বিহার বাঙালি সমিতির বার্তা নিয়ে একবার উত্তর-পূর্ব ভারতের বাঙালিদের মাঝে পৌঁছোতে পারলে ভালো হয়, এই প্রস্তাবটা প্রথম দিয়েছিলেন সমিতির সর্বপরিচিত শুভানুধ্যায়ী প্রফেসর তন্ময় বীর। কিন্তু সুযোগ আসছিলো না। গত বছর, বোধহয় মে মাসেই একটা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার প্রস্তাব এল, কিন্তু আমরাই নানান ব্যস্ততায় সুযোগটা হারালাম। নভেম্বরে যখন ‘বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন’এর তরফ থেকে তাঁদের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ এল, ডাক্তারবাবুকে বলায় তিনি সাগ্রহে স্বীকার করে নিলেন।
১৮ই জানুয়ারি বিকেলে
রওনা হয়ে রাতে কলকাতা। শেষ রাতে শিলচরের দিকে উড়লাম। শীতরোদে শিলচর থেকে বেরিয়ে দু’ঘন্টা পর করিমগঞ্জ।
করিমগঞ্জে আগে কখনো
যাই নি। বস্তুতঃ, বরাকবঙ্গে বা বরাক উপত্যকার কোনো শহরেই আগে কখনো যাই নি। একবার বহু
আগে আমি শিলচরে এক রাত হোটেলে থেকেছিলাম কিন্তু সে সফরের উদ্দেশ্য ভিন্ন ছিল। এমনকি
শিলচরের ভাষা শহীদদের কথাও তখন জানতাম না।
শিলচরে আমাদের সফরসঙ্গী
হলেন করিমগঞ্জের এক তরুণ স্কুলশিক্ষক এবং গাড়ির চালক। দুজনেই করিমগঞ্জের বাসিন্দা।
আগেই যেমন বলা ছিল, শহরে ঢুকে সবচেয়ে আগে রেলস্টেশন চত্বরে ‘ভাষা-শহীদ স্মারকস্তম্ভে’ ফুল দিলাম।
এটা ডাক্তারবাবুর আর আমার দুজনেরই বহু দিনকার ইচ্ছে ছিল।
করিমগঞ্জ এখন জেলা
সদর। সম্মেলন উপলক্ষে শহরের বেশ কয়েকটি জায়গায় আলাদা আলাদা ধরণের অনুষ্ঠান চলছে সেটা
জেনেছিলাম। কিন্তু শহরটা একেবারেই অজানা বলে একা একা বেরিয়ে ঘুরে আসা সম্ভব ছিল না।
হোটেল থেকে বেরিয়ে নিজেরাই সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জায়গাটার দিকে রওনা দেব কিনা
ভেবে ফোন করছিলাম তখনই আমাদের সঙ্গী এবং গাইড হিসেবে ‘নিযুক্ত’ করিমগঞ্জ কলেজে
ইতিহাসের অধ্যাপক বজলুর রহমান খাঁ সাহেব দেখা দিলেন। আগামী দু’দিন আমরা নিজেদেরকে তাঁর হাতেই সঁপে দিলাম।
বজলুরভাই ছিলেন বলে
যে ব্যাপারটা আন্দাজ করতাম সেটা করিমগঞ্জ শহরে সন্ধ্যায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম। বেঁচে
থাকার স্তরে স্তরে বাংলা ভাষিক-জাতীয়তার বিভাজনের যন্ত্রণা। যদি শহরের একেকটা এলাকা
পার হতে হতে কানে শোনেন – এই যে রাস্তার বাঁকটা
দেখছেন এখানে একটা খাল ছিল (এবং তারপর সে খাল-সম্পর্কিত জনশ্রুতি); ওই যে আলোটা দেখছেন
ওর পাশ দিয়েই আমরা বাড়ি ফিরতাম, এখন ওটা অন্য দেশ (এবং তারপর সে বাড়ি ফেরার গল্প) …, আপনার ভিতরটাতেও পাড় ভাঙতে থাকে।
আর তারপর! এক ষড়যন্ত্রমূলকভাবে
সীমায়িত গণভোটে (সিলেট রেফারেন্ডাম ১৯৪৭) সিলেট জেলাকে দুভাগে ভাগ করার বাহাত্তর বছর
বাদে যারা ভারতে থাকার পক্ষে রায় দিয়েছিল তাদেরই সরকারি আমলা আর পুলিস এসে ধমকায়, “কাগজ দেখান! প্রমাণ করুন যে আপনারা ঘুসপেঠিয়া, বহিরাগত নন!” আর তাও শুধু কোনো স্থানিক দুর্বৃত্তায়ন বা প্রশাসনিক অব্যবস্থার
কারণে নয়, দেশের নতুন আইনের অনুপালনে … তখন কেমন
লাগে?
আমরা যারা বিহারে
থাকি, আমাদের বুকে বিভাজনের কষ্টটা এক রকম। ভৌগোলিক ভাবে দূরের, এবং অনেক ক্ষেত্রে
সামাজিক স্মৃতিবাহিত। কিন্তু যাকে বরাকবঙ্গ বলা হয় তার বুকে বিভাজনের কষ্টটা প্রতিদিনকার,
যেন ঘরের দরজার পাল্লায় একটা খোলা পেরেক বা টিনের ফালি, খুলতে যাই অথবা বন্ধ করতে যাই,
রোজ একই জায়গায় খচ করে বিঁধে জখম করে দেয় – জখমের ওপর
জখম; আর সারতেই চায় না। কুশিয়ারার ওপারের অন্ধকার যেমন, সামনে এসে দাঁড়ানো অস্ত্রসজ্জিত
বিএসএফও তেমন, জখমটা খুঁচিয়ে দেয়।
অনুষ্ঠানের মঞ্চ অব্দি পুরো রাস্তাটা সাংস্কৃতিক ইতিহাসের স্থানিকতার জানান দিচ্ছিল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল বিপিনচন্দ্র পাল স্মৃতিভবনে। তিনি ভারতের জাতীয় নেতা, লাল-বাল-পাল ত্রয়ীর অংশ, এবং অবিভক্ত সিলেটের মানুষ। করিমগঞ্জ থেকে জকিগঞ্জ হয়ে সড়কপথে চার ঘন্টার পথ হবিগঞ্জ; সেখানেই তাঁর জন্ম। সেই স্মৃতিভবনে যাওয়ার রাস্তার মুখে বসানো হয়েছিল মুজতবা আলি স্মৃতি তোরণ। সৈয়দ মুজতবা আলির জন্ম তো খাস করিমগঞ্জেই। তোরণ পেরোবার পর ছিল একে একে ‘নলিনীকান্ত দাশ স্মৃতিতোরণ’, ‘মতীন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতিতোরণ’, ‘সুজিত চৌধুরি স্মৃতিতোরণ’, ‘নৃপতিরঞ্জন চৌধুরি স্মৃতিতোরণ’, ‘তরুণ দাস স্মৃতিতোরণ’, ‘সুবীর কর স্মৃতিতোরণ’ … আরো অনেক। বিপিনচন্দ্র পাল স্মৃতিভবনে ঢুকে বোর্ডে নজর বুলিয়ে দেখলাম এঁদের অনেকেই ‘বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন’এর করিমগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি বা সম্পাদক ছিলেন এক সময়।
বিহারকে জবরদস্তি বহির্বঙ্গ করা হয় নি। মধ্যযুগ থেকেই বিহারের ভাষিক-জাতীয় স্বরূপ ভিন্ন হতে শুরু করেছিল। আকবরের আমলের পনেরটা সুবার মধ্যে বিহার আলাদা, বঙ্গাল আলাদা। ইংরেজ আমলে প্রশাসনের সুবিধের জন্য প্রেসিডেন্সিতে শামিল করে নিলেই তো বিহার আর বাংলা এক হয়ে যায় না! বিশ শতকের শুরুতে বিহার-ওড়িশাকে বাংলা থেকে ছিন্ন করার পিছনে ইংরেজদের অভিসন্ধি বা কুমতলব যাই থাক না কেন, উনিশ শতকের শেষে শুধু শিক্ষিত বিহারিরাই চাইছিলেন তা নয়। বিচক্ষণ বাঙালিদেরও একাংশ বুঝছিলেন যে বিহারকে আলাদা করতেই হবে আজ নয় তো কাল। ভাষিক-আদমশুমারিতে বিহার বহির্বঙ্গই ছিল। কিন্তু বরাকবঙ্গ – শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি অঞ্চল তো খাস অন্তর্বঙ্গ! বিভাজনের লীলায় কি অদ্ভুত ভাবে বহির্বঙ্গ হয়ে উঠল! ভারতের ভাষা-মানচিত্রের হিসেবে দেখলে, পশ্চিমবঙ্গকে মূলভূমি ধরতে হয়। বিহারের মাননীয় রাজ্যপাল আবার গতবছর কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অনুসারে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ উদযাপন করতে বিহার বাঙালি সমিতিকে ডেকেছিলেন। আমারও কিছু বলার সৌভাগ্য হয়েছিল। বলেছিলাম, আমি খাস পাটনার জক্কনপুর মোহল্লার বাঙালি স্যার …! অর্থাৎ, আদতে বিহারি। কিন্তু করিমগঞ্জের বাঙালি? বা সিলেটের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক? বাংলার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক? তার ভৌগোলিক ছেদটা জোর করে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হয়েছে। তারপর সামাজিক, সাংস্কৃতিক দুর্ব্যবহারের কয়েকটা স্তর গড়ে উঠেছে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় অর্থনীতির সঙ্কটপর্বগুলোকে কাটাতে প্রয়োজনীয় ক্রমবর্দ্ধমান রাজনৈতিক সুবিধেবাদে।
স্থানিক ইতিহাস নিয়ে আজকাল বেশ কাজকর্ম হচ্ছে। কখনো কোথাও কোনো সভায় শুনেছিলাম তামিলনাডুতে এটা একটা আন্দোলনের মত। কোনো গ্রুপ একেকটা গ্রাম ধরে তার ইতিহাস, অনুলিখিত বা কথিত, সিডিতে ধরে রাখতে শুরু করেছে। পাটনায় আমার যখন যেখানে সুযোগ হয়েছে, এর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছি। এদিকে একেবারে ভিন্ন দিক থেকে ব্যাপারটা প্রণোদিত হয়েছে। মোবাইলের যুগে সামাজিক মাধ্যম আজ এক রাত-দিন বহমান মিলনমেলা। তাতে অনেকেই নিজের নিজের এলাকার ছেলেমেয়েদের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে সেই এলাকাটা সম্পর্কেও বলেন। ইউপিএসসির পরীক্ষায় হোক, বড় বিজ্ঞান সংস্থার বড় চাকরি পাওয়ায় হোক, টেলিভিশনে গান, নাচের প্রতিযোগিতায় হোক, তরুণ মুখগুলোর মফস্বলী বা গ্রামীণ শিকড় চাগিয়ে দিচ্ছে সেই এলাকাটা সম্পর্কে জানার ইচ্ছে। বিজ্ঞাপনে ট্যাগলাইন আসছে ‘রামপুরকে লোকে আজ পার্ক (একটা স্পোর্ট) দিয়ে চেনে’। ওমুক গ্রামের মেয়েদের কথা আসছে, তারা স্থানীয় এফএম রেডিও চালায় নারীদের ওপর জুলুমের প্রতিরোধে। হরিয়াণার মেয়ে কুস্তিগীর বা মণিপুরের মেয়ে বক্সার, আসামের মেয়ে ওয়েটলিফটার, এমনকি বড় বড় কম্পানির মেয়ে বাউন্সারেরাও সব গ্রামের মেয়ে এবং তাদের মুখে উঠে আসছে সেই গ্রামের সামাজিক দ্বন্দ্বের কথা – সেই সব মানুষের কথা যারা হাজার প্রতিকূলতার মধ্যে ঐ মেয়েদের সমর্থন করেছে, সাহস যুগিয়েছে। অতীত পথ দেখাচ্ছে বর্তমানকে। বই, উপন্যাস লেখা হচ্ছে ছোটো ছোটো শহরকে বিষয় করে, তারা ভেঙে দিচ্ছে মেট্রোপলিসের বা রাজধানীর গুমোর। যদিও বস্তুনিষ্ঠ স্থানীয় ইতিহাস একটা ভিন্ন কাজ। তবে কাজটার গুরুত্ব আজ অনেকে বুঝছে। আর করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, শিলচর বা বরাক এলাকার স্থানিক ইতিহাস এখানকার মানুষজনের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ কেননা সেটা শুধু বিভাজনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের প্রতি ক্ষোভ নয়, পরবর্তী পঁচাত্তর বছরের সামাজিক, ভাষিক ও সাংস্কৃতিক দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ।
সম্মেলনে পর পর তিন
দিন তিনটে আলোচনাচক্র ছিল, “উত্তরপূর্ব ভারতের
বাঙালিঃ অস্তিত্ব, সঙ্কট ও উত্তরণ”, “বাঙালির জাতিপরিচয় ও সংস্কৃতির বিকাশঃ স্মৃতি ও সত্তার উত্তরাধিকার” এবং “সমস্যাদীর্ণ বরাক
উপত্যকাঃ ভবিষ্যতের পথচিন্তা”। আমরা শুধু দ্বিতীয়টাতেই
অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু তিনটেরই বিষয়ের উল্লেখ করলাম প্রেক্ষিতটা বোঝাতে।
দুদিনের যাত্রায়
অনেক মানুষের সঙ্গে আলাপ হল। তাঁদের কারোরই জীবনযাপন বরাকে সীমিত নয়। অনেকেরই বিহার
বা হিন্দী এলাকার মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে। কলকাতা যাওয়া আসা তো আছেই। কিন্তু কথায়
বার বার অন্ধকার দুশ্চিন্তার ফিরে আসছিল ‘তৃতীয়’ আলোচনাচক্রের বিষয়টা – বরাকঃ ভবিষ্যতের
পথচিন্তা! আর চিন্তার কারণগুলোও স্পষ্ট। দেখতে পাওয়া যাচ্ছিলো – সাংস্কৃতিক সম্মেলনের ওপর গোয়েন্দা খবরদারি আর পরের দিন রাস্তায়
গেরুয়া মিছিলে। সরকারি ব্যাঙ্কের কয়েকটা শাখা দেখলাম, সাইনবোর্ডে বাংলা নেই। ভাষিক
জনসংখ্যার নকশাটা সময়ের সঙ্গে পাল্টাবেই। রোজগার, ব্যবসা সবই বাইরে থেকে লোক টানবে।
কিন্তু সেটাকে কাজে লাগিয়ে মূলনিবাসীকেই কোনঠাসা করে দেওয়া! ‘বহিরাগত’র সন্দেহ ছড়িয়ে দেওয়া
দেশের মনে। তাদের প্রতি, যারা জনমতের বিরুদ্ধে হওয়া জনমতসংগ্রহেও (উপরুল্লিখিত রেফারেন্ডামে)
এদেশে থাকার পক্ষে রায় দিয়েছিলো!
সংগঠনের কর্মকর্তা
ও কর্মী-স্বেচ্ছাসেবকদের আন্তরিক আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। আর এলাহি খাবার ব্যবস্থায় প্রায়
হাবুডুবু খেলাম।
এক অদেখা বাংলার
স্বপ্নলীন স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে ফিরলাম।
২৩.২.২৪
No comments:
Post a Comment