Friday, October 11, 2024

ছেঁড়া কোটের জেল্লা

শম্ভুদাই বোধহয় বলেছিল, সার্চলাইটে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে দ্যাখ। তখন, না ভালো লাগছে অডিট ফার্মের কাজ, না ভালো লাগছে সন্ধ্যেবেলার আইনের ক্লাস। টিউশনির পয়সায় বিশেষ কিছু হয় না। আর ভালোও লাগে না। এত ঝক্কি। টিউশনি করতে যেত পুনাইচকে। তার স্কুলেরই বন্ধুর দুই ভাইপো। রোজ পেট ভরে জলখাবার খাওয়াতো তার বৌদি। কিন্তু পয়সাটা তার হাতে দিত তার দাদা, আর সে পয়সা সে কিছুতেই দেয় না। তিন মাস পর একদিন গোঁ ধরল। তখন বলে কিনা, না, তোকে দিলে তো তুই আজেবাজে কাজে খর্চা করে দিবি! তুইই তো বলেছিস, তোর সবকিছুর এক্সপিরিয়েন্স নিতে ইচ্ছে করে। পারলে রেস খেলতেও যাবি। শেষে যদি সত্যিই রেসে খর্চা করে দিস?

সসালা। আমার পয়সা আমি রেসে খর্চা করি বা অন্য কোথাও খর্চা করি তাতে তোর কি রে? তুই আমার গার্জেন? সেসব আর বলল না। জোর করে পয়সাটা আদায় করল দুবারে। আর পড়াতে গেল না। তারপর কিদোয়াইপুরিতে পাঁচ ভাইবোনকে পড়াতে গেল। বড়ো মেয়েটাকেই শুধু টেবিলে পেত, বাকিগুলোকে খাটের নিচ থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করতে হত। প্রায় জড়িয়ে কোলে উঠিয়ে ধরে ধরে বসাতে হত। ওদের বাবা বোধহয় সেলসে ছিলেন আর মা কাজ করতেন হোটেলের রিসেপশনে। মায়ের সঙ্গেই তার কথা হয়েছিল। নিজের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পেটানো তার ধাতে নেই। কখনো কাউকে পেন্সিল দিয়েও মারে নি। কিন্তু এদেরকে পড়াতে গিয়ে ধরাধরি করতে হত বড্ড বেশি। বাড়িতে আর কেউ নেই। এমনকি বড় মেয়েটাকেও মাঝে মধ্যে হাত ধরে টেনে বসাতে হত খাতার সামনে।

একদিন অস্বস্তি হতে শুরু করল। এটা ঠিক নয়। মেয়েটি বড় হচ্ছে। কথাবার্তাগুলোও বড়দের মত হচ্ছে। মা-বাবা কেউ নেই সারা দুপুর। ভাগ্যিস চাকরির পরীক্ষাটা দেওয়ার ছিল। আগেভাগেই হোটেলে গিয়ে ওদের মা-কে বলে দিল, চাকরিতে জয়েন করার আছে, তাই আর আসতে পারবে না। ওদিকে সকালের টিউশনিটায় মজাই পেত, পাড়ায় হাঁটাপথে পৌঁছোন, ভাইটা কলকাতা-ফেরত বাচ্চা, সোর্ডফাইটের গল্প করছে সবসময়, বোনটা শান্ত। কিন্তু তাদের মা হঠাৎ চোখের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন, হাসপাতালে দিতে হল। টিউশনটা ছেড়ে গেল।

সবচেয়ে বিপাকে পড়ল মিঠাপুরের বড় স্কুলটার ক্যাম্পাসে ভোঁতা মেয়েটাকে পড়াতে গিয়ে। এ যে কিছুই বোঝে না। বোঝার কোনো স্পৃহাও নেই। দিব্যি দোহারা ফর্সা চেহারা, জোয়ান মেয়ে, অথচ একটা পড়া বোঝার বেলায় এমন ভোঁতা! তার রীতিমত ভয় করতে শুরু করল। একটা মানুষ নেই আশেপাশে, ক্যাম্পাস বলে সন্ধ্যায় বাইরেটাও অন্ধকার। এই নিয়ে তিন দিন একটা প্যারা বোঝাবার চেষ্টা করছে। মেয়েটা যে কিছুই বলে না! অথচ বোবাও নয়। বাবা-মা কিসের ভরসায় ছেড়ে দিয়েছে ওকে তার হাতে? ম্যাট্রিক পাশ করাবে? নাঃ সে পারবে না করাতে। মিছিমিছি বদনাম হবে। কষ্টও হচ্ছিল। কেন পারছে না মেয়েটা? কোথায় গলদ থেকে যাচ্ছে তার বোঝানোয়? নাঃ, অন্য কেউ পাশ করাক। ছেড়ে দিল।

তার আদর্শ ছিল তার নিজের ছোটোবেলার টিউটর। বন্ধুত্ব করে, গল্পের ছলে সব পড়া শিখিয়ে দেওয়া। কিন্তু সে বার বার অসফল হচ্ছিল সেই কাজে। বাধা যাই হোক, সে তো সেটা ভেঙে এগিয়ে যেতে পারছে না। যদি মেয়েটাকে পড়া বুঝিয়ে দিতে পারত আর মেয়েটা ম্যাট্রিক পাশ করত, তখন কেমন গর্ব হত তার? কিন্তু সে পারছে না। তার এক জামাইবাবু বিদ্বান মানুষ, গল্প করেন, এক গ্লাস দুধের বদলে ছেলে পড়িয়েছেন এক সময়। পড়িয়েছেন তো। সফলও হয়েছে তারা পরীক্ষায়। তিনি নিজেও বিদ্বান হয়েছেন। সে একজন বাজে টিউটর। পড়ানো তার দ্বারা হবে না। কথাটা তার মনে গেড়ে বসল।  

তাই আরো গোঁ চেপে গেল মাথায়, চাকরিই চাই, যেমন হোক একটা চাকরি, হাতে রোকড়া চাই মাস গেলে। একটু সাহায্যও করতে পারবে বাড়িতে। বিজ্ঞাপন দেখে এ্যাপ্লাই হলো, পরীক্ষা হলো, চাকরিটাও হয়ে গেল। ওদিকে শম্ভুদা, শুনল, চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে কলকাতা, পাটনায় তার আর ভালো লাগছে না। কলকাতার লোকগুলো বাইরে থাকতে পারে না কিছুতেই। 

মুখ ধুয়ে, চান করে একটু কিছু মুখে দিয়ে সকাল সাতটা থেকে সোয়া সাতটার মধ্যে বেরিয়ে যায়। স্কুলের পুরোনো রাস্তা ধরেই তবে সাইকেল বগলদাবা করে রেললাইন পেরিয়ে আর-ব্লক, এখনকার ইনকামট্যাক্সের চৌরাস্তা, হাইকোর্ট, উইমেন্স কলেজ ছাড়িয়ে বোরিং রোড, এ-এন-কলেজ, পাটলিপুত্র কলোনি কলোনির মাঠ পেরিয়ে একটা ছোট্টো বাগান, বাগানের লোহার গেটটা খোলাই থাকে। ভিতরে ঢুকে আবার ওদিকের কাঠের গেটটা খুলে বেরোলেই সদাকত আশ্রম এটাই বেস্ট শর্ট কাট; বাঁক নিলেই গঙ্গার ধারের রাস্তা, দুপা গিয়ে হাসপাতালের গেট। শহরের নামকরা মিশনারি হাসপাতাল। আটটায় ডিউটি, গেটের ডানদিকে সাইকেল-স্ট্যান্ডে সাইকেল ঢুকিয়ে মোটামুটি সময় মতো ঢুকেই পড়ে একাউন্টস সেকশনে।

প্রথম চাকরির অভিজ্ঞতাটা সবার রন্ধ্রে রন্ধ্রে থেকে যায়। পঞ্চাশ বছরে এত কিছু পাল্টালো, যুগ পাল্টালো, হুজুগ পাল্টালো তবু এখনও ... সাত হাজার টাকা মাইনের ছোটো প্রাইভেট কম্পানির চাকরিতে কোনদিকে-কতটা-কুলোবে বুঝতে হিমশিম, খিদেমুখে থুথু কাটে অনবরত, তবু উর্দিতে বা অন্য ফর্মাল পোষাকে বুকে বা কোমরে আইডি ক্লিপ করে রাখার কত গর্ব! যেন সে অন্য মানুষ এখন! হবে নাই বা কেন? চাকরীজীবী জাত, অথচ চাকরীহীন কোটি কোটি যুবক-যুবতী।

এক বছরই তো করেছিল। কিন্তু সে এক বছরের প্রতিটা মুহূর্ত এখনও মনটা আলোয় ভরিয়ে দেয়। কারণও ছিল। বাণিজ্যিক সংস্থাও তো নয়। একটা পুরোদস্তুর হাসপাতাল। তার বিভিন্ন ধরণের কর্মচারী। বিভিন্ন ইউনিট। প্রত্যেকটা কাজ করতে করতে তার মানবিক যোগাযোগগুলো স্পষ্ট থাকতো চোখের সামনে।

ছেচল্লিশ বছর আগে মাইনে ছিল দুশো পঁচাত্তর কিন্তু কুয়াশাও তো অন্যরকম ছিল। জ্বালা ধরত না চোখে বা চামড়ায়। শীতের সকালে ছয় মাইল সাইকেল চালিয়ে মুখে কুয়াশা মাখতে মাখতে পৌঁছোতো বাগানের শর্টকাটে; ওদিকের ছোট্টো কাঠের গেটটা ভেজা পিছল হয়ে থাকত কুয়াশায়। পৌঁছে বাথরুমে আয়নায় দেখে শিশুর মত উল্লসিত হতো যে পাঁজা পাঁজা কুয়াশার জলবিন্দু তখনও লেগে আছে ভুরুতে, গোঁফে, দাড়িতে।

শম্ভুদা চলে গেলেও, কলকাতা থেকে নতুন এক বাঙালি তারই সঙ্গে ঢুকেছে। তবে এদিককার নয়, খাস কলকাতার। রণজয়। রণজয়ের বয়স একটু বেশি, ফর্সা রোগা, সুন্দর, এলিট চেহারা; হাসপাতালের কাছেই নিজের স্ত্রীয়ের সঙ্গে একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। বিয়ে নিয়ে একটা ঝঞ্ঝাটও আছে বাড়ির সঙ্গে, বলেছিল।

টেবিলে আগে থেকেই রাখা থাকে বড় বড় বাঁধাই চার্ট। আগের দিন ভুগতান হওয়া ওপিডি, ইনপেশেন্ট বিলগুলো এবং আরো সমস্ত আয়। বিভিন্ন খরচ। বিভিন্ন সেকশন থেকে লেখা হয়ে এসেছে। যোগ করতে হবে। এবং বিভিন্ন হেডের টোটালের সঙ্গে সামটোটাল মিলছে কিনা দেখে নিয়ে এগোতে হবে।

তখন তো আর কম্পিউটার নেই। তার আগের, ডিজিটাল ক্যালকুলেটরও নেই। ছোটোবেলায় একবার বাবা নেপাল থেকে নিয়ে এসেছিলেন মেকানিকাল জাপানি মিনি এ্যাবাকাস, মেকানাইজড। ওদের সবসময় ছোট জিনিষ তৈরি করার শখ। একটা স্টিলের পেন্সিলকাঠি দিয়ে সংখ্যার সূক্ষ্ম স্টিল বেল্টগুলো ওপর-নিচে করে এগোতে হত।

অফিসে পৌঁছে দেখল মেকানিকাল এ্যাডিং মেশিন। ওই একই পদ্ধতির, তবে অটোমেটিক। পাঁচের বোতাম টিপলে ভিতরে সংখ্যার বেল্ট ঘুরে পাঁচ ছেপে যায় সামনের কাগজের রোলে। ফ্যাসিট এবং আরো দু-একটি কম্পানির। আর কী আওয়াজ! একটা রণজয় চালাচ্ছে, একটা সে চালাচ্ছে, একটা তার ডানদিকে বসে একজন পুরোনো কর্মচারী, তাদেরই গ্রেডের, শম্ভুজি, তিনি চালাচ্ছেন। ওদিকে আরেকটা নিজের কেবিনে বসে চালাচ্ছেন লুডউইগ, ক্যাশিয়ার। অথবা তাঁর কাজ হয়ে গেছে। মেশিনটা ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন বিলিং এসিস্ট্যান্ট ইগ্নেশিয়াস ফিডেলিস (সিনিয়র)কে। পুরো অফিস জুড়ে একটা বিচিত্র ঘররং-ঘট, ঘররং-ঘট আওয়াজ শুরু হয়ে যায় সকাল আটটা থেকে।     

নটায় একটা পনেরো মিনিটের চা খাওয়ার ব্রেক। সেকশন থেকে সবাই বেরিয়ে যায় ক্যান্টিনে। করিডোর ধরে আরো ভিতরে গিয়ে বাঁদিকে ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি আর লিফটঘর। তারই পাশ দিয়ে পিছনের উঠোনে যাওয়ার রাস্তা। উঠোন পেরোবার একটা ঢাকা ঢালু প্যাসেজ। একেবারে সামনে নার্সদের ক্যান্টিনের দরজা। ডানদিকে সিস্টার, ব্রাদার, ডাক্তার, বিভিন্ন অফিসারদের ক্যান্টিনের দরজা। বাঁদিকে একটা ঘর আর খোলা জায়গা নিয়ে অন্যান্য কর্মচারীদের ক্যান্টিন। বাঁদিকের ক্যান্টিনে তাই বাইরে ঘাসের ওপরও বসা যায়। চায়ের সঙ্গে খাবার জন্য থাকে আটার গুলগুল্লা।

এ জিনিষটা সে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে পাড়ার মোড়ে খাপরায় ছাওয়া দোকানটায়। সেখানে মেঝেও মাটির। দুএকটা তেলকাষ্টা বেঞ্চি আছে কিন্তু কর্পোরেশনের ঝাড়ুদারনিরা মাটিতেই হাঁটু মুড়ে বসে খায়। কড়াইয়ে ভেজে ভেজে কাঠের বড় ট্রেতে পাতা বিছিয়ে রাখা থাকে কচরি (মুসুরির ডালের ছোট্ট ছোট্ট ঝাল কুরকুরে বড়া, লঙ্কাভাজা, বুড়ো পটলের বিচি ভাজা, পুরি (আলুচনার তরকারি পাশে ডেকচিতে রাখা) আর এই আটার গুলগুল্লা। কী ভীষণ ইচ্ছা করতো খেতে! সেই গুলগুল্লা এখানে প্রথম খাওয়ার সুযোগ পেল।

কিছুই না। আটা, চিনি একটু সোডা দিয়ে গাঢ় লেই তৈরি করে কড়াইয়ে থুপ থুপ ছেড়ে দেওয়া। গোলাপজামের সাইজে গোল হয়ে ভাজা হয়ে উঠবে। খেতে মনে হবে মিস্টি বানরুটি, তবে ভাজা, তাই তিসির তেলের গন্ধ। অন্যেরা খাক বা না খাক, সে অবশ্যই দুটো খায়, চায়ের আগে। তারপর চা আর সিগরেট।

সিগরেটের ব্যাপারে রণজয় তো তার চেয়েও বেশি, তুখোড় চারমিনারখোর। আশে পাশে বসা সবাইকেই তার ভালো লাগে। বেশির ভাগেরই বাড়ি হয় বেতিয়া নয় দক্ষিণ বিহার। প্রত্যেকেরই দুটো করে নাম, হিন্দু নাম আর খ্রিশ্চান নাম। খ্রিশ্চান নামটাই চলে, তবে এক নামের দুজন হয়ে গেলে হিন্দু নামটা দিয়ে বোঝানো হয়। ইগ্নেশিয়াস ফিডেলিস, ইগ্নেশিয়াস এব্রাহাম, লুডউইগ, এলোয়শিয়াস পিকে অবশ্য পাটনার। পরে সে জানতে পেরেছিল যে তারও একটা ক্রিশ্চান নাম আছে। এনকোয়্যারি থেকে আসেন ভিক্টর সাহেব, ল্যাব থেকে কোঁকড়াচুলো কেরালাইট ছেলেটি।

সেকশন থেকে বল সাহেব আর চ্যাটার্জি সাহেবরা যান তারা ফিরে আসার পর, তবে এই ক্যান্টিনে নয়, ওদিককার, সিস্টারদের ক্যান্টিনে। এ্যাসিস্ট্যান্ট এডমিনিস্ট্রেটর, তিনিও সৌম্যদর্শন বাঙালি (সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে নাকি এসেছেন), কোথাও যান না, তাঁর ঘরেই চা আসে।

চা খেয়ে ফেরার পথেই একদিন ধরলেন সিস্টার কোচুথ্রেসিয়া। দেখতে ভীষণদর্শন বলে সেকশনে সবাই ঠাট্টা করতো। কিন্তু তিনি ছিলেন রুগীদের খাবারের ইনচার্জ এবং পরে আরো কাছ থেকে তার দেখার সুযোগ হয়েছিল, নিজের কাজ তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে করতেন। খাবার দেওয়ার সময় নিজে প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে গিয়ে, রুগীদের জিজ্ঞেস করে করে তদারক করতেন যে খাবার ঠিকমত আর পরিমাণমত দেওয়া হচ্ছে কি না। ডিমসেদ্ধটা কেমন, আপেলটা কেমন, কলাটা কেমন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতেন।

তিনিই ধরলেন। ভাই, রেসিডেন্ট নার্স আর স্টুডেন্টদের জন্য সিনেমা আনানো হবে, সাহেব বিবি গোলাম, তুমি একটা পোস্টার করে দাও। এই ক্যান্টিনের প্যাসেজের কোনো থামে লাগাবো। সে তো নিজেই দেখেনি সাহেব বিবি গোলাম! পড়েও নি। বাড়িতে উল্টোরথে বা প্রসাদে ছবিটবি দেখেছে। পোস্টারও কখনো কোনো ব্যাপারে তৈরি করতে হয় নি। কিন্তু কিছু একটা ছিল ওই রুক্ষ চেহারার, চওড়া ধাঁচের গড়নের কালো মহিলার আন্তরিক বলার ঢঙে।

কেন যে তাকেই ধরলেন মহিলা তাই বা কে জানে। অফিসে বসে তো কখনো সে কিছু আঁকে নি। মাঝে মধ্যে ছবি আঁকার ইচ্ছে জাগলেও কখনো সেদিকে তেমন এগোয় নি। এমনকি প্র্যাক্টিক্যাল বুকে ড্রয়িংগুলো ঠিকঠাক করতে হিমশিম খেতে হতো। তবু পোস্টারের বড় ড্রয়িং শিট কিনে এনে, কিছু রঙ তুলি কিনে, কিছু বোনেদের থেকে নিয়ে পোস্টার তৈরি করল রাত জেগে। সিস্টার কী খুশি! যে যাচ্ছে তাকেই দেখাচ্ছেন, লুক, হি হ্যাজ মেড সাচ এ্যান এক্সেলেন্ট পোস্টার

মদের পেয়ালা, বিবি, তাস, আর লেখা। তাতেই কী তারিফ! প্যাসেজের থামে সাঁটানো রইল এক সপ্তাহ। দ্বিতীয় দিন হঠাৎ চোখাচোখি হল একটি সুন্দর মুখের সঙ্গে। ফর্সা, প্রায় লাল আভা বেরুচ্ছে নিচের মেঝে থেকে উঠে আসা রোদে, চোখে চশমা, পানের মত নেপালি মুখ, গায়ে নার্সের সাদা পোষাক, মাথায় পরিচিত সাদা ফেট্টি। কী মিষ্টি হাসি! পোস্টারটা দেখিয়ে বলল, বিউটিফুল! ব্যাস, গলে গেল সে। মেয়েটি আর দুজন বন্ধুর সঙ্গে চলে গেল ক্যান্টিনের দিকে। সে ফিরছে। সাধারাণতঃ এটাই হয়, ওদের ফেরার সময় নার্সেরা ঢোকে। আর নার্সদের বেরুবার সময় ডাক্তার আর অফিসাররা।

পিছন থেকে কাঁধে একটা হাত পড়ল, মিনতি! মিনতি তামাং! বলে দুষ্টু হেসে এগিয়ে গেলেন কোচুথ্রেসিয়া। সিনেমা দেখানো হয়েছিল ক্যাম্পাসের ডানপ্রান্তে অডিটোরিয়ামটায়। কিন্তু ছুটির পর। কাজেই সিস্টারের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও দেখা হল না। ডিউটি শেষ হলে কেউ এক মুহুর্ত থাকতে চায় কাজের জায়গায়? তারপর আবার পাড়ায় অপেক্ষারত বন্ধুরা, সিগারেট, কিসুনজীর চা!... তবে পোস্টার তারপরেও তৈরি করে দিয়েছে যখনই সিস্টার কোচুথ্রেসিয়া নতুন সিনেমা আনিয়েছেন।

সেদিনও একটু আগে পৌঁছে গেছে। দশ মিনিট সময় আছে তখনও। যা করে, বাইরে বেরিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে কচি দেবদারু গাছগুলোর সারির নিচে দাঁড়িয়ে। ততক্ষণে সিঁড়ির মুখ অব্দি লাইন লাগাতে শুরু করেছে পেশাদার রক্তদাতারা বেশির ভাগই রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা এবং অন্য কায়িক শ্রমের মজুরেরা। ওপিডিতেও ভীড় জমতে শুরু করেছে। পিছনে আলতো করে হাতের চাপড় মেরে গেলেন ইগ্নেশিয়াস ফিডিলিস; বিল তৈরি করেন। গেটের কাছে তখন ঢুকছে রণজয়। ও এ পাড়াতেই ঘর ভাড়া নিয়েছে। হেঁটে আসে। এক মহিলার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছিল। ইনিও নার্স, তবে বেশির ভাগ দিনই শাড়ি পরেন। একটু সিনিয়র। তাকে দেখে হ্যালো করে এগিয়ে গেলেন, রণজিত দাঁড়িয়ে গেল।
-       ইনি কে বল তো? দেখা হয় প্রায় রোজই, কিন্তু চিনি না। ইনি তো হস্টেলে থাকেন না!
-       না, এই তো কাছেই, আলাদা ঘর নিয়ে থাকেন। শীলা কৌন্ডিনহা। অন্ধ্র প্রদেশের মানুষ। ওনার বরের ওষুধের দোকান আছে।
-       এখানে?
-       হ্যাঁ, তোমার বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় একটু এগিয়েই ডানদিকে দেখবে।
-       তার মানে, এখানকারই বাসিন্দা?
-       না। (সিগরেট ধরাতে ধরাতে) নকশাল রাজনীতিতে আছেন দুজনেই। ওখানে ধরপাকড় শুরু হওয়ায় এখানে চলে এসেছেন।
-       এখনও করেন রাজনীতি?
-       হ্যাঁ, ছাড়বেন কেন?  

একদিন বাড়ির পথে বাঁক না নিয়ে এগিয়ে পৌঁছেছিল মিঃ কৌন্ডিনহার দোকানে। শীতে তাড়াতাড়ি আলো কমে আসে। কাউন্টারে একটা সাদা জামা গায়ে দিয়ে বসেছিলেন। রাজনীতির কথা কিছু বলল না। হিন্দিতেই বলল, আপনারা শুনলাম অন্ধ্রের মানুষ, আমার সহকর্মী বলল। মিসেজ কৌন্ডিনহার বিষয়ে জিজ্ঞেস করছিলাম। তাই ভাবলাম দেখা করে আসি। ভদ্রলোক সিগরেট খান না। কিছুক্ষণ কথা বলতে বলতেই মিসেজ কৌন্ডিনহাও এসে গেলেন। চা জিজ্ঞেস করলেন। সে না বলে বেরিয়ে এল। বাড়ি যেতে যেতে রোমাঞ্চিত হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু ! কি জানি কেন এই রাজনীতিটা সে কিছুতেই সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করতে পারে না। সম্মান করে। কিন্তু কিছু একটা খটকায়! রণজয়কে বলেও ছিল। সে কিছু বলে নি। সে তোমার ব্যাপার! বলে এড়িয়ে গিয়েছিল।

গিয়ে বসেছে এ্যাডিং মেশিন নিয়ে ঘররর, ঘট, ঘররর, ঘট, ক্লিং একদিন আগের বিভিন্ন খরচের চার্টগুলো যোগ করতে একাউন্টেন্ট ডাকলেন। কাল থেকে আপনাকে নতুন কাজ দিচ্ছি। ওখানে ওই কাঠের ক্যাবিনেটগুলো দেখতে পাচ্ছেন? পাচ্ছিলাম, লাইব্রেরীর কার্ডের ক্যাবিনেটগুলো তো চেনা।

-       ওগুলো বিনকার্ডের ক্যাবিনেট। প্রত্যেকটা ক্যাবিনেটের ওপর ডিপার্টমেন্টের নাম লেখা আছে। ভিতরে কার্ডগুলোর প্রত্যেকটা ওই ডিপার্টমেন্টের একেকটা ফার্নিচার কিম্বা মেশিন কিম্বা অন্য আইটেমের। এছাড়া একটা ইনভেন্ট্রি রেজিস্টার আছে, মিস্টার মুখার্জির কাছ থেকে চেয়ে নেবেন। পুরো হাসপাতালের ওই ইনভেন্ট্রি আপডেট করতে হবে। পারবেন তো?

হাআআঃ। বাঁচলাম। ডিপার্টমেন্টগুলো ঘুরে ঘুরে দেখা যাবে। বসে বসে এই এ্যাডিং মেশিনে আর ঘ্যাঁতাতে হবে না।

নতুন কাজ শুরু হল। আগে হাসপাতালের প্রধান বাড়িটা একেকটা ওয়ার্ড, ওটি, ওপিডি, ক্লিনিক, রিসেপশন, রেজিস্ট্রেশন, মেডিল্যাল রেকর্ডস, অফিসঘর দুখানায় আরো ঘরগুলোয়, সিঁড়ির আশেপাশে যাবতীয় কাজের অকাজের পড়ে থাকা জিনিষগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ ফিরিস্তি। তারপর একদিন ওর জন্য স্বীকৃত হল বেসমেন্ট বা আন্ডারগ্রাউন্ডে প্রবেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার সব বাতিল যন্ত্রপাতি, বিরাট বিরাট এক্সরে

এবার তিনটে ক্যান্টিন, তারপর লিনেন ডিপার্টমেন্টের আলাদা বাড়িটায় প্রথম ঢোকা। বড় বড় ওয়াশিং মেশিন। বেশির ভাগই মহিলা কর্মচারী এবং সবার মুখ পরিচিত, ক্যান্টিনে দেখা হয় রোজ। লাল ব্লাউজ সাদা শাড়ি পরে সব হাসিমুখ বিহারি বৌয়েরা। তারপর মেনটেনেন্সের ব্লক, অডিটোরিয়াম। এসব সেরে শেষে সতর্কভাবে ঢুকল হস্টেলে। প্রথম থেকেই বাধো বাধো ঠেকছিল। যেদিন যেসব ঘরে অফ-ডিউটি কেউ না কেউ আছে সেসব ঘরেই ঢোকা। তাও দুপুর, ওদের একটা দিন আরাম করার সময়। কে কেমনভাবে থাকবে, ওকে দেখে মুখ খিঁচিয়ে না বার করে দেয়, মিথ্যে মিথ্যে অভদ্রতার অভিযোগ না করে নানা রকম ভয় ছিল।

যদিও জানত সবাইকে বলা আছে। নার্সিং হস্টেল, এএনএম হস্টেল। নাঃ কেউ খারাপ ব্যবহার করল না। ঘরের কড়া নাড়তেই ঘর খুলে দিল। ঘুরে ঘুরে সব গুনতে দিল খাট, টেবিল, আলমারি । তবে হ্যাঁ, মনে একটা ইচ্ছে ছিল, মিনতির ঘরেও ঢুকবে বুঝতেই পারল না। দুজন তিনজন করে এক ঘরে থাকে হয়তো ডিউটিতে ছিল! বাকিজনকেই দেখেছে! জিজ্ঞেস করবে কাকে, যে মিনতি তামাং কোন ঘরে থাকে? নাঃ, এখনো বন্ধুত্বই হয় নি, আর   

ক্যাশ কাউন্টারে প্যাঁচা

এত কাছ থেকে জীবনে আর দেখে নি। এত সুন্দর হয় প্যাঁচা!

দিনের বেলা। প্যাঁচার চোখ তো অন্ধ! তাই ক্যাশ কাউন্টারের ভিতরে বসা প্রায় নাকের সামনে দেখছিল মায়াবী প্রাণীটাকে।
-       উড়ে পালিয়ে যাবে না?
-       আরে দূর! ও তো অন্ধ এখন, দিনের বেলায়!
-       তবু, পায়ে একটা দড়িটড়ি বেঁধে রাখতেন!
-       কিচ্ছু দরকার নেই।
-       লক্ষ্মীপ্যাঁচা, তাই না লুডউইগজি?

ক্যাশিয়ার লুডউইগ লক্ষ্মী আর হুতোম শব্দ দুটো জানে না। সে তো কিছুই দেখেই নি কখনো। ব্যাস জানে যে প্যাঁচা দুরকম হয়। যেটা দেখতে সুন্দর বোঝাতে গেলে লুডউইগ মুন্ডু নাড়ল এবং তার সাথে মগজে রুলের বাড়ি দিল একটা আমরা তো এটাই খাই, খুব সুস্বাদু হয় মাংস

যাস্‌সালা! সব সৌন্দর্যের মায়ার বাঁয়া ফাটিয়ে দিল এক চাঁটিতে।

পর্ক কারি আর ফ্রায়েড রাইস

ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার বলতে ভাত, ডাল, একটা গামলায় ঝোল-তরকারি বা ডালনা টাইপের, আরেকটা গামলায় গরুর মাংসের তরকারি। প্রথম প্রথম খেত না। কেমন অস্বস্তি হত। রণজয় বামুন। সে দিব্যি খায়। সেই বলল, একই রকম, যেমন মাংস হয়! একটু বেশি চিবোতে হয়। না খেয়ে ওই আলু বেগুনের তরকারি খাওয়ার কোনো মানে আছে?

আর সত্যিই, কোনো অপশন তো নেই হয় ননভেজ হও তো বীফ খাও। নইলে ভেজ হও তো তরকারি খাও। কোনো দিন আলুবেগুন, কোনোদিন আলুবীন, কোনোদিন। শেষে দ্বিধা ঝেড়ে খেতে শুরু করল। এখন ভালোই লাগে। তবে উৎসবের দিন পর্ক কারি খেয়ে তার মুখে লেগে গেল।

তিন ধরণের কর্মচারীর ক্যান্টিন আলাদা আলাদা হলেও উৎসবের দিন (খ্রিশ্চান মতে) দুপুরের ডিনার হয় সবার একসঙ্গে, ওপাশের ছোট্টো বাগানটায়। রীতিমত লোভনীয় ডিনার এত সুস্বাদু যে হতে পারে শুয়োরের মাংসের তরকারি, পর্ক কারি, জানাই ছিল না। ফ্রায়েড রাইসটাও মন্দ নয়। আর খাবার নিয়ে ভিতরে ঢুকে তো সবার দল আলাদা, কাজেই বিব্রত হওয়ারও কিছু নেই। পেট ভরে খাওয়া যায়।

একবার রণজয়ের স্ত্রী বাড়িতে নেই, খ্রিশ্চান কলোনি থেকে কাঁচা শুয়োরের মাংস কাটিয়ে এনে নিজেই রান্না করল ঝোল আর ভাত। তাকেও ডেকেছিল খেতে। সঙ্গে হুইস্কি। ধুর, ওই স্বাদ তো এলই না, ভালো করে সেদ্ধই হল না। দুজনে বলাবলি করল, নাঃ, অন্য কোনো প্রসেস আছে, ওরা জানে, শিখতে হবে।   

রাজগীর

একবার রাজগীর সফর হল একাউন্টস আর এডমিনিস্ট্রেশনের সব স্টাফ প্লাস মিঃ বল আর মিঃ চ্যাটার্জি। দুতিনটে গাড়িতে করে। রওনা হওয়ার মূহুর্ত থেকে যাদুমন্ত্রে বন্দী করল, এডমিনিস্ট্রেটর সিস্টার লুসিয়ার চেম্বারের সামনে বসা স্টেনোটাইপিস্ট এব্রাহাম, কালো, ঢ্যাঙা চেহারা। কী গলা! গেয়েই চলেছে ও দুনিয়া কে রখওয়ালে, সুন দর্দ ভরে মেরে আলে । অন্তরায় মহল উদাস অওর গলিয়াঁ সূনী …’ যেন বুক কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। পুরো রাজগীর সফরে আব্রাহামের সঙ্গে সেঁটে বসে রইল সে। বস্তুতঃ, সে নিজেও আর বন্ধুবান্ধবের মধ্যে চর্চায় বাকি সবাই কিশোর কুমারেরই নাম বলে, দানাদার ভারি আওয়াজ, দেবানন্দের মতো হিরোর ভয়েস। মান্না দের নামটা ওঠে তার মুখে যে ক্লাসিকালের বুঝদারি দেখাতে চায়। মুকেশ যারা ভালোবাসে তারা রাজ কাপুরের ফিল্মের ইউথফুল গানগুলোর জায়গায় ও জানেওয়ালে টাইপের স্যাড সঙগুলোই গায় আর তাই মুকেশও দূরে থেকে যান। বাকি মোহম্মদ রফি! বিভূঁইয়ের বাঙালি এলিটিজম মনে মনে লাল ছড়ি ময়দান খড়ি গাইলেও রফির গুণগান করবে কেন? তাও আবার হেমন্ত, মান্না থাকতে? রফিসাহেব অধরাই থেকে যেতেন। যেমন মিউজিক ডিরেক্টরেও নওশাদ অধরা থেকে যেতেন। আব্রাহামভাই রফিকেও চিনিয়ে দিল সেদিন, রাজগীর সফরে আর নওশাদকেও চিনিয়ে দিল নিজের গানে।     

কচি দেবদারুর নিচে বৃষ্টি

চাকরির প্রথম দিন থেকেই একটা গোলাপি প্লাস্টিকের খাপ-ঢাকা ডাইরি থাকে তার ব্যাগে। পাড়ায় দূর থেকে তাকে ডাকতে হলে, যদি কেউ নাম ভুলে যায়, কবি বলে ডাকলেও চলে। ডাইরিটা ভরে উঠছে কবিতায়, গঙ্গায় ছায়া ফেলে আমেরিকার অর্থনীতি, আরবের তেল …”। ঐ তো সামনেই গঙ্গা! দুটো ট্রাক আর গাড়ি নিয়ে গাদাবোটটা এগিয়ে যাচ্ছে মেশিনের আওয়াজ ছড়িয়ে।

ওদিকে পত্রিকা সম্পাদনা চলছে। এবারের সংখ্যা ছাপা হচ্ছে কলকাতায়। বিশেষ সংখ্যা। দুএকবার যেতেও হয়েছে কলকাতায়, প্রেসপাড়ায়। প্রেসপাড়া জায়গাটা কী রোমাঞ্চকর! ঐ ঘিঞ্জি প্রায়ান্ধকার প্রেসের একটা কালচিটে টেবিলে দিনের বেলায় বাল্ব জ্বালিয়ে প্রুফ দেখতে যে তার কী ভালো লাগে! ঠিক মতো জানে না সে প্রুফ দেখা। লজ্জা হয়। শব্দ যোগ করার চিহ্ন আর শব্দ বদল করার চিহ্ন! শব্দ বা বাক্যাংশের জায়গা-বদলের চিহ্ন। কিছুই সে জানে না। তবে কম্পোজিটার ভদ্রলোক তা নিয়ে হাসাহাসি করেন না। ঠিক বুঝে নেন সে কী বোঝাতে চেয়েছে। অন্যের দেখা প্রুফ খুঁটিয়ে দেখে মনে রাখার চেষ্টা করে চিহ্নগুলো। প্রচ্ছদের জন্য একটা নতুন ছবি ভাবতে পারলে ভালো হত। ব্লকও তো ওখানে সস্তায় বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে। আগের ব্লকটা অনেক সময় একটু বেশি সোজাসাপ্টা লাগে।

বৃষ্টির মরশুমে ক্যান্টিনে দুপুরের খাবারে পেটভরে ভাত আর গরুর মাংসের তরকারি জলদি জলদি খেয়ে বাইরে যাওয়ার রাস্তায় কচি একটা দেবদারুর নিচে দাঁড়ায়। একটা সিগরেট ধরায়। বৃষ্টি যেন প্রকৃতির ক্লাস। সে পড়ুয়া ছেলে, পড়ছে, পড়া বুঝছে, নোট নিচ্ছে। যাদের ইচ্ছে নেই পড়ছে না। পরে আর বলতে এস না যেন কী পড়ালো রে আজকে? পাতা থেকে পাতায় ঝরে পড়া অক্ষরগুলো টুং টাং বাজে মাথায়।

বাঃ, প্রকৃতির ক্লাস! বৃষ্টির ক্লাস! কথাটা লাগসই। এবারের প্রচ্ছদে এই কবিতাটাই থাকতে পারে। 

রোববারের আড্ডায়

আজকাল রোজকার আসা চেহারাগুলো কমে গেছে। সবাই চাকরি বা কিছু একটা করার ধান্ধায়।
-       তুই বীফ খাস? শুয়োরও? ঘেন্না করে না?
-       আরে এ অন্য শুয়োর, গুয়ে শুয়োর নয়। আর বীফে খারাপ আছেটা কী? হ্যাঁ একটু বেশি গরম হয়। আমি তো আর রোজ খাই না। যেদিন তরকারিটা খাওয়ার মত হয় না, সেদিন ভাতের ওপর ডাল নিয়ে তার ওপর একটু বীফ কারি আর কয়েকটা পিস নিয়ে নিই। ভালোই লাগে খেতে। একটু কচকচে, শক্ত, এই আর কি।
-       সন্ধ্যে বেলায় আসবি?
গেল। স্ট্রং কিছু না, হাল্কা জিন, আর সোডা। পরে একবার জিনে রাম মিলিয়ে খেয়ে দেখেছিল কেমন মিষ্টি আর নেশালো হয়ে যায়। জিন আর দুটো চিকেনের টুকরোয় কিছুই নেশা হল না। রাত বাড়তে উঠল বীরেন্দরজি। সেক্রেটারিয়েটে কাজ করে। জোয়ান মানুষ, বৌ বোধহয় থাকে গ্রামের বাড়িতে। সুমিতও উঠল তার সাথে। তাকেও ডাকল।
-       যাবি নাকি? চল!
-       কোথায়? স্টেশনের দিকে।
-       কেন?
বীরেন্দরজি বলল, থোড়া লুৎফ্‌ উঠা লিজিয়ে আপ ভি? সে বোকার মতো তাকিয়ে রইল। সুমিত বোঝালো, আরে স্টেশনে দাঁতনওয়ালিগুলো থাকে না এসময়? কয়েকটা চলে আসে পয়সা দেখে; কতক্ষণ আর? ঘন্টাখানেকের মজা। চল্‌ না! একটু সুখ নিয়ে নে!-
    –       চলিয়ে, থোড়া ইসব কা ভি অনুভব রহনা চাহিয়ে!
-       নাঃ, তোরা যা। আমার দেরি হয়ে যাবে।

অন্ধকার রাস্তায় সাইকেলে একা ফিরতে ফিরতে ভাবছিল। দরকারে কোনো বেশ্যার কাছে কখনো যাবে না পণ করে নি, কিন্তু লাইনে বাচ্চা বাচ্চা রোগাপানা মেয়েগুলোকে দেখেই তার মনটা কুঁকড়ে যায়। এদের সঙ্গে? দাঁতনওয়ালিরাও তেমনি, পেটের দায়ে আসে বেচারিরা! হ্যাঁ, মোটামুটি বয়স্ক কোনো দূর! স্‌সালা দোগলা! ওদিকে মিনতির কথাও ভাবব আর এদিকে !

গান্ধী ময়দানে মিটিং

একদিন এ্যালয়সিয়াস শোকজ খেল। একটা মেডিক্যাল রেকর্ডে নাকি রাখার গাফিলতি, কেরালার লম্বা ছেলেটা, প্যাট্রিক, এ্যাডমিনিস্ট্রেটরের খাস লোক, এসে দেখে রিপোর্ট করেছে। এ্যালয়সিয়াসকে নাকি বরখাস্ত করা হবে। কোনো ডাক্তার রিপোর্ট করে নি কেন? তাদেরই তো এক্তিয়ার এই রিপোর্টগুলো! মিটিং করতে হবে। ইউনিয়ন চাই। তবে ধারে কাছে নয়, ম্যানেজমেন্ট খবর পেয়ে যাবে। কারোর বাড়িতে! গান্ধী ময়দানে চলুন সে-ই প্রস্তাবটা দিল। মনে ধরল সবার। কানে কানে খবর দেওয়া হল নিজের লোক বুঝে বুঝে। গান্ধী ময়দানটা কম দূর নয় হাসপাতাল থেকে। তবু সবাই পৌঁছোল। মিটিং হল সন্ধ্যার অন্ধকারে। সিদ্ধান্ত হল যে ইউনিয়ন তৈরি করতে হবে। এ হাসপাতালে তো কোনো ইউনিয়নই নেই। নার্সদেরও ইউনিয়ন নেই। এএনএমদেরও ইউনিয়ন নেই। কর্মচারি ইউনিয়ন দিয়েই শুরু হোক। কেউ প্রস্তাব দিল তার জন্য অমুক জায়গায় কথা বলে এডভাইস নিতে হবে। তবে আপাততঃ এ্যালয়সিয়াসকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত ফেরত করার জন্য প্রতিবাদ জানাবে সবাই একসঙ্গে, এ্যাডমিনিস্ট্রেটরের চেম্বারে গিয়ে।

কিন্তু তার আর দরকার পড়ল না। পরের দিন অফিসে পৌঁছেই বোঝা গেল যে মিটিংএর ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে। সিনিয়র দুএকজনকে ডেকে এ্যাডমিনিস্ট্রেটর, ইউনিয়নবাজি করলে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে গোছের হুমকি দিয়েছে বোধহয়, তবে এটাও বলে দিয়েছে (বোধহয় এ্যাসিস্ট্যান্ট এ্যাডমিনিস্ট্রেটরের পরামর্শে) যে এ্যালয়সিয়াসের বরখাস্ত হওয়া বা শোকজের জবাব চাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আপাততঃ এগোন হবে না।

চাকরি ছাড়ার আটত্রিশ বছর পর, এদিকে সে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে এক রুগীকে দেখতে গিয়েছিল। ওপিডিতে ঢোকার বড় সিঁড়িটা ছাড়িয়ে ওদিকে নতুন ক্যাফেটেরিয়া তৈরি হয়েছে রুগীর লোকজনের জন্য, সেখানেই চা লহেল তারা। ঢোকার মুখেই দেখেছিল সাইকেলস্ট্যান্ডে পতাকা উড়ছে একটা কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের; অর্থাৎ তাদেরই  এফিলিয়েশনে ইউনিয়ন চলছে এখন। বাঃ । সেদিনকার গান্ধী ময়দানের মিটিং বৃথা যায় নি তাহলে।

কোই হোতা নহীঁ আপনা

এই রকম ঝঞ্ঝাটে ফেলবে তাকে পিকে, ভাবে নি। পিকেরও একটা খ্রিশ্চান নাম আছে, তবে পিকে বলেই সবাই ডাকে। ইনপেশেন্টস রেজিস্ট্রেশনে বসে, তাই ডাক্তারদের সঙ্গে সবচেয়ে আগে তারই দেখা হয়। পিকে না থাকায় দুএকবার সে নিজেও ওই টেবিলটায় বসে দেখেছে, বড় ঝামেলার কাজ। তবে একটা লাভ হয় ওয়ার্ডগুলো থেকে আসা ফোনে সাড়া দিতে দিতে ইংরেজি বলা রপ্ত হয়ে যায়। ডাক্তাররা নিজেদের ডিউটিতে এসে চার্ট দেখে, তাদের এক্তিয়ারের রুগী কজন নাম লিখিয়েছে আজ! ডাক্তারদের সবার আলাদা আলাদা মেজাজ, মান রাখতে হিমশিম খেতে হয়।

সেই পিকেই তাকে ফাঁসালো। একটা কোনো পরবে দিন সেটা। ঠিক হয়েছিল যে অডিটোরিয়ামে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান হবে, নার্স, এএনএম বা স্টুডেন্টরা নানারকম নাচ, গান, ফ্যান্সিড্রেস আরো হরেকরকম পেশ করবে। এক তো সন্ধ্যেবেলায় থাকতে ইচ্ছে করে না। পিকেই ধরে বেঁধে নিয়ে গেল আর ওখানে গিয়ে তার নাম ঘোষণা করে দিল, যে সে নাকি গান গাইবে। পালাবার পথ না পেয়ে পিকেকেই বলল, যেমন নাম দিয়েছেন, চলুন আমার সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াবেন। আরে! আমি গিয়ে কী করব? দাঁড়িয়ে থাকবেন, চলুন!

তাই হল, পিকে এক পাশে দাঁড়িয়ে রইল আর সে জীবনে প্রথমবার মাইকে! তাও আবার গান গাইছে! অন্ধকার হলে মিনতি কোথায় আছে বোঝাও যায় না। সেই সেদিন থেকে মিনতির সঙ্গে যখনই দেখা হয় ক্যান্টিনের প্যাসেজে বা ওয়ার্ডের বারান্দায়, রিন রিন করে বেজে ওঠে মাথা, বুক, সারা শরীর। সদ্য দেখা ফিল্ম, সদ্য তোলা গান! সলিল চৌধুরির সুরে কিশোর কুমার কোই হোতা জিসকো আপনা

মিনতির গোল, ফর্সা, চশমা পরে একটু ওপরে তোলা মুখটা জেগে ছিল মনের ভিতর। দার্জিলিংএর পাহাড়ে কোথায় ওর বাড়ি? কাঠের বাড়ি? কোনো গ্রামে?

ছেঁড়া কোটের জেল্লা

স্যুট পরার ইচ্ছে কখনো হয় না। কিন্তু কোট পরতে ভালো লাগে সব সময়। তার সবচেয়ে বড় কারণ দুটো। কাঁধদুটো চওড়া দেখায়, হিরোটাইপের, আর অনেকগুলো পকেট সিগরেট, ডাইরি, পয়সা সব আলাদা আলাদা রাখা যায়। কোট বলতে একটা ট্রাঙ্ক থেকে হাতিয়েছিল, বাবার পুরোনো স্যুট; প্যান্টটা মায়ের সেলাই মেশিনে ড্রেনপাইপ করে আলাদা পরত আর কোটটা আলাদা। সেটা ছিঁড়ে গেছে কবেই। জ্যালজ্যালেই ছিল, ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে দুটোই একে একে ফচ্‌

আরেকটা যেটা বাবা এখন পরে, সেটার ওপর লোভ অনেকদিনের। গান্ধী ময়দানের পাশে নতুন গড়ে ওঠা আপনা বাজারএর বাড়িটায় সেল লেগেছিল; কোনো ত্রাণসংগ্রহে বিদেশ থেকে আসা কাপড়চোপড়ের ঝরতিপরতি। তাতেই বাবা কিনেছিল কোটটা সেও সঙ্গে গিয়েছিল। তখন থেকেই লোভ। শেষে বাবা একটা নতুন কোট কিনল, ব্যাস, সে পেয়ে গেল পুরোনো কালো কোটটা। পারফেক্ট ফিটিং। একটা পকেট ছেঁড়া। তাতেই সিগরেটের প্যাকেটটা রাখে, যাতে ঢুকে না যায়। ভিতরের লাইনিংটাও কোথাও কোথাও একটু ফেঁসে গেছে। কিন্তু বাইরে থেকে ফার্স্ট ক্লাস।

মিঃ চ্যাটার্জি ডাকলেন। উনি নাকি অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাচ্ছেন। আপনার সিনিয়র সেকেন্ডারিতে ম্যাথস ছিল না?

-       হ্যাঁ, কিন্তু নম্বর কম ছিল।

-       তাতে কিছু হবে না। (মিঃ বলের দিকে তাকিয়ে) হয়ে গেল স্যার। তমালই পড়াবে ওদের। কোনো অসুবিধে হবে না।

তখনই এক সঙ্গে মিঃ জন আর পিছু পিছু সিস্টার মারি থেরেস ঢুকলেন। মিঃ জন ভারতে অন্য কোনো কাজে এসে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হন। সেরে ওঠেন কিন্তু হাঁটাচলার ক্ষমতা ফিরে পান নি। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন এবং এখানে থাকাখাওয়ার বিনিময়ে হাসপাতালের নানারকম কাজ করে চলেন। সিস্টার মারি থেরেস এ্যাংলোবার্মিজ, বিশালদেহী এবং হয়তো যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে বলেই যেমন বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার সবার সঙ্গে, তেমনই কর্মঠ। উনিও ঠিক হাসপাতালের স্টাফ নন, বোধহয় মূল সেবাপ্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন।
-       সামথিং স্পেশ্যাল ইউ সিম টু বি টকিং এবাউট মিঃ চ্যাটার্জি।
-       নাথিং লাইক দ্যাট। (তার দিকে ইশারা করে) হি উইল টেক দ্য এরিথমেটিক ক্লাসেজ ফর এএনএম স্টুডেন্টস।
-       ও, সো ফাইনালি ইউ আর লিভিং আস! গোইং টু অস্ট্রেলিয়া!
-       ইয়েস, ইউ নো আই হ্যাভ মাই নিসেজ দেয়ার। দে আর মাই ওনলি রিলেটিভস!
-       সো, উই আর নট! (সিস্টার মারি থেরেসের চোখে দুষ্টুমি ভরা হাসি। জানতেন এর কোনো জবাব হয় না। নিজেই সামলে নিলেন।) এনি ওয়ে, হ্যাপি জার্নি। নেভার ফরগেট টু কাম হিয়ার হোয়েন ইউ কাম টু ইন্ডিয়া। (তার দিকে তাকিয়ে) অ্যান্ড ইউ বয়। হোয়াটস ইওর নেম?
-       তমাল, তমাল দাস।
-       ত্যামাল!
-       তমাল!
-       ওকে। তোমাল! (একবার ওপর থেকে নিচে ভালো করে দেখলেন। আবার মুখে দুষ্টু হাসি এনে বললেন) ড্রেস বেটার এ্যান্ড স্মার্টলি। এভরি আফটারনুন ইউ উইল বি গোইং টু ফেস এ ফ্লক অফ চার্পি ইয়ং বিউটিজ! (আরো রহস্য করে) নোবডি নোজ !

ধ্যাৎ! তাহলে তো নার্সিং দিতে হত। মিনতির সঙ্গে দেখা হত। কিন্তু নার্সিংএর অঙ্কগণিত একটু উঁচুস্তরের। তার আলাদা শিক্ষক আছে। এএনএমদেরটা এলিমেন্টারি।

ভাগ্যিস, জিজ্ঞেস করেন নি, হোয়াটস দ্য মিনিং অফ তোমাল। ফেঁসে যেত। জীবনে কখনো তমাল গাছ দেখে নি, শুধু কবিতায় পড়েছে।

ভালো ড্রেস আর কী পরবে, অতটাও ক্যালা নয় সে। তবু সিস্টার মারি থেরেসকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে বলে কালো কোটটা ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করে চড়িয়ে নিল পরের দিন। লাঞ্চের পরের সেশনে তার ক্লাস। এএনএম হোস্টেলে ঢুকতে গিয়ে দেখল কিচির মিচির করতে থাকা অনেকগুলো মেয়ে বাড়িটায় ঢোকার মুখ থেকে ক্লাসঘর অব্দি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এদের মধ্যে উত্তরপূর্বের চেহারা প্রায় নেইই। সব, হয় দক্ষিণ বিহারের আদিবাসী চেহারা, অথবা উত্তর আর মধ্য বিহারের চেহারা। কালো, শামলা, কিন্তু মুখগুলো মিষ্টি আর তারুণ্যে ভরা। কাউকে তাড়া দিতে হল না। তার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ক্লাসে ঢুকে বসে পড়ল। সবাই চিনত তাকে, ইনভেন্ট্রির সময় থেকে। 

সবাইকে হ্যালো, গুড আফটারনুন বলে সে টেবিল থেকে একটা চক নিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেল। বাঁদিকের সবকটা খোলা জানলা দিয়ে তেরছা রোদ পড়ছিল তার ছাত্রীদের ওপর।

ক্লাসের শেষে দেখল পরনের কালো কোটটার সাদা হয়ে উঠতে দেরি নেই।

কিন্তু একটা অনাবিল প্রসন্নতায় ভরেছিল তার মন।

পরের দিন সকালে ওই কোটটাই ঝেড়ে আবার পরে অফিসে পৌঁছোল। রণজয় জিজ্ঞেস করল, কেমন অভিজ্ঞতা হল? কোটটা তো পুরো চকের দাগে সাদা হয়ে আছে! ঝাড়েন নি?

-       ঝেড়েছি। অত সহজে যায় নাকি।    

 

১১.১০.২৪ 

No comments:

Post a Comment