রাজীবের গল্প
দেখতে দেখতে এতগুলো বছর কেটে গেল। শতক বদলে
গেল। সহস্রাব্দ বদলে গেল। যুগ বদলে গেল; বদলে গেল যুগবোধ। রাজীব ভাবে,
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি থেকে যুগ বদলে গেল বলাটা সঠিক নয়। কিন্তু উনিশশো একানব্বইয়ের পর সমাজে
কি বিরাট বদলগুলো ঘটল! সেগুলোকে আর কী ভাবে চিহ্নিত করা যায়? অন্ততঃ, গত শতকের পঞ্চাশ-ষাটের
দশকে জন্ম নেওয়া মানুষগুলোর কথা ভাবো! চৈতন্যের পর তারা যে বিশ্বটা দেখতে অভ্যস্ত ছিল,
সে-বিশ্বের গতিপ্রকৃতির যে একটা বোধে অভ্যস্ত ছিল, সেসব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল নব্বইয়ের
দশকে।
আজ হড়তাল। আটত্রিশ বছর চাকরি করে সে অবসর গ্রহণ
করেছে কিছুদিন আগে। কিন্তু অভ্যাসটা যায় নি। হড়তালের দিন যেমন এত বছর, সবচেয়ে আগে না
হলেও দ্বিতীয় বা তৃতীয় জন হয়ে পিকেটিংএ যোগ দিয়েছে এবং সারাদিন থেকেছে, আজও তেমনই এসেছে।
বিকেল হয়ে আসছে। এখন আর গেটের কাছে চাপ নেই।
ঢোকার জন্য জোরাজুরি করার লোকও নেই, সাংবাদিক আর ছবি-তুলিয়েরাও নেই। অদূরে একটা গাছের
ছায়ায় ওরা পাঁচ-ছ’জন বসে আছে। রাজীবের সামনে বসে আছে দেবেশ।
-
হ্যাঁ, কী বলছিলেন? নাম কেটে গেল, পাঁড়েবাবার
খাতা থেকে?
-
খাতা মানে ডাইরি, পকেট ডাইরি। আর ব্রাহ্মণকে
বাবা তো বলেই সবাই। তাই পান্ডেজি মানে রাধামোহন পান্ডে হয়ে গিয়েছিলেন পাঁড়েবাবা। তিনিই
তখন ঐ সংগঠনের প্রেসিডেন্ট। আমিও ঐ সংগঠনে। আজকের সংগঠন তো আর তখন ছিল না।
-
ডাইরিতে কী লিখতেন?
-
নোট রাখতেন! সংগঠনের যেই দিকগুলোর ওপর তাঁর
নজর থাকা জরুরি, সেই দিকগুলো নিয়ে তাঁর প্রতিদিনকার অব্জারভেশন লিখে রাখতেন। তেমনই
লিখে রাখতেন নাম। যে ছেলেটির কাজকর্ম দেখে মনে হল, এর মধ্যে পোটেনশিয়াল আছে, কাজে লাগাতে
হবে, তার নাম। তার বৈশিষ্ট্য। … তোমাদেরকেও তাই বলি, নেতা হয়েছ, ডাইরি রাখো। আমরা তো সংগঠনের দপ্তরেও
একটা টাস্ক-ডাইরি রাখার কালচার তৈরি করেছিলাম। কী কী অবিলম্বে করণীয়, লেখা থাকত। যে
পৌঁছোতো, পাতা উল্টে দেখে নিত। যদি কাজটা তার করার মত হত – ধরো, জোনাল অফিসে গিয়ে কারো লিভ-ক্লাসিফিকেশন
করিয়ে নিতে হবে, কারো মেডিক্লেম পেন্ডিং আছে … সে নিজেই গিয়ে দেখে আসত কাজটা। তখন তো আর কম্পিউটার আর এই মোবাইল
ছিল না।
পাশ থেকে মোহন বলল, “কিসের গল্প চলছে?” দেবেশ বলল, “এই সংগঠনটা তৈরি হওয়ার।” রাজীব সঙ্গে সঙ্গে বাধা
দিল, “না ভাই, সংগঠনটা
তৈরি হওয়ার গল্প অন্যেরা বলতে পারবে, যারা লড়াইটা আগে থেকে চালিয়ে যাচ্ছিল। আমি তখন
কেবল মাত্র ঢুকেছি ব্যাঙ্কে, হালচাল জানছি। আর সত্যি বলতে, ইউনিয়নবাজি, নেতাগিরি, এসব
করার মত মনোভাবও আমার ছিল না। ব্যস, একটা নৈতিক দায়িত্ববোধ ছিল যে, যে সংস্থায় কাজ
করে ডাল-রুটি উপার্জন করব, সেখানকার শ্রমিক সংগঠনে অবশ্যই থাকব। এবং পুরোপুরি সক্রিয়
থাকব। তাই, ইতিহাস-ফিতিহাস নয়, সেটা অন্য কেউ বলতে পারবে। ব্যস্, নিজের গল্পটুকু বলতে
পারি।”
-
তাই বলুন! আমরা তো কিছুই জানি না।
-
চেষ্টা করলেই জেনে নেবে অনেকখানি। পুরোনো মানুষজনেরা
তো আছে এখনও। আর সত্যিই, এসব ইতিহাস তো আর বড়ো ইতিহাসবিদেরা লিখবে না! আমরা, তোমরাই
সংগ্রহ করে লিখতে পারি – কবে, কিভাবে সংগঠন
তৈরি হল, একেকটা লড়াই কিভাবে আমরা লড়লাম …। একটা সেন্ট্রাল হিস্ট্রি তৈরি করা বেশি সহজ। কিন্তু এই যে খুচরো
ইতিহাস, লোকাল, অনেক মানুষের পার্সোনাল মিশিয়ে … খুব কঠিন এসব জোগাড় করা … সময়ের সাথে হারিয়ে যায়। …
-
দাঁড়ান, একটু চায়ের জন্য বলে দিই।
-
সদ্য ট্রান্সফার হয়ে এসেছিলাম তখন পাটনায়।
ওই ব্রাঞ্চে একটা ট্র্যাডিশন ছিল তখন। একেবারে নতুন হলে পোস্টেজ, একটু পুরোনো হলে ক্যাশ,
তারপর কাউন্টার … আর অভিজ্ঞ হয়ে এলে
ডে-বুক। আমি ডে-বুকই পেয়েছিলাম। সঙ্গে আরো দুজন। পাঠকজি আর শ্রীবাস্তবজি। একদিন পাঠকজি
বললেন, “তোমার নাম লেখা হয়ে
গেছে পাঁড়েবাবার খাতায়।” না বুঝে হাঁ করে
চেয়ে রইলাম। বললেন, “নতুন ছেলেরা, যারা
ব্যাঙ্কে ঢোকে, সবার ওপর নজর রাখেন পাঁড়েবাবা। রাজ্যের সভাপতি তো বটেই, আমাদের অভিভাবকও।
দু’দিনেই চিনে নেন কার
মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন করার মেটিরিয়াল আছে। আর তার নামটা লিখে রাখেন নিজের, ঐ যে দেখছো
একটা পকেট ডাইরি খুলে কিছু দেখছেন, ওতেই লিখে রাখেন।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, তা, আমাকে উনি জানলেন
কি করে? এই তো সবে এসেছি এই ব্রাঞ্চে!” বললেন, “পুরো ট্র্যাক আছে
তোমার, ওনার কাছে।” শুনে একটু গর্বই
হল আমার। তার মানে আমি ইউনিয়ন করার কর্মী হিসেবে চিহ্নিত হলাম! তখন কি আর জানতাম যে
পাঁচ বছরের মধ্যে পাঁড়েবাবার খাতা থেকে কাটা পড়বে নামটা?
-
আগে এই জায়গাটা বোঝান। কেন? কিভাবে আপনার মনে
ঢুকেছিল যে চাকরি করলে ইউনিয়ন করতেই হবে! তাও আবার এ্যাজ এ ম্যাটার অফ প্রাইড! … আমরা তো ভাবি না! আমিও ভাবি নি। হ্যাঁ, ঢুকে,
কিছুদিন থেকে, তবে বুঝেছি যে … নাঃ, এটা দরকার।
-
আমার নিজেরও মনে নেই কেন আর কিভাবে এই ভাবনার
পোকাটা ভিতরে ঘর করেছিল। স্কুলকলেজে কখনোই কোনো ইউনিয়ন করি নি। অথচ, চাকরিতে ঢোকার
সঙ্গে সঙ্গে জানি না কিভাবে ইউনিয়ন করার কথাটা ঢুকল মাথায়।
-
ভেবে বলুন না? তাড়াহুড়ো কিসের। পাঁচটা অব্দি
তো বসেই থাকব এখানে। (অদূরে চায়ের ঠেলার উদ্দেশে) “এ ভোলাজি, চায়ওয়া ভেজিয়ে না। তাজা বনাইয়ে, অওর চিনি কম।”
চায়ের গেলাসটা দেবেশের হাত থেকে নিয়ে বলল,
“পতা নহীঁ ইয়ার। কিন্তু
ঝোঁকটা ছিল। কুছ পঢ়াই-লিখাই, কুছ গুরুওঁ কা প্রভাব …”
-
গুরু?
-
আমার ছোটোবেলার টিউটর। আমার গুরু। …
-
এদিক ওদিক ছুটছাট চাকরি করতে করতেই ব্যাঙ্কের
ডাকটা এসে গেল। চলে গেলাম বাইরে। প্রথম দিন থেকেই দেখতে শুরু করলাম ইউনিয়ন কী। মানে,
কমরেডশিপ ক্যা হ্যয়। রাতে পৌঁছে, নতুন লোক, দিব্যি ব্যাঙ্কের ভিতরে জমাদারসাহেবের সঙ্গে
বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আগে থেকে খবর পাঠানো ছিল।
-
কেন?
-
ইউনিয়ন! যে নতুন সাথী হবে তাকে আশ্রয় দেওয়া,
আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, এসবও তো একটা কাজ! … পরের দিন একে একে সবার সঙ্গে দেখো হল, বন্ধুত্ব হল, একদিন ইউনিয়নের
ফর্ম ভরলাম। … তবে হ্যাঁ, একটা
কথা বলতে পারি।
-
কী
-
প্রথম দিন থেকেই আমার একটা মনোভাব ছিলঃ নেতা
যেই হও, মানব, আমি নেতা হওয়ার চেষ্টাও করব না, কিন্তু কিছু করার ডাক এলে বা প্রশ্ন
উঠলে, একা নয়, সবাই যেন এক সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিই। আর এই ধরণটাকে অভ্যাসে নিয়ে আসি।
-
মতলব?
-
আসলে সব জায়গায় কিছু ছেলে থাকে সক্রিয়। অফিসেও
দেখা যায়, তারা হয়তো অবসর সময়ে নেতাজির টেবিলের চারদিকে বসে আড্ডা মারছে। বেরুলো লাঞ্চটাইমে
চা খেতে, ইউনিয়নের জরুরি কথাটা সেখানেই সেরে নিল। খুব বেশি হলে ফিরে এসে, আরো দু’একজন মাথা যারা কাজ ছেড়ে বেরুতে পারে না, যেমন
হেড ক্যাশিয়ার, বা বাইরে বাইরে থাকে, বিল কালেক্টর, তাদেরকে আলাদা করে বলে দিল যে এইরকম
একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে অনেকেই ছেড়ে যেত। বিশেষ করে মহিলা কর্মচারি, তখন তারা সংখ্যাও
খুব কম এবং বেশির ভাগই স্বামীর মৃত্যুতে অনুকম্পায় চাকরি, তারা মেনেই চলত যে নেতারা
যা বলছে ব্যাস সেই মত চললেই হল। কিন্তু আমি জোর দিতাম, না, মিটিং ডাকো, সবাইকে ইনভল্ভ
করো। কেউ হয়ত বলল, ঠিক আছে, সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে, তাদের ওপিনিয়নও নিয়ে নেওয়া হবে।
আমি জোর দিতাম যে না, ফর্মাল মিটিং করতে হবে। কি জানি কিভাবে এসব মাথায় এসেছিল যে একটা
মিনিট বুক হবে, তাতে সবার সাইন থাকতে হবে, সে সুইপার হোক, বিলকালেক্টর হোক, গোডাউনকিপার
হোক, হেড ক্যাশিয়ার হোক, মহিলা কর্মচারি হোক (বিশেষকরে তাদের যাদের মিটিংএ পাওয়া সবচেয়ে
কঠিন হত)। …
-
ক’বছর ছিলেন বাইরে?
-
বেশি নয় সোয়া বছর, তখন তাড়াতাড়িই ট্রান্সফার
হয়ে যেত। … রিকোয়েস্ট ট্রান্সফার
রোস্টারে আমাদের ব্যাচের নামগুলো এসে গেছে, ট্রান্সফার হওয়া শুরুও হয়ে গেছে, আমার নাম
আসছেনা, বুঝলাম তদ্বির চলছে পাটনায়, আমি তো চিনিও না কাউকে, বোধহয় সেখানকার বড়বাবুই
বুদ্ধি দিলেন, এই তো রজত জয়ন্তী সম্মেলন হবে, ছুটি নিয়ে চলে যাও, নেতাদের সঙ্গে আলাপ
পরিচয় করো, জিজ্ঞেস করো নিজের ট্রান্সফারের বিষয়ে। দু’একদিন আগেই যাও। গুপ্তাজি জেনেরাল সেক্রেটারি,
খুব ভালো মানুষ, তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করো। … ছুটি নিয়ে মহেন্দ্রু পাড়ায় গিয়ে গুপ্তাজির সঙ্গে দেখা করলাম। ট্রান্সফারের
সমস্যা শুনলেন, হুঁ হুঁ করলেন, কিছু বললেন না। উল্টে বললেন, শোনো, কাল তো ওপেন সেশন,
পঞ্চাশটা হাতে লেখা পোস্টার তৈরি করে নিয়ে এস তো! …
-
পোষ্টার?
-
জীবনে প্রথম, রাত ভর জেগে পোস্টার তৈরি করলাম।
দাবিগুলোই বা কী? স্লোগান কী? কিছুই জানি না। দিলেনও না গুপ্তাজি, বললেনঃ কনফারেন্স
কা ডকুমেন্টস দেখ লেনা, ইয়ে লে যাও। বলে, এক সেট রিপোর্ট ধরিয়ে দিলেন। সেসব কি তখন
পড়া সম্ভব? নিজের এক বছরের অভিজ্ঞতায় যা কিছু জানতাম, প্লাস কিছু সাধারণ, মজদুর একতা,
বিশ্বশান্তি ইত্যাদি সম্পর্কিত স্লোগান, সেই সব নিয়ে …
-
তার মানে আপনি জানতেন পোষ্টার বানানো, আর গুপ্তাস্যরও
সে কথাটা জানতেন!
-
আরে না ভাই। তার আগে দু’একটা পোষ্টার করেছিলাম, তবে ইউনিয়নের নয়। আর
সে-কথা গুপ্তাজির জানার কথাই নয়। তবে হ্যাঁ, বাঙালি বলে হয়তো। আর হ্যাঁ, তিনি যে ব্রাঞ্চে
ছিলেন, সে ব্রাঞ্চে একজন মিহিরদা ছিলেন, জানতেন যে আমি শিল্পসাহিত্য ইত্যাদি চর্চা
করি … উনিই বলে থাকবেন
হয়তো, লড়কা আর্ট-মাইন্ডেড হ্যয়! … যা হোক, পোস্টার কালার, ক্রেয়ন আর চার্টপেপার কিনে, সারা রাত জেগে
সাকুল্যে উনিশটা পোস্টার তৈরি করলাম। তাতেই গুপ্তাজি খুশি। হলে সব দিকে টাঙাবার ব্যবস্থা
করলেন।
-
ফির?
-
সে-জন্যই হল কিনা জানি না কিন্তু দুএক মাস
পর অর্ডার এসে গেল। কটা বাজল? এই দেবেশ, পাঁচটা বাজছে। এবার গুটোও। পরে হবে গল্প।
-
বাকি রইল কিন্তু দাদা। পুরোটা শুনব।
-
একশো বার। আমারও তো ভাবতে, বলতে ভালোই লাগছে।
তুমি না জিজ্ঞেস করলে তো আমি চেষ্টাও করতাম না মনে করার!
২
“আমার আবার ট্র্যাক
কী?” পাঠকজিকে জিজ্ঞেস
করেছিল রাজীব।
-
আগের ব্রাঞ্চে তুমি কি করতে না করতে, ব্যাঙ্কের
ভিতরে, বাইরে, সবকিছুর খবর রাখেন পাঁড়েবাবা।
সেদিনই এই ভালো জিনিষটা মাথায় ঢুকেছিল তার।
যদিও তখন রপ্ত করে নি। পরে, অনেক পরে যখন পার্টিতে বারিদদার নেতৃত্বে কাজ করছে, দেখল
তিনি সেই কথাটাই বলছেন প্রত্যেকটি বৈঠকে, “তোমরা সকলেই নিজের নিজের ব্যাঙ্কে এক এক জন নেতা, অথচ ডাইরি রাখো
না। খুব হলে, একটা চিরকুট লিখে পকেটে রেখে নিলে। চলে না। প্রত্যেক নেতাকে ডাইরি রাখতে
হবে। পয়সা না থাকলে বলো আমি পয়সা দিয়ে কিনে দিচ্ছি।” ভাগ্যিস তত দিনে রাজীব নিজেও নিয়মিত ডাইরি
রাখা শুরু করে দিয়েছে, তাই পার্টিনেতার বকুনিটা উপভোগই করেছিল বসে বসে।
হড়তাল ছিল শুক্রবারে। ইউনিয়নের সাপ্তাহিক বসার
দিন বুধবার। সব ব্রাঞ্চ থেকে কর্মীরা আসবে। এই অভ্যাসটাও রাজীবই
শুরু করিয়েছিল এক সময়। আর মাসে দুমাসে সব ব্রাঞ্চের সদস্যদেরকে নিয়ে মাসমিটিং; ব্রাঞ্চের
ভিতরে হওয়ার দরকার নেই, পিছনের জমিতে ভাড়ায় পঞ্চাশটা চেয়ার আনিয়ে। রিকগনাইজড ইউনিয়ন
তো নয়, মেজরিটিও নেই। উঠতি রাইভাল ইউনিয়ন। স্ট্রেংথ-শো করতে হবে। ভিতরে মিটিং করা নিয়ে
ঝঞ্ঝাটে না যাওয়াটাই ভালো।
… দেবেশ বিশেষ করে
ডেকেছিল, বুধবারের মিটিংএ থাকতে বলেছিল। ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চে ঢুকে রাজীব
পরিতৃপ্ত বোধ করল। এখনও হয় মিটিং। তবে, হয়তো সবার এসে পৌঁছোবার ফ্রিকোয়েন্সি
কমে গেছে। ব্যাঙ্কের কাজকর্মও তো পালটে গেছে। টেকনলজি ঢুকছে নতুন নতুন। কোর ব্যাঙ্কিং
হওয়ার পরেও ছয় বছর পেরিয়ে গেছে।
পৌঁছোতেই দেবেশ আবার ধরল। লোকজন তখনও আসা বাকি
– সিটি, ফুলওয়ারি,
কঙ্কড়বাগ … মুরাদপুরও আসে নি।
-
হ্যাঁ, দাদা, এখন দেরি আছে মিটিংএর। চলুন,
আপনার গল্প শুনি।
-
কোথায় ছিলাম?
-
ট্রান্সফার এপিসোড কমপ্লিট, আগে বোলিয়ে।
-
হাঁ, এক বাত। উস সময় গওর নহীঁ কিয়ে থে। লেকিন,
এখন মনে হয়, ইট টুক রুট ইন মাই মাইন্ড। পাটনায় ফিরে আসার পর চার মাসও হয় নি, ঐতিহাসিক
বন্যা এল। ছাতে আট-নয় দিন, নিচে নেমে বাড়ি সাফ করতে একদিন, বিসিজির টিকায় ধুম জ্বরে
হাত ফুলিয়ে একদিন … সব মিলিয়ে পনেরো
দিন পরে যখন জয়েন করলাম, স্পেশ্যাল ছুটির কথা ওঠালাম। পাঠকজি বললেন, প্রভিজন নেই। পাঁড়েবাবা,
কিছু বললেন না। বাকিদের তো মুখে জিভই নেই। ভীষণ ক্ষোভ হল। … একটা সমস্যা অবশ্য ছিল। ব্যাঙ্কের ওই ব্রাঞ্চে
তখন অব্দি কোনো একজনকেও পাই নি, যে আমাদের পাড়ায় থাকে, বা বন্যার দুর্ভোগে পড়ে ডিউটিতে
আসতে পারে নি। সত্যিই তো, মানুষডোবা জল তো এদিকে হয়ই নি। … অন্যান্য ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের সঙ্গে তখনও
আমার পরিচয় হয় নি। … তাই একটা লিখিত
আবেদন দিলাম বটে, কিন্তু সেটা নিয়ে, যাকে বলে, লড়ে গেলাম না। ভাবলাম, আগে এদেরকে বোঝা
দরকার। পনের দিন আর্নড লিভ থেকে কাটা যাওয়া এমন কিছু বিষয় নয়। তবে এটাও বুঝে গেলাম
যে এই পাঠকজি, পাঁড়েবাবা, মিশ্রাজি, শ্রীবাস্তবজী … ইউনিয়নের তাবড় নেতাদের নতুন কোনো সমস্যা এলে সেটা নিয়ে এগোবার
ভাবনা নেই, ভাববার ফুরসতও নেই, সৎসাহসও নেই। একবারও, খবরের কাগজের বড় বড় হেডলাইন আর
ছবি দেখার পরও তারা স্পেশ্যাল ছুটির ব্যাপারটা, জোনাল অফিস, হেড অফিস তো দূরের কথা,
ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে চাপটুকুও দিল না যে আমার আবেদনটা রেকমেন্ড করে ফরোয়ার্ড করা হোক।
… অথচ … পাটনায় ৭৫এর বন্যা ফ্ল্যাশ ফ্লাড ছিল, জানোই।
বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণে এসেছিল। বিহারে অন্য কোথাও আসে নি। অথচ তার কয়েক বছর পরেই যখন
সারা বিহারের বন্যা-পরিস্থিতিতে বাড়ি-মেরামত ইত্যাদির জন্য ব্যাঙ্কের হেড অফিস থেকে
বিশেষ ফ্লাড-লোনের সার্কুলার হল, গ্রামেগঞ্জে সত্যি সত্যি যাদের বাড়ি ভেঙেছিল, তারা
কী পেল জানি না, শহরে দোতলা বাড়ি থাকা সত্ত্বেও ওই নেতাদের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে
গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত জমি-বাড়ির নকল কাগজ তৈরি করিয়ে সেই ঋণের জন্য আবেদন করল, অনেককে
করতে উৎসাহিত করল, এমনকি আমাকেও জিজ্ঞেস করল, লোন নেবে, তবে কোনো গ্রামের বাড়ির কাগজ
তৈরি করিয়ে দিচ্ছি।
-
নিয়েছিলেন?
-
পাগল? এসবের কখনো প্রবৃত্তিই হয় নি। তবে সেটা
পরের ঘটনা। তার আগে, এক বছরের মধ্যে অনেক কিছু ঘটেছিল। বন্যার আগেই দেশে এমার্জেন্সি
ডিক্লেয়ার হয়েছিল ২৫শে জুন। ইউনিয়নেও ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। সেসময় সাহিত্যিক বন্ধুদের
সঙ্গেই আমার বেশি সময় কাটত। তারই সঙ্গে একটা নতুন রাজনৈতিক চিন্তাধারাতেও আমি বইতে
শুরু করেছিলাম। মানে একই সঙ্গে সংগঠন, স্টাডি সার্কল … সব চলছিল। বা, যার জন্য আমার দুর্নামও হচ্ছিল,
হয়তো ব্যাঙ্কে এসেছি কিন্তু একটা বইয়ের মধ্যে আছি, তাই ব্যাঙ্কে ‘ছুটিতে থাকব’ বলে সামনে লাইব্রেরির মাঠটায় পড়তে বসে গেলাম,
বিকেল চারটে বেজে গেল। অনেক বই এভাবে পড়তে গিয়ে দু’শো দিনের বেশি লিভ-উইদাউট-পে হয়েছিল জানো? আগামি দশ বছরে। তার
মাইনে কাটিয়েছিলাম আগামি আরো তিন’বছর ধরে।
-
জব্বর লোক ছিলেন আপনি! লোকে বলত না, মাথায়
ছিট?
-
না বললেও, ভাবত নিশ্চয়ই। তবে কমরেড, ছিট একটু
রাখতে হবে মাথায়। সে লেখাপড়ার হোক, সাহিত্যের হোক, ইউনিয়নবাজির হোক, বন্ধুত্বের হোক
… ছিট না থাকলে কোনো
কাজ করার জুনুনটাই আসবে না। আর রুটিন লাইফ বাঁচতে বাঁচতে, টাকা কামাতে কামাতে এয়ারকন্ডিশন্ড
ভেজিটেবল হয়ে যাবো। … হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম?
ওদিকে ঐসব, আর এদিকে ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চে আমাদের পরের ব্যাচের এক ঝাঁক ছেলে ট্রান্সফার
হয়ে এল। পাঠকজি, পাঁড়েবাবা, মিশ্রাজি, শ্রীবাস্তবজী এনারা, কেউ প্রমোশনে কেউ ট্রান্সফার
রিকোয়েস্টে অন্য ব্রাঞ্চে চলে গেলেন। … নতুন ছেলেগুলো সবাই ভালো ছিল, তবে তার মধ্যে একজন, মণিভূষণ, আমার বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে লাগল। সে নিজে কায়স্থ, কিন্তু সেসময়
আমাদের ব্যাঙ্কে জাগতে থাকা কায়স্থবাদের প্রবল বিরোধী। কায়স্থদের মধ্যে অনেকেই নিজেদেরকে
জাতিবাদের বিরোধী বলত, কিন্তু পাশে দাঁড়িয়ে কায়স্থদের নামে একটা কুকথা বললে দেখতাম,
প্রাণ কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু মণিভূষণ তেমন ছিল না। তার সঙ্গে
ঘনিষ্ঠতায় ব্যাঙ্কের কিছু কিছু ব্যাপার আমিও দেখতে শুরু করলাম। বিশেষ করে জাতের ব্যাপারগুলো।
তখন ব্যাঙ্কে দুটো ইউনিয়ন। একটা আমাদের। রিকগনাইজড, মেজরিটি। অন্য ইউনিয়ন, মাইনরিটি,
কিন্তু তাদের লম্বা হাত। কেননা তারা একটি বিশেষ জাতের মানুষ, ভূমিহার (তাও আবার সবচেয়ে
বেশি গাজিপুর অঞ্চলের ভূমিহার), এবং সে জাতটার একসময় এই ব্যাঙ্কের, বিশেষ করে উত্তর
প্রদেশ আর বিহারের শাখাগুলোয় আধিপত্য ছিল। তাদের পক্ষে আছেন আবার, ব্যাঙ্কের একজন সিনিয়র জেনারেল
ম্যানেজার। বিভিন্ন প্রদেশে রিজিওনাল ম্যানেজার, শাখায় শাখায় সিনিয়র সিনিয়র ম্যানেজাররা
তো আছেই। অন্যদিকে আমাদের ইউনিয়নেও দুটো দল। ব্যাঙ্কের নতুন নিয়োগে বিরাট সংখ্যায় ঢুকেছে
কায়স্থ যুবক। তারা নেতৃত্বে না থাকলেও সংগঠনে
সবচেয়ে বড় গ্রুপ এবং এগ্রেসিভলি নেতৃত্বে আসতে চাইছে। তাদের পিছনেও আছে একজন জেনেরাল
ম্যানেজার, তার ওপর এই প্রদেশের রিজিওনাল ম্যানেজার, এস্ট্যাব্লিশমেন্ট ম্যানেজার এবং
জামশেদপুরের একজন সিনিয়র ম্যানেজার। শেষের জন আবার একসময় নেতাও ছিল। সবাই কায়স্থ। অথচ
নেতৃত্বে এখনও সেই পাঁড়েজি, পাঠকজি, মিশ্রাজি … দু’একটি কায়স্থ থাকলেও
তাঁরা একটু নিরীহ গোছের। সময় কাটিয়ে চলা মানুষ। এই ব্রাহ্মণপ্রধান দলের স্পন্সর আবার
ইউপিতে থাকা এই সংগঠনের সবচেয়ে বড় নেতা, ব্রাহ্মণ, ওয়র্কম্যান ডায়রেক্টর। … এই তিনটে পোলারাইজেশনের আশেপাশে ঘুরফির করছে
কিছু বাঙালি, কিছু মুসলমান এবং কিছু তারা, যারা তখনও সেভাবে ফোর্স হয়ে ওঠে নি – ব্যাকওয়ার্ড আর এসসি-এসটি। তাদেরই মধ্যে রাজ্য
সম্পাদক গুপ্তাজিও পড়েন, জাতে বৈশ্য, কিন্তু সৎ ও পরিশ্রমী। বস্তুতঃ কায়স্থ চাপ ঠেকাতেই
তাঁকে পদে বসানো।
-
এই জাতিবাদ খেয়ে গেল বিহারকে। এখনও কি শেষ
হয়েছে নাকি। হ্যাঁ, ব্যাকওয়ার্ডদের সংখ্যা রিক্রুটমেন্টে কিছু বেড়েছে।
-
এইসব যখন বুঝছি তখনই রাজ্য সম্মেলন হল ছাপরায়।
ছাপরায় যিনি সম্মেলন করাচ্ছিলেন তিনি আবার সংগঠনের কিম্বদন্তি নেতা সিংজি, রাজপুত।
সবার অন্তত মুখে মুখে তিনি দি-বেস্ট। তাঁর বিষয়ে গল্প শুনেছিলাম অনেক। মুখে মুখে গল্পে
গল্পে ঘুরতেন তিনি। … ছাপরা সম্মেলনেই
একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হল আমার। ছাপরা সিংজির নিজের জায়গা। তাই বলতে গেলে তিনিই প্রধান
অতিথিসেবক। সেই মত সুন্দর ব্যবস্থাও করেছিলেন। যা চাঁদা পুরো রাজ্য থেকে এসেছিল বা
ছাপরার মত ছোটো শহরে তোলা গিয়েছিল সেছাড়াও নিজে ব্যক্তিগতভাবে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়েছিলেন।
কিন্তু যা হয়। শুরু হতে দেরি, কাজেই লাঞ্চ ব্রেকেও দেরি। … সবজায়গাতেই সমস্যাটা হয়। কিন্তু আমি এবং আরো
অনেকেই স্পষ্ট দেখলাম, কায়স্থ যুবকদের নেতৃত্বে একটা দল, দেরিটাকে হাঙ্গামায় পরিণত
করার জন্য, নেতৃত্ব এবং বিশেষ করে সিংজিকে অপদস্থ করার জন্য কাজে লাগালো। তারা আমারও
বন্ধু, তাই আমিও প্রথমে না বুঝে ওদের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে সঙ্গ দিয়েছিলাম। সভাস্থল
থেকে বেরিয়ে দলটা মাঠের ডানদিকে যেখানে খাবার রান্না হচ্ছে সেদিকে এগোলো, আমিও গেলাম।
তাতে বেশি কিছু বলার ছিল না, খিদে পেয়েই যেতে পারে। তারপরেই দেখলাম চকিতে একটা ছোট্টো
গ্রুপ, “কী কী রান্না হয়েছে
এখন অব্দি, কী কী হয়নি” ইত্যাদি বলতে একটা
ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল। পিছু পিছু আমিও ঢুকলাম। দেখলাম, ইচ্ছে করে তারা তৈরি ভাতের ঝুড়ি,
ডালের ডেকচি, দইয়ের মালসা সব উল্টে ফেলে সারা ঘরে ছড়িয়ে দিল। যাতে কেউ খেতে না পায়
আর ক্ষোভটা ছড়ায়। ছিঃ! মনে মনে বলে আমি বাইরে এসে অদূরে মাঠে বসে পড়লাম। সেখানেই আরো
কয়েকজনকে পেলাম যারা ঘটনাটাকে পছন্দ করছিল না। …
দেবেশের মোবাইলে একটা ফোন আসছিল। ঈষৎ দূরে
গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে ফিরে এল।
-
কারোর তো খাওয়া হল না?
-
হল, আবার করে কিছু রান্না হল। দেরি হল অনেক।
-
তারপর? … আচ্ছা, এক মিনিট। এখন ফোন এসেছিল নিখিলের। ও ঢুকছে। বলল, কাল
বেগুসরাইয়ের দিকে যাবে, ব্রাঞ্চ ভিজিটে। জিজ্ঞেস করল আপনি যাবেন কিনা। যাবেন? আগে তো
গেছেন বেশ কয়েকবার।
-
বেগুসরাই গেছি, আশেপাশের সবকটা ব্রাঞ্চে যাই
নি। ঠিক আছে, যাবো। কাল কখন?
-
সকাল আটটায়। আপনাকে আপনার বাড়ির সামনে থেকে
পিক-আপ করে নেব!
-
ঠিক আছে।
-
তাহলে এখন আমরা মিটিংটা সেরে নিই।
সব ব্রাঞ্চ থেকে সাথীরা চলে এসেছিল। দেবেশ
চেয়ার ঘুরিয়ে বসল। রাজীবের পর, এখন সম্পাদক নিখিল, ব্যাকওয়ার্ড
জাতের। সিন্সিয়ার ছেলে। সে মিটিং শুরু করল। দেবেশ এখন তার ডান হাত।
৩
পরের দিন সকাল আটটা নাগাদ সাদা স্কর্পিওটা
চলে এল। রাজীব রাস্তাতেই ব্যাগ, জলের বোতল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। উঠে
বসল। উঠতে উঠতে ভাবছিল এতজন সঙ্গী পেলে আর পয়সা থাকলে সে-ও নিজের সময়ে গাড়ি ব্যবহার
করতে পারত। যেতে হত একা, জোর করে একজন সঙ্গী জোটাতো। তারপর বাস ধরত। ওই, বাইরে থেকে
বড়ো নেতা এলে গাড়ি করা হত। তখন আবার নেতা সঙ্গে যাওয়ার জন্য সবাই নেতা। সে নিজেই বলত,
আমি নিশ্চিন্তে পিছনে বসে যাবো ভাই। যখন নেতা হয়নি, তখন তো বেশ কয়েকবার জোর করে জায়গা
করতে হয়েছিল। একবার এম্ব্যাসাডরের জানলায় পিঠ দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সফর করেছিল পাটনা
থেকে মুজফফরপুর।
-
হাঁ দাদা, সুনাইয়ে। ছাপরা সম্মেলন। লাঞ্চের
পর।
-
লাঞ্চের পর। … বিকেলে। হ্যাঁ, যখন নির্বাচনের সময় হল, ঐ
কায়স্থ-দলটা থেকে একজন এসে আমাকে বলল, “দাদা, আপনি কমিটি মেম্বার হয়ে যান, একজন বাঙালি থাকা দরকার …” । সোজাসুজি না বলে দিলাম। আর ওই সম্মেলনেই
একজনকে দেখলাম। নাম শুনেছিলাম। পাটনাতেই সবাই বলাবলি করছিল, ছাপরায় গেলে দেখবেন, ক্রান্তিকারি
নেতা! সেই দেখলাম। সমুদ্রদা, রোগাপাতলা। তিনি নাকি চিরকালই বিদ্রোহী নেতা। মুজফফরপুরে
পোস্টেড। পায়জামা, পাঞ্জাবি, গায়ে চাদর জড়িয়ে, গরম গরম ভাষণ দিলেন। কিন্তু তখনও দুপুরের
ঘটনাটা নিয়ে এত বিচলিত ছিলাম, বিশেষ কিছু শুনছিলাম না।
গাড়িটা গঙ্গাসেতুতে ঢুকছে। দুদিকে ভাদ্রশেষের
প্রশস্ত নদী। মাঝের চরগুলো ডুবে আছে। কোনো কোনোটার ঘাসের সবুজ চুড়োগুলো হয়তো হাওয়ায়
দুলছে, তবে এত দূর থেকে দেখা যায় না।
-
থোড়া রুক যাও ভাই। গঙ্গাজি কো দেখলেঁ জরা।
-
আপনি মানেন এসব?
রাজীব মজা পেল,
“মতলব? নদীটা দেখা
যাচ্ছে, এতে মানামানির কী আছে?”
-
না, মানে, গঙ্গাজি বললেন।
-
সেটা এখানকার চলতি শব্দটা ব্যবহার করলাম। আর
ফালতু ফালতু লোককে দিনরাত জি জি বলছি, গঙ্গা তো সত্যিই জি। … হামারি সভ্যতা অওর সংস্কৃতি কি জননী হ্যয়!
শান্তিতে, জ্যামে না ফেঁসে সেতুটা পেরিয়ে যাওয়া
একটা মনে রাখার মতো ঘটনা। তাই পেরুলে পর সবাই একটু চা খেয়ে সেটা সেলিব্রেট করে। তারাও
করল। গাড়িতে পাঁচজন। সামনে নিখিল। পরের সিটটায় রাজীব আর দেবেশ।
পিছনের সিটে জগদীশ, বেগুসরাইয়েরই স্টাফ, ফিরছে। প্লাস ড্রাইভার।
-
হ্যাঁ, এবার বলুন।
-
ছাপরা সম্মেলন থেকে ফেরার কিছুদিনের মধ্যে
খবরটা চাউর হতে লাগল যে সারা দেশেই এই কর্তৃপক্ষ-স্বীকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠ সংগঠনের যে প্রতিষ্ঠিত
নেতৃত্ব, তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে। আমরাও ব্রাঞ্চে জানতে পারলাম। প্রধানতঃ
দুটো বিষয় নিয়ে। এক, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপোষ করে চলার নীতি আর দুই, সংগঠনে আভ্যন্তরীণ
গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ। লড়াই চলছে এবং খুব শিগগিরই
নতুন একটা সংগঠন জন্ম নিতে পারে। আরেকটা কথা শুনে নাও। সামান্য জ্ঞান বঢ়েগা।
- কী?
- আমি যে রাজনীতির সঙ্গে তখন যুক্ত ছিলাম, সেই গ্রুপেও কিন্তু ব্যাপারটা
নিয়ে ভালোই আলোচনা চলছিল যে কেন যেখানে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নবাগত, ন্যাসেন্ট,
সেখানে একই দলে বা সংগঠনে থেকে সমান্তরাল মঞ্চ তৈরি করে বেশি দিন কাজ করা যায় না। যেমন
ইয়োরোপে করা যায় এবং করাও হয়। কিন্তু ভারতের মত দেশে বিরোধের শুরু বিকল্প প্রস্তাব,
পরামর্শ দিয়ে হয়না, হয় নিষেধ, নিগেশন দিয়ে, এবং সেটা প্রথমেই আঘাত করে দুই চিন্তাধারার
মধ্যেকার সাংগঠনিক সম্পর্কে। কিছু বুঝলে?
- না।
- নানারকম রাজনৈতিক চিন্তার ঢেউ। আমার সময় ছিল। তোমার সময়েও থাকবে।
ভালো চিন্তার সূত্র যেখানে যা পাবে লিখে রাখা প্র্যাক্টিস করো। তখনি সমাধান হয়তো পাবে
না। তবে, ভালো প্রশ্ন ভালো উত্তরের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। পাঁড়েবাবা নয়, দেবেশবাবার
খাতায় লিখে রেখো। এনি ওয়ে, তত দিনে আমি আর ব্রাঞ্চে নতুন আসা যে ছেলেটি বন্ধু হয়েছিল,
মণিভূষণ, দুজনে হরিহরাত্মা হয়ে পড়েছি। ও-ই বেশি খবরাখবর রাখত
আর ব্রাঞ্চের অল ইন্ডিয়া রেডিও ছিল। দুজনে যেখানে যাই একসঙ্গে যাই। মাঝেমধ্যে গিয়ে
সিনেমা-টিনেমাও দেখে আসি কোনো সন্ধ্যায়। আর তারই সঙ্গে এ-ব্রাঞ্চ সে-ব্রাঞ্চে ঘুরে
নতুন একটা দলকে আমরা আবিষ্কার করলাম যারা বর্তমান সংগঠন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে, জাতিবাদী
প্রতিদ্বন্দ্বিতারও বিরুদ্ধে, সর্বভারতীয় ঘটনাবলী সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল এবং বর্তমান
সংগঠন থেকে বেরিয়ে নতুন একটা সংগঠন গড়ার সম্ভাবনাকে আশার চোখে দেখছে। যদিও আমার দিক
থেকে এই দেখার মধ্যে একটু অতিরিক্ত উৎসাহের ব্যাপার ছিল। কেননা, আমাদের ব্যাঙ্কের রাজ্য
সংগঠনে তেমন কোনো ঘটনা ঘটে নি, যা অন্য অনেক জায়গায় ঘটছে বলে আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম।
বা, হয়তো ঘটেছিল, আমিই জানতাম না।
- যেমন?
- সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে দেওয়া হচ্ছে না, প্রতিনিধি হতে দেওয়া
হচ্ছে না, সম্মেলনে যেখানে থাকার ব্যবস্থা সেখানে হামলা করা হচ্ছে … ।
- হামলা?
- হ্যাঁ! মারধর, জবরদস্তি বার করে দেওয়া, ডেলিগেট কার্ড না দেওয়া…। ওই মণিভূষণের সঙ্গেই সেসময় অন্যান্য ব্যাঙ্কেও যাওয়া শুরু
করলাম। কিছু পরিচয় হল। সেখানেও দেখলাম, একটা কিছু করার ভাবনাচিন্তা চলছে। সেসব জায়গায়
আবার নতুন নতুন দৃষ্টান্তও পেলাম, যে প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব কিভাবে ব্রাঞ্চে বিরোধী কন্ঠস্বরগুলোকে
কোনঠাসা করছে, অপমানিত করছে প্রতিদিন। … আর তারপর, সবচেয়ে
বড়ো নালিশ – সম্মেলন না করানো, বছরের পর বছর। আর অন্যদিকে, এসব ব্যাপার সম্পর্কে
নালিশ শুনেও যাতে কর্তৃপক্ষ তাদের রিকগনিশন বজায় রাখে, নিয়মিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন
মিটিং, স্ট্রাকচার্ড মিটিং করে …
- কী?
- ওই, যেটাকে আইআরএম বলি …। ব্যাঙ্ক যে ইন্ডাস্ট্রি,
শিল্প সেটা জানো তো। আর আমরা ওয়র্কমেন, সেই শিল্পের শ্রমিক, শাস্ত্রী এওয়ার্ড, দেসাই
এওয়ার্ড অনুসারে। তাই আইআরএম হয়, তাই আমরা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, বাইপার্টাইট সেটলমেন্ট
করি …
- হ্যাঁ এগুলো শুনেছি।
- সেই। যাতে রেগুলার আইআরএম চলতে থাকে তার জন্য তারা কর্তৃপক্ষের
সব শর্ত মেনে একের পর এক, শ্রমিকস্বার্থবিরোধী চুক্তি করে চলেছে … এসবই হচ্ছিল। কিন্তু আমাদের ব্যঙ্কে তখন অব্দি অন্ততঃ ওই মারধর, গুন্ডামি ইত্যাদি
হয় নি। হুটিং, বুলিইং একটু আধটু হয়তো ছিল। … তাই, অন্ততঃ আমার
মনে হচ্ছিল যে হয়তো আমরা আরেকটু সময় নিতে পারি, আরেকটু গভীর প্রচার করতে পারি অগণতান্ত্রিক
কাজকর্ম আর আত্মসমর্পণের নীতি নিয়ে …। তবে একটা ব্যাপার
ঘটেছিল। সিংজি সর্বমান্য নেতা ছিলেন। তাঁর ওপরে আগে সবার অগাধ বিশ্বাস ছিল। সবাই ভাবত,
সংগঠনের ভিতরে যে একটা জাতের লড়াই নেতৃত্বকে কুক্ষিগত করতে চাইছে, সেটা তিনি হতে দেবেন
না। একটা ব্যালেন্স বজায় রাখবেন। কিন্তু ছাপরার পর জামশেদপুর সম্মেলনে সবাই দেখল যে
তিনি দুর্বল হয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে কায়স্থ-ককাসটাকে স্পেস দিচ্ছেন। আমি যাইনি সেই সম্মেলনে।
ফিরে এসে ঠাট্টা করে সবাই বলত, দু’বোতল মদের বিনিময়ে
বিকিয়ে দিয়েছেন নিজেকে! সেটা না হলেও, তাঁর দুর্বলতা দেখতে পাচ্ছিল সবাই। … সেসবেরই ফলে, পুরো ইন্ডাস্ট্রিতে, আপোষনীতির বিরুদ্ধে আর সাংগঠনিক গণতন্ত্রের
প্রশ্নে প্রথম নতুন সংগঠন আমাদেরই ব্যাঙ্কেই তৈরি হল।
- প্রথম?
- হ্যাঁ। সারা ভারতে প্রথম। আমার নজরে মনে হচ্ছিল, ঐ ভূমিহার-প্রধান
সংগঠনটির ভুমিহারবাদ আর আমাদের সংগঠনে ব্রাহ্মণবাদের পর লালাবাদের সংক্রমণের বিরুদ্ধে
একটা ক্ষোভ প্রকাশের জায়গা থেকে তৈরি হচ্ছিল তৃতীয় সংগঠন। অর্থাৎ জাতিবাদের বিরোধ ছিল
সংগঠনটার মূল ভিত্তি। আর বিগত তিরিশ বছর ধরে সেটা আমাদের ব্যাঙ্কে এই সংগঠনের একটা
বিরাট অবদান।
- সংগঠন তৈরি করার ডাকটা তো দিলেন সেই সেনগুপ্তদা না কী যেন নাম
বললেন?
- সমুদ্রদা! হ্যাঁ, ছাপরা সম্মেলনে যাঁকে প্রথম দেখেছিলাম। তাঁরই
নেতৃত্বে মুজফফরপুরে এই সংগঠনটা তৈরি হল। … সবাই আমরা, মানে
যারা নতুন সংগঠন তৈরি করার পক্ষে ছিলাম, বলা যায় রোমাঞ্চিত ছিলাম, মুজফফরপুর রওনা দিলাম।
তখন তো আর গঙ্গাসেতু নেই। সবাই ভোরবেলায় স্টিমারে পাড়ি দিলাম। এখানে আরেকটা মজার ঘটনা
বলি। … স্টিমারে দেখা হল জামশেদপুরের এক কমরেডের সঙ্গে। ট্রেনে এসে স্টিমার ধরেছে। ছাপরায়
তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। স্টিমারের ডেকে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। ওই কমরেডও অতিবামের একটা
গ্রুপে কাজ করত। আমি নিজের গ্রুপ থেকে যে ধারণাটা নিয়ে যাচ্ছিলাম সেটা হল, সংগঠন যতই
স্থানীয় শক্তিতে তৈরি হোক না কেন, প্রেক্ষিত যেহেতু ভারত, সংগঠনটা সর্বভারতীয় হতে হবে।
এই কথাটা তুলব মঞ্চে, এমনই নির্দেশ নিয়ে যাচ্ছিলাম। আর জামশেদপুরের কমরেড বলল, ভাগ্যিস
রাজ্যস্তরের সংগঠন তৈরি হওয়ার কথা হচ্ছে, সর্বভারতীয় হলে তো আসতামই না। অবাক হলাম।
চিন্তাভাবনায় এত তফাৎ কেন? তাহলে মূল প্রিন্সিপলটা কী হওয়া উচিৎ? আমরা দুজনেই ভুল জায়গায়
নেই তো?
- কী হওয়া উচিৎ প্রিন্সিপল।
- একটু জটিল প্রশ্ন। ভারত সংবিধান অনুসারে ইউনিয়ন অফ স্টেটস। ভাবনার
দিক থেকে, বোধের দিক থেকে নেশন। দুটোই ঐতিহাসিক সত্য। পরে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে
পারে, যদি চাও।
- তখন তো সবাইকেই পহলেজা ঘাটে নেমে ট্রেন ধরতে হত।
- হ্যাঁ, ন’টা-সাড়ে ন’টার মধ্যে পৌঁছে
গেলাম। মুজফফরপুর তখন আলোয় আলো। সে সময়কার নামকরা সব নেতা আর কর্মীদের জমায়েত। গণসঙ্গীতের
একটা ট্রুপও তৈরি করেছিলেন সমুদ্রদা এবং তাঁর স্ত্রী, দুজনে মিলে। সেই ট্রুপ গান গাইল।
সম্মেলন হল। সবাই নিজের নিজের বক্তব্য রাখল। দুপুরে মুজফফরপুরের বিখ্যাত মাংসভাত খাওয়া
হল। আমায় জিজ্ঞেস করল ওই, আমার ব্রাঞ্চের যে সঙ্গী, মণিভূষণ,
কী নাম হওয়া উচিৎ সংগঠনের। আমি সব সময়, অন্ততঃ রাজ্যস্তরে ইংরেজির বিপক্ষে থাকতাম।
তাই সাজেস্ট করলাম, ব্যাঙ্কের নামের পর জুড়ে দাও কর্মচারী সঙ্ঘ। সেই নামই রয়ে গেল।
বলে, দেবেশের হ্যান্ডব্যাগের ওপর ছাপা, সংগঠনের নামটা দেখিয়ে চুপ করে গেল রাজীব।
- তারপর?
- তারপর আর কী? ব্যাস। গল্প শেষ!
- মানে?
- জন্ম নিল আমাদের নতুন সংগঠন, কর্মচারী সঙ্ঘ! রিকগনাইজড ইউনিয়নের
নেতারা অনেকদিন অব্দি টিটকিরি দিত, ‘তেরজনের সংগঠন’। অত কম না হলেও, সংগঠনটার সদস্য সেসময় মোটামুটি তেত্রিশ-চৌঁত্রিশ জনের বেশি ছিল
না। তারপর তো তিরিশ বছরের ইতিহাস। আজ স্কর্পিওতে চড়ে ব্রাঞ্চ ভিজিটে যাচ্ছি। বড়ো নেতারা
তখন ট্রেনে আসতেন, এখন ফ্লাইটে না হলে হয় না।
- আপনি এসব পছন্দ করেন না, তার মানে।
- পছন্দের ব্যাপার নয়। প্রয়োজনে অবশ্যই ব্যবহার করব সামর্থ্য থাকলে।
ফাইভ স্টারেও ডিনার করতে পারি। কিন্তু লক্ষ্য রাখব ব্যাপারটা যেন কমজোরি না হয়ে যায়।
- … আর পাঁড়েবাবার খাতা?
- সেটাই তো মজার ব্যাপার। জিজ্ঞেস আর কাকে করব, সে ব্রাঞ্চ থেকে
তো পুরোনো লোকেরা সবাই চলেই গিয়েছিলেন। তবে জানা কথা যে পাঁড়েবাবার খাতা থেকে নামটা
কাটা গিয়েছিল সেদিন! তাঁরই সংগঠন ভেঙে নতুন সংগঠন তৈরি করলাম তাঁর নাকের ডগায়! … হ্যাঁ, তবে কিছুদিন পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে অন্য কারোর খাতায় নামটা আমার কিছুদিন
আগেই চড়ে গেছে!
গাড়িটা ততক্ষণে জনদাহা পেরিয়ে মুসরিঘরারির দিকে এগোচ্ছে। রাস্তাও ভালো হয়েছে অনেক।
সে-একবার এমনই ভাদ্র মাসে সমস্তিপুর যেতে গিয়ে বাসটাই ফেঁসে গিয়েছিল ডাইভার্সনে। সব
যাত্রীকে কোমরজলে নেমে বাসটাকে ঠেলে ওপরে তুলতে হয়েছিল। তারপর আবার টায়ার বার্স্ট করল
দুবার। স্টেপনিও আর নেই। ভাগ্যিস জনদাহার মুখে। ড্রাইভার আর ক্লিনার চাকা গড়িয়ে নিয়ে
গিয়ে সারাই করিয়ে আনল! … আর শুধু সে একাই তো নয়! ‘তেরজনের সংগঠন’ অনেক সাথীর ভালোবাসার পরিশ্রমে আর উদ্দীপনায় আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ সংগঠন হয়ে উঠেছে।
পাশে বসা দেবেশ আর সামনের সিটে বসা নিখিলের দিকে তাকালো একবার। তারপর আবার পুরোনো দিনগুলোয়
ডুবে গেল।
৪
“হয়তো আমিই ভুল ছিলাম!” মটিহানির ভাতের দোকানে বসে, সদ্য ধোয়া হাতের
সঙ্গে সঙ্গে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলল রাজীব। টিশার্টের বোতাম
তিনটে খুলে পিছন দিকে ঠেলে দিল কলার। দোকানের ছেলেটি গেলাসে জল দিয়ে গেছে। এক ঢোঁক
জল খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিল। বেশি খেলে আবার ভাত খেতে অসুবিধা হবে। “হয়তো সত্যিই সেটাই সময় ছিল নতুন সংগঠন তৈরি
করার। … আরে কয়েক মাস আগে
পরের তো ব্যাপার। কিছু দিনের মধ্যেই আরো কিছু সংগঠন তৈরি হল, যেখানে আমাদেরই নেতৃত্ব
ছিল সেখানে ওদের পক্ষের কমরেডরা সংগঠন ভেঙে বেরিয়ে গেল, রাজ্য ফেডারেশনও তৈরি হল আর
শেষে অল ইন্ডিয়াও … আর অল ইন্ডিয়া তৈরি
হতে না হতে প্রথম হড়তালের ডাক …।”
-
আর আমাদের মেম্বারশিপ?
-
সেই তো বলছিলাম। নতুন সংগঠনের প্রথম হরতাল!
সফল করতে হবে। অথচ পঁচিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশজনের ব্রাঞ্চে আমাদের সদস্য সংখ্যা কোথাও তিন,
কোথাও দুই, কোথাও এক। কি করে হবে পিকেটিং? কে শুনবে আমাদের অনুরোধ, ব্যাঙ্কে না ঢোকার?
… কিন্তু সেই দেখলাম
আমাদের সাথীদের নৈতিক বল। আর নতুন সংগঠন গড়ে ওঠার প্রভাব। খোদ রাজধানীর সবচেয়ে বড় ব্রাঞ্চে
মাত্র একজন দাঁড়িয়ে গেল, আর তাকে দেখে, শুধু কয়েকজন ঐ কায়স্থবাদী নেতা ছাড়া আর কেউ
ব্রাঞ্চের ভিতরে গেল না। মোটামুটি তিন ঘন্টা তারা নৈতিক সমর্থনে দাঁড়িয়ে রইল বাইরে।
ভাত এসে গিয়েছিল। ধোঁয়া ওঠা ভাত, সর্ষে দিয়ে
রুই মাছের ঝোল আর লেবু, পেঁয়াজ। ভাত ভেঙে ঝোল ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করল নিখিল। “আর সেই হড়তালের পরই প্রথম বড় ভাঙন ধরল ওদের
সংগঠনে। এ ভাই, আমি মাছ খেতে খেতে কথা বলতে পারব না। বাঙালি হলেও বাঙালিয়ানা তো নেই,
মাছের কাঁটা বেছে খেতে সময় লাগে। খেয়ে নিই আগে।” ছোট, সরু দোকানটায় সবক’টা টেবিলের চেয়ারে ভর্তি খাইয়ে। আর, মাছ-ভাতেরই খরিদ্দার সবচেয়ে
বেশি। মনে হয়, মাছের জন্যই দোকানটায় ভিড় হয়। বেশ বড় বড় দু’টুকরো করে মাছ।
… “সংগঠনে নাম লেখালেই কি আর সবার স্বভাব পাল্টে যায়? মুজফফরপুর সম্মেলনের
কিছু দিন পরেই সংগঠনের রেজিস্ট্রেশনের কাজটা সামনে চলে এসেছিল।” একটা ঘটনা মনে পড়ে যাওয়ায় খাওয়া শেষ করতে
করতে বলল রাজীব। “তখন সাতজনেও হয়ে যেত। সবাই যেন এক জায়গা থেকে না হয় তাই সমুদ্রদা
সিদ্ধান্ত নিলেন যে পাটনার বিভিন্ন ব্রাঞ্চ থেকে চারজন আর মুজফফরপুরের ব্রাঞ্চ আর রিজিওনাল
অফিস থেকে নিজেকে নিয়ে তিনজন পৌঁছোবে। কে কে যাবে, ফোনে মণিভূষণকে
নামও বলে দিলেন। যেদিন পৌঁছোবার, সবাই সময় মত পৌঁছে গেল, একজন আর কিছুতেই পৌঁছোয় না।
শেষে রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে বাইরে বেরিয়েছি আমি আর মণিভূষণ,
টেলিফোন করব বলে, হঠাৎ দেখি একটা বড় গাছের আড়ালে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।”
-
কে?
-
ওই, সপ্তমজন! গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে একবার রেজিস্ট্রেশন
অফিসটার দিকে তাকাচ্ছে আর একবার রাস্তার দিকে – কেউ দেখছে কিনা। … ওখানেই ঝাড় খেল মণিভূষণের কাছে। ধরে নিয়ে
আসা হলে সমুদ্রদাও বকুনি দিলেন। যাহোক, সাতজনের স্বাক্ষরে ফর্ম জমা হয়ে গেল। কিছুদিনে
পেয়েও গেলাম নম্বর আর সার্টিফিকেট। …
বেসিনে হাত ধুয়ে দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ালো।
নিখিল কাউন্টারে পয়সা দিচ্ছিল। বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, “এখন তো শুনেছি বহুত ঝঞ্ঝটিয়া হয়ে গেছে রেজিস্ট্রেশন।”
-
হতেই দেয় না। স্পেশ্যাল ইকোনোমিক জোন, এক্সপোর্ট
প্রসেসিং জোন এসব তো শুরুই হয়েছিল ইউনিয়ন গড়ার পথ বন্ধ করার জন্য। মালিকেরা রাজ্যের
লেবার মিনিস্টারকে পয়সা পাঠাচ্ছে আর লেবার মিনিস্টার নিজে গিয়ে তদারক করছে যাতে রেজিস্ট্রেশন
অফিস কাউকে রেজিস্ট্রেশন না দেয় আর লেবার কমিশনারের অফিসে কোনো রকম আবেদন গ্রহণ না
করা হয়। এখন তো আইনেই সেসব রাস্তা করে দেওয়া হচ্ছে ধীরে ধীরে যাতে শ্রমিকেরা কোথাও
সুবিচার না পায়। … যাহোক, কোথায় যাবো
এবার?
-
ফিরব। তবে ফেরার পথে সমস্তিপুরে ঢুঁ মেরে যাবো।
-
তাহলে যাওয়া যাক।
সমস্তিপুরে যাওয়ার হাইওয়েতে এখন আর খুব কাছ
থেকে তামাকের ক্ষেত দেখা যায় না। কিন্তু সামনে কোথাও দুর্ঘটনা হওয়ায় হাইওয়েতে জাম ছিল।
গাড়িটা, আরো কয়েকটি গাড়ির মত ভিতরের রাস্তা ধরল। এখন দুপাশে তামাকের ক্ষেত। কিছু কিছু
ক্ষেতে একেবারেই সদ্য লাগানো হয়েছে। কিছু ক্ষেতে উদ্ভিদ্গুলো পাতা মেলেছে বড় বড়। একবার
অনেক আগে দ্বারভাঙ্গা থেকে সমস্তিপুরে আসছিল রাজীব। বিরাট বিরাট
পাতায় গিজগিজ করছে ক্ষেত। তার গুণমান কেমন, ভালো দামে বিক্রি হবে কিনা সেসব তো আর জানে
না, কিন্তু এত লোভনীয় লাগছিল পাতাগুলো!
“প্রথম বড় ভাঙন ধরল
হরতালের পর, বলছিলেন?” দেবেশ প্রশ্ন করল।
“হ্যাঁ, ঠিক তৃতীয়
সম্মেলনের আগে। মুজফফরপুরের পর দ্বিতীয় সম্মেলন হল জামশেদপুরে আর তৃতীয় একেবারে ছোটো
শহরে – কাত্রাসগড়ে – ১৯৮৩ সালে। খুব খাঁটি সাথীরা সংগঠনে যোগ দিয়েছিল
ওই ব্রাঞ্চ থেকে। প্লাস, ওদিককার অন্যান্য ব্রাঞ্চগুলোরও সহযোগিতা ছিল। … সেই ব্রাঞ্চেই তো শহীদ বেদীর পিছনে একটা নতুন
স্লোগান দিলাম …
-
নতুন স্লোগান, মানে?
-
আরে, ওই ‘অমর শহীদ কো লাল সলাম’ই সব জায়গায় থাকত। আমি লিখলাম, ‘শহীদোঁ তেরে অরমানোঁ কো, মঞ্জিল তক পহুঁচায়েঙ্গে!’ এখন জানি না আগে কোথাও শুনেছিলাম কিনা। কিন্তু
ডাইরিতে লিখে ছন্দটা বেঁধেছিলাম। মনে হয়েছিল, সবার মনে ধরবে। ধরেও গেল। জামশেদপুরের
একটি ছেলে, তেলেগুভাষী, ওই প্রথমে শুনতে চাইল, কিভাবে ওঠানো হবে। বলে দিলাম। … যাহোক, সেই সম্মেলনেরই আগে পাটনা এবং সারা
বিহারের অনেকগুলো ব্রাঞ্চ থেকে প্রায় একশো জনের মত যোগ দিল আমাদের সংগঠনে! ওই সংগঠনের
সব গুরুত্বপূর্ণ প্রবীণ নেতারা ছিলেন তার মধ্যে! পাটনায় এক সন্ধ্যায় একটা হলঘরে প্রায়
ষাটজনের মত মানুষ সামূহিক শপথ নিলেন। লাইট ছিল না। মোমবাতির আলোয়! কী নাটকীয় দৃশ্য!
… আর কাত্রাসগড়েই
…
-
কী?
-
যাকে সংগঠনের সভাপতি করা হয়েছিল সে বলল, আর
সে সভাপতি হবে না। কেন? না, ওই যারা এসেছেন, সিনিয়র নেতারা, তাদেরকে সে সামাল দিতে
পারবে না, কেননা সে নিজেও ওই ব্রাঞ্চে আছে … সভাপতির একটা ইজ্জত থাকে … ইত্যাদি। ফলে আমি হঠাৎ করে হয়ে গেলাম সভাপতি!
-
আপনি তো সাধারণ সম্পাদক ছিলেন!
-
সেসব তো অনেক পরের ব্যাপার।
ড্রাইভার সাহেব সমস্তিপুর ব্রাঞ্চের নিচের
খালি জমিটায় গাড়ি দাঁড় করাচ্ছিলেন। এক এক করে নেমে সবাই গা-হাত-পা টেনে সোজা করে দোতলায়
ব্রাঞ্চে ঢুকল।
সমস্তিপুর ব্রাঞ্চে আগে বেশ কয়েকবার এসেছে।
কিন্তু এবারে আর পুরোনো মানুষ কাউকে পেল না। ম্যানেজার তো বিহারের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও
ইউপিতে প্রথম কুড়ি বছর কাটিয়েছে। আর বড়বাবু বা হেড ক্যাশিয়ারও সদ্য প্রমোটেড, উত্তর
বিহারেরই অন্য ব্রাঞ্চে ছিল, তার নাম শুনেছে কিন্তু কখনো দেখে নি।
চা, জলখাবার খাওয়া হল। সংগঠনের দৈনন্দিন সমস্যা,
কারো ট্রান্সফার, কারো এলএফসি, কারো মেডিকাল ইনশিওরেন্স এসব আর রাজীব
পারতপক্ষে শোনেও না। শুনে করবেই বা কী? করতে হবে আজকে যারা নেতৃত্বে আছে তাদের।
তাছাড়া, কোর ব্যাঙ্কিং হওয়ার পর লাগাতার স্টাফ পোর্টালে, এইচআরএমএস-এ এত সব বদল হয়ে
চলেছে যে এখন সে আর কিছুই করতে পারবে না। লাভ? … নিখিল আর দেবেশই শুনল। কিছুক্ষণ বসে-টসে সবাই বেরুল।
জনদাহার রাস্তা দিয়েই ফিরছে গাড়ি। … কত কত ঘটনা! সেসব ব্যক্তিগত স্মৃতির ব্যাপার।
মণিভূষণ বা সে-সময়কার কেউ এখন পাশে থাকলেও নাহয় মনে করা যেত।
তবে সবচেয়ে বেশি মনে রাখার মত ঘটনা রাজনৈতিক গ্রুপটার সঙ্গে বিচ্ছেদ, বিয়ে আর পার্টিতে
যোগদান।
নিখিল পিছনে ঘুরে বলল, “তা আপনি তখন সাধারণ সম্পাদক তো হন নি। পরে
হলেন। আমি তখনো পাটনায় আসি নি, গোরখপুরে আছি।”
-
হ্যাঁ, আর … দুই খেপে।
দেবেশ জিজ্ঞেস করল, “দুই খেপে মানে?”
-
একবার হলাম। সরে গেলাম। আবার হলাম। আর এখন
অবসর নেওয়ার আগে সরে গেলাম।
-
এনি স্টোরি? মানে, আবার যখন হলেনই, সরে গিয়েছিলেন
কেন?
রাজীব এক মিনিট ভাবল, বলবে কি বলবে না। অন্য
ধরণের কিছু কথা বলতে হবে, “দেখ ভাই, আমি না
সভাপতি হতে চেয়েছিলাম না সাধারণ সম্পাদক হতে। ছিলাম বেসিক্যালি সাহিত্য-শিল্পের লোক,
জাস্ট উইথ দ্য কমিটমেন্ট যে যেখানে ডাল-রুটি কামাচ্ছি, সেখানকার কর্মী-সংগঠনে এ্যাক্টিভলি
কাজ করব। আর সেটাই করেছি সব সময়। কিন্তু ওই … যখনই কোনো ক্রাইসিস এসেছে আর দেখে মনে হয়েছে যে আর কোনো উপায় নেই,
আমি এগিয়ে না সামলালে সামলানো যাবে না, এগিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার সাহেব, পাসোয়ান চকে
একটু দাঁড়াবেন। লাই কিনব এক প্যাকেট।
-
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমরাও কিনব।
আবার থেমে গেল। এরপরের কথাগুলোও কি বলবে? আবার
ভাবল, নাঃ, বরং ভালো সুযোগ! এই কথার মধ্যেই ওদেরকে ধাক্কাটা দেওয়া যাবে, “ওই মনে হওয়াটার কিন্তু একটা প্রেক্ষাপট আছে।
ওটা ইম্পালসিভ নয়, গাইডেড।”
-
??
-
দেখ, সব সংগঠনকেই একটা গাইডেন্স দেওয়ার ব্যাপার
থাকে। এমনকি, একজিকিউটিভ কমিটি, তার চেয়ে ছোটো অফিস বিয়ারার্স … সেই ছোটো মিটিংকেও একটা পথ দেখাতে হয় আর সেটা
তোমরা এখন, মানে নিখিল, দেবেশ, এবং হয়তো আরো দু’একজন বসে করো। মিটিংএর আগে বসে হোমওয়র্ক করে নাও, কিভাবে সুষ্ঠুভাবে
মিটিংটা এগিয়ে নিয়ে যাবে, যাতে ঠিক সময়ের মধ্যে এজেন্ডাগুলো পুরো হয়, সবার মতামত ভালোভাবে
নেওয়া যায় আর সঠিক এবং কার্যকর সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যায়। … করো কিনা? করো তো?
-
হুম্।
-
হয়তো সাধারণ সময়ে বুঝতে পারা যায় না, কিন্তু
ক্রুশিয়াল কোনো মুহূর্তে, ক্রাইসিসে ফাঁসলে মনে হয়, বেরুতে পারছ না, ফেডারেশনের বড়
নেতার কাছে যাওয়া যাক, অল ইন্ডিয়ার সঙ্গে কথা বলা যাক ইত্যাদি … হয় না সেরকম?
-
হয়।
-
এই জায়গাটাতেই, এই গাইডেন্সের ব্যাপারটাতেই
আমাদের মানে ওয়র্কমেন, বা বৃহত্তর অর্থে শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতির প্রশ্ন উঠে আসে, শ্রমিকশ্রেণীর
রাজনৈতিক পার্টির প্রশ্ন উঠে আসে। … এই বিষয় নিয়ে এখন আর কিছু বলব না। তোমরা যদি আলাদা করে শুনতে চাও
তবে নিশ্চয়ই বসব, বলব কম্যুনিস্ট পার্টি কী, আমাদের রোজকার ট্রেড ইউনিয়নে ফাংকশনিংএ
তার গুরুত্ব কী। … যাহোক, যা বলছিলাম।
মনে হওয়া কথাটা সাধারণতঃ ব্যক্তিগত ইম্পাল্স হিসেবে দেখা হয়, তাই বললাম যে আমার ক্ষেত্রে
তা ছিল না। সংগঠনের ভালোমন্দ নিয়ে যখনি কোথাও কিছু বলেছি তার মূলগত দিকটা গাইডেড ছিল।
পার্টি গাইডেড। অর্থাৎ, বাইরে থেকে মনে হওয়া মনে হলেও সেটা আসলে পার্টির সিদ্ধান্ত
হত। মণিভূষণ পার্টিতে ছিল। আর তার দিক থেকে আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার মধ্যে একটা উদ্দেশ্যও
যে ছিল – আমাকে পার্টিতে
টানা – সেটাও বুঝতে পারছিলাম।
পার্টিনেতাদের সঙ্গে এক এক করে আলাপও হচ্ছিল, তোমরাও তাঁদেরকে চেন, তাঁরাও বলছিলেন
… আর তাতে আমার আপত্তিও
ছিল না। আগের অতিবাম রাজনৈতিক গ্রুপটা ছেড়ে আগেই বেরিয়ে এসেছিলাম। মোটামুটি বোঝো যে
কাত্রাস সম্মেলন, তারপর পাটনা, আবার গোমো। তারপরেই আমি পার্টিতে যোগ দিই। আর দেখ, সময়ের
এমন খেলা! … ৮৮-৮৯ নাগাদ মণিভূষণ
হয়েছিল সাধারণ সম্পাদক। ভালো ছিল। সবার প্রিয়, সবার বন্ধু, ড্যাশিং … কিন্তু এমন একটা কুকীর্তি করল যে সংগঠন প্রায়
ভাঙে আর কি! পরের সম্মেলনে পার্টি আমাকে বলল, অন্য কেউ নয়, আপনিই ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু!
সদস্যরা উদগ্রীব হয়ে চেয়ে দেখছে আপনি কী স্ট্যান্ড নেন। তাই, সংগঠনে বিশ্বাসের ভাঙন
রুখতে আপনাকেই দাঁড়াতে হবে ওর বিরুদ্ধে!
-
তারপর?
-
দাঁড়ালাম। বেশ কয়েকজন, যারা আমাদের দুজনেরই
কাছের মানুষ, কাকে ভোট দেবে বুঝতে না পেরে হল ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
-
??
-
জিতলাম। মণিভূষণ হেরে যত বিমর্ষ হয় নি, আমি
জিতে তার থেকে বেশি বিমর্ষ মুখে জয় স্বীকার করলাম। (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) বুঝে দেখ। যার
সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ায় আমি সংগঠনে এত সক্রিয় হয়ে উঠলাম, যার হাত ধরে আমি পার্টিতে যোগ
দিলাম, তারই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নির্বাচনে বাধ্য করতে হল সংগঠনকে। মাত্র কয়েকটি ভোটে
জিতে আমায় শুরু করতে হল নেতাগিরি, আর তাও একা;
মণিভূষণ আর সেভাবে রইল না পাশে! … তারপর তো কিছু দিনের মধ্যে যুগটাই বদলে যেতে শুরু করল, তোমরা জানোই।
হঠাৎ, সবাই শুনল, ড্রাইভার সাহেব চোখ না ঘুরিয়েই
মন্তব্য করলেন, “এবার পাঁড়েবাবার
খাতায় ফাইন্যালি নামটা কাটা পড়ল, কী স্যার?”
-
অরে, আপ ভি সুন রহে হ্যঁয়?
লজ্জা পেয়ে বললেন, “মাফ করিয়ে সর, কথাগুলো কানে যাচ্ছে … তাই …”
-
ঠিক আছে। কোনো ব্যাপার নয়। … কিন্তু, না ড্রাইভার সাহেব, নাম কাটা তো গিয়েছিল
আগেই, নামটা দোবারা চড়ল।
-
কেন?
-
এখন ততদিনে পাঁড়েবাবার খাতাটা হয়ত শ্রীবাস্তবজির
খাতা হয়ে গিয়েছিল, তাই নামটা আবার চড়ল, শত্রু হিসেবে, কেননা আমি টার্গেটে এসে গেলাম।
দেবেশ বলল, “দাঁড়ান। পাসোয়ান চক এসে গেছে। কটা প্যাকেট
নেব লাই-এর?”
-
দুটো, এই টাকাটা রাখো।
-
রাখুন তো! দু’প্যাকেট লাই-এর আবার পয়সা দেবেন আপনি? … চা খাবেন কেউ?
-
না, ঐ দুধের চা সারাদিন খেয়েছি, এবার খেলে
এসিডিটি জ্বালাবে।
বাকিরাও খাবে না বলল। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।
সবাই কিনল বৈশালীর বিখ্যাত চ্যাপ্টা, গোল গোল রামদানার লাই-এর প্যাকেট। একটা প্যাকেট
ছিঁড়ে সবাইকার হাতে হাতে একেকটা দিল দেবেশ। দিয়েই প্রশ্ন করল, “টার্গেটে এলেন মানে?”
-
বাঃ, তার পরেই তো শুরু হল সিবিআইয়ের কেস! সেসব
তো তোমাদের সামনেই হল!
-
না, মানে, নাম চড়ল বললেন?
-
নাম না চড়লে তো কেস দূরের কথা, সমস্যাটাই হত
না। ম্যানেজার, ভিজিল্যান্স, অফিসার বা এওয়ার্ড সংগঠন, খোদ সিবিআই … কোথায় কোথায় কোন কোন শ্রীবাস্তবজির খাতায়
নামটা ফরোয়ার্ড হচ্ছিল বুঝব কী করে? হ্যাঁ, মারটা খেলাম, আগামি কুড়ি বছর ধরে।
নিখিল বলল, “হুঁ, ... তবু চালিয়ে গেলেন আপনারা! আর আজ আপনাদের তৈরি করা সংগঠন, সংখ্যাগরিষ্ঠ। কর্তৃপক্ষ ডেকে
কথা বলছে!”
-
সংখ্যাগরিষ্ঠ তোমরা করেছ।
-
তা ঠিক, কিন্তু জমিটা …?”
চারদিকে ব্যাপ্ত অন্ধকারে আলোয় ভরা গঙ্গাসেতুর
মুখটা এগিয়ে আসছিল। লেনটাতে জাম নেই। আশেপাশের সবকটা গাড়ি দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। এই
গাড়িটাও তাল মিলিয়ে বাড়ালো গতিবেগ।
৪.৯.২৫/২৭.৭.২৫
No comments:
Post a Comment