মুখবন্ধ
ফ্রেডরিক এঙ্গেলসকে আমরা কার্ল মার্ক্সের
ঘনিষ্ঠতম ভাবধারাগত সহযোগী, এবং ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বন্ধু বলে জানি।
বস্তুতঃ আজকের কেন, হাজার হাজার বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাসে বন্ধুত্বের কয়েকটি
নিদর্শনের অন্যতম এই যুগল। ভাবধারাগত ঘনিষ্ঠতা এত বেশি ছিল
যে, যে বিশ্বদৃষ্টিকে আজ আমরা মার্ক্সবাদ বলে জানি সেই বিশ্বদৃষ্টি স্পষ্ট করার জন্য
জরুরি ভাবধারাগত সংগ্রামের প্রথম তিনটে ধাপের দলিল, যুগ্মনামে লিখিত দুটো গ্রন্থ ও
একটি পুস্তিকা – ‘পবিত্র পরিবার’, ‘জার্মান ভাবাদর্শ’ এবং যুগ-প্রবর্তক ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’ – রূপে আজ আমাদের
সামনে আছে। কিন্তু সেছাড়াও, পরবর্তী প্রতিটি গ্রন্থ, মার্ক্স লিখতে থাকলে এঙ্গেলসের
সঙ্গে প্রতিনিয়ত আলোচনা করে এগিয়েছেন; এঙ্গেলস লিখতে থাকলে মার্ক্সের সঙ্গে আলোচনা
করে এগিয়েছেন। মার্ক্সের মৃত্যুর পর তো এঙ্গেলস নিজের সমস্ত অর্দ্ধসমাপ্ত কাজ দূরে
সরিয়ে, মার্ক্সের অর্ধসমাপ্ত কাজ, ‘পূঁজি – ২য়’ খণ্ডের পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত রূপে আনতে এবং
তারপর পূঁজি – ৩য় খণ্ডের খসড়াগুলোকে
পাণ্ডুলিপি রূপে আনতে খরচ করেছেন জীবনের দশ বছর। চতুর্থ খণ্ড বলে যে খসড়াগুলো একত্র
করেছিলেন, সেগুলো তাঁর মৃত্যুর কয়েক দশক পর বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত সঙ্ঘ ‘থিওরিজ অফ সারপ্লাস ভ্যাল্যু’ নামে তিন খণ্ডে প্রকাশ করে। নিজের শুরু করা
দু’তিনটে কাজ তো পুরো
করা আর হলই না।
মৃত্যুর দু’বছর আগের মে দিবসের বিকেলে হাইড পার্কের মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন দেখলেন,
দূরে মার্ক্সের ছোটো মেয়ে ইলিয়ানর শ্রমিকদের মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসছে, মৃত বন্ধুর কথা
তাঁর মনে পড়েছিল। মার্ক্সের জন্য গর্বে ভরে উঠেছিল বুক।
যতদিন মার্ক্স বেঁচে ছিলেন, বিশ্ব-সর্বহারার
আন্তর্জাতিক ভাবধারাগত নেতৃত্ব মার্ক্সের হাতে ছিল, প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠায় তাঁর
অবদানে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপে সে নেতৃত্বের
গুরুত্ব বোঝা যায়। এঙ্গেলস সে সময় তাঁর নিজেরই ভাষায় ‘সঙ্গতকার’ (সেকেন্ড ফিড্ল) হয়ে থেকেছেন। মার্ক্সের মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই
তাঁকে সেই নেতৃত্ব নিজের হাতে নিতে হয়েছে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতিতে
এবং মার্ক্সেরই মতো, বিশ্বের শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ এবং ব্যক্তিগত দেখাসাক্ষাতে
বোঝা যায় সে নেতৃত্বের গুরুভার তিনি কিভাবে বহন করতেন। লেনিন বলেছিলেন, এঙ্গেলস “আধুনিক সর্বহারার শিক্ষক”!
ভাবধারাগত এই ঘনিষ্ঠতা বাদে ছিল ব্যক্তিগত
ও পারিবারিক বন্ধুত্ব। সে প্রসঙ্গগুলো মোটামুটি সবাই জানেন এবং তা এঙ্গেলসের জীবনীরই
অঙ্গ, তাই বরং জীবনীরই কালানুক্রমে আসুক।
প্রস্তুতিপর্ব
বারমেন-এলবারফেল্ড
জার্মানির বারমেন শহর সে সময় রাইন প্রদেশে
ছিল। এখন গুগলে সার্চ করতে গেলে ভেসে উঠবে বারমেন-উপার্টাল, কেননা বারমেন ছাড়া আরো
চারটে পুরোনো শহর নিয়ে তৈরি হয়েছে আজকের উপার্টাল শহর। উনিশ শতকের প্রারম্ভিক দশকগুলোয়
রাইন অঞ্চল বাকি জার্মানি থেকে বেশি শিল্পসমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। বারমেন ব্যতিক্রম ছিল
না। সে শহরেই কাপড় কলের মালিক এক ধনী পরিবারে ১৮২০ সালের ২৮শে নভেম্বর ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের
জন্ম। তাঁর বাবার নামও ইংরেজিতে ফ্রেডরিকই, যদিও জার্মানে ‘ফ্রিডরিশ’। মায়ের নাম এলিজাবেথ। ফ্রেডরিক তার বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান।
পরে তার আরো সাত জন ভাই বোন হয়েছিল।
এঙ্গেলসের শৈশবকাল ঘরের ভিতরে এবং বাইরে দুটো
পরস্পরবিরোধী জীবনদৃষ্টির দ্বারা অনবরত প্রভাবিত হতে থাকে। বাড়িতে এক দিকে ছিলেন ডাকসাইটে
স্বভাবের বাবা যাঁর ভয়ে বাড়ির সবাই, এমনকি মা-ও ত্রস্ত হয়ে থাকতেন। বাবা তখনকার জার্মানির
ধার্মিক পরিবেশ অনুসারে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিশ্চানই ছিলেন কিন্তু অভিজাত পরিবারের দীর্ঘ
বংশপরম্পরার সঙ্গে পূঁজিবাদী জীবনে আবশ্যক ব্যবসায়িক কাজকর্মের যোগ (যা স্বাভাবিকভাবেই
ধার্মিক পবিত্রতা মেনে চলত না) তাঁকে এবং পুরো পরিবারের আবহাওয়াটাকে কঠোর পবিত্রতাবাদী
লুথারিয়ান বানিয়ে দিয়েছিল। শুধু এঙ্গেলসের পরিবারটাকেই নয়, পুরো বারমেন এবং উপার্টাল
অঞ্চলের কুলীন সামাজিক জীবনটাকে গ্রাস করেছিল ভিতর থেকে ফাঁপা এই কঠোর পবিত্রতাবাদী
আবহাওয়া। অন্য দিকে, এঙ্গেলসের মা এলিজাবেথ কোমল স্বভাবের মহিলা ছিলেন এবং তাঁর একটা
সাহিত্যিক অভিরুচি ছিল। আর্থিক অর্থে সম্পদশালী হওয়া থেকে আত্মিক অর্থে সম্পদশালী হওয়া
তিনি শ্রেয়ষ্কর মনে করতেন। শিশু ফ্রেডরিকও মায়ের কাছেই শান্তি পেত। তার সাহিত্যিক,
সাঙ্গিতিক রুচিগুলোও মায়েরই সাহচর্যে তৈরি হল।
যদিও, এরই সঙ্গে একটা তৃতীয় পারিবারিক প্রভাবও
গুরুত্বপূর্ণ। এঙ্গেলসের দাদু (মায়ের দিকের পিতামহ) গ্রীক কিম্বদন্তী এবং অন্যান্য
অনেক পৌরাণিক কাহিনী জানতেন এবং তা থেকে নেওয়া গল্প বাড়ির ছোটোদের শোনাতেন। কিম্বদন্তীর
প্রসঙ্গ এবং চরিত্রগুলো শিশুমনে সাহিত্যের মাটি তৈরি করত।
ঘরের বাইরে, আত্মীয়স্বজন এবং পারিবারিক পরিচিতদের
সীমার বাইরে ছিল বারমেনের রাস্তাঘাট, সাধারণ প্রসন্ন জনজীবন এবং শ্রমিকদের বসত। জীবনের
দুঃখকষ্ট ছাপিয়ে আনন্দ ও সারল্যে ভরা জীবনবোধ।
স্বাভাবিকভাবে এঙ্গেলসের বালকমনে তিনটে প্রবৃত্তি
একসঙ্গে জায়গা করে নিল – (১) কঠোর ধার্মিক
পবিত্রতাবাদের বিরোধ যা একটু বড় হতেই নিরীশ্বরবাদে পৌঁছে গেল; (২) সাহিত্যপাঠ এবং লেখার
দিকে ঝোঁক; (৩) জনতার জীবনকে কাছ থেকে দেখার আকাঙ্ক্ষা।
বারমেনের পাশেই ছিল এলবারফেল্ড, জোড়া-শহরের
মত। সেটাও এখন উপার্টালের অংশ। বার্মেন মিউনিসিপাল স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পর ১৪ বছর
বয়সে এঙ্গেলসকে উঁচু ক্লাসের পড়াশুনোর জন্য এলবারফেল্ড জিমনাশিয়ামে ভর্তি করে দেওয়া
হল। অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্র ছিল সে। কিন্তু সেখানেই, এক বছর পর যখন বাবা, ছাত্রাবাসের
কামরায় গিয়ে ছেলের সঙ্গে দেখা করে তার মা-কে চিঠি লিখলেন তাঁর জোর, ছেলের লেখাপড়া থেকে
‘নিঃশর্ত আজ্ঞানুবর্তিতা’এর ওপর বেশি ছিল – “আপাতদৃষ্টিতে সে আগের চেয়ে বেশি বিনয়ী হয়েছে কিন্তু মনে হয় আগে এতবার
প্রচন্ড বকুনি খেয়ে এমনকি শাস্তি পেয়েও তার ভয় তাকে নিঃশর্তভাবে আজ্ঞানুবর্তী করতে
পারে নি।” ছেলেকে নিঃশর্ত আজ্ঞানুবর্তিতার
গণ্ডির ভেতরে আনার চেষ্টার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল খ্রিষ্টীয় পবিত্রতাবাদ ও সমসাময়িক
সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার সামনে নতিস্বীকার এবং পারিবারিক ব্যবসার প্রতি
টান।
ছাত্রাবাসে কিশোর ফ্রেডরিকের টেবিলে বাবা স্কুলের
লাইব্রেরি থেকে আনা, ১৩ শতকের নাইটস(বীর)-দের ওপর লেখা একটা পুরোনো বই পেলেন। যদিও
সেই মধ্যযুগের বীরেরাও খ্রিশ্চানই ছিলেন কিন্তু শিশুদের মগজে ঐ বীরদের বীরত্বপূর্ণ
অশ্বারোহণ এবং যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রভাবকে ভালো মনে মেনে নেওয়ার সাহস, বারমেন শহরের
আধ্যাত্মিক পবিত্রতাবাদেরও ছিল না আর জার্মান (প্রুশীয়) রাষ্ট্রশক্তিরও ছিল না। তাই
ফ্রেডরিকের বাবা শুধু এবিষয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন না যে ছেলে এইসব বই পড়ে, বরং আরো
ঘাবড়ে গেলেন যে ছেলে “কেমন নিরুদ্বেগে
এসব বই টেবিলের ওপর রেখে দেয়”। … বাবা ফ্রেডরিকের
মা-কে মনের কষ্টটা স্পষ্ট করে লিখলেন যে “অন্য সব দিক থেকে এত ভালো এই ছেলেটির” জন্য তিনি “প্রায়শই ভয়ে ভয়ে” থাকেন। চিঠিতে উনি জানালেন যে ফ্রেডরিকের
সাপ্তাহিক স্কুল-রিপোর্ট খুব ভালো নয়। আর তার কারণও তাঁর হিসেবে (সেটা ভুলও ছিল না)
ফ্রেডরিকের এই আচরণ।
এলবারফেল্ডের স্কুলে পড়ার সময়েই তরুণ ফ্রেডরিক
লেখালিখি শুরু করলেন। তাঁর প্রারম্ভিক লেখাগুলোর মধ্যে একটা, ১৮৩৭এর শুরুতে লেখা যিশুখ্রিস্টের
উদ্দেশে একটি কবিতা। এই কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্রের দ্বিতীয়
খন্ডে পাওয়া যায়। ঈশ্বরের একমাত্র পুত্র যিশুখ্রিষ্টকে তাঁর স্বর্গীয় আবাস থেকে আরেকবার
পৃথিবীতে অবতরণ করার প্রার্থনা জানিয়ে কবিতাটি শুরু হয়। শেষে কবি লেখেন –
প্রার্থনারই সুরে, সেই মানুষদের পাওনা অংশ
দেওয়ানোর কথা আছে এখানে, যাদের এঙ্গেলস নিজের শৈশবের দুনিয়ার চার দিকে, সারাদিন কঠোর
পরিশ্রমের পরেও বঞ্চিত হতে দেখছিলেন।
এসব তো প্রাথমিক ভাবনাচিন্তা ছিল। ১৭ বছর বয়স
পার হতে হতে তিনি, অন্ততঃ অন্যদের চোখে নাস্তিক, অর্থাৎ প্রচলিত জার্মান খ্রিষ্টমত,
প্রোটেস্ট্যান্টবাদ এবং বিশেষকরে পবিত্রতাবাদের বিরোধী চিন্তাভাবনাগুলোর সমর্থক ও প্রচারক
হয়ে উঠলেন। তাঁকে এলবারফেল্ড জিমনাশিয়াম ছাড়িয়ে দেওয়া হল। বাবার মনে হল, এ ছেলেকে লেখাপড়ায়
ধরে রাখার অর্থ হবে এর বিদ্রোহী মনোভাবটাকে আরো বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। তাই
তাকে প্রায় তিনশো কিলোমিটার দূরের একটি বাণিজ্য-কেন্দ্র, বন্দর-শহর ব্রেমেনের এক বাণিজ্য
সংস্থায় কেরানীগিরি করতে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
ব্রেমেন
কেমন কেমন সব পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করে
ভবিষ্যতের এই বিদ্বান পথপ্রদর্শক নিজের রাস্তা তৈরি করলেন। বাবা ব্রেমেনে কেরানীগিরি
করতে ছেড়ে আসলেন আর সেখানে ছেলে দার্শনিক হেগেলকে পড়া, আর একই সঙ্গে লেখার হাত শক্ত
করতে শুরু করলেন।
ব্রেমেনে পৌঁছে প্রথমে শুরু করলেন নিজের লেখা
কবিতাগুলোর মধ্যে থেকে বাছাই করে পত্রিকায় পাঠানো, অর্থাৎ প্রকাশন। মার্ক্স-এঙ্গেলস
রচনাসমগ্রের হিসেবে প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘বেদুইন’। পূঁজিবাদ কিভাবে
মরুবাসী আরব জনগোষ্ঠিগুলোর সামাজিক জীবন ধ্বংস করে তাদেরকে বাজারের তামাশা বানিয়ে দাঁড়
করিয়ে দিল, তাদের প্রাণশক্তি কেড়ে নিল, কবিতাটি তারই মর্মস্পর্শী ছবি। তরুণ এঙ্গেলসের
সাহিত্যিক ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা এ লেখার বিষয় নয়। শুধু তাঁর অনুভবে ও দৃষ্টিতে হতে থাকা
অগ্রগতির একটা নিদর্শন হিসেবে কথাটা বললাম।
১৮৩৯এর মার্চ-এপ্রিলে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ
সামাজিক প্রতিবেদন হাম্বুর্গের পত্রিকা ‘টেলিগ্রাফ ফুর ড্যুশল্যান্ড’এ পাঁচ কিস্তিতে প্রকাশিত হল। শিরোনাম ছিল ‘উপার্টালের চিঠি’। ওসওয়াল্ড ছদ্মনামে সাংবাদিকতার দুনিয়ায় এটা
তাঁর প্রথম পদক্ষেপ ছিল। এত জনপ্রিয়তা পেল সে লেখা, যে পত্রিকার প্রতিবেদন-সম্বলিত
পাঁচটা সংখ্যাই হাতে হাতে বিক্রি হয়ে গেল। ওদিকে, বার্মেন, এলবারফেল্ড এবং পুরো উপার্টাল
অঞ্চল নিবাসী পবিত্রতাবাদী কুলীন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী রাগে ফেটে পড়ল। ছদ্মনামের পেছনে
লুকিয়ে থাকা লেখকটিকে গরুখোঁজা শুরু করল।
প্রতিবেদনটা বড় এবং তাতে পুরো অঞ্চলের তৎকালীন
সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনের হালহকিকৎ নিয়ে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। উপার্টাল অঞ্চলের
নৈসর্গিক সৌন্দর্য কিভাবে শিল্পায়ন ও অব্যবস্থিত নগরায়নের ফলে কিভাবে নিরানন্দ ও হতশ্রী
হয়ে পড়েছে। উপার নদীর (যে নামে অঞ্চলটার নাম) মেটে জল যদি কোথাও রক্তিম মনে হয় সেটা
নদীর রূপ নয়, কাপড় রাঙাতে ব্যবহৃত রসায়নের মিশ্রণে আসা বিকৃতি। তারপর লেখক নজর দেন
রাস্তায়, বিশেষ করে সন্ধ্যায় বেরিয়ে অনেক রাত অব্দি যারা মৌজ করে সেই লোকজনদের অসভ্য,
অশ্লীল এবং মদ্যপ আচরণের দিকে। (পরে অন্য কোনো লেখায় তিনি এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার
কথা লিখেছিলেন যে কিভাবে তাঁর শৈশবে চোখের সামনে পুরো অঞ্চলটা, শ্রমিকদের বস্তি বৃদ্ধির
সঙ্গে সঙ্গে সস্তা মদের দোকানে ভরে উঠেছিল, অর্থাৎ শ্রমিকেরা অসভ্য, অশ্লীল আচরণ করা
মানুষ বা মদ্যপ ছিল না, তাদেরকে হতে বাধ্য করা হয়েছিল)। ঐ লেখায় তিনি তারপর লেখেন –
“এই অবস্থার কারণ
স্পষ্ট। প্রাথমিকভাবে ও সবচেয়ে বেশিভাবে দায়ী কারখানাগুলোর কাজ। নিচু ছাতের ঘরে কাজ
করতে থাকা মানুষগুলো অক্সিজেনের চেয়ে বেশি কয়লার ধোঁয়া আর ধুলোয় নিঃশ্বাস নেয়। এদের
মধ্যে অধিকাংশ ছ’বছর বয়স থেকেই কাজ
করা শুরু করে দেয়। এই পরিস্থিতিটাই তো তাদের জীবন থেকে সব আনন্দ আর শক্তি নিংড়ে বার
করে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট! যাদের বাড়িতে নিজেদের তাঁত আছে সে তাঁতিরা সকাল থেকে রাত অব্দি
তাঁতের ওপর নুয়ে বসে থাকে এবং একটা গরম উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের শিরদাঁড়ার মজ্জা
শুকোয়। যারা রহস্যবাদের শিকার হয় না তারা নেশার শিকার হয়ে ধ্বংস হয়।”
অনেক সময় আমরা ধর্ম সম্পর্কে মার্ক্সবাদের
বক্তব্য নিয়ে আলোচনায় দেখেছি, এক দল “জনগণের আফিং” এটুকুকেই স্লোগান করে তুলি, এবং অন্য দল “দুঃখের বহিঃপ্রকাশ, আত্মাহীন
অবস্থার আত্মা, দুর্দশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ” ইত্যাদি বলে শেষে একটা সমঝদারিতে পৌঁছোই।
মার্ক্সের পরিচিত বক্তব্যটা হেগেলের ‘অধিকারের দর্শন’এর সমালোচনার অংশ এবং ১৮৪৩ সালে লেখা। তবে তাঁর তরুণ মনে
ধর্ম বিষয়ে ধারণাগুলো নিশ্চয়ই দানা বাঁধছিল অনেক আগে থেকে!
এঙ্গেলসও তরুণ বয়সে নিজের মত করে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং যৌক্তিকতার দ্বিপথে কোনদিকে
যাবেন সেটা স্পষ্ট করে তুলছিলেন। তাঁর স্কুলজীবনের বন্ধু
ছিল দুই ভাই – উইলহেল্ম এবং ফ্রেডরিক গ্রেবার। দুজনকে আলাদা আলাদা
চিঠি লিখতেন কেননা দুজনের রুচি ভিন্ন ছিল। উইলহেল্মকে লেখা চিঠিগুলোর মধ্যে
একটায়, ১৫ই জুন ১৮৩৯এ তিনি লিখছেন, “... যখন এমন কারুর সঙ্গে দেখা হয় যে ইতিবাচক খ্রিষ্টধর্মকে ঔদ্ধত্যের
সঙ্গে খারিজ করছে, আমি এই উপদেশসমূহকে [চিঠিতে আগে উল্লিখিত খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে
সেধরণের কথাবার্তা যা যুক্তিবাদকে সরাসরি খারিজ করে না] সমর্থন করি, কিন্তু যখন যুক্তির স্বাধীনতা রক্ষার প্রশ্ন ওঠে,
আমি সমস্ত রকম বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি।”
বাবা তাঁকে ব্রেমেনে কেরানীগিরি করতে
পাঠিয়েছিলেন। কেমন চলছিল সে কাজ? ২০-২১ অক্টোবর ১৮৩৯এ আবার উইলহেল্মকে লেখা
চিঠিতেই ২১এর রোজনামচার মত করে লিখছেন, “আজকের দিনটা ভয়ানক ক্লান্তিকর গেল। অফিসে
গোলামি করতে করতে আধমরা হয়ে পড়েছি। ... কবিতা পরে পাঠাবো, এখন আর সময় নেই। ভালো
কিছু খাবারও নেই, সব একঘেয়ে।”
তবু তারই মধ্যে তিনি নিজেকে তৈরি করছিলেন।
ভাষা শিখছিলেন। দর্শন, সাহিত্য পড়ছিলেন। লিখছিলেন। এমনকি রোজকার আনন্দ পেতে
সন্ধ্যায় কয়্যারে সমবেত গানে অংশ নিচ্ছিলেন, চুটিয়ে সঙ্গীত পড়ছিলেন এবং শুনছিলেন। আর? যে খেলোয়াড় মনোভাব তাঁর সারা জীবনের সঙ্গী ছিল তাকেও সময় দিচ্ছিলেন।
চুটিয়ে শিখছিলেন ঘোড়সওয়ারি, তরোয়ালখেলা, সাঁতার আর স্কেটিং। অনেক
দিকে নিজেকে মেলে জীবনকে অনুভব করতেন, সেভাবেই মেলে
দিচ্ছিলেন।
যুব-জার্মান এবং যুব-হেগেলিয়ান
মূলতঃ উনি নিজেকে একজন ‘তরুণ জার্মান’ হিসেবে প্রস্তুত করছিলেন।
কথাটার মানে কী? তরুণ তো তিনি ছিলেনই, জার্মানও ছিলেন, কিন্তু ‘তরুণ জার্মান’ তখনকার দিনে একটা বাগধারা
বা চলতি পারিভাষিক অভিব্যক্তি হয়ে উঠেছিল। ১৮৩০ সালের জুলাই মাসে প্রথমে ফ্রান্স
এবং তারপর ইয়োরোপের আরো কয়েকটি দেশে রাজনৈতিক বিপ্লবের ঢেউ ওঠে। ইতিহাসে সেটা ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে প্রসিদ্ধ। রাষ্ট্রশক্তির
পরিবর্তনগুলো তো প্রত্যেকটি দেশের তৎকালীন ঐতিহাসিক পটভূমি অনুসারে হল, কিন্তু যে
কারণে সে পরিবর্তনে বিপ্লবের উপাদান নজরে এল তার কারণ ছিল শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকা। কেননা ঐ রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোতে ইয়োরোপের শ্রমিক শ্রেণী তাদের নিজেদের
দাবিসমূহ নিয়ে অংশগ্রহণ করল। তাদের রাজনৈতিক দাবিগুলো তখনো পূঁজিবাদী কিন্তু তার সঙ্গে
ছিল শ্রমসম্পর্কিত দাবি। ইয়োরোপের পুঁজিবাদীরা চমকে উঠে দেখল শ্রমিক আর তাদের নেতৃত্বে
চলতে প্রস্তুত নয়। [অনেক সময়ে বাংলা লেখাতেও পূঁজিবাদীদের জন্য ফরাসি শব্দ ‘বুর্জোয়া’ বা এমনকি ‘বুর্জোয়াজি’ও ব্যবহার হয়, কিন্তু আমি পূঁজিবাদী ব্যবহার করা সমীচীন মনে করলাম]
নিজেদের দাবি নিয়ে, নিজেদের স্লোগানে আওয়াজ তুলে, নিজেদের পতাকা নিয়ে তারা শহরের রাস্তায়
ব্যারিকেড গড়ে লড়ছে। রাজনৈতিক স্লোগানগুলো পূঁজিবাদী – মূলতঃ ‘মুক্তি-সাম্য-ভ্রাতৃত্ব’এর ডাক – হলেও একটি শ্রেণী
হিসেবে স্বাতন্ত্র্যের ঘোষণা তারা ১৮৩০এর জুলাই বিপ্লবের দিনগুলোয় করে দিল। এর ফলে,
ইওরোপের বেশির ভাগ দেশে একটা নতুন ঘটনা দেখা যেতে শুরু করল। শহরগুলোর বৌদ্ধিক জগতে
বড় সংখ্যায় মানুষ প্রজাতান্ত্রিক পরিবর্তনের পক্ষে দাঁড়াতে শুরু করল আর তাদের মধ্যে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় এগিয়ে এল যুবশ্রেণী। জার্মানিতে যে যুবরা এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকায়
ছিল তারা নিজেদের ‘যুব-জার্মান’ বলে চিহ্নিত করতে লাগল। খবরের কাগজগুলোতেও
তারা ঐ নামে চিহ্নিত হল। এঙ্গেলসের ব্রেমেনে পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য
ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন, চার্টিস্ট আন্দোলন, শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং প্রুশীয়
সেন্সরের হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও সে খবর জার্মানিতে দিব্যি পৌঁছোচ্ছিল।
যদিও প্রুশীয় সম্রাটের রাজত্বে ‘যুব-জার্মান’এর রাজনৈতিক অভিব্যক্তি সেভাবে প্রখর হয়ে ওঠে
নি। তবে তারই পরোক্ষ প্রভাবে, প্রধানতঃ কয়েকটি নতুন সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক প্রবৃত্তির
সমাবেশ ছিল। পাশাপাশি যুবদের আরেকটি দল ছিল। ‘যুব-হেগেলিয়ান’। সেটা আবার দার্শনিক ও ভাবাদর্শগত প্রবৃত্তির সমাবেশ। দুই দলে অনেক
কিছুই যৌথভাবে স্বীকৃত ছিল এবং অনেকেই শামিল ছিল দু’দলেই।
এই দুই দলেরই প্রধান ইতিবাচক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর
তিনটে দিক উল্লেখযোগ্য এঙ্গেলসের ব্রেমেন-বাসের বছরগুলোয়। প্রথম, তৎকালীন প্রুশীয় রাজতন্ত্রের
প্রতি ঘৃণা এবং বিরুদ্ধে স্থানগ্রহণ; দ্বিতীয়, ধর্মের নামে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বহাল
খ্রিষ্টধর্ম ও পুরোহিততন্ত্রের প্রতি ঘৃণা ও বিরুদ্ধ মনোভাব; এবং তৃতীয়, হেগেলীয় দার্শনিক
প্রণালীতে মানব-ইতিহাসের, ‘উৎকর্ষের বিকাশ’ রূপী যে প্রত্যয়, সমকালীন বৈপ্লবিক পরিবর্তনগুলোকে
বোঝার জন্য তার প্রয়োগ।
১৮৩৯এর ৮ই এপ্রিল ফ্রেডরিক গ্রেবারকে লিখছেন
–
“কে ছিল ১৮৩০ সালের
আগে? … বজ্রনিনাদের মত
তারপর জুলাই বিপ্লব এল, মুক্তির যুদ্ধের পর জনগণের আকাঙ্খার মহত্তম অভিব্যক্তি …”
ঐ চিঠিতেই পরের দিন, ৯ই এপ্রিল যোগ করছেন –
“তাহলে এখন আমি, বেচারা
বদমাইসটা, কী করি? রোজকার জীবনের এই একঘেয়ে পথে ঘাম ঝরাতে থাকি? ইচ্ছে করে না। রাজভক্ত
হয়ে যাই? তাহলে যেন জাহান্নমে যাই। স্যাক্সন (উত্তর-জার্মান জাতিগোষ্ঠি) সাধারণত্বে
রয়ে যাই? এ-রাম, ছিঃ! তাই, আমাকে অবশ্যই ‘যুব-জার্মান’ হতে হবে। বা, বলতে পারি, হয়েই আছি, এখনই, শরীরে আর সত্তায়। রাতে
ঘুমোতে পারি না, শুধুমাত্র শতাব্দীর চিন্তাভাবনাগুলোর জন্য। যখনই ডাকঘরে যাই আর প্রুশীয়
রাজ-চিহ্নের দিকে নজর পড়ে, স্বাধীনতার আবেগে আবিষ্ট হয়ে পড়ি। যতবার খবরের কাগজ পড়ি,
স্বাধীনতার পথে কতটা এগোলাম, খুঁজতে শুরু করে দিই।”
তিন মাস পর সেই বন্ধু গ্রেবারকে তিনি স্বাধীনতার
অর্থ বোঝাতে গিয়ে লিখলেন –
“তুমি বল যে সংশয়ে
অক্ষমতাই মনের স্বাধীনতা? ওটা মনের সবচেয়ে বড় দাসত্ব। শুধু সে-ই স্বাধীন যে নিজের প্রত্যয়-সম্পর্কিত
প্রতিটি সংশয়ের ওপর জয়লাভ করেছে। আর, আমার প্রত্যয়কে খণ্ডন করার দাবি আমি তোমার কাছে
মোটেও জানাচ্ছি না। আমি পুরো সনাতন ধর্মশাস্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি আমায় খণ্ডন করুক।”
এই প্রত্যয় ছিল সে সময়কার ইয়োরোপীয় নবজাগরণ,
যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রত্যয়। সনাতন খ্রিষ্টধর্মের সবক’টি মত, ধারণা এবং তার সাংস্কৃতিক আধিপত্যের
বিরুদ্ধে সংগ্রামরত থেকেও সে সময় তিনি ‘ঈশ্বর’ নামে একটি সত্তাকে
ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। পুরোপুরি নাস্তিক হন নি কিন্তু ব্রেমেন আর বারমেনের ছোটো
শহরের পরিবেশে দিন কাটিয়েও তিনি রাজধানী বার্লিনে হতে থাকা ‘যুব-হেগেলিয়ান’দের দার্শনিক কার্যকলাপ সম্পর্কে সব খবর নিতেন।
লিখছিলেন প্রধানতঃ সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতি বিষয়ে, কিন্তু একটি দার্শনিক বিশ্বদৃষ্টির
প্রয়োজন অনুভব করছিলেন।
১৮৩৯-৪০এর ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে ফ্রেডরিক
গ্রেবারকে অনেকদিন ধরে লেখা একটি চিঠিতে তিনি হেগেলের দর্শন নিয়ে, হেগেলের ভালো এবং
খারাপ শিষ্যদের নিয়ে, হেগেলের দার্শনিক প্রণালীর অখণ্ডতা নিয়ে অনেক কিছু লিখলেন। ২১শে
জানুয়ারি তিনি মস্করার সুরে লিখলেন, “উদাহরণার্থে ভাবো যদি এ চিন্তাসূত্রটি, যে বিশ্ব-ইতিহাস স্বাধীনতার
ধারণার বিকাশ, পুরো ওজন নিয়ে ব্রেমেনের পাদ্রীর ঘাড়ে এসে পড়ে তাহলে তার ভিতর থেকে কী
ধরণের দীর্ঘশ্বাস বেরুবে?”
সে চিঠিতে সেদিনই পরে প্রুশিয়ার সম্রাট ফ্রিডরিখ
উইলহেল্ম-৩ এর প্রতি ক্রোধে লিখলেন –
“এই রাজাই ১৮১৫ সালে
যখন ভয় পেয়েছিল, মন্ত্রীসভার তরফ থেকে ফতোয়া জারি করে প্রজাকে কথা দিয়েছিল যে যদি তারা
রাজাকে [তৎকালীন – লেখক] ঝক্কিঝামেলা
থেকে বার করে আনে তাহলে তারা [নিজেদের দেশের – লেখক] একটা সংবিধান পাবে! সেই – পাজি, পচা, ঈশ্বর-শাপিত – রাজাই এখন ঘোষণা করছে যে কাউকেই কোনো সংবিধান সে দিতে যাচ্ছে
না – মারাত্মক ঘেন্নায়
আমি লোকটাকে ঘৃণা করি, আর যদি আমি ঐ লোচ্চাটাকে এত তুচ্ছ মনে না করতাম তাহলে আরো বেশি
ঘৃণা করতাম … ১৮১৬ থেকে ১৮৩০
অব্দিকার কালখন্ডের চেয়ে বেশি রাজকীয় অপরাধে ভরা কালখণ্ড কখনো আসে নি। যতগুলো রাজপুত্র
এই কালখণ্ডে শাসন করেছে সবাই মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য।”
১৯৭৪ সালে সোভিয়েত সঙ্ঘ থেকে প্রকাশিত এঙ্গেলসের
জীবনীর প্রথম অধ্যায়ে উদ্ধৃতির এই শেষ অংশটুকু উদ্ধৃত। তারপর জীবনী-রচয়িতারা প্রুশীয়
সাম্রাজ্যের নীতি সম্পর্কে এঙ্গেলসের সেসময়কার সমঝদারির সারসংক্ষেপ করেছেন – গরীবের ক্ষতি করে সম্পদশালী অভিজাত শ্রেণীকে
রক্ষা এবং রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিকে নিষ্পেষিত করে, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে অজ্ঞতায় পর্যবসিত
করে, ধর্মকে ব্যবহার করে স্বৈরতন্ত্র বহাল রাখার নীতি।
এঙ্গেলস বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর বার্লিন যাওয়া,
সেখানে থাকা খুবই জরুরি। হেগেলের দর্শনের বামপন্থী অনুগামী তো তিনি হয়ে উঠেছিলেন, বার্লিনের
‘যুব-হেগেলিয়ান’দের খবরাখবরও নিয়মিত রাখতেন কিন্তু নিজের দার্শনিক
প্রয়োগের জন্য হেগেলীয় পদ্ধতি, দ্বান্দ্বিকতাকে এখনো স্পষ্টভাবে দেখতে ও চিনতে পারছিলেন
না। ব্রেমেনে কেরানীগিরি করতে করতে, বেঁচে যাওয়া সময়ে বুভুক্ষুর মত পড়তেন, লিখতেন আর
তারপরেও, সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, মন যতই অস্থির হোক, ভাই-বোন-বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠিতে
অনবরত আনন্দ ছড়াতেন। প্রত্যেকের মন বুঝতেন। বোনকে পাঠাতেন, নতুন শেখা স্বরলিপি লিখনের
নমুনা, শর্টহ্যান্ডের নমুনা, তাঁর বাড়তে থাকা ভাষা-জ্ঞান, রোজকার দেখা জীবনের দ্রুত-হাতে
আঁকা পেন্সিল স্কেচ, ড্রয়িং আর কার্টুন। ২৮শে সেপ্টেম্বর ১৮৩৯ তারিখে বোন মেরিকে লিখছেন
–
“আমি এখন ক্লাবে আছি।
ক্লাব বলতে বারমেনের সদ্ভাব-সংস্থা বা আত্মবিকাশ-সংস্থার অনুরূপ। এখানে রাখা সবচেয়ে
ভালো জিনিষ হল খবরের কাগজ, নানান খবরের কাগজ – ডাচ, ইংরেজি, মার্কিন-ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, তুর্কি আর জাপানি।
এই খবরের কাগজগুলো থেকে আমি তুর্কি আর জাপানি ভাষা বুঝতে শিখলাম, কাজেই এখন আমি ২৫টা
ভাষা বুঝি।” খুবই সম্ভব ‘বুঝি’ শব্দটা এখানে বোনের
কাছে তারুণ্যের চপল অভিব্যক্তি। তবে প্রধান ইয়োরোপীয় ভাষাগুলো যে ভালো করেই জানতেন
সে তো পরবর্তী বছরগুলোয় তাঁর কাজেই প্রমাণিত।
উইলহেল্ম গ্রেবারের সঙ্গে যেমন সঙ্গীতজ্ঞদের
নিয়ে আলোচনা করতেন, ফ্রেডরিক গ্রেবারের সঙ্গে দর্শন আর রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতেন।
সবার সঙ্গেই মাঝে মধ্যে মস্করা। তাঁর খেলোয়াড়ির কথা আগেই বলেছি। শরীরও ছিল খেলোয়াড়ের
মত বলিষ্ঠ, রূপবান, আকর্ষণীয়।
এসবেরই মাঝে ব্রেমেনে নদীর বন্যা ঢুকতো ঘরে।
নিজের ঘর ছেড়ে কোনো প্রতিবেশীর বাড়িতে যখন আশ্রয় নিতে যেতেন আর দেখতেন যে তাকেও জিনিষপত্র
বাঁচাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, তখন তিনিও তার সঙ্গে
সারা রাত জল ছেঁচে বার করতেন, আনাজপাতিগুলো বাঁচাবার ব্যবস্থা করতেন।
এঙ্গেলসের জীবনী-রচয়িতারা সঠিক বলেছেন যে দ্বান্দ্বিক
ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দর্শন অব্দি পৌঁছোনোর এবং বিশ্বের বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠক
এবং তাত্ত্বিক নেতা হয়ে ওঠার যে যাত্রাপথ, সে যাত্রাপথে এঙ্গেলসের সফর অনেক বেশি কঠিন
ছিল। মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ডের মুখবন্ধে সম্পাদক লিখছেন –
“এঙ্গেলসের পক্ষে
প্রগতিশীল দৃষ্টি অব্দি পৌঁছোনো মার্ক্সের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ছিল। তিনি বারমেনের
গোঁড়া, ধার্মিক শিল্পপতি পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা তাঁকে জোর করে স্কুল ছাড়িয়ে ব্যবসায়
জুতে দিলেন। পরিণামে, সমকালীন ধার্মিক, দার্শনিক, রাজনৈতিক এবং সাহিত্যিক প্রবৃত্তিগুলোর
গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে, ছোটোবেলা থেকে হৃদয়ে আর মস্তিষ্কে ভরা ধার্মিক চিন্তাধারণাগুলো
ছাড়িয়ে ওপরে ওঠার জন্য যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক আত্মানুসন্ধান করতে করতে তাঁকে স্বতন্ত্রভাবে
নিজের শিক্ষা পুরো করতে হল। প্রধানতঃ ধর্ম আর ধর্মশাস্ত্রের যে সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ
তিনি করেছিলেন, সেটাই তাঁকে প্রগতিশীল দার্শনিক ভাবনা অব্দি পৌঁছে দিল। তাঁর বিকাশে,
বিশেষ করে প্রথম দিকে, সাহিত্যেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।”
পবিত্রতাবাদী ক্রিশ্চান শিল্পপতি বাবা, ছেলের
বিদ্রোহী মেজাজটাকে অবদমিত করার, তার ভিতর থেকে বিপ্লবী চিন্তার শিকড়গুলো উৎপাটিত করার
সবরকম চেষ্টা করেছিলেন। সহজ উপায় বেছে নিয়েছিলেন যে তার লেখাপড়াই বন্ধ করিয়ে দেওয়া
যাক। এলবারফেল্ডের স্কুল থেকেও শেষ পরীক্ষা (আমাদের এখনকার হিসেবে ম্যাট্রিক) দেওয়ার
আগেই তাকে বার করে নিলেন আর ব্রেমেনে কেরানীগিরি করতে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানকার ম্যানেজারকেও
বলে এলেন যে ছেলেটাকে কাজের জোয়ালে বেঁধে রেখ। তবুও এঙ্গেলস স্ব-অধ্যয়ন আর রচনাকর্মের
মাধ্যমে এগোতে থাকলেন।
বার্লিন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এবং পরেও
বাবাকে বার বার অনুরোধ করেছিলেন যে তাঁকে বার্লিনে গিয়ে লেখাপড়া করার অনুমতি দেওয়া
হোক। বাবা মানলেন না। তীব্র তর্কবিতর্ক হল পরিবারে। শেষে সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগ দেওয়ার
পথেই বার্লিন যাওয়ার রাস্তা বার করতে হল।
সেনাবাহিনীতে যোগদান এবং বার্লিন
১৮৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে এঙ্গেলস
সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিলেন। সেসময়কার প্রুশীয় সরকারের নিয়মানুসারে নির্ধারিত একটি মেয়াদের
জন্য সেনাবাহিনীতে চাকরি বাধ্যতামূলক ছিল। বড়লোক পরিবারের ছেলেরা আধিকারিকদের ঘুষ দিয়ে
নিজেদের নাম কাটিয়েও নিত। কিন্তু এঙ্গেলসের জন্য এটা বার্লিন যাওয়ার একমাত্র রাস্তা
ছিল। বার্লিনে গেলে পতিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারগুলোয় শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত
থাকতে পারতেন। তারই সঙ্গে বার্লিনবাসী আমূল-পরিবর্তনবাদী বৈজ্ঞানিক এবং লেখকদের সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারতেন।
তাই, বাধ্যতামূলক স্বল্পমেয়াদী সামরিক সেবার
প্রার্থীদের পাওনা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এঙ্গেলস দ্বাদশ গার্ডস আর্টিলারি কম্পানি
বাছলেন। সেটা বার্লিনে অবস্থিত ছিল। যাওয়ার কয়েকদিন আগে ৯ সেপ্টেম্বর ১৮৪১এ তিনি সেসময়
ম্যানহেমে থাকা বোন মেরিকে ইঙ্গিতে লিখলেন –
“এক সপ্তাহ অথবা পনেরো
দিন পরে আমি নাগরিক হিসেবে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করতে অর্থাৎ সামরিক সেবা থেকে বাঁচার
জন্য যা কিছু করতে পারি করার জন্য বার্লিন রওনা হচ্ছি। কদ্দূর কী করতে পারি দেখার জন্য
আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।”
বার্লিনে কার্ল মার্ক্স বিগত পাঁচ বছর যাবৎ
ছিলেন এবং বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছিলেন। যখন এঙ্গেলস বার্লিন পৌঁছোলেন তার
পাঁচ মাস আগে মার্ক্স জেনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন। মার্ক্সের ইচ্ছে ছিল
অধ্যাপক হবেন এবং সে উদ্দেশ্যে বনও গেলেন। কিন্তু নতুন প্রুশীয় রাজার, আগের থেকে বেশি
স্বৈরাচারী প্রশাসন কঠোর ভাবে সবক’টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমালোচক কন্ঠস্বরগুলোকে বহিষ্কার করছিল। এমনকি
প্রুশীয় রাষ্ট্রশক্তির অমূল্য রত্ন, দার্শনিক হেগেলেরও পদমর্যাদা বিধিবৎ শেষ করে দেওয়া
হয়েছিল – কেননা তাঁরই দর্শনের
মধ্যে থেকে তাঁর বিপ্লবী যুব অনুগামীরা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের উপাদান খুঁজে বার করতে
শুরু করেছিল। তাঁর জায়গায় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী এবং নিম্নমানের দার্শনিক শেলিংকে পদমর্যাদায়
প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সমস্ত পদ থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছিল হেগেলবাদীদের।
এমন সময়ে মার্ক্সের মত সুপরিচিত আমূল-পরিবর্তনবাদী হেগেলিয়ানের অধ্যাপকের চাকরি পাওয়া
ছিল অসম্ভব। মার্ক্স সময় নষ্ট করলেন না। যে কাজ তাঁর লক্ষ্য ছিল, সে কাজেই পুরো সময়ের
কর্মী হয়ে নেমে পড়লেন। প্রুশীয় সরকার, প্রশাসন এবং সেন্সর-নীতির বিরুদ্ধে শাণিত রাজনৈতিক
সাংবাদিকতা শুরু করে দিলেন।
তাই, এঙ্গেলস যখন বার্লিনে পৌঁছোলেন, মার্ক্সও
সেখানেই ছিলেন। কিন্তু দুজনের দেখা হল না। কেননা এঙ্গেলস বিশ্ববিদ্যালয়ের আড্ডাগুলোয়
ঢুকছিলেন আর মার্ক্স সে আড্ডাগুলো থেকে বেরিয়ে নতুন জীবনের তালাশ শুরু করেছিলেন। আবার,
১৮৪২এর শেষে যখন বার্লিন থেকে বারমেনে ফিরে এলেন, মার্ক্স প্রায় সে সময়েই চলে গেলেন
কোলোন। যদিও তত দিনে মার্ক্স, ‘রাইনিশে জাইটুং’এর পৃষ্ঠা থেকে এক সমবয়সী প্রতিভাবান লেখক ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের নাম
জেনে গিয়েছিলেন।
মার্ক্সবাদী বিশ্বদৃষ্টির দুই আবিষ্কারকের
পহুঁচপথের ভিন্নতা এবং এঙ্গেলসের পথের দুর্গমতা এতেও বোঝা যায় যে দর্শনের যে পাঠকক্ষে
মার্ক্স একজন স্নাতক-ছাত্র হয়ে প্রবেশ করতেন, এঙ্গেলস, আপাত-নজরে অশিক্ষিত এক বহিরাগত
যুব (সৈনিক) হয়ে প্রবেশ করলেন। সে সময়েই প্রকাশিত হল এঙ্গেলসের ‘অতিথি ছাত্রের রোজনামচা’ নামে একটি আলেখ্য।
বার্লিন যাওয়ার পর এঙ্গেলস তাই করলেন যা উনি
ভেবে রেখেছিলেন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারে গিয়ে মনে হল ঠকে গেছেন। কেননা সেখানে
হেগেলও ছিলেন না আর হেগেলবাদী অন্য কোনো অধ্যাপকও ছিলেন না, যাদেরকে শুনতে তিনি এত
তোড়জোড় করে বার্লিনে এসেছিলেন। ছিলেন শেলিং যার লেকচার শুনলেই বিরক্ত হতেন এঙ্গেলস।
তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে তিনি নিয়মিত যেতেন। কেননা গেলে মানুষজনের সঙ্গে আলাপ হত
এবং মনে, অনেক আগে থেকে জমে থাকা আকাঙ্খাগুলো প্রস্ফুটিত হত। সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক
বিষয়ের ওপর লেখার পাশাপাশি তিনি দার্শনিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের ওপরও লিখছিলেন। এই দিনগুলোতেই
তাঁর একটা গুরুত্বপূর্ণ বড় দার্শনিক রচনা ‘শেলিং ও আকাশবাণী’ একটি পুস্তিকা হয়ে বেরুলো। এঙ্গেলস বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শেলিংএর
লেকচারও শুনছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে লিখছিলেনও। কিন্তু চিঠিপত্রে চোখ বোলালে বোঝা যায়
তিনি দর্শনশাস্ত্রের গভীরতর অধ্যয়নের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।
মার্ক্সের প্রথম দিকের বছরগুলোয়, আর্নোল্ড
রুজ নামে এক বামপন্থী হেগেলবাদী রাজনৈতিক ভাবুকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। তিনি মার্ক্সের
চেয়ে ১৬ বছর বড় ছিলেন এবং বামপন্থী হেগেলবাদ যারা শুরু করেছিল তাদের একজন ছিলেন। ১৮৪৪
সালে রুজ আর মার্ক্স প্যারিস থেকে এক সঙ্গে ‘ড্যএশ-ফ্রাঞ্জোসিশ জাহ্রবুখের’ (জার্মান-ফরাসি বার্ষিকী)র সম্পাদনা করেছিলেন।
এঙ্গেলসের কয়েকটি রাজনৈতিক প্রবন্ধ সেই পত্রিকায় ছেপেছিল। যাহোক সেটা পরের কথা। ১৮৪১-৪২এ
রুজ ড্রেসডেনে ছিলেন এবং ‘ড্যএশ জাহ্রবুখের’এর সম্পাদক ছিলেন। এঙ্গেলস সেই পত্রিকায় কখনো
সাহিত্যিক আবার কখনো দার্শনিক বিষয়েও লিখতেন। ১৫ই জুন ১৮৪২এ তিনি একটি প্রবন্ধ পাঠালেন
এবং লিখলেন যে নিকট ভবিষ্যতে আরো একটি প্রবন্ধ পাঠাবেন। ‘শেলিং ও আকাশবাণী’ও আগে এই পত্রিকাতেই ছাপার কথা ছিল কিন্তু
বড় হয়ে যাওয়ায় এঙ্গেলস আলাদা, পুস্তিকা করে বার করেছিলেন। কিন্তু এসবের পর ২৬ জুলাইয়ে
তাঁর লেখা চিঠি তাঁর মনের অবস্থাটা দেখায়।
শুধু এটুকু বলবার জন্য চিঠি লিখছি যে আপনাকে
আমি কিছু পাঠাবো না। কিছু দিনের জন্য আমি আমার সব সাহিত্যিক কাজকর্ম ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত
নিয়েছি যাতে অধ্যয়নে বেশি সময় দিতে পারি। তার কারণ সহজ। আমি যুবক এবং দর্শনে স্বশিক্ষিত।
আমার নিজের একটি দৃষ্টি তৈরি করতে এবং প্রয়োজনে সেটির রক্ষা করতে এ শিক্ষা পর্যাপ্ত।
কিন্তু সেই দৃষ্টির ভিত্তিতে ঠিক মত এবং সফলতার সঙ্গে কাজ করার জন্য নয়। আর, এ বিষয়ে
আমার কাছ থেকে একটু বেশিরই প্রত্যাশা থাকবে কেননা দর্শনে আমি ‘ট্র্যাভেলিং এজেন্ট’, ডক্টরের ডিগ্রি নিয়ে দার্শনিক চিন্তাভাবনা
লেখার অধিকার অর্জন করি নি। আমি আশা করি আবার যখন লিখতে শুরু করব এবং সেটাও নিজের নামে,
তখন এ প্রত্যাশাগুলো আমি পূরণ করতে পারব। তার সঙ্গে এটাও একটা কথা যে আমার এখন অনেক
ধরণের কাজ করার চেষ্টা চালানো উচিৎ নয় কেননা শিগগিরই আমি ব্যবসায়িক কাজে আগের চেয়ে
বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ব।
বিষয়ীগতভাবে দেখলে আমার সাহিত্যিক কার্যকলাপ
এখন অব্দি নিছক পরীক্ষামূলক ছিল। যার পরিণামে আমি জানতে পারলাম আমার স্বাভাবিক ক্ষমতাগুলো,
প্রগতির উদ্দেশ্যে এবং শতাব্দীর আন্দোলনে সক্রিয় অংশিদারীর উদ্দেশ্যে সাফল্যের সঙ্গে
এবং কার্যকরভাবে কাজ করার যোগ্য কিনা। আমি পরিণামে সন্তুষ্ট এবং এখন দ্বিগুণ উৎসাহে
অধ্যয়নে রত হয়ে সেই ক্ষমতাগুলো অর্জন করা কর্তব্য মনে করি যা জন্মগত হয় না।
সামরিক সেবায় দিনচর্যার ক্লান্তি সত্ত্বেও
এঙ্গেলস বার্লিনে কাটানো একটি বছর পুরোপুরি কাজে লাগালেন। নিজের মেধাজগতকে বিকশিত করলেন।
বার্লিনের তৎকালীন বৌদ্ধিক পটভূমিটা কাছ থেকে দেখার এবং পাশাপাশি যুব-জার্মান ও যুব-হেগেলিয়ান
দার্শনিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে মেলামেশা বাড়ানোর দুটো বড় ফল
হল। প্রথমতঃ, দার্শনিক লেখালিখির কাজে তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়ল যে কারণে ‘শেলিং ও আকাশবাণী’র মত বড় একটি রচনা পুস্তিকা করে বার করতে পারলেন।
দ্বিতীয়তঃ, তথাকথিত যুব-জার্মান নামের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়টির বাস্তবিক
অবস্থা দেখতে পেলেন। বুঝতে পারলেন যে এরা শুধু সাহিত্যিক লেখালিখিতেই সীমিত থাকবে,
সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে কষ্ট-টষ্ট জাহির করবে কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে, দুর্নীতিগ্রস্ত
প্রশাসনের বিরুদ্ধে, সেন্সর-নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলবে না। এঙ্গেলসের এই সমালোচনা এল
‘এলেকজান্ডার জুংঃ
আধুনিক জার্মান সাহিত্যের ওপর বক্তৃতা’ নামে আলেখ্যে। যুব-হেগেলিয়ান বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও কয়েকজনের সীমিত
চিন্তাভাবনা এঙ্গেলস দেখতে পেয়েছিলেন। সে বিষয়ে পরের অধ্যায়ে আলোচনা করব।
এখানে আরো একটি কথা বলে নেওয়া অপ্রাসঙ্গিক
হবে না। আমরা সাধারণতঃ মার্ক্সবাদী দর্শনের আবির্ভাবের আগের দুজন জার্মান দার্শনিকের
নাম জেনে থাকি। একজন হেগেল, আরেকজন ফায়ারবাখ। এখানে শুধু এটুকুই বলে রাখতে চাই যে লুডউইগ
ফায়ারবাখও কিন্তু যুব-হেগেলিয়ান ঘরানায় শামিল দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। এবং সেভাবেই তাঁকে
এবং তাঁর বিখ্যাত কৃতি ‘খ্রিষ্টধর্মের সারকথা’ বইটাকে প্রথমে মার্ক্স এবং এঙ্গেলস জানতেন।
অবস্থান গ্রহণ
মার্ক্সের সঙ্গে দেখা
সামরিক সেবার মেয়াদ পুরো হওয়ার পর ৮ই অক্টোবর
১৮৪২এ এঙ্গেলস বার্লিন ছাড়লেন। বাড়ি ফেরারই কথা, অর্থাৎ বারমেন, কিন্তু তার আগে করণীয়
একটা কাজ তাঁর মাথায় ছিল। চলে গেলেন কোলোন। ‘রাইনিশে জাইটুং’এর দপ্তর কোলোনেই ছিল আর ততদিনে এঙ্গেলস ঐ পত্রিকার নিয়মিত লেখক
হয়ে উঠেছিলেন। কার্ল মার্ক্সই ছিলেন ঐ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। বার্লিনে থাকাকালীন
এঙ্গেলস মার্ক্সের বিষয়ে অনেক কিছু জেনেছিলেন, বিশেষ করে সাধারণ যুব-হেগেলিয়ানদের চেয়ে
ঐ লোকটির প্রখরতর জ্ঞান ও ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্যের কথা যত শুনেছিলেন তা তাঁকে কৌতুহলী
করে তুলেছিল। কিন্তু যখন এঙ্গেলস ‘রাইনিশে জাইটুং’এর দপ্তরে পৌঁছোলেন তখন মার্ক্স সেখানে ছিলেন না। তাই দেখা হল না।
দেখা হওয়ার আগে থেকেই মার্ক্সকে এঙ্গেলস কোন
নজরে দেখতেন সেটা এঙ্গেলসেরই লেখা একটি ব্যঙ্গ-কাব্য পড়ে বোঝা যায়। আগেই বলা হয়েছে
যে প্রুশিয়ার রাজাবদলের পর সেন্সর-ব্যবস্থা কঠোর করে দেওয়া হল এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
বেছে বেছে হেগেলবাদীদের বের করে দেওয়া শুরু হল। সেই ক্রমে ব্রুনো বাউয়ারকেও ১৮৪২এর
মার্চ মাসে বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বার করে দেওয়া হল। সরকারের এই কার্যকলাপের বিরুদ্ধে
এবং তারই সঙ্গে যুব-হেগেলিয়ান বনাম গোঁড়া হেগেল-বিরোধীদের মধ্যেকার লড়াইটা নিয়ে এঙ্গেলস
একটি ব্যঙ্গ-কাব্য লিখলেন। সংক্ষিপ্ত নাম ‘আস্থার জয়’। তাতে এক এক করে বিভিন্ন যুব-হেগেলিয়ানদের বিষয়ে কয়েকটি করে পংক্তি
আছে। মার্ক্সকে নিয়ে লিখলেন –
বারমেনে ফিরে এঙ্গেলস এক মাসও থাকতে পেলেন
না। কয়েকদিনের মধ্যে তাঁকে জার্মানি ছেড়ে ইংল্যান্ডের শিল্পনগরী ম্যাঞ্চেস্টার রওনা
হতে হল। বাইরে বলার জন্য ছিল বাবার ছেলেকে ব্যবসা শেখাবার চেষ্টা। এর্মেন অ্যান্ড এঙ্গেলস
কম্পানির ম্যাঞ্চেস্টারে চলা সুতো-কারখানায় ফ্রেডরিককে বাণিজ্য এবং ব্যবস্থাপনার ব্যবহারিক
জ্ঞান আহরণ করতে পাঠানো হল। কিন্তু বাস্তবটা হল এই যে এঙ্গেলসের বাবা ভীষণভাবে ভয় পেয়েছিলেন।
ছেলের বিপ্লবী চিন্তাধারা এখন আর গোপন ছিল না। তাই তাকে জার্মান আর প্রুশীয় পুলিস থেকে
দূরে রাখা বাবার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।
নভেম্বর ১৮৪২এ ম্যাঞ্চেস্টার পৌঁছোনোর আগে
এঙ্গেলস আবার কোলোন গেলেন। এবার মার্ক্সের সঙ্গে তাঁর দেখা হল। ইতিহাসে নথিভুক্ত এটাই
তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ। কিন্তু এ সাক্ষাতে উষ্ণতা একটু কম ছিল। কথাবার্তায় দুজনেই সাবধানতা
অবলম্বন করছিলেন। কেননা এঙ্গেলস তখনো অব্দি যুব-হেগেলিয়ানদের ‘মুক্ত’ নামে একটি গোষ্ঠির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন আর মার্ক্স কঠোরভাবে সেই
গোষ্ঠি এবং তার নেতাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। যারা এসব ব্যাপারে গুজববাজি করে তারা এটুকুই
ছড়িয়েছিল। বলে নি যে এঙ্গেলস সেই গোষ্ঠিতে থেকেও তার নেতাদের, বিশেষকরে বাউয়ার ভাইদের
বিরুদ্ধে সেই বিষয়গুলোর ওপরই লড়াই চালাচ্ছিলেন যেগুলো মার্ক্স উঠিয়েছিলেন। গুজববাজরা
এঙ্গেলসেরও কান ভরে থাকবে মার্ক্সের বিরুদ্ধে কিছু বলে। কোন কোন বিষয়ে কথা হয়েছিল তা
তো জানা নেই কিন্তু কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে। অক্টোবর ১৮৪২এ মার্ক্স আর্নল্ড রুজকে
চিঠি লিখেছিলেন যাতে তিনটে পক্ষের প্রতি নিজের মনোভাব স্পষ্ট করেছিলেন – (১) খোদ আর্নল্ড রুজ এবং আরেকজন বুদ্ধিজীবীর
প্রতি, (২) ‘মুক্ত’ গোষ্ঠির প্রতি, আর (৩) নতুন সম্পাদকীয় নীতি
এবং সরকারের প্রতি। নিজের বক্তব্য সীমিত রেখেছিলেন চারটে বিষয়ে। প্রথমঃ স্বাধীনতা বা
মুক্তি শব্দটা নিয়ে বুকনিবাজি কম হোক, অশিক্ষিত, অতি-সরলীকৃত ধরণে কথা বলা বন্ধ হোক,
আত্মমুগ্ধতা পরিত্যাগ করে, বিশেষজ্ঞের জ্ঞানে বলীয়ান হয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলা হোক।
দ্বিতীয়ঃ কোনো আলোচনার মাঝে কথায় কথায় নাটকীয় ভাবে সাম্যবাদী, সমাজবাদী বা অন্য কোনো
নতুন বিশ্বদৃষ্টি ঢোকানোর প্রবৃত্তি বন্ধ হোক – এটা অনৈতিক। যদি সাম্যবাদ নিয়ে কথা বলতে হয় তাহলে আলাদাভাবে গুরুত্ব
সহকারে কথা হোক। তৃতীয়ঃ ধর্মের সমালোচনা রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমালোচনার কাঠামোয় হোক,
রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমালোচনা ধর্মের সমালোচনার কাঠামোয় নয়। চতুর্থঃ যে দর্শন নিয়ে
আলোচনা করতে হয় করা হোক, পুরোপুরি করা হোক, নিরীশ্বরবাদের লেবেল সাঁটিয়ে নয়।
স্বাভাবিক মনে হয় যে এঙ্গেলসের সঙ্গে কথাবার্তা
এসব নিয়েই হয়ে থাকবে। খোদ এঙ্গেলস পরে, ১৮৯৫এ স্মরণ করেছেন –
“মার্ক্স ততদিনে বাউয়ার
ভাইদের ভাইদের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন, অর্থাৎ তিনি এই ভাবনার বিরুদ্ধে ছিলেন যে ‘রাইনিশে জাইটুং’এর ব্যবহার রাজনৈতিক আলোচনা এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপে
নয়, বরং প্রধানতঃ ধর্মশাস্ত্রীয় বিষয়, নিরীশ্বরবাদ ইত্যাদির প্রচারের বাহক রূপে করা
হোক। এডগার বাউয়ারের ‘সবচেয়ে দূর অব্দি
যাওয়ার’ ইচ্ছাভিত্তিক বুলি
– কেন্দ্রীয় সাম্যবাদ;
– তারও বিরুদ্ধে ছিলেন
মার্ক্স … আর আমার চিন্তাভাবনাগুলোর
বাউয়ার ভাইদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে যতটা মিলে যাচ্ছিল, ততটা আমায় ওদের বন্ধু মনে করা
হচ্ছিল। উল্টো দিকে ওরা আমাকেও মার্ক্সের প্রতি সন্দেহপ্রবণ করে দিয়েছিল।” [ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, এ বায়োগ্রাফি, প্রগ্রেস
পাব্লিশার্স, মস্কো, ১৯৭৪, পৃষ্ঠা ৩৪এ মার্ক্স-এঙ্গেলস, জার্মান রচনাসমগ্র থেকে উদ্ধৃত]
ম্যাঞ্চেস্টারে দু’বছর
লেনিন লেখেন, “ইংল্যান্ডে আসার পরেই এঙ্গেলস সমাজবাদী হন।”
এঙ্গেলসের জন্ম জার্মানির সেই অঞ্চলে হয়েছিল
যেটি শিল্পের দিক থেকে সর্বাধিক উন্নত ছিল। তিনি নিজেও বড়লোক কারখানামালিকের পরিবারের
ছেলে। পুরো এলাকাটা শ্রমিকে আর শ্রমিক বস্তিতে ভরে থাকত। তাই যখন ইংল্যান্ডে এলেন তখন
জার্মানির শ্রমিকদের জীবন আর পূঁজিপতিদের জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে এলেন। কিন্তু
ইংল্যান্ড, ইংল্যান্ড। পুরো ইয়োরোপ থেকে দেশটার বাণিজ্যিক ভূগোল এবং সমাজ জীবন অনেকভাবে
একেবারে ভিন্ন হয়ে উঠেছিল। শিল্প বিপ্লব চেহারা পাল্টে দিয়েছিল শহরগুলোর। আর ম্যাঞ্চেস্টার
ইংল্যান্ডের সেই শহরগুলোর মধ্যে থেকে একটি ছিল যেখানে পূঁজিবাদী শিল্পায়নের ভিতরকার
নারকীয় বীভৎস চেহারা খুব কাছ থেকে দেখা যেত। অন্য দিকে, চার-পাঁচ বছর ধরে চলতে থাকা
চার্টিস্ট আন্দোলন, যেহেতু শ্রমিক শ্রেণীর স্বতন্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল তাই শ্রমিকদের
শ্রেণীগত ঐক্যের চমকপ্রদ শক্তি, শাসকশ্রেণীগুলোর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এবং রাষ্ট্রশক্তির
বুনটটাও গণজীবনে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। ম্যাঞ্চেস্টারে মাঝে মধ্যেই হতে থাকা জনসভাগুলোয়
তৎকালীন সমাজবাদীদের সঙ্গে এঙ্গেলসের দেখাসাক্ষাৎ হত এবং বন্ধুত্ব গড়ে উঠত। ইংল্যান্ডের
সমাজজীবনটাকে শ্রেণীদ্বন্দ্বের কষ্টিপাথরে বুঝতে তাঁর খুব বেশি সময় লাগল না।
১৮৪২এর নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় পক্ষে এঙ্গেলস
ম্যাঞ্চেস্টারে এলেন। কয়েকদিন আগে কোলোনে মার্ক্সের সঙ্গে সাক্ষাতে উষ্ণতার অভাব ছিল
ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীকালে এঙ্গেলস নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘রাইনিশে জাইটুং’এর সম্পাদকের পূরো ভরসা ছিল যে ইংল্যান্ডগামী
এই জার্মান যুবকই ঐ দেশটার বাস্তবিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জার্মান পাঠককে দিতে
থাকবে। আর সমুদ্র (ইংলিশ চ্যানেল) পেরিয়ে কারখানার কাজ করতে ইংল্যান্ড যেতে থাকা বড়লোক
বাড়ির এই জার্মান যুবকটি জানছিল যে সামাজিক-রাজনৈতিক, দার্শনিক অথবা সাংস্কৃতিক বিষয়ের
ওপর তার বিপ্লবধর্মী রচনাগুলোকে প্রুশীয় সেন্সরের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাপার কাজ,
‘রাইনিশে জাইটুং’এর ঐ নতুন প্রধান সম্পাদকই করবে। তাই ম্যাঞ্চেস্টারে
পৌঁছে মাস শেষ হওয়ার আগেই এঙ্গেলসের প্রথম প্রতিবেদন ‘রাইনিশে জাইটুং’এ পৌঁছে গেল। ৮ই ডিসেম্বরের সংখ্যায় সেটা ছেপে
বেরিয়েও গেল।
ইংল্যান্ডে তাঁর সারা জীবন কাটানোর ছিল। তবে
প্রথম পর্বে তিনি মোটামুটি দু’বছর ছিলেন। চাকরি করতে এসেছিলেন, সারাদিন সে কাজের ব্যস্ততা থাকত।
সকালে, সন্ধ্যায় লেখালিখি করতেন নিয়মিত – ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির ব্যাপারে সাধারণ জার্মান
পাঠককে ওয়াকিবহাল করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না – পূঁজিবাদী শোষণ, সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের কাঠামোয় পূঁজিবাদী শ্রেণীসমূহের
সঙ্গে অভিজাত শ্রেণীর আঁতাত, চার্টিস্ট আন্দোলন দমনে যৌথভাবে প্রচারিত তাদের মিথ্যে
… এসব নিয়ে লেখা প্রতিবেদনগুলো
প্রচ্ছন্নভাবে জার্মান পাঠকদের মধ্যে পরিবর্তনকামী আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলত এবং পথের
ইঙ্গিত দিয়ে রাখত।
‘রাইনিশে জাইটুং’এ ৯ই ডিসেম্বর ১৮৪২এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটাই
ধরা যাক। শুরুই করলেন, “লন্ডন, নভেম্বর ৩০,
ইংল্যান্ডে কি বিপ্লব সম্ভব, বা অন্ততঃ সম্ভবপর? এই প্রশ্নের ওপর ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ
নির্ভর করছে। …”
পূঁজি ও শ্রমের এই সংগ্রামে প্রথম দিকে উদাসীন
থাকা কৃষকদের মধ্যেও যে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক চেতনা বাড়ছে সে ঘটনাটির দিকেও তাঁর চোখ
ছিল। চোখ ছিল ফ্রান্স এবং অন্যান্য দেশের ঘটনাবলি এবং সমাজবাদী আন্দোলনের অগ্রগতির
ওপরও। ইংরেজিটা শেখাই ছিল। একটু মকশো করে চার্টিস্ট মুখপত্র ‘নর্দার্ন স্টার’ এবং ওয়েনপন্থী (আজকের ভাষায়, সুপরিচিত কল্পলৌকিক
সমাজবাদী রবার্ট ওয়েন-এর সমর্থক) সমাজবাদীদের পত্রিকা ‘নিউ মোরাল ওয়র্ল্ড’ এরও নিয়মিত লেখক হয়ে গেলেন তিনি।
সমাজবিপ্লবের যে ধারণা নিয়ে তিনি এসেছিলেন
তার ওপর হেগেলের প্রভাব ছিল, “ … তথাকথিত বস্তুগত
স্বার্থ ইতিহাসে কখনো স্বাধীন, পথপ্রদর্শক লক্ষ্য হতে পারে না, কিন্তু সেগুলো সচেতন
অথবা অচেতনভাবে একটি তত্ত্বের জন্য কাজ করে যেটি ঐতিহাসিক প্রগতিকে নিয়ন্ত্রিত করে।” [… the
so-called material interests can never operate in history as independent,
guiding aims, but always, consciously or unconsciously, serve a principle which
controls the threads of historical progress.]
[আভ্যন্তরীণ সংকট, রাইনিশে জাইটুং, ৯ই ডিসেম্বর
১৮৪২]
এই দু’বছরের কালখণ্ডে এঙ্গেলসের জীবনের দুটো দিক বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এবং
সে দুটোই একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এক, শ্রমিকশ্রেণীর জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখা, যার
অব্যবহিত পরের পদক্ষেপ তাঁর মহান কৃতি ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা’ (কন্ডিশন্স অফ দ্য ওয়র্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড); তারই সঙ্গে
পূঁজিবাদী প্রণালীরও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধ্যয়ন। দুই, মেরি বার্ন্সের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব।
ওপরে বলেছি যে এঙ্গেলস নিয়মিত লিখছিলেন। তবু,
এটা লক্ষ্যণীয় যে ডিসেম্বর ১৮৪২এ ‘রাইনিশে জাইটুং’এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের পর, পরবর্তী প্রতিবেদন মে ১৮৪৩এ, জ্যুরিখ
থেকে প্রকাশিত জার্মান পত্রিকা ‘শ্বেইজরিখের রিপাব্লিকানের’এ বেরুল। অর্থাৎ পাঁচ মাস তাঁর লেখার কাজ স্থগিত ছিল। ‘রাইনিশে জাইটুং’ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, লেখা পাঠাবার মত নতুন একটা
পত্রিকা খোঁজার ব্যাপারটা তো ছিলই, তবে এই পাঁচ মাসে তিনি ম্যাঞ্চেস্টারের শ্রমিক বস্তিতে
নিয়মিত ঘুরে ঘুরে বাস্তবিক অবস্থা দেখা এবং নোট নেওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। শ্রমিকের জীবনকে
কাছ থেকে দেখার এই কাজেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হল এবং তিনি তাঁর
ভালোবাসা খুঁজে পেলেন।
১৮৪৩এর জানুয়ারিতে প্রুশীয় সরকার ‘রাইনিশে জাইটুং’ বন্ধ করানোর সিদ্ধান্ত নিল। সে বছরই এপ্রিলে
পত্রিকার পরিচালক ও অর্থদাতারা প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে মার্ক্সকে সরে যেতে বাধ্য
করল। সরকার মার্ক্সের জীবন দুঃসহ করে তুলল, তিনি কোলন ছেড়ে অন্য শহরে চলে গেলেন। এদিকে
ম্যাঞ্চেস্টারেও এঙ্গেলসের পিছনে প্রুশীয় সরকারের গুপ্তচর লেগে ছিল। প্রতিদিন তিনি
কম্পানির দপ্তরে যেতেন। কম্পানির মালিক দুই পরিবারের একটির সদস্য হওয়ার কারণে সন্ধ্যের
দিকে কয়েকটি পূঁজিবাদী সামাজিকতা পালনেরও দায়িত্ব থাকত। তা সত্ত্বেও, কখনো এমনকি ওই
সামাজিকতা এড়িয়েও তিনি শ্রমিক বস্তিতে ঘোরার, ঘরে ঘরে যাওয়ার, কথা বলার সময় বার করে
নিতেন। আর এ কাজেই তাঁর সহায়ক হলেন আইরিশ শ্রমিক-পরিবারের তরুণী মেরি বার্ন্স।
মেরি বার্ন্স ম্যাঞ্চেস্টারেরই স্যালসফোর্ড
অঞ্চলে নিজের বাবা মাইকেল বার্ন্স, মা মেরি কনরয় এবং ছোট বোন লিডিয়ার সঙ্গে থাকতেন।
পরে গবেষকেরা খোঁজ করেছেন যে মেরির জীবিত মা সৎ-মা ছিলেন (নিজের মা ১৮৩৫ সালেই মারা
গিয়েছিলেন) আর তাই, পরে মেরি আর লিডিয়া আলাদা থাকতে শুরু করেছিলেন। গবেষকেরা এটাও অনুমান
করেছেন যে কারখানায় কাজ করা মেয়ে হলে তিনি এঙ্গেলসের সঙ্গে বস্তিতে ঘোরার সময়ই পেতেন
না। বরং, ম্যাঞ্চেস্টার পৌরসভার নথিপত্র দেখে তাঁরা গৃহভৃত্যের সূচিতে কোনো মেরি বার্ন্সের
নাম পেয়ে আন্দাজ করেছেন যে মেরি আর লিডিয়া গৃহভৃত্যের কাজ করতেন। যাই হোক, মেরি আর
লিডিয়া যে শুধু আইরিশ পরিবারের মেয়ে ছিলেন তা নয়। আইরিশ জাতীয়তা সম্পর্কিত বিষয়গুলো
নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা শ্রমিক তরুণী ছিলেন। ব্যাপারটার গুরুত্ব ছিল। কেননা আইরিশ জাতীয়তার
লড়াইয়ে সে সময় কিছু উগ্রপন্থী সক্রিয়তাও ছিল এবং তারা ইংল্যান্ডের পুলিশের নজরে ছিল।
ম্যাঞ্চেস্টারে সে সময় আইরিশ শ্রমিকের সংখ্যা অনেক – ‘লিটল আয়ারল্যান্ড’ নামে সেই কুখ্যাত অঞ্চল দারিদ্র্য এবং দুস্থতার
চরম সীমায় থাকত।
কারখানায় কর্মী হিসেবে পথেঘাটে হয়ে হোক বা
গৃহভৃত্য খুঁজতে গিয়ে বস্তির কোনো ঘরে, মেরি বার্ন্সের লড়াকু মনোভাবের জন্যই তিনি এঙ্গেলসের
নজরে এসেছিলেন মনে হয়, কেননা পুরো ইয়োরোপের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা
এঙ্গেলসের জন্য আইরিশ জাতীয়তার প্রশ্ন যথেষ্ট গুরুত্ব রাখত। ইংল্যান্ডের শ্রমিকদের
শোষণের ওপর তো তিনি কাজ করছিলেনই।
মেরি বার্ন্সের সঙ্গে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বের ফলে
এঙ্গেলসের, সন্ধ্যাবেলায় বা রাতে শ্রমিক পরিবারে পৌঁছোনো, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে
বাস্তব অবস্থা জানা সহজ হয়ে গেল। নইলে, হত না। মিলমালিকের ছেলেকে সন্দেহের নজরে দেখা
হত, কোনোরকম প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চাইত সবাই আর বেশি চাপ দিলে প্রাণসংশয় হতে পারত – বিশেষ করে ‘লিটল আয়ার্ল্যান্ড’এর মত জায়গাগুলোয়।
শ্রমিক পরিবারের সঙ্গে কথা বলার জন্য একটু
দেরি করে সন্ধ্যায় বা রাতে তাদের সঙ্গে বসা দরকার। একাজে মেরি সাহায্য করলেন। তিনি
জানতেন ফ্রেডরিক তাঁকে শহরের ভাড়াবাড়িটায় রাখতে পারবে না। রাখলে কম্পানির অন্য অংশীদার
এর্মেন চ্যাঁচামেচি করার সুযোগ পেয়ে যাবে, জার্মানিতে খবর চলে যাবে আর ফ্রেডরিককে ম্যাঞ্চেস্টার
ছেড়েই হয়তো চলে যেতে হবে। এর্মেন এমনিতেই কারখানার হিসেব দেখাশোনার কাজে এঙ্গেলস পরিবারের
ছেলের উপস্থিতি পছন্দ করছিল না। অন্যদিকে, ফ্রেডরিকের জন্যও, পূঁজিবাদী সমাজে ঘোরাফেরা
করতে হলে, ‘হল অফ সায়েন্স’এ গিয়ে পূঁজিবাদী বুদ্ধিজীবী এবং সমাজবাদীদের
সঙ্গে সখ্যতা করতে হলে, পূঁজিবাদী সংস্কৃতিসম্মত একটা বাড়ির ঠিকানা রাখা জরুরি ছিল।
তাই বন্ধু ও ভালোবাসার মানুষ ফ্রেডরিকের সুবিধের জন্য মেরি শ্রমিকদের বিভিন্ন পাড়ায়
বদলে বদলে ঘর নিতেন। সেখানে তিনি আর লিডিয়া থাকতেন। যখন তখন ফ্রেডরিক সেখানে থাকার
জন্য চলে আসতেন। ভবিষ্যতে যখন মেরি বার্ন্স জীবনসঙ্গিনী হলেন তখনও এঙ্গেলসের এই ‘দুটো-বাড়ি’তে দিন কাটানো অব্যাহত থাকল। কিন্তু সে গল্প পরে।
বইটার জন্য রসদ সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে এঙ্গেলস
পূঁজিবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতির অধ্যয়ন চালিয়ে যাচ্ছিলেন যার পরিণতি হিসেবে ১৮৪৩ সালের
অক্টোবর-নভেম্বর মাসে তিনি একটা বড় প্রবন্ধ লিখলেন – ‘রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের
সমালোচনার রূপরেখা’; ১৮৪৪এ সেটি ‘ডয়েশ-ফ্রাঞ্জোইশ জাহ্রবুখের’এ প্রকাশিত হল। বস্তুতঃ, এই লেখাটি পড়েই খোদ
মার্ক্স, পূঁজিবাদী রাজনৈতিক-অর্থশাস্ত্রের অধ্যয়নকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করলেন।
ভবিষ্যতে সেকাজে নিজের জীবনের পঁচিশ বছর দিলেন। ফলে পুরো দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণী পেল
জ্ঞানের একটি অস্ত্র – ‘পূঁজি’ – যার বিশ্লেষণের
সত্যতাকে অস্বীকার করার বিফল চেষ্টায় পূঁজিবাদী বুদ্ধিজীবীদের অর্থদাতারা আজও অর্থের
যোগান দিয়ে চলেছে।
পাঠকদেরকে বিস্মিত করার মত অন্তর্দৃষ্টির জন্য এঙ্গেলসের ঐ প্রবন্ধ প্রশংসিত তো হলই, প্রবন্ধটি পড়ে মার্ক্স নিজে একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করলেন। সেই সারসংক্ষেপ তাঁর নোটবুক থেকে রচনাসমগ্রে প্রকাশিত হয়েছে। সেসময় মার্ক্স প্যারিস চলে গিয়েছিলেন। পরে, ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত ‘রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের সমালোচনায় অবদান’র প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধে মার্ক্স, এঙ্গেলসের সেই প্রবন্ধের নামোল্লেখ করে লিখলেন, “পারিভাষিক আর্থিক শব্দাবলীর সমালোচনার ওপর একটি উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ’।
ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের প্রারম্ভ
‘এর্মেন এ্যান্ড এঙ্গেলস’এর সুতো কারখানায় বাণিজ্য ও ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণের
দু’বছর শেষ হয়ে গেল।
এঙ্গেলস জানতেন যে মার্ক্স প্যারিসে আছেন। তাই বাড়ি ফেরার পথে প্যারিসে চলে গেলেন।
গত দুই বছরে প্রকাশিত এঙ্গেলসের সবক’টি প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন মার্ক্স পড়েছিলেন। মার্ক্সেরও সবক’টি প্রবন্ধ ও রচনা এঙ্গেলস পড়েছিলেন। একে অপরকে
নিয়ে ভ্রান্তিগুলো মুছে গিয়েছিল। দুজনেই একে অপরের রাজনৈতিক ও দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টির
প্রশংসক হয়ে উঠেছিলেন। তাই ২৮শে আগস্ট ১৮৪৪এ প্যারিসে দুজনের দেখায় সেই ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের
প্রারম্ভ হল, বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণী আজ যার ঋণী।
লেনিন বলেন –
“প্রাচীন কিম্বদন্তীগুলোয়
বন্ধুত্বের বেশ কয়েকটি মর্মস্পর্শী নিদর্শন পাওয়া যায়। ইয়োরোপীয় সর্বহারা বলতে পারে
যে দুজন এমন বিদ্বান এবং যোদ্ধা তাদের বিজ্ঞানটি সৃজন করেছেন যাদের একে অপরের সঙ্গে
সম্পর্ক, মানব-বন্ধুত্বের বেশির ভাগ প্রাচীন মর্মস্পর্শী কাহিনী ছাপিয়ে যায়।”
১৮৪৩এর গ্রীষ্মে বাগদত্তা জেনি ভন ওয়েস্টফ্যালেনের
সঙ্গে মার্ক্সের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। জেনি নিজেও একজন সচেতন সামাজিক কর্মী এবং শিল্প
সমালোচক ছিলেন। কয়েক মাস আগে তাদের প্রথম সন্তান জন্ম নিয়েছিল। এদিকে এঙ্গেলসও ১৮৪৩এর
প্রথম দিকে স্যালসফোর্ড অঞ্চলের লড়াকু আইরিশ শ্রমিক মেরি বার্ন্সের সঙ্গে ভালোবাসার
সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
দুজনেই নিজেদের চিন্তাভাবনার পুরোনো হেগেলীয়
শিকড় ছিঁড়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। এঙ্গেলসের সঙ্গে ছিল ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা’র খসড়া পাণ্ডুলিপি, যা পড়ে মার্ক্স মন্ত্রমুগ্ধ
হলেন। মার্ক্সের কাছে ছিল ‘হেগেলের বিধি-দর্শনের
সমালোচনায় অবদান’এর পাণ্ডুলিপি। এবং,
সেছাড়া, সদ্যকৃত আর্থিক ও দার্শনিক অধ্যয়নের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাতার একটা পুরো বান্ডিল,
যার খবর দুনিয়া অনেক পরে পেল। নভেম্বর বিপ্লবের পর সোভিয়েত সঙ্ঘ সেই পাতাগুলোকে ‘১৮৪৪এর আর্থিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি’ নামে প্রকাশ করল। ‘হেগেলের বিধি-দর্শনের সমালোচনায় অবদান’ও প্রথমে ‘হেগেলের অধিকার-দর্শনের সমালোচনায় অবদান’ নামে ১৯২৭এ প্রকাশিত হয়েছিল।
এই সমস্ত রচনা এবং তা নিয়ে পারস্পরিক আলোচনায়
দুজনের কাছেই স্পষ্ট হল যে তাদের সমঝদারি অনেক বিষয়েই এক। দুজনেরই তত্ত্বে এবং অভিজ্ঞতায়
প্রত্যয় জন্মেছিল যে সমসাময়িক বর্তমানে শ্রমিক শ্রেণীই সমাজবদলের বৈপ্লবিক শক্তি। সেছাড়া
তাদের সমঝদারিতে মিলের তালিকায় ছিল সামাজিক বিপ্লবের তত্ত্বগুলোর শ্রেণীসমূহের বস্তুগত
স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্ক, সমাজব্যবস্থার সমালোচনার সঙ্গে বাস্তবিক সংগ্রামের সম্পর্ক,
চেতনার সঙ্গে অনুশীলনের সম্পর্ক এবং মানব-পরিচয় ও সম্পর্কগুলোর যাথার্থ্য সেগুলোর ভৌতিকতায়
থাকা ইত্যাদি। মুখ্য প্রশ্ন যে বিশ্বের ব্যাখ্যা নয়, পরিবর্তন, এ সত্যটাও মার্ক্সের
ভাবনায় চলে এসেছিল এবং লেখায় ঈষৎ ভিন্ন রূপে লিপিভুক্ত হয়েছিল। ধর্ম বিষয়ে মার্ক্সের
যে কথাগুলো আমরা বিগত একশো বছর ধরে উদ্ধৃত করে আসছি সেগুলোও মার্ক্সের এসময়কারই লেখার
অংশ।
অপর দিকে, মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রে
ব্যবহৃত পারিভাষিক শব্দগুলোর মধ্যে অনেকগুলো – ব্যবহার মূল্য, বিনিময় মূল্য, মুনাফা, মজুরি, দাম এবং মূল্য, মুদ্রার
পূঁজিরূপে চলন, শিল্পপূঁজি এবং বাণিজ্যপূঁজি ইত্যাদি – প্রাথমিক স্তরে এঙ্গেলস জুটিয়ে এনেছিলেন।
মার্ক্স ঐ শব্দাবলী ব্যবহার করে ওগুলোকে আরো স্পষ্ট করছিলেন উপরোক্ত ‘১৮৪৪এর আর্থিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি’ নামের কাগজের বান্ডিলে।
‘পবিত্র পরিবার’
উদ্দেশ্য দুজনেরই এক ছিল। জার্মানিতে এবং তারই
সঙ্গে পুরো ইয়োরোপে বিপ্লবী শক্তির সন্ধান, তাদের তত্ত্বগত অস্ত্রের যোগান দেওয়া এবং
সংগঠিত করা। কিন্তু তার জন্য তাদেরকে ছেড়ে আসা দেশে আগে থেকে চলতে থাকা তত্ত্বগত সংগ্রামে
একটা নিষ্পত্তিতে পৌঁছোবার ছিল। অর্থাৎ, যুব-হেগেলিয়ানদের চিন্তাভাবনার সর্বাঙ্গীণ
সমালোচনা। যুব-হেগেলিয়ানদের প্রধান নেতা ছিলেন ব্রুনো বাউয়ার। দুজনে স্থির করলেন যে
মার্ক্স-এঙ্গেলস জুটির প্রথম যৌথ রচনা ব্রুনো বাউয়ার এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে হবে।
তাঁরা দেখাবেন যে, “জার্মানিতে বাস্তবিক
মানবতাবাদের সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু ‘আধ্যাত্মিকতাবাদ’ বা ‘চিন্তাশীল ভাববাদ’ যা বাস্তবিক ব্যক্তি মানুষের বদলে ‘আত্মচেতনা’ বা ‘আত্মা’কে দাঁড় করায় …।”
দুই নতুন বন্ধু নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে
নিলেন। বইয়ের মুখবন্ধ বা কথামুখ দুজনে মিলে লিখলেন এবং স্বাক্ষর করলেন। মার্ক্স এঙ্গেলস
রচনাসমগ্র, চতুর্থ খণ্ডের সূচিপত্রে দেখতে পাচ্ছি এঙ্গেলসের ভাগে পড়েছিল প্রথম তিনটে
অধ্যায় এবং পরবর্তী অধ্যায়গুলোর কিছু কিছু অংশ। সেগুলো তিনি প্যারিসে বসে লিখে বারমেন
রওনা হয়ে গেলেন। বাকি বইটা মার্ক্স লিখলেন এঙ্গেলসের চলে যাওয়ার পর। ১৮৪৫ সালে বইটা
প্রকাশিত হল। প্রকাশকের পরামর্শে বইয়ের নাম হল ‘পবিত্র পরিবার, অথবা সমালোচনাত্মক সমালোচনার সমালোচনা’।
এর আগেই মার্ক্স ফায়ারবাখের দর্শনের প্রতি
আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মার্ক্সের কথায় এঙ্গেলসও ফায়ারবাখ পড়েন এবং প্রভাবিত হন।
পরে এ বিষয়ে এঙ্গেলস লিখেছেন, “‘পবিত্র পরিবার’ পড়লে দেখা যায় কত উৎসাহের সঙ্গে মার্ক্স নতুন
ধারণাকে” [ফায়ারবাখের বস্তুবাদ] “স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং – সমালোচনামূলক আপত্তি সত্ত্বেও – কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন।”
সর্বহারাকে বিপ্লবী শক্তি প্রতিপন্ন করার কাজে
‘পবিত্র পরিবার’এর ভূমিকা প্রসঙ্গে লেনিন বলেন, “ এই বাউয়ারভ্রাতৃদ্বয় ও অনুগামী মহাশয়রা সর্বহারাকে
সাদাসিধে জনসমষ্টি হিসেবে দেখতেন। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এই অহেতুক, ক্ষতিকারক প্রবৃত্তির
তীব্র বিরোধ করলেন। শ্রমিক – শাসক শ্রেণী ও রাষ্ট্রশক্তি কর্তৃক নিষ্পেষিত একজন বাস্তবিক ব্যক্তিমানুষ
– এর নামে চিন্তন-মনন
নয়, উন্নততর সমাজব্যবস্থার জন্য সংগ্রামের ডাক দিলেন তাঁরা। তাঁদের সন্দেহাতীত প্রত্যয়
ছিল যে সর্বহারা এই সংগ্রাম চালাতে যেমন সক্ষম তেমনই আগ্রহীও।”
এই বইয়ে দুজনে স্পষ্টভাবে সেই শ্রেণীকে প্রতিষ্ঠিত
করলেন যে উপরোক্ত (মুখবন্ধে উচ্চারিত) ‘যথার্থ মানবতাবাদ’এর বাহক সামাজিক শ্রেণী হবে এবং বিপ্লবের তত্ত্বে বলীয়ান হয়ে বস্তুগত
শক্তিতে পরিণত হবে। কিন্তু এর আগেও দুই বন্ধু ঐ শ্রেণীর কাছে দু’দিক থেকে পৌঁছেছিলেন। মার্ক্স রাষ্ট্রশক্তি,
সমাজ এবং ধর্মের সমালোচনায় ব্যবহৃত দ্বন্দ্বাত্মক বিশ্লেষণের পদ্ধতিতে এবং এঙ্গেলস
সামাজিক শ্রেণীগুলোর জন্ম-ইতিহাসের বস্তুগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে। এই প্রসঙ্গ দুই বন্ধুর
পথের ভিন্নতা এবং পরিপূরকতা দর্শায়।
জানুয়ারি ১৮৪৪এ লিখিত এবং ‘ডয়েশ-ফ্রাঞ্জোইশ জাহ্রবুখের’এ প্রকাশিত ‘হেগেলের বিধি-দর্শনের সমালোচনায় অবদান’এর ভূমিকায় মার্ক্স জার্মান মুক্তির ইতিবাচক
সম্ভাবনার ব্যাখ্যায় বলেন, “ইতিবাচক সম্ভাবনা এমন এক শ্রেণীর গঠনে রয়েছে যার শৃংখল সর্বাত্মক,
নাগরিক সমাজের এমন একটি শ্রেণী যা নাগরিক সমাজের শ্রেণী নয়, … এমন একটি সামাজিক শ্রেণী যার সর্বজনীন কষ্টই
তার সর্বজনীন চরিত্র … সমাজের অন্য সব
শ্রেণী থেকে নিজেকে মুক্ত না করে এবং পরিণামে অন্য সব শ্রেণীকে মুক্ত না করে যে শ্রেণী
নিজের মুক্তি অর্জন করতে পারবে না … একটি বিশেষ সামাজিক অবস্থা রূপে সমাজের সেই বিলয় হল সর্বহারা।”
ওদিকে ফেব্রুয়ারি ১৮৪৪এ লিখিত এবং সে বছরই
আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ‘ভোরওয়ার্টস’এ প্রকাশিত ‘ইংল্যান্ডের পরিস্থিতি – ১’ এ এঙ্গেলস লিখছেন, “ইংল্যান্ডের জন্য ১৮ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল শিল্পবিপ্লব
কর্তৃক সৃজিত সর্বহারা। নতুন শিল্পের দাবি ছিল উৎপাদনের অসংখ্য নতুন শাখার জন্য শ্রমিক
জনতার অবিচ্ছিন্ন লভ্যতা; এমন শ্রমিক যাদের অস্তিত্বই আগে ছিল না! … কারখানা-উৎপাদন এবং কৃষি-উৎপাদনকে একসাথে
যোগ করা অসম্ভব হওয়ায় নতুন শ্রমিক শ্রেণী পুরোপুরি নিজের শ্রমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে
পড়ল। … পুরো এই ক্রমবিকাশের
পরিণামেইংল্যান্ড এখন তিন দলে বিভাজিত – জমিভিত্তিক অভিজাততন্ত্র, ধনভিত্তিক অভিজাততন্ত্র এবং শ্রমিক-শ্রেণীভিত্তিক
গণতন্ত্র।” …
শেষমেশ, দুজনের মিলনের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের
কিছুটা ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত সঙ্ঘ কর্তৃক প্রকাশিত এঙ্গেলসের জীবনী থেকে অনুবাদ করছি –
“১৮৪৪ সালের আগস্ট
মাসের শেষ দিনগুলোয় এঙ্গেলস” [প্যারিসের] “সাঁ জর্মাঁ পাড়ায় ৩৮, রুয়ে ভ্যান্যুতে অবস্থিত মার্ক্সের নিবাসে
এলেন।
“দুজনে দেখতে এর থেকে বেশি আলাদা হওয়া সম্ভব ছিল না। এঙ্গেলসের চুল বাদামি, দীর্ঘ সুগঠিত শরীর, সৈনিক-সুলভ আচরণ, এবং ইংরেজ-সুলভ সংযমী শিষ্ট ব্যবহার। মার্ক্স বেঁটে, কর্মচঞ্চল, দ্রুতগতি, তীক্ষ্ণদৃষ্টি এবং মাথায় সিংহের কেশরের মত ছড়িয়ে থাকা কালো চুল। দুজনের নিজের ধরণ ছিল কাক করার। কিন্তু দুজনের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তির সম্পর্ক ছিল, সমপরিমাণ নিষ্ঠা এবং হৃদয়ের শুদ্ধতা ছিল, সাহস এবং ধৈর্য্যের অন্তরঙ্গতা ছিল। দুজনে এক পথের পথিক হলেন কেননা দুজনেই প্রত্যয়ী কম্যুনিস্ট ছিলেন, তেজোময় এবং দৃঢ়সংকল্প বিপ্লবী ছিলেন।
“প্যারিসে দশ দিন
এঙ্গেলস মার্ক্সের থেকে আলাদা হলেন না, তত্ত্বগত এবং ব্যবহারিক সমস্যাসমূহ নিয়ে আলোচনায়
রত থাকলেন। পরে এঙ্গেলস স্মৃতি থেকে লিখলেন, ‘সবক’টি তত্ত্বগত দিকে
আমাদের সম্পূর্ণ ঐক্য স্পষ্ট হল এবং আমাদের যৌথ কাজকর্ম সেসময় থেকেই শুরু হল।’ মার্ক্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব এঙ্গেলসের প্যারিসে
কাটানো দিনগুলোকে স্মরণীয় করে তুলল। বারমেন ফেরার পর মার্ক্সকে লিখলেন, ‘তোমার সঙ্গে কাটানো দশ দিন আমি এত আনন্দিত
এবং মানুষের মত ছিলাম, তারপর আর তেমনটা হতে পারল না।”
“কয়েক দশক পরে এঙ্গেলস
এই বন্ধুত্বের দিনক’টিকে আবার স্মরণ
করলেন, ‘ম্যাঞ্চেস্টারে থাকতে
থাকতে আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে আর্থিক তথ্য, যার এখন অব্দিকার ইতিহাসলেখনে হয়
কোনো ভূমিকাই ছিল না অথবা নিতান্ত উপেক্ষণীয় ভূমিকা ছিল, আধুনিক দুনিয়ায় অন্ততঃ একটি
চূড়ান্ত ঐতিহাসিক শক্তি। আজকের শ্রেণীগত শত্রুতার জন্মের ভিত্তি ঐ আর্থিক তথ্য। আর
যেসব দেশগুলোয় বড় শিল্পের আবির্ভাবের ফলশ্রুতি হিসেবে – বিশেষ করে ইংল্যান্ডে – এই শ্রেণীগত শত্রুতাগুলো বিকশিত হয়ে উঠেছে,
সে সব দেশে এই শত্রুতাই রাজনৈতিক দলগুলোর, দলগুলোর মধ্যেকার কলহের, এবং সেভাবে পুরো
রাজনৈতিক ইতিহাস গঠনের ভিত্তি হয়।এই একই উপলব্ধিতে মার্ক্সও, শুধু পৌঁছোন নি, ‘ডয়েশ-ফ্রাঞ্জোইশ জাহ্রবুখের’এ (১৮৪৪) এভাবে এর সাধারণীকরণ করেছিলেন যে
রাষ্ট্রশক্তি মোটেই নাগরিক সমাজকে নিয়ন্ত্রিত বা নিজের অনুকূল করে না, নাগরিক সমাজই
রাষ্ট্রশক্তিকে নিয়ন্ত্রিত বা নিজের অনুকূল করে। ফলে, নীতিসমূহ এবং তাদের ইতিহাসের
ব্যাখ্যা, আর্থিক সম্পর্কসমূহ এবং সেগুলোর বিকাশের দিক থেকে করতে হবে, বিপরীত পদ্ধতি
চলবে না। … যখন ১৮৪৫এর বসন্তে
আমরা আবার ব্রাসেলসে দেখা করলাম, উপরে উল্লিখিত বনিয়াদগুলোর ওপর মার্ক্স ইতিহাসের বস্তুবাদী
ধারণা এবং তার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো পুরোপুরি বিকশিত করে তুলেছিলেন। তখন আমরা সেই নতুন
পাওয়া দৃষ্টির বিস্তৃত প্রয়োগ বিভিন্ন দিকে করার কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত করলাম।’” [এঙ্গেলস রচিত ‘কম্যুনিস্ট লীগের ইতিহাস’]
সভায় প্রথম বক্তৃতা
দশ দিন প্যারিসে মার্ক্সের সঙ্গে থেকে ভাবধারাগত
কাজের জগতে আলোকিত হওয়ার পর এঙ্গেলস বারমেনে ফিরে এলেন। তবে সোজাসুজি নয়, রাস্তায় পড়া
ইয়োরোপের দু-চারটে শহরে থেমে, পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে করতে। খুবই উৎসাহিত
হলেন যে দু’বছরে সাম্যবাদী,
সমাজবাদী (সেসময়কার) ভাবাদর্শের পথিকদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে।
বারমেনে তাঁর বাড়ি। সেখানে তিনি এক বড়লোক পূঁজিপতি
পরিবারের সন্তান রূপে পরিচিত ছিলেন। তদনুরূপ মান-সম্মানও ছিল বারমেন-উপার্টালের পূঁজিবাদী
নাগরিক সমাজে। কিন্তু সেখানেও তিনি পরিচিত-অপরিচিত এবং শ্রমজীবী মানুষজনের সঙ্গে নিজের
নবলব্ধ অভিজ্ঞতার আলোয় ইংল্যান্ডের সামাজিক অবস্থা, শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক উত্থান,
আসন্ন বিপ্লবের লক্ষণ এবং সমাজবাদী প্রণালীর শ্রেষ্ঠতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে শুরু
করে দিলেন। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলেন যে ইংল্যান্ডে সচেতন এবং সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর
সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা যত সহজ, পিছিয়ে থাকা জার্মানির শ্রমিকদের কাছে পৌঁছোনো বা তাদের
সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা তত সহজ নয়। এক বন্ধুর সঙ্গে যৌথ প্রয়াসে পত্রিকা প্রকাশ করার
পরিকল্পনা নিলেন। কিন্তু প্রুশীয় সেন্সর বিপদের আভাস পেল। অনুমতি দিল না। বিভিন্ন জায়গায়
স্থানীয় ভাবে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে, প্যারিসে পাওয়া নতুন দৃষ্টি-সমন্বিত বিপ্লবী
চেতনার প্রচার চালিয়ে যেতে থাকলেন, যেন এটা তাঁর কার্যভার। অথচ তখনও তিনি কোনো দলের
সদস্য নন।
সেসময় জার্মান শিল্পপতি এবং পূঁজিবাদীদের এক
অংশে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মত নানা ধরণের কল্পলৌকিক সমাজবাদী ভাবাদর্শ জনপ্রিয় হয়ে
উঠছিল। প্রুশীয় প্রশাসনেরও মনে হল – ঠিক আছে, সরকার ফেলে দেওয়ার কথা তো আর বলবে না, প্রজাতন্ত্র, বিপ্লব,
এসব কথাও বলবে না, পরোপকারের কথা বলবে ক্লাবে বসে! ক্ষতি কী? তাই তারাও চোখ সরিয়ে নিল।
এঙ্গেলস ভাবলেন, এটাই সুযোগ। ক্লাবে আর সভাগৃহে পূঁজিবাদীরা ক্রিশ্চান ধর্মানুসারে
পরোপকারের কথা বলছে। তাদের আলোচনায় অংশ নিয়ে পূঁজিবাদী শোষণের বাস্তবতা শোনাই নাহয়।
সেটা করতে করতে ভাবনা এল, হাওয়া গরম হয়েছে, এবার সভা ডাকা যাক। ১৮৪৫ সালের ফেব্রুয়ারির
৮, ১৫ এবং ২২ তারিখে এলবারফেল্ডে তিনটে সভা হল। এ শহরেই এঙ্গেলসের কৈশোর কেটেছিল জিমনাশিয়ামের
ছাত্রাবাসে। ওপরে উল্লিখিত সোভিয়েত সঙ্ঘ প্রকাশিত জীবনী বলে যে প্রথম সভায় ৪০, দ্বিতীয়তে
১৩০ এবং তৃতীয়তে ২০০ মানুষের উপস্থিতি ছিল। এদের মধ্যে সর্বহারা একজনও ছিল না। নানা
ধরণের পূঁজিবাদী এবং মধ্যশ্রেণীর শ্রোতারা এসেছিল। এঙ্গেলস জীবনে প্রথমবার কোনো সভায়
ভাষণ দিলেন। প্রথমটায় ইংল্যান্ডের পরিস্থিতির বেশি উদাহরণ দেওয়ায় শ্রোতারা পরের দিন
জার্মানির পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে বললেন। তাই তিনি করলেন এবং সাম্যবাদের শ্রেষ্ঠতা
নিয়ে খোলাখুলি কথা বললেন। এটাও বললেন যে যে তত্ত্ব বাস্তবতা সঙ্গ ছাড়ে, তার শিকড় ধরে
কপোল কল্পনা। স্বাভাবিকভাবেই এই ভাষণগুলোর খুব ভালো প্রভাব পড়ল বক্তার নিজেরই মনে।
২২শে ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ ১৮৪৫ অব্দি, একটু একটু করে লেখা চিঠিতে এঙ্গেলস মার্ক্সকে
জানালেন, “অসাধারণ সফলতা পেলাম
… মনশ্চক্ষে বিমূর্ত
জনতাকে দেখে বিমূর্ত লেখালিখি থেকে একেবারেই ভিন্ন কাজ বাস্তবিক, শ্বাস নিতে থাকা মানুষদের
সামনে দাঁড়ানো, ছুঁতে পারার দূরত্বে থেকে সোজাসুজি প্রচার করা …।” প্রুশীয় গুপ্তচর মাধ্যমগুলোতেও খবর পৌঁছে গেল। এঙ্গেলস এবং তাঁর
বন্ধুদের সাবধান করে দেওয়া হল। এর পর সভা হলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরোত। আর সেটাই এঙ্গেলসকে
পরোক্ষে সাহায্য করল।
বারমেনে আসার পর থেকে প্রতিদিন বাবার সঙ্গে
ঝগড়া হত। রোজ ভাবতেন বেরিয়ে চলে যাবেন কিন্তু মায়ের দিকে তাকিয়ে পা আর এগোত না। ১৭ই
মার্চ মার্ক্সকে লিখলেন, “এই সভাগুলোর সঙ্গে
আমার সম্পর্ক আর যে স্থানীয় কম্যুনিস্টদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করি তাদের কয়েকজনের ‘স্বচ্ছন্দ’ আচরণ বাবার ধার্মিক গোঁড়ামি জাগিয়ে তুলেছে। আর আমার কথা যে কিছুতেই
আমি ঐ বাণিজ্যিক কাজকর্মে ফিরব না, আরো তাতিয়ে দিয়েছে তাঁকে।”
নিদ্রায়, জাগরণে সারাক্ষণ বাবা তাঁর ওপর নজর
রাখতেন, তাঁর নামে আসা চিঠিগুলো পড়তেন আর তিরস্কারের দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে থাকতেন।
এতে এঙ্গেলসের মন আরো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠত।
পিতা-পুত্রের ঝগড়া মায়ের বুকে বাজত। শুধু মেয়ের
মন রাখতে এঙ্গেলস পনের দিন বাবার বারমেনে অবস্থিত কারখানাতেও গেলেন। কিন্তু বিচলিত
হয়ে উঠলেন। “… শুধু পূঁজিবাদী
নয় একজন কারখানাদার হওয়া, এক এমন পূঁজিবাদী হওয়া যে নিজে সক্রিয় রূপে সর্বহারার বিরুদ্ধে!
… ভয়ানক!” সহজ সরলভাবে মার্ক্সকে লিখলেন।
যতক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকতেন, নিজের ইচ্ছানুসারে
মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা কথাবার্তা দিব্যি চলত। ঘরে ঢুকতেই শুরু হত বাবার তিরস্কারে
ভরা দৃষ্টির সামনে নিরস জীবন। একটাই কাজ ছিল যাতে শান্তি পেতেন – নিজের ঘরে ঢুকে ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা; বইটার পাণ্ডুলিপি
প্রস্তুত করা। “আমার মনে হয়, প্রতিদিন
যদি নিজের বইয়ে ইংরেজ সমাজকে ভয়-পাওয়ানো গল্পগুলো লেখার কাজ না থাকত, এত দিনে আমি পচে
গিয়ে থাকতাম; একাজটা অন্ততঃ আমার রক্তে ক্রোধের স্ফুটন বাঁচিয়ে রাখে।”
ইতিমধ্যে খবর এল যে রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য
এবং প্রুশীয় সরকারের চাপে ফ্রান্সের সরকার মার্ক্সকে প্যারিস থেকে বার করে দিয়েছে।
মার্ক্স সপরিবারে ব্রাসেলস চলে গেছেন। তক্ষুনি এঙ্গেলস সম্ভাবিত সাহায্যকর্তাদের সূচি
তৈরি করে সবাইকে চিঠি পাঠালেন। স্থানীয় স্তরে সাহায্য সংগ্রহ করলেন এবং নিজের অংশ যোগ
করে মার্ক্সকে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন।
ওদিকে শেষ অব্দি পিতা-পুত্রের লড়াইয়ে পুলিস
এঙ্গেলসকে ‘সাহায্য’ করল। রোজকার কার্যকলাপ, ভাষণ, সরকারের নজরে
বিপজ্জনক লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা ইত্যাদির কারণে এঙ্গেলসের গ্রেপ্তার হওয়া অবশ্যম্ভাবী
হয়ে উঠল। বারমেনে গ্রেপ্তার হলে বাবার এবং পরিবারের সম্মানে আঘাত লাগত। এঙ্গেলসও গ্রেপ্তারি
এড়াতে চাইছিলেন। হাতে অনেক কাজ। তাই যখন বাড়িতে ঘোষণা করলেন যে তিনি ব্রাসেলস (বেলজিয়াম)
যাবেন, বাবা আপত্তি করতে পারলেন না।
‘ইংল্যান্ডে
শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা’
যাহোক, বারমেন ছাড়ার আগে বইটার পাণ্ডুলিপি
তৈরি করে লাইপজিগের এক প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দিতে পেরেছিলেন। ১৮৪৫এর এপ্রিলে বারমেন
ছাড়লেন, আর সেমাসেই বইটা প্রকাশিত হল।
আগেই বলেছি কী অবস্থায় এঙ্গেলস পাণ্ডুলিপি
তৈরি করেছিলেন। সকাল-সন্ধ্যে বাবার তিরস্কারে ভরা মৌন, তাঁর সব চিঠি, সব কাগজের ওপর
সন্দেহপ্রবণ অনুসন্ধিৎসু নজর, মায়ের অসহায় ও কাতর মুখ! তার ওপর বাড়িতে নতুন হাঙ্গামা
শুরু হল যখন জানা গেল, বোন মেরি যে যুবকটির সঙ্গে বিয়ে করবে ঠিক করেছে সেও নাকি সাম্যবাদী!
বাইরে পুরো শহরে এঙ্গেলসের গতিবিধি স্থানীয় সরকারি গুপ্তচরদের নজরে। এসবেরই মধ্যে কয়েক
মাস বসে, “গলা অব্দি বইয়ের
স্তুপে ডুবে” এঙ্গেলস ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা’র পাণ্ডুলিপি তৈরি করলেন। সামনে ছড়ানো থাকত
ম্যাঞ্চেস্টার এবং আশেপাশে, একা কিম্বা মেরির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে অথবা কোনো শ্রমিক পরিবারের
বাড়িতে নেওয়া নোট, অন্যান্য কাগজপত্র।
মূল পাণ্ডুলিপির সঙ্গে তিনি ১৫ই মার্চ ১৮৪৫এ
ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণীর নামে একটি অর্পণ-পত্র লিখলেন, যেটা বইয়ের শুরুতে ছাপা হল।
৩০০র একটু বেশি পৃষ্ঠার এই বইয়ে, পূঁজিবাদী
উৎপাদন প্রণালী কিভাবে শ্রমিকের শোষণ করে তার বুক-কাঁপানো অমানবিক বাস্তবতা ফুটে উঠল।
যে ভাবুক এবং বুদ্ধিজীবীরা সমকালীন অর্থনীতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে চাইত, তাদেরকে
নাড়িয়ে দিল বইটা। যে ভবিষ্যৎবাণীগুলো করা হয়েছিল, সেগুলোকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে উঠে
পড়ে লেগে গেল পূঁজিবাদী বুদ্ধিজীবীদের দল। ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব এবং বিস্ময় জাগানো
আর্থিক উন্নতির বনিয়াদ হয়ে বিদ্যমান একটি নতুন শ্রেণীর অভ্যুদয় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন
এঙ্গেলস। এখন সমাজ-পরিবর্তনের কথা আর বিমূর্ত সদিচ্ছা নয়, নিকট ভবিষ্যতে এক প্রবল শক্তিধর
সামাজিক শ্রেণীর শেকল ভাঙার দিন হয়ে উঠল।
এঙ্গেলস নিজেই বইটার ভূমিকায় বলেন –
“বর্তমান সময়ের সব
সামাজিক আন্দোলনের বাস্তব ভিত্তি ও প্রস্থান-বিন্দু শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা। কেননা এই
অবস্থাই আজ পরিব্যাপ্ত সামাজিক দুর্দশার স্পষ্ট চরমতম সীমা … সমাজবাদী তত্ত্বগুলোকে শক্তপোক্ত জমি দেওয়ার
জন্য যেমন, সে তত্ত্বগুলোর অস্তিত্বে থাকার অধিকার সম্পর্কে রায় দেওয়ার জন্যও তেমন,
সর্বহারাদের অবস্থার জ্ঞান একান্ত প্রয়োজনীয়। সেই জ্ঞানই সব রকমের ভাবপ্রবণ স্বপ্ন
এবং পক্ষে-বিপক্ষে মনে উঠতে থাকা খোশখেয়ালগুলোকে শেষ করবে।”
এরপর এঙ্গেলস বলেন কেন ইংল্যান্ডেই এ অধ্যয়ন।
কেননা ইংল্যান্ডেই শ্রমিক শ্রেণীর প্রকৃত অবস্থা তার সর্বোত্তম রূপে বিদ্যমান। এবং
ইংল্যান্ডেই এ অবস্থাগুলোর আধিকারিক তদন্ত হয়েছে তথা আবশ্যক তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে
যা এধরণের অধ্যয়নের জন্য একান্ত জরুরি।
বাস্তব অবস্থার গভীর অধ্যয়ন তো ছিলই, তারই
সঙ্গে পূঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালীর কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রথমবার চিহ্নিত করা হল।
আর্থিক সঙ্কটের নিয়মিত চক্র, বেকারদের ফৌজের অব্যাহত উপস্থিতি, উৎপাদনের প্রসারের সঙ্গে
শোষণের ক্রমবর্দ্ধমানতা ইত্যাদি।
মার্ক্স তো নোটগুলো প্যারিসেই পড়েছিলেন। প্রকাশিত
হওয়ার পর যখন বইটা স্বীকৃতি ও সমাদর পেল তিনি খুব খুশি হলেন। এই বইয়ে উদ্ধৃত ইংরেজ
সরকারের আধিকারিক তদন্ত প্রতিবেদন এবং অন্যান্য সামগ্রীগুলো পরে মার্ক্সকে পথ দেখালো
যখন তাঁর মহাগ্রন্থ ‘পূঁজি’ রচনাকালে তিনি প্রতি দিন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে
যাওয়া শুরু করলেন। ‘পূঁজি’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পরেও মার্ক্স
আরেকবার বন্ধু-রচিত বইটা পড়লেন। ১৮৬৩র ৯ই এপ্রিলে লেখা মার্ক্সের একটি চিঠি পাওয়া যায়
যাতে তিনি এঙ্গেলসকে বলছেন, “আজও দেখা যায় কত সতেজতা এবং আবেগের সাথে, দৃষ্টির কতটা সাহসিকতায়,
পাণ্ডিত্য এবং বৈজ্ঞানিক অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে, এই পৃষ্ঠাগুলোয় বিষয়টাকে আয়ত্ত
করা হয়েছে।”
এমন কিছু আশার কথা অবশ্যই উৎসাহের সঙ্গে এ
বইয়ে লেখা হয়েছিল যা পুরো হল না। উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব তখনো আবিষ্কৃত হয় নি। তাই
পূঁজিবাদী শোষণের পুরো সত্যটা অনাবৃত হয় নি। কিন্তু দূরদৃষ্টির নিদর্শন লেখকের এই ভবিষ্যৎবাণী
যে পূঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালীতে হওয়া উৎপাদক শক্তির দ্রুত বিকাশ একদিন নিজেই পূঁজিবাদী
উৎপাদন প্রণালীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। বিপ্লব সর্বহারাই আনবে এবং সে বিপ্লব হবে সমাজবাদী।
সোভিয়েত সঙ্ঘ প্রকাশিত এঙ্গেলসের উপরোক্ত জীবনীতে
জার্মান শ্রমিক শ্রেণীর তৎকালীন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কবি জর্জ উইর্থের উল্লেখ আছে।
এঙ্গেলস যখন বার্মেন ছেড়ে ব্রাসেলস চলে গেলেন তখন জর্জ উইর্থ জুলাই মাসে (১৮৪৫) তাঁর
সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এঙ্গেলসের লেখা এবং ব্যক্তিত্বে এত প্রভাবিত হলেন যে উৎসাহের
সঙ্গে নিজের মাকে লিখলেন, “সম্পত্তিওয়ালা ভদ্রমহাশয়রা
সাবধান হয়ে যাও। জনগণের শক্তিশালী হাত আমাদের সঙ্গে আছে এবং সব জাতির সবচেয়ে ভালো মাথাগুলো
আমাদের সঙ্গে আসছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমার খুব প্রিয় বন্ধু, বারমেনের ফ্রেডরিক এঙ্গেলস
ইংরেজ শ্রমিকদের নিয়ে একটি বই লিখেছে যাতে কারখানাদারদের ওপর একদম সঠিক কিন্তু ভয়ানকভাবে
চাবুক চালিয়েছে। তার নিজের বাবার কারখানা আছে ইংল্যান্ডে এবং জার্মানিতে। এখন নিজের
পরিবারের সঙ্গে তার তীব্র মনোমালিন্য। তাকে ঈশ্বরহীন এবং শয়তান মনে করা হয় … কিন্তু আমি সেই ছেলেকে জানি। দেবতার মত দয়ালু।
অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। দিন রাত সর্বশক্তি দিয়ে সে শ্রমিক শ্রেণীর
ভালোর জন্য লড়াই করে।”
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল উপাদানগুলোর জন্ম
থিসিস অন ফায়ারবাখ
ব্রাসেলসে সেসময় নির্বাসিত জার্মান বিপ্লবীদের
সংখ্যা অনেক। এপ্রিল ১৮৪৫এ এঙ্গেলস ব্রাসেলস পৌঁছোলেন। কয়েক দিনেই, মার্ক্স সেসময় যেখানে
থাকছিলেন তার একেবারে কাছে একটা ঘর পেয়ে গেলেন ভাড়ায়। এই দিনগুলোতেই তিনি মার্ক্সের
পরিবারেরও ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হয়ে উঠলেন। এক সঙ্গে সারা দিন থেকে কাজ করার এমন সুযোগ আবার
তিন বছর পরে প্যারিসে, ১৮৪৮এর ইয়োরোপীয় বিপ্লবের আগে পেয়েছিলেন।
যত দিন ব্রেমেনে ছিলেন, মায়ের কষ্ট, পৈত্রিক
ব্যবসা, বাবার তিরস্কারভরা চোখ, সব মিলিয়ে পারিবারিক মনোমালিন্যের একটা ভার মাথায় চেপে
থাকত। ব্রেমেন থেকে বেরোতেই সেটা নেমে গিয়েছিল।
ব্রাসেলসে আসার একমাস আগে বন আর কোলোন ঘুরে বিপ্লবী বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎও করে
এসেছিলেন। হাল্কা মনে অনেক সম্ভাব্য কাজের উত্তেজনা ছিল।
মার্ক্সের সঙ্গে দেখা হতেই মার্ক্স তাঁর সদ্যকৃত
দার্শনিক অনুসন্ধানে আবিষ্কৃত ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার কথা বললেন। ‘থিসিস অন ফায়ারবাখ’এর পাণ্ডুলিপি বলে যে সেটি ঐ সময়েই, অর্থাৎ
এপ্রিল ১৮৪৫এ লেখা। লিখিত রূপে ঐ থিসিস সামনে থাকুক অথবা পরে লেখা হয়ে থাকুক, দুজনের
মধ্যেকার কথাবার্তা যে ঐ বিষয়েই হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
‘সংবেদনগত মানবিক
ক্রিয়া’ বা ‘ব্যবহারিক কর্ম’কে বাস্তবতা বা সংবেদ্যতার জগতের অন্তর্ভুক্ত
করা দর্শনের ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদের প্রথম বিপ্লব। ‘থিসিস অন ফায়ারবাখ’এর এই প্রথম থিসিস থেকেই শেষ থিসিসে পৌঁছোনো সম্ভবপর হয়ে ওঠে যে
‘বিষয়টা যদিচ, পরিবর্তন’। দুনিয়ার নানারকম দার্শনিক ব্যাখ্যার মধ্যে
কোন ব্যাখ্যাটি সঠিক তার নিরিখও পরিবর্তন ও সেই ব্যাখ্যার বিকাশও যুগপৎ, পরিবর্তনের
পথে।
বস্তুগত শক্তিই ইতিহাস তৈরি করে, তত্ত্ব নয়,
এই কথাটা অব্দি পৌঁছোনোর জন্য ইতিহাস যারা তৈরি করে, মানুষ, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সংঘটিত
হয়ে চলা তাদের দৈনন্দিন শ্রমকে, উৎপাদক ক্রিয়াকে বস্তু-তা, বস্তুগত ক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত
করার প্রয়োজন ছিল।
আর মানুষের দৈনন্দিন উৎপাদক ক্রিয়া যদি বস্তুগত
ক্রিয়া হয়, বস্তু ও বাস্তব ঘটনাজগতের অংশ হয় তাহলে তার মগজটাকে অনুসরণ করা যাক! ছুতোরের
মাথায় যে চেয়ারটা আছে, সেটা সত্যিই চেয়ার কিনা, চার-পায়া জিনিষটায় সত্যিই মানুষ বসবে
কিনা, তার সমাধান তো তর্কে হবে না, কাঠের তক্তা এমনকি প্রয়োজনে কুঁদো চেয়ারটা তৈরি
করতে হবে। তাই দ্বিতীয় থিসিস, – মানুষের চিন্তাভাবনাকে বিষয়গত সত্যের মর্যাদা দেওয়া যাবে কিনা সেটা
তাত্ত্বিক নয় ব্যবহারিক প্রশ্ন; মানুষকে তার চিন্তার সত্যতা, অর্থাৎ বাস্তবিকতা এবং
শক্তি, তার ইহজাগতিকতা ব্যবহারে, অনুশীলনে প্রমাণ করতে হবে।
এবং যেহেতু ছুতোর চেয়ারটা তৈরি করে বেঢপ কুঁদো
বা ভাঙা তক্তাটাকে মানুষের আরামে পরিবর্তিত করতে সফল হয়েছে তাই তৃতীয় থিসিস, – পরিস্থিতি ও সেই অনুসারে [মানুষের] পালনপোষণের
কথা বলা বস্তুবাদী মতবাদ ভুলে যায় যে মানুষ পরিস্থিতি বদলায় এবং শিক্ষাবিদকেই শিক্ষিত
হতে হবে। এই মতবাদকে তাই অবশ্যই সমাজকে দুভাগে ভাগ করতে হবে, যার একটি ভাগ সমাজের থেকে
শ্রেয়তর। সঙ্গে এটাও মনে রাখার যে পরিস্থিতি ও মানুষের গতিবিধি বদলের অথবা ‘আত্ম-পরিবর্তন’এর এই যে সমাপতন, এটাকে একমাত্র ‘বৈপ্লবিক অনুশীলন’ হিসেবেই যুক্তিপূর্ণ ভাবে বোঝা যেতে পারে।
সমাজকে দুভাগে ভাগ করলেই বোঝা যাবে যে সেই
“সমাজের আভ্যন্তরীণ
কলহ এবং অন্তর্নিহিত দ্বান্দ্বিকতা”র ফলশ্রুতি হিসেবেই লোকায়ত [বা ইহলৌকিক] জগত নিজের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন
করে স্বাধীন জগত হিসেবে মেঘে [স্বর্গে] প্রতিষ্ঠিত করে। ফায়ারবাখের কাজের গুরুত্ব এখানে
যে তিনি [ঐ স্বর্গে প্রতিষ্ঠিত] ধার্মিক জগতকে তার লোকায়ত আধারে জাত নিষ্পন্ন করেন।
কিন্তু এটুকু বললেই তো সেই স্বর্গকে মর্ত্যে নামানো যাবে না। স্বর্গকে মর্ত্যে নামাতে
হলে স্বর্গের লোকায়ত আধারটার দ্বান্দিক চরিত্র বুঝে বৈপ্লবিক বদল ঘটাতে হবে – পবিত্র পরিবারের শাসন শেষ করতে গেলে মর্ত্যের
পরিবারের শাসনটাকে যেমন তত্ত্বে তেমন ব্যবহারে ধ্বংস করতে হবে।
পঞ্চম থিসিসে মার্ক্স বলেন যে ফায়ারবাখ বিমূর্ত
চিন্তনে সন্তুষ্ট হন না, সংবেদ্য মনন চান, অথচ তিনি সংবেদ্যতাকে ব্যবহারিক, মানবিক-ইন্দ্রিয়গত
কার্যকলাপ হিসেবে ধরেন না।
আর তাই, আগে যে ‘লোকায়ত জগত’ অর্থাৎ মানব-সমাজের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি হিসেবে ধর্মের
জন্ম দেখানো হল, ফায়ারবাখ সেভাবে দেখেন না বলে ‘ধর্মের সার’ মানুষের সার’এ নিষ্পন্ন করলেও, সে সারকে “সামাজিক সম্পর্কের মোট-ফল” রূপে না দেখে একক ব্যক্তিতে নিহিত বিমূর্ত রূপে দেখেন। (এর ফলে
ফায়ারবাখকৃত দুটো ভুলের কথাও বলা আছে এই থিসিসে)।
ফায়ারবাখ, ফলে দেখেন না যে ‘ধার্মিক অনুভূতি’ নিজেই একটি ‘সামাজিক উৎপন্ন’; তাঁর দ্বারা বিশ্লেষিত বিমূর্ত ব্যক্তি বস্তুতঃ
একটি বিশেষ প্রকারের সমাজে লভ্য।
তাহলে মোদ্দা কথা এটাও হল যে সমাজ-জীবন মূলতঃ
ব্যবহারিক। সব রহস্য যা তত্ত্বকে রহস্যবাদের বা চিন্তার অস্পষ্টতায় ভুলপথে চালিত করে,
সেগুলোর যুক্তিযুক্ত সমাধান হয় মানুষের অনুশীলনে, ব্যবহারে এবং সেই ব্যবহারের অনুধাবনে।
নবম থিসিসে সাধারণভাবে চিন্তাপরায়ণ বস্তুবাদের
চরম সীমার কথা বলেন মার্ক্স। সংবেদ্যতাকে ব্যবহারিক কার্যকলাপ হিসেবে গ্রহণ না করা
সেই বস্তুবাদ শুধু ‘নাগরিক সমাজ’এ একক ব্যক্তিদের মনন।
দশমে তা থেকে নিজেদেরকে আলাদা করেন মার্ক্স।
বলেন, “পুরোনো বস্তুবাদের
দৃষ্টিকোণ ‘নাগরিক’ সমাজ, নতুন বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ মানব-সমাজ,
অথবা সম্মিলিত মানবতা।
এবং শেষে, একাদশতম থিসিসে এল সেই দুনিয়া-কাঁপানো
দার্শনিক নিষ্পত্তি, দার্শনিকেরা নানাভাবে দুনিয়াটার নিছক ‘ব্যাখ্যা’ করেছে; বিষয় বা প্রশ্ন বা সমস্যা যদিচ, বদল, পরিবর্তন। এই দুনিয়াটার,
এই মানবসমাজটার পরিবর্তন।
সেটা কি ব্যাখা না করেই হবে? না, ষষ্ঠ থিসিসেই
বাক্যাংশটা আছে – ‘ব্যবহারে এবং সেই ব্যবহারের অনুধাবনে’। পরিবর্তনের লড়াইয়ে শামিল হতে হবে এবং সে
পথেই সত্যতা প্রমাণিত হতে থাকবে ব্যাখ্যার।
দু’পাতায় জ্বলজ্বল করতে থাকা এগারটি আলোকবিন্দু-সমন্বিত এই নক্ষত্রপুঞ্জ
হাতে পেয়ে বা রচয়িতার মুখে শুনে স্থির থাকতে পারে কেউ? এঙ্গেলসও নিশ্চয়ই পারেন নি।
কিভাবে উদযাপন করেছিলেন সেই আনন্দময় অস্থিরতা তা অনুমান করতে পারি।
জার্মান আইডিওলজি
এটা উল্লেখযোগ্য যে মানুষের ঐতিহাসিক বিবর্তনের
অবলম্বনবিন্দু হিসেবে তার শ্রমকে মার্ক্স যে সময় রাখছেন তার অনেক পরে, জীবের বিবর্তনের
তত্ত্ব নিয়ে ডারউইন এসেছেন, মানুষের যৌন-ব্যবহার ও পরিবার নিয়ে ক্ষেত্র-সমীক্ষার তথ্য
ও নিষ্কর্ষ নিয়ে মর্গান এসেছেন।
যাহোক, শুধু এই থিসিসটুকু দিয়ে তো চলবে না।
কাজের পথে বেরিয়ে পড়ার আগে ফায়ারবাখ ও অন্যান্য জার্মান বস্তুবাদী ও সমাজবাদী দার্শনিকদের
সমালোচনাক্রমে নিজেদের নতুন দার্শনিক বিশ্বদৃষ্টিটাকে ভালো করে গুছিয়ে পেশ করতে হবে।
সে কাজটাই দুজনে মিলে করবেন ভাবলেন, কিন্তু
তার আগে অন্য কিছু কাজ করণীয় ছিল। ১৮৪৩ থেকেই মার্ক্স রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের অধ্যয়ন
চালিয়ে যাচ্ছিলেন। জার্মানির এক প্রকাশকের সঙ্গে ১৮৪৫এর ফেব্রুয়ারির শুরুতে চুক্তিও
হয়েছিল। বইটার নাম হওয়ার ছিল ‘ক্রিটিক ডের পলিটিক উন্ড ন্যাশনালোকোনমি’। সে কাজটা পুরো করতে একবার ইংল্যান্ডে যাওয়ার
ছিল। যদিও প্রুশীয় সেন্সরশিপের ভয়ে প্রকাশক শেষ পর্য্যন্ত বইটা প্রকাশিত করেন নি। সে
বইয়েরই সামগ্রী রুশবিপ্লব-পরবর্তী প্রজন্ম ‘১৮৪৪এর আর্থিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি’ নামের কাগজের বান্ডিল
হিসেবে পেল।
ইংরেজি ভালো জানতেন না বলে মার্ক্স এঙ্গেলসকে
সঙ্গে নিয়ে ইংল্যান্ডে গেলেন। এঙ্গেলসও সানন্দে সঙ্গ দিলেন। মার্ক্সের সঙ্গে দিন কাটবে!
আর সেখানে গিয়ে দুটো লেখা তাঁরও পুরো করার ছিল – একটা ইংল্যান্ডের সামাজিক ইতিহাসের ওপর আর আরেকটা বাণিজ্যে সংরক্ষণনীতির
ওপর।
জীবনীলেখকেরা আন্দাজ করেন যে ১৮৪৫এর ১২ জুলাই
থেকে ২১শে আগস্ট অব্দি দুই বন্ধু, এঙ্গেলসের পরিচিত শহর ম্যাঞ্চেস্টারে ছিলেন। তাঁদের
অধিকাংশ সময়, পুরো ইয়োরোপের প্রাচীনতম গ্রন্থালয়গুলোর অন্যতম, চ্যাটহ্যাম গ্রন্থালয়ে
কাটত। দুজনে নিজের নিজের কাজ অনুসারে নোট নিতে নিতে সেগুলো অদলবদল করতেন এবং একে অপরের
নোট পড়ে পাশে মন্তব্যে নিজের মতামত জানাতেন। মাঝে একদিন এঙ্গেলস মেরি বার্ন্সের সঙ্গে
দেখা করে মার্ক্সের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন। দুজনের ব্রাসেলস ফেরার সময় সঙ্গে
মেরিও কিছুদিনের জন্য বেড়াতে ব্রাসেলস গেলেন।
ব্রাসেলস ফেরার পর দুজনে আগে থেকে ভেবে রাখা
কাজে হাত দিলেন। সে কাজটিকে আমরা ‘জার্মান আইডিওলজি’ নামে জানি। এটা তাঁদের প্রথম পুরোপুরি যৌথ রচনা ছিল। রচনাসমগ্রে
দেওয়া বিবরণ অনুসারে নভেম্বর ১৮৪৫ থেকে আগস্ট ১৮৪৬ অব্দি দশ মাস সময়ে দুজনে গ্রন্থটি
পুরো করলেন। বইটার শিরোনামের পর লেখা ছিল “সেই আধুনিক জার্মান দর্শনের সমালোচনা”, “ফায়ারবাখ, ব্রুনো বাউয়ার এবং স্টার্নার” যার প্রতিনিধিত্ব করেন করেন এবং সেই “জার্মান সমাজবাদ”এরও সমালোচনা “বিভিন্ন ত্রাণকর্তা”র মাধ্যমে যা অভিব্যক্ত হয়। কিন্তু বইটা ঐতিহাসিক
বস্তুবাদেরও প্রথম পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা ছিল। দুঃখের কথা, বইটা পাণ্ডুলিপি রূপে পড়ে রইল
দশকের পর দশক। কোনো প্রকাশক ছাপতে তৈরি হল না কেননা যাদের সমালোচনা করা হয়েছিল তারা
সে সময় জার্মানির মেধাজগতে বিরাট নাম। ছিয়াশি বছর পর, ১৯৩২ সালে বইটা প্রথম প্রকাশ
করল সোভিয়েত সঙ্ঘ।
যদিও বইটা প্রকাশিত না হওয়া নিয়ে মার্ক্স কখনো
চিন্তিত হন নি, ১৮৫৯ সালে বলছেন যে “প্রধান উদ্দেশ্য, আত্ম-স্পষ্টীকরণ” তো হয়েই গিয়েছিল তাই আমরা পাণ্ডুলিপিগুলোকে
সানন্দে “ইঁদুরদের চর্বণমূলক
সমালোচনার জন্য রেখে দিয়েছিলাম”, আজও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বোঝার জন্য সবাইকে এই বইটা পড়ার পরামর্শ
দেওয়া হয়।
প্রায় চল্লিশ বছর পর এঙ্গেলস সময়টার কথা বলতে
গিয়ে বলেন, “এই বইটা লেখার পর
আমরা একেবারেই আর নতুন বৈজ্ঞানিক পরিণামগুলো বিশেষকরে বিদ্বানজগতের জন্য পাণ্ডিত্যপূর্ণ
ঢঙে লিখতে চাইছিলাম না। আমরা দুজনে আগে থেকেই গভীরভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনে লিপ্ত ছিলাম।
শিক্ষিত জগতে, বিশেষ করে পশ্চিম জার্মানিতে, আমাদের কয়েকজন অনুগামীও ছিলেন। সংগঠিত
সর্বহারাদের সঙ্গে আমাদের ভালোরকম সম্পর্ক ছিল। আমাদের দৃষ্টিকোণকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি
দেওয়া আমাদের কর্তব্য ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রথমে জার্মান এবং পরে ইয়োরোপীয় সর্বহারাদেরকে
আমাদের প্রত্যয়ের পক্ষে আনা ততটাই জরুরি ছিল। যেই এ ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টি স্পষ্ট
হল, আমরা নিজেদের কার্যভার পুরো করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।” [কম্যুনিস্ট লীগের ইতিহাস, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস,
১৮৮৫]
বিপ্লবী সর্বহারা সংগঠন নির্মাণের সংগ্রাম
কম্যুনিস্ট করেসপন্ডেন্স কমিটি
বা ‘পত্রবিনিময় সমিতি’। ‘জার্মান ভাবাদর্শ’ লেখার মধ্যে দিয়ে নিজেদের নতুন চিন্তাভাবনার
মূল উপাদানগুলো স্পষ্ট করার পর আর বড় তাত্ত্বিক কাজ নিয়ে বসার ইচ্ছে ছিল না। হাওয়া
পাল্টাচ্ছিল। আজকের অন্তর্জালে খুঁজলেও জানা যায়, পুরো ইয়োরোপে খাদ্য সংকটে জনরোষ ঘনিয়ে
উঠছিল। খোদ জার্মানিতে সংবিধান, মুক্ত নির্বাচন এবং প্রচ্ছন্নভাবে জার্মান ঐক্যের আন্দোলন
নতুন মোড় নিল যখন প্রুশিয়ার রাজা প্রুশিয়ার সবকটি রাজ্যের একীকৃত সংসদের (ডায়েট) সভা
আহ্বান করল ১১ই এপ্রিল ১৮৪৭এ। সভা আহ্বান করা হয়েছিল আরো কয়েকটি বিষয়ের সঙ্গে নতুন
রেলপথের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু সংসদ নিজেদের দাবি রাখল। প্রধান ছিল, আগে
সংবিধান তৈরি হোক এবং মুক্ত নির্বাচন হোক। ভয়ে, রাজা ২৬শে জুন সংসদই ভঙ্গ করে দিল।
কিন্তু সমস্যা ছিল মার্ক্স-এঙ্গেলসের যে একদিকে
শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনে সমাজবাদী ভাবধারার প্রভাব ছিল প্রায় শূন্য আর অন্য দিকে বুদ্ধিজীবীকেন্দ্রিক
সমাজবাদীদের যে দুটো ধারা ছিল, শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ সেদুটোর ধারণাতেই ছিল না।
এক ধারায় ছিল নানা ধরণের সংস্কারপন্থী কাজকর্মের কথা, অন্য ধারায় ছিল গোপন চক্রান্তমূলক
সংগঠনের মাধ্যমে বিপ্লব ঘটানোর কথা। দু’ধারার বিরুদ্ধেই মার্ক্স-এঙ্গেলসকে লড়াই করতে হয়েছিল। প্রথম ধারার,
বিশেষকরে প্রুধোঁপন্থীদের বিরুদ্ধে মার্ক্সের ‘দর্শনের দারিদ্র্য’ ১৮৪৭এই প্রকাশিত হয়েছিল। এঙ্গেলসের ‘আবাসন প্রশ্ন’ অবশ্য অনেক পরে, ১৮৭২এ লেখা। অর্থাৎ সংস্কারপন্থীদের
বিরুদ্ধে সংগ্রাম দুজনকে সারা জীবন চালিয়ে যেতে হয়েছিল।
চক্রান্তমূলক বিপ্লবের কথা বলা সংগঠনগুলোর
মধ্যে একটি ছিল উইলহেল্ম ওয়েটলিংএর নেতৃত্বে। খ্রিশ্চান-সাম্যবাদী এই ধারাটির সঙ্গে
এঙ্গেলসকে বেশ কয়েকবার মুখোমুখি তর্কে বসতে হয়েছিল।
বিভিন্ন দেশের সমাজবাদী, সাম্যবাদী নেতাদের
সঙ্গে এঙ্গেলসের ভালোরকম চেনাশুনো ছিল। তা সে ইংল্যান্ডের চার্টিস্টরা হোক বা এলবারফেল্ডের
কল্পলৌকিক সাম্যবাদী, ব্রাসেলস, বন, কোলোন, বার্লিনের লোক বা প্যারিসের সমাজবাদী সবার
সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক রাখতেন এঙ্গেলস। জার্মান ভাবাদর্শ রচনার প্রক্রিয়ায় লেখকদ্বয়
যে স্বপ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন, সে ধরণের সংগঠন গড়ে তোলা সে মুহূর্তে কঠিন ছিল। কেননা
যেমন আগেই বলা হল, প্রচুর সংখ্যক সমাজবাদী/সাম্যবাদী থাকলেও শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে তাদের
বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। পুরো ইয়োরোপে পূঁজিবাদী-প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের অঙ্কুর দেখা
যেতে শুরু করেছিল কিন্তু শ্রমিকশ্রেণীরও সমাজবাদী ভাবধারার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক ছিল
না।
১৮৭১ সালে এঙ্গেলস, ইতালির সমাজবাদী কার্লো
কাফিয়েরোকে চিঠি লিখতে গিয়ে স্মরণ করেন, “সে সময় সমাজবাদী এবং সাম্যবাদী ভাবধারায় প্রভাবিত সর্বহারা ছিলেন
গোনাগুনতি – সুইটজারল্যান্ডে,
ফ্রান্সে আর ইংল্যান্ডে যারা আবার আমাদেরই অনুগামী ছিলেন। জনগণের সঙ্গে কাজ করার উপায়
বিশেষ ছিল না আর আপনাদেরই মত আমরা বিদ্যালয়-শিক্ষক, সাংবাদিক এবং ছাত্রদের মধ্যে থেকে
আমাদের অনুগামীদের কাজে লাগাতে বাধ্য হতাম।”
তাদের সাথেই পরামর্শ করে মার্ক্স-এঙ্গেলস প্রতিষ্ঠা
করলেন ‘কম্যুনিস্ট করেসপন্ডেন্স
কমিটি’ – মনে করা হল এতে সম্পর্কগুলো ছড়াবে আর চিন্তাভাবনাগুলোর
আদান-প্রদান সুগম হবে। আর সত্যিই তাই হল। লোকে ব্রাসেলস কমিটি এবং মার্ক্স-এঙ্গেলসের
কাজের বিষয়ে জানতে শুরু করলেন।
প্রায় তিন বছর মার্ক্স ব্রাসেলসে ছিলেন। যেহেতু
ঘোষিত রাজনৈতিক কারণে তিনি প্যারিস থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন, এবং জার্মানির গুপ্তচরেরও
নজর ছিল, তাই বেলজিয়াম সরকারেরও হুঁশিয়ারি ছিল যে রাজনৈতিক কাজকর্ম বা প্রকাশনা করতে
যেন না দেখা যায়। তাই পাড়া বদলে বদলে ভাড়া নেওয়া মার্ক্সের বাড়িগুলোয় বিভিন্ন কারণে
পার্টি হত, নতুন বছরের পার্টি, দ্বিতীয় মেয়ে লরা আর ছেলে এডগারের জন্ম ব্রাসেলসেই হয়েছিল
তাই তাদের বার্থডে পার্টি (স্ত্রী জেনিও সহযোগী পেয়ে গিয়েছিলেন; জার্মানি্তে বাড়ির
কাছে থাকা এক মহিলা হেলেন ডেমুথকে পরিচারিকা করে জেনির মা ব্রাসেলসে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন)
… আর তারই আড়ালে কম্যুনিস্ট করেসপন্ডেন্স কমিটির ব্রাসেলসে লভ্য সদস্যদের
বৈঠকও হত মাঝে মধ্যে।
তেমন এক বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হল যে এঙ্গেলসকে
প্যারিস যেতে হবে অবিলম্বে। সেখানে এখনো করেসপন্ডেন্স কমিটি গঠিত হয় নি। এঙ্গেলসেরও
ইচ্ছে ছিল তা-ই। ১৮৪৬ সালের ১৫ই আগস্ট এঙ্গেলস প্যারিস চলে গেলেন। জানুয়ারি ১৮৪৮এ বিপজ্জনক
বিপ্লবী ঘোষিত করে ফ্রান্সের সরকার তাঁকে প্যারিস থেকে বিতাড়িত করল। দেড় বছর সময় পেয়েছিলেন।
সেই দেড় বছরে এঙ্গেলস ঘুরে ঘুরে ‘ট্রু সোশ্যালিস্ট’, ‘প্রুধোঁবাদী, ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’ (গোপন, চক্রান্তমূলক বিপ্লবের পথিক), ইত্যাদি
বিভিন্ন দলের অনুগামীদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন, চুটিয়ে তর্কবিতর্ক করলেন এবং সর্বহারা
বিপ্লবের নতুন পথের গুরুত্ব তাদেরকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের
হলেও তারা বেশির ভাগ রাজনৈতিক কারণে নির্বাসিত অথবা স্বেচ্ছানির্বাসিত, বিভিন্ন পেশায়
নিয়োজিত জার্মানই হত।
খুব কঠিন হত বোঝানো কেননা এঙ্গেলস অধিকাংশ
উদাহরণ ইংল্যান্ডের শ্রমিক-জীবন থেকে দিতেন। শিল্পোন্নয়নের সেই বিপুল কর্মকান্ড, সর্বহারা
শ্রেণী বলতে বিশাল একটি সামাজিক শ্রেণীর আবির্ভাব, সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন এসব তখনো
জার্মানি আর বেলজিয়াম তো দূরের কথা, ফ্রান্সেও অকল্পনীয় মনে হত। তাই এঙ্গেলসের কথাগুলো
বিশ্বাসযোগ্য মনে হত না আর তুমুল ঝগড়া হত।
ব্রাসেলসের ‘পত্রবিনিময় সমিতি’কে তিনি ১৮৪৬এর ২৩শে অক্টোবর চিঠি লিখলেন।
তাতে সেসব ঝগড়াগুলোর কথা জানিয়ে বললেন যে কিভাবে তিনি নিজের কথাগুলো শেষমেশ তিনটে উদ্দেশ্যে
সীমিত করতেন –
“(১) পূঁজিবাদীদের
বিরুদ্ধে সর্বহারাদের স্বার্থ সাধন করা; (২) এই কাজটা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ ও
তার স্থানে সামাজিক সম্পত্তি এবং সামাজিক অংশীদারির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে করা; (৩) এসব
উদ্দেশ্যের প্রাপ্তির জন্য বলসাধ্য গণতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যতীত অন্য কোনো উপায় গ্রহণ
না করা।”
সংগঠন নির্মাণের কাজে এই দেড় বছর এঙ্গেলসের
জন্য অনেকভাবে শিক্ষাপ্রদ হয়ে উঠল। প্যারিসে তাঁর পরিশ্রমে এবং ব্রাসেলস থেকে মার্ক্সকৃত
সাহায্যে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করল। প্যারিসে আগে থেকে চলতে থাকা সংগঠন ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’এর অধিকাংশ সদস্য মার্ক্স-এঙ্গেলসের নতুন মতাদর্শের
অনুগামী হয়ে উঠলেন এবং গোপন, চক্রান্তমূলক, অন্ধ গোঁড়ামির পথ ছাড়তে রাজি হলেন। কিছু
সূত্র বলে যে ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’এর পক্ষ থেকে তার প্রধান, কার্ল শ্যাপার চিঠি
দিলেন মার্ক্স-এঙ্গেলসকে যে তাঁদের পরামর্শমত নিয়মাবলী ও কর্মসূচিতে বদল ঘটাবার কাজে
সাহায্য করতে তাঁরা যেন সংগঠনের সদস্যতা গ্রহণ করেন। তখন মার্ক্স এবং এঙ্গেলস দুজনে
এবং তারপর ‘কম্যুনিস্ট করেসপন্ডেন্স
কমিটি’র সমুদয় সদস্য ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’এর সদস্যতা গ্রহণ করে নিলেন – ফলে সংগঠনে নিয়মাবলীতে সংশোধনের জন্য লড়াই
শুরু হল। এর ফলে, ইংল্যান্ড এবং অন্যান্য জায়গায় অনেকে যে ‘লীগ অফ জাস্ট’ বানানোর প্রস্তাব ঐ সমস্ত পন্থাগত কারণে এড়িয়ে
চলছিল তারা সংগঠনে আসতে শুরু করল।
সিদ্ধান্ত হল যে ‘লীগ অফ জাস্ট’এর প্রথম উদ্বোধনী সম্মেলন লন্ডনে হবে। সংগঠনের
নতুন নাম, চরিত্র, কর্মসূচি, গঠনতন্ত্রে ইত্যাদির জন্য মার্ক্স, এঙ্গেলস এবং তাঁদের
সহযোগীরা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
২রা জুন (উইকিপিডিয়া বলছে ১লা জুন) ১৮৪৭এ ‘লীগ অফ জাস্ট’এর প্রথম সম্মেলন লন্ডনে শুরু হল। পকেটে পয়সা
ছিল না বলে মার্ক্স এই সম্মেলনে শামিল হতে পারলেন না। ব্রাসেলস এবং পুরো বেলজিয়ামের
কম্যুনিস্টদের প্রতিনিধিত্ব করলেন মার্ক্স-এঙ্গেলসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আজীবন সহযোগী উইলহেল্ম
উলফ। এঙ্গেলস অনেক ঝগড়া, ঝঞ্ঝাট সহ্য করে, বিরুদ্ধ-শক্তিদেরকে পরাস্ত করে শেষে প্যারিসের
গোষ্ঠিগুলোর প্রতিনিধি হয়ে এলেন। কিন্তু প্রভাবিত করলেন পুরো সম্মেলনের কার্যকলাপ।
অন্যান্য প্রতিনিধি যারা তাঁদের অনুগামী ছিলেন তাদের সহযোগিতা পাওয়া গেল। সংগঠনের কর্মসূচি
ও গঠনতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন করা হল। সংগঠনের নাম বদলে রাখা হল ‘কম্যুনিস্ট লীগ’। প্রধান স্লোগান, ‘সব মানুষ ভাই ভাই’ পাল্টে করা হল, ‘সব দেশের শ্রমজীবী, এক হও’। [এই সম্মেলনের বিস্তারিত ঘটনাবলীর জানতে
ইচ্ছুক পাঠকেরা এঙ্গেলস রচিত ‘অন দ্য হিস্ট্রি অফ কম্যুনিস্ট লীগ’ পড়তে পারেন]
ওদিকে ১৮৪৬এর শেষে মাসগুলো থেকেই ফরাসি পুলিশের
খাতায় এঙ্গেলসের নাম লেখা হয়ে গিয়েছিল। এঙ্গেলস সাবধান থাকছিলেন আর লেখালিখির কাজ বাড়িয়ে
দিয়েছিলেন। ফরাসি রাজনীতির সংকট, প্রুশিয়া ও জার্মানিতে প্রজাতান্ত্রিক পরিবর্তনের
জন্য সংগ্রাম, ইংল্যান্ডে পূঁজিবাদী এবং চার্টিস্টদের মধ্যে লড়াই ইত্যাদি বিষয়ে তো
লিখছিলেনই, এবার ইয়োরোপের পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, সুইটজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ইত্যাদি
দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়েও লিখতে শুরু করলেন। তারই সঙ্গে সাহিত্যধর্মী বিষয়ের ওপরও
কয়েকটি প্রবন্ধ তৈরি করলেন। ওদিকে দিগন্তে আমেরিকাও উঠে এসেছিল। মার্ক্সের সঙ্গে একসাথে,
আমেরিকা-নিবাসী এক ভাববাদী-সাম্যপন্থী ক্রীজের বিরুদ্ধে একটি রচনায় তার বিভ্রান্তিকর
প্রচারগুলোর যাথার্থ্য সামনে এনে আমেরিকার সমাজবাদী বন্ধুদের সাবধান করলেন। মার্ক্স
সেসময় ‘দর্শনের দারিদ্র্য’ লিখছিলেন। হঠাৎ কাজ পড়ে যাওয়ায় তিনি সপরিবার
হল্যান্ড চলে যাওয়ায় এঙ্গেলসকে প্যারিসে বসেই ‘পত্রবিনিময় সমিতি’র যাবতীয় কাজ হাতে নিতে হল।
১৮৪৭এর ১৬-১৮ সেপ্টেম্বর, ব্রাসেলসে আন্তর্জাতিক
মুক্ত বাণিজ্য কংগ্রেস হওয়ার ছিল। মার্ক্স-এঙ্গেলস চিন্তা করলেন যে এই কংগ্রেসে বক্তা
হিসেবে নাম লেখাতে হবে। শেষে মার্ক্স এবং জর্জ উইর্থকে (পূর্বোল্লিখিত) বক্তা হিসেবে
স্বীকার করা হল। উইর্থের তেজোদ্দীপ্ত বক্তব্যে আয়োজকেরা এমন ঘাবড়ে গেল যে মার্ক্সকে
আর বলতেই দেওয়া হল না। দুজনে স্থির করলেন যে লিখেই এদের ভান্ডাফোড় করতে হবে।
মুক্ত ব্যাপারপন্থীদের সব বক্তব্য সংরক্ষণবাদের
বিরুদ্ধে। ফলে জনমত দুই শিবিরে বিভাজিত হয়। মার্ক্স-এঙ্গেলস মঞ্চটি ব্যবহার করে জনগণকে
বলতে চাইছিলেন যে দুটোই পূঁজিবাদীদেরই দুটো শিবির। দুটোর মধ্যে থেকে একটা বাছার ধাঁধায়
মাতলে সর্বহারার মুক্তি জুটবে না। তাকে তো পূঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালীটারই বিলোপসাধন
করতে হবে। এই আশয়েই দুজনে দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখলেন।
দ্বিতীয় কাজটা ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’এর নিয়মাবলি বা গঠনতন্ত্রে পরিবর্তনের কাজ
দিয়ে শুরু হয়েছিল। আগে, গোপন সংগঠনের মত একটা শপথ-পত্র ছিল। দুজনেই এমন কোনো শপথ-টপথের
ব্যাপার সরিয়ে দিতে চাইছিলেন। কিন্তু বেশ কয়েকজন প্রতিনিধির ইচ্ছে ছিল যে না, কিছু
একটা সেরকম থাকুক। তখন এঙ্গেলস নতুনভাবে সেটা লিখতে শুরু করলেন। নাম হল, ‘কম্যুনিস্ট আস্থার স্বীকারোক্তি’। খসড়াটা সবক’টি শাখায় আলোচনার জন্য পাঠানো হল। কিন্তু এঙ্গেলসের
নিজেরই সেটা পছন্দ হচ্ছিল না। না নাম, না কথ্য। তাই আবার লেখা শুরু করলেন। এবার নাম
দিলেন ‘সাম্যবাদের তত্ত্ব’ (প্রিন্সিপ্লস অফ কমিউনিজম)। লিখতে লিখতেই
ভাবতে শুরু করলেন যে তত্ত্ব নয়, ঘোষণাপত্র হিসেবে রূপ দেওয়া যাক লেখাটাকে।
১৮৪৭এর ২৩-২৪ নভেম্বর এঙ্গেলস একটা চিঠির ‘পুনশ্চ’এ মার্ক্সকে লিখলেন, “ঐ আস্থার স্বীকারোক্তিটা নিয়ে একটু ভাব। আমি ভাবছি প্রশ্নোত্তরী
রূপটা বাতিল করে লেখাটাকে কম্যুনিস্ট ‘ঘোষণাপত্র’ বলা উচিৎ।” [সে ক্ষেত্রে] “যেহেতু কিছুটা ইতিহাস বলতে হবে, বর্তমান রূপটা একেবারেই অনুপযুক্ত।
আমি যেটা লিখেছি সেটা আমি নিজের সঙ্গে নিয়ে যাব। সাদাসিধে আখ্যানের ধরণে লেখা। কিন্তু
প্রচন্ড ব্যস্ততা ছিল বলে শব্দব্যবহার জঘন্য। সাম্যবাদ কী – জিজ্ঞেস করে শুরু করেছি। তারপর সোজা চলে গেছি
সর্বহারায় – তার উৎপত্তির কথায়।
কিভাবে সর্বহারা আগের শ্রমিকদের থেকে ভিন্ন, সর্বহারা ও পূঁজিবাদীদের মধ্যে বৈপরীত্যের
বিকাশ, সংকট, নিষ্পত্তিসমূহ। এসবেরই মাঝে সব রকমের আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো এবং সবশেষে কম্যুনিস্টদের
পার্টিনীতি। যদ্দূর সর্বসাধারণে প্রকাশ করা যায়। এখানে যেটা আছে সেটা পুরোটা এখনও অনুমোদনের
জন্য পাঠানো হয় নি, কিন্তু কয়েকটি সামান্য বিষয়বিন্দু ছাড়া, আমার মনে হয় পুরোটাই এমন
রূপে অনুমোদন করিয়ে নিতে পারব যে অন্ততঃ তাতে আমাদের দৃষ্টিকোণের বিরুদ্ধে কিছু থাকবে
না।”
‘ঘোষণাপত্র’ কথাটা দুজনের চর্চায় নিয়ে এলেন এঙ্গেলস।
‘কম্যুনিস্ট
পার্টির ঘোষণাপত্র’
১৮৩০ সালের সতের বছর পর ইয়োরোপে আবার রাজনৈতিক
অশান্তি ঘনিয়ে আসছিল। ১৮৪৭এর জুনের পর ছয় মাসের মধ্যেই ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর দ্বিতীয় সম্মেলন (২৯শে নভেম্বর থেকে ৮ই
ডিসেম্বর) হল যাতে নিয়মাবলিতে আরো কিছু বদল ঘটল। কার্ল শ্যাপার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন
এবং এঙ্গেলস সচিব। নিজের ভাষণে এঙ্গেলস ‘সব দেশের শ্রমজীবীরা, এক হও’ স্লোগানটার পটভূমির ব্যাখ্যা করলেন। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি,
আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের অবস্থা যে ভিন্ন নয় তা বুঝিয়ে বললেন, “যেহেতু সব দেশের শ্রমিকদের অবস্থা এক, তাদের
স্বার্থ এক, তাদের শত্রু এক, তাই অবশ্যই তাদেরকে এক সঙ্গে লড়াই করতে হবে। সব জাতির
পূঁজিপতিদের সৌভ্রাতৃত্বের বিরুদ্ধে সব জাতির শ্রমিকদের সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।”
কর্মসূচিকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া সম্মেলনের একটি
প্রধান এজেন্ডা ছিল। সম্মেলন সে কাজের দায়িত্ব মার্ক্সকেই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। মার্ক্স
এই সম্মেলনে ছিলেনও এবং দীর্ঘ বাদানুবাদে তিনি এবং এঙ্গেলস তাঁদের নতুন তত্ত্বগুলো
সর্বসমক্ষে পেশ করার সুযোগও পেয়েছিলেন। সম্মেলন এ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিল যে কর্মসূচির
এই দলিলটাকে ঘোষণাপত্র নাম দেওয়া হবে। পূর্বোক্ত ‘কম্যুনিস্ট লীগের ইতিহাস’এর ওপর প্রবন্ধতে এঙ্গেলস স্মরণ করেছেন, “সব দ্বন্দ্ব এবং সংশয় শেষ হল। প্রাথমিক নতুন
নীতিগুলো সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হল। মার্ক্সকে এবং আমাকে ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করার
দায়িত্ব দেওয়া হল। সম্মেলনের পর অবিলম্বে করা হল সে কাজ। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কয়েক
সপ্তাহ আগে স্বীকৃত পাণ্ডুলিপি মুদ্রণের জন্য লন্ডনে পাঠানো হল। তারপর সে ঘোষণাপত্র
পুরো বিশ্ব ভ্রমণ করেছে। প্রায় সব ভাষায় অনুবাদ হয়ে গেছে। আজও অসংখ্য দেশে এই ঘোষণাপত্র
সর্বহারা আন্দোলনের পথপ্রদর্শকের কাজ করে।”
মার্ক্স-এঙ্গেলস রচিত ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’ বা ‘ইস্তাহার’এর একটি টীকাসম্বলিত সংস্করণ আছে। টীকাকার ডি রায়াজানফ। তিনি ১৯২২এ
মস্কোয় অবস্থিত মার্ক্স এঙ্গেলস ইন্সটিট্যুটএর নির্দেশক ছিলেন। তিনি বলেন – যেমন অভ্যাস ছিল মার্ক্সের, কোনো বিষয়ে লিখতে
হলে তিনি সতর্ক থাকতেন যে বিষয়টির প্রতি সুবিচার করতে পারছেন কিনা। তাই অনেক সময় নিচ্ছিলেন
ঘোষণাপত্র লিখতে। প্রকাশনে দেরি হয়ে যাচ্ছিল …। ওদিকে “বিপ্লবী ঝড়ের সুদূর গর্জন শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। জানুয়ারির শুরুতে
তাড়াতাড়ি একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছিল ইটালিতে। ১২ই জানুয়ারিতে সিসিলি আর তারপর পালের্মোয়
খোলাখুলি বিদ্রোহ শুরু হয়ে গিয়েছিল, অস্থায়ী সরকার বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে কোনো দিন
ফ্রান্সে বিপ্লব শুরু হতে পারত।” এই পরিস্থিতিতে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর কেন্দ্রীয় কমিটি প্রস্তাব নিয়ে ব্রাসেলসের আঞ্চলিক কমিটিকে ১৮৪৮
সালের ২৬শে জানুয়ারি চিঠি পাঠালো, “কেন্দ্রীয় কমিটি ব্রাসেলসের আঞ্চলিক কমিটিকে এই কাজের ভার দিচ্ছে
যে নাগরিক মার্ক্সের সঙ্গে তারা সম্পর্ক স্থাপন করুক। তাঁকে বলুক যে সদ্য সম্পন্ন কংগ্রেসে
তাঁকে কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র লেখার যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা যদি এবছর ১লা
ফেব্রুয়ারির মধ্যে লন্ডন না পৌঁছোয়, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।” … কেন্দ্রীয় কমিটির আদেশপ্রাপ্ত এবং কমিটির তরফ থেকে শ্যাপার, বাউয়ার
এবং মল (স্বাক্ষরকারী)। রায়াজানফ এটাও জানান যে ঘোষণাপত্র প্রকাশ পাওয়ার কয়েকদিন আগেই
প্যারিসে ফেব্রুয়ারির বিদ্রোহ হয়ে গেল। জার্মানিতে মার্চ বিপ্লবের কয়েক সপ্তাহ পর ঘোষণাপত্রের
কপি সেখানে পৌঁছোতে পারল! …”
এঙ্গেলস কোথায় ছিলেন সেসময়?
বা বলা যায়, কোথায়ই বা ছিলেন না?
একজন দক্ষ সংগঠনকর্তা হিসেবে এঙ্গেলস ইয়োরোপের
বিভিন্ন দেশে এবং সমাজের বিভিন্ন অংশে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। অনেকগুলো ভাষাও জানতেন।
লন্ডনে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর কংগ্রেস শুরু হওয়ার দিনেই তাঁকে পোল্যান্ডেরও
১৮৩০এর বিদ্রোহের বার্ষিকীতে ভাষণ দিতে যেতে হল। সেটা গণতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক বৈঠক
ছিল। পোল্যান্ডের জনগণের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সমর্থনে তিনি যে কথাগুলো বললেন সেটা
অদেখা ভবিষ্যতে অনেক দূর অব্দি প্রতিধ্বনিত হল, “এমনটা হতে পারে না যে একটি জাতি স্বাধীনও হয়ে যাবে আবার অন্য
জাতির ওপর নিপীড়নও চালিয়ে যাবে।”
৮ই ডিসেম্বর, লীগের কংগ্রেস শেষ হওয়ার পর মার্ক্স
ব্রাসেলস চলে গিয়েছিলেন। এঙ্গেলস কয়েকদিন পর, ১৭ই ডিসেম্বর ব্রাসেলস পৌঁছে ঘোষণাপত্র
তৈরি করার কাজে সাহায্য করতে লাগলেন। কিন্তু মাসের শেষে তাঁকে আবার প্যারিসে ফিরে যেতে
হল। ব্রাসেলসের গণতান্ত্রিক সঙ্ঘ তাঁকে ফরাসী গণতন্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্কে থাকার জন্য
নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল। কিছুদিন আগে তিনি এভাবে, গণতন্ত্রী ভ্রাতৃসঙ্ঘে
লন্ডন কমিটিরও প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন। (এই গণতন্ত্রী সঙ্ঘগুলোর নিজের ইতিহাস
আছে; মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এই সঙ্ঘগুলোর সমর্থক ছিলেন এবং জার্মানিতে আগের অনেক সংগঠনকে
যোগ করে জার্মান গণতন্ত্রী সঙ্ঘ তৈরি হওয়ার পিছনে তাঁদের প্রধান ভূমিকা ছিল)।
প্যারিসে গিয়ে এঙ্গেলস দেখলেন যে ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’এর ‘কম্যুনিস্ট লীগ’ হয়ে যাওয়ায় এবং মার্ক্স-এঙ্গেলসের মতাদর্শের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায়
যারা মনঃক্ষুন্ন হয়েছিল, তারা আবার ফিরে যেতে চাইছে ওয়েটলিংপন্থী চক্রান্তমূলক গোপন
সাংগঠনিক কাজকর্মের দিকে অথবা প্রুধোঁপন্থী সংস্কারের দিকে। এবং নানা রকম বিভ্রান্তিমূলক
প্রচার করে তারা বাকি সবাইয়ের ওপরও নিজেদের প্রভাব ছড়িয়েছে। এঙ্গেলস সাংগঠনিক সংগ্রামে
নেমে পড়লেন। ততদিনে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর দ্বিতীয় কংগ্রেসের দলিলও সব চলে এসেছিল।
এঙ্গেলসের কাজ একটু সহজ হয়ে গেল।
কিন্তু বেশি দিন তিনি প্যারিসে থাকতে পারলেন
না। জানুয়ারির শেষে ফরাসি সরকার তাঁকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্যারিস এবং তিন দিনের মধ্যে
ফ্রান্স ছাড়ার আদেশ দিল। অজুহাত দেওয়া হল যে তিনি জার্মান উদ্বাস্তুদের বৈঠকে বিপ্লবী
শুভকামনা জানিয়েছেন।
৩১শে জানুয়ারি ১৮৪৮এ এঙ্গেলস ব্রাসেলস চলে
এলেন। তত দিনে মার্ক্স ‘ঘোষণাপত্র’ লিখে লন্ডনে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
বিশ্বের সব ভাষায় সর্বাধিক বিক্রি হওয়া জনপ্রিয়
বইয়ের অন্যতম, যুগান্তকারী সৃষ্টি ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’এর ভাষা, বিন্যাস এবং অসাধারণ দ্বন্দ্বাত্মক ব্যঞ্জনাগুলো নিঃসন্দেহে
মার্ক্সের। কিন্তু আগের অধ্যায়েই দেখেছি, ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর দ্বিতীয় কংগ্রেস যে এই দলিলটি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিল, তার পিছনে
প্রধান শক্তি ছিলেন এঙ্গেলস, এবং দলিলটির কথ্যের একটা বড় অংশ এঙ্গেলস ‘প্রিন্সিপলস অফ কমিউনিজম’এ একত্র করেছিলেন।
১৮৪৮-৪৯এর বিপ্লবগুলো – ১
স্বর্ণাভ দিনগুলো এসে পড়েছিল। বিপ্লবে সক্রিয়
অংশগ্রহণ, তা-ও সমঝদারি স্পষ্ট করে। ইয়োরোপের বিপ্লবী সর্বহারার দিকনির্দেশকারী একটি
ঘোষণাপত্র হাতে নিয়ে!
লেনিন বলেন, “মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু
হয়ে উঠে আসে ১৮৪৮-৪৯এর গণবিপ্লবী সংগ্রামে তাঁদের অংশীদারির সময়কাল।”
১৮৪৮এর ২২-২৪ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে বিদ্রোহী
শ্রমিক এবং মধ্যবিত্ত সামাজিক গোষ্ঠিগুলো একজোট হয়ে রাজা লুই ফিলিপের রাজত্ব শেষ করে
প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করল। তার আগে জানুয়ারি মাসে সিসিলি দ্বীপ সুদ্ধু দক্ষিণ
ইতালির প্রদেশগুলোয় (ইতালি সে সময় অব্দি এক রাষ্ট্রে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে নি) বিদ্রোহ
সম্পন্ন হয়েছিল। বিপ্লবী আন্দোলনের জোয়ার জার্মান প্রদেশগুলোতেও পৌঁছোতে শুরু করল।
১৩ মার্চ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় এবং ১৮ই মার্চ প্রুশিয়ার রাজধানী বার্লিনে বিদ্রোহ
হল। সেই একই সময় অস্ট্রিয়া-সাম্রাজ্যের অধীন উত্তর-ইতালির শহর মিলানে অস্ট্রিয়ার সৈন্যবাহিনীকে
তাড়িয়ে দিল জনগণ। ফ্রান্সের ঘটনাবলীর প্রভাবে বেলজিয়ামেও প্রজাতান্ত্রিক সরকারের দাবিতে
আন্দোলনে গতি এল।
এঙ্গেলস সেসময় ব্রাসেলসেই ছিলেন। ২৫শে ফেব্রুয়ারি
(১৮৪৮) তিনি চার্টিস্টদের পত্রিকা ‘দ্য নর্দার্ন স্টার’এ লিখলেন, “সেদিন সন্ধ্যায় এ শহরে উত্তেজনা এবং অশান্তির পরিবেশ ছড়িয়ে ছিল।
নানান ধরণের গুজব ছড়াচ্ছিল কিন্তু বাস্তবে সেগুলো মানছিল না কেউ। রেলস্টেশনে ভরে ছিল
সব শ্রেণীর মানুষ। সবাই চিন্তায় ছিল, কোনো খবর আসছে কিনা। ফরাসি রাজদূত, রুমিনির প্রাক্তন
মার্কুইসও সেখানেই ছিলেন। রাত সাড়ে বারোটায়, বৃহস্পতিবারে সম্পন্ন বিপ্লবের জবর খবর
নিয়ে এল ট্রেন! স্টেশনের সমস্ত মানুষ উৎসাহের আকস্মিক বিস্ফোরণে ফেটে পড়ল, প্রজাতন্ত্র
জিন্দাবাদ! দ্রুত পুরো শহরে ছড়িয়ে গেল সে খবর।”
২৭শে ফেব্রুয়ারি ‘ড্যয়েশ-ব্রাসেলার-জাইটুং’এ ফ্রান্সের ঘটনা নিয়ে এঙ্গেলস লিখলেন, “পূঁজিবাদী শ্রেণীরা নিজেদের বিপ্লব সম্পন্ন
করল। গুইজোকে সিংহাসন থেকে ফেলে দিল, গুইজোর সঙ্গে বড়, পাইকারি ফাটকাবাজ ব্যাপারিদের
একচ্ছত্র রাজত্বও শেষ হয়ে গেল। কিন্তু এবার, যুদ্ধের দ্বিতীয় অঙ্কে, পূঁজিবাদীদের এক
পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে যাবে না। এবার সর্বহারা দাঁড়াবে পূঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে … এই চমকপ্রদ বিপ্লবের মাধ্যমে ফরাসী সর্বহারা
আবার থেকে ইয়োরোপীয় আন্দোলনের শীর্ষে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। প্যারিসের শ্রমিকদের
জয় হোক! পুরো দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছে তারা। একের পর এক সবকয়টি দেশে এর চাপ টের পাওয়া
যাবে, কেননা ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্রের জয় পুরো ইয়োরোপে গণতন্ত্রের জয়।”
বেলজিয়ামের বিপ্লবী কার্যকলাপে মার্ক্স এবং
এঙ্গেলস পুরোপুরি থাকতেন। সেখান থেকেই তাঁরা জার্মানির বিপ্লবী কার্যকলাপে নিজেদের
প্রভাব বিস্তার করছিলেন। ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এও তাঁদের প্রভাব বাড়ছিল। লন্ডনের কেন্দ্রীয়
কমিটি ব্রাসেলসের আঞ্চলিক কমিটিকে নিজেদের ক্ষমতা হস্তান্তর করল যাতে বিপ্লবী কার্যকলাপের
কেন্দ্রে থাকা সাথীরা সারা ইয়োরোপের কার্যকলাপকে সঞ্চালিত করতে পারে। ব্রাসেলসের এই
নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান হলেন মার্ক্স, এঙ্গেলস সে কমিটির সদস্যদের একজন ছিলেন।
১৮৪৮এর ইয়োরোপীয় বিপ্লবে এগিয়ে থেকে অংশগ্রহণ
করা পূঁজিবাদীদের দুর্বলতা ধরা পড়তে শুরু করল। এই বিপ্লবের অসফলতা, প্রতিবিপ্লবী শক্তিসমূহের
জয় ইত্যাদি ইতিহাসের বহুপঠিত অধ্যায়। কিন্তু বিপ্লবের দিনগুলোয়, অংশগ্রহণকারী অগ্রবর্তী
মানুষদের কার্যকলাপ খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় অসফল বিপ্লবের নামে ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত
এই কালখণ্ড কত সাফল্যের বীজ বপন করেছিল।
বেলজিয়ামে বেলজীয় রাজঘরাণার সরকার অবিলম্বে
জবাবী পদক্ষেপ নিল। পূঁজিবাদী গণতন্ত্রীদের দ্বিধা দেখে সেনাবাহিনীকে সতর্ক করে, খবর
ছড়িয়ে দিল যে প্রজাতন্ত্রের দাবি আসলে বিদেশী, প্রধানতঃ জার্মান শ্রমিক এবং গণতন্ত্রীরা
করছে। এই খবরের মাধ্যমে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর অধিকাংশ সদস্য চিহ্নিত হয়ে আক্রমণের লক্ষ্যে
এসে গেলেন। অনেকে গ্রেপ্তার হলেন, অনেকজনকে নিষ্কাশিত করা হল। ৩রা মার্চ মার্ক্সকে
চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বেলজিয়াম ছাড়ার আদেশ দেওয়া হল। এঙ্গেলস বেঁচে গেলেন কেননা, কয়েকদিন
আগেই পুলিস তাঁর পাসপোর্ট জারি করেছিল।
সেদিনই মার্ক্সের ঘরে বৈঠক হল আর মার্ক্সকে,
প্যারিসে গিয়ে নতুন কমিটি তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হল। বৈঠক শেষ হওয়ার পর যে মুহূর্তে
সবাই বেরিয়ে গেল পুলিস এসে মার্ক্স এবং তাঁর স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করল। ১৮ ঘন্টা নজরবন্দী
রাখার পর তাঁদের অবিলম্বে বেলজিয়াম ছেড়ে যেতে বলা হল। ৫ই মার্চ মার্ক্স প্যারিসে পৌঁছোলেন।
তারপর তাঁর পরিবারও পৌঁছোল।
কাজের দিক থেকে এঙ্গেলস এখন ‘লীগ’এর ব্রাসেলস আঞ্চলিক কমিটির প্রধান ছিলেন। তিনি মার্ক্সকে নিষ্কাশিত
করার পুলিসি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান শুরু করলেন। স্থানীয় গণতন্ত্রপন্থীদের
রাজি করলেন, তারা যেন সংবাদ-মাধ্যমে এবং সংসদে পুলিসি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা রাখে।
তার এমন পরিণাম হল যে বেলজীয় সরকার সেই পুলিস আধিকারিককে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হল যে
মার্ক্সের ঘরে তল্লাশি চালিয়েছিল (এবং গ্রেপ্তার করিয়েছিল)।
মার্চের শেষে এঙ্গেলসও প্যারিসে চলে এলেন।
‘লীগ’এর প্যারিসে তৈরি হওয়া নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতেও
এঙ্গেলস সদস্য ছিলেন। প্যারিসে পৌঁছে, নতুন অস্থায়ী সরকারে শামিল নিজের পরিচিত লোকজনের
সঙ্গে কথা বলে, খবরের কাগজ পড়ে আর কিছুটা নিজের দৃষ্টি দিয়ে এঙ্গেলস ফ্রান্সের রাজনৈতিক
পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করছিলেন। ১৮৪৮এর ২৬শে মার্চ লন্ডনে নিজের ভগ্নীপতি এমিল ব্লাঙ্ককে
লিখলেন, “বড় পূঁজিবাদী এবং
শ্রমিক একে অন্যের বিরুদ্ধে সোজা মোকাবিলায় দাঁড়িয়ে। পাতি-পূঁজিবাদী মধ্যবর্তীর ভূমিকায়
আছে কিন্তু সব মিলিয়ে তাদের ভূমিকা ঘৃণ্য। যদিও অস্থায়ী সরকারে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদেরই।
… সবকিছু যত শান্ত
হতে থাকবে, পাতি-পূঁজিবাদী আরো বেশি করে বড় পূঁজিপতিদের দিকে নুইতে থাকবে, অশান্তি
যত বেশি হবে, তারা তত বেশি শ্রমিকদের দিকে নুইতে থাকবে।
“সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক
হল, সরকার এক দিকে শ্রমিকদের প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু তার একটাও পুরো করতে পারে না।
কেননা পূঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ – যেমন, কঠোর, ওপর দিকে বাড়তে থাকা করের ব্যবস্থা, উত্তরাধিকার
শুল্ক, প্রবাসীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, মুদ্রা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা, সরকারি
ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি – নিয়ে তারা প্রয়োজনীয় তহবিল তৈরি করার সাহস করতে পারে না …”
প্যারিস আসার পর এঙ্গেলস মার্ক্সের সঙ্গে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এ কাজ করতে লাগলেন। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে অদ্ভুত
পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হল। দেখা গেল ‘লীগ’এর ভিতরে কয়েকজন,
সে সময়কার ফরাসি সরকারে থাকা পাতি-পূঁজিবাদীদের একটি পরিকল্পনার সমর্থক। এঙ্গেলসের
উপরোক্ত চিঠিতে যেমনটা আছে, পাতি-পূঁজিবাদীদের হাত থেকে ক্ষমতা বেরিয়ে যাচ্ছিল বড় পূঁজিবাদীদের
হাতে। তাই ওরা একটা নিকৃষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করল। তত্ত্বগত ভাবে কথাটা ঠিক ছিল যে জার্মানিতে
বিপ্লবী শক্তি আগুয়ান হলে ফ্রান্সে বিপ্লব বাঁচানো সহজ হবে। কিন্তু তার পন্থাটা ওরা
গ্রহণ করল ভুল। ওরা অস্ত্র জড়ো করা শুরু করল। পরিকল্পনা করা হল যে প্যারিসে থাকা জার্মান
বিপ্লবীরা সেই অস্ত্র নিয়ে জার্মানিতে ঢুকবে। কানে কানে খবরটা পেয়ে বড় পূঁজিবাদী এবং
অন্যান্য প্রতিবিপ্লবীরাও এই পরিকল্পনার সমর্থন করে সাহায্য করতে লাগল। তাদের মনে হল,
পরিকল্পনা সফল হলে জার্মান বিপ্লবী শ্রমিক এবং অন্য প্রবাসীরা প্যারিস ছেড়ে চলে যাবে।
ফলে প্যারিসের বিপ্লবী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে। আবার, যারা সীমানা পেরিয়ে জার্মানিতে
ঢুকবে, তারাও হয় মারা পড়বে অথবা গ্রেপ্তার হবে কেননা প্রুশীয় পুলিস সেখানে বসে আছে।
এমনকি গ্রেপ্তার হওয়া লোকগুলোর কাছ থেকে পুলিস সেই সব বিপ্লবীদেরও নাম-ঠিকানা জানতে
পারবে যারা তখনও জার্মানিতে আছে। অর্থাৎ, দুই দেশেরই প্রতিবিপ্লবীরা এই অতিবিপ্লবী
পরিকল্পনায় নিজেদের সাফল্য দেখতে পাচ্ছিল।
মার্ক্স-এঙ্গেলস তীব্র সুরে এই বিপজ্জনক পরিকল্পনার
বিরোধ করলেন। ‘লীগ‘এর বিভিন্ন বৈঠকে অনবরত সাংগঠনিক সংগ্রাম চালিয়ে
গেলেন। তা সত্ত্বেও এই পরিকল্পনা অনুসারে কয়েকজনকে কাজ করতে দেখে তাঁদের মনে হল, জার্মান
কম্যুনিস্ট আন্দোলনকে এই পুরো ব্যাপারটার ছোঁয়াচ থেকে বাঁচাতে হবে। প্রজাতন্ত্রী এবং
গণতন্ত্রীরা যেন দেখতে পায় যে জার্মান কম্যুনিস্ট পার্টি চক্রান্ত করে রাষ্ট্রশক্তি
দখলের চেষ্টা চালানোর পার্টি নয়, জার্মান শ্রমিক শ্রেণীর গণপার্টি, যেটি চায় যে জার্মানিতে
প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হোক এবং সেই রাজনৈতিক সংগ্রামে সে, সর্বহারার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক
দৃষ্টি নিয়ে, নিজের দাবিগুলো হাসিল করতে শামিল হয়।
এই উদ্দেশ্যে ১৮৪৮এর ২১-২৪ মার্চ, ‘জার্মানির কম্যুনিস্ট পার্টির দাবি’ নামে একটা দলিলের জন্ম হল। সে দলিল পাশ করলো
‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর কেন্দ্রীয় কমিটি। সে সময় তো দলিলটা প্রকাশিত
হলই, পরেও বেশ কয়েকবার সেটাকে পুনঃপ্রকাশ করতে হল। কেননা প্রজাতান্ত্রিক আন্দোলনে সর্বহারার
পক্ষ তুলে ধরার পথপ্রদর্শক হয়ে উঠল সেই দলিল। দাবিগুলো ছিলঃ
(১) পুরো জার্মানি হবে এক এবং অখণ্ড প্রজাতন্ত্র;
(২) সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার; (৩) গণপ্রতিনিধিদের অর্থপ্রদান যাতে শ্রমিকও
সংসদের সদস্য হতে পারে; (৪) জনতার সশস্ত্রীকরণ এবং একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর শ্রমসেনাবাহিনীতে
রূপান্তরণ; (৫) বিনামূল্যে আইনি পরিষেবা; (৬) সবরকম সামন্ততান্ত্রিক ভার, ঋণ, বেগারি,
দশাংশ ইত্যাদি যাকিছু আজ অব্দি গ্রামীণ জনগণের ওপর বোঝা হয়ে ছিল, তার ক্ষতিপূরণহীন
সমাপ্তি; (৭) যত রাজত্ব এবং সামন্তাধীন জমি, খনি, খাদ সব সম্পত্তি রাষ্ট্রের সম্পত্তি
হোক, পুরো সমাজের স্বার্থে সেইসব ভূসম্পত্তিতে বড়ো ভাবে হোক আধুনিক চাষ; (৮) কৃষকদের
বন্ধকে থাকা জমি রাষ্ট্রের সম্পত্তি হোক, সেই বন্ধকের ওপর সূদ কৃষক সরকারকে দেবে; (৯)
যেখানে ভাগচাষের ব্যবস্থা আছে জমি-ভাড়া/খাজনা অথবা মুক্তি-খাজনা কর রূপে সরকারকে দেয়
হোক; (১০) বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বদলে একটি সরকারি ব্যাংক হোক এবং সে ব্যাংক কর্তৃক
জারি কাগজ [নোট] বৈধ-মুদ্রা হোক; [সেসময় কাগজের মুদ্রা ছিল না] (১১) পরিবহণের সমস্ত
মাধ্যম, রেলপথ, খাল, বাষ্পের জাহাজ, রাস্তা, ডাক ইত্যাদি সরকার কর্তৃক অধিগৃহীত হোক
এবং দরিদ্রের জন্য নিঃশুল্ক হোক; (১২) সব সরকারি কর্মচারির মাইনে এক হোক, বেশি সে পাক
যাকে পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদন করতে হয়; (১৩) গির্জা এবং রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ;
(১৪) উত্তরাধিকারের অধিকার কম করা হোক; (১৫) ওপরের দিকে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া করের ভার,
ভোগ্যপণ্যের ওপর করের সমাপ্তি; (১৬) জাতীয় কর্মশালাসমূহের উদ্বোধন, সব শ্রমিকের জন্য
রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত রুজিরুটির গ্যারান্টি এবং যে কাজ করতে অক্ষম হবে তার জন্য ব্যবস্থা;
(১৭) জনগণের জন্য সর্বজনীন এবং নিঃশুল্ক শিক্ষা।
দাবির সঙ্গে তার ব্যাখ্যাও ছিল। শেষে লেখা
ছিল, “পুরো সম্ভবপর শক্তি
নিয়োজিত করে এই দাবিগুলোর সমর্থন করলে জার্মান সর্বহারা, পাতি-পূঁজিবাদী এবং ছোটো কৃষকের
স্বার্থরক্ষা হবে।”
১৮৪৮-৪৯এর বিপ্লবগুলো – ২
এপ্রিল ১৮৪৮এর শুরুতে যখন ‘জার্মানির কম্যুনিস্ট পার্টির দাবি’ প্রতিদিন কোনো না কোনো গণতন্ত্রী খবরের কাগজে
বেরুচ্ছে, হ্যান্ডবিল হয়ে হাতে হাতে ঘুরছে এবং শ্রমিকদের বৈঠকে সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে,
মার্ক্স-এঙ্গেলস জার্মানিতে ফিরে এলেন। তাঁদের ফিরে আসার আগেই তৎকালীন জার্মানির কয়েকটি
প্রদেশে জনগণের আক্রোশ ব্যক্ত হয়েছে। কয়েকটি প্রদেশের শাসক সংস্কারের দাবি স্বীকার
করে নিয়েছে। খোদ বার্লিনের রাস্তায় জনতা প্রুশিয়ার রাজার সামনে নিজেদের ক্ষোভ জানিয়েছে
এবং রাজা মৌখিক কিছু আশ্বাস দিয়েছে। অধিকাংশ প্রদেশে উদারপন্থী পূঁজীবাদীরা শাসনক্ষমতায়
এসে গেছে কিন্তু ফ্রান্সের উদাহরণ দেখে আর জার্মান শ্রমিকশ্রেণীরও বিপ্লবী মনোভাবের
সম্ভাবনায় আতঙ্কিত হয়ে তারা সামন্ততান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে আপোষে আসতে চাইছে। অন্য দিকে
পাতি-পূঁজিবাদী শ্রেণী নিজেদের আদর্শবাদী চিন্তার বাইরে আসতে পারছে না, শ্রমিকদেরকে
তাদের দাবিগুলো হাসিল করার বাস্তব পথ দেখাতে পারছে না।
জার্মানিতে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর সংগঠনও দুর্বল। জার্মান সর্বহারা, শ্রেণী-রূপ
গ্রহণ করার প্রাথমিক পর্যায়ে। মার্ক্স-এঙ্গেলস এসে এটাও দেখলেন যে গণতন্ত্রী শিবিরের
প্রতি জনতার বিশ্বাস এখনও অটুট। তাঁরা অনুভব করলেন, দুটো দলকে একসঙ্গে সম্বোধন করতে
হবে। প্রথম, গণতন্ত্রী শিবিরের ভিতরে দ্বিধাগ্রস্ত ও ভাববাদী পূঁজিবাদী ভিন্ন বিদ্যমান
বিপ্লবী অংশ, এবং ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর ভিতরে গুপ্ত-চক্রান্তপন্থী ও সংস্কারপন্থী
ভিন্ন সর্বহারা গণ-পার্টির সমর্থক অংশ। সেটা করতে গেলে দুটো সংগঠনেই সাংগঠনিক বাদানুবাদ
চালাতে হবে।
কোলোন শহরে পৌঁছে তাঁরা প্রথম কাজ স্থির করলেন।
‘রাইনিশে জাইটুং’এর মতই একটা খবরের কাগজ, ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’ বার করবেন তাঁরা। তার জন্য অর্থসাহায্য এবং
গ্রাহক-চাঁদা সংগ্রহ করা শুরু করে দিলেন। দ্বিতীয় কাজে, কোলোনের গণতন্ত্রী সমিতি (ডেমোক্রেটিক
সোসাইটি)র সঙ্গে কথাবার্তায় এগিয়ে সেই সমিতির সদস্যতা গ্রহণ করলেন। ‘লীগ’এর ভিতরকার পুরোনো অসুখগুলোর (চক্রান্তমূলক গোপনীয়তা এবং বিপরীতে,
সংস্কারপন্থা) অবস্থা দেখে স্থির করলেন আপাততঃ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে।
প্রতিদিন কিছু নতুন ঘটনা হয়ে চলেছিল। ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর জন্য অর্থসাহায্য আর চাঁদা সংগ্রহ করতে
এঙ্গেলস বার্মেন চলে গেলেন। এলবারফেল্ড এবং আশেপাশের অঞ্চলেও গেলেন। সামান্য কিছু তো
আসছিলই হাতে কিন্তু ব্রেমেন-এলবারফেল্ডের পুরোনো পূঁজিবাদী যারা কাল অব্দি উৎসাহী যুবক
এবং এঙ্গেলসের বন্ধু ছিল, এখন নিজেরাই কারখানাদার হয়ে, পত্রিকাটির সম্ভাবিত মনোভাব
বুঝে এক পয়সাও দিল না। এঙ্গেলস নিজের বাবার কাছে গিয়েও হাত পাতলেন। তিনিও দিলেন না।
কিন্তু, দেরি করা যায় না। প্রথম সংখ্যা জুলাইয়ে
প্রকাশিত হওয়ার ছিল। কিন্তু দুজনে প্রথম সংখ্যা জুন মাসেই প্রকাশিত করে দিলেন – পথ চলা শুরু হয়ে গেল। বাস্তবে এই নতুন খবরের
কাগজটা চালাবার দায়িত্ব এঙ্গেলসের ওপরই বর্তালো। প্রধান সম্পাদক ছিলেন মার্ক্স। নীতি-নির্দ্ধারণের
সময় পুরো সম্পাদক-মন্ডলী – যার অন্তর্ভুক্ত
ছিলেন ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর সবচেয়ে ভালো নেতৃবৃন্দ – বৈঠকে মার্ক্সের রাজনৈতিক দিকনির্দেশের জন্য
উপস্থিত থাকতেন। সেটা বাদে অধিকাংশ সম্পাদকীয়, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ এবং গুরুত্বপূর্ণ
প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখতেন এঙ্গেলস। বেশ কয়েকটি ভাষা জানতেন বলে ইয়োরোপের সব দেশের রাজনৈতিক
ঘটনাবলীর তথ্য, জার্মান, ফরাসি, ইংরেজি, ইতালীয়, স্পেনীয়, বেলজীয় এবং ড্যানিশ খবরের
কাগজগুলো থেকে সংগ্রহ করতেন।
মার্ক্স অবাক হতেন বন্ধুর অকল্পনীয় উদ্যমে।
পরেও, এঙ্গেলসের দক্ষ সাংবাদিকতা এবং বিভিন্ন ধরণের ঘটনার প্রতি সজাগ থাকার ক্ষমতা
নিয়ে মার্ক্স বলেছিলেন, “ও বাস্তবে একটা বিশ্বকোষ।
হাসিখুশি মেজাজে থাক বা গম্ভীর হয়ে থাক, দিনে-রাতে সবসময় কাজ করে চলার ক্ষমতা রাখে,
লেখায় আর ভাবায় ওর গতি শয়তানের মত ক্ষিপ্র।”
মার্ক্স-এঙ্গেলসের যা উদ্দেশ্য ছিল তারই অনুরূপ,
খবরের কাগজটা ঘোষিত রূপে গণতন্ত্রের মুখপত্র হয়েও জার্মানির উদীয়মান সর্বহারা পার্টির
পথপ্রদর্শক হয়ে রইল। বলা যেতে পারে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের দিনগুলোয় সর্বহারার কর্মসূচি
এই খবরের কাগজই প্রকাশ করে চলল। ১৯১৪ সালে লেনিন লেখেন, “‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’ বিপ্লবী সর্বহারার শ্রেষ্ঠতম মুখপত্র ছিল।
আজ অব্দি অন্য কোনো খবরের কাগজ তাকে পিছনে ফেলতে পারে নি।”
এক বছর পুরো হতে না হতে বন্ধ হয়ে গেল ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’। বিপ্লবী শক্তিগুলো ততদিনে দুর্বল হয়ে পড়েছিল;
সরকার বন্ধ করিয়ে দিল খবরের কাগজটাকে। এই এক বছরের সময়কালে এঙ্গেলস একশোরও বেশি প্রবন্ধ
ও প্রতিবেদন লিখলেন। তাতে নথিভুক্ত হয়ে থাকল জার্মানি, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া,
ইতালি, সুইটজারল্যান্ড এবং হাঙ্গেরির রাজনৈতিক ঘটনাবলি এবং বিপ্লবী সংগ্রাম।
আগের অধ্যায়ে উদ্ধৃত ‘জার্মানির কম্যুনিস্ট পার্টির দাবি’তে একটি দাবি ছিল জাতীয় কর্মশালা প্রতিষ্ঠা
করার, যাতে সবার রুজিরুটির ব্যবস্থা হতে পারে। মূলতঃ এটি ফ্রান্সের বিপ্লবী শ্রমিকদের
দাবি ছিল। ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির বৈপ্লবিক দিনগুলোতে তারা দাবিটা নতুন সরকারের কাছ
থেকে হাসিল করেই ছেড়েছিল। কিন্তু, সবাই জানেন যে ১৮৪৮ সালের ইয়োরোপীয় বিপ্লবগুলোর জয়
হয়েছিল মাত্র কিছু দিনের জন্য। জুন মাস আসতে আসতে আমূল পরিবর্তন চাওয়া পূঁজিবাদীরা
দুর্বল ও দিশেহারা হতে শুরু করল। লড়াকু শ্রমিকেরা একলা পড়ে গেল কেননা তখন অব্দি কৃষক
তাদের বন্ধু হয়ে ওঠে নি। উদারপন্থী পূঁজিবাদীরা ছোটো ছোটো সুবিধে পাওয়ার জন্যেও, পুরোনো
সামন্তবাদী, রাজতন্ত্রবাদী এবং প্রতিক্রিয়ার যে কোনো শক্তির সঙ্গে ঘৃণ্যতম চুক্তি করতে
প্রস্তুত ছিল। ফলে, এদিকে ১লা জুন মার্ক্স-এঙ্গেলসের ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’ প্রকাশিত হল আর ওদিকে প্যারিসে শ্রমিকদের
দাবিতে তৈরি হওয়া জাতীয় কর্মশালাগুলো ২৩শে জুন বন্ধ করে দেওয়া হল। শ্রমিকেরা ঐ সিদ্ধান্তের
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল কিন্তু চার দিনের লড়াইয়ের পর হেরে গেল। রাষ্ট্রশক্তির ওপর প্রতিক্রিয়াপন্থীদের
প্রভাব মজবুত হয়ে উঠেছিল। নিহত এবং আহত হল প্রায় ১০,০০০ বিপ্লবী শ্রমিক। ৪,০০০ শ্রমিককে
পাঠিয়ে দেওয়া হল ফরাসি আকজিরিয়ায়। এই গণসংহারের মাধ্যমে প্রতিবিপ্লব ফ্রান্সে নিজের
জয় সুনিশ্চিত করল। এঙ্গেলস লিখলেন, “শ্রমিকদের সাহস ছিল বিস্মিত করার মত। কুড়ি থেকে চল্লিশ হাজার শ্রমিক
তিন দিন পর্য্যন্ত আশি হাজারেরও বেশি সৈনিক এবং এক লক্ষ ন্যাশনাল গার্ডের গুলি, হাতবোমা,
আগুনের রকেট এবং সেই ‘অভিজাত’ জেনেরালদের সামরিক অভিজ্ঞতার মোকাবিলা করল,
যে ‘অভিজাত’ জেনেরালরা নির্দ্বিধায় আলজিরিয়ায় ব্যবহৃত
পদ্ধতি ব্যবহার করছিল। বড় সংখ্যায় পাশবিক হত্যালীলা চালিয়ে শ্রমিকদের দমন করা হল। হতাহত
শ্রমিকেরা জুলাই আর ফেব্রুয়ারিতে বলি হওয়া মানুষদের মত সম্মান পাবে না। কিন্তু ইতিহাসে
বিশেষ স্থান পাবে যে সর্বহারার প্রথম নির্ণায়ক সংগ্রামে তারা মারা গিয়েছিল।”
জার্মানিতেও, প্রতিবিপ্লবের এই জয়ের প্রভাব
দেখা গেল। মে ১৮৪৮এ যখন মার্ক্স-এঙ্গেলস কোলোনের ‘গণতন্ত্রী সমিতি’র সদস্যতা নিয়েছিলেন, এবং ‘লীগ’এর সিদ্ধান্ত অনুসারে
অন্যান্য নেতারাও নিজের নিজের শহরের ‘গণতন্ত্রী সমিতি’র সদস্য হয়েছিলেন, তার আগেই ফ্রাঙ্কফুর্টে ‘জার্মান সংসদ’এর (প্রজাতন্ত্রী বিপ্লবীদের গড়া) প্রথম বৈঠক
হয়ে গিয়েছিল। বিপ্লবী সর্বহারারও প্রধান দাবি, জার্মানির একতার প্রথম গণ-অভিব্যক্তি
ছিল এই সংসদ। কিন্তু প্যারিসের খবর আসার পর খবরের কাগজ এবং পত্রপত্রিকার ওপর সরকারি
হামলা বৃদ্ধি পেল। বিভিন্ন শহরে চলতে থাকা গণতন্ত্রী সমিতিগুলো বন্ধ করে দেওয়া হল।
‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এ মেইন্জ, ট্রিয়ের, এশেন, ম্যানহেইম, উল্ম,
বার্লিন, কোলোন, ডুসেলডর্ফ, ব্রেসলাউ এবং অন্যান্য শহরে চলতে থাকা পুলিশের জুলুম এবং
ব্যাডেন, উর্টেমবার্গ, বাভারিয়া ইত্যাদি শহরে গণতন্ত্রী সমিতি বন্ধ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে
লেখা হল। প্যারিসের ঘটনাবলি, কোন পরিস্থিতিতে জাতীয় কর্মশালাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হল
সেসব এবং আরো অন্যান্য বিষয়ে খবরের কাগজে লেখার পাশাপাশি এঙ্গেলস ‘কোলোন ওয়ার্কার্স লীগ’ এবং কোলোনের গণতন্ত্রী সমিতির আলোচনা ও তর্কবিতর্কগুলোয়
অংশগ্রহণ করতে থাকলেন।
‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’ চালানো কঠিন হচ্ছিল। পুরোনো অংশধারকেরা (শেয়ারহোল্ডার)
সঙ্গ ছাড়ছিল। মার্ক্স-এঙ্গেলস বার্লিন গেলেন। তারপর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় গেলেন। সেপ্টেম্বর
আসতে আসতে সরকার খবরের কাগজটার প্রকাশনের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে দিল। কাগজটার একজন
সম্পাদক, জর্জ উইর্থ লিখলেন –
“শহরটা কন্টকাকীর্ণ
হয়ে উঠেছিল। যেভাবে নিজের কাঁটা দাঁড় করিয়ে কন্টকাকীর্ণ হয় সজারু। প্রুশিয়ার প্রধান
দেবদূতের সশস্ত্র সৈনিকদের বন্যা ঢুকে পড়েছিল বাজারে, চৌরাস্তায়। যুদ্ধবাজদের একটা
দল নিয়ে এক লেফটেন্যান্ট আমাদের দরজার বাইরে এল, নাকাড়া বাজিয়ে গর্জন করে শোনাতে লাগল
আমাদের ন্যু রাইনিশে জাইটুংএর মৃত্যুর আদেশ।”
গ্রেপ্তারি থেকে বাঁচতে এঙ্গেলস বারমেন চলে
গেলেন। সেখানেও পুলিসের কাছে খবর পৌঁছে গেল। বাড়িতে একদিকে বাবার ক্রুদ্ধ হতাশা, অন্যদিকে
মায়ের কাতর মধ্যস্থতা – বিরক্ত হয়ে আরেক
সাথীকে সঙ্গে নিয়ে ব্রাসেলস চলে গেলেন। কিন্তু সেখানেও অবস্থা পাল্টে গিয়েছিল। বেলজীয়
পুলিস হোটেলে পৌঁছে গেল। মিথ্যে অজুহাতে যে এদের কাগজপত্রগুলো ঠিক নয়, দুজনকে গ্রেপ্তার
করে জেলে ঢুকিয়ে দিল। শহরে এঙ্গেলসের বন্ধু ছিল অনেক। তবু পুলিস তাঁদেরকে ‘ভবঘুরে’ ঘোষিত করে, সেদিনই ট্রেনে বসিয়ে ফ্রান্সের সীমায় পৌঁছে দিল।
৫ই অক্টোবর যখন এঙ্গেলস প্যারিসে পৌঁছোলেন
তখন পকেট প্রায় শূন্য। বিগত জুন মাসের বিদ্রোহ অবদমিত হওয়ার পর হতশ্রী, হতভাগ্য দেখাচ্ছিল
প্যারিস। কয়েক দিন থাকলেন। কিন্তু অসহ্য হয়ে উঠছিল। পকেটে পয়সাও ছিল না। শেষে প্যারিস
থেকে বার্ন (সুইটজারল্যান্ড) পর্য্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশো মাইল হেঁটেই পাড়ি দেবেন স্থির
করলেন। তাঁর সাথীটি প্যারিসে রয়ে গেলেন আর তিনি রওনা হয়ে গেলেন বার্নের পথে। প্যারিসে
তাঁর মনের অবস্থা পরে, জেনেভায় বসে লেখা একটি যাত্রা-বৃত্তান্তে বর্ণনা করেছেন। ‘প্যারিস থেকে বার্ন’ নামে এই অসমাপ্ত বৃত্তান্তটির ইংরেজি অনুবাদ
মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্রের সপ্তম খণ্ডে সঙ্কলিত। এক মাসের এই হাঁটাপথে তিনি ফ্রান্সের
চাষীদের খুব কাছ থেকে দেখলেন (সে অভিজ্ঞতা ঐ বৃত্তান্তে আছে) এবং শহরের শ্রমিকদের আর
গ্রামের কৃষকদের মধ্যেকার দূরত্বটা বুঝতে পারলেন।
ওদিকে কোলোনে পরিস্থিতি একটু ভালো হওয়ায় ১২ই
অক্টোবর ১৮৪৮ থেকে ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর প্রকাশনা আবার শুরু হল। সম্পাদক-মন্ডলীর
অধিকাংশ সদস্য হয় অন্যান্য জার্মান শহরে লুকিয়েছিলেন অথবা জার্মানি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
তাই, সেই সংখ্যাতেই প্রধান সম্পাদক মার্ক্স ঘোষণা করলেন যে সম্পাদক-মন্ডলীর একজন সদস্যকেও
বদলানো হবে না। মার্ক্সের মাথায় আসলে এঙ্গেলসকে নিয়ে চিন্তা ছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন
দূর সুইটজারল্যান্ডে কপর্দকশূন্য, কর্মহীন এবং বিপ্লবী সাথীদের সঙ্গহারা তাঁর বন্ধুটি
কেমন জীবন কাটাচ্ছে, তার মনের অবস্থাই বা কেমন। মাঝে এঙ্গেলসের আর্থিক কষ্ট এমন পর্যায়ে
পৌঁছেছিল যে মার্ক্সের কাছেই সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠাতে হয়েছিল। যখন নাকি তিনি জানতেন
মার্ক্সের আর্থিক অবস্থা কেমন। মার্ক্স কিছু পয়সা সংগ্রহ করে তাঁকে পাঠিয়েও ছিলেন।
কিন্তু যে ঠিকানায় পাঠানো হয়েছিল, সে ঠিকানায় পৌঁছোয় নি।
সম্পাদকেরা যখন কাজই করছে না তখন তাদের পুরো
মাইনে দেওয়া নিয়ে ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর নতুন অংশধারকদের আপত্তি ছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে
কোনো সিদ্ধান্তে আসতে বাধা দিলেন মার্ক্স। যেমন করে হোক অংশধারকদের বোঝালেন। তাঁর স্বার্থ
ছিল যে সব সাথী সম্পাদকেরা (এঙ্গেলস, প্যারিসে থেকে যাওয়া তাঁর সাথী এবং লীগের অন্যান্য
নেতা) এই পয়সাটুকু পাক।
সব দেশের সমাজবাদী শিবিরের ভিতরেই মার্ক্স-এঙ্গেলসের
বাড়তে থাকা প্রভাবে ঈর্ষান্বিত এবং নিন্দুক মানুষেরা ছিল। তারা সুযোগ পেল গুজব রটাবার
যে কারোর না থাকায় খবরের কাগজটার প্রকাশনে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় নি আর এখন তো অংশধারকেরা
কাজ ছেড়ে চলে যাওয়া সম্পাদকদের মাইনে দিতেও অস্বীকার করছে …। এঙ্গেলসের কানেও পৌঁছে থাকবে সেই গুজব। ওদিকে
মার্ক্সের পাঠানো পয়সাও তিনি পান নি। ২৬শে অক্টোবরে মার্ক্স খবরের কাগজের জন্য এঙ্গেলসকে
একটা “চিঠি এবং দীর্ঘ প্রবন্ধ” পাঠাতে লিখেছিলেন। কিন্তু দেখা যায়, নভেম্বরে
একটি চিঠির শেষে (চিঠিতে এঙ্গেলসকে পাঠানো পয়সার হিসেব, তাঁর নিজের কাছে কত পয়সা আছে
তার হিসেব, খবরের কাগজ এবং মামলা ইত্যাদি নিয়ে কিছু কথা আছে) তাঁকে লিখতে হচ্ছে, “এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে আমি তোমার কষ্টের
সময় ছেড়ে যেতে পারি এমন ভাবাটা একেবারেই খোশখেয়াল। তুমি সবসময় আমার প্রাণের বন্ধু থাকবে
আর আশা করি আমিও তেমনটাই থাকব তোমার।” এঙ্গেলসকে বিপ্লবী কার্যকলাপে ব্যস্ত রাখার জন্য মার্ক্স অনবরত
তাঁর কাছে আলাদা আলাদা বিষয়-সংকেত দিয়ে প্রবন্ধ, প্রতিবেদন ইত্যাদি চাইতে থাকতেন – কখনো প্রুধোঁকে নিয়ে, কখনো হাঙ্গেরিতে চলতে
থাকা বিপ্লবী যুদ্ধ নিয়ে, কখনো পাতি-পূঁজিবাদী আদর্শের মান নিয়ে, সুইটজারল্যান্ডের
যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র নিয়ে। সঙ্গে এটাও জুড়ে দিতেন, “বা অন্য কোনো বিষয় নিয়েও লিখতে পারো, যেমনটা
তুমি চাও।”
প্যারিস থেকে পায়ে হেঁটে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে
এঙ্গেলস জেনেভা পৌঁছেছিলেন, তারপর লুসান। লুসানের শ্রমিকদের মধ্যে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর কিছু সমর্থক পেলেন যারা তাঁর নাম আগে শুনেছিল।
তাই নির্দ্বিধায় কথাবার্তা হতে পারল। মনটা ভালো হল। মার্ক্সের পরামর্শে তিনি সেখান
থেকে বার্নের পথে রওনা দিলেন। নভেম্বরের ৯ তারিখে পৌঁছোলেন। লুসান ছেড়ে গেলেও লুসানের
শ্রমিক সঙ্ঘ তাঁকে ছাড়ল না। ডিসেম্বরে বার্নে জার্মান শ্রমিকদের সঙ্ঘগুলোর প্রথম কংগ্রেস
হওয়ার কথা ছিল। সেই কংগ্রেসে এঙ্গেলসকে তারা তাদের সঙ্ঘের প্রতিনিধি হতে বলল। শংসাপত্রে
লেখা হল, “ভাই, যেহেতু প্রতিনিধি
পাঠাতে পারব না, তাই আপনাকে অনুরোধ যে আপনি বার্নের শ্রমিক কংগ্রেসে আমাদের প্রতিনিধিত্ব
করুন। সর্বহারাদের স্বার্থে পুরোনো যোদ্ধা হওয়ার দরুন আপনি নিশ্চয়ই নিজের কর্তব্য ভালো
করে পালন করবেন। যদিও এবার আপনি পূঁজিবাদী এবং অন্যান্য বণিকদের বিরুদ্ধে লড়বেন না।
সেখানে শুধু সর্বহারারাই থাকবে যাদের সঙ্গে এবং যাদের জন্য আপনাকে লড়তে হবে।”
সেই কংগ্রেসে এঙ্গেলস বা অন্য কেউ কী বলেছিল
তার ইতিহাস তো লভ্য নয় কিন্তু এঙ্গেলস ভালো করেই নিজের কর্তব্য পালন করে থাকবেন। নতুন
সঙ্ঘের কেন্দ্রীয় কমিশনে তিনি নির্বাচিত হলেন। বার্ন থেকেই, নভেম্বরের শেষে এঙ্গেলস
সুইটজারল্যান্ডের বিষয়ে এবং সেই প্রসঙ্গে জার্মানির বিষয়ে লেখা শুরু করলেন। চিঠি এবং
প্রবন্ধ ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এ ছাপতে লাগল।
বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব
বিপ্লবী সামরিক সংগ্রামের গভীরে
সামরিক-বিজ্ঞান, যুদ্ধের নীতিগত এবং কৌশলগত
সমঝদারি ইত্যাদি সম্পর্কে এঙ্গেলসের পাণ্ডিত্য সুপ্রসিদ্ধ। বার্লিনের প্রুশীয় আর্টিলারিতে
কয়েক মাস কাটানোর ফলে ততটা নয় যতটা, বছরের পর বছর ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক
মানচিত্রে হতে থাকা পরিবর্তন, সামরিক গতিবিধি, যুদ্ধ এবং সরকারগুলোর বিরুদ্ধে জনগণের
বিপ্লবী যুদ্ধ, গেরিলা আক্রমণ, গণফৌজ-গঠন ইত্যাদি বিষয়ে গভীর অধ্যয়ন এবং লেখনের কারণবশতঃ।
১৮৪৯ সালের শুরুতে সুইটজারল্যান্ড থেকে জার্মানি ফিরে আসার পর তিনি তাঁর এই জ্ঞানকে
অনুশীলনে প্রয়োগ করার সুযোগ পেলেন।
এঙ্গেলস জার্মানি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন।
বিপ্লবী কার্যকলাপের কেন্দ্রে থাকার কথা ছিল তাঁর, কিনারায় নয়, – হলে গ্রেপ্তারই হতে হোক। মার্ক্স আরো কিছুদিন
সুইটজারল্যান্ডে থেকে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলেন কিন্তু এঙ্গেলস শুনলেন না। ১৮৪৯ সালের
জানুয়ারির মাঝামাঝি তিনি কোলোনে ফিরে এলেন। কোলোনে এবং অন্যান্য জার্মান শহরে তত দিনে
প্রতিক্রিয়া এবং প্রুশীয় রাজতন্ত্রের আধিপত্য মজবুত হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু হাঙ্গেরিতে বিপ্লবী সংগ্রাম জোয়ারে
ছিল। পোল্যান্ড এবং ইতালির রাজ্যগুলোতেও সংগ্রাম চলছিল। সেসব দিনে সাম্রাজ্যগুলোর পারস্পরিক
যুদ্ধে ইয়োরোপের দেশসমূহের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সীমান্ত বার বার বদলাতো। ঐ সব দেশে চলতে
থাকা জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম নিয়ে ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এ লেখার সময় এঙ্গেলস দুটো বিষয়কে সব সময় গুরুত্ব দিতেন। প্রথমতঃ,
সাম্রাজ্যগুলোয় ভেঙে ছড়িয়ে থাকা প্রতিটি জাতির একীকরণ। জার্মানির একীকরণের প্রশ্নে
এই প্রসঙ্গটা বার বার উঠে আসত। দ্বিতীয়তঃ, জাতীয় স্বাধীনতার গুরুত্ব – পোল্যান্ড, ইতালি, এবং অন্যান্য জায়গায় চলতে
থাকা বিপ্লবী সংগ্রামের প্রসঙ্গে সেটাকে পরিভাষিত করার দরকার পড়ত।
সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখত কোলোনের মত সৈন্যবেষ্টিত
শহরে, পূঁজিবাদী এবং প্রতিক্রিয়াপন্থী সংবাদ মাধ্যমের নিগ্রহ, প্রতিক্রিয়াপন্থী সামরিক
পদাধিকারিদের হামলা এবং উপর্যুপরি আদালতি সমন সহ্য করে, ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর মত খবরের কাগজ কিভাবে বিপ্লবের পতাকা তুলে
ধরে রাখত সমানে, নিজের পৃষ্ঠাগুলোয় মুদ্রিত সমালোচনামূলক প্রবন্ধে কাউকে বাদ দিত না।
সরকারি খবরের কাগজগুলো যখন অভিযোগ করত যে বিদেশের বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যোগসাজশ
আছে, মার্ক্স-এঙ্গেলস গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করতেন, “ফরাসি, ইংরেজ, ইতালীয়, সুইস, বেলজীয়, পোলিশ, মার্কিন এবং অন্যান্য
গণতন্ত্রীদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আমরা কখনো লুকোই নি!” এঙ্গেলস পরে স্মরণ করেছেন, “সম্পাদকীয় কামরায় সঙীন-লাগানো আটটি রাইফেল
ও ২৫০টি জ্যান্ত কার্তুজের উপস্থিতি এবং কম্পোজিটারদের মাথায় লাল জ্যাকোবিন টুপি থাকায়
আধিকারিকেরা আমাদের বাড়িটাকে দুর্গ মনে করত – এমন দুর্গ যেটা এক হামলায় কব্জা করা যাবে না।”
খবরের কাগজটার বিরুদ্ধে নালিশ তো হতেই থাকত।
১৮৪৯এর ৭ই ফেব্রুয়ারি মার্ক্স এবং এঙ্গেলসকে ব্যক্তিগত ভাবে জুরিদের (আদালতি নির্ণায়কসভা)
মুখোমুখি হতে হল। অভিযোগ ছিল, ৫ই জুলাই ১৮৪৮এর ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এ ‘গ্রেপ্তারি’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধে প্রকিউরেটর-জেনেরাল
জেইফেল এবং তার সেপাইদের অপমান করা হয়েছে। কাগজের প্রকাশক হের্মান কর্ফকেও আদালতে আনা
হল। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস আদালতটাকে পুরোপুরি ব্যবহার করলেন। প্রবন্ধটিতে জেইফেলের বিরুদ্ধে
করা অভিযোগ তো প্রমাণ করলেনই, বক্তব্যকে রাজনৈতিক রূপও দিলেন। এঙ্গেলস বললেন, ঠিক যেমন
‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এ লেখা হয়েছে, আধ-করা বিপ্লবের পরিণাম জনগণকে
ভুগতে হচ্ছে। বড় রকমের গণতান্ত্রিক জয় হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রশক্তি, অভিজাত শ্রেণীর
সঙ্গে সহযোগিতা করা বড় পূঁজির হাতে চলে গেছে। এই কারণেই বিপ্লবী ঢেউএর প্লাবন সত্ত্বেও
হঠাৎ সবক’টি জার্মান রাজ্যে
প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলো হামলা করার সুযোগ পেয়ে গেছে। জুরির আদালত দুজনকেই সসম্মানে
খালাস দিল। লাভ হল এই যে আদালতটা তাদের প্রচারের মঞ্চে পরিবর্তিত হল।
ওদিকে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর ভিতরে একটা দল আবার ‘লীগ’টাকে পুরোনো, ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’এর গোপনে কাজ করার ধরণধারণের দিকে টানছিল।
যখন নাকি ওদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ‘শ্রেণীবিহীন’ অর্থাৎ বিশেষ করে পাতি-পূঁজিবাদী।
মার্ক্স-এঙ্গেলস ঐ প্রবৃত্তির বিরোধ তো করছিলেনই,
কিন্তু ঐক্যমত হতে পারছিল না। তাঁরা বার বার ‘লীগ’এর নেতৃত্বকে শ্রমিক
সংগঠনগুলোর দিকে নজর দিতে বলছিলেন। নিজেরাও সে কাজেই এগিয়ে গেলেন। তাঁদের মনে হল এবার
প্রতিটি রাজ্যে শ্রমিক সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে গণতন্ত্রীদের সংগঠন থেকে আলাদা, পুরো
জার্মানির শ্রমিকদের একটা পার্টি গঠন করার সময় এসে গেছে। ১৮৪৯এর মে মাসে কাছের জেলাগুলোর
সম্মেলন এবং জুন মাসে লাইপজিগে পুরো জার্মানির শ্রমিক সংগঠনগুলোর একত্র সম্মেলনের তারিখ
নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। তখনই অন্য একটি ঘটনাপরম্পরা তাঁদের মনোযোগ আকর্ষিত করল।
সাধারণভাবে ইয়োরোপে প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলো
সুদৃঢ় হয়ে ওঠা সত্ত্বেও হাঙ্গেরি এবং তারই সঙ্গে পশ্চিম এবং দক্ষিণ জার্মানিতে বিপ্লবী
শক্তিগুলো তখনো হারে নি, নতুন নতুন বিক্ষোভের খবর আসছিল প্রতিদিন। এঙ্গেলসের শৈশবের
শহর এলবারফেল্ডও ঐ অঞ্চলে। তাঁর মাথায় সামরিক গতিবিধির একটা ছক রূপ নিতে শুরু করেছিল।
প্রথমতঃ, যে সব শহরে সেনাবাহিনীর দেওয়া সুরক্ষা আছে বা ছাউনি আছে সেসব শহরে অর্থহীন
কার্যকলাপ এড়িয়ে যাওয়া হোক। ছোটো শহরে, কারখানার শ্রমিক-সমুদায়ে এবং গ্রামীণ এলাকায়
এমন সক্রিয়তা বাড়ানো হোক যাতে সেনাবাহিনীর মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়। দ্বিতীয়তঃ এখনো অব্দি
যে সমস্ত শক্তিকে সংহত করা হয় নি তাদেরকে প্রস্তুত করে সম্ভাবিত বিদ্রোহের কেন্দ্রগুলোর
দিকে পাঠানো হোক; এভাবে সব দিকে তৈরি
হতে থাকা গণ-সেনাদেরকে একত্র করে বিপ্লবী সেনাবাহিনীর সুত্রপাত ঘটানো হোক।
এই ভাবনাকে কার্যকর করতে এঙ্গেলস কোলোন থেকে
এলবারফেল্ড রওনা হয়ে গেলেন। রাস্তায় একটা শহর পড়ে সোলিঙ্গেন, সেখানকার বিপ্লবী শ্রমিকদের
এঙ্গেলস একটি সামরিক কোম্পানিতে সংগঠিত করলেন এবং নিজের নেতৃত্বে ৪০০ সর্বহারার অস্ত্রসজ্জিত
দল নিয়ে ১১ই মে ১৮৪৯এ এলবারফেল্ডে প্রবেশ করলেন।
এলবারফেল্ডের বিদ্রোহে শ্রমিকেরা সেখানকার
কারাগার নিজেদের দখলে এনেছিল, দন্ডাধিকারীর দপ্তর ভেঙে দিয়েছিল, কিন্তু সেখানকার নেতৃত্ব
ছিল পাতি-পূঁজিবাদী ভরা সুরক্ষা সমিতির হাতে। বিপ্লবী সক্রিয়তা আরো বেশি করার বদলে
তারা পুরোনো প্রশাসকদের সঙ্গে চুক্তি করার দিকে অগ্রসর হতে লাগল। কিছু দিনেই আন্দোলন
ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। এঙ্গেলস নিজেকে ‘সুরক্ষা সমিতি’রই হাতে সঁপে বললেন যে তিনি রাজনৈতিক ব্যাপারে মাথা গলাবেন না, কেননা
তাঁর মতে “সেখানে সেসময় শুধু
কালো-লাল-সোনালি” [জার্মান ঐক্যের
রঙ] “আন্দোলনই সম্ভব ছিল
আর তাই রাজার সংবিধানের” [ফ্রাঙ্কফুর্ট সংসদে
গৃহীত] “বিরুদ্ধে যে কোনো
সক্রিয়তা এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ।” আর তাই, তিনি শুধু সামরিক বিষয়ে কাজ করতে চান। সামরিক-কমিশনে এঙ্গেলস
জায়গা পেয়ে গেলেন। তাঁকে দুর্গ-সুরক্ষা-নির্মাণ, ব্যারিকেডের দেখাশোনা এবং তোপখানার
জিম্মা দেওয়া হল। মন দিয়ে নিজের কাজে লেগে পড়লেন। ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দল তৈরি করলেন
এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে বানানো ব্যারিকেডগুলোকে শহরের বাইরের দিকে আবার তৈরি করতে বললেন।
অস্ত্রসজ্জিত ইউনিটগুলোর জায়গা বদলালেন। তাঁর কয়েকটি পরামর্শ সুরক্ষা সমিতি মানলও না।
তবুও তিন কাজ করে চললেন। বিপ্লবী শক্তিগুলোকে বাঁচানোর জন্য কিছু কাজ সুরক্ষা সমিতির
মতের বিরুদ্ধেও গিয়ে করলেন।
এঙ্গেলসের জীবনীকার [উপরোক্ত রুশি জীবনী] উল্লেখ
করেন যে ১৩ই মে, রবিবার, সকালে কাঁধে বিদ্রোহী কমান্ডারের বস্ত্র-চিহ্ন লাল চাদর ছড়িয়ে
হাঁটতে হাঁটতে এঙ্গেলস বারমেনের নিচের দিকের অংশের সঙ্গে এলবারফেল্ডের সংযোগকারী রাস্তাটায়
এসে পড়েন। হয় তিনি ব্যারিকেড তৈরি করার কাজ দেখতে অথবা বারমেনের শ্রমিকদের সঙ্গে দেখা
করতে যাচ্ছিলেন। একটি সেতুর ওপর তোলা ব্যারিকেডের ওপরে তিনি যেই পৌঁছোন, গির্জায় যেতে
থাকা তাঁর বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কী কথা হয়, আমরা জানি না, কিন্তু দুজনের দেখা
একটা কষ্টের নীরবতায় হয়েছিল আন্দাজ করা যায়।
পূঁজিবাদীরা ভীত ছিল। তারা এঙ্গেলসকে নিয়ে
নানা রকম গুজব ছড়ালো – কম্যুনিস্টেরা পুরো
বিপ্লবকে নিজেদের কুক্ষিগত করতে চায় … রাতের অন্ধকারে এঙ্গেলসের নেতৃত্বে ব্যারিকেডে লাগানো কালো-লাল-সোনালি
ঝান্ডাগুলো সরিয়ে লাক ঝান্ডা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি। সুরক্ষা সমিতির পাতি-পূঁজিবাদী
নেতৃত্ব এই সব গুজবে প্রভাবিত হয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করল যে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে এঙ্গেলসকে
এলবারফেল্ড ছেড়ে দিতে হবে। সিদ্ধান্ত শুনে অস্ত্রসজ্জিত শ্রমিক এবং স্বয়ংসেবকেরা ক্রুদ্ধ
হয়ে উঠল। কিন্তু ভিতরকার ঝগড়া বিপ্লবী শক্তিকে দুর্বল করত; প্রুশীয় সেনাবাহিনীও ওদিকে
এগিয়ে আসছিল। তাই ১৫ই মে এঙ্গেলস আবার কোলোন ফেরার পথে রওনা হয়ে গেলেন। ১৭ই মে, ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এ লেখা হল যে শ্রমিকেরা তাদের সম্পাদকীয় মন্ডলীর
একজন সদস্যকে স্নেহভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে দীর্ঘ সংগ্রামের দিনগুলোয়
শ্রমিক-স্বার্থের বিপদে পড়া উচিৎ নয়। যখন বড় লড়াই শুরু হবে, কাগজের অন্যান্য সম্পাদকদের
মত এঙ্গেলসকেও তাঁরা সম্মুখ রণাঙ্গনে পাবেন এবং সেসময় বিশ্বের কোনো শক্তি তাঁকে সরাতে
পারবে না।
কিন্তু বাস্তব এটাই যে সব অঞ্চলে বিদ্রোহ ভাঙতে
শুরু করেছিল। পাতি-পূঁজিবাদী নেতৃত্ব নিজের দ্বিধাগ্রস্ততায় নির্ণায়ক বিপ্লবী পদক্ষেপ
নিতে পারছিল না, পূঁজিবাদী শ্রেণী সামন্ততান্ত্রিক শক্তিদের সঙ্গে সমঝোতায় মশগুল ছিল
আর শ্রমিকেরা মোহমুক্ত হয়ে নিজেদের জায়গায় ফিরে যাচ্ছিল। প্রুশীয় সরকার দেখল যে চূড়ান্ত
আক্রমণের সময় এটাই। ফলে ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর ওপর দমনমূলক কার্যকলাপ শুরু হয়ে গেল। কাগজটার
সম্পাদকদের ওপর তেইশটা মামলা রুজু করা হল। মে মাসের ১৬ই তারিখেই ‘বিদেশী’ মার্ক্সকে চব্বিশ ঘন্টার নোটিশে প্রুশিয়া ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার
আদেশ দেওয়া হয়েছিল। বাকি সব সম্পাদককে আগেই হয় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল অথবা দেশ থেকে
বার করে দেওয়া হয়েছিল। ১৭ তারিখে এঙ্গেলসকে গ্রেপ্তার করার এবং ৬ই জুন তাঁকে তালাশ
করার আদেশ জারি হল।
খবরের কাগজ বন্ধ করার জন্য প্রধান সম্পাদক
কার্ল মার্ক্সকে পাঠানো নোটিশে লেখা ছিল যে তাঁর খবরের কাগজ, সদ্য প্রকাশিত প্রবন্ধাদির
মাধ্যমে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে লোকজনকে উসকাচ্ছে, সহিংস বিপ্লব এবং সামাজিক প্রজাতন্ত্রের
ওকালতি করছে এবং এ প্রকারে, সরকার কর্তৃক প্রদত্ত আতিথ্যের সীমারেখা তিনি লঙ্ঘন করছেন।
তাই, তাঁকে প্রদত্ত আতিথ্য ফেরত নেওয়া হচ্ছে আর যেহেতু তাঁর কোলোনে থাকার কাগজপত্রের
তারিখ বাড়ানো হয় নি তাই তিনি যেন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কোলোন ছেড়ে দেন।
‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর শেষ সংখ্যা মে মাসের ১৯ তারিখে লাল কালিতে
ছেপে বেরুল। সম্পাদকীয়তে মার্ক্স সরকারের মিথ্যে অভিযোগগুলো খণ্ডিত করলেন। সম্পাদকীয়
বলল, প্রথম থেকেই এই খবরের কাগজ সামাজিক প্রজাতন্ত্রের পক্ষে। সরকারি সিদ্ধান্ত ভীরুতাপূর্ণ
বলে তার নিন্দা করল। বলল যে এই সরকারের প্রতি কাগজটির কোনো সহানুভূতিও নেই আর এই সরকারের
কাছ থেকে কোনো সহানুভূতি কাগজটি চায়ও না। কোলোনের শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে একটি সম্বোধনে
তাঁদের সহানুভূতির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হল এবং বলা হল, কাগজের সম্পাদকদের শেষ
আহ্বান হবে ‘শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি’।
খবরের কাগজের এই সংখ্যাটি প্রকাশের দু’দিন আগে এঙ্গেলস লুকিয়ে পড়েছিলেন। প্রকাশ হওয়ার
পর মার্ক্সের সঙ্গে তিনি ফ্রাঙ্কফুর্ট রওনা হয়ে গেলেন।
প্রাঙ্কফুর্টে জাতীয় সংসদের বামপক্ষকে মার্ক্স-এঙ্গেলস
অনুরোধ করলেন যে তাঁরা যেন দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানিতে চলতে থাকা বিপ্লবী সংগ্রামের কেন্দ্রীয়
নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নেন। বোঝাবার চেষ্টা করলেন। এঙ্গেলস সে অঞ্চলের ভৌগোলিক মানচিত্র
এবং বিপ্লবী শক্তিদের অবস্থান বর্ণিত করে বললেন যে প্রান্তবর্তী দক্ষিণ-পশ্চিমের কালো
জঙ্গলে ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী ব্যাডেন শহরে হওয়া বিদ্রোহের গুরুত্ব আছে। সেটাকে সংগঠিত
করে পুরো দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির বিভিন্ন শহরে বিদ্রোহ করানো যায় এবং সংগঠিতভাবে প্রতিবিপ্লবী
প্রুশীয় সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করা যায়। ব্যাডেনের বিপ্লবী সেনাবাহিনীকে ফ্রাঙ্কফুর্টে
ডেকে গোটা ফ্রাঙ্কফুর্ট অধিকার করা যেতে পারে। তার প্রভাব পড়বে পুরো জার্মানির ওপর।
কিন্তু সংসদের বামপক্ষের পাতি-পূঁজিবাদীরা মানল না।
মার্ক্স-এঙ্গেলস তখন নিজেরাই ব্যাডেন গেলেন।
সেখানকার বিপ্লবী শক্তিদের নেতৃত্বকে বোঝালেন যাতে জাতীয় সংসদকে প্রভাবিত করার জন্য
তাঁরা নিজেদের সামরিক দল ফ্রাঙ্কফুর্টে পাঠান। কিন্তু তারাও এ প্রস্তাব মানল না। তখন
মার্ক্স-এঙ্গেলস দ্বিতীয় নিকটবর্তী শহর প্যালেটিনেট পৌঁছোলেন। সেখানেও চলছিল বিপ্লবী
আন্দোলন। অস্থায়ী সরকারে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর সদস্যেরাও ছিল এবং কয়েকজন গণতন্ত্রীও ছিল
‘লীগ’ সদস্যদের সমর্থনে। কিন্তু সেখানেও মার্ক্স-এঙ্গেলসের
প্রস্তাব মান্য হল না। আসলে প্রত্যেক জায়গায় বিদ্রোহ বা আন্দোলন স্থানীয় ছিল। পাতি-পূঁজিবাদী
নেতৃত্বের, পুরো জার্মানির বিপ্লবী একীকরণ সম্পর্কিত কোনো দৃষ্টি ছিল না।
প্যালেটিনেট থেকে একটি তৃতীয় শহর বিঙ্গেন যাওয়ার
পথে মার্ক্স-এঙ্গেলস স্থানীয় প্রশাসনের হাতে গ্রেপ্তার হলেন। তাঁদের ফেরত ফ্রাঙ্কফুর্ট
নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল। সেখান থেকে তাঁরা আবার বিঙ্গেন পৌঁছোলেন। মার্ক্স প্যারিসের
পথে রওনা হলেন আর এঙ্গেলস প্যালেটিনেটেরই ভিতরে অবস্থিত শহরতলী কাইজারস্লটার্নে ফিরে
এলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল সেখানেই একজন সাধারণ রাজনৈতিক প্রবাসী হয়ে থাকবেন। লড়াইয়ের মরশুম
আবার জেগে উঠলে “আন্দোলনে ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর একমাত্র জায়গা -একজন সৈনিকের” জায়গা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবেন।
প্যালেটিনেটের অস্থায়ী সরকার এঙ্গেলসকে বেশ
কয়েকবার সামরিক বা নাগরিক কোনো পদে থাকার প্রস্তাব দিল। এঙ্গেলস স্বীকার করলেন না।
কিন্তু অস্থায়ী সরকারের খবরের কাগজে লিখতে রাজি হয়ে গেলেন। লিখলেনও। কিন্তু এখানেও
একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হল। ‘উস্কানিমূলক’ হওয়ার অভিযোগে সম্পাদকেরা দ্বিতীয় প্রবন্ধটিকে খারিজ করে দিল। এঙ্গেলস
লেখা বন্ধ করে দিলেন।
তত দিনে প্রুশীয় সেনাবাহিনী প্যালেটিনেট পৌঁছে
গিয়েছিল। অস্থায়ী সরকার, গণতন্ত্রী আন্দোলন এবং বিপ্লবী সেনাবাহিনীকে দমন করার যুদ্ধ
শুরু হয়ে গেল। এঙ্গেলস তৎক্ষণাৎ সেখানকার ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর সদস্য এবং বিপ্লবী সেনাবাহিনীর অগ্রগামী দলটির ভারপ্রাপ্ত উইলিচের
সহকারী হয়ে গেলেন। পুরোদস্তুর যুদ্ধে অংশ নিলেন। বিপ্লবী সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে
এলবারফেল্ডের শ্রমিকেরা এসে গিয়েছিল। তারা এঙ্গেলসকে চিনতে পারল এবং এঙ্গেলসের নেতৃত্বে
কাজ করতে চাইল।
এঙ্গেলস দক্ষভাবে বিপ্লবী সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ
পরিচালিত করলেন। ছোট ছোট লড়াইগুলো ছেড়ে দিলেও চারটে বড় যুদ্ধে এঙ্গেলস রইলেন। বিপ্লবী
সেনাবাহিনী শেষ পর্য্যন্ত পরাজিত হল – ধীরে ধীরে পিছু হটতে হটতে ব্যাডেন-প্যালেটিনেটের বিদ্রোহী সৈন্যবাহিনীর
শেষ দলটা ১২ই জুলাই ১৮৪৯এ জার্মানির সীমান্ত পেরিয়ে সুইটজারল্যান্ডে প্রবেশ করল।
মার্ক্সের ছোট মেয়ে ইলিয়ানর নিজের স্মৃতিকথায়
লেখেন, “যাঁরাই তাঁকে” [এঙ্গেলসকে] “যুদ্ধে দেখেছেন, তাঁদের সবাইকে ওনার অসাধারণ
শান্ত স্বভাব এবং বিপদকে তুচ্ছ করা ঘৃণার কথা বলতে দেখা গেছে।”
প্রতিবিপ্লবী যুগের প্রারম্ভ এবং ইংল্যান্ডবাসী
হওয়ার সিদ্ধান্ত
উইলিচের নেতৃত্বে বিপ্লবী সেনাবাহিনীর শেষ
ইউনিটটার সঙ্গে সুইটজারল্যান্ডে প্রবেশ করার পর কয়েকটি দিন তাঁরা সবাই সীমান্তেই কাটালেন।
তারপর উইলিচের ইউনিটের শিবির হল ভেভে নামে একটি শহরে। এঙ্গেলস ভয় পাচ্ছিলেন মার্ক্স
প্যারিসে গ্রেপ্তার না হয়ে গিয়ে থাকেন। ভেভে পৌঁছোবার পরের দিনই জেনি মার্ক্সকে লেখা
তাঁর একটি চিঠি পাওয়া যায় [মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্র, খণ্ড ৩৮, পৃঃ ২০২-৪]। ২৫শে জুলাইয়ে
লিখিত ঈষৎ দীর্ঘ চিঠিতে তাঁর বিগত মাসাধিক কালের সামরিক গতিবিধি এবং বিপ্লবী সেনাবাহিনীর
শৌর্যের বর্ণনা আছে। শেষে তিনি লিখছেন, “যদি একবারটি নিশ্চিত হতে পারতাম যে মার্ক্স” [গ্রেপ্তার হয়নি] “মুক্ত অবস্থায় আছে! মাঝেমধ্যেই ভাবি যে প্রুশীয়
গুলিগোলার মাঝে আমার অবস্থান, জার্মানিতে থাকা অন্যান্যদের বা বিশেষ করে প্যারিসে থাকা
মার্ক্সের চেয়ে কম বিপজ্জনক ছিল। সত্বর আমার অনিশ্চিতি দূর করো।” জবাব পাওয়া যাচ্ছে ১৭ই আগস্টের। মার্ক্স লিখছেন,
“জানি না প্রথম চিঠিটা
পেলে কিনা, … আমি আবার লিখছি
আমার স্ত্রী এবং আমি তোমাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ছিলাম এবং তোমার খবর পাওয়ার পর খুব খুশি
হলাম।”
ভেভের শিবিরে থাকাকালীন এবং আশেপাশে ঘোরার
সময় বিভিন্ন ধরণের জার্মান অভিবাসীর সঙ্গে দেখা করার এবং বিপ্লবের অসফল হওয়ার কারণগুলো
মূর্তরূপে দেখার ও পরখ করার সুযোগ পেলেন এঙ্গেলস। পাতি-পূঁজিবাদী গণতন্ত্রীদের বাচাল
দম্ভ, নিজেদের শক্তি বেশি করে এবং শত্রুর শক্তি কম করে দেখার প্রবৃত্তি, অতিবিপ্লবীপনা
আর হতাশার মাঝে দোদুল্যমান থাকার অভ্যেস, অসফলতার প্রধান কারণগুলো খোঁজার বদলে একে
অন্যের সামরিক কার্যকলাপে ভুল খুঁজে বেড়ানো …। হ্যাঁ, কিন্তু এই শেষ অভিযোগটা – ভুল, অনুশাসনে ত্রুটি, সৈনিক-কর্তব্যবোধের
অভাব ইত্যাদি – যদি তাঁর ইউনিটের
ওপরে আসত, তখন তিনি নিজের ইউনিটের পক্ষ সমর্থনে নেমে পড়তেন।
জুলাইয়ের শেষে বিষয়টা নিয়ে একটা প্রবন্ধও লিখে
ফেললেন, ‘অস্বীকার’, যাতে তিনি প্রমাণিত করলেন যে তাঁর ইউনিট
শেষ পর্য্যন্ত নিজের বিপ্লবী কর্তব্য সম্পন্ন করেছিল। প্রবন্ধটি ছাপা হয় নি কোথাও কিন্তু
লেখার পর এঙ্গেলসের মনে হল পুরো বিপ্লবী অভিযানটা নিয়ে একটি পুস্তিকা লেখা উচিৎ। মার্ক্সও
প্যারিস থেকে লেখা চিঠিগুলোয় সে কাজটাই করতে তাঁকে উৎসাহিত করছিলেন। কিন্তু শিবিরের
পরিবেশ এমন ছিল, আশেপাশের মানুষজন আর সাহসী এবং দক্ষ সৈনিক হওয়া সত্ত্বেও খোদ ভারপ্রাপ্ত
উইলিচ, ভাবনাচিন্তায় এত পিছিয়ে ছিলেন যে এঙ্গেলস বিরক্ত হতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু
কোথাও যেতে পারছিলেন না কেননা পয়সা ছিল না।
সোভিয়েত রুশ প্রকাশিত এঙ্গেলসের জীবনীতে (উপরোক্ত)
লেখা আছে, আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর পরিবার থেকে কিছু পয়সা পাঠানো হয়েছিল। সে বইয়ে
লেখা নেই কে পাঠিয়েছিল। কিন্তু গুস্তাভ মেয়ার রচিত জীবনীতে এঙ্গেলসের ভগ্নীপতির (বোন
মেরির বর, এমিল ব্লাঁ-ই হবেন) পাঠানো একটি চিঠি উদ্ধৃত আছে। চিঠির ভাষা অতি নিম্নস্তরের,
কিন্তু পড়লে বোঝা যায় এঙ্গেলস পয়সা চেয়ে পাঠিয়েছিলেন, সে পয়সা দেয় নি। এঙ্গেলস যা কিছু
করছেন সেগুলোকে অশিক্ষিত মধ্যবিত্ত কূপমন্ডুকের ভাষায় ‘মানুষের উদ্ধার’এর জন্য করা ‘পণ্ডশ্রম’ বলে, চিঠিতে বাড়ি ফিরে আসতে বলা হয়েছিল এবং উপদেশ দেওয়া হয়েছিল
যে পয়সার জন্য তিনি বাবাকে লিখতে পারেন না তো মাকে লিখুন! যে এমিল ব্লাঁ-কে নিয়ে মেরির
বিয়ের আগে এঙ্গেলস এত উৎসাহিত ছিলেন যে ছেলেটি সমাজবাদী, তার এইরকম চিঠি পড়ে এঙ্গেলসের
মনের অবস্থা কেমন হয়ে থাকবে তা আঁচ করা যায়।
গুস্তাভ মেয়ার যথার্থ লিখেছেন, “এই ভাষাতেই অশিক্ষিতেরা এঙ্গেলসের মনে বিক্ষেপ
আনার চেষ্টা করত। কিন্তু এঙ্গেলসের মন বলত, ‘বিশ্ব নতুন যুগের প্রসব-বেদনায় পীড়িত’ – বছরের শুরুতে তিনি এই নতুন যুগকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। তাঁর মনে
হত এটাই ন্যায়সঙ্গত – যে সৃজনের ক্রিয়া
থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয় নি, তার তো ওই প্রসব-বেদনায় নিজের অংশ অবশ্যই পাওয়া উচিৎ!
প্রসন্ন হৃদয়ে তিনি কষ্টে অংশগ্রহণ করলেন কেননা তিনি অনুভব করলেন যে ভবিষ্যৎ তাঁর সঙ্গে
আছে।”
উপরোক্ত ঘটনাবলি থেকে একটা আভাস পাওয়া যায়
যে স্বামীর কথাবার্তায় তিনি আঁচ পেয়ে থাকবেন যে দাদার পয়সার দরকার আর মা বা বাবাকে
বলে পয়সা পাঠাবার ব্যবস্থা করে থাকবেন। এটা আন্দাজ করছি কেননা এর পরেও এমন প্রসঙ্গ
আছে যেখানে বোন মেরিই, পরিবারের সঙ্গে এঙ্গেলসের সম্পর্কের মাধ্যম হয়েছেন।
যাহোক, পয়সা পেয়েই এঙ্গেলস ভেভের শিবির ছেড়ে
লুসান পৌঁছোলেন এবং থাকার একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে নিজের পুস্তিকার ওপর কাজ করা শুরু
করলেন। পুস্তিকাটির নাম রাখলেন ‘বাদশাহী সংবিধানের জন্য জার্মান অভিযান’। ২৪শে আগস্ট নিজের বন্ধু জ্যাকব কুকাস শ্যাবেলিজকে
লিখলেন, “ … ব্যাডেন-প্যালেটিনেটের বিপ্লবী প্রহসনের বিষয়ে
নিজের স্মৃতিকথা লিখছি। … তুমি জানো যে আমি
বাচাল দাম্ভিক প্রজাতন্ত্রীদের বিভ্রমে থাকব না আর ওই প্রধানদের বাচালতার পিছনে লুকিয়ে
থাকা কাপুরুষতা দেখে নেব – সেটুকুর জন্য আমি
পর্যাপ্ত সমালোচক। ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর যোগ্য আমার প্রবন্ধটি অন্যান্য স্মৃতিকথা
থেকে আলাদা; পুরো গল্পটাকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণে পেশ করবে।”
যদিও, এ পুস্তিকাও কোথাও প্রকাশিত হতে পারল
না। জার্মানিতে হোক বা সুইটজারল্যান্ডে, ‘লীগ’এর সদস্য হোক বা
অন্য কোনো পুরোনো বন্ধু, কেউ এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করার অবস্থায় ছিল না।
সুইটজারল্যান্ডে একরকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলা
লোকেদের সঙ্গে এঙ্গেলস সম্পর্ক পাতিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। একবার বার্ন গেলেন। তখন
উইলহেল্ম উল্ফ এবং ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হল।
জেনেভায় প্রথম উইলহেল্ম লিবনেখটের সঙ্গে দেখা হল। পরে আজীবন তিনি বন্ধু ছিলেন। লিবনেখট
পরে এই প্রথম সাক্ষাতের একটি চমৎকার স্মৃতির কথা লিখেছেন, “ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের মাথাটা যা ছিল পরিষ্কার আর উজ্জ্বল। সবরকম রোমান্টিকতা এবং
ভাবপ্রবণতার কুয়াশা থেকে মুক্ত … পরিষ্কার উজ্জ্বল চোখ যা পৃষ্ঠদেশে না দাঁড়িয়ে, বস্তুগুলোকে বিদ্ধ
করে তলদেশ অব্দি দেখত … আমার ভিতরে তখনি
এসেছিল এই কথাটা যখন প্রথমবার আমাদের দেখা হয়েছিল … রাইখ সংবিধান অভিযানের অসফলতার পর জেনেভার হ্রদের ধারে ১৮৪৯
সালের গ্রীষ্মের শেষ দিনগুলোয় আমরা বেশ কিছু অভিবাসী কলোনি বানিয়েছিলাম … তার আগে নানা ধরণের বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে
ব্যক্তিগত ভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, যেমন রুজ, হেইঞ্জেন, জুলিয়াস ফ্রোবেল,
স্ট্রুভ … ব্যাডেন ও স্যাক্সনি
‘বিপ্লব’এ শামিল জনগণের আরো বেশ কয়েকজন নেতা, কিন্তু
আমার পরিচয়ের ঘনিষ্ঠতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার নজরে তাদের দীপ্তি ম্লান হতে থাকল … হাওয়ায় যত বেশি কুয়াশা থাকে ততই বস্তু আর
মানুষ বড় হয়ে দেখা দেয়। ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের গুণ ছিল যে স্পষ্ট দৃষ্টিসম্পন্ন তাঁর চোখের
সামনে কুয়াশা অদৃশ্য হয়ে যেত এবং বস্তু ও মানুষ তেমন রূপেই দেখা দিত যেমন হয় বস্তু
ও মানুষ। ঐ বিঁধে যাওয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং ফলে ভেদকারক নিষ্পত্তি প্রথম প্রথম আমায়
অস্বস্তিতে ফেলে দিত। কখনো কখনো আহত করত … সবসময় তাড়াতাড়ি না হয়ে থাকলেও … ব্যক্তি ও বস্তু নিয়ে আমাদের অভিমতে ঐক্যের জন্য … আমার ঐ ‘দক্ষিণ-জার্মান হাল-ছেড়ে-দেওয়া ভাব’ কখনো বাধা হয়ে ওঠে নি …”
ওদিকে প্যারিসে সপরিবারে মার্ক্স হয়রানির মধ্যে
ছিলেন। জুন মাসে গণতন্ত্রীদের একটি দলের বিরোধ-সমাবেশের পর ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়াশীল
সরকারের দমনমূলক কার্যকলাপ বেড়ে গেল। ১৯শে জুলাই মার্ক্সকে আদেশ দেওয়া হল যে তিনি যেন
অবিলম্বে প্যারিস ছেড়ে মর্বিহানে চলে যান। মর্বিহান পশ্চিমোত্তর ফ্রান্সের, জলাভূমি
ভরা একটি অস্বাস্থ্যকর জায়গা। এক প্রকারে সরকারের এ আদেশ ছিল বিপ্লবীদের যাতায়াতের
সুবিধাহীন অস্বাস্থ্যকর জায়গায় পাঠিয়ে মেরে ফেলার চক্রান্তের মত। মার্ক্স ফ্রান্স ছাড়ার
সিদ্ধান্ত নিলেন। সুইটজারল্যান্ডের পাসপোর্ট উনি পেতেনও না আর আগে থেকে সেখানে বসবাস
করা অভিবাসী জার্মান বিপ্লবীরা কদ্দিন থাকতে পারবেন সেটা ভাবার বিষয় ছিল। তাই ২৪শে
আগস্ট তিনি, স্ত্রী জেনি আর বাচ্চাদের প্যারিসে ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি দিলেন এবং লন্ডন
পৌঁছে গেলেন। এক দিন আগে লেখা চিঠিতে তিনি এঙ্গেলসকে জানিয়ে দিলেন যে পরিবারকে প্যারিসে
রেখে তিনি লন্ডনে যাচ্ছেন। এঙ্গেলসকেও লন্ডনে চলে আসতে বললেন।
“লন্ডনে একটি জার্মান
খবরের কাগজ শুরু করতে পারার ইতিবাচক সম্ভাবনা আছে। আবশ্যক তহবিলের একটা অংশের প্রাপ্তি
সম্পর্কে আমায় আশ্বস্ত করা হয়েছে।
“কাজেই তুমি এক্ষুনি
লন্ডনে আসার জন্য রওনা হয়ে পড়। এখানে এলে তুমি সুরক্ষিতও থাকবে। প্রুশীয়রা তোমার ওপর
দু’বার গুলি দাগবে,
(১) ব্যাডেনের জন্য; (২) এলবারফেল্ডের জন্য। আর, সুইটজারল্যান্ডে, যেখানে কিছু করতেও
পারবে না, পড়েই বা কেন থাকবে?
“লন্ডনে আসতে তোমার
কোনো অসুবিধে হবে না, সে এঙ্গেলস নামে হোক বা মেয়র নামে। যেই তুমি বলবে যে লন্ডনে যেতে
চাইছ, ফরাসি দূতাবাস থেকে লন্ডন যাওয়ার একতরফা পাসপোর্ট পাবে।
“আমি পুরোপুরি তোমার
লন্ডনে আসার ওপর ভরসা করছি। তুমি সুইটজারল্যান্ডে থাকতেই পারবে না। লন্ডনে আমরা কাজে
লেগে পড়ব। ……
“পুনর্বার, আমি এ
ব্যাপারে আশ্বস্ত হয়ে যে তুমি আমায় মাঝদরিয়ায় ছেড়ে দেবে না, তোমার আসার অপেক্ষা করছি।”
চিঠি পেয়ে এঙ্গেলসও স্থির করলেন তিনি ইংল্যান্ড
যাবেন। কিন্তু জার্মানি বা ফ্রান্সের সীমান্তে পৌঁছোলেই তাঁর গ্রেপ্তার হওয়া অবধারিত
ছিল । একমাত্র পথ ইতালির জেনোয়া বন্দর হয়ে। কিন্তু তার জন্য তাঁকে পিডেমন্ট শহরের সীমানা
পার করতে হত। তাই করলেন। পিডেমন্ট পুলিসের নজর বাঁচিয়ে তিনি অক্টোবরের শুরুতে জেনোয়া
পৌঁছোলেন। একটা ইংরেজ স্কুনারে (দুই মাস্তুলের পালতোলা ছোট জাহাজ) ৬ই অক্টোবর সাগরপথে
লন্ডন রওনা হলেন।
ইংল্যান্ডের তীরে পৌঁছোতে পাঁচ সপ্তাহ লাগল। এই পাঁচ সপ্তাহ তিনি নৌ-পরিবহন সম্পর্কে নিজের জ্ঞান বাড়ালেন। তাঁর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিগুলোয় ঐ সময়ের একটি ডাইরি আছে যাতে সূর্যের অবস্থান, হাওয়ার দিশা, সমুদ্রের অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে মন্তব্য আছে এবং পার হওয়া তটরেখাগুলোর রেখাচিত্র আছে।
লন্ডনে এক বছরঃ স্বতন্ত্র সর্বহারা বিপ্লবী
পার্টি নির্মাণ-প্রচেষ্টা
লন্ডনে আসার পর ১৮৪৯এর সেপ্টেম্বরে মার্ক্স
‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর অব্যবস্থিত অবস্থায় পড়ে থাকা কেন্দ্রীয়
সমিতিটার পুনর্গঠন করেছিলেন। এঙ্গেলস যেই চলে এলেন, তাঁকেও সমিতির অন্তর্ভুক্ত করে
নেওয়া হল। খুব শিগগিরই ‘লীগ’এর পুরোনো সাথীরা এই দুজনের সঙ্গী হয়ে উঠলেন।
কয়েকজন নতুন সাথীও, যেমন অগাস্ট উইলিচ, যাঁর সহকারী হয়ে এঙ্গেলস ব্যাডেন-প্যালেটিনেট
অভিযানের কমান্ডে ছিলেন, অথবা উইলহেল্ম লিবনেখট, যাঁর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল জেনেভায়,
‘লীগ’এ চলে এলেন।
একসঙ্গে হওয়ার পর মার্ক্স-এঙ্গেলস জার্মান
অভিবাসী, উদ্বাস্তু এবং নির্বাসিতদের সংগঠনগুলোতেও যোগ দিলেন এবং অনেক কাজ করলেন সেসব
সংগঠনগুলোর। সংগঠনগুলোর জন্য এঙ্গেলস জার্মানি এবং অন্যান্য দেশগুলোয় ছড়িয়ে থাকা নিজের
বন্ধুদেরকে দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করিয়ে আনালেন। সংগঠনগুলোয় পাতি-পূঁজিবাদী বিপ্লবীদের ভালো
প্রভাব ছিল। পাতি-পূঁজিবাদী ভাবধারার প্রভাব থেকে মুক্ত না করে সবাইকে সর্বহারা বিপ্লবী
মতাদর্শে যোগ করা এবং ভবিষ্যতে জার্মানির একটি স্বতন্ত্র সর্বহারা পার্টি গঠন করা সম্ভব
ছিল না। এই সংগ্রামে তাঁদের অনেক মিথ্যে অভিযোগেরও জবাব দিতে হল। কাজও করতে হল নতুন
নতুন। যেমন ‘জার্মান শিক্ষা সমিতি’কে বাঁচানোর জন্য তার মধ্যে তাঁরা ‘সামাজিক গণতন্ত্রী সমিতি’ গঠন করলেন, তাঁদেরকে অভিযুক্ত করা হল যে তাঁরা
শুধু কম্যুনিস্টদেরই সাহায্য করেন, এবং তহবিলের ব্যায়ে অনিয়ম হয়েছে। তার জবাবে ‘সামাজিক গণতন্ত্রী সমিতি’ পুরো হিসাব প্রকাশ করল এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করল যে সমিতির সদস্যেরা তহবিল থেকে কিছু পাবে না। যেহেতু অভাবগ্রস্ত শ্রমিক বিপ্লবী
উদ্বাস্তুদের সাহায্য করার মত তহবিল সংগৃহীত হয়ে আসছিল না, মার্ক্স-এঙ্গেলসের নেতৃত্বে
‘সামাজিক গণতন্ত্রী
সমিতি’র তরফ থেকে সামূহিক
রাত্রি-আবাস, সামূহিক ভোজনশালা, এমনকি বেকারদের জন্য কর্মশালাও চালানো হল।
এঙ্গেলসের কার্যকলাপ এটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল
না। শ্রমিকদের, লন্ডনে হওয়া আন্তর্জাতিক জমায়েতগুলোতেও এঙ্গেলস নিয়মিত যেতেন এবং ভাষণ
দিতেন। চার্টিস্টদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আগে থেকেই ভালো ছিল। ডিসেম্বর ১৮৪৯ থেকে আগস্ট
১৮৫০ অব্দি, চার্টিস্টদের মুখপত্র ‘ডেমোক্র্যাটিক রিভিউ’এ এঙ্গেলসের দুটো অস্বাক্ষরিত প্রবন্ধমালা ছাপল – ‘ফ্রান্সের চিঠি’ আর ‘জার্মানির চিঠি’। মার্ক্স রচিত ‘ফ্রান্সে শ্রেণীসংগ্রাম’এর প্রথম অধ্যায়ের এঙ্গেলস কৃত ‘সংক্ষিপ্তসার’ও ঐ পত্রিকাতেই ছাপল।
এসব কাজের মধ্যেই, মার্ক্স যেমন এঙ্গেলসকে
সুইটজারল্যান্ডে লিখেছিলেন, নতুন পত্রিকা প্রকাশনের প্রস্তুতিও চলছিল। ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর বিপ্লবী উত্তরাধিকারকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য
নতুন পত্রিকার নাম হল ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং
পলিটিশ্-একোনমিশ রেভ্যু’। আশা করছিলেন পত্রিকাটি
আগামী দিনে দৈনিক হবে।
পত্রিকার ঘোষণায় স্পষ্টতঃ লেখা হল যে এতে,
“সেই আর্থিক সম্পর্কগুলোর
বিস্তারিত এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থাকবে যেগুলো সব রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিত্তি।” এটাও লেখা হল যে ওপর ওপর শান্ত মনে হওয়া এই
সময়টার ব্যবহার, “বিপ্লবের চলে যাওয়া
সময়কালের ব্যাখ্যায়, যুযুধান পক্ষগুলোর চরিত্রের ব্যাখ্যায় এবং সেই সামাজিক সম্পর্কগুলোর
ব্যাখ্যায়” হওয়া উচিৎ “যে সম্পর্ক ঐ যুযুধান পক্ষগুলোর অস্তিত্ব এবং
সংগ্রামসমূহকে নির্ধারিত করে।”
তাঁদের কাছে পয়সা ছিল না। উইলহেল্ম উল্ফ, জর্জ
এক্যারিয়াস, ওয়েডেমেয়ার, ফ্রেইলিগ্রাথ ইত্যাদি পুরোনো বন্ধুরা মিলে সাহায্য করলেন।
প্রকাশনার স্থান হিসেবে লন্ডন এবং হামবুর্গ (জার্মানি)র সঙ্গে নিউইয়র্ক (আমেরিকা)রও
নাম ছাপা হত কেননা অনেক জার্মান বিপ্লবী উদ্বাস্তু আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন – আশা করা হল যে তাঁদের সাহায্যে পত্রিকা সেখানেও
বিতরিত হবে।
পত্রিকার মোট ছয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হতে পারল।
তার মধ্যেও পঞ্চম এবং ষষ্ঠ যুগ্ম সংখ্যা ছিল। সেটি প্রকাশিত হল ১৮৫০এর নভেম্বরের শেষে।
পত্রিকার পর্যালোচনামূলক মন্তব্যে আলোচিত হল যে পূঁজিবাদের সঙ্কটের সময় আপাততঃ অতীত,
পূঁজিবাদী সমাজের উৎপাদক শক্তিগুলো এই পূঁজিবাদী সম্পর্কগুলোর ভিতরেই যথাসম্ভব পুরোদস্তুর
বিকশিত হয়ে চলেছে। তাই এখন সময় নিজেদের শক্তিগুলোকে একত্র করার, আগামী দিনের বৈপ্লবিক
সময়ের জন্য তাদেরকে প্রস্তুত করার, নিজেদের রণকৌশল সময়ানুযায়ী সংশোধন করার। এই মন্তব্যের
জন্য মার্ক্স এবং এঙ্গেলসকে তাঁদের ঘনিষ্ঠতম সাথীদেরও সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিল। কেননা
তাঁরা জার্মানিতে অবিলম্বে আবার একটি বিপ্লবী জোয়ার তোলার সম্ভাবনা খুঁজছিলেন।
এই পত্রিকায় এঙ্গেলসের দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ
প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম, ‘জার্মান বাদশাহী
সংবিধানের জন্য অভিযান’ যার অধিকাংশ তিনি
সুইটজারল্যান্ডের লুসান শহরে বসে লিখেছিলেন এবং দ্বিতীয়, ‘জার্মানিতে কৃষক-যুদ্ধ’। দ্বিতীয়টি আজও মার্ক্সবাদের কালজয়ী রচনা
হিসেবে পঠিত হয়।
প্রথম প্রবন্ধের খুব প্রশংসা হল বিশেষ করে
তার জীবন্ত এবং আকর্ষণীয় বর্ণনার জন্য। বিপ্লবী গতিবিধিতে থাকুক বা না থাকুক, সংবিধানের
পক্ষে থাকা প্রতিটি শ্রেণীর বস্তুগত বিশ্লেষণ ছিল। দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির বিভিন্ন
অঞ্চলে বিপ্লবী কার্যকলাপের বর্ণনা ছিল – ব্যারিকেডের ওপর লড়াই, অস্ত্রসজ্জিত দলগুলোর মার্চ … – কিন্তু শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে। আর তাই, পরিচিতদের অনেকে রেগেও
গিয়েছিলেন ভীষণ, কেননা পাতি-পূঁজিবাদী মনোভাবের তীব্র সমালোচনা ছিল। এ ছাড়া পুরো জার্মানির
প্রধান শহর এবং রাজধানীর সাধারণ পরিস্থিতিরও বর্ণনা ছিল প্রবন্ধটিতে।
দ্বিতীয় প্রবন্ধটি এখন বইয়ের আকারে পাওয়া যায়।
নিজের সময়ের বিপ্লবের অসফলতার কারণ খুঁজতে খুঁজতেই লেখক ১৬শ শতকে পৌঁছেছিলেন কিন্তু
লেখার সময় তৎকালীন ধার্মিক পুনর্গঠনের ঘটনাটিকে ‘ধর্মশাস্ত্রীয় কলহ’এর প্রচলিত ধারণা থেকে বাইরে এনে তিনি ঐ কলহের শ্রেণীগত শিকড় চেনালেন
এবং ঘটনাটিকে কৃষক-যুদ্ধের পটভূমিতে আনলেন। একই সঙ্গে ঐ যুদ্ধকে তিনি জার্মানির প্রথম
পূঁজিবাদী বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করলেন। অসফলতার কারণগুলো তিনি তাঁর সমকালীন পূঁজিবাদীদের
দোদূল্যমান ভূমিকার মত তাদের পূর্বপুরুষ, মধ্যযুগের সম্পদশালী নগরবাসীদের দোদূল্যমান
ভূমিকায় দেখালেন। অত আগের বিপ্লবের চরিত্র যে পূঁজিবাদী হতে পারল, সেটা ঐ নগরবাসীদের
থাকার কারণে নয়, কৃষকদের দাবি সামন্ত-বিরোধী হওয়ার কারণে। প্রবন্ধটি নিজের সময়ের বিপ্লবকে
একটি জাতীয় ধারার সঙ্গে জুড়ল, আধুনিক সর্বহারাকে একটি বিপ্লবী উত্তরাধিকারের সঙ্গে
জুড়ল, এবং আগামী দিনে, সমাজবাদী বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক ও কৃষকের বন্ধুত্বের
ধারণাটিকে সম্ভাবিত করল।
এই পত্রিকাতেই মার্ক্সের সুপরিচিত প্রবন্ধ
‘ফ্রান্সে শ্রেণীসংগ্রাম
১৮৪৮-৪৯’ প্রকাশিত হয়েছিল।
উপরোক্ত দীর্ঘ প্রবন্ধ বাদে ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং পলিটিশ্-একোনমিশ রেভ্যু’এ আগে থেকে চলতে থাকা লড়াইগুলোরও ধারাবাহিকতা
ছিল। দুজনে বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং পুস্তিকার সমীক্ষা লিখতেন। তিনটে দিক থাকতো সে সমীক্ষাগুলোর।
বিগত বিপ্লবের বিশ্লেষণ বা অন্যান্য ভাবনার মাধ্যমে পাতি-পূঁজিবাদীদের শ্রেণীগত প্রভাব
বাড়াবার চেষ্টার ওপর আঘাত; কাছের লোক হোক বা দূরের, চক্রান্তধর্মী এবং মৌলবাদী গতিবিধির
তীব্র সমালোচনা; গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠিত বিদ্বানদের (যেমন টমাস কার্লাইল, খ্যাতনামা
ঐতিহাসিক) পূঁজিবাদের প্রতি এবং বিপরীতে জনগণের বিপ্লবী ক্রোধের প্রতি বদলাতে থাকা
মনোভাবের পর্দা ফাঁস।
এই সব ভাবধারাগত সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবে
ঐসব নেতৃত্বের প্রভাব থেকে আলাদা একটি সর্বহারা পার্টি গঠন করার আবশ্যকতা আগে থেকেই
বিদ্যমান ছিল। তার জন্য ‘কম্যুনিস্ট লীগ’কে পুনর্গঠিত করা দরকার। জার্মানির বিভিন্ন
শহরে এবং বিভিন্ন দেশে নিবাসী জার্মান রাজনৈতিক উদ্বাস্তুদের মাঝে সেই বার্তা নিয়ে
যাওয়ার জন্য এক বার্তাবাহকের প্রয়োজন। বার্তা হিসেবে মার্ক্স-এঙেলস লিখলেন ‘কম্যুনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্বোধন’। এই সম্বোধন এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। পাঁচটি
বিষয়বিন্দু আগামী দিনের মতাদর্শগত বিতর্কের অক্ষ তৈরি করল। (১) ১৮৪৮-৪৯ সালের বিপ্লবের
সময়কাল পার হয়ে গেছে; আসন্ন বিপ্লবের জন্য এখন মতাদর্শগত, সংগঠনগত প্রস্তুতির সময় তাই
সর্বহারার স্বতন্ত্র পার্টিনির্মাণ আশু কার্যভার। (২) তার জন্য ‘লীগ’এর সাথীদের একজোট করতে হবে, নতুন নেতৃত্বের নির্মাণ করতে হবে, এবং
ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে তার জন্য সবচেয়ে ভালো ভাবধারাগত ভিত্তি প্রদান করবে ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’। (৩) বিগত বিপ্লবে উদারপম্থী পূঁজিবাদীরা
জনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীল
শক্তিগুলোর সঙ্গে শুধু যে হাত মিলিয়েছে তা নয়, রাষ্ট্রশক্তিই আবার তাদের হাতে ফিরিয়ে
দিয়েছে। (৪) বিগত বিপ্লবে যাদের মধ্যে বিপ্লবী ক্রোধ সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল, পাতি-পূঁজিবাদী
এবং ধনবান নগরবাসী, যারা এখন দেখতে প্রায় সমাজবাদীদের মত, আগামী দিনের বিপ্লবে তারাও
উদারপন্থী পূঁজিবাদীদের মত সর্বহারা এবং সাধারণ শ্রমজীবীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে,
বরং আরো বিপজ্জনক প্রমাণিত হবে। (৫) তাই, সর্বহারার স্বতন্ত্র পার্টি হবে, যে পার্টি
প্রজাতন্ত্র এবং গণতন্ত্র অর্জন করার সংগ্রামে পাতি-পূঁজিবাদীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ
করবে, বরং তার বেশি – তাদের ওঠানো বিষয়গুলোকে
বৈপ্লবিক পদ্ধতিতে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার লড়াই লড়বে, যত দূর সম্ভব নিজেদের বিষয়গুলোকে
এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং নিজেদের সমঝদারিকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা চালাবে; একই সঙ্গে,
নিজেদের স্বার্থগুলো রক্ষা করবে, নিজেদের দাবিগুলো অর্জন করার জন্য স্বতন্ত্র সংগ্রাম
চালিয়ে যাবে – সর্বহারা শ্রেণী
এবং তার স্বতন্ত্র পার্টির যুদ্ধ-ঘোষণা হবে, ‘স্থায়ী বিপ্লব’।
লন্ডন এবং পুরো ইংল্যান্ডে যত বৈঠক বা সভা
হত, সেসবে এঙ্গেলসই বেশি বলতেন কেননা তখনও মার্ক্সের ইংরেজি ভালো হয় নি। চার্টিস্ট
খবরের কাগজগুলোতে তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকার কারণে চার্টিস্ট নেতাদের ওপরও
তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব পড়ছিল, সেটা দেখা যেত কাগজগুলোয় প্রকাশিত অন্যান্য লেখায়।
‘কম্যুনিস্ট পার্টির
ঘোষণাপত্র’এর প্রথম ইংরেজি
অনুবাদ একজন চার্টিস্টই করেছিলেন। ১৮৫০এ প্রকাশিত সেই অনুবাদেই, অনুবাদক চার্টিস্ট
নেতা হার্নি ভূমিকায় প্রকাশ করেছিলেন যে এই গুরুত্বপূর্ণ দলিল রচনা করেছেন মার্ক্স
এবং এঙ্গেলস।
কিন্তু ‘লীগ’এর ভিতরে কলহ বাড়ছিল।
বিপ্লবের সময় পেরিয়ে গেছে এটা মানতে কয়েকজন তৈরি ছিলেন না। তাঁরা অবিলম্বে বিপ্লবী
সক্রিয়তা এবং তার জন্য সেই পুরোনো চক্রান্তধর্মী পথের পক্ষে ছিলেন। আলাদা করে সর্বহারা
পার্টি বানানোরও তাঁরা বিরোধিতা করছিলেন। ঐক্য ধরে রাখার সব চেষ্টা বিফলে গেল। লন্ডনের
বদলে জার্মানির কোলোন শহরে কেন্দ্রীয় সমিতি করলেন মার্ক্স-এঙ্গেলস যাতে তাঁদের পক্ষের
এবং বিরোধী পক্ষের, দুদলেরই প্রতিনিধিত্ব থাকে। বৈঠকে সংখ্যালঘু প্রমাণিত হয়েও বিরোধী
পক্ষ ‘লীগ’এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাজ করতে লাগল। বিভিন্ন
জার্মান উদ্বাস্তু সংগঠনে, যেখানে পাতি-পূঁজিবাদীদের আধিপত্য ছিল, মার্ক্স-এঙ্গেলসকে
বিচ্ছিন্ন করা শুরু হল। অবশেষে তাঁদের বাধ্য হয়ে পদক্ষেপ নিতে হল। এক সময়কার ঘনিষ্ঠ
সাথী উইলিচ আর শ্যাপারকে মার্ক্সের সুপারিশে নিষ্কাশিত করল কোলোনের কেন্দ্রীয় কমিটি।
ওদিকে ঐ বিরোধী দলটির অসাবধানতায় কিছু দলিল জার্মান পুলিস এবং লন্ডন পুলিসের হাতে চলে
এল। মার্ক্স-এঙ্গেলস পুলিসের নজরে চলে এলেন।
দুজনেরই মনে অধ্যয়ন করার ইচ্ছা। কিন্তু কিভাবে?
বাঁচা কঠিন হয়ে পড়ছে। লেখা এবং বই প্রকাশিত হওয়ার এবং তা থেকে কিছু উপার্জন হওয়ার সম্ভাবনা
প্রায় শূন্য। চার্টিস্ট বা সেধরণের খবরের কাগজ তো পয়সা দিতে পারে না। মার্ক্স এবং তাঁর
পরিবার অর্থকষ্টেই ছিলেন। এঙ্গেলস কয়েকটি ভাষা জানতেন এবং ভালো সাংবাদিক ছিলেন, তাই
পয়সা-দেওয়া খবরের কাগজগুলোতে লিখে কিছু উপার্জন করে নিতেন। একলা মানুষ। কিন্তু মার্ক্স
এবং মার্ক্সের পরিবারও তো তাঁর পরিবার! সাধারণ গরীব জার্মান উদ্বাস্তুদের শেষ অব্দি
যে ধরণের জীবনযাপন করতে হচ্ছে সে দুস্থতা থেকে মার্ক্সকে বাঁচাতে হবে, এঙ্গেলস ভাবতে
শুরু করেছিলেন। তার এখন অনেক কিছু করবার আছে নতুন! যে দুনিয়াটা আসছে তার জন্য। সেই
দুনিয়া যে আনবে সেই সামাজিক শক্তিটার জন্য! এঙ্গেলস জানতেনও না যে বার্লিন পুলিসের
অধ্যক্ষ হিঙ্কেল্ডেও, ১৮৫২র এপ্রিলে পাঠানো তার প্রতিবেদনে (নিজের বিচ্ছিরি ভাষাতেই
সই) লিখবে যে মার্ক্স আর এঙ্গেলসের পার্টি, অন্যান্য সব প্রবাসী দলগুলো থেকে যে “জ্ঞানে ও প্রাণে অনেক বেশি শক্তিশালী, তা প্রশ্নাতীত।
… মার্ক্স নিজে একজন
সুপরিচিত ব্যক্তি এবং সবাই জানে যে বাকি ভীড়ের মগজে যতটা বৌদ্ধিক শক্তি আছে, তার বেশি
ওর আঙুলের ডগায় আছে।”
এঙ্গেলসের পরিবারে তাদের বড় ছেলের খবর পৌঁছেই
যেত বিভিন্ন মাধ্যমে। এ খবরও তারা পেয়ে গেল যে ফ্রেডরিক আর্থিক সঙ্কটে আছে। জার্মানিতে
সে আসবে না। লন্ডনে থাকাও কঠিন হতে থাকবে। জীবনীলেখক গুস্তাভ মেয়ার বলেন যে মা, বাবার
স্বীকৃতি নিয়ে এঙ্গেলসের সবচেয়ে কাছের বোনটার মাধ্যমে বার্তা পাঠালেন যে ফ্রেডরিকের
লন্ডনে থাকা উচিৎ নয়। কেননা লন্ডন সব রাজনৈতিক নির্বাসিতদের মেলামেশার জায়গা। বরং সে
অন্য কোথাও চলে যাক।
“আমরা ভাবছি, আপাততঃ
কিছু দিনের জন্য তো তুমি পারিবারিক ব্যবসায় ঢুকতেই পারো, মন দিয়ে কাজ করবে, তোমার একটা
আয় সুনিশ্চিত হবে। যখনই নিজের পার্টির সাফল্যের যুক্তিপূর্ণ সুযোগ দেখবে, তখনই এই ব্যবসা
ছেড়ে নিজের পার্টির জন্য কাজে লেগে যেতে পারবে!”
এই চিঠি পাওয়ার আগেই এঙ্গেলস মনস্থির করে নিয়েছিলেন।
গুস্তাভ মেয়ার তো এমনটাও লেখেন যে “আবার বিপ্লবী কার্যকলাপ শুরু করতে যাতে অসুবিধা হয় সেই উদ্দেশ্যে
এঙ্গেলসের বাবা” এঙ্গেলসের জন্য
“কলকাতায় একটা কাজ
খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এঙ্গেলস বরং নিউইয়র্ক চলে যেতেন, কেননা তাহলে মার্ক্স
তাঁর সঙ্গে যেতেন। যাক, ভালো হল, দুটো পরিকল্পনাই বিফল হল।”
বোন মেরি লিখিত উপরোক্ত চিঠিতে কোনো স্পষ্ট
প্রস্তাব ছিল না যে এঙ্গেলস যেন ম্যাঞ্চেস্টারে অবস্থিত এর্মেন অ্যান্ড এঙ্গেলসেই যোগ
দেন। এঙ্গেলসেরও কোনো এমন চিঠি নেই যে তিনি মাত্র কিছুদিনের জন্য পারিবারিক ব্যবসায়
যোগ দেওয়ার শর্ত রাখছেন। কিন্তু প্রতীত হয় যে কোনো না কোনো মাধ্যমে এ ধরণের কথাবার্তা
হয়ে থাকবে, এবং কিছু শর্তও নির্ধারিত হয়ে থাকবে যার আভাস পরবর্তী ঘটনাক্রমে পাওয়া যায়।
১৮৫০ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি এঙ্গেলস ম্যাঞ্চেস্টারে
চলে গেলেন এবং এর্মেন অ্যান্ড এঙ্গেলসে একজন কেরানি হয়ে যোগ দিলেন। তাঁর যাওয়ার দু-চার
দিন পরেই ১৯শে নভেম্বরে, লন্ডনে মার্ক্স ও জেনির এক বছরের ছেলে হাইনরিখ গুইদোর মৃত্যু
হল হঠাৎ। পুরো পরিবার, শোকস্তব্ধ জেনি এবং মার্ক্স, এমন একটা সময়ে এঙ্গেলসের অনুপস্থিতি
অনুভব করছিলেন।
ম্যাঞ্চেস্টারে জীবন
মেরি বার্ন্স
আলাদা থাকা মার্ক্স এবং এঙ্গেলস দুজনের জন্যেই
কষ্টের ছিল। মতাদর্শগত নির্ভরতা তো ছিলই, ঘনিষ্ঠতার আবেগ জড়িয়ে ধরেছিল সে নির্ভরতা।
মার্ক্সের সন্তানেরাও অপেক্ষা করত কখন এঙ্গেলস আসবেন ম্যাঞ্চেস্টার থেকে এবং তাদেরকে
গল্প শোনাবেন। জেনিও চাইতেন যতক্ষণ সম্ভব এঙ্গেলস থাকুন, রোজকার দুস্থতায় হয়রান জীবন
থেকে কিছুক্ষণের জন্য মানসিক নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে – শিশুদের মন বদলাবে,মার্ক্সের অস্থিরতা কমবে আর জেনিও একজন সাচ্চা
বন্ধু পাবেন যার সঙ্গে প্রয়োজনে গেরস্থালির সমস্যাগুলো নিয়েও খোলাখুলি আলোচনা করা যায়।
মার্ক্স তো এঙ্গেলস এলেই প্রায় নিজের ঘরে বন্দী করে নিতে চাইতেন আর তারপর কথোপকথনের
তোড় শুরু হয়ে যেত। একসাথে কাজ করার পরিকল্পনা তৈরি হত, নিজেদের আধলেখা প্রবন্ধ বা মন্তব্য
দেখিয়ে অভিমত চাওয়া হত, সংগঠনগুলোর অবস্থা নিয়ে আলোচনা হত, সর্বহারা পার্টি নির্মাণের
সমস্যা আসত … কত কত বিষয় থাকত
কথা বলার! দুজনে বেড়াতে যেতেন রাস্তায়। ফিরে এসে বই আর পত্রপত্রিকার পাহাড়ে ভরা ঘরটায়
একে অন্যের বিপরীতে কোনাকুনি হাঁটতেন, যাতে হাঁটার জায়গাটা বেশি হয়। পুরোনো বন্ধু আর
চার্টিস্ট সাথীদের সঙ্গে দেখাও হয়ে যেত এঙ্গেলসের, লন্ডনে এলে।
কিন্তু থাকতে তো হত ম্যাঞ্চেস্টারেই। আর দিনভর
সেই কম্পানির দপ্তরে, এঙ্গেলসের ভাষায় ‘বেনিয়াগিরি’ করতে হত। তবে একটা ঘটনা ঘটেছিল। যে কারণে পরিবার-সম্পর্কিত জটিলতাগুলো
কম হয়েছিল। এঙ্গেলসের বাবা পুরোপুরি পেশাদার শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি একেবারেই
সহ্য করতে পারতেন না যে তাঁর কাজের জায়গায় কোনো কর্মচারি, সে হোক না তাঁর ছেলে, ঢিলেমি
করুক। তাঁর মাথায় যেহেতু বসে ছিল যে ছেলে বিপথে গেছে, তাই তাকে একেবারেই ভরসা করতেন
না। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে ম্যাঞ্চেস্টারের কারখানাতে ফ্রেডরিক অফিসে কাজের নামে
ফাঁকি দিয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে। ওদিকে ছেলের অভ্যাস ছিল যে কোনো কাজ, ইচ্ছেয় হাতে নেওয়া
হোক বা অনিচ্ছেয় ঘাড়ে এসে পড়ুক, একনিষ্ঠ মনোযোগ সহকারে করার। যখন মাথাটা স্থির করে
নিল যে এখন, বোধহয় এক দীর্ঘ সময়ের জন্য তাঁর, প্রতিদিন সকালে এই কাপড়ের কারখানার দপ্তরে
বসে হিসেব লেখাটাই আগামী বিপ্লবের স্বার্থে জরুরি, প্রথম দিন থেকেই তিনি কাজটা মন দিয়ে
করা শুরু করে দিলেন। কিছুদিন পর, কম্পানির অবস্থা-সংক্রান্ত কয়েকটি রিপোর্ট বাবাকে
পাঠালেন। সেই প্রতিবেদনগুলো দেখে বাবা অবাক হলেন এবং খুব খুশি হলেন। ছেলেকে চিঠিতে
যা লিখলেন তার সহজ অর্থ এখন আমি তোমার ওপর ভরসা করি যে তুমি আমার সঠিক প্রতিনিধি। আমি
চাই তুমি ওখানেই থাকো আর পারিবারিক ব্যবসার দেখাশোনা কর।
কয়েক মাস পর তিনি নিজেই ম্যাঞ্চেস্টারে আসার
পরিকল্পনা করলেন। মা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এঙ্গেলসকে লিখে পাঠালেন যে সে যেন যেটুকু দরকার
সেটুকুই বাবার সঙ্গে থাকে আর রাজনীতির কথা যেন একেবারেই না তোলে। এঙ্গেলস তাই করছিলেন
কিন্তু বাবা থামলে তবে তো! এঙ্গেলসের সামনেই প্রুশীয় সরকারের শাসনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ
হয়ে উঠলেন। এঙ্গেলস ভিতরের রাগ চেপে চুপচাপ বসে রইলেন। পরে মার্ক্সকে লিখলেন, “দুটো কথা বলতাম আর ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর দিকে তাকাতাম!
ব্যস, তাঁর মুখ বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু আমাদের সম্পর্কও চিরদিনের জন্য বরফ হয়ে যেত। … যদি আমার আয়ের ব্যবহারিক দিকটা না থাকত, তাহলে
এই সব ফালতু স্নেহ, মমতার সম্পর্কের বদলে তেমনই ঠাণ্ডা ব্যবসায়িক সম্পর্ক পছন্দ করতাম।”
আয়ের প্রসঙ্গটার গূঢ়ার্থ এই যে উনি ম্যাঞ্চেস্টারের
কম্পানিটায় কেরানি হয়ে বেতনের বিনিময়ে কাজ করে যেতে চাইছিলেন না। উনি চাইছিলেন তাঁকে
জার্মান অংশীদার কম্পানির প্রতিনিধি করা হোক। তাহলে নিজের কাজের জন্য তিনি বেশি সময়
পেতেন। সে প্রস্তাব বাবা পরে মেনে নিলেন। এঙ্গেলস মার্ক্সকে লিখলেন, “কমসে কম তিন বছরের জন্য উনি আমায় এখানে রাখতে
চান। … তিন বছরের জন্যও
আমি এখানে কোনো বন্ধনে নেই। আমার লেখা নিয়ে বা বিপ্লব শুরু হয়ে গেলেও আমার এখানে থাকা
নিয়ে কোনো বাধানিষেধ নেই। … প্রতিনিধিত্ব এবং
বিনোদন ব্যয়ের নামে প্রথম থেকেই উনি আমাকে বার্ষিক প্রায় তিনশো পাউন্ড দিতে রাজি হয়েছেন।” এঙ্গেলস জানতেন না যে তিন কেন, আঠেরো বছর
তাঁকে ম্যাঞ্চেস্টারে কাটাতে হবে।
ম্যাঞ্চেস্টারে এসেই এঙ্গেলস মেরি বার্ন্সের
সঙ্গে দেখা করেছিলেন। একদিকে জার্মানিতে প্রতিবিপ্লবের পর্ব, অন্যদিকে লন্ডনে আর্থিক
অভাবের কারণে দুই বন্ধুর একসাথে কাজ না করতে পারা, তৃতীয়তঃ এই অবস্থা যে অর্থ উপার্জনের
জন্য প্রতিদিনকার গোলামির সেই শিকলটাই পরা যেটা থেকে ভেবেছিলেন মুক্তি পেয়ে গেছেন আট
বছর আগে … এই কষ্ট, অবসন্নতা
আর একাকীত্বে তাঁর একমাত্র সহায় ছিল মেরির ভালোবাসা।
বন্ধু কার্ল মার্ক্স এবং তাঁর আচরণে একটা পার্থক্য
ছিল। মার্ক্সের পুরো ব্যক্তিত্বে, আবিষ্কৃত নতুন যুগদৃষ্টিটাকে বিকশিত করার, মূর্তরূপে
আনার অস্থিরতা ভরা থাকত সব সময়। সেটা না করতে পারলে যেন শিশুর মত অসহায় হয়ে পড়তেন।
বন্ধুকে খুঁজতে থাকতেন। তাঁর ডাকনাম ‘মুর’ শুধু চেহারার দিক
থেকে নয়, মনোভাবের দিক থেকেও যথাযথ ছিল। অন্যদিকে, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, যুদ্ধক্ষেত্রে
হোক বা লেখার টেবিলে, যে কাজটা ভেবেছেন সেটা করার সময় ঠিক তেমনভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন
যেমন মার্ক্স, মানসিক শক্তি ও দক্ষতায় বন্ধুরই মত শীতল থাকতেন, কিন্তু কোনো কারণে কর্মভার
থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য হলে, অস্থির না হয়ে শান্ত ও মুক্ত-চিত্ত থাকার চেষ্টা করতেন।
বিভিন্ন নতুন নতুন বিষয় পড়া, নতুন ভাষা শেখা, ঘুরে বেড়ানো, মানুষের সঙ্গে কথা বলা … এই সব ব্যস্ততায় থেকে কাউকে নিজের কষ্টের
দিকে চোখ ফেলতে দিতেন না। দু’বছর আগে প্যারিস থেকে সুইটজারল্যান্ড হেঁটে হেঁটে পাড়ি দেওয়ার সময়
মনের অবসন্নতা কাটাতে ঢুকে যেতেন গ্রাম্যজীবনে, ফূর্তিতে মেতে উঠতেন। মার্ক্স বন্ধুর
এই মনোভাবটা জানতেন। তাই চিঠিতে অনবরত ঢালতেন বন্ধুত্বের উষ্ণতায় ভরা শব্দ, আর লেখার
জন্য চাপ থাকত প্রতিটি চিঠিতে। সেই চিঠিগুলোর সাহায্যেই এঙ্গেলস নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন
আর কাজের জগতে ফিরে এসেছিলেন।
মেরি বার্ন্স একজন আইরিশ শ্রমিক ছিলেন। লেখাপড়া
শেখেন নি; এঙ্গেলসের জীবনীলেখকেরা বলেন যে অত্যধিক মদ খাওয়ারও অভ্যেস ছিল। কথাবার্তা
তথাকথিত ভদ্রজনোচিত ছিল না। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস দুজনেই জন্মসূত্রে পূঁজিবাদী ছিলেন
কিন্তু বিপ্লবী চিন্তাভাবনা এবং সর্বহারার বিপ্লবী সংগ্রামে যুক্ত থাকার মাধ্যমে সর্বহারার
সাথী হয়েছিলেন। মার্ক্সের স্ত্রী-ও জন্মসূত্রে পূঁজিবাদী ছিলেন। কিন্তু মেরি জন্মসূত্রে
সর্বহারা ছিলেন। কখনো কারখানায়, কখনো বাড়িতে কাজ করতেন, শ্রমিকদের পাড়ায় ভাড়ার ঘর নিয়ে
থাকতেন। শ্রমিকদের লড়াই এবং আইরিশ স্বাধীনতার প্রতি দায়বদ্ধ এক দৃঢ়সংকল্প বিপ্লবী এবং
স্বাভিমানী, মুক্ত চিন্তার নারী ছিলেন। এঙ্গেলসেরও মেরির এই মনোভাবটাই ভালো লেগেছিল।
আট-নয় বছর আগে যখন ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীর
অবস্থা’ লেখার জন্য তিনি
ম্যাঞ্চেস্টারের শ্রমিক পাড়ায় থাকা, শ্রমিকদের বোঝা শুরু করেছিলেন তখন থেকে মেরি তাঁর
সহচর। দুজনেই একে অপরকে ভালোবেসেছিলেন। মাঝে আরো একবার একসঙ্গে হয়েছিলেন যখন মার্ক্স-এঙ্গেলস
দুজনেই কয়েক সপ্তাহের জন্য চ্যাটহ্যাম গ্রন্থাগারে লেখাপড়া করতে এলেন। সেবার মেরি এঙ্গেলসের
সঙ্গে ব্রাসেলসেও গিয়েছিলেন। এবার এঙ্গেলস ম্যাঞ্চেস্টারে এসেই মেরির বাড়িটাকে নিজের
আশ্রয় বানিয়ে নিলেন।
বলতে গেলে তাঁর দুটো ঠিকানা হল। একটা ভাড়া
বাড়ি নিলেন মধ্যবিত্ত পাড়ায়। সেখানে তখন চলে আসতেন যখন ব্যবসা-সম্পর্কিত মানুষজনের
সঙ্গে দেখা করতে হত বা পরিবারের কেউ দেখা করতে আসত। একে বসে লেখালিখি করার জন্যেও চলে
আসতেন। বাকি সময় শ্রমিক পাড়ায় মেরি এবং তার বোন লিডিয়ার ঘরে থাকতেন। তাঁর এই বাড়িটার
কথাই ম্যাঞ্চেস্টারে তাঁর বিপ্লবী বন্ধুরা জানতেন। এঙ্গেলসের সঙ্গে দেখা করতে কথা বলতে
তাঁরা এখানেই আসতেন। মেরি ও লিডিয়াকে নিজেদের বন্ধু, কমরেড মনে করতেন তাই কোনো ধরণের
গোপন আলোচনায় তাদের উপস্থিতি বা অংশগ্রহণ বাধা সৃষ্টি করত না। মেরিকে তাঁরা শ্রীমতী
এঙ্গেলস রূপেই চিনতেন এবং সেভাবেই সম্বোধন করতেন। যদিও এঙ্গেলস এবং মেরি কখনও পূঁজিবাদী
নিয়মানুসারে ধার্মিক রীতিতে বিয়ে করেন নি। সেখানে খাওয়াদাওয়ার খরচও কম ছিল, সস্তা রুটি,
সস্তা মাংস, সস্তা মদ – সপ্তাহের শেষে বেশি
পয়সা বাঁচত পকেটে মার্ক্সকে পাঠানোর জন্য।
লন্ডনে শেষের মাসগুলোয় খুবই কষ্টে কেটেছিল।
‘ন্যু রাইনিশে জাইটুংঃ
পলিটিশ্-একোনমিশ রেভ্যু’ বন্ধ করতে হয়েছিল।
এঙ্গেলসের ম্যাঞ্চেস্টারে আসার পর আর্থিক অবস্থা একটু ভালো হল। কয়েক মাস পর, ১৮৫১ সালের
গ্রীষ্ম শুরু হতে হতে মার্ক্সের কাছে, ‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য চার্লস ডানার বার্তা এল। চার্লস ডানা নিজেও
আগে কল্পলৌকিক সমাজবাদী ছিলেন। ১৮৪৮ সালের জার্মান বিপ্লবের সময় তিনি কোলোন গিয়েছিলেন
এবং মার্ক্সের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বার্তায় তিনি মার্ক্সকে খবরের কাগজটির স্থায়ী লন্ডন
সংবাদদাতা হওয়ার প্রস্তাব দিলেন। অভাবের সংসারে মার্ক্সের জন্য প্রস্তাবটা ভালো ছিল।
কিন্তু দুটো সমস্যা ছিল – এক, তাঁর ইংরেজি
তখনও ভালো হয় নি আর দুই, ধীরে ধীরে অর্থশাস্ত্রের অধ্যয়নে ঢুকতে শুরু করেছিলেন। তবুও,
এঙ্গেলসের ভরসায় তিনি প্রস্তাবটা স্বীকার করে নিলেন। এঙ্গেলসকে অনুরোধ করলেন যাতে এঙ্গেলস
নিয়মিত ঐ খবরের কাগজের জন্য প্রবন্ধ, প্রতিবেদন ইত্যাদি লিখে পাঠান। নাম মার্ক্সের
থাকবে। দৈনন্দিনে অভাবের একটা সুরাহা হবে। চিঠিতে একটা বিষয়ও বললেন, জার্মানিতে বিপ্লব
এবং তারপর প্রতিবিপ্লবের পর্ব। এঙ্গেলস বিষয়টির জ্ঞাতা তো ছিলেনই। ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর পুরোনো সংখ্যা এবং অন্যান্য সামগ্রীও তাঁর
কাছে ছিল। কাজেই লেখা শুরু করে দিলেন।
আগস্ট ১৮৫১ থেকে সেপ্টেম্বর ১৮৫২ অব্দি ১৯টা
লেখা ‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এ ছাপল। স্থায়ী লন্ডন সংবাদদাতা রূপে পাঠানো
প্রতিটি লেখায় মার্ক্সের স্বাক্ষর থাকত। তাঁরই নামে ছাপত। পঁয়তাল্লিশ বছর পর যখন মার্ক্সের
ছোট মেয়ে ইলিয়ানর মার্ক্স-এভলিং ঐ ধারাবাহিক লেখাগুলোকে আলাদা একটা বই করে ছাপালেন,
তিনিও জানতেন না ওগুলো এঙ্গেলসের লেখা। মার্ক্সের নামেই সে বইয়ের জার্মান অনুবাদও ছাপা
হল। শেষে, ১৯১৩ সালে যখন মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের চিঠিপত্র প্রকাশিত হল, তখন জানা গেল
যে ঐ লেখাগুলো এবং তার পরেরও অনেক প্রবন্ধ, প্রতিবেদন বাস্তবে এঙ্গেলসের লেখা। ঐ উনিশটি
ধারাবাহিক লেখা এখন এঙ্গেলস লিখিত গ্রন্থ রূপে ‘জার্মানিতে বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব’ নামে প্রাপ্য।
‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এর সঙ্গে মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের সম্পর্ক আগস্ট
১৮৫১ থেকে মার্চ ১৮৬২ অব্দি প্রায় এগারো বছর ছিল। প্রথম প্রথম সবগুলো এঙ্গেলস হয় নিজে
লিখতেন নয়তো মার্ক্স জার্মানে লিখলে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিতেন। ১৮৫৩র জানুয়ারি থেকে
মার্ক্স নিজেও ইংরেজিতে লিখতে শুরু করলেন। তারপর থেকে আলাদা আলাদা বিষয়ে দুজনের লেখা,
কাগজটায় ছাপতে লাগল।
‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এ ১৮৫৩ সালের ৭ই এপ্রিল একটি গুরুত্বপূর্ণ
প্রবন্ধ ছেপেছিল। সেটির সংক্ষিপ্ত বিজ্ঞাপনে কাগজের তরফ থেকে “সংবাদদাতার অদ্বিতীয় ক্ষমতা”র প্রতি “সম্মান” ব্যক্ত করা হয়েছিল, লেখা হয়েছিল “মিস্টার মার্ক্সের নিজস্ব অনেক সুনিশ্চিত অভিমত
আছে, তার কয়েকটি মানতে আমরা কিছুতেই রাজি নই, কিন্তু যাঁরা তাঁর নিবন্ধ পড়বেন না, তাঁরা
বর্তমান ইয়োরোপীয় রাজনীতির বড় প্রশ্নসমূহ সম্পর্কিত তথ্যাদির সবচেয়ে শিক্ষাপ্রদ উৎসগুলোর
মধ্যে একটির উপেক্ষা করবেন।” এই প্রশংসাবাক্যগুলো মার্ক্সের উদ্দেশ্যে হলেও কৃতিত্ব এঙ্গেলসেরই।
১লা জুলাই ১৮৫৩য় চার্লস ডানাও মার্ক্সের স্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে তাঁর স্বামীর
লেখা, ‘ট্রিবিউন’এর মালিক এবং পাঠক, দু’তরফেই উৎকৃষ্ট বলে সমাদৃত। এ প্রশংসাও প্রধানতঃ
এঙ্গেলসেরই প্রাপ্য।
এগারো বছরে দুজনে আমেরিকার খবরের কাগজটায় অনেক
প্রবন্ধ/প্রতিবেদন লিখেছিলেন। মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্র অনুসারে তাঁদের লেখাগুলো “বিভিন্ন দেশের আন্তরিক নীতি, বিদেশ নীতি, শ্রমিক
শ্রেণীর আন্দোলন, ইয়োরোপীয় দেশগুলোর আর্থিক উন্নয়ন, ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ, উৎপীড়িত
ও পরাধীন দেশসমূহের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন” ইত্যাদি বিষয়ে হত।
যদিও সবাই জানেন, তবুও উল্লেখ্য যে এই রচনা-শৃংখলাতেই
১৮৫৭-৫৮ সালে বিশ্ব ভারতের বিষয়ে সেই আলেখ্য ও প্রতিবেদনগুলো পেল, যাতে প্রথম বার উনিশ
শতকের সবচেয়ে বড় সামরিক গতিবিধি, সমকালীন ভারতীয় যুদ্ধকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রাম’ নামে অভিহিত করা হল। ভারত-সম্পর্কিত
প্রতিবেদন-শৃংখলায় এঙ্গেলসের ছিল এগারটি যা পরে চেনা গেছে। এমনিতেও, বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে হতে থাকা সৈন্য-সংক্রান্ত ঘটনাবলীর
ওপর লিখতে হলে এঙ্গেলস অপরিহার্য ছিলেন।
ম্যাঞ্চেস্টারে, মার্ক্সের থেকে বিচ্ছিন্ন
সারা দিন বাণিজ্যিক দপ্তরে ব্যস্ত থেকে, বিকেলে বা সকালে ‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এর জন্য লেখা তৈরি করে সময় পেলে এঙ্গেলস অন্যান্য
ভাষা, বিশেষ করে রুশীয় ভাষা শিখতেন। মার্ক্সকে চিঠিতে লিখলেনও, যে আগামী বিপ্লবে পুরো
ইয়োরোপের ঘটনাবলি বোঝার জন্য এবং তাতে হস্তক্ষেপ করার জন্য ইয়োরোপের সবক’টি ভাষা শিখে নেওয়া দরকার। এসবের পরেও যেদিন
সময় পেতেন, প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়, বিশেষকরে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র,
জীববিজ্ঞান ইত্যাদি অধ্যয়নে রত থাকতেন।
অনেক বছর পর স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে ইলিয়ানর
মার্ক্স-এভলিং লিখেছিলেন, “ভাবতেও ভয়ানক যে
এঙ্গেলসের মত মানুষ কুড়িটা বছর ঐভাবে কাটিয়ে দিলেন! কখনো নালিশ করলেন না, মুখ থেকে
একটা শব্দ বেরুল না! বরং তার উল্টোটা দেখত সবাই। এত খোশমেজাজ এবং নিজের কাজে এমন ডুবে
থাকতেন যে মনে হত তাবৎ দুনিয়ায় ‘দোকানে যাওয়া’, আর দপ্তরে বসার মত কোনো কাজ নেই!”
লেনিন লেখেন, “যদি এঙ্গেলসের নিঃস্বার্থ আর্থিক সাহায্য অনবরত
না পেতেন তাহলে মার্ক্স ‘পূঁজি’ তো পুরো করতে পারতেনই না, অভাবে ভেঙে পড়তেন
পুরোপুরি।”
উদীয়মান বিশ্ব
বন্ধুত্বের এক অমর কাহিনীতে মার্ক্সবাদী বিশ্বদৃষ্টির
সৃজন ও যাপন। মার্ক্সের জন্য অবিলম্বে সমকালীন আর্থিক ব্যবস্থাটির গঠনে প্রবেশ করা
জরুরি ছিল। যাতে যে আর্থিক শোষণের ফলে পূঁজিবাদী সমৃদ্ধি সংঘটিত হয়ে চলেছে তার সারতত্ত্বটা
আবিষ্কার ও প্রকাশ করতে পারেন। সর্বহারা একটি শ্রেণী যার শোষণ করছে পূঁজিপতি সেটা তো
সবাই দেখতে পাচ্ছে। এটাও সবাই দেখতে পাচ্ছে যে সর্বহারা একটি বিপ্লবী শ্রেণী কেননা
বিগত সবক’টি পূঁজিবাদী বিপ্লবে
সে-ই অগ্রবর্তী দল হয়ে থেকেছে প্রতিটি রণাঙ্গনে। পরে, প্রতিবিপ্লবী পর্বে তার লড়ে-পাওয়া-হকগুলোও
যে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং একাজে সে শ্রেণীও রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গ দিয়েছে যারা কাল পর্য্যন্ত
বিপ্লবী ছিল – পাতি-পূঁজিবাদী
এবং প্রজাতন্ত্রী পূঁজিবাদী – সে প্রসঙ্গ বিষয়ান্তর। প্রশ্ন হল – কেন প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন প্রধান দাবিতে
– মুক্তি, সাম্য,
ভ্রাতৃত্ব – সর্বহারা না মুক্তি
পায়, না সাম্য না ভ্রাতৃত্ব? এই তিনটে দাবিই পতাকায় লিখে তো সে গুলিবিদ্ধ হচ্ছে বিভিন্ন
দেশে! যখন পণ্যের উৎপাদনে এবং পণ্যের বাণিজ্যে তৈরি হয় ‘জাতির সম্পদ’, বিনিময়ের সাধারণ নিয়মানুসারে সব কিছু নিজের
দামে বিক্রি হয় তাহলে কিভাবে , কোন কারখানায় সমৃদ্ধি আর দারিদ্র্যের উৎপত্তি হয়? কোন
বিনিময়ে সমৃদ্ধি দিলে বদলে নিতে হয় দারিদ্র্য? এত লড়াকু শ্রেণী! তবু কেন মজুরি বৃদ্ধির
লড়াইয়ে, কাজের ঘন্টা কম করার লড়াইয়ে জয়লাভ করেও কিছুদিনের মধ্যে তাদের দুস্থতা আগের
মতই হয়ে যায়?
যে বস্তুবাদী দৃষ্টি তাঁরা অর্জন করেছিলেন
সে দৃষ্টি শাসক/শোষক অথবা অন্য কারোরই ইচ্ছা/ষড়যন্ত্র ইত্যাদিকে চূড়ান্ত উত্তর হিসেবে
গ্রহণ করতে অপারগ ছিল; চাইছিল মূল কারণ হিসেবে কোনো বস্তুগত ঘটনার প্রকাশ।
পূঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালীর ভিত্তিতে ছিল সেই
বস্তুগত ঘটনা। সেটা খোঁজার জন্য প্রয়োজন ছিল বিরামহীন অধ্যয়ন, যা মার্ক্স করছিলেন বাড়িতে
কিম্বা ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রন্থাগারে বসে। ইংল্যান্ডের কারখানা-সম্পর্কিত সংসদীয়
দলিলপত্রের নোট নিচ্ছিলেন, পূঁজিবাদী অর্থশাস্ত্রী, অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো
এবং অন্যান্যদের পড়ছিলেন। অর্থশাস্ত্রের ছাত্র তিনি ছিলেন না। কিন্তু যে নতুন দর্শন
অর্জন করেছিলেন তার সম্পূর্ণ সার্থকতা ছিল সমাজের সর্বাধিক বিপ্লবী শক্তির হাতে বিপ্লবের
চাবিকাঠি দেওয়াতেই – যে কোন ঘটনাটার
ঘটা বন্ধ করতে হবে, কোন ঘটনাটার বন্ধ হওয়ার মধ্যেই সমাজের বাস্তবিক, মুক্তি, সাম্য
এবং ভ্রাতৃত্ব নিহিত।
মার্ক্সকে এ কাজের জন্য মুক্ত রাখতে হবে। রাখতে
হলে এঙ্গেলসকে সারাদিন, শ্রমিকদের দুস্থ জীবন দেওয়া সেই পূঁজিবাদী কারখানারই দপ্তরে
‘মালিকের ছেলে’ হয়ে থাকতে হবে। বাণিজ্য দেখতে হবে, হিসাব
দেখতে হবে, সুট-বুট পরে নিজের ‘ঘোষিত’ বাড়িটিতে অথবা ক্লাবে
পূঁজিবাদী বেরাদরদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে, শেয়ারবাজারে যেতে হবে, তুলোর বাজারে
বা জাহাজঘাটার নীলামে যেতে হবে। কেননা নিজের জীবনের চেয়ে বেশি বন্ধু মার্ক্স এবং তার
পুরো পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জন করতে হবে। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যে পূঁজিবাদী খবরের
কাগজের জন্যও লিখতে হবে, কেননা তাতে পয়সা আসবে।
এত সব করার পর এঙ্গেলস চলে যেতেন নিজের পরিবারে,
অর্থাৎ শ্রমিক পাড়ায় তাঁর ‘অঘোষিত’ বাড়িতে, মেরি আর লিডিয়ার কাছে। তাদের সঙ্গে
এবং মাঝেমধ্যেই আসা বন্ধুদের সঙ্গে বসে খেতেন সস্তা মদ আর কালো রুটি।
বস্তুতঃ, ‘ঘোষিত’ বাড়িতেও সস্তা মদ আর কালো রুটিই থাকত। বাবা অথবা পরিবারের অন্য
কারোর আসার খবর পেলেই দামি মদ, খাওয়াদাওয়ার কিছু দামি জিনিষ এনে সাজিয়ে রাখতেন। কেননা
এ কথাটা লুকোনোরও থাকত যে তাঁর আয়ের একটা বড় অংশ লন্ডনে বন্ধুর পরিবারের জীবনধারণের
খরচ মেটাতে চলে যায়। কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে খবর পেয়েছেন আগামী বেশ কয়েক মাস বাড়ি
থেকে কেউ আসবে না, আসার নেই। সঙ্গে সঙ্গে ‘ঘোষিত’ বাড়িটা ছেড়ে একটু
সস্তা পাড়ায় অন্য একটা ঘোষিত বাড়ি নিয়ে ফেলেছেন। বাবার আসার সময় হলে আবার এক মাসের
জন্য ফিরে গেছেন দামি পাড়ার কোনো ঘরে।
সন্ধ্যেয় মেরির ঘরে বসে গল্প শুনতেন বন্ধুদের,
সাথীদের। আইরিশ স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ইংরেজ বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যেকার সম্পর্কগুলো
তাদেরকে বোঝাতে গিয়ে নিজেও আরো ভালো করে জাতীয় আত্মনির্ধারণের বিষয়টা বুঝতে পারতেন।
ঐ আড্ডায়ই জুটতেন উইলহেল্ম উল্ফ এবং কয়েকজন পুরোনো সাথী। তাঁরাও সেসময় ম্যাঞ্চেস্টারেই
থাকতে শুরু করেছিলেন। এ ধরণের মানুষদের বৈঠকের ওপর পুলিসের গুপ্তচরদের নজর থাকত বলে
পৌরনিগমের রেজিস্টারে মেরি বার্ন্সের বাড়িতে থাকা পুরুষের নাম বদলে বদলে লেখানো হত।
দুই বন্ধুর আলাদা থাকা শুরু হওয়ার পর প্রথম
বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে এল অক্টোবর ১৮৫২র কোলোন মামলা। কোলোন মামলা প্রুশীয় সরকারের ষড়যন্ত্র
ছিল। উদ্দেশ্য ছিল (১) জার্মানির বিপ্লবী ব্যক্তিদেরকে গুপ্তচরদের দেওয়া সূচি অনুসারে
বেছে বেছে গ্রেপ্তার করা; (২) তাদের কাছ থেকে
তথ্য নিয়ে নিজের চরদের ছদ্মবেশে, রাজনৈতিক অভিবাসী বানিয়ে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’ এবং বিশেষ করে ‘লীগ’এর সেই দলে ঢোকানো, যেটার বিষয়ে খবর আছে যে তাদের পথ পুরোনো ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’এর চক্রান্তধর্মী গুপ্তসংগঠনের পথ। (৩) সেই
সব চরকে দিয়ে সেই দলের দপ্তরে নকল কাগজপত্র রাখানো যাতে আদালতে ‘প্রমাণ’ করা যায় যে কম্যুনিস্টদের এই বিপ্লবী সংগঠন জার্মানির সরকারের
বিরুদ্ধে সক্রিয় দেশদ্রোহীদের জমায়েত, যাদের নেতাদের মধ্যে প্রমুখ কার্ল মার্ক্স এবং
ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। (৪) এই ভিত্তিতে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, অন্যান্য দেশ এবং বিশেষ করে
ইংল্যান্ডের সরকারের কাছে আপীল করা যে তারা যেন তাদের দেশে আশ্রয় নেওয়া সব জার্মান
অভিবাসীদের হয় নিজেদের উপনিবেশগুলোয় পাঠিয়ে দেয় অথবা জার্মানিকে দিয়ে দেয়।
প্রুশীয় রাজতন্ত্র জানত যে এই বিপ্লবী অগ্রগামী
শক্তিকে একবার ধ্বংস করতে পারলে রাজতন্ত্রের সমাপ্তির দাবি তো স্তব্ধ হবেই, রাজতন্ত্রেরই
ভিতরে সংবিধান চাওয়া বিপক্ষও শূন্য হয়ে যাবে।
‘লীগ’এর কেন্দ্রীয় কমিটি সে সময় কোলোনেই অবস্থিত
ছিল। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস ইংল্যান্ড থেকে সে কমিটিকে পরামর্শ দিতেন। আদালতে মামলা সাজানোর
জন্য মে-জুন ১৮৫২য় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ‘লীগ’এর আরো কয়েকজন সদস্যকে
কোলোনে গ্রেপ্তার করা হল। ইংল্যান্ডে জার্মান গুপ্তচরেরা মার্ক্স-এঙ্গেলসের ওপর নজরদারী
বাড়িয়ে দিল। সবচেয়ে আগে এঙ্গেলসই মার্ক্সকে সাবধান করলেন, “নিজের কাগজপত্রগুলো বাড়ির বাইরে কোনো সুরক্ষিত
জায়গায় রাখো। কিছুদিন ধরে আমার ওপর খুব কাছ থেকে নজর রাখা হচ্ছে। এক পা এগোতেই দু-তিনটে
চর পিছু ধরে। এখানে আমাদের থাকতে দেওয়া যে কত বিপজ্জনক তার গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা ব্রিটেনের
সরকারের কাছে করতে বুনসেন মহাশয়” [ইংল্যান্ডে প্রুশিয়ার রাজদূত] “পেছোবেন না”।
কিন্তু ‘লীগ’এর কেন্দ্রীয় কমিটির
এবং অন্যান্য গ্রেপ্তার সদস্যদের বিরুদ্ধে ১৮ মাস জোরদার তদন্ত চালিয়েও, এবং নিজেদের
চরদের মাধ্যমে নকল কাগজপত্র রাখিয়েও প্রুশীয় প্রশাসন মার্ক্স, এঙ্গেলস এবং অন্যান্য
বিপ্লবী সাথীদের কোনো চক্রান্তে লিপ্ত থাকার প্রমাণ ইংরেজ সরকারকে দেখাতে পারল না।
মার্ক্স-এঙ্গেলস কোলোনে গ্রেপ্তার সাথীদের
সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন এবং প্রুশীয় সরকারের ষড়যন্ত্র ফাঁস করার চেষ্টা করছিলেন, যদিও
ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের অধিকাংশ পূঁজিবাদী খবরের কাগজ তাদের বক্তব্য ছাপতে অস্বীকার
করেছিল।
লন্ডনে মার্ক্সের বাড়ি একটা পুরোদস্তুর দপ্তরে
পরিণত হয়েছিল যেখানে পুলিসকৃত জালিয়াতি এবং আদালতের কার্যকলাপে হতে থাকা জোচ্চুরির
বিরুদ্ধে প্রমাণ একত্র করা হত। তারপর সে প্রমাণ জার্মানিতে, গ্রেপ্তার সাথীদের উকিলের
কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হত। সেসব দিনের কথা জেনি মার্ক্স লিখিত একটি চিঠিতে পাওয়া
যায়। এডলফ ক্লসকে লিখছেন, “আপনি কল্পনা করুন
যে ‘মার্ক্সের দল’ কিভাবে সক্রিয় রয়েছে দিনরাত! যতটা মাথা দিয়ে,
ততটাই তারা হাত আর পা দিয়েও কাজ করতে বাধ্য … পুলিসের সমস্ত অভিযোগ মিথ্যে … সমস্ত কিছু এত ভীতিজনক … জালিয়াতির সমস্ত প্রমাণ এখান থেকেই পাঠানোর ছিল … তারপর সমস্ত কাগজ ছয় বা আট কপিতে আঁকাবাঁকা
রাস্তায় কোলোন পাঠানোর ছিল …ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে, প্যারিস হয়ে, এমনি করে … এখন আমরা উইর্থ আর এঙ্গেলসের কাছ থেকে এক
গাদা বাণিজ্যিক ঠিকানা এবং নকল বাণিজ্যিক চিঠি পেয়েছি যেগুলোর ব্যবহার দলিল, চিঠি ইত্যাদি
পাঠাবার জন্য করতে হবে … আমাদের ফ্ল্যাটে
পুরো একটা দপ্তর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। দু’তিনজন লেখে, বাকি ক’জন এখানে ওখানে বার্তা পাঠাবার বা অন্যান্য কাজে দৌড়োতে থাকে। তারপর
যারা বাকি থাকে তারা খুঁটে খুঁটে পয়সা জোটায় যাতে লেখকেরা নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে
রাখতে পারে আর এই অভূতপূর্ব অত্যাচারের আমলাতান্ত্রিক দুনিয়ার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোটাতে
পারে।”
কয়েকটি অভিযোগ খারিজ করতে বাধ্য হল আদালত।
তবুও, এগারোজন অভিযুক্তদের মধ্যে থেকে সাতজনকে একটি দুর্গে বন্দী থাকার সাজা দেওয়া
হল। মার্ক্সের কথায়, কোলোন মামলার ওপর ‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এ যে প্রতিবেদনটি এঙ্গেলস লিখলেন, তাতে কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে করা
সমস্ত মিথ্যে অভিযোগ খণ্ডিত করে এঙ্গেলস বললেন যে কম্যুনিস্টদের উদ্দেশ্য ছিল, “সেই দলটি বাঁচিয়ে রাখা যার কেন্দ্র ছিল তারা।
একই সঙ্গে তাদের উদ্দেশ্য ছিল দলটাকে সেই শেষ, নির্ণায়ক সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করা
যে সংগ্রাম ইয়োরোপের ওপর থেকে নিশ্চিত শুধু ‘অত্যাচারী’, ‘স্বেচ্ছাচারী’ আর ‘লুটেরা’দেরই আধিপত্য শেষ
করবে না, তার থেকেও বড় এবং দুর্দান্ত, শ্রমের ওপর পূঁজির আধিপত্যও শেষ করবে।”
‘লীগ’এর শক্তি ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। কোলোনের কেন্দ্রীয়
কমিটির অধিকাংশই দন্ডিত, দুর্গে বন্দী। মার্ক্সেরই প্রস্তাবে লন্ডন জেলা কমিটি ১৭ই
নভেম্বর ১৮৫২য় ‘লীগ’কে ভঙ্গ করার ঘোষণা করল। এঙ্গেলস লিখলেন, “কোলোন মামলার সঙ্গে জার্মান কম্যুনিস্ট শ্রমিক
আন্দোলনের প্রথম পর্ব শেষ হল।”
‘লীগ’ ভঙ্গ হওয়ার পর বিপ্লবী সর্বহারা পার্টি বলতে
আর কিছু ছিল না। কিন্তু মানুষেরা ছিল। মুখে নিজেদেরকে খোলাখুলি মার্ক্সবাদের অনুগামী
না বললেও তাদের কথাবার্তায়, পত্রিকায় প্রকাশিত রচনায়, ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’এ প্রতিপাদিত সমাজের শ্রেণীদ্বন্দ্বমূলক বিশ্লেষণ,
আর্থিক প্রণালীর গুরুত্ব ইত্যাদি ব্যাপারগুলো আসতে শুরু করেছিল। এঙ্গেলস কোনো এক বন্ধুকে
লিখলেন, যাক, এবার আর পাতি-পূঁজিবাদী এবং নানা ধরণের প্রজাতন্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক
রাখতে হবে না। সংগঠন স্বতন্ত্র হবে, সর্বহারার হবে এবং ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’এর ভিত্তিতে হবে। কিন্তু তেমনটা হতে দেরি ছিল।
ইয়োরোপে বিপ্লবের জোয়ার দুজনের আশার বিপরীত,
উঠছিল না। আর্থিক সঙ্কটকে জনগণের কাঁধে চাপাতে সক্ষম নতুন বিশ্ববাজার প্রণালী কায়েম
হচ্ছিল। বিশ্ববাজার সম্প্রসারিত করার জন্য শুরু হচ্ছিল যুদ্ধ। একদিকে প্যারিসে বিশ্ব
বাণিজ্য মেলা পূঁজির উৎপাদক শক্তির জয় ঘোষণা করছিল অন্যদিকে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে সেই পূঁজিই
ধ্বংসাত্মক শক্তি নিয়ে, রুশীয় জারতন্ত্র এবং অটোমান সাম্রাজ্যের পারস্পরিক কলহে, বাজার-বিস্তারের
সম্ভাবনা দেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এই যুদ্ধের বিষয়ে কথা বলতে বলতে
এবং ‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এর জন্য লেখা তৈরি করতে করতে নিজেদের মতাদর্শকে
নতুন নতুন দিকে প্রয়োগ করছিলেন।
দক্ষিণ ইয়োরোপের অধিকাংশ, এবং তার সঙ্গে আফ্রিকার
কিছু অংশ তুর্কির অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। অন্যদিকে পূর্ব ইয়োরোপের বড় অংশ রুশীয়
জারতন্ত্রের অধীন ছিল। এই দুই শক্তির যুদ্ধে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের ঝাঁপিয়ে পড়ায় নতুন
সাম্রাজ্যবাদের পূঁজিবাদী শাঁস বা সারতত্ত্ব বেরিয়ে আসতে শুরু করল। বিপরীতে, ঐ অধীন
জাতিগুলোর জাতীয়তার প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। আরো কিছু নতুন যুদ্ধ শুরু হচ্ছিল আফ্রিকা
এবং এশিয়ায়। এঙ্গেলস রুশি এবং অন্যান্য কয়েকটি স্লাভ ভাষা জানতেন। তাই খুব কাছ থেকে
দেখতে পাচ্ছিলেন ঘটনাগুলোকে এবং মার্ক্সকেও ওয়াকিবহাল রাখছিলেন। ঐসব জাতীয়তার বিষয়ে
লিখতে গিয়ে তাঁদেরকে জাতীয় মুক্তি এবং জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে
নিজেদের নীতি স্পষ্ট করতে হল। কয়েক বছরের মধ্যে ভারতে জাতীয় স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম
শুরু হওয়ার ছিল। চীনেও শুরু হওয়ার ছিল সংগ্রাম।
ম্যাঞ্চেস্টার আসার পর বেশ কয়েক বছর এঙ্গেলস
লন্ডন ছাড়া আর কোথাও যান নি। লন্ডনে সচরাচর উনি একাই যেতেন, কেননা মার্ক্সের সঙ্গে
সময় কাটাতে বা অন্য কারোর সঙ্গে দেখাসাক্ষাতে সুবিধে হত। ১৮৫৬র মে মাসে এঙ্গেলস স্ত্রী
মেরির সঙ্গে কিছু দিনের জন্য আয়ারল্যান্ড গেলেন। তাঁর কথায়, পুরোটা না হলেও দুই-তৃতীয়াংশ
ঘুরলেন। ফেরার পর ২৩শে মে, মার্ক্সকে চিঠি লিখলেন। চিঠিতে আয়ারল্যান্ডে পড়া আকালের
মর্মস্পর্শী বর্ণনার পাশাপাশি, ইংরেজ শাসন আইরিশ জাতীয়তাকে কোন অবস্থায় এনে ছেড়েছে
তার বর্ণনা করলেন। ইংল্যান্ডের পূঁজিবাদী উন্নয়নের চিহ্নও আয়ারল্যান্ডে ছিল না। জীর্ণ,
শীর্ণ, দাসত্বাধীন এক জাতীয়তা হয়ে জীবনধারণ করছিল সে দেশ। এঙ্গেলস লিখলেন, “পুলিস, পুরোহিত, উকিল, আমলা, জাগীরের মালিকেরা
প্রফুল্ল চিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ কোনো শিল্প নেই। ভাবাও কঠিন যে যদি অন্য দিকে এর
বিপরীত দিক, কৃষকদের দুস্থতা না থাকত তাহলে এসব পরজীবী উদ্ভিদগুলো কিকরে বাঁচত। সারা
দেশে ‘লোহার হাত’ দৃশ্যমান, সরকার প্রতিটি ব্যাপারে হস্তক্ষেপ
করে, স্বায়ত্বশাসনের চিহ্নমাত্র নেই। আয়ারল্যান্ডকে ইংল্যান্ডের প্রথম উপনিবেশ বলা
যেতে পারে … কারোর দৃষ্টি এড়াবে
না যে ইংরেজ নাগরিকের তথাকথিত স্বাধীনতার ভিত্তি উপনিবেশগুলোতে করে চলা নিপীড়ন।”
১৮৫৭র বিশ্ব পূঁজিবাদী সংকট
ইয়োরোপে প্রতিক্রিয়ার বাড়বাড়ন্তের ৮-৯ বছরের
সময়কালে, যখন বিপ্লবী পত্রপত্রিকা প্রকাশ করার সুযোগ কোনো দেশেই প্রায় ছিল না, মার্ক্স
এবং এঙ্গেলস প্রগতিশীল পূঁজিবাদী কিম্বা পূঁজিবাদী-গণতন্ত্রী সংবাদমাধ্যমগুলোর যথাসম্ভব
ব্যবহার করেছিলেন। ‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এর মত কাগজ তো পয়সা দিত। অনেকে দিতও না। তবু
আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ইত্যাদি দেশে প্রকাশিত এ পত্রিকাগুলোরই মাধ্যমে
তাঁরা নিজেদের মতাদর্শ আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতেন। পূঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী
সম্প্রসারণের ঘটনাটিকে দেখার ক্রমে তাঁদের নজর এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলোর দিকে ঘুরল।
উপনিবেশ ও ঔপনিবেশিকতার প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হতে হল। এরই মধ্যে (১৮৫৭-৫৮) ভারতে স্বাধীনতার
প্রথম সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল। (প্রকৃতপক্ষে ‘ভারতব্যাপী সংগ্রাম’, কেননা তার আগে স্থানীয় স্তরে পূর্বে, পশ্চিমে, উত্তরে, দক্ষিণে
অনেকগুলো প্রতিরোধ-সংগ্রামের তথ্য বিস্মৃতির গহ্বর থেকে পরবর্তীকালের ভারতীয় ইতিহাসবিদেরা
তুলে এনেছেন)।
মার্ক্স, এঙ্গেলস দুজনেই ‘ট্রিবিউন’এর সংখ্যাগুলোয় সে বিষয়ে অনেক প্রতিবেদন ও প্রবন্ধ লিখলেন। ভারত
সম্পর্কে মার্ক্সের গভীর অধ্যয়নের সঙ্গে বাংলা পাঠকেরা বহু দশক যাবৎ পরিচিত। মার্ক্স
ভারত সম্পর্কে অনেক আগেই কৌতুহলী হয়েছিলেন। সেটার কারণ অর্থনৈতিক – বহুলচর্চিত ‘এশীয় সমাজ’, তার ভূমিস্বামিত্ব, (এবং পরবর্তীকালে লর্ড কর্নওয়ালিসের আমলে
তার তথাকথিত সংস্কার, স্থায়ী বন্দোবস্ত), গ্রামব্যবস্থা ইত্যাদি। নিজের প্রধান কাজ
‘পূঁজি’র জন্য জমির মালিকানা ও ভাড়ার বিষয়টা পড়তে
পড়তে ভারতে সমাজের কথা তাঁর নজরে এসে থাকবে নিশ্চয়ই। ১৮৫৩ সালেই তিনি লেখেন ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’। পরবর্তীকালে তাঁর অপ্রকাশিত কাজের মহাফেজখানা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘ভারতীয় ইতিহাসের কালপঞ্জি’ যাতে ৬৬৪ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল অব্দি, ১২০০ বছরের ঘটনাবলি সংক্ষেপে
বিধৃত আছে! …
তাই ‘ট্রিবিউন’এ মার্ক্সের প্রকাশিত লেখার সংখ্যা অনেক। এঙ্গেলস সে তুলনায় অনেক
কম, মাত্র ৯ বা ১০টা। এবং লেখাগুলো শুধুই রণক্ষেত্রের গতিবিধি সংক্রান্ত। এখনও পড়লে
অবাক হতে হয় যখন তিনি লখনউ শহরে রেসিডেন্সির যুদ্ধের বিশ্লেষণ করেন। ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট,
গুগল আর্থ তো দূরের ব্যাপার, ক্যামেরাও যখন নেই, হাতে আঁকা মানচিত্র বেরোয় খবরের কাগজে
বা বইয়ে, তখন, জীবনে কখনো ভারতে বা লখনউয়ে না আসা মানুষ কিভাবে লখনউ শহর, গোমতীর তীর,
তীর ধরে চলা পথের ওপর তৈরি প্রাসাদ ইত্যাদির এমন বর্ণনা করে যেন সেখানে তার রোজকার
যাওয়া আসা! তেমনই বর্ণনা করেন দিল্লি বা কানপুর শহরের বা ভোজপুরের জঙ্গলের যেখানে বাবু
কুঁঅর সিং যুদ্ধরত! চিন্তার স্পষ্টতা অনুধাবনীয়, “তবুও আপাততঃ ব্রিটিশ আবার দখল করে নিয়েছে ভারত। বাংলার সৈন্যবাহিনীতে
শুরু হওয়া মহান বিদ্রোহ, বাস্তবে মনে হচ্ছে শেষ হতে চলেছে। কিন্তু এই দ্বিতীয় জয়ে ভারতীয়
জনগণের চিত্তের ওপর ইংল্যান্ডের প্রভাব বাড়ে নি। … বরং উল্টো, ইংরেজ নিজেই স্বীকার করছে যে অনুপ্রবেশকারী ক্রিশ্চানদের
প্রতি হিন্দু এবং মুসলমানদের পুরুষানুক্রমিক ঘৃণা আগে কখনো এত তীব্র ছিল না।”
মজার ব্যাপার, আগে যে ‘ভারতে বৃটিশ শাসন’এর কথা উঠল, তার কিছু মূলসূত্র তাঁকে এঙ্গেলস
সহজ ভাষায় তাঁকে দিয়েছিলেন। সেই ১৮৫৩ সালেরই ৬ই জুন একটি চিঠিতে লিখছেন, “পূর্বের দেশগুলোর সরকারে কখনো তিনটের বেশি
বিভাগ হত নাঃ বিত্ত (ঘরে লুট), যুদ্ধ (ঘরে ও বাইরে লুট) এবং সার্বজনিক কার্য (পুনরুৎপাদনের
ব্যবস্থা)। ভারতে ব্রিটিশ সরকার পয়লা এবং দোসরা নম্বর কাজদুটোকে শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে
করেছে। তেসরা নম্বরের কাজটাকে পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে। তাই ভারতের চাষবাস ধ্বংস হচ্ছে।”
এঙ্গেলস এক অসাধারণ সামরিক বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এ এবং অন্যান্য পত্রপত্রিকায় প্রায়ই তাঁর প্রবন্ধগুলো
হত, চার দিকে দেখা দিতে থাকা সামরিক পরিস্থিতি এবং হতে থাকা যুদ্ধের প্রতিদিনকার ঘটনাক্রমের
বিশ্লেষণ। ভবিষ্যতে ‘ট্রিবিউন’এর সম্পাদক চার্লস ডানা মার্ক্সকে, নিউ আমেরিকান
সাইক্লোপিডিয়া’র জন্য কয়েকটি বিষয়
নিয়ে লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিশ্বকোষটি আমেরিকা থেকে প্রকাশিতব্য ছিল। তন্মুহূর্তে
মার্ক্স সামরিক বিষয়গুলো নিয়ে লেখার দায়িত্ব এঙ্গেলসকে দিয়ে দিলেন। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের
সময় যখন যুদ্ধের পরিস্থিতির দ্রুত বদল শুরু হল, এঙ্গেলস এমনকি যুদ্ধ-সাংবাদিকের চাকরি
জন্যও চেষ্টা করেছিলেন। মাথায় ছিল যে পয়সাও পাওয়াও বন্ধ হবে না, রোজকার ব্যবসাদারী
থেকে ছুটিও পাবেন, সঙ্গে প্রাপ্তি হবে যুদ্ধরত দেশগুলো এবং রণক্ষেত্র ঘুরে দেখার আনন্দ।
‘ডেলি নিউজ’ নামে এক খবরের কাগজের সঙ্গে কথাও হল। কথা
এগোচ্ছিল, কিন্তু তিনি যে কম্যুনিস্ট এবং বিপ্লবী, সে তথ্য বেরিয়ে পড়ায় কাগজটি পিছিয়ে
গেল।
মাঝে মধ্যে সময় পেলেই এঙ্গেলস সাংস্কৃতিক এবং
লৌকিক ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কিত বইগুলোরও গভীর অধ্যয়ন করতেন। রুশীয় ভাষার পাশাপাশি
তিনি অন্যান্য কয়েকটি স্লাভিক ভাষাও শিখে নিয়েছিলেন। স্লাভ জাতিসমূহে বিদ্যমান পারস্পরিক
একতার সাংস্কৃতিক ভাবনা, যাকে প্যান-স্লাভিজ্ম বলা হয়, তার ওপর তাঁর গুরুত্বপূর্ণ
গবেষণা আছে। আরবী ভাষাও শেখা ছিল। আরবী বংশ এবং জাতিগুলোর লৌকিক ইতিহাসের সঙ্গে ওল্ড
টেস্টামেন্টের সম্পর্ক নিয়েও তিনি কাজ করেছিলেন।
উনিশ শতকের সে সময়টা প্রকৃতিবিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানের
বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নতুন অনুসন্ধানের সময়কাল ছিল। ১৪ই জুলাই ১৮৫৮য় মার্ক্সকে লেখা
একটি চিঠিতে এঙ্গেলস হেগেল রচিত ‘প্রকৃতির দর্শন’ পাঠাতে লেখেন এবং বলেন যে ‘বুড়ো যদি আজ একটা প্রকৃতির দর্শন লিখতে বসত, চার দিক থেকে উড়ে উড়ে আসত তথ্য!”
জীবকোষের বিকাশ নিয়ে পড়াশুনো করতে করতে তিনি
দ্বন্দ্ব-তত্ত্বের প্রমাণ জোটাতেন। তুলনামূলক শারীরবৃত্ত-সংক্রান্ত বিজ্ঞান পড়তে পড়তে,
মানুষ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী জীবের শরীরের মধ্যে সমরূপতা দেখে তিনি ভাবতে শুরু করতেন
যে শরীর-নির্মাণের নৈসর্গিক প্রক্রিয়ার একটি পর্যায় মানবশরীর, তাতে কোনো দৈবত্ব নেই।
১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হল চার্লস ডারউইনের গবেষণাগ্রন্থ ‘অরিজিন অফ স্পেসিজ’। সে বছরই ডিসেম্বরে পড়তে পড়তে ১১ই বা ১২ই
(এই ধন্দটা সংগ্রহকর্তাদেরই) ডিসেম্বর মার্ক্সকে লিখলেন, “ডারউইন … যাঁকে পড়ছি। অসাধারণ! এক ব্যাপারে পরম-কারণবাদকে ধ্বংস করা বাকি
ছিল, সেটা এখন করা হয়ে গেল। নিসর্গে ঐতিহাসিক বিকাশ প্রদর্শন করার এত বিরাট প্রচেষ্টা,
এবং এত সফল প্রচেষ্টা আগে কখনো হয় নি।”
শুধু রচনাকর্ম ধরে সংক্ষেপে এগোচ্ছি, তার মানে
এই নয় যে ম্যাঞ্চেস্টারে এঙ্গেলসের রোজকার জীবনটা টানা নিয়মমাফিক এবং নির্ঝঞ্ঝাট ছিল।
ম্যাঞ্চেস্টারের রাস্তায় দিনে রাতে কাজে বেরোলে যে কোনো নাগরিককে যে সব সমস্যায় পড়তে
হত, উটকো ঝামেলা পোহাতে হত, সে সবই এঙ্গেলসের বরাদ্দেও ছিল। উপরি, দুটো খেয়াল রাখতে
হত। বিপ্লবী কাজ-সংক্রান্ত ব্যাপার হলে অতিরিক্ত খেয়াল রাখতে হত যে পুলিসের নজরে না
পড়েন,কেননা তিনি জার্মান, আর পয়সা-সংক্রান্ত ব্যাপার হলে খেয়াল রাখতে হত, সামর্থ্যের
মধ্যে ধার-টার করে সমাধা হয়ে যায়, বাবাকে না বলতে হয়।
প্রথমটা মার্ক্সের তুলনায় কিছুই নয়, তার ওপর
স্থানীয় পরিচিতি কারখানাদারের ছেলে, কাজেই অত গা করতেন না। দ্বিতীয়টা হলে মুশকিলে পড়তেন।
যেমন ঐ ১৮৫৯এরই কথা। ২২শে সেপ্টেম্বর মার্ক্সকে লিখছেন যে মোদো মাতালদের ভিড়ে একজন
তাঁকে অপমান করছিল। রাগে হাতের ছাতাটা দিয়ে এক বাড়ি মারেন। কিন্তু ডাঁটির নিচে লাগানো
ধাতব খোলটা তার চোখে লেগে যায়। লোকটি সোজা উকিলের কাছে পৌঁছোয়। তিনিও কিছু ব্যবস্থা
নেন। ভাগ্যিস চোখে স্থায়ী কোনো ক্ষতি হয় নি এবং ক্ষতটাও সেরে গেছে, ভেবেছিলেন কিছু
পয়সা দিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু এখন ‘শুয়োরটা পাল্টি খেয়ে’ বলছে মামলা করবে। সেটা সত্যি হলে “দুশো পাউন্ডের বেশি লাগবে, আর তার ওপর ‘পাব্লিক স্ক্যান্ডাল’এর ভয় আর আমার বুড়ো মানুষটার সঙ্গে ঝগড়া, কেননা
পয়সাটা তাঁকেই দিতে হবে।” অর্থাৎ, এ ধরণের ঘটনাগুলো তাঁর জীবনে আসত।
খুব বেশি শ্রমে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ছিল। জীবনীলেখক
গুস্তাভ মেয়ার লেখেন, “এঙ্গেলস লম্বা, রোগা
কিন্তু স্বাস্থ্যবান শরীরের ব্যক্তি ছিলেন। নিজের শরীরটাকে ঘোড়সওয়ারি, সাঁতার, তরোয়ালখেলা
এবং খোলা হাওয়ায় ব্যায়াম করে শক্তপোক্ত করেছিলেন যাতে করণীয় কাজগুলো পুরো করতে পারেন।
অসুখবিসুখ কম হত। হলেও ডাক্তারের ওপর পুরোটা ছেড়ে না দিয়ে নিজেই সঠিক চিকিৎসার সন্ধান
করতেন। ১৮৫৭র গ্রীষ্মে যখন তিনি বিষিয়ে ওঠা গ্রন্থির কারণে গুরুতর অসুখে ভুগলেন, সেরে
উঠে আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন, শরীরে জটিলতা দেখা দিল তখনও, নিজে চিকিৎসা-সম্পর্কিত গ্রন্থাদি
পড়ে তা-ই করলেন। প্রথমে তো স্বাস্থ্যজনিত কারণে কাজ বন্ধ করতে অস্বীকার করলেন। মার্ক্সকে
জোর খাটাতে হল। শেষে বন্ধুর কথা শুনে কয়েক মাস সমুদ্রের তীরে গিয়ে কাটালেন, লিভারপুলের
কাছে ওয়াটারলু নামে একটি জায়গায়, তারপর উইট দ্বীপে, শেষে জার্সি দ্বীপে। জার্সিতে অক্টোবর
মাসে মার্ক্স দেখা করতে এসেছিলেন।”
দুজনেই একে অন্যের অসুস্থতায় অস্থির হয়ে পড়তেন
আর নিজেরাই একে অন্যের জন্য চিকিৎসাগ্রন্থের অধ্যয়ন শুরু করে দিতেন। চিঠি ভরিয়ে তুলতেন
কডলিভার ওয়েল, আয়োডিন আরো নানা রকম সেকালীন ওষুধের বর্ণনায়।
কয়েক মাস আরামের পর যখন এঙ্গেলস ম্যাঞ্চেস্টারে
ফিরে এলেন তার আগে খবরের কাগজের মাধ্যমে তিনি জেনে গিয়েছিলেন যে পূঁজিবাদী সংকটের নতুন
পর্ব শুরু হয়ে গেছে। যেহেতু ইতিমধ্যে বিশ্ববাজার কায়েম হয়ে গিয়েছিল, পূঁজিবাদের এই
প্রথম বিশ্বব্যাপী সংকট পুরো ইয়োরোপ এবং আমেরিকায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। শেয়ার বাজার,
ব্যাঙ্ক ইত্যাদিতে মন্দার সংকেত দিয়ে শেষে অতি-উৎপাদনের সংকট প্রকাশ পেল। ইংল্যান্ড
সবচেয়ে বেশি প্রভাবে ছিল। ম্যাঞ্চেস্টারের বাণিজ্য জগতে একমাত্র এঙ্গেলস বাদে সবার
মুখ ব্যাজার। মার্ক্সের মত তাঁরও দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে এর ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক সংকটা
শুরু হবে। ফলে বিপ্লবী আন্দোলনে নতুন জোয়ার উঠবে। নিজের কম্পানির জন্য প্রতিদিন শেয়ার
বাজারে যেতে হত। ১৫ই নভেম্বর ১৮৫৭য় মার্ক্সকে লিখলেন, “আমার মেজাজে হঠাৎ আসা এই অদ্ভুত প্রসন্নতা
দেখে ভদ্রমহোদয়গণ দন্ত পিষ্ট করিতেছেন! যথার্থই, শেয়ার বাজার একমাত্র জায়গা যেখানে
আমার মনের নিষ্প্রভতা মুছে যায়; উৎসাহে ভরে উঠি। তার ওপর সব সময় আমি ভবিষ্যতের একটা
অন্ধকার ছবি আঁকি। তাতে এই গাধাগুলোর মনের জ্বালা দ্বিগুণ হয়ে ওঠে।”
যদিও তেমন রাজনৈতিক সংকট এল না এবং বিপ্লবী
জোয়ার উঠল না, তিনটি দেশে গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবী কার্যকলাপ দেখা গেল। প্রথম, ইতালি।
ইতালি জাতীয় রাষ্ট্র রূপে তখনো ঐক্যবদ্ধ হতে পারে নি। ইতালির ঐক্যের জন্য আন্দোলন জোরদার
হয়ে উঠল। দ্বিতীয়, জার্মানি। জার্মানিও জাতীয় রাষ্ট্র রূপে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে নি। সেখানেও
আন্দোলন শুরু হল। তৃতীয়, আমেরিকা। আমেরিকার ঐক্যের জন্য শুরু হওয়া সংগ্রামটা উত্তর
দিকের রাজ্যগুলোর সঙ্গে দক্ষিণ দিকের রাজ্যগুলোর যুদ্ধের রূপ গ্রহণ করল। উত্তরের রাজ্যগুলো
দাসপ্রথা উচ্ছেদের পক্ষে ছিল। উত্তরের রাজ্যগুলোর হাতে ঐক্যের নেতৃত্ব থাকে তাহলে দাসপ্রথার
উচ্ছেদ হবে এবং তার বিরাট প্রভাব পড়বে ইয়োরোপের, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের ওপর। ভবিষ্যতে
তাই হলও। মার্ক্স-এঙ্গেলসের ঘনিষ্ঠ সাথী ওয়েডেমেয়ার আমেরিকাতেই ছিলেন।
তিন দেশের ঘটনাক্রমের ওপর দুজনেরই প্রবন্ধ
প্রকাশিত হতে লাগল। ১৮৫৯এর ফেব্রুয়ারি-মার্চে এঙ্গেলস একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ লিখলেন
‘পো অ্যান্ড রাইন’। পো ইতালির নদী এবং রাইন জার্মানির নদী। প্রবন্ধের
মাধ্যমে তিনি ঐক্যবদ্ধ ইতালি এবং ঐক্যবদ্ধ জার্মানির আশাআকাঙ্খার বিপরীতে ফ্রান্স এবং
জার্মানির সাম্রাজ্য-বিস্তারবাদী সামরিক দৃষ্টিভঙ্গির শ্রেণী-চরিত্র প্রকাশ করলেন।
সাধারণ চিন্তনের ভাষায় নয়। একজন অভিজ্ঞ সামরিক-সাংবাদিকের ভাষায় তিনি দেখালেন যে ফ্রান্স
এবং জার্মানির ঘোষিত দেশের স্বার্থের দিক থেকে দেখলে তাদের রণনীতিগত দাবির বিপরীত,
সামরিক গতিবিধিগুলো অর্থশূন্য। জার্মানিতে লেখকের নাম না জানিয়ে পুস্তিকাটি প্রকাশিত
হল। বিক্রি হল প্রচুর, সমীক্ষা এল অনেক। পরে একটি পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশনের সময়
লেখকের নাম জানা গেল।
স্ত্রী মেরি বার্ন্সের মৃত্যু
১৮৬০এর মার্চের মাঝামাঝি এঙ্গেলসের কাছে খবর
পৌঁছোল যে তাঁর বাবা অসুস্থ। বাবার সঙ্গে কোনোদিন তেমন বনিবনা হয় নি। তবু তিনি একবার
বাড়ি যেতে চাইছিলেন। বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছিল না।
১৮৪৯ সালে এলবারফেল্ড, ব্যাডেন আর প্যালেটিনেটে বিপ্লবী কার্যকলাপে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ফলে জার্মানির আদালতে অভিযোগগুলো ঝুলছিল। পরিবারের তরফ থেকেও অনেক চেষ্টা করা হল যাতে
বাড়ির বড় ছেলে অন্ততঃ পনের দিনের জন্য বাড়ি আসার অনুমতি পায়। কিন্তু অনুমতিপত্রে প্রুশীয়
গৃহমন্ত্রীর স্বাক্ষর হতে দেরি হল। ২০শে মার্চ বাবা মারা গেলেন।
এঙ্গেলস বারমেন পৌঁছোলেন ২৩শে মার্চ। দশ বছর
পর নিজের ভাই, বোন এবং মায়ের সঙ্গে দেখা হল। বাবার শেষকৃত্যের পর, যেহেতু তিনি এখন
স্থায়ী ভাবে ইংল্যান্ডের বাসিন্দা তাই জার্মানির এঙ্গেলস্ক্রির্শেন শহরে যে পারিবারিক
ব্যবসা আছে তাতে তাঁর নিজের অংশটা তাঁকে ছেড়ে দিতে বলল ভাইয়েরা। তার বদলে ম্যাঞ্চেস্টারের
এর্মেন অ্যান্ড এঙ্গেলস কম্পানিতে তাঁর ব্যক্তিগত অংশদারীর কোনো একটা ব্যবস্থা করা
হবে। তা-ই হল, তবে যে চুক্তিটা হল তাতে এঙ্গেলসের ক্ষতি হল। সবচেয়ে খারাপ লাগল যে এ
বিষয়ে পুরো কথাবার্তা তাঁর বারমেন পৌঁছোবার আগেই ভাইয়েরা সেরে নিয়েছিল। ওদিকে ম্যাঞ্চেস্টারে
এর্মেনও পারিবারিক পরিস্থিতির আভাস পেয়ে এঙ্গেলস পরিবারকে ঠকানোর চক্করে ছিল। ১৮৬১র
১৩ই ফেব্রুয়ারি মা-কে চিঠিতে লিখলেন, “মা, তোমার জন্য আমি এসব কিছু এবং আরো অনেক ব্যাপার হজম করে গেলাম।
পৃথিবীর কোনো কিছু পাওয়ার জন্য আমি সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে ঝগড়া করে তোমার জীবনসন্ধ্যায়
তিক্ততা আনব না – কক্ষনো না। মনে
হয় যখন আমি বাড়িতে ছিলাম, আমার আচরণও আমার চিঠির মতনই তোমাকে দেখিয়ে থাকবে যে কোনো
চুক্তিতে বাধা দেওয়ার ইচ্ছে থেকে দূরেই থাকতাম। বরং, খুশি মনেই প্রাপ্যটুকুও ছেড়ে দিলাম
যাতে সব কিছু তোমার ইচ্ছানুসারে হয়ে যায়।”
ম্যাঞ্চেস্টারে এঙ্গেলসের আর্থিক অবস্থা কিছুটা
পাল্টালো। তিনি কর্মচারিই রইলেন কিন্তু ১০,০০০ পাউন্ডের অংশীদারি এবং পরিণামে, মুনাফার
একটা অংশের প্রাপক হয়ে। এঙ্গেলস্কির্শেনে হওয়া চুক্তি অনুসারে কয়েক বছর পর এঙ্গেলসের
কম্পানির অংশীদার হওয়ার ছিল। হয়ে গেলে, কর্মচারী-জীবন থেকে ছুটি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি
হল।
ওদিকে প্রুশিয়ার নতুন সম্রাটের অভিষেক হল।
সে উৎসবে ১৮৬১র অক্টোবর মাসে ‘রাজ-ক্ষমা’ ঘোষণা করা হল। ফলে জার্মান রাজনৈতিক অভিবাসীদের জার্মানি যাওয়া
একটু সহজ হল। এঙ্গেলস অক্টোবরেই বারমেনে গিয়ে ছুটি কাটালেন। এক বছর পর আবার গিয়েছিলেন।
সে বছর মোসেল আর রাইন নদীর তীরে হাঁটতে হাঁটতে থুরিঙ্গিয়া (শখে হেঁটে পার করার দীর্ঘ
অরণ্যপথের জন্য বিখ্যাত জার্মান রাজ্য) পার করেছিলেন। তারপর বারমেন এবং এঙ্গেলস্কির্শেনেও
গিয়েছিলেন।
যে সময় এঙ্গেলস নিজের অসুখ, বাবার মৃত্যু,
ভাইদের সঙ্গে চুক্তি ইত্যাদি ঘটনায় ব্যস্ত ছিলেন, মার্ক্সেরও অবস্থা ভালো ছিল না। কিছু
দিন আগে তিনি পারিবারিক উত্তরাধিকারের অংশ পাওয়ার সূত্রে কিছু অর্থের অধিকারি হয়েছিলেন।
সেটা নিতে হাঙ্গেরি গিয়েও ছিলেন। ফিরে এসে সেই অর্থ দিয়ে একটা নতুন বাড়ি ভাড়া করেছিলেন
এবং আসবাবপত্রও কিনেছিলেন। কিন্তু মন্দা এসে পড়ায় ‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’ থেকে যা পেতেন সেটা কম হয়ে গেল, ‘বিশ্বকোষ’এর প্রকাশনা স্থগিত হয়ে গেল। ফলে বছর ঘুরতে না ঘুরতে নতুন কেনা
আসবাবপত্র বন্ধক রাখতে হল। বাচ্চাদের স্কুলের ফিস দেওয়া হল না বলে তারা বাড়িতেই দিন
কাটাতে লাগল। কখনো কখনো দিশেহারা হয়ে রাগে জেনির মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেত, “তুমি তো চাও বাচ্চাদের নিয়ে আমি মরে যাই!” এঙ্গেলসকে চিঠিতে কথাটা উল্লেখ করে মার্ক্স
লিখতেন, “ঠিকই বলে জেনি! কিছুই
করতে পারি না ওদের জন্য! … জেনিরও নালিশ থাকে
যে আমি বোধহয় এখানকার অবস্থার কথা সঠিকভাবে তোমায় জানাই না।”
প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, হাজার চাপ এলেও জীবনটাকে
পূঁজিবাদের জন্য “টাকা-বানানোর মেশিন
হতে দেব না।” সে প্রতিজ্ঞাও ভাঙার
মত অবস্থা চলে এল। এঙ্গেলসের জীবনীলেখক গুস্তাভ
মেয়ার উল্লেখ করেন যে মার্ক্স রেল কম্পানিতে কেরানির পদের জন্য আবেদনও জমা দিয়ে
এসেছিলেন। কিন্তু যাক, সেই ভয়ানক দিন আসে নি। এঙ্গেলসের আয় বেড়ে যাওয়ায় মার্ক্সের পরিবার
সে সময় একটু স্বস্তির মুখ দেখল।
১৮৬২ সালে শুরু হল পোল্যান্ডে আন্দোলন। পোল্যান্ড
রুশীয় জারতন্ত্রে অধীন ছিল। মার্ক্স-এঙ্গেলস নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন যে যদি পোল্যান্ডের
আন্দোলন বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহণ করে আর পোল্যান্ডের কৃষকেরা বিপ্লবী সংগ্রাম শুরু করে
তাহলে স্বাধীন পোল্যান্ড একটি জাতিরাষ্ট্র রূপে প্রতিষ্ঠিত হবে। যার ফলে রুশীয় জারতন্ত্রের
শক্তি এবং ইয়োরোপের ওপর তার প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাব অনেকটা কমে যাবে। কিন্তু এটা তবেই
হতে পারে যদি রুশের কৃষকেরাও পোল্যান্ডের কৃষকদের সমর্থনে আন্দোলন করে। কিন্তু তা হল
না। রুশের কৃষকদের কয়েক শতকের বিদ্রোহ এবং আন্দোলন তাদের সদ্য ভূদাস-প্রথা থেকে মুক্ত
করেছিল। আর পোল্যান্ডের আন্দোলনের দুর্বল অসংগঠিত নেতৃত্ব তাদের কৃষকদের কাছে গেলই
না। জার আলেকজান্ডার-২ পরে পোল্যান্ডের বিদ্রোহকে পিষে দিয়েছিল। কিন্তু সেসময় মার্ক্স-এঙ্গেলস
উৎসাহিত ছিলেন। স্থির হল যে একটি পুস্তিকা ছাপিয়ে জার্মানির শ্রমিকদের পোল্যান্ডের
বিদ্রোহের গুরুত্ব বোঝানো হবে। পোল্যান্ডের লড়াইয়ের সামরিক পরিস্থিতি এবং ঐতিহাসিক
পটভূমি লেখার দায়িত্ব এঙ্গেলস পেলেন। কয়েক দিনেই লিখে পুরো করে দিলেন। ভাবা হয়েছিল
যে দ্বিতীয় অংশ, তত্ত্বগত দিক মার্ক্স লিখবেন আর তখন বইটা ঘোষণাপত্রের মত ‘জার্মান শ্রমিক শিক্ষা সমিতি’র তরফ থেকে প্রকাশিত হবে। সে আর হয় নি।
৬ই জানুয়ারি ১৮৬৩, রাতে এঙ্গেলসের জীবনে অন্ধকার
নেমে এল। মেরি বার্ন্স মারা গেলেন। আইরিশ বিপ্লবী শ্রমিক মেরি বার্ন্স, এঙ্গেলসের শুধু
স্ত্রী ছিলেন না, ম্যাঞ্চেস্টারের শ্রমিক পাড়ায় তাঁর শ্রমিকবন্ধু-জীবন যাপনে শ্রীমতী
মেরি এঙ্গেলস ছিলেন না, তাঁর অহঙ্কার ছিলেন। নিজের রোজকার দ্বৈত জীবনের জ্বালায়, মেরি
সঙ্গে থাকলে তাঁর শ্রেণীঘৃণা আরো প্রবল হয়ে উঠত।
পরের দিন মার্ক্সকে লিখলেন, “প্রিয় মূর, মেরি চলে গেল। গত রাতে তাড়াতাড়ি
শুয়ে পড়েছিল। যখন মাঝরাতের একটু আগে লিজ্জি ঘুমোতে গেল ততক্ষণে মেরির মৃত্যু হয়ে গেছে।
একেবারে হঠাৎ। হৃদ্বৈকল্য অথবা সন্ন্যাস-জনিত বৈকল্য। সকাল অব্দি আমায় বলা হয় নি।
সোমবার সন্ধ্যে অব্দি একদম সুস্থ ছিল। বলতেই পারব না কেমন অনুভব করছি আমি। বেচারি প্রাণ
দিয়ে ভালোবাসত আমায়।”
ওপরের চিঠির জবাবে মার্ক্স যা লিখলেন তা এঙ্গেলসকে
আঘাত করল। দুজনের পত্রালাপে এই একটি ঘটনা পাওয়া যায় যাতে মার্ক্সের কথায় এঙ্গেলস আঘাত
পেলেন। বস্তুতঃ মার্ক্স নিজের অভাব এবং জেনির, হয়তো ঠিক সেক্ষণেই করা তিক্ত কোনো মন্তব্যে
মনঃক্ষুন্ন ছিলেন। তার-ই মধ্যে এঙ্গেলসের চিঠি এল আর মার্ক্স জবাব দিতে বসলেন। জেনি
বলতেনই যে মার্ক্স নিজের পরিবারের প্রকৃত অবস্থা এঙ্গেলসকে বলেন না। মার্ক্সও সেসব
কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে এক লাইনে মেরির মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করে নিজেরই পারিবারিক সমস্যার
কথা বয়ান করে পাঠিয়ে দিলেন। দুঃখে এবং রাগে এঙ্গেলস পাঁচ দিন কোনো জবাব দিলেন না। যখন
দিলেন তখনও ঠাণ্ডা কথায় মার্ক্সকে ঈষৎ বকুনি দিয়ে তার আর্থিক সমস্যা মেটাতে এদিকে কী
কী করেছেন তার বিবরণ লিখে পাঠিয়ে দিলেন।
মার্ক্স চিঠি পাঠানোর পর থেকেই লজ্জিত ছিলেন।
বুঝতে পারছিলেন ভুল করে ফেলেছেন। এঙ্গেলসের চিঠি পাওয়ার বারো দিন পর নিজের আচরণের জন্য
ক্ষমা চাইলেন। তত দিনে এঙ্গেলসও অনেকটা সামলে উঠেছিলেন।
ওদিকে পোল্যান্ডের লড়াই পুরোপুরি পথভ্রষ্ট
হচ্ছিল। জার্মানিতে তাঁদের বন্ধু ফার্দিনান্দ লাসালের কাজে দুজনেই অপ্রসন্ন ছিলেন।
একটাই লড়াই এগিয়ে চলেছিল – আমেরিকার গৃহযুদ্ধ।
এঙ্গেলস বেশ কিছু দিন যাবৎ কিছু লিখতে পারছিলেন না। নিঃসঙ্গতা কাটাতে আবার সেই পুরোনো
শখ, নতুন ভাষা শেখা শুরু করলেন আর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ইতিহাস পড়া শুরু করলেন। খবরের
কাগজের লেখায় ফিরতে কয়েক মাস লেগে গেল। তত দিন মার্ক্স একাই খবরের কাগজের লেখা, অন্যান্য
পত্রিকায় লেখা ইত্যাদি সামলালেন। ‘পূঁজি’র কাজে এগোতে ব্রিটিশ
মিউজয়ামেও যাওয়ার থাকত।
১৮৬৪র মে মাসে এঙ্গেলস আবার একটা ধাক্কা খেলেন।
উইলহেল্ম উল্ফ বা তাঁদের জন্য তাঁর চলতি নামে, ‘লুপুস’ দুজনেরই ভীষণ প্রিয় ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তবে থাকতেন ম্যাঞ্চেস্টারে
তাই এঙ্গেলসের সঙ্গেই বেশি, বলতে গেলে রোজকার ওঠাবসা ছিল। ৯ তারিখে তিনি মারা গেলেন।
তাঁর অসুস্থতার খবর শুনে তিন তারিখে মার্ক্সও পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তখনই উল্ফ মৃত্যুর
কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমিতির প্রতিষ্ঠা এবং ‘পূঁজি’ রচনার সমাপন
প্রথম আন্তর্জাতিক
ডেনমার্ক সীমান্তের কাছে জার্মানির একটি এলাকা
শ্লেস্বিগ-হোলস্টেইন। বিগত কিছু দিন ধরে সেখান থেকে রাজনৈতিক গতিবিধির খবর আসছিল। কিন্তু
যে মুখ দিয়ে খবর পৌঁছোচ্ছিল সে মুখগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়, তাই মার্ক্স-এঙ্গেলস ভরসা
করতে পারছিলেন না। শ্লেস্বিগ-হোলস্টেইন যাওয়ার রাস্তাতেই পড়ে এঙ্গেলস্কির্শেন আর মা
যেহেতু এখন সেখানেই আছেন, এঙ্গেলস ভাবলেন ঘুরেই আসবেন। সঙ্গে আরো দু’চারটে শহর ঘুরে আসবেন। তিনি কল্পনাতেও ছিল
না যে তাঁর না-থাকার সময়টুকুতে লন্ডনে একটা বড় ঘটনা ঘটে গিয়ে থাকতে পারে। তাই ফিরে
এসেও সোজা ম্যাঞ্চেস্টারে নিজের সওদাগরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কেননা, পূঁজিবাদী
বিশ্বসঙ্কট, আমেরিকার গৃহযুদ্ধ আর ভারতে কম্পানি শাসনের বদলে রানীর শাসন প্রতিষ্ঠিত
হওয়ার প্রভাব পড়ছিল ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পের ওপর।
যখন মার্ক্স চিঠিতে অস্থির হয়ে জানতে চাইলেন
তিনি কোনো খবর দিচ্ছেন না কেন, এতদিনে তো তাঁর ফিরে আসার কথা, তখন চিঠির জবাব দিলেন।
জবাবে তাঁর নিজের ব্যস্ততারই কথা ছিল, “তোমাকে এর আগে চিঠি না লিখতে পারার একমাত্র অজুহাত হতে পারে এই সংকট
আর সে কারণে আমার হাজারটা হয়রানি। সারা জীবনে আমি কখনো টাকাপয়সার এই ইহুদি কারসাজির
ব্যস্ত জগতে ঢুকি নি, কল্পনাও করা কঠিন যে আমায় এসব নিয়ে কত চিঠি চালাচালি করতে হচ্ছে
…” [শেষে লিখলেন] “তুমি কী ভাবো এই বাণিজ্যিক সংকটের ব্যাপারে?
আমার তো মনে হয় শেষ, অর্থাৎ এর সবচেয়ে খারাপ পর্বটা চলে গেছে। দুঃখ এটাই যে ঘটনাগুলো
ঠিক জায়গা মত পৌঁছোয় না।” [২রা নভেম্বর ১৮৬৪]
ঠিক কী তাঁকে ব্যস্ত রাখছিল তার আভাস ভাইকে
লেখা চিঠি থেকে পাওয়া যায়, কম্পানির হাতে মাত্র মাস-দেড় মাসের অর্ডার আছে। চার দিকে
কম্পানিগুলোর দেউলিয়া হওয়ার খবর …।
জবাবে ৪ঠা নভেম্বরে মার্ক্সের দীর্ঘ চিঠি পেলেন।
সঙ্গে অনেক কাগজপত্র। পড়ে বুঝলেন অনেক কিছু হয়ে গেছে তাঁর না-থাকার সময়টাতে। পৃথিবী
বিরাট ঘটনার দিকে এগোচ্ছে।
‘কম্যুনিস্ট লীগ’ ভঙ্গ হওয়ার পর থেকেই দুজনে চিন্তায় অস্থির
ছিলেন কিভাবে শ্রমিকদের একটা বড়, ইয়োরোপব্যাপী, সদর্থে আন্তর্জাতিক সংগঠন তৈরি করা
যায়। চেষ্টাও করলেন অনেকভাবে, সফল হলেন না। কিন্তু তাঁদের ছড়ানো চেতনার বীজ তো মাটি
ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়ছিল! অঙ্কুরিত হয়ে চলেছিল পুরো ইয়োরোপে! এবং, অবশ্যই আমেরিকায়ও!
বাস্তবে, যেমন মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্রের
৪১তম খণ্ডের (চিঠিপত্র ১৮৬১-৬৪) মুখবন্ধে সম্পাদকমন্ডলী মন্তব্য করেন, “শিল্পবিপ্লবের পরিণামে সর্বহারার সংখ্যাগত
শক্তিতে, সামাজিক গঠনে এবং শ্রেণী চেতনায় বিরাট পরিবর্তন আসছিল। ১৮৫৯-৬০ এর ‘লন্ডন ভবননির্মাণ-শ্রমিক হড়তাল’ প্রভাব ব্রিটেন ছাড়িয়ে বহুদূর অব্দি ছড়িয়ে
পড়েছিল। হড়তাল দেখিয়েছিল যে সর্বহারা আর পূঁজিবাদীর শ্রেণীস্বার্থ কখনো এক হতে পারে
না। স্বতন্ত্র সংগ্রামের পথে বেরিয়ে পড়া শ্রমিকশ্রেণী আন্দোলন, পূঁজিবাদীদের ভাবাদর্শগত
প্রভাব থেকে তার ক্রমমুক্তির সাক্ষ্য দিচ্ছিল।”
৪ঠা নভেম্বরে মার্ক্সের পাঠানো চিঠিতে এক,
দুই, তিন, চার সংখ্যা সম্বলিত চারটে বিষয়ক্রম ছিল। লিখেওছিলেন যে মনে রাখার জন্য নম্বর
দিয়ে লিখছি। প্রথমটা তাঁদের বন্ধু ও জার্মানিতে লড়াইয়ের সাথী ফার্দিনান্দ লাসালের দুঃখজনক
মৃত্যু পরবর্তী কয়েকটি ব্যাপার নিয়ে। দ্বিতীয়টাই আমাদের বিষয় “আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি”। তৃতীয়, কিছুদিন আগে পরিচিত ও বন্ধু হওয়া
রুশীয় বিপ্লবী মিখাইল বাকুনিন সম্পর্কে কিছু আশাব্যঞ্জক তথ্য। এবং চতুর্থ, এঙ্গেলসের
চিঠির শেষ অংশের জবাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য, “সংকট তীব্রতার ক্ষয়ে যা হারিয়েছে, পৌনঃপুনিকতায় ফিরিয়ে নিয়েছে”।
সংলগ্ন ছিল প্রথম দুটো বিষয়সংক্রান্ত কাগজপত্র।
সঙ্গে আবার এটাও লিখেছিলেন যে পড়ার পর যেন কাগজপত্রগুলো ঠিকভাবে ফেরত দেওয়া হয়। সেগুলোর
ওপর কাজ বাকি আছে। অর্থাৎ, বোঝা যায় মার্ক্স কতটা অধীর হয়ে জার্মানি থেকে এঙ্গেলসের
ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন।
চিঠির দ্বিতীয় বিষয়ক্রমে ছিলঃ
“কিছুদিন আগে লন্ডনের
শ্রমিকেরা প্যারিসের শ্রমিকদের পোল্যান্ডের বিষয়ে একটি বার্তা পাঠিয়ে আহ্বান করেছিল
যে বিষয়টা নিয়ে মিলেমিশে কাজ করা যাক।
“বার্তার জবাবে প্যারিসের
লোকেরা এক প্রতিনিধিদল পাঠালো। সে দলের নেতৃত্বে ছিলেন ‘তোল্যাঁ’, যিনি প্যারিসে বিগত নির্বাচনে শ্রমিকদের যথার্থ প্রতিনিধি
ছিলেন, সব দিক থেকে চমৎকার মানুষ। (তাঁর সঙ্গী ছেলেগুলোও সবাই চমৎকার)। ২৮শে সেপ্টেম্বর
১৮৬৪ তারিখে সেন্ট মার্টিন্স হলে একটি জনসভা আহ্বায়িত হল। আহ্বানকর্তা ছিলেন অডগার
(মুচি, স্থানীয় ‘কাউন্সিল অফ লন্ডন
ট্রেডস ইউনিয়ন্স’এর এবং বিশেষ করে,
ব্রাইটের সঙ্গে সম্পর্কিত ‘ট্রেডস ইউনিয়ন্স
সাফ্রেজ এজিটেশন সোসাইটি’রও সভাপতি) এবং ক্রেমার,
রাজমিস্ত্রী এবং ‘মেসন্স ইউনিয়ন’এর সেক্রেটারি। (এরা দুজনেই সেন্ট জেমস হলে
ব্রাইটের সভাপতিত্বে উত্তর আমেরিকার পরিস্থিতি নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন সভার আয়োজন করেছিল
…) একজন ‘লা লুবেজ’ নামে কাউকে পাঠানো হয়েছিল আমার কাছে। তিনি জিজ্ঞেস করতে এসেছিলেন
যে আমি জার্মান শ্রমিকদের পক্ষে সভায় অংশগ্রহণ করব কিনা। আর দ্বিতীয়তঃ, কোনো জার্মান
শ্রমিককে, বিশেষ করে, সেই সভায় অংশগ্রহণ করার জন্য ডাকতে চাইব কিনা। আমি তাঁকে একেরিয়াসের
নাম দিলাম। সভায় সে খুবই ভালোভাবে কথা রাখল। আমি মঞ্চে ছিলাম, কিছু বলি নি। জানতাম,
আমাদের কাজে যাদেরকে পেতে চাই তারা এই আয়োজনে অবশ্যই আসবে, লন্ডন থেকেও আর প্যারিস
থেকেও। তাই স্থিরই করেছিলাম যে এধরণের কোনো আমন্ত্রণ স্বীকার না করার আমার স্থায়ী নিয়মটা
এক্ষেত্রে ভাঙব।”
…… [সভার বর্ণনা, যাতে
সিদ্ধান্ত গৃহীত হল যে ওয়র্কিংমেন্স ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হবে, ১৮৬৫তে
বেলজিয়ামে তার কংগ্রেস হবে এবং সে উদ্দেশ্যে একটি অস্থায়ী কমিটি গঠিত হল]।
“… কমিটির প্রথম বৈঠকে
আমি যোগ দিয়েছিলাম। ‘নীতিগত ঘোষণা’ এবং ‘অস্থায়ী নিয়মাবলি’ তৈরি করার জন্য একটি উপসমিতি তৈরি হল (আমাকে নিয়ে)। অসুস্থতার কারণে
আমি উপসমিতির আর পরবর্তী অস্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারিনি।”
…… [দীর্ঘ বর্ণনা,
কিভাবে ‘নীতিগত ঘোষণা’ তৈরি করার প্রথম প্রয়াস অসফল হল; শ্রমিক শ্রেণীর
শ্রেণীগত ধারণাহীন মাজ্জিনিপন্থী অতিবিপ্লবী শব্দভারাক্রান্ত একটি দলিল শেষ অব্দি খারিজ
হল]।
“দু’দিন পর, ২০শে অক্টোবর, ইংল্যান্ডের তরফ থেকে
ক্রেমার, ইতালির তরফ থেকে ফন্টানা এবং” [পূর্বোক্ত] “লা লোপেজ আমার বাড়িতে এলেন। … আমার হাতে আগে তৈরি দলিলগুলো … ছিল না তাই কিছু তৈরি করতে পারি নি, কিন্তু
আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে যদি পারি, আগের তৈরি বস্তুটার একটা লাইনও আমি দলিলে থাকতে
দেব না। … রাত একটায় চল্লিশটা
নিয়মের মধ্যে প্রথমটা গৃহীত হল। ক্রেমার বলল (আর সেটাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল),
২৫শে অক্টোবরের কমিটি বৈঠকে পেশ করার মত কিছুই নেই আমাদের কাছে। কাজেই বৈঠক ১লা নভেম্বর
অব্দি স্থগিত রাখা হোক। কিন্তু ২৭শে অক্টোবর উপসমিতি বসে একটা নিশ্চিত নিষ্পত্তিতে
পৌঁছোবার চেষ্টা করতে পারে। স্বীকৃত হল এবং ‘দলিলগুলোর’ ভার আমায় অধ্যয়নের জন্য ‘অর্পিত’ করা হল।
আমি দেখতে পাচ্ছিলাম ঐ বস্তুটার কোনো গতি করা
অসম্ভব। যে অদ্ভুত ভাবে আমি ‘ইতিমধ্যে প্রবাহিত ভাবাবেগ’গুলোর সম্পাদন করতে চাইছিলাম তার ন্যায্যতা দেখাতে আমি একটা ‘শ্রমিক শ্রেণীসমূহকে সম্বোধন’ লিখলাম (যা মূল পরিকল্পনায় ছিল না; লেখাটা
বলতে গেলে ‘১৮৪৫ সাল থেকে শ্রমিক
শ্রেণীগুলোর দুঃসাহসিক অভিযানগুলোর এক ধরণের পর্যালোচনা’ হল। ছুতো দিলাম যে সব জরুরি তথ্য এই ‘সম্বোধন’এ আছে; একই কথার তিনবার পুনরাবৃত্তি করা উচিৎ নয়। প্রস্তাবনাটা
পুরো পাল্টে দিলাম, ‘নীতিগত ঘোষণা’ ছুঁড়ে ফেলে দিলাম আর চল্লিশটা নিয়মের জায়গায়
দশটা নিয়ম রাখলাম। ‘সম্বোধন’এ ‘আন্তর্জাতিক রাজনীতি’র উল্লেখে ‘জাতি’র বদলে আমি ‘দেশ’এর কথা বলেছি এবং রাশিয়ার নিন্দা করেছি, ছোট জাতিগুলোর না। উপসমিতি
আমার সব প্রস্তাব গ্রহণ করল। ওদের কথায় আমাকে নিয়মাবলির প্রস্তাবনায় ‘কর্তব্য’ও ‘অধিকার’ এবং ‘সত্য, নৈতিকতা ও ন্যায়বিচার’ সম্পর্কে দুটো দুটো বাক্য ঢোকাতে হল, কিন্তু সেগুলো এমন জায়গায় যে
কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা।” [মার্ক্স ‘ক্ষতি’ অর্থে এই নীতিমূলক শব্দগুলোর এমন অপব্যবহারের দিকে ইঙ্গিত করছেন
যা সংগঠনের কাজে বা শ্রমিক ঐক্যে বিভাজন ও বর্জনের প্রবৃত্তি আনতে পারে।]
জেনেরাল কমিটির সভায় আমার ‘সম্বোধন’ ইত্যাদি দারুণ উৎসাহে (নির্বিরোধে) গৃহীত হল। প্রকাশনের রূপ
পরের সপ্তাহে নির্ণীত হবে। ‘সম্বোধন’এর একটা কপি লা লুবেজের
কাছে ফরাসি অনুবাদের জন্য, এবং একটা কপই ফন্টানার কাছে ইতালীয়তে অনুবাদের জন্য দেওয়া
হয়েছে। … জার্মানে আমি নিজেই
অনুবাদ করব।”
“খুব কঠিন ছিল কথ্যটাকে
এমন রূপ দেওয়া যাতে আমাদের দর্শন শ্রমিক আন্দোলনের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গির কাছে গ্রহণীয়
হয়। … আন্দোলন ভাষার পুরোনো
সাহসিকতা গ্রহণ করার স্তরে ফিরে আসতে সময় নেবে। আমাদের ‘কাজে শক্ত, চালে নরম’ হতে হবে। …”
বেশ দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিলাম। শুধু বোঝানোর জন্য
যে মার্ক্স কেমন উদ্গ্রীব, অস্থির হয়ে ছিলেন বন্ধুকে সব কথা বলার জন্য! যাকে আমরা বলি,
না বললে যেন ভাত হজম হচ্ছিল না যে শ্রমিক শ্রেণীর নিজের হাতে করা প্রথম আন্তর্জাতিক
শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়াস তাঁদের মতাদর্শকে ‘নির্বিরোধে’, ‘দারুণ উৎসাহে’ গ্রহণ করেছে। এ তাঁদের দুজনের কুড়ি বছরের
অবিছিন্ন মতাদর্শগত সংগ্রামের জয়!
চিঠি পেয়ে সাত তারিখে এঙ্গেলস লিখলেন, “শ্রমিকদেরকে করা ওই ‘সম্বোধন’ না দেখে আমি থাকতে পারছি না। যেমন ধরণের মানুষেরা এই সংগঠনে
যোগ দিয়েছে তুমি বলছ, অবশ্যই ওই ‘সম্বোধন’ একটি শ্রেষ্ঠ কৃতি
হয়ে থাকবে। তবে ভালো ব্যাপার যে আমরা আবার সে-ধরণের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করছি
যারা অন্ততঃ নিজের শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। শেষ অব্দি বাস্তবে এই ব্যাপারটাই অর্থপূর্ণ
হবে।”
“অবশ্যই সেটি শ্রেষ্ঠ
কৃতি ছিল।” এঙ্গেলসের জীবনীলেখকদের
(সোভিয়েত সঙ্ঘ, ১৯৭৪) ভাষায়, “সভার দায়িত্বে থাকা ইংরেজ ট্রেড ইউনিয়নের লোকেরা এমন এক আন্তর্জাতিক
সংগঠন চাইছিল যেটি প্রাথমিকভাবে আর্থিক দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করবে … কাজের ঘন্টা কম করানো, হড়তালে সমন্বয় স্থাপন
করা, মজুরি নিয়ন্ত্রিত করা ইত্যাদি। ফরাসি শ্রমিক যারা প্রুধোঁর প্রভাবে ছিল, সুদ-মুক্ত
ঋণ এবং সমবায়ের পক্ষে এক বিশ্ব সংগঠনের স্বপ্ন দেখছিল। তাঁদের মনে হচ্ছিল সে-কাজটা
হলেই শোষণ শেষ হবে। তারপর ছিল পূঁজিবাদী গণতন্ত্রীরা, যারা আন্তর্জাতিককে সমকালীন গণতন্ত্রী
সংগঠনগুলোর অনুচর করতে চাইছিল।
“অন্যদিকে মার্ক্স
এই আন্তর্জাতিক সমিতিটিকে যথার্থ সর্বহারা গণসংগঠনের রূপ দিতে চাইছিলেন যেটি পূঁজিবাদী
ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগ্রামে সমন্বয় আনবে এবং পথপ্রদর্শন করবে। এঙ্গেলস পরে
লিখেছিলেন, ‘অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের
মধ্যে শুধু একজন ছিল যার মাথায় স্পষ্ট ধারণা ছিল যে কী হবে এবং কী তৈরি করতে হবে। এ
ছিল সেই মানুষটি যে যে ১৮৪৮ সালে বিশ্বে আহ্বান করেছিল সব দেশের সর্বহারা, এক হও!’”
ইতিহাস বলে যে মার্ক্স রচিত ওই সম্বোধন – (গৃহীত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক নাম – ‘শ্রমজীবীদের আন্তর্জাতিক সমিতির উদ্বোধনী সম্বোধন’) খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। পুরো ইয়োরোপ এবং আমেরিকায়
দলিলটি পড়া হল। ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী
সমিতি’ বা ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’, সেন্ট মার্টিন্স হলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর
থেকে আট বছর (হেগ সম্মেলন) ক্রমাগত বড় হয়ে চলল। যে-সময়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল বা
সরকারগুলোর খড়্গহস্ত যদ্দিন অব্দি তীব্রগতিতে নেমে আসে নি, সংগঠনটির আশি লক্ষ সদস্য
ছিল পুরো ইয়োরোপে।
কিন্তু এঙ্গেলসের মুক্তির সময় তখনো আসে নি।
এখন আর তিনি কম্পানির কেরানি ছিলেন না। এঙ্গেলস-পরিবারের উত্তরাধিকারী রূপে কম্পানির
অংশীদার ছিলেন। আর্থিক অবস্থা আগের থেকে ভালো ছিল। মার্ক্সকে আগের থেকে বেশি সাহায্য
করতে পারছিলেন। কিন্তু ভাইদের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল তার বয়ান অনুযায়ী ১লা জুলাই ১৮৬৯এর
আগে তিনি কম্পানির কাজ ছাড়তে পারবেন না। তত দিন তাঁকে রোজ দপ্তরে যেতে হবে। “এই অভিশপ্ত বাণিজ্যে … সময়ের বিনষ্টি … আমায় পুরোপুরি ভগ্নোদ্যম করে দেয়”, তিনি লেখেন। শুধু কাজই তো নয়, ব্যবসায়ীদের
সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, তাদের বিনোদনে, পার্টিতে, ক্লাবে যোগ দেওয়া সবেতেই থাকতে হত। তার
মধ্যে একটা শিকারই ছিল যেটা এঙ্গেলস পছন্দ করতেন আর মার্ক্স সন্ত্রস্ত থাকতেন, এই না
দুর্ঘটনা ঘটে। সেটা হলও একদিন – এঙ্গেলস বিচ্ছিরি ভাবে পড়ে গেলেন আর আহত হলেন।
ব্যস, আগেরই মত ব্যবসাজগতের সব রকম ঝুটঝামেলা
মিটিয়ে রাতে যখন তিনি শহরের শেষপ্রান্তে নিজের আসল ঘরে পৌঁছোতেন তখন শান্তি পেতেন।
মেরি তখন আর নেই। মেরির মৃত্যুর পর তাঁর বোন লিডিয়া বা লিজ্জি এঙ্গেলসের স্ত্রী। তিনিও
মেরিরই মত আইরিশ বিপ্লবে বিশ্বাসী। তবে আচরণে ভিন্ন, ঘরোয়া, শান্ত প্রকৃতির নারী। এঙ্গেলসের
বন্ধুরা আসতেন। উইলহেল্ম উল্ফ, ‘লুপুস’ গত হয়েছেন। এখন
আসেন স্যামুয়েল মুর, গুম্পার্ট, শোর্লেমার, ড্রোঙ্কে এবং কয়েকজন আরো, জার্মান অভিবাসী।
এখানেই ১৮৬৭ সালে তাঁর পল লাফার্গের সঙ্গে দেখা হল। লাফার্গ পরে নিজের স্মৃতিচারণে
লিখেছেন যে একদিন যখন তিনি মার্ক্সের বাড়িতে গেলেন (ততদিনে মার্ক্সের দ্বিতীয় মেয়ে
লরার সঙ্গে লাফার্গের বিয়ের কথা হয়ে গেছে), মার্ক্স বললেন, “এখন যেহেতু তুমি আমার মেয়ের হবু বর, এঙ্গেলসের
সঙ্গে তোমার দেখা আমায় করাতেই হবে, … আর আমরা ম্যাঞ্চেস্টার রওনা হয়ে গেলাম।”
ম্যাঞ্চেস্টারে বসে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’র সাধারণ পরিষদের কাজে মার্ক্সকে প্রত্যক্ষভাবে
সাহায্য করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু চিঠির মাধ্যমে তিনি মার্ক্সকে সাহায্য করতেন এবং
তাত্ত্বিক সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতেন। উপরোক্ত জীবনীতেই উল্লেখ রয়েছে কিভাবে এঙ্গেলস
ম্যাঞ্চেস্টার থেকেই ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী
সমিতি’র নেতাদের চিঠি লিখে
তাঁদের সাধারণ পরিষদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করতেন। ম্যাঞ্চেস্টারে নিজের
জার্মান এবং ইংরেজ বন্ধু, শ্রমিকনেতা এবং লেখকদের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, শিক্ষা
সমিতি ইত্যাদির জন্য ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী
সমিতি’র সদস্যতার কার্ড
বিলি করতেন, হড়তালরত শ্রমিকদের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করতেন (হড়তালে সাহায্য করা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’র একটি প্রধান কাজ ছিল)। নিজে সাহায্য পাঠাতেন
‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী
সমিতি’র ছাপাখানার জন্য।
কিন্তু ‘সমিতি’র কথা জার্মানির শ্রমিকদের কাছে কিভাবে পৌঁছোবে? ১৮৬৩ সালে জার্মানির
শ্রমিকদের দুটো বড় শীর্ষ সংগঠন তৈরি হয়েছিল। ‘লীগ অফ জার্মান ওয়ার্কার্স সোসাইটিজ’ ছিল পূঁজিবাদী উদারপন্থী এবং গণতন্ত্রীদের
সঙ্গে – পুরোনো সব শিক্ষা
সমিতির কেন্দ্র ছিল এই সংগঠন। দ্বিতীয়টি ছিল ‘জেনেরাল এসোসিয়েশন অফ জার্মান ওয়ার্কার্স’ যার নেতৃত্ব ছিল লাসালপন্থীদের হাতে। প্রুশীয়
আইন অনুসারে শ্রমিক সংগঠন গুলো কোনো বিদেশি সংগঠনের সঙ্গে সম্বদ্ধ হতে পারত না। তাই
যখন লাসালপন্থী নেতাদের মধ্যে থেকে একজন, যোহান ব্যাপ্টিস্ট ভন শ্বেইটজার মার্ক্সকে
একটা প্রস্তাব দিলেন, মার্ক্স এঙ্গেলসের সঙ্গে কথা বললেন আর দুজনেই রাজি হয়ে গেলেন।
প্রস্তাবটা ছিল, ১৫ই ডিসেম্বর ১৮৬৪তে তাঁদের যে খবরের কাগজ ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট’ শুরু হবে তাতে যেন মার্ক্স লেখেন। উইলহেল্ম
লিবনেখ্ট খবরের কাগজটির সহায়ক সম্পাদক ছিলেন। এঙ্গেলস মার্ক্সকে লিখলেন, “ভালো হল। আমরা একটা মাধ্যম পেলাম। লিবনেখ্ট
যখন সহ-সম্পাদক, কিছুটা গ্যারান্টি তো থাকছেই।” অবশ্য সমালোচনাও করলেম, “‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট’! এটা কেমন নাম হল? ‘সর্বহারা’ রাখত!” কেননা ভাবধারা-সম্পর্কিত
নাম ব্যাপক ঐক্য তৈরি করার পথে বাধা সৃষ্টি করে। এঙ্গেলস চাইছিলেন খবরের কাগজটা পুরো
শ্রেণীকে সম্বোধন করুক, যাতে তাকে একজোট করা যায়।
‘পূঁজি’ রচনার সমাপন
‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট’এর প্রথম দিকে সংখ্যাগুলোতে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতির উদ্বোধনী সম্বোধন’ ছাপা হল। এঙ্গেলসের প্রথম লেখা ছিল ডেনমার্কের
সামন্ত-প্রভুদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগ্রাম-সম্পর্কিত একটি লোকগীতির অনুবাদ – ‘হের টিডমান, ডেনমার্কের একটি পুরোনো লোকগীতি’। সঙ্গে লেখকীয় মন্তব্য ছিল, “গানটি দেখায় কিভাবে … কৃষকেরা অভিজাতদের অহঙ্কার চূর্ণ করল। জার্মানির
মত দেশের জন্য, যেখানে অভিজাতের সংখ্যা ততই, যত পূঁজিবাদীর, আর সর্বহারাদের মধ্যে যতজন
শিল্পশ্রমিক, বেশি যদি নাও হয় অন্ততঃ ততজনই কৃষিশ্রমিক, উদ্দীপনায় ভরা এই প্রাচীন কৃষক
গীতি সবদিক থেকে উপযুক্ত।
কিন্তু, ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট’এ আরো লেখার পরিকল্পনা বাতিল করতে হল কেননা কাগজটার হালচালে বোঝা
যাচ্ছিল যে তারা পূঁজিবাদী শিবিরের সমালোচনার আড়ালে অভিজাত শ্রেণী, প্রুশীয় রাজতন্ত্র
এবং বিশেষকরে বিসমার্কের নীতিগুলোর সমর্থন করছে। এঙ্গেলস একটা বড় প্রবন্ধ তৈরি করেছিলেন
কাগজটার জন্য। শেষে সে প্রবন্ধ একটি চটিবই হিসেবে বার করতে হল – ‘প্রুশীয় সামরিক প্রশ্ন এবং জার্মান শ্রমিক পার্টি’। সামরিক-সংস্কার বা সৈন্যবাহিনী-সংক্রান্ত
সংস্কার এমন একটা বিষয় যেটার ব্যাপারে সাধারণভাবে এটাই বোঝানো হয় যে এতে আবার শ্রমিক
শ্রেণীর কী বক্তব্য থাকতে পারে। শ্রমিক শ্রেণী তখনই কিছু বলবে যখন এইসব সংস্কারের কারণে
তার ওপর করের বোঝা বা অন্যান্য প্রশাসনিক খরচের বোঝা চাপানো হবে। যখন নাকি বিষয়টি রাষ্ট্রের
শক্তি-ভারসাম্য-সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভবিষ্যতে সেটা প্রমাণও হল যখন বিসমার্কের
সামরিক-সংস্কারের পর প্রুশীয় সেনাবাহিনী অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করল; এই শক্তিপ্রদর্শনের
ফলে সংসদে পূঁজিবাদী বিপক্ষ বিসমার্কের শাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করল। খুবই সরল ভাষায়
লিখিত এই বইয়ের প্রথম অংশে, তথ্যাদির সাথে, প্রুশীয় সরকার যে সামরিক-সংস্কার হাতে নিয়েছে
তার ঐতিহাসিক পটভূমি দেওয়া আছে। দ্বিতীয় অংশে এই সামরিক-সংস্কার প্রসঙ্গে সংসদের বিপক্ষ,
অর্থাৎ পূঁজিবাদী শক্তিসমূহের সুবিধেবাদ, দুর্বলতা ইত্যাদি বিবৃত করা হয়েছে। তৃতীয়
অংশ শুরু হচ্ছে এই প্রশ্নের সঙ্গে যে এতে শ্রমিক শ্রেণী কী করবে? (মনে রাখতে হবে যে
সে সময় জার্মানিতে সার্বজনীন বয়স্ক ভোটাধিকার ছিল না)। সবচে’ আগে এঙ্গেলস পরামর্শ দেন যে সামরিক বাহিনীর
সংস্কারের অংশ হিসেবে যদি সার্বজনীন সামরিক-সেবা (সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক চাকরি)
বলবৎ হয়, তাহলে শ্রমিক শ্রেণীর দাবি তোলা উচিৎ যে সেটা যেন নিরপবাদ রূপে বলবৎ হয়। কেন?
কেননা অস্ত্রধারী ভোটদাতা ভালো ভাবে নিজের ভোট রক্ষা করপ্তে সক্ষম। কিন্তু এটা তো তাৎকালিক
ব্যাপার। আসল প্রশ্ন যে শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতি কী হবে? জার্মানির মত দেশে যেখানে পূঁজিবাদী
শক্তির উত্থান হলেও সামন্তবাদ এখনও শক্তিশালী এবং রাষ্ট্রশক্তি, সামাজিক শক্তি রূপে
সর্বহারার উদয়ের পর পূঁজিবাদী এবং সামন্তবাদী, দুই শক্তিই তাকে নিজের শিবিরে টানার
চেষ্টা করতে থাকে – বরং, সামাজিক আন্দোলনে
সক্রিয় একটা পাতি-পূঁজিবাদী শ্রেণীও আছে – সেখানে শ্রমিক শ্রেণীর নিজের রাজনীতি কী হবে? এই রাজনৈতিক দৃশ্যে
এঙ্গেলস একটি নতুন বাড়তে থাকা প্রবৃত্তি, বোনাপার্টবাদেরও শ্রেণীগত বিশ্লেষণ করেন।
দেখান যে কেমনভাবে একটা স্বৈরাচারী সরকার, শ্রমিকদেরকে নিজের দিকে টানার জন্য পূঁজিবাদী
শোষণের কথা তো বলে কিন্তু ঘৃণ্য অভিজাতশ্রেণীর দুর্নীতি আড়াল করে রাখে। এই সব বিভিন্ন
শ্রেণীগত কার্যকলাপের ভিতরে থেকে শ্রমিক কেমনভাবে একের পর এক রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়ে,
কখনো এই শ্রেণী কখনো ঐ শ্রেণীর সঙ্গে হাত মিলিয়াও নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অভীষ্ট
লক্ষ্যের দিকে এগোবে, সে পথেরই বর্ণনা করেন এঙ্গেলস বইটার তৃতীয় অংশে। ভালো প্রচার
পেয়েছিল বইটা। আলাদা আলাদা অংশ বিভিন্ন জায়গায় ছাপা হয়েছিল।
এ বইটা লেখা হয়েছিল ১৮৬৫তে। দপ্তরে, শহরে ও
আবাসে দৈনন্দিন, সাংগঠনিক কাজকর্ম এবং চিঠিপত্রে/সাক্ষাতে মার্ক্সের সঙ্গে আলোচনা বাদে
জীবনের কালপঞ্জী ধরতে গেলে রচনাসমগ্র দেখেই এগোতে হয়। ১৮৬৫র পর দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ
পাচ্ছি ১৮৬৬তে। প্রথমটা হল, ‘পোল্যান্ডের প্রশ্নে শ্রমিক শ্রেণীসমূহের কী করণীয়’। পোল্যান্ডের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্র-শক্তি
হওয়ার প্রশ্ন, পোল্যান্ডের বিদ্রোহ-দমন … সমস্ত কিছু মিলেমিশে একটা টাটকা ক্ষত হয়ে উঠেছিল পোল্যান্ডের প্রশ্ন।
‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক
সমিতি’ প্রতিষ্ঠার বনিয়াদ
যে সভায় রচিত হয়েছিল সেটাও পোল্যান্ডেরই সমর্থনে ডাকা হয়েছিল। এঙ্গেলসের প্রবন্ধে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা ছিল প্রুধোঁবাদের। ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’তে, বিশেষকরে ফ্রান্স এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশের প্রুধোঁবাদী সদস্যেরা
জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে যে কথাগুলো রাখছিল সেগুলো ফ্রান্স-শাসনরত বোনাপার্টবাদেরই
কথা। প্রতিটি বিকশিত স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্রশক্তির অধীনে সেই দেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগত
জনগোষ্ঠির জন্য তারা জাতীয় স্বাধীনতা দাবি করছিল। এ ধরণের কথাবার্তা ছিল লুই বোনাপার্টের
পরিকল্পনায় মদতগার। বিকশিত জাতিরাষ্ট্রশক্তিগুলো নিজের নিজের দেশের কয়েকটি করে জাতীয়
আন্দোলন শান্ত করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সে দেশ আক্রমণ করে ঢুকবে ফ্রান্স – এটাই ছিল লুই বোনাপার্টের পরিকল্পনা! … এ ধরণের কথাবার্তা পোল্যান্ডের জাতিসত্ত্বার
প্রশ্নটাকে আড়াল করে দিচ্ছিল। বিভাজিত পোল্যান্ডকে লুটেপুটে খাচ্ছিল প্রুশীয়, অস্ট্রীয়
এবং রুশীয় রাজতন্ত্র আর পোল্যান্ডের অভিজাতশ্রেণী তাদেরই পা চাটছিল। এঙ্গেলসের প্রবন্ধ
‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী
সমিতি’র সভাগুলোয় মার্ক্সকে
তো সাহায্য করলই, ভবিষ্যতের জন্য সর্বহারাশ্রেণীর আন্তর্জাতিক নীতিও স্পষ্ট করল।
দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘জার্মানির যুদ্ধ প্রসঙ্গে মন্তব্য’। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল প্রুশীয় এবং অস্ট্রীয়
রাষ্ট্রশক্তির মধ্যে চলতে থাকা যুদ্ধের বিশ্লেষণ করে জার্মান সর্বহারাকে জার্মানির
একীকরণের প্রশ্নে উজ্জীবিত করা। এবং তাদেরকে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রী ও পাতি-পূঁজিবাদী
দুর্বলতা থেকে বাঁচানো।
ওদিকে মার্ক্সের দীর্ঘ একনিষ্ঠ সাধনা সম্পন্ন
হওয়ার মুখে ছিল।
অনেক বছরের গভীর অধ্যয়ন, চারটি গবেষণা-পর্বের
পরিকল্পনা (পূঁজির উৎপাদন প্রক্রিয়া, পূঁজির প্রচলন প্রক্রিয়া, সামগ্রিকভাবে পূঁজিবাদী
উৎপাদন, উদ্বৃত্তমূল্যের সিদ্ধান্তসমূহ), সবগুলো পর্বেরই সামগ্রীসংগ্রহ ও বিশ্লেষণের
কাজ একটু একটু করে পুরো করে শেষে লিখতে বসা …। ১৮৬৪ সালের ২৯শে নভেম্বর লুডউইগ কুগেলমানকে চিঠিতে তিনি লিখছেন,
“মনে হয় পূঁজির ওপর
আমার বইটা … অবশেষে, পরের বছর
প্রেসে পাঠানোর জন্য তৈরি হতে পারবে।” তার আগেই প্রকাশক, হামবুর্গের মেসনারের সঙ্গে কথাবার্তাও হয়ে গেছে,
চুক্তিও হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। দু’মাস পর দেখা যাচ্ছে এঙ্গেলস তাড়া দিচ্ছেন। বলছেন মেসনারের কাছে নিজেই
যাও, টাকাপয়সা নিয়ে কথা বলো। “তাছাড়া, এবার তাড়াতাড়ি শেষ কর। বইটার জন্য আদর্শ সময়, জনগণের মনে
আবার আমাদের প্রতি সম্ভ্রম ফিরে এসেছে।”
১৮৬৫ গেল, ১৮৬৬ গেল। দেরি হওয়ায় প্রকাশকের
সঙ্গে চুক্তি বদল হল। কিন্তু পুরো হল না। ১৮৬৭র
শুরুতেও দিন পেরিয়ে যেতে লাগল। কারণ একই, সাংগঠনিক কাজের চাপ, রাজনৈতিক লেখার চাপ,
শরীরের বাড়তে থাকা অসুখ এবং তার জন্য বাধ্যতামূলক ছুটি, একান্ত প্রয়োজনে এদিক ওদিক
যাওয়া …। একটা নমুনা দিই।
চিঠিটা এঙ্গেলসকে লেখা, ১৮৬৭র ১৯শে জানুয়ারি, “দীর্ঘকালীন নীরবতার জন্য কাজের চাপের অজুহাত দিয়ে মেসনার” [প্রকাশক] “লিখেছে যে আমার পরিকল্পনা ‘তার কাছে স্বীকার্য নয়’।”
যাহোক, সে সমস্যা মিটে গেছিল। মেসনার এক সঙ্গে
দুই খণ্ড তৈরি চাইছিলেন আর মার্ক্স চাইছিলেন, শেষ হয়ে আসা প্রথম খণ্ড অবিলম্বে ছেপে
বেরোক। শ্রমিক আন্দোলনে জোয়ার এসেছে। শ্রমের শোষণের উদ্বৃত্তমূল্য-তত্ত্বটা এই মুহূর্তে
সবার কাছে পৌঁছে যাওয়ার দরকার আছে।
দ্বিতীয় খণ্ড একসঙ্গে কেন দিতে পারবেন না সে
বিষয়ে এঙ্গেলসকে লিখছেন, “দেরি যা হয়েছে তা
হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ড সম্পর্কে কথা দেওয়ার পথে বিরাট বাধা হল এই সত্যিটা যে প্রথম খণ্ড
বেরিয়ে গেলে আমায় স্বাস্থ্যের কারণে ছুটি নিতে হবে। আর মহাদেশে” [ইংল্যান্ড বাদে ইয়োরোপের মূলভূমি অর্থে]
“একটু ঘুরেফিরে নিশ্চিত
হতে হবে যে আর্থিক অবস্থা ভালো করার কোনো উপায় করতে পারি কিনা। অবস্থা দিনের পর দিন
আরো খারাপ হচ্ছে, এত বিপজ্জনক যে যে-কোনো দিন সব কিছু মাথায় ভেঙে পড়তে পারে। শুধু রুটিওয়ালারই
কুড়ি পাউন্ড বকেয়া আছে। তারপর আছে মাংসওয়ালা, মুদির দোকান, কর ইত্যাদি। এসবকিছুর ওপর
আবার … ” [বলছেন যে বাড়িটা যেহেতু অন্য কেউ কিনে নিয়েছে,
সে গত তিন মাসের ভাড়া চাইছে অবিলম্বে এবং যেহেতু এই মার্চেই লীজ শেষ হবে, থাকতে হলে
বেশি সময়ের লীজ নিতে বলছে। না জবাব দিলে দালাল নতুন ভাড়াটে খুঁজবে।]
“শরীরের অবস্থা গত
কয়েক সপ্তাহ ধরে আগের চেয়ে ভালো আছে, বাঁ কোমরে মাত্র কয়েকটা ছোট ফোঁড়া” [কার্বাঙ্কল] “তবে তেমন কিছু নয়। শুধু ভয়াবহ অনিদ্রা, যা
অস্থির করে তোলে …”
এক মাস পর ২১শে ফেব্রুয়ারি আবার লিখছেন, “একেক দিন করে আমি তোমায় চিঠি লেখার দিনটা পিছিয়ে
দিচ্ছিলাম, কিন্তু বড় চাপের মধ্যে আছি। যদি মুদিকে অন্ততঃপক্ষে পাঁচ পাউন্ড না দিই,
পরশু সে তার কর্মচারিকে বাড়িতে পাঠাবে।
“একটু অতিরিক্ত খরচও
হয়েছে। লরার স্বাস্থ্যের জন্য একটু একটু শ্যাম্পেন খাওয়াতে বলেছিল। তার ছোট বোতলের
দুই পাউন্ড দিতে হয়েছে আর সেই, ডাক্তারেরই পরামর্শে ও যে কসরত শিখবে, তার জন্যও দুই
পাউন্ড অগ্রিম দিতে হয়েছে।
“কাজটা” [পূঁজি] “শিগগিরই শেষ হবে। আজকেই হয়ে যেত যদি এত বেশি হয়রানির মধ্যে না
পড়তাম।”
এঙ্গেলস কিন্তু জানুয়ারির পর কোনো চিঠির জবাব
দেন নি, শুধু টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কেন? ১৩ই মার্চে চিঠি লিখে বললেন, কাজে তো আটকা
পড়েইছিলাম কিন্তু “ইচ্ছে করেও লিখিনি
যে আগে ‘বইটা’ পুরো হয়ে যাক। এখন, আশা করি পুরো হয়ে গেছে।
মেসনারের সঙ্গে কবে দেখা করতে যাবে?”
অবশেষে ২রা এপ্রিল মার্ক্স লিখলেন, “প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বই লেখা শেষ হওয়ার ঘোষণা
না করতে পারা অব্দি তোমায় চিঠি লিখব না। হয়ে গেছে শেষ। দেরি হওয়ার কারণ বলেও তোমায়
বিরক্ত করতে চাই নি। যেমন কোমরের সামনে, পিছনে, শীশ্নের কাছে এত ফোঁড়া যে লেখার জন্য
বসাই প্রচন্ড কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছিল। …
“পরের সপ্তাহে পান্ডুলিপিটা
আমায় নিজেই হামবুর্গে নিয়ে যেতে হবে। …”
চার তারিখে সে চিঠি পেয়েই এঙ্গেলস চিঠি লিখতে
বসলেন, “প্রিয় মুর,”
প্রথম শব্দ লিখলেন, “হুররা!
‘দাস ক্যাপিটাল’ বা ‘পূঁজি’ যে সত্যের প্রকাশ
ঘটালো, আর যে সমস্ত দুঃখকষ্টকে জয় করে মার্ক্স বইটা লিখে উঠলেন, সে-কথা ভাবলে আজও ওই
জয়ের উদ্ঘোষ আমাদের মুখ থেকে আপনিই বেরিয়ে আসে – হুররা! শোষণ নির্মূল করে, মানুষের জীবনকে সুন্দর করে তোলার যুগান্তকারী
অস্ত্র হাতে পেল সর্বহারা!
আইরিশ প্রশ্ন, ফরাসি-প্রুশীয় যুদ্ধ এবং প্যারি কমিউন
ম্যাঞ্চেস্টারে শেষ কয়েকটি বছর
এদিকে মার্ক্স ‘পূঁজি’র প্রথম খণ্ড পুরো করলেন, ওদিকে জার্মানি থেকে ভালো খবর এল।
জার্মান শ্রমিক শ্রেণীর সবচেয়ে ভালো নেতাদের
মধ্যে থেকে দু’জন, উইলহেল্ম লিবনেখ্ট
এবং অগাস্ট বেবেল উত্তর-জার্মানির সংসদে নির্বাচিত হলেন। প্রথমবার প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তবাদী-পূঁজিবাদী
সংসদে সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হলেন।
এঙ্গেলসের রুশীয় জীবনীটায় একটি উদ্ধৃতি আছে,
লরাকে (মার্ক্সের মেজ মেয়ে) লেখা এঙ্গেলসের একটি চিঠি থেকে। “স্যাক্সনির শ্নিবার্গ থেকে তোমার বন্ধু ‘লাইব্রেরি’” [মার্ক্সের পরিবারে উইলহেল্ম লিবনেখ্টকে
দেওয়া নাম] “কাউন্ট জুর লিপ্প্কে
হারিয়েছে, উত্তর-জার্মানির অতি-গুরুত্বপূর্ণ সংসদে নির্বাচিত হয়েছে, আর বোধহয় শিগগিরই
নিজের প্রথম বক্তৃতা দেবে।” সেই বক্তৃতার পর
মার্ক্সের বন্ধু কুগেলমানকে লিখলেন, “বার্লিনের গরু-মোষের বাথানে লিবনেখ্ট খুব ভালো কাজ করছে।” অর্থাৎ, খুব খুশি ছিলেন তিনি যে জার্মানিতে
পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। লিবনেখ্টকে পরামর্শ দিলেন, “বিস্মার্কের শত্রুদের ওপরও ততোটাই তীব্র আক্রমণ চালাও যতটা বিস্মার্কের
ওপর, কেননা ওরাও অকাজের।” লিবনেখ্ট আর বেবেলের
প্রত্যেকটি সংসদীয় বক্তৃতা তিনি মন দিয়ে পড়তেন এবং তাদের ভুলত্রুটিগুলো শোধরাতে থাকতেন।
বলতেন, সব একসঙ্গে চলবে – সরকারী নীতির সমালোচনা,
পূঁজিবাদী গণতন্ত্রীদের দুর্বলতা এবং সমঝোতার প্রবৃত্তির ওপর প্রহার, এবং সর্বহারা
পার্টি-লাইনকে অগ্রসর করা। বস্তুতঃ, মার্ক্স-এঙ্গেলসের নিয়মিত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে
সাধারণ অবস্থায় পূঁজিবাদী সংসদীয় রাজনীতিতে সর্বহারা পার্টির রণকৌশলের ভিত্তি রচিত
হল।
‘পূঁজি’র প্রকাশন, লিবনেখ্ট ও বেবেলের নির্বাচনে
জয়লাভ এবং মার্ক্স-এঙ্গেলসের নিয়মিত হস্তক্ষেপের প্রভাবে ৫ই ডিসেম্বর ১৮৬৮তে ন্যুরেমবার্গে
অনুষ্ঠিত ‘লীগ অফ জার্মান ওয়ার্কার্স
সোসাইটিজ’এর কংগ্রেসে অধিকাংশ
সদস্য উদারপন্থী পূঁজিবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল। ন্যুরেমবার্গে গৃহীত কর্মসূচি
‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী
সমিতি’র লাইনে এল। এর প্রভাব
দ্বিতীয় জার্মান সংগঠন ‘জেনেরাল এসোসিয়েশন
অফ জার্মান ওয়ার্কার্স’এর ওপরও পড়ল। লাসালপন্থীরা
দুর্বল হতে লাগল। সংগঠনের সাধারণ কনভেনশনে মার্ক্সের ‘পূঁজি’ প্রসঙ্গে একটি প্রতিবেদন পড়া হল, সবাই শুনল।
ইতোমধ্যে জার্মান পুলিস ‘জেনেরাল এসোসিয়েশন’এর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল। ১৮৬৮র সেপ্টেম্বরে
এঙ্গেলসের একটি প্রবন্ধ লাইপজিগের এক শ্রমিক-পক্ষীয় সংবাদপত্রে বেরোল, যাতে তিনি লাসালবাদের
সমালোচনা করে পরামর্শ দিলেন যে পুরোনো ধাঁচের সংগঠন আবার দাঁড় করানোর বদলে, ‘এসোসিয়েশন’এর সদস্যরা যদি একটি ঐক্যবদ্ধ সর্বহারা পার্টি গড়ে তুলতে সাহায্য
করেন, সেটা শ্রেয়তর হবে। এইসব পরামর্শ এবং উদ্ভূত হতে থাকা পরিস্থিতির প্রভাবে ‘এসোসিয়েশন’ থেকেও একটা বিপ্লবী অংশ বেরিয়ে গেল। ১৮৬৯র
৭ থেকে ৯ই আগস্ট, আইসেনাখে একটি বড় অধিবেশনে যোগ দিল ‘জেনেরাল এসোসিয়েশন অফ জার্মান ওয়ার্কার্স’এর বিপ্লবী অংশ, ‘লীগ অফ জার্মান ওয়ার্কার্স সোসাইটিজ’এর এবং ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’র জার্মান অংশ এবং কয়েকটি ট্রেড ইউনিয়ন। সিদ্ধান্ত হল যে ‘সামাজিক-গণতন্ত্রী শ্রমিক পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এভাবে, বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের
মতাদর্শে জার্মান শ্রমিকদের প্রথম গণ-পার্টি প্রতিষ্ঠিত হল। পার্টির সংবাদপত্র হল ‘ভোকস্টাট’। এই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে থাকা প্রবন্ধ, প্রতিবেদন ইত্যাদির
মাধ্যমে এঙ্গেলস পার্টির পথপ্রদর্শনে সাহায্য করতে লাগলেন।
১৮৬৭র এপ্রিলে ‘পূঁজি’র প্রথম খণ্ড পুরো হয়েছিল। গ্রন্থটি লেখার সময় হোক বা তারও আগে সামগ্রী
সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ, গবেষণার দিকগুলো বা রচনার পরিকল্পনা … প্রতিটি স্তরে মার্ক্স এঙ্গেলসের সঙ্গে আলোচনা
করে এগিয়েছিলেন। এখন হামবুর্গ থেকে যেমন যেমন প্রুফ আসতে লাগল, মার্ক্স দেখে এঙ্গেলসের
কাছে পাঠিয়ে দিতে লাগলেন। এঙ্গেলসের পরামর্শে অনেক জায়গায় পাঠে সংস্কার করলেন মার্ক্স।
গ্রন্থটি মুদ্রিত হতে হতে সেপ্টেম্বরের শেষ এসে গেল।
এঙ্গেলসের জন্য শুরু হল একটি নতুন যুদ্ধ-কাল।
অক্টোবর ১৮৬৭ থেকে জুলাই ১৮৬৮ অব্দি এঙ্গেলস বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং সংবাদপত্রের জন্য
‘পূঁজি’র সমীক্ষা লিখে গেলেন। ১২ই অক্টোবরে লিখলেন
‘ডায় জুকুংফ্ট’ এবং ‘রাইনিশে জাইটুং’এর জন্য। ২২শে অক্টোবর ‘এলবারফেল্ডার জাইটুং’এর জন্য। ৩ থেকে ৮ নভেম্বরের মাঝে ‘ডুসেলডর্ফার জাইটুং’এর জন্য। ১২-১৩ ডিসেম্বরে ‘ডের বেওবাখ্টের’এর জন্য। সেদিনই আরেকটি পত্রিকা ‘স্টাট্স-এঞ্জেইগার ফুর উর্টেমবার্গ’এর জন্যও লিখলেন একটি সমীক্ষা। ১৮৬৮র জানুয়ারির
শুরুতে ‘ন্যুয়ে বাডিশ ল্যান্ডেসজাইটুং’এর জন্য লিখলেন। ‘ডেমোক্রাটিশেস ওশেনব্লাট’এর জন্য লিখলেন মার্চের প্রথম দিকে। মে-জুন
মাসে দীর্ঘ একটি সমীক্ষা ‘দ্য ফোর্টনাইটলি
রিভিউ’এর জন্য তৈরি করলেন।
পত্রিকাটা ইংরেজি, অনুবাদটা করতে দিলেন স্যামুয়েল মুরকে, যিনি পরে ‘পূঁজি’রও প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। ইংল্যান্ডের এই পত্রিকায় সমীক্ষাটি
স্যামুয়েল মুরের নামেই ছাপার কথা ছিল। কিন্তু পত্রিকাটি শেষ অব্দি সাহসই করতে পারল
না ছাপার। ফল ভোগ করল বিশ্ব, কেননা ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোয়, ‘পূঁজি’ নামে যে একটি বই বেরিয়েছে আর তাতে প্রমাণ করা হয়েছে যে আধুনিক সভ্যতার
পূঁজিবাদী সমৃদ্ধির ভিত্তি হল শ্রমের শোষণ, সে খবরটাই তখন পৌঁছোলো না।
১৮৬৮র গ্রীষ্মকালে এঙ্গেলস শুরু করেছিলেন ‘সিনপসিস অফ ভল্যুম ওয়ান অফ ক্যাপিটাল বাই কার্ল
মার্ক্স’ লেখা শুরু করেছিলেন।
এই দীর্ঘ প্রবন্ধটাও তিনি ‘দ্য ফোর্টনাইটলি
রিভু’এর জন্য তৈরি করছিলেন।
কিন্তু যখন খবর পেলেন যে সমীক্ষাটা ছাপে নি, এই প্রবন্ধটাও তিনের-দুই-ভাগ লিখে ছেড়ে
দিলেন। নইলে এই অসাধারণ সিনপসিসটার পূর্ণরূপ বিশ্বের পাঠকেরা পড়তে পেত।
এই সব সমীক্ষাগুলো লিখতে লিখতেই তিনি মার্ক্সের
জীবন নিয়ে একটি লেখা তৈরি করলেন। এটাই মার্ক্সের প্রথম জীবনকথা। লেখাটা খুব দরকার ছিল
কেননা জার্মানিতে ফার্দিনান্দ লাসালের যথেষ্ট প্রভাব ছিল সেসময়। তার একটা বিশেষ কারণও
ছিল। লাসালপন্থীরা যখন দেখল যে শ্রমিক সংগঠনে মার্ক্স-এঙ্গেলসের প্রভাব বাড়ছে, তারা
মার্ক্সবাদেরই চিন্তাসূত্রগুলো নিজেদের ধরণে বিকৃত করে প্রচার করা শুরু করলেন যে এসব
তো লাসালেরই ভাবনা, মার্ক্স চুরি করে নিয়েছেন। এঙ্গেলস জীবনকথাটি ‘ডায় গার্টেনলব’এর জন্য লিখেছিলেন। কিন্তু তারা ছাপল না। পরের
বছর আগস্টে আবার লিখলেন, তখন ছাপল ‘ডায় জুকুংফ্ট’।
ধীরে ধীরে, বাণিজ্যিক দৈনন্দিনের একঘেয়েমি
থেকে মুক্তি পাওয়ার দিন এগিয়ে আসছিল। দপ্তরে বসে কাজ করার শর্তের সময়কাল ৩০শে জুন ১৮৬৯তে
শেষ হওয়ার ছিল। এবং শর্ত অনুযায়ী এঙ্গেলস তাঁর নিজের অংশের পূঁজি তার এক বছর পরে ওঠাতে
পারতেন। কিন্তু কম্পানিতে এঙ্গেলসের অংশীদার এর্মেন জানতেন যে এঙ্গেলস এইসব কাজের একঘেয়েমির
কারণে অবসাদে ভোগেন। তাই প্রস্তাব দিলেন যে এক বছর আগেই নাহয় এঙ্গেলস নিজের অংশের পূঁজিটাও
উঠিয়ে নিন। এতদিন ধরে কাজ করেছেন বলে অবসরগ্রহণ-জনিত কিছু সুবিধেরও ব্যবস্থা করে দেওয়ারও
প্রস্তাব দিলেন। এঙ্গেলস খুশি হলেন বটে কিন্তু মনে হল আরো কিছু অর্থের বন্দোবস্ত হলে
মার্ক্স এবং তার পরিবারকে একটু বেশি সাহায্য করতে পারা যাবে। তাই তিনি, এক বছর আগে
নিজের অংশের পূঁজি উঠিয়ে নেওয়ার ক্ষতিপূরণ চাইলেন। একটু দীর্ঘ দরদামের পর সেটাও স্থির
হয়ে গেল।
১লা জুলাই ১৮৬৯, এঙ্গেলস প্রিয় বন্ধুকে লিখলেন,
“প্রিয় মুর, হুর্রা!
আজ ‘মিষ্ট বাণিজ্য’” [সমকালীন পূঁজিবাদী ধারণা যে বাণিজ্য মানুষকে
উগ্র থেকে ভদ্র বানায়] “শেষ হল এবং আমি এক
মুক্ত মানুষ। … টুসি” [মার্ক্সের ছোট মেয়ে, প্রায়ই ম্যাঞ্চেস্টারে
এঙ্গেলসের কাছে চলে আসতেন] “আর আমি আজ সকালে আমার প্রথম মুক্ত দিন, ক্ষেতের রাস্তায় অনেকক্ষণ
ধরে হেঁটে উদযাপন করলাম।”
সেদিনই মাকেও চিঠি লিখলেন, “মা, আজ আমার মুক্তির প্রথম দিন। আর তোমাকে
চিঠি লেখা এমন একটা দিন ব্যবহার করার সবচেয়ে ভালো উপায়। …” [গটফ্রিড এর্মেনের সঙ্গে দরকষাকষির দীর্ঘ
বর্ণনার পর] “এই নতুন স্বাধীনতাটাই
আমার দরকার ছিল। কাল থেকে আমি একদম নতুন মানুষ হয়ে গেছি আর আমার বয়স দশ বছর কমে গেছে।
আজ সকালে বিষন্ন শহরটায় যাওয়ার বদলে কয়েক ঘন্টা এই চমৎকার আবহাওয়ায় ক্ষেতে হাঁটলাম।
“গুদামে, মদের দোকানের
উঠোনে খোলা আমার বিষন্ন ঘরটায় বসে আমি যেমন ধরণের কাজ করতাম, তার থেকে একেবারে ভিন্ন
ধরণের কাজ করা যায় আরামদায়কভাবে সাজানো আমার ঘরের টেবিলটায়, যার সামনের জানলা খুলে
চৌকাঠে ফুলদানি রাখা যায়, সামনের গাছ দেখা যায়; কালো ধোঁয়ার দাগে ভরে যায় না সব কিছু।”
মার্ক্স জবাব দিলেন ৩রা জুলাই, “প্রিয় ফ্রেড, ‘মিশরের বন্দীত্ব’ [বাইবেলের উদাহরণ; মোজেস যাদেরকে নিয়ে ফারাওয়ের
শাসন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন] থেকে পালিয়ে আসতে পারার জন্য অভিনন্দন!”
“এই ঘটনার সম্মানে
একটু বেশিই মদ খেয়ে ফেললাম, তবে রাতের দিকে, প্রুশীয় সশস্ত্র পুলিসের মত সূর্যোদয়ের
আগে নয়।”
টুসি অর্থাৎ ইলিয়ানর পরে স্মৃতিচারণ করেছেন,
“এঙ্গেলস যখন এই বাঁধোয়া
শ্রমের কালান্তে পৌঁছোলেন আমি সঙ্গে ছিলাম। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম কিভাবে এতগুলো বছর
উনি কত কিছু সয়ে থাকবেন। আমি ভুলব না যখন সকালে দপ্তরে যাওয়ার সময় জুতো পরতে পরতে,
কোনো যুদ্ধ জয় করার মত কন্ঠস্বরে ঘোষণা করলেন, “শেষ বারের মত …”
“কয়েক ঘন্টা পর আমরা
গেটে ওনাকে নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। যে বাড়িটায় উনি থাকতেন তার সামনে একটা ছোটো
মাঠ ছিল। ওনাকে আমরা মাঠ পার করে আসতে দেখলাম। নিজের ছড়িটা হাওয়ায় ঘোরাচ্ছিলেন আর গান
গাইছিলেন। হাসিতে ভরা ছিল মুখ। সেই মুহূর্তটা উদযাপন করার জন্য আমরা টেবিল সাজালাম,
শ্যাম্পেন খেলাম! কী আনন্দে ছিলাম আমরা!”
১০ই জুলাই কুগেলমানকে এঙ্গেলস লিখলেন, “আপনাকে আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই যে ঐ অভিশপ্ত
বাণিজ্য থেকে ছাড়া পেয়ে, নিজের জন্য কাজ করতে সক্ষম হয়ে কতটা খুশি আমি। বিশেষ করে এজন্যও
যে ছুটিটা তখন পেলাম যখন ইয়োরোপের ঘটনাবলি দ্রুততর গতিতে সংকটজনক বাঁকের দিকে যাচ্ছে,
যে কোনো দিন হঠাৎ, হতে পারে আকাশে মেঘ গর্জন করে উঠবে।” এঙ্গেলস কেন, কেউই জানত না তখন যে দু’বছরের মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীর প্রথম স্বতন্ত্র
রাষ্ট্রশক্তি ‘প্যারি কমিউন’ প্রতিষ্ঠিত হবে।
ম্যাঞ্চেস্টার থেকে ছাড়া পেতে আরো কিছু দিন
লাগবে। কাগজে স্বাক্ষর হওয়া, পয়সাটা হাতে পাওয়া …। কিন্তু লেখাপড়ার জন্য এখন সারাদিনের অটুট সময়। তাই এঙ্গেলস
একটা নতুন বড় কাজ হাতে নিলেন।
বিগত দুই বছর ধরে আয়ারল্যান্ডের প্রশ্ন ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিজীবী সমিতি’র সাধারণ পরিষদে উঠছিল। প্রশ্নটার সম্মুখীন
তাঁকে বাড়িতেও হতে হত কেননা বর্তমান স্ত্রী লিডিয়াও আইরিশ জাতীয়তা আন্দোলনের ততটাই
তীব্র সমর্থক ছিলেন যতটা তাঁর দিদি মেরি। কিন্তু টাটকা ঘটনা ছিল যে ১৮৬৭ সালে আয়ারল্যান্ডে
একটি বিদ্রোহ ঘটেছিল। বিদ্রোহের প্রভাব লন্ডন এবং ম্যাঞ্চেস্টার অব্দি ছড়িয়ে পড়ল। বিদ্রোহী
আইরিশ প্রজাতন্ত্রী ভ্রাতৃত্ব নিজেদের ‘ফেইনিয়ান’ [আইরিশ ভাষায় ‘জনতা’] বলত। বিদ্রোহ অসংগঠিত
ও দুর্বল ছিল তাই পুরোপুরি অসফল হল। কিন্তু তার আবেগ বিশ শতক অব্দি প্রতিধ্বনিত হয়েছিল।
সেদিন অব্দিও, এবং বোধহয় আজও আয়ারল্যান্ডের বড় প্রজাতন্ত্রী পার্টিটার নাম ‘সিন ফেইন’, মানে আমরা, জনতা। সে যাহোক, ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’তে আয়ারল্যান্ডের বিদ্রোহ নিয়ে আলোচনা হল।
আইরিশ বন্দীদের ছাড়িয়ে নেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় ম্যাঞ্চেস্টারে শহীদ হওয়া বিদ্রোহীদেরকে
বিশ্বের শ্রমিক শ্রদ্ধার চোখে দেখছিল। মার্ক্স সাধারণ পরিষদে আইরিশ জাতীয়তা আন্দোলনের
সমর্থনে আইরিশ স্বাধীনতা অর্থাৎ ব্রিটিশ রাষ্ট্র থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করার দাবি প্রস্তাবিত
করলেন। জাতীয়তার প্রশ্নে পোল্যান্ডের পর এটি দ্বিতীয় বিষয় ছিল এবং শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের
সঙ্গে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বন্ধুত্বের প্রথম তত্ত্বায়ন। ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণী
আইরিশ বিদ্রোহী বন্দিদের প্রশ্নে বিভাজিত ছিল। মার্ক্স এঙ্গেলসের সাহায্য চাইলেন। এঙ্গেলস
বড় কাজের পরিকল্পনা করলেন যে প্রাচীন কাল থেকে আইরিশ জনতার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করবেন।
তার জন্য আরো একবার আয়ারল্যান্ড যাওয়ার দরকার ছিল।
১৮৬৯এর ৬ই সেপ্টেম্বর এঙ্গেলস, তাঁর স্ত্রী
লিডিয়া (লিজ্জি) বার্ন্স এবং ইলিয়ানর (টুসি) আয়ারল্যান্ড রওনা হলেন। দশ দিন ঘুরে ১৬
তারিখে তাঁরা ফিরে এলেন। তারপর এঙ্গেলস আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস নিয়ে কাজ শুরু করলেন।
একেকটা অধ্যায় ভেবে নোট লিখে পরিকল্পনা সাজালেন। প্রথম দিকের কয়েকটি অংশ লিখলেনও।
প্যারি কমিউন
আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস লেখার কাজটা শেষ অব্দি
আর হল না। ১৮৭০ সালের জুলাইয়ে ফ্রান্স আর প্রুশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পরের বছর প্যারিসে
শাসনক্ষমতা দখল করল শ্রমিকদের প্রথম সরকার, ‘প্যারি কমিউন’। এঙ্গেলস নিজেও ম্যাঞ্চেস্টারের পাট চুকিয়ে সেপ্টেম্বর মাস থেকে
লন্ডনে বসবাস শুরু করলেন। তিনি এসে পৌঁছোতেই ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’র সাধারণ পরিষদ তাঁকে পরিষদের অন্তর্ভুক্ত করে নিল। তিনিও পুরোপুরি
সমিতির কাজে যোগ দিলেন।
আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস লেখার জন্য তিনি যে প্রস্তুতি
নিয়েছিলেন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্র, খণ্ড ২১ (ইংরেজি)এর
মুখবন্ধে এবং পাঠের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৪৫এ ফুটনোটে (১৮৪)।
“এঙ্গেলসের ‘আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস’এর অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি, সেই পাণ্ডুলিপির
প্রস্তুতিমূলক সামগ্রী (‘গোল্ডউইনের বই – আইরিশ ইতিহাস এবং আইরিশ চরিত্র – এর ওপর নোটস’ এবং ‘আইরিশ বাজেয়াপ্তকরণের ইতিহাসের বিবিধ’) সাক্ষ্য দেয় যে প্রাচীন কাল থেকে আয়ারল্যান্ডের
এমন একটি বৃহৎ, সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস তৈরি করার ইচ্ছে ছিল তাঁর, যাতে দেশটির অধীনতার পর্বগুলো
এবং আইরিশ জনতার মুক্তিসংগ্রামের যাত্রাপথ আলোকিত হয়।
“এঙ্গেলস ‘আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস’এর পাণ্ডুলিপির শুধু প্রথম অধ্যায় (‘নৈসর্গিক অবস্থা’) এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ের (পুরোনো আয়ারল্যান্ড)
প্রারম্ভটা পুরো করতে পেরেছিলেন …।” [মুখবন্ধ]
"… ১৮৬৯এর শেষে শুরু করে ১৮৭০এর প্রথম ছ’মাস এঙ্গেলস” [‘আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস’এর ওপর।] “কাজ করেছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল কয়েকটি খন্ডে বইটি লেখার এবং যা আছে
তা তার ক্ষুদ্র অংশ। বিরাট সংখ্যায় বাছাই করা সাহিত্যিক এবং ঐতিহাসিক সূত্রগ্রন্থ অধ্যয়ন
করেছিলেন – প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয়
লেখকদের কাজ, কালানুক্রমিক ইতিবৃত্ত, প্রাচীন বিধানতন্ত্রের সংগ্রহ, আইন ও আইনসংক্রান্ত
বই, লোকবৃত্ত, পর্যটকদের নোট, প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, অর্থনীতি, ভূগোল, ভূতত্ত্ব …। গ্রন্থপঞ্জিতেও এঙ্গেলস তাঁর পড়া সবক’টি বইয়ের উল্লেখ করেন নি।
[তাঁর অসম্পূর্ণ প্রস্তুতিমূলক কাজের “… সংগৃহীত সামগ্রীতে আছে ১৫টি পৃষ্ঠাংকিত নোটবই,
গ্রন্থাদি থেকে উদ্ধৃতি, সাহিত্যের সূচি, আলাদা আলাদা কাগজের তা-এ লেখা নোট এবং খবরের
কাগজের কাটিং। এসব দর্শায় আইরিশ ইতিহাসে তাঁর গবেষণার বিস্তৃত পরিধি এবং তার কিছু দিকে
তাঁর উপলব্ধির বিস্তার।
“আইরিশ সূত্রগুলো
নিয়ে গবেষণা করতে তিনি গেলিক গোষ্ঠির ভাষাও শিখেছিলেন …”
আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস নিয়ে তিনি কাজ করতে পারলেন
না ঠিকই তবে আয়ারল্যান্ডের গভীর প্রভাব পড়েছিল তাঁর ওপর। আইরিশ জনতার কষ্ট, জাতীয় মুক্তির
জন্য তাদের সংগ্রাম, বৃটিশ সাম্রাজ্যে বার বার সে সংগ্রামের রক্তাক্ত দমন এবং সে সংগ্রামের
প্রতি আয়ারল্যান্ডের ভূস্বামী এবং পূঁজিবাদীদের বিশ্বাসঘাতক শ্রেণী-ভূমিকা … এসবের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল সে মাটির প্রতি
ভালোবাসা যে মাটি তাঁকে মেরি এবং লিজ্জি, দু’জন অনন্য শ্রমিক নারীর প্রণয় দিয়েছিল। গুস্তাভ মেয়ার এঙ্গেলসের লেখা
থেকে আয়ারল্যান্ডের নিসর্গ নিয়ে কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করেন, “এখানকার আবহাওয়াও, এখানকার নিবাসীদের মত বৈপরীত্যে
ভরা। আকাশ আইরিশ নারীর মুখের মত – বৃষ্টি আর রোদ একের পর এক হঠাৎ হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে আসতে থাকে;
ইংল্যান্ডের সেই একঘেয়ে ধূসরতা কোথাও নেই।”
১৮৭০এর প্রারম্ভে
এঙ্গেলস ‘জার্মানিতে কৃষক
যুদ্ধ’এর দ্বিতীয় সংস্করণের
জন্য একটি ভূমিকা লিখলেন। উইলহেল্ম লিবনেখ্ট ১৮৬৯র ডিসেম্বরেই তাঁর কাছে, ‘ডের ভোকস্টাট’এ কিস্তিতে ছেপে প্রবন্ধটি আবার একটা বই করে
পুনর্মুদ্রণের অনুমতি চেয়েছিলেন। আর তাই বলেছিলেন একটি নতুন ভূমিকা লিখে দিতে।
ভূমিকা একটা গুরুত্বপূর্ণ
দলিলে পরিণত হল। কেননা এঙ্গেলস তাতে গ্রামীণ অঞ্চলে হতে থাকা শ্রেণীগত পৃথকীকরণ নিয়ে
আলোচনা করলেন। কোন শ্রেণীর সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান কী এবং বিপ্লবের পথে শ্রমিক শ্রেণীর
সাচ্চা সাথী হবে কোন শ্রেণী তার বিশ্লেষণ করলেন। অবশ্যই কাজটা তৎকালীন জার্মানির সমাজকে
সামনে রেখে করা, কিন্তু তার গুরুত্ব ছিল আন্তর্জাতিক। শ্রমিক এবং কৃষকের বন্ধুত্বের
বাস্তবিক সম্ভাবনাগুলোর সংকেত দিলেন। ভূমিকার শেষ বাক্য ছিল, “যেদিন খেতমজুরেরা নিজেদের স্বার্থ বুঝতে শিখে
যাবে, একটি প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের – তা সে সামন্ততান্ত্রিক হোক বা আমলাতান্ত্রিক বা পূঁজিবাদী – জার্মানিতে শাসনে থাকা অসম্ভব হয়ে যাবে।”
১৯৭০এর প্রারম্ভ
থেকেই এঙ্গেলস লন্ডনে বাড়ি খোঁজা শুরু করে দিয়েছিলেন। সেকাজে সাহায্য করছিলেন মার্ক্স
এবং মার্ক্সের চেয়েও বেশি, তাঁর স্ত্রী জেনি। জেনি নিজেদের বাড়িটারও মেরামত ইত্যাদি
করিয়ে, এঙ্গেলসকে প্রথমে এসে সেখানেই উঠতে বলে দিয়েছিলেন। ওদিকে এঙ্গেলসের যে অভিজাত
ভদ্রলোকের বাড়ি ভাড়া নেওয়ার ছিল, সে ছিল বাতিকগ্রস্ত। নিজের মত করে সে ম্যাঞ্চেস্টারে
খোঁজখবর নিতে লাগল যে এই ফ্রেডরিক এঙ্গেলস লোকটা কেমন। যাহোক সেসব শেষ হল আর সেপ্টেম্বর
মাসে এঙ্গেলস নিজের স্ত্রী লিডিয়ার সঙ্গে ম্যাঞ্চেস্টার ছেড়ে লন্ডনের সেই বাড়িটায় এসে
উঠলেন। তাঁর নতুন ঠিকানা হল ১২২, রিজেন্ট পার্ক রোড। আগামী চব্বিশ বছর এটাই তাঁর বাড়ির
ঠিকানা হয়ে থাকল।
অনেক বছর আগে, এক
বন্ধুকে চিঠিতে নিজের আর মার্ক্সের ঠিকানা জানিয়ে ঠাট্টার ছলে লিখেছিলেন, ঠিকানা মনে
না থাকলে ডঃ মার্ক্স, লন্ডন লিখে পাঠিয়ে দিও, পৌঁছে যাবে। এঙ্গেলসের এই ঠিকানাটাও পরবর্তীকালে
বিশ্বের বিপ্লবী সর্বহারার নেতাদের জন্য ততটাই আপন হয়ে উঠেছিল।
যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক
শ্রমজীবী সমিতি
ম্যাঞ্চেস্টার ছাড়ার
তিন মাস আগেই ইয়োরোপের পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছিল। এঙ্গেলস যা অনুমান করেছিলেন সেমতই
ফ্রান্স আর প্রুশিয়ার (অর্থাৎ জার্মানিরও) যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল ১৯শে জুলাই। সবচেয়ে
বড় বিপদ ঘনিয়ে উঠেছিল ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী
সমিতি’র আকাশে। দু’দেশেরই সরকার আর পূঁজিবাদীরা দেশপ্রেমের নামে
নিজের নিজের দেশের শ্রমিকদের যুদ্ধের সমর্থনে টানার চেষ্টায় ছিল। তেমনটা হলে, একদিকে
সারা বিশ্বের শ্রমিকদের জন্য প্রেরণা, ফরাসি শ্রমিকদের বিপ্লবী ঐতিহ্য ধ্বংস হয়ে যেত।
অন্য দিকে বিপ্লবী সর্বহারা পার্টির পতাকাতলে জার্মানির শ্রমিকশ্রেণীকে একজোট করার
যে প্রচেষ্টা মার্ক্স আর এঙ্গেলস এত বছর ধরে করে আসছিলেন সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে
যেত। দু’দেশেই শক্ত হত প্রতিক্রিয়ার
হাত।
এসবই ‘আন্তর্জাতিক’এর নেতারা মোটামুটি বুঝতে পারছিলেন। যুদ্ধের
সম্ভাবনা দেখা দিতেই সব দেশে, ‘আন্তর্জাতিক’এর সঙ্গে সম্বদ্ধ শ্রমিক-সংগঠনগুলো যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু
করে দিয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সে প্রতিবাদ আরো জোরালো হয়ে উঠল। কিন্তু আরেকটি দিক
ছিল যুদ্ধের। আক্রমণ করেছিল ফ্রান্স। কাজেই সহজবুদ্ধি বলে যে জার্মানির জন্য যুদ্ধটা
আত্মরক্ষার যুদ্ধ! কিন্তু প্রুশীয় রাজতন্ত্রের – যার অধীন ছিল জার্মানির বিচ্ছিন্ন রাজ্যগুলো – সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা কিছু কম ছিল না।
তাই প্রুশীয় রাজতন্ত্রের সাম্রাজ্যবাদী ভাবভঙ্গিমা থেকে নিজেদেরকে আলাদা করে, বরং আক্রান্তের
কপট মুখোশ জনগণের দৃষ্টিগোচর করে, জার্মানির আত্মরক্ষার পক্ষ সমর্থন করতে হত। এটাও
সত্য যে যুদ্ধে নেপোলিয়ন তৃতীয়ের নেতৃত্বাধীন ফরাসি সরকারের (‘দ্বিতীয় সাম্রাজ্য’ নামে পরিচিত) জয়, জার্মানির একীকরণের পথে বিরাট
বাধা সৃষ্টি করত। একই বাধা সৃষ্টি হত শ্রমিক শ্রেণীর স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কার্যকলাপের
পথেও। ‘দ্বিতীয় সাম্রাজ্য’এর পরাজয়ে দুই দেশেরই শ্রমিক শ্রেণীর লাভ ছিল।
ফ্রান্সে ‘নেপোলিয়ন তৃতীয়’র রাজত্ব আধুনিকীকরণের নামে শ্রমিকদের ওপর
যে হামলা চালিয়েছিল, তাদের অধিকারসমূহ যেভাবে ছিনিয়ে নিয়েছিল তার প্রতিকার সম্ভব হত।
অন্যদিকে জার্মানির একীকরণের সংগ্রাম এবং শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক কার্যকলাপে তীব্রতা
আসত।
‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’ যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্ক্সকে ইয়োরোপ এবং আমেরিকার শ্রমিকদের
নামে একটি সম্বোধন লিখতে বলেছিল। মার্ক্স তখনি লিখে ওদেরকে পাঠিয়ে এক কপি এঙ্গেলসকেও
পাঠিয়ে দিলেন। পাশাপাশি এঙ্গেলসকে পরামর্শ দিলেন যুদ্ধ নিয়ে খবরের কাগজে লিখতে। এঙ্গেলস
ভেবেও ছিলেন লিখবেন। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘পল মল গেজেট’এর সঙ্গে কথা হয়েছিল লিখলে ওরা পারিশ্রমিক দেবে। জুলাই ১৮৭০ থেকে
ফেব্রুয়ারি ১৮৭১ পর্য্যন্ত এঙ্গেলস সেই খবরের কাগজে ‘যুদ্ধ-বিষয়ক মন্তব্য’ নামে ৫৯টা নিবন্ধ লিখলেন। যদিও লেখাগুলোয়
লেখকের নাম ছিল না।
মার্ক্সের মনে হচ্ছিল
জার্মানিতে জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং ‘ডের ভোকস্টাট’এর সম্পাদক উইলহেল্ম লিবনেখ্ট যুদ্ধটাকে ঠিকমত
বুঝছেন না। তাই সেখান থেকে প্রকাশিত যুদ্ধ-সম্পর্কিত হ্যান্ডবিল, প্রতিবেদন ইত্যাদি
সব বান্ডিল বেঁধে এঙ্গেলসের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন পড়ে নিজের মতামত জানাতে। সে সময়
এঙ্গেলস অসুস্থ ছিলেন তাই র্যামসগেটে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। ১৫ই আগস্ট, ১৮৭০এ মার্ক্সকে
লিখলেন, “ব্যাপারটা মনে হয়
এরকমঃ জার্মানিকে নিজের জাতীয় অস্তিত্বের রক্ষার জন্য যুদ্ধে টেনে এনেছে ব্যাদিংগ্বে।” [নেপোলিয়নের চলতি নাম] “যদি ব্যাদিংগ্বে জার্মানিকে পরাজিত করে, দীর্ঘ
সময়ের জন্য বোনাপার্টবাদ শক্তিশালী হবে এবং জার্মানি, বোধহয় কয়েক প্রজন্মকালের জন্য
ভগ্নদশায় পড়ে থাকবে। তখন আর স্বতন্ত্র জার্মান শ্রমিক শ্রেণী আন্দোলন বলেও আর কিছু
থাকবে না। জার্মানির জাতীয় অস্তিত্ব পুনরুদ্ধার করার সংগ্রাম সব কিছু শুষে নেবে; খুব
বেশি হলে জার্মান শ্রমিকেরা ফরাসি শ্রমিকদের অনুসরণ করতে বাধ্য হবে। যদি জার্মানি জেতে,
ফরাসি বোনাপার্টবাদ অন্ততঃ ধ্বংস হবে, জার্মান ঐক্যের প্রতিষ্ঠা নিয়ে অন্তহীন কোলাহল
শেষ হবে, জার্মান শ্রমিকেরা আজকের অবস্থা থেকে একেবারে ভিন্ন অবস্থায় জাতীয় স্তরে সংগঠিত
হতে সক্ষম হবে, এবং ফরাসি শ্রমিকেরা, এর পর যে সরকারই আসুক, নিশ্চিত বোনাপার্টবাদ থেকে
বেশি মুক্ত পরিবেশ পাবে। সব শ্রেণীর জার্মান জনতা উপলব্ধি করেছে যে প্রশ্নটা সর্বপ্রথমে
জাতীয় অস্তিত্বের প্রশ্ন আর তাই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেই পরিস্থিতিতে একটি রাজনৈতিক
দল গৌণ সব কারণ দেখিয়ে সম্পূর্ণভাবে যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার কথা বলবে (যেমনটা উইলহেল্ম
বলছে), মনে হয় অসম্ভব।
“সঙ্গে এটাও যোগ করব যে ব্যাদিংগ্বে এই যুদ্ধ ফরাসি জনতার উগ্র জাতীয়তাবাদ
ছাড়া শুরু করতে পারত না। সেই জনতার মধ্যে আছে পূঁজিবাদী, পাতি-পূঁজিবাদী, চাষী এবং
চাষীদের মধ্যে থেকে উঠে আসা সাম্রাজ্যবাদের পোষক, হসম্যানপন্থী নির্মাণ-ব্যাবসায় নিয়োজিত
সর্বহারা, যাদেরকে বড় বড় শহরে বোনাপার্ট সৃষ্টি করেছে। যতক্ষণ এই উগ্র জাতীয়তাবাদের
মাথায় আঘাত, এবং সঠিক স্থানে ভালোমত আঘাত, পড়বে না, জার্মানি আর ফ্রান্সের মধ্যে শান্তি
প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।
[এরপর জার্মানির
সরকার এবং বিসমার্কের প্রস্তুতির ধরণ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা আছে]
“আমার মনে হয় আমাদের লোকেরাঃ
“১। তত দূর অব্দি জাতীয় আন্দোলনে … যোগ দিতে পারে যত দূর অব্দি সেটি জার্মানির রক্ষায় সীমিত (শান্তি
প্রতিষ্ঠা অব্দি সে রক্ষা বিশেষ পরিস্থিতিতে আক্রমণকেও অন্তর্ভুক্ত করে);
“২। পাশাপাশি জার্মান জাতীয় স্বার্থ এবং রাজবংশগত-প্রুশীয় স্বার্থের
মধ্যের ফারাকটার ওপর জোর দিতে পারে;
“৩। অ্যালসাশে এবং লোরেইন দখলের বিরোধ করতে পারে – বিসমার্ক জানাচ্ছে যে সে ঐ দুটো অঞ্চলকে বাভারিয়া
আর ব্যাডেনের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়;
“৪। যে মুহূর্তে প্যারিসে উগ্র-জাতীয়তাবাদমুক্ত প্রজাতান্ত্রিক সরকার
প্রতিষ্ঠিত হবে, তার সঙ্গে সম্মানজনক শান্তির পক্ষে কাজ করতে পারে;
“৫। জার্মান এবং ফরাসি শ্রমিকদের স্বার্থের ঐক্যের ওপর অনবরত জোর
দিতে পারে, বলতে পারে যে তারা দু’পক্ষই যুদ্ধ সমর্থন করে না এবং তারা একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করছেও
না;
“৬। রুশের প্রতি সেই মনোভাব রাখতে পারে যেটা ‘আন্তর্জাতিক’এর সম্বোধনে লেখা আছে।”
এত দীর্ঘ উদ্ধৃতি
দেওয়ার কারণ, যুদ্ধের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি যে জটিলতার সৃষ্টি করেছিল, সেটা দূর করতে এঙ্গেলসের
এই চিঠি কাজ করেছিল।
এই চিঠিতে শেষে আরো
একটা ইংগিত ছিল, যে লিবনেখ্ট যেন ধরেই নিয়েছেন যে যুদ্ধে নেপোলিয়ন জয়লাভ করবে আর তাতেই
ঘরের শত্রু বিসমার্ক শেষ হবে। অর্থাৎ পূঁজিবাদী যুদ্ধ থেকে দূরে এবং নির্লিপ্ত থাকার
শ্রেণীগত রণকৌশলটাকে যান্ত্রিকভাবে বলবৎ করে স্বপ্ন দেখছিলেন। এঙ্গেলস আরো বলেছিলেন,
অভিযোগ করেছিলেন যে মার্ক্সও লিবনেখ্টেরই পক্ষে।
চিঠিটা পেয়ে মার্ক্সের
মনে হল একসঙ্গে বসে কথা বলা জরুরি। ‘সামাজিক-গণতন্ত্রী শ্রমিক পার্টি’র কমিটি, যাকে ব্রুন্সউইক কমিটি বলা হত, আগ্রহও প্রকাশ করেছিল
যে মার্ক্স-এঙ্গেলস একটি বিশদ ব্যাখ্যা পাঠান যে জার্মান শ্রমিকদের রণকৌশলগত লাইন কী
হবে। আগস্টের শেষ সপ্তাহে মার্ক্স ম্যাঞ্চেস্টারে গেলেন। পুরো সপ্তাহটা এঙ্গেলসের সঙ্গে
কাটালেন। তারপর দুজনে যুগ্মভাবে ‘সামাজিক-গণতন্ত্রী শ্রমিক পার্টির কমিটির নামে চিঠি’ লিখে জার্মান সর্বহারা এবং ‘সামাজিক-গণতন্ত্রী শ্রমিক পার্টি’র জন্য আবশ্যক রণকৌশলগত লাইনের ব্যাখ্যা করলেন।
ওদিকে নেপোলিয়ন তৃতীয়
এবং কুখ্যাত ‘দ্বিতীয় সাম্রাজ্য’এর পতন তো ১৮৭০এর সেপ্টেম্বরেই হয়ে গেল। পূঁজিবাদী
প্রজাতন্ত্র – ফরাসি ইতিহাস অনুসারে
‘তৃতীয় প্রজাতন্ত্রের
গঠন হল। ফ্রান্সে ‘তৃতীয় প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হল বটে, কিন্তু শ্রমিকেরা ক্ষোভে
ফেটে পড়ছিল। যুদ্ধ যখন চলছে তখনই তারা কিছু করে ফেলতে চাইছিল। ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’র তরফ থেকে মার্ক্স এবং এঙ্গেলস বার বার মানা
করছিলেন এমন কিছু করতে। কিন্তু যুদ্ধে পরাজয়ের কিছুদিন পরই বিদ্রোহ করল শ্রমিকেরা।
রাজধানীতে ঐতিহাসিক কমিউন, ‘প্যারি কমিউন’ প্রতিষ্ঠিত হল। তাঁদের মানা শুনুক বা না শুনুক, কমিউনের পক্ষে তো
মার্ক্স-এঙ্গেলসকে, পুরো ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী
সমিতি’কে দাঁড়াতেই হত।
প্রথমবার শ্রমিক শ্রেণী রাষ্ট্রক্ষমতা নিজের হাতে নিয়েছিল!
কিন্তু সে কথার আগে,
এঙ্গেলসের লন্ডনে আসার পরের দিনগুলো একটু দেখে নিই।
রিজেন্ট পার্ক রোডে
এঙ্গেলসের নতুন বাড়ি, হাঁটা পথে মার্ক্সের বাড়ি থেকে দশ মিনিট দূরে ছিল। ১৮৭০এর ২০শে
সেপ্টেম্বরে সে বাড়িতে থাকা শুরু করার পর প্রায় প্রতিদিনই দুই বন্ধুর দেখা হত। প্রতিদিন
সামনাসামনি কথাবার্তা শুরু হওয়ায়, সমাজবাদী চিন্তনে, সংগঠনে ও আন্দোলনে মার্ক্সবাদের
হস্তক্ষেপ আরো গতি পেল। পল লাফার্গ এঙ্গেলসকে নিয়ে স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, “প্রতিদিন মোটামুটি একটার সময় তিনি মার্ক্সের
সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। আবহাওয়া ভালো থাকলে আর মার্ক্স সুস্থ থাকলে দুজনে হ্যাম্পস্টিড
হীথের দিকে হাঁটতে বেরিয়ে পড়তেন। না বেরোলে মার্ক্সের পড়ার ঘরে দুজনে, কামরার বিপরীত
কোণ থেকে আড়াআড়ি চলতে চলতে ঘন্টা, দু’ঘন্টা কথাবার্তায় মজে থাকতেন।” মার্ক্সের পরিবারে এঙ্গেলস সবার আপন ছিলেন। প্রতিদিনকার আসাযাওয়ায়
তারাও খুশি হল। এঙ্গেলস মানুষটাও ছিলেন হাসিখুশি।
এঙ্গেলসের একটা ভালো
অভ্যাস ছিল। নিজের কাগজপত্র, বই সব গুছিয়ে রাখতেন। চিঠিগুলো তো আরো যত্নে সাজিয়ে রাখতেন।
তারিখ অনুসারে ফাইলে তো থাকতই, তার ওপর লেখাও থাকত কবে চিঠিটা পেয়েছেন, জবাব দিয়েছেন
কিনা, দিলে কবে দিয়েছেন …। এই অভ্যাসগুলো
পরবর্তী দিনে আরো কাজে এসেছিল যখন সারা বিশ্বের বিপ্লবী কর্মী ও নেতাদের সঙ্গে পত্রালাপ
বাড়তে লাগল।
আরেকটি ভালো অভ্যাস
ছিল যে সারাদিনের ব্যস্ততা সত্ত্বেও জামাকাপড় ভালো ভাবে পরতেন। এমন নয় যে রোজ বদলাতেন।
লাফার্গ লেখেন যে দ্বিতীয় কোনো মানুষকে তিনি চেনেন না “যে এত দিন ধরে একই জামা-প্যান্ট পরলেও না সেদু’টোতে ভাঁজ পড়ত না নোংরা হত।” জীবনীলেখকেরা বলেন যে তাঁর প্রয়োজনও কম ছিল,
মিতব্যয়ীও ছিলেন।
১৮৭০এর ৪ঠা অক্টোবর
তিনি মার্ক্সের প্রস্তাবে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী
সমিতি’র সাধারণ পরিষদের
সদস্য নির্বাচিত হলেন। তাঁর ভাষা-জ্ঞান আছে জেনে তাঁকে কয়েকটি দেশের সচিব নিযুক্ত করা
হল – সে দেশগুলোয় ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’র সঙ্গে সম্বদ্ধ সংগঠনগুলোর দেখভাল তিনিই করবেন।
১৮৭১এর ১৮ই জানুয়ারি
ফ্রান্সের শ্রমিকদের বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেল। মার্ক্স-এঙ্গেলস সে খবর পেলেন ১৯শে জানিয়ারি।
চার মাস আগে এঙ্গেলস মার্ক্সকে লিখেছিলেন, “যদি প্যারিসে কিছুমাত্র করা যায় তাহলে শান্তিপ্রতিষ্ঠার আগে শ্রমিকদের
উড়ান থামাতে হবে …” নইলে “বৃথাই তারা জার্মান সৈনিকদের হাতে মারা পড়বে
আর সে ধাক্কায় কুড়ি বছর পিছিয়ে যাবে।”
সে সময় দুজনেই এক
বিশেষ বার্তাবাহক অগাস্ট সেরেলিয়ারের মাধ্যমে ফ্রান্সে ‘আন্তর্জাতিক’এর নেতাদের খবর পাঠিয়েছিলেন যে যেন তারা সময়ের
আগে কিছু না করেন, বরং অনুকূল পরিস্থিতির সুবিধা নিয়ে পার্টিকে সংগঠিত করেন। কিন্তু
বিদ্রোহ হল।
তার আগেই জার্মান
সেনাবাহিনী ফ্রান্সে ঢুকে পড়েছিল। মার্চ মাস শুরু হতে হতে তারা প্যারিসে ঢুকে পড়ল।
শহরে প্যারেড করে তারা বেরিয়ে গেল। পূঁজিবাদী প্রজাতন্ত্রের প্রধানেরা নিজেদের সেনাবাহিনী,
কোতোয়াল, আমির-উমরাহদের নিয়ে প্যারিস ছেড়ে আগেই পালিয়ে ছিল ভার্সাই শহরের দিকে। তিন
সপ্তাহের মধ্যে শাসনহীন প্যারিসে শ্রমিকদের বিপ্লবী সরকার গঠিত হল। এখন তো আর উপায়
ছিল না। শ্রমিকদের এই বিপ্লবী সরকারের সমর্থনে শুধু মার্ক্স-এঙ্গেলস কেন, ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’র সব নেতাদেরকে, সব দেশের শাখা এবং সম্বদ্ধ
সংগঠনগুলোকে অবিলম্বে আসতে হত। ‘কমিউন’কে সাহায্য করতে
হত যতটা সম্ভব।
এঙ্গেলসের উপরুল্লিখিত
রুশীয় জীবনীতে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী
সমিতি’র কার্যবিবরণী থেকে
নিয়ে লেখা হয়েছে যে, “২১শে মার্চ ১৮৭১এ
এঙ্গেলস পরিষদে ভাষণ দেওয়ার ক্রমে প্যারিসে সম্পন্ন বিপ্লবের কথা বলেন। বিপ্লবে নেতৃত্ব
প্রদানকারী ন্যাশনাল গার্ডসের সর্বহারা চরিত্র প্রকাশে আনেন। ঘটনাটির জনপ্রিয় এবং গভীর
গণতান্ত্রিক প্রকৃতির ওপর জোর দেন।” কিন্তু দক্ষ সামরিক বিশেষজ্ঞ ছিলেন বলে দেখতে পাচ্ছিলেন অবস্থাটা।
বিপ্লবীদের স্বপ্ন, তাদের বৈপ্লবিক সমাজ সংস্কার কর্মসূচি, সারা বিশ্বের সর্বহারার
উৎসাহিত সমর্থন সত্ত্বেও কৌশলগত সামরিক কার্যকলাপে তারা পিছিয়ে পড়ছিল। তাড়িয়ে দেওয়া
পূঁজিবাদী প্রজাতন্ত্রী শক্তিগুলোর সেনাবাহিনী ভার্সাই থেকে ফিরে আসছিল।
এঙ্গেলস কয়েকটি পরামর্শও
দিলেন কিন্তু সেগুলো মানা হল না। ১১ই এপ্রিলের পরিষদ-বৈঠকে তিনি আবার বললেন যে ‘ভার্সাইএর শক্তিরা’ এগোচ্ছে আর প্যারিসের মানুষদের পিছু হঠতে
হচ্ছে …। বিশদভাবে তিনি
‘প্যারি কমিউন’ বনাম ভার্সাইয়ের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর
রণকৌশলগত পরিস্থিতি বৈঠকে পেশ করলেন। এই বক্তব্যের কয়েকদিন পরেই মার্ক্সের ঐতিহাসিক
সম্বোধন ‘ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ’ পরিষদে পড়া হল। এঙ্গেলস আগেরই মত বইটার প্রকাশনের
কাজে, ব্যাপক প্রচারে এবং বিভিন্ন ইয়োরোপীয় ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করতে নেমে পড়লেন।
‘কমিউন’এবং ‘কমিউন’ প্রতিষ্ঠাকারী সাথীদেরকে (কমিউনার্ডস), এবং পাশাপাশি ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’কে রক্ষা করা ছিল প্রাথমিক কাজ। সারা বিশ্বের
পূঁজিবাদী সরকারগুলো এবং তাদের সংবাদ মাধ্যম একযোগে কমিউনের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো শুরু
করে দিয়েছিল। শুরু করে দিয়েছিল ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’র শাখা এবং সম্বদ্ধ সংগঠনগুলোর ওপর পাশবিক আক্রমণ।
মে’মাসের শেষ দিনগুলোয় পূঁজিবাদী শক্তিসমূহের
সেনাবাহিনী ফিরে এসে ‘প্যারি কমিউন’কে ধ্বংস করে দিল। হাজার হাজার কমিউনার্ডকে
দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলিবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হল। কয়েক হাজার মানুষকে জেলে পোরা
হল অথবা কালাপানিতে, ফ্রান্সের উপনিবেশগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। যারা পালিয়ে যেতে পারল,
তাদেরও তল্লাশ শুরু হয়ে গেল বিভিন্ন দেশে, একটা কাজ খুঁজে পরিবারের অন্নসংস্থান করা
কঠিন হয়ে গেল।
বস্তুতঃ, কমিউনকে
রক্তে ডুবিয়ে দেওয়া হল। প্যারিস থেকে পালিয়ে যে শরণার্থীরা লন্ডনে আসতে লাগল, এঙ্গেলস
‘আন্তর্জাতিক’এর সাধারণ পরিষদের তরফ থেকে প্রথমে ব্যক্তিগত
স্তরে এবং পরে বিশেষ ত্রাণ কমিটির মাধ্যমে তাদের জন্য সাহায্য জোটানো, কাজ খোঁজা শুরু
করে দিলেন।
‘আন্তর্জাতিক’এর ওপর আক্রমণ তীব্র হয়ে উঠল। ফরাসি সরকার সবক’টি ইয়োরোপীয় সরকারকে বার্তা পাঠালো যে তারা
যেন ‘আন্তর্জাতিক’কে নিশ্চিহ্ন করার ব্যবস্থা নেয়। এঙ্গেলস লিখেছেন,
“সন্দিগ্ধ ব্যক্তিদের
অনুসন্ধান অভিযান সার্বজনিকভাবে শুরু হয়ে গেছে। পুরোনো বিশ্বের সবক’টি শক্তি – সামরিক ট্রাইব্যুনাল থেকে নাগরিক আদালত, পুলিস এবং সংবাদ-মাধ্যম,
খুচরো সামরিক-অভিজাত এবং পূঁজিবাদী – কেউ এই ‘সন্দিগ্ধ-সন্ধান’এর প্রতিযোগিতায় পিছনে থাকতে চাইছে না। পুরো মহাদেশে একটা জায়গা
নেই যেখানে তাদের ভিতরে ভয় জাগানো, শ্রমিকদের এই সুমহান ভ্রাতৃত্বকে বেআইনি ঘোষিত করা
জন্য যত কিছু সম্ভব করা হচ্ছে না।”
ব্যক্তিগতভাবে মার্ক্স-এঙ্গেলসের
ওপরও আক্রমণ তীব্র ছিল। এমনকি এঙ্গেলসের মা-ও ‘কমিউন’এর বিষয়ে শোনা পূঁজিবাদী
অপপ্রচারগুলো উগরে দিয়ে, ‘কমিউন’কে সমর্থন করেছে বলে ছেলে ফ্রেডরিক এবং তার
বন্ধু মার্ক্সকে তীক্ষ্ণ ভাষায় ভর্ৎসনা করলেন। সংযত থেকেও কঠোর
ভাষায় এঙ্গেলস ‘কমিউন’এর প্রতি নিজের সমর্থনের পুনরাবৃত্তি করলেন।
তিনি লিখলেন, “কয়েকজন বন্দীকে কমিউনার্ডরা
প্রুশীয় ধরণে মেরে ফেলেছে বলে আর কয়েকটি প্রাসাদ তারা প্রুশীয় দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে
পুড়িয়ে ফেলেছে বলে (বাকি সব কথা মিথ্যে) কী বিরাট হৈচৈ! কিন্তু কেউ উল্লেখ পর্য্যন্ত
করছে না যে ভার্সাই-ফেরতগুলো যান্ত্রিকভাবে ৪০,০০০ পুরুষ, নারী আর শিশুদেরকে হত্যা
করল, তাও তাদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার পর! … মিথ্যেকথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে আপনার গলায় ঠুঁসে দেওয়া হয়েছে।” তারপর লিখলেন, “আপনি জানেন বিগত তিরিশ বছর ধরে আমার যে দৃষ্টিভঙ্গি
তাতে কোনো পরিবর্তন হয় নি। আর এটা কোনো অবাক হওয়ার মত ব্যাপার নয় যে আমি শুধু ওদের
সমর্থনই করছি না, … বরং অন্যান্যভাবে
নিজের দায়িত্বও পুরো করছি। না করলে আপনি আমার জন্য লজ্জিত হতেন।”
এঙ্গেলস যে দেশগুলোর
জন্য ‘আন্তর্জাতিক’এর সচিব ছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল স্পেন। স্পেন
থেকে তাঁদের একজন সাংবাদিক ফ্রান্সিস্কো মোরা, ১৮৭১এর ১২ই আগস্ট এঙ্গেলসকে লিখলেন,
“বয়স হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও
‘আন্তর্জাতিক’এর মহান উদ্দেশ্যের প্রতি আপনি যেমন উৎসাহ
দেখান, তা আমাকেও উৎসাহের সঙ্গে কাজ করার প্রেরণা যোগায়। তার সাথে, আমায় আশা রাখারও
প্রেরণা যোগায় যে আমার মাথার চুল ধূসর হোক বা বয়সের ভারে আমি ন্যুব্জ হই, তত দিন কাজ
করে যাব যত দিন না বোঝা-বওয়া পশুর মত বেঁচে থাকতে আমাদের বাধ্য করা এই অসাম্যের সমাজ
ধ্বংস হয়।”
'আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি'তে ভাঙন
‘আন্তর্জাতিক’এর ওপর মার্ক্স-এঙ্গেলস এবং বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের প্রভাব বেড়ে চলেছিল।
জার্মানির লাসালবাদ, ফ্রান্সের প্রুধোঁবাদ ইত্যাদির প্রভাব ক্ষীণ হয়ে আসছিল। ঠিক সে
সময়ে বাকুনিনবাদের হামলা হল ‘আন্তর্জাতিক’এর ওপর। বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের সামনে দাঁড়াবার শক্তি বাকুনিনপন্থায়
ছিল না। কিন্তু হামলাটা সেসময় হল যখন ‘প্যারি কমিউন’এর পরাজয়ের পর ইয়োরোপের প্রতিটি দেশে সবক’টা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ‘আন্তর্জাতিক’ এবং সম্বদ্ধ সংগঠনগুলোকে শেষ করার জন্য এককাট্টা
হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকদের একাংশের ভিতরে ছড়াচ্ছে ক্ষুব্ধ হতাশা।
ঠিক সেই সময়টায় মিখাইল
বাকুনিনের ‘এলায়েন্স ফর সোশ্যাল
ডেমোক্র্যাসি’ ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’র সঙ্গে সম্বদ্ধ হতে চাইল। মার্ক্স ‘পূঁজি’র পরবর্তী খন্ডগুলোর পাণ্ডুলিপি তৈরি করা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাই
সম্বদ্ধ হওয়ার জন্য পাঠানো কাগজপত্র সব এঙ্গেলসের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
বলতে গেলে তখন থেকে
শুরু করে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী
সমিতি’ ভঙ্গ হওয়া অব্দি
পুরো সময়টায় সাংগঠনিক বিষয়ে এঙ্গেলসেরই ভূমিকা ছিল প্রধান। মার্ক্স ব্যস্তও ছিলেন,
এঙ্গেলসও চাইছিলেন ‘পূঁজি’র কাজ দ্রুত গতিতে পুরো হোক। তবে এঙ্গেলসের
ভূমিকা বাড়ার আরেকটা কারণ ছিল। তিনি সব দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলোর গতিবিধি সম্পর্কে খবর
রাখতেন। বেশির ভাগ দেশের ভাষা এমনকি উপভাষাগুলোও জানতেন।
বাকুনিন ‘আন্তর্জাতিক’এর সঙ্গে সম্বদ্ধ থেকে ‘এলায়েন্স ফর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি’র নিয়ম অনুসারে কাজ করতে চাইছিলেন। তাঁদেরকে
এই শর্ত সরিয়ে নিতে বলা হল। তাৎকালিক ভাবে শর্তটা মেনে নিলেও সম্বদ্ধতা পেয়ে যাওয়ার
পর বাকুনিন ‘এলায়েন্স’কে আবার বাঁচিয়ে তুললেন। ‘এলায়েন্স’এরই কাজ করতে লাগলেন ‘আন্তর্জাতিক’এর নামে। বিভিন্ন দেশের সংগঠনে তার খারাপ প্রভাব পড়তে লাগল।
ওদিকে ‘আন্তর্জাতিক’এর কংগ্রেস ডাকা জরুরি ছিল। অসফল ‘প্যারি কমিউন’এর শিক্ষার আলোয় কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করার
ছিল, যাতে সেই বার্তা সব দেশের শ্রমিক শ্রেণীর কাছে পৌঁছে যায়। প্রস্তাবগুলোর ভাবাদর্শগত
ভিত্তিতে সংগঠনগুলোকে সংহত করা যায়।
কংগ্রেসে সব দেশ
থেকে প্রতিনিধি আসবে, সেটাও সম্ভব ছিল না। সব দেশে পুলিসের নজরদারি; সংগঠনের ভিতরেও
চর। কংগ্রেস হবেই বা কোথায়?
এঙ্গেলসই পরামর্শ দিলেন যে তাহলে কংগ্রেস না করে ‘রুদ্ধ-দ্বার’ অর্থাৎ প্রতিনিধি সম্মেলন হোক লন্ডনে। সম্মেলনের স্থান, প্রতিনিধিদের পরিচয়পত্র ইত্যাদি স্থির করার কাজে ছিলেন এঙ্গেলস এবং ‘প্যারি কমিউন’ থেকে আসা কয়েকজন শরণার্থী সাথী। ১৮৭১এর ১৭ই সেপ্টেম্বর লন্ডন সম্মেলন সম্পন্ন হল। এই প্রতিনিধি সম্মেলনে অনেক দেশেরই প্রতিনিধি আসতে পারেন নি, তাই গৃহীত প্রস্তাবগুলো বিভিন্ন দেশের আলাদা আলাদা কংগ্রেসে স্বীকৃত করানো জরুরি ছিল। সেসব জায়গাতেও তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হল সংগঠনকে। পূঁজিবাদী খবরের কাগজগুলো মনের সুখে লিখে চলেছিল যে ‘আন্তর্জাতিক’এ ভাঙন ধরেছে। লাগাতার বিভন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে পত্রালাপের মধ্যে এঙ্গেলস কার্মেলো পালাদিনো নামে এক সদস্যকে লিখলেনঃ
“ভুলবেন না যে ‘আন্তর্জাতিক’এর নিজের একটা ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসই, যা নিয়ে আমরা কারণসঙ্গতভাবে
গর্বিত, ‘আন্তর্জাতিক’এর নিয়মাবলীর ওপর শ্রেষ্ঠ মন্তব্য। নিজের গৌরবময়
ইতিহাসকে আপন না করার ইচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক’এর একেবারেই নেই। … সাধারণ পরিষদ যে বড় দায়িত্বগুলো নিয়েছে, তা নিয়ে আপনার মনে যত আশঙ্কাই
থাক না কেন, সাধারণ পরিষদ সেই পতাকার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে যাকে রক্ষা করার দায়িত্ব
তাকে সভ্য বিশ্বের শ্রমিকেরা সাত বছর ধরে দিয়ে রেখেছে।”
এই সময়টায় এঙ্গেলস
বড় লেখালিখি বিশেষ কিছু করতে পারেন নি। তিন দিকে নিয়মিত কাজ করে গেছেনঃ (১) ‘আন্তর্জাতিক’এর সাধারণ পরিষদে স্পেন ও ইতালির সচিবরূপে
কাজ; (২) কয়েকটি খবরের কাগজে রুশ এবং অন্যান্য কয়েকটি জায়গার জাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে
প্রতিবেদন; আর (৩) বাকুনিনপন্থা এবং ইংল্যান্ডের অরাজনৈতিক ট্রেড-ইউনিয়নবাদের বিরুদ্ধে
সংগ্রাম।
‘আন্তর্জাতিক’ আনুষ্ঠানিকভাবে ভঙ্গ হল ১৮৭৬এ। কিন্তু ১৮৭১এ লন্ডন সম্মেলনের পর
যখন গৃহীত প্রস্তাবগুলো বিভিন্ন দেশের কংগ্রেসে স্বীকৃত করাবার প্রক্রিয়া চলছিল তখনই
তত্ত্বে এবং বাস্তবে ফারাকটা বার বার উঠে আসতে লাগল। তত্ত্বগত ভাবে ‘আন্তর্জাতিক’ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে মার্ক্স-এঙ্গেলস প্রতিপাদিত
বৈজ্ঞানিক সমাজবাদ এবং সেই সূত্রেই তৈরি কর্মসূচি, নিয়মাবলী এবং বিভিন্ন প্রস্তাব গ্রহণ
করে থাকলেও, বাস্তবে শ্রমিক শ্রেণীর গণ-বিপ্লবী পার্টি একমাত্র জার্মানিতে ছিল। যদিও
এই সাত বছর বিভিন্ন দেশে শ্রমিক সংগঠন এবং সংগঠনে সদস্য বিপুল সংখ্যায় বেড়ে চলেছিল,
শ্রমিক শ্রেণীর গণ-বিপ্লবী পার্টি কোথাও তৈরি হয় নি।
সেপ্টেম্বর ১৮৭২এ
হেগ কংগ্রেসে এই বাস্তব আরো পরিষ্কারভাবে উঠে এল। যদিও মার্ক্স-এঙ্গেলস যে উদ্দেশ্য
নিয়ে গিয়েছিলেন সেটা পুরো হয়েছিল। ১৫টি দেশের ৬৫জন প্রতিনিধিদের মধ্যে মাত্র ২০-২৫%
নৈরাজ্যবাদ (বাকুনিনপন্থা) এবং সংস্কারবাদের (প্রধানতঃ ইংরেজ ট্রেড-ইউনিয়নবাদ) সঙ্গে
রইল। বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কংগ্রেসের মুখ্য প্রস্তাবগুলোর সমর্থন করল। নিয়মাবলীতে
শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক সক্রিয়তা, শ্রমিকশ্রেণীর স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পার্টি ইত্যাদি
শর্তগুলো যোগ হল; সর্বহারার একনায়কত্ব নিয়েও আলোচনা হল। বাকুনিন এবং তার সঙ্গীদের নিষ্কাশিত
করা হল।
একটা প্রস্তাবের
বিরুদ্ধে ছিল অনেকেই। সাধারণ পরিষদের দপ্তর লন্ডন থেকে নিউইয়র্কে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব।
কেননা লন্ডনে থাকলে অরাজকতাবাদীদের সঙ্গে সঙ্গে পুলিসের চরও ঢুকে পড়বে। ঢুকেছে তার
প্রমাণও ছিল। তবু কেউ মানল না। শেষে চাপ দিতে মার্ক্স-এঙ্গেলসকে বলতে হল তাঁরা সাধারণ
পরিষদে থাকবেন না। তবে গিয়ে সবাই মানল প্রস্তাবটা।
‘প্রথম আন্তর্জাতিক’ তার কর্মভার পুরো করেছিল। ‘প্যারি কমিউন’ নতুন ভবিষ্যতের দিকে পথ দেখিয়ে গিয়েছিল। ১৮৭৪এ এফ এ সোর্জকে নতুন
সৃজিত সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা হয়েছিল। তাঁকে এঙ্গেলস ১৮৭৪এর ১২ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বরের
মধ্যে লিখিত একটি চিঠিতে বলছেন, ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’ “‘দ্বিতীয় সাম্রাজ্য’এর যুগের উৎপত্তি ছিল, যখন সারা ইয়োরোপ জুড়ে
অত্যাচার, তক্ষুনি নতুন করে জেগে ওঠা শ্রমিক আন্দোলনে ঐক্য এবং অভ্যন্তরীণ বিবাদে ক্ষান্তি
চাইছিল। এমন এক মুহূর্ত ছিল যখন সর্বহারার সাধারণ বিশ্বজনীন স্বার্থ সামনে আসতে পেরেছিল।
জার্মানি, স্পেন, ইতালি এবং ডেনমার্ক আন্দোলনে হয় সদ্য ঢুকেছিল অথবা ঢুকছিল। বাস্তবে
১৮৬৪তে আন্দোলনের তাত্ত্বিক চরিত্র সারা ইয়োরোপেই, মানে জনগণের চোখে, অত্যন্ত আস্পষ্ট
ছিল। জার্মান সাম্যবাদ তখনো শ্রমিকের পার্টি হিসেবে ছিল না। প্রুধোঁবাদে তার প্রিয়
ধারণা ও খেয়ালগুলোর ওপর জোর দেওয়ার মত শক্তি ছিল না। বাকুনিনের নতুন ছাইপাঁশ তখন তার
নিজের মাথাতেও জন্ম নেয় নি। এমনকি ইংরেজ ট্রেড ইউনিয়নের নেতারাও ভেবেছিল যে তারা নিয়মাবলীর
বিবেচ্য শর্তাধীন কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলনে ঢুকতে পারবে। প্রথম বড় সাফল্যেই সবক’টি উপদলের ইত্যাকার সারল্যে ভরা মিলন বিস্ফোরিত
হওয়ার ছিল। সেই সাফল্য ‘কমিউন’; নিঃসন্দেহে ‘আন্তর্জাতিক’এর মেধাগত সন্তান। যদিও সেটিকে উৎপন্ন করতে
‘আন্তর্জাতিক’ কিছুই করে নি, তবু” [মেধাগত সন্তান হওয়ার কারণেই] “সে অর্থে পুরোপুরি ন্যায্যভাবে ‘আন্তর্জাতিক’কে দায়ী করা হয়েছিল। যখন ‘কমিউন’এর কল্যাণে ‘আন্তর্জাতিক’ ইয়োরোপে একটি নৈতিক শক্তি হয়ে উঠল, অবিলম্বে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল।
সবক’টি প্রবৃত্তি সাফল্যটাকে
নিজেদের জন্য ব্যবহার করতে চাইল। অনিবার্য পচন শুরু হয়ে গেল। … দশ বছর ‘আন্তর্জাতিক’ ইয়োরোপের ইতিহাসের সেই দিকটার ওপর আধিপত্য ধরে রেখেছিল যেটা ভবিষ্যতের
দিক। পিছন ফিরে নিজের কাজের দিকে সে গর্ব সহকারে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারে।” পরে লিখছেন, “আমি বিশ্বাস করি যখন কয়েক বছরে মার্ক্সের রচনার
প্রভাব পড়বে, আগামী আন্তর্জাতিক সোজাসুজি কম্যুনিস্ট হবে এবং আমাদের নীতিগুলোই ঘোষণা
করবে।”
প্রগাঢ় তাত্ত্বিক লিখনের পথে
এ্যান্টি ড্যুহরিং
(ড্যুহরিং-মতভঞ্জন)
এঙ্গেলসের বয়স এখন
পঞ্চাশের বেশি। কিন্তু কর্মশক্তি আগেরই মত। কুড়ি বছর ম্যাঞ্চেস্টারে সওদাগরি দপ্তরে
যাওয়াআসা, বণিক, শিল্পপতি শ্রেণীর সঙ্গে থাকার বাধ্যবাধকতা যে মানুষটাকে তার প্রাণবন্ত
স্বভাব সত্ত্বেও অবসাদে ঠেলে দিত, তার চিরকালীন যোদ্ধা-সৈনিক সত্ত্বা্টি যেন লন্ডনে
আসতেই খোলাখুলি বেরিয়ে এল। মার্ক্সের পরিবারে সবাই তাঁকে ‘জেনারেল’ নামেই ডাকত। সত্যি সত্যিই তিনি জেনারেলের ভূমিকা গ্রহণ করলেন।
লন্ডনের বাড়িতে স্ত্রী
লিডিয়া ছাড়া এখন চলে এসেছিল লিডিয়ার ভাইঝি মেরি এলেন বার্ন্স, যার ডাকনাম ছিল ‘পাম্প্স’। প্রথম স্ত্রী মেরির সঙ্গে তিনি এভাবে থাকতে পারেন নি, সে কষ্ট
বুকে ছিল নিশ্চয়ই, তবে তার উল্লেখ তিনি সেভাবে কোথাও করেন নি।
‘আন্তর্জাতিক’এর ভূমিকা শেষ হয়ে গিয়েছিল। মার্ক্স-এঙ্গেলসের মতাদর্শ, সর্বহারা
চেতনা, সর্বহারা ঐক্য এবং সমাজবাদী বিপ্লবের বিজ্ঞানমনস্ক উপলব্ধি ইউরোপ এবং আমেরিকার
বড় অংশে বিপ্লবী এবং সমাজবাদীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল।
পরে লেনিন এই সময়কালটা নিয়ে মন্তব্য করেছেন যে সময়টা
“সর্বহারা শ্রেণী
চরিত্র সমন্বিত গণ-সমাজবাদী পার্টি নির্মিত হওয়ার, বিকশিত এবং পরিপক্ক হওয়ার” সময় ছিল।
এঙ্গেলসের সামনে
প্রাথমিকতাগুলো স্পষ্ট ছিল। সবচেয়ে আগে মার্ক্স এবং তার পরিবারকে আর্থিক সাহায্য যাতে
মার্ক্স যুগের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক কাজ, বিশেষ করে অর্থশাস্ত্রীয় গবেষণা
‘পূঁজি’র পরবর্তী খণ্ডগুলো পুরো করতে পারেন। তারপর
দ্বিতীয়, মার্ক্সের সঙ্গে মিলেমিশে ইয়োরোপ এবং আমেরিকায় সর্বহারা পার্টি নির্মাণে এবং
বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের মতাদর্শে সে পার্টিকে বলিয়ান করে তুলতে সাংগঠনিক এবং তাত্ত্বিক
সাহায্য। তৃতীয়, মার্ক্সের এবং যুগ্মভাবে মার্ক্স-এঙ্গেলসের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ এবং
পুস্তিকাগুলোর যথাসম্ভব অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ এবং প্রকাশন। চতুর্থ, মার্ক্স প্রণীত
দ্বান্দ্বিক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টির, জ্ঞান ও আলোচনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ।
এঙ্গেলসের, ওপরে
উল্লিখিত সোভিয়েত জীবনীতে (পৃঃ ২৮০, ইংরেজি অনুবাদ) এঙ্গেলসের একটি কথন উদ্ধৃত করা
হয়েছে।
“মার্ক্সকে এবং আমাকে, দুজনকেই বেশ সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞানধর্মী কাজ
করতে হবে। এখন অব্দি সে কাজ করতে সক্ষম বা ইচ্ছুক অন্য কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। বিশ্ব
ইতিহাসের বর্তমান স্থির সময়টাকে কাজে লাগিয়ে পুরো করতে হবে সে কাজ। কে জানে কত শিগগির
কোন ঘটনা আমাদের আবার ব্যবহারিক আন্দোলনের ব্যস্ততায় টেনে নিয়ে যাবে। তাই এই সংক্ষিপ্ত
অবকাশটাকে আমাদের, ততটাই আবশ্যক তত্ত্বগত প্রভাবের কিছুটা বিশদে যেতে ব্যবহার করতেই
হবে।”
মার্ক্সের মেয়েরা
এখন বড় হয়ে গিয়েছিল (সাত সন্তানের মধ্যে থেকে তিন ছেলে আর এক মেয়ের শিশুকালেই মৃত্যু
হয়েছিল)। ১৮৭২ সালে তাদের দুজন, জেনি এবং লরা নিজের নিজের স্বামী শার্ল লংগোয়ে এবং
পল লাফার্গের সঙ্গে কাছাকাছি অন্য বাড়িতে থাকতে শুরু করেছিলেন। মার্ক্সের ছোটো মেয়ে
ইলিয়ানর ষোল বছর বয়স থেকেই বাড়িতে মার্ক্সের সচিবের কাজ করছিলেন এবং সভা, সম্মেলন প্রভৃতিতে
মার্ক্সের সঙ্গে যেতেন।
এঙ্গেলসের কাছে ঐ
তিন মেয়েই নিজের মেয়ের মত ছিলেন। লরা এবং পলের তিন সন্তানের মৃত্যু তাঁকেও ততটাই কষ্ট
দিত যতটা মার্ক্সকে। আর জেনির স্বামী শার্ল, যিনি প্যারি কমিউনের যোদ্ধা ছিলেন বলে
কোথাও চাকরি পাচ্ছিলেন না, চাকরি পাওয়া অব্দি এঙ্গেলস আর্থিক সাহায্য দিয়ে গিয়েছিলেন।
এঙ্গেলসের আশাবাদ, প্রাণবন্ত স্বভাব এবং আনন্দময় উপস্থিতি তাদের সবাইকে শক্তি প্রদান
করত।
ডি রায়াজানফ, যিনি
কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্রের টীকা-সম্বলিত সংস্করণের সম্পাদনা করেছেন, মার্ক্স-এঙ্গেলসের
একটি জীবনীও লিখেছেন। নতুন ভাবে। পূর্ণরূপে তাত্ত্বিক বিকাশের জীবনী। সেই জীবনীতে এঙ্গেলসের
মনের অবস্থার ওপর তিনি নতুন আলোকপাত করেন। বলেন যে ‘পূঁজি’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত অবশ্যই হয়েছিল কিন্তু সমাজবাদীদের মধ্যেকার
যে ছোট্টো অংশটি নিজেদের মার্ক্সবাদের অনুগামী বলত তাদের অবস্থা ছিল করুণ। মার্ক্স-এঙ্গেলসের
পদ্ধতি, ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা, শ্রেণীসংগ্রাম সম্পর্কিত শিক্ষা – কিছুই তারা জানত না। এমনকি উইলহেল্ম লিবনেখ্টও
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সঙ্গে অন্যান্য ভাবনা মিশিয়ে ফেলতেন। অর্থাৎ, সেসময় বাকুনিনপন্থীদের
সঙ্গে মার্ক্সবাদীদের যে তীব্র সংগ্রামের কথা বলা হয়, তার চেয়ে তীব্রতর সংগ্রামের আবশ্যকতা
মার্ক্সবাদীদের ভিতরে ছিল। তাই, “শেষ অব্দি এঙ্গেলস মার্ক্সবাদের তত্ত্বগুলোর রক্ষা এবং প্রচারের
দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়ে নিলেন …। কখনো কোনো প্রবন্ধ তাঁকে আকৃষ্ট করত, তার ওপর, অথবা সমসাময়িক ইতিহাসের
কোনো তথ্যের ওপর তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন, যাতে একটা একটা করে দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বৈজ্ঞানিক
সমাজবাদ এবং অন্যান্য সমাজবাদী প্রণালীর মধ্যের তফাৎটা স্পষ্ট করতে পারেন। অথবা, অনুশীলনগত
কোনো অস্পষ্ট প্রশ্নের ওপর বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের দৃষ্টি থেকে আলোকপাত করতে পারেন, তাঁদের
পদ্ধতির ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখাতে পারেন।”
যদিও ভাগ করা খুব
কঠিন, কাজগুলো একে অন্যের সঙ্গে মিশে থাকে, তবুও আলোচ্য বছরগুলোয় এবং তার পরেও, এঙ্গেলসের
প্রকাশিত-অপ্রকাশিত, সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ তাত্ত্বিক লিখনগুলিকে আমরা চারটি ধারায় দেখার
চেষ্টা করব – (১) মার্ক্সবাদের
রক্ষা, প্রচার এবং সর্বাঙ্গীণ পরিচিতি; (২) সমসাময়িক ইতিহাসের বিভিন্ন প্রসঙ্গের ওপর
মার্ক্সবাদী দৃষ্টিপাত; (৩) প্রকৃতি-বিজ্ঞানে বস্তুবাদ; (৪) মানব-বিজ্ঞানে বস্তুবাদ।
পরবর্তী বিভিন্ন অধ্যায়ে এই উপশীর্ষকগুলো ব্যবহৃত হবে কেননা, জীবনীটি সংক্ষেপিত এবং
অধ্যায়গুলো কালানুক্রমিক।
(১) মার্ক্সবাদের
রক্ষা, প্রচার এবং সর্বাঙ্গীণ পরিচিতি – মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের প্রধান চিন্তাগুলোর একটা ছিল, জার্মান সামাজিক-গণতন্ত্রী
দল মার্ক্সবাদী দৃষ্টি নিয়ে চলুক, লাসালবাদ, প্রুধোঁবাদ এবং অন্যান্য পাতি-পূঁজিবাদী
প্রভাব থেকে মুক্ত থাকুক। সে পার্টির মুখপত্র ‘ডের ভোকস্টাট’এ এঙ্গেলস আগে থেকেই লিখতেন। বাকুনিনপন্থীদের ‘আন্তর্জাতিক’এ ভাঙন ধরানোর চেষ্টা এবং পূঁজিবাদী খবরের
কাগজে প্রচারিত হতে থাকা গুজবের জবাবে মার্ক্স-এঙ্গেলস লিখেছিলেন ‘আন্তর্জাতিকে কাল্পনিক ভাঙন’। জবাবটা সাধারণ পরিষদের তরফ থেকে ছিল আর ১৮৭২এর
সেপ্টেম্বরে ‘ডের ভোকস্টাট’এই ছেপেছিল। ‘আন্তর্জাতিক’এর হেগ কংগ্রেসের ওপর এঙ্গেলসের প্রতিবেদনও
ঐ পত্রিকায় ছেপেছিল। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন উইলহেল্ম লিবনেখ্ট। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস
তাঁকে বার বার বোঝাতেন ভালো করে না দেখে কোনো লেখা স্বীকার না করতে কেননা পত্রিকাটি
পার্টির মুখপত্র। কিন্তু পার্টি মুখপত্রে তত্ত্বগত বিতর্ক চালানো নিয়ে লিবনেখ্টের
নিজস্ব অভিমত ছিল। সেই সূত্রেই একটি ঘটনা ঘটল। লেখকের নাম না দিয়ে নয়টি সংখ্যায় ধারাবাহিক
ছাপল পূঁজিবাদ-সৃষ্ট আবাসন সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এক লেখকের সংস্কার-মনস্ক প্রূধোঁবাদী
সমাধানসূত্র, ‘আবাসন প্রশ্ন-প্রসঙ্গে’। এঙ্গেলস যখন প্রশ্ন করলেন এসব পার্টি মুখপত্রে
কিকরে ছাপছে তখন লিবনেখ্ট তাঁকে প্রবন্ধটার জবাবী প্রবন্ধ লিখতে বললেন। এভাবেই তিন
ভাগে এল এঙ্গেলসের গুরুত্বপূর্ণ লেখা ‘আবাসন প্রশ্ন’। লেখাটিতে এঙ্গেলস বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের মৌলিক তত্ত্বগুলোকে এমন
একটি সমস্যার ওপর প্রয়োগ করে প্রমাণিত করেছেন, যে সমস্যার মিথ্যা সমাধান, পাতি-পূঁজিবাদী
সমাজতন্ত্রী এবং পূঁজিবাদী সমাজ-সংস্কারকদের পরোপকারী মায়াজাল বিস্তারে আজও সবচেয়ে
বেশি কাজে লাগে। তিন ভাগের প্রথম ভাগে ‘ডের ভোকস্টাট’এর নামহীন লেখকের (পরে জানা গেল তাঁর নাম ডঃ মূলবার্গার, একজন প্রুধোঁপন্থী)
জবাব ছিল। দ্বিতীয় ভাগে আবাসনের প্রশ্নের সমাধানে পূঁজিবাদী পরিকল্পনাসমূহের সমালোচনা
ছিল। তৃতীয় ভাগে, উপরোক্ত দুইভাগের প্রেক্ষিতে প্রুধোঁবাদের সর্বজনীন সমালোচনা ছিল।
‘ডের ভোকস্টাট’ বাদে জার্মান ভাষার অন্যান্য পত্রিকায় তো তিনি লিখতেনই, প্রয়োজনানুসারে,
বিশেষ করে ‘আন্তর্জাতিক’এর বিরুদ্ধে মিথ্যে প্রচারের জবাব দিতে অথবা
বিভিন্ন দেশের শ্রমিক আন্দোলন এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অথবা আর্থিক ঘটনাবলি নিয়ে,
ইংরেজি, ফরাসি, স্পেনীয়, ইতালীয় এবং অন্যান্য ভাষাতেও তিনি লিখতেন।
১৮৭৩এর অক্টোবরে
এঙ্গেলস খবর পেলেন যে তাঁর মা অসুস্থ। মাকে দেখতে এঙ্গেলস্কির্শেন চলে গেলেন। সেখানেই
শেষ নিশ্বাস নিলেন মা। ২০-২২ দিন মায়ের সঙ্গে ছিলেন এঙ্গেলস।
বছর ঘুরতে না ঘুরতে
পোল্যান্ডের প্রশ্ন আবার জেগে উঠল কেননা রুশের জার ইংল্যান্ডে এসেছিলেন। সেই সুযোগে
পোল্যান্ডের উদ্বাস্তুদের তরফ থেকে ইংল্যান্ডের জনগণের নামে একটি সম্বোধন প্রকাশিত
করা হয়েছিল। সেই সম্বোধনের ঐতিহাসিক পৃষ্ঠভূমির ব্যাখ্যা করে এবং পোল্যান্ডের স্বাধীনতার
প্রশ্নের গুরুত্বে জোর দিয়ে এঙ্গেলস নয় কিস্তিতে প্রবন্ধ লিখলেন ‘ডের ভোকস্টাট’এ, ১৮৭৫এর এপ্রিল অব্দি। প্রথম কিস্তিতেই লিখলেন,
“১৮৬৩তে পোল্যান্ড
দেখিয়ে দিয়েছিল তাকে হত্যা করা যায় না। এখনও তা-ই দেখাচ্ছে। জাতিসমূহের ইয়োরোপীয় পরিবারে
তার স্বতন্ত্র অস্তিত্বের দাবি অকাট্য।” লিখলেন যে পোল্যান্ডের পুনর্প্রতিষ্ঠা, পোল্যান্ড বাদে সেই জাতিগুলোর
জন্যও জরুরি, যারা তাকে বিভাজিত করে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে রেখেছে, অর্থাৎ রুশ এবং
জার্মানি। কেননা, “যে জনগণ অন্য জনগণের
উৎপীড়ন করে, সে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না।” এই প্রবন্ধের শেষ কিস্তি ‘রুশের সামাজিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে’ পরে আলাদা করে ছাপা হয়েছিল। এই লেখাটিতে ইয়োরোপীয় সামরিকবাদের
প্রধান কারণ রূপে রুশীয় সামরিকবাদকে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
মার্ক্সবাদের সাধারণ পাঠক ‘গোথা কর্মসূচির সমালোচনা’ নামে মার্ক্সের একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনার কথা জানেন। সেই সমালোচনার একটি অংশ, ১৮৭৫এর ১৮ থেকে ২৮শে মার্চ অব্দিকার সময়ে এঙ্গেলস কর্তৃক অগাস্ট বেবেলকে লেখা দীর্ঘ চিঠি। ‘আন্তর্জাতিক’এ অংশগ্রহণ করার ‘অপরাধে’ উইলহেল্ম লিবনেখ্ট এবং অগাস্ট বেবেল, দুজনেরই দু’বছরের কারাবাস হয়েছিল। দুই নেতার অনুপস্থিতিতে তাদের পার্টি, ‘সামাজিক-গণতন্ত্রী শ্রমিক পার্টি’র ভিতর লাসালপন্থীদের দলের সঙ্গে ঐক্যের ভাবনা জোর পেল। দুই নেতা যখন পরে ছাড়া পেলেন তাঁরাও এই ঐক্য-প্রয়াসকে স্বীকার করলেন। জার্মানির গোথা শহরে হওয়ার ছিল সেই ঐক্য কংগ্রেস। কংগ্রেসে যে কর্মসূচি পেশ হবে তার খসড়া ছাপানো হল দুই দলেরই মুখপত্রে। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস দুজনেই ঐক্য-প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানালেন, কিন্তু কর্মসূচির সমালোচনা করলেন। এঙ্গেলস লাসালপন্থীদের কাছে টানার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আশঙ্কার কথা লিখলেন – যে এমন উল্টোপাল্টা কর্মসূচির ভিত্তিক ঐক্য বোধহয় স্থায়ী হবে না। মার্ক্স রচিত ‘গোথা কর্মসূচির সমালোচনা’ এবং এঙ্গেলসের বেবেলকে পাঠানো দীর্ঘ চিঠি, এদুটো মিলেই তৈরি হয় মার্ক্সবাদী দলিল যা কর্মসূচি-রচনায় সারা বিশ্বের কম্যুনিস্ট পার্টিগুলোকে সাহায্য করে এসেছে।
মার্ক্সবাদী সাহিত্যের
একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হল তাঁদের লেখা চিঠিপত্র। রচনাসমগ্রের প্ররহম ও দ্বিতীয় খণ্ডকে
(যাতে কৈশোর ও তারুণ্যে লিখিত চিঠি, যা পাওয়া গেছে, সংগৃহীত আছে) তাতে অন্তর্ভুক্ত
না করলেও চিঠিপত্র কালানুক্রমিক ১৭ খন্ডে (ইংরেজি অনুবাদে ১৮ থেকে ৫০) সংগৃহীত। এগুলোর
মধ্যে সাধারণভাবে তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ভাবনার দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ চিঠিসমূহের দুটো
সংকলন আছে – একটি প্রগতি প্রকাশন,
মস্কো প্রকাশিত এবং দ্বিতীয়টি ১৯৩৪এর মার্টিন লরেন্স প্রকাশিত সঙ্কলনের ন্যাশনাল বুক
এজেন্সি, কলকাতা কৃত পুনর্মুদ্রণ।
১৯৭৬ সালে উইলহেল্ম
উল্ফের একটি জীবনী লিখলেন এঙ্গেলস। উইলহেল্ম উল্ফ মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের সবচেয়ে পুরোনো
এবং বিশ্বস্ত সাথী ও ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। পরিচিতরা তাঁকে ‘লুপুস’ নামে ডাকত। বয়সে মার্ক্স থেকেও দশ বছর বড় ছিলেন। পেশায় স্কুলশিক্ষক,
কিশোর বয়স থেকেই বিপ্লবী কার্যকলাপে জড়িত ছিলেন। মার্ক্স-এঙ্গেলসের সঙ্গে তাঁর প্রথম
দেখা হয়েছিল ব্রাসেলসে, ১৮৪৬ সালে। ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এ তিনিও একজন সম্পাদক ছিলেন। পরে যখন ম্যাঞ্চেস্টারে থাকতে শুরু
করলেন এঙ্গেলসের সঙ্গে নিয়মিত দেখা হত। ১৮৬৪তে যখন ম্যাঞ্চেস্টারে তাঁর মৃত্যু হল,
মার্ক্স এবং এঙ্গেলস দুজনেই তাঁর মৃত্যুশয্যার পাশে ছিলেন। তাঁর কাছে যা কিছু ছিল সব
মার্ক্সকে দিয়ে গিয়েছিলেন যাতে মার্ক্স নিজের কাজ পুরো করতে পারেন। মার্ক্স নিজের মহাগ্রন্থ
‘পূঁজি’ তাঁকেই উৎসর্গ করেছেন এবং লিখে গেছেন “সর্বহারার নির্ভীক, বিশ্বস্ত এবং মহাপ্রাণ
যোদ্ধা, আমার অবিস্মরণীয় বন্ধু উইলহেল্ম উল্ফকে উৎসর্গীকৃত”। উল্ফের জীবনী মার্ক্স নিজেও লেখার কথা ভেবেছিলেন।
তার নোটস আছে। এঙ্গেলস রচিত জীবনীতে, সাইলেশিয়ার কৃষকদের অবস্থার ওপর উল্ফের লেখা এবং
‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এ প্রকাশিত জনপ্রিয় প্রবন্ধগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত
বর্ণনাও দেওয়া আছে। এগারো কিস্তিতে এই জীবনী ‘ডায় ন্যু ওয়েল্ট’ নামে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল যার সম্পাদনায় ছিলেন উইলহেল্ম লিবনেখ্ট।
এঙ্গেলসের সুপরিচিত
কিন্তু অসমাপ্ত গ্রন্থ ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’। ১৮৭৩এই বইটা নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু অন্যান্য কাজের চাপে এগোতে পারছিলেন না। তেমনই একটি কাজের ফরমাশ করলেন উইলহেল্ম
লিবনেখ্ট। গোথা কর্মসূচির মার্ক্স-এঙ্গেলস কৃত সমালোচনার বিশেষ কিছু দুই পার্টির মিলন-সম্মেলন
গ্রহণ করে নি। ফলে লাসালপন্থীদের সঙ্গে মিলনের পর জার্মান সামাজিক-গণতন্ত্রবাদের ভাবাদর্শগত
স্তরে অধঃপতন ঘটছিল। বিভিন্ন কৃত্রিম ভাবুকদের বই জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। তাদেরই মধ্যে
একজন ছিলেন হের ইউজেন ড্যুহরিং। সামাজিক-গণতন্ত্রীরা, এমনকি অগাস্ট বেবেলের মত মানুষেরাও
সে-সময় ড্যুহরিংএর মতবাদে প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন। খোদ লিবনেখ্ট নিজের পত্রিকায় ড্যুহরিংকে
জায়গা দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন ড্যুহরিং সোজাসুজি মার্ক্সের সমালোচনা শুরু করে দিলেন
তখন লিবনেখ্টের চৈতন্য হল। ড্যুহরিংএর সমালোচনা লিখতে এঙ্গেলসকে অনুরোধ করলেন। সেটা
১৮৭৫এর এপ্রিল মাসের কথা। ১৮৭৬এর মে মাস থেকে আগস্ট মাস অব্দি এঙ্গেলস স্বাস্থ্যগত
কারণে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে ইংল্যান্ডের র্যামসগেটে সমুদ্রতীরে ছিলেন। সেখানেই ড্যুহরিংএর
বইগুলো পড়লেন। মার্ক্সও বললেন যে ড্যুহরিংএর অভিমতগুলোর পূর্ণাঙ্গ সমালোচনা হওয়া উচিৎ।
এঙ্গেলসের প্রায় দু’বছরের পরিশ্রমে
(সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ – জুন ১৮৭৮) বিশ্ব
একটি অমূল্য গ্রন্থ পেল, এ্যান্টি ড্যুহরিং (ড্যুহরিংতত্ত্ব-ভঞ্জন)। গ্রন্থটিকে বলা
হয় মার্ক্সবাদের বিশ্বকোষ। যেহেতু ‘ডের ভোকস্টাট’ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তার জায়গায় এসেছিল ‘ভোরওয়ার্টস’। সেই পত্রিকাতেই ৩রা জানুয়ারি ১৮৭৭ থেকে ৭ই জুলাই ১৮৭৮ অব্দি
রচনাটি ধারাবাহিক প্রকাশিত হল।
ড্যুহরিংএর কয়েকটি
তত্ত্বের সমালোচনা এঙ্গেলস আগেও ‘ডের ভোকস্টাট’এর পৃষ্ঠায় করেছিলেন। সস্তা দিশি মদের বাজার নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন
‘প্রুশিয়ান শ্ন্যাপ্স
ইন দ্য জার্মান রাইখস্ট্যাগ’। জার্মানির গ্রামীণ অঞ্চলে আলুর মদের ভাটি এবং সম্পর্কিত রাজনীতি
নিয়ে লেখা এই প্রবন্ধটিতে এঙ্গেলস দেখিয়েছিলেন কিভাবে শ্রমিক, খেত মজুর প্রভৃতি শোষিত
শ্রেণীদেরকে আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে মদের ব্যবহার করা হয়। তাতে
ইংরেজশাসিত ভারত সম্পর্কেও কটাক্ষ ছিল। লিখেছিলেন, ভারতের ইংরেজ শাসক তো নিজের জনতার
বদলে চীনের জনতাকে দাবিয়ে রাখার জন্য আফিংএর ব্যবহার করে। আর জার্মানির শাসকশ্রেণী
নিজেরই জনতাকে দাবিয়ে রাখার জন্য সস্তা বিষাক্ত দিশি মদ বিক্রি করে। সেই প্রবন্ধেই
ড্যুহরিংকে কটাক্ষ করেন যে এঁদের মত মানুষেরা এতেও গ্রামীণ অঞ্চলের শিল্পায়ন এবং উন্নয়ন
খুঁজে নেবেন।
যাহোক, এ্যান্টি-ড্যুহরিং
বা ড্যুহরিংতত্ত্ব-ভঞ্জন তত্ত্ব-ভঞ্জনের জন্য বিখ্যাত হয় নি। ড্যুহরিং কে ছিলেন তা
লোকে জানতেও চায় না। এমনিতেও, সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর যে কোনো ভঞ্জন-সাহিত্য পড়া এবং
বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রসঙ্গগুলো সমসাময়িকতা হারিয়ে ফেলে। তা সত্ত্বেও এঙ্গেলসের এই
গ্রন্থের জনপ্রিয়তা এখনো অক্ষুন্ন। এঙ্গেলস নিজেই গ্রন্থটির ভূমিকায় তার কারণ জানান,
“সমালোচনার লক্ষ্যটাই
এমন ছিল যে এত বিশদে যেতে হল। লক্ষ্য, ড্যুহরিংএর গ্রন্থাদির বৈজ্ঞানিক অন্তঃসার যতটুকু,
সে তুলনায় তার সমালোচনা অনেক বেশি। কিন্তু দুটো অন্য চিন্তার কথা আমার যুক্তিবিস্তারের
দৈর্ঘ্যকে দোষমুক্ত করতে পারে। প্রথমতঃ, ড্যুহরিংএর রচনার বিষয় এত বিবিধ যে সেগুলোর
ওপর নিজের কথা রাখতে গিয়ে, সেই বিতর্কিত বিষয়সমষ্টির মধ্যে সাধারণভাবে বৈজ্ঞানিক অথবা
ব্যবহারিক গুরুত্বের বিষয়গুলোর ওপর ইতিবাচক রূপে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি রাখার সুযোগ পেলাম
…।” অন্যান্য চিন্তা পরে স্পষ্ট করেছেন, “এই বইয়ে আলোচিত হের ড্যুহরিংএর ‘প্রণালী’ অত্যন্ত ব্যাপক তাত্ত্বিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রসারিত। যেখানে
যেখানে তিনি গেছেন, তাঁর পিছু পিছু সেখানে গিয়ে তাঁর ধারণার বিরুদ্ধে আমার ধারণা রাখতে
আমি বাধ্য ছিলাম। ফলে আমার নেতিবাচক সমালোচনা ইতিবাচক হয়ে গেল। যা ছিল তত্ত্ব-ভঞ্জন,
তা হয়ে গেল মার্ক্স এবং আমার প্রচারিত দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি এবং সাম্যবাদী বিশ্বদৃষ্টির
প্রতিপাদন। মার্ক্স রচিত ‘দর্শনের দারিদ্র্য’ এবং ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’এ এই দৃষ্টি প্রথমবার বিশ্বের সামনে উপস্থাপিত করা হয়েছিল। পরবর্তী
কুড়ি বছর, অর্থাৎ ‘পূঁজি’র প্রকাশন অব্দি সে দৃষ্টি উন্মেষপর্বে ছিল।
একের পর এক জনসমষ্টিতে সেই বিশ্বদৃষ্টির প্রভাব তীব্র গতিতে বেড়ে চলেছে। এখন ইয়োরোপের
সীমার বাইরে অনেক দূর অব্দি, সেই সমস্ত দেশে সে-দৃষ্টি স্বীকৃতি এবং সমর্থন পাচ্ছে
– যেখানে সর্বহারাও
যেমন আছে, নির্ভীক বৈজ্ঞানিক চিন্তকও আছে।”
জীবনে কঠোর আঘাত
এবং সংগ্রামে থাকার চ্যালেঞ্জ
ড্যুহরিংএর লেখাগুলো
পড়ার এবং ‘এ্যান্টি ড্যুহরিং’ লেখার সময়টায় এঙ্গেলস খুবই দুশ্চিন্তায় থাকতেন।
স্ত্রী বার বার অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। আগে তাঁর হাঁপানি এবং সাইটিকার সমস্যা ছিল। ১৮৭৬
সালে দুবার স্ত্রীকে নিয়ে এঙ্গেলস কয়েক সপ্তাহের জন্য র্যামসগেটে গিয়ে থাকলেন যাতে
সমুদ্রে স্নান করে এবং রোদ সেঁকে তাঁর স্বাস্থ্যলাভ হয়। (পরের বছর একই কারণে ব্রাইটনেও
গিয়েছিলেন)। সেখানে ইলিয়ানরও আসতেন। মাঝে মার্ক্স জার্মানিতে গেলে তাঁর স্ত্রী জেনি
এবং পরিচারিকা হেলেন ডেমুথও (ডাকনাম ‘লেঞ্চেন’) সেখানে গিয়ে থাকলেন
যাতে লিডিয়া (এঙ্গেলসের স্ত্রী) সঙ্গ পান।
কিন্তু ফিরে আসার
পর লিডিয়ার শরীর আবার খারাপ হওয়া শুরু করল। নতুন নতুন রোগের লক্ষণ দেখা দিতে লাগল।
ওষুধ দেওয়া হচ্ছিল, বাড়ির কাজে এঙ্গেলস নিজেই হাত লাগাচ্ছিলেন। ১৮৭৭এর ১৪ই ফেব্রুয়ারি
এঙ্গেলস তাঁর এক বন্ধু ফিলিপ পলির স্ত্রী ইডা পলিকে নিজের স্ত্রীর খারাপ হতে থাকা স্বাস্থ্যের
বিষয়ে লিখছেন। চলাফেরার ক্ষমতা না হারিয়ে ফেলেন লিডিয়া সে আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন। শেষে
লিখছেন, “আপনার হাসি পেত যদি
কাল রাতে আমাকে বিছানা করতে বা আজ সকালে রান্নাঘরে উনুন জ্বালাতে দেখতেন।”
লিডিয়ার ভাইঝি পাম্পসের
বয়স কম কিন্তু স্বভাব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। লোক-দেখানি, খরচের হাত, রুক্ষ মেজাজ …। তাই ১৮৭৫এর নভেম্বর মাসে পাম্পসকে এঙ্গেলস
এবং লিডিয়া, জার্মানির রেনাউ শহরে বাসরত উপরোক্ত পলি পরিবারের স্থানীয় অভিভাবকত্বে,
হাইডেলবার্গের বোর্ডিং হাউজে রেখে এসেছিলেন। তার দেখাশোনা করার জন্য সঙ্গে ছিলেন জনৈকা
মিস শ্যাপ্স। কিন্ত পাম্পস এবং মিস শ্যাপ্সকে সেখান থেকে ১৮৭৭এর মার্চে ফিরিয়ে আনতে
হল। কেননা লিডিয়া প্রতিদিনকার কাজগুলোও করতে পারছিলেন না।
এঙ্গেলসকে নিয়মিত
লেখার কাজ করতেই হবে। ‘এ্যান্টি ড্যুহরিং’এর কাজের সঙ্গে সঙ্গে ১৮৭৭ সালে তাঁকে জার্মান
নির্বাচন, ইতালিতে সমাজবাদী আন্দোলনে প্রগতি, মজুরিবৃদ্ধি এবং অন্যান্য দাবিতে ইংল্যান্ডের
ক্ষেতমজুরদের সংগ্রাম প্রভৃতি বিষয়ে ‘ভোরওয়ার্টস’, ‘দ্য লেবার স্ট্যান্ডার্ড’, ‘লা প্লেবে’ এবং অন্যান্য পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতে হল। কার্ল মার্ক্সের একটি
ছোটো জীবনীও লিখলেন, জার্মানি, ফ্রান্স, আমেরিকা এবং রুশের সমাজবাদী আন্দোলন এবং আলোচ্য
বছরে ইয়োরোপের শ্রমজীবীদের অবস্থা নিয়েও প্রতিবেদন লিখলেন।
কিন্তু রচনাসমগ্রের
কালানুক্রমে বোঝা যায়, ১৮৭৮এর মার্চের শেষে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘লেবার স্ট্যান্ডার্ড’এর জন্য ‘১৮৭৭এ ইয়োরোপের শ্রমজীবীদের অবস্থা’র শেষ কিস্তি লেখার পর, আড়াই মাস কেটে গেলে
শুধু একটি চিঠি লিখেছিলেন ১২ই জুন। ‘ডেলি নিউজ’এর সম্পাদকের নামে সেই চিঠিটা, মার্ক্সের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে লিখেছিলেন।
শেষ চিঠিটাও আরো দুমাস পর, ১০ই আগস্টে। সেটাও এ কারণে যে ‘এ্যান্টি ড্যুহরিং’ বই হয়ে ছেপে এসে গিয়েছিল এবং রুশের এক বন্ধুকে
পাঠাবার ছিল।
এই মৃত্যুশোক এঙ্গেলসকে
অবশ করে দিয়েছিল। মৃত্যুর ঠিক পরেই লেখা দুটো চিঠিতে তাঁর মনের, বিক্ষিপ্ত অবস্থায়
স্থির থাকার চেষ্টা টের পাওয়া যায়। নিজেদের পুরোনো সাথী ফ্রেডরিক লেসনার কে লিখলেন,
“প্রিয় লেসনার, এখনি
মৃত্যু আমার স্ত্রী বেচারিকে দীর্ঘ যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করেছে। … ওয়াইন তোমাকে পাঠাতে পারব না। চাইলে যে কোনো
সময় এসে নিয়ে যেতে পারো।” কিছুক্ষণ পরেই বারমেনে
নিজের ভাই রুডলফকে দ্বিতীয় চিঠি লিখলেন, “প্রিয় রুডলফ, দীর্ঘ অসুস্থতার পর আজ সকাল দেড়টার সময় আমার স্ত্রী,
যাঁর সঙ্গে আইনগত বিয়ে আমি কাল সন্ধ্যেবেলাতেই করেছিলাম, শান্তিতে গত হয়েছেন। … মনে হয় একটু বেশি খরচ হবে আর যেহেতু ব্যাঙ্কে
পয়সা কম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ২০০ পাউন্ড পাঠিয়ে আমায় অনুগৃহীত কর।”
মার্ক্স সে-সময় সপরিবারে
মেলবোর্ন, ওর্সেস্টারে ছিলেন। ১৪ই সেপ্টেম্বর ফিরে আসেন।কী কথা হল তা তো লেখা নেই।
তবে এঙ্গেলস নিশ্চয়ই কিছু দিনের জন্য বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করে থাকবেন। একই সঙ্গে
মার্ক্সকে বলে থাকবেন দু’এক বার তাঁর বাড়ি
ঘুরে আসতে যাতে আসতে থাকা চিঠিগুলো হয় গুছিয়ে রেখে দেওয়া হয় অথবা এঙ্গেলস যেখানে থাকবেন
সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৬ই সেপ্টেম্বরে এঙ্গেলস চলে যান লিটলহ্যাম্পটন। সঙ্গে ছিল
পাম্পস এবং তার দেখাশোনার জন্য রাখা মাদাম রেনশ’।
এখন অস্তিত্বহীন
জার্মান ডেমোক্র্যাটিক রিপাব্লিক (জিডিআর) থেকে ১৯৭২ সালে হাইনরিখ গেমকাউয়ের নেতৃত্বে
এক লেখকমণ্ডলী কর্তৃক এঙ্গেলসের জীবনী লিখিত এবং প্রকাশিত হয়। তাতে লেখা আছে, “সেসব দিনে এঙ্গেলসের ভিতরের অনুভূতিগুলো কেমন
হয়ে থাকবে সে বিষয়ে একটা লাইন, একটা শব্দও আমাদের কাছে পৌঁছোয় নি। কিন্তু শব্দের চেয়ে
বেশি অর্থপূর্ণ এই তথ্য যে যে এঙ্গেলস এত উৎসাহের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলীতে
অংশগ্রহণ করতেন, জার্মানি, ফ্রান্স এবং অন্যান্য দেশে নিজেদের সাথীদের সঙ্গে পত্রালাপ
কয়েক সপ্তাহ প্রায় পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেন।” আর সেটা সত্যি। লিটলহ্যাম্পটন যাওয়ার পর ১৮, ১৯ এবং ২১শে সেপ্টেম্বর
এঙ্গেলস মার্ক্সের তিনটে চিঠির জবাব দেন। তারপর লন্ডনে ফিরে এসে এক এক মাস পর দুজন
সাথীকে দুটো চিঠি লেখেন।
মার্ক্সও বুঝতে পারছিলেন
আঘাতের গভীরতা। এঙ্গেলস জবাব দিন আর নাই দিন, সবসময় রাজনৈতিক ঘটনাবলীর খবর দিতে থাকতেন
এবং লড়াইয়ের কাজগুলোয় যে তাঁর দরকার পড়ছে সে কথা বলতে কখনো ভুলতেন না। আগেও উল্লেখ
করেছি যে এঙ্গেলস যখন পায়ে হেঁটে প্যারিস থেকে সুইটজারল্যান্ডে পৌঁছেছিলেন … মার্ক্স এভাবেই বন্ধুকে কাজে ফিরে আসতে সাহায্য
করেছিলেন। ২৪শে সেপ্টেম্বর ১৮৭৮এও এঙ্গেলসকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে
বিশদভাবে লেখার পর লিখলেন, “আশা করি প্রকৃতি-মা তোমায় সুস্থ হতে সাহায্য করছেন, টুসি, জেনিচেন
আর আমার স্ত্রীর তরফ থেকে ভালোবাসার বার্তাসহ, তোমার মুর।”
যাহোক, এঙ্গেলস তো!
যোদ্ধা, সারা বিশ্বের সর্বহারার সবচেয়ে প্রিয় দুই সাথীর এক! কয়েক সপ্তাহ পর কাজে ফিরে
এলেন।
পনের বছর পর একটি
চিঠিতে এঙ্গেলস লিজ্জি বার্ন্স সম্পর্কে লেখেন, “আমার স্ত্রী … সাচ্চা আইরিশ সর্বহারা বংশের নারী ছিলেন। পূঁজিবাদীদের ‘শিক্ষিত’ এবং ‘সংবেদনশীল’ কন্যাদের শালীন এবং মার্জিত আচরণ থেকে আমার কাছে অনেক বেশি মূল্যবান
ছিল নিজের শ্রেণীর জন্য আমার স্ত্রীর জন্মগত তীব্র অনুভূতি এবং সেগুলো, সব কঠিন পরিস্থিতিতে
আমার সবচেয়ে বড় অবলম্বন হত।” [৮ই মার্চ ১৮৯২, জুলি বেবেলকে লেখা চিঠি]
…………………
(২) সমসাময়িক ইতিহাসের
বিভিন্ন প্রসঙ্গের ওপর মার্ক্সবাদী দৃষ্টিপাত
এঙ্গেলসের লন্ডনে
ফেরার আগেই একটি বড় ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। জার্মানিতে সমাজবাদী-বিরোধী আইন বলবৎ হয়েছিল।
তবুও, রচনাসমগ্র অনুসারে, এই হামলার পৃষ্ঠভূমিতে তাঁর প্রথম সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন ২১শে
মার্চ ১৮৭৯এ প্রকাশিত। সে-সময় অব্দিকার চিঠিও কম। আন্দাজ করা যেতে পারে যে যেহেতু জার্মানির
সবকয়টি সমাজবাদী সংবাদপত্র এবং পত্রিকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল, রাজনৈতিক প্রতিবেদন
প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে গিয়েছিল। জার্মানিতে কর্মরত, পার্টির সাথীদের সাহায্য
করাও একটা কাজ ছিল। সেছাড়া পুরোটা সময় এঙ্গেলস দিচ্ছিলেন ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’ রচনায় – পড়ছিলেন, নোট নিচ্ছিলেন অথবা লেখায় এগোচ্ছিলেন।
কিন্তু তাৎকালিক
বিষয়ে লেখালিখি পুরোপুরি বন্ধ করা যায় না। মতাদর্শগত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নতুন পথেরও
সন্ধান করার থাকে। জার্মানিতে বিসমার্কের সরকার সমাজবাদীদের আক্রমণ করেছে – সে আক্রমণ অসফল করার রাস্তাও বার করতে হবে।
পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র ‘ভোরওয়ার্টস’ এবং অন্যান্য প্রকাশনের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে ভাবা হল যে
জ্যুরিখ (সুইটজারল্যান্ড) থেকে নতুন কেন্দ্রীয় মুখপত্র ‘ডের সোশ্যেলডেমোক্র্যাট’ প্রকাশ করা হবে। ১৮৭৯ সালে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের
মধ্যে লাইপজিগ, জ্যুরিখ, প্যারিস এবং লন্ডনের নেতাদের সঙ্গে পত্রালাপ চলল। প্রকাশনের
সম্ভাব্য জায়গা, সম্ভাব্য সম্পাদকমণ্ডলী, টাকাপয়সার ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে কথা হল।
তারই অনুক্রমে মার্ক্স-এঙ্গেলস অগাস্ট বেবেলের নামে কিন্তু উইলহেল্ম লিবনেখ্ট, উইলিয়াম
ব্র্যাক এবং অন্যান্য সকলের প্রাপ্য একটি বিজ্ঞপ্তি-পত্র (সার্কুলার লেটার) লিখলেন।
সেই বিজ্ঞপ্তি-পত্রে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদকে দুজনে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করলেন কেননা
(পত্রে স্পষ্ট) দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ জ্যুরিখ থেকে প্রকাশিতব্য নতুন মুখপত্রের ওপর
প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছিল। রচনাসমগ্র অনুসারে এই বিজ্ঞপ্তি-পত্রের খসড়া তৈরি
করলেন এঙ্গেলস, ১১ই সেপ্টেম্বর ১৮৭৯এ। মার্ক্স সে-সময় র্যামসগেটে নিজের বড় মেয়ের কাছে
ছিলেন। ১৭ তারিখে তাঁর ফেরার পর সেই বিজ্ঞপ্তি-পত্রটিকে শেষ রূপ দেওয়া হল এবং পাঠানো
হল।
এঙ্গেলসের প্রবন্ধাদির
প্রকাশনে ধারাবাহিকতা ফিরল ১৮৮০র মার্চে। ‘লা এগালিতে’ নামে একটি ফরাসি খবরের কাগজে দুই কিস্তিতে প্রকাশিত হল ‘শ্রীমান বিসমার্কের সমাজবাদ’। তাৎক্ষণিক ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ সরিয়ে দেখলেও
এই প্রবন্ধে একটি সাধারণ বক্তব্য আছে যে শোষকশ্রেণীর কর্তৃত্ববাদী সরকার যখন সমাজবাদীর
শক্তির বিরুদ্ধে চলা আক্রমণ থেকে দৃষ্টি সরানোর উদ্দেশ্যে জনগণের জন্য আর্থিক পরিকল্পনা
এবং সংস্কারাদির কথা বলে, সে পরিকল্পনাগুলোও পূঁজিবাদী ফাটকাবাজ এবং নানান ধরণের শোষকদের
লাভ নজরে রেখেই তৈরি হয়। প্রবন্ধটি প্রকাশনের একমাস আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে লেখা হয়েছিল।
মার্চ থেকে মে মাসের
মধ্যে তিন কিস্তিতে একটি অন্য ফরাসি খবরের কাগজ, ‘লা রেভ্যু সোশ্যালিস্ত’এ প্রকাশিত হল এঙ্গেলসের অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রবন্ধ ‘সমাজবাদঃ কাল্পনিক এবং বৈজ্ঞানিক’। পল লাফার্গের অনুরোধে ‘ড্যুহরিংতত্ত্ব-ভঞ্জন’এর তিনটে অধ্যায়ের ফরাসিতে পুনর্লিখনে ফলে
তৈরি হল প্রবন্ধটি। বিগত একশো চুয়াল্লিশ বছরে বিশ্বের অনেক ভাষায় এই পুস্তিকার অনুবাদ
হয়েছে এবং এঙ্গেলস জীবিত থাকতেই বেশ কয়েকটি সংস্করণ হয়েছে। আজও সহজ ভাষায় বৈজ্ঞানিক
সমাজবাদের কথা জানার জন্য একটি প্রাথমিক পুস্তিকা এই বই।
সমসাময়িক ইতিহাসের
বিভিন্ন প্রসঙ্গে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিপাত করা প্রবন্ধের পূর্বানুবৃত্তি শুরু হয় এক বছর
পর, মে ১৮৮১তে। তার আগের দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজ পাওয়া যায় মার্ক্সের সঙ্গে যুগ্ম নামে।
প্রথমটা, ১৮৩০এ পোল্যান্ডে হওয়া বিপ্লবের ৫০তম বার্ষিকীতে জেনেভায় অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকের
জন্য বার্তা, যাতে মার্ক্স এবং এঙ্গেলস ছাড়াও পল লাফার্গ এবং ফ্রেডরিক লেসনারের নাম
আছে। ৪ঠা ডিসেম্বর ১৮৮০র এই বার্তা ‘লা প্রিকার্সার’এ প্রকাশিত হয়েছিল এবং পরে পোলিশ ভাষায় হ্যান্ডবিল হয়ে ছেপেছিল।
দ্বিতীয়টা, ২১শে মার্চ ১৮৮১তে লেখা খুব ছোটো একটি বার্তা। ‘প্যারি কমিউন’এর ১০ বছর উপলক্ষে স্লাভভাষীদের বৈঠকের সভাপতির
নামে। ছোটো হলেও গুরুত্বপূর্ণ কেননা ‘প্যারি কমিউন’এর আত্মোৎসর্গকে তিনটে সমকালীন ঘটনার মাধ্যমে রেখাঙ্কিত করা হয়েছিল,
(১) রুসের সেন্ট পিটার্সবার্গে এক নারোদনিক সংগঠন কর্তৃক জার আলেকজান্ডার-২এর হত্যা;
(২) প্রুশীয় রাষ্ট্রশক্তির নিজেরই রাজত্বে ভয়াক্রান্ত হয়ে সমাজবাদী-বিরোধী আইন বলবৎ
করা; এবং (৩) ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী
সমিতি’ ভেঙে যাওয়া সত্ত্বেও
ইয়োরোপ এবং আমেরিকার শ্রমিকদের মধ্যে জন্ম নিতে থাকা, আগের চেয়েও বড় এবং ব্যাপক ঐক্য।
মে ১৮৮১তে এঙ্গেলস
ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ‘দ্য লেবার স্ট্যান্ডার্ড’এ নিয়মিত লেখার প্রস্তাব পেলেন। খবরের কাগজটির
ভাবনাচিন্তার ধরণ জেনেও এঙ্গেলস সে-প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। কেননা, ১৮৮১ সালে ইয়োরোপ
এবং আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলন অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল অথচ ইংল্যান্ডের শ্রমিক আন্দোলন
ট্রেড-ইউনিয়নবাদে আটকে ছিল। এঙ্গেলসের সোভিয়েত জীবনী থেকেই এ তথ্যও পাওয়া যায় যে উনিশ
শতকের সাতের দশকের শেষে জার্মানি ছাড়াও অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, স্পেন
এবং পোর্তুগালে সমাজবাদী পার্টি তৈরি হয়ে গিয়েছিল; যদিও সবাই যে বৈজ্ঞানিক সমাজবাদেরই
মতাদর্শে চলছিল এমন নয়। উত্তর আমেরিকাতেও সমাজবাদী শ্রমিক পার্টি গঠিত হয়ে গিয়েছিল।
কিছু দিন বাদে হাঙ্গেরিতে জেনারাল ওয়ার্কার্স পার্টি তৈরি হল, নেদালল্যান্ডসে সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক
ইউনিয়ন এবং উত্তর ইতালিতে ওয়ার্কার্স পার্টি তৈরি হল। ফ্রান্সের পার্টির প্রতি মার্ক্স
এবং এঙ্গেলসের বিশেষ নজর ছিল কেননা ‘কম্যুন’এর পরাজয়ের পর সেখানে
যে একের পর এক দমনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছিল, তার প্রতিকারে ফরাসি সমাজবাদীদের সাহায্যের
প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডে পুরোপুরি ট্রেড-ইউনিয়নবাদেরই প্রাধান্য ছিল। পরে কখনো
এঙ্গেলস বলেও ছিলেন যে ট্রেড-ইউনিয়নবাদী খবরের কাগজে লেখা তাঁর জন্য “পুরোনো চার্টিস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়ে, ‘লেবার স্ট্যান্ডার্ড’এর মাধ্যমে নিজের ভাবনাগুলো প্রকাশ করার” চেষ্টা ছিল।
‘দ্য লেবার স্ট্যান্ডার্ড’এ এঙ্গেলস গভীর তত্ত্বগত বিষয় বাদ দিয়ে শ্রমিকদের জীবন এবং তাদের
আর্থিক উদ্বেগসমূহ নিয়ে লেখা পাঠাতে লাগলেন। ‘ন্যায্য দিনের কাজের বদলে ন্যায্য দিনের মজুরি’, ‘মজুরি প্রণালী’, ‘ট্রেড ইউনিয়নসমূহ’, ‘ফরাসি বাণিজ্যিক চুক্তি’, ‘দুটি মডেল নগর পরিষদ’, ‘আমেরিকায় খাদ্য ও ভূমির প্রশ্ন’, ‘মজুরির তত্ত্ব এবং ভুট্টা-বিরোধী আইনি লীগ’, ‘শ্রমজীবীদের পার্টি’, ‘বিসমার্ক এবং জার্মান
শ্রম পার্টি’, ‘কাপাস এবং লোহা’, ‘সামাজিক শ্রেণী – আবশ্যক এবং অনাবশ্যক’ ইত্যাদি রচনাগুলো আগস্ট ১৮৮১ অব্দি লেখা হল। কিন্তু শেষ অব্দি বন্ধ
করতে হল কেননা খবরের কাগজের সম্পাদকের সঙ্গে মতের অমিল বেড়েই চলেছিল।
তিন বছর আগে এঙ্গেলসের
স্ত্রী মারা গেছেন। এখন মার্ক্সের স্ত্রী অসুস্থ। জেনি ভন ওয়েস্টফ্যালেন বছরের প্রথম
থেকেই অসুস্থ থাকছেন। ওদিকে মার্ক্সও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বার বার। ডাক্তারের পরামর্শে
মাঝে মধ্যে শুকনো হাওয়ার অঞ্চলে গিয়ে থেকে আসছেন কয়েক সপ্তাহ, কখনো স্ত্রীকে সঙ্গে
নিয়ে, কখনো, জেনি শয্যাশায়ী থাকলে একা। মার্ক্সের বড় মেয়ের জীবনও কষ্টের। এরা সবাই
এঙ্গেলসেরও আপন কাজেই সমস্যাগুলো জড়িয়ে রাখে তাঁকে। এছাড়াও থাকে তাঁর পরিবারের আলাদা
সমস্যা। লিডিয়ার ভাইঝি এখন বড় হয়ে গেছে। সে একজনকে বিয়ে করেছে কিন্তু তার ছোটোবেলার
কুঅভ্যাসগুলো এখনো যায় নি। তার বিবাহিত জীবনেরও খরচ এঙ্গেলসকে মেটাতে হয়।
এঙ্গেলসের খরচ ১৮৭৮এর
অক্টোবরের পর আরো একটি কারণে বেড়ে গেছে। জার্মানিতে সমাজবাদী-বিরোধী আইনের জমানা শুরু
হওয়ার পর অনেক সমাজবাদী নেতা আর্থিক কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। কারোর গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা।
কারোর চাকরি চলে গেছে। কেউ কোনো মামলায় ফেঁসে আছে। তাদের সবাইকে এঙ্গেলস যথাসম্ভব সাহায্য
করেন। ঠিক তেমন করেই, যেমন প্যারি কমিউনের পরাজয়ের পর কমিউনের যোদ্ধা সাথীদের সাহায্য
করতেন। এই সমস্ত কিছু সামলে তিনি বিজ্ঞানের অধ্যয়নে থেকে ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’ নিয়ে নিজের কাজটায় এগোচ্ছিলেন। ১৮৮১ সালের
শেষে তাঁর আরো একটি কঠিন আঘাত পাওয়ার ছিল।
গভীর তাত্ত্বিক লিখনের পথে – ২
জেনি ভন ওয়েস্টফ্যালেনের
মৃত্যু
১৮৮১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর
দীর্ঘ রোগভোগের পর ৬৭ বছর বয়সে মার্ক্সের স্ত্রী জেনি মার্ক্স – জেনি ভন ওয়েস্টফ্যালেন – মারা গেলেন। তাঁর যকৃতে কর্কট রোগ সনাক্ত
হয়েছিল। মার্ক্স নিজে সে-সময় খুবই অসুস্থ ছিলেন। ৭ তারিখে বড় মেয়েকে লেখা চিঠি থেকে
তাঁর মনের অবস্থা টের পাওয়া যায়। ডাক্তার তাঁকে ঘরের বাইরে বেরোতেও মানা করেছিলেন,
অর্থাৎ নিজের স্ত্রীর শবযাত্রায় তিনি থাকতে পারেন নি।
এঙ্গেলসের জন্য এই
মৃত্যু দুটো আঘাত নিয়ে এসেছিল। জেনি তাঁর ওপর সবচেয়ে বেশি ভরসা করতেন। সচ্ছল পরিবারের
মেয়ে এবং নিজের একটি বৌদ্ধিক পরিচয় রাখা নারী হয়েও তিনি কখনো নালিশ করেন নি যে তাঁর
জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল; মার্ক্স নিজের অন্তরঙ্গ মুহূর্তে কথাটা ভেবে কষ্ট পেতেন সেটা
আলাদা ব্যাপার। শৈশব থেকে দুজনে একে অন্যের বন্ধু ছিলেন এবং ভালোবেসে তাঁরা বিয়ে করেছিলেন।
… ব্রাসেলস থেকে রাতের
অন্ধকারে মার্ক্সকে নিষ্কাশিত করা হয়েছিল। জেনি গর্ভবতী ছিলেন। বড় মেয়ে কোলে, তার বয়স
তখন মাত্র কয়েক মাস। একা একাই মার্ক্সের পিছু পিছু গেলেন। গর্ভের সন্তানের জন্ম হল
প্যারিসে। সেখান থেকেও বলতে গেলে মার্ক্সকে নিষ্কাশিতই করা হল। তৃতীয় মেয়ের জন্ম হল
লন্ডনে। আরো চারটে সন্তান শৈশবেই মারা গেল। প্রতিদিনের জীবনে কতভাবে দুস্থতা এবং অপমান
সহ্য করতে হল। কখনো বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হল কখনো দোকানদারের লোক বাড়িতে বকেয়া
উশুল করতে চলে এল, কখনো বাড়ির বাসনপত্র বন্ধক রাখতে হল, আকছার শীত সহ্য করার মত কাপড়
থাকত না গায়ে। এসবেরও বেশি ছিল বিরোধীদের ছড়ানো মিথ্যে, কুৎসিত অভিযোগের কষ্ট, যা মার্ক্সকে
সইতে হত এবং সঙ্গে তিনিও সইতেন। আর সেই সব কষ্টের মুহূর্তে মার্ক্সের সঙ্গে যে ছোট
ছোট কথাকাটাকাটি হত সেটাও এই নালিশে হত যে মার্ক্স নিশ্চয়ই নিজের বন্ধুকে ঠিকমত বাড়ির
পরিস্থিতিটা বলেন নি। নিশ্চয়ই লজ্জায় চুপ থেকেছেন। নইলে এমন হতেই পারে না যে এঙ্গেলস
জানবেন অথচ অবিলম্বে কোনো ব্যবস্থা করবেন না। এতোটাই ভরসা ছিল, আপনজনের অধিকার ছিল
জেনির, এঙ্গেলসের ওপর।
অন্য দিকে এঙ্গেলস
জানতেন মার্ক্সের জীবনে জেনির ভূমিকা। হৃদয়ের যোগ তো ছিলই, সেছাড়াও, বাড়ির সবরকম কাজে
লেঞ্চেনকে (পরিচারিকা হেলেন ডেমুথকে) সাহায্য করেও তিনি মার্ক্সের ব্যক্তিগত সচিব এবং
লড়াইয়ের অংশীদার হতেন। চিঠি লিখতেন, ডাকঘরে যেতেন, কাগজপত্রগুলো গুছিয়ে রাখতেন …। বিশ্বের শ্রমিক আন্দোলনের খবরাখবর নিতেন।
যৌবনে নিজের যোগ্যতায় ভালো নাট্য-সমালোচক হয়েছিলেন। কিন্তু লন্ডনের জীবনে সে কাজে এগোনোর
বিশেষ সুযোগ পেলেন না। সবরকমভাবে সর্বহারা আন্দোলনের একজন হয়ে গেলেন। বিপ্লবী নারীরা,
অথবা বিপ্লবী পুরুষ কর্মীদের স্ত্রীরা, যাঁরা মার্ক্সের বাড়িতে আসতেন, জেনির বন্ধুত্ব,
সর্বহারা আন্দোলনের বিষয়ে জানার ঔৎসুক্য এবং সহজ আতিথ্যের স্মৃতি সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন।
… যদিও ছোটো মেয়ে
ইলিয়ানর বড় হওয়ার পর মার্ক্সের সচিব হওয়ার কাজ থেকে কিছুটা ছুটি পেয়েছিলেন। এঙ্গেলসের
সঙ্গেও তাঁর পত্রালাপের বড় অংশ জুড়ে এসবই থাকত – জার্মানি থেকে কাল কে এসেছিলেন, কী কথা হয়েছে, আজ প্যারিস থেকে
কে এসেছিলেন, কী বার্তা দিয়ে গেছেন, মার্ক্স আপনাকে অমুক বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখতে
বলেছেন, মার্ক্সের ঐ রচনাটি আমি নকল করতে বসেছিলাম কিন্তু মনে হয় তিনি আরো একটু গভীরে
যাচ্ছেন (অর্থাৎ বার বার নতুন নকল তৈরি করতে হচ্ছে) …। তাই এঙ্গেলসের জন্য একটা আঘাত যেমন ছিল তাঁকে
সবচেয়ে বেশি ভরসা করা একজন মানুষের চলে যাওয়া, আরেকটি আঘাত ছিল এই অনুভূতি যে মার্ক্স
কতটা একলা হয়ে গিয়ে থাকবেন, তাও এত অসুস্থ শরীরে।
জেনির মৃত্যুর পর,
জেনিকে নিয়ে এঙ্গেলসের দুটো প্রবন্ধ লিখলেন। একটি ইংরেজিতে, যার ফরাসি অনুবাদ ‘লা ইগালিতে’তে ছাপল। এর বিষয়বস্তু তিনি জেনির সমাধিতে পড়ার ভাষণের খসড়া হিসেবে
তৈরি করেছিলেন। দ্বিতীয়টি এরই ভিত্তিতে জার্মানে লিখলেন, যেটি ‘ডের সোশ্যালডেমোক্র্যাট’এ ছাপল। দুটোতেই জেনির বিষয়ে তিনি লিখলেন,
“সেদিন থেকে” [বিয়ের দিন থেকে] “তিনি নিজের স্বামীর অদৃষ্টে, শ্রমে এবং সংগ্রামে
শুধু অনুসরণ নয়, বরং, শ্রেষ্ঠ বিবেচনা এবং আন্তরিক উৎসাহের সঙ্গে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন।
… এমন স্পষ্ট ও সমালোচক
মেধা, রাজনৈতিক চাতুর্য, আগ্রহী কর্মচঞ্চল ব্যক্তিত্ব এবং আত্মত্যাগের ক্ষমতা নিয়ে
এক নারী, বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য কত কিছু করেছেন তা প্রচারে পাঠানো হয় নি, পত্রিকার
কলামে নথিভুক্ত হয় নি।”
ওদিকে রাশিয়ায় ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’এর দ্বিতীয় সংস্করণ বার হওয়ার ছিল। বেশ কিছু
বছর ধরে মার্ক্স এবং এঙ্গেলস রাশিয়ার বিপ্লবীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিলেন। ষাটের দশকে
‘ঘোষণাপত্র’এর প্রথম রুশীয় অনুবাদ বাকুনিন করেছিলেন। এই
নতুন অনুবাদ প্লেখানভ করছিলেন।
জেনির মৃত্যুর সময়
মার্ক্স ব্রঙ্কাইটিস এবং প্লুরিসিতে খুব খারাপভাবে ভুগছিলেন। একটু ভালো হলে তাঁকে কিছু
দিনের জন্য দক্ষিণ-ইংল্যান্ডের একটি শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল যে গরম
আর শুকনো হাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেলে আলজিয়ার্সে গিয়ে থাকবেন। রোগের কিছুটা উপশম হওয়ায়
তিনি লন্ডনে ফিরে এলেন। ২১শে জানুয়ারি এঙ্গেলসের সঙ্গে বসে, রুশীয় ভাষায় ‘ঘোষণাপত্র’এর দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য একটি ভূমিকা লিখলেন। এই ভূমিকায় অন্যান্য
বিষয় বাদে একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নে নিজেদের ব্যাখ্যা প্রস্তুত করলেন। রুশীয় বিপ্লবীদের
মাঝে বিতর্কের বিষয় হত পরম্পরাগত গ্রামীণ কমিউনগুলোর প্রতি মনোভাব। এর আগেও বিভিন্ন
প্রবন্ধে এবং ব্যক্তিগত চিঠিতে মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এ-বিষয়ে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন।
এবার দুজনকার যুগ্ম অভিমত, আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’এর ভূমিকায় গেল।
মার্ক্স-এঙ্গেলসের
বন্ধু ছিলেন এক জার্মান রসায়নবিদ কার্ল স্কর্লেমার। এই সময়টায় তিনি নিয়মিত এঙ্গেলসের
বাড়িতে যেতেন। কখনো কখনো থেকেও যেতেন। তিনি খোলাখুলিভাবে সাম্যবাদের সঙ্গে ছিলেন। এমন
এক সময়ে যখন চার দিকে দার্শনিক হেগেলকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা করা হচ্ছিল, তিনি হেগেলকে
অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। এ কারণে তাঁকে ‘লাল রসায়নবিদ’ও বলা হত। হাইড্রোকার্বন সম্পর্কিত গবেষণায় এবং রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাসে
তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। ১৮৮২ সালের প্রথম দিকে তিনি এঙ্গেলসের সঙ্গেই সময় কাটাচ্ছিলেন
কেননা মার্ক্সকে স্বাস্থ্যলাভের জন্য প্রথমে ভেন্টানর (দক্ষিণ-ইংল্যান্ড) এবং তারপর
আলজিয়ার্স (উত্তর-আফ্রিকায় ফরাসি উপনিবেশ) পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে এঙ্গেলস
পুরোপুরি ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন কেননা স্কর্লেমারের সঙ্গে
কথাবার্তাও প্রকৃতি-বিজ্ঞানের বিষয়াদি নিয়ে হত।
আরো একটা কাজ তিনি
সে সময় করছিলেন। পরিকল্পনাটা পুরোনো। সে-সময়কার যখন স্ত্রী লিডিয়া অসুস্থ ছিলেন। জার্মানির
একটা ইতিহাস লেখা শুরু করেছিলেন। যদিও সে-ইতিহাসও পুরো হয় নি এবং ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’র মতই, সেই অসমাপ্ত পান্ডুলিপিও তাঁর জীবনকালে
প্রকাশিত হয় নি। কিন্তু ১৮৮২র প্রারম্ভিক দিনগুলোয় তিনি ধীরে ধীরে সে-ইতিহাস রচনাতেও
ব্যস্ত থাকতেন। যেহেতু মার্ক্স সঙ্গে ছিলেন না আর লন্ডনে থেকে কাজও করতে পারছিলেন না,
তাই এঙ্গেলসের ওপর চাপ ছিল বেশি। দু’তিন দিন পর পর এঙ্গেলসকে মার্ক্সের বাড়িতেও যেতে হত। বাড়িতে শুধু
পরিচারিকা হেলেন ডিমুথ থাকতেন। টুসি কখনো সখনো আসতেন। বড় মেয়ে জেনিও কখনো সখনো আসতেন।
কখনো কোনো দেশের কোনো সাথী মার্ক্সকে পাঠানো কোনো চিঠির উল্লেখ করতেন, যার উত্তর তিনি
পান নি। এঙ্গেলসকে মার্ক্সের পড়ার ঘরে গিয়ে সে চিঠি খুঁজে বার করতে হত। কখনো হেলেনের
হাতে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে আসতে হত যাতে রোজকার কাজকর্ম চলে। সে-সময় নিজেও ঈষৎ অসুস্থই
থাকতেন। লন্ডনের আবহাওয়ার কারণে সব সময় ঠাণ্ডা লেগে থাকত; বাঁ কানে কম শুনতেন।
এই দিনচর্যার মাঝেই এপ্রিলে খবর এল যে ১৩ তারিখে জার্মানিতে ব্রুনো বাউয়ারের মৃত্যু হয়েছে। মার্ক্স-এঙ্গেলস রচিত ‘জার্মান ভাবাদর্শ’এ সমালোচনার কেন্দ্রে ছিল ব্রুনো বাওয়ারের দর্শন। সে সময় ব্রুনো বাওয়ার জার্মান বৌদ্ধিক সমাজে প্রায় শীর্ষে ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধিক সমাজ তাঁকে ভুলে গেল। খবরের কাগজে, পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে আর কোনো আলোচনা হত না। এ ব্যাপারটা এঙ্গেলসকে খুব কষ্ট দিত। মৃত্যু অন্ততঃ তাঁর ইতিবাচক অবদানগুলোকে স্মরণ করার একটা সুযোগ হোক! এঙ্গেলস স্মরণ করলেন যে ব্রুনো বাওয়ার ক্রিশ্চানধর্মের ইতিহাসের ওপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। সে কাজের প্রয়োজন যেমন ধর্মশাস্ত্রীদের কাছে তেমনই সমাজবাদীদের কাছে। অথচ ধর্মশাস্ত্রীরা তাঁর রচনা থেকে চুরি করে করে লিখলেও তাঁর সম্পর্কে কখনো একটা শব্দও বলে না। এই ‘ব্রুনো বাওয়ার এবং প্রারম্ভিক ক্রিশ্চানধর্ম’ তাঁর প্রথম লেখা ছিল ‘ডের সোশ্যালডেমোক্র্যাট’এর পাতায়।
সেই খবরের কাগজের
জন্যই আরেকটি লেখা এঙ্গেলস আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে পাঠালেন। ইংরেজি লোকগীতির জার্মান
অনুবাদ। ‘ব্রের ছোটো পাদ্রী’ (দ্য ভিকার অফ ব্রে) এমন এক পাদ্রীর আত্মকথা
ছিল যে প্রত্যেকটি রাজা, প্রত্যেকটি শাসনের প্রতি নিজের বিশ্বস্ততা জাহির করত। গানের
অনুবাদের সঙ্গে এঙ্গেলসের মন্তব্য ছিল যে আজও এমনই অবস্থা। আর জার্মানিতে তো আমরা অনেকগুলো
রাজনৈতিক পাল্টিখাওয়া পাদ্রীর জায়গায় ‘ব্রের পোপ’কেই শাসনে বসিয়ে দিয়েছি যে প্রতিদিন নিজেই রাজনৈতিক তত্ত্ব পাল্টে
নিজের সিংহাসন বাঁচিয়ে নেয়। আর হবে না-ই বা কেন! ‘সবকিছু ঈশ্বরের মহিমায়’ (জার্মান অর্থঃ সবকিছু বেশি কর উশুল করার জন্য আর বেশি বড় সৈন্যবাহিনী
তৈরি করার জন্য!)
সেপ্টেম্বর মাসে
লিখিত এবং প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ছিল ‘দ্য মার্ক’। মার্ক প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় জার্মানি এবং আশেপাশের বেশ কয়েকটি
দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্যাপ্ত এক ধরণের সামাজিক সংগঠন ছিল। সে সংগঠন কায়েম করেছিল
মুক্ত ছোটো কৃষকদের ছোটো ছোটো সমূহ এবং তার ভিত্তি ছিল জমির যৌথ চাষের কিছু নিয়ম। রাজনৈতিক
এবং আর্থিক, দু’ভাবেই প্রত্যেকটি
মার্ক একটি স্বতন্ত্র জনসমষ্টি হত এবং পুরো সমাজের ওপর তার প্রবল রাজনৈতিক প্রভাব থাকত।
গঠনের ইতিহাস দেখলে হয়ত দেখা যাবে যে মার্কের প্রারম্ভিক সদস্যেরা রক্তসম্পর্কে আত্মীয়
ছিল। চমৎকার এই ঐতিহাসিক রচনাটির মাধ্যমে এঙ্গেলস ভূসম্পত্তির তৎকালীন পূঁজিবাদী-সামন্তবাদী
ব্যবস্থাকে আক্রমণ করেন। রচনাটি তাঁর পুস্তিকা, ‘সমাজবাদঃ কাল্পনিক এবং বৈজ্ঞানিক’এর জার্মান সংস্করণের পরিশিষ্ট রূপে মুদ্রিত
হল। পরে ইংরেজি সংস্করণেও রচনাটির অনুবাদ পরিশিষ্ট হিসেবে রইল। ‘দ্য মার্ক’ লেখার পাশাপাশি এঙ্গেলস ‘সমাজবাদঃ কাল্পনিক এবং বৈজ্ঞানিক’কে পুস্তিকারূপ দেওয়ার জন্য একটি কথামুখও লিখলেন।
(৩) প্রকৃতি-বিজ্ঞানে
বস্তুবাদ
সবাই জানেন যে এঙ্গেলসের
জীবনকালে ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’ ছেপে বেরোয় নি। ছাপার মত
জায়গায় লেখক আনতেও পারেন নি। মার্ক্সের মৃত্যুর পর ‘পূঁজি’র দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ডের
সম্পাদনা এবং প্রকাশনায় এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে নিজের খসড়া বইটার কথা ভাবারও আর
অবকাশ রইল না। ১৮৯৫ সালে এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর পাণ্ডুলিপি এল বার্নস্টাইনের হাতে।
সেই পাণ্ডুলিপির দুটো প্রবন্ধ, ‘প্রেতলোকে প্রকৃতিবিজ্ঞান’ এবং ‘বানর থেকে মানুষে বিবর্তনে
শ্রমের ভূমিকা’
এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর ছেপে বেরিয়েছিল। ১৮৭২ সাল থেকে ১৮৮৩ সাল, অর্থাৎ মার্ক্সের
মৃত্যু অব্দি লিখতে পারা এই অর্দ্ধসমাপ্ত বইটার প্রথম মুদ্রণ ও প্রকাশন হয় ৩৯ বছর
পর। ১৯২৫ সালে সোভিয়েত সঙ্ঘ প্রকাশ করে এর মূল জার্মান সংস্করণ এবং রুশীয় অনুবাদ।
১৯৩৪ সালে প্রগ্রেস পাব্লিশার্স, মস্কো থেকে ইংরেজি অনুবাদ বেরোয়। ১৯৪০ সালে
ক্লেমেন্স দত্ত্ অনুদিত এবং সম্পাদিত একটি ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করেছিল লরেন্স
এন্ড উইশার্ট লিমিটেড। তাতে দীর্ঘ একটি মুখবন্ধ লেখেন খ্যাতনামা জীববিজ্ঞানী
জে.বি.এস.হ্যাল্ডেন। তাতে মার্ক্সবাদের অজেয়তা, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদীদের
কাজের গুরুত্ব (লেনিন রচিত ‘মেটিরিয়ালিজম এন্ড এম্পিরিও-ক্রিটিসিজম’এর চর্চা সহ), বিশ শতকের নতুন নতুন গবেষণা ও অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে এঙ্গেলসের
কাজের প্রাসঙ্গিকতা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু সমালোচনা ইত্যাদির পর লিখেছিলেন,
“১৮৯৫এ যখন এঙ্গেলস
মারা গেলেন, পান্ডুলিপিটা বার্নস্টাইনের হাতে এসেছিল। বার্নস্টাইন সেই পাণ্ডুলিপি ছাপার
ব্যবস্থা করলেন না। এ শুধু মার্ক্সবাদের দুর্ভাগ্য নয়, প্রকৃতিবিজ্ঞানের
সবকয়টি শাখার দুর্ভাগ্য। ১৯২৪ সালে তিনি সেই পাণ্ডুলিপি (অথবা তার অংশ) আইনস্টাইনকে
দিলেন। যদিও আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টি থেকে তাঁর সেটি দারুণ কিছু আকর্ষণীয় মনে
হল না, সামগ্রিকভাবে তিনি প্রকাশনার পক্ষে ছিলেন।”
যদিও সিপিআই(এম)এর
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির উদ্যোগে যে বাংলা অনুবাদ আজ সহজলভ্য, তার মুখবন্ধে বার্নস্টাইনের
কথা নেই। লেখা আছে, “এঙ্গেলসের মৃত্যুর
পর দীর্ঘ ত্রিশ বছর এই পান্ডুলিপিটি রক্ষিত ছিল জার্মান সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির
মহাফেজখানায়।”
কেন এঙ্গেলস এ ধরণের
একটি কাজে হাত দিলেন? কেন মার্ক্স এবং এঙ্গেলস বছরের পর বছর নিজেদের মধ্যে অথবা অন্যান্য
বৈজ্ঞানিক বন্ধুদের সঙ্গে বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনায় চিঠিচালাচালি করে
গেলেন? কেন মার্ক্স গণিতের অধ্যয়নে ব্যাপৃত থেকে এত এত নোট তৈরি করলেন যে সে নোট এখন
বই, লোকে পড়ে? নিজের মুখবন্ধের প্রথমেই হ্যাল্ডেন লেখেন, “বিজ্ঞানের সঙ্গে মার্ক্সবাদের সম্পর্ক দুই
স্তরে। প্রথম তো এই যে মার্ক্সবাদীরা মানুষের অন্যান্য কার্যকলাপের অধ্যয়নের মত বিজ্ঞানেরও
অধ্যয়ন করেন। সে অধ্যয়ন দেখায় যে কোনো সমাজের বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপ কিভাবে তার পরিবর্তনশীল
প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে, সেই নির্ভরতাই অবশেষে উৎপাদন পদ্ধতির ওপর নির্ভরতা হয়, এবং
কিভাবে বিজ্ঞান উৎপাদনের পদ্ধতিসমূহ ও পরিণামে পুরো সমাজটাকে পরিবর্তিত করে। ইতিহাসের
প্রতি যে কোনো ধরণের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির জন্য এই বিশ্লেষণটা জরুরি এবং আজকাল অ-মার্ক্সবাদীরাও
এর কিছু অংশ গ্রহণ করছে। কিন্তু দ্বিতীয়তঃ মার্ক্স এবং এঙ্গেলস সমাজের পরিবর্তনগুলোর
বিশ্লেষণ করেই সন্তুষ্ট হতেন না। দ্বান্দ্বিকতায় তাঁরা শুধু সমাজে এবং মানুষের চিন্তনে
বদলের সাধারণ নিয়মগুলোর বিজ্ঞান নয়, সেই বহির্জগতেরও বদলের বিজ্ঞানটা দেখতেন, মানুষের
চিন্তনে যার প্রতিফলন ঘটে। অর্থাৎ বলা যায় যে দ্বান্দ্বিকতার প্রয়োগ যেমন ‘বিশুদ্ধ’ বিজ্ঞানের সমস্যাদিতে করা যায় তেমনই বিজ্ঞানের সামাজিক সম্পর্কসমূহেও
করা যায়।”
রচনাসমগ্রে, সম্পর্কিত
মন্তব্য থেকেঃ
“এঙ্গেলস ১৮৭৩এর জানুয়ারিতে প্রথমে ভেবেছিলেন যে … নিজের গবেষণার ফলগুলোকে, একজন স্থূল বস্তুবাদী,
লুডইগ বুখনারের সমালোচনায় খণ্ডন-মূলক রচনার মত করে সংক্ষেপিত করবেন। পরে মনস্থির করেন
যে কাজটা সর্বাঙ্গীণ হবে। ৩০শে মে, ১৮৭৩ নাগাদ তিনি কাজটার পরিকল্পনা পুরো করে মার্ক্সকে
চিঠিতে জানিয়ে দেন। মার্ক্স চিঠিটা কার্ল স্কোর্লেমারকে দেখান। তিনি এঙ্গেলসের পরিকল্পনার
প্রধান বিন্দুগুলো অনুমোদন করেন।
“……
‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’র ওপর এঙ্গেলসের কাজকে দুটো প্রধান পর্বে ভাগ করা যেতে পারেঃ ১৮৭৩এর
শুরু থেকে ১৮৭৮এর জানুয়ারি অব্দি, আবার ১৮৭৮এর গ্রীষ্ম থেকে ১৮৮২র গ্রীষ্ম অব্দি। প্রথম
পর্বে এঙ্গেলস প্রধানতঃ তথ্য সংগ্রহ করেন, তাছাড়া ‘ভূমিকা’ আর বেশির ভাগ অসম্পূর্ণ অংশগুলো লেখেন। পরবর্তী পর্বে ভবিষ্যতের
কাজের একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করেন … এবং সবকয়টি অধ্যায়, প্রবন্ধ এবং বাকি অসম্পূর্ণ অংশগুলো লেখেন।
যখন মার্ক্স মারা যান, ‘পূঁজি’র প্রকাশন পুরো করার কাজ এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক
শ্রেণীর আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজ এঙ্গেলসের সারাটা দিন নিয়ে নিতে থাকে। তাই “‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’ নিয়ে কাজ করা বলতে গেলে ছেড়েই দিতে হয়; কাজটা
অসমাপ্ত থেকে যায়।
“‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’ আমাদের কাছে চারটে ফোল্ডারে পৌঁছেছে। ঐ চারটে ফোল্ডারে এঙ্গেলস
তাঁর কাজ সম্পর্কিত যাবতীয় প্রবন্ধ ও নোট বিন্যস্ত করেছেন। ফোল্ডারগুলোকে তিনি নাম
দিয়েছেনঃ (১) ‘দ্বান্দ্বিকতা এবং
প্রকৃতিবিজ্ঞান’, (২) ‘প্রকৃতির তত্ত্বানুসন্ধান এবং দ্বান্দ্বিকতা’, (৩) ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’ এবং (৪) ‘গণিত এবং প্রকৃতিবিজ্ঞান; বিবিধ’। দুটো ফোল্ডারে – দ্বিতীয় এবং তৃতীয় – লেখকের তৈরি করা বিষয়সূচি আছে, যা ফোল্ডারে থাকা সামগ্রীগুলোর বিন্যাসের
ইঙ্গিত দিচ্ছে …। প্রথম এবং চতুর্থ
ফোল্ডারে পাতাগুলোর বিন্যাস সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না যে এঙ্গেলস এমনটাই চেয়েছিলেন
কিনা।
“প্রথম ফোল্ডারে (‘দ্বান্দ্বিকতা এবং প্রকৃতিবিজ্ঞান’) দুটো ভাগ আছেঃ (১) ১১টা ডবল পাতায় লেখা নোট,
লেখক সে পাতার সংখ্যা দিয়েছেন, প্রত্যেকটি পাতার শিরোনাম ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’। … (২) সংখ্যাচিহ্নিত না করা কুড়িটি পাতা, প্রত্যেকটিতে বড় বা ছোটো
নোট …।
“দ্বিতীয় ফোল্ডারে (‘প্রকৃতির তত্ত্বানুসন্ধান এবং দ্বান্দ্বিকতা’) তিনটে বড় নোট আছেঃ ‘বাস্তব বিশ্বে গাণিতিক অসীমের আদিরূপ সম্পর্কে,
‘প্রকৃতির ‘যান্ত্রিক’ ধারণা সম্পর্কে’, ‘নাগেলির অসীমকে জানার
অক্ষমতা সম্পর্কে’। আর আছে ‘ড্যুহরিংতত্ত্ব[-খন্ডন]এর পুরোনো মুখবন্ধঃ
দ্বান্দ্বিকতা সম্পর্কে’, ‘বানর থেকে মানুষে বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা’ এবং একটি বড় অসম্পূর্ণ অংশ, ‘‘ফায়ারবাখ’ থেকে বর্জিত’ নামে। এই ফোল্ডারের জন্য এঙ্গেলসের তৈরি করা বিষয়সূচি ইঙ্গিত করে
যে এতে আরো দুটো প্রবন্ধ ছিলঃ ‘গতির মৌলিক রূপসমূহ’ আর ‘প্রেতলোকে প্রকৃতিবিজ্ঞান’। পরে, বিষয়সূচি থেকে এই দুটো শিরোনাম এঙ্গেলস
কেটে বাদ দিয়ে তৃতীয় ফোল্ডারে রাখেন, যেখানে তাঁর অসমাপ্ত কাজের, বেশি পুরো হওয়া অঙ্গগুলো
রাখা ছিল।
“তৃতীয় ফোল্ডারে (‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’) সবচেয়ে বেশি পুরো হওয়া ছ’টি প্রবন্ধ আছেঃ ‘গতির মৌলিক রূপসমূহ’, ‘গতির মাপ – কাজ’, ‘বিদ্যুৎ’, ‘প্রেতলোকে প্রকৃতিবিজ্ঞান’, ‘ভূমিকা’ এবং ‘জোয়ারের ঘর্ষণ’ …।
“চতুর্থ ফোল্ডারে (‘গণিত এবং প্রকৃতিবিজ্ঞান; বিবিধ’) দুটো অসমাপ্ত অধ্যায় আছেঃ ‘দ্বান্দ্বিকতা’ এবং ‘তাপ’। ১৮টি পাতা, সংখ্যাচিহ্নিত নয়, প্রত্যেকটিতে
দীর্ঘ অথবা হ্রস্ব নোট … অনেকগুলো পাতা ভর্তি
গাণিতিক কলন। …”
[মার্ক্স-এঙ্গেলস
রচনাসমগ্র (ইংরেজি), খণ্ড ২৫, পৃঃ ৬৬০, নোট সংখ্যা ১৩০]
আশা করি এই দীর্ঘ
উদ্ধৃতি বোঝাবে যে মার্ক্স-এঙ্গেলস জুটির এই নিজেকে ‘সহবাদক’ বা ‘সেকেন্ড ফিড্ল’ বলা মানুষটি কেমনভাবে গুটি সাজিয়ে যুদ্ধে
নামতেন!
এমন বিশাল পরিকল্পনা
নিয়ে শুরু করা কাজগুলোর অসমাপ্তি আরো বেশি করে ইঙ্গিত করে সর্বহারা বিপ্লবের প্রতি
তাঁর প্রগাঢ় দায়বদ্ধতার দিকে।
গভীর তাত্ত্বিক লিখনের পথে – ৩
মার্ক্সের মৃত্যু
মার্ক্স এবং এঙ্গেলস,
দুজনেরই জীবনকালে প্রকাশিত গ্রন্থাদির সংখ্যা থেকে মৃত্যুর পরে প্রকাশিত গ্রন্থাদি
(নোটসের সংগ্রহসুদ্ধু) কম নয়। মার্ক্সের তো বরং বেশিই। ‘পূঁজি’ দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ডেরই শেষরূপ দিয়ে যেতে পারলেন না। ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বসমূহ’ তিন খণ্ডে এঙ্গেলসও প্রকাশ করতে পারলেন না,
সোভিয়েত সঙ্ঘ থেকে বেরোল। তারপর বেরোল ১৮৪৫এর, ১৮৫৬র পাণ্ডুলিপিগুলো, গ্রুন্ড্রিস,
এবং গাণিতিক আর জাতিতাত্ত্বিক নোটবুক। দুজনের যুগ্মভাবে লেখা ‘জার্মান ভাবাদর্শ’ও সোভিয়েত রুশ বার করল।
এঙ্গেলসেরও ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’র অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি সোভিয়েত সঙ্ঘ বার করল।
আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস, জার্মানির ইতিহাস সম্পর্কে নেওয়া নোট রচনাসমগ্রে প্রকাশিত।
১৮৮২র প্রারম্ভিক
মাসগুলোয় আরেকটি কাজে তিনি এগোচ্ছিলেন। জার্মানির ইতিহাসের ওপর কাজ শুরু করেছিলেন ১৮৮০তে।
আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস নিয়ে কাজ করার সময় তাঁর সামনে প্রধান প্রশ্ন ছিল, কেন বার বার
চেষ্টা করেও আয়ারল্যান্ড ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হতে পারছে না, তার
সমাজের ঐতিহাসিক জটিলতাগুলো কী। জার্মানির প্রাচীনকালের এবং মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে
কাজ শুরু করার সময় তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, জার্মান জাতির রাজনৈতিক-ভৌগোলিক ঐক্যের
আলোয় জার্মান কৃষকদের তৎকালীন অবস্থা সম্পর্কে জানা এবং জার্মানিতে কর্মরত সমাজবাদীদের
কৃষকদের মধ্যে কাজ করার জন্য অনুপ্রেরিত করা।
আগের কোনো একটি অধ্যায়ে
জার্মান ইতিহাসের এই পাণ্ডুলিপি থেকেই প্রকাশিত ‘দ্য মার্ক’ নামে প্রবন্ধটির উল্লেখ আছে, যেটি পরে ‘সমাজবাদঃ বৈজ্ঞানিক এবং কাল্পনিক’এর পরিশিষ্ট হিসেবে সংযোজিত হল। সেই প্রবন্ধের
শেষে তিনি বলেন, “এই হল কৃষক সম্পর্কে
আমাদের দৃষ্টি। আর যতই অভুক্ত ও দুর্বল হয়ে হোক না কেন, মুক্ত কৃষক শ্রেণীর প্রত্যাবর্তনের,” [ভূদাস প্রথা থেকে] “গুরুত্ব এটাই যে এই মুক্তি কৃষকদের, স্বাভাবিক
বন্ধু শ্রমিকদের মদত নিয়ে, নিজেদেরকে সাহায্য করার অবস্থায় এনে দিয়েছে। ব্যস, কেমন
করে, সেটা যত তাড়াতাড়ি তারা জেনে যায়!” পরে এঙ্গেলস কৃষকদেরকে সম্বোধন করেন, “এ বিষয়ে ভাবুন, জার্মান কৃষকগণ! একমাত্র সামাজিক-গণতন্ত্রীরাই
আপনাদেরকে সাহায্য করতে পারে।”
১৮৮২র ১৬ই ডিসেম্বরে
এঙ্গেলস মার্ক্সকে চিঠি লিখে, তার সঙ্গে ‘দ্য মার্ক’এর পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠিতেই মনে জাগতে থাকা প্রশ্নগুলোও
জানিয়েছিলেন।
………
১৮৮২র ফেব্রুয়ারি
মাসে ডাক্তারদের পরামর্শে মার্ক্স আলজিয়ার্সে (সেসময় ফরাসি উপনিবেশ, এখন স্বাধীন আলজিরিয়ার
রাজধানী) যান। ২০শে ফেব্রুয়ারি থেকে ২রা মে অব্দি সেখানে ছিলেন। যাওয়ার সময় প্যারিসের
একটি মফস্বল শহর আর্জেন্তেল হয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে থাকতেন স্বামী-সন্তান সহ তাঁর বড়
মেয়ে জেনি লঙ্গোয়ে। সেটাই বড় মেয়ের সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা। ইংল্যান্ডে থাকতেই জেনির ক্যান্সার
হয়েছিল। ফ্রান্সে গিয়েও তা আর ভালো হল না। ১৮৮৩র ১১ই জানুয়ারি মাত্র ৩৮ বছর বয়সে জেনি
মারা যান। মার্ক্সের স্ত্রী জেনি ভন ওয়েস্টফ্যালেনের জন্য যেমন, তাঁদের মেয়ে জেনি লঙ্গোয়ের
জন্যও শোকবার্তা লেখার দায়িত্ব এল এঙ্গেলসের ওপর। লেখাটা দরকার ছিল কেননা মৃদুভাষিণী
জেনি, হাজারটা শারীরিক কষ্ট সত্ত্বেও অন্যায়ের প্রতিবাদে কখনো পিছু হটেন নি। আয়ারল্যান্ডের
বিদ্রোহের পর আইরিশ বন্দীদের প্রতি ইংরেজ সরকারের আচরণ কেমন ছিল তা ফাঁস করেছিল জেনির
লেখা, এবং খবরের কাগজে সে লেখা পড়ে সরকার নড়েচড়ে বসেছিল। পদক্ষেপ নিয়েছিল তৎক্ষণাৎ।
এঙ্গেলসের লেখা শোকবার্তা ১৮ই জানুয়ারির ‘সোশ্যেলডেমোক্র্যাট’এ ছাপল।
এই শোকবার্তার পর
১৪ই মার্চ অব্দি এঙ্গেলসের কোনো প্রবন্ধ, প্রতিবেদন কোনো খবরের কাগজে প্রকাশিত হয় নি।
রচনাসমগ্র অনুসারে মার্ক্সের শেষ চিঠি ১৩ই জানুয়ারিতে লেখা, যাতে তিনি ডাক্তারকে মেয়ের
মৃত্যুর কথা জানিয়ে ভেন্টনোর (যেখানে সে সময় ছিলেন) থেকে লন্ডনে ফেরার সংবাদ দিচ্ছেন।
এঙ্গেলসের বেশ কয়েকটি চিঠি আছে – বার্নস্টাইন, কাউটস্কি এবং বেবেলকে রাজনীতি-সম্পর্কিত এবং লরা লাফার্গকে
ব্যক্তিগত – কিন্তু সবকয়টিতে
মার্ক্সের শারীরিক অবনতির উল্লেখ আছে। এ কথারও উল্লেখ আছে যে বড় মেয়ের মৃত্যুতে মার্ক্স
গভীরভাবে শোকাহত।
অবশেষে ১৪ই মার্চের
সেই অপরাহ্ন এল। এঙ্গেলস প্রথম টেলিগ্রাম করলেন শার্ল লঙ্গোয়েকে, যে বিকেল তিনটেয় মার্ক্স
মারা গেছেন। দ্বিতীয় টেলিগ্রাম করলেন ফ্রেডরিক এ্যাডলফ সোর্জকে। তারপর অগাস্ট বেবেলকে।
রচনাসমগ্রে উল্লেখ আছে যে তারপর আরো অনেককে এঙ্গেলস টেলিগ্রাম অথবা নোট পাঠিয়েছিলেন।
সেগুলোর উল্লেখ অন্যান্য চিঠিতে আছে কিন্তু লভ্য নয়। সেদিনই সন্ধ্যায় উইলহেল্ম লিবনেখ্টকে
লেখা একটি দীর্ঘ চিঠিতে তিনি সেই বিকেলের পরিস্থিতির বর্ণনা করলেন, “ঠিক দুপুর দুটোর পর” [প্রতিদিন এঙ্গেলস ঐ সময়টাতেই বন্ধুর সঙ্গে
দেখা করতে যেতেন] “দেখলাম বাড়ির সব
ক’জনের চোখে জল। আমাকে
বলা হল, সে বড়ই দুর্বল হয়ে পড়েছে। লেঞ্চেন আমাকে ওপরে আসার জন্য ডাক দিল। বলল সে আধঘুমে
আছে। আর যখন ঘরে পৌঁছোলাম – লেঞ্চেন দুমিনিটের
জন্য বাইরে এসেছিল – দেখলাম সে গভীর
নিদ্রায়, কিন্তু চিরনিদ্রায়। এই শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্দ্ধাংশের সবচেয়ে বড় প্রতিভা, চিন্তা
করা বন্ধ করে দিয়েছিল।”
আরো অনেক সমাজবাদী
সাথীকে চিঠি লিখেছিলেন যাতে ঐ বেদনাঘন মুহূর্তটির বর্ণনার পাশাপাশি মার্ক্স সম্পর্কেও
কিছু কথা ছিল। ভবিষ্যতে কাজের দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা ছিল। মার্ক্সের মৃত্যুর পরের দিন
এঙ্গেলস ১৮৪৮এর সংগ্রামের সাথী জোহান ফিলিপ বেকারকে লিখলেন, “৪৮এর আগের পুরোনো সাথীদের মধ্যে শুধু আমরা
দুজনই বেঁচে রইলাম। ঠিক আছে! তাহলে আমরাই ফাটলটা বোজাবো। গুলি চলতে পারে এবং বন্ধুরা
পড়ে যেতে পারে, কিন্তু সে ঘটনা আমরা প্রথমবার দেখছি না। আর আমাদের মধ্যে থেকে যদি কারোর
গায়ে গুলি লাগে – লাগবে! ব্যস, যেন
জায়গা মত লাগে যাতে খুব বেশিক্ষণ ছটফট করতে না হয়।”
এঙ্গেলসের নিঃসঙ্গতা
দেখে অনেকে পরামর্শ দিল অন্য কোথাও চলে যাওয়ার। কিন্তু এঙ্গেলসের মাথায় পরিষ্কার ছিল
– এবার তো আর কোত্থাও
যাবেন না। প্রথমত এই কারণে যে ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক আবহাওয়া সেই দিনগুলোয় সবচেয়ে বেশি
শান্ত ছিল, হঠাৎ কোনোদিন দেশ-থেকে-নিষ্কাশিত ঘোষিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল না। তাছাড়া মার্ক্সের
মৃত্যুর পর কাগজপত্রের ঐ সিন্দুকগুলো বয়ে নিয়ে কোথায় কোথায় যাবেন? আর গেলে মার্ক্সের
রচনাগুলোর কাজ পুরো কিকরে হবে? ১৮৮৩র ৩০শে এপ্রিল অগাস্ট বেবেলকে লিখলেন, “যদি কেউ নিজের তাত্ত্বিক কাজ করে যেতে চায়,
তাহলে যে ধরণের শান্তির তার দরকার পড়বে, সে ধরণের শান্তি শুধু এখানেই আছে। অন্যান্য
সব জায়গায় ব্যবহারিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে হবে। অনেক সময় নষ্ট করতে হবে। আমার মনে
হয় ব্যবহারিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আমি যে কোনো মানুষের চেয়ে বেশি লাভ করেছি আর তাত্ত্বিক
কাজে, এখনো অব্দি দেখতে পাচ্ছি না মার্ক্সের আর আমার জায়গা কে নেবে। যুবরা এখনো অব্দি
একাজে যা চেষ্টা করেছে তার মূল্য খুবই কম, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শূন্যের চেয়েও কম। একমাত্র
লোক কাউটস্কি, যে পড়াশুনো করে, কিন্তু তাকে জীবিকার জন্য লিখতে হয়। অন্য কোনো কারণ
যদি না-ও থাকে, শুধু এই কারণে সে কিছু করতে পারবে না। আমার বয়স এখন তেষট্টি বছর। চোখ
অব্দি ঢাকা ছিল কাজে। তার ওপর এখন এসে গেল মার্ক্সের ‘পূঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ডের সম্ভাবিত এক বছরের কাজ। আরেক বছরের কাজ হবে মার্ক্সের
জীবনী, ১৮৪৩ সাল থেকে ১৮৬৩ সাল অব্দিকার জার্মান সমাজবাদী আন্দোলন এবং ১৮৬৪ থেকে ১৮৭২
পর্য্যন্ত ‘আন্তর্জাতিক’এর ইতিহাস রচনা। এই শান্তিপূর্ণ বাসস্থানের
বদলে এমন কোনো জায়গা বেছে নেওয়া যেখানে আমাকে সভায় আর খবরের কাগজের লড়াইয়ে অংশ নিতে
হবে, আমার পক্ষে নিছক পাগলামি। কারোর দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে দেওয়ার জন্য ঐটুকুই পর্যাপ্ত,
আর সত্যিই আচ্ছন্ন করে দেবে। হ্যাঁ, যদি পরিস্থিতি সেরকম হত যেমন ১৮৪৮-৪৯এ ছিল, তাহলে
আবার আমি ঘোড়ায় জিন পরাতাম।”
মার্ক্সের সমাধিতে
দাঁড়িয়ে এঙ্গেলস যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটা সবাই পড়েছেন। পুরো ভাষণটাই বাংলা অনুবাদে
পাওয়া যায়। তবু তার কয়েকটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করব। বোধহয় অপ্রয়োজনীয় মনে হবে না কেননা
ভাষণে মার্ক্সের কাজের যে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে, সে কাজগুলো মার্ক্সের সঙ্গে তাঁর চার
দশকের বন্ধুত্বের আবেগঘন জগতেই পোষিত-বিকশিত হয়েছে। তাই সে কাজগুলো তাঁরও জীবনের অংশ।
“ডারউইন যেমন জৈব প্রকৃতির বিকাশের নিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন, তেমনি
মার্ক্স আবিষ্কার করেছেন মানুষের ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম … কোনো নির্দিষ্ট জাতির বা নির্দিষ্ট যুগের অর্থনৈতিক
বিকাশের মাত্রাই হল সেই ভিত্তি যার ওপর গড়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট জাতিটির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান,
আইনের ধ্যান-ধারণা, শিল্পকলা এমনকি তাদের ধর্মীয় ভাবধারা পর্যন্ত এবং সেই দিক থেকেই
এগুলির ব্যাখ্যা করতে হবে …
“কিন্তু শুধু এই নয়। বর্তমান পূঁজিবাদী উৎপাদন-পদ্ধতির এবং এই পদ্ধতি
যে বুর্জোয়া সমাজ সৃষ্টি করেছে তার গতির বিশেষ নিয়মটিও মার্ক্স আবিষ্কার করেন। যে সমস্যার
সমাধান খুঁজতে গিয়ে এতদিন পর্যন্ত সব বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ ও সমাজতন্ত্রী সমালোচক উভয়েরই
অনুসন্ধান অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছিল, তার ওপর সহসা আলোকপাত হল উদ্বৃত্ত মূল্য আবিষ্কারের
ফলে।
“একজনের জীবদ্দশার পক্ষে এরকম দুটো আবিষ্কারই যথেষ্ট। এমনকি এরকম
একটা আবিষ্কার করতে পারার সৌভাগ্য যাঁর হয়েছে তিনিও ধন্য। কিন্তু মার্ক্সের চর্চার
প্রতিটি ক্ষেত্রে – এবং তিনি চর্চা
করেছিলেন বহু বিষয় নিয়ে এবং কোনোটাই ওপর ওপর নয় – তার প্রতিটি ক্ষেত্রে, এমনকি গিণিতশাস্ত্রেও তিনি স্বাধীন আবিষ্কার
করে গেছেন।
“এই হল বিজ্ঞানী মানুষটির রূপ। কিন্তু এটা তার ব্যক্তিত্বের অর্ধেকও
নয়। …
“কারণ মার্ক্স সবার আগে ছিলেন বিপ্লববাদী। তাঁর জীবনের আসল ব্রত ছিল
পূঁজিবাদী সমাজ এবং এই সমাজ যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে তার উচ্ছেদে কোনো
না কোনো উপায়ে অংশ নেওয়া, আধুনিক প্রলেতারিয়েতের মুক্তিসাধনের কাজে অংশ নেওয়া … তাঁর ধাতটাই ছিল সংগ্রামের।
“এবং তাই, তাঁর কালের লোকেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রোশ ও কুৎসার
পাত্র হয়েছেন মার্ক্স। … আর আজ সাইবেরিয়ার
খনি থেকে কালিফোর্নিয়া পর্যন্ত, ইউরোপ ও আমেরিকার সব অংশে লক্ষ লক্ষ বিপ্লবী সহকর্মীদের
প্রীতির মধ্যে, শ্রদ্ধার মধ্যে, শোকের মধ্যে তাঁর মৃত্যু।”
[অনুবাদ নেওয়া হয়েছে
প্রগতি প্রকাশন, মস্কো প্রকাশিত, বাংলায় মার্ক্স-এঙ্গেলসের দুই খণ্ডে রচনা সংকলনের
দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম অংশ, পৃঃ ১৬৪-১৬৫ থেকে]
মার্ক্স বলেছিলেন
তাঁর দেহ কবরস্থ করার সময় যেন শোক-মিছিলের মত কোনো আড়ম্বর না করা হয়। তাই ১৭ই মার্চে
হাইগেট সমাধিস্থানে (যে অংশে স্বীকৃত নাগরিক সমাজ এবং গির্জা দ্বারা বহিষ্কৃত মানুষদের
কবর দেওয়া হত) মাত্র কয়েকজনের উপস্থিতিতে তাঁর দেহ কবরস্থ করা হল। সেখানেই দুবছর আগে
তাঁর স্ত্রী, জেনি ভন ওয়েস্টফ্যালেনের দেহও কবরস্থ করা হয়েছিল। মার্ক্সের শোকযাত্রায়
এঙ্গেলস বাদে উপস্থিত ছিলেন পল ও লরা লাফার্গ (তাঁরাই ফ্রান্সের শ্রমিক দলেরও প্রতিনিধিত্ব
করছিলেন), শার্ল লঙ্গোয়ে, ইলিয়ানর মার্ক্স-এভেলিং ও এডোয়ার্ড এভেলিং, হেলেন ডেমুথ,
উইলহেল্ম লিবনেখ্ট, ফ্রেডরিক লেসনার, জি. লোচনার, দুজন বৈজ্ঞানিক – এডুইন রে ল্যাঙ্কেস্টার এবং কার্ল স্কোর্লেমার,
গটফ্রিড লেম্কে এবং কবি আর্নেস্ট র্যাডফোর্ড। ‘ডের সোশ্যেলডেমোক্র্যাট’ এবং লন্ডনে কার্যরত ‘জার্মান শ্রমিক শিক্ষা সমিতি’র তরফ থেকে কবরের ওপর ফুলের মালা রাখা হয়েছিল। তাঁদের পাঠানো
শোকবার্তা পড়েছিলেন শার্ল লঙ্গোয়ে।
একথাটাও বলে নেওয়া
যেতে পারে যে শেষ অব্দি এখানে পাশাপাশি চারজন কবরস্থ হয়েছিলেন – মার্ক্সের স্ত্রী, মার্ক্স, তাঁর নাতি হ্যারি
লঙ্গোয়ে (শৈশবেই মৃত) এবং বাড়ির পরিচারিকা হেলেন ডেমুথ। একাত্তর বছর পর ১৯৫৪ সালে মার্ক্স
মেমোরিয়াল কমিটি, ইংল্যান্ডের তরফ থেকে এই সমাধিস্থান থেকে একশো মিটার দূরে একটা নতুন
জায়গা কেনা হয় এবং চারজনেরই কফিন আগের জায়গা থেকে উঠিয়ে নতুন জায়গায় সমাধিস্থ করা হয়।
সেখানেই পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয় এবং মার্ক্সের আবক্ষ প্রতিমা বসানো হয়
যা আমরা আজকাল দেখতে পাই। ১৯৫৬ সালে গ্রেট ব্রিটেনের কম্যুনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ
সম্পাদক এই স্মৃতিস্তম্ভ এবং প্রতিমার আবরণ উন্মোচন করেন।
মার্ক্সের মৃত্যুর
পর এঙ্গেলস নিজের সমস্ত কাজ ছেড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বন্ধুর পড়ার ঘরে ডাঁই হয়ে থাকা বই
ও কাগজপত্র গুছিয়ে এক জায়গায় করতে। বিশেষ করে অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিগুলো এবং অজস্র নোটের
পৃষ্ঠাগুলোকে বিন্যস্ত করার দরকার ছিল। ইলিয়ানর যেমন ষোলো বছর বয়স থেকে মার্ক্সের সচিব
ছিলেন, এখন এঙ্গেলসের এই কাজে সহযোগী হলেন। ১৮৮৩ সালের ২২শে মে এঙ্গেলস জেনেভায় জোহান
ফিলিপ বেকারকে লিখলেন, “চমৎকৃত হই যে মার্ক্স
১৮৪৮এরও আগেকার কাগজ, চিঠি আর পান্ডুলিপিগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে। জীবনী রচনার অসাধারণ
সামগ্রী সব। সে জীবনী লিখব অবশ্যই, আর একই সঙ্গে সে লেখা, ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’ এবং রাইনের নিম্নাঞ্চলে ১৮৪৮-৪৯এর আন্দোলনের
ইতিহাস হবে। পরে গিয়ে সে লেখায় ১৮৪৯ থেকে ১৮৫২র অন্তর্বর্তী সময়ে, ধূর্ততার সঙ্গে মার্ক্সকে
ধাক্কা দিয়ে লন্ডন-প্রবাসে পাঠিয়ে দেওয়ার ইতিহাসও থাকবে। থাকবে ‘আন্তর্জাতিক’ গঠনের ইতিহাস। কাজের প্রথম দায়িত্ব হল ‘পূঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ডের সম্পাদনা আর সেটা খেলাকথা নয়। দ্বিতীয় গ্রন্থের” [দ্বিতীয় খণ্ডের মূল কথ্য অংশ হল দ্বিতীয়
গ্রন্থ] “চার বা পাঁচটা সংশোধিত
রূপ আছে যার মধ্যে শুধু প্রথমটা পুরো, বাকি ক’টা মাত্র শুরুই হয়েছে।” [রচনাসমগ্রে, সম্পর্কিত নোটে ব্যাপারটার আরো বিশদ ব্যাখ্যা আছে]
“মার্ক্সের মত মানুষের
লেখাপত্র নিয়ে কাজ করতে পরিশ্রম লাগে; সে একেকটা শব্দ ওজন করে লিখত। কিন্তু আমার জন্য
এটা ভালোবাসার পরিশ্রম। অন্ততঃ আবার আমি আমার পুরোনো সাথীর সঙ্গে থাকব।
বিগত কয়েক দিন যাবৎ
আমি ১৮৪২-৬২র চিঠিগুলো বাছছি। পুরোনো সময়টার দিকে তাকালে দিনগুলো জীবিত হয়ে ওঠে। সেই
আনন্দগুলোও যা বিরোধীদেরকে নিয়ে হাসিঠাট্টায় পেতাম। পুরোনো কিছু কর্ম মনে করে হাসতে
হাসতে চোখে জল এসে গেল। আমাদের আমুদে মেজাজটা শেষ পর্য্যন্ত ভাঙতে পারলই না আমাদের
বিরোধীরা। কিন্তু আবার গুরুগম্ভীর মুহূর্তও আসত কখনো কখনো।”
১৮৮৩ সাল প্রায় পুরোটাই
মার্ক্সের পাণ্ডুলিপি গোছাতে আর তারপর, ‘পূঁজি’র প্রথম খণ্ডের তৃতীয়
জার্মান সংস্করণ তৈরি করতে চলে গেল। সেই বছরই ২৯শে জুন এঙ্গেলস ফ্রেডরিক অ্যাডলফ সোর্জকে
লিখছেন, “‘পূঁজি’র তৃতীয় সংস্করণের জন্য আমাকে খুব বেশি কাজ
করতে হচ্ছে … তাত্ত্বিক অংশের
পুরোটাই প্রায় পরিমার্জন করার ব্যাপার।” এ কথাটার কারণ, মার্ক্স তাঁর শেষ সংশোধনগুলো ফরাসি অনুবাদের পৃষ্ঠায়
করেছিলেন, যখন নাকি সে অনুবাদটাই সঠিক ছিল না। অর্থাৎ প্রত্যেকটি সংশোধনকে আগে ফরাসি
তারপর জার্মান সংস্করণের সঙ্গে মিলিয়ে তবে মূল কথ্যে পরিবর্তন করতে হচ্ছিল।
যেহেতু মার্ক্স আর
নেই, তাই সেই সমস্ত সাথীর চিঠির জবাব দিতে হচ্ছিল যাঁরা আগে মার্ক্সকেই বেশি চিঠি লিখতেন।
সেই প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে হচ্ছিল যার জবাব আগে মার্ক্স দিতেন। এঁদের মধ্যে প্রধানতম
ছিলেন রাশিয়ার সাথীরা, কেননা রাশিয়ায় বিপ্লবী কার্যকলাপ তীব্র গতিতে বেড়ে চলেছিল।
এসবের মধ্যেই ছোটো
ছোটো লেখা যেতেই থাকত খবরের কাগজে। মে মাসের দুটো লেখা আছে রচনাসমগ্রে। একটির বিষয়,
কবি বন্ধু উইর্থের একটি কবিতা আর আরেকটির বিষয়, ক্রিশ্চানধর্মের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ।
জুন মাসে, ‘ঘোষণাপত্র’এর সেবছরই প্রকাশিতব্য জার্মান সংস্করণের মুখবন্ধ
লিখলেন; তাতে দুঃখ করলেন যে তাঁর একার স্বাক্ষরে এটা ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’এর প্রথম সংস্করণ হবে। মুখবন্ধে এক প্যারায়
‘ঘোষণাপত্র’এর তাত্ত্বিক সারমর্ম লিখে তার শ্রেয় তিনি
মার্ক্সকে দিলেন। বললেন যে একথাটা প্রথম থেকেই বলে আসছিলেন কিন্তু এবার ’ঘোষণাপত্র’এর পৃষ্ঠায় কথাটা নথিভুক্ত হয়ে যাওয়া উচিৎ। পরে, ১৮৮৮তে যখন ইংরেজি
সংস্করণ বেরোল, তখনো এঙ্গেলস তার মুখবন্ধে কথাটা লিখে দিলেন।
জুন মাসের ১২-১৩
তারিখে বার্নস্টাইনকে একটা চিঠি লিখে সামনের দিনগুলোয় নিজের করণীয় কাজের ফিরিস্তি দিলেনঃ
“১) কাগজগুলো গোছানো” [রচনাসমগ্রে, সম্পর্কিত টীকা বলে যে এ কাজটা করতে তাঁর সময় লেগেছিল
নয় মাস, ১৮৮৪র মার্চ মাস অব্দি; তারপর সে কাগজগুলো তিনি নিজের বাড়িতে নিয়ে যান] “একাজটা আমায় একাই করতে হবে কেননা, আমি ছাড়া
আর কেউ এ পুরোনো কাগজগুলোর গুরুত্ব জানে না। পুরোপুরি এলোমেলো একটা পাহাড়! অনেক কিছু
এখনো পাই নি। অনেকগুলো প্যাকেট আর বাক্সো এখনো খোলাও হয় নি।
“২) তৃতীয় সংস্করণটা” [পূঁজি’র] “দেখা; খুচরো অদলবদল আর ফরাসি সংস্করণ থেকে
কয়েকটা সংশোধন অন্তর্ভুক্ত করা। তার ওপর প্রুফ দেখা।
“৩) ইংরেজি অনুবাদ” [পূঁজি’র] “প্রকাশ করার যে সুযোগটা হাতে এসেছে সেটার সদ্ব্যবহার
করা – এ ব্যাপারে আজ আমি
এখানকার এক বড় প্রকাশকের কাছে গিয়েছিলাম – আর তারপর সে অনুবাদটার পরিমার্জন করা, নিজে (অনুবাদ যে করছে, মুর,
সে এক নম্বর অনুবাদক, ২৬ বছর ধরে আমাদের বন্ধু, কিন্তু ঢিমা)।
“৪) দ্বিতীয় খণ্ডের” [পূঁজি’] “শুরুর তৃতীয় এবং চতুর্থ রূপদুটোকে মেলাতে হবে,
প্রেসের জন্য তৈরি করতে হবে, তাছাড়া পুরো দ্বিতীয় খণ্ডের একটি পরিষ্কার কপি তৈরি করতে
হবে।”
(৪) মানব-বিজ্ঞানে
বস্তুবাদ
মার্ক্সের মৃত্যুর
পর এক বছর পর্য্যন্ত তাঁর বাড়িটা ছাড়া যায় নি। প্রথম দিকে তো ইলিয়ানর আর লেঞ্চেন দুজনে
ওখানেই থাকতেন। প্রতিদিন এঙ্গেলস আসতেন আর দুজনের সাহায্যে মার্ক্সের পড়ার ঘর, অন্যান্য
জায়গা, খবরের কাগজের স্তূপ, ভাঁড়ার ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে মার্ক্সের সংগ্রহ একজায়গায়
করতেন, গোছাতেন আর তারপর একটু একটু করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতেন। একটা চিঠিতে এঙ্গেলস
উল্লেখ করেন যে দুই ঘনমিটার জায়গায় তো শুধু রুশীয় পরিসংখ্যানের বার্ষিকী, যেগুলো মার্ক্স
‘পূঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ড, ‘পূঁজির প্রচলন’এর জন্য জোগাড় করেছিলেন। সে বাদে ছিল শ্রমিক
আন্দোলন সম্পর্কিত দলিল। …
এঙ্গেলসও এখন আর
আগের মত সুস্থ থাকছিলেন না। মাঝে মাঝে কোথাও সমুদ্রের তীরে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে আসতেন।
প্রায়ই সঙ্গে থাকত পাম্পস, তার স্বামী, বাচ্চারা। থাকতেন রসায়নবিদ বন্ধু স্কোর্লেমার
এবং অন্য কোনো বন্ধু। এদিকে যবে থেকে ইলিয়ানর নিজের আলাদা বাসস্থান করে নিয়েছিলেন,
হেলেন ডেমুথ এঙ্গেলসের বাড়িতে চলে এসেছিলেন। এসে বাড়ির দায়িত্ব তো নিজের কাঁধে নিলেনই,
এতদিনকার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী হওয়ার দরুন এঙ্গেলসের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক
বিশ্বাসপাত্র হয়ে উঠলেন। হেলেনের (বা ‘লেঞ্চেন’এর, কখনও ‘নিম’এর) আসাতে এঙ্গেলস পরিত্রাণ পেলেন, নইলে পাম্পসের পরিবারের ঝুটঝামেলায়
তাঁর হয়রানি হত রোজকার।
মার্ক্সের সংগ্রহের
কিছু কিছু বই ইলিয়ানর নিয়ে গেলেন, কিছু লরা পেলেন (তাঁর দরকার ছিল ‘আন্তর্জাতিক’ সংক্রান্ত দলিলগুলো) আর বাকি বই জার্মানিতে
সামাজিক-গণতন্ত্রীদের গ্রন্থালয়গুলোতে দিয়ে দেওয়া হল। সব কাগজপত্রের ব্যবস্থা হওয়ার
পর ২৪শে মার্চ ১৮৮৪তে বাড়ি খালি করে বাড়ির মালিককে চাবি দিয়ে দেওয়া হল।
মার্ক্স রচিত ‘দর্শনের দারিদ্র্য’ প্রুধোঁর ‘দারিদ্র্যের দর্শন’এর জবাব ছিল এবং ফরাসি ভাষাতেই লেখা হয়েছিল। প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৭এ।
পঁয়ত্রিশ বছর পর জার্মান ভাষায় বইটার অনুবাদ করার কথা ভাবলেন এডোয়ার্ড বার্নস্টাইন।
পরে কার্ল কাউটস্কিও সঙ্গে চলে এলেন। এঙ্গেলস তাঁদের দুজনকে অভিনন্দন জানালেন এবং বছরের
শেষে (১৮৮৩) অনুবাদটা সম্পাদিত করলেন। ১৮৪৭এ প্রকাশিত ফরাসি সংস্করণের পৃষ্ঠায় মার্ক্স-কৃত
সংশোধন অনুসরণ করে জার্মান অনুবাদে টীকা যোগ করলেন এবং একটি মুখবন্ধ লিখলেন। সে মুখবন্ধে
কোনো এক ব্যক্তিকে সমুচিত জবাব দিলেন যে মার্ক্সকে নিয়ে কুৎসা রটাচ্ছিল। হয়তো বার্নস্টাইন
বলে থাকবেন তা নিয়ে কিছু কথা। এঙ্গেলস তাঁকে লিখলেন, “যেমন আগে একবার কাউটস্কিকে বলেছি, আমরা মার্ক্সের
নকল তো করতে পারব না কিন্তু আমাদের ধরণ মার্ক্সের থেকে একেবারে আলাদাও হতে পারে না।
এ কথাটা যদি সব সময় মাথায় রাখো তাহলেই বোধহয় আমরা এমন কিছু কাজ করতে পারব যা পাঠকের
পাতে দেওয়ার যোগ্য।”
এঙ্গেলস নিজেকে কথা
দিয়েছিলেন যে তিনি মার্ক্সের এমন জীবনী লিখবেন যেটা ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’ এবং ১৮৪৮ সালে রাইনের নিম্নাঞ্চলের সংগ্রামের
ইতিহাস হবে। তেমন একটি প্রবন্ধ আমরা পাই ১৮৮৪র মার্চে। এই প্রবন্ধে খবরের কাগজের সম্পাদক
রূপে মার্ক্সের অসাধারণ ক্ষমতা এবং দক্ষতার পাশাপাশি খবরের কাগজটির প্রভূত জনপ্রিয়তা
এবং শাসকশ্রেণীর ভিতরে বাড়তে থাকা ভীতি নিয়ে আলোচনা আছে। একই সঙ্গে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে এই খবরের কাগজের মাধ্যমে
জার্মান বিপ্লবে সর্বহারার কর্মসূচি জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হল।
এঙ্গেলস বলতেন, মার্ক্সের
তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক বিপ্লবী কাজকর্মগুলোকে প্রচারে নিয়ে আসা একটি গুরুত্বপূর্ণ
কাজ। তিনি নিজেও ভেবেছিলেন এই কাজকর্মগুলোকে প্রধান উপজীব্য করে তিনি একটি বড় জীবনী
লিখবেন। ভেবেছিলেন, সেই জীবনীতে তিনি মার্ক্সের লেখা চিঠি এবং অন্যান্য সামগ্রীও কাজে
আনবেন। ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর ইতিহাস বাদেও তাতে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’র সময়কালেরও বিস্তৃত ইতিবৃত্ত থাকবে। ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’ গঠনে মার্ক্স-কৃত কাজকে তিনি এতোটাই গুরুত্ব
দিতেন যে একটি চিঠিতে লেখেন, “ ‘আন্তর্জাতিক’ ছাড়া মার্ক্সের জীবন হীরের সেই আংটির মত হবে যার হীরেটাই খুলে নেওয়া
হয়েছে।” কিন্তু সমগ্রতায়
তেমন একটি জীবনী লেখার সুযোগ তিনি পান নি। তিন বার মার্ক্সের জীবনী লেখেন – ১৮৬৯এ, ১৮৭৭এ আর ১৮৯২এ। জীবনের এই বর্ণনা
এবং মূল্যায়নে ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’ পর্বের গুরুত্ব যোগ করার জন্য তিনি আলাদা করে
একটি প্রবন্ধ লেখেন যার উল্লেখ রয়েছে আগের প্যারায়। কিন্তু ‘আন্তর্জাতিক’এ মার্ক্সের ভূমিকা নিয়ে, ১৮৭৭ আর ১৮৯২এ লেখা
জীবনীতে যেটুকু আছে সে-ছাড়া আলাদা করে বিস্তৃত ইতিবৃত্তে তিনি যেতে পারেন নি।
১৮৮৪তে এঙ্গেলস পুরোপুরি
একটাই চিন্তায় ডুবে ছিলেন যে ‘পূঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ডের
কাজে কিভাবে এগোবেন। পাণ্ডুলিপি পড়তে পড়তে তাঁর এমনটাও মনে হচ্ছিল যে মার্ক্সের পরিকল্পনা
অনুসারে দ্বিতীয় খণ্ডে দুটো বইকে ঢোকানো সম্ভবপর হবে না, তৃতীয় খণ্ড লাগবে। আর মার্ক্সের
পরিকল্পনায় যে অংশটা তৃতীয় খণ্ড হওয়ার ছিল – ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের
সিদ্ধান্তসমূহ’ – সেটাকে চতুর্থ খণ্ড করতে হবে।
কিন্তু এ সমস্ত ভাবনাচিন্তার
মধ্যেই তাঁর হাতে এল মার্ক্সের বাড়ি থেকে আনা কাগজপত্রগুলোয় একটা ‘সারসংগ্রহ’ (কন্সপেক্টাস), যাতে কোনো একটা বই থেকে বেশ বড় বড় উদ্ধৃতি তুলে
তার পাশে মন্তব্য লেখা ছিল। সারসংগ্রহটা ১৮৮০-৮১ সালের। উদ্ধৃত বইটার নাম ‘প্রাচীন সমাজ, অথবা বন্যজীবন থেকে বর্বরজীবন
হয়ে সভ্যতা পর্য্যন্ত মানবপ্রগতিধারা নিয়ে গবেষণা’ (এন্সিয়েন্ট সোসাইটি, রিসার্চেজ ইন দ্য লাইন্স অফ হিউম্যান প্রগ্রেস
ফ্রম স্যাভেজারি থ্রু বার্বারিজম টু সিভিলাইজেশন)। ১৮৭৭এ লন্ডন থেকে প্রকাশিত এই বইয়ের
লেখক মার্কিন বৈজ্ঞানিক লুই হেনরি মর্গান।
১৮৮৪র ১৬ই ফেব্রুয়ারি
এঙ্গেলস কাউটস্কির সঙ্গে চিঠিতে বিভিন্ন করণীয় কাজ সম্পর্কে আলোচনা করতে করতে শেষে
লিখেছিলেন, “সমাজের আদিম অবস্থা
নিয়ে একটি নির্ণায়ক বই আছে – ততটাই নির্ণায়ক যতটা জীবতত্ত্বের ক্ষেত্রে ডারউইনের ছিল – এবং আবারও, মার্ক্সই সে বইটা আবিষ্কার করেছিল।
মর্গানের ‘প্রাচীন সমাজ’ ১৮৭৭। মার্ক্স বলেছিল আমায় বইটার কথা। কিন্তু
আমার মাথায় সেসময় ভরা ছিল অন্যান্য ব্যাপার। দ্বিতীয়বার আর বলেও নি। তার পক্ষে নিঃসন্দেহে
সেটাই স্বাভাবিক কেননা, সে নিজেই জার্মান পাঠকদের সঙ্গে সে বইটার পরিচয় ঘটাতে চাইছিল।
উদ্ধৃতির সামগ্রিকতায় সে-ইচ্ছেটা দেখতে পাই। তাঁর বিষয়ের সীমায়, মর্গান নিজের জন্য
মার্ক্সের বস্তুবাদী ঐতিহাসিক দৃষ্টির পুনরাবিষ্কার করেন, এবং এমন সব নিষ্পত্তি করেন
যা আধুনিক সমাজের জন্য, একেবারে সাম্যবাদী সত্যানুমান। … যদি আমার সময় থাকত, বইটার ওপর, মার্ক্সের
নোটগুলো সঙ্গে নিয়ে আমি ‘সোশ্যেলডেমোক্র্যাট’ বা ‘ন্যু জেইট’এর হাল্কা লেখার কলামের জন্য সামগ্রী তৈরি করতাম, কিন্তু সেসব এখন
আর ভাবারও প্রশ্ন ওঠে না। … এই ভদ্রসম্প্রদায়গুলো
বইটাকে এদেশে দাবিয়ে রাখার সব রকম চেষ্টা করছে। বইটা আমেরিকায় ছাপানো, আর যদিও নামপত্রে
যুগ্ম-প্রকাশক হিসেবে লন্ডনের একটি সংস্থার নাম দেওয়া আছে, পাঁচ সপ্তাহ আগে বইটা পাঠাবার
ফরমাশ করা সত্ত্বেও এখনো পাই নি।”
কিন্তু মনে হয় কাউটস্কি
আবদার করে থাকবেন। কেননা এধরণের প্রশ্নে তাঁর কৌতূহল ছিল। আগেও তিনি বিবাহের প্রকার,
ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে এঙ্গেলসের অভিমত জানতে চেয়েছিলেন। তাই ২৪শে মার্চ এঙ্গেলস কাউটস্কিকে
লিখলেন, “সময় পেলে কিছু করব
বিষয়টা নিয়ে, তোমার ‘ন্যু জেইট’এর জন্য। কিন্তু একটা শর্ত, তোমায় সে লেখাটা
পরে বই করে ছাপতে রাজি হতে হবে। … আসলে কাজটার জন্য আমি মার্ক্সের কাছে ঋণী, আর” [সেই সুবাদে] “আমি মার্ক্সের মন্তব্যগুলো বইয়ের অন্তর্ভুক্ত
করতে পারব।”
মার্ক্সের যাবতীয়
রচনাকে বিশ্বের সামনে আনাই এঙ্গেলসের বাকি জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর মর্গানের
বইয়ের ওপর মার্ক্সের সারসংগ্রহে করা মন্তব্যগুলো তাহলেই প্রকাশিত হতে পারত যদি তিনি
সেই বইটা লিখতেন যেটা মার্ক্স লিখতে পারলেন না। শুধু এই কারণেই এঙ্গেলস বইটা লিখলেন
আর আজ, সারা বিশ্বের জাতিতত্ত্ববিদেরা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক মানববিজ্ঞানের ক্ষেত্রকর্মীরা,
সে আফ্রিকায় কাজ করুক অথবা তামিলনাডুর নীলগিরিতে, বইটাকে সূত্র-গ্রন্থ রূপে ব্যবহার
করে। সে পথপ্রদর্শক হিসেবে করুক বা ‘ভূল প্রমাণ করার’ জন্য করুক। ১৮৮৪র এপ্রিলের শুরু থেকে মে মাসের শেষ অব্দি লেখা হল
‘পরিবার, ব্যক্তিগত
সম্পত্তি এবং রাষ্ট্রের উৎপত্তি’।
বইটা মর্গানের বইএর
ওপর মার্ক্সের মন্তব্যের সংগ্রহ করলে কোনো উদ্দেশ্য সাধিত হত না। বই তো একটা অস্ত্র।
মার্ক্স থাকলে তিনিই সে বইটা লিখতেন। সারসংগ্রহ দেখে এঙ্গেলসের মনেও হল যে মার্ক্স,
মানবসমাজের প্রারম্ভিক বিকাশের ইতিহাসের ওপর নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি গ্রন্থ
রচনা করতে চেয়েছিলেন। কেননা মর্গান ছাড়াও সে সারসংগ্রহে অন্যান্য বিদ্বানদের, জাতিতত্ত্ববিদ
ও মানব-বিজ্ঞানীদের রচনা থেকে উদ্ধৃতি ছিল, সে উদ্ধৃতির পাশে মার্ক্সের মন্তব্য ছিল।
তাই এঙ্গেলসও সেটাই করলেন। ভিত্তিস্বরূপ মর্গানের বইটা তো ছিলই। পাশাপাশি প্রাচীন ইতিহাসের
ওপর তৎকালীন অন্যান্য বই, প্রবন্ধ এবং বিভিন্ন সামগ্রী ব্যবহার করে বইটা লিখলেন। মার্ক্সের
প্রায় প্রতিটি মন্তব্য যেমন ছিল তেমন ভাবেই মার্ক্সের নামে অন্তর্ভুক্ত করলেন। এটাও
দেখালেন যে মার্ক্স-কৃত সারসংগ্রহের কাঠামো মর্গানের বইয়ের থেকে ভিন্ন কেন। (১৯৪১এ
সোভিয়েত সঙ্ঘ মার্ক্সের সারসংগ্রহের রুশীয় অনুবাদ প্রকাশ করে; ১৯৭২ সেটির মূল ইংরেজি
সংস্করণ প্রকাশিত হয় – ‘দ্য এথনোলজিকাল নোটবুক্স অফ কার্ল মার্ক্স’)।
‘আধুনিক সর্বহারার সেরা যোদ্ধা
এবং শিক্ষক’
‘পূঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ডের সম্পাদনা
১৮৮৪র এপ্রিল-মে
দুমাস ‘পরিবার, ব্যক্তিগত
সম্পত্তি এবং রাষ্ট্রের উৎপত্তি’তে লেগে গেল। কিন্তু ‘পূঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ডের
সম্পাদনা বড় কাজ। একটু আগে কার্ল কাউটস্কিকে লেখা ১৬ই ফেব্রুয়ারির চিঠি উদ্ধৃত করা
হয়েছে। তার কুড়ি দিন আগে, ২৮শে জানুয়ারি পেয়োত্র লাভরভকে এঙ্গেলস লিখেছিলেন, “শেষ পর্য্যন্ত, দ্বিতীয় খণ্ডের জন্য দিনের
আলো দেখতে পাচ্ছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর জন্য, অর্থাৎ, দ্বিতীয় গ্রন্থ” [দ্বিতীয় খণ্ডের মূলকথ্য] “‘পূঁজির প্রচলন’এর শুরু আর শেষের জন্য আমাদের কাছে ১৮৭৫ সাল
এবং তারপরের একটা পাঠ আছে। শুধু সংকেত অনুসারে উদ্ধৃতিগুলো ছাড়া এতে কোনো কিছু যোগ
করতে হবে না। মাঝের ভাগের জন্য ১৮৭০এর আগে থেকে তৈরি হতে থাকা অন্ততঃ চারটে পাঠ আছে,
আর সেখানেই একমাত্র অসুবিধা। তৃতীয় খণ্ড, ‘সমগ্রতায় পূঁজিবাদী উৎপাদন’ ১৮৬৯ আগে থেকে তৈরি হতে থাকা দুটো পাঠে আছে। তারপর আর কিছু নেই,
কয়েকটি নোট আর সমীকরণে ভরা একটা নোটবই। সেটার উদ্দেশ্য, উদ্বৃত্ত মূল্যের দর কেন মুনাফার
দর হয়ে যায় তার বিভিন্ন কারণে পৌঁছোন। কিন্তু রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে লেখা নানান
বই থেকে নেওয়া উদ্ধৃতিগুলোয় জমি-ভাড়ার ওপর প্রভূত সামগ্রী আর অঢেল নোট আছে। বাকিগুলো
পয়সা-পূঁজি, ঋণ, ঋণের দলিল হিসেবে কাগুজে পয়সা ইত্যাদি সম্পর্কিত। এখনো অব্দি আমি জানি
না তৃতীয় গ্রন্থে এগুলো আমি কিভাবে ব্যবহার করব। মনে হয় এগুলোকে আলাদা একটা প্রকাশনে
একসঙ্গে করা যেতে পারে। আর ‘পূঁজি’তে অন্তর্ভুক্ত করা
খুব কঠিন হলে আমি নিশ্চিত সেটাই করব। আমার সবচেয়ে বড় চিন্তা হল বইটা যেন যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি
বা’র হয়, আর যে বইটা
আমি প্রকাশ করব সেটা যেন সন্দেহাতীত ভাবে মার্ক্সের বই হয়।”
বন্ধুত্ব এঙ্গেলসের
জন্য একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা ছিল। তাঁর কাছে ‘পূঁজি’র খন্ডগুলোর প্রকাশনা
এ কারণেও জরুরি ছিল কেননা তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, অর্থশাস্ত্র এমন একটি বিজ্ঞান হয়ে
দাঁড়িয়েছে যাতে ধোঁয়াশার কারবার সবচেয়ে বেশি। ১৩ই আগস্টে তিনি জর্জ হাইনরিখ ভন ভোলমার
নামে এক ব্যক্তিকে লেখেন, “আজ কোনো বিজ্ঞানে
এত ঢিলেঢালা ভাবে কাজ হয় না, যত অর্থশাস্ত্রে হয়, আর বিশ্বের যাবতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের
হাল এক। … ইংল্যান্ড আর আমেরিকায়,
ফ্রান্স আর জার্মানিরই মত, সর্বহারা আন্দোলনের চাপে পূঁজিবাদী অর্থশাস্ত্রীরা সবাই
নিজেদের ওপর ‘আরামকেদারা-সমাজতন্ত্রী’ এবং ‘মানবকল্যাণবাদী’র রঙ চড়িয়ে নিয়েছে; কোনো ব্যতিক্রম নেই। এক তরফে চতুর্দিকে সমালোচনাশূন্য,
দয়াবান পল্লবগ্রাহিতা, অন্য তরফে নরম, নমনীয়, আঠালো এক পদার্থ যাকে যেকোনো রকম আকৃতি
দেওয়া যায়, আর সেকারণেই ঐ পদার্থ থেকে কেরিয়ারপন্থীদের সংস্কৃতির জন্য একটি উৎকৃষ্ট
তরল চুঁইতে থাকে। ঠিক যেমন ব্যাক্টিরিয়া কালচারের জন্য চুঁইতে থাকে বাস্তবিক জেলাটিন
থেকে।” এর পর এঙ্গেলস একথাও
লেখেন যে মেধাগত ক্ষয়ের এই প্রবৃত্তি এখন সামাজিক-জনবাদী দলগুলোর প্রান্তের দিকে থাকা
লোকগুলোকেও ধরতে শুরু করেছে।
তাই ‘পূঁজি’র খন্ডগুলোর প্রকাশনা কোনো পরিস্থিতিতেই থামতে পাবে না – এঙ্গেলসের শরীর অকেজো হয়ে পড়লেও নয়।
কেমন ছিল তাঁর শরীরের
অবস্থা? ১৮৮৪র ১১ই অক্টোবর তিনি অগাস্ট বেবেলকে লেখেন, “জুনের শুরু থেকে আমি লেখার টেবিলে বসতে পারছি।
একটু ব্যথা হয়; ডাক্তারের আদেশ অমান্য করতে হয়। গত প্রায় ১৮ মাস ধরে একটা অদ্ভুত অসুখে
আমার চলাফেরা কম হয়ে গেছে। এই অসুখ দেখে ডাক্তাররাও হতবাক। আমার প্রতিদিনের জীবনের
পুরোনো ঢঙগুলো, যাতে প্রচুর চলাফেরা ছিল, পুরোপুরি ছাড়তে হয়েছে। অসুখটা লিখতেও বাধা
দিচ্ছে। ব্যস, এই দশ দিন ধরে, যান্ত্রিক উপকরণের সাহায্যে একটু স্বাধীনভাবে আমি চলাফেরা
করতে পারছি। ভরসা আছে যে এই উপকরণগুলো অভ্যাসে এসে গেলে মোটামুটি পুরোনো জীবনযাপনে
ফিরতে পারব। … সে যাহোক, লিখতে
না পারলেও, বলে তো লেখাতে পারছিলাম অন্ততঃ … ‘পূঁজি’র দ্বিতীয় গ্রন্থটা পুরোপুরি, পাণ্ডুলিপি পড়ে
আমি লেখালাম
আর যথার্থে মুদ্রণের
জন্য তৈরি করে দিলাম। পাশাপাশি” [প্রথম খণ্ডের] “ইংরেজি অনুবাদেরও আটের-তিন ভাগ পরিমার্জন করে নিয়েছি। আরো অনেক কিছু
পড়েছি, মানে ভালোরকম কাজ করেছি এই সময়টায়।”
কতটা অন্তরঙ্গতা,
কতটা স্নেহ নিয়ে তিনি ‘পূঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ডের সম্পাদনা করছিলেন তার প্রমাণ
খোদ তাঁর লেখা ভূমিকার [প্রথম জার্মান সংস্করণ ১৮৮৫] ভাষা।
১৮৮৪তেই ১৫ই অক্টোবর
এঙ্গেলস যোহান ফিলিপ বেকারকে লিখছেন, “আমার দুর্ভাগ্য যে যবে থেকে আমরা মার্ক্সকে হারিয়েছি, আমাকে তার
প্রতিনিধিত্ব করতে হচ্ছে। সারা জীবন আমি সেই ভূমিকায় কাটিয়ে দিলাম যেটার যোগ্য ছিলাম,
বলতে পারো সহবাদক। আর আমি অবশ্যই বিশ্বাস করি যে নিজের কাজ আমি ভালো করে করেছি। খুব
খুশি ছিলাম যে মার্ক্সের মত প্রধান বাদকের সঙ্গে আছি। কিন্তু এখন, যখন আশা করা হচ্ছে
যে তত্ত্বের ব্যাপারে আমি মার্ক্সের জায়গা নেব আর প্রধান বাদক হব, নিশ্চয়ই বড়-সড় বিচ্যুতি
হবে আর এ ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশি সচেতন আর কেউ নয়। আর, সময় একটু অশান্ত না হওয়া পর্য্যন্ত
আমরা বুঝতেও পারবো না মার্ক্সের মৃত্যুতে আমরা কী হারিয়েছি। আমাদের কারোর দৃষ্টিতে
সেই বিশালতা নেই যার দরুন, ঠিক সেসময় যখন তৎক্ষণাৎ সক্রিয় হওয়ার ডাক আসত, সে ঘটনাসমূহের
মূলে পৌঁছে যেত আর অভ্রান্তভাবে সঠিক সমাধান সামনে রাখত। বেশি শান্তিপূর্ণ সময়ে হতে
পারত যে ঘটনাবলী আমায় সঠিক আর তাকে ভুল প্রমাণিত করে দিল, কিন্তু বিপ্লবের মুহূর্তে
তার নিষ্পত্তি যথার্থই অব্যর্থ হত।
‘আধুনিক সর্বহারার সেরা যোদ্ধা এবং শিক্ষক’
কথাটা লেনিনের। মার্ক্স
যতদিন বেঁচেছিলেন, দুজনে একসাথে থাকতেন যুদ্ধে, সে মতাদর্শগত হোক, রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক।
মার্ক্সের মৃত্যুর পর এঙ্গেলসকে একাই হয়ে উঠতে হল ইয়োরোপীয় সমাজবাদীদের পরামর্শদাতা
এবং নেতা। সবাই আসতেন তাঁর কাছে। সরকারের সবরকম উৎপীড়ন সত্ত্বেও জার্মানিতে সমাজবাদীদের
শক্তি বেড়ে উঠছিল। তাদের প্রতিনিধিস্থানীয় নেতারা যেমন আসতেন এঙ্গেলসের বাড়িতে, তেমনই
আসতেন রাশিয়া, স্পেন, ইটালি, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের সমাজবাদীরা। লন্ডনে এঙ্গেলসের বাড়িটা
এখন তাদের সবার জন্য জ্ঞান, তথ্য, পরামর্শ, পথনির্দেশ এবং বিপ্লবী প্রাণশক্তির আঁচ
নিয়ে যাওয়ার ঠিকানা হয়ে উঠেছিল।
অসুস্থ থাকতেন তবু
ঝুঁকে চলতেন না। ছ’ফুটের শরীর একেবারে
অসম্ভব হয়ে যাওয়া অব্দি সোজা রেখেছিলেন। শরীরের নানা রকম কষ্ট সত্ত্বেও আমুদে মেজাজটাই
লোকে দেখতে পেত। কত মানুষ আসত তাঁর কাছে! অনেকে তাঁর বাড়িতেই থেকে যেত। যাদের লন্ডনে
বা অন্য কোথাও থাকার জায়গা থাকত, তারা সেখানে ঝোলাঝুলি রেখে দেখা করতে চলে আসত। সেছাড়া,
মাঝেমধ্যেই এসে থাকার জন্য রসায়নবিদ বন্ধু স্কোর্লেমার তো ছিলেনই। প্রায়ই চলে আসত পাম্পস,
তার স্বামী পার্সি (রোশার), তাদের বাচ্চারা। কখনো সখনো আসতেন লরা এবং পল লাফার্গ, ইলিয়ানর
এবং এডোয়ার্ড এভেলিং, শার্ল লঙ্গোয়ে। হেলেন ডেমুথ এবং এঙ্গেলস সবার উষ্ণ আতিথ্যের ব্যবস্থা
করতেন। সাহায্যও করতেন নিয়মিত। মনে করে করে অনেক সাথীকে কিছু কিছু পয়সা পাঠাতেন, যখন
যেমন সম্ভব।
তারপর চিঠি! প্রচুর
চিঠি লিখতেন। জার্মানি, ফ্রান্স, রুস, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র
আমেরিকা, হল্যান্ড, সুইটজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, রুমানিয়া বাদে লন্ডনের বাইরে ইংল্যান্ডের
নানান শহর থেকে চিঠি আসত তাঁর কাছে। প্রত্যেকের প্রশ্নের যতটা পারেন, পুরো জবাব দিতেন।
পরামর্শ দিতেন। সে যেন নিজেকে দূরের কেউ মনে না করে তাই নিজের কাজের বিষয়েও তাকে লিখতেন।
সকালে খবরের কাগজ
আসত। একটা বা দুটো নয়, অনেকগুলো। বিভিন্ন ভাষায়, আর তিনি সবকয়টি খবরের কাগজ পড়তেন।
অতিথিদের আপন করার জন্য তাদের সঙ্গে কথা বলতেন তাদের ভাষায় – জার্মানের সঙ্গে জার্মান, ফরাসির সঙ্গে ফরাসি,
রুশীয়র সঙ্গে রুশীয়, ইতালীয়র সঙ্গে ইতালীয়, পর্তুগালির সঙ্গে পর্তুগালি, পোল্যান্ডবাসীর
সঙ্গে পোলিশ, স্পেনীয়র সঙ্গে স্পেনীয়, রুমানীয়র সঙ্গে রুমানীয়, ইংরেজের সঙ্গে ইংরেজি
– কোনো এশীয় অতিথির
নাম পাওয়া যায় না, নইলে তুর্কি তো জানতেনই তিনি। এডোয়ার্ড এভেলিং তাঁর ভাষাজ্ঞানের
কথা বলতে গিয়ে ঠাট্টা করে বলেন, “আর এই তুচ্ছ কথাটা বলার কি কোনো প্রয়োজন আছে যে গ্রীক আর ল্যাটিন
তো তিনি জানতেনই!”
এঙ্গেলসের সঙ্গে
পত্রালাপে থাকতেন পাস্কেল মার্তিনেত্তি। তাঁর একটি চিঠির জবাবে এঙ্গেলস ১৮৮৩র ২২শে
আগস্ট লিখছেন, “ভাষা শেখার জন্য
এভাবে এগোই – সে-ভাষার সবচেয়ে
কঠিন ক্লাসিক লেখক হিসেবে যাঁকে পাই, সঙ্গে অভিধান রেখে তাঁকে পড়তে শুরু করে দিই। বিভক্তিরূপ,
ধাতুরূপ আর সর্বনাম ছাড়া ব্যাকরণ বোঝার পরোয়া করি না। এভাবে, ইতালীয় আমি দান্তে, পেত্রার্ক
আর আরিয়োস্তো দিয়ে শুরু করেছিলাম, স্পেনীয়, সের্ভান্তেস আর ক্যাল্ডেরনকে দিয়ে, রুশীয়,
পুশকিনকে দিয়ে। তারপর সেভাষার খবরের কাগজ ইত্যাদি পড়ি।”
রাশিয়ার নারোদনিক
বিপ্লবী লেখিকা ভেরা জাসুলিচ তখন থেকেই দুজনের রুশীয় সাথী যখন মার্ক্স বেঁচেছিলেন।
দেখা করতেও আসতেন এবং নিয়মিত চিঠিও লিখতেন। এডোয়ার্ড এভেলিং নিজের স্মৃতিচর্চায়, এঙ্গেলসের
সঙ্গে দেখা করতে আসা বা পত্রালাপে থাকা সাথীদের ওপর এঙ্গেলসের তাত্ত্বিক এবং নৈতিক
প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে ভেরা জাসুলিচের নাম নেন। ভেরা জাসুলিচ বলতেন যে কোনো খারাপ
কথা মুখে এলে বা খারাপ কাজ মাথায় এলে তাঁরা শুধু একটা কথা ভেবে থেমে যেতেন যে ‘জেনেরাল’ কী ভাববেন!
দিনের বেলায় লেখাপড়ার
কাজ নিয়েই থাকতেন বেশিক্ষণ। রাতে চোখ কাজ করত না। আর দিনের কাজে, লেখা বা সম্পাদনা
ছাড়াও একটা বড় কাজ ছিল সাংগঠনিক নজরদারি। বিভিন্ন নেতা বা কর্মীদের মাধ্যমে পুরো ইয়োরোপ
এবং আমেরিকার সর্বহারা আন্দোলন এবং সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে হাল সময় অব্দিকার
খবর রাখতেন।
উনিশ শতকের আশির
দশক থেকে পূঁজিবাদী উৎপাদনে নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা দিতে শুরু করেছিল। এঙ্গেলস ব্যাপারটা
লক্ষ্য করেছিলেন। আগে প্রত্যেক দশ বছরে অতি-উৎপাদনের সংকট আসত, উৎপাদক শক্তির ধ্বংস
হত, তারপর আবার শুরু হত উৎপাদন। এখন পূঁজিপতিরা, সংকটগুলো উপনিবেশের দিকে ঠেলে দিতে
সক্ষম হয়ে গিয়েছিল। ফলে আশঙ্কা বেড়ে গিয়েছিল যে আগামী সংকট আরো অনেক বড় এবং বিশ্বব্যাপী
হবে। পূঁজিবাদী শিল্প তীব্র গতিতে বিকশিত হচ্ছিল। নতুন নতুন আবিষ্কার, উৎপাদনের উপকরণগুলোকে
আরো বেশি শোষণে সক্ষম করে তুলছিল। ইয়োরোপীয় দেশগুলো নিজেদের মধ্যে, অন্যান্য মহাদেশে
বাড়তে থাকা তাদের ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতার শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজছিল।
আসলে ‘প্যারি কমিউন’এর পর থেকেই, বড় বড় দেশের সরকারগুলো পারস্পরিক
উত্তেজনা কম করার চেষ্টায় রত থাকত যাতে একসঙ্গে মিলেমিশে শ্রমিক আন্দোলন এবং সমাজবাদী
কার্যকলাপ দমন করা যায়। রাশিয়া ইংল্যান্ডের বন্ধুত্ব চাইছিল যাতে রুশীয় রাজনৈতিক অভিবাসীরা
ইংল্যান্ডে আশ্রয় না পায়। ইংল্যান্ড আমেরিকার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াচ্ছিল যাতে আইরিশ
বিপ্লবীদের আমেরিকা থেকে বার করে ইংল্যান্ড পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জার্মানি তো নিজের দেশেই
সমাজবাদী-বিরোধী আইন বলবৎ করে রেখেছিল আর এমন কিছু চুক্তির অপেক্ষা করছিল যাতে ইংল্যান্ড,
সুইটজারল্যান্ড, আমেরিকা ইত্যাদি থেকে জার্মান রাজনৈতিক অভিবাসীদের ফেরত আনিয়ে জেলে
পোরা যেতে পারে। ফরাসি রাজনৈতিক অভিবাসীরা, বিশেষ করে ‘কমিউন’এর বেঁচে থাকা যোদ্ধারা, ১৮৭৯এর সরকারি সিদ্ধান্তের পর ফ্রান্সে
ফিরে গিয়েছিলেন (যেমন খোদ মার্ক্সের জামাই শার্ল লঙ্গোয়ে), কিন্তু ‘কমিউন’এর পরাজয়ের ফলে সেখানে প্রতিক্রিয়ার শক্তি বেড়েছিল।
এক দিকে আর্থিক উন্নয়নের
পাশাপাশি পূঁজিবাদীদের রাজনৈতিক জয়, সর্বহারা আন্দোলনকে দমন করার জন্য প্রতিক্রিয়ার
সঙ্গে চুক্তি আর অন্য দিকে এই কঠিন পরিস্থিতিতেও পুরো ইয়োরোপ এবং আমেরিকায় শ্রমিক আন্দোলন
আর সমাজবাদী রাজনৈতিক কার্যকলাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ, মার্ক্সবাদেরও চ্যালেঞ্জ
ছিল। ফলে, যদি মার্ক্স জীবিত থাকতেন তাহলে সেটা বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের ঐ দুই প্রণেতার
ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠত। কিন্তু মার্ক্স আর নেই। একা এঙ্গেলস ঐ চ্যালেঞ্জগুলোর
মুখোমুখি হচ্ছিলেন।
১৮৮৫ সালে ফ্রান্সে
নির্বাচন হল। সে বছরই এক মাস পর ব্রিটেনে নির্বাচন হল। জার্মানিতে নির্বাচন হল ১৮৮৭তে।
সে বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও নির্বাচন হল। এই সব নির্বাচনে মার্ক্সবাদী দৃষ্টি থেকে,
সমাজবাদীদের কার্যকৌশল কী হওয়া উচিৎ, উদারপন্থী বা পূঁজিবাদী র্যাডিক্যাল বা পাতি-পূঁজিবাদীদের
সঙ্গে চুক্তির কোনো সম্ভাবনা হতে পারে কিনা, হলে তার শর্তগুলো কী হবে এই সমস্ত ব্যাপার
এঙ্গেলসের চিন্তায় থাকত এবং চিঠিতে সেসব দেশের পরিস্থিতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে
তিনি সাথীদের বাস্তব পরামর্শ দিতেন। সেভাবেই, রুশীয় জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামাজিক-গণতন্ত্রীদের
কিভাবে এগোনো উচিৎ, ইতালির রাজতন্ত্রে কাজ করা সমাজবাদীদের কী করা উচিৎ, স্পেন বা বেলজিয়াম
বা হাঙ্গেরি … পুরো ইয়োরোপ এবং
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজবাদীদের পথপ্রদর্শন করাকে তিনি ‘আন্তর্জাতিক’এর এক সৈনিকের মত নিজের দায়িত্ব মনে করতেন।
১৮৯৪এ যখন ‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হল তার ভূমিকায়, প্রকাশনে
বিলম্বের কারণ হিসেবে বললেন, “সাহিত্যে অগ্রগতি” [মার্ক্সবাদী সাহিত্য] “একই সঙ্গে খোদ আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনে হতে থাকা অগ্রগতির সংকেতমাত্র
ছিল। আর সে অগ্রগতি আমার ওপর নতুন কর্মভার এনে ফেলল। আমাদের গণ-সক্রিয়তার প্রথম দিন
থেকেই বিভিন্ন দেশের সমাজবাদী এবং শ্রমিকদের জাতীয় আন্দোলনগুলোর মধ্যেকার সম্পর্ক-সূত্র
হয়ে থাকার কাজের প্রধান দায়িত্ব মার্ক্স এবং আমার কাঁধে ছিল। যে অনুপাতে আন্দোলন ছড়ালো,
সেই অনুপাতে কাজটাও ছড়ালো। মৃত্যু পর্য্যন্ত মার্ক্সও এ কাজে ব্যাপৃত থাকতেন। কিন্তু
তাঁর মৃত্যুর পর, ক্রমশঃ বাড়তে থাকা কাজটা আমাকেই করতে হত। বিভিন্ন জাতীয় শ্রমিক দলগুলোর
জন্য, একে অন্যের সঙ্গে সোজাসুজি সম্পর্কে থাকা এখন নিয়ম হয়ে গেছে। তবুও, আমার তাত্ত্বিক
কাজগুলোর কথা মাথায় রেখে যেটুকু আমি চাই তার চেয়ে অনেক বেশি অনুরোধ এখনো আমার সাহায্য
চেয়ে আসতে থাকে। আমার মত মানুষ, যে গত পঞ্চাশ বছর ধরে আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছে, আন্দোলন-সম্পর্কিত
কাজকে নিজের বিবেকের কর্তব্য মনে করে, যাতে দেরি করা চলে না। আমাদের এই ঘটনাবহুল
সময়ে, ঠিক ১৬ শতকের মতই, সামাজিক বিষয়ে বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক শুধু প্রতিক্রিয়ার দিকেই
দৃষ্ট হন, আর সেইজন্যেই, সেই ভদ্রলোকেরা সঠিক অর্থে তাত্ত্বিকও হন না, নিছক প্রতিক্রিয়ার
রক্ষক হন।
“যেহেতু আমি লন্ডনে থাকি, শীতকালে পার্টিগুলোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক
শুধু চিঠিপত্রে সীমিত থাকে। গ্রীষ্মকালে সে সম্পর্কগুলো বেশির ভাগই ব্যক্তিগত হয়। পাশাপাশি,
সংখ্যাগত ভাবে অনবরত বাড়তে থাকা দেশসমূহের আন্দোলন এবং তার চেয়েও বেশি গতিতে বাড়তে
থাকা মুখপত্রগুলোকে বুঝতে থাকারও দরকার পড়ে। তাই যে কাজগুলো পুরো করা বাধা পড়ে বলে
সম্ভব হয় না, সেগুলো শীতের মাসে, প্রধানতঃ বছরের প্রথম তিন মাসে করতে বাধ্য হই।”
[শব্দে জোর বর্তমান
লেখকের]
সত্যি বলতে, প্রথমে
মার্ক্স-এঙ্গেলসের, আর মার্ক্সের মৃত্যুর পর একা এঙ্গেলসের যে ব্যক্তিগত ভূমিকা ছিল
বিভিন্ন দেশে, যেভাবে তাঁরা সমাজবাদীদের সংগঠিত করতেন, পার্টির নির্মাণে সাহায্য করতেন
এবং সেসব দেশের আর্থিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে নেতৃত্বের পথপ্রদর্শন করতেন,
তার ওপর আলাদা আলাদা বই লেখা যায়। যেমন, ‘মার্ক্স-এঙ্গেলস এবং জার্মানির সমাজবাদী আন্দোলন’, ‘মার্ক্স-এঙ্গেলস এবং রাশিয়ার সমাজবাদী আন্দোলন’ এবং তেমনই, মার্ক্স-এঙ্গেলস এবং ফ্রান্স,
এবং ইংল্যান্ড, এবং ইতালি, এবং স্পেন, এবং বেলজিয়াম, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক
… ! হয়তো লেখা হয়েওছে
সেসব দেশের ভাষায়!
‘পূঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ডের
পাণ্ডুলিপির প্রেসকপি তৈরি হতে হতে ১৮৮৪র বছরটা শেষ হয়ে গেল। কিন্তু সারা বছর, সেকাজের
পাশাপাশি এঙ্গেলস অন্যান্য সম্পাদনার কাজও চালাচ্ছিলেন। বিশেষ করে মার্ক্সের এবং তাঁর
পুরোনো বইগুলোর নতুন সংস্করণ এবং নতুন অনুবাদের সম্পাদনা। প্রায় প্রত্যেকটিরই সঙ্গে
লিখতে হত একটি নতুন ভুমিকা অথবা মুখবন্ধ। এবং তাতে এত নতুন তথ্য বা ভাবনা থাকত যে আলাদা
করে, প্রবন্ধ হিসেবে খবরের কাগজে বা পত্রিকায় ছাপত। ১৮৮৪ থেকে ১৮৮৫ মধ্যে তিনি ‘পূঁজি’র প্রথম খণ্ডের ইংরেজি অনুবাদ, ‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং রাষ্ট্রের উতপত্তি’র ইতালীয় এবং ড্যানিশ (ডেনমার্কের ভাষা) সংস্করণ,
‘লুই বোনাপার্টের
অষ্টাদশ ব্রুমের’এর ফরাসি সংস্করণ
এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইংরেজিতে প্রকাশিতব্য ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা’র সম্পাদনা করলেন। আগেই উল্লেখ করেছি যে বার্নস্টাইন
এবং কাউটস্কি জার্মানে অনুবাদ করেছিলেন ‘দর্শনের দারিদ্র্য’। সে অনুবাদের সম্পাদনা তো করলেনই, একটি দীর্ঘ এবং গুরুত্বপূর্ণ
মুখবন্ধ এবং অনুপূরক যোগ করলেন। ‘মজুরি, শ্রম এবং পূঁজি’র নতুন সংস্করণেরও নতুন ভূমিকা লিখলেন। এই সময়কালেই, ৩৫ বছর আগে
লেখা বই ‘জার্মানিতে কৃষক-যুদ্ধ’ পুনর্বার লেখা শুরু করলেন কেননা সে-বইয়ে নথিভুক্ত
ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সঙ্গে জড়িত কিছু নতুন তথ্য উঠে এসেছিল যেগুলোর ভিত্তিতে ঐ ঘটনাবলীর
ওপর নতুন আলোকপাত করা যেত। অবশ্য, একাজটা পুরো হতে পারল না।
সবচেয়ে বেশি ব্যগ্র
থাকতেন ‘কম্যুনিস্ট পার্টির
ঘোষণাপত্র’এর প্রচারের ব্যাপারে।
একথাও বলতেন যে বইটার অনুবাদ করা খুব কঠিন। আলোচ্য সময়কালে ‘ঘোষণাপত্র’এর নতুন জার্মান সংস্করণ বাদে ফরাসি, রুশীয়, ড্যানিশ এবং ইংরেজি
অনুবাদ হল। সবগুলোরই সম্পাদনা এঙ্গেলস করলেন। কয়েকটির জন্য নতুন মুখবন্ধ লিখলেন।
‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ড
এঙ্গেলস ভেবেছিলেন
১৮৮৪ শেষ হতে হতে যদি ‘পূঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ড তৈরি করে মুদ্রণের জন্য পাঠিয়ে
দিতে পারেন তাহলে তৃতীয় খণ্ডের কাজ পরের এক বছরে, অর্থাৎ ১৮৮৫তে পুরো করে ফেলতে পারবেন।
১৮৮৫র ২২শে ফেব্রুয়ারি তিনি জ্যুরিখে হার্মান শ্লুটারকে লিখলেন, “পূঁজির দ্বিতীয় গ্রন্থের শেষ পাণ্ডুলিপি কাল
যাবে। পরের দিন থেকে আমি তৃতীয় গ্রন্থের ওপর কাজ করা শুরু করব।”
কিন্তু যখন কাজ করতে
শুরু করলেন, দেখলেন এ যে রত্নে ভরা অতল সাগর! পনের দিন কাজ করার পর, ১৮৮৫র ৮ই মার্চ
লরা লাফার্গকে লিখলেন, “যত গভীরে যাচ্ছি,
‘পূঁজি’, তৃতীয় গ্রন্থ তো মহৎ থেকে মহত্তর হয়ে চলেছে।
যখন নাকি ৫২৫ পৃষ্ঠার বইটার মাত্র ২৩০ সংখ্যক পৃষ্ঠা অব্দি পৌঁছেছি, সেটাও মাঝখানের
৭০টা পৃষ্ঠা সরিয়ে, কেননা সেই পৃষ্ঠাগুলোর জন্য পরে লেখা একটা অন্য পাণ্ডুলিপি আছে।
বোঝা কঠিন কী করে একটা মানুষ যার মগজে এত অসাধারণ সব আবিষ্কার ছিল, আনুপূর্বিক এবং
সম্পূর্ণ একটি বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ছিল, ২০ বছর নিজের মগজেই ধরে রাখল! কেননা যে পাণ্ডুলিপির
ওপর আমি কাজ করছি, সেটা হয় প্রথম খণ্ডের সময়েই অথবা তার আগেই তৈরি করা হয়েছে। এবং তার
আবশ্যক অংশগুলো পুরোনো সেই ১৮৬০-৬২র পাণ্ডুলিপিতেই ছিল।” পরে আরেকটি চিঠিতে নিকোলাই ড্যানিয়েলসনকে
লিখছেন যে বোধহয় এই তৃতীয় গ্রন্থও দুই খণ্ডে যাবে এবং তার পর থাকবে ইতিহাস, উদ্বৃত্ত
মূল্যের তত্ত্বসমূহের, যেটা আলাদা করে প্রকাশিত করতে হবে। (মনে হয় আগেই উল্লেখিত হয়েছে
যে তিন খণ্ডে এই ইতিহাস এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর সোভিয়েত সঙ্ঘে প্রকাশ হয়েছিল)।
যখন এঙ্গেলস ‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত পান্ডুলিপিসমূহ, খসড়া এবং অন্যান্য
কাগজগুলো ঘাঁটতে শুরু করলেন, দেখলেন যে প্রায় পুরো গ্রন্থটাই – যার শিরোনাম ছিল ‘সমগ্রতায় পূঁজিবাদী উৎপাদন’ – লিখতে হবে। এঙ্গেলস লিখলে মার্ক্সের লেখা থেকে পড়বে কে? আগেই কোথাও
বলেছি যে মার্ক্সের লেখা মার্ক্স নিজেই ভালো করে পড়তে পারতেন না। তাঁকে উদ্ধার করতেন
তাঁর স্ত্রী। অথবা এঙ্গেলস এসে পড়লে এঙ্গেলস। এখন তো আর জেনি মার্ক্সও নেই, স্বয়ং মার্ক্সও
নেই। তাঁদের বড় দুই মেয়ের নিজেদের পারিবারিক দৈনন্দিন। ওদিকে ইলিয়ানরও স্যামুয়েল মুরের
সঙ্গে বসে ‘পূঁজি’র প্রথম খণ্ডের ইংরেজি অনুবাদে ব্যস্ত। লরার
ভাগেও কিছু কাজ আছে। শেষে, পুরো পান্ডুলিপিটা ঠিক করে লেখানোর জন্য এঙ্গেলসকে একজন
সচিব রাখতে হল। তাঁর নাম অস্কার এইসেনগার্টেন। সারা দিন এঙ্গেলস, টেবিলে ছড়িয়ে সাজানো
মার্ক্সের পাণ্ডুলিপি, খসড়া বা বিভিন্ন নোট থেকে পড়ে পড়ে লেখাতেন, একেকটা অংশের পুরো
পাণ্ডুলিপি তৈরি করাতেন তার পর নিজে সেটার সম্পাদনা করতেন।
একাজে প্রায় সাড়ে
পাঁচ, ছয় মাস লেগে গেল। ১৮৮৫র ২২থেকে ২৪শে জুনের মাঝে লেখা একটি চিঠিতে অগাস্ট বেবেলকে
জানাচ্ছেন, “পূঁজি’ তৃতীয় গ্রন্থের অধিকাংশ ভাগ পান্ডুলুপিগুলো
থেকে লেখানো হয়ে গেছে। এখন এটা পড়ার মত হাতে লেখা একটা পাণ্ডুলিপি। এই কাজটা আরো প্রায়
৫-৬ সপ্তাহে পুরো হয়ে যাবে। তারপর অত্যন্ত কঠিন একটি চূড়ান্ত সম্পাদনা পর্ব শুরু হবে;
অনেক কাজ করতে হবে তার জন্য।”
আর সেই কাজে দশ বছর
লেগে গেল।
‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ডের প্রকাশন
হল ১৮৯৪এ। সোভিয়েত সঙ্ঘে প্রকাশিত জীবনী অনুসারে, তৃতীয় খণ্ডের কাজ তিনি ১৮৮৪ সালের
ফেব্রুয়ারির শেষে শুরু করেছিলেন আর ১৮৯৪এর ১২ই জানুয়ারি ‘ভোরওয়ার্টস’এ ঘোষণা করতে পারলেন যে তৃতীয় খণ্ড ছাপতে চলে গেছে, সেপ্টেম্বর
নাগাদ বেরিয়ে যাবে।
শরীর অসুস্থ থাকত
বলে মার্ক্সের রচনাগুলো সম্পাদন করার মাধ্যমেই তিনি বন্ধুর সাহচর্যও অনুভব করতেন। ১৮৮৫র
৮ই মার্চ লরা লাফার্গকে লিখছেন, “শনিবারে নিম আর টুসি হাইগেটে যাবে, পাম্পসও যাবে। আমি যেতে পারব
না। চলাফেরার ক্ষমতার ব্যাপারে আমি খুবই পরিবর্তনশীল ব্যক্তি এবং সদ্য, শান্ত থাকার
একটা ছোট্ট নির্দেশ পেয়েছি। যাহোক, আমি সেই গ্রন্থ নিয়ে কাজে ব্যাপৃত থাকব যেটি ‘মোহ্র’এর” [মার্ক্সের ডাকনাম]
“স্মৃতিস্তম্ভ হবে
– এমন স্মৃতিস্তম্ভ
যা সে নিজে বানিয়েছে এবং অন্যেরা যা বানাতে পারত তার চেয়ে অনেক বেশি মহিমান্বিত। শনিবারে
দু’বছর হয়ে যাবে! তবুও,
সত্যিই আমি বলতে পারি যে যখন আমি এই গ্রন্থটির ওপর কাজ করি, আমি তার সঙ্গে সজীব যোগাযোগে
থাকি।”
নিয়মিত কাজগুলো – ‘পূঁজি’র সম্পাদন, অন্যান্য
গ্রন্থের নতুন সংস্করণ এবং অনুবাদের সম্পাদন, সেগুলোর জন্য প্রয়োজনানুসারে ভূমিকা বা
মুখবন্ধ লেখা, বিভিন্ন দেশের সাথীদের চিঠির জবাব দেওয়া অথবা নিজের তরফ থেকে লেখা ইত্যাদি
– বাদেও প্রয়োজনে
আলাদা করে রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখতেই হত। ১৮৮৫র অক্টোবর-নভেম্বরে ‘কম্যুনিস্ট লীগের ইতিহাস’ এবং ‘প্রুশীয় কৃষকদের ইতিহাস’ নিয়ে দুটো বড় প্রবন্ধ লিখলেন।
কিরকম কাজের চাপ
ছিল তা ১৮৮৬র ২৯শে জানুয়ারি এডলফ সোর্জকে লেখা একটি চিঠি পড়লে স্পষ্ট হয়। প্রথমে লেখেন
যে আমেরিকায় এক মহিলা তাঁর লেখা ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা’র অনুবাদ করেছেন, তার পাণ্ডুলিপি তিনি সংশোধন করছেন। তারপর নিজের
পরবর্তী কাজের ফিরিস্তি দেন, “এরপর আমার হাতে আছে – শুধু পরিমার্জনের কাজ বলছি – (১) ‘অষ্টাদশ ব্রুমের” [লুই বোনাপার্টের] “ফরাসিতে, … (২) … ‘মজুরি-শ্রম এবং পূঁজি’ ইতালীয়তে, (৩) ‘পরিবারের’” [ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের] “‘উৎপত্তি’, ড্যানিশে, (৪) ‘ঘোষণাপত্র’” [কম্যুনিস্ট] “এবং ‘সমাজবাদঃ কাল্পনিক
এবং বৈজ্ঞানিক’ ড্যানিশে, – দুটোই ছেপে গেছে কিন্তু ভুলে ভরা, (৫) ‘পরিবারের …উৎপত্তি’ ফরাসিতে, (৬) ‘সমাজবাদঃ বৈজ্ঞানিক এবং কাল্পনিক’ ইংরেজিতে। আরো আসছে। দেখতে পাচ্ছ তো? ব্যস, একজন স্কুলমাস্টার
হয়ে গেছি। পরীক্ষার খাতা দেখছি। সৌভাগ্য যে আমার ভাষাজ্ঞান বেশি প্রসারিত নয়। হলে পর,
রুশীয়, পোলিশ, সুইডিশ ইত্যাদি অনুবাদেরও স্তূপ গড়ে তুলত আমার সামনে।”
১৮৮৫র পর ১৮৮৬ এসে
গেল। কাজ বাড়তে থাকল। ১৮৮৬র নভেম্বরে হার্মান শ্লুটারকে লিখলেন যে ‘মজুরি-শ্রম ও পূঁজি’র ইতালীয় অনুবাদ দশ মাস আর ‘অষ্টাদশ ব্রুমের …’এর ফরাসি অনুবাদ আট মাস ধরে আদ্ধেক সম্পাদিত
হয়ে পড়ে আছে। তার ওপর শ্লুটার পাঠিয়ে দিয়েছেন চার্টিস্ট আন্দোলনের ওপর একটি পাণ্ডুলিপি
– তার ভূমিকা লিখতে
হবে। এঙ্গেলসের নিজের লেখা ‘আবাসনের প্রশ্ন’, তার দ্বিতীয় সংস্করণের প্রস্তুতি নিতে হবে। শ্লুটারেরই প্রস্তাবিত
আরো দুচারটে কাজ নিয়ে কিছু কথা ছিল চিঠিটায়। এঙ্গেলসের পুরোনো লেখা ‘রাশিয়ার সামাজিক-সম্পর্ক প্রসঙ্গে’র দ্বিতীয় মুদ্রণের জন্য নতুন ভূমিকা লিখতে বলেছিলেন শ্লুটার। এঙ্গেলস
মানা করে দিলেন। আবার করে রাশিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাস পড়তে হত। শ্লুটারের দ্বিতীয় প্রস্তাব
ছিল যে ‘ড্যুহরিংতত্ত্ব-খন্ডন’এর একটি অধ্যায় ;ইতিহাসে বল’ তিনি আলাদা করে ছাপবেন। তবে তার জন্য অধ্যায়টার
রূপ একটু বদলাতে হবে। বদল তো করেই দিলেন এঙ্গেলস। লেখাটা ছেপেও গেল। কিন্তু তাঁর মনে
হল যে বিষয়টাকে আরেকটু সম্প্রসারিত করে একটি বই করলে ভালো হয়। যদিও বইয়ের কাজ শেষ অব্দি
পুরো হল না কিন্তু সেই আদ্ধেক করা বই ‘ইতিহাসে বলের ভূমিকা’, আজও একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক রচনা।
‘ইতিহাসে বলের ভূমিকা’র রচনাকাল ১৮৮৭র প্রারম্ভিক মাসগুলো। তার আগেই, ১৮৮৬তে এঙ্গেলস আরেকটি
তাত্ত্বিক রচনা তৈরি করেছিলেন যেটি সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল – ‘লুডইউগ ফায়ারবাখ এবং ধ্রুপদী জার্মান দর্শনের অবসান’।
দার্শনিক দৃষ্টি
স্পষ্ট করার কাজে খণ্ডনমূলক রচনার গুরুত্ব অপরিসীম। শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামে আরো বেশি
কেননা শিক্ষার পূঁজিবাদী ব্যবস্থা পুরোটাই, শোষণের নির্মম সত্যকে অন্তরালে রাখার নীতিশাস্ত্র-ভিত্তিক।
মার্ক্সের মৃত্যুর
পরে পরেই, ১৮৮৩র ২রা এপ্রিল এঙ্গেলস প্যেওত্র লাভরভকে লিখছেন, “শেষ পর্য্যন্ত কাল ঐ পান্ডুলিপিগুলো হাঁটকানোর
জন্য বেশ কিছুটা সময় পাবো, বিশেষ করে দ্বান্দ্বিকতার একটি রূপরেখা যা তিনি সব সময় লিখতে
চাইতেন।” এমনটা লেখার কারণ
ছিল। পঁচিশ বছর আগে মার্ক্স এঙ্গেলসকে লিখেছিলেন, “যদি সময় পাই, কাজটা” [তাত্ত্বিক] “করব। দুটো বা তিনটে কাগজে” [কাগজ বলতে বড় তা, যেটা ভাঁজ করে আট বা বারো পৃষ্ঠা হয়] “সাধারণ পাঠকের বোঝার মত করে পদ্ধতির যৌক্তিক
দিকটা খোলসা করতে চাইব, যেটির আবিষ্কারও করলেন হেগেল, আবার নিজেই রহস্যময়ও করে দিলেন।”
মার্ক্স নিজে কাজটা
করতে পারলেন না। এঙ্গেলসও, করবেন ভাবা সত্ত্বেও, তৎক্ষণাৎ করতে পারলেন না। ১৮৮৫ সালে
একটা বই এল বাজারে – সি. এন. স্টার্কের
লেখা ‘লুডউইগ ফায়ারবাখ’। বইটা পড়েই এঙ্গেলস বসে গেলেন স্টার্কের তত্ত্ব
ও অভিমতগুলো খণ্ডিত করার কাজে। তবুও লেখাটাকে পুরোপুরি খণ্ডনমূলক করলেন না। কেন? … তার জবাব এঙ্গেলস নিজেই দিয়েছেন ১৮৮৮ সালে,
যখন লেখাটা বই হয়ে বেরুল (আগে ১৮৮৬তে ‘ডায় ন্যু জেইট’এ ছেপেছিল) আর এঙ্গেলসকে কথামুখ লিখতে হল। আগে তিনি ‘জার্মান ভাবাদর্শ’এর উল্লেখ করলেন। কিভাবে মার্ক্সের সঙ্গে বসে
লিখলেন, যদিও ছাপল না কিন্তু প্রধান উদ্দেশ্য – ‘আত্মশুদ্ধি’ – পুরো হল। তারপর লিখলেনঃ
“তারপর চল্লিশ বছরের বেশি কেটে গেল। মার্ক্স মারা গেলেন। কিন্তু আমাদের
দুজনের মধ্যে কারোরই বিষয়টার দিকে ফিরে যাওয়ার সুযোগ হল না। হেগেলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক
নিয়ে অনেক জায়গায় আমরা আমাদের কথা রেখেছি কিন্তু কোথাও সামগ্রিক, সুসঙ্গতভাবে নয়। ফায়ারবাখের
কাছে তো আমরা আর যাইই নি ফিরে, যখন নাকি কিছু বিষয়ে তিনি হেগেলীয় দর্শন এবং আমাদের
ধারণার মধ্যবর্তী যোগসূত্র। …
“এহেন পরিস্থিতিতে আমার মনে হল, হেগেলীয় দর্শনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের
একটি ছোটো, সুসঙ্গত বর্ণনার প্রয়োজন – কিভাবে আমরা ঐ দর্শনের দিকে এগোলাম, এবং কিভাবে আলাদা হলাম ঐ দর্শন
থেকে – ক্রমাগত বাড়ছে।
সমানভাবে এটাও মনে হল যে আমাদের ‘স্টার্ম ও ড্র্যাং’ পর্বে” [ফরাসি নবচিন্তন-প্রভাবিত
জার্মান সাহিত্য আন্দোলন] “অন্য যেকোনো হেগেলোত্তর
দার্শনিক থেকে বেশি ফায়ারবাখ কিভাবে আমাদের প্রভাবিত করেছিলেন তার পূর্ণ স্বীকৃতি একটি
সম্মানের ঋণ, যা অপ্রদত্ত থেকে গেছে। তাই, ‘ন্যু জেইট’এর সম্পাদকেরা যখন আমাকে ফায়ারবাখের ওপর স্টার্কের বইটার একটা সমালোচনামূলক
সমীক্ষা লিখতে বললেন, সুযোগটা আমি লুফে নিলাম।”
‘জার্মান ভাবাদর্শ’ প্রথম প্রকাশিত হল ১৯৩২ সালে। অর্থাৎ, পঁয়তাল্লিশ বছর অব্দি ‘লুডউইগ ফায়ারবাখ এবং ধ্রুপদী জার্মান দর্শনের
অবসান’ আগ্রহী পাঠকদের
জন্য মার্ক্সবাদের উদ্ভব-সম্পর্কিত একমাত্র বিস্তারিত তাত্ত্বিক রচনা ছিল। স্বাভাবিকভাবেই
রচনাটি জনপ্রিয় হল। ১৮৮৮ সালে যখন বই হয়ে ছাপল তখন মার্ক্সের লেখা ‘থিসিস অন ফায়ারবাখ’ও এঙ্গেলস তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন। ফলে তিন পৃষ্ঠার
এই বিস্ময়কর সূত্র-সমষ্টিও বেয়াল্লিশ বছর পর প্রথমবার পাঠকদের চোখের সামনে এল। ১৮৮৯
সালে বইটার একটা অননুমোদিত রুশীয় সংস্করণ প্রকাশিত হল। তাতে অবশ্য লেখকের নামও ছিল
না আর অনেককিছু ইচ্ছেমত যোগ করা বা সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৮৯০ সালে পোলিশ ভাষায় অনুবাদ
হল আর তারপর ১৮৯২ সালে বইটার জর্জি প্লেখানভ-কৃত পূর্ণ রুশীয় অনুবাদ জেনেভা থেকে প্রকাশিত
হল। সে বছরই বুলগারীয় ভাষাতেও অনুবাদ হল। ১৮৯৪ সালে প্যারিস থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার
দুই সংখ্যায় ধারাবাহিক প্রকাশিত ফরাসি অনুবাদ; করেছিলেন লরা লাফার্গ। ১৯০৩ সালে বই
হয়ে প্রকাশিত হল ইংরেজিতে।
দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের আগেপরে
সমাজবাদীদের বেঁচে
থাকতে হবে!
নিজের পৈত্রিক, ব্যবসায়ী
পরিবারের পরম্পরা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এঙ্গেলস সারা জীবন দুটো পরিবারকে নিজের দায়িত্ব
মেনে চললেন – এক, মার্ক্সের আর
দুই, নিজের। এখন সে দুই পরিবার অনেকগুলো পরিবার হয়ে গিয়েছিল। মার্ক্স ছিলেন না, তাঁর
স্ত্রী ছিলেন না, তাঁদের বড় মেয়েও ছিলেন না। কিন্তু বড় মেয়ের স্বামী ছিলেন, সন্তানেরা
ছিল। দ্বিতীয় মেয়ে এবং তার স্বামী ছিলেন, সন্তানেরা ছিল। ছোটো মেয়ে এবং তাঁর স্বামী
ছিলেন। সবার তিনি খোঁজখবর রাখতেন। মার্ক্সের বড় জামাই শার্ল থাকতেন প্যারিসের পাশে,
আর্জেন্তেল-এ। চাকরি করতেন, সমাজবাদী আন্দোলনের সঙ্গে থাকতেন। কিন্তু পল, মানে দ্বিতীয়
জামাই ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও প্রধানতঃ সমাজবাদী আন্দোলনেই সক্রিয় থাকতেন – নানান সমস্যার মোকাবিলা, বিভিন্ন মামলায় হাজিরা,
গ্রেপ্তারির ভয় ইত্যাদি ঘিরে থাকত পরিবারটাকে। ইলিয়ানর এবং এডোয়ার্ড এভেলিং দুজনেই
পুরোটা সময় আন্দোলন আর সংস্কৃতিকর্মে থাকতেন। এঙ্গেলসের যখনই মনে হত এদের মধ্যে কারোর
আর্থিক সাহায্য দরকার, তিনি নিজেই যতটা সম্ভব পাঠিয়ে দিতেন। তাঁর ভালোও লাগত যে মার্ক্সের
পরিবারের বর্তমান সদস্যদেরকে করা সাহায্যটাও শেষ অব্দি সমাজবাদী আন্দোলনেরই কাজে লাগছে।
তবে লিডিয়ার ভাইঝি পাম্পসের স্বামী রোশার নিজের কাজেই পয়সাকড়ির অভাবে পড়তেন মাঝেমধ্যে।
তাই পাম্পসকে তো প্রায়ই সাহায্য করতে হত।
এরা ছাড়া, জার্মানি
থেকে নির্বাসিত অথবা রাজনৈতিক অভিবাসী, সমাজবাদী আন্দোলনের শরিক যে কোনো সাথীর সাহায্যের
প্রয়োজন হলে সবচে’ আগে সাহায্যের হাত
বাড়াতেন এঙ্গেলস। সাহায্যপ্রার্থী সমাজবাদী আন্দোলনের অংশীদার কিনা অথবা আন্দোলনে অংশীদার
হওয়ার কারণে জুলুমের শিকার কিনা সেটা খেয়াল রাখতেন। কেননা অনেকেই জানত যে এঙ্গেলস এধরণের
সাহায্য করে থাকেন। একবার এমনই এক ছাত্র পড়ার খরচ চালানোর জন্য দু’তিন বছর ঋণ হিসেবে মাসোহারা দেওয়ার অনুরোধ
করল। এঙ্গেলস দিতে অস্বীকার করে স্পষ্ট লিখলেন, “বছরের পর বছর ধরে যাদেরকে আমি সাহায্য করে আসছি, তারা শুধু জার্মানি
আর ইংল্যান্ডেই সীমিত নয়। এবং তাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ
এমন, ব্যক্তিগত অথবা পার্টিগত সম্পর্কের কারণে যাদের থেকে আমি নিজেকে ছিন্ন করতে পারব
না। এভাবে, এত বেশি পরিমাণে আমি স্থায়ী নিয়মিত দায়িত্ব গ্রহণ করে নিয়েছি যে এখন আমি
নিজেই হতবুদ্ধি হয়ে ভাবি যে এই দায়িত্ব পালন করব কিভাবে? [১৮৮৭র ১০ই অক্টোবর জোহান
ওয়েসকে লেখা চিঠি]
অন্য দিকে, কিভাবে
তিনি সমাজবাদী যোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের খেয়াল রাখতেন তার দৃষ্টান্ত অন্য একটি চিঠিতে
আছে। কার্ল ফ্যান্ডার এক জার্মান বিপ্লবী ছিলেন। মার্ক্স-এঙ্গেলসের সাথী ছিলেন, ‘কম্যুনিস্ট লীগ’ এবং ‘আন্তর্জাতিক’, দুয়েরই সাধারণ পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৮৭৬ সালে, ৫৮ বছর বয়সে তাঁর
মৃত্যু হল। তাঁর পরিবারের বিষয়ে এঙ্গেলস ১৮৮৮র ২৯শে ফেব্রুয়ারি উইলহেল্ম লিবনেখটকে
লিখছেনঃ
“যদি আপনারা প্রত্যেক তিন মাসে শ্রীমতী ফ্যান্ডারের জন্য ১০০ মার্কের
ব্যবস্থা করে দেন, একই পরিমাণ অর্থের ব্যবস্থা আমিও করব। তাহলে তাঁর কাছে বাৎসরিক ৪০
পাউন্ড পৌঁছোবে। বেশি রকম অভাবের মুখোমুখি হতে হবে না তাঁকে।
“ফ্যান্ডারের মৃত্যুর পর শ্রীমতী ফ্যান্ডারের কাছে যেটুকু পয়সা ছিল,
সেটা খরচ করে তিনি একটা লজ খুলেছিলেন। কিন্তু লজটা ছিল বাজে পাড়ায় আর তাঁর দুর্ভাগ্যের
আরো কিছু কারণ ছিল … সংক্ষেপে, সে লজ
চলল না। তারপর তিনি একটা ছোটো দোকান দিলেন। কিন্তু তাঁর যে মেয়েটি এধরণের ছোটো ব্যবসা
চালাতে পারত সে মারা গেল। অর্থাৎ, পয়সা শেষ হয়ে গেল। ফ্যান্ডারের এক ভাই ছিল যাকে ফ্যান্ডার
পয়সা দিয়ে বাধ্যতামূলক সামরিক নিয়োগ থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল। দীর্ঘ সময় অব্দি তার প্রতিপালন
করেছিল। সে ভাই এখন নিউ আল্ম, মিনেসোটায় থাকে। সে নিজের বোনকে তার দ্বিতীয় মেয়েকে সঙ্গে
নিয়ে চলে আসতে বলল। সেখানে গিয়ে শ্রীমতী ফ্যান্ডার দেখলেন যে তাঁকে পাড়ায় ‘গরীব আত্মীয়’ বলে পরিচয় করিয়ে বাড়ির কাজকর্মের জন্য ডাকা
হয়েছে। শ্রীমতী ফ্যান্ডার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলেন না। পনের দিনের ভিতরে ফিরে এলেন।
যেটুকু পয়সা বেঁচেছিল তা আসাযাওয়ায় শেষ হয়ে গেল। তারপর যাকিছু সম্ভব তাঁর জন্য করা
হয়েছে কিন্তু একমাত্র আমিই তাঁকে বেশি দিন সাহায্য করতে পারি। অথচ সে সাহায্য পর্যাপ্ত
হবে না কেননা আমায় অন্যান্য জায়গাতেও সাহায্য পাঠাতে হয়। …”
এভাবেই এঙ্গেলস সবার
হালহকীকতের খবর রাখতেন আর সাহায্য পাঠাতেন।
সারাটা সপ্তাহ বাড়িতে
শুধু লেখাপড়ার কাজ করতেন আর সাদামাটা খাবার খেতেন। যেহেতু চোখের দৃষ্টি দুর্বল ছিল
তাই শুধু দিনের বেলায় কাজ করতেন। সন্ধ্যেবেলায় মানুষজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ সারতেন।
রবিবারে অতিথিরা আসতেন। সন্তানদের (মার্ক্সেরও) পরিবার এবং সেসময় লন্ডনে উপস্থিত বা
ম্যাঞ্চেস্টার থেকে আসা বন্ধু আর সাথীরাও পৌঁছোতেন। স্কোর্লেমার, কাউটস্কি, লেসনার
এবং আরো কয়েকজন তো নিয়মিত অতিথি ছিলেন। সব কাজ বন্ধ রেখে সেদিন এঙ্গেলস প্রাণ খুলে
অতিথি আপ্যায়ন করতেন। হেলেন ডিমুথও সঙ্গে থাকতেন। সারা বাড়ি গল্পগুজবে আর হাসিঠাট্টায়
ভরে উঠত। সপ্তাহভর মুখ বুজে কাজ আর রোববারে প্রাণ খোলা আনন্দ, এই দুটো দিকই এঙ্গেলসের
অনুশাসিত দিনযাপনের অঙ্গ ছিল।
জনৈক মাহন (সম্ভবতঃ
জন লিঙ্কন মাহন) হয়তো কোনো কাজের ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন। টুসির মাধ্যমে সে
খবরটা পেয়েছিলেন এঙ্গেলস। টুসি নিজের বাড়িতেও ডেকেছিলেন। ১৮৮৮র ১০ই মে-তে লেখা একটা
ছোট্টো চিঠি আছে এঙ্গেলসের, “আমার প্রিয় টুসি, ধন্যবাদ, কিন্তু আমরা আসতে পারব না। ‘নিম’কে বাজারে যেতে হবে নইলে রোববারে তোমরা ডিনার পাবে না, আর আমাকে
এমেরিকান মেলের মাধ্যমে শনিবারে পাণ্ডুলিপি” [এঙ্গেলসের লেখা ‘সংরক্ষণ ও মুক্ত বাণিজ্য’] “পাঠাতে হবে। পাণ্ডুলিপি
এখনো তৈরিই হয় নি।
“মাহনকে বল যে রোববারে আমি নিজের ‘ব্যক্তিগত বন্ধু’দের আপ্যায়ন করি। কাজেই রোববারে এখানে কাজের কথার কোনো সুযোগ নেই।
যদি সে আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়, সারা সপ্তাহে যে কোনো সন্ধ্যায় স্বাগতম! …”
কখনো কখনো এতেও বাধা
আসত। আগে থেকে খবর না দিয়ে হয়তো পাম্পসই চলে আসত বাচ্চাদেরকে নিয়ে। বাচ্চারা দাদুর
লেখাপড়া বন্ধ করে দিত। এঙ্গেলসকে তখন তাদের জন্য ‘সবচেয়ে ভালো’ কাগজের নৌকো তৈরি করতে হত।
একটা প্রশ্ন উঠতে
পারে। হেলেন ডেমুথই কি বাড়ির সমস্ত কাজ করতেন? অবশ্যই তিনি পরিচারিকা হিসেবে জার্মানি
থেকে মার্ক্স ও জেনির সংসারে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁর বয়স এখন ৬৮ বছর! লরা লাফার্গকে
১৮৮৮র ৩রা জুনে লেখা চিঠিতে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। চিঠির শেষ প্যারায় লিখছেন,
“এক বছরেরও বেশি সময়
ধরে যেটার চেষ্টা করছিলাম, বাড়ির গৃহস্থালিতে সে বিপ্লবটি ঘটাতে পেরেছি। অ্যানিকে কাজ
ছাড়তে বলেছিলাম; গত রাতে সে চলে গেছে। নতুন একটি মেয়েকে পেয়েছি। নিমকে এখন, যেটুকু
সে সত্যিই চায় তার চেয়ে বেশি কাজ করতে হবে না, আর সকাল অব্দি ঘুমোতে পারবে।”
একটা খুশির দিন এল।
জার্মানির রাইখস্ট্যাগে সরকার হারল। কুখ্যাত সমাজবাদী-বিরোধী আইনের মেয়াদ পাঁচ বছরের
জন্য বাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব খারিজ হল। প্রস্তাব খারিজ করানোয় প্রধান ভূমিকা পালন করল
অগাস্ট বেবেল আর আরেকজন সমাজবাদী সাংসদ সিঙ্গারের ভাষণ। শেষে কোনো রকমে সরকার রাইখস্ট্যাগে
দু’বছর মেয়াদ বাড়ানোর
স্বীকৃতি হাসিল করল, তাও প্রস্তাবিত নতুন ধারাগুলো বাদে। ১৮৮৮র ২৩শে ফেব্রুয়ারি এঙ্গেলস
লিবনেখটকে লিখলেন, “সমাজবাদী-বিরোধী
আইন নিয়ে বাদানুবাদ, সংসদীয় সংগ্রামে আমাদের আজ অব্দিকার সবচেয়ে বড় জয়।” (শ্রমিকদের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ফলে এই
আইন শেষ পর্য্যন্ত ১৮৯০এর ৩০শে সেপ্টেম্বর বাতিল হয়েছিল)।
এঙ্গেলসের শরীর তো
দুর্বল হচ্ছিলই, চোখের দুর্বলতা তাঁকে বেশি কষ্ট দিচ্ছিল। এক ধরণের কনজাংটিভাইটিসের
অসুখ ধরেছিল; দু’ঘন্টার বেশি লেখাপড়ার
কাজ করতে পারছিলেন না। আর বিরক্তি হত যখন দ্বিতীয়বার বসার পর, এগোবার জন্য আগের দু’ঘন্টার কাজ আবার থেকে দেখতে হত; নষ্ট হত সময়।
আগে একবার তিনি ভেবেছিলেন, নতুন প্রজন্মের কোনো এক সাথীকে, বিশেষ করে কাউটস্কি বা বার্নস্টাইন,
কোনো একজনকে মার্ক্সের পাণ্ডুলিপি পড়ে পড়ে লেখার কাজে লাগাবেন। তার জন্য একজন সচিবের
প্রাপ্য মাসোহারাও দেবেন, যাতে ওদের আয়ের সমস্যা না হয়। তাতে দুটো লাভ হবে। মার্ক্সের
হাতের লেখা পড়তে সক্ষম একজন সাথী তৈরি হয়ে যাবে। লেখার কাজের জন্য আলাদা করে নতুন সচিব
রাখতে হবে না (এইসেনগার্টেনের সঙ্গে চুক্তি ১৮৮৫তেই শেষ হয়ে গিয়েছিল)। আর ফলে, এঙ্গেলস
একটু আরাম তো পাবেনই, যদি মৃত্যুও হয়, মনে শান্তি থাকবে যে মার্ক্সের রচনাগুলোর প্রকাশনা
বন্ধ হবে না।
এঙ্গেলসের রুশীয়
জীবনী (ইংরেজি অনুবাদ ১৯৭৪) লিখছে, “কিন্তু এই শিক্ষা-প্রদান, স্পষ্টতঃ ‘বাণিজ্যিক’ ভিত্তিতে (এঙ্গেলসের নিজের সঞ্চয় থেকে ব্যয় করে) শুধু কাউটস্কির
সঙ্গে কার্যকর হল। পাণ্ডুলিপির কিয়দংশের তিনি পাঠোদ্ধার করে নিজের হাতে লিখেছিলেন।”
এই বক্তব্য সমর্থন
করে এঙ্গেলসের চিঠি। ১৮৯২এর ২৪এ ডিসেম্বর তিনি স্টুটগার্টে কাউটস্কিকে লিখছেন, “প্রিয় ব্যারন,” [এই নামেই তিনি কাউটস্কিকে ডাকতেন] “এই শীতে আমি অগাস্টকে” [অগাস্ট বেবেল] “চ্যানেল পেরিয়ে আসতে রাজি করার চেষ্টায় আছি।
কয়েকদিনের জন্য হলেও ভালো, আর আশা করছি সে রাজি হয়ে যাবে। যদি সে আসে, যেহেতু তাকে
স্টুটগার্ট হয়েই আসতে হবে, খুব ভালো হয় যদি তুমি তাকে মার্ক্সের পুরোনো পান্ডুলিপিগুলো
আর পাণ্ডুলিপির সেই অংশগুলো যেগুলো তুমি পুরো করে নিয়েছ, দিয়ে দাও।” সম্পর্কিত পাদটীকা বলে, এই পান্ডুলিপিগুলো
চতুর্থ খণ্ডের, অর্থাৎ, ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের
তত্ত্বসমূহ”এর ছিল। এঙ্গেলস
সে পান্ডুলিপিগুলো প্রকাশ করতে পারেন নি। ১৯০৫-১০ সালে কাউটস্কিই প্রথম সেগুলোর প্রকাশনার
ব্যবস্থা করেন।
এটা স্পষ্ট যে এঙ্গেলসের
মৃত্যুর পর মার্ক্সের পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধারকারী মাত্র দুজন ছিলেন, ইলিয়ানর এবং কাউটস্কি।
আমেরিকা সফর
যাহোক। কিছুদিনের
ছুটির প্রয়োজন ছিল আর তা-ও সমুদ্রের হাওয়ায়। ডাক্তাররা বলেছিলেন যে এতে দেহের বলও ফিরবে
এবং চোখও ভালো হবে। আগেও বেশ কয়েকবার তোড়জোড় শুরু করে শেষে পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছিল।
এবার সবকিছু ঠিকঠাক এগোল। ১৮৮৮র ৮ই আগস্ট এঙ্গেলস, স্কোর্লেমার, ইলিয়ানর এবং এডোয়ার্ড
এভেলিং ‘সিটি অফ বার্লিন’ নামের জাহাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে
রওনা হলেন। সফরটা পুরোপুরি ব্যক্তিগত এবং গোপন রাখা হয়েছিল কেননা এঙ্গেলস যুক্তরাষ্ট্রে
অপরিচিত ছিলেন না। যে বছরগুলোয় ওখানে গৃহযুদ্ধ চলছিল, মার্ক্স এবং এঙ্গেলস, দুজনেরই
লেখা ওখানকার খবরের কাগজে ছাপত। এদিকে দুজনেরই বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ ঐ দেশে প্রকাশিত
হয়েছে। দেড় বছর আগে, ১৯৮৭র জানুয়ারিতে ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা’র এমেরিকান অনুবাদ ও সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তার নতুন কথামুখ
হিসেবে এঙ্গেলস লিখেছিলেন ‘এমেরিকায় শ্রম-আন্দোলন’। সে লেখা আলাদা করেও ছেপেছে এবং যথেষ্ট আলোচিত
হয়েছে। তারপর এবছরই চার মাস আগে ‘মুক্ত বাণিজ্যের প্রশ্নে বক্তৃতা’র পুনর্মুদ্রণের জন্যও একটা কথামুখ লিখেছেন, ‘সংরক্ষণবাদ এবং মুক্ত বাণিজ্য’। সে লেখাটিও আলোচিত হয়েছে কেননা তাতে তিনি
এমেরিকায় বেশ কয়েক বছর ধরে চলতে থাকা সংরক্ষণবাদী নীতির সমীক্ষা করেছেন। খুব স্বাভাবিক
যে সাংবাদিকেরা, বিশেষ করে জার্মানভাষী মার্কিন শ্রমজীবী সংবাদপত্রের সাংবাদিকেরা সাক্ষাৎকার
নেওয়ার জন্য বন্দর থেকেই পিছু নিত।
এঙ্গেলসের জন্য এই
সফর তাঁর অভিজ্ঞতার জগতে একটি নতুন ঘটনা ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেসময় ‘নতুন বিশ্ব’ নামে খ্যাত ছিল এবং অনেক বছর ধরে এঙ্গেলসের এই ‘নতুন বিশ্ব’ দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সে ইচ্ছে পুরো হল এত বছর পর।
এ্যাটলান্টিক মহাসাগর
পেরোতে এক সপ্তাহ লাগল। জাহাজে খুব আনন্দে থাকলেন এঙ্গেলস। নিউইয়র্কে এক সপ্তাহের প্রথম
কয়েক দিন হোটেলে কাটিয়ে চলে গেলেন অ্যাডলফ সর্জের বাড়ি। সোর্জের সঙ্গে কথাবার্তায় সেখানকার
শ্রমিক আন্দোলনের অবস্থা, সমাজবাদী শ্রমিক পার্টি এবং আম জনতার বিষয়ে নানান তথ্য জানলেন।
নিউইয়র্ক থেকে এঙ্গেলস
গেলেন বোস্টন। সাথীদেরকে নিয়মিত চিঠি লেখা এঙ্গেলস গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কাজের মত
করতেন। পারিবারিক চিঠিও লিখতেন, তবে খুব কম। সব চিঠিতেই থাকত হৃদয়ের উষ্ণতা, যেন চাইছেন
চিঠির প্রাপক, শুধু দেহে ভালো নয়, মনেও উদ্দীপ্ত থাকুক। জাহাজ থেকেও চিঠি লিখেছিলেন।
বোস্টনে এক সকালে খবর পেলেন যে জার্মান রাইখস্ট্যাগের একটি আসনে উপনির্বাচনে উইলহেল্ম
লিবনেখট জয়লাভ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে চিঠি লিখতে বসলেন –
“প্রিয় লিবনেখট, এই একটু আগে, ঠিক সকাল ৯.৩০এ ‘বোস্টন হেরাল্ড’এ দেখলাম যে তুমি বার্লিনে ১০,০০০ ভোটের নিরঙ্কুশ
সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত হয়েছ। আমরা সবাই – আমি, স্কোর্লেমার এবং দুই এভেলিং – তোমাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
“এক সপ্তাহ নিউইয়র্কের হোবোকেন শহরতলিতে (সোর্জের সঙ্গে) কাটিয়ে আমরা
সোমবার থেকে এখানে আছি। আগামীকাল নায়াগ্রায় যাবো। আর যদি সম্ভব হয়, সেখান থেকে শিকাগো,
নাহলে তেলের অঞ্চলে যাবো। আর তারপর টোরন্টো, মন্ট্রিল, শ্যামপ্লেন হ্রদ, এ্যাড্রিয়নড্যাক্স
এবং এ্যালব্যান্ডি হয়ে হাডসনের পথে নিউইয়র্ক ফিরব।…”
বোস্টনে ছিলেন উইলি
বার্ন্স, তাঁর স্ত্রী লিডিয়ার ভাইপো, যিনি অনেক আগেই এমেরিকায় চলে এসেছিলেন। এঙ্গেলসের
দেখে খুব ভালো লাগল যে একটা রেল কম্পানিতে কর্মরত উইলি সক্রিয় ভাবে শ্রমিক আন্দোলনে
যুক্ত রয়েছেন। সোর্জকে চিঠিতে লিখলেনও সেকথা।
পাঁচ দিন কাটালেন
নায়াগ্রা জলপ্রপাতে। লরাকে চিঠি লিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোর রীতিনীতি, সংস্কৃতি
আর সামন্ততান্ত্রিকতার পূর্বভার-হীন পূঁজিবাদী বিকাশের কয়েকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
জানালেন হাল্কা কথায়।
তারপর ওন্টারিও হ্রদ
পার করে পৌঁছোলেন মন্ট্রিল, (ক্যানাডা)। ক্যানাডা থেকে অনেক জায়গায় ঘুরে তাঁরা হাডসন
নদীপথে নিউইয়র্ক পৌঁছোলেন। পুরো সফরটাই ব্যক্তিগত রইল। সময়াভাবে এমনকি তাঁর বই, ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা’র মার্কিন অনুবাদক ফ্লোরেন্স কেলি-উইশ্নেভেৎস্কির
সঙ্গেও দেখা করতে পারলেন না। চিঠি লিখে দুঃখ প্রকাশ করলেন। শুধু ইয়োরোপের পথে রওনা
হওয়ার আগে এঙ্গেলস ‘আন্তর্জাতিক’এর পুরোনো সাথী, সাংবাদিক থিয়োডোর কুনোকে একটি
সাক্ষাৎকার দিলেন যেটা ‘নিউইয়র্কার ভোক্সজাইটুং’এ প্রকাশিত হল।
ফেরার সময় জাহাজ
থেকে নিজের ভাই হের্মানকে যে চিঠি লিখলেন তাতে আরো নানান কথার সঙ্গে নিজের শরীরের আর
মনের অবস্থাও জানালেন –
“সফর দারুণ ভালো কাজ করেছে আমার শরীরে। বয়স পাঁচ বছর কম মনে হচ্ছে,
সব দুর্বলতা অন্তর্ধান করেছে, এমনকি চোখও আগের চেয়ে ভালো হয়েছে …”
২৯শে সেপ্টেম্বর
এঙ্গেলস লন্ডনে ফিরে এলেন। ৮ই অক্টোবর কনরাড শ্মিড্টকে লিখলেন, “মার্কিনদেশে ভ্রমণ অনেক কিছু ভালো করেছে আমার।
যদি আমার দৃষ্টিশক্তি আশানুরূপ বজায় থাকে, এই শীতে তৃতীয় খণ্ড ছাপাখানার জন্য তৈরি
হয়ে যাবে। এক বছরের মধ্যে সেটা ঐ দলটিকে” [চিঠিতে উল্লেখিত জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধ্যাপকসমুহ যারা
সেসময় মার্ক্সের ভাবনার বিকৃতি ঘটাচ্ছিল] “কামানের গোলার মত আঘাত করবে। … এমেরিকা আমার খুবই আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। সবার নিজের চোখে এই দেশটিকে
দেখা উচিৎ যার ইতিহাস পণ্য উৎপাদনের পিছনে যায় না আর যে দেশ পূঁজিবাদী উৎপাদনের প্রতিশ্রুত
ভূমি।”
দ্বিতীয় ‘আন্তর্জাতিক’ অভিমুখে
‘প্রথম আন্তর্জাতিক’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী
সমিতি’ বিগঠিত হওয়ায় সর্বহারা
বিপ্লবের যোদ্ধারা সবাই খুব কষ্ট পেয়েছিলেন, ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু মার্ক্স আর এঙ্গেলস
সত্যটা দেখতে পাচ্ছিলেন যে বিগঠন অবশ্যম্ভাবী ছিল। শ্রমিকদের প্রথম আন্তর্জাতিক সংগঠন
‘প্যারি কমিউন’এর রূপে একটি বিপ্লবী সক্রিয়তাকে উৎসাহিত করল,
সব দেশের সর্বহারাদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের অর্থকে পরিভাষিত করে প্রত্যেকটি দেশজ/স্থানীয়
সংগ্রামে আন্তর্জাতিক সমর্থন সুনিশ্চিত করল, পূঁজিবাদী-সামন্ততন্ত্রী-রাজতন্ত্রী যুদ্ধবাজ-জাতীয়তাবাদের
বিরুদ্ধে সর্বহারাকে দাঁড়াতে শেখালো এবং দূর-দূরান্ত অব্দি দেশগুলোয় সমাজবাদের প্রচারে
সাহায্য করল। “আমাদের অভিমত যে” [আগামী আন্তর্জাতিক সংগঠন] “নিছক প্রচার সমিতি হবে না”, ১৮৮২র ১০এ ফেব্রুয়ারি এঙ্গেলস যোহান ফিলিপ
বেকারকে লিখেছিলেন, “বরং বিশুদ্ধরূপে
সক্রিয়তার সমিতি হবে।” মার্ক্স জীবিত ছিলেন
সেসময়। দুজনেরই বক্তব্য ছিল যে আন্তর্জাতিক তো জীবিত রয়েছে! প্রত্যেকটি দেশ থেকে প্রকাশিত
হতে থাকা একেকটি সমাজবাদী পত্রিকা একেকটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র। সব দেশের সংগঠন এখন
একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। এখন তো পরিস্থিতিও বৈপ্লবিক নয়। দ্রুত পূঁজিবাদী বিকাশের একটি
পর্ব। সময়ের অপেক্ষা করতে হবে যখন “বিধিবৎ একটি আন্তর্জাতিক আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।”
আর সেই সময় দেখা
যেতে লাগল আশির দশকের শেষে। ইয়োরোপ আর এমেরিকায় শ্রমিকদের ব্যাপক হরতাল, কাজ-বন্ধ ও
আন্দোলনাত্মক কার্যকলাপ শুরু হল। হরতালগুলো গণসংগ্রামের রূপ নিতে শুরু করল। ১৮৮৬রই
মে মাসে হে মার্কেট স্কোয়্যার, শিকাগোর ঘটনাটি ঘটল। ১৮৮৭র নভেম্বরে পার্সন্স, ফিশার,
স্পাইস এবং এঞ্জেলকে ফাঁসি দেওয়া হল। হরতালের উদ্দীপনায় নতুন নতুন ট্রেড ইউনিয়ন জন্ম
নিচ্ছিল। পাশাপাশি, শ্রমিকদের রাজনৈতিক পার্টিসমূহও জন্ম নিচ্ছিল। অধুনালুপ্ত জার্মান
ডেমোক্র্যাটিক রিপাব্লিক থেকে ১৯৭২এ প্রকাশিত এঙ্গেলসের জীবনীতে (প্রধান লেখকঃ হাইনরিখ
গেমকাউ) দেওয়া তথ্য অনুসারে, ১৮৮৯র মাঝামাঝি সময় অব্দি বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, জার্মানি,
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, ইতালি, নরওয়ে, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, সুইটজারল্যান্ড, স্পেন,
হাঙ্গেরি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের রাজনৈতিক পার্টি তৈরি হয়ে গিয়েছিল এবং
রাশিয়া ও অন্যান্য কয়েকটি দেশে মার্ক্সবাদী গোষ্ঠি অথবা সর্বহারা সংগঠন সক্রিয় ছিল।
১৮৮৭র সেপ্টেম্বর
মাসে ইংল্যান্ডের ট্রেড ইউনিয়নগুলো নিজেদের অধিবেশনে, ট্রেড ইউনিয়নপন্থী নেতাদের বিরুদ্ধে
গিয়ে শ্রমিকদের স্বতন্ত্র সংগঠন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিল। মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্র,
খণ্ড ৪৮এর পাদটীকা সংখ্যা ১৬৫ বলছে, “৫ থেকে ১২ই সেপ্টেম্বর ১৮৮৭ পর্য্যন্ত সোয়ানসিতে অনুষ্ঠিত বিংশতিতম
বার্ষিক ট্রেড ইউনিয়ন্স কংগ্রেস একটি স্বতন্ত্র শ্রমিক সংগঠন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিল।
এই উদ্দেশ্যে আহ্বায়িত একটি বৈঠক এই ন্যাশনাল লেবার এসোসিয়েশনের কর্মসূচির রূপরেখা
তৈরি করল। কথা ছিল যে এই ন্যাশনাল লেবার এসোসিয়েশনটি ‘লেবার ইলেক্টোরাল কমিটি’ হিসেবে কাজ করবে। যথাক্রমে, কংগ্রেস নভেম্বর
১৮৮৮এ লন্ডনে আন্তর্জাতিক শ্রম কংগ্রেস আহ্বান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। ইতিহাসে প্রথমবার
সেই কংগ্রেস ভূসম্পত্তির জাতীয়করণের পক্ষে, আট-ঘন্টা শ্রমদিবসের জন্য সংগ্রামের প্রেক্ষিতে
ট্রেড ইউনিয়ন সদস্যদের মধ্যে গণভোট করানোর পক্ষে এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ
করল।”
এর জেরে ১৮৮৭র অক্টোবর-নভেম্বরে
লন্ডনও উত্তাল হয়েছিল। হাজার হাজার শ্রমিক এবং সমাজবাদীরা পথে নেমেছিলেন বেকারি এবং
আয়ারল্যান্ডের প্রশ্নে। নৃশংস পুলিশি হামলায় দুজন প্রদর্শনকারী নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছিলেন।
(আজকাল আন্তর্জালের সুবিধে আছে। ইচ্ছে হলে নিজের মুঠোফোনে সার্চ করুন ‘ব্লাডি সানডে, ইংল্যান্ড, ১৮৮৭; লন্ডনের অবস্থা
জেনে নিতে পারবেন)। এই বিশাল প্রদর্শন আর সমাবেশগুলোর নেতৃত্বে অংশগ্রহণকারী ছিলেন
মার্ক্সের ছোটো মেয়ে ইলিয়ানর এবং তাঁর স্বামী এডোয়ার্ড।
১৮৮৭তেই ১৬ই সেপ্টেম্বর
এঙ্গেলস এডলফ সোর্জকে লিখলেন, “এখানে অনুষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস দেখিয়ে দিল যে পুরোনো ট্রেড
ইউনিয়নগুলোতে একটা বিপ্লব ঘটিত হচ্ছে। নেতাদের এবং … শ্রমিক-সাংসদদের বিরুদ্ধে গিয়ে এই কংগ্রেস স্বতন্ত্র শ্রমিক
দল তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। … ফ্রান্স থেকে এখনো অব্দি কোনো খবর পাইনি, কারোর সঙ্গে দেখাও হয়
নি কেননা লাফার্গ দু’এক সপ্তাহের জন্য
জার্সিতে গেছে। … বেবেলের সঙ্গে আলোচনা
হলেই তোমাকে জার্মানির বিষয়ে জানাবো।”
সমসাময়িক ফ্রান্সের
খবর পল লাফার্গের মাধ্যমেই জানতে পারতেন এঙ্গেলস। কেননা প্যারি কমিউনের পরাজয় ও তৎপরবর্তী
ভয়ানক নির্যাতন ও দমনের এক দশক পর ১৮৮০তে কমিউনের যোদ্ধাদের জন্য রাজনৈতিক ক্ষমা ঘোষণা
করা হয়। পাঠকদের মনে আছে হয়তো যে তারপরেই মার্ক্সের বড় জামাই শার্ল লঙ্গোয়ে স্ত্রী
জেনিকে নিয়ে প্যারিসের শহরতলী আর্জেন্তেলে বসবাস শুরু করতে পারেন। তার পরের এক দশক
ফ্রান্সের তৃতীয় রিপাব্লিকের সরকার একদিকে বিপ্লবী সমাজবাদীদের কোণঠাসা করার এবং অন্যদিকে
নানাভাবে পূঁজিবাদী কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে থেকে সমাজবাদী ভাবনাচিন্তা
নির্মূল করার চেষ্টা চালাতে থাকে। ১৮৮০তেই জুল গ্যেসদে (বা গ্যেদ) এবং পল লাফার্গ ফরাসী
শ্রমিক পার্টি গঠন করেন এবং শ্রমিক-বিপ্লবের শক্তিগুলোকে কোণঠাসা করার সরকারি ও বেসরকারি
(সুবিধেবাদী মধ্যবিত্ত বা পাতি-পূঁজিবাদী শ্রেণী) প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কাজ করতে থাকেন।
বিপ্লবী সক্রিয়তার
সম্ভাবনাকে ভ্রূণেই নিষ্পেষিত করতে পূঁজিবাদী গণতান্ত্রিক সরকারগুলো যা করে, ফরাসি
সরকারও তাই করত। কথায় কথায় জিগির তুলত ‘প্রজাতন্ত্র বিপন্ন’! সেই সূত্রে অক্টোবরের শেষে এঙ্গেলস তির্যক স্বরে পল লাফার্গকে
লেখেন, “প্রজাতন্ত্র ততদিন
বিপন্ন থাকবে যতদিন সৈনিকের হাতে রাইফেল থাকবে কিন্তু শ্রমিকের হাতে থাকবে না।”
জার্মানিতে সমাজবাদীদের
ভিতরে একটা আলোড়ন চলছিল। ১১ই অক্টোবরে লরাকে চিঠিতে লেখেন যে তিনি বেবেলের আসার অপেক্ষায়
আছেন। জার্মানির যে ঘটনাবলী বিস্তারে শোনার জন্য তিনি অপেক্ষায় ছিলেন (পরে এসেছিলেন
বেবেল), সে ঘটনার বর্ণনা সম্পর্কিত পাদটীকায় এভাবে পাওয়া যায়, “২রা থেকে ৬ই অক্টোবর ১৮৮৭, সুইটজারল্যান্ডের
সেন্ট গ্যালেনে সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি অফ জার্মানির কংগ্রেস চলে। উপস্থিত ছিলেন
৭৯জন প্রতিনিধি। কংগ্রেস নিম্নলিখিত প্রশ্নসমূহ আলোচনা করেঃ পার্টির রাইখস্ট্যাগ উপদলের
প্রতিবেদন, রাইখস্ট্যাগে এবং ল্যান্ডট্যাগে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ডেপুটিদের সক্রিয়তা,
সামাজিক ক্ষেত্রে কর এবং বহিঃশুল্ক বিষয়ে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে পার্টির
মনোভাব, বিগত ও আসন্ন নির্বাচনে পার্টির নীতি, আন্তর্জাতিক সোশ্যালিস্ট কংগ্রেস আহ্বায়িত
করা এবং নৈরাজ্যবাদীদের প্রতি মনোভাব। … কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে ১৮৮৮তে, শ্রম আইনসমূহ সংক্রান্ত
বিষয়ে আলোচনা করতে আন্তর্জাতিক শ্রম কংগ্রেস আহ্বায়িত করা হবে।”
অর্থাৎ, প্রায় একই
সময়ে ইংল্যান্ডের ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস এবং জার্মানির সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির
কংগ্রেস আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নিল। প্রথমটি নাম দিয়েছিল শ্রম
কংগ্রেস এবং দ্বিতীয়টি, সমাজবাদী কংগ্রেস। প্রেক্ষিত এক, সারা বিশ্বে আট ঘন্টার শ্রমদিন
সহ বিভিন্ন শ্রম-আইনের পক্ষে সংগ্রাম এবং ঘোষিত উদ্দেশ্যও, দু’দলেরই প্রায় এক, ঐ প্রেক্ষিত-প্রসূত।
এঙ্গেলস বেবেলের
কাছ থেকে হোক বা অন্য সূত্র থেকে হোক, জানলেন যে এ বিষয়ে ইংল্যান্ডের ট্রেড ইউনিয়নসমূহের
সাথীদের সঙ্গে কথা বলার প্রস্তাব এসেছে সেন্ট গ্যালেনের সভায়। তিনি এই ভাবনার প্রশংসা
করে দুই দেশ যাতে যুক্তভাবে আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করে, তার সম্ভাবনা খতিয়ে
দেখতে বললেন। কিন্তু তেমন কিছু হতে পারল না। ওদিকে জার্মান সমাজবাদীরা সময় থাকতে আন্তর্জাতিক
কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করার বিশেষ প্রস্তুতিও নিল না। এঙ্গেলস তাদেরকে সাবধান করেছিলেন যে
তাড়াহুড়োয় সিদ্ধান্ত নিয়ে আধখ্যাঁচড়া কাজ করলে সংস্কারপন্থীদের পক্ষে কংগ্রেসে আধিপত্য
বিস্তার করা সহজ হবে। আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের জন্য যদি প্রস্তুতি নেওয়া হয় তাহলে সেটা
যেন মার্ক্সবাদের বাস্তব ভিত্তিতে হয়; ফরাসি আর জার্মান সমাজবাদীরা মিলেমিশে সেই কংগ্রেসের
আয়োজন করুক। বছর ঘুরতে ঘুরতে দেখা গেল এঙ্গেলসের আশঙ্কা সত্যে পরিণত হচ্ছে। ১৮৮৮র নভেম্বরে
লন্ডনে আন্তর্জাতিক শ্রম কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হল। খুব কম সংখ্যা পোঁছোল শ্রম
সংগঠনগুলো। আর বোধহয় তাই, প্রস্তাব গৃহীত হল যে ফরাসি সমাজবাদীদের মধ্যে থেকে একটি
সংস্কারপন্থী পার্টিকে – যাদেরকে ‘পসিবিলিস্টস’ বলা হত – ১৮৮৯এর জুলাইয়ে প্যারিসে আন্তর্জাতিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত করার
দায়িত্ব দেওয়া হোক। প্রস্তাব জ্ঞাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সংস্কারপন্থী দলটি আরেক সুবিধেবাদী
সংগঠন, সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক ফেডরেশনের সঙ্গে কথা বলে, ১৮৮৯এর জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক
শ্রমিক কংগ্রেসের অধিবেশন আয়োজিত করার প্রস্তুতি শুরু জরে দিল।
মজার ব্যাপার যে
১৮৮৯র জুলাই মাসের সময়টার প্রস্তাব কোনো এক সময় এঙ্গেলসই দিয়েছিলেন। কেননা ১৮৮৯এর জুলাইয়ে
ফরাসি বিপ্লবের শতাব্দী পুরো হওয়ার ছিল। কিন্তু, এবার আয়োজকদের রাজনীতিক চেহারা দেখে
এঙ্গেলস চিন্তিত হয়ে উঠলেন। সব ক’জন সাথীর সঙ্গে – জার্মানিতে বেবেল, লিবনেখট, ফ্রান্সে লাফার্গ – তিনি চিঠির মাধ্যমে কথা বললেন। পসিবিলিস্টদের
নেতাদের সঙ্গে তাদের কথা বলতে বললেন যাতে অধিবেশনে মার্ক্সবাদীদেরও ভূমিকা থাকে, পুরোটাই
সংস্কারপন্থীদের আয়ত্তে না চলে যায়।
কিন্তু সংস্কারপন্থীরা
পুরো প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল অধিবেশনটাকে নিজেদের আয়ত্তে রাখার। তাদের চাতুরি আর কিছুটা
নিজের সাথীদের ঢিলেমিতে ক্ষুব্ধ হয়ে এঙ্গেলস অধিবেশনটাকে ‘অভিশপ্ত’ বলে নিজেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তাঁর জার্মান অনুগামী, বিশেষ
করে বার্নস্টাইনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি রাজনৈতিক প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। দেশে দেশে নিজের
অনুগামী, পরিচিত সমাজবাদী এবং শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তিনি অধিবেশনে তাদের উপস্থিতি
সুনিশ্চিত করলেন। অধিবেশন-সম্পর্কিত সমস্ত দলিল নিজে বসে লেখালেন। ‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদনার কাজ কয়েক মাস বন্ধ থাকল।
অবশেষে, বাস্তিল
কারাগার ভাঙার দিনে একশো বছর পর (১৮৮৯র ১৪ই জুলাই; ২০শে জুলাই অব্দি চলেছিল) প্যারিসে,
একসঙ্গে দুটো অধিবেশন শুরু হল। ফরাসি আর ইংরেজ সংস্কারপন্থীরা যে অধিবেশনের আয়োজন করেছিল
তাতে উপস্থিত হল মাত্র নয়টি দেশের প্রতিনিধি। অন্যদিকে মার্ক্সবাদী নেতৃবৃন্দ আয়োজিত
অধিবেশনে ২০টি দেশ থেকে ৪০৭ জন প্রতিনিধি এসেছিল (এই প্রতিনিধি সংখ্যা এঙ্গেলসের সোভিয়েত
জীবনী থেকে নেওয়া; মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্র বলে ৩৯৩)।
এঙ্গেলস নিজে অধিবেশনে
যান নি। কিন্তু প্রতি মুহূর্তের খবর রাখার চেষ্টা করছিলেন। ১৭ই জুলাই, অর্থাৎ চতুর্থ
দিনে নিউইয়র্কের হোবোকেনে এডলফ সোর্জকে লিখলেন, “আমাদের কংগ্রেস সত্রস্থ এবং প্রত্যক্ষতঃ দারুণ সফল। পরশু অব্দি
৩৫৮ জন প্রতিনিধি এসেছিল, আরো আসছে। প্রায় আদ্ধেক বিদেশি, ৮১ জন জার্মান, শুধু পোসেন
ছাড়া বাকি সবকয়টি বড় আর ছোটো রাজ্য ও প্রদেশ থেকে। প্রথম দিনে প্রথম হলটা খুব ছোটো
পড়েছিল, দ্বিতীয় দিনে দ্বিতীয় হলটা, তখন তৃতীয় হল খোঁজা শুরু হল। … প্রথমবার কয়লাখনি অঞ্চল থেকে স্কটিশ আর জার্মান
খনি-শ্রমিকেরা একসঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য আগে থেকে জড়ো হয়ে যাচ্ছে।
“পসিবিলিস্টদের অধিবেশনে আছে ৮০ জন বিদেশি (৪২ ব্রিটিশ, যার মধ্যে
১৫ জন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশন থেকে আর ১৭ জন ট্রেড ইউনিয়ন থেকে), ৭ জন অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান
(অবশ্যই নিছক লোকদেখানি কেননা সেখানকার প্রকৃত আন্দোলন পুরোটাই আমাদের দিকে), ৭ জন
স্পেনীয়, ৭ জন ইতালীয় (তার মধ্যে ৩ জন বিদেশবাসী ইতালীয় সমাজের), ৭ জন বেলজিয়, ৪ জন
মার্কিন (তাদের মধ্যে ২ জন … আমার সঙ্গে দেখা করেছিল), ২ জন পর্তুগিজ, ১ জন সুইস (স্ব-নামিত),
১ জন পোলিশ। প্রায় সবাই ট্রেড ইউনিয়নপন্থী। এরা বাদে ৪৭৭ জন ফরাসি, যদিও তারা মাত্র
১৩৬টা ট্রেড ইউনিয়ন চেম্বার এবং ৭৭টা সমাজবাদী পাঠচক্র থেকে এসেছে, যেহেতু প্রত্যেকটা
ক্ষুদ্র গোষ্ঠি তিনজন করে প্রতিনিধি পাঠাতে পার। যখন নাকি আমাদের ১৮০ জন ফরাসির প্রত্যেকে
একেকটি বিশেষ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে।
“ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডে চোরা পথে আধিপত্য বিস্তার করার, পসিবিলিস্ট
আর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশনের চক্রান্ত সব দিক থেকে বিফল হয়েছে। নিজেদের আন্তর্জাতিক
নেতা দেখাবার ভন্ডামিও বিফল হয়েছে। পাশাপাশি দুটো কংগ্রেস যদি তাদের শক্তি এক জায়গায়
জড়ো করার উদ্দেশ্যও পুরো করে, … যাতে বিশ্ব দেখতে পায় কোনদিকে প্রকৃত আন্দোলন এক হয়েছে আর কোনদিকে
মেকি, তাহলেই যথেষ্ট।”
এতটা দীর্ঘ উদ্ধৃতি
দিলাম কেননা বোঝা যাবে কতটা ওস্তাদ ‘মেঠো’ সংগঠক ছিলেন তিনি।
তৃণমূল স্তরে রাজনীতির মৌলিক নিয়মগুলো জানতেন!
মার্ক্সবাদীদের নেতৃত্বাধীন
অধিবেশনে এমনকি সেই সব দেশ থেকেও প্রতিনিধি এসেছিল, যেমন নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, বুলগারিয়া,
রুমানিয়া, আর্জেন্টিনা, যেখানে বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন সদ্য শুরু হয়েছিল। অধিবেশন-স্থল
প্ল্যাকার্ডে ভরা ছিল – ‘দুনিয়ার মজুর এক হও’, পূঁজিপতি শ্রেণীর রাজনৈতিক ও আর্থিক অবসান’, ‘উৎপাদনের উপকরণসমূহের জাতীয়করণ’ ইত্যাদি। অধিবেশনের আলোচনায় কথাটা এসেও গেল যে শ্রমের মুক্তি
একমাত্র সর্বহারা শ্রেণীই আনতে পারে – পূঁজিপতিদের শাসনের অবসান ঘটিয়ে এবং উৎপাদনের উপকরণগুলোর জাতীয়করণের
জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করে। আট ঘন্টা শ্রমদিন এবং আন্তর্জাতিক স্তরে শিল্প-শ্রমিকের
অবস্থার উন্নতির জন্য আইনের দাবি জানিয়ে অধিবেশনে আন্তর্জাতিক শ্রমবিধির ভিত্তি রচিত
হল। অধিবেশন সিদ্ধান্ত নিল উপরোক্ত দাবিসমূহের সমর্থনে সব দেশে প্রদর্শন এবং সমাবেশের
মাধ্যমে ১লা মে, ১৮৯০এর তারিখটি উদযাপিত হবে।
বেশ কয়েক বছর পর
লেনিন সেসব দিনগুলোর কথায় লিখলেন, “এঙ্গেলসের বয়স সেসময় ৬৮ বছর; যৌবনের পূর্ণ উৎসাহে তিনি সে-লড়াইয়ে
ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।”
এঙ্গেলস অধিবেশনেও
যান নি, অধিবেশনের সিদ্ধান্তগুলোকে রূপ দিতে কোনো সাহায্যও করেন নি। কয়েক মাসের খাটাখাটনির
শুধু একটাই উদ্দেশ্য ছিল। সুবিধেবাদী এবং সংস্কারপন্থীদের বিরুদ্ধে মার্ক্সবাদী সংখ্যাগরিষ্ঠতা
যেন একজোট হয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়ায় এবং সঠিক পথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বিশ্বের শ্রমজীবীদের
সামনে পেশ করতে পারে। তাঁর মূল্যায়নে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত ছিল সব দেশে পয়লা মে উদযাপন
করার সিদ্ধান্ত। ২৭শে আগস্ট তিনি লরাকে লিখলেন, “অধিবেশনে সবচেয়ে ভালো কাজ হল এটাই।”
অধিবেশন আনুষ্ঠানিক
ভাবে নতুন আন্তর্জাতিক সংগঠন বানানোর কোনো সিদ্ধান্ত নিল না। এঙ্গেলসও চাইছিলেন যে
আগে দেশে দেশে আন্দোলন আরেকটু এগোক। তবে, সাধারণ পরম্পরা অনুসারে, অধিবেশন শেষ করার
আগে পরবর্তী অধিবেশন কোথায় এবং কবে হবে তার একটা সিদ্ধান্ত হয়। সেটা হল না, আর এঙ্গেলস
ব্যাপারটা সমালোচনাও করলেন। কিন্তু, যেটা পরে লেনিনও নোট করেছিলেন যে অধিবেশন, “প্রত্যেকটি প্রয়োজনীয় বিষয়ে মার্ক্সবাদী দৃষ্টি
গ্রহণ করল”, তাঁকে সবচেয়ে বেশি
আশ্বস্ত করেছিল।
প্রথম আন্তর্জাতিক
মে-দিবস
এঙ্গেলস আবার ডুবে
গেলেন ‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদনায়। পাশাপাশি প্রথম
খণ্ডের চতুর্থ জার্মান সংস্করণের সম্পাদনাও চলতে লাগল। মার্কিন দেশে সফর এবং হালফিলের
উৎসাহজনক ঘটনাগুলোর ভালো প্রভাব পড়েছিল তাঁর শরীরের আর মনের ওপর। ১৮৯০এর ৯ই জানুয়ারি
ভাইকে লিখলেন, “যখন বলি যে আমার
বয়স সত্তর চলছে, ডাক্তাররাও বিশ্বাস করেন না। … তাঁরা বলেন দশ-পনের বছর কম মনে হচ্ছে আমার বয়স।” আর সত্যিই, তাঁর কর্মতৎপরতা দেখে লোকে অবাক
হয়ে গেল। দু-দুটো গ্রন্থের সম্পাদনার পাশাপাশি তিনি সারাদিনে জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি,
ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশ থেকে প্রচুর সংখ্যায় আসতে থাকা রাজনৈতিক
সাহিত্যগুলো পড়তেন। খবরের কাগজে লেখালিখি আবার শুরু করলেন। রাশিয়ার নিকোলাই ড্যানিয়েলসনকে
১৮৮৯র ১৪ই ডিসেম্বর পল লাফার্গ একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠির অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছিঃ
“এঙ্গেলসের চোখের অসুখ এখনো রয়েছে তবে মনে হয়, যে সাবধানতা অবলম্বন
করে চলছেন, চোখদুটোর অবস্থা খারাপের দিকে যায় নি, ক্রমে ভালো হচ্ছে। নিজের বিষয়ে কথা
বলা তিনি পছন্দ করেন না। তৃতীয় ব্যক্তিদের মুখে আমি তাঁর স্বাস্থ্যের কথা জানতে পারি।
সৌভাগ্যের কথা, স্বাস্থ্যের অবস্থা সন্তোষজনক।
“তিনি এখন তৃতীয় খণ্ড নিয়ে কাজ করছেন। কাউটস্কি তাঁকে সাহায্য করছেন।
তুমি উইলিয়ামের” [মার্ক্সের আরেকটি
ছদ্মনাম] “কোঁকড়ানো হাতের-লেখার
সঙ্গে পরিচিত। পান্ডুলিপিগুলোয় সে লেখা আরো খারাপ, যেহেতু তাতে সংক্ষিপ্তি আছে যেগুলো
আন্দাজ করতে হয়, কাটাকুটি আর অসংখ্য সংশোধন আছে যেগুলোর অর্থোদ্ধার করতে হয়। প্রাচীন
গ্রিসীয় লিখনের নিচের ঘষে-মুছে-ফেলা যুক্তাক্ষর সমন্বিত লেখা পড়ার মত কঠিন। কাউটস্কি
পান্ডুলিপিটা পুরো পড়ে একটা নকল তৈরি করে, যেটাকে এঙ্গেলস অন্যান্য পাণ্ডুলিপির সঙ্গে
মিলিয়ে যাচাই করেন। …
“এঙ্গেলস সদ্য তাঁর উনসত্তরতম জন্মদিন পার করেছেন এবং আমাকে যেমন
লিখেছেন, সংখ্যাটা উল্টে দিলেও উনসত্তরই থাকে” [ইংরেজি 69] “আমি বলেছি নিরানব্বই অব্দি অপেক্ষা করুন, তখন উল্টোলে ছেষট্টি দেখাবে” [99><66] “ব্যাপারটা অসাধারণ যে তিনি একদিকে উইলিয়ামের
রচনাগুলোর প্রকাশনার জন্য কাজ করতে সক্ষম আর অন্যদিকে ইয়োরোপ আর এমেরিকার সবকয়টি দেশের
সঙ্গে ব্যাপক স্তরে পত্রালাপ চালিয়ে যাচ্ছেন! আমি জানি না আপনাকে তিনি রুশীয় ভাষায়
লেখেন কিনা। রুশীয় পড়েন তো গড়গড় করে। তবে যে লোকটিকে চিঠি লিখছেন, বলেন লিখবেনও তারই
ভাষায়। তিনি যথার্থ বহুভাষী এবং শুধু সাহিত্যিক ভাষা নয়, আইসল্যান্ডিকের মত উপভাষাগুলোও
জানেন। প্রভেঙ্কাল ও ক্যাটালানের মত প্রাচীন ভাষাগুলোও। এসব ভাষার জ্ঞান অগভীরও নয়।
স্পেনে আর পর্তুগালে গিয়ে শুনেছি সেখানকার বন্ধুরা বলছেন, তাঁদের কাছে লেখা চিঠিগুলো
নিখুঁত স্পেনীয় আর পর্তুগিজ ভাষায় লেখা। আর ইতালীয়তে যে লেখেন তা আমিই জানি। সাদৃশ্যে
ভরা এই তিন ‘বোন-ভাষা’য়, না গুলিয়ে ফেলে লেখার চেয়ে দুরূহতর কিছু
নেই। এঙ্গেলস অবশ্য এক অসাধারণ মানুষ। আমি কখনো এমন মেধা দেখি নি যা এত তারুণ্যময়,
এত চটপটে আর যেটি বিশ্বকোষের মত এত জ্ঞানে ভরা। যখন ভাবি যে কুড়ি বছর লোকটা ম্যাঞ্চেস্টারের
এক বাণিজ্য সংস্থায় আইনি পরামর্শদাতার কাজ করেছে, অবাক হই মাথায় এত জ্ঞান জড়ো করার
সময় সে পেল কখন। যখন নাকি বলতেই হয়, শরীরে খুব লম্বা হলেও তার মাথাটা খুব বড় নয়।”
আর, তারুণ্যময় হবেন
না-ই বা কেন? ১৮৯০এর ফেব্রুয়ারিতে আরেকটি ভালো খবর এল – ২০শে ফেব্রুয়ারিতে সম্পন্ন জার্মানির সংসদীয়
নির্বাচনে সামাজিক-গণতন্ত্রীদের বিরাট জয়। এঙ্গেলসের ভরসা ছিল যে তারা জিতবে। বিগত
বছরগুলোয় তিনি নিয়মিত জার্মানির পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করছিলেন।
একেকটি ঘটনার সূত্র জুড়ে তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে বিসমার্কের সরকার দ্রুতগতিতে তার
জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে এবং জনতার ভিতরে সামাজিক-গণতন্ত্রীদের প্রভাব বাড়ছে। নির্বাচনে
তাঁর কৌতূহল এত বেশি ছিল যে বেবেলকে এক বিশেষ সাংকেতিক ভাষায় তিনি সেদিন ঘন্টায় ঘন্টায়
টেলিগ্রাম করতে লিখেছিলেন। স্থানীয় ডাকঘরে গিয়েও বলে এসেছিলেন যে দিন হোক অথবা রাত,
টেলিগ্রাম এলেই যেন তাঁকে পৌঁছে দেওয়া হয়। ফলাফল তাঁর প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি ভালো
হল। সামাজিক-গণতন্ত্রী প্রত্যাশীদের পক্ষে প্রায় পনের লক্ষ ভোট পড়ল এবং তার পঁয়তিরিশটা
আসনে জয়লাভ করল। সামাজিক-গণতন্ত্রীরা কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলো থেকেও ভোট পাওয়ায় এঙ্গেলস
আরো বেশি প্রভাবিত হলেন; বললেন বিসমার্ক যুগের সমাপ্তির প্রারম্ভ। আর সত্যিই, ২০শে
মার্চ তারিখে বিসমার্ক ইস্তফা দিতে বাধ্য হল।
মে মাস এসে গেল।
আন্তর্জাতিক সমাজবাদী কংগ্রেসের অধিবেশনের আহ্বান অনুসারে ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া,
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক দেশে ১লা মে, ১৮৯০এর তারিখটা উদযাপন করা হল। ইংল্যান্ডে
বড় করে তেমন আয়োজন ১লা মে’তে সম্ভব ছিল না
তাই পরবর্তী রবিবার, অর্থাৎ ৪ঠা মে’তে বড় সমাবেশ করার জন্য হাইড পার্কে জায়গা সংরক্ষিত করা হয়েছিল।
ফলে, পয়লা মে তারিখে তিনি বাড়িতেই ছিলেন। ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’এর চতুর্থ জার্মান সংস্করণের কথামুখ লিখছিলেন। “ঘোষণাপত্র কিছু পরিমাণে ১৮৪৮ সালের পরের আধুনিক
শ্রমিক শ্রেণীর ইতিহাসকে প্রতিফলিত করে। আজ নিঃসন্দেহে এই পুস্তিকা, সমাজবাদী সাহিত্যের
সবচেয়ে ব্যাপক স্তরে প্রচারিত, সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক উৎপন্ন – সাইবেরিয়া থেকে ক্যালিফোর্নিয়া অব্দি সবকয়টি
দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের সাধারণ কর্মসূচি।”
লন্ডনে ১লা মে’র কার্যক্রমের (৪ঠা মে’তে আয়োজিত) গুরুত্ব ছিল কেননা ইংল্যান্ডে পূঁজিবাদী
শিল্পের অগ্রগতি বাকি সব দেশের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। ৪ঠা মে’র ঘটনাগুলো বর্তমান লেখকেরই একটি প্রবন্ধে
বিধৃত আছে। সেখান থেকে তুলে নিচ্ছিঃ
“ … একটা গল্প আছে। ইলিয়ানর (টুসি, মার্ক্সের
ছোট মেয়ে) এবং তার স্বামী এডোয়ার্ড লন্ডনে গ্যাস ও অন্যান্য শ্রমিকদের মধ্যে লড়াকু
ইউনিয়ন তৈরি করে সমাজবাদী প্রচারপ্রসারের কাজ করছিলেন। ইলিয়ানর তো এত জনপ্রিয় নেত্রী
হয়ে উঠেছিলেন যে তাঁকে শ্রমিকেরা মা বলে সম্বোধন করতে শুরু করেছিল। এবার যখন সিদ্ধান্ত
হল যে লন্ডনে মে দিবস এক তারিখে নয়, চার তারিখে বড় সভা করে হবে সে সিদ্ধান্তের বড় অংশীদার
ছিল সংস্কারপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলো। তারা আগেভাগে পৌরসভার দপ্তরে গিয়ে বেশির ভাগ জায়গার
দখল নিয়ে নিল। ওখানে, এবং আমেরিকাতেও তখন মঞ্চ গড়ে সভা হত না। বড় চাকাওয়ালা উঁচু টানা-গাড়ি
থাকত, ওয়াগনকার্ট বলা হত, সেগুলো জায়গা মত দাঁড় করিয়ে দেওয়া হত। বেশির ভাগ জায়গা মানে,
ওয়াগনকার্ট লাগানো সভাস্থল সংরক্ষিত করে নিল সংস্কারপন্থীরা। ইলিয়ানর এবং অন্যান্যদের
নেতৃত্বে লড়াকু ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা গিয়ে দেখলেন সব আগেই সংরক্ষিত। অনেক ঝগড়াঝাঁটি
হল। কিছু করার ছিল না। বাকি থাকা কিছুটা জায়গায় ওয়াগনকার্ট লাগানোর ব্যবস্থা করে তাঁরা
নিজেদের নামে সংরক্ষিত করালেন। ৩০শে এপ্রিল ১৮৯০ এঙ্গেলস সোর্জকে লিখলেন, ‘একমাত্র টুসি আর এভেলিংএর দৌলতে আসছে রোববার, লন্ডনে আট ঘন্টা
শ্রম-দিনের দাবীতে বিশাল প্রদর্শন-সমাবেশ হবে।’
৪ঠা মে সকাল থেকেই এঙ্গেলস আনন্দে মাতোয়ারা
ছিলেন। মার্ক্সের স্বপ্ন সফল হচ্ছে। যে স্লোগান তাঁরা কম্যুনিস্ট লীগ গঠন করার সময়
তৈরি করেছিলেন, ঘোষণাপত্রের মাথায় যে স্লোগান লেখা হল, ‘দুনিয়ার শ্রমিক এক হও!’ – আট ঘন্টা শ্রম-দিনের দাবিতে পয়লা মে আন্তর্জাতিক
শ্রমিক দিবস উদযাপনের মধ্যে দিয়ে সে স্লোগান প্রথম রূপায়িত হচ্ছে। সভায় যাওয়ার জন্য
অনেক আগে থেকেই তৈরি হলেন। বরং ওনার মুখেই শুনি সেদিনকার কথা। ৯ই মে অগাস্ট বেবেলকে
উনি লিখলেনঃ
“‘পূঁজিবাদী প্রেসকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে
এখানে ৪ঠা মে’র প্রদর্শন একেবারে অভিভূত করে দেওয়ার মত ছিল।
আমি ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে (একটা ভারি মালগাড়ি) ছিলাম এবং ভীড়ের মাত্র একটা অংশই – পাঁচ ভাগের বা ধর আট ভাগের এক ভাগ – দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু যদ্দূর চোখ যাচ্ছিল, এক বিশাল সমুদ্র
ছিল মানুষের মুখের। আড়াই লক্ষ থেকে তিন লক্ষ লোক, তার চার ভাগের তিন ভাগই প্রদর্শনকারী
শ্রমিক। এভেলিং, লাফার্গ আর স্তেপন্যাক আমার প্ল্যাটফর্ম থেকে বলল। আমি নিজে শুধু দর্শক
ছিলাম। লাফার্গ, ফরাসি ধাঁচে বলা তার সুন্দর ইংরেজি আর দখিনা উদ্দীপনার জন্য প্রচুর
তালি কুড়োল। তালি কুড়োল স্তেপন্যাকও। ওদিকে এডকে, যে টুসির প্ল্যাটফর্মে ছিল দারুণভাবে
স্বাগত জানাল জমায়েত।
‘সাতটা প্ল্যাটফর্মের প্রত্যেকটা একে অন্যের
থেকে ১৫০ মিটার দূরত্বে ছিল। শেষেরগুলো পার্কের কিনার থেকে ১৫০ মিটার জায়গা ছেড়ে ছল।
কাজেই আমাদের সভার (আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন করে আট ঘন্টার শ্রম-দিন বলবৎ করার পক্ষে)
মোট জায়গা ছিল লম্বায় ১২০০ মিটার আর চওড়ায় ৪০০-৫০০ মিটার। পুরো জায়গাটা ঠাসাঠাসিভাবে
ভরা ছিল। তার পরে ছিল ট্রেডস কাউন্সিলের ছ’টা প্ল্যাটফর্ম আর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশনের দুটো প্ল্যাটফর্ম।
কিন্তু শ্রোতাদের সংখ্যা আমাদের আদ্ধেকও ছিল না।
‘সব কথার শেষ কথা, এখানে আজ অব্দি আয়োজিত সবচেয়ে
বড় সভা ছিল এটা। তার ওপর, বিশেষ করে আমাদের বিরাট জয় নিহিত ছিল এ সভায়। তুমি ভোক্সব্লাটএ
এডের রিপোর্টে পড়ে থাকবে। ট্রেডস কাউন্সিল আর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশন ভেবেছিল
এদিন আমাদের পার্ক থেকে বাইরে রাখবে, করেও ফেলেছিল তেমনটাই। কিন্তু তারা ধোঁকা খেয়ে
গেল। এভেলিং কমিশনার অফ পাব্লিক ওয়র্ক্সকে বাধ্য করল আমাদেরকেও সাতটা প্ল্যাটফর্ম দিতে।
যদিও সেটা নিয়মবিরুদ্ধ। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ টোরিরা ক্ষমতায় ছিল এবং এভেলিং ওদের ভয়
দেখাতে সফল হল যে জায়গা না দিলে আমাদের লোকেরা অন্যদের প্ল্যাটফর্মে জবরদস্তি ঢুকে
পড়বে। আর শেষ অব্দি, আমাদের সভাটাই হল সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে সংগঠিত আর সবচেয়ে বেশি উৎসাহে
ভরা। জমায়েতের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আট ঘন্টার শ্রমদিনের পক্ষে। এভেলিং, এবং তার
থেকেও বেশি টুসি পুরো ব্যাপারটা সংগঠিত করেছে। আন্দোলনে ওদের জায়গা এখন আগের থেকে সম্পূর্ণ
ভিন্ন। গ্যাসশ্রমিক এবং সাধারণ শ্রমিকদের ইউনিয়ন, নতুন ধরণের কাজের শ্রমসঙ্ঘগুলোর মধ্যে
সবচেয়ে ভালো। ওরা এ দুজনকে সমর্থন করে এবং ওদের ছাড়া আজকের ব্যাপারটা হত না। এবার আমাদের
দায়িত্ব হবে আমাদের আজকের সভা সংগঠিত করা কমিটিটাকে – ট্রেড ইউনিয়ন এবং র্যাডিক্যাল ও সোশ্যালিস্ট ক্লাবের প্রতিনিধিদের
– একজোট রাখা এবং এদেরকে নিয়েই এখানে আন্দোলনের
কেন্দ্র গড়ে তোলা।’
“চিঠির শেষে লিখলেন,
‘মার্ক্সকে এই জাগরণ দেখাতে আমি আমার সমস্ত
কিছু ত্যাগ করতে পারতাম! … ওই পুরোন মালগাড়িটা থেকে নামার সময় আমার মাথা
দু’ইঞ্চি উঁচু হয়ে গিয়েছিল।’
৪ঠা মে’র প্রদর্শন নিয়ে এঙ্গেলস একটি রিপোর্ট লিখলেন আর্বেইটার জাইটুংএ।
প্রথমেই লিখলেন, ‘মে দিবসের আয়োজন
করে সর্বহারা এক নতুন যুগের নির্মাণ করেছে। শুধু এ কারণে নয় যে এ দিনটার চরিত্র বিশ্বজনীন।
এ কারণেও শুধু নয় যে এই আয়োজন লড়াকু শ্রমিক শ্রেণীর প্রথম আন্তর্জাতিক সক্রিয়তা ছিল।
বরং এ কারণে যে বিভিন্ন দেশকে এক এক করে দেখলে বোঝা যায়’ [মে দিবসের আয়োজন সেখানকার শ্রমিক আন্দোলনে]
‘গুরুত্বপূর্ণ প্রগতিকে
চিহ্নিত করছে।’”
৭০তম জন্মদিন, ব্রাসেলসের আন্তর্জাতিক অধিবেশন এবং এরফুর্ট কর্মসূচি
হেলেন ডেমুথের মৃত্যু
কাজের চাপে এঙ্গেলস
আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তাররা অবিলম্বে তাঁকে লন্ডন ছেড়ে কোনো অন্য জায়গায়, ভালো
আবহাওয়ায় গিয়ে গ্রীষ্মকালটা কাটাবার পরামর্শ দিলেন। ১লা জুলাই তিনি আর স্কোর্লেমার
বাষ্পশক্তিতে চলা একটি বড় নৌকোয় সামুদ্রিক সফরে বেরিয়ে পড়লেন। তিন সপ্তাহের বেশি সময়কাল
ধরে চলল সে-সফর। নরওয়ের পশ্চিমী তটরেখা ধরে চলতে চলতে সে-নৌকো উত্তরে সবচেয়ে দূরের
জায়গা নর্থ কেপ অব্দি গিয়ে ফিরে এল। এবারও সফরটা গোপন রাখা হল কেননা জার্মান জাহাজগুলো
নরওয়ের বন্দরে দাঁড়িয়েছিল আর তার মধ্যে একটায় ছিল প্রাশিয়ার রাজা উইলহেল্ম।
সফরের দিনগুলো ভরপুর
আনন্দে কাটালেন এঙ্গেলস। বন্দরগুলোয় নেমে নরওয়েবাসীদের জীবনযাত্রা দেখলেন। ফিরে এসে
দেখলেন যে তাঁর ভাড়াবাড়ির মালিক পাল্টে গেছে আর নতুন মালিক বাড়িটা রং করাচ্ছে। ফলে
আরো একমাস ইংল্যান্ডের সমুদ্রতীর ফকস্টোনে কাটালেন।
যথেষ্ট সুস্থ হয়ে
ফিরে, পুরো কর্মশক্তি নিয়ে তিনি আবার কাজে লেগে গেলেন। সবচেয়ে আগে এক এক করে গত দু’মাসে আসা সবকয়টি চিঠির জবাব দিলেন। যেমন তাঁর
অভ্যাস ছিল, কোনো চিঠির জবাব না দিয়ে তিনি থাকতেন না আর কয়েকটি বাদ দিয়ে, সব প্রেষকের
প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর ও সংশয়ের নিরসন বিশদে লিখে তিনি জবাব দিতেন। নিজের মনে প্রশ্ন
এলেও খোলাখুলি আলোচনা করতেন সাথীদের সঙ্গে। মার্ক্স ও এঙ্গেলসের চিঠিগুলো তাই সমসাময়িক
বিশ্ব-ইতিহাসের, বিভিন্ন দেশে ঘটতে থাকা রাজনৈতিক ঘটনাবলির মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণের
রত্ন-ভান্ডার।
দু’তিনটে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ
করার ছিল। সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলো রচনাসমগ্রে আছে। তার মধ্যে একটার উল্লেখ একটু বিস্তারে
গিয়ে করা জরুরি। বিষয়টা হল ১৮৮৯এর পর ১৮৯১এ আন্তর্জাতিক অধিবেশন আয়োজিত করার প্রস্তুতি।
পাঠকেরা নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন যে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে দুটো আন্তর্জাতিক শ্রমিক অধিবেশন
হয়েছিল। মার্ক্সবাদীদের নেতৃত্বে হওয়া অধিবেশন বেশি সফল হয়েছিল কিন্তু তারা একটা ভুল
করেছিল যে পরবর্তী অধিবেশনের জায়গা আর তারিখ নিয়ে কোনো আলোচনা করে নি, সিদ্ধান্তও নেয়
নি। এবার ফরাসি পসিবিলিস্টস এবং সুবিধেপন্থীরা বেলজিয় শ্রমিক পার্টির সঙ্গে কথা বলে
তাদেরকে ব্রাসেলসে আন্তর্জাতিক অধিবেশন করার অনুরোধ জানালো। বেলজিয় শ্রমিক পার্টি প্রস্তাব
স্বীকার করে ১৮৯১ সালে ব্রাসেলসে আন্তর্জাতিক অধিবেশন করার ঘোষণা করল এবং ইংল্যান্ডের
ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে আমন্ত্রণ জানালো। ইংল্যান্ডের ট্রেড ইউনিয়ন, বিশেষ করে নতুন ট্রেডইউনিয়নগুলো
যারা গত বছরের ৪ঠা মে’র সমাবেশে সবচেয়ে
বেশি সংখ্যায় উৎসাহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছিল, সহর্ষে স্বীকার করল আমন্ত্রণ। এঙ্গেলস
খবরটা পেয়ে সম্ভাব্য বিপদের সংকেত পেলেন। ফলে আবার হস্তক্ষেপ করলেন।
ঐ ট্রেড ইউনিয়নগুলোর
জন্য আমন্ত্রণ স্বীকার করা স্বাভাবিক ছিল, কেননা প্রথমবার তারা কোনো আন্তর্জাতিক মঞ্চে
যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছিল। ভুল তো ছিল জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড অথবা অন্য দেশের সমাজবাদী,
বিশেষ করে যারা মার্ক্সবাদী তাদের, যে তারা বসে রইল। এখন একটাই সম্ভাবনা অবশিষ্ট রইল
যে পসিবিলিস্ট বা সুবিধেপন্থী আয়োজকেরা এই সমাজবাদী এবং মার্ক্সবাদী দলগুলোকেও আমন্ত্রণ
জানাবে। কিন্তু সে-ক্ষেত্রেও – এঙ্গেলস এই প্যাঁচগুলো ভালো করে জানতেন – এমনভাবে জানাবে যাতে অংশগ্রহণ করা সম্ভব না
হয়। আর তাহলে সংবাদ-মাধ্যমগুলোয় খবর যাবে যে আয়োজকেরা ঐক্যের প্রচেষ্টা করেছিল কিন্তু
মার্ক্স-এঙ্গেলসের অনুগামী সমাজবাদীরাই সে প্রচেষ্টা বিফল করল। তখন আর আলাদাভাবে সমান্তরাল
কোনো অধিবেশন করানোও সম্ভব হত না – ভাবমুর্তি নষ্ট হত, বলা হত যে এরাই শ্রমিক-ঐক্যে ভাঙন ধরাচ্ছে।
সাধারণ শ্রমজীবীদের ওপর ব্যাপারটার খারাপ প্রভাব পড়ত।
এঙ্গেলস অবিলম্বে
জার্মানি আর ফ্রান্সে নিজের সাথীদের চিঠি লিখলেন। তাঁর কৌশল ছিল, এক্ষুনি যাও, আয়োজকদের
সঙ্গে নিজেদের মত করে যোগাযোগ কর এবং একীকৃত অধিবেশনের কথা বল। একীকরণএর শর্ত কী কী
হতে পারে তাও লিখে দিলেন। চিঠির পাশাপাশি একটি দীর্ঘ নোটও এবিষয়ে তৈরি করলেন যা এঙ্গেলসের
পাণ্ডুলিপিসমূহে পাওয়া গিয়েছে এবং এখন রচনাসমগ্রে প্রকাশিত।
ভবিষ্যতে তাঁর পরামর্শ
অনুসারে কাজ হল। আয়োজকেরাও একীকৃত অধিবেশনের প্রস্তাব স্বীকার করল। তখন এঙ্গেলস পরামর্শ
দিলেন যে অধিবেশনে জার্মান সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক পার্টির যে প্রতিনিধিরা যাবেন তাঁরা
যেন ইয়োরোপের সব সমাজবাদী পার্টিগুলোর সেই সমস্ত প্রতিনিধিদের ডেকে একটি প্রারম্ভিক
সম্মেলন আহ্বান করেন যাঁরা আন্তর্জাতিক অধিবেশনে যাবেন। সেই সম্মেলনে এই একীকৃত অধিবেশনের
পক্ষে অভিমত গঠন করে। সেটাও হল। হ্যাল-এ (জার্মানি) অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ব্রাসেলস
অধিবেশনকে একীকৃত অধিবেশন রূপে সফল করার সর্বসম্মত অভিমত গঠিত হল।
এঙ্গেলসের ভরসা ছিল
যে অধিবেশনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাঁদের, অর্থাৎ মার্ক্সবাদের অনুগামী, বিপ্লবী সমাজবাদীদেরই
থাকবে এবং যাবতীয় সিদ্ধান্তগ্রহণকে প্রভাবিত করবে।
……
৪ঠা নভেম্বর হেলেন
ডেমুথ, দুই পরিবারের সবার প্রিয় ‘লেঞ্চেন’ বা ‘নিম’ মারা গেলেন। পশ্চিম জার্মানির সারল্যান্ড রাজ্যের এক কৃষক পরিবারের
মেয়ে হেলেনকে, কিশোর-বয়সেই রেখে নিয়েছিল ওয়েস্টফ্যালেন পরিবার (মার্ক্সের স্ত্রীর পৈত্রিক
পরিবার)। ১৮৪৩ সালে বিয়ে হওয়ার দু’বছর পর ১৮৪৫ সালে, মার্ক্স আর জেনিকে জার্মানি ছেড়ে ব্রাসেলসে আসতে
হয়েছিল। সে সময় জেনির কোলে ছিল জেনি ক্যারোলিন (জেনিচেন) আর পেটে ছিল লরা। তখনই জেনির
মা বাড়ি থেকে হেলেনকে ব্রাসেলসে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জেনি থেকে ছ’বছর ছোটো ছিলেন হেলেন।
সেদিন থেকে নিয়ে
মার্ক্সের মৃত্যু অব্দি আটতিরিশ বছর হেলেন, মার্ক্স পরিবারের গৃহ-পরিচারিকা – কার্যতঃ কর্ত্রী, পারিবারিক বন্ধু এবং সবচেয়ে
কাছের রাজনৈতিক বিশ্বাসপাত্র হয়ে ছিলেন। মার্ক্সের মৃত্যুর পর ঘর খালি হয়ে গেল; ইলিয়ানর
স্বামীর সঙ্গে অন্য বাড়ি নিয়ে নিলেন। ফলে এঙ্গেলসও পুরোপুরি একা রয়ে গেলেন। তাই হেলেনকে
নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন এঙ্গেলস। এখানে এসেও গৃহকর্ত্রী হয়ে গেলেন। পাম্পস বড় হচ্ছিল,
তার অভিভাবক হয়ে উঠলেন। নিকটতম রাজনৈতিক বিশ্বাসপাত্র তো প্রথম থেকেই ছিলেন। এখন মার্ক্সের
পাণ্ডুলিপি ও বইপত্র, দলিল ইত্যাদি সাজাতে এঙ্গেলসের সাহায্য করতে লাগলেন। দুজনে একই
বয়সের ছিলেন তাই দুজনেরই নিঃসঙ্গতা কাটত। খুব বেশি লেখাপড়া জানতেন না হেলেন। কিন্তু
অবসর পেলেই বসে জোরে জোরে আউড়ে বই পড়তেন। রাতে নিজের ঘরে বসে, বা কখনো চিঠি লিখতে লিখতে
এঙ্গেলস হেলেনের পড়ার আওয়াজ শুনতেন। হেলেনের ক্যান্সার হয়েছিল। মৃত্যুর পর তাঁকে, মার্ক্সের
ইচ্ছানুসারে, হাইগেটে মার্ক্সের কবরের পাশে কবরস্থ করা হল।
হেলেনের মৃত্যুর
পরের দিন এঙ্গেলস সোর্জকে লিখলেন, “আজ আপনাকে একটি দুঃখের খবর জানাতে হবে। আমার ভালো, প্রিয় আর বিশ্বস্ত
লেঞ্চেন, কিছুদিনের সংক্ষিপ্ত ও অধিকাংশতঃ কষ্টহীন অসুস্থতার শেষে গতকাল বিকেলে শান্তভাবে
ঘুমিয়ে পড়েছে। এবাড়িতে আমরা একসাথে সাত বছর আনন্দে কাটিয়েছি। ১৮৪৮এর আগের দিনগুলোর
সংগ্রামসঙ্গীদের মধ্যে শুধু আমরা দুজনেই বেঁচে ছিলাম। এখন আবার আমি একা। আমি গত সাত
বছর যেমন শান্তিতে কাজ করেছি, তেমনই শান্তিতে মার্ক্স যে অনেকগুলো বছর ধরে কাজ করতে
পেরেছিল, বিরাট পরিমাণে তা হেলেনের জন্য। কিকরে চালাবো জানি না। আরেকটা জিনিষ যা কষ্টদায়কভাবে
হারাবো সেটা হল পার্টির ব্যাপারে তার বিষ্ময়কর কৌশলী পরামর্শ।”
হেলেনের মৃত্যুর
পর এঙ্গেলসকেই তার ইষ্টিপত্র কার্যকর করতে হত। ইষ্টিপত্র এটুকুই ছিল যে মৃত্যুর পর
তাঁর সঞ্চিত অর্থ তাঁর দত্তক পুত্র ফ্রেডরিক লুইস ডেমুথকে দিয়ে দেওয়া হোক। হেলেনের
মৃত্যুর এবং এই ইষ্টিপত্রের খবর দেওয়ার জন্য এঙ্গেলস ১২ই নভেম্বর হেলেনের এক ভাইপো
অ্যাডলফ রীফারকে চিঠি লিখলেন। চিঠিতে অন্যান্য কথা যা লেখার সাথে সাথে এটাও লিখলেন
যে, “আমরা ১৯৪৫ সাল থেকে
বন্ধু ছিলাম। যখন আমার বন্ধু কার্ল মার্ক্সের মৃত্যুর পর তিনি আমার গৃহস্থালির দায়িত্ব
নিয়ে আমায় সম্মানিত এবং প্রসন্ন করলেন, সেদিন থেকে আমার জীবনের অনেক বছরের প্রশান্তি
ও পরিতোষের পর্ব শুরু হল। বস্তুতঃ এমন গার্হস্থ্য আনন্দ আমি ১৮৭৮ সালে আমার স্ত্রীর
মৃত্যুর পর আর পাই নি। কিন্তু সেসমস্ত কিছু চিরকালের জন্য শেষ হয়ে গেল। … আমি এবং মার্ক্সের মেয়েরা ছাড়াও, নানান জাতির
হাজার হাজার বন্ধু – সে এমেরিকার প্রান্তরে
থাকুক বা সাইবেরিয়ার কারাগারে, অথবা ইয়োরোপের সব দেশে – তাঁর মৃত্যুতে শোকাকুল।”
চিঠিতে ইষ্টিপত্র
সম্পর্কে যে কথাটা লেখা আছে সেটাও উদ্ধৃত করছি, “মৃতক একটি ইষ্টিপত্র করেছিলেন যাতে নিজের একমাত্র উত্তরাধিকারী
করেছিলেন ফ্রেডরিক লুইস নামে এক ব্যক্তিকে। ফ্রেডরিক লুইস তাঁর মৃত বন্ধুর পুত্র, যাকে
তিনি শৈশবেই দত্তক নিয়েছিলেন এবং লালনপালন করে একজন ভালো, পরিশ্রমী মেকানিক বানিয়েছিলেন।
সে ব্যক্তি, তাঁর দত্তক-মায়ের অনুমতিক্রমে অনেক বছর আগেই ডেমুথ পদবি গ্রহণ করেছিলেন
এবং সেই নামেই ইষ্টিপত্রে নামিত আছেন। … ইষ্টিপত্রের অনুবাদের একটি নকল সংলগ্ন।”
৭০তম জন্মদিন
কঠোর বাস্তব ছিল
যে নিজের ৭০তম জন্মদিনের কয়েকদিন আগে হওয়া হেলেনের মৃত্যুতে এঙ্গেলস একেবারে নিঃসঙ্গ
হয়ে পড়েছিলেন। বুঝতে পারছিলেন এই নিঃসঙ্গতা বাকি জীবনে বয়ে বেড়াতে হবে; কাছাকাছি সমবয়সী
সাথী বলতে কেউ রইল না। কিন্তু পাশাপাশি একটা ব্যবহারিক সমস্যাও ছিল। বাড়ির কাজকর্মের
জন্য পরিচারিকা তো লন্ডনে পেয়ে যাবেন, কিন্তু তিনি কেমন মানুষ হবেন? সারা ঘরে রাখা
কাগজ, বই, দলিল, পাণ্ডুলিপিগুলোর মূল্য কি তিনি বুঝবেন? ছড়িয়ে থাকলে সাজিয়ে গুছিয়ে
তুলে রাখবেন, না …? বিভিন্ন দেশ থেকে
সাথীরা আসেন, তাদের সঙ্গে সেই রাজনীতির কথা হবে যে রাজনীতির চিহ্ন মুছতে তৎপর অধিকাংশ
দেশের গুপ্তচর-পুলিস – সেই কথাবার্তার
প্রতি সে-মহিলার মনোভাব কেমন হবে? আর যদি বিরূপ হয়, তার প্রতি নজর রাখবে কে? যদি এঙ্গেলসকেই
রাখতে হয়, তাহলে কাজ হবে কিভাবে?
হেলেন ডেমুথের মৃত্যুর
পর এইসব চিন্তার মাঝেই অসংখ্য শোক-সমবেদনার বার্তা আসছিল। তারই একটা ছিল লুইসা স্ট্রেসারের
টেলিগ্রাম। কাউটস্কির স্ত্রী ছিলেন, বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেছে; ভিয়েনা (অস্ট্রিয়া)-র
মানুষ। অস্ট্রিয়ার সমাজবাদী আন্দোলনের নেতা ভিক্টর অ্যাডলারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।
লুইসা অত্যন্ত ভালো স্বভাবের নারী। এঙ্গেলস, হেলেন, ইলিয়ানর, লরা সবাই তাঁকে পছন্দ
করতেন এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য পরোক্ষভাবে কাউটস্কির সমালোচনা করতেন।
৯ই নভেম্বর এঙ্গেলস
লুইসা স্ট্রেসার (কাউটস্কি) -কে যে চিঠি লিখেছিলেন, তার অংশমাত্র লেখকের তর্জমায় উদ্ধৃত
ছিল গুস্তাভ মেয়ার রচিত এঙ্গেলসের জীবনীতে। রচনাসমগ্রে সেটাই মুদ্রিত হয়েছে।
“… তোমাকে বলার প্রয়োজন নেই যে কিভাবে আমার দিনগুলো
কেটেছে, কত নীরস আর নিঃসঙ্গ মনে হয়েছে জীবন। এখনো মনে হয়। আর তারপর প্রশ্নটা জাগল – এবার কী? আর সে প্রশ্নের উত্তরের মত প্রিয়
লুইসা, প্রাণবন্ত আর স্বস্তিদায়ক একটি মুখচ্ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সারা দিন,
সারা রাত ভেসে রইল। আর সেই মুখচ্ছবি তোমার ছিল। তখন নিম্মির মত আমিও বললাম, ‘ওহ! যদি লুইসাকে এখানে পেতাম!’ কিন্তু ভাবতে সাহস করিনি যে সেটা সত্যি হবে।
… সে যাই হোক, প্রশ্নটা
সবচেয়ে আগে সোজাসুজি তোমাকে না করলে আমি এক মুহূর্তও শান্তি পেতাম না। … যে-ই আমার গৃহস্থালি সামলাবে, তাকে স্থানীয়
রীতি মানতে হবে। সেই রীতি অনুসারে এক ভদ্রমহিলা” [লেডি] “কায়িক শ্রম না-ও করতে পারে। সেটা আমার ওপরও জোর করে চাপানো যেতে
পারে, এবং আমাকে এমন কাউকে নিতে বাধ্য করা যেতে পারে যে আমাদের পার্টির সদস্য নয় … । কাজেই তোমাকে শুধু কাজের তদারকি করতে হবে।
বাকি সময়টুকু তুমি তোমার যা ইচ্ছে করতে পারো …
সেই পরিস্থিতিতে
সমস্ত ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের এখানে বসে কথা বলতে হবে – হয় আমরা ভালো বন্ধুর মত একসঙ্গে থাকব অথবা
ভালো বন্ধুর মত আলাদা হয়ে যাবো। সিদ্ধান্ত নেওয়া তোমার কাজ। ভেবে নাও, অ্যাডলারের সঙ্গে
আলোচনা করে নাও। যদি, যেমন আশঙ্কা করি, আমার এই দিবাস্বপ্ন পুরো না হয়, অথবা যদি ভাবো
যে তোমার দিক থেকে, সুফল বা সুখের তুলনায় অসুবিধা আর হয়রানি বেশি হবে, তাহলে কথা না
ঘুরিয়ে স্পষ্ট জানিও। তুমি আমার জন্য ত্যাগস্বীকার করবে, তা হতে দেব না; যথেষ্ট স্নেহ
করি তোমায় …। আর সেই কারণে অনুনয়
করছি ত্যাগস্বীকার কোরো না। তোমার মাধ্যমে অ্যাডলারকেও অনুরোধ করছি, তেমন কিছু করতে
যেন তোমায় বারণ করে। তুমি যুবতী এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে তোমার সামনে। তিন সপ্তাহে
আমি সত্তরে পড়ব। হাতে সময় থাকবে খুব কম। যৌবনময় এবং আশান্বিত একজনের সময় সেই কয়েক বছরের
জন্য বলি দেওয়া যেতে পারে না। কেননা, মোটের ওপর এখনও নিজের কাজগুলো করে নেওয়ার জন্য
পর্যাপ্ত শক্তি আছে আমার …”
বইয়ে যা আছে তার
প্রায় পুরোটাই এখানে দিলাম। কেননা স্পর্শকাতর নয় তবু ভুলবোঝাবুঝির অবকাশ আছে বলে স্পর্শকাতর
মনে চিঠিটা আঘাত করতে পারত। চিঠিটা পড়লেই বোঝা যায় আর এঙ্গেলসও সেটা জানতেন।
কিন্তু যাই হোক,
তেমন কিছু হল না; স্ট্রেসার প্রস্তাবটা স্বীকার করলেন এবং মনে হয় ১৯শে নভেম্বর লন্ডনে
এলেন। এঙ্গেলসের সমস্যা শেষ হল। কয়েকদিন পর ২৮শে নভেম্বর যখন বার্লিন থেকে বেবেল, লিবনেখট,
সিঙ্গার আর স্থানীয় অনেক সাথী ও ব্যক্তিগত বন্ধুরা এসে এঙ্গেলসকে তাঁর জন্মদিনে অভিনন্দন
ও শুভেচ্ছা জানালেন তখন বাড়িতে লুইসাও ছিলেন। আগামী বছরগুলোয় লুইসা স্ট্রেসারই এঙ্গেলসের
গেরস্থালি সামলালেন এবং সচিব রূপে কাজ করতে থাকলেন।
এঙ্গেলসের সত্তরতম
জন্মদিন উদযাপনের প্রসঙ্গটাকে তাঁর সবকয়টি জীবনীতে বড় করে জায়গা দেওয়া হয়েছে। কেননা
সেটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে তো হেলেন ডেমুথের মৃত্যুর পর এঙ্গেলসের
নিঃসঙ্গতা, লিডিয়ার মৃত্যুসময় থেকে শুরু হওয়া নিঃসঙ্গতা আরো নির্জন হয়ে উঠেছিল। সাত
বছর আগে মার্ক্সের মৃত্যুর পর, তার আগের প্রায় পাঁচ দশকে পল্লবিত ও ফলবান হয়ে ওঠা ভাবনাচিন্তাগত
গভীর বন্ধুত্বের জগতটাও শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখন তিনি শুধু সেই জগতটাকে যতটা সম্ভব বিশ্বের
দৃষ্টির গোচরে আনছিলেন … এটুকুই তাঁর অবশিষ্ট
ভূমিকা বলে তিনি স্বীকার করতেন। পুরোনো তেজোদ্দীপ্ত যোদ্ধাদের অগ্রজসম যোহান ফিলিপ
বেকারও তিন বছর আগে মারা গেছেন।
জন্মদিনের দু’দিন আগে ২৬ নভেম্বর এডলফ সোর্জকে লিখলেন, “জন্মদিন উদযাপন করার মত মানসিক অবস্থা একেবারেই
নেই। তার ওপর এইসব অর্থহীন হো-হাল্লা, যা ভালো সময়েও অসহ্য লাগে আমার। আর শেষমেশ, আমি
অনেকটাই একজন সাধারণ মানুষ যে মার্ক্স-উপ্ত খ্যাতির ফসল কাটছে।”
কিন্তু এঙ্গেলসের
সত্তরতম জন্মদিন উদযাপন, বিগত বেয়াল্লিশ বছরে মার্ক্সবাদ নামে নতুন বিশ্বদৃষ্টিটি জন্ম
নিয়ে যে বিরাট বিকাশ পেয়েছে বিশ্বে, তার সাক্ষী হল। ব্যক্তিগত অভিনন্দনের চিঠি তো এলই,
বহু দেশ থেকে এল। কিন্তু যে টেলিগ্রামগুলো এল, সেগুলো বিশেষকরে দল, সংগঠন, সংস্থা অথবা
উপদলের তরফ থেকে এসেছিল। বার্লিন থেকে তিনটে, ভিয়েনা থেকে তিনটে, প্যারিস থেকে রোমানিয়ার
ছাত্ররা, বার্ন (সুইটজারল্যান্ড) থেকে ‘রুশীয় সামাজিক-গণতন্ত্রী’, লাইপজিগ থেকে ‘শহর এবং দেশ’, বোচাম (জার্মানি) থেকে ‘শ্রেণী সচেতন খনিশ্রমিক’, স্টুটগার্ট থেকে ‘সামাজিক-গণতন্ত্রী’ … আরো অনেক দেশ, শহর
ও দল…। অনেকে উপহার পাঠালেন,
একজন এঙ্গেলসের ছবির এলবাম তৈরি করে পাঠালেন, আরো অনেক জিনিষ। জীবনীতে উদ্ধৃত প্যেওত্র
লাভরভ লিখছেন, “আপনাকে অভিনন্দন।
সমাজবাদের ইতিহাসে কার্ল মার্ক্সের পাশে একমাত্র আপনার নাম অনপনেয় অক্ষরে লেখা আছে।
মহীয়ান তাঁর নামের ঔজ্জ্বল্যে আপনার নাম স্তিমিত হয় না।” প্লেখানভ লিখলেন, “সর্বহারা শ্রেণীর জন্য যে কাজ এঙ্গেলস করেছেন
তার তুলনা আজ কারোর সঙ্গে করা যেতে পারে না।”
যেমন অভ্যাস ছিল,
এঙ্গেলস এক এক করে সব চিঠির উত্তর দিলেন। ঠাট্টা করে লরাকে লিখেছিলেন যে একদিনের কবিতার
(চিঠি পাওয়া) পর শুরু হয় এত দিনের গদ্য (চিঠির উত্তর দেওয়া)। লাভরভের চিঠির জবাবে তিনি
যা লিখেছিলেন মোটামুটি সব চিঠিতে শব্দের ভিন্নতা বাদ দিলে সেই একই কথা লিখলেন, “গত শুক্রবারে আমার ওপর যে সম্মান বর্ষিত হল
তার সিংহভাগের হকদার আমি নই। আর একঠা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। … বাকি যে ছোটো অংশটা আমি নিজের বলে দাবি করতে
পারি, কোনোরকম ধৃষ্টতায় না গিয়ে সেটুকু আমি গ্রহণ করি, এবং তার যোগ্য থাকার চেষ্টা
আমি ভরপুর করব।”
কাজ ছিল অনেক। অনবরত
বসে বসে কাজ করা এঙ্গেলসের জন্য সম্ভব হচ্ছিল না। নিজেই কোনো চিঠিতে লিখেছেন যে ওনার
এখন বছর সব মিলিয়ে আট সপ্তাহের ছুটির দরকার পড়ছিল। কাজের চাপে আর দুশ্চিন্তায় পরের
বছর, অর্থাৎ ১৮৯১এ তাঁকে বেশ কয়েকবার লন্ডনের দমবন্ধ মেঘলা আবহাওয়া থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের
বা খোলা হাওয়ায় যেতে হল। জুনের শেষ থেকে আগস্টের শেষ অব্দি তিনি প্রায় বাইরেই রইলেন,
উইট দ্বীপের রাইড নামে একটা জায়গায়। সঙ্গে ছিলেন স্কোর্লেমার আর জুলিয়ান হার্নে। হোটেল
খোঁজার দরকার পড়ল না কেননা পাম্পস সেসময় নিজের স্বামীর সঙ্গে সেখানেই থাকছিল। তারপর
সেপ্টেম্বরে এঙ্গেলসরা দু’সপ্তাহের জন্য আয়ারল্যান্ড
আর স্কটল্যান্ডের দিকে চলে গেলেন। সেই সফরে পাম্পস (মেরি এলেন রোশার) এবং এঙ্গেলসের
তৎকালীন গৃহকর্ত্রী ও সচিব লুইসা ট্রেসারও সঙ্গে ছিলেন।
কিন্তু জুন মাসে
বাইরে যাওয়ার আগে এঙ্গেলস ৩রা মে, মে-দিবস উদযাপন করতে হাইড পার্কে অবশ্যই গিয়েছিলেন।
বস্তুতঃ ১৮৯০এর ৪ঠা মে তিনি যে হাইড পার্কের সমাবেশে শামিল হয়েছিলেন, তার পর থেকে প্রতি
বছর তিনি মে-দিবসের সমাবেশের প্রতীক্ষা করতেন এবং উৎসবে যোগ দেওয়ার আনন্দ অনুভব করতেন।
পরে, চিঠি লিখতে বসে গর্বের সঙ্গে লন্ডনের সমাবেশে তাঁর অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করে
অন্যান্য দেশে কবে, কিভাবে উদযাপিত হল সে-বিষয়ে জানতে চাইতেন। ১৮৯২এর লন্ডন সমাবেশ
৩রা মে-তে হল। তাতে তিনি মঞ্চ সংখ্যা ৬-এ, ‘ন্যু জেইট’ খবরের কাগজের প্রতিনিধি সাংবাদিক হিসেবে ব্যাজ পরে উপস্থিত ছিলেন।
তাঁর নিজের অনুমানে সেই সমাবেশে আড়াই লক্ষ শ্রমিক যোগ দিয়েছিলেন।
তাঁর কাজের সেই অংশগুলোর
ওপর এই জীবনীতে বেশি জোর দিচ্ছি যেগুলোর সঙ্গে, নিজেদেরকে সম্পর্কযুক্ত করা সহজ। সব
দেশের সমাজবাদী আন্দোলনের বিকাশে তাঁর যোগদানের কথার বিশদে গেলে জীবনীর পৃষ্ঠা সংখ্যা
নাহক আরো বাড়বে। ইংল্যান্ডে যেহেতু তিনি ছিলেন তাই সেখানে তাঁর ভূমিকার কিয়দংশ বলা
আবশ্যক হয়ে পড়ে।
রাশিয়ার ওপর মার্ক্স
এবং এঙ্গেলস দুজনেই বিশেষভাবে কাজ করেছিলেন কেননা ইয়োরোপীয় প্রতিক্রিয়ার সবচেয়ে মজবুত
দুর্গ ছিল রাশিয়া এবং তার সামরিকবাদ। প্রুশীয় সাম্রাজ্যের অটুট থাকার, পূঁজিবাদী বিপ্লব
এবং প্যারি কমিউনের দেশ ফ্রান্সে প্রতিক্রিয়ার মজবুত হয়ে ওঠার, ব্রিটেনে রক্ষণশীল শক্তির
রাজনৈতিকভাবে লাভজনক অবস্থানে থাকার প্রধান কারক হয়ে উঠত রাশিয়ার জারতন্ত্র এবং তার
সামরিকনীতি। ১৮৮৯-৯০ সালের ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারিতে এঙ্গেলস তিন কিস্তিতে একটি দীর্ঘ
প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ‘রুশীয় জারতন্ত্রের
বিদেশনীতি’। লেখার কারণ ছিল
ঘনিয়ে ওঠা যুদ্ধ-পরিস্থিতি। লেখাটি সেসময় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। রুশীয় ভাষায় ছেপেছিল
(সোস্যাল ডেমোক্রাট)। জার্মান ভাষায় ছেপেছিল (ন্যু জেইট)। এঙ্গেলসেরই নিজের করা অনুবাদে
ইংরেজিতে ‘টাইম’ পত্রিকায় ছেপেছিল। পরে পোলিশ, বুলগারীয় এবং
আরো অন্যান্য ভাষায় ছেপেছিল।
কিন্তু সে-কাজ নিয়েও
আলোচনা, ইতিহাসের গবেষকদের জন্য জরুরি হলেও, সাধারণ পাঠকের জন্য খুব কিছু কৌতূহলোদ্দীপক
হবে না। কেননা ভারতে আমরা রাশিয়াকে নভেম্বর বিপ্লবের সময় থেকেই বেশি চিনি, এবং তার
গাথায় জড়িয়ে থাকে লেনিনের জীবন ও তাঁর সংগ্রাম। তবে একটা মজার কথার উল্লেখ করা যেতে
পারে। আগেই বলা হয়েছে যে মার্ক্স, ‘পূঁজি’ নিয়ে গবেষণার কাজে
রুশীয় কৃষি সম্পর্কিত পরিসংখ্যান এবং দলিল এত জমা করেছিলেন যে সেটা এঙ্গেলসের ভাষায়
‘দুই ঘনমিটার’ জায়গা নিয়ে ছিল। পল লাফার্গ নিজের স্মৃতিচারণে
উল্লেখ করেন, যখনই মার্ক্স এঙ্গেলসকে বকতেন যে ‘মানুষের জন্য কাজ করার কথা না ভেবে’ শুধু জ্ঞানার্জনের আনন্দে মেতে থাকে [পাঠক
মনে রাখবেন যে এটা মার্ক্স-এঙ্গেলসের স্তরের ভাবনা], এঙ্গেলস পাল্টা জবাব দিতেন, “তোমার এই কৃষি-সম্পর্কিত রুশীয় প্রকাশনগুলো
পুড়িয়ে ফেলতেও আমার আনন্দ হবে, এগুলোই তোমাকে বছরের পর বছর ধরে আটকে রেখেছে, ‘পূঁজি’টা শেষ করতে পারছ না!”
অবশ্য সবচেয়ে বেশি
কাজ তাঁরা জার্মানিকে নিয়ে করেছিলেন। জন্মে ও মাতৃভাষায় তাঁরা জার্মান ছিলেন, কিন্তু
একমাত্র সেজন্য নয়। তাঁরা যে দর্শন, যে বিশ্বদৃষ্টি বিকশিত করলেন তার মানবিক সারতত্ত্ব
সে দৃষ্টি-অবলম্বনকারী সবাইকেই বিশ্বনাগরিক করে তোলে। আর ভাষাও, এঙ্গেলসের মত না হোক,
চার-পাঁচটা ভাষা তো মার্ক্সও জানতেনই। জার্মানির ওপর তাঁরা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিলেন
কারণ, তাঁদেরই প্রারম্ভিক কাজের ফলে জার্মানির সমাজবাদী আন্দোলনে সামাজিক-গণতন্ত্রী
পার্টির মার্ক্সবাদী বা বৈজ্ঞানিক সমাজবাদী কর্মধারা, সর্বহারা বিপ্লবের কর্মধারা সবচেয়ে
প্রবল হয়ে উঠেছিল। আর সেই ধারা বা সেই শক্তি বা উপদল-কৃত তত্ত্বগত, সাংগঠনিক এবং পরে
সংসদীয় কাজ অবিলম্বে পাশের দেশগুলোর বিপ্লবী আন্দোলনগুলোকে প্রভাবিত করত। ‘এরফুর্ট কর্মসূচি’র ওপর বিতর্কে এমনটাই হল।
জার্মানিতে সমাজবাদী-বিরোধী
আইন প্রত্যাহৃত হওয়ার পর সামাজিক-গণতন্ত্রী পার্টি নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত
নিল। এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হল ১৮৯০এর অক্টোবরে, হ্যালে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে। সামাজিক-গণতন্ত্রী
পার্টির কার্যনির্বাহী কমিটি ১৮৯১এর ১৮ই জুন এঙ্গেলস সহ অন্যান্য জার্মান সামাজিক-গণতন্ত্রী
নেতাদের নতুন কর্মসূচির খসড়া পাঠিয়ে দিল। গোথা কর্মসূচি (এই জীবনীতে আগে উল্লেখিত)
বা ঐক্য কর্মসূচির ১৬ বছর পর পার্টির নতুন কর্মসূচি তৈরি হতে চলেছিল।
এঙ্গেলস আশঙ্কিত
ছিলেন যে ১৬ বছরের অগ্রগতির ফলে লাসালপন্থা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেও, সুবিধেবাদ কোনো
না কোনো রূপে সবসময় মাথা তুলতে পারে। অনেকগুলো সুযোগ ছিল মাথা তোলার – সমাজবাদী-বিরোধী আইন প্রত্যাহার, পার্টির
সংসদীয় জয় …। এঙ্গেলস প্রথম
কাজ করলেন যে নতুন কর্মসূচি নির্মাণ উপলক্ষে একটি নতুন কথামুখের সঙ্গে ‘গোথা কর্মসূচির সমালোচনা’ ছাপতে পাঠিয়ে দিলেন ‘ন্যু জেইট’এ। বস্তুতঃ ১৮৭৫এ রচনাটি কোথাও প্রকাশিত হয় নি। মার্ক্সের জীবনকালেও
হয় নি। এতদিন পর প্রথম ছাপতে যাচ্ছে বলে এঙ্গেলস পান্ডুলিপিতে কিছু সংশোধন করলেন। বিশেষ
করে যে শব্দগুলোতে ব্যক্তিগত কটাক্ষ ছিল এবং এত দীর্ঘ সময়ে অর্থহীন হয়ে পড়েছিল সে শব্দগুলোর
জায়গায় কয়েকটি করে বিন্দু বসিয়ে দিলেন। যে শব্দে সেন্সরের আপত্তি হতে পারত সে শব্দগুলোর
জায়গাতেও তা-ই করলেন। জার্মানিতে পার্টির ভিতরে সংসদীয় দলের একাংশ এবং আরো কয়েকজন সদস্য
ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখল না। তবে সাধারণভাবে সদস্য এবং সমর্থকেরা স্বাগত জানালো।
দ্বিতীয় কাজ – যখন নতুন কর্মসূচির খসড়া এসে পৌঁছোল তখন এঙ্গেলস
তার একটি সমালোচনা লিখলেন, ‘১৮৯১এর সামাজিক-গণতন্ত্রী কর্মসূচির খসড়ার সমালোচনা’। যদিও সেসময় কোথাও ছাপা হল না সেই সমালোচনা।
রচনাসমগ্রের পাদটীকা অনুসারে এই লেখাটির পাণ্ডুলিপি ১৯০১ সালে, অর্থাৎ এঙ্গেলসের মৃত্যুর
ছ’বছর পর লিবনেখটের
কাগজপত্রে পাওয়া গেল এবং তখন ‘ন্যু জেইট’এ প্রকাশিত হল।
যদিও সমালোচনার প্রারম্ভে
এঙ্গেলস নতুন কর্মসূচির সমর্থন করেছিলেন এবং লিখেছিলেন যে, “বিশেষ করে লাসালপন্থী এবং স্থূল সমাজবাদী,
সেকেলে হয়ে পড়া দু’ধারারই মজবুত অবশেষগুলোকে
মোটামুটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে”, বিশদে গিয়ে তিনি কর্মসূচিতে ব্যবহৃত কিছু শব্দের সমালোচনা করেছিলেন
কেননা শব্দগুলো বিভ্রান্ত করছিল। নিজেই সেগুলোর সংশোধিত বিকল্পও দিয়েছিলেন। ইতিহাস
বলে যে সেই সংস্কারগুলো সাধারণভাবে গ্রহণ করেই কর্মসূচিকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়েছিল।
তার অর্থ দাঁড়ায় যে এঙ্গেলসের ‘সমালোচনা’ সময়মতই জার্মান পার্টির কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে পৌঁছেছিল।
১৪ই অক্টোবর থেকে
২০শে অক্টোবর অব্দি জার্মানির এরফুর্টে পার্টির যে কংগ্রেস হল তার ফলাফলে এঙ্গেলস নিশ্চিন্ত
এবং প্রসন্ন হলেন। এঙ্গেলসের পূর্বোল্লিখিত সোভিয়েত জীবনী বলে, “জার্মান সামাজিক-গণতন্ত্রীরা যে মার্ক্সবাদী
কর্মসূচি গ্রহণ করল, পুরো আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী আন্দোলনের ওপর তার প্রবল প্রভাব পড়ল।
পাতি-পূঁজিবাদী সমাজবাদের বিভিন্ন ধারার বিরুদ্ধে মার্ক্সবাদের মতাদর্শগত জয় ছিল এই
কর্মসূচি। আগামী অনেক বছর পর্য্যন্ত এই কর্মসূচি, অন্যান্য দেশের সমাজবাদীদের কাছে
মডেল হয়ে রইল।”
এরফুর্টে জার্মান
পার্টির কংগ্রেসের দু’মাস আগে, ১৬ থেকে
২২ আগস্ট অব্দি ব্রাসেলসে আন্তর্জাতিক সমাজবাদী শ্রমিকদের অধিবেশন হয়েছিল। এই অধিবেশনের
প্রস্তুতির কাজে এঙ্গেলসের ভূমিকার কথা আগেই বলা হয়েছে। অধিবেশনের সাফল্য নিয়ে তিনি
চিন্তিত ছিলেন সেসময়। ২০শে জুলাই লরাকে লিখেছিলেন, “পল ভাবছে টুসি অপ্রয়োজনে ব্রাসেলস নিয়ে চিন্তিত – কিন্তু আমি ভাবছি না। হতেও পারে যে সব কিছু
ঠিক মত হয়ে যাবে। আর সবাই ঐকান্তিক ভাবে মূল কাজগুলো করতে থাকলে অবশ্যই হবে। কিন্তু
এধরণের অধিবেশনের একটু বেশিই অভিজ্ঞতা আছে আমার। জানি যে কত সহজে সব কিছু ভুল হয়ে যেতে
পারে। … আমাদের একটা ভুলের
ফলে, একটা কোনো সুযোগের উপেক্ষা করার ফলে আগামী কয়েক বছর অব্দি আমাদের সে-কাজই করে
যেতে হবে যা অপ্রয়োজনীয়, অথচ অপরিহার্য।”
যাহোক, তেমন হল না।
অধিবেশনে বেশ কয়েকটি ইয়োরোপীয় দেশের এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো সমাজবাদী
পার্টি এবং ট্রেড ইউনিয়ন থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো প্রতিনিধি এসেছিলেন। শ্রম আইন, হরতাল,
বয়কট, সামরিকবাদ এবং মে-দিবস উদযাপন নিয়ে আলোচনা হল। সব দেশের শ্রমিককে আহ্বান জানানো
হল পূঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে। হরতাল এবং বয়কটকে শ্রমিকদের একমাত্র অস্ত্র হিসেবে
ব্যবহার করা নিয়ে কথা হল। বলা হল যে শ্রমিকদের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন অত্যাবশ্যক। সামরিকবাদ
এবং যুদ্ধকে পূঁজিবাদের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে চিহ্নিত করা হল। সমাজবাদীরা যে শান্তির
পক্ষে সে কথাটা সাধারণভাবে স্বীকৃত হল। সব দেশে মে-দিবস উদযাপনের আহ্বান করা হল।
সামরিকবাদ নিয়ে আলোচনার
প্রধান কারণ ছিল ইয়োরোপের অবস্থা। রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনের ভয়ানক
ঘাটতি আকালের পরিস্থিতি উৎপন্ন করেছিল। তার সম্ভাবিত পরিণাম ছিল পূঁজিবাদী সংকট এবং
সে সংকট থেকে মুক্তি পেতে একমাত্র পূঁজিবাদী অস্ত্রের ব্যবহার – যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের
প্রচার। এ বিষয়ে এঙ্গেলসের প্রবন্ধও এল সেসময় তৎকালীন সংবাদপত্রে।
ব্রাসেলসের পরিণামে
মোটের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে ২রা সেপ্টেম্বর এঙ্গেলস অ্যাডলফ সোর্জকে লিখলেন, “তত্ত্বের প্রশ্নে মার্ক্সবাদীরা পুরো অধিবেশনে
জয়লাভ করেছে।” পাশাপাশি অধিবেশনের
দুটো ঘটনা গুনিয়েছিলেন। প্রথম, অধিবেশনের শুরুতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিদের হাতে নৈরাজ্যবাদী
প্রবৃত্তিগুলোর পরাজয়। আর দ্বিতীয়, ইংল্যান্ডের শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন, বিশেষ করে
অদক্ষ শ্রমিকদের লড়াকু ট্রেডইউনিয়নগুলোর অধিবেশনে অন্তর্ভুক্তি।
‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ডের প্রকাশনা
মার্ক্সের, নিজের
এবং তাঁদের দুজনের যুগ্ম পূর্বপ্রকাশিত রচনয়াগুলোর নতুন সংস্করণের সম্পাদনা এবং প্রকাশনা
এঙ্গেলসকে, প্রতিদিনকার রাজনৈতিক লিখন, বিভিন্ন দেশের পার্টি-প্রতিনিধিদের সঙ্গে পত্রালাপ
বা দেখাসাক্ষাতের নিয়মিত ব্যস্ততা থেকে আলাদা, চিন্তনের একটা সুযোগ দিত। কেননা অনুবাদক
বা প্রকাশকেরা নতুন কথামুখ বা ভূমিকা চাইতেন। ফলে, ‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদনার কাজ মাথার ওপর থাকা সত্ত্বেও এঙ্গেলস কিছু
দিনের জন্য নিজের প্রিয় বিষয়সমূহের – দর্শন, রাজনৈতিক ইতিহাস, প্রাচীন ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি – অধ্যয়নে এবং সে-সংক্রান্ত লেখালেখিতে ডুবে
যেতেন। অনেকগুলো গ্রন্থের জন্য এবং বেশ কয়েকটি ভাষায় লেখা তাঁর কথামুখ বা ভূমিকাগুলি
দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যে যেই সমাজের পাঠকের – ভিন্ন ভাষার বা ভিন্ন প্রজন্মের – কাছে রচনাটি পৌঁছোচ্ছে, তাদের সমকালীন ঐতিহাসিক
পরিস্থিতির সঙ্গে মূল রচনাটির সারবস্তুর সম্পর্ক কিভাবে উন্মোচিত করতে হয়।
তবে, ‘সমাজবাদঃ কল্পলৌকিক এবং বৈজ্ঞানিক’এর ইংরেজি সংস্করণের প্রকাশনার সময় আরো একটি
ব্যাপার হল। এডোয়ার্ড এভেলিং অনুবাদ করে দিয়েছিলেন, প্রকাশকের সঙ্গে কথাও হয়ে গিয়েছিল।
প্রকাশক তাত্ত্বিক পুস্তিকার একটি শৃংখলা তৈরি করছিলেন। সবকয়টি পুস্তিকার দাম সমান
হবে, এবং একটু বেশিই হবে। সেই শৃংখলাতেই এই লেখাটিও প্রকাশিত হওয়ার ছিল। দামের অনুপাতে
লেখা ছোটো, তাই প্রকাশক প্রথমে তো ছাপাখানার ঢংএ ‘লিডিং’ বদলে লেখার পৃষ্ঠাসংখ্যা বাড়ালেন। কিন্তু কত বাড়াবেন! তখন এঙ্গেলসকে
খবর পাঠালেন যে কথামুখ নয়, ভূমিকা চাই, দীর্ঘ।
সাত দিন লাগল ভূমিকা
লিখতে। ফলে পরবর্তী প্রজন্ম একটি অসাধারণ প্রবন্ধ পেয়ে গেল। ১৮৯২এর ১৬ই এপ্রিল এঙ্গেলস
বেবেলকে লিখলেন, “কাজটা খুব সহজ ছিল
না। প্রথমবার আমি ‘ছিঃক্ষিত’ ইংরেজ জনতার সামনে নিজেকে পেশ করছিলাম আর
তার জন্য একটু চিন্তাভাবনা করার দরকার ছিল। যাক, শেষ অব্দি যেটা বেরিয়ে এল সেটা এদিক-ওদিককার
অনেককিছুর বিষয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ যার পুরোটা জুড়ে একটি সুসঙ্গত পুনরাবৃত্ত সুর আছে
– ব্রিটিশ পূঁজিবাদীদেরকে
নিয়ে কঠোর বিদ্রুপ।”
তবে ‘এদিক-ওদিককার অনেককিছু’টা এলোমেলো নয়, চলতি যুগের ইতিহাসের তিন-চারটি
দিক। ইংরেজ পূঁজিবাদী দর্শনের উত্থান ও পতন, পর পর সংস্কারের (নতুন নতুন পন্থার) মধ্যে
দিয়ে) নবোত্থিত পূঁজিবাদের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে ক্রিশ্চান ধর্মে পরিবর্তন, ইংরেজ পূঁজিবাদী
আমূল-পরিবর্তনবাদের উত্থান ও পতন, ইংরেজ সামন্ততন্ত্রের উঠতি পূঁজিবাদের সঙ্গে সমন্বয়সাধন
– রাষ্ট্রশক্তি আয়ত্তে
রাখতে পারস্পরিক চুক্তি, নতুন বিপ্লবী শক্তি হিসেবে শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমবিকাশ। প্রত্যেকটা
দিক নিয়ে আলোচনায় ফ্রান্সেরও প্রসঙ্গ এসেছে কেননা পূঁজিবাদী বিপ্লবের অর্থনৈতিক দিকটার
‘চরম অভিব্যক্তি’ যেমন ইংল্যান্ডে হয়েছিল, রাজনৈতিক দিকটার
‘চরম অভিব্যক্তি’ ফ্রান্সে হয়েছিল। প্রয়োজনে জার্মানিরও প্রসঙ্গ
এসেছে কেননা পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিকাশের দিক থেকে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পরেই জার্মানি।
কয়েক দশক আগে রচিত
‘পবিত্র পরিবার’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে বস্তুবাদের
অগ্রগতিতে ইংল্যান্ডের ভূমিকার বিষয়ে মার্ক্সবাদীদের অভিমত কী। ‘পবিত্র পরিবার’এ মার্ক্স লিখেছিলেন, “… সপ্তদশ শতকের পরের সবকয়টি আধুনিক বস্তুবাদের
আদিনিবাস ইংল্যান্ড।” তারপর মিনিম্যালিস্ট,
ফ্রান্সিস বেকন, হবস, লক প্রভৃতি চিন্তাবিদদের দর্শনে বস্তুবাদের অগ্রগতি দেখাতে দেখাতে
তিনি সমকাল অব্দি পৌঁছেছিলেন। এঙ্গেলস সেই পুরো প্রসঙ্গটির দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন,
“একথাই বলেছিলেন,
আধুনিক বস্তুবাদের ব্রিটিশ উৎপত্তির বিষয়ে কার্ল মার্ক্স।” তারপর দেখিয়েছেন চিন্তার ক্ষেত্রে অধঃপতনের
পথ। পাশাপাশি ক্রিশ্চান ধর্মের ক্ষেত্রে পূঁজিবাদী সংস্কারের বিভিন্ন ঐতিহাসিক রূপগ্রহণ।
অবশেষে উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ইয়োরোপে উপর্যুপরি বৈপ্লবিক অস্থিরতার পর সামন্তবাদের
সঙ্গে পূঁজিবাদী শক্তিগুলোর আপোষ।
“নতুন প্রস্থানবিন্দু হল উঠতি মধ্যশ্রেণী” [বা পূঁজিবাদী] “এবং প্রাক্তন-সামন্ত ভূস্বামীদের মধ্যে আপোষ।
দ্বিতীয় শ্রেণীটি, যদিও আজকাল তাকে অভিজাতশ্রেণী বলা হয়, অনেক আগেই সেই পথে এগিয়েছে
যে পথে ফ্রান্সের লুই ফিলিপ অনেক পরে ‘রাজত্বের প্রথম পূঁজিবাদী’তে পরিণত হল।” তাদের “অভ্যেস এবং প্রবৃত্তিগুলো
যত না সামন্তপন্থী ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি পূঁজিবাদী। পয়সার মূল্য তারা খুব ভালো করে
জানে … ইংরেজ ‘অভিজাতশ্রেণী’ শিল্পোৎপাদনের অগ্রগতিকে রোধ করার বদলে পরোক্ষে
মুনাফা কামিয়েছে … বড় ভূস্বামীদের
একটি অংশ সবসময় ছিল যারা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণে, লগ্নীপূঁজি ও শিল্পপূঁজির নেতৃস্থানীয়দের
সঙ্গে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক।” এবং পরিণামে, ১৬৮৯এর সমঝোতা (সাংবিধানিক রাজতন্ত্র)। ভালো ভালো
সরকারি পদ, কর্মভারহীন পদ, উঁচু বেতন ইত্যাদিগুলো বড় ভূস্বামী পরিবারগুলোর জন্য ছেড়ে
দেওয়া হল। শর্ত একটাই, লগ্নী, শিল্প এবং বাণিজ্যের মধ্যশ্রেণীদের স্বার্থ দেখতে হবে
পর্যাপ্তভাবে। ছোটো ছোটো ব্যাপার নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি হতে পারে কিন্তু, “সামগ্রিক ভাবে, অভিজাত কুলীনতন্ত্র খুবই ভালো
জানত যে তাদের আর্থিক সমৃদ্ধি অপরিবর্তনীয়ভাবে শিল্প ও বাণিজ্যের মধ্যশ্রেণীর সমৃদ্ধির
সঙ্গে আবদ্ধ।
“সেই সময় থেকে, পূঁজিবাদী এক বিনীত যদিচ তখনও ইংল্যান্ডের শাসকশ্রেণীসমূহের
স্বীকৃত অংশ ছিল। শাসকশ্রেণীগুলোর বাকি অংশের সঙ্গে, জাতির মহান শ্রমজীবী জনগণকে নিজেদের
অধীনত্বে রাখা তারও সাধারণ স্বার্থ ছিল।”
তারপর তার ধার্মিকতা,
ধার্মিকতার ঝান্ডায় রাজা এবং ভূস্বামীদের পক্ষে থেকে তার লড়াই, এবং জাতির উৎপাদনকারী
জনতাকে, অর্থাৎ শ্রমজীবী জনগণকে পদদলিত রাখার জন্য সেই ধর্মের ব্যবহার।
তারপর দেখিয়েছেন
বস্তুবাদ কিভাবে ফ্রান্সে গেল, সেখানকার পূঁজিবাদী বিপ্লবকে অনুপ্রেরিত করল। কিন্তু
সেখানেও শেষে বেশিদিন একা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারল না। সামন্তবাদের সঙ্গে সমঝোতা হল।
এভাবে আরো অনেক কথার
পর ইতিহাসের এই গতিপথে শ্রমিক শ্রেণীর বিকাশের ইতিহাসে এসেছেন এঙ্গেলস। এবং পুরো ইয়োরোপে
শ্রমজীবী শ্রেণীর বিপ্লবের অপ্রতিরোধ্যতার ওপর জোর দিয়ে প্রবন্ধ শেষ করেছেন।
প্রবন্ধটির জার্মান অনুবাদ আলাদা করে ‘ন্যু জেইট’ পত্রিকায় ছাপল। পরে আরো অনেকবার মুদ্রিত হয়েছিল।
১৮৯২এর ২৭শে জুন
কার্ল স্কর্লেমার মারা গেলেন। নিজের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং আদর্শ ব্যক্তির মৃত্যু এঙ্গেলসকে
বিচলিত করে তুলল। স্কর্লেমার ম্যাঞ্চেস্টারেই থাকতেন। ১৮৫৮ সালে রসায়ন বিজ্ঞানে কাজ
করার জন্য তিনি জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডে চলে এসেছিলেন। রসায়ন বিজ্ঞানে তাঁর উল্লেখযোগ্য
অবদান আছে। সমাজবাদী চিন্তাভাবনা এবং মার্ক্স-এঙ্গেলসের সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য তিনি
‘লাল রসায়নবিদ’ নামে পরিচিত ছিলেন। এঙ্গেলস খবর পেয়ে সঙ্গে
সঙ্গে ম্যাঞ্চেস্টারে পৌঁছোলেন। কিন্তু তার আগেই স্কর্লেমারের দেহ কবরস্থ করা হয়ে গিয়েছিল।
‘ভোরওয়ার্টস’এ যে শোকবার্তা এবং সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্ত প্রকাশিত
হল তার শুরুতেই এঙ্গেলস লিখলেন, “নিজের বিশ্বাস লুকিয়ে রাখা তো দূর, মৃত্যু পর্য্যন্ত তিনি জার্মানির
সোশ্যালিস্ট পার্টির সক্রিয় এবং নিয়মিত বকেয়া-আদায় দেওয়া সদস্য ছিলেন। … ১৮৭১ সালে তাঁর নাম রয়্যাল সোসাইটি, বিজ্ঞানের
ইংরেজ অ্যাকাডেমির সদস্যতার জন্য প্রস্তাবিত করা হয়েছিল এবং তিনি অবিলম্বে নির্বাচিত
হয়েছিলেন, যেমনটা সচরাচর হয় না। … কিন্তু এই সব গণ-সম্মানে তাঁর কোনো ফারাক পড়ত না। এমনই নিরহঙ্কারী
ছিলেন তিনি …” বিজ্ঞান-বিষয়ে মার্ক্সের
এবং বিশেষ করে এঙ্গেলসের কাজে তিনি সারা জীবন সাহায্য করে গেলেন।
এবছরই শেষের মাসগুলোয়
কখনো, জার্মান ভাষায় জেনা থেকে প্রকাশিতব্য রাজনীতিবিজ্ঞানের অভিধানের জন্য কার্ল মার্ক্সের
একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী লেখার প্রস্তাব এল এঙ্গেলসের কাছে। তৃতীয়বার তিনি মার্ক্সের জীবনী
লিখলেন। ৯ থেকে ২৫ নভেম্বর অব্দিকার দু’সপ্তাহে লিখিত এবারের প্রবন্ধটিতে ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’, ‘পূঁজি (প্রথম খণ্ড)’ এবং মার্ক্সের শেষ বছরগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা তো ছিলই, অতিরিক্ত
একটা কাজও তিনি করে রাখলেন যেটা পরের প্রজন্মের মার্ক্স-গবেষকদের প্রচুর সাহায্য করল।
প্রথম থেকে মৃত্যুকাল অব্দি প্রকাশিত, মৃত্যুর পর প্রকাশিত এবং তখনও প্রকাশের প্রতীক্ষারত
মার্ক্সের যাবতীয় রচনার তিনি একটি সূচি তৈরি করলেন, এবং প্রবন্ধের শেষে তিনি সেই সূচির
যতটা সম্ভব অন্তর্ভুক্ত করলেন। শেষ লাইনে ঘোষণাও করে দিলেন যে ‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ড ১৮৯৩এ প্রকাশিত হবে।
এখানেই উল্লেখ করা
ভালো যে দু’বছর আগে তিনি নিজের
রচনাগুলিরও একটি সূচি তৈরি করেছিলেন। রচনাসমগ্রের পাদটীকা সময়টা বলছে জুলাই ১৮৯০এর
পর। তাই যদি হয়, তাহলে সময়টা, স্বাস্থ্যলাভের জন্য স্কর্লেমারের সঙ্গে সমুদ্রপথে নর্থ
কেপ অব্দি যাত্রা করে ফিরে আসার পর। অর্থাৎ, ফিরে এসে, বাড়িতে নতুন মালিক রং করাচ্ছে
দেখে যখন ফকস্টোনে গিয়ে কিছুদিন রইলেন, তখনই, যেহেতু হাতের কাজ সব বাড়িতে পড়ে তাই বসে
তৈরি করা মনে হয়। মার্ক্সকে এবং নিজেদের বন্ধুত্বকে যে কী চোখে দেখতেন তা এই সূচি পড়লে
বোঝা যায়। খবর-কাগুজে রচনা তো মার্ক্সেও বাদ দিলেন, নিজেরটাতেও বাদ দিয়েছিলেন, সামরিক
বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোও নিজের সূচিতে বাদ দিয়েছিলেন। অথচ মার্ক্সের লেখার পুনঃপ্রকাশে
লেখা একেকটি মুখবন্ধ ও ভূমিকাও সূচির অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন আর সূচির শিরোনাম দিয়েছিলেন
‘আমার অমর রচনা’। সূচিটা পরে তাঁর পান্ডুলিপিতে আবিষ্কৃত হয়েছিল।
১৯৯৩ সালের শুরুতে
তাঁর দুটো স্বতন্ত্র প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। অর্থাৎ, অনেক দিন পর, সেগুলো কোনো গ্রন্থের
মুখবন্ধ বা ভূমিকা ছিল না, দীর্ঘ লিখিত ভাষণ বা শুভেচ্ছাবার্তাও ছিল না। খণ্ডনমূলক
লেখার শৃংখলাও ছিল না, যেমন দু’বছর আগে তাঁকে লিখতে হয়েছিল। ব্রেন্তানো নামে এক ব্যক্তি মার্ক্সের
ঘ্রন্থাদি এবং চিন্তাভাবনার ওপর ‘চুরি’র অভিযোগ করেছিল।
অবশ্য মার্ক্সের বিরুদ্ধে ‘চুরি’র ঈর্ষাজনিত অভিযোগ তাঁর জীবনকালে এবং মৃত্যুর
পরও অনবরত কেউ না কেউ করে গেছে। লিখিত অভিযোগ তো বটেই, নিজেদের ভাষণে মৌখিক অভিযোগও
করেছে অনেক পাতি-পূঁজিবাদী সমাজবাদী নেতা এবং তথাকথিত পণ্ডিতেরা। যে কোনো সস্তা বুদ্ধিজীবী
আজও সংবাদ মাধ্যমের প্রচারে আসার জন্য এই একটাই খেলা খেলে। এখন আর শুধু মার্ক্স নয়,
মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন …। হয় লেখার ওপর কাদা
ছেটাও, অথবা ব্যক্তিগত জীবনের ওপর কাদা ছেটাও। এঙ্গেলস যতদিন বেঁচে ছিলেন তাঁকে এধরণের
কুৎসাজীবী পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিল।
কিন্তু এদুটো প্রবন্ধের
বিষয় ছিল ভিন্ন। এবং দুটোই আজকের পরিস্থিতিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ১৮৯২-৯৩এ ইতালিতে
একটা বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছিল। কেলেঙ্কারিতে ইতালীয় সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ, উকিল,
সাংবাদিক এবং কয়েকজন বেসরকারি ব্যক্তিও শামিল ছিল। ইতালির সমাজবাদী দার্শনিক অ্যান্তোনিও
ল্যাব্রিওলা এঙ্গেলসের বন্ধু ছিলেন। তিনিই সব কাগজপত্র জোগাড় করে এনে দিলেন। এঙ্গেলস
প্রবন্ধটা লিখে ‘ভোরওয়ার্টস’এ ছাপানোর জন্য পাঠিয়ে সম্পাদক লিবনেখটকে লেখকের
নাম গোপন রাখতে বললেন যাতে ইতালির পুলিস বা গুপ্তচর তাঁর দিকে নজর রাখতে রাখতে ল্যাব্রিওলা
পর্য্যন্ত না পৌঁছে যায়। প্রবন্ধটার নাম দিলেন ‘ইতালীয় পানামা’।
১৮৭৯ সালে, ফ্রান্সের
মন্ত্রী, আধিকারিক এবং সংবাদ মাধ্যমগুলোকে ঘুষ দিয়ে একটা কেলেঙ্কারি করা হয়েছিল। ক্যারিবিয়ান
সমুদ্র এবং প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগস্থলে যোজক একটি স্থলভূমি আছে যা উত্তর ও দক্ষিণ
আমেরিকাকে যোগ করে। তাকে বলা হয় ‘পানামার ইস্থমাস’। এখন তার ওপর দিয়েই গেছে পানামা খাল। এই পানামা খাল ১৯০৪-১৯১৪র
সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছে। কিন্তু তার আগে এই খাল খোঁড়ার বরাত নিয়েছিল
ফ্রান্স এবং তখন অনেক টাকার বেআইনি লেনদেন হয়েছিল, কিন্তু খাল খোঁড়া হয় নি। সেটাই ইতিহাসে
‘পানামা কেলেঙ্কারি’ বলে পরিচিত। এঙ্গেলস তাই দশ বছর আগে হওয়া
কেলেঙ্কারির ইঙ্গিতটা নিজের প্রবন্ধের নাম হিসেবে ব্যবহার করলেন।
দ্বিতীয় প্রবন্ধ-শৃঙ্খলা
ছিল ‘ইয়োরোপে কি নিরস্থীকরণ
সম্ভব’? আট কিস্তিতে এই
লেখা ‘ভোরওয়ার্টস’এ ছেপেছিল। তাৎকালিক কারণ – প্রতিরক্ষা ব্যয়ে বৃদ্ধির জন্য রাইখস্ট্যাগে
একটি বিধেয়ক নিয়ে বিতর্ক। কিন্তু সাধারণভাবেও জনপ্রিয় হয়েছিল প্রবন্ধটি। পুস্তিকা হিসেবে
বেশ কয়েকবার ছাপা হল। পুস্তিকা হওয়ার সময় এঙ্গেলস একটা মুখবন্ধও লিখলেন। সেই মুখবন্ধে
বললেন, মূল প্রবন্ধগুলিতে “আমি ক্রমবর্দ্ধমান
সাধারণ গ্রাহ্যতা পাওয়া একটি অনুমান ধরে এগিয়েছি যে – স্থায়ী সেনাবাহিনীর ব্যবস্থা পুরো ইয়োরোপে
এমন চরমে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে যে তার পরিণামে হয় সব দেশের মানুষ সামরিক ভারগ্রস্ততায়
আর্থিকভাবে বিধ্বস্ত হবে অথবা একে অন্যেকে ধ্বংস করার সাধারণ যুদ্ধে অধঃপতিত হবে। যদি
না সময় থাকতে জনগণকে সাধারণভাবে সশস্ত্র করে ঐ স্থায়ী সেনাবাহিনীগুলোকে গণসেনাতে পরিবর্তিত
করা হয়।
“আমি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি যে এই পরিবর্তন এই মুহূর্তে সম্ভব।
বর্তমান সরকারসমুদয়ের পক্ষেও সম্ভব আর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও সম্ভব। এই অবস্থাটাকে
আমি আমার আলোচনার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছি এবং আপাততঃ শুধু সেই উপায়গুলোর প্রস্তাব
দিয়েছি যেগুলো যে কোনো সরকার, জাতীয় সুরক্ষাকে বিঘ্নিত না করে গ্রহণ করতে পারে। আমি
সামরিক দৃষ্টি থেকে শুধু এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত করতে চাই যে ক্রমশঃ, স্থায়ী সেনাবাহিনীর
বিলোপ না ঘটানোর পেছনে কোনো যুক্তি নেই আর তবুও যদি এই সেনাবাহিনীগুলোকে বহাল রাখা
হয়, তার কারণ সামরিক নয়, রাজনৈতিক – অর্থাৎ এক কথায়, সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য বাহ্য শত্রু থেকে নয়, আন্তরিক
শত্রু থেকে সুরক্ষা প্রদান।”
অনেক বছর পর, ১৮৯৩
সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে এঙ্গেলস ইয়োরোপ সফরে বেরোলেন। তাঁর চিঠিপত্র পড়লে দেখা
যায় আগের বছরও তিনি যাওয়ার তোড়জোড় করেছিলেন কিন্তু ঠিক যাওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
এবার তাই, এক সপ্তাহ আগেই ইস্টবোর্নে গিয়ে সমুদ্রের হাওয়ায় একটু শক্তি ফিরিয়ে নিলেন
তারপর পয়লা আগস্ট মহাদেশের মূলভূমির দিকে যাওয়ার জাহাজে চড়লেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর সচিব
ও গৃহকর্ত্রী লুইসা স্ট্রেসার। বন্ধুদের সঙ্গে, সাথীদের সঙ্গে, নিজের ভাইয়ের পরিবারের
সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করার পাশাপাশি আরো দুটো অতিরিক্ত কারণ ছিল এই সফরের। প্রথমতঃ, তাঁর
উদ্দেশ্য ছিল ৬ই আগস্ট জ্যুরিখে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক সমাজবাদী শ্রমিক অধিবেশনে
অংশগ্রহণ। দ্বিতীয়তঃ, ‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদনার সমাপ্তি দৃশ্যমান
হতে শুরু করেছিল। উনিশ দিন আগে, ১২ই জুলাই তিনি ফিলিপো তুরাতিকে লিখেছিলেন, “তৃতীয় খণ্ড এখনও নাকাল করছে, তবে মন খুশিতে
আছে যে শেষটা দেখতে পাচ্ছি।”
মহাদেশে পৌঁছে সবচেয়ে
আগে তিনি কোলোন গেলেন। সেখানে অগাস্ট বেবেল এবং তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন। তারপর
বেবেল দম্পতির সঙ্গে মাইঞ্জ এবং স্ট্রসবার্গ হয়ে জ্যুরিখ পৌঁছোলেন। সুইটজারল্যান্ডেই
গ্রবুন্ডেনে তাঁর ভাই হের্মান থাকতেন। জ্যুরিখ থেকে নিজের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য
গ্রবুন্ডেনে চলে গেলেন। ১২ই আগস্টে জ্যুরিখ ফিরে এলেন আন্তর্জাতিক সমাজবাদী শ্রমিক
অধিবেশনের শেষ সত্রে অংশগ্রহণ করার জন্য। অধিবেশনে ১৮টি দেশের ৪১১ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ
করছিলেন। অধিবেশন কক্ষে মার্ক্সের ছবি টাঙানো ছিল। অধিবেশনের ব্যুরো এঙ্গেলসকে সত্রে
সভাপতিত্ব করার আমন্ত্রণ জানালো এবং সত্রের সমাপ্তির ঘোষণা করতে অনুরোধ করল।
এঙ্গেলসের সমাপন-ভাষণ,
ইংরেজি, ফরাসি আর জার্মান, তিন ভাষায় হল। নিজের ভাষণে তিনি মার্ক্সকে স্মরণ করলেন,
‘প্রথম আন্তর্জাতিক’এর ঐতিহাসিক ভূমিকা চিহ্নিত করলেন এবং সব দেশের
সর্বহারাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই মঞ্চটিকে বহাল রাখার আহ্বান জানালেন। বললেন –
“ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে মার্ক্স এবং আমি ‘ড্যুশ ফ্রাঞ্জোইশ জাহ্রবুখের’এ আমাদের প্রথম সমাজবাদী প্রবন্ধ প্রকাশ করে
আন্দোলনে প্রবেশ করেছিলাম। এই পঞ্চাশ বছরে সমাজবাদ ছোটো ছোটো সম্প্রদায় থেকে শক্তিশালী
দলে পরিণত হয়েছে, আর তা দেখে পুরো সরকারি দুনিয়া ভয়ে পিছোচ্ছে। মার্ক্স মারা গেছেন,
কিন্তু যদি জীবিত থাকতেন, সবার চেয়ে বেশি তিনি নিজের জীবনের কাজে ন্যায়সঙ্গত গর্ব করতে
পারতেন। আরেকটি বার্ষিকী আছে উদযাপন করার। ‘আন্তর্জাতিক’এর শেষ কংগ্রেস ১৮৭২ সালে হয়েছিল। … এবং আন্তর্জাতিক আজ আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।
… আলাদা সম্প্রদায়
যাতে না হই তার জন্য আলোচনায় সম্মতি জানাতে হবে, কিন্তু সাধারণ অবস্থান ধরে রাখতে হবে।”
সুইটজারল্যান্ডে
কয়েকদিন ঘুরে, মিউনিখ আর স্যালজবার্গ হয়ে ভিয়েনা গেলেন। ভিয়েনায় ১৪ই সেপ্টেম্বর তারিখে
তিনি সামাজিক-গণতন্ত্রীদের একটি বৈঠককে সম্বোধিত করলেন। ভিয়েনা থেকে প্রাগ এবং কার্লসবাড
(কার্লোভি ভেরি) হয়ে বার্লিন পৌঁছোলেন। বার্লিনে ১৬ থেকে ২৮শে সেপ্টেম্বর পর্য্যন্ত
থাকলেন। তামাম পুলিশি নজর সত্ত্বেও তিনি সামাজিক-গণতন্ত্রীদের একটি সভাকে সম্বোধিত
করলেন যাতে ৪০০০ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। ২৬শে সেপ্টেম্বর এঙ্গেলসের জন্য একটি অভিনন্দন
সমারোহ হল যাতে বক্তৃতা-ক্রমে উইলহেল্ম লিবনেখট জার্মানির শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনে
এঙ্গেলসের ভূমিকার কথা বললেন। সেপ্টেম্বরের শেষে রটারড্যাম হয়ে এঙ্গেলস লন্ডনে ফিরে
এলেন।
এসেই ব্যস্ত হয়ে
পড়লেন তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদনা পুরো করতে। আগেই ফিলিপো তুরাতিকে যেমন লিখেছিলেন যে শেষটা
দেখতে পাচ্ছেন, তাই ১৯৯৪ সালের প্রথম থেকেই এক একটা অংশকে চূড়ান্ত রূপ দিয়ে প্রকাশকের
কাছে পাঠাতে শুরু করে দিলেন। ৯ই জানুয়ারি স্টুটগার্টে কার্ল কাউটস্কিকে লিখলেন, “প্রিয় ব্যারন, এড নিঃসন্দেহে তোমাকে তৃতীয়
খণ্ডের একাংশ (মোটামুটি এক ঘনফুটের এক তৃতীয়াংশ) পাঠানোর কথা বলে দিয়েছে। যেহেতু সেটা
সুরক্ষিতভাবে হামবুর্গে পৌঁছে গেছে, আমি তোমাকে ‘ন্যু জেইট’এর জন্য তার একটা ছোটো সমীক্ষা পাঠাতে পারব, আর সেটা এই চিঠির সঙ্গে
পাঠালাম। … দ্বিতীয় তৃতীয়াংশের
ওপর কাজ চলছে; আশা করি শিগগিরই তৈরি হয়ে যাবে।”
৯ই জানুয়ারিতেই একটা
সমীক্ষামূলক ছোটো প্রবন্ধ আর একটা খবর লিখেছিলেন। আধপৃষ্ঠার খবরটা ‘কার্ল মার্ক্সের ‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ড’ শিরোনামে ১২ই জানুয়ারি ‘ভোরওয়ার্টস’এ প্রকাশিত হয়েছিল। আর প্রবন্ধটা ‘‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ডের বিষয়বস্তু’ নামে ‘ন্যু জেইট’এ এবং ‘আর্বেইটার জাইটুং’এ ২৬শে জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছিল।
১৮৯৪এর অনেকগুলো
মাস এভাবেই কাটল – এক এক অংশের পাণ্ডুলিপিকে
চূড়ান্ত রূপ দিচ্ছেন, তারই মধ্যে প্রুফ চলে আসছে; সেগুলো দেখছেন, ডাকে পাঠাচ্ছেন প্রকাশকের
কাছে এবং এভাবে ছাপার আগের শেষ প্রুফ হাতে এলে পাঠিয়ে দিচ্ছেন রুশীয় অর্থশাস্ত্রী বিদ্বান
নিকোলাই ড্যানিয়েলসনের কাছে। ‘পূঁজি’র প্রথম ও দ্বিতীয়
খন্ডও এভাবেই, প্রুফ পাঠিয়ে পাঠিয়ে রুশীয় ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।
কথাটা গুরুত্বপূর্ণ
যে মূল জার্মানের পর, ‘পূঁজি’র অনুবাদ ও প্রকাশনা রুশীয় ভাষাতেই হয়েছিল
প্রথম। রুশীয় অনুবাদে প্রথম খণ্ড বেরুল ১৮৭২ সালে, মুল জার্মানের (১৮৬৭) পাঁচ বছর পর।
কেননা বইটির গুরুত্ব তখনও অনুভূত হয় নি ইয়োরোপের পাঠক সমাজে। অনুভূত হওয়ার পর রুশীয়
সমাজবাদীরা আর দেরি করে নি। দ্বিতীয় খণ্ড মূল জার্মানে ১৮৮৫তে প্রকাশিত হওয়ার পর রুশীয়
অনুবাদও ১৮৮৫তেই প্রকাশিত হয়েছিল। আর তৃতীয় খণ্ড মূল জার্মানে ১৮৯৪এ প্রকাশিত হলে ১৮৯৬এ
রুশীয়তে প্রকাশিত হয়েছিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, এত কঠোর জারতন্ত্রের সেন্সর কিন্তু
‘পূঁজি’তে কখনো আপত্তিকর কিছু খুঁজে পায় নি। তাদের
অভিমত ছিল যে এটি বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ।
আর বিক্রি! প্রথম
খণ্ডের মূল জার্মান গ্রন্থটি পাঁচ বছরে এক হাজার বিক্রি হয়েছিল। যখন নাকি রুশীয় অনুবাদ
পাঁচ বছরে তিন হাজার বিক্রি হয়েছিল। মার্ক্স নিজেই বলতেন, রাশিয়াই সেই দেশ যেখানে তাঁর
‘পূঁজি’ গ্রন্থটি, “যে কোনো জায়গা থেকে বেশি পঠিত হয় এবং মূল্যবান
মনে করা হয়।”
তৃতীয় খণ্ডের কাজের
ব্যস্ততার মধ্যেই এঙ্গেলসের বাড়িতে একটি সুখবর তৈরি হল। ১৮৯৪এর মার্চ মাসে তাঁর সচিব
লুইসা স্ট্রেসার (যদিও বিবাহবিচ্ছেদের পরেও লোকমুখে তাঁর পরিচিত নাম লুইসা কাউটস্কিই
ছিল) এল. ফ্রেবার্গার নামে এক ডাক্তারকে বিয়ে করলেন। ফ্রেবার্গারও অস্ট্রিয়ার মানুষ
ছিলেন এবং তাঁরও নিবাস ছিল ভিয়েনা। কিন্তু ডাক্তারি পেশায় লন্ডনের হাসপাতালের সঙ্গে
যুক্ত ছিলেন। বিয়ের পর যখন দুজনে এঙ্গেলসের সঙ্গে দেখা করলেন এঙ্গেলস ফ্রেবার্গারকে
তাঁর বাড়িতেই থাকার প্রস্তাব দিলেন। প্রস্তাবটা ফ্রেবার্গার এবং লুইসা দুজনেরই মনঃপুত
হল। এতে দুটো লাভ হল। লুইসা এঙ্গেলসের সচিব ও গৃহকর্ত্রী রয়ে গেলেন আর এঙ্গেলস অসুস্থ
হয়ে পড়লে দেখাশোনা করা, আরামের জন্য বাধ্য করা, চিকিৎসার প্রয়োজনে নিয়মিত পরীক্ষাগুলো
করানো ইত্যাদি কাজে লুইসা ফ্রেবার্গারের সাহায্য পেতে লাগলেন।
জুন মাসে এঙ্গেলস
একটি ভিন্নধর্মী লেখা, ‘প্রারম্ভিক খ্রিষ্টধর্মের
ইতিহাস প্রসঙ্গে’ নিয়ে কিছুদিনের
জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কাউটস্কিকে একটা চিঠিতে লিখলেন যে ১৮৪১ সাল থেকে বিষয়টা তাঁর
মাথায় ঢুকেছিল। আগেও দুবার লেখার কথা ভেবেছিলেন। প্রধানতঃ খ্রিষ্ট সাহিত্যের বিশ্লেষণ
করে তিনি দেখালেন যে খ্রিষ্টধর্ম নিজের প্রারম্ভিক অবস্থায় রোম সাম্রাজ্যের অবদমিত,
নিষ্পেষিত, তিরষ্কৃত মানুষদেরই প্রভাবিত করেছিল, তারাই এধর্মের প্রারম্ভিক অনুগামী
হয়েছিল। বিপরীত দিক থেকে দেখলে বলা যায়, যে কোনো সময়ের অবদমিত, নিষ্পেষিত, অত্যাচারিত
ও তিরষ্কৃত মানুষের হৃদয়ের অভিব্যক্তি এমনই সব ধর্মমতের মাধ্যমে, ধর্মসভা ইত্যাদির
মাধ্যমে হয়। আধুনিক শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের সঙ্গে ঐ সমস্ত অভিব্যক্তিগুলোর আভ্যন্তরীণ
বিষয়বস্তুর একটি গভীর সম্পর্ক আছে। তফাৎ এটুকুই যে ওদের ভাবনায় ‘মুক্তি’ ভিন্ন বিশ্বে অর্থাৎ পরলোকে সম্ভব যখন নাকি শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের
ভাবধারা অনুসারে মুক্তি ইহলোকে অর্থাৎ এই বিশ্বেই সম্ভব।
এঙ্গেলস নিজের সামনে
লক্ষ্য রেখেছিলেন যে সেপ্টেম্বর পর্য্যন্ত তিনি ‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদনার কাজ শেষ করে ফেলবেন। সময় মত করেও নিলেন।
কিন্তু প্রুফ দেখার কাজের মাঝেই নতুন বাড়ি নিতে হল। ডাক্তার ফ্রেবার্গারের চলে আসার
পর থেকেই বাড়িটা একটু ছোটো পড়ছিল। এখন লুইসা গর্ভবতী। প্রসবের পর আরো বেশি জায়গার প্রয়োজন
হবে। তাই এঙ্গেলস বাড়িটা ছেড়ে ঐ রিজেন্ট পার্ক রোডেই একটু বড় দেখে বাড়ি নিলেন। যেকোনো
বড় শহরে নতুন ভাড়াবাড়ি নিতে গেলে অনেক হয়রানি হয়। এঙ্গেলসেরও হল। কিন্তু নিজের পড়ার
ঘর দেখে তিনি খুশি হলেন। ৯ই অক্টোবরে তাঁরা নতুন বাড়িতে এলেন আর ৬ই নভেম্বরে লুইসা
একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন। এই সব ব্যস্ততার মাঝেই এঙ্গেলস ‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ডের শেষ অংশগুলোর অবশিষ্ট প্রুফ প্রকাশককে পাঠিয়ে দিলেন।
২৪শে নভেম্বর, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে ড্যানিয়েলসনকে সাংকেতিক ভাষায় লিখলেন, “আপনি যা পেয়েছেন তার ধারাবাহিকতায় আরো কিছু
আমি আপনাকে পাঠাবার চেষ্টা করব” অর্থাৎ, আশ্বাস দিলেন যে শেষ প্রুফগুলো ফিরে এলে তাঁকে পাঠিয়ে দেবেন।
নিচে প্রতিবারের মত স্বাক্ষর করলেন এল. কে., অর্থাৎ লুইসা কাউটস্কি। এই নামটাই রাশিয়ায়
চিঠি পাঠানোর জন্য ব্যবহার করতেন।
চুয়াত্তর বছর বয়স,
মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, তবু কেমন দিনযাপন ছিল এঙ্গেলসের? কাছের মানুষ বলতে মার্ক্সের
দুই মেয়ে। ছোটো ইলিয়ানর লন্ডনেই থাকতেন। তাই প্রায় প্রতি সপ্তাহে দেখা হয়ে যেত। চিঠিতে
মনের কথা লিখতেন ফ্রান্সবাসী লরাকে। ১৭ই ডিসেম্বর লরাকে লিখলেন –
“তুই বলিস তৃতীয় খণ্ড শেষ হলে, চতুর্থ খণ্ডের কাজ শুরু করার আগে আমি
একটু বিশ্রাম করতে চাইব। এবার আমি বলি যে আমার অবস্থাটা কী।
“আমাকে ইয়োরোপের পাঁচটা বড় এবং অনেকগুলো ছোটো দেশের আর তাছাড়া মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের আন্দোলনগুলোর ওপর নজর রাখতে হয়। তার জন্য আমি তিনটে জার্মান, দুটো ইংরেজি,
একটা ইতালীয় দৈনিক নিই। পয়লা জানুয়ারি থেকে একটা ভিয়েনার দৈনিক নেব। মোট সাতটা। সাপ্তাহিক
বলতে আমি জার্মানি থেকে নিই দুটো, অস্ট্রিয়া থেকে সাতটা, ফ্রান্স থেকে একটা, এমেরিকা
থেকে তিনটে (দুটো ইংরেজি, একটা জার্মান), ইতালীয় দুটো, পোলিশ, বুলগারীয়, স্পেনীয় এবং
বোহেমীয় একটা একটা। এগুলোর মধ্যে তিনটের ভাষা আমি এখনও ক্রমশঃ রপ্ত করছি। এসবের পর
থাকে বিভিন্ন ধরণের মানুষ যারা দেখা করতে আসে (এক্ষুনি, কয়েক মিনিট আগে আমস্টারডাম
থেকে পোল্যাক একজন জার্মান ভাষ্করকে পাঠিয়েছে, কপর্দকশূন্য এবং বেকার)। তারপর আসে সংবাদদাতারা,
‘আন্তর্জাতিক’এর দিনগুলোর চেয়েও বেশি। অনেকেই দীর্ঘ ব্যাখ্যা
চায় আর সময় খায় সবাই। এ সমস্তকিছু আর তারপর তৃতীয় খণ্ড। এমনকি প্রুফ দেখার সময় সুদ্ধু
পুরো ১৮৯৪ সালে আমি একটার বেশি বই পড়তে পারি নি।
“এর পর মোহ্র” [মার্ক্স] “-কে লেখা লাসালের চিঠিগুলোর প্রকাশনা। টুসি টাইপ করে দিয়েছে। আমার
টেবিলে রাখা আছে। কিন্তু এই বাড়িবদলের জন্য আমি ওগুলো ছুঁতেও পারি নি। ছোঁওয়ার মানে
হল টিপ্পনী লেখা, বহুকাল আগের তথ্যের এবং মোহ্রের সঙ্গে আমার চিঠিচালাচালির উল্লেখগুলো
করা – আর একটু বুদ্ধি
করে একটা মুখবন্ধ লেখা।
“তারপর আমার নিজের অসমাপ্ত লেখাগুলোর স্তূপ। ‘জার্মানিতে কৃষক যুদ্ধ’ পুরোটা আবার করে লেখা। বহু বছর বইটা বিক্রিতে
নেই, আর তৃতীয় খণ্ডের পর ওটাই ধরব বলে কথা দিয়েছি। তার জন্য অনেক পড়াশুনো করতে হবে।
প্রুফ দেখার পাশাপাশি চালাবো ভেবেছিলাম, কিন্তু অসম্ভব। যাহোক, আমাকেই দেখতে হবে কী
করে করা যায় কাজটা।
তারপর, ঘাড়ের ওপর
থাকা ছোটো ছোটো কাজগুলোর কথা যদি নাও বলি, মোহ্রের রাজনৈতিক জীবনের অন্তত প্রধান অধ্যায়গুলো
– ১৮৪২-১৮৫২ আর ‘আন্তর্জাতিক’ – আমি লিখতে চাই। পরেরটা সবচেয়ে জরুরি আর এখনই জরুরি। সেটাই আগে লিখতে
চাই। কিন্তু তার জন্য বার বার বাধা পাওয়ার পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাই, কবে পাবো সেটা?
“এই সব কিছু আমাকেই করতে হবে, আর এরপর করতে হবে মোহ্র আর আমার আগেকার
ছোটো লেখাগুলোর পুনর্সংস্করণ। তার জন্য সংগ্রহ করছি। খুব বেশি সফল হই নি। কিছু লেখা
বার্লিনে পার্টির মহাফেজখানায় আছে। অনেক কিছুর এখনো খোঁজ পাই নি। যেমন প্রথম ‘রাইনিশে জাইটুং’এর কপি। ১৮৪২-৫০এর প্রবন্ধগুলোর দুই তৃতীয়াংশ
সংগ্রহ করতে পারলেও কাজ শুরু করে দিতাম। কেননা নিশ্চিত জানি তার দ্বিতীয় সংস্করণের
সময় আসতে আসতে আরো অনেকগুলো লেখা পাওয়া যেত। কিন্তু আমরা এখনো ততটা এগোই নি।
আর তারপর চতুর্থ
খণ্ড। সে খণ্ডের একেবারে খসড়া একটা পাণ্ডুলিপি আছে; এখন বলা অসম্ভব তার কতটা ব্যবহার
করা যাবে। আমি নিজে আর সেটার জট খুলে পড়ে লেখানোর দায়িত্ব নিতে পারব না যেমন দ্বিতীয়
আর তৃতীয় খণ্ডের বেলায় নিয়েছিলাম। আদ্ধেকে পৌঁছোবার আগেই আমার দৃষ্টিক্ষমতা পুরোপুরি
নষ্ট হয়ে যাবে। এ ব্যাপারটা অনেক বছর আগেই আন্দাজ করে একটা ঘুরপথ বার করেছিলাম। ভেবেছিলাম
তরুণ প্রজন্মের দু’একজন বুদ্ধিমান মানুষকে
মোহ্রের হাতের লেখা পড়তে শেখানো কাজের কাজ হবে। কাউটস্কি আর বার্নস্টাইনের কথা ভেবেছিলাম
কাউটস্কি তখনও লন্ডনে ছিল (৬/৭ বছর আগে)। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সে রাজি হয়ে গেল। বললাম,
তাকে আমি পান্ডুলিপি যা-আছে-যেমন-আছে তার চূড়ান্ত ‘শুদ্ধ অনুলিপি’ করার একশো পাউন্ড দেব। যেখানে সে পাঠোদ্ধার করতে পারবে না, আমি
সাহায্য করব। শুরু করল। তারপর লন্ডন ছেড়ে চলে গেল। সঙ্গে একটা নোটবই নিয়ে গেল আর তারপর
বছরের পর বছর তার কোনো খবর নেই। ‘ন্যু জেইট’ নিয়ে সে খুব ব্যস্ত ছিল তাই পাণ্ডুলিপি আর তার নকল ফেরত চাইলাম।
পুরো নোটবইটার একের আট বা একের ছয় ভাগ নকল করেছিল। বার্নস্টাইন খুব বেশি ব্যস্ত তো
বটেই, অতিপরিশ্রান্ত, এখনো নিউরেস্থেনিয়া থেকে সেরে ওঠে নি; তাকে কাজটা করতে বলতে সাহস
করি না। টুসি করবে কিনা দেখি। বার্নস্টাইন নিজের থেকে করতে চাইলে ভালো। যদি না চায়,
আমি চাই না কেউ কালকে বলুক যে আমি তার কাঁধে কাজের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তার অসুখ বাড়িয়ে
দিয়েছি।”
নিজের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ
হয়েও এসব কাজের অনেকটাই তিনি পুরো করতে পারেন নি। এই চিঠি লেখার সাড়ে সাত মাস পরে তো
তিনি চলেই গেলেন।
কিন্তু মার্ক্সের
প্রধান গবেষণাগ্রন্থ ‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হল। ভেবেছিলেন এক বছর
লাগবে, লাগল নয় বছর। এঙ্গেলসের নজর দিয়ে তার বিষয়বস্তুগুলোর দিকে তাকানো হয়তো কৌতুহলোদ্দীপক
হবে।
‘পূঁজি’র তৃতীয় খণ্ডের বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে
“মার্ক্সের ‘পূঁজি’র তৃতীয় বই, ‘সমগ্রতায় পূঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়া’, ‘ভোরওয়ার্টস’এর ঘোষণা অনুযায়ী আগামী শরতে বেরিয়ে যাবে। মনে আছে নিশ্চয়ই যে
প্রথম বই ‘পূঁজিবাদী উৎপাদনের
প্রক্রিয়া’ নিয়ে ছিল, দ্বিতীয়তে
‘পূঁজির প্রচলনের
প্রক্রিয়া’র অনুসন্ধান করা
হয়েছিল। তৃতীয় বই ‘সমগ্রতায় পুঁজিবাদী
উৎপাদন প্রক্রিয়া’ নিয়ে আলোচনা করবে।
এভাবে উৎপাদনের এবং প্রচলনের আলাদা আলাদা প্রক্রিয়াগুলোকে বিচ্ছিন্নতায় নয়, পূঁজির
গতিবিধির একরূপ সামগ্রিক প্রক্রিয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে এবং সে গতিবিধির যোগসূত্র হিসেবে
তাদের আন্তঃসংযোগে পরীক্ষা করা হয়েছে। যেহেতু প্রথম দুটো বই এই প্রক্রিয়ার দুটো প্রধান
দিকের কোনো একটি র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল, বিষয়বস্তুতে সম্পূরণের আবশ্যকতা রয়ে
গেল এবং বইদুটোর গড়ন হল একপেশে আর বিমূর্ত। ব্যাপারটা বিশেষ করে এই তথ্যে স্পষ্ট হয়
যে দুটো বইয়েই উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বানুসন্ধান, প্রথম আত্মসাৎকারী, শিল্প-পূঁজিপতির
আয়ত্তাধীন হওয়ার স্থানকাল অব্দি করা গেছে। সাধারণভাবে সূচিত করা হয়েছে যে প্রথম আত্মসাৎকারীই
যে শেষ আত্মসাৎকারী হবে, সেটা অবধারিতও নয়, হয়ও না। কিন্তু, বিভিন্ন স্বার্থসম্পন্ন
পক্ষগুলোর – ব্যবসায়ী, মহাজন,
ভূস্বামী ইত্যাদির – মধ্যে উদ্বৃত্ত
মূল্যের বিতরণেই পূঁজির আনুপূর্বিক গতিবিধি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে এবং বলতে গেলে, সমাজে
খোলাখুলি হতে দেখা যায়। তাই, প্রথম দুটো বইয়ে বিশ্লেষিত প্রক্রিয়া অতিক্রম করার পর
উদ্বৃত্ত মূল্যের বিতরণ, তৃতীয় বইয়ে প্রবাহিত মূল সুরটি গঠন করে। যে নিয়মগুলো এই বিতরণকে
নিয়ন্ত্রিত করে, সবিস্তারে সেগুলোর ব্যাখ্যা করা হয়েছেঃ উদ্বৃত্ত মূল্যের দরের সঙ্গে
মুনাফার দরের সম্পর্ক; মুনাফার গড় দরের নির্মাণ; আর্থিক বিকাশের পথে মুনাফার এই গড়
দরের ক্রমাগত পতনের প্রবৃত্তি; বাণিজ্যিক মুনাফার পরিবর্তিত গতিপথ; ঋণপূঁজির হস্তক্ষেপ
এবং মুনাফার, সুদে ও উদ্যোগের মুনাফায় বিভাজন; ঋণপূঁজি ও তার প্রধান দুটি অবলম্বন,
ব্যাঙ্ক এবং প্রতারক উদ্ভব, স্টক এক্সচেঞ্জের ভিত্তিতে রচিত ঋণব্যবস্থা; উদ্বৃত্ত মুনাফার
উৎপত্তি এবং বিশেষ কিছু অবস্থায় তার জমিভাড়ায় রূপান্তরণ; এই ভাড়ার প্রাপক ভূসম্পত্তি; ফলে, শ্রম কর্তৃক নতুন সৃজিত
উৎপন্ন মূল্যের তিন ধরণের আয়ে সামগ্রিক বিতরণ – মজুরি, মুনাফা (সুদ সহ), জমিভাড়া; পরিশেষে, এই তিন ধরণের আয়ের প্রাপকঃ
শ্রমিক, পূঁজিপতি, ভূস্বামী – আজকের সমাজের শ্রেণীসমূহ। দুর্ভাগ্যের কথা, এই শেষ ভাগ – শ্রেণীসমূহের – বিশদে মার্ক্স যান নি।
“যাহোক, বিষয়বস্তুর এই সংক্ষিপ্ত নিরীক্ষা এটা বোঝাতে যথেষ্ট যে যেসব
প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলোকে গ্রন্থের প্রথম দুই খণ্ডে অপরিহার্য কারণে অনুত্তরিত ছেড়ে
যেতে হয়েছিল, এই খণ্ডে সেই প্রশ্নগুলো সব দিক থেকে উপযুক্ত ভাবে আলোচিত হয়েছে।”
No comments:
Post a Comment