ভুগোলের সঙ্গে রাজনীতির যে সম্পর্ক সেটা আমি না জানলেও বিদ্বানেরা তো জানবেনই। মনে প্রশ্ন জাগে না, যে নিচের ঘটনাগুলোর পাশাপাশি ঘটা নিছক কাকতালীয় না অন্তর্সম্পর্কিত? – (ক) ১৯৩৬এ বিহার ও ওড়িশার বিভাজন এবং ১৯৩৮এ বিহার বাঙালি সমিতির প্রতিষ্ঠা; (খ) ১৯৬৭ সালে বিহার সহিত নয়টি রাজ্যে সম্মিলিত বিধায়ক দলের সরকার প্রতিষ্ঠার আগের অস্থির সময় এবং তখনই, ১৯৬৬ সালে নিষ্ক্রিয়১ বিহার বাঙালি সমিতির পুনর্গঠন এবং পুনরুজ্জীবন; (গ) ২০০০ সালে বিহার ও ঝাড়খন্ডের বিভাজন এবং ২০০৬ সালে বিহার বাঙালি সমিতির বিকাশের নতুন পর্যায়ের প্রারম্ভ!
তারও আগে গেলে, বাংলা-বিহার বিভাজনের পরেই তো ইংরেজ প্রশাসন
কর্তৃক ডোমিসাইল রুল সম্পর্কিত সার্কুলার জারি হওয়া, বিহারে বাঙালিদের সঙ্গে সরকারি
দুর্ব্যবহারের প্রারম্ভ ও ফলশ্রুতিতে বিহার বাঙালি সমিতির জন্ম।
সমাজবিজ্ঞানে কার্য্যকারণ সম্পর্কগুলো এত সরল হয় না। তবে
এটা স্পষ্ট যে সমিতির কাজেকর্মে ব্যস্ততা যখনই বেড়েছে, নতুন উদ্যমে যখনই শুরু হয়েছে
সাংগঠনিক উজ্জীবন, তার সম সময়ে দেখা যাচ্ছে একটা ভৌগোলিক বিভাজন। অর্থাৎ, হয়তো এভাবেও বলা যায় যে (১) যখনই বিহার
ছিন্ন হয়েছে, সেখানকার বাঙালির বাঙালিত্বের যে একটা জনবিস্তৃতি, একটা বিশেষ সামাজিক
অস্মিতা ছিল সে-যাবৎ স্মৃতি ও সত্তায়, তাতেই সবচেয়ে প্রবল কুড়ুলের ঘা পড়েছে; (২) আবার
তখনই সরকারে, প্রশাসনে ও মিডিয়ার একাংশে বেড়েছে বিশেষ করে বাঙালিদেরই বিহারের জনজীবন
থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা – কখনো ‘বহিরাগত’, কখনো
‘নগণ্য’ বা
‘নেই’ বলে,
আর (৩) তখনই অবশিষ্ট বাঙালির বেশি করে মনে হয়েছে তাদের সংগঠনটাকে জিইয়ে রাখার কথা।
প্রথম বার তো মূল বাংলাই বিচ্ছিন্ন হল, তারপর ওড়িশা বিচ্ছিন্ন
হল, তারপর মানভূমের বড় অংশ বিচ্ছিন্ন হল (প্রভাবটা পড়তে সময় লাগলো সংগঠন একেবারেই নিষ্ক্রিয়
ছিল বলে; রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হওয়ার চাপে চাগিয়ে উঠলো) আর সব শেষে ঝাড়খন্ড বিচ্ছিন্ন
হল, নতুন অধ্যায় শুরু হল।
মোটামুটি ভাবে বলতে গেলে সমিতির ইতিহাসে বিকাশের এই যে তিনটে
পর্যায় আছে সে-তিনটেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে।
১
১৯৩৮ সালে বিহার বাঙালি সমিতির প্রতিষ্ঠা হল। পাটনার এংলো-স্যাংস্কৃট
স্কুলে ১২ই ফেব্রুয়ারি যে বৈঠকে সমিতির প্রতিষ্ঠা হল, তাতে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা
সারা বিহার থেকে এসেছিলেন। পাঠানো নোটিসে লেখা ছিল –
“A representative meeting of
the Bengalees residing in Bihar will be held at the Suhrid Parishad and Hemchandra
Library on Saturday, the 12th February at 5 p.m. to consider various
questions of interest to the community and to organise a strong Central
Association of the Bengalees in Bihar on a democratic basis.
“You are cordially invited
to attend.”
P. R. Das
Convener
এই নোটিসে মোট একুশটা জেলা সদর বা শহর – পাটনা,
রাঁচি, গয়া, ছাপরা, ডালটনগঞ্জ, পুরুলিয়া, ভাগলপুর, জামশেদপুর, ঝরিয়া, পূর্ণিয়া, মুজঃফরপুর,
দ্বারভাঙ্গা, মোতিহারী, আরা, সাঁওতাল পরগণা, হাজারীবাগ, মুঙ্গের, সমস্তিপুর, চাইবাসা,
পাকুড় এবং দুমকা – থেকে মানুষ এসেছিল।
কোনও কারণে সুহৃদ পরিষদ ও হেমচন্দ্র গ্রন্থাগারে বৈঠক হতে
পারে নি, এখন যে স্কুলটাকে আমরা পি এন এংলো স্কুল বলে জানি, সেখানে হয়েছিল।
স্পষ্টতঃ সমিতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একজন ব্যক্তি কর্তৃক
(তা সে যতই স্বনামধন্য হন না কেন) আহ্বায়িত বৈঠকে এতগুলো জেলা থেকে মানুষের আসা প্রমাণ
করে সংগঠন গড়ার প্রয়োজনীয়তা বিশেষ বোঝাতে হয় নি, সবারই মনের চাহিদা ছিল।
তার প্রধান কারণটা সবাই জানেন। ভকতপ্রসাদ মজুমদার এবং গুরুচরণ
সামন্ত লিখিত “বিহার বাঙালি সমিতির ইতিবৃত্ত” বিগত
পঁচিশ বছর ধরে সমিতির দপ্তরে লভ্য। তাতে সমিতির প্রথম বার্ষিক অধিবেশনে (জামশেদপুর,
৮ই এপ্রিল ১৯৩৯) প্রথম সম্পাদক শৈলেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণের প্রাসঙ্গিক
অংশ উদ্ধৃত করা হয়েছে। এদিকে দু’তিন বছরে কলকাতা আন্তর্জাতিক
পুস্তক মেলা উপলক্ষে দুটো বইও প্রকাশিত হয়েছে – ‘বিহার
বাঙালি সমিতি, সংহতি ও সমন্বয়ে …” এবং ইংরেজিতে “দি বিহারি
বেঙ্গলি কোশ্চেন”। কাজেই সে বিষয় নিয়ে এখন আলোচনা
করবো না।
কিন্তু অন্য একটি দিক উল্লেখ করা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে
না। উপরুল্লিখিত “… ইতিবৃত্ত” বলছে
–
“১৯৩৮ থেকেই যে কেউ জাতি, ধর্ম,
পেশা নির্বিশেষে সমিতির সদস্য হতে পারেন। সমিতির সকল সদস্যই বিহারবাসী। … ১৯৩৮
সালে যাঁরা দাতা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে পুরুলিয়ার ললিত মিত্র মহাশয়ের এক হাজার টাকা ও
দেওঘরের শিবকালী সোম মহাশয়ের পাঁচ টাকা দান সম্পাদক কর্তৃক সমান প্রশংসায় স্বীকৃত হয়েছে।
… পুনর্গঠিত সমিতির বীরকিটি এবং আগলই শাখার সকল কর্মকর্তাই
ইসলাম ধর্মাবলম্বী, অধিকাংশ সদস্যও তাই। ১৯৭৮-এর ধলভূমগড় শাখার সম্পাদক ছিলেন শ্রী
মাধব রাও (বাঙলা ও তেলেগুভাষী), মোসাবনী শাখার সভাপতি ছিলেন শ্রী যদুনাথ বাস্কে (বাঙলা
ও সাঁওতালীভাষী) এবং সহ-সভাপতি ছিলেন শ্রী হৃষিকেশ দাশ (বাঙলা ও ওড়িয়াভাষী)।”
১৯৩৮এর পর থেকে সমিতির বার্ষিক অধিবেশন হয় যথাক্রমে, জামশেদপুর
(১৯৩৯), হাজারিবাগ (১৯৪০), মুজঃফরপুর (১৯৪১), ভাগলপুর (১৯৪২), মুঙ্গের (১৯৪৩), দ্বারভাঙ্গা
(১৯৪৪), পুরুলিয়া (১৯৪৫), পাটনা (১৯৪৬), জামশেদপুর (১৯৪৭)।
এই দশ বছরে সমিতির ‘লক্ষ্য
ও উদ্দেশ্য’ অনুসারে কী কী কাজ হয়েছিল তার
বিস্তারিত বিবরণ এ মুহূর্তে লভ্য নয়। ‘ডোমিসাইল
রূল’ নামক বিভেদনীতিটার আক্রমণ প্রতিহত করার প্রথম উদ্দেশ্যে
যে সমিতি সফল হয়েছিল তা সবাই জানেন। এবং এই লড়াইয়ে সমিতি যে নিজের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক
চরিত্রকে সুসংহত করেছিল তা, সদস্যতা ও সম্মেলন সম্পর্কিত ওপরের দুটো প্যারাগ্রাফেই
স্পষ্ট।
‘ … ইতিবৃত্ত’এ লেখা
আছে, “১৯৪১-এর পর থেকে ধীরে ধীরে, এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত
সমিতি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।” খুব স্বাভাবিক! বিহার
বাঙালি সমিতির ইতিহাসের প্রথম পর্যায় শুরু হওয়ার দেড় বছরের মধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
এবং চার বছরের মাথায় শুরু হয় ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’
এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়। সমিতির চরিত্র প্রথম থেকেই ‘অরাজনৈতিক’। যদিও
জাতীয় স্বাধীনতা সঙ্কীর্ণ অর্থে শুধুমাত্র রাজনৈতিক এজেন্ডা নয় তবু সমিতির ব্যানারে
সে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। কেননা সদস্যরা সবাই নিশ্চয়ই কোনো একটি ভাবধারার
মানুষ ছিলেন না। তাই তাঁরা নাগরিক হিসেবেই সে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে থাকবেন। আর দেশের
ভবিষ্যৎ-নির্দ্ধারক সর্বাত্মক আন্দোলনে ছোটো ছোটো ভাষিক ও অন্যান্য পরিচয়-ভিত্তিক সংগঠনগুলোর
কাজকর্মে ভাঁটার টান আসবে সেটাই তো স্বাভাবিক!
১৯৩৮ সালে সমিতির প্রতিষ্ঠা-বৈঠকেই ‘বিহার
হেরাল্ড’এর তদানীন্তন মালিক রায় বাহাদুর
মিহির নাথ রায় পত্রিকাটির মালিকানা অধিকার বিহার বাঙালি সমিতিকে দেওয়ার প্রস্তাব দেন।
সমিতি সে প্রস্তাব স্বীকার করে। ‘বিহার হেরাল্ড’এর ওপরে
আমরা আজও লেখা দেখতে পাই, ‘সেকুলারিজম এ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি
ইজ আওয়ার মোটো’। আপাততঃ বিহার হেরাল্ড ডিজিটাইজেশনের
কাজ চলছে। হয়ে গেলে আমরা ওই পত্রিকারই পৃষ্ঠা থেকে হয়তো সমিতির ১৯৩৮-১৯৪৭ পর্যায়ের
কাজকর্ম সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য পাবো।
কেউ বলতে পারে, স্বাধীনতা সংগ্রামের বছরগুলো তো বুঝলাম।
তারপর? তা, তারপরের বছরগুলো কি দেখতে পান? সাতচল্লিশে দেশভাগের মর্মান্তিক রাজনৈতিক
চক্রান্তের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা, পঞ্চাশে সংবিধান গ্রহণ, একান্নোয় প্রথম পাঁচসালা
পরিকল্পনা, একান্নো-বাহান্নোয় প্রথম সাধারণ নির্বাচন, তিপ্পান্নোয় রাজ্য পুনর্গঠন আয়োগ
গঠন, পঞ্চান্নোয় তার রিপোর্ট ও পুনর্গঠনের কাজ শুরু, ছাপ্পান্নোয় দ্বিতীয় পাঁচসালা
এবং শিল্পনীতি প্রস্তাব, এক দিকে দেশের শ্রীবৃদ্ধি আর অন্য দিকে মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্য-যোগান,
বেকারি, দারিদ্র-দূরীকরণ ইত্যাদি প্রশ্নে ব্যাপক মোহভঙ্গ … আর
এই দেড় দশক ধরে ক্রমাগত গভীর হয়ে চলেছে বাঙালির জীবনে ও মননে উদ্বাস্তু-সমস্যা! হ্যাঁ,
সমস্যাটা উদ্বাস্তুদের তো বটেই, কিন্তু সাধারণভাবে বাঙালিদেরও তো। তাদের সার্বিক যাপনকে
প্রভাবিত করছে প্রতিনিয়ত। বিধান রায় তো উদ্বাস্তু ছিলেন না। পাটনায় জন্ম, বাল্যকাল
… শেষে কিম্বদন্তী ডাক্তার এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
অথচ স্বাধীনতার পর প্রথম পাটনায় এলেন কী করতে? না নিজের পৈত্রিক ভিটেতে নিজের মা-বাবার
নামে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু কেন? পাটনায় আসা বাঙালি উদ্বাস্তু দুস্থ পরিবারের
মেয়েদের নিখরচায় পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে। যারা শিক্ষিকা/শিক্ষক হলেন, প্রধান শিক্ষিকা
হলেন তাঁরা কিন্তু উদ্বাস্তু নন। খাস পাটনার বাঙালি। কিন্তু উদ্বাস্তু-সমস্যা তাঁদের
ব্যবহারিক জীবনে ও সাংস্কৃতিক/নৈতিক মননে ঢুকে গেল।
সাতচল্লিশের উদ্বাস্তু বিহারে ষাটের দশক অব্দি এসেছে। ছত্তিসগড়ে
দন্ডকারণ্যে গেছে ১৯৬৩তে। স্বাভাবিক ভাবে বিহারের বাঙালিদের ‘সমিতিত্ব’টাই
প্রশ্নসঙ্কুল হয়ে উঠছিল। দুই দশক নিষ্ক্রিয় থাকা স্বাভাবিক।
২
দ্বিতীয় পর্যায় ১৯৬৬তে শুরু হল। ‘ … ইতিবৃত্ত’ বলছে,
“১৯৬৬তে এটি পুনর্গঠিত হয় এবং কেন্দ্রীয় কমিটি ২৫শে
ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ সালে, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার ত্রিশ বছর পরেও পূর্বোক্ত চারটি ধারাই যথাযথ
বজায় রাখে। কেবল Provinceএর বদলে State শব্দ
ব্যবহৃত হয়, কারণ ১৯৫০ সালের ভারতীয় সংবিধানে রাজ্যগুলিকে State আখ্যা দেওয়া হয়। উল্লিখিত
তারিখে আরও যে কয়েকটি উদ্দেশ্য সংযোজিত হয়, তার মূল বিষয় হল – বাঙলা
ভাষা ও সাহিত্যের সংরক্ষণ ও পরিবর্দ্ধন করা; শিক্ষা ও অন্যান্য কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান
স্থাপন ও অধিগ্রহণ করা; পুস্তকাগার স্থাপন ও পরিচালনা করা, ছাপাখানা চালানো এবং পুস্তক
ও পত্রিকা প্রকাশ করা; নানাবিধ প্রতিষ্ঠান স্থাপন প্রভৃতি।”
এই পর্যায়ের ইতিহাসটা আমরা অনেকেই জানি। বর্তমান বরিষ্ঠ
সদস্যদের মধ্যে অনেকে আছেন যাঁরা এই পর্যায়ের বিভিন্ন গতিবিধিতে অংশগ্রহণ করেছেন। এই
পর্যায়ের বিরাট তিনটে কাজের মধ্যে একটা হল ১৯৭৪ সালে কর্মাটাঁড়ে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগরের বাড়ি ‘নন্দনকানন’ অধিগ্রহণ,
সংরক্ষণ, উন্নতিসাধন (রাজ্য, কেন্দ্র সরকার ও রেল মন্ত্রককে অনবরত দাবি জানিয়ে শেষে
১৯৭৮ সালে কর্মাটাঁড় রেলস্টেশনের নাম ‘বিদ্যাসাগর’ করাতে
পারা); উল্লেখ্য যে সেই দশকের শেষে যখন কেন্দ্রীয় সরকারের
‘প্রৌঢ় শিক্ষা কার্যক্রম’ শুরু
হয় তার ১০০টা কেন্দ্রের সঞ্চালন কেন্দ্র বা হাব হয় নন্দনকাননে।
দ্বিতীয় বিরাট কাজ হল ১৯৮১তে সরকারের ওপর চাও সৃষ্টি করতে
সাংগঠনিক স্তরে বাংলা আকাডেমি প্রতিষ্ঠা ও এক বছর পর সরকারকে দিয়ে ভারতের প্রথম বাংলা
আকাডেমি (বিহার বাঙলা আকাডেমি) প্রতিষ্ঠা করাতে পারা।
তৃতীয় কাজ হল, বিহারের স্থানীয় ভাষিক আবহে পশ্চিমবঙ্গের
বাংলা পাঠ্যপুস্তকে ছাত্রদের অসুবিধে হচ্ছে বুঝে বিহারের নিজস্ব বাংলা পাঠ্যপুস্তক
তৈরি করানো। শিক্ষা বিভাগকে দিয়ে তার সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য এনসিইআরটির
সহযোগিতায় ওয়র্কশপের আয়োজন করে নতুন পাঠ্যপুস্তক তৈরি হয় এবং স্কুলে স্কুলে সেসব পাঠ্যপুস্তকই
স্বীকৃত হয়।
চতুর্থ কাজ, ‘বেহার
হেরাল্ড’এর নিয়মিত প্রকাশন এবং বেশ কয়েকটি
শহরে বাঙালি-অবাঙালি ঘরে ঘরে পৌঁছ, এবং প্রথমে সাহিত্যপত্র হিসেবে ও পরে সাংগঠনিক মুখপত্র
ও বুলেটিন হিসেবে ‘সঞ্চিতা’র নিয়মিত
প্রকাশন।
পঞ্চম কাজ, বিভিন্ন দাবিদাওয়া ও নালিশের নিষ্পত্তি করতে
সরকার ও প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত বার্তা।
এবং, ষষ্ঠ কাজ, যেটা বস্তুতঃ প্রথম কাজ, সংগঠনটাকে আবার
দাঁড় করানো। ‘ … ইতিবৃত্ত’ বলছে
–
“পুনর্গঠনের সময় ১৯৬৬ সালে আগস্ট
মাসে পাটনা শাখাই ছিল একমাত্র২ শাখা। ১৯৬৮র মে মাস পর্য্যন্ত এইভাবে চলার
পর ১৯৬৮র আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভাগলপুর ছাড়া আরো ৮টি শাখা পুনর্গঠনের পর থেকে
শাখা ও সদস্য ছিল নিম্নরূপ – …”
দেখা যাচ্ছে শাখার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে আগামী তেরো বছরে ১০২এ
পৌঁছেছে আর ‘প্রাপ্ত লেভী অনুসারে সদস্য সংখ্যা’ আগামী
উনিশ বছরে ১১০০০এ পৌঁছেছে।
সংখ্যাই বলছে, (এবং সে তথ্য সমর্থনকারী অন্যান্য দস্তাবেজও
আছে), সদস্যতা আর উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তে সীমিত নেই, শহরের গরীব বাঙালি শুধু নয়, গ্রামের
চাষি বাঙালি অব্দি ছড়িয়েছে।
৩
তৃতীয় পর্যায় শুরু হওয়ার সময় আর নতুন শতক ও সহস্রাব্দ শুরু
হওয়ার সময় এক হয়ে গেছে কেননা তখনই বিহারকে বিভাজিত করে ঝাড়খন্ড রাজ্য তৈরি করা হল।
তৃতীয় পর্যায় মানে এ নয় যে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের মাঝের দু’দশক
যেমন সমিতি নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল, দ্বিতীয় ও তৃতীয়ের মাঝেও তেমন কোনো কালখন্ড আছে। না।
আশির দশকে আকাডেমির কাজ বিস্ময়কর! সে তুলনায় নন্দনকাননের কাজ একটু স্তিমিত। নব্বইয়ের
দশকে নব্দনকাননের কাজ আবার গতি পেয়েছে। আকাডেমির কাজ একটু কমেছে। সংগঠন এগিয়েছে। সর্বভারতীয়
একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শেষে ভারতীয় বাংলাভাষী মহাসভার আয়োজন হয়েছে
পাটনায়।
কিন্তু এটা উল্লেখ্য যে জনজীবনের ধারায় পরিবর্তনের প্রভাব
অন্য সবার মত বিহারের বাঙালিদের ওপরও পড়েছিল। স্বাধীনতা-উত্তর যে ভারতীয় জীবন এক বিশেষ
অর্থনীতির ক্রমবিকাশে (এবং ডামাডোলে, সমস্যায়, সংগ্রামে) চলতে অভ্যস্ত ছিল তার সব কিছু
ওলটপালট করে দিয়েছিল ১৯৯১ – একদিকে সোভিয়েত বিপর্যয়,
নতুন অর্থনীতি আর অন্যদিকে নতুন তথ্যপ্রযুক্তির নতুন দিগন্তের উন্মোচন। এবং তার প্রভাব
সমিতির কাজকর্মের ওপরও পড়ছিল।
তৃতীয় পর্যায়ের কাজকর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ‘বিহার
বাঙালি সমিতি, সংহতি ও সমন্বয় …’ বইটায় আছে। কাজেই সেসব
বলে আর কথা বাড়াবো না। শুধু সেই আলোচনাগুলোরই প্রসঙ্গ টেনে বলবো, তৃতীয় পর্যায়ের প্রধান
বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
(১) বিহারের বিভিন্ন জেলায় গ্রামাঞ্চলবাসী বাঙালি উদ্বাস্তুদের
মধ্যে বিহার বাঙালি সমিতিকে ছড়িয়ে দেওয়া হল। বৃহত্তর অর্থে, বিহারবাসী সাড়ে ছয় লক্ষ
উদ্বাস্তুর সমস্যাকে সমিতি নিজের দায়িত্ব করে নিল। ফলে, সদস্যতার শ্রেণীচরিত্র জনজীবনের
আরো গভীরে প্রবেশ করলো। (সিংভূম, ধলভূম, মানভূম বা সাঁওতাল পরগণার গ্রামীণ বাঙালির
স্বার্থরক্ষা এখন যেমন ঝাড়খন্ড বাঙালি সমিতির কর্তব্য, বিহারে পুনর্বাসিত বাঙালি উদ্বাস্তুসমাজের
স্বার্থরক্ষা এখন বিহার বাঙালি সমিতির কর্তব্য।) এই বিরাট পদক্ষেপের চমকপ্রদ ফলশ্রুতি
– চম্পারণের যে উদ্বাস্তু বাঙালি প্রায় ‘ইচ্ছাকৃত’ ভাবে
বাংলা ভুলে ভোজপুরি সমাজের লেজুড় হয়ে বাস করছিল, ছ-সাত বছরে তারা আবার ‘বাঙালি’ হয়ে
পঞ্চায়েত ও জেলা পর্ষদ নির্বাচনে ১০০র বেশি সংখ্যায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হল।
(২) সংগ্রামের নতুন পথে বিহার বাঙালি সমিতিকে চলতে দেখা
গেল। জেলায় জেলায় ধরনা, জেলাশাসকের কাছে ডেপুটেশন ও স্মারকলিপি প্রদান, রাজধানীতে কেন্দ্রীয়
ধরনা, মিছিল, গ্রামে গ্রামে প্রচারসভা ও শেষে ভোট বয়কটের ডাক … এসব
অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন ছিল। এবং তার প্রভাবও অকল্পনীয় হল। যে রাজ্যের প্রশাসন তাচ্ছিল্যের
সুরে বলেছিল “বিহারে আর বাঙালি কই” সেই
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সমিতির সভাপতিকে ডেকে পাঠিয়ে প্রশাসনিক বৈঠক ডেকে দাবিদাওয়াগুলোর
নিষ্পত্তি করলো। বিহার রাজ্য সংখ্যালঘু আয়োগে রোটেশনে একজন বাঙালি উপাধ্যক্ষ নেওয়ার
কথা থাকলেও প্রথম ২০১১ সালে সমিতির সভাপতিকে সরকার উপাধ্যক্ষ নামিত করলো।
(৩) বিহার বাঙালি সমিতি, ঝাড়খন্ড বাঙালি সমিতিকে সঙ্গে নিয়ে
নতুনভাবে বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা সমিতি ও নন্দনকানন পরিচালন সমিতি তৈরি করলো। বিদ্যাসাগরের
জন্মদিন ও মৃত্যুদিন ছাড়াও ‘গুরুদক্ষিণা’ নামে
একটি নতুন বাৎসরিক কর্মসূচি নেওয়া হল। একদিকে স্থানীয় স্কুলগুলোর ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ
মানুষকে অনুষ্ঠানের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হল এবং অন্য দিকে বিদ্যাসাগরের দ্বিশতজন্মবার্ষিকী
উপলক্ষে এশিয়াটিক সোসাইটি এবং বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক
স্থাপিত হল। বিভিন্ন দাতা ও ঝাড়খন্ড সরকারের সহযোগিতায় নন্দনকানন এখন সেজে উঠেছে। এখন
ব্লকের নামও বিদ্যাসাগর।
(৪) প্রায় দুই দশক পর বিহার বাঙলা আকাডেমি ২০১২ এবং ২০১৩য়
দুটো আন্তর্জাতিক সেমিনার করলো। ২০১৬ অব্দি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশন তো হলই, পাঠ্যপুস্তক
(তৈরি হওয়া সত্ত্বেও) মুদ্রিত হয় নি বলে স্কুলে স্কুলে, আকাডেমির তরফ থেকে তার ফটোকপি
বিনামূল্যে বিতরণ করা হল।
(৫) ১৯৮৭ থেকে বন্ধ পড়ে থাকা ‘বেহার
হেরাল্ড’এর প্রকাশন ২০১৫ থেকে আবার শুরু
হল। ‘বেহার হেরাল্ড’এর সংরক্ষিত
পুরোনো সংখ্যাগুলোর ডিজিটাল-করণ, উইকিপিডিয়ার পশ্চিমবঙ্গ গ্রুপের সহযোগিতায় শুরু হয়েছে।
কোরোনার সময় ‘সঞ্চিতা’ প্রকাশ
বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলা উপলক্ষে প্রতি বছর ‘সঞ্চিতা,
সাহিত্য সংখ্যা’ প্রকাশিত হচ্ছে। এই পর্যায়ে
সমিতি আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করেছে যার মধ্যে আছে, ত্রিভাষিক সচিত্র রবীন্দ্রজীবনী,
সমিতির প্রতিষ্ঠাতা শ্রী পি. আর. দাশ লিখিত ‘দি বেঙ্গলি
বিহারি কোশ্চেন’এর নতুন সংস্করণ এবং ‘বিহার
বাঙালি সমিতি, সংহতি ও সমন্বয় …’। ২০১৭ সাল থেকে সমিতি
‘বিহার বাংলা সাহিত্য সম্মেলন’এর আয়োজন
করেছিল। পরে ভাগলপুরেও সে আয়োজন হয়।
(৬) ২০১১ সালে পাটনায়, মুজফফরপুরে এবং ভাগলপুরে কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশতবার্ষিকী উদযাপন করা হল। স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। তার
আগে ২০০৬ সালে বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশের
সার্দ্ধশতবার্ষিকী উদযাপন হয়েছিল।
(৭) বহির্বঙ্গের বাঙালিদের ঐক্যকে লক্ষ্যে রেখে ২০১১ সালেই
পাটনায় ভারতীয় বঙ্গভাষী মহাসভার অধিবেশন হয়েছিল। তারপর বেশ কয়েকবার সমিতির সম্মেলনে
বহির্বঙ্গের অতিথিরা এসেছেন। ইতিমধ্যে দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া বেঙ্গলি এসোসিয়েশন তৈরি
হয়েছে। বিহার বাঙালি সমিতি তার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সদ্য কলকাতায় সমিতি ‘বিহার
বঙ্গভাষী সম্মেলন’এর আয়োজন করলো।
(৮) বিহার বাঙালি সমিতি নিজের নিয়মাবলী অনুসারে বিদ্যালয়
ও অন্যান্য সংস্থাকে সম্বদ্ধতা প্রদান করতে পারে। পাটনার রামমোহন রায় সেমিনারি এখন
বিহার বাঙালি সমিতির সঙ্গে সম্বদ্ধ। সে ছাড়া পাটনার অঘোর প্রকাশ শিশু সদনের পরিচালন
সমিতিও বিহার বাঙালি সমিতির দায়িত্ব। মুজফফরপুরের হরিসভা স্কুলও বিহার বাঙালি সমিতির
মুজফফরপুর শাখা পরিচালন করে। সমিতির শাখাগুলো স্থানীয় সংখ্যালঘু বাঙালি বিদ্যালয়, গ্রন্থাগার
ইত্যাদি যে সংস্থারই রক্ষণাবেক্ষণে থাকুক না কেন, সেগুলোর ওপর নজর রাখবে এবং সমিতির
কেন্দ্রে সে সম্পর্কে প্রতিবেদন পাঠাবে যাতে ভূমি-মাফিয়াচক্রে বেহাত হওয়ার পরিস্থিতি
এলে সরকার ও মিডিয়াকে ওয়াকিবহাল করা যায় – এটা
কেন্দ্রীয় পরামর্শ।
………………………
এখন ২০২৪। সমিতির কার্যনির্বাহী সমিতির গড় আয়ু পঞ্চাশের
কম হবে না। সেটাকে কমিয়ে চল্লিশে নিয়ে আসা আমাদের আশু কর্তব্য। কীভাবে করবো, সেটাই
হবে আগামী সভা ও সম্মেলনগুলোর প্রধান বিচার্য বিষয়। যদি করতে পারি, তাহলেই আপাততঃ বন্ধ
পড়ে থাকা আকাডেমিকে আবার চালু করাতে পারবো, অমুদ্রিত বাংলা বই মুদ্রিত ও বিতরিত করাতে
পারবো, বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আপামর বিহারি-বাঙালির ভালোবাসা উজ্জীবিত রাখতে
পারবো (যার ফলে বিহারের সার্বিক উন্নয়নে তাদের অংশীদারি আরো ভালো হবে), সমিতির গতি
অপ্রতিহত থাকবে এবং ২০৩৭এ আমরা সমিতির শতবর্ষে প্রবেশ করবো।
--------
১। ভকতপ্রসাদ মজুমদার এবং গুরুচরণ সামন্ত লিখিত “বিহার
বাঙালি সমিতির ইতিবৃত্ত” বলছে, “১৯৪১-এর
পর থেকে ধীরে ধীরে, এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত সমিতি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, ১৯৫৬
সালে মানভূম জেলার ১৯টা থানা সম্বলিত এলাকা পুরুলিয়া জেলা হয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়ার
এবং ফলে মানভূম ভাষা আন্দোলনের চুড়ান্ত দিনগুলো আর পরিসমাপ্তির বছরগুলোয় বিহার বাঙালি
সমিতি নিষ্ক্রিয় ছিল।
২। মনে রাখতে হবে ১৯৩৮এর ১২ই ফেব্রুয়ারি ২১টা শহর থেকে প্রতিনিধি
এসে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিল।
No comments:
Post a Comment