এদিকে ঝাড়খণ্ডের দুমকা ওদিকে পশ্চিমবঙ্গের সাঁইথিয়া সারাদিন শাটল করা বাসগুলো বলে রাণীশ্বর প্রায় মাঝামাঝি, তবে আদতে সেটা পশ্চিমবঙ্গেরই কাছে। গৌতমবাবু যেখানে থাকেন তার পাঁচ-ছ’ কিলোমিটারের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সীমা। হ্যাঁ, বলা যায় দুমকা-রাণীশ্বরের মাঝে অপরূপা মাসাঞ্জোর থাকায় দূরত্বটা পুষিয়ে যায়। আরো পুষিয়ে দেয় এক পাহাড়ে ইস্কুল থেকে আরেক পাহাড়ে বাড়ি যাওয়া, স্কুলড্রেস-পরা বাচ্চা ও কিশোরীদের কলকলানি – ময়ূরাক্ষীর বাঁধ খোলা থেকে কম নয় তার প্রতিধ্বনি।
এবছরই গৌতমবাবুর
ডাকে রাণীশ্বর গিয়েছিলাম। পাথরায় ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের বিদ্যালয় পরিসরে একুশে ফেব্রুয়ারি
উদযাপনে। আমার জীবনের আটচল্লিশ বছর অব্দি জায়গাটা আপন বিহারেই ছিল, কিন্তু কখনো যাওয়া
হয় নি। যখন গেলাম, ট্রেনটা ভাগলপুর, মন্দার ছেড়ে এগোতেই অনুভূতি হল যে ভিন-প্রদেশে
ঢুকছি, যদিও তার ট্রিগারটা ছিল নিছক পঁচিশ বছর আগে তৈরি রাজনৈতিক-তথ্য, বিহার-ঝাড়খণ্ডের
বিভাজন। নইলে মানুষজনে, ভাষায়, গাছপালায়, পশুতে ও ভূচিত্রে মিশে-মিশে হতে থাকা বদলটা
একই রাগে সুরের বিস্তার। এবং বাংলাও সে-রাগেরই স্বরসমূহের মধ্যে একটি, যেমন অঙ্গিকা,
যেমন সাঁওতালী – হয়তো বা কখনো প্রধান, কখনো অপ্রধান।
রাণীশ্বরের আগেই
একটি স্টপেজে গৌতমবাবু দাঁড়িয়েছিলেন। নেমে তাঁর বাইকে সওয়ার হলাম। এসব রাস্তায় হেলমেট
চেক করার কেউ নেই, না তাঁর না আমার। তাই কানে, চুলে ফুরফুরে বাতাস খেতে খেতে গিয়ে পৌঁছোলাম
একটি রোডসাইড গার্ডেন রেস্তোরাঁয়। মূলতঃ ঢাবা-ই, তবে খাটিয়ায় আসনপিঁড়ি বসে খাওয়ার ব্যবস্থা
নেই, টেবিল-চেয়ার তাই রেস্তোরাঁ। গৌতমবাবুর সৌজন্যে পেট ভরে চিকেন-ভাত খেয়ে আবার রওনা
দিলাম। কিছুক্ষণ পর পৌঁছোলাম রাণীশ্বর। তারপর ভিতরের রাস্তায় নেমে ক্ষেত, মাঠ পেরিয়ে
পাথরার ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের আবাসিক বালক বিদ্যালয়ের হাতায়। কী তার অতিথি-আবাস! মন
ভরে যায়। তেমনই তার পরিচ্ছন্নতা এবং রান্না ও অন্যান্য কাজের দায়িত্বে থাকা ছাত্র ও
স্বামীজিদের নিয়মানুবর্তিতা।
তন্ময় বীর তো আগে
থেকেই বন্ধু। নতুন বন্ধুত্ব হল রতন কুমার ঘোষ-বাবুর সঙ্গে। যে ছেলেটি চায়ের কথা জিজ্ঞেস
করতে এল, চিনিছাড়া কালো চা-য়ের কথা বলতে হাসিমুখে ঘাড় নেড়ে দিব্যি নিয়ে এল একটু পরে,
এবং সেটা মাপমতন ভিজিয়ে তৈরি করা লিকার ছিল। অপরাহ্নের আলোয় পিছনের ব্যালকনিতে বসে
চা খাওয়ার র্যালা তো আর কথায় বোঝানো যাবে না, ছবি ও সেল্ফিতে যেটুকু আসবে তাতেই তুষ্ট
থাকতে হবে।
পুরো পরিসর, বাগান,
পিছনের খেলার মাঠ ঘুরে বেড়িয়ে আর গল্প করতে করতেই সন্ধ্যারাত। রাতে তাড়াতাড়িই খাবার
খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। রতনবাবুই আমার রুমমেট ছিলেন। তাই অনেকক্ষণ কথা হল বিভিন্ন বিষয়ে।
পরের সকালে চা-খেয়ে
কিছুক্ষণ পরিসরের বাইরে-ভিতরে বাগানের কেয়ারিতে ঘোরাঘুরি করে, বাথরুমের কাজ সেরে, জলখাবার
খেতে খেতে গৌতমবাবু চলে এলেন। একটা গাড়িতে করে বিয়ে গেলেন ‘সাঁওতালকাটা পুকুর’ দেখাতে।
জায়গাটার যে আজ মোটামুটি যথাযথ সংরক্ষণ হচ্ছে, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হয়েছে, বাইরে সুন্দর
ফলক লাগানো হয়েছে, হাইওয়ের বিপরীত দিকে গড়া হয়েছে যাত্রী প্রতীক্ষালয় – এসবের পিছনে সমাজ-সচেতন সাংবাদিক গৌতমবাবুর অবদান অনেকখানি।
সেখান থেকে এলাম
ময়ুরাক্ষী নদীর সেতুর ওপর। সেতুর দুপাশে ময়ুরাক্ষীর আঁকাবাঁকা জল আর বিস্তৃত চর। সময়
বেশি ছিল না, তাই নিচে নেমে জলের কাছে যাওয়া বা এক আঁজলা জল তুলে মুখে মাথায় মাখানো,
যা সচরাচর সব নদীর কাছে গেলেই করি, করা হল না।
ফিরে এসে চলে গেলাম
এক দিকে তৈরি হতে থাকা মঞ্চের দিকে। মাঝে বাগান পেরোতে গিয়ে দেখলাম সেবাশ্রমের ভারপ্রাপ্ত
স্বামীজি (সুশিক্ষিত সাঁওতালি মানুষ) দুটি ছেলেকে নিয়ে কিছু করছেন। কাছে গিয়ে দেখলাম
(ও শুনলাম) কোথাও বাগানের ফসলের প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা আছে, তার জন্য টবসুদ্ধু ঝাড়পোঁছ
করে গাড়িতে তোলা হচ্ছে, হয়ে-থাকা বিরাট বিরাট শালগম, বাঁধাকপি এবং অন্যান্য তরিতরকারি।
গাছগাছালির নিচ দিয়ে
অনুষ্ঠান-প্রাঙ্গণের দিকে যেতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি আকর্ষিত করল কাল সন্ধ্যায় প্রথম দেখা
ময়ুরটি। এত ঘরোয়া! দিব্যি আমাদের সামনে গাছের দুই ডালের ফাঁকে পেখম ঝুলিয়ে বসে আছে
– প্রায় গায়ে লাগিয়ে পেখমের নকশা বা সামনে তার
গ্রীবাভঙ্গিমার ছবি তুলছি, তার ভ্রুক্ষেপ নেই।
সভাস্থলে গেলাম।
কিছুক্ষণ পর দেখি আমাদের পিছুপিছু আসল তদারককারীর মত সেও এসে দর্শকদের পিছনেই বসে পড়ল।
গান দিয়ে শুরু হল অনুষ্ঠান। ওমা, অবাক কান্ড, নাচতে শুরু করল ময়ুরটি। কয়েকটি গানের
পর যখন একুশে ফেব্রুয়ারি এবং বাংলাভাষা ইত্যাদি নিয়ে বক্তব্য রাখার পর্য্যায় শুরু হল
ময়ুরটি চড়ে গেল গাছের ডালে এবং সেখান থেকেই মাঝেমধ্যে আমাদের ধমকাতে শুরু করল।
বিকেলে তন্ময় বীর
এবং রতন কুমার ঘোষ মহাশয়কে সাঁইথিয়া স্টেশনে পৌঁছে দিতে যখন গাড়ি এল, আমিও সঙ্গে গেলাম।
একটু পরেই শুরু হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গ। আমি কখনো সাঁইথিয়া যাই নি। এই প্রথম ঢুকলাম শহরটায়।
দোকানপাটে ভরা একটা সরু রাস্তা দিয়ে স্টেশনে পৌঁছোলাম। স্টেশন চত্বরে কোনো চায়ের দোকান
ছিল না। কাজেই একসঙ্গে চা খাওয়ার ইচ্ছেটা আর পুরো হল না। তন্ময় এবং রতনবানু স্টেশনে
ঢুকে গেলেন। তারপর আমি এবং গৌতমবাবু আগেকার রাস্তাটায় হেঁটে ঈষৎ পিছিয়ে গিয়ে একটা চায়ের
দোকান পেলাম।
কোনো নতুন অচেনা
এবং ছোটো শহরে সন্ধ্যা কেমন নিবিড় হয়ে ওঠে! মানুষজন, শিশুরা, সাধারণ কথাবার্তা, টোটোগুলোর
আসাযাওয়া, তাতে বসে থাকা নারীমুখগুলো … মিলেমিশে
আচ্ছন্ন করে দেয়। যাহোক, সেভাবটা কাটিয়ে আবার গাড়িতে ফিরে এলাম। সেরাতটা আশ্রমের অতিথিশালায়
একাই কাটল।
পরের দিন সকালে আশপাশটা
ঘুরে আসতে আসতে সাদিপুরে নিজের বাড়ি থেকে আবার চলে এলেন গৌতমবাবু। স্পোর্টস-শু পরে
একদম তৈরি। আমাকে বাইকে করে রাণীশ্বরের মোড়ে নিয়ে এলেন। হাল্কা বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল।
দুমকাগামী বাস এলে থামানো হল। উঠে পড়লাম।
ম্যাসাঞ্জোর আরো
বেশি করে টানছিল মেঘলা বেলায়। পরে কখনো সময় করে উঠতে পারলে যাবো। তবে আমার মন ভরিয়ে
স্কুলের মেয়েদের এক পাহাড়তলিতে ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে বাস ভরিয়ে দেওয়া আর দূরের আরো কয়েকটি
পাহাড়তলিতে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে বাড়ির পথ ধরা। চারদিকের পাহাড়ে যেন অনুরণিত হচ্ছিল তাদের
কন্ঠস্বর। ফিরে এসে লিখলামঃ
জলের কলতান নিম্নাভিমুখী।
বালিকাদের ঊর্ধ্বাভিমুখী –
বাসের দরজা খুলে
ঢুকে ভেঙে দেয় মাসাঞ্জোরের
পর্যটনী চিত্রলতা।
পাথরে, বনে
প্রতিধ্বনিত হতে শুনি আকাঙ্খার
স্ত্রীলিঙ্গ সাহস।
এক পাহাড়তলিতে ইস্কুল,
আরেকটাতে বাড়ি,
জলজঙ্গলজমির ভবিষ্যৎ
দ্বন্দ্বের তারা দিশারি।
সংযোজন
বিহারের
সুর ঝাড়খন্ডে পৌঁছোবে না ঝাড়খন্ডের সুর বিহারে পৌঁছোবে না তা কি কখনো হয়? দুমকায় পাটনা
থেকে ট্রেনটা এল দুঘন্টা দেরিতে। তারপর প্রস্তুত হয়ে আধঘন্টা পর রওনা দিল। লোয়ার বার্থ
রিজার্ভ করা ছিল। দিনে শোবে কে? তবে লোয়ার বার্থ হলে জানলার ধারের সিটটা পাওয়া যায়।
ম্যাসাঞ্জোরের কাছে বাসে চড়া স্কুলের মেয়েদের কচকচির সুর মাথায় নিয়ে বসেছিলাম। ভাগলপুর
পৌঁছোতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
উঠে
এল এক ঝাঁক ছেলেমেয়ে আর সঙ্গে এলেন তাদের সফরের অভিভাবক এক শিক্ষিকা। সামনের আর ওপরের
বাঙ্কটা ভরে গাদাগাদি তারা বসে পড়ল। এরা একটু বড়, প্লাস-টু অথবা কলেজের। কথায় কথায়
মনে হল অন্য কোনো প্রদেশে দাবার অলিম্পিয়াড বা প্রতিযোগিতা হচ্ছে, তাতেই অংশগ্রহণ করতে
চলেছে। পাটনা থেকে ট্রেন ধরবে রাতে। এদের কচকচির সুরও অন্য রকমের। এবং শিক্ষিকাও নিজের
অবস্থান বজায় রেখে সে কচকচিতে সঙ্গ দিচ্ছিলেন, ঠিক যেমন একটি টিমে হওয়া উচিৎ।
একটু
পরে, সুলতানগঞ্জ স্টেশনে উঠে এলেন ছ’সাতজন গ্রামীণ মহিলা। কুম্ভে যাচ্ছেন। তারা আমার বাঙ্ক এবং সামনের
বাঙ্ক মিলিয়ে বসে পড়লেন। সামনের বাঙ্কে বসা দুই মহিলার একজনের বোধহয় রিজার্ভেশন ছিল।
নইলে বান্ধবীর সঙ্গে জানলার ধারের সিটটা বাগিয়ে বসতে পারতেন না। আর তাদের বসায় আগের
দলটার জায়গা কম পড়ে গেল। তখন এক আশ্চর্য্য ব্যাপার দেখলাম। বিহারের সাধারণ সামাজিক
পরিবেশে সামন্ততান্ত্রিক প্রভাব থাকায় ছেলেমেয়ের সম্পর্ক নিয়ে এত জল ঘোলা করা হয়! অপরাধ
তো নিজের জায়গায় আছেই। সামনের সিটে কিন্তু দেখলাম নিজেদের কচকচি এবং নানাধরণের উদ্ভাবনী
খেলা এক মুহুর্তের জন্যও না থামিয়ে, জায়গার অভাবে মেয়েগুলো দিব্যি ছেলেদের কোলের একপাশে
চেপে বসল। ছেলেগুলোও একটুও বিব্রত হল না, সিঁটোলো না আবার সুযোগও নিল না। দিব্যি বাঁহাত
দিয়ে কোলে বসা মেয়েগুলোর কাঁধ ধরে রাখল যাতে পড়ে না যায় আর ডান হাত ঘুরিয়ে নাচিয়ে কথা
চালিয়ে যেতে থাকল। শিক্ষিকা, ভ্রুক্ষেপ তো দূরের কথা, দেখলেনই না।
গ্রামীণ
মহিলাদের কচকচির সুর আবার অন্য ধরণের। তাদের ভাষা শুনে আমার কবিবন্ধু এবং অগ্রজসম আলোকধন্বার
কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর শৈশবের গ্রামও সুলতানগঞ্জের কাছে, মুঙ্গের জেলায়। তাঁর একটি
কবিতায় তিনি সেই নারীদের কথা বলেছেম যাঁরা তাঁকে শৈশবে স্কুল থেকে ফেরার পথে হাত ধরে
রাস্তা পার করিয়ে দিত। আমার সহযাত্রীদের দেখে সেই নারীদের কথা মনে পড়ল। একা একা মধ্যবয়সী
এক দল নারী কুম্ভমেলা দেখতে বেরিয়েছেন। আমার পাশের জন তো কিছুতেই আমাকে সিটে পা গুটিয়ে
বসার মত জায়গা দেবেন না পণ করেছেন। সমানে আমায় চাপতে চাপতে এমন অবস্থা করেছেন যে এখন
হয় আমি নিজের হাঁটুটা তাঁর হাঁটুর ওপর চাপাই অথবা তিনি নিজের হাঁটুটা আমার হাঁটুর ওপর
চাপান। মুখে কিছু বলছেন না অবশ্য। তারই মধ্যে শুনলাম সামনের জানলার ধারে বসা নারীটির
কথা, “আরো এগিয়েও যেতে পারি। হরিদ্বার, হৃষিকেশ
… এখন তো আর পয়সার কোনো সমস্যা নেই। কার্ড
দেখিয়ে যে কোনো দোকান থেকে হাজারে-নয়শো পেয়ে যাবো। পয়সাও আছে একাউন্টে। বাড়ি ফিরতে
যাবো কেন এত তাড়াতাড়ি?”
পুরোনো
ভাবনাটা মাথায় এল। নারীরা জনসংখ্যার আদ্ধেক। জীবনযাপনের প্রত্যেকটি পথে যদি নারীদের
সংখ্যা সেই অনুপাতে হয়ে যায়, ট্রেনে, বাসে, অফিসে, খেলার মাঠে, গলির ভিতর, দিনে হোক
অথবা রাতে … নারী-পুরুষ সমান সমান … অনেক সমস্যার সমাধান আপনাআপনিই হয়ে
যাবে!
১২.১০.২০২৫/ ১৭.১০.২৫
No comments:
Post a Comment