নিজের বক্তব্যের শেষ অংশে পৌঁছে জয়িতা ওরকম একটা খোঁচা দিয়ে গেলেন ? এধরণের খোঁচাগুলো
বিজনের একেবারে বরদাস্ত হয় না। সোজাসুজি সমালোচনা করুন ! তা না, আস্তে করে ইঙ্গিতে
একটা খোঁচা দিয়ে মনের কথাটা চেপে যাওয়া … রাগ ধরে যায়।
“আমরা তো জানিই যে
(একটু মিষ্টি হেসে) সতীপ্রথা, বিধবাবিবাহে নিষেধ এসব সমাজের খুবই সীমিত অংশের সমস্যা
ছিল … বেঙ্গল রেনেসাঁ বলতে যা কিছু হয়েছিল তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, আমি তাতে যাচ্ছি
না।” বলে ব্যস, চুপ? আপনি বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষের অনুষ্ঠানেই বলতে এসেছেন, এটুকুও বলুন যে বাংলায় এবং ভারতে সেই সীমিত অর্থেই
নাহয়, নারীমুক্তির প্রশ্নে একটা প্রাথমিক ধাক্কা, স্থিতাবস্থা ভাঙার একটা সম্ভাবনা
জাগানোর সংকেত রামমোহন এবং বিদ্যাসাগরই দিয়েছিলেন ! বললেন না কেন?
আর না হলে বলুন যে আরো অনেক কিছু উনি করেন নি কেননা উনিও শেষ অর্থে ইংরেজ সমর্থক
মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের চাকুরিজীবী অংশের একজন … ওই লাইনটাই ধরুন
বা আরো এগোন … মূর্তির মাথাটা ভাঙুন আবার … তা নয়, পাথরের কানে
একটা কাগজকাটা ছুরির খোঁচা দিয়ে কি ভাবব্যঞ্জনা জাগিয়ে গেলেন? …
এটা ডিশনেস্টি। অথচ জয়িতাকে ডিশনেস্ট ভাবতেও খারাপ লাগে। দেখছে না হয় আজ প্রথম।
চেনে তো তিরিশ বছর ধরে ! ওর বড় হওয়া, সুন্দরী বলে, নর্তকী বলে নামডাক হওয়া, অনেকের
বুক জ্বালিয়ে একটি তামিল ছেলেকে বিয়ে করা, দাপুটে শিক্ষিকা হওয়া, বামপন্থী রাজনীতির
মহলে ঘোরা ফেরা … !
অটো ধরছিল তখনই ফোন এল স্বর্ণেন্দুদার, “একবার আসবে? খুব
জরুরি কিছু কথা আছে।“ বলে দিল ক্লান্ত আছি, কাল আসব। হয়ত একটু রুঢ়ভাবেই বলল। আসলে
স্বর্ণেন্দুদার ডাক এলেই দ্বিধায় পড়ে যায় বিজন। কারণ তাঁর খুব জরুরি কথাগুলো কখনই তার
খুব জরুরি মনে হয় না। অথচ ডাকটা উপেক্ষা করতে পারে না কেননা সব সময় তিনি একটু অসুস্থ
থাকেন। চোখের জন্য রাতে চলাফেরা করতেও অসুবিধা হয়।
অটোটা ছেড়ে দিল মাঝপথে, শুনেই আসি কী বলেন ! ওভারব্রিজটার সাইডওয়াক ধরে রেললাইন
পেরিয়ে হাঁটা দিল পুরোন পাড়ার রাস্তায়। আগে তারা থাকত এদিকেই। এখন নিজেদের ফ্ল্যাটে
চলে গেছে, ঈষৎ একটেরে একটা দিকে।
রাস্তাটাই তো বদলে যায় প্রতিদিন ! এখান থেকে বাঁক নেওয়ার আগে একবার বাঁদিকে চোখ
তুললে – কৃষ্ণ প্রতিপদের সন্ধ্যায় বিরাট কমলা রঙের চাঁদ উঠত শিরিষের মাথায়, ‘পদাবলী চাঁদ’, কোথাও লিখেছিল বিজন – এখন একটা টাওয়ার ক্রেন আর জেসিবি। চারদিকে গর্ত ভরাট করা আবর্জনার স্তুপ। কিছু
একটা তৈরি হচ্ছে বড় সড় !
-
এসেই পড়লাম। আবার
কাল হবে কি হবে না। বলুন !
-
ভালো করলে। বস !
এ্যাই … বিজন এসেছে !
কেতকীবৌদি বেরিয়ে এলেন, “পরোটা খাবে? বানাচ্ছি।“
-
না, এখন খেয়ে নিলে
বাড়িতে বকুনি খেতে হবে।
-
কটা বাজে? আটটা তো
! একটা পরোটা খেলে কী হবে? দাঁড়াও দিচ্ছি।
কথাটা জরুরিই ছিল। তবে এতে তার কিছু করার আছে বলে বিজন মনে করল না। সব জায়গায়
নাক গলালে চলে না। বিকেলের আলোচনাচক্রে জয়িতার খোঁচা মারা কথাটার উল্লেখ করল।
-
ও তো ওই লাইনেই আছে।
নবজাগরণের যে কী গুরুত্ব অনেকেই বোঝে না। তারা জানেও না যে তারা নবজাগরণেরই সন্তান।
বিদ্যাসাগরের কাজ তো বহু বৎসর পর্যন্ত অন্তরালেই থেকে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের যে বাণী,
অক্ষয় মনুষ্যত্বের কথা, অজেয় পৌরুষের কথা, কতদিন তার মর্ম বোঝেনি মানুষ!
জীবনে কখনো এসব এত সিরিয়াসলি চর্চা করে নি। মাথা ভাঙা সমর্থন করে নি কেন না ওই
রাজনীতি তখনও বড় গোলমেলে মনে হয়েছে বিজনের। আর মূর্তির মাথা ভাঙা কোন ধরণের প্রতীকী
প্রতিবাদ? ইডিয়টিক! … কিন্তু এখন চর্চা করতে বাধ্য হচ্ছে কেন না কাজগুলো ঘাড়ে এসে
পড়ছে। স্বর্ণেন্দুদাদের ভাবনাচিন্তার মধ্যে একটা মাস্টারমশাই টাইপের ব্যাপার আছে – প্রাতঃস্মরণীয়রা প্রাতঃস্মরণীয়, এখনো তাদের সামনে ধরেই পেরোতে হবে আজকের ভাঙন
আর সংকট। নাঃ, একটা যোগসূত্র হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা আছে, একটা ধারাবাহিকতাই কিন্তু
ডায়ালেকটিক …
বাড়ি ফেরার আগে কয়েকটা ওষুধ কিনতে হত। দোকানে দাঁড়িয়ে ব্যাগে প্রেস্ক্রিপশনটা
খুঁজতে খুঁজতেই ফোন এল। তুলে দেখল পার্টি অফিসের ল্যান্ডলাইন। শিউনাথজি। “দাদা, সামনের শনিবারে মধুবনি যেতে পারবেন?”
-
কেন?
-
ইউথের ক্লাস। সুনীলজির
যাওয়ার ছিল, উনি যেতে পারছেন না। নিন, সেক্রেটারির সাথে কথা বলুন।
যেতে আপত্তি ছিল না। অন্য কোন সেরকম কাজও নেই। রাজি হয়ে গেল। সাতসকালে বাস ধরতে
হবে এই যা।
সবচেয়ে বড় সমস্যা বিজনের নিজের ভিতরের। পাঁচ রকম ভাবে পাঁচটা খোপ কাটা ঘরে বাঁচতে
হলে ও ভিতর থেকে যুৎ পায় না। এই স্বর্ণেন্দুদার তোলা বিষয়, ওদিকে জয়িতার বক্তব্যের
বিরুদ্ধে মনে উঠতে থাকা রাগ, আগামী শনিবার, রোববার মধুবনিতে বলার জন্য নোট তৈরি করা
… সব যেন এক সূত্রে বাঁধা হয়, মানে বাঁধা তো আছেই, ও যেন দেখতে পায় সূত্রটা … এমনকি বাড়ি, পরিবার … ভাবতে ভাবতে মোবাইলটা চোখের কাছে আনল – সাড়ে ন’টা। পৌঁছোতে পৌঁছোতে দশটা। এমন কোন ব্যাপার নয় তবে রাতে রাস্তাটা
হাইওয়ের মত হয়ে যায়। সারাদিন জিরো মাইলে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকগুলো ঢুকতে থাকে আর দূরপাল্লার
বাসগুলো বেরুতে থাকে একের পর এক। রাস্তা পার হওয়াও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়।
বাড়ি পৌঁছে দেখল মোটামুটি সব ঠিক আছে। কারোর চোখে মুখে বিশেষ টেনশন নেই। এটুকুই
দেখে সে। একধরণের স্বার্থপরতাই বলা যায়। শুধু নিজের কাজের সুবিধেটুকু পেতে। কেননা সত্যিই
টেনশনের মত কিছু হয়ে থাকলে কাজে মন বসে না তার। এতটা সন্ন্যাসী হতে পারে নি। রাতে বৌয়ের
সাথে হলে শারীরিক যে ব্যাপারটা থাকত এখন বয়সে সেটাও স্তিমিত।
-
এত রাতে ফিরে এসেও
আবার কাজ নিয়ে বসলে? মশারিটাও টাঙাও নি।
-
আমিই টাঙাব, প্লিজ,
রাগ কোরো না। এক্ষুনি গুটিয়ে ফেলছি, কয়েকটা পয়েন্ট লিখে নিই।
সেই তো এক দাবি ওদের – বেসিক মার্ক্সিজ্ম। অবশ্য ইউথে নতুন ছেলেমেয়েরা আসতে থাকেই।
কিন্তু তাদের জন্য আলাদা করে ক্লাসের ব্যবস্থা না করে সম্মেলন উপলক্ষ্যে একবেলা ক্লাস,
শ’দেড়েক ছেলে, হয়ত মেয়েও অল্প কয়েকজন, কোঁ কোঁ আওয়াজ করা মাইক, শোরগোল … ক্লাস, লেকচার কিছুই হয় না শেষ পর্য্যন্ত … তবু দেখব চেষ্টা
করে নতুন, আজকের দিনের উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারগুলো বোঝাবার। তবে সেসব কাল ভাবব, এখন শুধু
কয়েকটা পয়েন্ট লিখে নিই। …
২
আলোচনাচক্রের সংগঠকদের মধ্যে বিজনও ছিল। দুমাস আগে যখন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে
মিটিং করা হয়েছিল তাতে বক্তাদের মধ্যে জয়িতার নামটা সে-ই ঢুকিয়েছিল। জোর করে নয় অবশ্য,
খুশি মনেই সমর্থন জানিয়েছিল সবাই। চেনা মুখ। মহিলা। একটা ব্যালেন্সও থাকবে। আর বিজন
এ ব্যাপারে সব সময় একটু সচেতন থাকে – মহিলা কতজন? অনুপাত?
সকালে উঠে নোটটা নিয়ে বসতেই কাল সন্ধ্যের কথা মনে পড়ল। কিছু পয়সাও তার দেওয়ার
ছিল – খরচের ভার নেওয়ার অংশিদারিতে। দিয়েছে কিনা তাও মনে নেই। একটু বেলায় জিজ্ঞেস করতে
হবে নিলেশকে। প্রেসে বক্তব্য লিখে দেওয়ার কাজটা নিলেশেরই করার ছিল। হোয়াটস্যাপে একটা
মেসেজ করল, খবরের কাগজে কিছু বেরিয়েছে কিনা জানাতে, অথবা সোজা ফেসবুকে পোস্ট করতে।
তারপর বাজারে বেরুল। আজ বুধবার। একটাই দিন যাতে সবাই আমিষ খাবে। যা আচার অনুষ্ঠানের
ধুম পড়েছে বিদ্যাসাগরের দেশে ! কারোর অমুক দিন মানা কারো তমুক দিন। একমাত্র বিজনেরই
কোনো মানা নেই কিন্তু আবার সেই একমাত্র যে মাছ-মাংস-ডিম ছেড়ে কুমড়ো ডাঁটা আর কলমি শাক
আর মাদ্রাজি ওল খোঁজে। … কে জানে, গিয়ে হয়ত দেখব মাছের দোকানগুলো বন্ধ। কী? না আজকে কাঁঠাল
অমাবস্যা – ভক্তিনরা গঙ্গাস্নানে যাবে ! পাছে মাছের ছোঁয়া লাগে তাই ভক্তরা
ফতোয়া জারি করেছে আজ মাছের দোকান বন্ধ থাকবে।
যাহোক খোলা ছিল। মাছউলি অদূরে ছায়ায় বসে ছিল, এল না। নিজের ছেলের বৌকে (? নাকি
বাপের বাড়ি আসা বিবাহিতা মেয়েকে?) পাঠিয়ে দিল। মেয়েটির বাঁ হাতে একটাও আঙুল নেই, একটুকরো
তেলো শুধু। প্রথম যেদিন দেখেছিল বিজনের মনে চকিতে এসেছিল কুষ্ঠ নয় তো? এখনো লজ্জিত
হয়। কতরকম ভাবে দলা পাকিয়ে, মুচড়ে, বিকৃত হয়ে থাকে আমাদের মন!
বাজার যাওয়া আসার বড় রাস্তার একদিকে ল্যাটারাল ড্রেন, ওপরে পাটাতন বসিয়ে ফুটপাথ
করে দেওয়া হয়েছে – একাজটা নীতিশ কুমারের সরকার আসার পরেই হয়েছিল। রাস্তাটা চওড়া
কিন্তু গাড়ি বাঁচিয়ে চলার প্রশ্ন থাকে। তাই বিজন এই ফুটপাথ ধরেই আসে যায়। নিশ্চিন্তে
ভাবনাচিন্তা করা যায়। …
মার্ক্স। এংগেলস। বিদ্যাসাগর। অক্ষয় দত্ত। মার্ক্স বাকি তিনজনের থেকে দু’বছরের বড়। বা, বাকি তিনজন একই বয়সী।
বলা যায় কি? হ্যাঁ, বলা যায়, সময়কে একটা বিমূর্ত বিশ্বজনীন সময় হিসেবে দেখলে।
কিন্তু সময় তো একটা মাত্রা, বস্তুর গতির ! ১৮১৮/১৮২০র জার্মানি আর ১৮১৮/১৮২০র ভারত
কি এক বস্তু? অবশ্য সেটাও হয়, পৃথিবীর ভৌগোলিক এককটা ধরলে। ঐতিহাসিক সময়ের নিরিখে মার্ক্সকে
বাকি তিনজনের থেকে দু’বছরের বড় বা বাকি তিনজন সমবয়সী এমন বলা যায় না। মার্ক্স, এঙ্গেলস
অনেকটা এগিয়ে আছেন ঐতিহাসিক সময়ে। আবার গতিবেগ কিন্তু বিদ্যাসাগরের বেশি। আগামী দেড়শরও
কম বছরে বাংলা ও ভারত আধুনিক বিশ্বের অঙ্গ হয়ে উঠছে – অর্থনীতিতে, প্রকৌশলের ব্যবহারে, জ্ঞানচর্চার ব্যপকতায় পিছিয়ে আছে কিন্তু বোধে,
সচেতনতায় জার্মানি যতটা ভারতকে ধরতে পারছে, ভারতও জার্মানিকে ততটা ধরতে পারছে।
কাজেই বয়সে বড়, ছোট, সমবয়সী সব একটা স্তরে গিয়ে ফ্যালাসি। কী যেন বলে বাংলায়?
মনে পড়ল না। মোবাইল খুলে গুগলে বাংলাটা খুঁজল – ভ্রান্তি না হেত্বাভাস
– কোনটা ব্যবহার করা উচিত? প্রকৃত অর্থে হেত্বাভাসই হবে বোধহয়।
কিন্তু না। ভ্রান্তি বা হেত্বাভাস কোনোটাই বলা ঠিক হবে না। আজ আমরা তাদের সবারই
দ্বিশতবার্ষিকী নিয়ে চিন্তা করতে সক্ষম হয়েছি এটা সত্য। একশ বছর আগে তাঁদের শতবার্ষিকী
নিয়ে চিন্তা করতেও কিন্তু সক্ষম ছিলাম না – মার্ক্স-এঙ্গেলসের
তো নয়ই, বিদ্যাসাগর-অক্ষয় দত্তেরও নয়। জ্ঞান ও স্বাধীনতার সংগ্রাম আমাদের সক্ষম করেছে।
আর তাই হেত্বাভাসটাও চিনছি।
সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে সেটাও তো ভ্রান্তি ! ছিল না, হল। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে
ঘোরে সেটা জানার পর। অথচ এখনো রোজকার জীবনের সব কাজ ওই ভ্রান্তির ভাষাতেই চলছে – সূর্য উঠছে, ডুবছে … । আমাদেরও দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপন ওই হেত্বাভাসটা মেনে নিয়ে করলেই
বেশি সফল হবে। অনেকে না মেনেই করবে – প্রাতঃস্মরণীয় মনিষী
হিসেবে, পাশাপাশি টাঙানো ছবিতে মালা দেওয়ার মত। কিন্তু তাতে বিদ্যাসাগর- অক্ষয় দত্তকেও
বুঝতে অসুবিধে হবে আর মার্ক্স-এঙ্গেলসকেও!
কিন্তু, বিজন নোটটা সামনে রেখে আবার ভাবতে লাগল, সমস্যা তো অন্যখানে ! যারা মার্ক্স
(এঙ্গেলস ছেড়েদিলাম) করছে, তারা বিদ্যাসাগর (অক্ষয় দত্ত ছেড়েই দিলাম) করছে না, যারা
বিদ্যাসাগর করছে তারা মার্ক্স করছে না আর যারা দুটোই করছে, তারাও আলাদা আলাদা মন ও
সংবেদন নিয়ে করছে। এক সূত্রে, না পাশাপাশি ছবি নয়, জ্ঞানের সূত্রে এক শৃংখলায় আনছে
না।
সেটা আনতে হবে। কিভাবে? …
হঠাত থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল একটা বিশাল
গর্তের সামনে। পরপর দুটো পাটাতন সরিয়ে নিচে নামিয়ে রাখা ! কেন? ভেঙে গেছে? কংক্রিটের
স্ল্যাব? এক্ষুনি হুমড়ি খেয়ে পড়ত। অবশ্য অভাবনীয় কিছু নয়। অনেক জায়গাতেই এরকম হয়ে আছে
শহরে, সে নিজেই দেখেছে। তবু। মনে হল ফেসবুক আপডেটের ভালো বিষয় পাওয়া গেল। মোবাইলটা
বার করে দুটো ছবি তুলল। তারপর নিচে নেমে এগিয়ে আবার উঠে পড়ল ফুটপাথে।
৩
শনিবার ভোরবেলায় ফোন। কমরেড সুনীল।
-
তৈরি?
-
হ্যাঁ, তৈরি হচ্ছি।
নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনি কোথায়? দিল্লী?
-
না, যাইনি। আমিও
আপনার সঙ্গেই যাচ্ছি।
-
সে কি? তাহলে আমি
যাব কেন?
-
চলুন ! তৈরি হয়েছেন
যখন ! একসাথেই যাব দুজনে। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। ইউথের সম্মেলন তো। গাড়ির পয়সা দেবে।
সাতটা নাগাদ বেরিয়ে আসুন গলির মোড়ে। অবশ্য আমি বেরুলে পর ফোন করে দেব।
বাঃ, বড় গাড়ি ! এসিও চলছে। আরামে হাত-পা ছড়িয়ে যাওয়া যাবে। কিছুক্ষণেই গঙ্গা ব্রিজে
উঠে দ্রুত এগোতে লাগল। সকাল বলে জ্যাম নেই।
-
হ্যাঁ, কীভাবে বলবেন?
-
আপনারই তো প্রথমে
বলার কথা ছিল।
-
সে ছাড়ুন না। আপনি
আগে বলুন, তারপর আমি দেশ-প্রদেশের রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে বলব। শিক্ষাসম্পর্কিত কিছু
বিষয়ের ওপর ফোকাস করব।
-
আমার মাথায় এ ক’দিন ধরে অন্য একটা চিন্তা ঘুরছে। আপনি তো সেদিনের সেমিনারে যেতে পারেন নি। আমি
কার্ড পাঠিয়েছিলাম হোয়াটস্যাপে। ফেসবুকেও ট্যাগ করেছিলাম। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের
দ্বিশতবার্ষিকী আসছে তো আগামী বছর। সেই উপলক্ষ্যে একটা আলোচনাচক্র ডেকেছিল বাঙালি সমিতি।
জয়িতা সান্যালকে তো আপনি চেনেন ! অধ্যাপিকা। তাঁকেও ডেকেছিলাম। বিশেষ করে বামপন্থী
বলেই ডেকেছিলাম। কিন্তু মহিলা একটু অতিবামপন্থী স্মার্টনেস দেখিয়ে গেলেন।
মধুবনি পৌঁছোতে তিন ঘন্টা তো লাগবেই। কাজেই ধীরে সুস্থে নিজের ভাবনাগুলো কমরেডকে
জানাল বিজন।
-
সেসব তো বুঝলাম।
আপনি ভাবুন। কিন্তু এখন তো বক্তব্য রাখতে হবে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়ে সব। কীভাবে
মার্ক্সবাদের মূলতত্ত্বগুলো বোঝাবেন সেটাভাবতে চেষ্টা করুন।
মধুবনির এলাকাটা তার ভালোও লাগে আবার বিরক্তও করে। ভালো লাগে মিথিলাঞ্চলের গন্ধ,
সবুজ, গরম, মাখানা আর ভাষা। পুকুরের কৈ মাছের ঝোল, ভাত। বিভুতিবাবুর অঞ্চল। পান্ডৌলও
বেশি দূরে নয় আর দ্বারভাঙা তো আসতেই পড়ে। খারাপ লাগে ঘিঞ্জি এলাকার জলকাদায়। পাটনায়
তো ছোটবেলা থেকে জল ঠেঙিয়েই ঘুরছে প্রতি বছর তিন চার মাস। একই পরিস্থিতি অন্য কোথাও
দেখলে আর ঘুরতে ইচ্ছে করে না।
মূলতত্ত্ব। আবার সেই এক উদাহরণ – জলের বাষ্পায়ন,
ইলেক্ট্রন-প্রোটন, পূঁজিপতি-শ্রমিক, বিপ্লব … দেশের ইতিহাস, রোজকার
চেনাজানা ঘটনাবলি, (ছাত্র-যুব যখন), কলেজের বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন, রাস্তা মেরামত
নিয়ে, জলের সাম্পহাউজ চেয়ে পথ অবরোধ, ঝঞ্ঝাট এসব থেকে উদাহরণ পাওয়া যায় না? বা ধরা
যাক, এই বিদ্যাসাগর, রামমোহনেরই কাজ – সতীপ্রথারোধ, বিধবাবিবাহ
… এসবের মধ্যে দেখান যাবে না বিপরীতের ঐক্য ও সংঘর্ষ, পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত
পরিবর্তন, নিষেধের নিষেধ? …
সুনীলজির দিকে ঘুরে তাকাল বিজন। উনি বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ডাক না দিয়েই বলে
উঠল, “আমি এই দ্বৈত সত্ত্বা নিয়ে ভুগতে চাই না, বুঝলেন কমরেড। সেদিনের সেমিনারের প্রসঙ্গও
আলাদা আর চলতি কর্মসূচিটাও বাঙালি সমিতির। আর আজকের ক্লাসের প্রসঙ্গ আলাদা, কর্মসূচি
পার্টির। কিন্তু দেশ একটা আর আমিও একটাই। বিহারের বাঙালি তাই নিজের ভাষাগত অধিকারের
প্রশ্নেও থাকি। …… আজকে অন্যরকম ভাবে কথাগুলো বলার চেষ্টা করব কমরেড। বক্তব্য হয়ত
চুড়ান্ত অগোছালো হবে। আপনি সামলে নেবেন।”
সুনীলজি ঘুরে হাসলেন।
“নো প্রব্লেম। ওরাই
তো নতুন প্রজন্ম। ভরসা রাখুন!”
১৮.৯.২২
No comments:
Post a Comment