সন্ধ্যে হলেই মাঝে মধ্যে স্টেশন পেরিয়ে বাঁদিকের রেলকোয়ার্টারগুলোয় ত্রিদিববাবুর বাড়িমুখো হয় মলয়। একটু ভালো চা, সঙ্গে বৌদির হাতের রোজই কিছু না কিছু নোন্তা-মিষ্টি, নরম আড্ডা, বাচ্চাদুটো পড়ছে বা গানবাজনা শিখছে দেখে ভালো লাগা, কবিতাচর্চা …। কখনো নারায়ণদাও, হীরাপুর থেকে ফেরার পথে চলে আসেন। পত্রিকা দেন, নতুন কোনো সংখ্যা। বলেন, নতুন পত্রিকা বার করার উদ্যোগ নিলে ভালো হয়। ‘প্রবাহ’ বন্ধ হয়ে গেছে। দাশরথিবাবুর কথা বলেন। আরো যার যার কাছ থেকে ভালো লেখা পাওয়া নিশ্চিত তাদের নাম গোনান। পিছনে দেয়ালের দিকে তাকান, “আজ হল বাইশে মার্চ, চুয়াত্তর। ধরে নাও, পুজোর সময় যদি বার করি?”
ফিরে আকছার দিন,
পুরো মেসবাড়ি রাতে আবার বেরোয়, সদলবলে। পুরানা বাজারের শেষে ডানদিকে যে রাস্তাটা ইন্ডিয়ান
অয়েলের দিকে গেছে, সে রাস্তায় ঢুকেই বাঁদিকে ভাতরুটির ভালো দোকান। রুটি তরকারি খেয়ে
ফেরার পথে সবাই ঢোকে আরেকটা গলিতে। বিখ্যাত ঠেক। রাতের আলোয় গরম গরম ভাজা জিলিপি আর
গেলাসে গরম দুধ। সেসব সেরে পান মুখে দিয়ে বাড়ি ফেরে। কখনো মেসের বাইরের কেউ থাকে, পাঁচজন
হয়। কখনো মেসেরই কেউ থাকে না, তিনজন হয়।
কখনো একাও হতে হয়;
বিশেষ করে ছট ইত্যাদির সময়। একা হলে ফেরেও না কখনো কখনো। রুটি খেয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটা
দেয়। ঘাড়-ছোঁয়া ঘিঞ্জি দোকানপাট আর বাতিল রেললাইন পেরিয়ে ডি.সি.লাইনের প্ল্যাটফর্মে
আর ডানদিকে ওভারব্রিজে ওঠার রাস্তা। ওভারব্রিজটা স্টেশনে যাওয়ার নয়, ওপার-এপার করার।
ব্রিজে উঠেই একটা সিগরেট ধরায়। ধোঁয়া মিশে যায় নিচে ধকধক করে স্টার্ট নিতে থাকা ভাপের
ইঞ্জিনের সাদা ধোঁয়ায়। ঘুরে আসে রেলওয়ে ক্লাব ছাড়িয়ে ডানদিকে একটু ওপরে উঠে বড় জলের
ট্যাঙ্কটা অব্দি। সবুজ-সবুজ ছায়াচ্ছন্ন, ভালো লাগে জায়গাটা।
একবার তারা এখানেও
মেসবাড়ির জন্য ঘরের খোঁজে এসেছিল। যে ঘরের খোঁজ পেয়েছিল, দেখা গেল সেটা ঐ বিশাল জলের
ট্যাঙ্কটার ঠিক নিচে। গরমকালের জন্য ফার্স্টক্লাস। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা একটা বড় হলঘরের মত
ব্যাপার। … কিন্তু যদি কোনো
কারণে ওপরের ট্যাঙ্কটায় জলের ভারে ফাটল ধরে … ! মনে মনে ভেবেই শিউরে উঠে ঘরটা রিজেক্ট করেছিল সবাই। সঙ্গে শিউলোচনবাবুও
ছিলেন। নিজের সীতামঢ়িয়া ধরণে, পাতা হাত নাচিয়ে নাচিয়ে বললেন, “না না ভাই, ই কোই রহনে কি জগহ হ্যয়? ঘর ছোড়কে
আপলোগ আয়ে হ্যঁয় নওকরি করনে কে লিয়ে কি মরনে কে লিয়ে? চলিয়ে! চলিয়ে!”
আগের মেসবাড়ি ছিল
একটা খামারবাড়ির দোতলা। পিছনে ক্ষেত। কখনো এমনও হয়েছে, ভাত ডাল রান্না করার পর রান্নার
ছেলেটির খেয়াল হয়েছে যে তরকারি তো কিছু নেই। তখন বাবুদের কাউকে বলেছে, দোতলার সিঁড়ি
থেকেই সোজা পিছনে হাঁক দিয়েছে মলয় দু’তিন মুঠো ঢ্যাঁড়স ছিঁড়ে দিয়ে যেতে। সেই ঢ্যাঁড়স ধুয়ে কেটে গরম তেলের
কড়াইয়ে পড়েছে আর ক্ষেতের ছোঁড়াটা দু’টাকা নিয়ে গেছে।
তখন শকীলও ছিল সেই
মেসে। করলে অঙ্কের লেকচারারিই করবে, ব্যাঙ্কের কেরানীগিরি করবে না বলে ছেড়ে চলে গেল।
অবশ্য সেসময় অনেকেই যেত। তবে শকীলটা যদ্দিন ছিল ভালো লাগত। একই মেসে হিন্দু-মুসলমান
খাবার খাচ্ছে, এক বিছানায় শুচ্ছে … বাড়ি থেকে শবেবারাতের কী সুস্বাদু মিষ্টি নিয়ে এসেছিল। মলয় অনেক
চেষ্টা করেছিল রামবলীজিকেও মেসে টেনে আনার। ‘নিচু জাত’ বলে নিজেই আলাদা হয়ে থাকেন। মেসে এলে প্রথম প্রথম মেঝেতে বসতে যেতেন;
মলয় বুঝত এটা গ্রাম্য সঙ্কোচ নয়, একটা অবস্থান গ্রহণ, একটু দেখানি, কেননা রামবলীজির
বয়সও কম নয়, আর যদ্দুর সে জেনেছিল, রামবলীজি নিজের এলাকায় নাকি একবার নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছিলেন।
তাই নিচে বসাটা তাঁর অস্ত্র হত জাত তুলে কেউ কোনো মন্তব্য করলে তার জন্য প্রস্তুত থাকার।
মেসে এসে নিচে বসতে
গেলেই মলয় হাত ধরে টেনে খাটে বসাতো। খবরের কাগজের ওপর বিকেলের নাস্তা চিঁড়ে ভাজা আর
হয়তো আলু বা ফুলকপি ভাজা ছড়িয়ে রাখা হয়েছে – রামবলীজিকে নিতে বললে চরণামৃত নেওয়ার মত করে ডানহাতটা বাঁ ছুঁইয়ে
এগিয়ে দিতেন। খপ করে ধরে মলয় হাতটা চিঁড়ে ভাজার
মধ্যে ঢুকিয়ে দিত। অলক্ষ্যে অন্যদের ওপর চোখ বুলিয়ে নিত, কেউ উত্তেজিত হচ্ছে কিনা।
তাই এখন আর রামবলীজির
সে রোগটা নেই, কিন্তু মেসে যোগ দেন নি। হ্যাঁ, একদিন মলয়কে, আলাদা করে শুধু মলয়কে তাঁর
ঘরে গিয়ে ডালভাত খেতে নেমন্তন্ন করলেন। প্রায় বস্তির ঘরের মতই একতলা একটা ঘর। খাপরার
চালা। মাটি বেরিয়ে আসা ভাঙা মেঝে। মলয় বুঝল মানুষটা আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক। নিজের জাতবেরাদরের
মধ্যে থাকছেন। নিচু বলে কথিত জাতের, প্রতিরোধী এই মনোভাব সে প্রথম দেখল কারোর মধ্যে।
মাথায় গেঁথে গেল। তাদের আগের মেসবাড়ির মতই
রামবলীজির ঘরের পিছনে ক্ষেত। তবে ঢ্যাঁড়সের নয়, লালশাকের। মোটাচালের ভাতের সঙ্গে গরম
গরম লাল শাক আর অড়হরের ডাল। খুব তৃপ্তি করে খেল মলয়।
মলয়দের এখনকার মেসবাড়িটা
পরমেশ্বর সাউজির একতলা বাড়ির একাংশ। বাড়িটা চারকোনা। মানে চার সারি ঘর একে অন্যের সঙ্গে
জোড়া আর মাঝখানে উঠোন। ওদিকে চওড়া রাস্তাটার দিকে মুখ করে দুটো ঘরপ্রমাণ জায়গা নিয়ে
সাউজির মুদির দোকান। সে দোকানের পিছনে আর ডানদিকে তার পরিবারের থাকার ঘরগুলো। এপ্রান্তে
ডানদিকের শেষের আগের ঘরটা তার রেশন দোকান, যার মুখ একটা সরু গলিতে খোলে।
দিনে গান্ধিনগরের
দিকের রাস্তাটা দিয়ে আসে সরকারি আনাজের বস্তা বওয়া ট্রেলার। গলির মুখে দাঁড়ায়। লেবারেরা
পিঠে তুলে রেশনের দোকানে ঢোকায়। রাতে, সেই লেবারেরাই আবার দোকানটার উঠোনের দিকের দরজাটা
খোলে। সরকারি বস্তা খুলে আনাজগুলো অন্য বস্তায় ভরে। তারপর কোনাকুনি উল্টো দিকে মুদির
দোকানে ঢুকিয়ে দেয়। মুদির দোকানের সামনে মানাইটাঁড়ের রাস্তা।
রেশনের দোকানের পর
সে-গলির শেষ ঘর। তার দরজা গলিতে নয়। বস্তুতঃ রেশন দোকানের দরজা ছাড়া আর কোনো ঘরের দরজাই
ঐ গলিতে নয়। শেষ বা কোনার ঘরটা মলয়দের মেসবাড়ির প্রথম ঘর। বাইরের দরজা খোলে আড়াআড়ি
আরেকটা গলিতে। তারপর মেসবাড়ির আরেকটা ঘর। গলির দিকে শুধুই জানলা; দরজা খোলে ভিতরে – ছোট্টো উঠোনে। বাঁদিকে, পায়খানা, স্নানঘর
আর ডানদিকে রান্নার জায়গা। উঠোনের অপর প্রান্তে দরজাটা ভিতরের বড়ো উঠোনে খোলে।
মলয়েরই উদ্যোগে শুরু
হয়েছে এই মেসবাড়ি। পাটনায় সে দেখেছে রথীনদা, অলকদাদের মেসের জীবন, পুরোনো কলকাতার বিষয়ে
বিভিন্ন লেখায় পড়েছে, একটা ইচ্ছে ধরেছিল যে একসঙ্গে যখন এতগুলো ছেলে নানান জায়গা থেকে
এসেছি, একসঙ্গে মেস করে থাকব। রোজ সন্ধ্যায় খান্নাজির বাড়িতে যে রামির আড্ডা বসত এক-দেড়
ঘন্টা, সেখানেই কথাটা পেড়েছিল। সবাই আলাদা আলাদা মাসির বাড়িতে, কাকার বাড়িতে আছি কেন,
একসঙ্গে মেস করে থাকলেই তো হয়। এমন কিছু পয়সা লাগবে না, শেয়ার করলে। আর কারোর গলগ্রহ
হয়েও থাকতে হবে না। খান্নাজিও সায় দিয়েছিলেন।
সাতজনের মধ্যে তিনজনের
পক্ষে আসা সম্ভবই ছিল না, একজন ব্রজভূষণ, ভুমিহার আর ভিন্ন সংগঠনের সদস্য, একজন শিউলোচনজি
পরিবার নিয়েই চাকরিতে এসেছে – গোমো-লাইনের ধারে দোতলায় থাকে, আর আরেকজন রামবলীজি। মলয় নিজে বাদে
বাকি তিনজন, নবল গোরক্কা মানে ফর্সা নবল, নবল করিয়ক্কা মানে কালো নবল আর চন্দু। তিনজনেই
হীরাপুর আর সরাইডেলার আত্মীয়ের বাড়ি ছেড়ে চলে এল মেসে থাকতে। তিনজনই অবিবাহিত। এবং
তিনজনই কায়স্থ, লালাজি। সে যাহোক, এখন দিব্যি কাটছে সকাল সন্ধ্যে আর রাতগুলো।
মাসের প্রথম দিকে
পকেটে পয়সা থাকে। তখন আর ভাতরুটির দোকান না। চারজনেই চলে যায় বার-রেস্টুরেন্টে। ধানবাদেই,
চঞ্চনির বাড়ি থেকে একটু এগিয়ে পানিটঙ্কির কাছে, আর নয়তো সোজা ঝরিয়ায়। আগে থেকে ঠিক
থাকলে কখনো একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ব্রিজের নিচে রিগ্যালে বা ঝরিয়ার হলটায় গিয়ে সিনেমা
দেখে। কিন্তু সিনেমা দেখা হোক বা না হোক, মাসের প্রথমে চারজনেই মিলে তন্দুরি রুটি,
মাংস আর বিয়ার সাবাড় করে। হুইস্কিও চলে তবে কম। কেননা চন্দু খায় না।
মলয় ছাড়া আর কেউই
ইংরেজি সিনেমার ভক্ত নয়। তাই রেলওয়ে ক্লাবে জুডিথ, বা এনকাউন্টার্স অফ দ্য থার্ড কাইন্ড
এলে দেখতে একাই যেতে হয়। আবার সে বাদে কেউ বাঙালিও নয়। তাই রেলওয়ে ইন্সটিট্যুটে বাংলা
সিনেমা দেখতে হলেও সেই একা। রেলওয়ে ইন্সটিট্যুটটা স্টেশনের এপারে। যে রুটির দোকানে
রাতে যায়, সে রাস্তাতেই, ইন্ডিয়ান অয়েলের ডিপো ছাড়িয়ে আরেকটু যেতে হয়। স্বাধীনতার আগে,
ইন্সটিট্যুটটা ছিল রেলের ভারতীয় আধিকারিকদের জন্য আর ওপারের রেলওয়ে ক্লাবটা ইওরোপীয়
আধিকারিকদের জন্য।
এসবেরই মাঝে একদিন
খবর ছড়িয়ে পড়ল জয়প্রকাশ নারায়ণ আসছেন ধানবাদে। সম্পূর্ণ ক্রান্তির আহ্বান নিয়ে। যদিও
মলয় তখনো স্পষ্ট কোনো রাজনীতির মানুষ হয়ে ওঠে নি। ছাত্র আন্দোলনেও কখনো থাকে নি। সাহিত্যই
তার সবচেয়ে ভালো লাগার জায়গা। তবু পাটনা ছাড়ার সময় একটা মোটামুটি ধারণা নিয়ে ধানবাদে
এসেছিল। উনসত্তর থেকে তিয়াত্তরে সে কলেজজীবন থেকে চাকরিজীবনে এসেছে। কংগ্রেস সরকারের
বিরুদ্ধে সংযুক্ত বিধায়ক দল গঠন, পাটনার রাস্তায় ছাত্র-যুবদের হাঙ্গামা, মহামায়াবাবুর
সরকার, তারপর বাংলাদেশ যুদ্ধ, ওদিকে দিল্লিতেও অস্থিরতা …! পাড়ার দাদাদের মধ্যে যারা তার প্রিয় তারাও
মোটামুটি বামপন্থী! তার সমঝদারি একটা ব্যাপারে একরোখা হয়ে উঠেছিল যে সাহিত্যে রাজনীতি
বাদ যায় না! নিজের লেখালিখিতেও ঐ জায়গাটা খুঁজতে চাইত। সেসব নিয়ে তর্কও করত আড্ডাগুলোয়।
ব্যাঙ্কে বা মেসে
বা খান্নাজির আড্ডায় স্পষ্ট বক্তব্য রাখতে শুরু করল যে যদিও জেপি-র আন্দোলনের সবকিছু
সমর্থন করা হয়তো যায় না (সবকিছু যে সমর্থন করছে না সেটা আগেই জানিয়ে দেওয়া বস্তুতঃ
নিজেকে বামপন্থী জাহির করার একটা ঔদ্ধত্য) – “একটা স্বতঃস্ফূর্ত
আন্দোলন ছক মেনেই এগোবে এমন তো কোনো কথা নেই! তা’বলে আন্দোলনটার বিরুদ্ধে যাওয়া চলে না। জনতার আন্দোলন, সঙ্গে
থাকতেই হবে।” কংগ্রেস সরকার,
স্বৈরাচার, দুর্নীতি, … বুঝুক না বুঝুক
আউড়ে চলল।
সরকারের বিরুদ্ধে
আন্দোলনের সমর্থনে থাকার একটা যুব-প্রবণতা সেই বোধহয় ১৯৬৮-৬৯ সালে, দয়ানন্দ স্কুলের
মাঠে বিনোদানন্দ ঝায়ের (নাকি ভাগবত ঝা আজাদ, মনে নেই) সভা থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
আগামি পাঁচ বছরে হাওয়া উত্তরোত্তর গরম হয়ে উঠেছে। চুয়াত্তরের ফেব্রুয়ারিতে সকালের বাসের
ছাতে বসে পাটনা থেকে ধানবাদ আসতে আসতে, সহযাত্রীদের সঙ্গেও এসব বিষয় নিয়েই সে চর্চা
করেছে। কেননা তখন খবরের কাগজ খুললেই গুজরাত আর বিহারের খবর।
ধানবাদে আসার তিন
মাসের মধ্যে শুরু হয়ে গেল রেল হড়তাল। সে হড়তালকে অসফল প্রমাণ করতে সকাল থেকে রাত অব্দি
ইয়ার্ডে খালি ইঞ্জিন দৌড় করানোর হাস্যকর চেষ্টা, মিশ্রাজি রেলমন্ত্রী বলে সবকয়টি ব্রাহ্মণ
টিটিই-র সময় মত সাদা শার্ট কালো কোট পরে ডিউটিতে যাওয়া, ‘অরে ঝাজি, কহাঁ চলে’ জিজ্ঞেস করলে মুখ লুকিয়ে নেওয়া, রেলকলোনি
থেকে পুরুষ কর্মচারীদের পালিয়ে যাওয়া, রোজ তাদের খোঁজে সাদাপোষাকে ইন্টেলিজেন্সের হামলা,
কাউকে পেলে টেনে নিয়ে গিয়ে নির্য্যাতনের খবর … অনেক কিছু রোজকার আসা-যাওয়ার পথে সবার মত মলয়ও দেখেছে এবং আরো অনেক
কিছু পথচারীদের আলোচনায় শুনেছে।
………………
জেপির জনসভা হল পোলো
গ্রাউন্ডে। আর সেই জনসভায় মাঠে বসে নিজের কানে মলয় শুনল যে “শ্রমিক আর বিপ্লবের নেতা নয়, ছাত্ররাই আজ বিশ্বের
সমস্ত পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিচ্ছে, সম্পূর্ণ ক্রান্তিতেও তারাই নেতৃত্ব দেবে!” – শুনে মেজাজটা খিঁচড়ে গেল তার। মঞ্চ থেকে জেপির তির্যক মন্তব্যও
ছুটে এল, “ধানবাদ তো কয়লাঞ্চল।
লক্ষ লক্ষ কয়লা শ্রমিকদের বাস। কোথায়? আজকের এই জনসভায় কয়লাশ্রমিকরা নেই কেন?” পরের রোববারেই চলে গেল কলকাতা। পাটনা থেকে
আসার সময় নিজের কোনো বই সঙ্গে করে নিয়ে আসে নি। কে জানে কোথায় থাকবে! কতটুকু জায়গা
পাবে। তারপর বাসজার্নি। জিনিষই বা কত নেবে!
মাইনের কিছু টাকা
হাতে ছিল। কোলফিল্ডে কোলকাতায় পৌঁছে সোজা কলেজস্ট্রীট। এনবিএ থেকে লেনিনের সিলেক্টেড
কিনল হিন্দিতে, চার ভল্যুমে। আর মার্ক্স-এঙ্গেলস সিলেক্টেড কিনল বাংলায়, দুই ভল্যুমে।
মনের ভাবটা ছিল, যেহেতু সে হিন্দিভাষীদের মধ্যে বাস করে আর লেনিন অন্যান্যদের সঙ্গে
তর্ক করার জন্য, তাই হিন্দি ভল্যুম। আর, নিজে যেহেতু সে বাঙালি, আর মার্ক্স-এঙ্গেলস
নিজের জন্য, তাই বাংলা ভল্যুম। এই ফারাকটা যে কত হাস্যকর, সেটা তখন সে বোঝে নি। অনেক
পরে বুঝেছিল। … কবিতার বই দেখল
অনেক, কিন্তু কিনল না। পাটনায় আছেই। এবার গেলে নিয়ে আসবে। আর এখন, লেনিন জরুরি। বিপ্লবে
শ্রমিকশ্রেণী নেতৃত্ব দেবে না? এমন প্রতিক্রিয়াশীল কথা তো কখনো শুনি নি। জেপি বলতেই
পারতেন, শ্রমিক-কৃষকের সঙ্গে অগ্রণী ভূমিকায় আজ ছাত্ররাও থাকবে! কিন্তু কী বললেন? …
অবশ্য এটা ঠিক যে
শ্রমিক-কৃষক সংগঠনের কোনো ডাক এই সম্পূর্ণ ক্রান্তিকে সমর্থন করার ব্যাপারে মলয় নিজেও
এখনও শোনে নি। হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার আর সিপিআইএম জেপির আন্দোলনের সঙ্গে
থাকার কথা জানিয়েছে, নারায়ণদা বলছিলেন। রায়বাবুও পুরোপুরি সমর্থনে আছেন। ওদিকে বিহারে
তৈরি হয়েছে ছাত্র-যুবা সংঘর্ষ বাহিনী। গুজরাটে ছাত্রযুবরা সরকার ফেলেছে। … কলকাতা থেকে ফিরে এসেই মলয় মেসের বিছানায়
শুয়ে পড়তে শুরু করে দিল। কী পড়বে? ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ পাটনায় পড়েছে কিছুটা। ব্যাঙ্কে চাকরি করে। সোজা শুরু করে দিল, ‘সাম্রাজ্যবাদঃ পূঁজিবাদের চরম পর্যায়’। জানলার তাকে সাজিয়ে রাখল বইগুলো। যেমন রামবলীজির
শূদ্রত্বের পরিচয়ের রাজনীতি, প্রতিরোধী অস্ত্র তাদের মেসে এসে নিচে বসা, হাত পাতা,
নিজের জাতের সঙ্গে থাকা, মেসের ঘরে মলয়ের বামপন্থার পরিচয়ের রাজনীতির সংকেত আর প্রতিরোধী
অস্ত্র হল, জানলার তাকে সাজিয়ে রাখা মার্ক্স-এঙ্গেলস আর লেনিনের বই।
যদিও এসবে মেসের
বাকি তিনজন বা অফিসের অন্যান্য সহকর্মীরা বিশেষ কৌতূহলী হল না। বরং, বাঙালি, বামপন্থী
হবেই, এ ধরণের একটু সমীহের দূরত্ব অর্জন করল। বস্তুতঃ তার নিজেরও জীবন বিশেষ প্রভাবিত
হল না। এমন নয় যে কিছুদিনের মধ্যে বইগুলো পড়ে শেষ করল। শুধু সাহিত্যিক ঝোঁকে একটা আশাবাদ
আনার জেদ এল। আরো বেশি করে মানুষের কথা লিখতে হবে, সংগ্রামের কথা লিখতে হবে, এই সব।
কিন্তু প্রবাসে চাকরি জীবন তো একই ঘটনাপ্রবাহের অভিঘাতে চলে না। সেদিন কাউন্টারে মাথা
নামিয়ে কাজ করছে, হঠাৎ সামনে থেকে ডাক শুনতে পেল, “মিঠু!” … কে? এই নামে তো
এখানকার কেউ তাকে ডাকবে না। মাথা উঠিয়ে চমকে গেল। সুপ্রতিমদা! এখানে?
-
কেমন আছো? সারপ্রাইজ দিলাম তো? বেরুতে পারবে?
-
হ্যাঁ হ্যাঁ। এ চন্দু, জরা দেখ লেনা ভাই। মেরে
বহনোই সাহব আয়ে হুয়ে হ্যঁয়।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলাম, “এখানে? তোমার অফিসের কোনো কাজে?”
-
আমি এখন বোকারোয় পোস্টেড।
সেদিন আবার একটা
নতুন জামা, প্যান্ট পরেছে। অনেকদিন ধরে ইচ্ছে ছিল শিফনের ছিটের একটা শার্ট করাবে। সেই
শার্ট আর বিশেষ ডিজাইনের প্যান্ট। দর্জিকে বলে হাঁটুর কাছে পকেট করিয়ে, সেই প্যান্টের
কাপড়েরই একটা টুকরোর ওপর ক্রোশিয়েতে ফুলের ছবি আর ইংরেজিতে একটা লাইন লিখিয়েছে। পাটনায়
গিয়ে, মাকে আর বোনকে দিয়ে লিখিয়ে গোড়ালির কাছে সেলাই করিয়েছে। দাড়িটাও এখন ফ্রেঞ্চকাট।
কাল বিকেলে ঐ জামা-প্যান্ট-গগলসে বন্ধুদের সঙ্গে একটা গ্রুপ ছবিও তুলিয়েছে স্টুডিওয়।
তাই সুবীরদার সামনে
বেরুতে লজ্জা করছিল। কিন্তু সুবীরদা দেখলেনও না। সোজা নেমে ব্যাঙ্কমোড় হয়ে ঝরিয়ার রাস্তায়
ঢুকে ডানদিকের গলিতে একটা ছোট্ট সাইনবোর্ডের দিকে এগোলেন – ট্রিঙ্কা’জ। তখনও অব্দি সে কখনো দেখে নি রেস্টুরেন্টটা। দেখে মনে হল বাঃ,
বেশ ছিমছাম তো! সুপ্রতিমদা অর্ডার দিলেন সেদ্ধ ঢ্যাঁড়স, স্মোকড বা ভাপা মাছ আর মাইল্ড
বিয়ার, হার্লেম। বাঃ, কম্বিনেশনটা খেতেও দারুণ!
তারপর থেকে বেশ কয়েকমাস
অব্দি মাঝেমধ্যেই শনিবারের বিকেলে বা রোববার সকালে ধানবাদ-চন্দ্রপুরা প্যাসেঞ্জার ধরে
বোকারো যাওয়া আর সোমবার ভোরবেলা রওনা দিয়ে ফিরে আসা রুটিন হয়ে গেল কয়েক মাস অব্দি।
সেক্টর ওয়ানে রামমন্দিরের পিছনের কোয়ার্টারটায় জ্যাঠতুতো বোন মিনতি আর সুপ্রতিমদার
সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া একটা দারুণ লোভনীয় সফর হয়ে উঠল। একদিকে বুর্জোয়া এলিটিজম! – একজিকিউটিভ কোয়ার্টারে রাতে লনে বসে ডিমসেদ্ধ,
হোয়াইট হর্স হুইস্কি, গল্প, এবং অফুরান একটা দুপুর …। আর অন্য দিকে ভারতবর্ষ – ধানবাদ-চন্দ্রপুরা প্যাসেঞ্জারের সাধারণ যাত্রী, গরীব মানুষ,
তাদের কথোপকথন, বাংলা-সাঁওতালি-খোরঠা-হিন্দি ভাষার কলধ্বনি, ব্যাটারিবক্সের জায়গাটায়
বসে কয়লাচোর নারী আর তার বাচ্চার সফর, পাথরের কিটিকিটি বাজিয়ে বাচ্চা ছেলেদের আর অন্যান্য
ভিখিরিদের গান …। সপ্তাহে দেড় দিন
যেন একই সঙ্গে দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন দুনিয়ার সফর সেরে আসত।
…………………
আজ আবার কাউন্টারে
কাজ করছে, গার্ড এসে খবর দিল, বাইরে কেউ ডাকছে। বাইরে বারান্দায় গিয়ে দেখল। নাঃ, গেটে
তো কেউ নেই! গার্ড উল্টো দিকে তাকাতে বলল। আসলে বিল্ডিংএ দুটো সিঁড়ি। দুটোই একটা টানা
বারান্দায় উঠেছে। কিন্তু যেহেতু সুরক্ষার ব্যাপার, ব্যাঙ্কের এক্তিয়ারে আসা অংশটার
দুদিকেই গ্রিল। একদিকেরটা স্থায়ীভাবে বন্ধ থাকে। সেদিকে ওঠা সিঁড়িটা অন্য একটি ব্যাঙ্ক
আর ইনশিওরেন্স অফিসে যাওয়ার পথ। সেদিকেই দেখল নারায়ণদা দাঁড়িয়ে হাসছেন।
-
শনিবার তো, ছুটি হবে না?
-
আরেকটু পরে।
-
ঠিক আছে। ছুটি হলে চলে এস, আমি এখানে আছি।
এখানে আছি মানে ইনশিওরেন্সে, আশিস ভঞ্জের কাছে।
ছেলেটা আর্টিস্ট, ভালো ছবি আঁকে। ফিরে এসে কাউন্টারের কাজ মিটিয়ে সহকর্মীদের বলে বেরোল।
এদিকের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে মার্কেটটা পেরিয়ে ওদিকের সিঁড়ি দিয়ে উঠল। আশিস বসালো।
“চা খাবেন তো? এ্যাই,
আরেকটা চা।” চাওয়ালা হাতে কেটলি
নিয়ে ঘুরছিলই। দিয়ে গেল।
“আগামীকাল সাহিত্যকার সঙ্ঘের সভা, মনে আছে তো?” নারায়ণদা হাতে একটা টাইপকরা বিজ্ঞপ্তি-সহ-আমন্ত্রণপত্র
দিতে দিতে বললেন। “এখন একটু বেরোব,
দু’চার জায়গায় খবর দেওয়া
বাকি আছে। যাবে আমার সঙ্গে?”
পাটনায় থাকাকালীন এই নারায়ণদাই চিঠিপত্রে তার
সঙ্গে ধানবাদ নামের অপরিচিত শহরটার একমাত্র যোগসূত্র ছিলেন। ধানবাদে রাতে পৌঁছে পরের
দিন সকালেই গিয়েছিল নারায়ণদার বাড়ি। নারায়ণদার সঙ্গে সঙ্গে থেকেই এই শহরে সে নতুন করে
সাহিত্যচর্চা ধরার চেষ্টা করছে। কত মানুষের সঙ্গে তিনি আলাপ করিয়ে দেন, যখনি তাঁর সঙ্গে
সে বেরোয়! …পুরানা বাজার হয়ে
নারায়ণদা ইন্ডিয়ান অয়েলের রাস্তাটার দিকে বাঁক নিলেন।
-
এদিকে কোথায়?
- চলোই না।
গিয়ে পৌঁছোলেন প্রায়
জনশূন্য স্থানে একটা পানের দোকানের গুমটিতে। আশেপাশে আর একটাও দোকানঘর নেই। হ্যাঁ,
রাস্তা দিয়ে যাওয়া মানুষেরা আছে। পিছনে অদূরে ইন্ডিয়ান অয়েলের ক্যাম্পাস, তার কর্মচারিরা
টিফিনে নিশ্চয়ই বেরোয়। পানের দোকানে বসে থাকা ছোটোখাটো বয়স্ক মানুষটাকে নমস্কার করলেন
নারায়ণদা। তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে বললেন, “এ হল ধানবাদে আসা নতুন কবি পানুরিদা, মলয় দাস। আর মলয়, ইনি হলেন
শ্রীনিবাস পানুরি।” তার নমস্কারে ভদ্রলোক
মাথা নুইয়ে হাত জড়ো করলেন। “ইনি খোরঠা ভাষার নামকরা কবি, আর জানো, সংস্কৃত ‘মেঘদূত’ অনুবাদ করেছেন খোরঠা ভাষায়!” খোরঠা ভাষা সে জানে না, বস্তুতঃ রোজকার চলার পথে শোনেও নি সেভাবে।
তাই যতটা সম্ভ্রমের সঙ্গে কথাটা গ্রহণ করা উচিৎ, বোধহয় করল না। পরে নারায়ণদাকে জিজ্ঞেস
করল ভদ্রলোক পানের দোকান কেন চালান। “ঐ পানের দোকানটাই তো ওনার সম্বল! ওতেই পরিবারের খরচ চলে!”
পুরানা বাজার হয়ে
দিনের বেলা বাড়ি ফেরার থাকলে নারায়ণদা কোলিয়ারি কামগার ইউনিয়নের দপ্তরে ঢুঁ মারবেনই।
আজও তার ব্যত্যয় হল না। এখানেই, ধানবাদে আসার শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই নারায়ণদা রায়বাবুর,
মানে এ. কে. রায়ের সঙ্গে মলয়ের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ রায়বাবু ছিলেন না।
বসে থাকা কমরেডরা জানালো কাল আসবেন। “চলো, এক কাপ চা খেয়ে তারপর যেও”, বলে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। রাতে ধানবাদে পৌঁছোনোর পরের সকালে
এখানেই নারায়ণদার মায়ের হাতে ভাত খেয়েছিল। আজ নারায়ণদা ওঘরে বসে যতক্ষণ ভাত খেলেন,
সে বাইরের ঘরে নারায়ণদার বিছানায় বসে চা খেল আর গোপাল হালদারের ‘সংস্কৃতির রূপান্তর’এর পাতা ওল্টালো।
পরের দিন ধানবাদ
সাহিত্যকার সঙ্ঘের সভা হল মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের হলঘরটায়। নারায়ণদার সুবাদে অনেকেই
চেনা মুখ। সবাই হিন্দি, উর্দু, খোরঠা, সাঁওতালি লেখালিখির দুনিয়ার। বাংলার বলতে সে
আর নারায়ণদা। ত্রিদিববাবু হলে আরেকজন হতেন। কিন্তু তিনি এসবে আসেন না। আরো অনেকে নিশ্চয়ই
আসেন না। এই বহুভাষী ব্যাপারটা নিয়ে নারায়ণদাকেই সে দেখে, এত উৎসাহিত থাকেন। কবিতার
ভাববিনিময়ের থেকে বেশি, একটা সৌভ্রাতৃত্ব যে প্রতিষ্ঠিত হয় সেটা বোঝে। কাজটাকে শ্রদ্ধা
করে, সব সভায় যায়, ঝরিয়াতে, বড় কবি সম্মেলনেও গিয়েছে একবার।
কিন্তু বসে বসে অতক্ষণ
আজেবাজে কবিতা, আগ্নেয়াস্ত্রের মত ছন্দবাজি শোনা … অসম্ভব। নারায়ণদার মুখের দিকে তাকায় আর বসে থাকে। নিজের ডাক
এলে ফাঁপরে পড়ে, কী পড়ব! সত্যিই তো, কী পড়বে? পাটনায় থাকতে থাকতে, সেখানকার রাজনৈতিক,
সামাজিক বাতাবরণে একটা কাব্যভাষা আয়ত্ত করছিল। শ্লেষাত্মক স্টেটমেন্ট, অবসাদ, মৃত্যুচিন্তা,
স্বপ্নের উদ্ঘোষ, গীতিময়তা, স্টাইলাইজেশন … নিজের ভিতরের মেজাজটাকে খুঁজতে চেষ্টা করছিল। আবার সেসব কাটিয়ে
বেরোবারও একটা চেষ্টাও ছিল। বামপন্থী ঝোঁকটা বার বার ধাক্কা দিচ্ছিল ঈষৎ উচ্চগ্রামের
একটা কন্ঠস্বরে যাওয়ার জন্য।
যেমন মায়াকভস্কি!
… যেমন সুকান্ত! … যেমন নাজিম! … কিন্তু মেকি হয়ে পড়ছিল। তারপর দেখা হল হিন্দির
সেই কবির সঙ্গে। কবিতার হোলটাইমার! ম্যাট্রিকের পরেই লেখাপড়া ছেড়ে কবিতা আর রাজনীতিতে
আছেন। কী অসাধারণ কন্ঠস্বর তাঁর কবিতায়! মলয় ভাবত ‘জাতীয় কন্ঠস্বর’ ফেনোমেননটা রবিঠাকুর, নজরুলের যুগের সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে। ‘জনতার কন্ঠস্বর’ আর একজন কেউ নয়। বিভিন্ন ভাষার কবিদের সমষ্টি।
হিন্দির সেই কবির, সারা ভারতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা দীর্ঘ কবিতাটা পড়তে পড়তে মনে হল, “এই তো ম্যানিফেস্টো! জনগণের কবিতার! … আমি কি পারব এমন লিখতে?”
ধানবাদে এসে শুরু
করা নিজের নোটবুকটা খুলে দেখে মলয়, বার বার। প্রথমেই পাতার পর পাতা ‘আমার কবিতা’ নামে একটা দীর্ঘ অসমাপ্ত কবিতা। সেই ধরণের উদ্ঘোষক কন্ঠস্বর
হওয়ার কী অক্ষম, নির্জীব চেষ্টা! নকলও নয়। তারও অধম। পার্স্পেক্টিভটাই হারিয়ে গেছে।
কেননা, ধানবাদের জীবনে সে এখনো বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা অর্জন করে নি। এখানকার সমাজ, রাজনীতির
সঙ্গে যে সংশ্লেষটা জরুরি সেটা এখনো ঘটে নি। তার ভাষা আরো হারিয়ে যাচ্ছে এই বহুভাষী
কবিতার জগতে এসে। কলকাতায় যায় মাঝে মাঝে। পত্রপত্রিকা নিয়ে আসি। কিন্তু তা আবার কলকাতার
বা বাংলার জলমাটিমানুষের বাতাবরণ। তার ওপর, কলকাতা মেট্রোপলিস হওয়ায়, মহানগরের একটা
সেরিব্রাল আধিপত্য। … আরো গোঁ চাপে মাথায়।
“নিজের স্থানিকতা
ছাড়ব না কিছুতেই। বিহারের মানুষ। লালদীঘিতে প্রেমের ফুল ফোটাবো না …।”
জুলাইয়ে দুদিন ছুটি
ছিল। রোববার নিয়ে তিন দিন। ভেবেই ছিল ফাঁক পেলে দেওঘর ছুটবে। শ্যামলদার সঙ্গে দেখা
করতেই হবে। অঝোর বৃষ্টির মধ্যে দেওঘরে নেমে ক্যাস্টর টাউনের পুরোনো বড় লাল বাড়িটার
গেটের সামনে পৌঁছোলো। বাগানের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। রাস্তার ওপারে তিন সিঁড়ি উঠে বারান্দা।
শ্যামলদা ডাকছেন, “চলে এস!” ওদিকে শ্যামলদার মা দাঁড়িয়ে। কী বাড়ি! এই
সব শহরেই এধরণের বাড়ি ভাড়ায় পাওয়া যায়। কথাবার্তা, আলোচনা, গান, কবিতা, খাওয়াদাওয়া,
নন্দন পাহাড়, তপোবন, সারাঠে ঘোরাঘুরিতে দুটো দিন কেটে গেল। রাতে পৌঁছোলেন বাসুদেবজি।
উত্তর বিহারে কলেজে শিক্ষক। বললেন, “কাল তো শ্যামলদা থাকবেন না, অফিস! চলো আমরা শিমুলতলা ঘুরে আসি।” পরের দুপুরে শিমুলতলা ঘুরে আসা … সব নিয়ে সারা জীবনের সম্পদ হয়ে উঠল দুটো দিন।
নন্দন পাহাড়ে ভাঙা শিশুমূর্তির অবশিষ্ট দুটো শ্বেতপাথরের ছোট্টো পা বেদির ওপর, শিমুলতলায়
রেলকলোনির গেটে সেই মিষ্টি গৃহবধুর মুখে পড়া রোদ আর তাঁর প্রশ্ন, “চারটের ট্রেনটা কি পৌঁছেছে স্টেশনে? বলতে পারবেন?” …
ডাইরি, নোটবুক ভরে
উঠছে শুরু করা কবিতায়, গল্পে এমনকি নাটকে! শেষ আর কোনোটাই হচ্ছে না। কী করতে চায় সে?
পত্রিকাগুলো পড়ে মাথায় নতুন ভুত চাপছে – ছন্দ, মিল …! আনতে গিয়ে কাত হয়ে এলিয়ে পড়ছে ভাষা। তার ওপর মিস্টিসিজ্ম। ধ্যাৎ।
এসব তার জিনিষ না। তবে নারায়ণদা দুটো কবিতা চেয়ে নিয়েছিলেন, দুটোই পাটনায় লেখা। পাটনার
একটি সাহিত্য পত্রিকায় বেরোল। একবার পাটনায় গেলে সেই পত্রিকাটা নিয়ে এল।
………………
ভাদ্রের গরমে আর হয়তো কয়লার ধুলোয় মলয়কে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থায়
পড়তে হয়েছে। কাউকে না বলার মত। বলেও নি কাউকে। মেসের সহকর্মীরা জানে, একটু বিশেষ লেখালিখির
কাজ আছে বলে তাদের সঙ্গে অফিসে যাচ্ছে না, কুড়ি-পঁচিশ মিনিট দেরি করে যাবে, ম্যানেজারকে
বলে দেবে তারা। রান্নার ছেলেটি এই সময় বাজারে যায়, তাই গেছে। তাকে বলেছে, “নিশ্চিন্তে যা, তুই ফিরলে পরেই বেরোব।” আর নিজে! দরজা বন্ধ করে, স্নান সেরে এখন
উঠোনের কড়া রোদে গামছা খুলে উলঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে।
তলপেটের নিচে, বিশেষ
করে ওই না-বলার মতো জায়গাগুলোয় অদ্ভুত ধরণের ফোঁড়া ছড়িয়ে পড়েছে। তার ওপর তেলের মতো
একটা মলমের প্রলেপ দিয়েছে। বাঁহাতে গামছা ধরে আছে আর চোখদুটো সতর্ক, ছাতের দিকে তাকিয়ে
– কারো ছায়ার আভাস
পেলেই, বা কথা শুনলেই গামছাটা গায়ে ফেলবে। পিছনে একটা চেয়ার রাখা। পাঁচ মিনিট পর চেয়ারে
পা গুটিয়ে বসে দুটো জংঘা দুদিকে ছড়িয়ে দেবে, যাতে ভিতর দিকের ফোঁড়াগুলোও রোদ্দুর পায়।
তেলটা শুধু লাগালে হবে না, রোদ্দুরে থাকতে হবে আধঘন্টা, ডাক্তার বলেছে। উঠোন ছাড়া রোদ্দুর
কোথায়? ঘরগুলোয় কি আর রোদ্দুর ঢোকে?
যদি সত্যিই বাড়ির
মালিক সাউজির বাড়ির কেউ ছাতে চলে আসে। কর্মচারি হলে সমস্যা নেই। মেয়েদের কেউ এলেই …! উঁকি মেরে দেখেই হিহি করে হেসে পালিয়ে যাবে!
… আজ অব্দি ভালো করে
মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়েও দেখে নি। সাউজির মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার মত মনের অবস্থাও তার
নয়। মেয়েদের সঙ্গে বিশেষ ভাবসাব করা তার ধাতেও নেই। “নইলে তো পাটনাতেই পটিয়ে ফেলতাম কাউকে। বড় হওয়ার
পাড়ায় কি কম মেয়ে এক সঙ্গে বড় হচ্ছিল?” … অবশ্য ধানবাদে রোজকার
চলাফেরায়, কোথাও কোনো বাড়িতে কোনো মেয়ের সঙ্গে আজ অব্দি তার আলাপ হয় নি। হীরাপুরের
দিকে থাকলে হয়ত হত। বাঙালিদের পাড়া।
“এসব ফোঁড়া কি আর সাধে হয়?” ডাক্তারের কথাটা মনে পড়ায় মনে মনে বলল, “নারীযোগের শাস্তি নয় ডাক্তারসাহেব, নারীবিয়োগের
শাস্তি! সমস্যা তো শুধু ফোঁড়া নয়। জোয়ান শরীর – নিজের হাতে ঐসব জায়গায় প্রলেপ লাগাতে লাগাতে উত্তেজনা আসে। তখন
আরো বিপদ। কেউ দেখে ফেললেও লজ্জা, আর বেশি উত্তেজনা এলে আরেকটা ইচ্ছে, নিজের জন্যও
লজ্জাকর। করাও যায় না কেননা কষ্ট হয়। উত্তেজনা এলে ফোঁড়াগুলোয় টান পড়ে। বুঝছেন? … ব্যথা করে রীতিমত।”
কে জানে কেন ঐসব জায়গায় বড় বড় ফোস্কার মত ফোঁড়া
বেরুনো শুরু হল। অফিসের নিচে মার্কেটে এক ডাক্তার ছিল, আগরওয়াল। সে দেখে রক্ত নিয়ে
পাঠালো রাঁচিতে। রিপোর্ট এলে বলল, “দাদা, আপনার এক্সপোজার হয়নি তো এদিকে?”
- মানে?
- না মানে, জোয়ান বয়স, একা থাকেন, ইচ্ছে টিচ্ছে তো হয়ই। তাই জিজ্ঞেস
করছিলাম, প্রস্টিটিউটের কাছে যাননি তো?
- না, কিন্তু হয়েছেটা কী? (মলয় ভাবল, “দু’একবার মনে হলেও গেলাম না কখনো, আর এখন … ইচ্ছে থাকলেও অসুখ হয় নাকি? মদ খাওয়ার ইচ্ছে
থাকলে লিভার সিরোসিস?”)
-
ব্লাড প্লুরিসি হয়েছে আপনার, আমি ওষুধ দিচ্ছি।
তবে একবার পাটনায় দেখিয়ে নিলে ভালো করবেন।
মনটাকে এক ঝাঁকানিতে
নরকে ফেলে দিল ডাক্তারটা। প্লুরিসি কি ভেনেরাল ডিজিজ? অসুখটা কী তাই জানে না সে। আর
হবেই বা কেন? বেশ্যাবৃত্তি করলে ছেলেদের সিফিলিস, মেয়েদের গনোরিয়া আরো কিসব যেন হয়
শুনেছে। প্লুরিসি তো শোনেও নি। আর বেশ্যা কেন, সেভাবে যাকে সংসর্গ বলে তেমন কোনো নারী্র
সঙ্গই হয় নি তার এখনো পর্য্যন্ত। এই ধানবাদ শহরে আজ অব্দি যেখানে যেখানে গেছে, কাউকে
তেমন পায়ও নি যে ‘মনে ধরেছে কিন্তু
বলতে পারছি না’ বলে মনোকষ্টে আছে।
কোথাও কিছুই নেই, আর তার মধ্যে প্লুরিসি?
সংসর্গ! … হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পড়ল সন্ধ্যায় ব্যাঙ্কমোড়
পেরোতে পেরোতে। যদিও সে-প্রায় তিন-চার বছর আগের। তখন সদ্য বদলেছে শরীর আর মন। রাতে
পেচ্ছাপ করতেই যাচ্ছিল বাথরুমে কিন্তু গায়ে কাপড় ছিল না; উত্তেজিত অবস্থায় ছিল। একটা
সরু বারান্দা পেরিয়ে যেতে হত। ডানদিকের একটা চিলতে ঘরে কাজের মাসি থাকতেন। যথেষ্ট বয়স্ক,
প্রায় বৃদ্ধা। মাসি না বলে দিদাও বলা যায়। চুল সব পাকা। মলয় খেয়ালই করে নি তিনি দরজাটা
একটু ফাঁক করে দাঁড়িয়েছিলেন। বাথরুম থেকে বেরিয়ে তাঁর ঘরের সামনে দিয়ে এগোতেই অন্ধকারে
তিনি খপ করে ধরলেন হাতটা। আর টেনে নিজের ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে নিলেন।
আদর করে জাপটে ধরে
নিজের ওপর শুইয়ে নিলেন তাকে। সেটাই মলয়ের প্রথম বলতে গেলে যৌন সম্ভোগ ছিল। কী করল,
বা উনি কী করালেন কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোথাও তাঁর নরম ভিতরে সে ঝরে গেল। উঠে অধোমুখে
নিজের ঘরে বিছানায় চলে গেল মলয়। তাহলে কি? … নাঃ, এত দিন পর কিছু হয় নাকি? কে জানে! … মা-বাবা অন্য ঘরে শুত। কিছু সন্দেহ করেছিল
কি? পরের দিন মায়ের সঙ্গে কিছু কথাবার্তার পর মহিলা কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু
মলয় নিজেকে বা সেই নারীকে যেমন সেদিনও পারে নি, আজও রাগ বা ঘেন্না করতে পারে না। এমনকি
তার লজ্জাও করে না তেমন। “আমি তো কোনো জোর
খাটাই নি। তিনিও আদর করেই আগ বাড়িয়ে আমার খিদে মিটিয়েছিলেন।” …
পাটনাতেই দেখাতে
হবে। এখানে কাউকে বলা মানে পাঁচ কান হওয়া আর বিব্রত হওয়ার একশেষ। করিয়ক্কা নবল হয়তো
সারা ব্যাঙ্কে কানে কানে ছড়িয়ে দেবে। পাটনার ট্রেনে সে-রাতটা যে কিভাবে কাটল! রিজার্ভেশনের
বালাই কারোরই থাকে না। গোমো গয়া হয়ে ভোরে পাটনা অব্দি সবাই, সিট পেলে সিটে, নইলে গেটের
কাছে কাগজ পেতে বসেই আসা-যাওয়া করে। মলয় ভিতরে ঢোকেই নি রাতে। গয়া থেকে পাটনা, ট্রেনে
ভিড় না থাকা সত্ত্বেও গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আর যে সব গান কখনো গাইতে ইচ্ছে
করে নি, বাবার, মায়ের বা অন্য কারো গলায় শোনা কীর্তনের বা ভজনের স্তিমিত সুরগুলো বিলাপের
মতো সামনের অন্ধকার থেকে উঠে এসেছে আর প্রায় অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছে জেগে উঠেছে ঐ অন্ধকারে
ঝাঁপিয়ে পড়ার। ভাগ্যিস বড়ো কোনো নদী-নালা নেই ঐ পথে। এক জাহানাবাদে নদীখাত আর তারপর
পুনপুনে ছোট্টো নদী। মহানদী, গোদাবরীর মতো বিস্তৃত অন্ধকার জলরাশি থাকলে?
… পাটনায় নতুন অগ্রজসম বন্ধু সেই হিন্দি কবির দাদা ডাক্তার। খুব প্রাণবন্ত
মানুষ, আদ্যন্ত বামপন্থী – জেলে গিয়ে রাজনৈতিক
বন্দীদের হালহকিকত জেনে আসেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করে আসেন নিয়মিত। যদিও তিনি সেভাবে
ডাক্তার হিসেবে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করেন না; একটা প্যাথোলজিকাল ক্লিনিক চালান। মলয়
নিজের বন্ধুকে নিজের সমস্যার কথা বলতেই তিনি দাদাকে দেখাতে বললেন। দাদা দেখলেন। আশ্বস্ত
করলেন – তাঁর একেবারেই মনে
হচ্ছে না প্লুরিসি, মাল্টিপল সামার বয়েলস। “তবু আপনি একবার …” একজন সিনিয়র চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের নাম বললেন। পরের দিন তাঁকেও গিয়ে
দেখালো। তিনিও আশ্বস্ত করলেন, প্লুরিসি নয়, (আগের ডাক্তারের নাম নিয়ে বললেন), ঠিকই
বলেছে ও, মাল্টিপল সামার বয়েলস। তিনটে ওষুধ
লিখে দিলেন। দুটো মলম আর পাউডার টাইপের জিনিষ আর একটা খাওয়ার ট্যাবলেট। কিনে নিয়ে এই
সেদিন ধানবাদে ফিরে এসেছে মলয়।
আর তারপর শুরু হয়েছে
এই – রোজ সকালে চান করে,
খেয়ে, সবাইকে বিদেয় করে, উঠোনে গামছা খুলে দাঁড়িয়ে মলম লাগানো আর তার ওপর রোদ্দুর লাগানো।
আর ভয়ার্ত চোখে ছাতের দিকে চেয়ে থাকা। ঐ হারামজাদা ডাক্তার আগরওয়ালকেই বা আর কী বলত!
মারধর তো আর করা যায় না। একটাই অস্ত্র ছিল তার মোক্ষম, “দাদা, হম তো ব্লাড স্যাম্পল রাঁচি ভেজকর জাঁচ
করায়ে। অব আপ হি বতাইয়ে ক্যা করতে?”
“তবে আগরওয়ালটা ফোঁড়াগুলোকে যৌনরোগ বলেছিল বলেই দুটো অভিজ্ঞতা হল
কিন্তু” উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকতে
থাকতে মলয় ভাবে, “এক, মরার ইচ্ছে কেমন
হয় সেটা জানার, আর, দুই, মরার ইচ্ছে জাগলে কেমন কেমন সব গান মনে পড়ে সেটা বোঝার! বাংলায়
তো আর বড় হই নি। জিভের ডগায় হিন্দি সিনেমার গান, রবীন্দ্রসঙ্গীতও নয়, নজরুল গীতিও নয়,
আধুনিকও নয়। তাই বাবার গাওয়া নামগান, কীর্তনের সুর সে রাতে ট্রেনের বাইরের অন্ধকার
থেকে ছুটে এসে যেভাবে ঝাপটা মারছিল … ওঃ, মরার ইচ্ছে শুধু নতুন গানই নয়, জীবনে ও কবিতায় সঙ্গীতের জায়গাটা
নতুনভাবে ধরিয়ে দিয়ে গেল।
আর?” নিজের সঙ্গেই রসিকতা করল, “ফোঁড়াগুলো হয়েছে বলেই না টানা দশ-বারো দিন ল্যাংটা হয়ে বেলা দশটায়
উঠোনে সানবাথ নিতে পারছিস ইংরেজদের মত, তাও লিটারালি সারা শরীরে! ছাতে নজর রাখার জন্য
বডিটা ঘোরাতে হচ্ছে দু’দিকে!”
- হুঁহ, ভাগ্যিস পেছনে হয় নি। তাহলে উপুড় হয়ে রোদ্দুরের সেঁক দিতে
হত। ছাতে কেউ এল কিনা দেখতেও পেতাম না।
যাহোক, ফোঁড়াগুলো
সেরে গেছে। পুজোয়, ভাইফোঁটায় বাড়িতে কাটিয়ে এসেছে। এখন ডিসেম্বরের শেষের শীত। সবাই
দু’এক দিনের ছুটিতে
বাড়ি গেছে। শুধু মলয় আর চন্দু যায় নি। বড়বাবু খান্নাজির টেবিলের সামনে বসে গল্প করছিল।
অনেকদিন ধরে পারসনাথ ঘোরার ইচ্ছে। চন্দু একটু ঘরকুনো। তবু তাকেই খোঁচালো, চল না কাল
পারসনাথ ঘুরে আসি। খান্নাজি বললেন, হ্যাঁ, যাও, ভালো ঘোরার জায়গা। যাও। যাও। … খান্নাজির উৎসাহদানে ব্যাটা রাজি হল কোনোরকমে।
…………………
বোকামি হোক বা বুদ্ধিমানি, পরদিন সকালে বাস থেকে নামার সময় সামনে
পাহাড়টা দেখে দুজনে নেমে পড়ল। একবার কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেসও করল না, চড়ার রাস্তা এদিক
দিয়ে কিনা। পাহাড়ে চড়তে আসছে সেটাও তো বলে নি। পাহাড়ের নিচে গ্রাম, কেউ যেতেই পারে
কোনো গ্রামে! পরেশনাথের পাহাড়ে চড়ার রাস্তা যে আরো কিছুটা এগিয়ে ডুমরিতে ডানদিকে বাঁক
নিয়ে মধুবন থেকে, সেটা খান্নাজিও বলে দেন নি। বস্তুতঃ তাদের মাথাতেই আসে নি যে যখন
এত বিখ্যাত তীর্থস্থান, নিশ্চয়ই অন্য কোনো দিক থেকে গাড়িতে যাওয়ার রাস্তা থাকবে। এই
অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। গয়ার পর পারসনাথের নামে রেলস্টেশন আছে।
গোবিন্দপুরে যে বাসটা ধরেছিল সে বাসটার কন্ডাক্টর অনেক আগেই ডানদিকে
হাত তুলে দেখালেন, “ওই তো পারসনাথ পাহাড়! এখানেই নামবেন?” … “হ্যাঁ, হ্যাঁ বলে নেমে পড়ল মলয়। চন্দুও পিছু পিছু, “কোথায় জঙ্গলে নামিয়ে দিলি বল তো? এবার কী করব?” … হাইওয়ে ছেড়ে ঝোপঝাড়
জঙ্গল কিছুটা পেরোতেই শুরু হয়ে গেল চড়াই, পাহাড়। পায়ে চলা রাস্তা খুঁজে চড়তে চড়তে,
ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে, পাথর থেকে পাথরে লাফ দিয়ে, ডুমুর গাছের নিচে বিশ্রাম নিয়ে, সত্যিই দুজনে
ঘন্টা দু’একের মধ্যে পৌঁছেও গেল চুড়োয়। দশটায় শুরু করেছিল।
বারো-সোয়া বারোটায় মন্দিরের সামনের সমতল জায়গাটায় পৌঁছে গেল।
আগে আগে মলয়, পিছনে অবিশ্রান্ত বকুনি দিতে দিতে চন্দু। উঠে সবচেয়ে
আগে জলের জায়গা খুঁজে জল খেল। ঘাড়ে, মাথায় জল দিল, তারপর জৈন মন্দিরটার ডান দিক ধরে
পিছনে গিয়ে আন্দাজ মত তাকালো – ঐ রোদ পড়া কুয়াশার
ভিতরেই হবে ধানবাদ। মলয় একটা সিগরেট ধরালো। আদৌ জানার উপায় নেই সত্যিই ঠিক ঐদিকেই ধানবাদ
কিনা। দু’তিনজন জৈন শ্রমণ ঘোরাঘুরি করছিলেন কিন্তু হাতে
সিগরেট নিয়ে তাদেরকে ঘাঁটাতে সাহস হল না। খিদে পেয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুই নেই। বাদামের
খোঁইচাওয়ালা, চাওয়ালা … । এদিক ওদিক ঘুরতে
ঘুরতে উল্টো দিকে গাড়ি পার্ক করার জায়গাটা চোখে পড়ল। তারপরই চওড়া রাস্তা নিচের দিকে
গেছে।
ঘন্টাখানেক পরে ওদিক দিয়েই নামা শুরু করল দুজনে। নামার সময় ঘুরে
ঘুরে নামতে অনেক বেশি সময় লাগল। গাছের ছায়ায় ছায়ায় অন্ধকারও হয়ে আসছিল তাড়াতাড়ি। নিচে
নেমে খোঁজ নিল – না, এখান থেকে কিচ্ছু পাওয়া যাবে না। বড় রাস্তা,
মানে হাইওয়েতে যেতে হবে। এবার শুরু হল চন্দুর পাগলামি। মাটিতে উবু হয়ে বসে হাউমাউ করে
কাঁদতে শুরু করে দিল। “… এ কোথায় নিয়ে এল
এই নির্বোধটা আমায়! আদিবাসীদের গ্রাম, অন্ধকারে আমাদের ওপর তীর চালিয়ে দেবে, মরে যাবো।
…”
যত ওকে বোঝায় মলয়, মানতেই চায় না। উঠবেও না। এক কদম যাবেও না। আবার
কাঁদতে শুরু করল “… শিবু সোরেনের এলাকা … আজ আমরা নির্ঘাত মারা পড়ব।” এবার মলয়ও
একটু সতর্ক হয়ে উঠল। শিবু সোরেন কিম্বদন্তি মানুষ! পাহাড়ে পাহাড়ে কম্যুনিটি ফার্মিং
শেখাচ্ছেন আদিবাসীদের, বিনোদবিহারি মাহাতো আর রায়বাবুর শিষ্য এক সময়কার … এসব নারায়ণদার মুখে শুনেছিল। কিন্তু তাঁর এলাকাই বা কোথায়, কেমন,
সেসব জানত না। কোনো রকমে বকেঝকে, চন্দুকে কখনো টানতে টানতে, কখনো পিছনে ছেড়ে এগিয়ে
যেতে যেতে হাইওয়েতে পৌঁছোল।
দাঁড়িয়ে আছে তো আছে। একটাও বাস যাচ্ছে না। সময় বেশি হয় নি, সন্ধ্যারাত,
কিন্তু অন্ধকার। কোথাও আলো নেই। অনেকক্ষণ পরে একটা ট্রাক দেখা গেল। দৌড়ে রাস্তার মাঝখানে
গিয়ে পাগলের মত হাত নাড়াতে থাকল মলয় ট্রাকটা থামানোর জন্য। যাক, ট্রাকটা গিয়ার বদলাচ্ছে,
টের পেল। থামলে পর, পাশে সরে এসে ট্রাকের ড্রাইভারের জানলায় উঠে কাকুতি মিনতি করল তাদেরকে
নিয়ে নেওয়ার জন্য। ড্রাইভার বলল, গোবিন্দপুর যাবে না। রাজগঞ্জের মোড়ে নামিয়ে দেবে।
তাই সই। পিছনের ডালা বেয়ে তিরপল ঢাকা অন্ধকারে ঢুকল। ট্রাক চলতে
শুরু করল। তখন গায়ে গায়ে ধাক্কায় ঠাহর হল যে তারা একা নয়, আগে থেকে সাত আটজন লেবার
সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাকটা কোথাও সিমেন্ট নামিয়ে আসছে। আর লেবারদের গায়ে সাদা সিমেন্ট
লেগে থাকার কারণে অন্ধকারে চোখ সইলে তাদেরকে ঠাহর করা যাচ্ছে। সিমেন্টের ধুলোয় হাঁচি
আসা শুরু হল। যাক, ভালোয় ভালোয় রাজগঞ্জের মোড়ে নামিয়ে চলে গেল ট্রাকটা। সামনেই একটা
রেস্টুরেন্ট। ঢুকে দু’দুখানা করে বড় মিষ্টি
খেল দুজনে, জল খেল, তারপর চলতি বাস ধরে গোবিন্দপুর, ধানবাদ।
চন্দু নেমে গেল হীরাপুরে। কেঁদেকেটে একেবারে বিপর্য্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
তাই বাধা দিল না মলয়। পুরানা বাজারে খাবার খেয়ে রাত এগারোটায় ফাঁকা মেসবাড়িতে ঢুকল।
রান্নার ছেলেটা, সীতারাম, সেও বাড়ি গেছে। চিৎপাত শুয়ে ঘুমিয়ে রইল দুই-ঘর-চার-বিছানায়
একা। এক পাঁইট রাম থাকলে ভালো হত। বাজারে পেয়েও যেত। কিন্তু ভুলে গেল। তাও তো দুখানা
কম্বলের ওমে শরীরের ঠান্ডাভাব কেটে গেছে তাড়াতাড়ি। এই তো কিছুদিন আগে পাটনা থেকে রাত্রে
ফিরে ঘরে ঢুকে দেখল, কেউ ফেরেনি, আর ইঁদুরের ভয়ে সীতারাম সব তোষক, কম্বলগুলো ট্রাঙ্কে
ঢুকিয়ে তালা মেরে গেছে। খাটের নিচের থেকে বার করল এক গাদা খবরের কাগজ। পর পর দু দিস্তা
সাজিয়ে তৈরি করল কাগজের তোষক, আর দুই দিস্তা সাজিয়ে পা থেকে কোমর আর কোমর থেকে বুক
অব্দি কাগজের লেপ। কাগজেরই মোড়কে ঘুমিয়ে কাটালো রাতভর।
পরের দিন চন্দুর কান্নাকাটির খবরটা চন্দু নিজেই রটিয়ে দিল ব্যাঙ্কে
আর দোষ গেল মলয়ের ওপর। তারই নির্বুদ্ধিতা আর দুঃসাহসে নাকি দুজনে বিপদে পড়েছিল। খান্নাজির
বাড়িতে রামির আড্ডায় চানাচুর চিবোচ্ছিল মলয়। বকবক শুনতে শুনতে ক্ষেপে বলল, “অব কান পকড়তে হ্যঁয়, কহীঁ নহিঁ জায়েঙ্গে তুম্হারে সাথ। এয়সা ভি
কোই ডরপোক হোতা হ্যয়? মিরগিকে বিমার জ্যয়সা ভুকার পারকে রোনে লগা থা রোড পর ব্যয়েঠ
কর সালা!” বলে তাসের হাতটা ফেলে উঠে বেরিয়ে গেল। পরে
খান্নাজি আবার ধরে এনে বসালেন।
পারসনাথে ওঠার সময়
দীর্ঘ গাছগাছালি আর রোদ্দুরের যে মায়াময় রূপ দেখেছিল, একটা পকেট ডাইরিতে সেটা লিখতে
চেষ্টা করল। কিন্তু ছাঁদটা হয়ে গেল নাজিম হিকমতের বিচ্ছিরি নকল। পরে একবার পাটনায় গেল।
অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে সেই অগ্রজ বন্ধু হিন্দি কবিও বললেন নতুন কী লিখেছে, পড়ে শোনাতে।
ডাইরিটা খুলেই থেমে গেল। এটা কী? কিছু হয়েছে? ধ্যাৎ। ডাইরি বন্ধ করে রেখে দিল। শ্যামলদার
কবিতার মেজাজ বলতে গেলে তার গুরুমন্ত্র। কিন্তু সেই ঋজুতা, প্রয়োজনে সঙ্গীতময়তা, প্রয়োজনে
তীব্র বক্রোক্তি, কিছুতেই আনতে পারছে না সে নিজের কলমে।
একটা কাজের কাজ হয়েছে,
নারায়ণদার নতুন সাহিত্যপত্রিকার উদ্যোগটা শুরু হয়ে গেছে। সহকারী হিসেবে তাতে অংশ নিচ্ছে
মলয় পুরোপুরি। নারায়ণদার কথায় লেখা জোগাড় করতে গেল দুবরাজপুর। কোলফিল্ডে অন্ডাল পৌঁছে
সেখান থেকে অন্ডাল-সাঁইথিয়া প্যাসেঞ্জার। দুবরাজপুরে আগে একবার গিয়েছিল। এক বন্ধুর
বিয়েতে দল বেঁধে। মামা-ভাগ্নে পাহাড়েও অনেক মস্তি করেছিল। এবার গেল এক কবির ছোট্টো
শান্ত বাড়িতে। বাইরের বারান্দায় ঠাণ্ডা মাদুরে শুয়ে রইল ঘন্টাখানেক। কবি লেখাটা পুরো
করে দিলেন। তারপর গেল জামশেদপুরে। কয়েকজন কবির কবিতা জোগাড় করতে, বিষ্টুপুরে, কাজরিতে।
তারপর কলকাতায়। প্রেসের কাজ দেখতে। প্রচ্ছদটাও নিজেই বানালো মলয়। নিজের একটা কবিতা
দিল নারায়ণদাকে। … ভাষার এলিয়ে পড়া
ভাবটা কাটাতে পারছে না। কাটাতে গেলে হয়ে উঠছে রুক্ষ। একটা বাঁধুনি দরকার। শব্দের প্রতি
মনোযোগ।
একটা কবি সম্মেলনের
ডাক এসেছে। একটি পত্রিকার তরফ থেকে আয়োজন। আসানসোলে। বিরাট ব্যাপার। কে নেই! মাঝে মধ্যে
মলয়ও ঐ পত্রিকায় লিখেছে। তাই তার জন্যেও কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ। সকাল সকাল পৌঁছে গেল।
পুরোনো পরিচিত এবং বন্ধুবৎসল তিন-চার জনের দল তৈরি হল। কমল চক্রবর্তী ছিলেন, ছিলেন
স্থানীয় বিধু বাউরি। তাদেরই সঙ্গে গেল স্টেশনের ধারে ঝুপড়িতে দিশি খেতে। দিশি খেয়ে
ফিরে গেটের মুখেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা। স্বপ্নেও ভাবে নি এভাবে হাতে ছোঁয়ার
দূরত্বে দেখা হয়ে যাবে। মাথায় দিশি কাজ করছে। অন্যেরা কথা বলল। সে শুধু শুনল।
বিকেলের দিকে তার
নম্বর এল কবিতা পাঠে। সুনীল সামনেই বসে। শক্তি আসেন নি। হল ভর্তি কবি ও শ্রোতা। সদ্য
যুক্তি-তক্কো-গপ্পো বেরিয়েছে। তাই অনন্য রায় এখন স্টার। মনীন্দ্র রায়ও আছেন। কবিতা
পড়ল একটা। সুনীল শুনছিলেন, মাথা নাড়ছিলেন। … সে নিজে অবশ্য দিশির ঘোরের মধ্যে ছিল। হয়তো তাই, কবিতাটা পড়তে পারল।
আড়ষ্ট হয় নি। নাকি, হয়েছিল? সন্ধ্যায় বর্দ্ধমান-গয়া প্যাসেঞ্জারের খালি বেঞ্চটায় সেই
যে শুয়ে ঘুমোল, ঘুম ভাঙল ধানবাদে পৌঁছে। গায়ের খাদির গেরুয়া পাঞ্জাবিটা বেরঙা হওয়ায়
মেরুনে ছুপিয়েছিল। সেটা বেঞ্চের ধুলোয় ধূসর হয়ে গেছে। মেসে সীতারাম খাবার ঢেকে রেখেছিল।
জামাকাপড় ছেড়ে মুখহাতপা ধুয়ে খেয়ে নিল।
পাশের বিছানায় গোরিয়ক্কা
নবল ঘুমিয়ে আছে। ক’দিন পর ওর বিয়ে।
… একটা সিগরেট ধরিয়ে
বালিশের নিচ থেকে নোটবইটা বার করে পাতা উল্টে গেল মলয়। কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে শব্দের
খেলায়! যখন যার কবিতা পড়ে, ব্যস, নকল করতে শুরু করে। … খালি পৃষ্ঠা খুলল। কিছুক্ষণ পরে লিখল, “পারছি না।” তারপর লিখল, “ঋজুতা”। আবার লিখল, “পারছি না”। তারপর পুরোটা ঘিচপিচ করে কেটে, কলম ঘষে ঘষে বুজিয়ে দিল। ফের
লিখল, “তবু লিখতেই হবে”। সেটাকে শুধরে করল, “লিখবই!” নোটবইটা বন্ধ করে আবার বালিশের নিচে রেখে দিল। সামনে তাকের ওপর
জগে খাওয়ার জল রাখা ছিল। জল খেয়ে আলোটা নেভাতে গিয়ে আরেকবার নবলের দিকে তাকালো। ঘুমের
মধ্যে ব্যাটা স্বপ্ন দেখছে, একেবারে ফুলশয্যার …। “টেনে লুঙ্গিটা নামিয়ে
দিই? সালার স্বপ্ন কেটে যাবে! … ধুর! আর ভাল্লাগে না এসব। ঘুমোক বেচারা।” নিজের বিছানায় গিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল
মলয়। ঘুম ছিলই চোখে।
৯.১০.২৫
No comments:
Post a Comment