Monday, September 19, 2022

লিপাপোতি

চাঁদের আলোয় ফাঁদের মজলিস। গুপ্ত কিন্তু মন্ত্রণা নয়, মন্ত্রসভা। যারা এসেছে শপথ নিয়ে এসেছে যে হৃদয় খুলে কথা বলবে। এখন যুঝছে এই সমস্যা থেকে বেরুতে। তৈরি করছে আরেকটা হৃদয় যেটা খোলা ক্ষতিকর হবে না, মানে লগ অন টু দ্বিতীয় হৃদয়!

ফ্ল্যাট বাড়ির বড় ছাতের এক কোনায় একটা বাল্ব জ্বালানর ব্যবস্থা হয়েছে। মাদুর বিছিয়ে বসেছে নাইন ম্যান কমিটি আমি, রাজীব, আসিফ, বরুণদা, অবধেশ, অমর, শেখর, সীতারাম আর মদন সিং। মদন সিংএরই প্রস্তাব মত এই মজলিশ, আমার বাড়িতে।

এই মজলিশের চার বছর পর মদন সিং মুখের ক্যান্সারের চিকিৎসা আরম্ভ করেছিল আর সাত বছরের মাথায় মারা গেল।

একটু পরে নিচে, ফ্ল্যাটে গিয়ে আমি একটা বড় গামলায় করে মুড়ি, ছোলা, বাদাম আর একটা ছোটো গামলায় করে সিঙাড়া নিয়ে এলাম। জল আগেই এনে রেখে দিয়েছি। চায়ের ব্যবস্থা পরে হবে।

মন খুলে কথা না বললে এই বসার কোনো মানে হয় না মদন সিং বলল, আমি জানিনা আপনারা বুঝতে পারছেন কিনা যে সংগঠনের দুজন নেতৃস্থানীয় সদস্যের মাঝের এই শীতযুদ্ধ কীরকম খারাপ প্রভাব ফেলছে সংগঠনের ওপর।

সত্যি খুব খারাপ, বরুণদা একটা ছোলা ভেঙে তার খোসার গুঁড়ো ফুঁয়ে উড়িয়ে একটা অংশ মুখে ফেলে বললেন, সংগঠনের প্রগতি আটকে গেছে সুদ্ধু এই টেনশনে আমরা ঐক্যবদ্ধ একটা নেতৃত্ব নিয়ে যেতে পারছি না কর্মচারীদের কাছে।"

ওঃ, আসল কথাটাই তো বলতে ভুলে গেছি। যে দুজনের ছত্রিশের পরিসংখ্যান (ছত্তিস কা আঁকড়া, মানে দেবনাগরিতে লেখা তিন আর ছয়ের মত একে অন্যের দিকে পিঠ ফিরিয়ে থাকা) মেটাতে এই মন্ত্রসভা বা সঙ্কল্প সমারোহ সেই অমর আর অবধেশের মধ্যে দ্বিতীয়জন তখন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক (রাজীবের পর) আর প্রথমজন সর্বভারতীয় পরিচালনা সমিতির যুগ্মসচিব।

মুড়ি, ছোলা, বাদাম হল, এক রাউন্ড চা হল, আরেক রাউন্ড চায়ের প্রস্তাবে না না হল, যারা সিগরেট খায় না তাদেরও দুএকজন দেখি একটা বলে সিগরেট চেয়ে খেল। ফ্ল্যাটবাড়ির সান্ধ্যভ্রমণকারী বাসিন্দারা ছাতে হাঁটতে উঠে বেশ কয়েকবার আলোর বৃত্তে এসে কুশল বিনিময় করে গেল, বুঝতে চেষ্টা করে গেল আলোচনার জটিল বিষয়টি কী।

-   শান্তিতে বসে একটু কথা বলার উপায় নেই। এক এক করে এসে শুঁকে যাচ্ছে।

-   এপার্টমেন্টের ছাত তো আর মিটিংএর জায়গা নয়!

-   মিটিং কোথায়? যে বাড়িতে থাকি সে বাড়ির ছাতে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আড্ডা মারতে পারব না?

-   ছাড় ওসব। রাত হয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমরা কোথায় পৌঁছোলাম?

যেখান থেকে চলা শুরু করেছিলাম, ফুট কাটল শেখর। এত পেসিমিস্টিক হোয়ো না বরুণদা ঠোঁটে একটু সমর্থনের হাসি অথচ চোখে একটু ধমক ফুটিয়ে বললেন, অমর আর অবধেশ দুজনেই স্বীকার করছে যে ব্যাপারটা নেহাৎই মনকষাকষি। অবধেশের অনুযোগ যে অমর সিনিয়র হয়েও তার সাথে সেভাবে সহযোগিতা করেনি যেমন ও আশা করেছিল; তাই সিনিয়র হিসেবে শ্রদ্ধা বা কোনো কমরেডলি ফিলিং ও অমরের প্রতি রাখতে পারে না। অমরও ওরই কথার প্রতিধ্বনি করছে যে অবধেশ ওকে কমরেডলি ফিলিং বা সিনিয়র হিসেবে রিগার্ড দেখায় না বলে ও অবধেশকে কাছে টানতে পারে না। দুজনেই এটাও মানছে যে এটা সংগঠনের পক্ষে ক্ষতিকর। এখন বরফ ভাঙতে উদ্যোগী হতে হবে দুজনকেই। সংগঠন সর্বোপরি। সংগঠনের পক্ষে যা ক্ষতিকর তা কখনো চলতে পারে না।

শেখর আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, বরুণদা চুপ করিয়ে দিলেন, এসব মনকষাকষি কাজের মধ্যে দিয়েই শেষ হতে পারে। একসাথে মিলে কাজ করো। একসাথে ট্যুর প্রোগ্রাম করো। ম্যানেজমেন্টের কাছে একসঙ্গে যাও। যা কিছু কর্মসূচি আসছে ওপর থেকে বা আমরাই তৈরি করছি সেগুলো রূপায়িত করো একসঙ্গে। অসুখটাও নতুন নয়, চিকিৎসাও নতুন নয়। চিকিৎসা না করলে তার ফলটাও তোমাদেরই ভোগ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা সংগঠনে আমির স্থান নেই। আমিকে ত্যাগ করতে হবে। কী? ঠিক তো? সবাই একমত এ বিষয়ে?

কে আর বলবে না। ঐক্যমতের বেশ একটা ঝোড়ো গুঞ্জন বয়ে গেল ছোটখাটো।

 

বরুণদা আগে থেকে যাব যাব করলেও নিচে নেমে আমার ফ্ল্যাটে ঢুকলেন। কুশল বিনিময়। আমি বেসমেন্টে গিয়ে একে একে সবাইকে বিদায় করলাম। রাজীব রয়ে গেল। শেখরও রয়ে গেল। একটু পরে বরুণদাও নেমে এলেন।

খুব ভালো হল, না? আজকের মিটিংটা? শেখর বরুণদাকে শুনিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কত সুন্দর সবাই হৃদয় খুলে কথা বলল, মনকষাকষি মিটে গেল, অহঙ্কার পরিত্যাজ্য হবে আজ থেকে, এরকম একটা সিদ্ধান্ত হয়ে গেল প্রায়!

বরুণদা হেসে উঠলেন। বাইফোকাল চশমা পরা মানুষেরা দরাজ ভাবে মুখ ছড়িয়ে চোখ কুঁচকে হাসলে চোখদুটো কপালের দিকে উঠছে এমন একটা আভাস হয়, বুঝছ তো সবই। এভাবেই চলবে কিছুদিন। কোনো উপায় নেই। এটা একটা প্রসেস।

চোখের কোনে জল এসে গিয়েছিল। চশমা খুলে মুছতে মুছতে বললেন, ইউনিয়ন বলো, পার্টি বলো, কমরেড কথাটার মূলেও আছে বন্ধুত্ব আর শেষ প্রান্তে গিয়েও বন্ধুত্ব। কমরেড মানে হৃদয়ের, মস্তিষ্কের এবং কাজের শ্রেষ্ঠ বন্ধুত্ব। হৃদয় থাকবে না, কাছের মানুষকে কাছে টানার জোর থাকবে না, মস্তিষ্কে থাকবে চেতনার অভাব আর তিকড়মবাজি তাহলে কাজের ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব কতদিন টিঁকবে? আবার এটাও ঠিক যে শেষমেশ কাজের বন্ধুত্বই ধীরে ধীরে মাথাটাকে পরিষ্কার করে আর হৃদয়টাকে খোলার রাস্তা দেয় সেটারই চেষ্টা করি, আর কি!

-   যাই বলুন, এ হচ্ছে শুধু লিপাপোতি! মুখের ওপর সত্যি কথাটা কেউ বলছে না যে দুজনেই একে অন্যকে ভিতর থেকে অবিশ্বাস করে। এবং কেন করে, তার গোড়াটা আছে অন্য কোথাও হয়ত যখন ওরা দুজনে একসাথে এক ব্রাঞ্চে কাজ করত তখনকার কিছু ঘটনা থেকে, বা তারও আগে থেকে।

-   হতে পারে। (একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বরুণদা) কিন্তু ওই লিপাপোতি না কী যেন বললে! ওর মানে কী?

-   লিপাপোতির আবার মানে কী? লিপাপোতি মানে লিপাপোতি! মানে ভাঙা, ফাটা পুরোনো মালের ওপর রঙ চড়িয়ে বাজারে ছাড়া, স্যাঁতস্যাঁতে ফাটল ধরা বাড়ি, চুনকাম, ডিস্টেম্পার করে নতুন দেখানো লিপা মানে প্রলেপ লাগানো, পোতি অর্থে গাঢ় করে রঙ চড়ানো।

-   লিপাপোতি, লিপাপোতি বাঃ! কিন্তু তার মানে পুরোনো বাড়িতে চুনকাম হওয়া উচিৎ নয়, তুমি বলছ?

-   উচিৎ নয় কে বলছে? কিন্তু ভিতরে ফাটল তো রয়েই গেল। ফাটলটা ভরবে কী করে?

-   সে ঠিক কথা। কিন্তু চুনকামটাও তো হওয়া দরকার। ফাটলটা লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে। সামনে ম্যানেজমেন্ট। পাশে লেঙ্গি মারার জন্য রাইভ্যাল ইউনিয়ন। ফাটলটা দেখনাই হয়ে থাকলে চলবে?

-   না, তা চলবে না। কিন্তু ফাটলটা ভরতেও হবে তো? ভিতরে ভিতরে যদি ইঁটে নোনা ধরে গিয়ে থাকে? জল ঢুকে লোহার ছড়ে যদি জং ধরে গিয়ে থাকে পুরোটা?

যাহোক একটা কথা বুঝলাম, রাজীব পিছন থেকে এসে এক হাত আমার কাঁধে আরেক হাত শেখরের কাঁধে রেখে দাঁড়ালো, আমি হলাম চুন, শেখর জল আর সুমন আঠা। বরুণদার দিকে ছুঁড়ল, আপনি ডিস্টেম্পার! আর বাকি সবাই সিঁড়ি, দড়িদড়া, বুরুশ !

-   ???

-   আরে, নাইনম্যান কমিটি তো তৈরি হয়ে গেল! সেই নজনের দুজনে ফাটল। বাকি সাতজন সব সময় ঘিরে থাকুন। দুজনের একজন কেউ উল্টোপাল্টা মুখ খুললেই কভার করুন!

ফাজলামো রাখ। আচ্ছা তোমাদের কেন মনে হচ্ছে কিছুতেই কিছু হবে না?, বরুনদা সবার দিকেই প্রশ্নটা ছুঁড়লেন, কোনো একটা সমাধানে পৌঁছোবার তো এটাই পথ!

কেননা এটা বাংলা নয়, বিহার। শেখর মুখটা নির্বিকার রেখে বলল। ওর বলার ভঙ্গীতে কিছু ছিল, আমরা সবাই চোখ ঘোরালাম।

-   জাতপাতের জায়গাটা মনে রাখতে হবে। দুজনই নিজেদের জাতের বিশেষত্বের অহঙ্কারে কোনো জাতকে নিজেদের ধারে কাছে গণ্য করে না।

-   মানে?

-   একজনের জাত, উঁচু হলেও মাঝারি, কিন্তু শিক্ষায় সবার থেকে এগিয়ে। আরেকজনের জাত, নিচু হলেও মাঝারি, কিন্তু বুদ্ধিতে আর সামাজিক ক্রিয়াকর্মে ব্রাহ্মণতুল্য। দুজনে কখনো একে অন্যকে বিশ্বাস করতে পারে না। পারত যদি ততটা উঁচুতে নিজেকে তুলতে পারত। তার জন্য দরকার সত্যিকারের শিক্ষা। দুজনের মধ্যে সেটা পাওয়ার ইচ্ছেটুকুও নেই।

আমি তো আমি, বরুণদাও হাঁ করে চেয়েছিলেন।

কথার কী জোর! এই জন্য বলি যে মদ না খাও না খাও, কিন্তু মোদোদের ছেড় না। মগজ খোলসা থাকে ওদের! কিন্তু কাজে?

জানি না। মদ ছাড়লে তবে তো! পরিবারে সমস্যাও আছে। সেটাও হয়ত একটা কারণ মদ খাওয়ার। সেও তো এক লিপাপোতি! বুকের যন্ত্রণার লিপাপোতি!  

 

ঠিক আছে, বাড়ি যাও তোমরা, আমিও বেরোবো, বরুণদা বললেন, সত্যিই ইঁটে নোনা ধরে গিয়ে থাকলে বা ছড়ে জং ধরে থাকলে ভেঙে নতুন করে গড়তে হবে। দরকার হলে দুজনকেই বাদ দিতে হবে সুযোগ সুবিধে মত। তবে সংগঠনটা ধরে রেখেই তো! তাই আপাততঃ লিপাপোতিই চলুক, যদ্দিন চলে।

 

 

No comments:

Post a Comment