিজের ভঙ্গিতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, অন্যমনস্ক, অন্যদিকে তাকিয়ে । একটুও
নড়ছে না । হয়ত, খেয়ালও করছেনা যে ওর ধাক্কা লাগছে ।
[২৭.৪.৮৫]