কর্তৃপক্ষ অনেক কিছুকে আইন বলে চালাতে চায়। অনেক কিছুকে জোর করে নিজেদের অধিকারক্ষেত্রে নিয়ে নিতে চায়। কাগজে কলমে তো তার প্রতিরোধ হয়ই না, এমনকি লোকবলেও হয় না। হাঙ্গামার পরিস্থিতি তৈরি করতে হয়। কিষণ সেটা দুবার করে দেখিয়ে ছিল। প্রথমবার, ডিজিএম সাহেবের ভিজিটের সময়।
রোজ বলা হচ্ছিল ব্রাঞ্চের ওই সাকুল্যে একখানা স্নানঘর বা পায়খানা
সম্পর্কে। ঢোকার মুখে ডানদিকে দুটো পেচ্ছাপ করার জায়গা আর তার ঠিক আগে একটা আবর্জনার
ড্রাম। সেসবে যাহোক করে দিন কেটে যাচ্ছিল। কেউ খেয়ালও করেনি আগে, ব্রাঞ্চে একজন মহিলা
কর্মচারি আছেন, চা-জল খাওয়ান, বিধবা, অনুকম্পার ভিত্তিতে চাকরি, দরকার পড়লে তিনি কোথায়
যাবেন। তিনিও বুঝতেন অবস্থা। তাই দরকারটাকেই দমিয়ে রাখতেন যতটা পারা যায়। কাজে যাওয়া
মহিলার অধিকাংশকে এখনও অনেক জায়গায় তাই করতে হয়। বাড়ির বাইরে জল কম খায়।
সমস্যা এল যখন কর্মচারিদের নতুন প্রজন্ম এল এবং অনুকম্পার চাকরিতে
আরো দুজন মহিলা কর্মচারী এলেন। একজন মহিলা আধিকারিকও এলেন স্থানান্তরিত হয়ে। চল্লিশজন
কর্মচারি ও আধিকারিক, তার মধ্যে মাত্র চারজন, দশ পার্সেন্ট; এমন কিছু ব্যাপার নয়। কিন্তু,
কর্মচারি সংগঠনও নতুন একটা তৈরি হয়েছে। ‘নতুন মোল্লা
পেঁয়াজ বেশি খায়’ বাগ্ধারাটা চরিতার্থ করতেই হোক বা সংগঠনগত
প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই হোক, তারা বেশি বেশি করে খুঁজে বের করতে শুরু করল ব্যবস্থাপনার
ভুলচুকগুলো।
ফলে কর্তৃপক্ষের কাছে, সব শাখাদপ্তর থেকে সদস্যদেরকে দিয়ে স্বাক্ষর
করিয়ে জমা দেওয়া দাবিপত্রের মধ্যে একটা ছিল, প্রত্যেক শাখায় মহিলা কর্মচারিদের জন্য
যথাযথ টয়লেট সুবিধা। এই শাখায় সেটা মূর্ত রূপ পেলঃ স্নানঘরের ভিতরে ঢুকে পায়খানার জায়গার
বাইরে মেয়েদের পেচ্ছাপখানার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ, পা রাখার দুটো স্ল্যাব,
মাঝখানটা অগভীর করে কেটে পাশ দিয়ে যাওয়া জলনিকাশির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া। আর পুরো জায়গাটা
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার নিয়মিত ব্যবস্থা করা।
এমন কোনো বড় কাজ
নয়। কিন্তু হচ্ছিলই না। কিষণ ছিল ঐ নতুন সংগঠনের ইউনিটের সম্পাদক। যেদিন ডিজিএম এলেন, হঠাৎ হইহই। সবাই নিজেদের কাজ
ছেড়ে ম্যানেজারের চেম্বারে ঢুকল। দেখল, পেচ্ছাপের জায়গার পাশে রাখা আবর্জনার ছোটো ড্রামটা
ম্যানেজারের টেবিলের ওপর রাখা। কিষণ কিছু একটা বলে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ম্যানেজার,
ডিজিএম, তাঁর দুজন সঙ্গী আধিকারিক ভয়ে আঁতকে উঠে বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে আছে। ভিড়ে একজন
ফিসফিস করল, “ঐ ড্রামটা আনলো কে? থুথু, পানের পিকে ভর্তি!
…
- কে আবার! কিষণই!
- ঘেন্নাপিত্তি নেই? উঁচু ঘরের ছেলে! রাজপুত!
- কী করবে? কথাই শুনছে না ম্যানেজমেন্ট!
তারই মধ্যে শোনা গেল কিষণের শান্ত, গম্ভীর গলা, “বসুন আপনারা স্যার! আপনাদের জন্য চা, জলখাবার আসছে। আপনাদের যখন
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সমস্যা নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই, এই ড্রামটার পাশে রেখেই খান
চা-জলখাবার!”
ম্যানেজার মুখ কাঁচুমাচু
করে বলল, “আমি আজই লেডিজ ইউরিন্যালটা তৈরি করার জন্য
বলে দিচ্ছি। আর সুইপারকে দিয়ে জায়গাটা নিয়মিত পরিষ্কার করাবার ব্যবস্থা করছি।”
- চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তৈরি চাই। রামেশ্বর! লে
যাও ইসকো!
রামেশ্বর সুইপার,
সাফাইকর্মী। একে ওকে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে ড্রামটা তুলে নিয়ে গেল।
-
জরা সফাই
ভী কর দেনা। পোছা লেকর আও। (ম্যানেজারকে বলল) আশ্বাস নিয়ে যাচ্ছি। আর আসবো না।
উপরুল্লিখিত দাবিপত্রেই আরেকটি দাবি ছিল, প্রতিটি শাখায় লাঞ্চরুমের
ব্যবস্থা। সে ব্যবস্থা এই শাখায় ছিল, কিন্তু বেশির ভাগ শাখায় ছিল না। ওই কাজের টেবিলগুলোর
মধ্যে কোনো একটা খালি দেখে সবাই চেয়ার জড়ো করত প্রতিদিন। কিন্তু এখানে ছিল বলেই, সে-দাবিটা
নিয়ে তেমন কোনো চিন্তা ছিল না কারোর। চিন্তা শুরু হল এটিএম তৈরি হবে এমন কানাঘুষো শোনার
পর। কাল বিকেলে নাকি জোনালের প্রেমিসেস ডিপার্টমেন্টের আধিকারিকেরা এসেছিল, মাপজোক
নিয়ে গেছে। তারা বলেছে লাঞ্চরুমটাই সবচেয়ে ভালো জায়গা। আবার একজন নাকি বলেছে, ভালো
হবে, ওটাই এদের ইউনিয়নবাজির জায়গা ছিল, হাপিশ হবে।
ব্যাস, ঐ কথাটাতেই আগুন ধরে গেল। তবে, তখনও সবাই বোঝেনি তাদের লাঞ্চরুমটার
গুরুত্ব। সবার মুখে একটাই বিষয় নিয়ে চর্চা ছিল, প্রেমিসেস ডিপার্টমেন্ট কত টাকা কমিশন
খেয়েছে ঠিকেদারের কাছে। ডিজিএম তার কত প্রতিশত পেয়েছে। ম্যানেজারকে দেখে অবশ্য মনে
হচ্ছিল না সে কিছু পেয়েছে বলে।
শেষে একদিন রাজমিস্ত্রির লেবাররা এল। লাঞ্চরুমের ভিতরে জলের বেসিনের
নিচে গাঁইতি বসালো। আওয়াজটা হলের ভিতরে বসা কিষণের কানে যাওয়া মাত্র সে দৌড়ে গেল। গাঁইতি-ফাঁইতি
কেড়ে নিয়ে লেবারদের ভাগিয়ে দিল। একটু পরেই জোনালের আধিকারিকেরা হাজির। কে করেছে? সিরিয়াস
ম্যাটার। শোকজ করুন। হ্যান ত্যান …। কিষণ লাঞ্চরুমে
পড়ে থাকা একটা গাঁইতি উঠিয়ে আনল। পালাতে গিয়ে লেবারেরা ছেড়ে গিয়েছিল। বা হয়তো ভেবেছিল,
ছোটো ঝঞ্ঝাট, কাল খতম হয়ে গেলে আবার তো আসতে হবেই।
ম্যানেজারের চেম্বারে
যেখানে আধিকারিকেরা দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে গিয়ে গাঁইতিটা উঠিয়ে বলল, “এই তো বেশ জায়গা এটিএম তৈরি করার! ম্যানেজারের এত বড় চেম্বারের দরকার
কী?” বলে ইচ্ছে করে একজন আধিকারিকের ঘাড়ের পাশ
দিয়ে গাঁইতিটা দেয়ালে বসালো। সজোরে চালালেও বসালো আলতো করে, যাতে দেয়ালে দাগ না পড়ে।
কিন্তু কাজ যা হবার হয়ে গেল সেদিন। বিকেলে জোনাল অফিস থেকে নতুন প্ল্যান অ্যাপ্রুভ
হয়ে এসে গেলঃ লাঞ্চরুম না ছুঁয়ে তার দরজার বাইরে তৈরি হবে এটিএমের অ্যাান্টেরুম, আর
সামনের দিকে একটা ঘর তুলে তাতে রাখা হবে মেশিন। খালি একটাই অনুরোধ, লাঞ্চরুমে ঢোকার
রাস্তাটা বাইরে দিয়ে হবে।
ওকে, ওকে, এবমস্তু! জয় হো ডিজিএম সাহব কা!
সেদিন টিফিনের সময়
সবাই ঢুকতে গিয়ে উপলব্ধি করল লাঞ্চরুমটা কী!
ওদিকে চাপরাশি রানী দেবী নিজের টিফিনটা খুলছেন। তপশীলী জাত। তাঁর
মৃত স্বামী এই শাখাতেই সাফাইকর্মী ছিলেন। তাঁর পাশেই এসে বসে পড়লেন সাবিত্রী গুপ্তা।
ইনি অনুকম্পায় এসেছেন। ক্যাশ-ক্লার্ক। বানিয়া, অর্থাৎ পশ্চাৎপদ। দেখ না দেখ, নতুন ট্রান্সফারে
আসা আধিকারিক নীরা কুমারীও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন। আধিকারিকেরা পরে বসে, কিন্তু তখন
একা টিফিন খেতে হবে; এখানে অন্ততঃ আরো দুজন নারী আছে।
ওদিকে দপ্তরী নীরজ রজক (জাতে ধোপা) আর বড়বাবু মেহরোত্রাজি তাঁদের
টিফিন-ডিবে খুলছেন। পাশ দিয়ে ঢুকল কেরানি বিপিন পোদ্দার। ঠিক তার পরেই মাসুদ টিটকিরি
দিতে দিতে ঢুকল, “কি রে পোদ্দার, সেই রোজকার লাউ-ফাউয়ের তরকারি
নিয়ে এসেছিস?” সঙ্গে সঙ্গে পোদ্দারের জবাব, “তুই কী আনিস রে শালা কুঁজড়া, নিজেকে নবাব খানদান বলিস? এই দ্যাখ্,
সেই আলুসেদ্ধ” বলে হাতের রুটির টুকরোটা আলুসেদ্ধয় ডোবালো।
মাসুদও পোদ্দারের লাউ বা টিন্ডার বড় একটা অংশ সোজা নিজের টিফিনডিবেতে নিয়ে রাখল।
এল শ্রীবাস্তব, টেবিলেই উঠে পড়ে আসন করে বসে পড়ল, যাতে সবার ভাগ
পেতে পারে। নিজে কিন্তু কিচ্ছু আনে নি, রোজকার মতই। “জিওগ্রাফিতে গোল্ড মেডালিস্ট হলে কি হবে” ফোড়ন কাটল পোদ্দার, “জাতে লালাজি
যে!” এমনি ভাবেই এক এক করে সেদিনকার উপস্থিত প্রায়
বারো-তের জন হাজির হল।
সব শেষে এলেন হেড ক্যাশিয়ার ঝাজি, ব্রাহ্মণ। হাত ধুলেন অনেকক্ষণ
ধরে। তাঁর রোজকার বক্তব্য, নোট ছুঁলে ভালো করে হাত ধুয়ে নিও ভাই। নোটের চেয়ে নোংরা
কিচ্ছু হয় না। শুধু ভেবে দেখো যে কোথায় কোথায় লোকে লুকিয়ে রাখে নোটের গাড্ডিগুলো। সে-যা
কিছু বলুন, টিফিন-ডিবেটা তিনি কিন্তু আগেই খুলে এগিয়ে দেন টেবিলের ওপর, যাতে অন্যেরা
খেতে পারে। তিনি এসে এর ওর তার টিফিন থেকে খাবলা তোলেন।
এমনটাই প্রায় রোজ হত। নারীদের দলটাও বাদ পড়ত না। তারা নিজেরা উঠে
আসত না, কিন্তু এদিকের কেউ না কেউ, হয়তো কিষণ বা সঞ্জয়, ওদিক থেকে তরকারি তুলে নিয়ে
আসত আর এদিককার ভালো যেগুলো – তরকারি, বা আলুর,
ছাতুর পরোটা – একটু একটু করে ওদিকে দিয়ে আসত। সঞ্জয়ও আবার,
টিফিন আনতো না। সদ্য বিয়ে হয়েছে। বৌ সেরকম তাড়াতাড়ি সব রান্না করে উঠতে পারে না। আর
মা অসুস্থ। নীরা কুমারীকে দেখিয়ে মেকি দীর্ঘশ্বাস ফেলত, “নীরাজির মত শ্বাশুড়ি তো আর পাই নি, যে নিজে সকালে উঠে পুত্রবধুর
টিফিন গুছিয়ে দেবে!”
তবে মাসে অন্ততঃ একদিন নিজের বৌকে দিয়ে লুচি আর মুরগির মাংস রান্না
করাতো। বা হয়তো নিজেই আদ্ধেক কাজ এগিয়ে একটু দেরিতে আসত। আগের দিন সবাইকে বলে যেত,
কেউ যেন টিফিন না আনে, দুপুর আড়াইটে নাগাদ তার ছোটো ভাই একটা বড় টিফিন-ক্যারিয়ার পৌঁছে
দিত। আর আলাদা করে একটা পনিরের ঝোল, যারা মাংস খায় না তাদের জন্য। মাসুদ দুটোতেই ভাগ
বসাতো। আধঘন্টার লাঞ্চ-আওয়ার। বড় জোর পনেরো মিনিট এখানে। তারপর তো বাইরে, মন্ডলজির
চায়ের ঠেকে। তারপর সিগরেট, খৈনি বা পান। কিন্তু ঐ পনেরো মিনিট এক অদ্ভুত দৃশ্য তৈরি
করত আমাদের লাঞ্চরুম।
সবচেয়ে মজার কথা, প্রতিদ্বন্দী সংগঠনে সাতজন অবশিষ্ট ছিল। তাদের
মধ্যেকারও দুজন, রবীন্দ্র শর্মা আর ভোলা মিস্ত্রি
ঢুকে পড়েছিল এই দলে। ওদের একটা স্বার্থ ছিল। একজন বিল কালেক্টার। ক্লিয়ারিং
থেকে এসে খিদে পেয়ে যেত। আরেকজন বসত ড্রাফট, বিলস আর হুন্ডির টেবিলে। লাঞ্চের পরেই
বেশি চাপ থাকত কাজের। না, সংগঠন ছাড়ল না। এদিককার দলও ওদের সম্মান রাখতে, ওরা ঢুকলেই
সাংগঠনিক কোনোরকম কথাবার্তা বন্ধ করে দিত।
একদিন শিবেব্দ্র প্রসাদ, কেরানি থেকে সদ্য আধিকারিক হয়েছে, জল খেতে
ঢুকে দুঃখ করে মিন মিন করেছিল মেহরোত্রাজির কানে, “স্সালা, মিছিমিছি প্রমোশন নিয়ে নিলাম!” কেউ শুনতে পায় নি। শুনল লম্বা ঢ্যাঙা বুড়ো মেহরোত্রাজির তীক্ষ্ণ
গলা, “তো নে না রে ডিমোশন, মিনমিনাচ্ছিস কেন! কেউ
মানা করেছে? ম্যানেজারকে লিখে দে! বল তো, আমিই লিখিয়ে দিচ্ছি! পাছায় দম নেই আর এখানে
মিনমিনাচ্ছে!”
১৮.৯.২৫
No comments:
Post a Comment