মুখবন্ধ
ফ্রেডরিক এঙ্গেলসকে আমরা কার্ল মার্ক্সের
ঘনিষ্ঠতম ভাবধারাগত সহযোগী, এবং ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বন্ধু বলে জানি।
বস্তুতঃ আজকের কেন, হাজার হাজার বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাসে বন্ধুত্বের কয়েকটি
নিদর্শনের অন্যতম এই যুগল। ভাবধারাগত ঘনিষ্ঠতা এত বেশি ছিল
যে, যে বিশ্বদৃষ্টিকে আজ আমরা মার্ক্সবাদ বলে জানি সেই বিশ্বদৃষ্টি স্পষ্ট করার জন্য
জরুরি ভাবধারাগত সংগ্রামের প্রথম তিনটে ধাপের দলিল, যুগ্মনামে লিখিত দুটো গ্রন্থ ও
একটি পুস্তিকা – ‘পবিত্র পরিবার’, ‘জার্মান ভাবাদর্শ’ এবং যুগ-প্রবর্তক ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’ – রূপে আজ আমাদের
সামনে আছে। কিন্তু সেছাড়াও, পরবর্তী প্রতিটি গ্রন্থ, মার্ক্স লিখতে থাকলে এঙ্গেলসের
সঙ্গে প্রতিনিয়ত আলোচনা করে এগিয়েছেন; এঙ্গেলস লিখতে থাকলে মার্ক্সের সঙ্গে আলোচনা
করে এগিয়েছেন। মার্ক্সের মৃত্যুর পর তো এঙ্গেলস নিজের সমস্ত অর্দ্ধসমাপ্ত কাজ দূরে
সরিয়ে, মার্ক্সের অর্ধসমাপ্ত কাজ, ‘পূঁজি – ২য়’ খণ্ডের পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত রূপে আনতে এবং
তারপর পূঁজি – ৩য় খণ্ডের খসড়াগুলোকে
পাণ্ডুলিপি রূপে আনতে খরচ করেছেন জীবনের দশ বছর। চতুর্থ খণ্ড বলে যে খসড়াগুলো একত্র
করেছিলেন, সেগুলো তাঁর মৃত্যুর কয়েক দশক পর বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত সঙ্ঘ ‘থিওরিজ অফ সারপ্লাস ভ্যাল্যু’ নামে তিন খণ্ডে প্রকাশ করে। নিজের শুরু করা
দু’তিনটে কাজ তো পুরো
করা আর হলই না।
মৃত্যুর দু’বছর আগের মে দিবসের বিকেলে হাইড পার্কের মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন দেখলেন,
দূরে মার্ক্সের ছোটো মেয়ে ইলিয়ানর শ্রমিকদের মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসছে, মৃত বন্ধুর কথা
তাঁর মনে পড়েছিল। মার্ক্সের জন্য গর্বে ভরে উঠেছিল বুক।
যতদিন মার্ক্স বেঁচে ছিলেন, বিশ্ব-সর্বহারার
আন্তর্জাতিক ভাবধারাগত নেতৃত্ব মার্ক্সের হাতে ছিল, প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠায় তাঁর
অবদানে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপে সে নেতৃত্বের
গুরুত্ব বোঝা যায়। এঙ্গেলস সে সময় তাঁর নিজেরই ভাষায় ‘সঙ্গতকার’ (সেকেন্ড ফিড্ল) হয়ে থেকেছেন। মার্ক্সের মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই
তাঁকে সেই নেতৃত্ব নিজের হাতে নিতে হয়েছে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতিতে
এবং মার্ক্সেরই মতো, বিশ্বের শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ এবং ব্যক্তিগত দেখাসাক্ষাতে
বোঝা যায় সে নেতৃত্বের গুরুভার তিনি কিভাবে বহন করতেন। লেনিন বলেছিলেন, এঙ্গেলস “আধুনিক সর্বহারার শিক্ষক”!
ভাবধারাগত এই ঘনিষ্ঠতা বাদে ছিল ব্যক্তিগত
ও পারিবারিক বন্ধুত্ব। সে প্রসঙ্গগুলো মোটামুটি সবাই জানেন এবং তা এঙ্গেলসের জীবনীরই
অঙ্গ, তাই বরং জীবনীরই কালানুক্রমে আসুক।
প্রস্তুতিপর্ব
বারমেন-এলবারফেল্ড
জার্মানির বারমেন শহর সে সময় রাইন প্রদেশে
ছিল। এখন গুগলে সার্চ করতে গেলে ভেসে উঠবে বারমেন-উপার্টাল, কেননা বারমেন ছাড়া আরো
চারটে পুরোনো শহর নিয়ে তৈরি হয়েছে আজকের উপার্টাল শহর। উনিশ শতকের প্রারম্ভিক দশকগুলোয়
রাইন অঞ্চল বাকি জার্মানি থেকে বেশি শিল্পসমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। বারমেন ব্যতিক্রম ছিল
না। সে শহরেই কাপড় কলের মালিক এক ধনী পরিবারে ১৮২০ সালের ২৮শে নভেম্বর ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের
জন্ম। তাঁর বাবার নামও ইংরেজিতে ফ্রেডরিকই, যদিও জার্মানে ‘ফ্রিডরিশ’। মায়ের নাম এলিজাবেথ। ফ্রেডরিক তার বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান।
পরে তার আরো সাত জন ভাই বোন হয়েছিল।
এঙ্গেলসের শৈশবকাল ঘরের ভিতরে এবং বাইরে দুটো
পরস্পরবিরোধী জীবনদৃষ্টির দ্বারা অনবরত প্রভাবিত হতে থাকে। বাড়িতে এক দিকে ছিলেন ডাকসাইটে
স্বভাবের বাবা যাঁর ভয়ে বাড়ির সবাই, এমনকি মা-ও ত্রস্ত হয়ে থাকতেন। বাবা তখনকার জার্মানির
ধার্মিক পরিবেশ অনুসারে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিশ্চানই ছিলেন কিন্তু অভিজাত পরিবারের দীর্ঘ
বংশপরম্পরার সঙ্গে পূঁজিবাদী জীবনে আবশ্যক ব্যবসায়িক কাজকর্মের যোগ (যা স্বাভাবিকভাবেই
ধার্মিক পবিত্রতা মেনে চলত না) তাঁকে এবং পুরো পরিবারের আবহাওয়াটাকে কঠোর পবিত্রতাবাদী
লুথারিয়ান বানিয়ে দিয়েছিল। শুধু এঙ্গেলসের পরিবারটাকেই নয়, পুরো বারমেন এবং উপার্টাল
অঞ্চলের কুলীন সামাজিক জীবনটাকে গ্রাস করেছিল ভিতর থেকে ফাঁপা এই কঠোর পবিত্রতাবাদী
আবহাওয়া। অন্য দিকে, এঙ্গেলসের মা এলিজাবেথ কোমল স্বভাবের মহিলা ছিলেন এবং তাঁর একটা
সাহিত্যিক অভিরুচি ছিল। আর্থিক অর্থে সম্পদশালী হওয়া থেকে আত্মিক অর্থে সম্পদশালী হওয়া
তিনি শ্রেয়ষ্কর মনে করতেন। শিশু ফ্রেডরিকও মায়ের কাছেই শান্তি পেত। তার সাহিত্যিক,
সাঙ্গিতিক রুচিগুলোও মায়েরই সাহচর্যে তৈরি হল।
যদিও, এরই সঙ্গে একটা তৃতীয় পারিবারিক প্রভাবও
গুরুত্বপূর্ণ। এঙ্গেলসের দাদু (মায়ের দিকের পিতামহ) গ্রীক কিম্বদন্তী এবং অন্যান্য
অনেক পৌরাণিক কাহিনী জানতেন এবং তা থেকে নেওয়া গল্প বাড়ির ছোটোদের শোনাতেন। কিম্বদন্তীর
প্রসঙ্গ এবং চরিত্রগুলো শিশুমনে সাহিত্যের মাটি তৈরি করত।
ঘরের বাইরে, আত্মীয়স্বজন এবং পারিবারিক পরিচিতদের
সীমার বাইরে ছিল বারমেনের রাস্তাঘাট, সাধারণ প্রসন্ন জনজীবন এবং শ্রমিকদের বসত। জীবনের
দুঃখকষ্ট ছাপিয়ে আনন্দ ও সারল্যে ভরা জীবনবোধ।
স্বাভাবিকভাবে এঙ্গেলসের বালকমনে তিনটে প্রবৃত্তি
একসঙ্গে জায়গা করে নিল – (১) কঠোর ধার্মিক
পবিত্রতাবাদের বিরোধ যা একটু বড় হতেই নিরীশ্বরবাদে পৌঁছে গেল; (২) সাহিত্যপাঠ এবং লেখার
দিকে ঝোঁক; (৩) জনতার জীবনকে কাছ থেকে দেখার আকাঙ্ক্ষা।
বারমেনের পাশেই ছিল এলবারফেল্ড, জোড়া-শহরের
মত। সেটাও এখন উপার্টালের অংশ। বার্মেন মিউনিসিপাল স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পর ১৪ বছর
বয়সে এঙ্গেলসকে উঁচু ক্লাসের পড়াশুনোর জন্য এলবারফেল্ড জিমনাশিয়ামে ভর্তি করে দেওয়া
হল। অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্র ছিল সে। কিন্তু সেখানেই, এক বছর পর যখন বাবা, ছাত্রাবাসের
কামরায় গিয়ে ছেলের সঙ্গে দেখা করে তার মা-কে চিঠি লিখলেন তাঁর জোর, ছেলের লেখাপড়া থেকে
‘নিঃশর্ত আজ্ঞানুবর্তিতা’এর ওপর বেশি ছিল – “আপাতদৃষ্টিতে সে আগের চেয়ে বেশি বিনয়ী হয়েছে কিন্তু মনে হয় আগে এতবার
প্রচন্ড বকুনি খেয়ে এমনকি শাস্তি পেয়েও তার ভয় তাকে নিঃশর্তভাবে আজ্ঞানুবর্তী করতে
পারে নি।” ছেলেকে নিঃশর্ত আজ্ঞানুবর্তিতার
গণ্ডির ভেতরে আনার চেষ্টার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল খ্রিষ্টীয় পবিত্রতাবাদ ও সমসাময়িক
সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার সামনে নতিস্বীকার এবং পারিবারিক ব্যবসার প্রতি
টান।
ছাত্রাবাসে কিশোর ফ্রেডরিকের টেবিলে বাবা স্কুলের
লাইব্রেরি থেকে আনা, ১৩ শতকের নাইটস(বীর)-দের ওপর লেখা একটা পুরোনো বই পেলেন। যদিও
সেই মধ্যযুগের বীরেরাও খ্রিশ্চানই ছিলেন কিন্তু শিশুদের মগজে ঐ বীরদের বীরত্বপূর্ণ
অশ্বারোহণ এবং যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রভাবকে ভালো মনে মেনে নেওয়ার সাহস, বারমেন শহরের
আধ্যাত্মিক পবিত্রতাবাদেরও ছিল না আর জার্মান (প্রুশীয়) রাষ্ট্রশক্তিরও ছিল না। তাই
ফ্রেডরিকের বাবা শুধু এবিষয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন না যে ছেলে এইসব বই পড়ে, বরং আরো
ঘাবড়ে গেলেন যে ছেলে “কেমন নিরুদ্বেগে
এসব বই টেবিলের ওপর রেখে দেয়”। … বাবা ফ্রেডরিকের
মা-কে মনের কষ্টটা স্পষ্ট করে লিখলেন যে “অন্য সব দিক থেকে এত ভালো এই ছেলেটির” জন্য তিনি “প্রায়শই ভয়ে ভয়ে” থাকেন। চিঠিতে উনি জানালেন যে ফ্রেডরিকের
সাপ্তাহিক স্কুল-রিপোর্ট খুব ভালো নয়। আর তার কারণও তাঁর হিসেবে (সেটা ভুলও ছিল না)
ফ্রেডরিকের এই আচরণ।
এলবারফেল্ডের স্কুলে পড়ার সময়েই তরুণ ফ্রেডরিক
লেখালিখি শুরু করলেন। তাঁর প্রারম্ভিক লেখাগুলোর মধ্যে একটা, ১৮৩৭এর শুরুতে লেখা যিশুখ্রিস্টের
উদ্দেশে একটি কবিতা। এই কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্রের দ্বিতীয়
খন্ডে পাওয়া যায়। ঈশ্বরের একমাত্র পুত্র যিশুখ্রিষ্টকে তাঁর স্বর্গীয় আবাস থেকে আরেকবার
পৃথিবীতে অবতরণ করার প্রার্থনা জানিয়ে কবিতাটি শুরু হয়। শেষে কবি লেখেন –
প্রার্থনারই সুরে, সেই মানুষদের পাওনা অংশ
দেওয়ানোর কথা আছে এখানে, যাদের এঙ্গেলস নিজের শৈশবের দুনিয়ার চার দিকে, সারাদিন কঠোর
পরিশ্রমের পরেও বঞ্চিত হতে দেখছিলেন।
এসব তো প্রাথমিক ভাবনাচিন্তা ছিল। ১৭ বছর বয়স
পার হতে হতে তিনি, অন্ততঃ অন্যদের চোখে নাস্তিক, অর্থাৎ প্রচলিত জার্মান খ্রিষ্টমত,
প্রোটেস্ট্যান্টবাদ এবং বিশেষকরে পবিত্রতাবাদের বিরোধী চিন্তাভাবনাগুলোর সমর্থক ও প্রচারক
হয়ে উঠলেন। তাঁকে এলবারফেল্ড জিমনাশিয়াম ছাড়িয়ে দেওয়া হল। বাবার মনে হল, এ ছেলেকে লেখাপড়ায়
ধরে রাখার অর্থ হবে এর বিদ্রোহী মনোভাবটাকে আরো বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। তাই
তাকে প্রায় তিনশো কিলোমিটার দূরের একটি বাণিজ্য-কেন্দ্র, বন্দর-শহর ব্রেমেনের এক বাণিজ্য
সংস্থায় কেরানীগিরি করতে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
ব্রেমেন
কেমন কেমন সব পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করে
ভবিষ্যতের এই বিদ্বান পথপ্রদর্শক নিজের রাস্তা তৈরি করলেন। বাবা ব্রেমেনে কেরানীগিরি
করতে ছেড়ে আসলেন আর সেখানে ছেলে দার্শনিক হেগেলকে পড়া, আর একই সঙ্গে লেখার হাত শক্ত
করতে শুরু করলেন।
ব্রেমেনে পৌঁছে প্রথমে শুরু করলেন নিজের লেখা
কবিতাগুলোর মধ্যে থেকে বাছাই করে পত্রিকায় পাঠানো, অর্থাৎ প্রকাশন। মার্ক্স-এঙ্গেলস
রচনাসমগ্রের হিসেবে প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘বেদুইন’। পূঁজিবাদ কিভাবে
মরুবাসী আরব জনগোষ্ঠিগুলোর সামাজিক জীবন ধ্বংস করে তাদেরকে বাজারের তামাশা বানিয়ে দাঁড়
করিয়ে দিল, তাদের প্রাণশক্তি কেড়ে নিল, কবিতাটি তারই মর্মস্পর্শী ছবি। তরুণ এঙ্গেলসের
সাহিত্যিক ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা এ লেখার বিষয় নয়। শুধু তাঁর অনুভবে ও দৃষ্টিতে হতে থাকা
অগ্রগতির একটা নিদর্শন হিসেবে কথাটা বললাম।
১৮৩৯এর মার্চ-এপ্রিলে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ
সামাজিক প্রতিবেদন হাম্বুর্গের পত্রিকা ‘টেলিগ্রাফ ফুর ড্যুশল্যান্ড’এ পাঁচ কিস্তিতে প্রকাশিত হল। শিরোনাম ছিল ‘উপার্টালের চিঠি’। ওসওয়াল্ড ছদ্মনামে সাংবাদিকতার দুনিয়ায় এটা
তাঁর প্রথম পদক্ষেপ ছিল। এত জনপ্রিয়তা পেল সে লেখা, যে পত্রিকার প্রতিবেদন-সম্বলিত
পাঁচটা সংখ্যাই হাতে হাতে বিক্রি হয়ে গেল। ওদিকে, বার্মেন, এলবারফেল্ড এবং পুরো উপার্টাল
অঞ্চল নিবাসী পবিত্রতাবাদী কুলীন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী রাগে ফেটে পড়ল। ছদ্মনামের পেছনে
লুকিয়ে থাকা লেখকটিকে গরুখোঁজা শুরু করল।
প্রতিবেদনটা বড় এবং তাতে পুরো অঞ্চলের তৎকালীন
সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনের হালহকিকৎ নিয়ে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। উপার্টাল অঞ্চলের
নৈসর্গিক সৌন্দর্য কিভাবে শিল্পায়ন ও অব্যবস্থিত নগরায়নের ফলে কিভাবে নিরানন্দ ও হতশ্রী
হয়ে পড়েছে। উপার নদীর (যে নামে অঞ্চলটার নাম) মেটে জল যদি কোথাও রক্তিম মনে হয় সেটা
নদীর রূপ নয়, কাপড় রাঙাতে ব্যবহৃত রসায়নের মিশ্রণে আসা বিকৃতি। তারপর লেখক নজর দেন
রাস্তায়, বিশেষ করে সন্ধ্যায় বেরিয়ে অনেক রাত অব্দি যারা মৌজ করে সেই লোকজনদের অসভ্য,
অশ্লীল এবং মদ্যপ আচরণের দিকে। (পরে অন্য কোনো লেখায় তিনি এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার
কথা লিখেছিলেন যে কিভাবে তাঁর শৈশবে চোখের সামনে পুরো অঞ্চলটা, শ্রমিকদের বস্তি বৃদ্ধির
সঙ্গে সঙ্গে সস্তা মদের দোকানে ভরে উঠেছিল, অর্থাৎ শ্রমিকেরা অসভ্য, অশ্লীল আচরণ করা
মানুষ বা মদ্যপ ছিল না, তাদেরকে হতে বাধ্য করা হয়েছিল)। ঐ লেখায় তিনি তারপর লেখেন –
“এই অবস্থার কারণ
স্পষ্ট। প্রাথমিকভাবে ও সবচেয়ে বেশিভাবে দায়ী কারখানাগুলোর কাজ। নিচু ছাতের ঘরে কাজ
করতে থাকা মানুষগুলো অক্সিজেনের চেয়ে বেশি কয়লার ধোঁয়া আর ধুলোয় নিঃশ্বাস নেয়। এদের
মধ্যে অধিকাংশ ছ’বছর বয়স থেকেই কাজ
করা শুরু করে দেয়। এই পরিস্থিতিটাই তো তাদের জীবন থেকে সব আনন্দ আর শক্তি নিংড়ে বার
করে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট! যাদের বাড়িতে নিজেদের তাঁত আছে সে তাঁতিরা সকাল থেকে রাত অব্দি
তাঁতের ওপর নুয়ে বসে থাকে এবং একটা গরম উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের শিরদাঁড়ার মজ্জা
শুকোয়। যারা রহস্যবাদের শিকার হয় না তারা নেশার শিকার হয়ে ধ্বংস হয়।”
অনেক সময় আমরা ধর্ম সম্পর্কে মার্ক্সবাদের
বক্তব্য নিয়ে আলোচনায় দেখেছি, এক দল “জনগণের আফিং” এটুকুকেই স্লোগান করে তুলি, এবং অন্য দল “দুঃখের বহিঃপ্রকাশ, আত্মাহীন
অবস্থার আত্মা, দুর্দশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ” ইত্যাদি বলে শেষে একটা সমঝদারিতে পৌঁছোই।
মার্ক্সের পরিচিত বক্তব্যটা হেগেলের ‘অধিকারের দর্শন’এর সমালোচনার অংশ এবং ১৮৪৩ সালে লেখা। তবে তাঁর তরুণ মনে
ধর্ম বিষয়ে ধারণাগুলো নিশ্চয়ই দানা বাঁধছিল অনেক আগে থেকে!
এঙ্গেলসও তরুণ বয়সে নিজের মত করে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং যৌক্তিকতার দ্বিপথে কোনদিকে
যাবেন সেটা স্পষ্ট করে তুলছিলেন। তাঁর স্কুলজীবনের বন্ধু
ছিল দুই ভাই – উইলহেল্ম এবং ফ্রেডরিক গ্রেবার। দুজনকে আলাদা আলাদা
চিঠি লিখতেন কেননা দুজনের রুচি ভিন্ন ছিল। উইলহেল্মকে লেখা চিঠিগুলোর মধ্যে
একটায়, ১৫ই জুন ১৮৩৯এ তিনি লিখছেন, “... যখন এমন কারুর সঙ্গে দেখা হয় যে ইতিবাচক খ্রিষ্টধর্মকে ঔদ্ধত্যের
সঙ্গে খারিজ করছে, আমি এই উপদেশসমূহকে [চিঠিতে আগে উল্লিখিত খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে
সেধরণের কথাবার্তা যা যুক্তিবাদকে সরাসরি খারিজ করে না] সমর্থন করি, কিন্তু যখন যুক্তির স্বাধীনতা রক্ষার প্রশ্ন ওঠে,
আমি সমস্ত রকম বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি।”
বাবা তাঁকে ব্রেমেনে কেরানীগিরি করতে
পাঠিয়েছিলেন। কেমন চলছিল সে কাজ? ২০-২১ অক্টোবর ১৮৩৯এ আবার উইলহেল্মকে লেখা
চিঠিতেই ২১এর রোজনামচার মত করে লিখছেন, “আজকের দিনটা ভয়ানক ক্লান্তিকর গেল। অফিসে
গোলামি করতে করতে আধমরা হয়ে পড়েছি। ... কবিতা পরে পাঠাবো, এখন আর সময় নেই। ভালো
কিছু খাবারও নেই, সব একঘেয়ে।”
তবু তারই মধ্যে তিনি নিজেকে তৈরি করছিলেন।
ভাষা শিখছিলেন। দর্শন, সাহিত্য পড়ছিলেন। লিখছিলেন। এমনকি রোজকার আনন্দ পেতে
সন্ধ্যায় কয়্যারে সমবেত গানে অংশ নিচ্ছিলেন, চুটিয়ে সঙ্গীত পড়ছিলেন এবং শুনছিলেন। আর? যে খেলোয়াড় মনোভাব তাঁর সারা জীবনের সঙ্গী ছিল তাকেও সময় দিচ্ছিলেন।
চুটিয়ে শিখছিলেন ঘোড়সওয়ারি, তরোয়ালখেলা, সাঁতার আর স্কেটিং। অনেক
দিকে নিজেকে মেলে জীবনকে অনুভব করতেন, সেভাবেই মেলে
দিচ্ছিলেন।
যুব-জার্মান এবং যুব-হেগেলিয়ান
মূলতঃ উনি নিজেকে একজন ‘তরুণ জার্মান’ হিসেবে প্রস্তুত করছিলেন।
কথাটার মানে কী? তরুণ তো তিনি ছিলেনই, জার্মানও ছিলেন, কিন্তু ‘তরুণ জার্মান’ তখনকার দিনে একটা বাগধারা
বা চলতি পারিভাষিক অভিব্যক্তি হয়ে উঠেছিল। ১৮৩০ সালের জুলাই মাসে প্রথমে ফ্রান্স
এবং তারপর ইয়োরোপের আরো কয়েকটি দেশে রাজনৈতিক বিপ্লবের ঢেউ ওঠে। ইতিহাসে সেটা ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে প্রসিদ্ধ। রাষ্ট্রশক্তির
পরিবর্তনগুলো তো প্রত্যেকটি দেশের তৎকালীন ঐতিহাসিক পটভূমি অনুসারে হল, কিন্তু যে
কারণে সে পরিবর্তনে বিপ্লবের উপাদান নজরে এল তার কারণ ছিল শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকা। কেননা ঐ রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোতে ইয়োরোপের শ্রমিক শ্রেণী তাদের নিজেদের
দাবিসমূহ নিয়ে অংশগ্রহণ করল। তাদের রাজনৈতিক দাবিগুলো তখনো পূঁজিবাদী কিন্তু তার সঙ্গে
ছিল শ্রমসম্পর্কিত দাবি। ইয়োরোপের পুঁজিবাদীরা চমকে উঠে দেখল শ্রমিক আর তাদের নেতৃত্বে
চলতে প্রস্তুত নয়। [অনেক সময়ে বাংলা লেখাতেও পূঁজিবাদীদের জন্য ফরাসি শব্দ ‘বুর্জোয়া’ বা এমনকি ‘বুর্জোয়াজি’ও ব্যবহার হয়, কিন্তু আমি পূঁজিবাদী ব্যবহার করা সমীচীন মনে করলাম]
নিজেদের দাবি নিয়ে, নিজেদের স্লোগানে আওয়াজ তুলে, নিজেদের পতাকা নিয়ে তারা শহরের রাস্তায়
ব্যারিকেড গড়ে লড়ছে। রাজনৈতিক স্লোগানগুলো পূঁজিবাদী – মূলতঃ ‘মুক্তি-সাম্য-ভ্রাতৃত্ব’এর ডাক – হলেও একটি শ্রেণী
হিসেবে স্বাতন্ত্র্যের ঘোষণা তারা ১৮৩০এর জুলাই বিপ্লবের দিনগুলোয় করে দিল। এর ফলে,
ইওরোপের বেশির ভাগ দেশে একটা নতুন ঘটনা দেখা যেতে শুরু করল। শহরগুলোর বৌদ্ধিক জগতে
বড় সংখ্যায় মানুষ প্রজাতান্ত্রিক পরিবর্তনের পক্ষে দাঁড়াতে শুরু করল আর তাদের মধ্যে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় এগিয়ে এল যুবশ্রেণী। জার্মানিতে যে যুবরা এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকায়
ছিল তারা নিজেদের ‘যুব-জার্মান’ বলে চিহ্নিত করতে লাগল। খবরের কাগজগুলোতেও
তারা ঐ নামে চিহ্নিত হল। এঙ্গেলসের ব্রেমেনে পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য
ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন, চার্টিস্ট আন্দোলন, শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং প্রুশীয়
সেন্সরের হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও সে খবর জার্মানিতে দিব্যি পৌঁছোচ্ছিল।
যদিও প্রুশীয় সম্রাটের রাজত্বে ‘যুব-জার্মান’এর রাজনৈতিক অভিব্যক্তি সেভাবে প্রখর হয়ে ওঠে
নি। তবে তারই পরোক্ষ প্রভাবে, প্রধানতঃ কয়েকটি নতুন সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক প্রবৃত্তির
সমাবেশ ছিল। পাশাপাশি যুবদের আরেকটি দল ছিল। ‘যুব-হেগেলিয়ান’। সেটা আবার দার্শনিক ও ভাবাদর্শগত প্রবৃত্তির সমাবেশ। দুই দলে অনেক
কিছুই যৌথভাবে স্বীকৃত ছিল এবং অনেকেই শামিল ছিল দু’দলেই।
এই দুই দলেরই প্রধান ইতিবাচক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর
তিনটে দিক উল্লেখযোগ্য এঙ্গেলসের ব্রেমেন-বাসের বছরগুলোয়। প্রথম, তৎকালীন প্রুশীয় রাজতন্ত্রের
প্রতি ঘৃণা এবং বিরুদ্ধে স্থানগ্রহণ; দ্বিতীয়, ধর্মের নামে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বহাল
খ্রিষ্টধর্ম ও পুরোহিততন্ত্রের প্রতি ঘৃণা ও বিরুদ্ধ মনোভাব; এবং তৃতীয়, হেগেলীয় দার্শনিক
প্রণালীতে মানব-ইতিহাসের, ‘উৎকর্ষের বিকাশ’ রূপী যে প্রত্যয়, সমকালীন বৈপ্লবিক পরিবর্তনগুলোকে
বোঝার জন্য তার প্রয়োগ।
১৮৩৯এর ৮ই এপ্রিল ফ্রেডরিক গ্রেবারকে লিখছেন
–
“কে ছিল ১৮৩০ সালের
আগে? … বজ্রনিনাদের মত
তারপর জুলাই বিপ্লব এল, মুক্তির যুদ্ধের পর জনগণের আকাঙ্খার মহত্তম অভিব্যক্তি …”
ঐ চিঠিতেই পরের দিন, ৯ই এপ্রিল যোগ করছেন –
“তাহলে এখন আমি, বেচারা
বদমাইসটা, কী করি? রোজকার জীবনের এই একঘেয়ে পথে ঘাম ঝরাতে থাকি? ইচ্ছে করে না। রাজভক্ত
হয়ে যাই? তাহলে যেন জাহান্নমে যাই। স্যাক্সন (উত্তর-জার্মান জাতিগোষ্ঠি) সাধারণত্বে
রয়ে যাই? এ-রাম, ছিঃ! তাই, আমাকে অবশ্যই ‘যুব-জার্মান’ হতে হবে। বা, বলতে পারি, হয়েই আছি, এখনই, শরীরে আর সত্তায়। রাতে
ঘুমোতে পারি না, শুধুমাত্র শতাব্দীর চিন্তাভাবনাগুলোর জন্য। যখনই ডাকঘরে যাই আর প্রুশীয়
রাজ-চিহ্নের দিকে নজর পড়ে, স্বাধীনতার আবেগে আবিষ্ট হয়ে পড়ি। যতবার খবরের কাগজ পড়ি,
স্বাধীনতার পথে কতটা এগোলাম, খুঁজতে শুরু করে দিই।”
তিন মাস পর সেই বন্ধু গ্রেবারকে তিনি স্বাধীনতার
অর্থ বোঝাতে গিয়ে লিখলেন –
“তুমি বল যে সংশয়ে
অক্ষমতাই মনের স্বাধীনতা? ওটা মনের সবচেয়ে বড় দাসত্ব। শুধু সে-ই স্বাধীন যে নিজের প্রত্যয়-সম্পর্কিত
প্রতিটি সংশয়ের ওপর জয়লাভ করেছে। আর, আমার প্রত্যয়কে খণ্ডন করার দাবি আমি তোমার কাছে
মোটেও জানাচ্ছি না। আমি পুরো সনাতন ধর্মশাস্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি আমায় খণ্ডন করুক।”
এই প্রত্যয় ছিল সে সময়কার ইয়োরোপীয় নবজাগরণ,
যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রত্যয়। সনাতন খ্রিষ্টধর্মের সবক’টি মত, ধারণা এবং তার সাংস্কৃতিক আধিপত্যের
বিরুদ্ধে সংগ্রামরত থেকেও সে সময় তিনি ‘ঈশ্বর’ নামে একটি সত্তাকে
ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। পুরোপুরি নাস্তিক হন নি কিন্তু ব্রেমেন আর বারমেনের ছোটো
শহরের পরিবেশে দিন কাটিয়েও তিনি রাজধানী বার্লিনে হতে থাকা ‘যুব-হেগেলিয়ান’দের দার্শনিক কার্যকলাপ সম্পর্কে সব খবর নিতেন।
লিখছিলেন প্রধানতঃ সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতি বিষয়ে, কিন্তু একটি দার্শনিক বিশ্বদৃষ্টির
প্রয়োজন অনুভব করছিলেন।
১৮৩৯-৪০এর ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে ফ্রেডরিক
গ্রেবারকে অনেকদিন ধরে লেখা একটি চিঠিতে তিনি হেগেলের দর্শন নিয়ে, হেগেলের ভালো এবং
খারাপ শিষ্যদের নিয়ে, হেগেলের দার্শনিক প্রণালীর অখণ্ডতা নিয়ে অনেক কিছু লিখলেন। ২১শে
জানুয়ারি তিনি মস্করার সুরে লিখলেন, “উদাহরণার্থে ভাবো যদি এ চিন্তাসূত্রটি, যে বিশ্ব-ইতিহাস স্বাধীনতার
ধারণার বিকাশ, পুরো ওজন নিয়ে ব্রেমেনের পাদ্রীর ঘাড়ে এসে পড়ে তাহলে তার ভিতর থেকে কী
ধরণের দীর্ঘশ্বাস বেরুবে?”
সে চিঠিতে সেদিনই পরে প্রুশিয়ার সম্রাট ফ্রিডরিখ
উইলহেল্ম-৩ এর প্রতি ক্রোধে লিখলেন –
“এই রাজাই ১৮১৫ সালে
যখন ভয় পেয়েছিল, মন্ত্রীসভার তরফ থেকে ফতোয়া জারি করে প্রজাকে কথা দিয়েছিল যে যদি তারা
রাজাকে [তৎকালীন – লেখক] ঝক্কিঝামেলা
থেকে বার করে আনে তাহলে তারা [নিজেদের দেশের – লেখক] একটা সংবিধান পাবে! সেই – পাজি, পচা, ঈশ্বর-শাপিত – রাজাই এখন ঘোষণা করছে যে কাউকেই কোনো সংবিধান সে দিতে যাচ্ছে
না – মারাত্মক ঘেন্নায়
আমি লোকটাকে ঘৃণা করি, আর যদি আমি ঐ লোচ্চাটাকে এত তুচ্ছ মনে না করতাম তাহলে আরো বেশি
ঘৃণা করতাম … ১৮১৬ থেকে ১৮৩০
অব্দিকার কালখন্ডের চেয়ে বেশি রাজকীয় অপরাধে ভরা কালখণ্ড কখনো আসে নি। যতগুলো রাজপুত্র
এই কালখণ্ডে শাসন করেছে সবাই মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য।”
১৯৭৪ সালে সোভিয়েত সঙ্ঘ থেকে প্রকাশিত এঙ্গেলসের
জীবনীর প্রথম অধ্যায়ে উদ্ধৃতির এই শেষ অংশটুকু উদ্ধৃত। তারপর জীবনী-রচয়িতারা প্রুশীয়
সাম্রাজ্যের নীতি সম্পর্কে এঙ্গেলসের সেসময়কার সমঝদারির সারসংক্ষেপ করেছেন – গরীবের ক্ষতি করে সম্পদশালী অভিজাত শ্রেণীকে
রক্ষা এবং রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিকে নিষ্পেষিত করে, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে অজ্ঞতায় পর্যবসিত
করে, ধর্মকে ব্যবহার করে স্বৈরতন্ত্র বহাল রাখার নীতি।
এঙ্গেলস বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর বার্লিন যাওয়া,
সেখানে থাকা খুবই জরুরি। হেগেলের দর্শনের বামপন্থী অনুগামী তো তিনি হয়ে উঠেছিলেন, বার্লিনের
‘যুব-হেগেলিয়ান’দের খবরাখবরও নিয়মিত রাখতেন কিন্তু নিজের দার্শনিক
প্রয়োগের জন্য হেগেলীয় পদ্ধতি, দ্বান্দ্বিকতাকে এখনো স্পষ্টভাবে দেখতে ও চিনতে পারছিলেন
না। ব্রেমেনে কেরানীগিরি করতে করতে, বেঁচে যাওয়া সময়ে বুভুক্ষুর মত পড়তেন, লিখতেন আর
তারপরেও, সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, মন যতই অস্থির হোক, ভাই-বোন-বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠিতে
অনবরত আনন্দ ছড়াতেন। প্রত্যেকের মন বুঝতেন। বোনকে পাঠাতেন, নতুন শেখা স্বরলিপি লিখনের
নমুনা, শর্টহ্যান্ডের নমুনা, তাঁর বাড়তে থাকা ভাষা-জ্ঞান, রোজকার দেখা জীবনের দ্রুত-হাতে
আঁকা পেন্সিল স্কেচ, ড্রয়িং আর কার্টুন। ২৮শে সেপ্টেম্বর ১৮৩৯ তারিখে বোন মেরিকে লিখছেন
–
“আমি এখন ক্লাবে আছি।
ক্লাব বলতে বারমেনের সদ্ভাব-সংস্থা বা আত্মবিকাশ-সংস্থার অনুরূপ। এখানে রাখা সবচেয়ে
ভালো জিনিষ হল খবরের কাগজ, নানান খবরের কাগজ – ডাচ, ইংরেজি, মার্কিন-ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, তুর্কি আর জাপানি।
এই খবরের কাগজগুলো থেকে আমি তুর্কি আর জাপানি ভাষা বুঝতে শিখলাম, কাজেই এখন আমি ২৫টা
ভাষা বুঝি।” খুবই সম্ভব ‘বুঝি’ শব্দটা এখানে বোনের
কাছে তারুণ্যের চপল অভিব্যক্তি। তবে প্রধান ইয়োরোপীয় ভাষাগুলো যে ভালো করেই জানতেন
সে তো পরবর্তী বছরগুলোয় তাঁর কাজেই প্রমাণিত।
উইলহেল্ম গ্রেবারের সঙ্গে যেমন সঙ্গীতজ্ঞদের
নিয়ে আলোচনা করতেন, ফ্রেডরিক গ্রেবারের সঙ্গে দর্শন আর রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতেন।
সবার সঙ্গেই মাঝে মধ্যে মস্করা। তাঁর খেলোয়াড়ির কথা আগেই বলেছি। শরীরও ছিল খেলোয়াড়ের
মত বলিষ্ঠ, রূপবান, আকর্ষণীয়।
এসবেরই মাঝে ব্রেমেনে নদীর বন্যা ঢুকতো ঘরে।
নিজের ঘর ছেড়ে কোনো প্রতিবেশীর বাড়িতে যখন আশ্রয় নিতে যেতেন আর দেখতেন যে তাকেও জিনিষপত্র
বাঁচাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, তখন তিনিও তার সঙ্গে
সারা রাত জল ছেঁচে বার করতেন, আনাজপাতিগুলো বাঁচাবার ব্যবস্থা করতেন।
এঙ্গেলসের জীবনী-রচয়িতারা সঠিক বলেছেন যে দ্বান্দ্বিক
ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দর্শন অব্দি পৌঁছোনোর এবং বিশ্বের বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠক
এবং তাত্ত্বিক নেতা হয়ে ওঠার যে যাত্রাপথ, সে যাত্রাপথে এঙ্গেলসের সফর অনেক বেশি কঠিন
ছিল। মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ডের মুখবন্ধে সম্পাদক লিখছেন –
“এঙ্গেলসের পক্ষে
প্রগতিশীল দৃষ্টি অব্দি পৌঁছোনো মার্ক্সের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ছিল। তিনি বারমেনের
গোঁড়া, ধার্মিক শিল্পপতি পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা তাঁকে জোর করে স্কুল ছাড়িয়ে ব্যবসায়
জুতে দিলেন। পরিণামে, সমকালীন ধার্মিক, দার্শনিক, রাজনৈতিক এবং সাহিত্যিক প্রবৃত্তিগুলোর
গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে, ছোটোবেলা থেকে হৃদয়ে আর মস্তিষ্কে ভরা ধার্মিক চিন্তাধারণাগুলো
ছাড়িয়ে ওপরে ওঠার জন্য যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক আত্মানুসন্ধান করতে করতে তাঁকে স্বতন্ত্রভাবে
নিজের শিক্ষা পুরো করতে হল। প্রধানতঃ ধর্ম আর ধর্মশাস্ত্রের যে সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ
তিনি করেছিলেন, সেটাই তাঁকে প্রগতিশীল দার্শনিক ভাবনা অব্দি পৌঁছে দিল। তাঁর বিকাশে,
বিশেষ করে প্রথম দিকে, সাহিত্যেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।”
পবিত্রতাবাদী ক্রিশ্চান শিল্পপতি বাবা, ছেলের
বিদ্রোহী মেজাজটাকে অবদমিত করার, তার ভিতর থেকে বিপ্লবী চিন্তার শিকড়গুলো উৎপাটিত করার
সবরকম চেষ্টা করেছিলেন। সহজ উপায় বেছে নিয়েছিলেন যে তার লেখাপড়াই বন্ধ করিয়ে দেওয়া
যাক। এলবারফেল্ডের স্কুল থেকেও শেষ পরীক্ষা (আমাদের এখনকার হিসেবে ম্যাট্রিক) দেওয়ার
আগেই তাকে বার করে নিলেন আর ব্রেমেনে কেরানীগিরি করতে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানকার ম্যানেজারকেও
বলে এলেন যে ছেলেটাকে কাজের জোয়ালে বেঁধে রেখ। তবুও এঙ্গেলস স্ব-অধ্যয়ন আর রচনাকর্মের
মাধ্যমে এগোতে থাকলেন।
বার্লিন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এবং পরেও
বাবাকে বার বার অনুরোধ করেছিলেন যে তাঁকে বার্লিনে গিয়ে লেখাপড়া করার অনুমতি দেওয়া
হোক। বাবা মানলেন না। তীব্র তর্কবিতর্ক হল পরিবারে। শেষে সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগ দেওয়ার
পথেই বার্লিন যাওয়ার রাস্তা বার করতে হল।
সেনাবাহিনীতে যোগদান এবং বার্লিন
১৮৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে এঙ্গেলস
সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিলেন। সেসময়কার প্রুশীয় সরকারের নিয়মানুসারে নির্ধারিত একটি মেয়াদের
জন্য সেনাবাহিনীতে চাকরি বাধ্যতামূলক ছিল। বড়লোক পরিবারের ছেলেরা আধিকারিকদের ঘুষ দিয়ে
নিজেদের নাম কাটিয়েও নিত। কিন্তু এঙ্গেলসের জন্য এটা বার্লিন যাওয়ার একমাত্র রাস্তা
ছিল। বার্লিনে গেলে পতিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারগুলোয় শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত
থাকতে পারতেন। তারই সঙ্গে বার্লিনবাসী আমূল-পরিবর্তনবাদী বৈজ্ঞানিক এবং লেখকদের সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারতেন।
তাই, বাধ্যতামূলক স্বল্পমেয়াদী সামরিক সেবার
প্রার্থীদের পাওনা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এঙ্গেলস দ্বাদশ গার্ডস আর্টিলারি কম্পানি
বাছলেন। সেটা বার্লিনে অবস্থিত ছিল। যাওয়ার কয়েকদিন আগে ৯ সেপ্টেম্বর ১৮৪১এ তিনি সেসময়
ম্যানহেমে থাকা বোন মেরিকে ইঙ্গিতে লিখলেন –
“এক সপ্তাহ অথবা পনেরো
দিন পরে আমি নাগরিক হিসেবে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করতে অর্থাৎ সামরিক সেবা থেকে বাঁচার
জন্য যা কিছু করতে পারি করার জন্য বার্লিন রওনা হচ্ছি। কদ্দূর কী করতে পারি দেখার জন্য
আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।”
বার্লিনে কার্ল মার্ক্স বিগত পাঁচ বছর যাবৎ
ছিলেন এবং বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছিলেন। যখন এঙ্গেলস বার্লিন পৌঁছোলেন তার
পাঁচ মাস আগে মার্ক্স জেনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন। মার্ক্সের ইচ্ছে ছিল
অধ্যাপক হবেন এবং সে উদ্দেশ্যে বনও গেলেন। কিন্তু নতুন প্রুশীয় রাজার, আগের থেকে বেশি
স্বৈরাচারী প্রশাসন কঠোর ভাবে সবক’টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমালোচক কন্ঠস্বরগুলোকে বহিষ্কার করছিল। এমনকি
প্রুশীয় রাষ্ট্রশক্তির অমূল্য রত্ন, দার্শনিক হেগেলেরও পদমর্যাদা বিধিবৎ শেষ করে দেওয়া
হয়েছিল – কেননা তাঁরই দর্শনের
মধ্যে থেকে তাঁর বিপ্লবী যুব অনুগামীরা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের উপাদান খুঁজে বার করতে
শুরু করেছিল। তাঁর জায়গায় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী এবং নিম্নমানের দার্শনিক শেলিংকে পদমর্যাদায়
প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সমস্ত পদ থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছিল হেগেলবাদীদের।
এমন সময়ে মার্ক্সের মত সুপরিচিত আমূল-পরিবর্তনবাদী হেগেলিয়ানের অধ্যাপকের চাকরি পাওয়া
ছিল অসম্ভব। মার্ক্স সময় নষ্ট করলেন না। যে কাজ তাঁর লক্ষ্য ছিল, সে কাজেই পুরো সময়ের
কর্মী হয়ে নেমে পড়লেন। প্রুশীয় সরকার, প্রশাসন এবং সেন্সর-নীতির বিরুদ্ধে শাণিত রাজনৈতিক
সাংবাদিকতা শুরু করে দিলেন।
তাই, এঙ্গেলস যখন বার্লিনে পৌঁছোলেন, মার্ক্সও
সেখানেই ছিলেন। কিন্তু দুজনের দেখা হল না। কেননা এঙ্গেলস বিশ্ববিদ্যালয়ের আড্ডাগুলোয়
ঢুকছিলেন আর মার্ক্স সে আড্ডাগুলো থেকে বেরিয়ে নতুন জীবনের তালাশ শুরু করেছিলেন। আবার,
১৮৪২এর শেষে যখন বার্লিন থেকে বারমেনে ফিরে এলেন, মার্ক্স প্রায় সে সময়েই চলে গেলেন
কোলোন। যদিও তত দিনে মার্ক্স, ‘রাইনিশে জাইটুং’এর পৃষ্ঠা থেকে এক সমবয়সী প্রতিভাবান লেখক ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের নাম
জেনে গিয়েছিলেন।
মার্ক্সবাদী বিশ্বদৃষ্টির দুই আবিষ্কারকের
পহুঁচপথের ভিন্নতা এবং এঙ্গেলসের পথের দুর্গমতা এতেও বোঝা যায় যে দর্শনের যে পাঠকক্ষে
মার্ক্স একজন স্নাতক-ছাত্র হয়ে প্রবেশ করতেন, এঙ্গেলস, আপাত-নজরে অশিক্ষিত এক বহিরাগত
যুব (সৈনিক) হয়ে প্রবেশ করলেন। সে সময়েই প্রকাশিত হল এঙ্গেলসের ‘অতিথি ছাত্রের রোজনামচা’ নামে একটি আলেখ্য।
বার্লিন যাওয়ার পর এঙ্গেলস তাই করলেন যা উনি
ভেবে রেখেছিলেন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারে গিয়ে মনে হল ঠকে গেছেন। কেননা সেখানে
হেগেলও ছিলেন না আর হেগেলবাদী অন্য কোনো অধ্যাপকও ছিলেন না, যাদেরকে শুনতে তিনি এত
তোড়জোড় করে বার্লিনে এসেছিলেন। ছিলেন শেলিং যার লেকচার শুনলেই বিরক্ত হতেন এঙ্গেলস।
তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে তিনি নিয়মিত যেতেন। কেননা গেলে মানুষজনের সঙ্গে আলাপ হত
এবং মনে, অনেক আগে থেকে জমে থাকা আকাঙ্খাগুলো প্রস্ফুটিত হত। সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক
বিষয়ের ওপর লেখার পাশাপাশি তিনি দার্শনিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের ওপরও লিখছিলেন। এই দিনগুলোতেই
তাঁর একটা গুরুত্বপূর্ণ বড় দার্শনিক রচনা ‘শেলিং ও আকাশবাণী’ একটি পুস্তিকা হয়ে বেরুলো। এঙ্গেলস বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শেলিংএর
লেকচারও শুনছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে লিখছিলেনও। কিন্তু চিঠিপত্রে চোখ বোলালে বোঝা যায়
তিনি দর্শনশাস্ত্রের গভীরতর অধ্যয়নের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।
মার্ক্সের প্রথম দিকের বছরগুলোয়, আর্নোল্ড
রুজ নামে এক বামপন্থী হেগেলবাদী রাজনৈতিক ভাবুকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। তিনি মার্ক্সের
চেয়ে ১৬ বছর বড় ছিলেন এবং বামপন্থী হেগেলবাদ যারা শুরু করেছিল তাদের একজন ছিলেন। ১৮৪৪
সালে রুজ আর মার্ক্স প্যারিস থেকে এক সঙ্গে ‘ড্যএশ-ফ্রাঞ্জোসিশ জাহ্রবুখের’ (জার্মান-ফরাসি বার্ষিকী)র সম্পাদনা করেছিলেন।
এঙ্গেলসের কয়েকটি রাজনৈতিক প্রবন্ধ সেই পত্রিকায় ছেপেছিল। যাহোক সেটা পরের কথা। ১৮৪১-৪২এ
রুজ ড্রেসডেনে ছিলেন এবং ‘ড্যএশ জাহ্রবুখের’এর সম্পাদক ছিলেন। এঙ্গেলস সেই পত্রিকায় কখনো
সাহিত্যিক আবার কখনো দার্শনিক বিষয়েও লিখতেন। ১৫ই জুন ১৮৪২এ তিনি একটি প্রবন্ধ পাঠালেন
এবং লিখলেন যে নিকট ভবিষ্যতে আরো একটি প্রবন্ধ পাঠাবেন। ‘শেলিং ও আকাশবাণী’ও আগে এই পত্রিকাতেই ছাপার কথা ছিল কিন্তু
বড় হয়ে যাওয়ায় এঙ্গেলস আলাদা, পুস্তিকা করে বার করেছিলেন। কিন্তু এসবের পর ২৬ জুলাইয়ে
তাঁর লেখা চিঠি তাঁর মনের অবস্থাটা দেখায়।
শুধু এটুকু বলবার জন্য চিঠি লিখছি যে আপনাকে
আমি কিছু পাঠাবো না। কিছু দিনের জন্য আমি আমার সব সাহিত্যিক কাজকর্ম ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত
নিয়েছি যাতে অধ্যয়নে বেশি সময় দিতে পারি। তার কারণ সহজ। আমি যুবক এবং দর্শনে স্বশিক্ষিত।
আমার নিজের একটি দৃষ্টি তৈরি করতে এবং প্রয়োজনে সেটির রক্ষা করতে এ শিক্ষা পর্যাপ্ত।
কিন্তু সেই দৃষ্টির ভিত্তিতে ঠিক মত এবং সফলতার সঙ্গে কাজ করার জন্য নয়। আর, এ বিষয়ে
আমার কাছ থেকে একটু বেশিরই প্রত্যাশা থাকবে কেননা দর্শনে আমি ‘ট্র্যাভেলিং এজেন্ট’, ডক্টরের ডিগ্রি নিয়ে দার্শনিক চিন্তাভাবনা
লেখার অধিকার অর্জন করি নি। আমি আশা করি আবার যখন লিখতে শুরু করব এবং সেটাও নিজের নামে,
তখন এ প্রত্যাশাগুলো আমি পূরণ করতে পারব। তার সঙ্গে এটাও একটা কথা যে আমার এখন অনেক
ধরণের কাজ করার চেষ্টা চালানো উচিৎ নয় কেননা শিগগিরই আমি ব্যবসায়িক কাজে আগের চেয়ে
বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ব।
বিষয়ীগতভাবে দেখলে আমার সাহিত্যিক কার্যকলাপ
এখন অব্দি নিছক পরীক্ষামূলক ছিল। যার পরিণামে আমি জানতে পারলাম আমার স্বাভাবিক ক্ষমতাগুলো,
প্রগতির উদ্দেশ্যে এবং শতাব্দীর আন্দোলনে সক্রিয় অংশিদারীর উদ্দেশ্যে সাফল্যের সঙ্গে
এবং কার্যকরভাবে কাজ করার যোগ্য কিনা। আমি পরিণামে সন্তুষ্ট এবং এখন দ্বিগুণ উৎসাহে
অধ্যয়নে রত হয়ে সেই ক্ষমতাগুলো অর্জন করা কর্তব্য মনে করি যা জন্মগত হয় না।
সামরিক সেবায় দিনচর্যার ক্লান্তি সত্ত্বেও
এঙ্গেলস বার্লিনে কাটানো একটি বছর পুরোপুরি কাজে লাগালেন। নিজের মেধাজগতকে বিকশিত করলেন।
বার্লিনের তৎকালীন বৌদ্ধিক পটভূমিটা কাছ থেকে দেখার এবং পাশাপাশি যুব-জার্মান ও যুব-হেগেলিয়ান
দার্শনিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে মেলামেশা বাড়ানোর দুটো বড় ফল
হল। প্রথমতঃ, দার্শনিক লেখালিখির কাজে তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়ল যে কারণে ‘শেলিং ও আকাশবাণী’র মত বড় একটি রচনা পুস্তিকা করে বার করতে পারলেন।
দ্বিতীয়তঃ, তথাকথিত যুব-জার্মান নামের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়টির বাস্তবিক
অবস্থা দেখতে পেলেন। বুঝতে পারলেন যে এরা শুধু সাহিত্যিক লেখালিখিতেই সীমিত থাকবে,
সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে কষ্ট-টষ্ট জাহির করবে কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে, দুর্নীতিগ্রস্ত
প্রশাসনের বিরুদ্ধে, সেন্সর-নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলবে না। এঙ্গেলসের এই সমালোচনা এল
‘এলেকজান্ডার জুংঃ
আধুনিক জার্মান সাহিত্যের ওপর বক্তৃতা’ নামে আলেখ্যে। যুব-হেগেলিয়ান বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও কয়েকজনের সীমিত
চিন্তাভাবনা এঙ্গেলস দেখতে পেয়েছিলেন। সে বিষয়ে পরের অধ্যায়ে আলোচনা করব।
এখানে আরো একটি কথা বলে নেওয়া অপ্রাসঙ্গিক
হবে না। আমরা সাধারণতঃ মার্ক্সবাদী দর্শনের আবির্ভাবের আগের দুজন জার্মান দার্শনিকের
নাম জেনে থাকি। একজন হেগেল, আরেকজন ফায়ারবাখ। এখানে শুধু এটুকুই বলে রাখতে চাই যে লুডউইগ
ফায়ারবাখও কিন্তু যুব-হেগেলিয়ান ঘরানায় শামিল দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। এবং সেভাবেই তাঁকে
এবং তাঁর বিখ্যাত কৃতি ‘খ্রিষ্টধর্মের সারকথা’ বইটাকে প্রথমে মার্ক্স এবং এঙ্গেলস জানতেন।
অবস্থান গ্রহণ
মার্ক্সের সঙ্গে দেখা
সামরিক সেবার মেয়াদ পুরো হওয়ার পর ৮ই অক্টোবর
১৮৪২এ এঙ্গেলস বার্লিন ছাড়লেন। বাড়ি ফেরারই কথা, অর্থাৎ বারমেন, কিন্তু তার আগে করণীয়
একটা কাজ তাঁর মাথায় ছিল। চলে গেলেন কোলোন। ‘রাইনিশে জাইটুং’এর দপ্তর কোলোনেই ছিল আর ততদিনে এঙ্গেলস ঐ পত্রিকার নিয়মিত লেখক
হয়ে উঠেছিলেন। কার্ল মার্ক্সই ছিলেন ঐ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। বার্লিনে থাকাকালীন
এঙ্গেলস মার্ক্সের বিষয়ে অনেক কিছু জেনেছিলেন, বিশেষ করে সাধারণ যুব-হেগেলিয়ানদের চেয়ে
ঐ লোকটির প্রখরতর জ্ঞান ও ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্যের কথা যত শুনেছিলেন তা তাঁকে কৌতুহলী
করে তুলেছিল। কিন্তু যখন এঙ্গেলস ‘রাইনিশে জাইটুং’এর দপ্তরে পৌঁছোলেন তখন মার্ক্স সেখানে ছিলেন না। তাই দেখা হল না।
দেখা হওয়ার আগে থেকেই মার্ক্সকে এঙ্গেলস কোন
নজরে দেখতেন সেটা এঙ্গেলসেরই লেখা একটি ব্যঙ্গ-কাব্য পড়ে বোঝা যায়। আগেই বলা হয়েছে
যে প্রুশিয়ার রাজাবদলের পর সেন্সর-ব্যবস্থা কঠোর করে দেওয়া হল এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
বেছে বেছে হেগেলবাদীদের বের করে দেওয়া শুরু হল। সেই ক্রমে ব্রুনো বাউয়ারকেও ১৮৪২এর
মার্চ মাসে বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বার করে দেওয়া হল। সরকারের এই কার্যকলাপের বিরুদ্ধে
এবং তারই সঙ্গে যুব-হেগেলিয়ান বনাম গোঁড়া হেগেল-বিরোধীদের মধ্যেকার লড়াইটা নিয়ে এঙ্গেলস
একটি ব্যঙ্গ-কাব্য লিখলেন। সংক্ষিপ্ত নাম ‘আস্থার জয়’। তাতে এক এক করে বিভিন্ন যুব-হেগেলিয়ানদের বিষয়ে কয়েকটি করে পংক্তি
আছে। মার্ক্সকে নিয়ে লিখলেন –
বারমেনে ফিরে এঙ্গেলস এক মাসও থাকতে পেলেন
না। কয়েকদিনের মধ্যে তাঁকে জার্মানি ছেড়ে ইংল্যান্ডের শিল্পনগরী ম্যাঞ্চেস্টার রওনা
হতে হল। বাইরে বলার জন্য ছিল বাবার ছেলেকে ব্যবসা শেখাবার চেষ্টা। এর্মেন অ্যান্ড এঙ্গেলস
কম্পানির ম্যাঞ্চেস্টারে চলা সুতো-কারখানায় ফ্রেডরিককে বাণিজ্য এবং ব্যবস্থাপনার ব্যবহারিক
জ্ঞান আহরণ করতে পাঠানো হল। কিন্তু বাস্তবটা হল এই যে এঙ্গেলসের বাবা ভীষণভাবে ভয় পেয়েছিলেন।
ছেলের বিপ্লবী চিন্তাধারা এখন আর গোপন ছিল না। তাই তাকে জার্মান আর প্রুশীয় পুলিস থেকে
দূরে রাখা বাবার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।
নভেম্বর ১৮৪২এ ম্যাঞ্চেস্টার পৌঁছোনোর আগে
এঙ্গেলস আবার কোলোন গেলেন। এবার মার্ক্সের সঙ্গে তাঁর দেখা হল। ইতিহাসে নথিভুক্ত এটাই
তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ। কিন্তু এ সাক্ষাতে উষ্ণতা একটু কম ছিল। কথাবার্তায় দুজনেই সাবধানতা
অবলম্বন করছিলেন। কেননা এঙ্গেলস তখনো অব্দি যুব-হেগেলিয়ানদের ‘মুক্ত’ নামে একটি গোষ্ঠির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন আর মার্ক্স কঠোরভাবে সেই
গোষ্ঠি এবং তার নেতাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। যারা এসব ব্যাপারে গুজববাজি করে তারা এটুকুই
ছড়িয়েছিল। বলে নি যে এঙ্গেলস সেই গোষ্ঠিতে থেকেও তার নেতাদের, বিশেষকরে বাউয়ার ভাইদের
বিরুদ্ধে সেই বিষয়গুলোর ওপরই লড়াই চালাচ্ছিলেন যেগুলো মার্ক্স উঠিয়েছিলেন। গুজববাজরা
এঙ্গেলসেরও কান ভরে থাকবে মার্ক্সের বিরুদ্ধে কিছু বলে। কোন কোন বিষয়ে কথা হয়েছিল তা
তো জানা নেই কিন্তু কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে। অক্টোবর ১৮৪২এ মার্ক্স আর্নল্ড রুজকে
চিঠি লিখেছিলেন যাতে তিনটে পক্ষের প্রতি নিজের মনোভাব স্পষ্ট করেছিলেন – (১) খোদ আর্নল্ড রুজ এবং আরেকজন বুদ্ধিজীবীর
প্রতি, (২) ‘মুক্ত’ গোষ্ঠির প্রতি, আর (৩) নতুন সম্পাদকীয় নীতি
এবং সরকারের প্রতি। নিজের বক্তব্য সীমিত রেখেছিলেন চারটে বিষয়ে। প্রথমঃ স্বাধীনতা বা
মুক্তি শব্দটা নিয়ে বুকনিবাজি কম হোক, অশিক্ষিত, অতি-সরলীকৃত ধরণে কথা বলা বন্ধ হোক,
আত্মমুগ্ধতা পরিত্যাগ করে, বিশেষজ্ঞের জ্ঞানে বলীয়ান হয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলা হোক।
দ্বিতীয়ঃ কোনো আলোচনার মাঝে কথায় কথায় নাটকীয় ভাবে সাম্যবাদী, সমাজবাদী বা অন্য কোনো
নতুন বিশ্বদৃষ্টি ঢোকানোর প্রবৃত্তি বন্ধ হোক – এটা অনৈতিক। যদি সাম্যবাদ নিয়ে কথা বলতে হয় তাহলে আলাদাভাবে গুরুত্ব
সহকারে কথা হোক। তৃতীয়ঃ ধর্মের সমালোচনা রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমালোচনার কাঠামোয় হোক,
রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমালোচনা ধর্মের সমালোচনার কাঠামোয় নয়। চতুর্থঃ যে দর্শন নিয়ে
আলোচনা করতে হয় করা হোক, পুরোপুরি করা হোক, নিরীশ্বরবাদের লেবেল সাঁটিয়ে নয়।
স্বাভাবিক মনে হয় যে এঙ্গেলসের সঙ্গে কথাবার্তা
এসব নিয়েই হয়ে থাকবে। খোদ এঙ্গেলস পরে, ১৮৯৫এ স্মরণ করেছেন –
“মার্ক্স ততদিনে বাউয়ার
ভাইদের ভাইদের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন, অর্থাৎ তিনি এই ভাবনার বিরুদ্ধে ছিলেন যে ‘রাইনিশে জাইটুং’এর ব্যবহার রাজনৈতিক আলোচনা এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপে
নয়, বরং প্রধানতঃ ধর্মশাস্ত্রীয় বিষয়, নিরীশ্বরবাদ ইত্যাদির প্রচারের বাহক রূপে করা
হোক। এডগার বাউয়ারের ‘সবচেয়ে দূর অব্দি
যাওয়ার’ ইচ্ছাভিত্তিক বুলি
– কেন্দ্রীয় সাম্যবাদ;
– তারও বিরুদ্ধে ছিলেন
মার্ক্স … আর আমার চিন্তাভাবনাগুলোর
বাউয়ার ভাইদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে যতটা মিলে যাচ্ছিল, ততটা আমায় ওদের বন্ধু মনে করা
হচ্ছিল। উল্টো দিকে ওরা আমাকেও মার্ক্সের প্রতি সন্দেহপ্রবণ করে দিয়েছিল।” [ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, এ বায়োগ্রাফি, প্রগ্রেস
পাব্লিশার্স, মস্কো, ১৯৭৪, পৃষ্ঠা ৩৪এ মার্ক্স-এঙ্গেলস, জার্মান রচনাসমগ্র থেকে উদ্ধৃত]
ম্যাঞ্চেস্টারে দু’বছর
লেনিন লেখেন, “ইংল্যান্ডে আসার পরেই এঙ্গেলস সমাজবাদী হন।”
এঙ্গেলসের জন্ম জার্মানির সেই অঞ্চলে হয়েছিল
যেটি শিল্পের দিক থেকে সর্বাধিক উন্নত ছিল। তিনি নিজেও বড়লোক কারখানামালিকের পরিবারের
ছেলে। পুরো এলাকাটা শ্রমিকে আর শ্রমিক বস্তিতে ভরে থাকত। তাই যখন ইংল্যান্ডে এলেন তখন
জার্মানির শ্রমিকদের জীবন আর পূঁজিপতিদের জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে এলেন। কিন্তু
ইংল্যান্ড, ইংল্যান্ড। পুরো ইয়োরোপ থেকে দেশটার বাণিজ্যিক ভূগোল এবং সমাজ জীবন অনেকভাবে
একেবারে ভিন্ন হয়ে উঠেছিল। শিল্প বিপ্লব চেহারা পাল্টে দিয়েছিল শহরগুলোর। আর ম্যাঞ্চেস্টার
ইংল্যান্ডের সেই শহরগুলোর মধ্যে থেকে একটি ছিল যেখানে পূঁজিবাদী শিল্পায়নের ভিতরকার
নারকীয় বীভৎস চেহারা খুব কাছ থেকে দেখা যেত। অন্য দিকে, চার-পাঁচ বছর ধরে চলতে থাকা
চার্টিস্ট আন্দোলন, যেহেতু শ্রমিক শ্রেণীর স্বতন্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল তাই শ্রমিকদের
শ্রেণীগত ঐক্যের চমকপ্রদ শক্তি, শাসকশ্রেণীগুলোর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এবং রাষ্ট্রশক্তির
বুনটটাও গণজীবনে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। ম্যাঞ্চেস্টারে মাঝে মধ্যেই হতে থাকা জনসভাগুলোয়
তৎকালীন সমাজবাদীদের সঙ্গে এঙ্গেলসের দেখাসাক্ষাৎ হত এবং বন্ধুত্ব গড়ে উঠত। ইংল্যান্ডের
সমাজজীবনটাকে শ্রেণীদ্বন্দ্বের কষ্টিপাথরে বুঝতে তাঁর খুব বেশি সময় লাগল না।
১৮৪২এর নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় পক্ষে এঙ্গেলস
ম্যাঞ্চেস্টারে এলেন। কয়েকদিন আগে কোলোনে মার্ক্সের সঙ্গে সাক্ষাতে উষ্ণতার অভাব ছিল
ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীকালে এঙ্গেলস নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘রাইনিশে জাইটুং’এর সম্পাদকের পূরো ভরসা ছিল যে ইংল্যান্ডগামী
এই জার্মান যুবকই ঐ দেশটার বাস্তবিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জার্মান পাঠককে দিতে
থাকবে। আর সমুদ্র (ইংলিশ চ্যানেল) পেরিয়ে কারখানার কাজ করতে ইংল্যান্ড যেতে থাকা বড়লোক
বাড়ির এই জার্মান যুবকটি জানছিল যে সামাজিক-রাজনৈতিক, দার্শনিক অথবা সাংস্কৃতিক বিষয়ের
ওপর তার বিপ্লবধর্মী রচনাগুলোকে প্রুশীয় সেন্সরের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাপার কাজ,
‘রাইনিশে জাইটুং’এর ঐ নতুন প্রধান সম্পাদকই করবে। তাই ম্যাঞ্চেস্টারে
পৌঁছে মাস শেষ হওয়ার আগেই এঙ্গেলসের প্রথম প্রতিবেদন ‘রাইনিশে জাইটুং’এ পৌঁছে গেল। ৮ই ডিসেম্বরের সংখ্যায় সেটা ছেপে
বেরিয়েও গেল।
ইংল্যান্ডে তাঁর সারা জীবন কাটানোর ছিল। তবে
প্রথম পর্বে তিনি মোটামুটি দু’বছর ছিলেন। চাকরি করতে এসেছিলেন, সারাদিন সে কাজের ব্যস্ততা থাকত।
সকালে, সন্ধ্যায় লেখালিখি করতেন নিয়মিত – ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির ব্যাপারে সাধারণ জার্মান
পাঠককে ওয়াকিবহাল করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না – পূঁজিবাদী শোষণ, সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের কাঠামোয় পূঁজিবাদী শ্রেণীসমূহের
সঙ্গে অভিজাত শ্রেণীর আঁতাত, চার্টিস্ট আন্দোলন দমনে যৌথভাবে প্রচারিত তাদের মিথ্যে
… এসব নিয়ে লেখা প্রতিবেদনগুলো
প্রচ্ছন্নভাবে জার্মান পাঠকদের মধ্যে পরিবর্তনকামী আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলত এবং পথের
ইঙ্গিত দিয়ে রাখত।
‘রাইনিশে জাইটুং’এ ৯ই ডিসেম্বর ১৮৪২এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটাই
ধরা যাক। শুরুই করলেন, “লন্ডন, নভেম্বর ৩০,
ইংল্যান্ডে কি বিপ্লব সম্ভব, বা অন্ততঃ সম্ভবপর? এই প্রশ্নের ওপর ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ
নির্ভর করছে। …”
পূঁজি ও শ্রমের এই সংগ্রামে প্রথম দিকে উদাসীন
থাকা কৃষকদের মধ্যেও যে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক চেতনা বাড়ছে সে ঘটনাটির দিকেও তাঁর চোখ
ছিল। চোখ ছিল ফ্রান্স এবং অন্যান্য দেশের ঘটনাবলি এবং সমাজবাদী আন্দোলনের অগ্রগতির
ওপরও। ইংরেজিটা শেখাই ছিল। একটু মকশো করে চার্টিস্ট মুখপত্র ‘নর্দার্ন স্টার’ এবং ওয়েনপন্থী (আজকের ভাষায়, সুপরিচিত কল্পলৌকিক
সমাজবাদী রবার্ট ওয়েন-এর সমর্থক) সমাজবাদীদের পত্রিকা ‘নিউ মোরাল ওয়র্ল্ড’ এরও নিয়মিত লেখক হয়ে গেলেন তিনি।
সমাজবিপ্লবের যে ধারণা নিয়ে তিনি এসেছিলেন
তার ওপর হেগেলের প্রভাব ছিল, “ … তথাকথিত বস্তুগত
স্বার্থ ইতিহাসে কখনো স্বাধীন, পথপ্রদর্শক লক্ষ্য হতে পারে না, কিন্তু সেগুলো সচেতন
অথবা অচেতনভাবে একটি তত্ত্বের জন্য কাজ করে যেটি ঐতিহাসিক প্রগতিকে নিয়ন্ত্রিত করে।” [… the
so-called material interests can never operate in history as independent,
guiding aims, but always, consciously or unconsciously, serve a principle which
controls the threads of historical progress.]
[আভ্যন্তরীণ সংকট, রাইনিশে জাইটুং, ৯ই ডিসেম্বর
১৮৪২]
এই দু’বছরের কালখণ্ডে এঙ্গেলসের জীবনের দুটো দিক বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এবং
সে দুটোই একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এক, শ্রমিকশ্রেণীর জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখা, যার
অব্যবহিত পরের পদক্ষেপ তাঁর মহান কৃতি ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা’ (কন্ডিশন্স অফ দ্য ওয়র্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড); তারই সঙ্গে
পূঁজিবাদী প্রণালীরও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধ্যয়ন। দুই, মেরি বার্ন্সের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব।
ওপরে বলেছি যে এঙ্গেলস নিয়মিত লিখছিলেন। তবু,
এটা লক্ষ্যণীয় যে ডিসেম্বর ১৮৪২এ ‘রাইনিশে জাইটুং’এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের পর, পরবর্তী প্রতিবেদন মে ১৮৪৩এ, জ্যুরিখ
থেকে প্রকাশিত জার্মান পত্রিকা ‘শ্বেইজরিখের রিপাব্লিকানের’এ বেরুল। অর্থাৎ পাঁচ মাস তাঁর লেখার কাজ স্থগিত ছিল। ‘রাইনিশে জাইটুং’ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, লেখা পাঠাবার মত নতুন একটা
পত্রিকা খোঁজার ব্যাপারটা তো ছিলই, তবে এই পাঁচ মাসে তিনি ম্যাঞ্চেস্টারের শ্রমিক বস্তিতে
নিয়মিত ঘুরে ঘুরে বাস্তবিক অবস্থা দেখা এবং নোট নেওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। শ্রমিকের জীবনকে
কাছ থেকে দেখার এই কাজেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হল এবং তিনি তাঁর
ভালোবাসা খুঁজে পেলেন।
১৮৪৩এর জানুয়ারিতে প্রুশীয় সরকার ‘রাইনিশে জাইটুং’ বন্ধ করানোর সিদ্ধান্ত নিল। সে বছরই এপ্রিলে
পত্রিকার পরিচালক ও অর্থদাতারা প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে মার্ক্সকে সরে যেতে বাধ্য
করল। সরকার মার্ক্সের জীবন দুঃসহ করে তুলল, তিনি কোলন ছেড়ে অন্য শহরে চলে গেলেন। এদিকে
ম্যাঞ্চেস্টারেও এঙ্গেলসের পিছনে প্রুশীয় সরকারের গুপ্তচর লেগে ছিল। প্রতিদিন তিনি
কম্পানির দপ্তরে যেতেন। কম্পানির মালিক দুই পরিবারের একটির সদস্য হওয়ার কারণে সন্ধ্যের
দিকে কয়েকটি পূঁজিবাদী সামাজিকতা পালনেরও দায়িত্ব থাকত। তা সত্ত্বেও, কখনো এমনকি ওই
সামাজিকতা এড়িয়েও তিনি শ্রমিক বস্তিতে ঘোরার, ঘরে ঘরে যাওয়ার, কথা বলার সময় বার করে
নিতেন। আর এ কাজেই তাঁর সহায়ক হলেন আইরিশ শ্রমিক-পরিবারের তরুণী মেরি বার্ন্স।
মেরি বার্ন্স ম্যাঞ্চেস্টারেরই স্যালসফোর্ড
অঞ্চলে নিজের বাবা মাইকেল বার্ন্স, মা মেরি কনরয় এবং ছোট বোন লিডিয়ার সঙ্গে থাকতেন।
পরে গবেষকেরা খোঁজ করেছেন যে মেরির জীবিত মা সৎ-মা ছিলেন (নিজের মা ১৮৩৫ সালেই মারা
গিয়েছিলেন) আর তাই, পরে মেরি আর লিডিয়া আলাদা থাকতে শুরু করেছিলেন। গবেষকেরা এটাও অনুমান
করেছেন যে কারখানায় কাজ করা মেয়ে হলে তিনি এঙ্গেলসের সঙ্গে বস্তিতে ঘোরার সময়ই পেতেন
না। বরং, ম্যাঞ্চেস্টার পৌরসভার নথিপত্র দেখে তাঁরা গৃহভৃত্যের সূচিতে কোনো মেরি বার্ন্সের
নাম পেয়ে আন্দাজ করেছেন যে মেরি আর লিডিয়া গৃহভৃত্যের কাজ করতেন। যাই হোক, মেরি আর
লিডিয়া যে শুধু আইরিশ পরিবারের মেয়ে ছিলেন তা নয়। আইরিশ জাতীয়তা সম্পর্কিত বিষয়গুলো
নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা শ্রমিক তরুণী ছিলেন। ব্যাপারটার গুরুত্ব ছিল। কেননা আইরিশ জাতীয়তার
লড়াইয়ে সে সময় কিছু উগ্রপন্থী সক্রিয়তাও ছিল এবং তারা ইংল্যান্ডের পুলিশের নজরে ছিল।
ম্যাঞ্চেস্টারে সে সময় আইরিশ শ্রমিকের সংখ্যা অনেক – ‘লিটল আয়ারল্যান্ড’ নামে সেই কুখ্যাত অঞ্চল দারিদ্র্য এবং দুস্থতার
চরম সীমায় থাকত।
কারখানায় কর্মী হিসেবে পথেঘাটে হয়ে হোক বা
গৃহভৃত্য খুঁজতে গিয়ে বস্তির কোনো ঘরে, মেরি বার্ন্সের লড়াকু মনোভাবের জন্যই তিনি এঙ্গেলসের
নজরে এসেছিলেন মনে হয়, কেননা পুরো ইয়োরোপের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা
এঙ্গেলসের জন্য আইরিশ জাতীয়তার প্রশ্ন যথেষ্ট গুরুত্ব রাখত। ইংল্যান্ডের শ্রমিকদের
শোষণের ওপর তো তিনি কাজ করছিলেনই।
মেরি বার্ন্সের সঙ্গে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বের ফলে
এঙ্গেলসের, সন্ধ্যাবেলায় বা রাতে শ্রমিক পরিবারে পৌঁছোনো, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে
বাস্তব অবস্থা জানা সহজ হয়ে গেল। নইলে, হত না। মিলমালিকের ছেলেকে সন্দেহের নজরে দেখা
হত, কোনোরকম প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চাইত সবাই আর বেশি চাপ দিলে প্রাণসংশয় হতে পারত – বিশেষ করে ‘লিটল আয়ার্ল্যান্ড’এর মত জায়গাগুলোয়।
শ্রমিক পরিবারের সঙ্গে কথা বলার জন্য একটু
দেরি করে সন্ধ্যায় বা রাতে তাদের সঙ্গে বসা দরকার। একাজে মেরি সাহায্য করলেন। তিনি
জানতেন ফ্রেডরিক তাঁকে শহরের ভাড়াবাড়িটায় রাখতে পারবে না। রাখলে কম্পানির অন্য অংশীদার
এর্মেন চ্যাঁচামেচি করার সুযোগ পেয়ে যাবে, জার্মানিতে খবর চলে যাবে আর ফ্রেডরিককে ম্যাঞ্চেস্টার
ছেড়েই হয়তো চলে যেতে হবে। এর্মেন এমনিতেই কারখানার হিসেব দেখাশোনার কাজে এঙ্গেলস পরিবারের
ছেলের উপস্থিতি পছন্দ করছিল না। অন্যদিকে, ফ্রেডরিকের জন্যও, পূঁজিবাদী সমাজে ঘোরাফেরা
করতে হলে, ‘হল অফ সায়েন্স’এ গিয়ে পূঁজিবাদী বুদ্ধিজীবী এবং সমাজবাদীদের
সঙ্গে সখ্যতা করতে হলে, পূঁজিবাদী সংস্কৃতিসম্মত একটা বাড়ির ঠিকানা রাখা জরুরি ছিল।
তাই বন্ধু ও ভালোবাসার মানুষ ফ্রেডরিকের সুবিধের জন্য মেরি শ্রমিকদের বিভিন্ন পাড়ায়
বদলে বদলে ঘর নিতেন। সেখানে তিনি আর লিডিয়া থাকতেন। যখন তখন ফ্রেডরিক সেখানে থাকার
জন্য চলে আসতেন। ভবিষ্যতে যখন মেরি বার্ন্স জীবনসঙ্গিনী হলেন তখনও এঙ্গেলসের এই ‘দুটো-বাড়ি’তে দিন কাটানো অব্যাহত থাকল। কিন্তু সে গল্প পরে।
বইটার জন্য রসদ সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে এঙ্গেলস
পূঁজিবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতির অধ্যয়ন চালিয়ে যাচ্ছিলেন যার পরিণতি হিসেবে ১৮৪৩ সালের
অক্টোবর-নভেম্বর মাসে তিনি একটা বড় প্রবন্ধ লিখলেন – ‘রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের
সমালোচনার রূপরেখা’; ১৮৪৪এ সেটি ‘ডয়েশ-ফ্রাঞ্জোইশ জাহ্রবুখের’এ প্রকাশিত হল। বস্তুতঃ, এই লেখাটি পড়েই খোদ
মার্ক্স, পূঁজিবাদী রাজনৈতিক-অর্থশাস্ত্রের অধ্যয়নকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করলেন।
ভবিষ্যতে সেকাজে নিজের জীবনের পঁচিশ বছর দিলেন। ফলে পুরো দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণী পেল
জ্ঞানের একটি অস্ত্র – ‘পূঁজি’ – যার বিশ্লেষণের
সত্যতাকে অস্বীকার করার বিফল চেষ্টায় পূঁজিবাদী বুদ্ধিজীবীদের অর্থদাতারা আজও অর্থের
যোগান দিয়ে চলেছে।
পাঠকদেরকে বিস্মিত করার মত অন্তর্দৃষ্টির জন্য এঙ্গেলসের ঐ প্রবন্ধ প্রশংসিত তো হলই, প্রবন্ধটি পড়ে মার্ক্স নিজে একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করলেন। সেই সারসংক্ষেপ তাঁর নোটবুক থেকে রচনাসমগ্রে প্রকাশিত হয়েছে। সেসময় মার্ক্স প্যারিস চলে গিয়েছিলেন। পরে, ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত ‘রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের সমালোচনায় অবদান’র প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধে মার্ক্স, এঙ্গেলসের সেই প্রবন্ধের নামোল্লেখ করে লিখলেন, “পারিভাষিক আর্থিক শব্দাবলীর সমালোচনার ওপর একটি উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ’।
ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের প্রারম্ভ
‘এর্মেন এ্যান্ড এঙ্গেলস’এর সুতো কারখানায় বাণিজ্য ও ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণের
দু’বছর শেষ হয়ে গেল।
এঙ্গেলস জানতেন যে মার্ক্স প্যারিসে আছেন। তাই বাড়ি ফেরার পথে প্যারিসে চলে গেলেন।
গত দুই বছরে প্রকাশিত এঙ্গেলসের সবক’টি প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন মার্ক্স পড়েছিলেন। মার্ক্সেরও সবক’টি প্রবন্ধ ও রচনা এঙ্গেলস পড়েছিলেন। একে অপরকে
নিয়ে ভ্রান্তিগুলো মুছে গিয়েছিল। দুজনেই একে অপরের রাজনৈতিক ও দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টির
প্রশংসক হয়ে উঠেছিলেন। তাই ২৮শে আগস্ট ১৮৪৪এ প্যারিসে দুজনের দেখায় সেই ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের
প্রারম্ভ হল, বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণী আজ যার ঋণী।
লেনিন বলেন –
“প্রাচীন কিম্বদন্তীগুলোয়
বন্ধুত্বের বেশ কয়েকটি মর্মস্পর্শী নিদর্শন পাওয়া যায়। ইয়োরোপীয় সর্বহারা বলতে পারে
যে দুজন এমন বিদ্বান এবং যোদ্ধা তাদের বিজ্ঞানটি সৃজন করেছেন যাদের একে অপরের সঙ্গে
সম্পর্ক, মানব-বন্ধুত্বের বেশির ভাগ প্রাচীন মর্মস্পর্শী কাহিনী ছাপিয়ে যায়।”
১৮৪৩এর গ্রীষ্মে বাগদত্তা জেনি ভন ওয়েস্টফ্যালেনের
সঙ্গে মার্ক্সের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। জেনি নিজেও একজন সচেতন সামাজিক কর্মী এবং শিল্প
সমালোচক ছিলেন। কয়েক মাস আগে তাদের প্রথম সন্তান জন্ম নিয়েছিল। এদিকে এঙ্গেলসও ১৮৪৩এর
প্রথম দিকে স্যালসফোর্ড অঞ্চলের লড়াকু আইরিশ শ্রমিক মেরি বার্ন্সের সঙ্গে ভালোবাসার
সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
দুজনেই নিজেদের চিন্তাভাবনার পুরোনো হেগেলীয়
শিকড় ছিঁড়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। এঙ্গেলসের সঙ্গে ছিল ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা’র খসড়া পাণ্ডুলিপি, যা পড়ে মার্ক্স মন্ত্রমুগ্ধ
হলেন। মার্ক্সের কাছে ছিল ‘হেগেলের বিধি-দর্শনের
সমালোচনায় অবদান’এর পাণ্ডুলিপি। এবং,
সেছাড়া, সদ্যকৃত আর্থিক ও দার্শনিক অধ্যয়নের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাতার একটা পুরো বান্ডিল,
যার খবর দুনিয়া অনেক পরে পেল। নভেম্বর বিপ্লবের পর সোভিয়েত সঙ্ঘ সেই পাতাগুলোকে ‘১৮৪৪এর আর্থিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি’ নামে প্রকাশ করল। ‘হেগেলের বিধি-দর্শনের সমালোচনায় অবদান’ও প্রথমে ‘হেগেলের অধিকার-দর্শনের সমালোচনায় অবদান’ নামে ১৯২৭এ প্রকাশিত হয়েছিল।
এই সমস্ত রচনা এবং তা নিয়ে পারস্পরিক আলোচনায়
দুজনের কাছেই স্পষ্ট হল যে তাদের সমঝদারি অনেক বিষয়েই এক। দুজনেরই তত্ত্বে এবং অভিজ্ঞতায়
প্রত্যয় জন্মেছিল যে সমসাময়িক বর্তমানে শ্রমিক শ্রেণীই সমাজবদলের বৈপ্লবিক শক্তি। সেছাড়া
তাদের সমঝদারিতে মিলের তালিকায় ছিল সামাজিক বিপ্লবের তত্ত্বগুলোর শ্রেণীসমূহের বস্তুগত
স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্ক, সমাজব্যবস্থার সমালোচনার সঙ্গে বাস্তবিক সংগ্রামের সম্পর্ক,
চেতনার সঙ্গে অনুশীলনের সম্পর্ক এবং মানব-পরিচয় ও সম্পর্কগুলোর যাথার্থ্য সেগুলোর ভৌতিকতায়
থাকা ইত্যাদি। মুখ্য প্রশ্ন যে বিশ্বের ব্যাখ্যা নয়, পরিবর্তন, এ সত্যটাও মার্ক্সের
ভাবনায় চলে এসেছিল এবং লেখায় ঈষৎ ভিন্ন রূপে লিপিভুক্ত হয়েছিল। ধর্ম বিষয়ে মার্ক্সের
যে কথাগুলো আমরা বিগত একশো বছর ধরে উদ্ধৃত করে আসছি সেগুলোও মার্ক্সের এসময়কারই লেখার
অংশ।
অপর দিকে, মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রে
ব্যবহৃত পারিভাষিক শব্দগুলোর মধ্যে অনেকগুলো – ব্যবহার মূল্য, বিনিময় মূল্য, মুনাফা, মজুরি, দাম এবং মূল্য, মুদ্রার
পূঁজিরূপে চলন, শিল্পপূঁজি এবং বাণিজ্যপূঁজি ইত্যাদি – প্রাথমিক স্তরে এঙ্গেলস জুটিয়ে এনেছিলেন।
মার্ক্স ঐ শব্দাবলী ব্যবহার করে ওগুলোকে আরো স্পষ্ট করছিলেন উপরোক্ত ‘১৮৪৪এর আর্থিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি’ নামের কাগজের বান্ডিলে।
‘পবিত্র পরিবার’
উদ্দেশ্য দুজনেরই এক ছিল। জার্মানিতে এবং তারই
সঙ্গে পুরো ইয়োরোপে বিপ্লবী শক্তির সন্ধান, তাদের তত্ত্বগত অস্ত্রের যোগান দেওয়া এবং
সংগঠিত করা। কিন্তু তার জন্য তাদেরকে ছেড়ে আসা দেশে আগে থেকে চলতে থাকা তত্ত্বগত সংগ্রামে
একটা নিষ্পত্তিতে পৌঁছোবার ছিল। অর্থাৎ, যুব-হেগেলিয়ানদের চিন্তাভাবনার সর্বাঙ্গীণ
সমালোচনা। যুব-হেগেলিয়ানদের প্রধান নেতা ছিলেন ব্রুনো বাউয়ার। দুজনে স্থির করলেন যে
মার্ক্স-এঙ্গেলস জুটির প্রথম যৌথ রচনা ব্রুনো বাউয়ার এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে হবে।
তাঁরা দেখাবেন যে, “জার্মানিতে বাস্তবিক
মানবতাবাদের সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু ‘আধ্যাত্মিকতাবাদ’ বা ‘চিন্তাশীল ভাববাদ’ যা বাস্তবিক ব্যক্তি মানুষের বদলে ‘আত্মচেতনা’ বা ‘আত্মা’কে দাঁড় করায় …।”
দুই নতুন বন্ধু নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে
নিলেন। বইয়ের মুখবন্ধ বা কথামুখ দুজনে মিলে লিখলেন এবং স্বাক্ষর করলেন। মার্ক্স এঙ্গেলস
রচনাসমগ্র, চতুর্থ খণ্ডের সূচিপত্রে দেখতে পাচ্ছি এঙ্গেলসের ভাগে পড়েছিল প্রথম তিনটে
অধ্যায় এবং পরবর্তী অধ্যায়গুলোর কিছু কিছু অংশ। সেগুলো তিনি প্যারিসে বসে লিখে বারমেন
রওনা হয়ে গেলেন। বাকি বইটা মার্ক্স লিখলেন এঙ্গেলসের চলে যাওয়ার পর। ১৮৪৫ সালে বইটা
প্রকাশিত হল। প্রকাশকের পরামর্শে বইয়ের নাম হল ‘পবিত্র পরিবার, অথবা সমালোচনাত্মক সমালোচনার সমালোচনা’।
এর আগেই মার্ক্স ফায়ারবাখের দর্শনের প্রতি
আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মার্ক্সের কথায় এঙ্গেলসও ফায়ারবাখ পড়েন এবং প্রভাবিত হন।
পরে এ বিষয়ে এঙ্গেলস লিখেছেন, “‘পবিত্র পরিবার’ পড়লে দেখা যায় কত উৎসাহের সঙ্গে মার্ক্স নতুন
ধারণাকে” [ফায়ারবাখের বস্তুবাদ] “স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং – সমালোচনামূলক আপত্তি সত্ত্বেও – কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন।”
সর্বহারাকে বিপ্লবী শক্তি প্রতিপন্ন করার কাজে
‘পবিত্র পরিবার’এর ভূমিকা প্রসঙ্গে লেনিন বলেন, “ এই বাউয়ারভ্রাতৃদ্বয় ও অনুগামী মহাশয়রা সর্বহারাকে
সাদাসিধে জনসমষ্টি হিসেবে দেখতেন। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এই অহেতুক, ক্ষতিকারক প্রবৃত্তির
তীব্র বিরোধ করলেন। শ্রমিক – শাসক শ্রেণী ও রাষ্ট্রশক্তি কর্তৃক নিষ্পেষিত একজন বাস্তবিক ব্যক্তিমানুষ
– এর নামে চিন্তন-মনন
নয়, উন্নততর সমাজব্যবস্থার জন্য সংগ্রামের ডাক দিলেন তাঁরা। তাঁদের সন্দেহাতীত প্রত্যয়
ছিল যে সর্বহারা এই সংগ্রাম চালাতে যেমন সক্ষম তেমনই আগ্রহীও।”
এই বইয়ে দুজনে স্পষ্টভাবে সেই শ্রেণীকে প্রতিষ্ঠিত
করলেন যে উপরোক্ত (মুখবন্ধে উচ্চারিত) ‘যথার্থ মানবতাবাদ’এর বাহক সামাজিক শ্রেণী হবে এবং বিপ্লবের তত্ত্বে বলীয়ান হয়ে বস্তুগত
শক্তিতে পরিণত হবে। কিন্তু এর আগেও দুই বন্ধু ঐ শ্রেণীর কাছে দু’দিক থেকে পৌঁছেছিলেন। মার্ক্স রাষ্ট্রশক্তি,
সমাজ এবং ধর্মের সমালোচনায় ব্যবহৃত দ্বন্দ্বাত্মক বিশ্লেষণের পদ্ধতিতে এবং এঙ্গেলস
সামাজিক শ্রেণীগুলোর জন্ম-ইতিহাসের বস্তুগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে। এই প্রসঙ্গ দুই বন্ধুর
পথের ভিন্নতা এবং পরিপূরকতা দর্শায়।
জানুয়ারি ১৮৪৪এ লিখিত এবং ‘ডয়েশ-ফ্রাঞ্জোইশ জাহ্রবুখের’এ প্রকাশিত ‘হেগেলের বিধি-দর্শনের সমালোচনায় অবদান’এর ভূমিকায় মার্ক্স জার্মান মুক্তির ইতিবাচক
সম্ভাবনার ব্যাখ্যায় বলেন, “ইতিবাচক সম্ভাবনা এমন এক শ্রেণীর গঠনে রয়েছে যার শৃংখল সর্বাত্মক,
নাগরিক সমাজের এমন একটি শ্রেণী যা নাগরিক সমাজের শ্রেণী নয়, … এমন একটি সামাজিক শ্রেণী যার সর্বজনীন কষ্টই
তার সর্বজনীন চরিত্র … সমাজের অন্য সব
শ্রেণী থেকে নিজেকে মুক্ত না করে এবং পরিণামে অন্য সব শ্রেণীকে মুক্ত না করে যে শ্রেণী
নিজের মুক্তি অর্জন করতে পারবে না … একটি বিশেষ সামাজিক অবস্থা রূপে সমাজের সেই বিলয় হল সর্বহারা।”
ওদিকে ফেব্রুয়ারি ১৮৪৪এ লিখিত এবং সে বছরই
আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ‘ভোরওয়ার্টস’এ প্রকাশিত ‘ইংল্যান্ডের পরিস্থিতি – ১’ এ এঙ্গেলস লিখছেন, “ইংল্যান্ডের জন্য ১৮ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল শিল্পবিপ্লব
কর্তৃক সৃজিত সর্বহারা। নতুন শিল্পের দাবি ছিল উৎপাদনের অসংখ্য নতুন শাখার জন্য শ্রমিক
জনতার অবিচ্ছিন্ন লভ্যতা; এমন শ্রমিক যাদের অস্তিত্বই আগে ছিল না! … কারখানা-উৎপাদন এবং কৃষি-উৎপাদনকে একসাথে
যোগ করা অসম্ভব হওয়ায় নতুন শ্রমিক শ্রেণী পুরোপুরি নিজের শ্রমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে
পড়ল। … পুরো এই ক্রমবিকাশের
পরিণামেইংল্যান্ড এখন তিন দলে বিভাজিত – জমিভিত্তিক অভিজাততন্ত্র, ধনভিত্তিক অভিজাততন্ত্র এবং শ্রমিক-শ্রেণীভিত্তিক
গণতন্ত্র।” …
শেষমেশ, দুজনের মিলনের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের
কিছুটা ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত সঙ্ঘ কর্তৃক প্রকাশিত এঙ্গেলসের জীবনী থেকে অনুবাদ করছি –
“১৮৪৪ সালের আগস্ট
মাসের শেষ দিনগুলোয় এঙ্গেলস” [প্যারিসের] “সাঁ জর্মাঁ পাড়ায় ৩৮, রুয়ে ভ্যান্যুতে অবস্থিত মার্ক্সের নিবাসে
এলেন।
“দুজনে দেখতে এর থেকে বেশি আলাদা হওয়া সম্ভব ছিল না। এঙ্গেলসের চুল বাদামি, দীর্ঘ সুগঠিত শরীর, সৈনিক-সুলভ আচরণ, এবং ইংরেজ-সুলভ সংযমী শিষ্ট ব্যবহার। মার্ক্স বেঁটে, কর্মচঞ্চল, দ্রুতগতি, তীক্ষ্ণদৃষ্টি এবং মাথায় সিংহের কেশরের মত ছড়িয়ে থাকা কালো চুল। দুজনের নিজের ধরণ ছিল কাক করার। কিন্তু দুজনের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তির সম্পর্ক ছিল, সমপরিমাণ নিষ্ঠা এবং হৃদয়ের শুদ্ধতা ছিল, সাহস এবং ধৈর্য্যের অন্তরঙ্গতা ছিল। দুজনে এক পথের পথিক হলেন কেননা দুজনেই প্রত্যয়ী কম্যুনিস্ট ছিলেন, তেজোময় এবং দৃঢ়সংকল্প বিপ্লবী ছিলেন।
“প্যারিসে দশ দিন
এঙ্গেলস মার্ক্সের থেকে আলাদা হলেন না, তত্ত্বগত এবং ব্যবহারিক সমস্যাসমূহ নিয়ে আলোচনায়
রত থাকলেন। পরে এঙ্গেলস স্মৃতি থেকে লিখলেন, ‘সবক’টি তত্ত্বগত দিকে
আমাদের সম্পূর্ণ ঐক্য স্পষ্ট হল এবং আমাদের যৌথ কাজকর্ম সেসময় থেকেই শুরু হল।’ মার্ক্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব এঙ্গেলসের প্যারিসে
কাটানো দিনগুলোকে স্মরণীয় করে তুলল। বারমেন ফেরার পর মার্ক্সকে লিখলেন, ‘তোমার সঙ্গে কাটানো দশ দিন আমি এত আনন্দিত
এবং মানুষের মত ছিলাম, তারপর আর তেমনটা হতে পারল না।”
“কয়েক দশক পরে এঙ্গেলস
এই বন্ধুত্বের দিনক’টিকে আবার স্মরণ
করলেন, ‘ম্যাঞ্চেস্টারে থাকতে
থাকতে আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে আর্থিক তথ্য, যার এখন অব্দিকার ইতিহাসলেখনে হয়
কোনো ভূমিকাই ছিল না অথবা নিতান্ত উপেক্ষণীয় ভূমিকা ছিল, আধুনিক দুনিয়ায় অন্ততঃ একটি
চূড়ান্ত ঐতিহাসিক শক্তি। আজকের শ্রেণীগত শত্রুতার জন্মের ভিত্তি ঐ আর্থিক তথ্য। আর
যেসব দেশগুলোয় বড় শিল্পের আবির্ভাবের ফলশ্রুতি হিসেবে – বিশেষ করে ইংল্যান্ডে – এই শ্রেণীগত শত্রুতাগুলো বিকশিত হয়ে উঠেছে,
সে সব দেশে এই শত্রুতাই রাজনৈতিক দলগুলোর, দলগুলোর মধ্যেকার কলহের, এবং সেভাবে পুরো
রাজনৈতিক ইতিহাস গঠনের ভিত্তি হয়।এই একই উপলব্ধিতে মার্ক্সও, শুধু পৌঁছোন নি, ‘ডয়েশ-ফ্রাঞ্জোইশ জাহ্রবুখের’এ (১৮৪৪) এভাবে এর সাধারণীকরণ করেছিলেন যে
রাষ্ট্রশক্তি মোটেই নাগরিক সমাজকে নিয়ন্ত্রিত বা নিজের অনুকূল করে না, নাগরিক সমাজই
রাষ্ট্রশক্তিকে নিয়ন্ত্রিত বা নিজের অনুকূল করে। ফলে, নীতিসমূহ এবং তাদের ইতিহাসের
ব্যাখ্যা, আর্থিক সম্পর্কসমূহ এবং সেগুলোর বিকাশের দিক থেকে করতে হবে, বিপরীত পদ্ধতি
চলবে না। … যখন ১৮৪৫এর বসন্তে
আমরা আবার ব্রাসেলসে দেখা করলাম, উপরে উল্লিখিত বনিয়াদগুলোর ওপর মার্ক্স ইতিহাসের বস্তুবাদী
ধারণা এবং তার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো পুরোপুরি বিকশিত করে তুলেছিলেন। তখন আমরা সেই নতুন
পাওয়া দৃষ্টির বিস্তৃত প্রয়োগ বিভিন্ন দিকে করার কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত করলাম।’” [এঙ্গেলস রচিত ‘কম্যুনিস্ট লীগের ইতিহাস’]
সভায় প্রথম বক্তৃতা
দশ দিন প্যারিসে মার্ক্সের সঙ্গে থেকে ভাবধারাগত
কাজের জগতে আলোকিত হওয়ার পর এঙ্গেলস বারমেনে ফিরে এলেন। তবে সোজাসুজি নয়, রাস্তায় পড়া
ইয়োরোপের দু-চারটে শহরে থেমে, পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে করতে। খুবই উৎসাহিত
হলেন যে দু’বছরে সাম্যবাদী,
সমাজবাদী (সেসময়কার) ভাবাদর্শের পথিকদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে।
বারমেনে তাঁর বাড়ি। সেখানে তিনি এক বড়লোক পূঁজিপতি
পরিবারের সন্তান রূপে পরিচিত ছিলেন। তদনুরূপ মান-সম্মানও ছিল বারমেন-উপার্টালের পূঁজিবাদী
নাগরিক সমাজে। কিন্তু সেখানেও তিনি পরিচিত-অপরিচিত এবং শ্রমজীবী মানুষজনের সঙ্গে নিজের
নবলব্ধ অভিজ্ঞতার আলোয় ইংল্যান্ডের সামাজিক অবস্থা, শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক উত্থান,
আসন্ন বিপ্লবের লক্ষণ এবং সমাজবাদী প্রণালীর শ্রেষ্ঠতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে শুরু
করে দিলেন। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলেন যে ইংল্যান্ডে সচেতন এবং সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর
সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা যত সহজ, পিছিয়ে থাকা জার্মানির শ্রমিকদের কাছে পৌঁছোনো বা তাদের
সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা তত সহজ নয়। এক বন্ধুর সঙ্গে যৌথ প্রয়াসে পত্রিকা প্রকাশ করার
পরিকল্পনা নিলেন। কিন্তু প্রুশীয় সেন্সর বিপদের আভাস পেল। অনুমতি দিল না। বিভিন্ন জায়গায়
স্থানীয় ভাবে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে, প্যারিসে পাওয়া নতুন দৃষ্টি-সমন্বিত বিপ্লবী
চেতনার প্রচার চালিয়ে যেতে থাকলেন, যেন এটা তাঁর কার্যভার। অথচ তখনও তিনি কোনো দলের
সদস্য নন।
সেসময় জার্মান শিল্পপতি এবং পূঁজিবাদীদের এক
অংশে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মত নানা ধরণের কল্পলৌকিক সমাজবাদী ভাবাদর্শ জনপ্রিয় হয়ে
উঠছিল। প্রুশীয় প্রশাসনেরও মনে হল – ঠিক আছে, সরকার ফেলে দেওয়ার কথা তো আর বলবে না, প্রজাতন্ত্র, বিপ্লব,
এসব কথাও বলবে না, পরোপকারের কথা বলবে ক্লাবে বসে! ক্ষতি কী? তাই তারাও চোখ সরিয়ে নিল।
এঙ্গেলস ভাবলেন, এটাই সুযোগ। ক্লাবে আর সভাগৃহে পূঁজিবাদীরা ক্রিশ্চান ধর্মানুসারে
পরোপকারের কথা বলছে। তাদের আলোচনায় অংশ নিয়ে পূঁজিবাদী শোষণের বাস্তবতা শোনাই নাহয়।
সেটা করতে করতে ভাবনা এল, হাওয়া গরম হয়েছে, এবার সভা ডাকা যাক। ১৮৪৫ সালের ফেব্রুয়ারির
৮, ১৫ এবং ২২ তারিখে এলবারফেল্ডে তিনটে সভা হল। এ শহরেই এঙ্গেলসের কৈশোর কেটেছিল জিমনাশিয়ামের
ছাত্রাবাসে। ওপরে উল্লিখিত সোভিয়েত সঙ্ঘ প্রকাশিত জীবনী বলে যে প্রথম সভায় ৪০, দ্বিতীয়তে
১৩০ এবং তৃতীয়তে ২০০ মানুষের উপস্থিতি ছিল। এদের মধ্যে সর্বহারা একজনও ছিল না। নানা
ধরণের পূঁজিবাদী এবং মধ্যশ্রেণীর শ্রোতারা এসেছিল। এঙ্গেলস জীবনে প্রথমবার কোনো সভায়
ভাষণ দিলেন। প্রথমটায় ইংল্যান্ডের পরিস্থিতির বেশি উদাহরণ দেওয়ায় শ্রোতারা পরের দিন
জার্মানির পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে বললেন। তাই তিনি করলেন এবং সাম্যবাদের শ্রেষ্ঠতা
নিয়ে খোলাখুলি কথা বললেন। এটাও বললেন যে যে তত্ত্ব বাস্তবতা সঙ্গ ছাড়ে, তার শিকড় ধরে
কপোল কল্পনা। স্বাভাবিকভাবেই এই ভাষণগুলোর খুব ভালো প্রভাব পড়ল বক্তার নিজেরই মনে।
২২শে ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ ১৮৪৫ অব্দি, একটু একটু করে লেখা চিঠিতে এঙ্গেলস মার্ক্সকে
জানালেন, “অসাধারণ সফলতা পেলাম
… মনশ্চক্ষে বিমূর্ত
জনতাকে দেখে বিমূর্ত লেখালিখি থেকে একেবারেই ভিন্ন কাজ বাস্তবিক, শ্বাস নিতে থাকা মানুষদের
সামনে দাঁড়ানো, ছুঁতে পারার দূরত্বে থেকে সোজাসুজি প্রচার করা …।” প্রুশীয় গুপ্তচর মাধ্যমগুলোতেও খবর পৌঁছে গেল। এঙ্গেলস এবং তাঁর
বন্ধুদের সাবধান করে দেওয়া হল। এর পর সভা হলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরোত। আর সেটাই এঙ্গেলসকে
পরোক্ষে সাহায্য করল।
বারমেনে আসার পর থেকে প্রতিদিন বাবার সঙ্গে
ঝগড়া হত। রোজ ভাবতেন বেরিয়ে চলে যাবেন কিন্তু মায়ের দিকে তাকিয়ে পা আর এগোত না। ১৭ই
মার্চ মার্ক্সকে লিখলেন, “এই সভাগুলোর সঙ্গে
আমার সম্পর্ক আর যে স্থানীয় কম্যুনিস্টদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করি তাদের কয়েকজনের ‘স্বচ্ছন্দ’ আচরণ বাবার ধার্মিক গোঁড়ামি জাগিয়ে তুলেছে। আর আমার কথা যে কিছুতেই
আমি ঐ বাণিজ্যিক কাজকর্মে ফিরব না, আরো তাতিয়ে দিয়েছে তাঁকে।”
নিদ্রায়, জাগরণে সারাক্ষণ বাবা তাঁর ওপর নজর
রাখতেন, তাঁর নামে আসা চিঠিগুলো পড়তেন আর তিরস্কারের দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে থাকতেন।
এতে এঙ্গেলসের মন আরো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠত।
পিতা-পুত্রের ঝগড়া মায়ের বুকে বাজত। শুধু মেয়ের
মন রাখতে এঙ্গেলস পনের দিন বাবার বারমেনে অবস্থিত কারখানাতেও গেলেন। কিন্তু বিচলিত
হয়ে উঠলেন। “… শুধু পূঁজিবাদী
নয় একজন কারখানাদার হওয়া, এক এমন পূঁজিবাদী হওয়া যে নিজে সক্রিয় রূপে সর্বহারার বিরুদ্ধে!
… ভয়ানক!” সহজ সরলভাবে মার্ক্সকে লিখলেন।
যতক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকতেন, নিজের ইচ্ছানুসারে
মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা কথাবার্তা দিব্যি চলত। ঘরে ঢুকতেই শুরু হত বাবার তিরস্কারে
ভরা দৃষ্টির সামনে নিরস জীবন। একটাই কাজ ছিল যাতে শান্তি পেতেন – নিজের ঘরে ঢুকে ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা; বইটার পাণ্ডুলিপি
প্রস্তুত করা। “আমার মনে হয়, প্রতিদিন
যদি নিজের বইয়ে ইংরেজ সমাজকে ভয়-পাওয়ানো গল্পগুলো লেখার কাজ না থাকত, এত দিনে আমি পচে
গিয়ে থাকতাম; একাজটা অন্ততঃ আমার রক্তে ক্রোধের স্ফুটন বাঁচিয়ে রাখে।”
ইতিমধ্যে খবর এল যে রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য
এবং প্রুশীয় সরকারের চাপে ফ্রান্সের সরকার মার্ক্সকে প্যারিস থেকে বার করে দিয়েছে।
মার্ক্স সপরিবারে ব্রাসেলস চলে গেছেন। তক্ষুনি এঙ্গেলস সম্ভাবিত সাহায্যকর্তাদের সূচি
তৈরি করে সবাইকে চিঠি পাঠালেন। স্থানীয় স্তরে সাহায্য সংগ্রহ করলেন এবং নিজের অংশ যোগ
করে মার্ক্সকে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন।
ওদিকে শেষ অব্দি পিতা-পুত্রের লড়াইয়ে পুলিস
এঙ্গেলসকে ‘সাহায্য’ করল। রোজকার কার্যকলাপ, ভাষণ, সরকারের নজরে
বিপজ্জনক লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা ইত্যাদির কারণে এঙ্গেলসের গ্রেপ্তার হওয়া অবশ্যম্ভাবী
হয়ে উঠল। বারমেনে গ্রেপ্তার হলে বাবার এবং পরিবারের সম্মানে আঘাত লাগত। এঙ্গেলসও গ্রেপ্তারি
এড়াতে চাইছিলেন। হাতে অনেক কাজ। তাই যখন বাড়িতে ঘোষণা করলেন যে তিনি ব্রাসেলস (বেলজিয়াম)
যাবেন, বাবা আপত্তি করতে পারলেন না।
‘ইংল্যান্ডে
শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা’
যাহোক, বারমেন ছাড়ার আগে বইটার পাণ্ডুলিপি
তৈরি করে লাইপজিগের এক প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দিতে পেরেছিলেন। ১৮৪৫এর এপ্রিলে বারমেন
ছাড়লেন, আর সেমাসেই বইটা প্রকাশিত হল।
আগেই বলেছি কী অবস্থায় এঙ্গেলস পাণ্ডুলিপি
তৈরি করেছিলেন। সকাল-সন্ধ্যে বাবার তিরস্কারে ভরা মৌন, তাঁর সব চিঠি, সব কাগজের ওপর
সন্দেহপ্রবণ অনুসন্ধিৎসু নজর, মায়ের অসহায় ও কাতর মুখ! তার ওপর বাড়িতে নতুন হাঙ্গামা
শুরু হল যখন জানা গেল, বোন মেরি যে যুবকটির সঙ্গে বিয়ে করবে ঠিক করেছে সেও নাকি সাম্যবাদী!
বাইরে পুরো শহরে এঙ্গেলসের গতিবিধি স্থানীয় সরকারি গুপ্তচরদের নজরে। এসবেরই মধ্যে কয়েক
মাস বসে, “গলা অব্দি বইয়ের
স্তুপে ডুবে” এঙ্গেলস ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা’র পাণ্ডুলিপি তৈরি করলেন। সামনে ছড়ানো থাকত
ম্যাঞ্চেস্টার এবং আশেপাশে, একা কিম্বা মেরির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে অথবা কোনো শ্রমিক পরিবারের
বাড়িতে নেওয়া নোট, অন্যান্য কাগজপত্র।
মূল পাণ্ডুলিপির সঙ্গে তিনি ১৫ই মার্চ ১৮৪৫এ
ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণীর নামে একটি অর্পণ-পত্র লিখলেন, যেটা বইয়ের শুরুতে ছাপা হল।
৩০০র একটু বেশি পৃষ্ঠার এই বইয়ে, পূঁজিবাদী
উৎপাদন প্রণালী কিভাবে শ্রমিকের শোষণ করে তার বুক-কাঁপানো অমানবিক বাস্তবতা ফুটে উঠল।
যে ভাবুক এবং বুদ্ধিজীবীরা সমকালীন অর্থনীতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে চাইত, তাদেরকে
নাড়িয়ে দিল বইটা। যে ভবিষ্যৎবাণীগুলো করা হয়েছিল, সেগুলোকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে উঠে
পড়ে লেগে গেল পূঁজিবাদী বুদ্ধিজীবীদের দল। ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব এবং বিস্ময় জাগানো
আর্থিক উন্নতির বনিয়াদ হয়ে বিদ্যমান একটি নতুন শ্রেণীর অভ্যুদয় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন
এঙ্গেলস। এখন সমাজ-পরিবর্তনের কথা আর বিমূর্ত সদিচ্ছা নয়, নিকট ভবিষ্যতে এক প্রবল শক্তিধর
সামাজিক শ্রেণীর শেকল ভাঙার দিন হয়ে উঠল।
এঙ্গেলস নিজেই বইটার ভূমিকায় বলেন –
“বর্তমান সময়ের সব
সামাজিক আন্দোলনের বাস্তব ভিত্তি ও প্রস্থান-বিন্দু শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা। কেননা এই
অবস্থাই আজ পরিব্যাপ্ত সামাজিক দুর্দশার স্পষ্ট চরমতম সীমা … সমাজবাদী তত্ত্বগুলোকে শক্তপোক্ত জমি দেওয়ার
জন্য যেমন, সে তত্ত্বগুলোর অস্তিত্বে থাকার অধিকার সম্পর্কে রায় দেওয়ার জন্যও তেমন,
সর্বহারাদের অবস্থার জ্ঞান একান্ত প্রয়োজনীয়। সেই জ্ঞানই সব রকমের ভাবপ্রবণ স্বপ্ন
এবং পক্ষে-বিপক্ষে মনে উঠতে থাকা খোশখেয়ালগুলোকে শেষ করবে।”
এরপর এঙ্গেলস বলেন কেন ইংল্যান্ডেই এ অধ্যয়ন।
কেননা ইংল্যান্ডেই শ্রমিক শ্রেণীর প্রকৃত অবস্থা তার সর্বোত্তম রূপে বিদ্যমান। এবং
ইংল্যান্ডেই এ অবস্থাগুলোর আধিকারিক তদন্ত হয়েছে তথা আবশ্যক তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে
যা এধরণের অধ্যয়নের জন্য একান্ত জরুরি।
বাস্তব অবস্থার গভীর অধ্যয়ন তো ছিলই, তারই
সঙ্গে পূঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালীর কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রথমবার চিহ্নিত করা হল।
আর্থিক সঙ্কটের নিয়মিত চক্র, বেকারদের ফৌজের অব্যাহত উপস্থিতি, উৎপাদনের প্রসারের সঙ্গে
শোষণের ক্রমবর্দ্ধমানতা ইত্যাদি।
মার্ক্স তো নোটগুলো প্যারিসেই পড়েছিলেন। প্রকাশিত
হওয়ার পর যখন বইটা স্বীকৃতি ও সমাদর পেল তিনি খুব খুশি হলেন। এই বইয়ে উদ্ধৃত ইংরেজ
সরকারের আধিকারিক তদন্ত প্রতিবেদন এবং অন্যান্য সামগ্রীগুলো পরে মার্ক্সকে পথ দেখালো
যখন তাঁর মহাগ্রন্থ ‘পূঁজি’ রচনাকালে তিনি প্রতি দিন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে
যাওয়া শুরু করলেন। ‘পূঁজি’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পরেও মার্ক্স
আরেকবার বন্ধু-রচিত বইটা পড়লেন। ১৮৬৩র ৯ই এপ্রিলে লেখা মার্ক্সের একটি চিঠি পাওয়া যায়
যাতে তিনি এঙ্গেলসকে বলছেন, “আজও দেখা যায় কত সতেজতা এবং আবেগের সাথে, দৃষ্টির কতটা সাহসিকতায়,
পাণ্ডিত্য এবং বৈজ্ঞানিক অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে, এই পৃষ্ঠাগুলোয় বিষয়টাকে আয়ত্ত
করা হয়েছে।”
এমন কিছু আশার কথা অবশ্যই উৎসাহের সঙ্গে এ
বইয়ে লেখা হয়েছিল যা পুরো হল না। উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব তখনো আবিষ্কৃত হয় নি। তাই
পূঁজিবাদী শোষণের পুরো সত্যটা অনাবৃত হয় নি। কিন্তু দূরদৃষ্টির নিদর্শন লেখকের এই ভবিষ্যৎবাণী
যে পূঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালীতে হওয়া উৎপাদক শক্তির দ্রুত বিকাশ একদিন নিজেই পূঁজিবাদী
উৎপাদন প্রণালীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। বিপ্লব সর্বহারাই আনবে এবং সে বিপ্লব হবে সমাজবাদী।
সোভিয়েত সঙ্ঘ প্রকাশিত এঙ্গেলসের উপরোক্ত জীবনীতে
জার্মান শ্রমিক শ্রেণীর তৎকালীন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কবি জর্জ উইর্থের উল্লেখ আছে।
এঙ্গেলস যখন বার্মেন ছেড়ে ব্রাসেলস চলে গেলেন তখন জর্জ উইর্থ জুলাই মাসে (১৮৪৫) তাঁর
সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এঙ্গেলসের লেখা এবং ব্যক্তিত্বে এত প্রভাবিত হলেন যে উৎসাহের
সঙ্গে নিজের মাকে লিখলেন, “সম্পত্তিওয়ালা ভদ্রমহাশয়রা
সাবধান হয়ে যাও। জনগণের শক্তিশালী হাত আমাদের সঙ্গে আছে এবং সব জাতির সবচেয়ে ভালো মাথাগুলো
আমাদের সঙ্গে আসছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমার খুব প্রিয় বন্ধু, বারমেনের ফ্রেডরিক এঙ্গেলস
ইংরেজ শ্রমিকদের নিয়ে একটি বই লিখেছে যাতে কারখানাদারদের ওপর একদম সঠিক কিন্তু ভয়ানকভাবে
চাবুক চালিয়েছে। তার নিজের বাবার কারখানা আছে ইংল্যান্ডে এবং জার্মানিতে। এখন নিজের
পরিবারের সঙ্গে তার তীব্র মনোমালিন্য। তাকে ঈশ্বরহীন এবং শয়তান মনে করা হয় … কিন্তু আমি সেই ছেলেকে জানি। দেবতার মত দয়ালু।
অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। দিন রাত সর্বশক্তি দিয়ে সে শ্রমিক শ্রেণীর
ভালোর জন্য লড়াই করে।”
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল উপাদানগুলোর জন্ম
থিসিস অন ফায়ারবাখ
ব্রাসেলসে সেসময় নির্বাসিত জার্মান বিপ্লবীদের
সংখ্যা অনেক। এপ্রিল ১৮৪৫এ এঙ্গেলস ব্রাসেলস পৌঁছোলেন। কয়েক দিনেই, মার্ক্স সেসময় যেখানে
থাকছিলেন তার একেবারে কাছে একটা ঘর পেয়ে গেলেন ভাড়ায়। এই দিনগুলোতেই তিনি মার্ক্সের
পরিবারেরও ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হয়ে উঠলেন। এক সঙ্গে সারা দিন থেকে কাজ করার এমন সুযোগ আবার
তিন বছর পরে প্যারিসে, ১৮৪৮এর ইয়োরোপীয় বিপ্লবের আগে পেয়েছিলেন।
যত দিন ব্রেমেনে ছিলেন, মায়ের কষ্ট, পৈত্রিক
ব্যবসা, বাবার তিরস্কারভরা চোখ, সব মিলিয়ে পারিবারিক মনোমালিন্যের একটা ভার মাথায় চেপে
থাকত। ব্রেমেন থেকে বেরোতেই সেটা নেমে গিয়েছিল।
ব্রাসেলসে আসার একমাস আগে বন আর কোলোন ঘুরে বিপ্লবী বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎও করে
এসেছিলেন। হাল্কা মনে অনেক সম্ভাব্য কাজের উত্তেজনা ছিল।
মার্ক্সের সঙ্গে দেখা হতেই মার্ক্স তাঁর সদ্যকৃত
দার্শনিক অনুসন্ধানে আবিষ্কৃত ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার কথা বললেন। ‘থিসিস অন ফায়ারবাখ’এর পাণ্ডুলিপি বলে যে সেটি ঐ সময়েই, অর্থাৎ
এপ্রিল ১৮৪৫এ লেখা। লিখিত রূপে ঐ থিসিস সামনে থাকুক অথবা পরে লেখা হয়ে থাকুক, দুজনের
মধ্যেকার কথাবার্তা যে ঐ বিষয়েই হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
‘সংবেদনগত মানবিক
ক্রিয়া’ বা ‘ব্যবহারিক কর্ম’কে বাস্তবতা বা সংবেদ্যতার জগতের অন্তর্ভুক্ত
করা দর্শনের ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদের প্রথম বিপ্লব। ‘থিসিস অন ফায়ারবাখ’এর এই প্রথম থিসিস থেকেই শেষ থিসিসে পৌঁছোনো সম্ভবপর হয়ে ওঠে যে
‘বিষয়টা যদিচ, পরিবর্তন’। দুনিয়ার নানারকম দার্শনিক ব্যাখ্যার মধ্যে
কোন ব্যাখ্যাটি সঠিক তার নিরিখও পরিবর্তন ও সেই ব্যাখ্যার বিকাশও যুগপৎ, পরিবর্তনের
পথে।
বস্তুগত শক্তিই ইতিহাস তৈরি করে, তত্ত্ব নয়,
এই কথাটা অব্দি পৌঁছোনোর জন্য ইতিহাস যারা তৈরি করে, মানুষ, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সংঘটিত
হয়ে চলা তাদের দৈনন্দিন শ্রমকে, উৎপাদক ক্রিয়াকে বস্তু-তা, বস্তুগত ক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত
করার প্রয়োজন ছিল।
আর মানুষের দৈনন্দিন উৎপাদক ক্রিয়া যদি বস্তুগত
ক্রিয়া হয়, বস্তু ও বাস্তব ঘটনাজগতের অংশ হয় তাহলে তার মগজটাকে অনুসরণ করা যাক! ছুতোরের
মাথায় যে চেয়ারটা আছে, সেটা সত্যিই চেয়ার কিনা, চার-পায়া জিনিষটায় সত্যিই মানুষ বসবে
কিনা, তার সমাধান তো তর্কে হবে না, কাঠের তক্তা এমনকি প্রয়োজনে কুঁদো চেয়ারটা তৈরি
করতে হবে। তাই দ্বিতীয় থিসিস, – মানুষের চিন্তাভাবনাকে বিষয়গত সত্যের মর্যাদা দেওয়া যাবে কিনা সেটা
তাত্ত্বিক নয় ব্যবহারিক প্রশ্ন; মানুষকে তার চিন্তার সত্যতা, অর্থাৎ বাস্তবিকতা এবং
শক্তি, তার ইহজাগতিকতা ব্যবহারে, অনুশীলনে প্রমাণ করতে হবে।
এবং যেহেতু ছুতোর চেয়ারটা তৈরি করে বেঢপ কুঁদো
বা ভাঙা তক্তাটাকে মানুষের আরামে পরিবর্তিত করতে সফল হয়েছে তাই তৃতীয় থিসিস, – পরিস্থিতি ও সেই অনুসারে [মানুষের] পালনপোষণের
কথা বলা বস্তুবাদী মতবাদ ভুলে যায় যে মানুষ পরিস্থিতি বদলায় এবং শিক্ষাবিদকেই শিক্ষিত
হতে হবে। এই মতবাদকে তাই অবশ্যই সমাজকে দুভাগে ভাগ করতে হবে, যার একটি ভাগ সমাজের থেকে
শ্রেয়তর। সঙ্গে এটাও মনে রাখার যে পরিস্থিতি ও মানুষের গতিবিধি বদলের অথবা ‘আত্ম-পরিবর্তন’এর এই যে সমাপতন, এটাকে একমাত্র ‘বৈপ্লবিক অনুশীলন’ হিসেবেই যুক্তিপূর্ণ ভাবে বোঝা যেতে পারে।
সমাজকে দুভাগে ভাগ করলেই বোঝা যাবে যে সেই
“সমাজের আভ্যন্তরীণ
কলহ এবং অন্তর্নিহিত দ্বান্দ্বিকতা”র ফলশ্রুতি হিসেবেই লোকায়ত [বা ইহলৌকিক] জগত নিজের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন
করে স্বাধীন জগত হিসেবে মেঘে [স্বর্গে] প্রতিষ্ঠিত করে। ফায়ারবাখের কাজের গুরুত্ব এখানে
যে তিনি [ঐ স্বর্গে প্রতিষ্ঠিত] ধার্মিক জগতকে তার লোকায়ত আধারে জাত নিষ্পন্ন করেন।
কিন্তু এটুকু বললেই তো সেই স্বর্গকে মর্ত্যে নামানো যাবে না। স্বর্গকে মর্ত্যে নামাতে
হলে স্বর্গের লোকায়ত আধারটার দ্বান্দিক চরিত্র বুঝে বৈপ্লবিক বদল ঘটাতে হবে – পবিত্র পরিবারের শাসন শেষ করতে গেলে মর্ত্যের
পরিবারের শাসনটাকে যেমন তত্ত্বে তেমন ব্যবহারে ধ্বংস করতে হবে।
পঞ্চম থিসিসে মার্ক্স বলেন যে ফায়ারবাখ বিমূর্ত
চিন্তনে সন্তুষ্ট হন না, সংবেদ্য মনন চান, অথচ তিনি সংবেদ্যতাকে ব্যবহারিক, মানবিক-ইন্দ্রিয়গত
কার্যকলাপ হিসেবে ধরেন না।
আর তাই, আগে যে ‘লোকায়ত জগত’ অর্থাৎ মানব-সমাজের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি হিসেবে ধর্মের
জন্ম দেখানো হল, ফায়ারবাখ সেভাবে দেখেন না বলে ‘ধর্মের সার’ মানুষের সার’এ নিষ্পন্ন করলেও, সে সারকে “সামাজিক সম্পর্কের মোট-ফল” রূপে না দেখে একক ব্যক্তিতে নিহিত বিমূর্ত রূপে দেখেন। (এর ফলে
ফায়ারবাখকৃত দুটো ভুলের কথাও বলা আছে এই থিসিসে)।
ফায়ারবাখ, ফলে দেখেন না যে ‘ধার্মিক অনুভূতি’ নিজেই একটি ‘সামাজিক উৎপন্ন’; তাঁর দ্বারা বিশ্লেষিত বিমূর্ত ব্যক্তি বস্তুতঃ
একটি বিশেষ প্রকারের সমাজে লভ্য।
তাহলে মোদ্দা কথা এটাও হল যে সমাজ-জীবন মূলতঃ
ব্যবহারিক। সব রহস্য যা তত্ত্বকে রহস্যবাদের বা চিন্তার অস্পষ্টতায় ভুলপথে চালিত করে,
সেগুলোর যুক্তিযুক্ত সমাধান হয় মানুষের অনুশীলনে, ব্যবহারে এবং সেই ব্যবহারের অনুধাবনে।
নবম থিসিসে সাধারণভাবে চিন্তাপরায়ণ বস্তুবাদের
চরম সীমার কথা বলেন মার্ক্স। সংবেদ্যতাকে ব্যবহারিক কার্যকলাপ হিসেবে গ্রহণ না করা
সেই বস্তুবাদ শুধু ‘নাগরিক সমাজ’এ একক ব্যক্তিদের মনন।
দশমে তা থেকে নিজেদেরকে আলাদা করেন মার্ক্স।
বলেন, “পুরোনো বস্তুবাদের
দৃষ্টিকোণ ‘নাগরিক’ সমাজ, নতুন বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ মানব-সমাজ,
অথবা সম্মিলিত মানবতা।
এবং শেষে, একাদশতম থিসিসে এল সেই দুনিয়া-কাঁপানো
দার্শনিক নিষ্পত্তি, দার্শনিকেরা নানাভাবে দুনিয়াটার নিছক ‘ব্যাখ্যা’ করেছে; বিষয় বা প্রশ্ন বা সমস্যা যদিচ, বদল, পরিবর্তন। এই দুনিয়াটার,
এই মানবসমাজটার পরিবর্তন।
সেটা কি ব্যাখা না করেই হবে? না, ষষ্ঠ থিসিসেই
বাক্যাংশটা আছে – ‘ব্যবহারে এবং সেই ব্যবহারের অনুধাবনে’। পরিবর্তনের লড়াইয়ে শামিল হতে হবে এবং সে
পথেই সত্যতা প্রমাণিত হতে থাকবে ব্যাখ্যার।
দু’পাতায় জ্বলজ্বল করতে থাকা এগারটি আলোকবিন্দু-সমন্বিত এই নক্ষত্রপুঞ্জ
হাতে পেয়ে বা রচয়িতার মুখে শুনে স্থির থাকতে পারে কেউ? এঙ্গেলসও নিশ্চয়ই পারেন নি।
কিভাবে উদযাপন করেছিলেন সেই আনন্দময় অস্থিরতা তা অনুমান করতে পারি।
জার্মান আইডিওলজি
এটা উল্লেখযোগ্য যে মানুষের ঐতিহাসিক বিবর্তনের
অবলম্বনবিন্দু হিসেবে তার শ্রমকে মার্ক্স যে সময় রাখছেন তার অনেক পরে, জীবের বিবর্তনের
তত্ত্ব নিয়ে ডারউইন এসেছেন, মানুষের যৌন-ব্যবহার ও পরিবার নিয়ে ক্ষেত্র-সমীক্ষার তথ্য
ও নিষ্কর্ষ নিয়ে মর্গান এসেছেন।
যাহোক, শুধু এই থিসিসটুকু দিয়ে তো চলবে না।
কাজের পথে বেরিয়ে পড়ার আগে ফায়ারবাখ ও অন্যান্য জার্মান বস্তুবাদী ও সমাজবাদী দার্শনিকদের
সমালোচনাক্রমে নিজেদের নতুন দার্শনিক বিশ্বদৃষ্টিটাকে ভালো করে গুছিয়ে পেশ করতে হবে।
সে কাজটাই দুজনে মিলে করবেন ভাবলেন, কিন্তু
তার আগে অন্য কিছু কাজ করণীয় ছিল। ১৮৪৩ থেকেই মার্ক্স রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের অধ্যয়ন
চালিয়ে যাচ্ছিলেন। জার্মানির এক প্রকাশকের সঙ্গে ১৮৪৫এর ফেব্রুয়ারির শুরুতে চুক্তিও
হয়েছিল। বইটার নাম হওয়ার ছিল ‘ক্রিটিক ডের পলিটিক উন্ড ন্যাশনালোকোনমি’। সে কাজটা পুরো করতে একবার ইংল্যান্ডে যাওয়ার
ছিল। যদিও প্রুশীয় সেন্সরশিপের ভয়ে প্রকাশক শেষ পর্য্যন্ত বইটা প্রকাশিত করেন নি। সে
বইয়েরই সামগ্রী রুশবিপ্লব-পরবর্তী প্রজন্ম ‘১৮৪৪এর আর্থিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি’ নামের কাগজের বান্ডিল
হিসেবে পেল।
ইংরেজি ভালো জানতেন না বলে মার্ক্স এঙ্গেলসকে
সঙ্গে নিয়ে ইংল্যান্ডে গেলেন। এঙ্গেলসও সানন্দে সঙ্গ দিলেন। মার্ক্সের সঙ্গে দিন কাটবে!
আর সেখানে গিয়ে দুটো লেখা তাঁরও পুরো করার ছিল – একটা ইংল্যান্ডের সামাজিক ইতিহাসের ওপর আর আরেকটা বাণিজ্যে সংরক্ষণনীতির
ওপর।
জীবনীলেখকেরা আন্দাজ করেন যে ১৮৪৫এর ১২ জুলাই
থেকে ২১শে আগস্ট অব্দি দুই বন্ধু, এঙ্গেলসের পরিচিত শহর ম্যাঞ্চেস্টারে ছিলেন। তাঁদের
অধিকাংশ সময়, পুরো ইয়োরোপের প্রাচীনতম গ্রন্থালয়গুলোর অন্যতম, চ্যাটহ্যাম গ্রন্থালয়ে
কাটত। দুজনে নিজের নিজের কাজ অনুসারে নোট নিতে নিতে সেগুলো অদলবদল করতেন এবং একে অপরের
নোট পড়ে পাশে মন্তব্যে নিজের মতামত জানাতেন। মাঝে একদিন এঙ্গেলস মেরি বার্ন্সের সঙ্গে
দেখা করে মার্ক্সের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন। দুজনের ব্রাসেলস ফেরার সময় সঙ্গে
মেরিও কিছুদিনের জন্য বেড়াতে ব্রাসেলস গেলেন।
ব্রাসেলস ফেরার পর দুজনে আগে থেকে ভেবে রাখা
কাজে হাত দিলেন। সে কাজটিকে আমরা ‘জার্মান আইডিওলজি’ নামে জানি। এটা তাঁদের প্রথম পুরোপুরি যৌথ রচনা ছিল। রচনাসমগ্রে
দেওয়া বিবরণ অনুসারে নভেম্বর ১৮৪৫ থেকে আগস্ট ১৮৪৬ অব্দি দশ মাস সময়ে দুজনে গ্রন্থটি
পুরো করলেন। বইটার শিরোনামের পর লেখা ছিল “সেই আধুনিক জার্মান দর্শনের সমালোচনা”, “ফায়ারবাখ, ব্রুনো বাউয়ার এবং স্টার্নার” যার প্রতিনিধিত্ব করেন করেন এবং সেই “জার্মান সমাজবাদ”এরও সমালোচনা “বিভিন্ন ত্রাণকর্তা”র মাধ্যমে যা অভিব্যক্ত হয়। কিন্তু বইটা ঐতিহাসিক
বস্তুবাদেরও প্রথম পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা ছিল। দুঃখের কথা, বইটা পাণ্ডুলিপি রূপে পড়ে রইল
দশকের পর দশক। কোনো প্রকাশক ছাপতে তৈরি হল না কেননা যাদের সমালোচনা করা হয়েছিল তারা
সে সময় জার্মানির মেধাজগতে বিরাট নাম। ছিয়াশি বছর পর, ১৯৩২ সালে বইটা প্রথম প্রকাশ
করল সোভিয়েত সঙ্ঘ।
যদিও বইটা প্রকাশিত না হওয়া নিয়ে মার্ক্স কখনো
চিন্তিত হন নি, ১৮৫৯ সালে বলছেন যে “প্রধান উদ্দেশ্য, আত্ম-স্পষ্টীকরণ” তো হয়েই গিয়েছিল তাই আমরা পাণ্ডুলিপিগুলোকে
সানন্দে “ইঁদুরদের চর্বণমূলক
সমালোচনার জন্য রেখে দিয়েছিলাম”, আজও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বোঝার জন্য সবাইকে এই বইটা পড়ার পরামর্শ
দেওয়া হয়।
প্রায় চল্লিশ বছর পর এঙ্গেলস সময়টার কথা বলতে
গিয়ে বলেন, “এই বইটা লেখার পর
আমরা একেবারেই আর নতুন বৈজ্ঞানিক পরিণামগুলো বিশেষকরে বিদ্বানজগতের জন্য পাণ্ডিত্যপূর্ণ
ঢঙে লিখতে চাইছিলাম না। আমরা দুজনে আগে থেকেই গভীরভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনে লিপ্ত ছিলাম।
শিক্ষিত জগতে, বিশেষ করে পশ্চিম জার্মানিতে, আমাদের কয়েকজন অনুগামীও ছিলেন। সংগঠিত
সর্বহারাদের সঙ্গে আমাদের ভালোরকম সম্পর্ক ছিল। আমাদের দৃষ্টিকোণকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি
দেওয়া আমাদের কর্তব্য ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রথমে জার্মান এবং পরে ইয়োরোপীয় সর্বহারাদেরকে
আমাদের প্রত্যয়ের পক্ষে আনা ততটাই জরুরি ছিল। যেই এ ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টি স্পষ্ট
হল, আমরা নিজেদের কার্যভার পুরো করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।” [কম্যুনিস্ট লীগের ইতিহাস, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস,
১৮৮৫]
বিপ্লবী সর্বহারা সংগঠন নির্মাণের সংগ্রাম
কম্যুনিস্ট করেসপন্ডেন্স কমিটি
বা ‘পত্রবিনিময় সমিতি’। ‘জার্মান ভাবাদর্শ’ লেখার মধ্যে দিয়ে নিজেদের নতুন চিন্তাভাবনার
মূল উপাদানগুলো স্পষ্ট করার পর আর বড় তাত্ত্বিক কাজ নিয়ে বসার ইচ্ছে ছিল না। হাওয়া
পাল্টাচ্ছিল। আজকের অন্তর্জালে খুঁজলেও জানা যায়, পুরো ইয়োরোপে খাদ্য সংকটে জনরোষ ঘনিয়ে
উঠছিল। খোদ জার্মানিতে সংবিধান, মুক্ত নির্বাচন এবং প্রচ্ছন্নভাবে জার্মান ঐক্যের আন্দোলন
নতুন মোড় নিল যখন প্রুশিয়ার রাজা প্রুশিয়ার সবকটি রাজ্যের একীকৃত সংসদের (ডায়েট) সভা
আহ্বান করল ১১ই এপ্রিল ১৮৪৭এ। সভা আহ্বান করা হয়েছিল আরো কয়েকটি বিষয়ের সঙ্গে নতুন
রেলপথের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু সংসদ নিজেদের দাবি রাখল। প্রধান ছিল, আগে
সংবিধান তৈরি হোক এবং মুক্ত নির্বাচন হোক। ভয়ে, রাজা ২৬শে জুন সংসদই ভঙ্গ করে দিল।
কিন্তু সমস্যা ছিল মার্ক্স-এঙ্গেলসের যে একদিকে
শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনে সমাজবাদী ভাবধারার প্রভাব ছিল প্রায় শূন্য আর অন্য দিকে বুদ্ধিজীবীকেন্দ্রিক
সমাজবাদীদের যে দুটো ধারা ছিল, শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ সেদুটোর ধারণাতেই ছিল না।
এক ধারায় ছিল নানা ধরণের সংস্কারপন্থী কাজকর্মের কথা, অন্য ধারায় ছিল গোপন চক্রান্তমূলক
সংগঠনের মাধ্যমে বিপ্লব ঘটানোর কথা। দু’ধারার বিরুদ্ধেই মার্ক্স-এঙ্গেলসকে লড়াই করতে হয়েছিল। প্রথম ধারার,
বিশেষকরে প্রুধোঁপন্থীদের বিরুদ্ধে মার্ক্সের ‘দর্শনের দারিদ্র্য’ ১৮৪৭এই প্রকাশিত হয়েছিল। এঙ্গেলসের ‘আবাসন প্রশ্ন’ অবশ্য অনেক পরে, ১৮৭২এ লেখা। অর্থাৎ সংস্কারপন্থীদের
বিরুদ্ধে সংগ্রাম দুজনকে সারা জীবন চালিয়ে যেতে হয়েছিল।
চক্রান্তমূলক বিপ্লবের কথা বলা সংগঠনগুলোর
মধ্যে একটি ছিল উইলহেল্ম ওয়েটলিংএর নেতৃত্বে। খ্রিশ্চান-সাম্যবাদী এই ধারাটির সঙ্গে
এঙ্গেলসকে বেশ কয়েকবার মুখোমুখি তর্কে বসতে হয়েছিল।
বিভিন্ন দেশের সমাজবাদী, সাম্যবাদী নেতাদের
সঙ্গে এঙ্গেলসের ভালোরকম চেনাশুনো ছিল। তা সে ইংল্যান্ডের চার্টিস্টরা হোক বা এলবারফেল্ডের
কল্পলৌকিক সাম্যবাদী, ব্রাসেলস, বন, কোলোন, বার্লিনের লোক বা প্যারিসের সমাজবাদী সবার
সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক রাখতেন এঙ্গেলস। জার্মান ভাবাদর্শ রচনার প্রক্রিয়ায় লেখকদ্বয়
যে স্বপ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন, সে ধরণের সংগঠন গড়ে তোলা সে মুহূর্তে কঠিন ছিল। কেননা
যেমন আগেই বলা হল, প্রচুর সংখ্যক সমাজবাদী/সাম্যবাদী থাকলেও শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে তাদের
বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। পুরো ইয়োরোপে পূঁজিবাদী-প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের অঙ্কুর দেখা
যেতে শুরু করেছিল কিন্তু শ্রমিকশ্রেণীরও সমাজবাদী ভাবধারার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক ছিল
না।
১৮৭১ সালে এঙ্গেলস, ইতালির সমাজবাদী কার্লো
কাফিয়েরোকে চিঠি লিখতে গিয়ে স্মরণ করেন, “সে সময় সমাজবাদী এবং সাম্যবাদী ভাবধারায় প্রভাবিত সর্বহারা ছিলেন
গোনাগুনতি – সুইটজারল্যান্ডে,
ফ্রান্সে আর ইংল্যান্ডে যারা আবার আমাদেরই অনুগামী ছিলেন। জনগণের সঙ্গে কাজ করার উপায়
বিশেষ ছিল না আর আপনাদেরই মত আমরা বিদ্যালয়-শিক্ষক, সাংবাদিক এবং ছাত্রদের মধ্যে থেকে
আমাদের অনুগামীদের কাজে লাগাতে বাধ্য হতাম।”
তাদের সাথেই পরামর্শ করে মার্ক্স-এঙ্গেলস প্রতিষ্ঠা
করলেন ‘কম্যুনিস্ট করেসপন্ডেন্স
কমিটি’ – মনে করা হল এতে সম্পর্কগুলো ছড়াবে আর চিন্তাভাবনাগুলোর
আদান-প্রদান সুগম হবে। আর সত্যিই তাই হল। লোকে ব্রাসেলস কমিটি এবং মার্ক্স-এঙ্গেলসের
কাজের বিষয়ে জানতে শুরু করলেন।
প্রায় তিন বছর মার্ক্স ব্রাসেলসে ছিলেন। যেহেতু
ঘোষিত রাজনৈতিক কারণে তিনি প্যারিস থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন, এবং জার্মানির গুপ্তচরেরও
নজর ছিল, তাই বেলজিয়াম সরকারেরও হুঁশিয়ারি ছিল যে রাজনৈতিক কাজকর্ম বা প্রকাশনা করতে
যেন না দেখা যায়। তাই পাড়া বদলে বদলে ভাড়া নেওয়া মার্ক্সের বাড়িগুলোয় বিভিন্ন কারণে
পার্টি হত, নতুন বছরের পার্টি, দ্বিতীয় মেয়ে লরা আর ছেলে এডগারের জন্ম ব্রাসেলসেই হয়েছিল
তাই তাদের বার্থডে পার্টি (স্ত্রী জেনিও সহযোগী পেয়ে গিয়েছিলেন; জার্মানি্তে বাড়ির
কাছে থাকা এক মহিলা হেলেন ডেমুথকে পরিচারিকা করে জেনির মা ব্রাসেলসে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন)
… আর তারই আড়ালে কম্যুনিস্ট করেসপন্ডেন্স কমিটির ব্রাসেলসে লভ্য সদস্যদের
বৈঠকও হত মাঝে মধ্যে।
তেমন এক বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হল যে এঙ্গেলসকে
প্যারিস যেতে হবে অবিলম্বে। সেখানে এখনো করেসপন্ডেন্স কমিটি গঠিত হয় নি। এঙ্গেলসেরও
ইচ্ছে ছিল তা-ই। ১৮৪৬ সালের ১৫ই আগস্ট এঙ্গেলস প্যারিস চলে গেলেন। জানুয়ারি ১৮৪৮এ বিপজ্জনক
বিপ্লবী ঘোষিত করে ফ্রান্সের সরকার তাঁকে প্যারিস থেকে বিতাড়িত করল। দেড় বছর সময় পেয়েছিলেন।
সেই দেড় বছরে এঙ্গেলস ঘুরে ঘুরে ‘ট্রু সোশ্যালিস্ট’, ‘প্রুধোঁবাদী, ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’ (গোপন, চক্রান্তমূলক বিপ্লবের পথিক), ইত্যাদি
বিভিন্ন দলের অনুগামীদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন, চুটিয়ে তর্কবিতর্ক করলেন এবং সর্বহারা
বিপ্লবের নতুন পথের গুরুত্ব তাদেরকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের
হলেও তারা বেশির ভাগ রাজনৈতিক কারণে নির্বাসিত অথবা স্বেচ্ছানির্বাসিত, বিভিন্ন পেশায়
নিয়োজিত জার্মানই হত।
খুব কঠিন হত বোঝানো কেননা এঙ্গেলস অধিকাংশ
উদাহরণ ইংল্যান্ডের শ্রমিক-জীবন থেকে দিতেন। শিল্পোন্নয়নের সেই বিপুল কর্মকান্ড, সর্বহারা
শ্রেণী বলতে বিশাল একটি সামাজিক শ্রেণীর আবির্ভাব, সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন এসব তখনো
জার্মানি আর বেলজিয়াম তো দূরের কথা, ফ্রান্সেও অকল্পনীয় মনে হত। তাই এঙ্গেলসের কথাগুলো
বিশ্বাসযোগ্য মনে হত না আর তুমুল ঝগড়া হত।
ব্রাসেলসের ‘পত্রবিনিময় সমিতি’কে তিনি ১৮৪৬এর ২৩শে অক্টোবর চিঠি লিখলেন।
তাতে সেসব ঝগড়াগুলোর কথা জানিয়ে বললেন যে কিভাবে তিনি নিজের কথাগুলো শেষমেশ তিনটে উদ্দেশ্যে
সীমিত করতেন –
“(১) পূঁজিবাদীদের
বিরুদ্ধে সর্বহারাদের স্বার্থ সাধন করা; (২) এই কাজটা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ ও
তার স্থানে সামাজিক সম্পত্তি এবং সামাজিক অংশীদারির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে করা; (৩) এসব
উদ্দেশ্যের প্রাপ্তির জন্য বলসাধ্য গণতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যতীত অন্য কোনো উপায় গ্রহণ
না করা।”
সংগঠন নির্মাণের কাজে এই দেড় বছর এঙ্গেলসের
জন্য অনেকভাবে শিক্ষাপ্রদ হয়ে উঠল। প্যারিসে তাঁর পরিশ্রমে এবং ব্রাসেলস থেকে মার্ক্সকৃত
সাহায্যে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করল। প্যারিসে আগে থেকে চলতে থাকা সংগঠন ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’এর অধিকাংশ সদস্য মার্ক্স-এঙ্গেলসের নতুন মতাদর্শের
অনুগামী হয়ে উঠলেন এবং গোপন, চক্রান্তমূলক, অন্ধ গোঁড়ামির পথ ছাড়তে রাজি হলেন। কিছু
সূত্র বলে যে ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’এর পক্ষ থেকে তার প্রধান, কার্ল শ্যাপার চিঠি
দিলেন মার্ক্স-এঙ্গেলসকে যে তাঁদের পরামর্শমত নিয়মাবলী ও কর্মসূচিতে বদল ঘটাবার কাজে
সাহায্য করতে তাঁরা যেন সংগঠনের সদস্যতা গ্রহণ করেন। তখন মার্ক্স এবং এঙ্গেলস দুজনে
এবং তারপর ‘কম্যুনিস্ট করেসপন্ডেন্স
কমিটি’র সমুদয় সদস্য ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’এর সদস্যতা গ্রহণ করে নিলেন – ফলে সংগঠনে নিয়মাবলীতে সংশোধনের জন্য লড়াই
শুরু হল। এর ফলে, ইংল্যান্ড এবং অন্যান্য জায়গায় অনেকে যে ‘লীগ অফ জাস্ট’ বানানোর প্রস্তাব ঐ সমস্ত পন্থাগত কারণে এড়িয়ে
চলছিল তারা সংগঠনে আসতে শুরু করল।
সিদ্ধান্ত হল যে ‘লীগ অফ জাস্ট’এর প্রথম উদ্বোধনী সম্মেলন লন্ডনে হবে। সংগঠনের
নতুন নাম, চরিত্র, কর্মসূচি, গঠনতন্ত্রে ইত্যাদির জন্য মার্ক্স, এঙ্গেলস এবং তাঁদের
সহযোগীরা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
২রা জুন (উইকিপিডিয়া বলছে ১লা জুন) ১৮৪৭এ ‘লীগ অফ জাস্ট’এর প্রথম সম্মেলন লন্ডনে শুরু হল। পকেটে পয়সা
ছিল না বলে মার্ক্স এই সম্মেলনে শামিল হতে পারলেন না। ব্রাসেলস এবং পুরো বেলজিয়ামের
কম্যুনিস্টদের প্রতিনিধিত্ব করলেন মার্ক্স-এঙ্গেলসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আজীবন সহযোগী উইলহেল্ম
উলফ। এঙ্গেলস অনেক ঝগড়া, ঝঞ্ঝাট সহ্য করে, বিরুদ্ধ-শক্তিদেরকে পরাস্ত করে শেষে প্যারিসের
গোষ্ঠিগুলোর প্রতিনিধি হয়ে এলেন। কিন্তু প্রভাবিত করলেন পুরো সম্মেলনের কার্যকলাপ।
অন্যান্য প্রতিনিধি যারা তাঁদের অনুগামী ছিলেন তাদের সহযোগিতা পাওয়া গেল। সংগঠনের কর্মসূচি
ও গঠনতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন করা হল। সংগঠনের নাম বদলে রাখা হল ‘কম্যুনিস্ট লীগ’। প্রধান স্লোগান, ‘সব মানুষ ভাই ভাই’ পাল্টে করা হল, ‘সব দেশের শ্রমজীবী, এক হও’। [এই সম্মেলনের বিস্তারিত ঘটনাবলীর জানতে
ইচ্ছুক পাঠকেরা এঙ্গেলস রচিত ‘অন দ্য হিস্ট্রি অফ কম্যুনিস্ট লীগ’ পড়তে পারেন]
ওদিকে ১৮৪৬এর শেষে মাসগুলো থেকেই ফরাসি পুলিশের
খাতায় এঙ্গেলসের নাম লেখা হয়ে গিয়েছিল। এঙ্গেলস সাবধান থাকছিলেন আর লেখালিখির কাজ বাড়িয়ে
দিয়েছিলেন। ফরাসি রাজনীতির সংকট, প্রুশিয়া ও জার্মানিতে প্রজাতান্ত্রিক পরিবর্তনের
জন্য সংগ্রাম, ইংল্যান্ডে পূঁজিবাদী এবং চার্টিস্টদের মধ্যে লড়াই ইত্যাদি বিষয়ে তো
লিখছিলেনই, এবার ইয়োরোপের পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, সুইটজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ইত্যাদি
দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়েও লিখতে শুরু করলেন। তারই সঙ্গে সাহিত্যধর্মী বিষয়ের ওপরও
কয়েকটি প্রবন্ধ তৈরি করলেন। ওদিকে দিগন্তে আমেরিকাও উঠে এসেছিল। মার্ক্সের সঙ্গে একসাথে,
আমেরিকা-নিবাসী এক ভাববাদী-সাম্যপন্থী ক্রীজের বিরুদ্ধে একটি রচনায় তার বিভ্রান্তিকর
প্রচারগুলোর যাথার্থ্য সামনে এনে আমেরিকার সমাজবাদী বন্ধুদের সাবধান করলেন। মার্ক্স
সেসময় ‘দর্শনের দারিদ্র্য’ লিখছিলেন। হঠাৎ কাজ পড়ে যাওয়ায় তিনি সপরিবার
হল্যান্ড চলে যাওয়ায় এঙ্গেলসকে প্যারিসে বসেই ‘পত্রবিনিময় সমিতি’র যাবতীয় কাজ হাতে নিতে হল।
১৮৪৭এর ১৬-১৮ সেপ্টেম্বর, ব্রাসেলসে আন্তর্জাতিক
মুক্ত বাণিজ্য কংগ্রেস হওয়ার ছিল। মার্ক্স-এঙ্গেলস চিন্তা করলেন যে এই কংগ্রেসে বক্তা
হিসেবে নাম লেখাতে হবে। শেষে মার্ক্স এবং জর্জ উইর্থকে (পূর্বোল্লিখিত) বক্তা হিসেবে
স্বীকার করা হল। উইর্থের তেজোদ্দীপ্ত বক্তব্যে আয়োজকেরা এমন ঘাবড়ে গেল যে মার্ক্সকে
আর বলতেই দেওয়া হল না। দুজনে স্থির করলেন যে লিখেই এদের ভান্ডাফোড় করতে হবে।
মুক্ত ব্যাপারপন্থীদের সব বক্তব্য সংরক্ষণবাদের
বিরুদ্ধে। ফলে জনমত দুই শিবিরে বিভাজিত হয়। মার্ক্স-এঙ্গেলস মঞ্চটি ব্যবহার করে জনগণকে
বলতে চাইছিলেন যে দুটোই পূঁজিবাদীদেরই দুটো শিবির। দুটোর মধ্যে থেকে একটা বাছার ধাঁধায়
মাতলে সর্বহারার মুক্তি জুটবে না। তাকে তো পূঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালীটারই বিলোপসাধন
করতে হবে। এই আশয়েই দুজনে দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখলেন।
দ্বিতীয় কাজটা ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’এর নিয়মাবলি বা গঠনতন্ত্রে পরিবর্তনের কাজ
দিয়ে শুরু হয়েছিল। আগে, গোপন সংগঠনের মত একটা শপথ-পত্র ছিল। দুজনেই এমন কোনো শপথ-টপথের
ব্যাপার সরিয়ে দিতে চাইছিলেন। কিন্তু বেশ কয়েকজন প্রতিনিধির ইচ্ছে ছিল যে না, কিছু
একটা সেরকম থাকুক। তখন এঙ্গেলস নতুনভাবে সেটা লিখতে শুরু করলেন। নাম হল, ‘কম্যুনিস্ট আস্থার স্বীকারোক্তি’। খসড়াটা সবক’টি শাখায় আলোচনার জন্য পাঠানো হল। কিন্তু এঙ্গেলসের
নিজেরই সেটা পছন্দ হচ্ছিল না। না নাম, না কথ্য। তাই আবার লেখা শুরু করলেন। এবার নাম
দিলেন ‘সাম্যবাদের তত্ত্ব’ (প্রিন্সিপ্লস অফ কমিউনিজম)। লিখতে লিখতেই
ভাবতে শুরু করলেন যে তত্ত্ব নয়, ঘোষণাপত্র হিসেবে রূপ দেওয়া যাক লেখাটাকে।
১৮৪৭এর ২৩-২৪ নভেম্বর এঙ্গেলস একটা চিঠির ‘পুনশ্চ’এ মার্ক্সকে লিখলেন, “ঐ আস্থার স্বীকারোক্তিটা নিয়ে একটু ভাব। আমি ভাবছি প্রশ্নোত্তরী
রূপটা বাতিল করে লেখাটাকে কম্যুনিস্ট ‘ঘোষণাপত্র’ বলা উচিৎ।” [সে ক্ষেত্রে] “যেহেতু কিছুটা ইতিহাস বলতে হবে, বর্তমান রূপটা একেবারেই অনুপযুক্ত।
আমি যেটা লিখেছি সেটা আমি নিজের সঙ্গে নিয়ে যাব। সাদাসিধে আখ্যানের ধরণে লেখা। কিন্তু
প্রচন্ড ব্যস্ততা ছিল বলে শব্দব্যবহার জঘন্য। সাম্যবাদ কী – জিজ্ঞেস করে শুরু করেছি। তারপর সোজা চলে গেছি
সর্বহারায় – তার উৎপত্তির কথায়।
কিভাবে সর্বহারা আগের শ্রমিকদের থেকে ভিন্ন, সর্বহারা ও পূঁজিবাদীদের মধ্যে বৈপরীত্যের
বিকাশ, সংকট, নিষ্পত্তিসমূহ। এসবেরই মাঝে সব রকমের আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো এবং সবশেষে কম্যুনিস্টদের
পার্টিনীতি। যদ্দূর সর্বসাধারণে প্রকাশ করা যায়। এখানে যেটা আছে সেটা পুরোটা এখনও অনুমোদনের
জন্য পাঠানো হয় নি, কিন্তু কয়েকটি সামান্য বিষয়বিন্দু ছাড়া, আমার মনে হয় পুরোটাই এমন
রূপে অনুমোদন করিয়ে নিতে পারব যে অন্ততঃ তাতে আমাদের দৃষ্টিকোণের বিরুদ্ধে কিছু থাকবে
না।”
‘ঘোষণাপত্র’ কথাটা দুজনের চর্চায় নিয়ে এলেন এঙ্গেলস।
‘কম্যুনিস্ট
পার্টির ঘোষণাপত্র’
১৮৩০ সালের সতের বছর পর ইয়োরোপে আবার রাজনৈতিক
অশান্তি ঘনিয়ে আসছিল। ১৮৪৭এর জুনের পর ছয় মাসের মধ্যেই ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর দ্বিতীয় সম্মেলন (২৯শে নভেম্বর থেকে ৮ই
ডিসেম্বর) হল যাতে নিয়মাবলিতে আরো কিছু বদল ঘটল। কার্ল শ্যাপার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন
এবং এঙ্গেলস সচিব। নিজের ভাষণে এঙ্গেলস ‘সব দেশের শ্রমজীবীরা, এক হও’ স্লোগানটার পটভূমির ব্যাখ্যা করলেন। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি,
আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের অবস্থা যে ভিন্ন নয় তা বুঝিয়ে বললেন, “যেহেতু সব দেশের শ্রমিকদের অবস্থা এক, তাদের
স্বার্থ এক, তাদের শত্রু এক, তাই অবশ্যই তাদেরকে এক সঙ্গে লড়াই করতে হবে। সব জাতির
পূঁজিপতিদের সৌভ্রাতৃত্বের বিরুদ্ধে সব জাতির শ্রমিকদের সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।”
কর্মসূচিকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া সম্মেলনের একটি
প্রধান এজেন্ডা ছিল। সম্মেলন সে কাজের দায়িত্ব মার্ক্সকেই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। মার্ক্স
এই সম্মেলনে ছিলেনও এবং দীর্ঘ বাদানুবাদে তিনি এবং এঙ্গেলস তাঁদের নতুন তত্ত্বগুলো
সর্বসমক্ষে পেশ করার সুযোগও পেয়েছিলেন। সম্মেলন এ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিল যে কর্মসূচির
এই দলিলটাকে ঘোষণাপত্র নাম দেওয়া হবে। পূর্বোক্ত ‘কম্যুনিস্ট লীগের ইতিহাস’এর ওপর প্রবন্ধতে এঙ্গেলস স্মরণ করেছেন, “সব দ্বন্দ্ব এবং সংশয় শেষ হল। প্রাথমিক নতুন
নীতিগুলো সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হল। মার্ক্সকে এবং আমাকে ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করার
দায়িত্ব দেওয়া হল। সম্মেলনের পর অবিলম্বে করা হল সে কাজ। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কয়েক
সপ্তাহ আগে স্বীকৃত পাণ্ডুলিপি মুদ্রণের জন্য লন্ডনে পাঠানো হল। তারপর সে ঘোষণাপত্র
পুরো বিশ্ব ভ্রমণ করেছে। প্রায় সব ভাষায় অনুবাদ হয়ে গেছে। আজও অসংখ্য দেশে এই ঘোষণাপত্র
সর্বহারা আন্দোলনের পথপ্রদর্শকের কাজ করে।”
মার্ক্স-এঙ্গেলস রচিত ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’ বা ‘ইস্তাহার’এর একটি টীকাসম্বলিত সংস্করণ আছে। টীকাকার ডি রায়াজানফ। তিনি ১৯২২এ
মস্কোয় অবস্থিত মার্ক্স এঙ্গেলস ইন্সটিট্যুটএর নির্দেশক ছিলেন। তিনি বলেন – যেমন অভ্যাস ছিল মার্ক্সের, কোনো বিষয়ে লিখতে
হলে তিনি সতর্ক থাকতেন যে বিষয়টির প্রতি সুবিচার করতে পারছেন কিনা। তাই অনেক সময় নিচ্ছিলেন
ঘোষণাপত্র লিখতে। প্রকাশনে দেরি হয়ে যাচ্ছিল …। ওদিকে “বিপ্লবী ঝড়ের সুদূর গর্জন শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। জানুয়ারির শুরুতে
তাড়াতাড়ি একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছিল ইটালিতে। ১২ই জানুয়ারিতে সিসিলি আর তারপর পালের্মোয়
খোলাখুলি বিদ্রোহ শুরু হয়ে গিয়েছিল, অস্থায়ী সরকার বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে কোনো দিন
ফ্রান্সে বিপ্লব শুরু হতে পারত।” এই পরিস্থিতিতে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর কেন্দ্রীয় কমিটি প্রস্তাব নিয়ে ব্রাসেলসের আঞ্চলিক কমিটিকে ১৮৪৮
সালের ২৬শে জানুয়ারি চিঠি পাঠালো, “কেন্দ্রীয় কমিটি ব্রাসেলসের আঞ্চলিক কমিটিকে এই কাজের ভার দিচ্ছে
যে নাগরিক মার্ক্সের সঙ্গে তারা সম্পর্ক স্থাপন করুক। তাঁকে বলুক যে সদ্য সম্পন্ন কংগ্রেসে
তাঁকে কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র লেখার যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা যদি এবছর ১লা
ফেব্রুয়ারির মধ্যে লন্ডন না পৌঁছোয়, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।” … কেন্দ্রীয় কমিটির আদেশপ্রাপ্ত এবং কমিটির তরফ থেকে শ্যাপার, বাউয়ার
এবং মল (স্বাক্ষরকারী)। রায়াজানফ এটাও জানান যে ঘোষণাপত্র প্রকাশ পাওয়ার কয়েকদিন আগেই
প্যারিসে ফেব্রুয়ারির বিদ্রোহ হয়ে গেল। জার্মানিতে মার্চ বিপ্লবের কয়েক সপ্তাহ পর ঘোষণাপত্রের
কপি সেখানে পৌঁছোতে পারল! …”
এঙ্গেলস কোথায় ছিলেন সেসময়?
বা বলা যায়, কোথায়ই বা ছিলেন না?
একজন দক্ষ সংগঠনকর্তা হিসেবে এঙ্গেলস ইয়োরোপের
বিভিন্ন দেশে এবং সমাজের বিভিন্ন অংশে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। অনেকগুলো ভাষাও জানতেন।
লন্ডনে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর কংগ্রেস শুরু হওয়ার দিনেই তাঁকে পোল্যান্ডেরও
১৮৩০এর বিদ্রোহের বার্ষিকীতে ভাষণ দিতে যেতে হল। সেটা গণতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক বৈঠক
ছিল। পোল্যান্ডের জনগণের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সমর্থনে তিনি যে কথাগুলো বললেন সেটা
অদেখা ভবিষ্যতে অনেক দূর অব্দি প্রতিধ্বনিত হল, “এমনটা হতে পারে না যে একটি জাতি স্বাধীনও হয়ে যাবে আবার অন্য
জাতির ওপর নিপীড়নও চালিয়ে যাবে।”
৮ই ডিসেম্বর, লীগের কংগ্রেস শেষ হওয়ার পর মার্ক্স
ব্রাসেলস চলে গিয়েছিলেন। এঙ্গেলস কয়েকদিন পর, ১৭ই ডিসেম্বর ব্রাসেলস পৌঁছে ঘোষণাপত্র
তৈরি করার কাজে সাহায্য করতে লাগলেন। কিন্তু মাসের শেষে তাঁকে আবার প্যারিসে ফিরে যেতে
হল। ব্রাসেলসের গণতান্ত্রিক সঙ্ঘ তাঁকে ফরাসী গণতন্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্কে থাকার জন্য
নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল। কিছুদিন আগে তিনি এভাবে, গণতন্ত্রী ভ্রাতৃসঙ্ঘে
লন্ডন কমিটিরও প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন। (এই গণতন্ত্রী সঙ্ঘগুলোর নিজের ইতিহাস
আছে; মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এই সঙ্ঘগুলোর সমর্থক ছিলেন এবং জার্মানিতে আগের অনেক সংগঠনকে
যোগ করে জার্মান গণতন্ত্রী সঙ্ঘ তৈরি হওয়ার পিছনে তাঁদের প্রধান ভূমিকা ছিল)।
প্যারিসে গিয়ে এঙ্গেলস দেখলেন যে ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’এর ‘কম্যুনিস্ট লীগ’ হয়ে যাওয়ায় এবং মার্ক্স-এঙ্গেলসের মতাদর্শের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায়
যারা মনঃক্ষুন্ন হয়েছিল, তারা আবার ফিরে যেতে চাইছে ওয়েটলিংপন্থী চক্রান্তমূলক গোপন
সাংগঠনিক কাজকর্মের দিকে অথবা প্রুধোঁপন্থী সংস্কারের দিকে। এবং নানা রকম বিভ্রান্তিমূলক
প্রচার করে তারা বাকি সবাইয়ের ওপরও নিজেদের প্রভাব ছড়িয়েছে। এঙ্গেলস সাংগঠনিক সংগ্রামে
নেমে পড়লেন। ততদিনে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর দ্বিতীয় কংগ্রেসের দলিলও সব চলে এসেছিল।
এঙ্গেলসের কাজ একটু সহজ হয়ে গেল।
কিন্তু বেশি দিন তিনি প্যারিসে থাকতে পারলেন
না। জানুয়ারির শেষে ফরাসি সরকার তাঁকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্যারিস এবং তিন দিনের মধ্যে
ফ্রান্স ছাড়ার আদেশ দিল। অজুহাত দেওয়া হল যে তিনি জার্মান উদ্বাস্তুদের বৈঠকে বিপ্লবী
শুভকামনা জানিয়েছেন।
৩১শে জানুয়ারি ১৮৪৮এ এঙ্গেলস ব্রাসেলস চলে
এলেন। তত দিনে মার্ক্স ‘ঘোষণাপত্র’ লিখে লন্ডনে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
বিশ্বের সব ভাষায় সর্বাধিক বিক্রি হওয়া জনপ্রিয়
বইয়ের অন্যতম, যুগান্তকারী সৃষ্টি ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’এর ভাষা, বিন্যাস এবং অসাধারণ দ্বন্দ্বাত্মক ব্যঞ্জনাগুলো নিঃসন্দেহে
মার্ক্সের। কিন্তু আগের অধ্যায়েই দেখেছি, ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর দ্বিতীয় কংগ্রেস যে এই দলিলটি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিল, তার পিছনে
প্রধান শক্তি ছিলেন এঙ্গেলস, এবং দলিলটির কথ্যের একটা বড় অংশ এঙ্গেলস ‘প্রিন্সিপলস অফ কমিউনিজম’এ একত্র করেছিলেন।
১৮৪৮-৪৯এর বিপ্লবগুলো – ১
স্বর্ণাভ দিনগুলো এসে পড়েছিল। বিপ্লবে সক্রিয়
অংশগ্রহণ, তা-ও সমঝদারি স্পষ্ট করে। ইয়োরোপের বিপ্লবী সর্বহারার দিকনির্দেশকারী একটি
ঘোষণাপত্র হাতে নিয়ে!
লেনিন বলেন, “মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু
হয়ে উঠে আসে ১৮৪৮-৪৯এর গণবিপ্লবী সংগ্রামে তাঁদের অংশীদারির সময়কাল।”
১৮৪৮এর ২২-২৪ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে বিদ্রোহী
শ্রমিক এবং মধ্যবিত্ত সামাজিক গোষ্ঠিগুলো একজোট হয়ে রাজা লুই ফিলিপের রাজত্ব শেষ করে
প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করল। তার আগে জানুয়ারি মাসে সিসিলি দ্বীপ সুদ্ধু দক্ষিণ
ইতালির প্রদেশগুলোয় (ইতালি সে সময় অব্দি এক রাষ্ট্রে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে নি) বিদ্রোহ
সম্পন্ন হয়েছিল। বিপ্লবী আন্দোলনের জোয়ার জার্মান প্রদেশগুলোতেও পৌঁছোতে শুরু করল।
১৩ মার্চ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় এবং ১৮ই মার্চ প্রুশিয়ার রাজধানী বার্লিনে বিদ্রোহ
হল। সেই একই সময় অস্ট্রিয়া-সাম্রাজ্যের অধীন উত্তর-ইতালির শহর মিলানে অস্ট্রিয়ার সৈন্যবাহিনীকে
তাড়িয়ে দিল জনগণ। ফ্রান্সের ঘটনাবলীর প্রভাবে বেলজিয়ামেও প্রজাতান্ত্রিক সরকারের দাবিতে
আন্দোলনে গতি এল।
এঙ্গেলস সেসময় ব্রাসেলসেই ছিলেন। ২৫শে ফেব্রুয়ারি
(১৮৪৮) তিনি চার্টিস্টদের পত্রিকা ‘দ্য নর্দার্ন স্টার’এ লিখলেন, “সেদিন সন্ধ্যায় এ শহরে উত্তেজনা এবং অশান্তির পরিবেশ ছড়িয়ে ছিল।
নানান ধরণের গুজব ছড়াচ্ছিল কিন্তু বাস্তবে সেগুলো মানছিল না কেউ। রেলস্টেশনে ভরে ছিল
সব শ্রেণীর মানুষ। সবাই চিন্তায় ছিল, কোনো খবর আসছে কিনা। ফরাসি রাজদূত, রুমিনির প্রাক্তন
মার্কুইসও সেখানেই ছিলেন। রাত সাড়ে বারোটায়, বৃহস্পতিবারে সম্পন্ন বিপ্লবের জবর খবর
নিয়ে এল ট্রেন! স্টেশনের সমস্ত মানুষ উৎসাহের আকস্মিক বিস্ফোরণে ফেটে পড়ল, প্রজাতন্ত্র
জিন্দাবাদ! দ্রুত পুরো শহরে ছড়িয়ে গেল সে খবর।”
২৭শে ফেব্রুয়ারি ‘ড্যয়েশ-ব্রাসেলার-জাইটুং’এ ফ্রান্সের ঘটনা নিয়ে এঙ্গেলস লিখলেন, “পূঁজিবাদী শ্রেণীরা নিজেদের বিপ্লব সম্পন্ন
করল। গুইজোকে সিংহাসন থেকে ফেলে দিল, গুইজোর সঙ্গে বড়, পাইকারি ফাটকাবাজ ব্যাপারিদের
একচ্ছত্র রাজত্বও শেষ হয়ে গেল। কিন্তু এবার, যুদ্ধের দ্বিতীয় অঙ্কে, পূঁজিবাদীদের এক
পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে যাবে না। এবার সর্বহারা দাঁড়াবে পূঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে … এই চমকপ্রদ বিপ্লবের মাধ্যমে ফরাসী সর্বহারা
আবার থেকে ইয়োরোপীয় আন্দোলনের শীর্ষে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। প্যারিসের শ্রমিকদের
জয় হোক! পুরো দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছে তারা। একের পর এক সবকয়টি দেশে এর চাপ টের পাওয়া
যাবে, কেননা ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্রের জয় পুরো ইয়োরোপে গণতন্ত্রের জয়।”
বেলজিয়ামের বিপ্লবী কার্যকলাপে মার্ক্স এবং
এঙ্গেলস পুরোপুরি থাকতেন। সেখান থেকেই তাঁরা জার্মানির বিপ্লবী কার্যকলাপে নিজেদের
প্রভাব বিস্তার করছিলেন। ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এও তাঁদের প্রভাব বাড়ছিল। লন্ডনের কেন্দ্রীয়
কমিটি ব্রাসেলসের আঞ্চলিক কমিটিকে নিজেদের ক্ষমতা হস্তান্তর করল যাতে বিপ্লবী কার্যকলাপের
কেন্দ্রে থাকা সাথীরা সারা ইয়োরোপের কার্যকলাপকে সঞ্চালিত করতে পারে। ব্রাসেলসের এই
নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান হলেন মার্ক্স, এঙ্গেলস সে কমিটির সদস্যদের একজন ছিলেন।
১৮৪৮এর ইয়োরোপীয় বিপ্লবে এগিয়ে থেকে অংশগ্রহণ
করা পূঁজিবাদীদের দুর্বলতা ধরা পড়তে শুরু করল। এই বিপ্লবের অসফলতা, প্রতিবিপ্লবী শক্তিসমূহের
জয় ইত্যাদি ইতিহাসের বহুপঠিত অধ্যায়। কিন্তু বিপ্লবের দিনগুলোয়, অংশগ্রহণকারী অগ্রবর্তী
মানুষদের কার্যকলাপ খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় অসফল বিপ্লবের নামে ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত
এই কালখণ্ড কত সাফল্যের বীজ বপন করেছিল।
বেলজিয়ামে বেলজীয় রাজঘরাণার সরকার অবিলম্বে
জবাবী পদক্ষেপ নিল। পূঁজিবাদী গণতন্ত্রীদের দ্বিধা দেখে সেনাবাহিনীকে সতর্ক করে, খবর
ছড়িয়ে দিল যে প্রজাতন্ত্রের দাবি আসলে বিদেশী, প্রধানতঃ জার্মান শ্রমিক এবং গণতন্ত্রীরা
করছে। এই খবরের মাধ্যমে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর অধিকাংশ সদস্য চিহ্নিত হয়ে আক্রমণের লক্ষ্যে
এসে গেলেন। অনেকে গ্রেপ্তার হলেন, অনেকজনকে নিষ্কাশিত করা হল। ৩রা মার্চ মার্ক্সকে
চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বেলজিয়াম ছাড়ার আদেশ দেওয়া হল। এঙ্গেলস বেঁচে গেলেন কেননা, কয়েকদিন
আগেই পুলিস তাঁর পাসপোর্ট জারি করেছিল।
সেদিনই মার্ক্সের ঘরে বৈঠক হল আর মার্ক্সকে,
প্যারিসে গিয়ে নতুন কমিটি তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হল। বৈঠক শেষ হওয়ার পর যে মুহূর্তে
সবাই বেরিয়ে গেল পুলিস এসে মার্ক্স এবং তাঁর স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করল। ১৮ ঘন্টা নজরবন্দী
রাখার পর তাঁদের অবিলম্বে বেলজিয়াম ছেড়ে যেতে বলা হল। ৫ই মার্চ মার্ক্স প্যারিসে পৌঁছোলেন।
তারপর তাঁর পরিবারও পৌঁছোল।
কাজের দিক থেকে এঙ্গেলস এখন ‘লীগ’এর ব্রাসেলস আঞ্চলিক কমিটির প্রধান ছিলেন। তিনি মার্ক্সকে নিষ্কাশিত
করার পুলিসি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান শুরু করলেন। স্থানীয় গণতন্ত্রপন্থীদের
রাজি করলেন, তারা যেন সংবাদ-মাধ্যমে এবং সংসদে পুলিসি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা রাখে।
তার এমন পরিণাম হল যে বেলজীয় সরকার সেই পুলিস আধিকারিককে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হল যে
মার্ক্সের ঘরে তল্লাশি চালিয়েছিল (এবং গ্রেপ্তার করিয়েছিল)।
মার্চের শেষে এঙ্গেলসও প্যারিসে চলে এলেন।
‘লীগ’এর প্যারিসে তৈরি হওয়া নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতেও
এঙ্গেলস সদস্য ছিলেন। প্যারিসে পৌঁছে, নতুন অস্থায়ী সরকারে শামিল নিজের পরিচিত লোকজনের
সঙ্গে কথা বলে, খবরের কাগজ পড়ে আর কিছুটা নিজের দৃষ্টি দিয়ে এঙ্গেলস ফ্রান্সের রাজনৈতিক
পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করছিলেন। ১৮৪৮এর ২৬শে মার্চ লন্ডনে নিজের ভগ্নীপতি এমিল ব্লাঙ্ককে
লিখলেন, “বড় পূঁজিবাদী এবং
শ্রমিক একে অন্যের বিরুদ্ধে সোজা মোকাবিলায় দাঁড়িয়ে। পাতি-পূঁজিবাদী মধ্যবর্তীর ভূমিকায়
আছে কিন্তু সব মিলিয়ে তাদের ভূমিকা ঘৃণ্য। যদিও অস্থায়ী সরকারে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদেরই।
… সবকিছু যত শান্ত
হতে থাকবে, পাতি-পূঁজিবাদী আরো বেশি করে বড় পূঁজিপতিদের দিকে নুইতে থাকবে, অশান্তি
যত বেশি হবে, তারা তত বেশি শ্রমিকদের দিকে নুইতে থাকবে।
“সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক
হল, সরকার এক দিকে শ্রমিকদের প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু তার একটাও পুরো করতে পারে না।
কেননা পূঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ – যেমন, কঠোর, ওপর দিকে বাড়তে থাকা করের ব্যবস্থা, উত্তরাধিকার
শুল্ক, প্রবাসীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, মুদ্রা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা, সরকারি
ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি – নিয়ে তারা প্রয়োজনীয় তহবিল তৈরি করার সাহস করতে পারে না …”
প্যারিস আসার পর এঙ্গেলস মার্ক্সের সঙ্গে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এ কাজ করতে লাগলেন। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে অদ্ভুত
পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হল। দেখা গেল ‘লীগ’এর ভিতরে কয়েকজন,
সে সময়কার ফরাসি সরকারে থাকা পাতি-পূঁজিবাদীদের একটি পরিকল্পনার সমর্থক। এঙ্গেলসের
উপরোক্ত চিঠিতে যেমনটা আছে, পাতি-পূঁজিবাদীদের হাত থেকে ক্ষমতা বেরিয়ে যাচ্ছিল বড় পূঁজিবাদীদের
হাতে। তাই ওরা একটা নিকৃষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করল। তত্ত্বগত ভাবে কথাটা ঠিক ছিল যে জার্মানিতে
বিপ্লবী শক্তি আগুয়ান হলে ফ্রান্সে বিপ্লব বাঁচানো সহজ হবে। কিন্তু তার পন্থাটা ওরা
গ্রহণ করল ভুল। ওরা অস্ত্র জড়ো করা শুরু করল। পরিকল্পনা করা হল যে প্যারিসে থাকা জার্মান
বিপ্লবীরা সেই অস্ত্র নিয়ে জার্মানিতে ঢুকবে। কানে কানে খবরটা পেয়ে বড় পূঁজিবাদী এবং
অন্যান্য প্রতিবিপ্লবীরাও এই পরিকল্পনার সমর্থন করে সাহায্য করতে লাগল। তাদের মনে হল,
পরিকল্পনা সফল হলে জার্মান বিপ্লবী শ্রমিক এবং অন্য প্রবাসীরা প্যারিস ছেড়ে চলে যাবে।
ফলে প্যারিসের বিপ্লবী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে। আবার, যারা সীমানা পেরিয়ে জার্মানিতে
ঢুকবে, তারাও হয় মারা পড়বে অথবা গ্রেপ্তার হবে কেননা প্রুশীয় পুলিস সেখানে বসে আছে।
এমনকি গ্রেপ্তার হওয়া লোকগুলোর কাছ থেকে পুলিস সেই সব বিপ্লবীদেরও নাম-ঠিকানা জানতে
পারবে যারা তখনও জার্মানিতে আছে। অর্থাৎ, দুই দেশেরই প্রতিবিপ্লবীরা এই অতিবিপ্লবী
পরিকল্পনায় নিজেদের সাফল্য দেখতে পাচ্ছিল।
মার্ক্স-এঙ্গেলস তীব্র সুরে এই বিপজ্জনক পরিকল্পনার
বিরোধ করলেন। ‘লীগ‘এর বিভিন্ন বৈঠকে অনবরত সাংগঠনিক সংগ্রাম চালিয়ে
গেলেন। তা সত্ত্বেও এই পরিকল্পনা অনুসারে কয়েকজনকে কাজ করতে দেখে তাঁদের মনে হল, জার্মান
কম্যুনিস্ট আন্দোলনকে এই পুরো ব্যাপারটার ছোঁয়াচ থেকে বাঁচাতে হবে। প্রজাতন্ত্রী এবং
গণতন্ত্রীরা যেন দেখতে পায় যে জার্মান কম্যুনিস্ট পার্টি চক্রান্ত করে রাষ্ট্রশক্তি
দখলের চেষ্টা চালানোর পার্টি নয়, জার্মান শ্রমিক শ্রেণীর গণপার্টি, যেটি চায় যে জার্মানিতে
প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হোক এবং সেই রাজনৈতিক সংগ্রামে সে, সর্বহারার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক
দৃষ্টি নিয়ে, নিজের দাবিগুলো হাসিল করতে শামিল হয়।
এই উদ্দেশ্যে ১৮৪৮এর ২১-২৪ মার্চ, ‘জার্মানির কম্যুনিস্ট পার্টির দাবি’ নামে একটা দলিলের জন্ম হল। সে দলিল পাশ করলো
‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর কেন্দ্রীয় কমিটি। সে সময় তো দলিলটা প্রকাশিত
হলই, পরেও বেশ কয়েকবার সেটাকে পুনঃপ্রকাশ করতে হল। কেননা প্রজাতান্ত্রিক আন্দোলনে সর্বহারার
পক্ষ তুলে ধরার পথপ্রদর্শক হয়ে উঠল সেই দলিল। দাবিগুলো ছিলঃ
(১) পুরো জার্মানি হবে এক এবং অখণ্ড প্রজাতন্ত্র;
(২) সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার; (৩) গণপ্রতিনিধিদের অর্থপ্রদান যাতে শ্রমিকও
সংসদের সদস্য হতে পারে; (৪) জনতার সশস্ত্রীকরণ এবং একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর শ্রমসেনাবাহিনীতে
রূপান্তরণ; (৫) বিনামূল্যে আইনি পরিষেবা; (৬) সবরকম সামন্ততান্ত্রিক ভার, ঋণ, বেগারি,
দশাংশ ইত্যাদি যাকিছু আজ অব্দি গ্রামীণ জনগণের ওপর বোঝা হয়ে ছিল, তার ক্ষতিপূরণহীন
সমাপ্তি; (৭) যত রাজত্ব এবং সামন্তাধীন জমি, খনি, খাদ সব সম্পত্তি রাষ্ট্রের সম্পত্তি
হোক, পুরো সমাজের স্বার্থে সেইসব ভূসম্পত্তিতে বড়ো ভাবে হোক আধুনিক চাষ; (৮) কৃষকদের
বন্ধকে থাকা জমি রাষ্ট্রের সম্পত্তি হোক, সেই বন্ধকের ওপর সূদ কৃষক সরকারকে দেবে; (৯)
যেখানে ভাগচাষের ব্যবস্থা আছে জমি-ভাড়া/খাজনা অথবা মুক্তি-খাজনা কর রূপে সরকারকে দেয়
হোক; (১০) বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বদলে একটি সরকারি ব্যাংক হোক এবং সে ব্যাংক কর্তৃক
জারি কাগজ [নোট] বৈধ-মুদ্রা হোক; [সেসময় কাগজের মুদ্রা ছিল না] (১১) পরিবহণের সমস্ত
মাধ্যম, রেলপথ, খাল, বাষ্পের জাহাজ, রাস্তা, ডাক ইত্যাদি সরকার কর্তৃক অধিগৃহীত হোক
এবং দরিদ্রের জন্য নিঃশুল্ক হোক; (১২) সব সরকারি কর্মচারির মাইনে এক হোক, বেশি সে পাক
যাকে পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদন করতে হয়; (১৩) গির্জা এবং রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ;
(১৪) উত্তরাধিকারের অধিকার কম করা হোক; (১৫) ওপরের দিকে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া করের ভার,
ভোগ্যপণ্যের ওপর করের সমাপ্তি; (১৬) জাতীয় কর্মশালাসমূহের উদ্বোধন, সব শ্রমিকের জন্য
রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত রুজিরুটির গ্যারান্টি এবং যে কাজ করতে অক্ষম হবে তার জন্য ব্যবস্থা;
(১৭) জনগণের জন্য সর্বজনীন এবং নিঃশুল্ক শিক্ষা।
দাবির সঙ্গে তার ব্যাখ্যাও ছিল। শেষে লেখা
ছিল, “পুরো সম্ভবপর শক্তি
নিয়োজিত করে এই দাবিগুলোর সমর্থন করলে জার্মান সর্বহারা, পাতি-পূঁজিবাদী এবং ছোটো কৃষকের
স্বার্থরক্ষা হবে।”
১৮৪৮-৪৯এর বিপ্লবগুলো – ২
এপ্রিল ১৮৪৮এর শুরুতে যখন ‘জার্মানির কম্যুনিস্ট পার্টির দাবি’ প্রতিদিন কোনো না কোনো গণতন্ত্রী খবরের কাগজে
বেরুচ্ছে, হ্যান্ডবিল হয়ে হাতে হাতে ঘুরছে এবং শ্রমিকদের বৈঠকে সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে,
মার্ক্স-এঙ্গেলস জার্মানিতে ফিরে এলেন। তাঁদের ফিরে আসার আগেই তৎকালীন জার্মানির কয়েকটি
প্রদেশে জনগণের আক্রোশ ব্যক্ত হয়েছে। কয়েকটি প্রদেশের শাসক সংস্কারের দাবি স্বীকার
করে নিয়েছে। খোদ বার্লিনের রাস্তায় জনতা প্রুশিয়ার রাজার সামনে নিজেদের ক্ষোভ জানিয়েছে
এবং রাজা মৌখিক কিছু আশ্বাস দিয়েছে। অধিকাংশ প্রদেশে উদারপন্থী পূঁজীবাদীরা শাসনক্ষমতায়
এসে গেছে কিন্তু ফ্রান্সের উদাহরণ দেখে আর জার্মান শ্রমিকশ্রেণীরও বিপ্লবী মনোভাবের
সম্ভাবনায় আতঙ্কিত হয়ে তারা সামন্ততান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে আপোষে আসতে চাইছে। অন্য দিকে
পাতি-পূঁজিবাদী শ্রেণী নিজেদের আদর্শবাদী চিন্তার বাইরে আসতে পারছে না, শ্রমিকদেরকে
তাদের দাবিগুলো হাসিল করার বাস্তব পথ দেখাতে পারছে না।
জার্মানিতে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর সংগঠনও দুর্বল। জার্মান সর্বহারা, শ্রেণী-রূপ
গ্রহণ করার প্রাথমিক পর্যায়ে। মার্ক্স-এঙ্গেলস এসে এটাও দেখলেন যে গণতন্ত্রী শিবিরের
প্রতি জনতার বিশ্বাস এখনও অটুট। তাঁরা অনুভব করলেন, দুটো দলকে একসঙ্গে সম্বোধন করতে
হবে। প্রথম, গণতন্ত্রী শিবিরের ভিতরে দ্বিধাগ্রস্ত ও ভাববাদী পূঁজিবাদী ভিন্ন বিদ্যমান
বিপ্লবী অংশ, এবং ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর ভিতরে গুপ্ত-চক্রান্তপন্থী ও সংস্কারপন্থী
ভিন্ন সর্বহারা গণ-পার্টির সমর্থক অংশ। সেটা করতে গেলে দুটো সংগঠনেই সাংগঠনিক বাদানুবাদ
চালাতে হবে।
কোলোন শহরে পৌঁছে তাঁরা প্রথম কাজ স্থির করলেন।
‘রাইনিশে জাইটুং’এর মতই একটা খবরের কাগজ, ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’ বার করবেন তাঁরা। তার জন্য অর্থসাহায্য এবং
গ্রাহক-চাঁদা সংগ্রহ করা শুরু করে দিলেন। দ্বিতীয় কাজে, কোলোনের গণতন্ত্রী সমিতি (ডেমোক্রেটিক
সোসাইটি)র সঙ্গে কথাবার্তায় এগিয়ে সেই সমিতির সদস্যতা গ্রহণ করলেন। ‘লীগ’এর ভিতরকার পুরোনো অসুখগুলোর (চক্রান্তমূলক গোপনীয়তা এবং বিপরীতে,
সংস্কারপন্থা) অবস্থা দেখে স্থির করলেন আপাততঃ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে।
প্রতিদিন কিছু নতুন ঘটনা হয়ে চলেছিল। ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর জন্য অর্থসাহায্য আর চাঁদা সংগ্রহ করতে
এঙ্গেলস বার্মেন চলে গেলেন। এলবারফেল্ড এবং আশেপাশের অঞ্চলেও গেলেন। সামান্য কিছু তো
আসছিলই হাতে কিন্তু ব্রেমেন-এলবারফেল্ডের পুরোনো পূঁজিবাদী যারা কাল অব্দি উৎসাহী যুবক
এবং এঙ্গেলসের বন্ধু ছিল, এখন নিজেরাই কারখানাদার হয়ে, পত্রিকাটির সম্ভাবিত মনোভাব
বুঝে এক পয়সাও দিল না। এঙ্গেলস নিজের বাবার কাছে গিয়েও হাত পাতলেন। তিনিও দিলেন না।
কিন্তু, দেরি করা যায় না। প্রথম সংখ্যা জুলাইয়ে
প্রকাশিত হওয়ার ছিল। কিন্তু দুজনে প্রথম সংখ্যা জুন মাসেই প্রকাশিত করে দিলেন – পথ চলা শুরু হয়ে গেল। বাস্তবে এই নতুন খবরের
কাগজটা চালাবার দায়িত্ব এঙ্গেলসের ওপরই বর্তালো। প্রধান সম্পাদক ছিলেন মার্ক্স। নীতি-নির্দ্ধারণের
সময় পুরো সম্পাদক-মন্ডলী – যার অন্তর্ভুক্ত
ছিলেন ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর সবচেয়ে ভালো নেতৃবৃন্দ – বৈঠকে মার্ক্সের রাজনৈতিক দিকনির্দেশের জন্য
উপস্থিত থাকতেন। সেটা বাদে অধিকাংশ সম্পাদকীয়, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ এবং গুরুত্বপূর্ণ
প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখতেন এঙ্গেলস। বেশ কয়েকটি ভাষা জানতেন বলে ইয়োরোপের সব দেশের রাজনৈতিক
ঘটনাবলীর তথ্য, জার্মান, ফরাসি, ইংরেজি, ইতালীয়, স্পেনীয়, বেলজীয় এবং ড্যানিশ খবরের
কাগজগুলো থেকে সংগ্রহ করতেন।
মার্ক্স অবাক হতেন বন্ধুর অকল্পনীয় উদ্যমে।
পরেও, এঙ্গেলসের দক্ষ সাংবাদিকতা এবং বিভিন্ন ধরণের ঘটনার প্রতি সজাগ থাকার ক্ষমতা
নিয়ে মার্ক্স বলেছিলেন, “ও বাস্তবে একটা বিশ্বকোষ।
হাসিখুশি মেজাজে থাক বা গম্ভীর হয়ে থাক, দিনে-রাতে সবসময় কাজ করে চলার ক্ষমতা রাখে,
লেখায় আর ভাবায় ওর গতি শয়তানের মত ক্ষিপ্র।”
মার্ক্স-এঙ্গেলসের যা উদ্দেশ্য ছিল তারই অনুরূপ,
খবরের কাগজটা ঘোষিত রূপে গণতন্ত্রের মুখপত্র হয়েও জার্মানির উদীয়মান সর্বহারা পার্টির
পথপ্রদর্শক হয়ে রইল। বলা যেতে পারে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের দিনগুলোয় সর্বহারার কর্মসূচি
এই খবরের কাগজই প্রকাশ করে চলল। ১৯১৪ সালে লেনিন লেখেন, “‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’ বিপ্লবী সর্বহারার শ্রেষ্ঠতম মুখপত্র ছিল।
আজ অব্দি অন্য কোনো খবরের কাগজ তাকে পিছনে ফেলতে পারে নি।”
এক বছর পুরো হতে না হতে বন্ধ হয়ে গেল ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’। বিপ্লবী শক্তিগুলো ততদিনে দুর্বল হয়ে পড়েছিল;
সরকার বন্ধ করিয়ে দিল খবরের কাগজটাকে। এই এক বছরের সময়কালে এঙ্গেলস একশোরও বেশি প্রবন্ধ
ও প্রতিবেদন লিখলেন। তাতে নথিভুক্ত হয়ে থাকল জার্মানি, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া,
ইতালি, সুইটজারল্যান্ড এবং হাঙ্গেরির রাজনৈতিক ঘটনাবলি এবং বিপ্লবী সংগ্রাম।
আগের অধ্যায়ে উদ্ধৃত ‘জার্মানির কম্যুনিস্ট পার্টির দাবি’তে একটি দাবি ছিল জাতীয় কর্মশালা প্রতিষ্ঠা
করার, যাতে সবার রুজিরুটির ব্যবস্থা হতে পারে। মূলতঃ এটি ফ্রান্সের বিপ্লবী শ্রমিকদের
দাবি ছিল। ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির বৈপ্লবিক দিনগুলোতে তারা দাবিটা নতুন সরকারের কাছ
থেকে হাসিল করেই ছেড়েছিল। কিন্তু, সবাই জানেন যে ১৮৪৮ সালের ইয়োরোপীয় বিপ্লবগুলোর জয়
হয়েছিল মাত্র কিছু দিনের জন্য। জুন মাস আসতে আসতে আমূল পরিবর্তন চাওয়া পূঁজিবাদীরা
দুর্বল ও দিশেহারা হতে শুরু করল। লড়াকু শ্রমিকেরা একলা পড়ে গেল কেননা তখন অব্দি কৃষক
তাদের বন্ধু হয়ে ওঠে নি। উদারপন্থী পূঁজিবাদীরা ছোটো ছোটো সুবিধে পাওয়ার জন্যেও, পুরোনো
সামন্তবাদী, রাজতন্ত্রবাদী এবং প্রতিক্রিয়ার যে কোনো শক্তির সঙ্গে ঘৃণ্যতম চুক্তি করতে
প্রস্তুত ছিল। ফলে, এদিকে ১লা জুন মার্ক্স-এঙ্গেলসের ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’ প্রকাশিত হল আর ওদিকে প্যারিসে শ্রমিকদের
দাবিতে তৈরি হওয়া জাতীয় কর্মশালাগুলো ২৩শে জুন বন্ধ করে দেওয়া হল। শ্রমিকেরা ঐ সিদ্ধান্তের
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল কিন্তু চার দিনের লড়াইয়ের পর হেরে গেল। রাষ্ট্রশক্তির ওপর প্রতিক্রিয়াপন্থীদের
প্রভাব মজবুত হয়ে উঠেছিল। নিহত এবং আহত হল প্রায় ১০,০০০ বিপ্লবী শ্রমিক। ৪,০০০ শ্রমিককে
পাঠিয়ে দেওয়া হল ফরাসি আকজিরিয়ায়। এই গণসংহারের মাধ্যমে প্রতিবিপ্লব ফ্রান্সে নিজের
জয় সুনিশ্চিত করল। এঙ্গেলস লিখলেন, “শ্রমিকদের সাহস ছিল বিস্মিত করার মত। কুড়ি থেকে চল্লিশ হাজার শ্রমিক
তিন দিন পর্য্যন্ত আশি হাজারেরও বেশি সৈনিক এবং এক লক্ষ ন্যাশনাল গার্ডের গুলি, হাতবোমা,
আগুনের রকেট এবং সেই ‘অভিজাত’ জেনেরালদের সামরিক অভিজ্ঞতার মোকাবিলা করল,
যে ‘অভিজাত’ জেনেরালরা নির্দ্বিধায় আলজিরিয়ায় ব্যবহৃত
পদ্ধতি ব্যবহার করছিল। বড় সংখ্যায় পাশবিক হত্যালীলা চালিয়ে শ্রমিকদের দমন করা হল। হতাহত
শ্রমিকেরা জুলাই আর ফেব্রুয়ারিতে বলি হওয়া মানুষদের মত সম্মান পাবে না। কিন্তু ইতিহাসে
বিশেষ স্থান পাবে যে সর্বহারার প্রথম নির্ণায়ক সংগ্রামে তারা মারা গিয়েছিল।”
জার্মানিতেও, প্রতিবিপ্লবের এই জয়ের প্রভাব
দেখা গেল। মে ১৮৪৮এ যখন মার্ক্স-এঙ্গেলস কোলোনের ‘গণতন্ত্রী সমিতি’র সদস্যতা নিয়েছিলেন, এবং ‘লীগ’এর সিদ্ধান্ত অনুসারে
অন্যান্য নেতারাও নিজের নিজের শহরের ‘গণতন্ত্রী সমিতি’র সদস্য হয়েছিলেন, তার আগেই ফ্রাঙ্কফুর্টে ‘জার্মান সংসদ’এর (প্রজাতন্ত্রী বিপ্লবীদের গড়া) প্রথম বৈঠক
হয়ে গিয়েছিল। বিপ্লবী সর্বহারারও প্রধান দাবি, জার্মানির একতার প্রথম গণ-অভিব্যক্তি
ছিল এই সংসদ। কিন্তু প্যারিসের খবর আসার পর খবরের কাগজ এবং পত্রপত্রিকার ওপর সরকারি
হামলা বৃদ্ধি পেল। বিভিন্ন শহরে চলতে থাকা গণতন্ত্রী সমিতিগুলো বন্ধ করে দেওয়া হল।
‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এ মেইন্জ, ট্রিয়ের, এশেন, ম্যানহেইম, উল্ম,
বার্লিন, কোলোন, ডুসেলডর্ফ, ব্রেসলাউ এবং অন্যান্য শহরে চলতে থাকা পুলিশের জুলুম এবং
ব্যাডেন, উর্টেমবার্গ, বাভারিয়া ইত্যাদি শহরে গণতন্ত্রী সমিতি বন্ধ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে
লেখা হল। প্যারিসের ঘটনাবলি, কোন পরিস্থিতিতে জাতীয় কর্মশালাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হল
সেসব এবং আরো অন্যান্য বিষয়ে খবরের কাগজে লেখার পাশাপাশি এঙ্গেলস ‘কোলোন ওয়ার্কার্স লীগ’ এবং কোলোনের গণতন্ত্রী সমিতির আলোচনা ও তর্কবিতর্কগুলোয়
অংশগ্রহণ করতে থাকলেন।
‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’ চালানো কঠিন হচ্ছিল। পুরোনো অংশধারকেরা (শেয়ারহোল্ডার)
সঙ্গ ছাড়ছিল। মার্ক্স-এঙ্গেলস বার্লিন গেলেন। তারপর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় গেলেন। সেপ্টেম্বর
আসতে আসতে সরকার খবরের কাগজটার প্রকাশনের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে দিল। কাগজটার একজন
সম্পাদক, জর্জ উইর্থ লিখলেন –
“শহরটা কন্টকাকীর্ণ
হয়ে উঠেছিল। যেভাবে নিজের কাঁটা দাঁড় করিয়ে কন্টকাকীর্ণ হয় সজারু। প্রুশিয়ার প্রধান
দেবদূতের সশস্ত্র সৈনিকদের বন্যা ঢুকে পড়েছিল বাজারে, চৌরাস্তায়। যুদ্ধবাজদের একটা
দল নিয়ে এক লেফটেন্যান্ট আমাদের দরজার বাইরে এল, নাকাড়া বাজিয়ে গর্জন করে শোনাতে লাগল
আমাদের ন্যু রাইনিশে জাইটুংএর মৃত্যুর আদেশ।”
গ্রেপ্তারি থেকে বাঁচতে এঙ্গেলস বারমেন চলে
গেলেন। সেখানেও পুলিসের কাছে খবর পৌঁছে গেল। বাড়িতে একদিকে বাবার ক্রুদ্ধ হতাশা, অন্যদিকে
মায়ের কাতর মধ্যস্থতা – বিরক্ত হয়ে আরেক
সাথীকে সঙ্গে নিয়ে ব্রাসেলস চলে গেলেন। কিন্তু সেখানেও অবস্থা পাল্টে গিয়েছিল। বেলজীয়
পুলিস হোটেলে পৌঁছে গেল। মিথ্যে অজুহাতে যে এদের কাগজপত্রগুলো ঠিক নয়, দুজনকে গ্রেপ্তার
করে জেলে ঢুকিয়ে দিল। শহরে এঙ্গেলসের বন্ধু ছিল অনেক। তবু পুলিস তাঁদেরকে ‘ভবঘুরে’ ঘোষিত করে, সেদিনই ট্রেনে বসিয়ে ফ্রান্সের সীমায় পৌঁছে দিল।
৫ই অক্টোবর যখন এঙ্গেলস প্যারিসে পৌঁছোলেন
তখন পকেট প্রায় শূন্য। বিগত জুন মাসের বিদ্রোহ অবদমিত হওয়ার পর হতশ্রী, হতভাগ্য দেখাচ্ছিল
প্যারিস। কয়েক দিন থাকলেন। কিন্তু অসহ্য হয়ে উঠছিল। পকেটে পয়সাও ছিল না। শেষে প্যারিস
থেকে বার্ন (সুইটজারল্যান্ড) পর্য্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশো মাইল হেঁটেই পাড়ি দেবেন স্থির
করলেন। তাঁর সাথীটি প্যারিসে রয়ে গেলেন আর তিনি রওনা হয়ে গেলেন বার্নের পথে। প্যারিসে
তাঁর মনের অবস্থা পরে, জেনেভায় বসে লেখা একটি যাত্রা-বৃত্তান্তে বর্ণনা করেছেন। ‘প্যারিস থেকে বার্ন’ নামে এই অসমাপ্ত বৃত্তান্তটির ইংরেজি অনুবাদ
মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্রের সপ্তম খণ্ডে সঙ্কলিত। এক মাসের এই হাঁটাপথে তিনি ফ্রান্সের
চাষীদের খুব কাছ থেকে দেখলেন (সে অভিজ্ঞতা ঐ বৃত্তান্তে আছে) এবং শহরের শ্রমিকদের আর
গ্রামের কৃষকদের মধ্যেকার দূরত্বটা বুঝতে পারলেন।
ওদিকে কোলোনে পরিস্থিতি একটু ভালো হওয়ায় ১২ই
অক্টোবর ১৮৪৮ থেকে ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর প্রকাশনা আবার শুরু হল। সম্পাদক-মন্ডলীর
অধিকাংশ সদস্য হয় অন্যান্য জার্মান শহরে লুকিয়েছিলেন অথবা জার্মানি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
তাই, সেই সংখ্যাতেই প্রধান সম্পাদক মার্ক্স ঘোষণা করলেন যে সম্পাদক-মন্ডলীর একজন সদস্যকেও
বদলানো হবে না। মার্ক্সের মাথায় আসলে এঙ্গেলসকে নিয়ে চিন্তা ছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন
দূর সুইটজারল্যান্ডে কপর্দকশূন্য, কর্মহীন এবং বিপ্লবী সাথীদের সঙ্গহারা তাঁর বন্ধুটি
কেমন জীবন কাটাচ্ছে, তার মনের অবস্থাই বা কেমন। মাঝে এঙ্গেলসের আর্থিক কষ্ট এমন পর্যায়ে
পৌঁছেছিল যে মার্ক্সের কাছেই সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠাতে হয়েছিল। যখন নাকি তিনি জানতেন
মার্ক্সের আর্থিক অবস্থা কেমন। মার্ক্স কিছু পয়সা সংগ্রহ করে তাঁকে পাঠিয়েও ছিলেন।
কিন্তু যে ঠিকানায় পাঠানো হয়েছিল, সে ঠিকানায় পৌঁছোয় নি।
সম্পাদকেরা যখন কাজই করছে না তখন তাদের পুরো
মাইনে দেওয়া নিয়ে ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর নতুন অংশধারকদের আপত্তি ছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে
কোনো সিদ্ধান্তে আসতে বাধা দিলেন মার্ক্স। যেমন করে হোক অংশধারকদের বোঝালেন। তাঁর স্বার্থ
ছিল যে সব সাথী সম্পাদকেরা (এঙ্গেলস, প্যারিসে থেকে যাওয়া তাঁর সাথী এবং লীগের অন্যান্য
নেতা) এই পয়সাটুকু পাক।
সব দেশের সমাজবাদী শিবিরের ভিতরেই মার্ক্স-এঙ্গেলসের
বাড়তে থাকা প্রভাবে ঈর্ষান্বিত এবং নিন্দুক মানুষেরা ছিল। তারা সুযোগ পেল গুজব রটাবার
যে কারোর না থাকায় খবরের কাগজটার প্রকাশনে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় নি আর এখন তো অংশধারকেরা
কাজ ছেড়ে চলে যাওয়া সম্পাদকদের মাইনে দিতেও অস্বীকার করছে …। এঙ্গেলসের কানেও পৌঁছে থাকবে সেই গুজব। ওদিকে
মার্ক্সের পাঠানো পয়সাও তিনি পান নি। ২৬শে অক্টোবরে মার্ক্স খবরের কাগজের জন্য এঙ্গেলসকে
একটা “চিঠি এবং দীর্ঘ প্রবন্ধ” পাঠাতে লিখেছিলেন। কিন্তু দেখা যায়, নভেম্বরে
একটি চিঠির শেষে (চিঠিতে এঙ্গেলসকে পাঠানো পয়সার হিসেব, তাঁর নিজের কাছে কত পয়সা আছে
তার হিসেব, খবরের কাগজ এবং মামলা ইত্যাদি নিয়ে কিছু কথা আছে) তাঁকে লিখতে হচ্ছে, “এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে আমি তোমার কষ্টের
সময় ছেড়ে যেতে পারি এমন ভাবাটা একেবারেই খোশখেয়াল। তুমি সবসময় আমার প্রাণের বন্ধু থাকবে
আর আশা করি আমিও তেমনটাই থাকব তোমার।” এঙ্গেলসকে বিপ্লবী কার্যকলাপে ব্যস্ত রাখার জন্য মার্ক্স অনবরত
তাঁর কাছে আলাদা আলাদা বিষয়-সংকেত দিয়ে প্রবন্ধ, প্রতিবেদন ইত্যাদি চাইতে থাকতেন – কখনো প্রুধোঁকে নিয়ে, কখনো হাঙ্গেরিতে চলতে
থাকা বিপ্লবী যুদ্ধ নিয়ে, কখনো পাতি-পূঁজিবাদী আদর্শের মান নিয়ে, সুইটজারল্যান্ডের
যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র নিয়ে। সঙ্গে এটাও জুড়ে দিতেন, “বা অন্য কোনো বিষয় নিয়েও লিখতে পারো, যেমনটা
তুমি চাও।”
প্যারিস থেকে পায়ে হেঁটে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে
এঙ্গেলস জেনেভা পৌঁছেছিলেন, তারপর লুসান। লুসানের শ্রমিকদের মধ্যে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর কিছু সমর্থক পেলেন যারা তাঁর নাম আগে শুনেছিল।
তাই নির্দ্বিধায় কথাবার্তা হতে পারল। মনটা ভালো হল। মার্ক্সের পরামর্শে তিনি সেখান
থেকে বার্নের পথে রওনা দিলেন। নভেম্বরের ৯ তারিখে পৌঁছোলেন। লুসান ছেড়ে গেলেও লুসানের
শ্রমিক সঙ্ঘ তাঁকে ছাড়ল না। ডিসেম্বরে বার্নে জার্মান শ্রমিকদের সঙ্ঘগুলোর প্রথম কংগ্রেস
হওয়ার কথা ছিল। সেই কংগ্রেসে এঙ্গেলসকে তারা তাদের সঙ্ঘের প্রতিনিধি হতে বলল। শংসাপত্রে
লেখা হল, “ভাই, যেহেতু প্রতিনিধি
পাঠাতে পারব না, তাই আপনাকে অনুরোধ যে আপনি বার্নের শ্রমিক কংগ্রেসে আমাদের প্রতিনিধিত্ব
করুন। সর্বহারাদের স্বার্থে পুরোনো যোদ্ধা হওয়ার দরুন আপনি নিশ্চয়ই নিজের কর্তব্য ভালো
করে পালন করবেন। যদিও এবার আপনি পূঁজিবাদী এবং অন্যান্য বণিকদের বিরুদ্ধে লড়বেন না।
সেখানে শুধু সর্বহারারাই থাকবে যাদের সঙ্গে এবং যাদের জন্য আপনাকে লড়তে হবে।”
সেই কংগ্রেসে এঙ্গেলস বা অন্য কেউ কী বলেছিল
তার ইতিহাস তো লভ্য নয় কিন্তু এঙ্গেলস ভালো করেই নিজের কর্তব্য পালন করে থাকবেন। নতুন
সঙ্ঘের কেন্দ্রীয় কমিশনে তিনি নির্বাচিত হলেন। বার্ন থেকেই, নভেম্বরের শেষে এঙ্গেলস
সুইটজারল্যান্ডের বিষয়ে এবং সেই প্রসঙ্গে জার্মানির বিষয়ে লেখা শুরু করলেন। চিঠি এবং
প্রবন্ধ ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এ ছাপতে লাগল।
বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব
বিপ্লবী সামরিক সংগ্রামের গভীরে
সামরিক-বিজ্ঞান, যুদ্ধের নীতিগত এবং কৌশলগত
সমঝদারি ইত্যাদি সম্পর্কে এঙ্গেলসের পাণ্ডিত্য সুপ্রসিদ্ধ। বার্লিনের প্রুশীয় আর্টিলারিতে
কয়েক মাস কাটানোর ফলে ততটা নয় যতটা, বছরের পর বছর ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক
মানচিত্রে হতে থাকা পরিবর্তন, সামরিক গতিবিধি, যুদ্ধ এবং সরকারগুলোর বিরুদ্ধে জনগণের
বিপ্লবী যুদ্ধ, গেরিলা আক্রমণ, গণফৌজ-গঠন ইত্যাদি বিষয়ে গভীর অধ্যয়ন এবং লেখনের কারণবশতঃ।
১৮৪৯ সালের শুরুতে সুইটজারল্যান্ড থেকে জার্মানি ফিরে আসার পর তিনি তাঁর এই জ্ঞানকে
অনুশীলনে প্রয়োগ করার সুযোগ পেলেন।
এঙ্গেলস জার্মানি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন।
বিপ্লবী কার্যকলাপের কেন্দ্রে থাকার কথা ছিল তাঁর, কিনারায় নয়, – হলে গ্রেপ্তারই হতে হোক। মার্ক্স আরো কিছুদিন
সুইটজারল্যান্ডে থেকে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলেন কিন্তু এঙ্গেলস শুনলেন না। ১৮৪৯ সালের
জানুয়ারির মাঝামাঝি তিনি কোলোনে ফিরে এলেন। কোলোনে এবং অন্যান্য জার্মান শহরে তত দিনে
প্রতিক্রিয়া এবং প্রুশীয় রাজতন্ত্রের আধিপত্য মজবুত হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু হাঙ্গেরিতে বিপ্লবী সংগ্রাম জোয়ারে
ছিল। পোল্যান্ড এবং ইতালির রাজ্যগুলোতেও সংগ্রাম চলছিল। সেসব দিনে সাম্রাজ্যগুলোর পারস্পরিক
যুদ্ধে ইয়োরোপের দেশসমূহের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সীমান্ত বার বার বদলাতো। ঐ সব দেশে চলতে
থাকা জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম নিয়ে ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এ লেখার সময় এঙ্গেলস দুটো বিষয়কে সব সময় গুরুত্ব দিতেন। প্রথমতঃ,
সাম্রাজ্যগুলোয় ভেঙে ছড়িয়ে থাকা প্রতিটি জাতির একীকরণ। জার্মানির একীকরণের প্রশ্নে
এই প্রসঙ্গটা বার বার উঠে আসত। দ্বিতীয়তঃ, জাতীয় স্বাধীনতার গুরুত্ব – পোল্যান্ড, ইতালি, এবং অন্যান্য জায়গায় চলতে
থাকা বিপ্লবী সংগ্রামের প্রসঙ্গে সেটাকে পরিভাষিত করার দরকার পড়ত।
সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখত কোলোনের মত সৈন্যবেষ্টিত
শহরে, পূঁজিবাদী এবং প্রতিক্রিয়াপন্থী সংবাদ মাধ্যমের নিগ্রহ, প্রতিক্রিয়াপন্থী সামরিক
পদাধিকারিদের হামলা এবং উপর্যুপরি আদালতি সমন সহ্য করে, ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর মত খবরের কাগজ কিভাবে বিপ্লবের পতাকা তুলে
ধরে রাখত সমানে, নিজের পৃষ্ঠাগুলোয় মুদ্রিত সমালোচনামূলক প্রবন্ধে কাউকে বাদ দিত না।
সরকারি খবরের কাগজগুলো যখন অভিযোগ করত যে বিদেশের বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যোগসাজশ
আছে, মার্ক্স-এঙ্গেলস গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করতেন, “ফরাসি, ইংরেজ, ইতালীয়, সুইস, বেলজীয়, পোলিশ, মার্কিন এবং অন্যান্য
গণতন্ত্রীদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আমরা কখনো লুকোই নি!” এঙ্গেলস পরে স্মরণ করেছেন, “সম্পাদকীয় কামরায় সঙীন-লাগানো আটটি রাইফেল
ও ২৫০টি জ্যান্ত কার্তুজের উপস্থিতি এবং কম্পোজিটারদের মাথায় লাল জ্যাকোবিন টুপি থাকায়
আধিকারিকেরা আমাদের বাড়িটাকে দুর্গ মনে করত – এমন দুর্গ যেটা এক হামলায় কব্জা করা যাবে না।”
খবরের কাগজটার বিরুদ্ধে নালিশ তো হতেই থাকত।
১৮৪৯এর ৭ই ফেব্রুয়ারি মার্ক্স এবং এঙ্গেলসকে ব্যক্তিগত ভাবে জুরিদের (আদালতি নির্ণায়কসভা)
মুখোমুখি হতে হল। অভিযোগ ছিল, ৫ই জুলাই ১৮৪৮এর ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এ ‘গ্রেপ্তারি’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধে প্রকিউরেটর-জেনেরাল
জেইফেল এবং তার সেপাইদের অপমান করা হয়েছে। কাগজের প্রকাশক হের্মান কর্ফকেও আদালতে আনা
হল। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস আদালতটাকে পুরোপুরি ব্যবহার করলেন। প্রবন্ধটিতে জেইফেলের বিরুদ্ধে
করা অভিযোগ তো প্রমাণ করলেনই, বক্তব্যকে রাজনৈতিক রূপও দিলেন। এঙ্গেলস বললেন, ঠিক যেমন
‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এ লেখা হয়েছে, আধ-করা বিপ্লবের পরিণাম জনগণকে
ভুগতে হচ্ছে। বড় রকমের গণতান্ত্রিক জয় হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রশক্তি, অভিজাত শ্রেণীর
সঙ্গে সহযোগিতা করা বড় পূঁজির হাতে চলে গেছে। এই কারণেই বিপ্লবী ঢেউএর প্লাবন সত্ত্বেও
হঠাৎ সবক’টি জার্মান রাজ্যে
প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলো হামলা করার সুযোগ পেয়ে গেছে। জুরির আদালত দুজনকেই সসম্মানে
খালাস দিল। লাভ হল এই যে আদালতটা তাদের প্রচারের মঞ্চে পরিবর্তিত হল।
ওদিকে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর ভিতরে একটা দল আবার ‘লীগ’টাকে পুরোনো, ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’এর গোপনে কাজ করার ধরণধারণের দিকে টানছিল।
যখন নাকি ওদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ‘শ্রেণীবিহীন’ অর্থাৎ বিশেষ করে পাতি-পূঁজিবাদী।
মার্ক্স-এঙ্গেলস ঐ প্রবৃত্তির বিরোধ তো করছিলেনই,
কিন্তু ঐক্যমত হতে পারছিল না। তাঁরা বার বার ‘লীগ’এর নেতৃত্বকে শ্রমিক
সংগঠনগুলোর দিকে নজর দিতে বলছিলেন। নিজেরাও সে কাজেই এগিয়ে গেলেন। তাঁদের মনে হল এবার
প্রতিটি রাজ্যে শ্রমিক সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে গণতন্ত্রীদের সংগঠন থেকে আলাদা, পুরো
জার্মানির শ্রমিকদের একটা পার্টি গঠন করার সময় এসে গেছে। ১৮৪৯এর মে মাসে কাছের জেলাগুলোর
সম্মেলন এবং জুন মাসে লাইপজিগে পুরো জার্মানির শ্রমিক সংগঠনগুলোর একত্র সম্মেলনের তারিখ
নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। তখনই অন্য একটি ঘটনাপরম্পরা তাঁদের মনোযোগ আকর্ষিত করল।
সাধারণভাবে ইয়োরোপে প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলো
সুদৃঢ় হয়ে ওঠা সত্ত্বেও হাঙ্গেরি এবং তারই সঙ্গে পশ্চিম এবং দক্ষিণ জার্মানিতে বিপ্লবী
শক্তিগুলো তখনো হারে নি, নতুন নতুন বিক্ষোভের খবর আসছিল প্রতিদিন। এঙ্গেলসের শৈশবের
শহর এলবারফেল্ডও ঐ অঞ্চলে। তাঁর মাথায় সামরিক গতিবিধির একটা ছক রূপ নিতে শুরু করেছিল।
প্রথমতঃ, যে সব শহরে সেনাবাহিনীর দেওয়া সুরক্ষা আছে বা ছাউনি আছে সেসব শহরে অর্থহীন
কার্যকলাপ এড়িয়ে যাওয়া হোক। ছোটো শহরে, কারখানার শ্রমিক-সমুদায়ে এবং গ্রামীণ এলাকায়
এমন সক্রিয়তা বাড়ানো হোক যাতে সেনাবাহিনীর মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়। দ্বিতীয়তঃ এখনো অব্দি
যে সমস্ত শক্তিকে সংহত করা হয় নি তাদেরকে প্রস্তুত করে সম্ভাবিত বিদ্রোহের কেন্দ্রগুলোর
দিকে পাঠানো হোক; এভাবে সব দিকে তৈরি
হতে থাকা গণ-সেনাদেরকে একত্র করে বিপ্লবী সেনাবাহিনীর সুত্রপাত ঘটানো হোক।
এই ভাবনাকে কার্যকর করতে এঙ্গেলস কোলোন থেকে
এলবারফেল্ড রওনা হয়ে গেলেন। রাস্তায় একটা শহর পড়ে সোলিঙ্গেন, সেখানকার বিপ্লবী শ্রমিকদের
এঙ্গেলস একটি সামরিক কোম্পানিতে সংগঠিত করলেন এবং নিজের নেতৃত্বে ৪০০ সর্বহারার অস্ত্রসজ্জিত
দল নিয়ে ১১ই মে ১৮৪৯এ এলবারফেল্ডে প্রবেশ করলেন।
এলবারফেল্ডের বিদ্রোহে শ্রমিকেরা সেখানকার
কারাগার নিজেদের দখলে এনেছিল, দন্ডাধিকারীর দপ্তর ভেঙে দিয়েছিল, কিন্তু সেখানকার নেতৃত্ব
ছিল পাতি-পূঁজিবাদী ভরা সুরক্ষা সমিতির হাতে। বিপ্লবী সক্রিয়তা আরো বেশি করার বদলে
তারা পুরোনো প্রশাসকদের সঙ্গে চুক্তি করার দিকে অগ্রসর হতে লাগল। কিছু দিনেই আন্দোলন
ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। এঙ্গেলস নিজেকে ‘সুরক্ষা সমিতি’রই হাতে সঁপে বললেন যে তিনি রাজনৈতিক ব্যাপারে মাথা গলাবেন না, কেননা
তাঁর মতে “সেখানে সেসময় শুধু
কালো-লাল-সোনালি” [জার্মান ঐক্যের
রঙ] “আন্দোলনই সম্ভব ছিল
আর তাই রাজার সংবিধানের” [ফ্রাঙ্কফুর্ট সংসদে
গৃহীত] “বিরুদ্ধে যে কোনো
সক্রিয়তা এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ।” আর তাই, তিনি শুধু সামরিক বিষয়ে কাজ করতে চান। সামরিক-কমিশনে এঙ্গেলস
জায়গা পেয়ে গেলেন। তাঁকে দুর্গ-সুরক্ষা-নির্মাণ, ব্যারিকেডের দেখাশোনা এবং তোপখানার
জিম্মা দেওয়া হল। মন দিয়ে নিজের কাজে লেগে পড়লেন। ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দল তৈরি করলেন
এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে বানানো ব্যারিকেডগুলোকে শহরের বাইরের দিকে আবার তৈরি করতে বললেন।
অস্ত্রসজ্জিত ইউনিটগুলোর জায়গা বদলালেন। তাঁর কয়েকটি পরামর্শ সুরক্ষা সমিতি মানলও না।
তবুও তিন কাজ করে চললেন। বিপ্লবী শক্তিগুলোকে বাঁচানোর জন্য কিছু কাজ সুরক্ষা সমিতির
মতের বিরুদ্ধেও গিয়ে করলেন।
এঙ্গেলসের জীবনীকার [উপরোক্ত রুশি জীবনী] উল্লেখ
করেন যে ১৩ই মে, রবিবার, সকালে কাঁধে বিদ্রোহী কমান্ডারের বস্ত্র-চিহ্ন লাল চাদর ছড়িয়ে
হাঁটতে হাঁটতে এঙ্গেলস বারমেনের নিচের দিকের অংশের সঙ্গে এলবারফেল্ডের সংযোগকারী রাস্তাটায়
এসে পড়েন। হয় তিনি ব্যারিকেড তৈরি করার কাজ দেখতে অথবা বারমেনের শ্রমিকদের সঙ্গে দেখা
করতে যাচ্ছিলেন। একটি সেতুর ওপর তোলা ব্যারিকেডের ওপরে তিনি যেই পৌঁছোন, গির্জায় যেতে
থাকা তাঁর বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কী কথা হয়, আমরা জানি না, কিন্তু দুজনের দেখা
একটা কষ্টের নীরবতায় হয়েছিল আন্দাজ করা যায়।
পূঁজিবাদীরা ভীত ছিল। তারা এঙ্গেলসকে নিয়ে
নানা রকম গুজব ছড়ালো – কম্যুনিস্টেরা পুরো
বিপ্লবকে নিজেদের কুক্ষিগত করতে চায় … রাতের অন্ধকারে এঙ্গেলসের নেতৃত্বে ব্যারিকেডে লাগানো কালো-লাল-সোনালি
ঝান্ডাগুলো সরিয়ে লাক ঝান্ডা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি। সুরক্ষা সমিতির পাতি-পূঁজিবাদী
নেতৃত্ব এই সব গুজবে প্রভাবিত হয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করল যে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে এঙ্গেলসকে
এলবারফেল্ড ছেড়ে দিতে হবে। সিদ্ধান্ত শুনে অস্ত্রসজ্জিত শ্রমিক এবং স্বয়ংসেবকেরা ক্রুদ্ধ
হয়ে উঠল। কিন্তু ভিতরকার ঝগড়া বিপ্লবী শক্তিকে দুর্বল করত; প্রুশীয় সেনাবাহিনীও ওদিকে
এগিয়ে আসছিল। তাই ১৫ই মে এঙ্গেলস আবার কোলোন ফেরার পথে রওনা হয়ে গেলেন। ১৭ই মে, ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এ লেখা হল যে শ্রমিকেরা তাদের সম্পাদকীয় মন্ডলীর
একজন সদস্যকে স্নেহভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে দীর্ঘ সংগ্রামের দিনগুলোয়
শ্রমিক-স্বার্থের বিপদে পড়া উচিৎ নয়। যখন বড় লড়াই শুরু হবে, কাগজের অন্যান্য সম্পাদকদের
মত এঙ্গেলসকেও তাঁরা সম্মুখ রণাঙ্গনে পাবেন এবং সেসময় বিশ্বের কোনো শক্তি তাঁকে সরাতে
পারবে না।
কিন্তু বাস্তব এটাই যে সব অঞ্চলে বিদ্রোহ ভাঙতে
শুরু করেছিল। পাতি-পূঁজিবাদী নেতৃত্ব নিজের দ্বিধাগ্রস্ততায় নির্ণায়ক বিপ্লবী পদক্ষেপ
নিতে পারছিল না, পূঁজিবাদী শ্রেণী সামন্ততান্ত্রিক শক্তিদের সঙ্গে সমঝোতায় মশগুল ছিল
আর শ্রমিকেরা মোহমুক্ত হয়ে নিজেদের জায়গায় ফিরে যাচ্ছিল। প্রুশীয় সরকার দেখল যে চূড়ান্ত
আক্রমণের সময় এটাই। ফলে ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর ওপর দমনমূলক কার্যকলাপ শুরু হয়ে গেল। কাগজটার
সম্পাদকদের ওপর তেইশটা মামলা রুজু করা হল। মে মাসের ১৬ই তারিখেই ‘বিদেশী’ মার্ক্সকে চব্বিশ ঘন্টার নোটিশে প্রুশিয়া ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার
আদেশ দেওয়া হয়েছিল। বাকি সব সম্পাদককে আগেই হয় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল অথবা দেশ থেকে
বার করে দেওয়া হয়েছিল। ১৭ তারিখে এঙ্গেলসকে গ্রেপ্তার করার এবং ৬ই জুন তাঁকে তালাশ
করার আদেশ জারি হল।
খবরের কাগজ বন্ধ করার জন্য প্রধান সম্পাদক
কার্ল মার্ক্সকে পাঠানো নোটিশে লেখা ছিল যে তাঁর খবরের কাগজ, সদ্য প্রকাশিত প্রবন্ধাদির
মাধ্যমে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে লোকজনকে উসকাচ্ছে, সহিংস বিপ্লব এবং সামাজিক প্রজাতন্ত্রের
ওকালতি করছে এবং এ প্রকারে, সরকার কর্তৃক প্রদত্ত আতিথ্যের সীমারেখা তিনি লঙ্ঘন করছেন।
তাই, তাঁকে প্রদত্ত আতিথ্য ফেরত নেওয়া হচ্ছে আর যেহেতু তাঁর কোলোনে থাকার কাগজপত্রের
তারিখ বাড়ানো হয় নি তাই তিনি যেন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কোলোন ছেড়ে দেন।
‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর শেষ সংখ্যা মে মাসের ১৯ তারিখে লাল কালিতে
ছেপে বেরুল। সম্পাদকীয়তে মার্ক্স সরকারের মিথ্যে অভিযোগগুলো খণ্ডিত করলেন। সম্পাদকীয়
বলল, প্রথম থেকেই এই খবরের কাগজ সামাজিক প্রজাতন্ত্রের পক্ষে। সরকারি সিদ্ধান্ত ভীরুতাপূর্ণ
বলে তার নিন্দা করল। বলল যে এই সরকারের প্রতি কাগজটির কোনো সহানুভূতিও নেই আর এই সরকারের
কাছ থেকে কোনো সহানুভূতি কাগজটি চায়ও না। কোলোনের শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে একটি সম্বোধনে
তাঁদের সহানুভূতির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হল এবং বলা হল, কাগজের সম্পাদকদের শেষ
আহ্বান হবে ‘শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি’।
খবরের কাগজের এই সংখ্যাটি প্রকাশের দু’দিন আগে এঙ্গেলস লুকিয়ে পড়েছিলেন। প্রকাশ হওয়ার
পর মার্ক্সের সঙ্গে তিনি ফ্রাঙ্কফুর্ট রওনা হয়ে গেলেন।
প্রাঙ্কফুর্টে জাতীয় সংসদের বামপক্ষকে মার্ক্স-এঙ্গেলস
অনুরোধ করলেন যে তাঁরা যেন দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানিতে চলতে থাকা বিপ্লবী সংগ্রামের কেন্দ্রীয়
নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নেন। বোঝাবার চেষ্টা করলেন। এঙ্গেলস সে অঞ্চলের ভৌগোলিক মানচিত্র
এবং বিপ্লবী শক্তিদের অবস্থান বর্ণিত করে বললেন যে প্রান্তবর্তী দক্ষিণ-পশ্চিমের কালো
জঙ্গলে ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী ব্যাডেন শহরে হওয়া বিদ্রোহের গুরুত্ব আছে। সেটাকে সংগঠিত
করে পুরো দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির বিভিন্ন শহরে বিদ্রোহ করানো যায় এবং সংগঠিতভাবে প্রতিবিপ্লবী
প্রুশীয় সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করা যায়। ব্যাডেনের বিপ্লবী সেনাবাহিনীকে ফ্রাঙ্কফুর্টে
ডেকে গোটা ফ্রাঙ্কফুর্ট অধিকার করা যেতে পারে। তার প্রভাব পড়বে পুরো জার্মানির ওপর।
কিন্তু সংসদের বামপক্ষের পাতি-পূঁজিবাদীরা মানল না।
মার্ক্স-এঙ্গেলস তখন নিজেরাই ব্যাডেন গেলেন।
সেখানকার বিপ্লবী শক্তিদের নেতৃত্বকে বোঝালেন যাতে জাতীয় সংসদকে প্রভাবিত করার জন্য
তাঁরা নিজেদের সামরিক দল ফ্রাঙ্কফুর্টে পাঠান। কিন্তু তারাও এ প্রস্তাব মানল না। তখন
মার্ক্স-এঙ্গেলস দ্বিতীয় নিকটবর্তী শহর প্যালেটিনেট পৌঁছোলেন। সেখানেও চলছিল বিপ্লবী
আন্দোলন। অস্থায়ী সরকারে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর সদস্যেরাও ছিল এবং কয়েকজন গণতন্ত্রীও ছিল
‘লীগ’ সদস্যদের সমর্থনে। কিন্তু সেখানেও মার্ক্স-এঙ্গেলসের
প্রস্তাব মান্য হল না। আসলে প্রত্যেক জায়গায় বিদ্রোহ বা আন্দোলন স্থানীয় ছিল। পাতি-পূঁজিবাদী
নেতৃত্বের, পুরো জার্মানির বিপ্লবী একীকরণ সম্পর্কিত কোনো দৃষ্টি ছিল না।
প্যালেটিনেট থেকে একটি তৃতীয় শহর বিঙ্গেন যাওয়ার
পথে মার্ক্স-এঙ্গেলস স্থানীয় প্রশাসনের হাতে গ্রেপ্তার হলেন। তাঁদের ফেরত ফ্রাঙ্কফুর্ট
নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল। সেখান থেকে তাঁরা আবার বিঙ্গেন পৌঁছোলেন। মার্ক্স প্যারিসের
পথে রওনা হলেন আর এঙ্গেলস প্যালেটিনেটেরই ভিতরে অবস্থিত শহরতলী কাইজারস্লটার্নে ফিরে
এলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল সেখানেই একজন সাধারণ রাজনৈতিক প্রবাসী হয়ে থাকবেন। লড়াইয়ের মরশুম
আবার জেগে উঠলে “আন্দোলনে ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর একমাত্র জায়গা -একজন সৈনিকের” জায়গা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবেন।
প্যালেটিনেটের অস্থায়ী সরকার এঙ্গেলসকে বেশ
কয়েকবার সামরিক বা নাগরিক কোনো পদে থাকার প্রস্তাব দিল। এঙ্গেলস স্বীকার করলেন না।
কিন্তু অস্থায়ী সরকারের খবরের কাগজে লিখতে রাজি হয়ে গেলেন। লিখলেনও। কিন্তু এখানেও
একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হল। ‘উস্কানিমূলক’ হওয়ার অভিযোগে সম্পাদকেরা দ্বিতীয় প্রবন্ধটিকে খারিজ করে দিল। এঙ্গেলস
লেখা বন্ধ করে দিলেন।
তত দিনে প্রুশীয় সেনাবাহিনী প্যালেটিনেট পৌঁছে
গিয়েছিল। অস্থায়ী সরকার, গণতন্ত্রী আন্দোলন এবং বিপ্লবী সেনাবাহিনীকে দমন করার যুদ্ধ
শুরু হয়ে গেল। এঙ্গেলস তৎক্ষণাৎ সেখানকার ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর সদস্য এবং বিপ্লবী সেনাবাহিনীর অগ্রগামী দলটির ভারপ্রাপ্ত উইলিচের
সহকারী হয়ে গেলেন। পুরোদস্তুর যুদ্ধে অংশ নিলেন। বিপ্লবী সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে
এলবারফেল্ডের শ্রমিকেরা এসে গিয়েছিল। তারা এঙ্গেলসকে চিনতে পারল এবং এঙ্গেলসের নেতৃত্বে
কাজ করতে চাইল।
এঙ্গেলস দক্ষভাবে বিপ্লবী সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ
পরিচালিত করলেন। ছোট ছোট লড়াইগুলো ছেড়ে দিলেও চারটে বড় যুদ্ধে এঙ্গেলস রইলেন। বিপ্লবী
সেনাবাহিনী শেষ পর্য্যন্ত পরাজিত হল – ধীরে ধীরে পিছু হটতে হটতে ব্যাডেন-প্যালেটিনেটের বিদ্রোহী সৈন্যবাহিনীর
শেষ দলটা ১২ই জুলাই ১৮৪৯এ জার্মানির সীমান্ত পেরিয়ে সুইটজারল্যান্ডে প্রবেশ করল।
মার্ক্সের ছোট মেয়ে ইলিয়ানর নিজের স্মৃতিকথায়
লেখেন, “যাঁরাই তাঁকে” [এঙ্গেলসকে] “যুদ্ধে দেখেছেন, তাঁদের সবাইকে ওনার অসাধারণ
শান্ত স্বভাব এবং বিপদকে তুচ্ছ করা ঘৃণার কথা বলতে দেখা গেছে।”
প্রতিবিপ্লবী যুগের প্রারম্ভ এবং ইংল্যান্ডবাসী
হওয়ার সিদ্ধান্ত
উইলিচের নেতৃত্বে বিপ্লবী সেনাবাহিনীর শেষ
ইউনিটটার সঙ্গে সুইটজারল্যান্ডে প্রবেশ করার পর কয়েকটি দিন তাঁরা সবাই সীমান্তেই কাটালেন।
তারপর উইলিচের ইউনিটের শিবির হল ভেভে নামে একটি শহরে। এঙ্গেলস ভয় পাচ্ছিলেন মার্ক্স
প্যারিসে গ্রেপ্তার না হয়ে গিয়ে থাকেন। ভেভে পৌঁছোবার পরের দিনই জেনি মার্ক্সকে লেখা
তাঁর একটি চিঠি পাওয়া যায় [মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্র, খণ্ড ৩৮, পৃঃ ২০২-৪]। ২৫শে জুলাইয়ে
লিখিত ঈষৎ দীর্ঘ চিঠিতে তাঁর বিগত মাসাধিক কালের সামরিক গতিবিধি এবং বিপ্লবী সেনাবাহিনীর
শৌর্যের বর্ণনা আছে। শেষে তিনি লিখছেন, “যদি একবারটি নিশ্চিত হতে পারতাম যে মার্ক্স” [গ্রেপ্তার হয়নি] “মুক্ত অবস্থায় আছে! মাঝেমধ্যেই ভাবি যে প্রুশীয়
গুলিগোলার মাঝে আমার অবস্থান, জার্মানিতে থাকা অন্যান্যদের বা বিশেষ করে প্যারিসে থাকা
মার্ক্সের চেয়ে কম বিপজ্জনক ছিল। সত্বর আমার অনিশ্চিতি দূর করো।” জবাব পাওয়া যাচ্ছে ১৭ই আগস্টের। মার্ক্স লিখছেন,
“জানি না প্রথম চিঠিটা
পেলে কিনা, … আমি আবার লিখছি
আমার স্ত্রী এবং আমি তোমাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ছিলাম এবং তোমার খবর পাওয়ার পর খুব খুশি
হলাম।”
ভেভের শিবিরে থাকাকালীন এবং আশেপাশে ঘোরার
সময় বিভিন্ন ধরণের জার্মান অভিবাসীর সঙ্গে দেখা করার এবং বিপ্লবের অসফল হওয়ার কারণগুলো
মূর্তরূপে দেখার ও পরখ করার সুযোগ পেলেন এঙ্গেলস। পাতি-পূঁজিবাদী গণতন্ত্রীদের বাচাল
দম্ভ, নিজেদের শক্তি বেশি করে এবং শত্রুর শক্তি কম করে দেখার প্রবৃত্তি, অতিবিপ্লবীপনা
আর হতাশার মাঝে দোদুল্যমান থাকার অভ্যেস, অসফলতার প্রধান কারণগুলো খোঁজার বদলে একে
অন্যের সামরিক কার্যকলাপে ভুল খুঁজে বেড়ানো …। হ্যাঁ, কিন্তু এই শেষ অভিযোগটা – ভুল, অনুশাসনে ত্রুটি, সৈনিক-কর্তব্যবোধের
অভাব ইত্যাদি – যদি তাঁর ইউনিটের
ওপরে আসত, তখন তিনি নিজের ইউনিটের পক্ষ সমর্থনে নেমে পড়তেন।
জুলাইয়ের শেষে বিষয়টা নিয়ে একটা প্রবন্ধও লিখে
ফেললেন, ‘অস্বীকার’, যাতে তিনি প্রমাণিত করলেন যে তাঁর ইউনিট
শেষ পর্য্যন্ত নিজের বিপ্লবী কর্তব্য সম্পন্ন করেছিল। প্রবন্ধটি ছাপা হয় নি কোথাও কিন্তু
লেখার পর এঙ্গেলসের মনে হল পুরো বিপ্লবী অভিযানটা নিয়ে একটি পুস্তিকা লেখা উচিৎ। মার্ক্সও
প্যারিস থেকে লেখা চিঠিগুলোয় সে কাজটাই করতে তাঁকে উৎসাহিত করছিলেন। কিন্তু শিবিরের
পরিবেশ এমন ছিল, আশেপাশের মানুষজন আর সাহসী এবং দক্ষ সৈনিক হওয়া সত্ত্বেও খোদ ভারপ্রাপ্ত
উইলিচ, ভাবনাচিন্তায় এত পিছিয়ে ছিলেন যে এঙ্গেলস বিরক্ত হতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু
কোথাও যেতে পারছিলেন না কেননা পয়সা ছিল না।
সোভিয়েত রুশ প্রকাশিত এঙ্গেলসের জীবনীতে (উপরোক্ত)
লেখা আছে, আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর পরিবার থেকে কিছু পয়সা পাঠানো হয়েছিল। সে বইয়ে
লেখা নেই কে পাঠিয়েছিল। কিন্তু গুস্তাভ মেয়ার রচিত জীবনীতে এঙ্গেলসের ভগ্নীপতির (বোন
মেরির বর, এমিল ব্লাঁ-ই হবেন) পাঠানো একটি চিঠি উদ্ধৃত আছে। চিঠির ভাষা অতি নিম্নস্তরের,
কিন্তু পড়লে বোঝা যায় এঙ্গেলস পয়সা চেয়ে পাঠিয়েছিলেন, সে পয়সা দেয় নি। এঙ্গেলস যা কিছু
করছেন সেগুলোকে অশিক্ষিত মধ্যবিত্ত কূপমন্ডুকের ভাষায় ‘মানুষের উদ্ধার’এর জন্য করা ‘পণ্ডশ্রম’ বলে, চিঠিতে বাড়ি ফিরে আসতে বলা হয়েছিল এবং উপদেশ দেওয়া হয়েছিল
যে পয়সার জন্য তিনি বাবাকে লিখতে পারেন না তো মাকে লিখুন! যে এমিল ব্লাঁ-কে নিয়ে মেরির
বিয়ের আগে এঙ্গেলস এত উৎসাহিত ছিলেন যে ছেলেটি সমাজবাদী, তার এইরকম চিঠি পড়ে এঙ্গেলসের
মনের অবস্থা কেমন হয়ে থাকবে তা আঁচ করা যায়।
গুস্তাভ মেয়ার যথার্থ লিখেছেন, “এই ভাষাতেই অশিক্ষিতেরা এঙ্গেলসের মনে বিক্ষেপ
আনার চেষ্টা করত। কিন্তু এঙ্গেলসের মন বলত, ‘বিশ্ব নতুন যুগের প্রসব-বেদনায় পীড়িত’ – বছরের শুরুতে তিনি এই নতুন যুগকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। তাঁর মনে
হত এটাই ন্যায়সঙ্গত – যে সৃজনের ক্রিয়া
থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয় নি, তার তো ওই প্রসব-বেদনায় নিজের অংশ অবশ্যই পাওয়া উচিৎ!
প্রসন্ন হৃদয়ে তিনি কষ্টে অংশগ্রহণ করলেন কেননা তিনি অনুভব করলেন যে ভবিষ্যৎ তাঁর সঙ্গে
আছে।”
উপরোক্ত ঘটনাবলি থেকে একটা আভাস পাওয়া যায়
যে স্বামীর কথাবার্তায় তিনি আঁচ পেয়ে থাকবেন যে দাদার পয়সার দরকার আর মা বা বাবাকে
বলে পয়সা পাঠাবার ব্যবস্থা করে থাকবেন। এটা আন্দাজ করছি কেননা এর পরেও এমন প্রসঙ্গ
আছে যেখানে বোন মেরিই, পরিবারের সঙ্গে এঙ্গেলসের সম্পর্কের মাধ্যম হয়েছেন।
যাহোক, পয়সা পেয়েই এঙ্গেলস ভেভের শিবির ছেড়ে
লুসান পৌঁছোলেন এবং থাকার একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে নিজের পুস্তিকার ওপর কাজ করা শুরু
করলেন। পুস্তিকাটির নাম রাখলেন ‘বাদশাহী সংবিধানের জন্য জার্মান অভিযান’। ২৪শে আগস্ট নিজের বন্ধু জ্যাকব কুকাস শ্যাবেলিজকে
লিখলেন, “ … ব্যাডেন-প্যালেটিনেটের বিপ্লবী প্রহসনের বিষয়ে
নিজের স্মৃতিকথা লিখছি। … তুমি জানো যে আমি
বাচাল দাম্ভিক প্রজাতন্ত্রীদের বিভ্রমে থাকব না আর ওই প্রধানদের বাচালতার পিছনে লুকিয়ে
থাকা কাপুরুষতা দেখে নেব – সেটুকুর জন্য আমি
পর্যাপ্ত সমালোচক। ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর যোগ্য আমার প্রবন্ধটি অন্যান্য স্মৃতিকথা
থেকে আলাদা; পুরো গল্পটাকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণে পেশ করবে।”
যদিও, এ পুস্তিকাও কোথাও প্রকাশিত হতে পারল
না। জার্মানিতে হোক বা সুইটজারল্যান্ডে, ‘লীগ’এর সদস্য হোক বা
অন্য কোনো পুরোনো বন্ধু, কেউ এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করার অবস্থায় ছিল না।
সুইটজারল্যান্ডে একরকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলা
লোকেদের সঙ্গে এঙ্গেলস সম্পর্ক পাতিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। একবার বার্ন গেলেন। তখন
উইলহেল্ম উল্ফ এবং ‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হল।
জেনেভায় প্রথম উইলহেল্ম লিবনেখটের সঙ্গে দেখা হল। পরে আজীবন তিনি বন্ধু ছিলেন। লিবনেখট
পরে এই প্রথম সাক্ষাতের একটি চমৎকার স্মৃতির কথা লিখেছেন, “ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের মাথাটা যা ছিল পরিষ্কার আর উজ্জ্বল। সবরকম রোমান্টিকতা এবং
ভাবপ্রবণতার কুয়াশা থেকে মুক্ত … পরিষ্কার উজ্জ্বল চোখ যা পৃষ্ঠদেশে না দাঁড়িয়ে, বস্তুগুলোকে বিদ্ধ
করে তলদেশ অব্দি দেখত … আমার ভিতরে তখনি
এসেছিল এই কথাটা যখন প্রথমবার আমাদের দেখা হয়েছিল … রাইখ সংবিধান অভিযানের অসফলতার পর জেনেভার হ্রদের ধারে ১৮৪৯
সালের গ্রীষ্মের শেষ দিনগুলোয় আমরা বেশ কিছু অভিবাসী কলোনি বানিয়েছিলাম … তার আগে নানা ধরণের বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে
ব্যক্তিগত ভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, যেমন রুজ, হেইঞ্জেন, জুলিয়াস ফ্রোবেল,
স্ট্রুভ … ব্যাডেন ও স্যাক্সনি
‘বিপ্লব’এ শামিল জনগণের আরো বেশ কয়েকজন নেতা, কিন্তু
আমার পরিচয়ের ঘনিষ্ঠতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার নজরে তাদের দীপ্তি ম্লান হতে থাকল … হাওয়ায় যত বেশি কুয়াশা থাকে ততই বস্তু আর
মানুষ বড় হয়ে দেখা দেয়। ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের গুণ ছিল যে স্পষ্ট দৃষ্টিসম্পন্ন তাঁর চোখের
সামনে কুয়াশা অদৃশ্য হয়ে যেত এবং বস্তু ও মানুষ তেমন রূপেই দেখা দিত যেমন হয় বস্তু
ও মানুষ। ঐ বিঁধে যাওয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং ফলে ভেদকারক নিষ্পত্তি প্রথম প্রথম আমায়
অস্বস্তিতে ফেলে দিত। কখনো কখনো আহত করত … সবসময় তাড়াতাড়ি না হয়ে থাকলেও … ব্যক্তি ও বস্তু নিয়ে আমাদের অভিমতে ঐক্যের জন্য … আমার ঐ ‘দক্ষিণ-জার্মান হাল-ছেড়ে-দেওয়া ভাব’ কখনো বাধা হয়ে ওঠে নি …”
ওদিকে প্যারিসে সপরিবারে মার্ক্স হয়রানির মধ্যে
ছিলেন। জুন মাসে গণতন্ত্রীদের একটি দলের বিরোধ-সমাবেশের পর ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়াশীল
সরকারের দমনমূলক কার্যকলাপ বেড়ে গেল। ১৯শে জুলাই মার্ক্সকে আদেশ দেওয়া হল যে তিনি যেন
অবিলম্বে প্যারিস ছেড়ে মর্বিহানে চলে যান। মর্বিহান পশ্চিমোত্তর ফ্রান্সের, জলাভূমি
ভরা একটি অস্বাস্থ্যকর জায়গা। এক প্রকারে সরকারের এ আদেশ ছিল বিপ্লবীদের যাতায়াতের
সুবিধাহীন অস্বাস্থ্যকর জায়গায় পাঠিয়ে মেরে ফেলার চক্রান্তের মত। মার্ক্স ফ্রান্স ছাড়ার
সিদ্ধান্ত নিলেন। সুইটজারল্যান্ডের পাসপোর্ট উনি পেতেনও না আর আগে থেকে সেখানে বসবাস
করা অভিবাসী জার্মান বিপ্লবীরা কদ্দিন থাকতে পারবেন সেটা ভাবার বিষয় ছিল। তাই ২৪শে
আগস্ট তিনি, স্ত্রী জেনি আর বাচ্চাদের প্যারিসে ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি দিলেন এবং লন্ডন
পৌঁছে গেলেন। এক দিন আগে লেখা চিঠিতে তিনি এঙ্গেলসকে জানিয়ে দিলেন যে পরিবারকে প্যারিসে
রেখে তিনি লন্ডনে যাচ্ছেন। এঙ্গেলসকেও লন্ডনে চলে আসতে বললেন।
“লন্ডনে একটি জার্মান
খবরের কাগজ শুরু করতে পারার ইতিবাচক সম্ভাবনা আছে। আবশ্যক তহবিলের একটা অংশের প্রাপ্তি
সম্পর্কে আমায় আশ্বস্ত করা হয়েছে।
“কাজেই তুমি এক্ষুনি
লন্ডনে আসার জন্য রওনা হয়ে পড়। এখানে এলে তুমি সুরক্ষিতও থাকবে। প্রুশীয়রা তোমার ওপর
দু’বার গুলি দাগবে,
(১) ব্যাডেনের জন্য; (২) এলবারফেল্ডের জন্য। আর, সুইটজারল্যান্ডে, যেখানে কিছু করতেও
পারবে না, পড়েই বা কেন থাকবে?
“লন্ডনে আসতে তোমার
কোনো অসুবিধে হবে না, সে এঙ্গেলস নামে হোক বা মেয়র নামে। যেই তুমি বলবে যে লন্ডনে যেতে
চাইছ, ফরাসি দূতাবাস থেকে লন্ডন যাওয়ার একতরফা পাসপোর্ট পাবে।
“আমি পুরোপুরি তোমার
লন্ডনে আসার ওপর ভরসা করছি। তুমি সুইটজারল্যান্ডে থাকতেই পারবে না। লন্ডনে আমরা কাজে
লেগে পড়ব। ……
“পুনর্বার, আমি এ
ব্যাপারে আশ্বস্ত হয়ে যে তুমি আমায় মাঝদরিয়ায় ছেড়ে দেবে না, তোমার আসার অপেক্ষা করছি।”
চিঠি পেয়ে এঙ্গেলসও স্থির করলেন তিনি ইংল্যান্ড
যাবেন। কিন্তু জার্মানি বা ফ্রান্সের সীমান্তে পৌঁছোলেই তাঁর গ্রেপ্তার হওয়া অবধারিত
ছিল । একমাত্র পথ ইতালির জেনোয়া বন্দর হয়ে। কিন্তু তার জন্য তাঁকে পিডেমন্ট শহরের সীমানা
পার করতে হত। তাই করলেন। পিডেমন্ট পুলিসের নজর বাঁচিয়ে তিনি অক্টোবরের শুরুতে জেনোয়া
পৌঁছোলেন। একটা ইংরেজ স্কুনারে (দুই মাস্তুলের পালতোলা ছোট জাহাজ) ৬ই অক্টোবর সাগরপথে
লন্ডন রওনা হলেন।
ইংল্যান্ডের তীরে পৌঁছোতে পাঁচ সপ্তাহ লাগল। এই পাঁচ সপ্তাহ তিনি নৌ-পরিবহন সম্পর্কে নিজের জ্ঞান বাড়ালেন। তাঁর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিগুলোয় ঐ সময়ের একটি ডাইরি আছে যাতে সূর্যের অবস্থান, হাওয়ার দিশা, সমুদ্রের অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে মন্তব্য আছে এবং পার হওয়া তটরেখাগুলোর রেখাচিত্র আছে।
লন্ডনে এক বছরঃ স্বতন্ত্র সর্বহারা বিপ্লবী
পার্টি নির্মাণ-প্রচেষ্টা
লন্ডনে আসার পর ১৮৪৯এর সেপ্টেম্বরে মার্ক্স
‘কম্যুনিস্ট লীগ’এর অব্যবস্থিত অবস্থায় পড়ে থাকা কেন্দ্রীয়
সমিতিটার পুনর্গঠন করেছিলেন। এঙ্গেলস যেই চলে এলেন, তাঁকেও সমিতির অন্তর্ভুক্ত করে
নেওয়া হল। খুব শিগগিরই ‘লীগ’এর পুরোনো সাথীরা এই দুজনের সঙ্গী হয়ে উঠলেন।
কয়েকজন নতুন সাথীও, যেমন অগাস্ট উইলিচ, যাঁর সহকারী হয়ে এঙ্গেলস ব্যাডেন-প্যালেটিনেট
অভিযানের কমান্ডে ছিলেন, অথবা উইলহেল্ম লিবনেখট, যাঁর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল জেনেভায়,
‘লীগ’এ চলে এলেন।
একসঙ্গে হওয়ার পর মার্ক্স-এঙ্গেলস জার্মান
অভিবাসী, উদ্বাস্তু এবং নির্বাসিতদের সংগঠনগুলোতেও যোগ দিলেন এবং অনেক কাজ করলেন সেসব
সংগঠনগুলোর। সংগঠনগুলোর জন্য এঙ্গেলস জার্মানি এবং অন্যান্য দেশগুলোয় ছড়িয়ে থাকা নিজের
বন্ধুদেরকে দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করিয়ে আনালেন। সংগঠনগুলোয় পাতি-পূঁজিবাদী বিপ্লবীদের ভালো
প্রভাব ছিল। পাতি-পূঁজিবাদী ভাবধারার প্রভাব থেকে মুক্ত না করে সবাইকে সর্বহারা বিপ্লবী
মতাদর্শে যোগ করা এবং ভবিষ্যতে জার্মানির একটি স্বতন্ত্র সর্বহারা পার্টি গঠন করা সম্ভব
ছিল না। এই সংগ্রামে তাঁদের অনেক মিথ্যে অভিযোগেরও জবাব দিতে হল। কাজও করতে হল নতুন
নতুন। যেমন ‘জার্মান শিক্ষা সমিতি’কে বাঁচানোর জন্য তার মধ্যে তাঁরা ‘সামাজিক গণতন্ত্রী সমিতি’ গঠন করলেন, তাঁদেরকে অভিযুক্ত করা হল যে তাঁরা
শুধু কম্যুনিস্টদেরই সাহায্য করেন, এবং তহবিলের ব্যায়ে অনিয়ম হয়েছে। তার জবাবে ‘সামাজিক গণতন্ত্রী সমিতি’ পুরো হিসাব প্রকাশ করল এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করল যে সমিতির সদস্যেরা তহবিল থেকে কিছু পাবে না। যেহেতু অভাবগ্রস্ত শ্রমিক বিপ্লবী
উদ্বাস্তুদের সাহায্য করার মত তহবিল সংগৃহীত হয়ে আসছিল না, মার্ক্স-এঙ্গেলসের নেতৃত্বে
‘সামাজিক গণতন্ত্রী
সমিতি’র তরফ থেকে সামূহিক
রাত্রি-আবাস, সামূহিক ভোজনশালা, এমনকি বেকারদের জন্য কর্মশালাও চালানো হল।
এঙ্গেলসের কার্যকলাপ এটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল
না। শ্রমিকদের, লন্ডনে হওয়া আন্তর্জাতিক জমায়েতগুলোতেও এঙ্গেলস নিয়মিত যেতেন এবং ভাষণ
দিতেন। চার্টিস্টদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আগে থেকেই ভালো ছিল। ডিসেম্বর ১৮৪৯ থেকে আগস্ট
১৮৫০ অব্দি, চার্টিস্টদের মুখপত্র ‘ডেমোক্র্যাটিক রিভিউ’এ এঙ্গেলসের দুটো অস্বাক্ষরিত প্রবন্ধমালা ছাপল – ‘ফ্রান্সের চিঠি’ আর ‘জার্মানির চিঠি’। মার্ক্স রচিত ‘ফ্রান্সে শ্রেণীসংগ্রাম’এর প্রথম অধ্যায়ের এঙ্গেলস কৃত ‘সংক্ষিপ্তসার’ও ঐ পত্রিকাতেই ছাপল।
এসব কাজের মধ্যেই, মার্ক্স যেমন এঙ্গেলসকে
সুইটজারল্যান্ডে লিখেছিলেন, নতুন পত্রিকা প্রকাশনের প্রস্তুতিও চলছিল। ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর বিপ্লবী উত্তরাধিকারকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য
নতুন পত্রিকার নাম হল ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং
পলিটিশ্-একোনমিশ রেভ্যু’। আশা করছিলেন পত্রিকাটি
আগামী দিনে দৈনিক হবে।
পত্রিকার ঘোষণায় স্পষ্টতঃ লেখা হল যে এতে,
“সেই আর্থিক সম্পর্কগুলোর
বিস্তারিত এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থাকবে যেগুলো সব রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিত্তি।” এটাও লেখা হল যে ওপর ওপর শান্ত মনে হওয়া এই
সময়টার ব্যবহার, “বিপ্লবের চলে যাওয়া
সময়কালের ব্যাখ্যায়, যুযুধান পক্ষগুলোর চরিত্রের ব্যাখ্যায় এবং সেই সামাজিক সম্পর্কগুলোর
ব্যাখ্যায়” হওয়া উচিৎ “যে সম্পর্ক ঐ যুযুধান পক্ষগুলোর অস্তিত্ব এবং
সংগ্রামসমূহকে নির্ধারিত করে।”
তাঁদের কাছে পয়সা ছিল না। উইলহেল্ম উল্ফ, জর্জ
এক্যারিয়াস, ওয়েডেমেয়ার, ফ্রেইলিগ্রাথ ইত্যাদি পুরোনো বন্ধুরা মিলে সাহায্য করলেন।
প্রকাশনার স্থান হিসেবে লন্ডন এবং হামবুর্গ (জার্মানি)র সঙ্গে নিউইয়র্ক (আমেরিকা)রও
নাম ছাপা হত কেননা অনেক জার্মান বিপ্লবী উদ্বাস্তু আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন – আশা করা হল যে তাঁদের সাহায্যে পত্রিকা সেখানেও
বিতরিত হবে।
পত্রিকার মোট ছয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হতে পারল।
তার মধ্যেও পঞ্চম এবং ষষ্ঠ যুগ্ম সংখ্যা ছিল। সেটি প্রকাশিত হল ১৮৫০এর নভেম্বরের শেষে।
পত্রিকার পর্যালোচনামূলক মন্তব্যে আলোচিত হল যে পূঁজিবাদের সঙ্কটের সময় আপাততঃ অতীত,
পূঁজিবাদী সমাজের উৎপাদক শক্তিগুলো এই পূঁজিবাদী সম্পর্কগুলোর ভিতরেই যথাসম্ভব পুরোদস্তুর
বিকশিত হয়ে চলেছে। তাই এখন সময় নিজেদের শক্তিগুলোকে একত্র করার, আগামী দিনের বৈপ্লবিক
সময়ের জন্য তাদেরকে প্রস্তুত করার, নিজেদের রণকৌশল সময়ানুযায়ী সংশোধন করার। এই মন্তব্যের
জন্য মার্ক্স এবং এঙ্গেলসকে তাঁদের ঘনিষ্ঠতম সাথীদেরও সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিল। কেননা
তাঁরা জার্মানিতে অবিলম্বে আবার একটি বিপ্লবী জোয়ার তোলার সম্ভাবনা খুঁজছিলেন।
এই পত্রিকায় এঙ্গেলসের দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ
প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম, ‘জার্মান বাদশাহী
সংবিধানের জন্য অভিযান’ যার অধিকাংশ তিনি
সুইটজারল্যান্ডের লুসান শহরে বসে লিখেছিলেন এবং দ্বিতীয়, ‘জার্মানিতে কৃষক-যুদ্ধ’। দ্বিতীয়টি আজও মার্ক্সবাদের কালজয়ী রচনা
হিসেবে পঠিত হয়।
প্রথম প্রবন্ধের খুব প্রশংসা হল বিশেষ করে
তার জীবন্ত এবং আকর্ষণীয় বর্ণনার জন্য। বিপ্লবী গতিবিধিতে থাকুক বা না থাকুক, সংবিধানের
পক্ষে থাকা প্রতিটি শ্রেণীর বস্তুগত বিশ্লেষণ ছিল। দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির বিভিন্ন
অঞ্চলে বিপ্লবী কার্যকলাপের বর্ণনা ছিল – ব্যারিকেডের ওপর লড়াই, অস্ত্রসজ্জিত দলগুলোর মার্চ … – কিন্তু শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে। আর তাই, পরিচিতদের অনেকে রেগেও
গিয়েছিলেন ভীষণ, কেননা পাতি-পূঁজিবাদী মনোভাবের তীব্র সমালোচনা ছিল। এ ছাড়া পুরো জার্মানির
প্রধান শহর এবং রাজধানীর সাধারণ পরিস্থিতিরও বর্ণনা ছিল প্রবন্ধটিতে।
দ্বিতীয় প্রবন্ধটি এখন বইয়ের আকারে পাওয়া যায়।
নিজের সময়ের বিপ্লবের অসফলতার কারণ খুঁজতে খুঁজতেই লেখক ১৬শ শতকে পৌঁছেছিলেন কিন্তু
লেখার সময় তৎকালীন ধার্মিক পুনর্গঠনের ঘটনাটিকে ‘ধর্মশাস্ত্রীয় কলহ’এর প্রচলিত ধারণা থেকে বাইরে এনে তিনি ঐ কলহের শ্রেণীগত শিকড় চেনালেন
এবং ঘটনাটিকে কৃষক-যুদ্ধের পটভূমিতে আনলেন। একই সঙ্গে ঐ যুদ্ধকে তিনি জার্মানির প্রথম
পূঁজিবাদী বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করলেন। অসফলতার কারণগুলো তিনি তাঁর সমকালীন পূঁজিবাদীদের
দোদূল্যমান ভূমিকার মত তাদের পূর্বপুরুষ, মধ্যযুগের সম্পদশালী নগরবাসীদের দোদূল্যমান
ভূমিকায় দেখালেন। অত আগের বিপ্লবের চরিত্র যে পূঁজিবাদী হতে পারল, সেটা ঐ নগরবাসীদের
থাকার কারণে নয়, কৃষকদের দাবি সামন্ত-বিরোধী হওয়ার কারণে। প্রবন্ধটি নিজের সময়ের বিপ্লবকে
একটি জাতীয় ধারার সঙ্গে জুড়ল, আধুনিক সর্বহারাকে একটি বিপ্লবী উত্তরাধিকারের সঙ্গে
জুড়ল, এবং আগামী দিনে, সমাজবাদী বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক ও কৃষকের বন্ধুত্বের
ধারণাটিকে সম্ভাবিত করল।
এই পত্রিকাতেই মার্ক্সের সুপরিচিত প্রবন্ধ
‘ফ্রান্সে শ্রেণীসংগ্রাম
১৮৪৮-৪৯’ প্রকাশিত হয়েছিল।
উপরোক্ত দীর্ঘ প্রবন্ধ বাদে ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং পলিটিশ্-একোনমিশ রেভ্যু’এ আগে থেকে চলতে থাকা লড়াইগুলোরও ধারাবাহিকতা
ছিল। দুজনে বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং পুস্তিকার সমীক্ষা লিখতেন। তিনটে দিক থাকতো সে সমীক্ষাগুলোর।
বিগত বিপ্লবের বিশ্লেষণ বা অন্যান্য ভাবনার মাধ্যমে পাতি-পূঁজিবাদীদের শ্রেণীগত প্রভাব
বাড়াবার চেষ্টার ওপর আঘাত; কাছের লোক হোক বা দূরের, চক্রান্তধর্মী এবং মৌলবাদী গতিবিধির
তীব্র সমালোচনা; গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠিত বিদ্বানদের (যেমন টমাস কার্লাইল, খ্যাতনামা
ঐতিহাসিক) পূঁজিবাদের প্রতি এবং বিপরীতে জনগণের বিপ্লবী ক্রোধের প্রতি বদলাতে থাকা
মনোভাবের পর্দা ফাঁস।
এই সব ভাবধারাগত সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবে
ঐসব নেতৃত্বের প্রভাব থেকে আলাদা একটি সর্বহারা পার্টি গঠন করার আবশ্যকতা আগে থেকেই
বিদ্যমান ছিল। তার জন্য ‘কম্যুনিস্ট লীগ’কে পুনর্গঠিত করা দরকার। জার্মানির বিভিন্ন
শহরে এবং বিভিন্ন দেশে নিবাসী জার্মান রাজনৈতিক উদ্বাস্তুদের মাঝে সেই বার্তা নিয়ে
যাওয়ার জন্য এক বার্তাবাহকের প্রয়োজন। বার্তা হিসেবে মার্ক্স-এঙেলস লিখলেন ‘কম্যুনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্বোধন’। এই সম্বোধন এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। পাঁচটি
বিষয়বিন্দু আগামী দিনের মতাদর্শগত বিতর্কের অক্ষ তৈরি করল। (১) ১৮৪৮-৪৯ সালের বিপ্লবের
সময়কাল পার হয়ে গেছে; আসন্ন বিপ্লবের জন্য এখন মতাদর্শগত, সংগঠনগত প্রস্তুতির সময় তাই
সর্বহারার স্বতন্ত্র পার্টিনির্মাণ আশু কার্যভার। (২) তার জন্য ‘লীগ’এর সাথীদের একজোট করতে হবে, নতুন নেতৃত্বের নির্মাণ করতে হবে, এবং
ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে তার জন্য সবচেয়ে ভালো ভাবধারাগত ভিত্তি প্রদান করবে ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’। (৩) বিগত বিপ্লবে উদারপম্থী পূঁজিবাদীরা
জনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীল
শক্তিগুলোর সঙ্গে শুধু যে হাত মিলিয়েছে তা নয়, রাষ্ট্রশক্তিই আবার তাদের হাতে ফিরিয়ে
দিয়েছে। (৪) বিগত বিপ্লবে যাদের মধ্যে বিপ্লবী ক্রোধ সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল, পাতি-পূঁজিবাদী
এবং ধনবান নগরবাসী, যারা এখন দেখতে প্রায় সমাজবাদীদের মত, আগামী দিনের বিপ্লবে তারাও
উদারপন্থী পূঁজিবাদীদের মত সর্বহারা এবং সাধারণ শ্রমজীবীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে,
বরং আরো বিপজ্জনক প্রমাণিত হবে। (৫) তাই, সর্বহারার স্বতন্ত্র পার্টি হবে, যে পার্টি
প্রজাতন্ত্র এবং গণতন্ত্র অর্জন করার সংগ্রামে পাতি-পূঁজিবাদীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ
করবে, বরং তার বেশি – তাদের ওঠানো বিষয়গুলোকে
বৈপ্লবিক পদ্ধতিতে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার লড়াই লড়বে, যত দূর সম্ভব নিজেদের বিষয়গুলোকে
এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং নিজেদের সমঝদারিকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা চালাবে; একই সঙ্গে,
নিজেদের স্বার্থগুলো রক্ষা করবে, নিজেদের দাবিগুলো অর্জন করার জন্য স্বতন্ত্র সংগ্রাম
চালিয়ে যাবে – সর্বহারা শ্রেণী
এবং তার স্বতন্ত্র পার্টির যুদ্ধ-ঘোষণা হবে, ‘স্থায়ী বিপ্লব’।
লন্ডন এবং পুরো ইংল্যান্ডে যত বৈঠক বা সভা
হত, সেসবে এঙ্গেলসই বেশি বলতেন কেননা তখনও মার্ক্সের ইংরেজি ভালো হয় নি। চার্টিস্ট
খবরের কাগজগুলোতে তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকার কারণে চার্টিস্ট নেতাদের ওপরও
তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব পড়ছিল, সেটা দেখা যেত কাগজগুলোয় প্রকাশিত অন্যান্য লেখায়।
‘কম্যুনিস্ট পার্টির
ঘোষণাপত্র’এর প্রথম ইংরেজি
অনুবাদ একজন চার্টিস্টই করেছিলেন। ১৮৫০এ প্রকাশিত সেই অনুবাদেই, অনুবাদক চার্টিস্ট
নেতা হার্নি ভূমিকায় প্রকাশ করেছিলেন যে এই গুরুত্বপূর্ণ দলিল রচনা করেছেন মার্ক্স
এবং এঙ্গেলস।
কিন্তু ‘লীগ’এর ভিতরে কলহ বাড়ছিল।
বিপ্লবের সময় পেরিয়ে গেছে এটা মানতে কয়েকজন তৈরি ছিলেন না। তাঁরা অবিলম্বে বিপ্লবী
সক্রিয়তা এবং তার জন্য সেই পুরোনো চক্রান্তধর্মী পথের পক্ষে ছিলেন। আলাদা করে সর্বহারা
পার্টি বানানোরও তাঁরা বিরোধিতা করছিলেন। ঐক্য ধরে রাখার সব চেষ্টা বিফলে গেল। লন্ডনের
বদলে জার্মানির কোলোন শহরে কেন্দ্রীয় সমিতি করলেন মার্ক্স-এঙ্গেলস যাতে তাঁদের পক্ষের
এবং বিরোধী পক্ষের, দুদলেরই প্রতিনিধিত্ব থাকে। বৈঠকে সংখ্যালঘু প্রমাণিত হয়েও বিরোধী
পক্ষ ‘লীগ’এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাজ করতে লাগল। বিভিন্ন
জার্মান উদ্বাস্তু সংগঠনে, যেখানে পাতি-পূঁজিবাদীদের আধিপত্য ছিল, মার্ক্স-এঙ্গেলসকে
বিচ্ছিন্ন করা শুরু হল। অবশেষে তাঁদের বাধ্য হয়ে পদক্ষেপ নিতে হল। এক সময়কার ঘনিষ্ঠ
সাথী উইলিচ আর শ্যাপারকে মার্ক্সের সুপারিশে নিষ্কাশিত করল কোলোনের কেন্দ্রীয় কমিটি।
ওদিকে ঐ বিরোধী দলটির অসাবধানতায় কিছু দলিল জার্মান পুলিস এবং লন্ডন পুলিসের হাতে চলে
এল। মার্ক্স-এঙ্গেলস পুলিসের নজরে চলে এলেন।
দুজনেরই মনে অধ্যয়ন করার ইচ্ছা। কিন্তু কিভাবে?
বাঁচা কঠিন হয়ে পড়ছে। লেখা এবং বই প্রকাশিত হওয়ার এবং তা থেকে কিছু উপার্জন হওয়ার সম্ভাবনা
প্রায় শূন্য। চার্টিস্ট বা সেধরণের খবরের কাগজ তো পয়সা দিতে পারে না। মার্ক্স এবং তাঁর
পরিবার অর্থকষ্টেই ছিলেন। এঙ্গেলস কয়েকটি ভাষা জানতেন এবং ভালো সাংবাদিক ছিলেন, তাই
পয়সা-দেওয়া খবরের কাগজগুলোতে লিখে কিছু উপার্জন করে নিতেন। একলা মানুষ। কিন্তু মার্ক্স
এবং মার্ক্সের পরিবারও তো তাঁর পরিবার! সাধারণ গরীব জার্মান উদ্বাস্তুদের শেষ অব্দি
যে ধরণের জীবনযাপন করতে হচ্ছে সে দুস্থতা থেকে মার্ক্সকে বাঁচাতে হবে, এঙ্গেলস ভাবতে
শুরু করেছিলেন। তার এখন অনেক কিছু করবার আছে নতুন! যে দুনিয়াটা আসছে তার জন্য। সেই
দুনিয়া যে আনবে সেই সামাজিক শক্তিটার জন্য! এঙ্গেলস জানতেনও না যে বার্লিন পুলিসের
অধ্যক্ষ হিঙ্কেল্ডেও, ১৮৫২র এপ্রিলে পাঠানো তার প্রতিবেদনে (নিজের বিচ্ছিরি ভাষাতেই
সই) লিখবে যে মার্ক্স আর এঙ্গেলসের পার্টি, অন্যান্য সব প্রবাসী দলগুলো থেকে যে “জ্ঞানে ও প্রাণে অনেক বেশি শক্তিশালী, তা প্রশ্নাতীত।
… মার্ক্স নিজে একজন
সুপরিচিত ব্যক্তি এবং সবাই জানে যে বাকি ভীড়ের মগজে যতটা বৌদ্ধিক শক্তি আছে, তার বেশি
ওর আঙুলের ডগায় আছে।”
এঙ্গেলসের পরিবারে তাদের বড় ছেলের খবর পৌঁছেই
যেত বিভিন্ন মাধ্যমে। এ খবরও তারা পেয়ে গেল যে ফ্রেডরিক আর্থিক সঙ্কটে আছে। জার্মানিতে
সে আসবে না। লন্ডনে থাকাও কঠিন হতে থাকবে। জীবনীলেখক গুস্তাভ মেয়ার বলেন যে মা, বাবার
স্বীকৃতি নিয়ে এঙ্গেলসের সবচেয়ে কাছের বোনটার মাধ্যমে বার্তা পাঠালেন যে ফ্রেডরিকের
লন্ডনে থাকা উচিৎ নয়। কেননা লন্ডন সব রাজনৈতিক নির্বাসিতদের মেলামেশার জায়গা। বরং সে
অন্য কোথাও চলে যাক।
“আমরা ভাবছি, আপাততঃ
কিছু দিনের জন্য তো তুমি পারিবারিক ব্যবসায় ঢুকতেই পারো, মন দিয়ে কাজ করবে, তোমার একটা
আয় সুনিশ্চিত হবে। যখনই নিজের পার্টির সাফল্যের যুক্তিপূর্ণ সুযোগ দেখবে, তখনই এই ব্যবসা
ছেড়ে নিজের পার্টির জন্য কাজে লেগে যেতে পারবে!”
এই চিঠি পাওয়ার আগেই এঙ্গেলস মনস্থির করে নিয়েছিলেন।
গুস্তাভ মেয়ার তো এমনটাও লেখেন যে “আবার বিপ্লবী কার্যকলাপ শুরু করতে যাতে অসুবিধা হয় সেই উদ্দেশ্যে
এঙ্গেলসের বাবা” এঙ্গেলসের জন্য
“কলকাতায় একটা কাজ
খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এঙ্গেলস বরং নিউইয়র্ক চলে যেতেন, কেননা তাহলে মার্ক্স
তাঁর সঙ্গে যেতেন। যাক, ভালো হল, দুটো পরিকল্পনাই বিফল হল।”
বোন মেরি লিখিত উপরোক্ত চিঠিতে কোনো স্পষ্ট
প্রস্তাব ছিল না যে এঙ্গেলস যেন ম্যাঞ্চেস্টারে অবস্থিত এর্মেন অ্যান্ড এঙ্গেলসেই যোগ
দেন। এঙ্গেলসেরও কোনো এমন চিঠি নেই যে তিনি মাত্র কিছুদিনের জন্য পারিবারিক ব্যবসায়
যোগ দেওয়ার শর্ত রাখছেন। কিন্তু প্রতীত হয় যে কোনো না কোনো মাধ্যমে এ ধরণের কথাবার্তা
হয়ে থাকবে, এবং কিছু শর্তও নির্ধারিত হয়ে থাকবে যার আভাস পরবর্তী ঘটনাক্রমে পাওয়া যায়।
১৮৫০ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি এঙ্গেলস ম্যাঞ্চেস্টারে
চলে গেলেন এবং এর্মেন অ্যান্ড এঙ্গেলসে একজন কেরানি হয়ে যোগ দিলেন। তাঁর যাওয়ার দু-চার
দিন পরেই ১৯শে নভেম্বরে, লন্ডনে মার্ক্স ও জেনির এক বছরের ছেলে হাইনরিখ গুইদোর মৃত্যু
হল হঠাৎ। পুরো পরিবার, শোকস্তব্ধ জেনি এবং মার্ক্স, এমন একটা সময়ে এঙ্গেলসের অনুপস্থিতি
অনুভব করছিলেন।
ম্যাঞ্চেস্টারে জীবন
মেরি বার্ন্স
আলাদা থাকা মার্ক্স এবং এঙ্গেলস দুজনের জন্যেই
কষ্টের ছিল। মতাদর্শগত নির্ভরতা তো ছিলই, ঘনিষ্ঠতার আবেগ জড়িয়ে ধরেছিল সে নির্ভরতা।
মার্ক্সের সন্তানেরাও অপেক্ষা করত কখন এঙ্গেলস আসবেন ম্যাঞ্চেস্টার থেকে এবং তাদেরকে
গল্প শোনাবেন। জেনিও চাইতেন যতক্ষণ সম্ভব এঙ্গেলস থাকুন, রোজকার দুস্থতায় হয়রান জীবন
থেকে কিছুক্ষণের জন্য মানসিক নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে – শিশুদের মন বদলাবে,মার্ক্সের অস্থিরতা কমবে আর জেনিও একজন সাচ্চা
বন্ধু পাবেন যার সঙ্গে প্রয়োজনে গেরস্থালির সমস্যাগুলো নিয়েও খোলাখুলি আলোচনা করা যায়।
মার্ক্স তো এঙ্গেলস এলেই প্রায় নিজের ঘরে বন্দী করে নিতে চাইতেন আর তারপর কথোপকথনের
তোড় শুরু হয়ে যেত। একসাথে কাজ করার পরিকল্পনা তৈরি হত, নিজেদের আধলেখা প্রবন্ধ বা মন্তব্য
দেখিয়ে অভিমত চাওয়া হত, সংগঠনগুলোর অবস্থা নিয়ে আলোচনা হত, সর্বহারা পার্টি নির্মাণের
সমস্যা আসত … কত কত বিষয় থাকত
কথা বলার! দুজনে বেড়াতে যেতেন রাস্তায়। ফিরে এসে বই আর পত্রপত্রিকার পাহাড়ে ভরা ঘরটায়
একে অন্যের বিপরীতে কোনাকুনি হাঁটতেন, যাতে হাঁটার জায়গাটা বেশি হয়। পুরোনো বন্ধু আর
চার্টিস্ট সাথীদের সঙ্গে দেখাও হয়ে যেত এঙ্গেলসের, লন্ডনে এলে।
কিন্তু থাকতে তো হত ম্যাঞ্চেস্টারেই। আর দিনভর
সেই কম্পানির দপ্তরে, এঙ্গেলসের ভাষায় ‘বেনিয়াগিরি’ করতে হত। তবে একটা ঘটনা ঘটেছিল। যে কারণে পরিবার-সম্পর্কিত জটিলতাগুলো
কম হয়েছিল। এঙ্গেলসের বাবা পুরোপুরি পেশাদার শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি একেবারেই
সহ্য করতে পারতেন না যে তাঁর কাজের জায়গায় কোনো কর্মচারি, সে হোক না তাঁর ছেলে, ঢিলেমি
করুক। তাঁর মাথায় যেহেতু বসে ছিল যে ছেলে বিপথে গেছে, তাই তাকে একেবারেই ভরসা করতেন
না। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে ম্যাঞ্চেস্টারের কারখানাতে ফ্রেডরিক অফিসে কাজের নামে
ফাঁকি দিয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে। ওদিকে ছেলের অভ্যাস ছিল যে কোনো কাজ, ইচ্ছেয় হাতে নেওয়া
হোক বা অনিচ্ছেয় ঘাড়ে এসে পড়ুক, একনিষ্ঠ মনোযোগ সহকারে করার। যখন মাথাটা স্থির করে
নিল যে এখন, বোধহয় এক দীর্ঘ সময়ের জন্য তাঁর, প্রতিদিন সকালে এই কাপড়ের কারখানার দপ্তরে
বসে হিসেব লেখাটাই আগামী বিপ্লবের স্বার্থে জরুরি, প্রথম দিন থেকেই তিনি কাজটা মন দিয়ে
করা শুরু করে দিলেন। কিছুদিন পর, কম্পানির অবস্থা-সংক্রান্ত কয়েকটি রিপোর্ট বাবাকে
পাঠালেন। সেই প্রতিবেদনগুলো দেখে বাবা অবাক হলেন এবং খুব খুশি হলেন। ছেলেকে চিঠিতে
যা লিখলেন তার সহজ অর্থ এখন আমি তোমার ওপর ভরসা করি যে তুমি আমার সঠিক প্রতিনিধি। আমি
চাই তুমি ওখানেই থাকো আর পারিবারিক ব্যবসার দেখাশোনা কর।
কয়েক মাস পর তিনি নিজেই ম্যাঞ্চেস্টারে আসার
পরিকল্পনা করলেন। মা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এঙ্গেলসকে লিখে পাঠালেন যে সে যেন যেটুকু দরকার
সেটুকুই বাবার সঙ্গে থাকে আর রাজনীতির কথা যেন একেবারেই না তোলে। এঙ্গেলস তাই করছিলেন
কিন্তু বাবা থামলে তবে তো! এঙ্গেলসের সামনেই প্রুশীয় সরকারের শাসনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ
হয়ে উঠলেন। এঙ্গেলস ভিতরের রাগ চেপে চুপচাপ বসে রইলেন। পরে মার্ক্সকে লিখলেন, “দুটো কথা বলতাম আর ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর দিকে তাকাতাম!
ব্যস, তাঁর মুখ বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু আমাদের সম্পর্কও চিরদিনের জন্য বরফ হয়ে যেত। … যদি আমার আয়ের ব্যবহারিক দিকটা না থাকত, তাহলে
এই সব ফালতু স্নেহ, মমতার সম্পর্কের বদলে তেমনই ঠাণ্ডা ব্যবসায়িক সম্পর্ক পছন্দ করতাম।”
আয়ের প্রসঙ্গটার গূঢ়ার্থ এই যে উনি ম্যাঞ্চেস্টারের
কম্পানিটায় কেরানি হয়ে বেতনের বিনিময়ে কাজ করে যেতে চাইছিলেন না। উনি চাইছিলেন তাঁকে
জার্মান অংশীদার কম্পানির প্রতিনিধি করা হোক। তাহলে নিজের কাজের জন্য তিনি বেশি সময়
পেতেন। সে প্রস্তাব বাবা পরে মেনে নিলেন। এঙ্গেলস মার্ক্সকে লিখলেন, “কমসে কম তিন বছরের জন্য উনি আমায় এখানে রাখতে
চান। … তিন বছরের জন্যও
আমি এখানে কোনো বন্ধনে নেই। আমার লেখা নিয়ে বা বিপ্লব শুরু হয়ে গেলেও আমার এখানে থাকা
নিয়ে কোনো বাধানিষেধ নেই। … প্রতিনিধিত্ব এবং
বিনোদন ব্যয়ের নামে প্রথম থেকেই উনি আমাকে বার্ষিক প্রায় তিনশো পাউন্ড দিতে রাজি হয়েছেন।” এঙ্গেলস জানতেন না যে তিন কেন, আঠেরো বছর
তাঁকে ম্যাঞ্চেস্টারে কাটাতে হবে।
ম্যাঞ্চেস্টারে এসেই এঙ্গেলস মেরি বার্ন্সের
সঙ্গে দেখা করেছিলেন। একদিকে জার্মানিতে প্রতিবিপ্লবের পর্ব, অন্যদিকে লন্ডনে আর্থিক
অভাবের কারণে দুই বন্ধুর একসাথে কাজ না করতে পারা, তৃতীয়তঃ এই অবস্থা যে অর্থ উপার্জনের
জন্য প্রতিদিনকার গোলামির সেই শিকলটাই পরা যেটা থেকে ভেবেছিলেন মুক্তি পেয়ে গেছেন আট
বছর আগে … এই কষ্ট, অবসন্নতা
আর একাকীত্বে তাঁর একমাত্র সহায় ছিল মেরির ভালোবাসা।
বন্ধু কার্ল মার্ক্স এবং তাঁর আচরণে একটা পার্থক্য
ছিল। মার্ক্সের পুরো ব্যক্তিত্বে, আবিষ্কৃত নতুন যুগদৃষ্টিটাকে বিকশিত করার, মূর্তরূপে
আনার অস্থিরতা ভরা থাকত সব সময়। সেটা না করতে পারলে যেন শিশুর মত অসহায় হয়ে পড়তেন।
বন্ধুকে খুঁজতে থাকতেন। তাঁর ডাকনাম ‘মুর’ শুধু চেহারার দিক
থেকে নয়, মনোভাবের দিক থেকেও যথাযথ ছিল। অন্যদিকে, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, যুদ্ধক্ষেত্রে
হোক বা লেখার টেবিলে, যে কাজটা ভেবেছেন সেটা করার সময় ঠিক তেমনভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন
যেমন মার্ক্স, মানসিক শক্তি ও দক্ষতায় বন্ধুরই মত শীতল থাকতেন, কিন্তু কোনো কারণে কর্মভার
থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য হলে, অস্থির না হয়ে শান্ত ও মুক্ত-চিত্ত থাকার চেষ্টা করতেন।
বিভিন্ন নতুন নতুন বিষয় পড়া, নতুন ভাষা শেখা, ঘুরে বেড়ানো, মানুষের সঙ্গে কথা বলা … এই সব ব্যস্ততায় থেকে কাউকে নিজের কষ্টের
দিকে চোখ ফেলতে দিতেন না। দু’বছর আগে প্যারিস থেকে সুইটজারল্যান্ড হেঁটে হেঁটে পাড়ি দেওয়ার সময়
মনের অবসন্নতা কাটাতে ঢুকে যেতেন গ্রাম্যজীবনে, ফূর্তিতে মেতে উঠতেন। মার্ক্স বন্ধুর
এই মনোভাবটা জানতেন। তাই চিঠিতে অনবরত ঢালতেন বন্ধুত্বের উষ্ণতায় ভরা শব্দ, আর লেখার
জন্য চাপ থাকত প্রতিটি চিঠিতে। সেই চিঠিগুলোর সাহায্যেই এঙ্গেলস নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন
আর কাজের জগতে ফিরে এসেছিলেন।
মেরি বার্ন্স একজন আইরিশ শ্রমিক ছিলেন। লেখাপড়া
শেখেন নি; এঙ্গেলসের জীবনীলেখকেরা বলেন যে অত্যধিক মদ খাওয়ারও অভ্যেস ছিল। কথাবার্তা
তথাকথিত ভদ্রজনোচিত ছিল না। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস দুজনেই জন্মসূত্রে পূঁজিবাদী ছিলেন
কিন্তু বিপ্লবী চিন্তাভাবনা এবং সর্বহারার বিপ্লবী সংগ্রামে যুক্ত থাকার মাধ্যমে সর্বহারার
সাথী হয়েছিলেন। মার্ক্সের স্ত্রী-ও জন্মসূত্রে পূঁজিবাদী ছিলেন। কিন্তু মেরি জন্মসূত্রে
সর্বহারা ছিলেন। কখনো কারখানায়, কখনো বাড়িতে কাজ করতেন, শ্রমিকদের পাড়ায় ভাড়ার ঘর নিয়ে
থাকতেন। শ্রমিকদের লড়াই এবং আইরিশ স্বাধীনতার প্রতি দায়বদ্ধ এক দৃঢ়সংকল্প বিপ্লবী এবং
স্বাভিমানী, মুক্ত চিন্তার নারী ছিলেন। এঙ্গেলসেরও মেরির এই মনোভাবটাই ভালো লেগেছিল।
আট-নয় বছর আগে যখন ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীর
অবস্থা’ লেখার জন্য তিনি
ম্যাঞ্চেস্টারের শ্রমিক পাড়ায় থাকা, শ্রমিকদের বোঝা শুরু করেছিলেন তখন থেকে মেরি তাঁর
সহচর। দুজনেই একে অপরকে ভালোবেসেছিলেন। মাঝে আরো একবার একসঙ্গে হয়েছিলেন যখন মার্ক্স-এঙ্গেলস
দুজনেই কয়েক সপ্তাহের জন্য চ্যাটহ্যাম গ্রন্থাগারে লেখাপড়া করতে এলেন। সেবার মেরি এঙ্গেলসের
সঙ্গে ব্রাসেলসেও গিয়েছিলেন। এবার এঙ্গেলস ম্যাঞ্চেস্টারে এসেই মেরির বাড়িটাকে নিজের
আশ্রয় বানিয়ে নিলেন।
বলতে গেলে তাঁর দুটো ঠিকানা হল। একটা ভাড়া
বাড়ি নিলেন মধ্যবিত্ত পাড়ায়। সেখানে তখন চলে আসতেন যখন ব্যবসা-সম্পর্কিত মানুষজনের
সঙ্গে দেখা করতে হত বা পরিবারের কেউ দেখা করতে আসত। একে বসে লেখালিখি করার জন্যেও চলে
আসতেন। বাকি সময় শ্রমিক পাড়ায় মেরি এবং তার বোন লিডিয়ার ঘরে থাকতেন। তাঁর এই বাড়িটার
কথাই ম্যাঞ্চেস্টারে তাঁর বিপ্লবী বন্ধুরা জানতেন। এঙ্গেলসের সঙ্গে দেখা করতে কথা বলতে
তাঁরা এখানেই আসতেন। মেরি ও লিডিয়াকে নিজেদের বন্ধু, কমরেড মনে করতেন তাই কোনো ধরণের
গোপন আলোচনায় তাদের উপস্থিতি বা অংশগ্রহণ বাধা সৃষ্টি করত না। মেরিকে তাঁরা শ্রীমতী
এঙ্গেলস রূপেই চিনতেন এবং সেভাবেই সম্বোধন করতেন। যদিও এঙ্গেলস এবং মেরি কখনও পূঁজিবাদী
নিয়মানুসারে ধার্মিক রীতিতে বিয়ে করেন নি। সেখানে খাওয়াদাওয়ার খরচও কম ছিল, সস্তা রুটি,
সস্তা মাংস, সস্তা মদ – সপ্তাহের শেষে বেশি
পয়সা বাঁচত পকেটে মার্ক্সকে পাঠানোর জন্য।
লন্ডনে শেষের মাসগুলোয় খুবই কষ্টে কেটেছিল।
‘ন্যু রাইনিশে জাইটুংঃ
পলিটিশ্-একোনমিশ রেভ্যু’ বন্ধ করতে হয়েছিল।
এঙ্গেলসের ম্যাঞ্চেস্টারে আসার পর আর্থিক অবস্থা একটু ভালো হল। কয়েক মাস পর, ১৮৫১ সালের
গ্রীষ্ম শুরু হতে হতে মার্ক্সের কাছে, ‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য চার্লস ডানার বার্তা এল। চার্লস ডানা নিজেও
আগে কল্পলৌকিক সমাজবাদী ছিলেন। ১৮৪৮ সালের জার্মান বিপ্লবের সময় তিনি কোলোন গিয়েছিলেন
এবং মার্ক্সের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বার্তায় তিনি মার্ক্সকে খবরের কাগজটির স্থায়ী লন্ডন
সংবাদদাতা হওয়ার প্রস্তাব দিলেন। অভাবের সংসারে মার্ক্সের জন্য প্রস্তাবটা ভালো ছিল।
কিন্তু দুটো সমস্যা ছিল – এক, তাঁর ইংরেজি
তখনও ভালো হয় নি আর দুই, ধীরে ধীরে অর্থশাস্ত্রের অধ্যয়নে ঢুকতে শুরু করেছিলেন। তবুও,
এঙ্গেলসের ভরসায় তিনি প্রস্তাবটা স্বীকার করে নিলেন। এঙ্গেলসকে অনুরোধ করলেন যাতে এঙ্গেলস
নিয়মিত ঐ খবরের কাগজের জন্য প্রবন্ধ, প্রতিবেদন ইত্যাদি লিখে পাঠান। নাম মার্ক্সের
থাকবে। দৈনন্দিনে অভাবের একটা সুরাহা হবে। চিঠিতে একটা বিষয়ও বললেন, জার্মানিতে বিপ্লব
এবং তারপর প্রতিবিপ্লবের পর্ব। এঙ্গেলস বিষয়টির জ্ঞাতা তো ছিলেনই। ‘ন্যু রাইনিশে জাইটুং’এর পুরোনো সংখ্যা এবং অন্যান্য সামগ্রীও তাঁর
কাছে ছিল। কাজেই লেখা শুরু করে দিলেন।
আগস্ট ১৮৫১ থেকে সেপ্টেম্বর ১৮৫২ অব্দি ১৯টা
লেখা ‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এ ছাপল। স্থায়ী লন্ডন সংবাদদাতা রূপে পাঠানো
প্রতিটি লেখায় মার্ক্সের স্বাক্ষর থাকত। তাঁরই নামে ছাপত। পঁয়তাল্লিশ বছর পর যখন মার্ক্সের
ছোট মেয়ে ইলিয়ানর মার্ক্স-এভলিং ঐ ধারাবাহিক লেখাগুলোকে আলাদা একটা বই করে ছাপালেন,
তিনিও জানতেন না ওগুলো এঙ্গেলসের লেখা। মার্ক্সের নামেই সে বইয়ের জার্মান অনুবাদও ছাপা
হল। শেষে, ১৯১৩ সালে যখন মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের চিঠিপত্র প্রকাশিত হল, তখন জানা গেল
যে ঐ লেখাগুলো এবং তার পরেরও অনেক প্রবন্ধ, প্রতিবেদন বাস্তবে এঙ্গেলসের লেখা। ঐ উনিশটি
ধারাবাহিক লেখা এখন এঙ্গেলস লিখিত গ্রন্থ রূপে ‘জার্মানিতে বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব’ নামে প্রাপ্য।
‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এর সঙ্গে মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের সম্পর্ক আগস্ট
১৮৫১ থেকে মার্চ ১৮৬২ অব্দি প্রায় এগারো বছর ছিল। প্রথম প্রথম সবগুলো এঙ্গেলস হয় নিজে
লিখতেন নয়তো মার্ক্স জার্মানে লিখলে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিতেন। ১৮৫৩র জানুয়ারি থেকে
মার্ক্স নিজেও ইংরেজিতে লিখতে শুরু করলেন। তারপর থেকে আলাদা আলাদা বিষয়ে দুজনের লেখা,
কাগজটায় ছাপতে লাগল।
‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এ ১৮৫৩ সালের ৭ই এপ্রিল একটি গুরুত্বপূর্ণ
প্রবন্ধ ছেপেছিল। সেটির সংক্ষিপ্ত বিজ্ঞাপনে কাগজের তরফ থেকে “সংবাদদাতার অদ্বিতীয় ক্ষমতা”র প্রতি “সম্মান” ব্যক্ত করা হয়েছিল, লেখা হয়েছিল “মিস্টার মার্ক্সের নিজস্ব অনেক সুনিশ্চিত অভিমত
আছে, তার কয়েকটি মানতে আমরা কিছুতেই রাজি নই, কিন্তু যাঁরা তাঁর নিবন্ধ পড়বেন না, তাঁরা
বর্তমান ইয়োরোপীয় রাজনীতির বড় প্রশ্নসমূহ সম্পর্কিত তথ্যাদির সবচেয়ে শিক্ষাপ্রদ উৎসগুলোর
মধ্যে একটির উপেক্ষা করবেন।” এই প্রশংসাবাক্যগুলো মার্ক্সের উদ্দেশ্যে হলেও কৃতিত্ব এঙ্গেলসেরই।
১লা জুলাই ১৮৫৩য় চার্লস ডানাও মার্ক্সের স্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে তাঁর স্বামীর
লেখা, ‘ট্রিবিউন’এর মালিক এবং পাঠক, দু’তরফেই উৎকৃষ্ট বলে সমাদৃত। এ প্রশংসাও প্রধানতঃ
এঙ্গেলসেরই প্রাপ্য।
এগারো বছরে দুজনে আমেরিকার খবরের কাগজটায় অনেক
প্রবন্ধ/প্রতিবেদন লিখেছিলেন। মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্র অনুসারে তাঁদের লেখাগুলো “বিভিন্ন দেশের আন্তরিক নীতি, বিদেশ নীতি, শ্রমিক
শ্রেণীর আন্দোলন, ইয়োরোপীয় দেশগুলোর আর্থিক উন্নয়ন, ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ, উৎপীড়িত
ও পরাধীন দেশসমূহের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন” ইত্যাদি বিষয়ে হত।
যদিও সবাই জানেন, তবুও উল্লেখ্য যে এই রচনা-শৃংখলাতেই
১৮৫৭-৫৮ সালে বিশ্ব ভারতের বিষয়ে সেই আলেখ্য ও প্রতিবেদনগুলো পেল, যাতে প্রথম বার উনিশ
শতকের সবচেয়ে বড় সামরিক গতিবিধি, সমকালীন ভারতীয় যুদ্ধকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রাম’ নামে অভিহিত করা হল। ভারত-সম্পর্কিত
প্রতিবেদন-শৃংখলায় এঙ্গেলসের ছিল এগারটি যা পরে চেনা গেছে। এমনিতেও, বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে হতে থাকা সৈন্য-সংক্রান্ত ঘটনাবলীর
ওপর লিখতে হলে এঙ্গেলস অপরিহার্য ছিলেন।
ম্যাঞ্চেস্টারে, মার্ক্সের থেকে বিচ্ছিন্ন
সারা দিন বাণিজ্যিক দপ্তরে ব্যস্ত থেকে, বিকেলে বা সকালে ‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এর জন্য লেখা তৈরি করে সময় পেলে এঙ্গেলস অন্যান্য
ভাষা, বিশেষ করে রুশীয় ভাষা শিখতেন। মার্ক্সকে চিঠিতে লিখলেনও, যে আগামী বিপ্লবে পুরো
ইয়োরোপের ঘটনাবলি বোঝার জন্য এবং তাতে হস্তক্ষেপ করার জন্য ইয়োরোপের সবক’টি ভাষা শিখে নেওয়া দরকার। এসবের পরেও যেদিন
সময় পেতেন, প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়, বিশেষকরে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র,
জীববিজ্ঞান ইত্যাদি অধ্যয়নে রত থাকতেন।
অনেক বছর পর স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে ইলিয়ানর
মার্ক্স-এভলিং লিখেছিলেন, “ভাবতেও ভয়ানক যে
এঙ্গেলসের মত মানুষ কুড়িটা বছর ঐভাবে কাটিয়ে দিলেন! কখনো নালিশ করলেন না, মুখ থেকে
একটা শব্দ বেরুল না! বরং তার উল্টোটা দেখত সবাই। এত খোশমেজাজ এবং নিজের কাজে এমন ডুবে
থাকতেন যে মনে হত তাবৎ দুনিয়ায় ‘দোকানে যাওয়া’, আর দপ্তরে বসার মত কোনো কাজ নেই!”
লেনিন লেখেন, “যদি এঙ্গেলসের নিঃস্বার্থ আর্থিক সাহায্য অনবরত
না পেতেন তাহলে মার্ক্স ‘পূঁজি’ তো পুরো করতে পারতেনই না, অভাবে ভেঙে পড়তেন
পুরোপুরি।”
উদীয়মান বিশ্ব
বন্ধুত্বের এক অমর কাহিনীতে মার্ক্সবাদী বিশ্বদৃষ্টির
সৃজন ও যাপন। মার্ক্সের জন্য অবিলম্বে সমকালীন আর্থিক ব্যবস্থাটির গঠনে প্রবেশ করা
জরুরি ছিল। যাতে যে আর্থিক শোষণের ফলে পূঁজিবাদী সমৃদ্ধি সংঘটিত হয়ে চলেছে তার সারতত্ত্বটা
আবিষ্কার ও প্রকাশ করতে পারেন। সর্বহারা একটি শ্রেণী যার শোষণ করছে পূঁজিপতি সেটা তো
সবাই দেখতে পাচ্ছে। এটাও সবাই দেখতে পাচ্ছে যে সর্বহারা একটি বিপ্লবী শ্রেণী কেননা
বিগত সবক’টি পূঁজিবাদী বিপ্লবে
সে-ই অগ্রবর্তী দল হয়ে থেকেছে প্রতিটি রণাঙ্গনে। পরে, প্রতিবিপ্লবী পর্বে তার লড়ে-পাওয়া-হকগুলোও
যে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং একাজে সে শ্রেণীও রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গ দিয়েছে যারা কাল পর্য্যন্ত
বিপ্লবী ছিল – পাতি-পূঁজিবাদী
এবং প্রজাতন্ত্রী পূঁজিবাদী – সে প্রসঙ্গ বিষয়ান্তর। প্রশ্ন হল – কেন প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন প্রধান দাবিতে
– মুক্তি, সাম্য,
ভ্রাতৃত্ব – সর্বহারা না মুক্তি
পায়, না সাম্য না ভ্রাতৃত্ব? এই তিনটে দাবিই পতাকায় লিখে তো সে গুলিবিদ্ধ হচ্ছে বিভিন্ন
দেশে! যখন পণ্যের উৎপাদনে এবং পণ্যের বাণিজ্যে তৈরি হয় ‘জাতির সম্পদ’, বিনিময়ের সাধারণ নিয়মানুসারে সব কিছু নিজের
দামে বিক্রি হয় তাহলে কিভাবে , কোন কারখানায় সমৃদ্ধি আর দারিদ্র্যের উৎপত্তি হয়? কোন
বিনিময়ে সমৃদ্ধি দিলে বদলে নিতে হয় দারিদ্র্য? এত লড়াকু শ্রেণী! তবু কেন মজুরি বৃদ্ধির
লড়াইয়ে, কাজের ঘন্টা কম করার লড়াইয়ে জয়লাভ করেও কিছুদিনের মধ্যে তাদের দুস্থতা আগের
মতই হয়ে যায়?
যে বস্তুবাদী দৃষ্টি তাঁরা অর্জন করেছিলেন
সে দৃষ্টি শাসক/শোষক অথবা অন্য কারোরই ইচ্ছা/ষড়যন্ত্র ইত্যাদিকে চূড়ান্ত উত্তর হিসেবে
গ্রহণ করতে অপারগ ছিল; চাইছিল মূল কারণ হিসেবে কোনো বস্তুগত ঘটনার প্রকাশ।
পূঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালীর ভিত্তিতে ছিল সেই
বস্তুগত ঘটনা। সেটা খোঁজার জন্য প্রয়োজন ছিল বিরামহীন অধ্যয়ন, যা মার্ক্স করছিলেন বাড়িতে
কিম্বা ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রন্থাগারে বসে। ইংল্যান্ডের কারখানা-সম্পর্কিত সংসদীয়
দলিলপত্রের নোট নিচ্ছিলেন, পূঁজিবাদী অর্থশাস্ত্রী, অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো
এবং অন্যান্যদের পড়ছিলেন। অর্থশাস্ত্রের ছাত্র তিনি ছিলেন না। কিন্তু যে নতুন দর্শন
অর্জন করেছিলেন তার সম্পূর্ণ সার্থকতা ছিল সমাজের সর্বাধিক বিপ্লবী শক্তির হাতে বিপ্লবের
চাবিকাঠি দেওয়াতেই – যে কোন ঘটনাটার
ঘটা বন্ধ করতে হবে, কোন ঘটনাটার বন্ধ হওয়ার মধ্যেই সমাজের বাস্তবিক, মুক্তি, সাম্য
এবং ভ্রাতৃত্ব নিহিত।
মার্ক্সকে এ কাজের জন্য মুক্ত রাখতে হবে। রাখতে
হলে এঙ্গেলসকে সারাদিন, শ্রমিকদের দুস্থ জীবন দেওয়া সেই পূঁজিবাদী কারখানারই দপ্তরে
‘মালিকের ছেলে’ হয়ে থাকতে হবে। বাণিজ্য দেখতে হবে, হিসাব
দেখতে হবে, সুট-বুট পরে নিজের ‘ঘোষিত’ বাড়িটিতে অথবা ক্লাবে
পূঁজিবাদী বেরাদরদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে, শেয়ারবাজারে যেতে হবে, তুলোর বাজারে
বা জাহাজঘাটার নীলামে যেতে হবে। কেননা নিজের জীবনের চেয়ে বেশি বন্ধু মার্ক্স এবং তার
পুরো পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জন করতে হবে। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যে পূঁজিবাদী খবরের
কাগজের জন্যও লিখতে হবে, কেননা তাতে পয়সা আসবে।
এত সব করার পর এঙ্গেলস চলে যেতেন নিজের পরিবারে,
অর্থাৎ শ্রমিক পাড়ায় তাঁর ‘অঘোষিত’ বাড়িতে, মেরি আর লিডিয়ার কাছে। তাদের সঙ্গে
এবং মাঝেমধ্যেই আসা বন্ধুদের সঙ্গে বসে খেতেন সস্তা মদ আর কালো রুটি।
বস্তুতঃ, ‘ঘোষিত’ বাড়িতেও সস্তা মদ আর কালো রুটিই থাকত। বাবা অথবা পরিবারের অন্য
কারোর আসার খবর পেলেই দামি মদ, খাওয়াদাওয়ার কিছু দামি জিনিষ এনে সাজিয়ে রাখতেন। কেননা
এ কথাটা লুকোনোরও থাকত যে তাঁর আয়ের একটা বড় অংশ লন্ডনে বন্ধুর পরিবারের জীবনধারণের
খরচ মেটাতে চলে যায়। কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে খবর পেয়েছেন আগামী বেশ কয়েক মাস বাড়ি
থেকে কেউ আসবে না, আসার নেই। সঙ্গে সঙ্গে ‘ঘোষিত’ বাড়িটা ছেড়ে একটু
সস্তা পাড়ায় অন্য একটা ঘোষিত বাড়ি নিয়ে ফেলেছেন। বাবার আসার সময় হলে আবার এক মাসের
জন্য ফিরে গেছেন দামি পাড়ার কোনো ঘরে।
সন্ধ্যেয় মেরির ঘরে বসে গল্প শুনতেন বন্ধুদের,
সাথীদের। আইরিশ স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ইংরেজ বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যেকার সম্পর্কগুলো
তাদেরকে বোঝাতে গিয়ে নিজেও আরো ভালো করে জাতীয় আত্মনির্ধারণের বিষয়টা বুঝতে পারতেন।
ঐ আড্ডায়ই জুটতেন উইলহেল্ম উল্ফ এবং কয়েকজন পুরোনো সাথী। তাঁরাও সেসময় ম্যাঞ্চেস্টারেই
থাকতে শুরু করেছিলেন। এ ধরণের মানুষদের বৈঠকের ওপর পুলিসের গুপ্তচরদের নজর থাকত বলে
পৌরনিগমের রেজিস্টারে মেরি বার্ন্সের বাড়িতে থাকা পুরুষের নাম বদলে বদলে লেখানো হত।
দুই বন্ধুর আলাদা থাকা শুরু হওয়ার পর প্রথম
বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে এল অক্টোবর ১৮৫২র কোলোন মামলা। কোলোন মামলা প্রুশীয় সরকারের ষড়যন্ত্র
ছিল। উদ্দেশ্য ছিল (১) জার্মানির বিপ্লবী ব্যক্তিদেরকে গুপ্তচরদের দেওয়া সূচি অনুসারে
বেছে বেছে গ্রেপ্তার করা; (২) তাদের কাছ থেকে
তথ্য নিয়ে নিজের চরদের ছদ্মবেশে, রাজনৈতিক অভিবাসী বানিয়ে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’ এবং বিশেষ করে ‘লীগ’এর সেই দলে ঢোকানো, যেটার বিষয়ে খবর আছে যে তাদের পথ পুরোনো ‘লীগ অফ দ্য জাস্ট’এর চক্রান্তধর্মী গুপ্তসংগঠনের পথ। (৩) সেই
সব চরকে দিয়ে সেই দলের দপ্তরে নকল কাগজপত্র রাখানো যাতে আদালতে ‘প্রমাণ’ করা যায় যে কম্যুনিস্টদের এই বিপ্লবী সংগঠন জার্মানির সরকারের
বিরুদ্ধে সক্রিয় দেশদ্রোহীদের জমায়েত, যাদের নেতাদের মধ্যে প্রমুখ কার্ল মার্ক্স এবং
ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। (৪) এই ভিত্তিতে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, অন্যান্য দেশ এবং বিশেষ করে
ইংল্যান্ডের সরকারের কাছে আপীল করা যে তারা যেন তাদের দেশে আশ্রয় নেওয়া সব জার্মান
অভিবাসীদের হয় নিজেদের উপনিবেশগুলোয় পাঠিয়ে দেয় অথবা জার্মানিকে দিয়ে দেয়।
প্রুশীয় রাজতন্ত্র জানত যে এই বিপ্লবী অগ্রগামী
শক্তিকে একবার ধ্বংস করতে পারলে রাজতন্ত্রের সমাপ্তির দাবি তো স্তব্ধ হবেই, রাজতন্ত্রেরই
ভিতরে সংবিধান চাওয়া বিপক্ষও শূন্য হয়ে যাবে।
‘লীগ’এর কেন্দ্রীয় কমিটি সে সময় কোলোনেই অবস্থিত
ছিল। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস ইংল্যান্ড থেকে সে কমিটিকে পরামর্শ দিতেন। আদালতে মামলা সাজানোর
জন্য মে-জুন ১৮৫২য় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ‘লীগ’এর আরো কয়েকজন সদস্যকে
কোলোনে গ্রেপ্তার করা হল। ইংল্যান্ডে জার্মান গুপ্তচরেরা মার্ক্স-এঙ্গেলসের ওপর নজরদারী
বাড়িয়ে দিল। সবচেয়ে আগে এঙ্গেলসই মার্ক্সকে সাবধান করলেন, “নিজের কাগজপত্রগুলো বাড়ির বাইরে কোনো সুরক্ষিত
জায়গায় রাখো। কিছুদিন ধরে আমার ওপর খুব কাছ থেকে নজর রাখা হচ্ছে। এক পা এগোতেই দু-তিনটে
চর পিছু ধরে। এখানে আমাদের থাকতে দেওয়া যে কত বিপজ্জনক তার গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা ব্রিটেনের
সরকারের কাছে করতে বুনসেন মহাশয়” [ইংল্যান্ডে প্রুশিয়ার রাজদূত] “পেছোবেন না”।
কিন্তু ‘লীগ’এর কেন্দ্রীয় কমিটির
এবং অন্যান্য গ্রেপ্তার সদস্যদের বিরুদ্ধে ১৮ মাস জোরদার তদন্ত চালিয়েও, এবং নিজেদের
চরদের মাধ্যমে নকল কাগজপত্র রাখিয়েও প্রুশীয় প্রশাসন মার্ক্স, এঙ্গেলস এবং অন্যান্য
বিপ্লবী সাথীদের কোনো চক্রান্তে লিপ্ত থাকার প্রমাণ ইংরেজ সরকারকে দেখাতে পারল না।
মার্ক্স-এঙ্গেলস কোলোনে গ্রেপ্তার সাথীদের
সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন এবং প্রুশীয় সরকারের ষড়যন্ত্র ফাঁস করার চেষ্টা করছিলেন, যদিও
ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের অধিকাংশ পূঁজিবাদী খবরের কাগজ তাদের বক্তব্য ছাপতে অস্বীকার
করেছিল।
লন্ডনে মার্ক্সের বাড়ি একটা পুরোদস্তুর দপ্তরে
পরিণত হয়েছিল যেখানে পুলিসকৃত জালিয়াতি এবং আদালতের কার্যকলাপে হতে থাকা জোচ্চুরির
বিরুদ্ধে প্রমাণ একত্র করা হত। তারপর সে প্রমাণ জার্মানিতে, গ্রেপ্তার সাথীদের উকিলের
কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হত। সেসব দিনের কথা জেনি মার্ক্স লিখিত একটি চিঠিতে পাওয়া
যায়। এডলফ ক্লসকে লিখছেন, “আপনি কল্পনা করুন
যে ‘মার্ক্সের দল’ কিভাবে সক্রিয় রয়েছে দিনরাত! যতটা মাথা দিয়ে,
ততটাই তারা হাত আর পা দিয়েও কাজ করতে বাধ্য … পুলিসের সমস্ত অভিযোগ মিথ্যে … সমস্ত কিছু এত ভীতিজনক … জালিয়াতির সমস্ত প্রমাণ এখান থেকেই পাঠানোর ছিল … তারপর সমস্ত কাগজ ছয় বা আট কপিতে আঁকাবাঁকা
রাস্তায় কোলোন পাঠানোর ছিল …ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে, প্যারিস হয়ে, এমনি করে … এখন আমরা উইর্থ আর এঙ্গেলসের কাছ থেকে এক
গাদা বাণিজ্যিক ঠিকানা এবং নকল বাণিজ্যিক চিঠি পেয়েছি যেগুলোর ব্যবহার দলিল, চিঠি ইত্যাদি
পাঠাবার জন্য করতে হবে … আমাদের ফ্ল্যাটে
পুরো একটা দপ্তর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। দু’তিনজন লেখে, বাকি ক’জন এখানে ওখানে বার্তা পাঠাবার বা অন্যান্য কাজে দৌড়োতে থাকে। তারপর
যারা বাকি থাকে তারা খুঁটে খুঁটে পয়সা জোটায় যাতে লেখকেরা নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে
রাখতে পারে আর এই অভূতপূর্ব অত্যাচারের আমলাতান্ত্রিক দুনিয়ার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোটাতে
পারে।”
কয়েকটি অভিযোগ খারিজ করতে বাধ্য হল আদালত।
তবুও, এগারোজন অভিযুক্তদের মধ্যে থেকে সাতজনকে একটি দুর্গে বন্দী থাকার সাজা দেওয়া
হল। মার্ক্সের কথায়, কোলোন মামলার ওপর ‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এ যে প্রতিবেদনটি এঙ্গেলস লিখলেন, তাতে কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে করা
সমস্ত মিথ্যে অভিযোগ খণ্ডিত করে এঙ্গেলস বললেন যে কম্যুনিস্টদের উদ্দেশ্য ছিল, “সেই দলটি বাঁচিয়ে রাখা যার কেন্দ্র ছিল তারা।
একই সঙ্গে তাদের উদ্দেশ্য ছিল দলটাকে সেই শেষ, নির্ণায়ক সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করা
যে সংগ্রাম ইয়োরোপের ওপর থেকে নিশ্চিত শুধু ‘অত্যাচারী’, ‘স্বেচ্ছাচারী’ আর ‘লুটেরা’দেরই আধিপত্য শেষ
করবে না, তার থেকেও বড় এবং দুর্দান্ত, শ্রমের ওপর পূঁজির আধিপত্যও শেষ করবে।”
‘লীগ’এর শক্তি ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। কোলোনের কেন্দ্রীয়
কমিটির অধিকাংশই দন্ডিত, দুর্গে বন্দী। মার্ক্সেরই প্রস্তাবে লন্ডন জেলা কমিটি ১৭ই
নভেম্বর ১৮৫২য় ‘লীগ’কে ভঙ্গ করার ঘোষণা করল। এঙ্গেলস লিখলেন, “কোলোন মামলার সঙ্গে জার্মান কম্যুনিস্ট শ্রমিক
আন্দোলনের প্রথম পর্ব শেষ হল।”
‘লীগ’ ভঙ্গ হওয়ার পর বিপ্লবী সর্বহারা পার্টি বলতে
আর কিছু ছিল না। কিন্তু মানুষেরা ছিল। মুখে নিজেদেরকে খোলাখুলি মার্ক্সবাদের অনুগামী
না বললেও তাদের কথাবার্তায়, পত্রিকায় প্রকাশিত রচনায়, ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’এ প্রতিপাদিত সমাজের শ্রেণীদ্বন্দ্বমূলক বিশ্লেষণ,
আর্থিক প্রণালীর গুরুত্ব ইত্যাদি ব্যাপারগুলো আসতে শুরু করেছিল। এঙ্গেলস কোনো এক বন্ধুকে
লিখলেন, যাক, এবার আর পাতি-পূঁজিবাদী এবং নানা ধরণের প্রজাতন্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক
রাখতে হবে না। সংগঠন স্বতন্ত্র হবে, সর্বহারার হবে এবং ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ঘোষণাপত্র’এর ভিত্তিতে হবে। কিন্তু তেমনটা হতে দেরি ছিল।
ইয়োরোপে বিপ্লবের জোয়ার দুজনের আশার বিপরীত,
উঠছিল না। আর্থিক সঙ্কটকে জনগণের কাঁধে চাপাতে সক্ষম নতুন বিশ্ববাজার প্রণালী কায়েম
হচ্ছিল। বিশ্ববাজার সম্প্রসারিত করার জন্য শুরু হচ্ছিল যুদ্ধ। একদিকে প্যারিসে বিশ্ব
বাণিজ্য মেলা পূঁজির উৎপাদক শক্তির জয় ঘোষণা করছিল অন্যদিকে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে সেই পূঁজিই
ধ্বংসাত্মক শক্তি নিয়ে, রুশীয় জারতন্ত্র এবং অটোমান সাম্রাজ্যের পারস্পরিক কলহে, বাজার-বিস্তারের
সম্ভাবনা দেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এই যুদ্ধের বিষয়ে কথা বলতে বলতে
এবং ‘নিউইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন’এর জন্য লেখা তৈরি করতে করতে নিজেদের মতাদর্শকে
নতুন নতুন দিকে প্রয়োগ করছিলেন।
দক্ষিণ ইয়োরোপের অধিকাংশ, এবং তার সঙ্গে আফ্রিকার
কিছু অংশ তুর্কির অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। অন্যদিকে পূর্ব ইয়োরোপের বড় অংশ রুশীয়
জারতন্ত্রের অধীন ছিল। এই দুই শক্তির যুদ্ধে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের ঝাঁপিয়ে পড়ায় নতুন
সাম্রাজ্যবাদের পূঁজিবাদী শাঁস বা সারতত্ত্ব বেরিয়ে আসতে শুরু করল। বিপরীতে, ঐ অধীন
জাতিগুলোর জাতীয়তার প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। আরো কিছু নতুন যুদ্ধ শুরু হচ্ছিল আফ্রিকা
এবং এশিয়ায়। এঙ্গেলস রুশি এবং অন্যান্য কয়েকটি স্লাভ ভাষা জানতেন। তাই খুব কাছ থেকে
দেখতে পাচ্ছিলেন ঘটনাগুলোকে এবং মার্ক্সকেও ওয়াকিবহাল রাখছিলেন। ঐসব জাতীয়তার বিষয়ে
লিখতে গিয়ে তাঁদেরকে জাতীয় মুক্তি এবং জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে
নিজেদের নীতি স্পষ্ট করতে হল। কয়েক বছরের মধ্যে ভারতে জাতীয় স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম
শুরু হওয়ার ছিল। চীনেও শুরু হওয়ার ছিল সংগ্রাম।
ম্যাঞ্চেস্টার আসার পর বেশ কয়েক বছর এঙ্গেলস
লন্ডন ছাড়া আর কোথাও যান নি। লন্ডনে সচরাচর উনি একাই যেতেন, কেননা মার্ক্সের সঙ্গে
সময় কাটাতে বা অন্য কারোর সঙ্গে দেখাসাক্ষাতে সুবিধে হত। ১৮৫৬র মে মাসে এঙ্গেলস স্ত্রী
মেরির সঙ্গে কিছু দিনের জন্য আয়ারল্যান্ড গেলেন। তাঁর কথায়, পুরোটা না হলেও দুই-তৃতীয়াংশ
ঘুরলেন। ফেরার পর ২৩শে মে, মার্ক্সকে চিঠি লিখলেন। চিঠিতে আয়ারল্যান্ডে পড়া আকালের
মর্মস্পর্শী বর্ণনার পাশাপাশি, ইংরেজ শাসন আইরিশ জাতীয়তাকে কোন অবস্থায় এনে ছেড়েছে
তার বর্ণনা করলেন। ইংল্যান্ডের পূঁজিবাদী উন্নয়নের চিহ্নও আয়ারল্যান্ডে ছিল না। জীর্ণ,
শীর্ণ, দাসত্বাধীন এক জাতীয়তা হয়ে জীবনধারণ করছিল সে দেশ। এঙ্গেলস লিখলেন, “পুলিস, পুরোহিত, উকিল, আমলা, জাগীরের মালিকেরা
প্রফুল্ল চিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ কোনো শিল্প নেই। ভাবাও কঠিন যে যদি অন্য দিকে এর
বিপরীত দিক, কৃষকদের দুস্থতা না থাকত তাহলে এসব পরজীবী উদ্ভিদগুলো কিকরে বাঁচত। সারা
দেশে ‘লোহার হাত’ দৃশ্যমান, সরকার প্রতিটি ব্যাপারে হস্তক্ষেপ
করে, স্বায়ত্বশাসনের চিহ্নমাত্র নেই। আয়ারল্যান্ডকে ইংল্যান্ডের প্রথম উপনিবেশ বলা
যেতে পারে … কারোর দৃষ্টি এড়াবে
না যে ইংরেজ নাগরিকের তথাকথিত স্বাধীনতার ভিত্তি উপনিবেশগুলোতে করে চলা নিপীড়ন।”
No comments:
Post a Comment