Friday, September 23, 2022

ঝান্ডাসাথিন

তোমায় নিয়ে যখনি খুব 
দর্পে কিছু বলার থাকে 
আমি আমার ভাষায় ফিরি, 
সে ভাষা জানোও না, 
বোঝোও না, করব কী ? 

এ জমি তোমার ভাষার, মানছি। 
আমিও তো আছি! 
জন্মকম্ম সব এখানে, 
ভাষা বলতে তোমার যেমন, 
আমারটাতেও থাকি।

এই যেমন আশ্বিনের চাঁদিফাটা রোদে 
সমাবেশে আসছে প্রাণের সমারোহে, 
দিনবদলে বিশ্বাসের জয় –

দেখছি তোমায়, এ বয়সেও
খাড়া আছো, কোমরে হাত, 
পাকা সাদা চুল উড়ছে কালো রোগা মুখে, 
বুকে ব্যাজ, কাঁধে লাল 
                       ঝান্ডায় পরিচয়।

তোমার কথা বলতে তোমার
কাছেই হই অচিন –

যখন থাকি সারা দেশে
বা দুনিয়ায় তোমার পাশে, ... 
ঝান্ডাসাথিন!

২৩.৯.২২



Wednesday, September 21, 2022

কাজে বস্তুবাদঃ প্রসঙ্গ নবজাগরণ

যা চলছে, সেটাকে ঈশ্বরের বিধান হিসেবে না মানা, ভাবা যে তা থেকে মুক্তি এই পার্থিব জীবনেই সম্ভব, সে মুক্তি আনার তাগিদে ক্রিয়াশীল হওয়া – কোনো কল্পলোকের দুনিয়া বাস্তবায়িত করার স্বপ্ন নিয়ে নয়; বাস্তব ঐতিহাসিক পরিস্থিতি অনুধাবন করে – সেটাই তো বস্তুবাদী হওয়া! 

বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব বিশ্লেষণ! সেই বিচারে বলা যেতে পারে যে ভারতে উনবিংশ শতকে সমাজবদলের সক্রিয়তার মধ্যেই নিহিত ভারতীয় বস্তুবাদেরও ধারা। সংস্কার থেকে শুরু করে শাসন বদল অব্দি প্রসারিত সেই সক্রিয়তায় বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায় সেই বস্তুবাদের তত্ত্বগুলো – কোথাও বেশি, কোথাও হয়তো বা একটু কম। যখন মীরাটের বিদ্রোহী সেপাইরা বাহাদুর শাহ জাফরকে নিজেদের, অর্থাৎ উদ্দিষ্ট ইংরেজ-মুক্ত ভারতের সম্রাট ঘোষণা করেও যুদ্ধপরিচালনার জন্য নিজেরাই একটা সামরিক পরিষদ (এ ধরণের সামরিক পরিষদ তার আগে মোগলশাসনে ছিল না) গঠন করেন, তাঁরা ঐতিহাসিক বাস্তবটা অনুধাবন করার পরিচয় দেন; আবার বিদ্যাসাগর মশাই যখন মিসেস কার্পেন্টারের, অতি-উৎসাহে ব্রাহ্মসমাজকে রাজি করিয়ে ফিমেল নর্মাল স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন, তিনিও ঐতিহাসিক বাস্তবটা অনুধাবন করার পরিচয় দেন। 

এঁরা কেউই নিজেদের দার্শনিক ভাবনা ও বিশ্বদৃষ্টি নিয়ে মাথা ঘামান নি। উনবিংশ শতাব্দীর ভারতে নতুন স্কুল তৈরি করার মত দার্শনিক আবির্ভূত হন নি (পন্ডিত দর্শনবেত্তা ছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের মত), অর্থাৎ নীতিশাস্ত্র, ঈশ্বরতত্ত্ব, প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানের পুনর্মূল্যায়ন ইত্যাদি নিয়ে চিন্তাভাবনার বড় জোয়ার আসা সত্ত্বেও, দর্শনের মূল দুটো প্রশ্ন – তত্ত্বমীমাংসা ও জ্ঞানমীমাংসা – নিয়ে আলাদা করে একদম নতুন কিছু কেউ ভেবেছেন বলে জানিনা। নানাভাবে প্রশ্নদুটোর কাছাকাছি সবাই এসেছেন, আসতেই হবে, কিন্তু মুখোমুখি হন নি। সবচেয়ে কাছাকাছি যাঁরা গেছেন, তাঁরা বস্তুকে সাধারণভাবে এক ঈশ্বরের সৃষ্টি বলেও তার স্বতন্ত্র, স্বয়ম্ভু, স্বনিয়মে ও কার্যকারণসম্পর্কে গতিশীল অস্তিত্বের ওপর জোর দিয়েছেন, এবং জ্ঞানকে, বস্তুর সাথে মানুষের, বা জগতের সাথে চিত্তের সৃজনী সংঘাতের উৎপত্তি না বললেও, জ্ঞানও যে বস্তু, সেটা চিহ্নিত করেছেন। এ তো গেল তাঁদের কথা, যাঁরা জ্ঞানজগতের মানুষ ছিলেন। বিদ্রোহী সেপাইদের সাথে তো জ্ঞানজগতের মানুষ বলতে ছিলেন শুধু বিভিন্ন প্রদেশের কিছু লোককবি ও শিল্পী।

কিন্তু তাঁদের সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্যে যদি ভারতীয় বস্তুবাদের ধারাটিকে পুনরাবিষ্কৃত না করি, তাহলে আধুনিক ভারতীয় দর্শনের প্রতিভূ হিসেবে উল্লেখ্য হয়ে থাকবেন আবার শুধু কিছু ভাববাদী দার্শনিক ও গুরু, ঠিক যেমন আগে হয়েছিল। প্রাচীনকালের ভারতীয় নিরীশ্বরবাদকে চিহ্নিত করার জন্য উনবিংশ শতকে বিদেশী ভারতবিদদের প্রয়োজন হয়েছিল। (যদিও এখানেও একমেবাদ্বিতীয়ম বিদ্যাসাগরের ভূমিকা অনস্বীকার্য – তিনিই এশিয়াটিক সোসাইটিকে খরচের জন্য রাজি করিয়ে, কলকাতা ও বেনারসের পুঁথি মিলিয়ে মিলিয়ে মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ বইটির সম্পাদনা করেন ১৮৫৮ সালে। পরে অক্ষয় দত্ত নিজের ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’এর উপক্রমণিকা লেখার সময় সেই বই থেকেই চার্বাকের উক্তিগুলো নেন বলে মনে হয়।) 

সেভাবেই বিংশ শতাব্দীতে, বিশেষ করে সোভিয়েত বিপ্লবের পর এদেশে মার্ক্সবাদী চিন্তাধারার প্রবল গ্রহণযোগ্যতার একটা বস্তুগত কারণ তো পাব – পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং শিল্পশ্রমিক শ্রেণীর প্রাদুর্ভাব, কিন্তু আরো কিছু কারণ অদৃশ্য থেকে যাবে।

অর্থাৎ কাজের মধ্যে দর্শনের খোঁজ। মার্ক্সের ভাষায় ‘প্র্যাক্টিক্যাল মেটিরিয়ালিস্টস’দের খোঁজ। যারা ‘প্র্যাক্টিক্যাল প্র্যাক্টিস’ (‘হোলি ফ্যামিলি’তে ব্রুনো বাওয়ারদের ‘ক্রিটিক্যাল ক্রিটিসিজম’এর বিরুদ্ধে এসব শব্দজোট শ্লেষাত্মক অর্থে ব্যবহার করেছিলেন মার্ক্স) করে তাদের খোঁজ। 

‘হোলি ফ্যামিলি’তে ইংরেজ এবং ফরাসী দর্শনচিন্তার ধারার বিশ্লেষণ করে মার্ক্স দেখিয়েছেন কিভাবে ইংল্যান্ডে ফ্রান্সিস বেকন, হবস, লক প্রভৃতি দার্শনিকদের মননে ইংরেজি বস্তুবাদ … এবং তারপর ফরাসী দার্শনিকদের (অগাস্ত কোম্‌তে প্রভৃতি) মননে ফরাসী বস্তুবাদ এগিয়েছে। এবং এ দুই বস্তুবাদই জার্মান বস্তুবাদের মহান পূর্বসূরী। বইটি ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত।

অন্যদিকে ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’এর দ্বিতীয় খন্ডের উপক্রমণিকায়, প্রাচীন ভারতীয় দর্শন নিয়ে আলোচনায় নিরীশ্বরবাদ বা নাস্তিক্যবাদের প্রাধান্য প্রমাণ করে অক্ষয় কুমার দত্ত তাঁর নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেন সারা জীবনের ক্ষোভ, “উল্লিখিত রূপ দার্শনিক গ্রন্থকারেরা অনেকেই সতেজ বুদ্ধির সুপুষ্ট বীজ লইয়া জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। যদি তত্ত্বানুসন্ধানের প্রকৃত পথালম্বন পূর্বক বিশুদ্ধ বিজ্ঞান-মার্গে বিচরণ করিতে পারিতেন, তবে বহুকাল পূর্বে ভারত-ভূমিও ইয়ুরোপ-ভূমির  ন্যায় এ অংশে ভূ-স্বর্গ-পদে অধিরূঢ় হইতেন, তাহার সন্দেহ নাই। তাঁহারা বিশ্বের যথার্থ প্রকৃতি ও সেই প্রকৃতিসিদ্ধ নিয়মাবলী নির্দ্ধারণ পূর্বক কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য-নিরূপণের নিশ্চিত উপায় চেষ্টা না করিয়া কেবল আপনাদের অনুধ্যান-বলে দুই একটি প্রকৃত মতের সহিত অনেকগুলি মনঃকল্পিত মত উদ্ভাবন করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের একটি পথ-প্রদর্শকের অভাব ছিল। একটি বেকন্‌ – একটি বেকন – একটি বেকন তাঁহাদের আবশ্যক হইয়াছিল। … কিন্তু বুঝি এ জল-বায়ু-মৃত্তিকায় প্রকৃত তত্ত্ব-পথ-প্রদর্শিনী, যুগ-প্রলয়কারিণী, নবোদ্ভাবিনী, মহীয়সী বুদ্ধি-শক্তির সমুদ্ভাব হওয়া সম্ভব নয়। সে ব্যাপারটি বুঝি ইয়ুরোপেরই কার্য্য। রত্ন-গর্ভা ইয়ুরোপ দুই কালে যেরূপ দুইটি অমূল্য রত্ন প্রসব করিয়াছেন, সেরূপ আর কস্মিন্‌ কালে কুত্রাপি হয় নাই। বেকন্‌ ও কোন্ত, দুই ভূখন্ডের উপর দুই সূর্য্য। ঐ দুইটি পরম পবিত্র জ্যোতির্ম্ময় শব্দ মূর্ত্তিমান জ্ঞানেরই সংজ্ঞা।” [উদ্ধৃতির অংশ বিশেষে জোর বর্তমান লেখকের] 

১৮৮৩তে প্রকাশিত এই স্বাদেশিক আত্মোলব্ধির এক শতক আগে থেকে বাংলায় এবং ভারতে ‘প্র্যাক্টিক্যাল মেটিরিয়ালিস্ট’দের ‘প্র্যাক্টিক্যাল প্র্যাক্টিস’ শুরু হয়ে গেছে। হ্যাঁ এক দশক। ভারত তো ইংল্যান্ডও না, ফ্রান্সও না, জার্মানিও না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ‘দ্বৈত বিপ্লব’ও পায় নি ভারত আর সেই ‘দ্বৈত বিপ্লব’এর প্রভাবে জার্মানির দার্শনিক উৎকণ্ঠাও পায় নি। পেল এক নিকৃষ্ট, লোভী, দুর্নীতিপরায়ণ কম্পানি-শাসন। এত যুগের শান্ত (নিরুপদ্রব না হলেও) এক ধাঁচের জীবনে সে একটা ভাঙচুর, একটা বিপর্যয় এনে দিল প্রথমে নবাবী ফৌজ কমিয়ে রোজগারহীন সৈন্যদলে বৃদ্ধি এনে ও পরে নতুন ভূমিব্যবস্থা (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত) এনে চাষীদের জীবনে, খাজনা আদায়ের নামে শুধু আর্থিক শোষণই নয়, চাষের জমিতে তাদের অধিকারটাও অনিশ্চয়তায় ভরে দিয়ে। এহেন পরিস্থিতিতে শুরু হল স্থানীয় কৃষকদের বিদ্রোহ, শ্রমিক ও তাঁতীদের আন্দোলন। সুপ্রকাশ রায়ের মূল গবেষণাগ্রন্থ ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’এ তো তার বিস্তৃত বর্ণনা আছেই, সঙ্গে আছে তার মূল্যায়ণ এবং সবচেয়ে বিতর্কিত প্রসঙ্গ – উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের সাথে তার সম্পর্ক। অযোধ্যা সিংএর হিন্দি বই ‘ভারত কা মুক্তি সংগ্রাম’ শুধু সংগ্রামের এলাকাভিত্তিক বর্ণনা আরো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে। বিতর্কের প্রশ্নেও পরে যাব। তবে আগে দেখি এ বিদ্রোহগুলো ‘প্র্যাক্টিক্যাল ক্রিটিসিজম’এর ক্ষেত্রে কিভাবে এগিয়েছিল।

‘হোলি ফ্যামিলি’তেই মার্ক্স, ব্রুনো বাওয়ারের সমালোচনায় রবার্ট ওয়েন বা চার্লস ফুরিয়েরের কাল্পনিক সমাজবাদী প্রয়োগগুলো মাথায় রেখে বলছেন, “The criticism of the French and the English is not an abstract, preternatural personality outside mankind; it is the real human activity of individuals who are active members of society and who suffer, feel, think and act as human beings. That is why their criticism is at the same time practical, their communism a socialism in which they give practical, concrete measures, and in which they not only think but even more act, it is the living, real criticism of existing society, the recognition of the causes of "the decay".”

সুপ্রকাশ রায় তাঁর গ্রন্থের শুরুতেই মুখবন্ধে, ‘(৫) স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম’ অংশে বলছেন –

“সমশের গাজী ত্রিপুররাজের শাসন ধ্বংস করিয়া এবং ত্রিপুরা জেলায় স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়া বিনা মূল্যে সকল কৃষকদের মধ্যে জমি বন্টন ও কর রহিত করিয়াছিলেন, জলাশয় প্রভৃতি খনন করিয়া জনসাধারণের জলকষ্ট দূর করিয়াছিলেন। ময়মনসিংহের পর্বত-অরণ্যচারী গারোগণ ইংরেজ শাসকশক্তি-সমর্থিত সুসঙ্গ-জমিদারির বিরুদ্ধে দীর্ঘকালের সংগ্রামের মধ্য দিয়াই স্বাধীন গারোরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিয়াছিল। ‘প্রথম পাগলপন্থী’ গারো-বিদ্রোহ’এ টিপু গারোর নেতৃত্বে গারোগণ সুসঙ্গের জমিদার পরিবারকে বিতাড়িত করিয়া সাময়িক ভাবে স্বাধীন গারোরাজ্য প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম হইয়াছিল। বঙ্গদেশের ‘ওয়াহাবী বিদ্রোহে’ (বারাসত-বিদ্রোহে) তিতুমীরের নেতৃত্বে ওয়াহাবীরা চব্বিশ পরগনা, নদীয়া ও যশোহর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়া তিতুমীরকে সেই স্বাধীন রাজ্যের বাদশাহ বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিল। ‘বাদশাহ’ তিতুমীর তাঁহার স্বাধীন রাজ্য হইতে সকল জমিদার ও নীলকরদের বিতাড়িত করিয়াছিলেন, কৃষকদের উৎপীড়কগোষ্ঠীর উপর কর বসাইয়াছিলেন, জনসাধারণের উপর হইতে সকল প্রকার কর তুলিয়া দিয়াছিলেন এবং গ্রামে গ্রামে আদালত বসাইয়াছিলেন। … ফরিদপুরের ‘ফরাজি বিদ্রোহ’ও ফরিদপুরের জনসাধারণের স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হইয়াছিল। এই বিদ্রোহের প্রধান নায়ক দুদুমিঞা ছিলেন সেই স্বাধীন রাজ্যের কর্ণধার। দুদুমিঞা সকল শোষক শ্রেণীর নিকট হইতে কর আদায়, জনসাধারণের উপর হইতে সকল প্রকার করের বিলোপ সাধন এবং গ্রামে গ্রামে বৃদ্ধ ব্যক্তিদের লইয়া আদালত প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। সাঁওতাল-বিদ্রোহের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা। … ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহে কেবল দিল্লীতে একটি কেন্দ্রীয় সরকার, উত্তর-ভারতের চারটি প্রদেশের গ্রামাঞ্চল জুড়িয়া গণ-শাসন প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।”

এবার আসি সুপ্রকাশ রায়ের গ্রন্থের তথাকথিত ‘বিতর্কিত’ প্রসঙ্গে। মুখবন্ধেই পুরো  নবজাগরণকে “কৃষক-শোষণের ব্যবস্থা দৃঢ়তর করিবার জন্য” বলে দোষী সাব্যস্ত করেন। পড়ে মনে হবে কৃষক আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যেই শুরু করা ওই নবজাগরণ বা রেনাঁশা আন্দোলন ইংরেজ শাসকদের ষড়যন্ত্র যেন। শহরের ভদ্রলোক বা মধ্যশ্রেণী ওই ষড়যন্ত্রে দাবাখেলার বোড়ে মাত্র। পরে, গ্রন্থের প্রাসঙ্গিক অধ্যায়েও তিনি স্পষ্ট বলেন “উনবিংশ শতাব্দীর এই দুই আন্দোলন ছিল পরস্পর-বিরোধী”। তারপর বিশদে গিয়ে কিছু কাজের “প্রগতিশীলতা”র উল্লেখ করলেও স্পষ্ট করেন যে কৃষক-বিরোধিতাই তাদের চুড়ান্ত অবস্থান। 

কিন্তু সংস্কারপন্থী এই মধ্যশ্রেণীর উদ্ভবের কারণ কী? 

সুপ্রকাশ রায় গ্রন্থে তিনটে কারণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। দুটো বিষয়গত। এক, নতুন ভূমিব্যবস্থা ও দুই, নতুন (মেকলে-মস্তিষ্ক প্রসূত) শিক্ষাব্যবস্থা। একটা বিষয়ীগত, “ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর দেওয়া ভূমিস্বত্বের অধিকারবলে জমিদারশ্রেণী ও মধ্যশ্রেণী একদিকে কৃষক-শোষণের ব্যবস্থা দৃঢ়তর করিবার জন্য এবং অপর দিকে ইংরেজসৃষ্ট নূতন সমাজের নেতৃত্ব লাভের জন্যই তাহাদের তথাকথিত ‘রিনাসান্স’-আন্দোলন আরম্ভ করিয়াছিল।” [উদ্ধৃতির অংশ বিশেষে জোর বর্তমান লেখকের] 

দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটা অনেকখানি সত্যি কিন্তু প্রথম উদ্দেশ্যটা অর্দ্ধসত্য। এটা ঠিক যে নতুন ভূমিব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে বৈকল্পিক ভূমিব্যবস্থার কথা নবজাগরণে উচ্চারিত হয় নি, সে সময় সেটা সম্ভবও ছিল না – ‘লাঙল যার জমি তার’এর স্লোগান তখন অব্দি মার্ক্সও ভেবে উঠতে পারেন নি হয়ত – কিন্তু নবজাগরণের যে অগ্রগণ্য কর্মনায়ক ও চিন্তানায়কদের কথা আমরা সর্বদা বলি তাঁরা কেউই “কৃষক-শোষণের ব্যবস্থা দৃঢ়তর করিবার” পক্ষে ছিলেন না সেটা তথ্যে প্রমাণিত। রামমোহন রায়ের ক্ষেত্রে দ্রষ্টব্য সুশোভন চন্দ্র সরকার সম্পাদিত ‘রামমোহন রায় অন ইন্ডিয়ান ইকনমি’ (Evidences of Raja Rammohun Roy, Questions and answers বিশেষ করে প্রশ্নোত্তর সংখ্যা ৭ এবং ৯]। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে দ্রষ্টব্য তাঁর ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’। তিনি অবশ্যই “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়াতে বাঙ্গালা দেশের” “বিশেষ উপকার” হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন, কেন না, “পূর্ব্বের ন্যায় রাজস্ব বিষয়ে নিত্য নূতন পরীবর্ত্তের প্রথা” চলতে থাকলে “এদেশের কখনই মঙ্গল” হত না “কিন্তু ইহাতে দুই অমঙ্গল ঘটিয়াছে। প্রথম এই যে, ভূমি ও ভূমির মূল্য সটীক না জানিয়া বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। তাহাতে কোন কোন ভূমিতে অত্যন্ত অধিক ও কোন কোন ভূমিতে যৎসামান্য কর নির্দ্ধারিত হইয়াছে। দ্বিতীয় এই যে, সমুদায় ভূমি যখন বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া গেল তখন যে সকল প্রজারা আবাদ করিয়া চিরকাল ভূমির উপস্বত্ব ভোগ করিয়া আসিতেছিল, নুতন ভূম্যধিকারিদিগের স্বেচ্ছাচার হইতে তাহাদের পরিত্রাণের কোন বিশিষ্ট উপায় নির্দ্দিষ্ট করা হয় নাই।” [উদ্ধৃতির অংশ বিশেষে জোর বর্তমান লেখকের] (বইটা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্য ছিল।) নবজাগরণের শিখরস্বরূপ বিদ্যাসাগরের শ্রেণিভিত্তি ও কল্যাণকারী ভূমিকার কথা বলছিনা কেননা, উপরোক্ত দৃষ্টিতে শেষবিচারে তিনিও ইংরেজ সরকারের বেতনভোগী শহুরে চাকরিজীবী ও বুর্জোয়া ফিলান্থ্রপিস্ট রূপে অভিহিত হবেন।  

রাইয়তদের অবস্থা প্রসঙ্গে অক্ষয় কুমার দত্তের তীব্র বক্তব্য অন্যত্র কোথাও আছে, আমি পড়েছি। তবে রামমোহন রায়ের অকালমৃতুতে তাঁর যে অশ্রুপাত, ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় – ২’ এর উপক্রমণিকায়, তাতে বলছেন, “দুঃখজীবী কৃষিজীবিগণ! যে সময়ে তোমরা স্বদেশ ও বিদেশের জন্য অপর্য্যাপ্ত অন্ন প্রস্তুত করিয়াও নিজে স্বচ্ছন্দ মনে ও নিরশ্রুনয়নে অত্যপকৃষ্ট তন্ডুল গ্রাসও গ্রহণ করিতে পাও নাই, সেই সময়ে যিনি …” ইত্যাদি। কাজেই ধরা যেতে পারে যে তিনিও কৃষকের শোষণের ব্যবস্থা দৃঢ়তর করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন না।

মদ্যপ হরিশচন্দ্র মুখার্জি, তাঁর সম্পাদিত হিন্দু প্যাট্রিয়টের মাধ্যমে এবং মামলামোকদ্দমায় ব্যক্তিগত টাকা খরচ করে কিভাবে রাইয়ত ও নীলচাষীদের লড়াই লড়েছিলেন তা বইপত্রে লেখা আছে। আবার কাঙাল হরিনাথ বা হরিনাথ মজুমদার তাঁর ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’য় জমিদারদের অত্যাচার নিয়ে যা কিছু লিখেছেন তাও বিশ্বের মহাফেজখানায় রক্ষিত আছে। …

কাদের কথা বলবেন? ওই ইয়ং বেঙ্গল, হিন্দু কলেজের ছাত্রদের কথা তো? হ্যাঁ, তাঁদের মধ্যে যাঁরা নবজাগরণের প্রতিনিধিস্থানীয় বলেও গণ্য করা হয়, তাঁরাও ভূমিব্যবস্থা নিয়ে বা চাষীদের অবস্থা নিয়ে কিছু বলেন নি। তাঁরা দেখেনও নি সেদিকে। তাঁরা সেভাবেই শিক্ষিত ও দীক্ষিত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কৃষকের শোষণের ব্যবস্থা দৃঢ়তর করার জন্য কম্পানি সরকারকে আপীল করেছিলেন কিনা জানিনা, কিন্তু তাঁদের নীরবতাকে ইংরেজ সরকার ও জমিদারদের অত্যাচারের পরোক্ষ সমর্থন হিসেবে ধরা যেতে পারে।

প্রশ্ন হল যে আমরা এভাবে দেখছি কেন? এভাবে দেখছি না কেন যে বিশ্বইতিহাসে নিচের শ্রেণীর আন্দোলনের চাপে মধ্যশ্রেণীতে ফাটল ধরার এবং এক অংশের নিম্নাভিমুখী হওয়ার যে ঘটনাগুলো দেখতে পাওয়া যায়, এটাও তারই মত একটি ঘটনা? মধ্যশ্রেণীর একটা অংশ ভেঙে বেরুল – তার কিয়দংশ নিম্নাভিমুখী হল, যতটা সম্ভব, কিয়দংশ নিম্নাভিমুখী হল না কিন্তু ভিন্নমুখী হল, শ্রেণীটার মূল-সমূহে ফিরে গেল না? আমি অন্ততঃ এভাবেই দেখি।   

এবার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বস্তুবাদের বিকাশে, প্র্যাক্টিক্যাল মেটিরিয়ালিস্ট হিসেবে, ‘প্র্যাক্টিক্যাল ক্রিটিসিজম’ বা ‘প্র্যাক্টিক্যাল প্র্যাক্টিস’ কে কিভাবে কতটা করলেন। 

 এখানে আরো একটি ঘটমান বিষয়ের উল্লেখ হওয়া উচিৎ। ওই ‘হোলি ফ্যামিলি’তেই, ইংরেজি বস্তুবাদের ‘আদিপুরুষ’ বেকনের দর্শন থেকে ‘আস্তিক্যের কুসংস্কার’ সরাবার যে কাজটা পরবর্তী বস্তুবাদী দার্শনিকেরা করেছিলেন, সে প্রসঙ্গে গিয়ে মার্ক্স লেখেন, “At all events, for materialists, deism is but an easy-going way of getting rid of religion.”  তাই যদি হয়, এবং অবশ্যই, আমাদেরও অভিজ্ঞতা বলে তাইই হয়, তাহলে রামমোহনের ‘তুহফতুল মুওয়হহিদিন’ থেকে ব্রাহ্মসমাজ অব্দি চিন্তনসংগ্রামকে “গেটিং রিড অফ রেলিজিয়ন”, ধর্মমুক্ত হওয়ার মেটিরিয়ালিস্ট, বস্তুবাদী প্রয়াস হিসেবে কেন দেখব না? শুধু তাই নয়, কলকাতা থেকে অনেক দূরে, বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নমঃশূদ্রদের মাঝে হরিচাঁদ ঠাকুরের আন্দোলন ও তাঁর দ্বাদশ আজ্ঞাকেও একই ভাবে মেটিরিয়ালিস্ট বা বস্তুবাদী চিন্তার পূর্বসূরী বলে কেন বুঝব না? 

আমি সেভাবেই বুঝি। এবং সেভাবে বোঝার তাগিদেই আমি নবজাগরণের সংস্কারমূলক কর্মযজ্ঞকে দেখি। 

এবং যে লড়াইটা প্রথম দিকে সংস্কারপন্থী হিন্দুদের সাথে সংস্কারবিরোধী হিন্দুদের ছিল, ধীরে ধীরে তার রূপটা বদলায়। উগ্র বিদেশিয়ানায় আক্রান্ত ইয়ং বেঙ্গলএর প্রতিভূরাও দুভাগে ভাগ হয়। এক ভাগ সংস্কারপন্থীদের সাথে যায়, যেমন মাইকেল নিজেই শেষ অব্দি সংস্কারপথীদের সাহায্য  করেন, অন্য ভাগ গোঁড়া হিন্দুতে পরিবর্ত্তিত হয়। জাতীয়তাবাদের অঙ্কুরোদ্গমের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারবিরোধী হিন্দুয়ানির ধারাটা নতুন এক সংস্কারের পথ ধরে – ব্রাহ্মসমাজের দেখাদেখি নতুন উদারমনস্ক গুরুদের উদ্ভব হয়, তাঁরা বেশির ভাগ কোনো না কোনো ভাবে জাতীয়তাবাদী ধারার সাথে যুক্ত হয়ে, এবং জাতপাতের বিরোধী হয়ে ধর্মবিশ্বাসের হারিয়ে যাওয়া জমিটা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেন। 

জমি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টাটা আরো প্রাবল্য পায় শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যেও সংস্কারপন্থা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হওয়ায়। জাতীয়তাবাদী প্রেরণায় জাতের বেড়াজাল ভাঙার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হয়ে দাঁড়ায় রানী রাসমনি স্থাপিত মন্দির এবং তারই পুরোহিত হিসেবে আসা মানুষটি সর্বশ্রেষ্ঠ ফসল হয়ে ওঠেন নব্য, উদারমনস্ক হিন্দুয়ানির। আর সেই রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ ধর্ম আর জাতীয়তাবাদের পরম ঐক্যে সারা ভারতকে উদবুদ্ধ করে তোলেন। এটা কি দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত বিষয় নয় যে আজকের ফ্যাসিবাদী কর্পোরেট-হিন্দুত্ব স্বামী বিবেকানন্দের কর্ম ও বাণীকে নিজেদের ধারার পূর্বসূরী হিসেবে যতই দেখাতে যায়, আজকের বস্তুবাদী ধারা সে প্রচেষ্টার বেলুন ফুটো করতে সেই স্বামীজীরই বিভিন্ন বাণীকে ব্যবহার করে – যুবদের জন্য, নারীদের জন্য, শিক্ষার পক্ষে, দারিদ্রমোচনের প্রশ্নে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে? 

সংস্কারপন্থীদের মধ্যে প্রবলতম যে বস্তুবাদী ধারাটির উদয় হয়েছিল রামমোহনের কাজে, বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়চন্দ্রের কাজে (এবং উল্লেখনীয় ভাবে, বিশুদ্ধ থেইজম বা ঈশবাদের মোড়কে, সাহিত্যেও), সেটিও মরে যায়নি। উত্তরসূরিরা তত্ত্বগত ভাবে বস্তুবাদের অত কাছে হয়ত যাননি, যতটা ওঁরা দুজনে ছিলেন, কিন্তু কাজে তাঁরা আরো বেশী করে এগিয়ে গেছেন শোষিত জনতার সমর্থনে – শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক, শ্রমিকদের প্রারম্ভিক প্রতিরোধে। জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক ধারাটি তৈরি হওয়ার পর এ কাজগুলো তারই এক্তিয়ারে চলে আসে। 

এভাবেই তৈরি হয় সোভিয়েত বিপ্লবের খবরের সঙ্গে আসা মার্ক্সবাদী ভাবনাকে সহজে গ্রহণ করে নেওয়ার জমি।  

২২.৯.২২



অভ্যাস

গাছের পিছনে বাড়িটায়
রোদ্দুর পড়েছে গাছের চেয়ে বেশী।
বাড়ির ভিতরে মুখ –
আদ্ধেক জানালা,
আদ্ধেক গাছ।

দেশ নয়
শহর নয়
শুধু কয়েকটি পথ আমরা বাঁচি
আজীবন।
ঘুরে ফিরে সেই কয়েকটি পথ
যা এক জীবনে কুলোয়।

পরিচিত ঠেকগুলোর সাথে
বয়স বাড়ে 
কোণঠাসা হই।

দরজা খুললে পা থেকে মাথা অব্দি দাঁড়ায়
নতুন কন্ঠস্বর।

সমুদ্র দুইভাবে ডাকে।
দুইভাবে সাড়া দেওয়া
আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। 



Tuesday, September 20, 2022

রোববার

·        বাবু (দশ বছর), তার মা, বাবা, দাদু
·        চাওয়ালা বৃদ্ধ, তার পুত্রবধু, তার নাতি শিবু (দশ বছর),
·        তিনজন গ্রাহক (তার মধ্যে দুজন প্রেস ফটোগ্রাফার ও তার বন্ধু)
·        ক্লাসের দিদিমণি

[স্টেজের পিছনে বাঁদিকে একটা বসার জায়গা। ঘর। রোববারের সকাল। বাবু মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। মা হাত মুছতে মুছতে এসে একবার তাড়া দিয়ে গেল।]
মা -    যা না বাবু, একঘন্টার তো ক্লাস! তার জন্য সকাল থেকে ঘ্যাঁতাতে হয়। (নেপথ্যে ছেলের বাবাকে) শুনছ! ওঠো না এবার! ওকে পৌঁছে দিয়ে এস।

বাবা - (নেপথ্য থেকে) পৌঁছে দেওয়ার কী আছে? একাই তো যায়। এক রোববার ইচ্ছে যখন করছে না ছাড়ো! সারা সপ্তাহ ভোরবেলা থেকে স্কুলে যাওয়ার চাপে থাকেই বেচারা!

মা -    দূর! সব একরকমের! কী বলব। আচ্ছা দাঁড়া! আজ দুপুরে আমিই ধরব তোকে।

[দাদু ঢোকেন।]

দাদু - কী হল? প্রতি রোববারের ব্যাপার? [বাবুর সামনে এসে বসেন। রহস্যের মত করে বলেন] আচ্ছা, ঠিক আছে, আজ বাংলা ক্লাসে যেতে হবে না। শোনো না ভাই! শরীরে যুৎ পাচ্ছি না। একটু হাঁটতে যাব। না গেলে শরীরটা আরো খারাপ হবে। তুমি যাবে আমার সাথে? তুমি সঙ্গে থাকলে একটু বল পাব। [হেসে যোগ করেন] চকলেট পাবে ফেরার সময়।

[বাবু মোবাইলের দিকে তাকিয়ে গেমটা শেষ করতে করতে উঠে দাঁড়ায়। তারপর মোবাইলটা ড্রয়ারে রেখে দাদুর দিকে হাত বাড়ায়।]

বাবু -  চল। চকলেট চাই না। ক্লাসে যেতে ভাল্লাগে না।

দাদু - তা ঠিক! সারা সপ্তাহ তো ভোরবেলা থেকে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়া। তোমার বাবাও তো সারা সপ্তাহ অফিসে ছোটে। তাই রোববারে তোমাকে নিয়ে আর বেরোতে চায় না। হয় এরকম। আমিও যখন চাকরি করতাম এরকমই হত। [নেপথ্যে ছেলের মাকে বলেন।] বৌমা, আমি বাবুকে নিয়ে বেরুচ্ছি।

মা -    [পর্দা থেকে আধেক মুখ বার করে] ক্লা

দাদু - [আড়ালে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেন] নাঃ। ওর ইচ্ছে যখন নেই, থাক। জোর কোরো না। এই আমার সঙ্গে একটু বেড়াতে যাচ্ছে।

মা -    [বাবু কে] আজেবাজে কিছু খাওয়ার আবদার করবি না কিন্তু। আর মোবাইল নিয়ে যাবি না।

বাবু -  [ড্রয়ারের দিকে দেখায়] রাখা আছে।

          [দুজনে বেরিয়ে যায়। স্টেজের ডানদিক থেকে ঢোকেন একজন বৃদ্ধ, এক মহিলা, বাবুরই সমবয়সী এক শিশু, নেপথ্য থেকে একটা টেবিল, একটা বেঞ্চি, তিনচারটে বিস্কুটের বোয়াম, চায়ের স্টোভ, সসপ্যান সঙ্গে নিয়ে। চায়ের দোকান সাজান। একজন গ্রাহকও ঢুকে বেঞ্চিতে বসে। অন্যদিক থেকে ঘুরতে ঘুরতে ঢোকেন বাবু আর বাবুর দাদু।]

দাদু তারপর বুঝলে! তোমরা তো দেখনি কানপুরের ফিল্ডে বিশ্বনাথের স্কোয়্যার কাট।

বাবু বিশ্বনাথ?

দাদু হ্যাঁ, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। (হাসতে হাসতে) তাবলে গুন্ডা নয় কিন্তু। যদিও মোটা গোঁফটা ছিল। সাউথের দিকে ওই ধরণের গোঁফ খুব পছন্দ। কিন্তু ছোট্টো খাট্টো। ব্যাটটা যেন আস্তে করে ঘাসের ওপর বুলিয়ে দিল, আর বল সোজা বাউন্ডারিতে। আর্ট, আর্ট ছিল ওর খেলায়।

বাবু - হুম্‌, তোমার মতিগতি বুঝতে পারছি, চা খাবে এখন।

দাদু - বাঃ, এতক্ষণ হাঁটলাম! একটু চা খাব না?

বাবু - চিনি ছাড়া খাবে কিন্তু।

দাদু -  হ্যাঁ রে ভাই, চিনি ছাড়া, দুধ ছাড়া [দোকানে ঢুকতে ঢুকতে] কী ঘোষবাবু, একাই দোকান সামলাচ্ছেন?

ঘোষ - নাঃ, একা কোথায়? বৌমা ওই বাসনগুলো ধুচ্ছে। [ততক্ষণে ওনার নাতি শিবু একগোছা ধোয়া বাসন নিয়ে ঢুকে টেবিলের একদিকে সাজিয়ে রাখল।] আর এই, নাতি এগিয়ে দিচ্ছে।

দাদু - ছেলে এখনো আমেদাবাদে?

ঘোষ - হ্যাঁ, দেখুন কদিন থাকতে পারে। পুরোনো হলেই তো ছাঁটাই। আবার নতুন দল আসবে। সেই ভয়ে বৌ, ছেলেকে নিয়ে যায় না। একটা পারমানেন্ট কাজ পেলে স্বস্তি হয়।

শিবু - পইসা দ! দুধ লাবে কে পড়তই ন?

দাদু -  [শিবুকে দেখিয়ে] ও বাংলা বলতে পারে না?

ঘোষ - বলতে পারে মোটামুটি। কিন্তু ওই, অভ্যেস। চারদিকে যে ভাষায় কথা তাই

দাদু - স্কুলে যায় তো?

ঘোষ - সে যায়। ওখানে তো আর

দাদু - হ্যাঁ, সে জানি। স্কুলে আর বাংলা কোত্থেকে শিখবে। [বাবুর দিকে তাকিয়ে] তুমি তো বাংলা বলতে পার, তাই না? দাদুভাই?

বাবু - লিখতেও পারি একটু একটু।

ঘোষ - [দাদুকে] চা খাবেন তো?

দাদু - হ্যাঁ, লিকার। দুধ, চিনি ছাড়া। [ঘোষবাবু স্টোভ থেকে কেটলি নামিয়ে একটা ছোটো মগে জল চাপান।]

ঘোষ - [বাবুর দিকে ইশারা করে] আর ও? বিস্কুট দেব?

দাদু - কী ভাই, খাবে? আচ্ছা, থাক। [ঘোষবাবুকে] না, দেবেন না ওকে। ওর মা আবার বকবে। [একটু থেমে] ওনারও মোটামুটি একই অবস্থা। বাড়িতে বাংলা শুনছে জন্ম থেকে তাই বলতে পারে ভালোই, কিন্তু [বাবুর দিকে দুষ্টুমিভরা চোখে তাকিয়ে] লেখাটা শিখতে বললেই ব্যস, প্রতি রোববার

ঘোষ - রোববার?

দাদু -  রোববারে বাংলার ক্লাস নেন এক দিদিমণি। এই, কাছেই। প্রতি রোববারে দাদুভাইয়ের মা দাদুভাইকে নিয়ে পড়েন, যা যা, বাংলা ক্লাসে যা! আর দাদুভাই, না না …’ [বাবুকে] রাগ করছ না তো, তোমার বিষয়ে বলছি বলে?

বাবু -  আমি তো শিখেই গেছি অ, আ, ক, খ লেখা। তবু মা জোর করে পাঠাবে। না আরো ভালো করে শিখে নে। পোয়েট্রি রিসাইট করা শেখ গান শেখ বাংলায় ভালো করে লেখা প্র্যাক্টিস কর বোরিং ভাল্লাগে না আমার

ঘোষ - কী ভালো লাগে দাদুভাই তোমার? খেলা? ক্রিকেট?

দাদু -  হ্যাঁ, সেটা ভালো লাগে। বিকেলে যায় তো। কিন্তু না হলে, ব্যস মোবাইল গেম

বাবু -  মোটেই না। ভালো লাগে সবই। কিন্তু স্কুলে বাংলা পোয়েট্রি আর গান কে শুনবে? সেই মা আবার ধরে নিয়ে যাবে বেঙ্গলি নিউ ইয়ারে, ক্লাবের প্রোগ্রামে। একজনও স্কুলের বন্ধু নেই সেখানে!   

          [শিবু এক কাপ লিকার চা দিয়ে যায় দাদুর হাতে।]

দাদু - [শিবুকে] তুমি তো দাদুর সাথে, মায়ের সাথে তো বাংলায় কথা বলতে পার। বল না কেন?

শিবু - [ভাঙা উচ্চারণে] ঠিকঠাক হয় না। ভালো পারি না।

দাদু - [বাবুকে] তুমি তো বললে লেখা শিখে গেছ। ওকে বাংলা লেখা শিখিয়ে দেবে?

বাবু - [শিবুকে] তুমি শিখবে?

শিবু - হমরা ফুরসৎ কহাঁ? অভি দুধ লাবে কে হ্যয়!

          [ওদিক থেকে শিবুর মা ঢোকেন হাতভর্তি বাসন নিয়ে]

মা -    লইহ বাদ মেঁ। অভি বইঠ থোড়া হুনকর লগলে। বাত কর!

[বাবু শিবুর হাত ধরে। পাশে বসায়। ততক্ষণে আরো দুজন গ্রাহক ঢোকে দোকানে। একজনের গলায় ক্যামেরা, ক্যামেরার ব্যাগ, গায়ে ফটোগ্রাফারদের মত জ্যাকেট।]

ফটো - ক্যা দাদা, অভি নাস্তা কুছ ন বনায়ে হ্যঁয়? আচ্ছা, চায়-এ পিলাইয়ে। দুগো বিস্কুট দিজিয়ে সাথ মেঁ।

অন্য -  অলগ সে তাজা বনওয়াও না।

ঘোষ - অলগ সে বনানে কে লিয়ে তো ইন্তজার করনা পড়েগা। দুধ আয়েগা তব। পিজিয়ে, কোই রাত কা বাসি নহিঁ হ্যয়, অভি বনায়ে হ্যঁয়।

ফটো - অরে বৈঠ ন। বঙ্গালিদাদা কে দুকান কী চায় ভি ঠিক হ্যয় অওর সমোসা ভি। বনৈবে নহিঁ কিয়ে হ্যঁয়। ন তো ওয়হি খাতে।

বাবু -  [শিবুকে] একদম সহজ। [ঘোষবাবুর দিকে তাকায়। ওর তাকানো দেখে বুঝতে পেরে ওর দাদু উঠে গিয়ে ঘোষবাবুর ক্যাশবাক্সের ওপর রাখা নোটবই আর কলমটা উঠিয়ে এনে এগিয়ে দেন বাবুর দিকে। বাবু নোটবইয়ে কলম দিয়ে আস্তে আস্তে লেখে।] কী লিখলাম বল তো?

শিবু - [নোটবইটা হাতে নিয়ে সোজা করে দেখে মাথা নাড়ে।] বুঝি না।

বাবু - ওর নিচে ওইভাবেই লেখ তো।

শিবু - [কলমটা হাতে নিয়ে চেষ্টা করে, পারে না।] ন হোতই হমরা সে।

বাবু - [কলমসুদ্ধু ওর হাতটা চেপে ধরে নিজের লেখার ওপর বোলায়।] এই হল শ। স নয়, শ, শ। আর এই হল রস্‌সিকার। শি। এই হল ব, ব। এই হল রস্‌সুকার। বু। শিবু। তোমার নাম। লেখ নিচে। [শিবু ভাঙা ভাঙা লেখে।]

মা -    [দুজন গ্রাহককে চা আর বিস্কুট দিতে দিতে এতক্ষণ উদগ্রীব হয়ে এদিকে তাকিয়ে দেখছিলেন। এসে শিবুর লেখা দেখে হেসে হাততালি দিয়ে উঠলেন, বাঃ, বাঃ। তারপর বয়াম থেকে একটা বিস্কুট বার করে বাবুর দিকে এগিয়ে দিলেন] এই নাও, খাও। মাঝেমধ্যে রোববারে এসে ওকে অ-আ-ক-খ শিখিয়ে গেলে তোমাকে বিস্কুট খাওয়াব। বাবু বিস্কুটটা হাতে নিয়ে দাদুর দিকে তাকায়।

দাদু - খাও, খাও। উনি দিয়েছেন তো!

          [বাবু বিস্কুটটা দুহাতে চেপে ভেঙে একটা টুকরো শিবুর মুখে ঠুঁসতে যায়।]

ফটো - এ রুকো, রুকো! [উঠে দৌড়ে এসে বাবুর হাতটা ধরে আটকে দেয়। তারপর ক্যামেরার লেন্সটা খুলে তাক করে বলে] অব খিলাও বাবু। এক ফোটো তো বনতা হ্যয়। বঢ়িয়া ফোটো, বিস্কুট খিলাতে হুয়ে। [বাবু বিস্কুটের আদ্ধেকটা শিবুকে খাওয়াতে খাওয়াতে বাঁহাতে বাকি আদ্ধেকটা নিজের মুখে পোরে।]

দাদু - চল, এবার যাওয়া যাক। দেরি হলে আবার মা বকবে। [ফটোগ্রাফারকে] ছবিটা পারলে আমাকে পাঠিয়ে দিও ভাই। এই নাও আমার মোবাইল নম্বর। [পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে বলেন। ফটোগ্রাফার লিখে নেয়।]

অন্য আপকা পোতা হোনহার লড়কা হ্যয়। পঢ়াও বেটা, ইসি তরহ হর রবিবার কো আকর উসকো লিখনা সিখায়া করো। শিকছা এ্যায়সে হী আগে বঢ়েগা। জরুরি হ্যয়।

দাদু -  উও ভী মাতৃভাষা কী শিকছা! স্কুলোঁ মেঁ পঢ়ায়া হী নহীঁ জাতা। [ফটোগ্রাফারকে] কভি ইস সমস্যা কো ভী কভর কিজিয়ে!

ফটো - তো কহাঁ সিখতা হ্যয় আপকা পোতা? ঘর পর?

দাদু -   হা হা ঘর পর কিসে ফুরসত হ্যয় ভাই? য়হীঁ জুবিলি ক্লব মেঁ এক ম্যাডম সিখাতি হ্যঁয় রবিবার কো।

ফটো [মোবাইলটা বার করে] ক্যা নাম হ্যয় উনকা?

দাদু -  অনুরাধা শিকদার। উয়ো খুদ টিচর হ্যঁয় স্কুল মেঁ।

ফটো - ঠিক হ্যয় স্যর! মিলেঙ্গে উনসে। এক ফিচর হোনা চাহিয়ে ইস প্রব্লেম পর। নমস্কার! [বলে দুজনে বেরিয়ে যায়]

[দোকান ছেড়ে মাঝ স্টেজে সামনের দিকে আসে দুজনে।]

বাবু -  তুমি এত ভালো হিন্দি শিখলে কি করে? তুমি তো ছোটবেলায়, গল্প করো, যে কোন গ্রামে

দাদু -  ধ্যাৎ, তুমি তো প্রেস্টিজ পাংকচার করে দেবে, কালনা গ্রাম হল? তুমি গেলে বুঝবে। এখন তো অন্য রূপ। তবে তখনও গ্রাম ছিল না। ঐতিহাসিক শহর। কত মন্দির! লোকে দেখতে যায়, দূর দূর থেকে।

বাবু -  হিন্দি শিখলে কি করে, বল না!

দাদু -  বলতে বলতে, পড়তে পড়তে। ইংরিজিও সেভাবে শিখেছি। ভাষা চাইলেই শেখা যায়। হরিনাথ দের নাম শুনেছ? বহু পুরোনো দিনের মানুষ। আজকের নয়। তিনি আঠাশটা ভাষা জানতেন।

বাবু -  (বিস্ময়ে) আঠাশটা!

দাদু -  এমনিতেও দেখ, তুমি তো বাবা, মার সঙ্গে শিলং বেড়াতে গিয়েছিলে?

বাবু -  হ্যাঁ।

দাদু -  সেখানে হোটেলে যে ম্যানেজারবাবু ছিলেন, মনে আছে? তোমাকে চকলেট দিয়েছিলেন!

বাবু -  হ্যাঁ।

দাদু -  উনি কটা ভাষা জানতেন, মনে করে দেখ তো?

বাবু -  (করে গুনতে গুনতে) বাংলা, ইংলিশ, হিন্দি

দাদু -  ব্যস? আর খাসি? অসমিয়া? উনি খাসি খবরের কাগজ পড়তেন, অসমিয়া খবরের কাগজ পড়তেন। অথচ লেখাপড়া কী? এমন কিছু না। ভাষা চাইলেই শেখা যায়।  

[ওদিক থেকে বাংলা ক্লাসের দিদিমণি ঢোকেন।]

দিদি - আরে? কী হল অয়ন, আজ ক্লাসে এলে না যে? [দাদুর দিকে তাকিয়ে] নমস্কার! আপনি ওকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন? কোনো কাজে?

দাদু -  হ্যাঁ, ভীষণ জরুরি কাজে। তা আপনি ক্লাস ছেড়ে কোথায় চললেন? এত তাড়াতাড়ি তো শেষ হয় না!

দিদি - হ্যাঁ, আজ পড়াইও নি। একটা গানের রিহার্সাল করাব ভাবলাম, সামনে নেতাজি জয়ন্তি আছে, তাও পুরো হল না। আমার নিজেরই একটা আর্জেন্ট ফোন এসে গেল।

দাদু -  কোন গানটা গাওয়াবেন?

দিদি - ওই তো! কদম কদম বঢ়ায়ে যা! আর যদি দুটো গানের সময় দেয় অর্গানাইজাররা তাহলে বল বল বল সবে …, ওটা ওদের তৈরিই আছে, ১৫ই আগস্টে গেয়েছিল। আমি আসি এখন, তাড়া আছে।

দাদু হ্যাঁ, হ্যাঁ, যান!

দিদি - একজন অসুস্থ। তাই ছুটি দিয়ে দিলাম। [বাবুকে] কী অয়ন, সামনের রোববারে আসবে তো? আমার তাড়া আছে, এগোচ্ছি এখন। [এগিয়ে যেতে যেতে] এস কিন্তু। গানের রিহার্সালেও তোমাকে দরকার।

দাদু - [জোরে, দূরে যাওয়া দিদিমণিকে] যাবে, যাবে। যাবে নিশ্চয়ই। আপনার ছাত্র এখন শিক্ষক বলে কথা! [বাবুকে] কী দাদু! যাবে নিশ্চয়ই এবার, নাকি? নইলে ওকে শেখাবে কী করে? তুমি নাকি স্বাধীনতা দিবসে গান গেয়েছিলে? বল বল বল সবে? গেয়ে শোনাও না একটু!

বাবু -  সে তো সবাই মিলে গেয়েছিলাম!

দাদু -  মানে তুমিও গেয়েছিলে তো? নাকি গলায় আওয়াজ নেই, দেখে দেখে মুখ নাড়িয়ে যাচ্ছি

বাবু -  না গেয়েছিলাম

দাদু -  তা শোনাও না!

বাবু - বিস্কুটের কথাটা মাকে বোলো না।

দাদু -  ও, ব্ল্যাকমেল? আচ্ছা, ঠিক আছে, বলব না। এবার শোনাও!  এমনিতেও, মা বকবে না তোমাকে। নিশ্চিন্ত থাক।

বাবু - না, মা না, বাবা বকবে। [দাদু হেসে ওঠেন] বুঝেছি, বুঝেছি। শোনাও এবার গানটা!

          [বাবু গানটা ধরে। দাদুও তাতে গলা মেলান। আস্তে আস্তে দুজনে একে অন্যের হাত ধরে বেরিয়ে যায়। এদিকে বাবুর বাবা একটা টুল আর বাল্ব হাতে নিয়ে ঢোকেন। একটা দেয়ালের কাছে টুলটা রেখে তার ওপর দাঁড়িয়ে বাল্ব বদলান।]

বাবা -  শুনছো? প্যাসেজের বাল্বটা বদলে দিলাম।

মা -     প্যাকেটটা?

বাবা -  আছে ড্রয়ারে। তবে দরকার নেই। বাল্বেই লেখা আছে কেনার তারিখ।

মা -     ওরা এত দেরি করছে কেন কে জানে! একবার ফোন করো না!

[ফোন করার আগেই দাদু আর বাবু ঢোকে বাড়িতে]

দাদু -  এসে গেছি। এসে গেছি। ফোন করতে হবে না।

মা -    এত দেরি হল কোথায়?

দাদু -  কেন? একটাই ক্লাস আছে দাদুভাইয়ের জন্য? যেখানে ওকে ছাত্র হতে হবে? আর তোমার বকুনি শুনতে হবে? আর সেই ক্লাস? যেখানে ও টিচার?

বাবা -  মানে?

দাদু -  তুই তো কথাই বলিস না! বড় ভারি অফিসে কাজ করনেওয়ালা হয়েছে। প্রতি রোববারে ওর মা বলে যাবে, বাবুকে ক্লাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য আর তুই সোফায় বসে পা নাচাবি। নিজে একটু আদর করে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারিস না?

মা -    ওকে ছাড়ুন তো। আমি চা দিচ্ছি আপনাকে। টিচার কী বলছিলেন?

দাদু -  সে পরে বলব। আগে বলো, ও যে এত সুন্দর বাংলা গান গায় কখনো শুনেছো?

মা -    হ্যাঁ। সে তো কোরাসে গেয়েছিল। সে প্রোগ্রামেও তো ওর বাবা গেল না। আপনি ছিলেন না সে সময়। আমি একাই গিয়েছিলাম।

দাদু -  আমি তো আজ শুনলাম। দাদুভাই, প্লিজ, আরেকটি বার শোনাও। বাবাকে ছাড়ো। আচ্ছা আমি গাইছি, আমার সঙ্গে গাও
বল বল বল সবে,
শতবীণাবেণু রবে,
[বাবু গলা মেলায়]
ভারত আবার            জগতসভায়
শ্রেষ্ঠ আসন লবে।
[রান্নাঘর থেকে মা গলা মেলান]
ধর্মে মহান হবে,
কর্মে মহান হবে,
নবদিনমণি               উদিবে আবার
পুরাতন এ পূরবে।
          [বাবুর বাবাকে] কি রে? তুই মেলা, গলা! [বাবাও গলা মেলান।]
বল বল বল সবে

          হ্যাঁ, এই তো! একে বলে ক্লাস। এবার চা দাও বৌমা। একটু আরামে বসে খাই।

 

[শেষ]


২১.৯.২০২২/ ১.৯.২০২৩ 

Monday, September 19, 2022

লিপাপোতি

চাঁদের আলোয় ফাঁদের মজলিস। গুপ্ত কিন্তু মন্ত্রণা নয়, মন্ত্রসভা। যারা এসেছে শপথ নিয়ে এসেছে যে হৃদয় খুলে কথা বলবে। এখন যুঝছে এই সমস্যা থেকে বেরুতে। তৈরি করছে আরেকটা হৃদয় যেটা খোলা ক্ষতিকর হবে না, মানে লগ অন টু দ্বিতীয় হৃদয়!

ফ্ল্যাট বাড়ির বড় ছাতের এক কোনায় একটা বাল্ব জ্বালানর ব্যবস্থা হয়েছে। মাদুর বিছিয়ে বসেছে নাইন ম্যান কমিটি আমি, রাজীব, আসিফ, বরুণদা, অবধেশ, অমর, শেখর, সীতারাম আর মদন সিং। মদন সিংএরই প্রস্তাব মত এই মজলিশ, আমার বাড়িতে।

এই মজলিশের চার বছর পর মদন সিং মুখের ক্যান্সারের চিকিৎসা আরম্ভ করেছিল আর সাত বছরের মাথায় মারা গেল।

একটু পরে নিচে, ফ্ল্যাটে গিয়ে আমি একটা বড় গামলায় করে মুড়ি, ছোলা, বাদাম আর একটা ছোটো গামলায় করে সিঙাড়া নিয়ে এলাম। জল আগেই এনে রেখে দিয়েছি। চায়ের ব্যবস্থা পরে হবে।

মন খুলে কথা না বললে এই বসার কোনো মানে হয় না মদন সিং বলল, আমি জানিনা আপনারা বুঝতে পারছেন কিনা যে সংগঠনের দুজন নেতৃস্থানীয় সদস্যের মাঝের এই শীতযুদ্ধ কীরকম খারাপ প্রভাব ফেলছে সংগঠনের ওপর।

সত্যি খুব খারাপ, বরুণদা একটা ছোলা ভেঙে তার খোসার গুঁড়ো ফুঁয়ে উড়িয়ে একটা অংশ মুখে ফেলে বললেন, সংগঠনের প্রগতি আটকে গেছে সুদ্ধু এই টেনশনে আমরা ঐক্যবদ্ধ একটা নেতৃত্ব নিয়ে যেতে পারছি না কর্মচারীদের কাছে।"

ওঃ, আসল কথাটাই তো বলতে ভুলে গেছি। যে দুজনের ছত্রিশের পরিসংখ্যান (ছত্তিস কা আঁকড়া, মানে দেবনাগরিতে লেখা তিন আর ছয়ের মত একে অন্যের দিকে পিঠ ফিরিয়ে থাকা) মেটাতে এই মন্ত্রসভা বা সঙ্কল্প সমারোহ সেই অমর আর অবধেশের মধ্যে দ্বিতীয়জন তখন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক (রাজীবের পর) আর প্রথমজন সর্বভারতীয় পরিচালনা সমিতির যুগ্মসচিব।

মুড়ি, ছোলা, বাদাম হল, এক রাউন্ড চা হল, আরেক রাউন্ড চায়ের প্রস্তাবে না না হল, যারা সিগরেট খায় না তাদেরও দুএকজন দেখি একটা বলে সিগরেট চেয়ে খেল। ফ্ল্যাটবাড়ির সান্ধ্যভ্রমণকারী বাসিন্দারা ছাতে হাঁটতে উঠে বেশ কয়েকবার আলোর বৃত্তে এসে কুশল বিনিময় করে গেল, বুঝতে চেষ্টা করে গেল আলোচনার জটিল বিষয়টি কী।

-   শান্তিতে বসে একটু কথা বলার উপায় নেই। এক এক করে এসে শুঁকে যাচ্ছে।

-   এপার্টমেন্টের ছাত তো আর মিটিংএর জায়গা নয়!

-   মিটিং কোথায়? যে বাড়িতে থাকি সে বাড়ির ছাতে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আড্ডা মারতে পারব না?

-   ছাড় ওসব। রাত হয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমরা কোথায় পৌঁছোলাম?

যেখান থেকে চলা শুরু করেছিলাম, ফুট কাটল শেখর। এত পেসিমিস্টিক হোয়ো না বরুণদা ঠোঁটে একটু সমর্থনের হাসি অথচ চোখে একটু ধমক ফুটিয়ে বললেন, অমর আর অবধেশ দুজনেই স্বীকার করছে যে ব্যাপারটা নেহাৎই মনকষাকষি। অবধেশের অনুযোগ যে অমর সিনিয়র হয়েও তার সাথে সেভাবে সহযোগিতা করেনি যেমন ও আশা করেছিল; তাই সিনিয়র হিসেবে শ্রদ্ধা বা কোনো কমরেডলি ফিলিং ও অমরের প্রতি রাখতে পারে না। অমরও ওরই কথার প্রতিধ্বনি করছে যে অবধেশ ওকে কমরেডলি ফিলিং বা সিনিয়র হিসেবে রিগার্ড দেখায় না বলে ও অবধেশকে কাছে টানতে পারে না। দুজনেই এটাও মানছে যে এটা সংগঠনের পক্ষে ক্ষতিকর। এখন বরফ ভাঙতে উদ্যোগী হতে হবে দুজনকেই। সংগঠন সর্বোপরি। সংগঠনের পক্ষে যা ক্ষতিকর তা কখনো চলতে পারে না।

শেখর আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, বরুণদা চুপ করিয়ে দিলেন, এসব মনকষাকষি কাজের মধ্যে দিয়েই শেষ হতে পারে। একসাথে মিলে কাজ করো। একসাথে ট্যুর প্রোগ্রাম করো। ম্যানেজমেন্টের কাছে একসঙ্গে যাও। যা কিছু কর্মসূচি আসছে ওপর থেকে বা আমরাই তৈরি করছি সেগুলো রূপায়িত করো একসঙ্গে। অসুখটাও নতুন নয়, চিকিৎসাও নতুন নয়। চিকিৎসা না করলে তার ফলটাও তোমাদেরই ভোগ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা সংগঠনে আমির স্থান নেই। আমিকে ত্যাগ করতে হবে। কী? ঠিক তো? সবাই একমত এ বিষয়ে?

কে আর বলবে না। ঐক্যমতের বেশ একটা ঝোড়ো গুঞ্জন বয়ে গেল ছোটখাটো।

 

বরুণদা আগে থেকে যাব যাব করলেও নিচে নেমে আমার ফ্ল্যাটে ঢুকলেন। কুশল বিনিময়। আমি বেসমেন্টে গিয়ে একে একে সবাইকে বিদায় করলাম। রাজীব রয়ে গেল। শেখরও রয়ে গেল। একটু পরে বরুণদাও নেমে এলেন।

খুব ভালো হল, না? আজকের মিটিংটা? শেখর বরুণদাকে শুনিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কত সুন্দর সবাই হৃদয় খুলে কথা বলল, মনকষাকষি মিটে গেল, অহঙ্কার পরিত্যাজ্য হবে আজ থেকে, এরকম একটা সিদ্ধান্ত হয়ে গেল প্রায়!

বরুণদা হেসে উঠলেন। বাইফোকাল চশমা পরা মানুষেরা দরাজ ভাবে মুখ ছড়িয়ে চোখ কুঁচকে হাসলে চোখদুটো কপালের দিকে উঠছে এমন একটা আভাস হয়, বুঝছ তো সবই। এভাবেই চলবে কিছুদিন। কোনো উপায় নেই। এটা একটা প্রসেস।

চোখের কোনে জল এসে গিয়েছিল। চশমা খুলে মুছতে মুছতে বললেন, ইউনিয়ন বলো, পার্টি বলো, কমরেড কথাটার মূলেও আছে বন্ধুত্ব আর শেষ প্রান্তে গিয়েও বন্ধুত্ব। কমরেড মানে হৃদয়ের, মস্তিষ্কের এবং কাজের শ্রেষ্ঠ বন্ধুত্ব। হৃদয় থাকবে না, কাছের মানুষকে কাছে টানার জোর থাকবে না, মস্তিষ্কে থাকবে চেতনার অভাব আর তিকড়মবাজি তাহলে কাজের ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব কতদিন টিঁকবে? আবার এটাও ঠিক যে শেষমেশ কাজের বন্ধুত্বই ধীরে ধীরে মাথাটাকে পরিষ্কার করে আর হৃদয়টাকে খোলার রাস্তা দেয় সেটারই চেষ্টা করি, আর কি!

-   যাই বলুন, এ হচ্ছে শুধু লিপাপোতি! মুখের ওপর সত্যি কথাটা কেউ বলছে না যে দুজনেই একে অন্যকে ভিতর থেকে অবিশ্বাস করে। এবং কেন করে, তার গোড়াটা আছে অন্য কোথাও হয়ত যখন ওরা দুজনে একসাথে এক ব্রাঞ্চে কাজ করত তখনকার কিছু ঘটনা থেকে, বা তারও আগে থেকে।

-   হতে পারে। (একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বরুণদা) কিন্তু ওই লিপাপোতি না কী যেন বললে! ওর মানে কী?

-   লিপাপোতির আবার মানে কী? লিপাপোতি মানে লিপাপোতি! মানে ভাঙা, ফাটা পুরোনো মালের ওপর রঙ চড়িয়ে বাজারে ছাড়া, স্যাঁতস্যাঁতে ফাটল ধরা বাড়ি, চুনকাম, ডিস্টেম্পার করে নতুন দেখানো লিপা মানে প্রলেপ লাগানো, পোতি অর্থে গাঢ় করে রঙ চড়ানো।

-   লিপাপোতি, লিপাপোতি বাঃ! কিন্তু তার মানে পুরোনো বাড়িতে চুনকাম হওয়া উচিৎ নয়, তুমি বলছ?

-   উচিৎ নয় কে বলছে? কিন্তু ভিতরে ফাটল তো রয়েই গেল। ফাটলটা ভরবে কী করে?

-   সে ঠিক কথা। কিন্তু চুনকামটাও তো হওয়া দরকার। ফাটলটা লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে। সামনে ম্যানেজমেন্ট। পাশে লেঙ্গি মারার জন্য রাইভ্যাল ইউনিয়ন। ফাটলটা দেখনাই হয়ে থাকলে চলবে?

-   না, তা চলবে না। কিন্তু ফাটলটা ভরতেও হবে তো? ভিতরে ভিতরে যদি ইঁটে নোনা ধরে গিয়ে থাকে? জল ঢুকে লোহার ছড়ে যদি জং ধরে গিয়ে থাকে পুরোটা?

যাহোক একটা কথা বুঝলাম, রাজীব পিছন থেকে এসে এক হাত আমার কাঁধে আরেক হাত শেখরের কাঁধে রেখে দাঁড়ালো, আমি হলাম চুন, শেখর জল আর সুমন আঠা। বরুণদার দিকে ছুঁড়ল, আপনি ডিস্টেম্পার! আর বাকি সবাই সিঁড়ি, দড়িদড়া, বুরুশ !

-   ???

-   আরে, নাইনম্যান কমিটি তো তৈরি হয়ে গেল! সেই নজনের দুজনে ফাটল। বাকি সাতজন সব সময় ঘিরে থাকুন। দুজনের একজন কেউ উল্টোপাল্টা মুখ খুললেই কভার করুন!

ফাজলামো রাখ। আচ্ছা তোমাদের কেন মনে হচ্ছে কিছুতেই কিছু হবে না?, বরুনদা সবার দিকেই প্রশ্নটা ছুঁড়লেন, কোনো একটা সমাধানে পৌঁছোবার তো এটাই পথ!

কেননা এটা বাংলা নয়, বিহার। শেখর মুখটা নির্বিকার রেখে বলল। ওর বলার ভঙ্গীতে কিছু ছিল, আমরা সবাই চোখ ঘোরালাম।

-   জাতপাতের জায়গাটা মনে রাখতে হবে। দুজনই নিজেদের জাতের বিশেষত্বের অহঙ্কারে কোনো জাতকে নিজেদের ধারে কাছে গণ্য করে না।

-   মানে?

-   একজনের জাত, উঁচু হলেও মাঝারি, কিন্তু শিক্ষায় সবার থেকে এগিয়ে। আরেকজনের জাত, নিচু হলেও মাঝারি, কিন্তু বুদ্ধিতে আর সামাজিক ক্রিয়াকর্মে ব্রাহ্মণতুল্য। দুজনে কখনো একে অন্যকে বিশ্বাস করতে পারে না। পারত যদি ততটা উঁচুতে নিজেকে তুলতে পারত। তার জন্য দরকার সত্যিকারের শিক্ষা। দুজনের মধ্যে সেটা পাওয়ার ইচ্ছেটুকুও নেই।

আমি তো আমি, বরুণদাও হাঁ করে চেয়েছিলেন।

কথার কী জোর! এই জন্য বলি যে মদ না খাও না খাও, কিন্তু মোদোদের ছেড় না। মগজ খোলসা থাকে ওদের! কিন্তু কাজে?

জানি না। মদ ছাড়লে তবে তো! পরিবারে সমস্যাও আছে। সেটাও হয়ত একটা কারণ মদ খাওয়ার। সেও তো এক লিপাপোতি! বুকের যন্ত্রণার লিপাপোতি!  

 

ঠিক আছে, বাড়ি যাও তোমরা, আমিও বেরোবো, বরুণদা বললেন, সত্যিই ইঁটে নোনা ধরে গিয়ে থাকলে বা ছড়ে জং ধরে থাকলে ভেঙে নতুন করে গড়তে হবে। দরকার হলে দুজনকেই বাদ দিতে হবে সুযোগ সুবিধে মত। তবে সংগঠনটা ধরে রেখেই তো! তাই আপাততঃ লিপাপোতিই চলুক, যদ্দিন চলে।