মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকে মানুষটির মনে, সারা জীবনের ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নগুলো প্রবলভাবে নাড়া দিতে শুরু করল। আর তার ফলে বিশেষ ভাবে জেগে উঠল তিন-চারটে পরিবারের মুখ যেগুলো তার জীবনের বিভিন্ন সময়ের ‘সাহেব’দের পরিবার।
আমাদের সমাজে চতুর্থ
শ্রেণীর বা মুখের কথায় ‘ফোর্থ গ্রেড’এর, অন্যান্য শ্রেণীদের পরিবারে একটা বিশেষ
গুরুত্ব আছে। ফোর্থ গ্রেড, সরকারি চাকরি করলে তো বটেই, বেসরকারি চাকরি করলেও ফোর্থ
গ্রেড। এবং কোনো চাকরি না করে ছোটোখাটো ব্যবসা করলেও ফোর্থ গ্রেড, বিশেষ করে থার্ড,
সেকেন্ড আর ফার্স্ট গ্রেডের পরিবারগুলোর দৈনিক কথাবার্তায়। আর এই ফোর্থ গ্রেডের মানুষেরা
সারা জীবন, চাকরি বা ব্যবসার কাজ ছাড়াও প্রতিদিন, কোনো না কোনো সাহেব/হাকিম/হুজুর/মালিক
পরিবারের ফাইফরমাশ খাটে। সরকারি এবং বেসরকারি চাকুরেদের ক্ষেত্রে ফার্স্ট বা সেকেন্ড
গ্রেডের ‘সাহেব’দের পরিবারে খাটাটা বাধ্যতামূলক হয়। ব্যবসাদার
হলে সামাজিক আনুগত্যের অভিব্যক্তি হয়, যেমন উঁচু বাড়ির লাগোয়া নিচু কুঁড়েতে থাকা গোয়ালা,
ধোপা, এমনকি ছুতোর বা দর্জিও। (সেক্ষেত্রে বরং ডোমেরা মুক্ত কেননা পরম্পরাগতভাবে অচ্ছুৎ
হওয়ার জেরে একমাত্র সাফাইয়ের কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে তাদেরকে ডাকাই হয় না)। তবে বাধ্যতাটাও
ধীরে ধীরে স্বভাবে পরিণত হয় কেননা দু’পয়সা বখশিশের সঙ্গে সঙ্গে প্রচ্ছন্ন আশ্রয় এবং প্রশ্রয় জোটে যেটাকে
সময় মতো কাজে লাগাতে পারলে ছেলের চাকরি, মেয়ের বিয়ে, বাড়ি তোলা ইত্যাদিতে ভাঙিয়ে মদত
পাওয়া যায়।
থার্ড গ্রেডের ‘সাহেব’দের ক্ষেত্রে ব্যাপারটায় সংশ্লেষ বেড়ে যায়। সেখানে বাধ্যতা বলতে
কম থাকে। একটা সূক্ষ্ম পর্দার এধার-ওধার থেকে ‘সাহেব’ এবং সেবক দুজনেই
একে অন্যের ‘প্রায় বাড়ির লোক’ হয়ে ওঠে, এবং সেধরণেরই প্রত্যাশা গড়ে ওঠে
দু’তরফে। আবার সেখানেই
কখনো কখনো পর্দায় ফুটো হয়; পরিণামে কলহ আর কেলেঙ্কারিরও জন্ম হয়।
যাহোক, সেসব ফিল্মী
ব্যাপার। তবে দপ্তরের চাপরাশি আর গৃহভৃত্যের মধ্যেকার অন্যোন্যতা অনেকদিন
ধরেই বর্তমান। দপ্তরের চাপরাশি যেমন গৃহভৃত্যের কাজ করে, যে গৃহভৃত্য হয়ে মনিবের ঘরে
ঢোকে সেও স্বপ্ন দেখে যে হুজুর তাকে দপ্তরে চাপরাশির কাজটা পাইয়ে দেবেন (– সে জানে শুরুটা আজকাল ডেলি ওয়েজ বা লিভ ভ্যাকেন্সি
দিয়েই হয়)।
ইয়াসিন এই কক্ষপথেই
চল্লিশ বছর কাটিয়েছেন। হঠাৎ তাঁকে গলার ক্যান্সার আক্রমণ করেছে এবং তিনি এখন মৃত্যুপথযাত্রী।
অন্যান্য ভালো গৃহভৃত্যের বা গৃহভৃত্যের কাজ করা চাপরাশিদের মতো ইয়াসিনেরও সেসব বাড়িতে
বিশিষ্ট স্থান থাকত যেখানে যেখানে তিনি কাজ করেছেন। প্রায় পরিবারের অঙ্গ হয়ে থাকতেন।
উচ্চবিত্ত পরিবারের
(অর্থাৎ থার্ড গ্রেড নয়, সেকেন্ড বা ফার্স্ট গ্রেড) সদস্যদের বিবিধ প্রকার নিঃসঙ্গতা,
অহঙ্কারের ঠোকাঠুকি এবং নানান মানসিক সমস্যার মাঝে গৃহভৃত্যদের নীরব, অনুশাসিত, কর্মঠ,
অন্তরঙ্গ তবু বিজাতীয় উপস্থিতি মাঝে মাঝে জটিল মানবিক বিভ্রম তৈরি করে।
কর্মক্ষম দিনগুলোয়
ইয়াসিনও বহুবার এই বিভ্রমে পৌঁছেছেন আর কিছুদিনের জন্য সেই অলীক জগতে ঘোরাফেরা করেছেন
যেখানে ধনী আর গরীবে কোনো ভেদ নেই, মনিব বা মনিবানি বা পুরো মনিব পরিবার এবং গৃহভৃত্য
পারস্পরিক সুহৃদ। ইয়াসিন কখনো বন্ধু কখনো অভিভাবক কখনো সন্তান হয়েছেন। তারপর একদিন
অনিবার্যভাবে হঠাৎ সেই জগতটা ছোট্টো কিন্তু রূঢ়তম আঘাতে ভেঙে গেছে। ইয়াসিনও সেই সময়গুলোতে
নিজেকে স্থির রাখতে পারেন নি – নিজেকে প্রতারিত মনে করার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জ্বালায় অসভ্যতাও
করেছেন কখনো কখনো।
মৃত্যুপথযাত্রী ইয়াসিনের
মনে সেই মুহূর্তগুলো ভীড় করে জেগে উঠল। এবং তিনি সিদ্ধান্ত করলেন যে মারা যাওয়ার আগে
ঐ পরিবারগুলোতে যাবেন এবং নিজের তখনকার ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইবেন।
ধীরে ধীরে এই ইচ্ছাটা
তাঁকে আবিষ্ট করে তুলল। যেন কৃত-‘অন্যায়’এর পাপ থেকে মুক্তি
পাওয়ার যথার্থ সম্ভব প্রায়শ্চিত্তপথ তিনি খুঁজে পেয়েছেন আর, দারিদ্র্য নয়, সংসারের
জ্বালাযন্ত্রণা নয়, নিজের অসফলতা বা অক্ষমতাগুলো নয়, ‘অন্যায়’এর এই পাপবোধটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো মানসিক ভার।
দুই ছেলেকে বলাতে তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে
লাগল। স্ত্রীও বুঝলেন না। অসুস্থ শরীর নিয়েও ইয়াসিনকে বার বার উত্তেজিত হতে হল, “তোরা বুঝছিস না! যাঁদের নেমক খেয়েছি আমি, যাঁদের
বদান্যতা ছিল বলে তোরা মানুষ হলি, সংসারটা চলল, ফরিদার বিয়ে হল, তাঁরাই তো আমার জন্য
আল্লার দূত ছিলেন! তাঁদের আমি অপমান করেছি …”
“অপমান করেছ? আর তোমাকে যে যখন ইচ্ছে হল তারা দূর দূর করে তাড়িয়ে
দিল, সেটা মনে পড়ছে না?”
প্রবল ভাবে মাথা নাড়লেন ইয়াসিন, “কিচ্ছু না, কিচ্ছু না! তাঁরা সব বড়ো বড়ো লোক।
আমাকে বাড়ির একজনের মতো রেখেছিলেনি। আল্লা তো আমার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন যে আমি নিজের
হোশ, নিজের ইমান ঠিক রাখতে পারি, নাকি নিজেকে ওঁদের সমান ভাবতে শুরু করি। আর আমি, পাপী
মানুষ, নিজেকে ওঁদের সমান ভাবতে শুরু করে দিতাম। তাই তো গন্ডগোলটা লাগত প্রতিবার!
মৃত্যুপথযাত্রীর
অনেক অবুঝ ইচ্ছাও স্বজনেরা মেনে নেয়। বিবেকের তাড়নায় মেনে নিতে বাধ্য হয়। ইয়াসিনের
পরিবারও মেনে নিল।
ইয়াসিনের বাড়িটা
শহরের প্রান্ত ছাড়িয়ে এক গ্রামে। ইদানিং শহর ঐ গ্রামটাকে গ্রাস করে নিজের একটা অঞ্চল
করে নিচ্ছে। নিজের চাকরী জীবন, ছেলেদের স্কুলে নিয়ে বা কাজেকর্মে যাওয়া আসা সাইকেলেই
চলেছে এতকাল। কালেভদ্রে রিকশা বা অটো লেগেছে বিয়েশাদি বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে যেতে।
কিন্তু গুরুতর অসুস্থ মানুষ সাইকেল চালায় কী করে! তাই ক্ষুদ্র সম্বল থেকে কিছুটা বার
করে পকেটে রেখে ইয়াসিন দুই ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ি থেকে বেরোন।
খোলা ইঁটের দুধাপ
নেমেই রাস্তা। আঠাশ বছর আগে বিহারশরীফ থেকে এসে যখন এই প্রত্যন্ত এলাকায় বাড়ি নেন তখন,
মুসলমান বস্তিতে হলেও ইয়াসিন নিজেই রাস্তায় একজন বিজাতীয় মানুষ হতেন। ধীরে ধীরে পরিবেশ
ঘরোয়া হয়ে ওঠে। দুপুরবেলা শান্ত রাস্তায় নিমফুল ঝরত। থ্রেশিং মেশিনের আওয়াজ আসত সামনে
থেকে আর মোড়ের কাছে কুকুরগুলো ঝিমোতো। আটা পেষাইয়ের কলটাও বসতিতে ছিল না, বড়ো রাস্তার
ওপর ছিল।
গত তিন বছরে হুলিয়া
বদলে গেছে। নিচে নেমেই বাঁদিকে চায়ের দোকান। সেখানে সাতসকাল থেকে জমির দালাল, খরিদ্দার
আর সদ্যজাগ্রত ব্যবসাবুদ্ধির গরমে দারুণ প্যাঁচালো মুখ করে নিবিষ্ট মনে চা খেতে থাকা
জমিবিক্রেতা চাষিদের ভীড়। ক্রমাগত স্কুটার, মটোর সাইকেল, ট্রাক আর ট্র্যাক্টর-ট্রেলারের
আসাযাওয়া।
চা-ওয়ালা জিজ্ঞেস করল ছেলেদের, “কোথায় বেরুলে বাপকে নিয়ে এই বেলায়? ডাক্তারের
কাছে?”
কোথায় বেরুচ্ছে বলতে
হলে অনেক কিছু বলতে হয়। তাই ছোট্ট একটা ‘হুঁ’ বলে দায় সেরে তারা
এগিয়ে যায়। ক্যানালের পাশ দিয়ে বড়ো রাস্তায় উঠে, অটো ধরে পৌঁছোয় স্টেশন। সেখান থেকে
আবার অটো ধরে পুলের ওপর। নেমে রিকশা ধরে রিয়াজ কলোনি, ডঃ ইকবাল রশিদের বাড়ি।
ইকবাল রশিদ হাড়ের
ডাক্তার তবে সাধারণ শল্যচিকিৎসক হিসেবেও সুনাম আছে। আজ তাঁর বিরাট চারতলা নার্সিং হোম।
ইয়াসিন যখন এবাড়িতে প্রথম এসেছিলেন তখন নার্সিং হোমের জায়গায় পুরোনো ব্রিটিশ জমানার
ভিলায় ছিল ‘রশিদ ক্লিনিক’, ইকবালের বাবার নামে। ভিলার চারদিকের বাগানের
জমিতে একটু একটু করে ভিত বাড়িয়ে গড়ে উঠেছিল রিয়াজ কলোনির প্রথম দিককার বাড়িঘরগুলো।
নার্সিং হোমের পিছনেই আবাস। দারোয়ান ইয়াসিনকে
চিনে পথ ছেড়ে দিল। হঠাৎ এতদিন পর দেখা রোগজীর্ণ মানুষটার হালচাল জানার পর খবর দিল,
“কিন্তু, সাহেব তো
বাড়িতে নেই!”
-
কোথায় গেছেন? এসময় তো বাড়িতেই থাকেন!
-
হ্যাঁ, গেছেন রাজপুরায়। এনার দাদুর একটা এস্টেট
ছিল না? আমবাগান, পুকুর …! সেটারই জরীপ চলছে।
-
কেন?
-
‘রশিদ গার্ডেন্স’ নামে কলোনি তৈরি হবে। বড়ো মানুষদের বাড়িঘর।
-
বড়ো সাহেব তো কোনোদিন যানও নি ওদিকে!
-
তিনি আগের দিনের মানুষ ছিলেন – তাঁর জমানা আজাদির জমানা ছিল। মানুষজনও অন্যরকম
ছিল।
-
তা ইকবাল সাহেবও কিন্তু বাপের গুণ পেয়েছেন।
এত নামডাকওয়ালা ডাক্তার, তবু গরীবদের তো মুফতেই দেখেন!
-
আরে, মানুষের কথা তো হচ্ছে না! হচ্ছে জমানার
কথা। দৌলত, জমীন … এসব তো আর পড়ে থাকে
না। যেমন জমানা চায়, তেমন চেহারা দিতে হয়। না দিলে হাতছাড়া হয়ে যায়। পয়সার জুবান আছে
– সে যা বলে, তার
মালিককে তা শুনতে হয়।
দর্শনতত্ত্বের কথাটা বলার গর্বে দারোয়ানসাহেব
দাড়ি চোমরালেন।
-
আর মেমসাহেব?
-
তিনিও সঙ্গে গেছেন। তিনিই তো দেখাশোনা করছেন
পুরো ব্যাপারটা।
-
ফিরবেন কখন?
-
ফিরবেন। দুপুরের খানা খাবেন। আপনি বসুন না
ভিতরে। অসুস্থ মানুষ, কোথায় যাবেন এখন? চলুন, আমার ঘরেই বসুন।
দারোয়ানসাহেব গেটের
শিকলটা লাগিয়ে ওদের তিনজনকে বাগানের ধারে নিজের ঘরটায় নিয়ে গেলেন।
ডঃ ইকবাল রশিদ এলেন একটা নাগাদ। ইয়াসিন খবর
পাঠিয়ে দেখা করলেন বসার ঘরের পার্শ্ববর্তী বারান্দায়।
-
আদাব ইয়াসিন সাহেব। একি চেহারা হয়েছে আপনার?
কী হয়েছে? আপনি বসুন। (একটা বেতের চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করেন)
উত্তেজনায় শরীর হঠাৎ নিজে থেকে কাঁপতে শুরু
করেছিল ইয়াসিনের। এ বাড়িতে এসব জায়গায় বসার অভ্যাস নেই। তাই দাঁড়িয়ে থাকেন।
-
আদাব, আদাব ছোটো সাহেব। কী হয়েছে! কী হয় নি?
এরা তো আমায় বলে না, কিন্তু আমি জানি আমি বেশি দিন … গলায় …।
বাকরুদ্ধ ইয়াসিনের
মুখ থেকে ডঃ ইকবাল রশিদের দৃষ্টি গলার দিকে নামল। গলার ফোলা, ইয়াসিনের কথা আর দুপাশে
দুই ছেলের চোখ দেখে তিনি আন্দাজ পেয়ে গেলেন কী হয়েছে। … ধাক্কা লাগল তাঁরও, অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কাছে
গিয়ে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকিয়ে। তাঁকে বাড়ি থেকে স্কুলে আর স্কুল থেকে বাড়িতে পৌঁছে
দিত এই মানুষটা।
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে গেল ডঃ রশিদের। ইয়াসিনদের
অপেক্ষা করতে বলে, বারান্দা দিয়ে নেমে সদর দরজার পোর্টিকোর দিকে গেলেন। গাড়িটা দাঁড়
করানো আছে। ঠিক যা ভেবেছিলেন তাই। জানালার কাঁচগুলো ওঠানো নেই। আর পোর্টফোলিও ব্যাগটা
পিছনের সিটে পড়ে আছে। এত অন্যমনস্ক পরভীন। যেন হাওয়ায় উড়ে চলে। পয়সা কিভাবে আসে তার
বোধ নেই। গাড়ির ভিতরে ঢুকে কাঁচগুলো ওঠালেন। ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গাড়ি লক করলেন।
তারপর ভিতরে গেলেন ডাইনিং হলের দিকে। স্ত্রী বিস্ময়ে লজ্জিত হলেন।
-
ওঃ, আই এ্যাম সো সরি।
-
নট ফর দ্য ফার্স্ট টাইম।
-
সব ঠিকঠাক আছে তো? দেখে নিয়েছ?
-
দেখিনি। কিছু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেন …? কথায় বলে পরিস্থিতি চোর তৈরি করে।
-
কে এসেছে কে? কার সাথে কথা বলছ? এখানে খাবার
ঠাণ্ডা হচ্ছে।
-
বাবার সময়ের একজন কাজের লোক। তুমি চেন না।
নাউ হি ইজ ডাইং। … আমি আসছি এক্ষুনি।
ডঃ রশিদ আবার পিছনের বারান্দার দিকে গেলেন
যেখানে ইয়াসিন মাটিতে বসেছিলেন। বড়ো সাহেবের ছেলেকে ঢুকতে দেখে দুই ছেলের হাতে ভর দিয়ে
উঠে দাঁড়াতে যান।
- বসে থাকুন। বসে থাকুন, উঠতে হবে না।
ডঃ ইকবালের এক দিদি
তখন কলেজের ছাত্রী। ইকবালও আন্দাজ পেতেন যে বাড়িতে অস্বস্তিকর কিছু একটা চলছে। তাঁর
দিদির কলেজের এক বন্ধু গিরিজাশঙ্কর – তার সাথেই দিদির বিয়ে হল পরে – মাঝে মাঝেই বাড়িতে আসত। বাবা ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের মানুষ,
ভালো বা মন্দ লাগার ঊর্ধ্বে তিনি নিজের মূল্যবোধের মান রাখতে ব্যাপারটায় আপত্তি জানান
নি কখনো। মায়ের আপত্তি ছিল কিন্তু সুর ছিল নরম। কঠোর ছিল দাদুর আপত্তি। আর ইয়াসিন,
বোধহয় নিমকের খাতিরেই বা নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে দাদুর তরফে থাকতেন। এটুকু হলে
কিছু বলার ছিল না। কিন্তু দাদু শেষে মরীয়া হয়ে একটা বিচ্ছিরি কান্ড ঘটালেন ছেলেটাকে
ঠাণ্ডা করতে আর তাতে বোকার মত আগ বাড়িয়ে গেলেন ইয়াসিন। বেশ গর্ব করে এসে বললেন যে ছেলেটাকে
বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, যত বড়ো পাখা ততটাই ওড়া উচিৎ। “দেখুন ওর বাড়ির লোকদের! রুকসানা দিদির এইসব কান্ডকারখানার জন্যই
না ওরা এখানে এসে আমাদের বেইজ্জত করতে সাহস পায়!”
বেচারা ইয়াসিন। ঐ
“আমাদের” কথাটার তাৎপর্য কয়েকদিন পর বিকেলেই তিনি টের
পেয়ে গেলেন। রুকসানা বাড়ি ফিরল গিরিজাকে নিয়ে, রেজিস্ট্রি অফিস থেকে সোজা। দাদু ওদের
আশীর্বাদ করবেন না, তবু দুজনে তাঁর আশীর্বাদ চাইল।
তারপরেই রুকসানা
গম্ভীর মুখে সবাইকে শুনিয়ে বলল, “ইয়াসিনচাচাকে যদি তোমরা রাখতে চাও রাখো। কিন্তু বাইরের কোনো কাজে।
বাড়ির কাজে নয়।” বাকি সবাইও এই ব্যবস্থায়
সায় দিল। কিন্তু ইয়াসিনও তখন মোটামুটি যুবক। রক্ত গরম। গিরিজাশঙ্করের সামনে বলা কথাটায়
নিহিত অপমান তাঁর সহ্য হল না। সাহেবকে বলে কাজ ছেড়ে দিলেন। ভেবেছিলেন, সাহেব নিজের
মুখে কিছু বলবেন। অন্ততঃ একবারও বলবেন – না, থেকে যাও, আমি দেখছি ব্যাপারটা। ক’দিন নাহয় ছুটি নিয়ে নাও। … কিন্তু কিছু বললেন না।
তাঁর বৌয়ের তখন দ্বিতীয়
বাচ্চা হবে। সাহেবের আচরণে সেদিন কাঠ মেরে গেলেও বাধ্য হয়ে ফিরে গেলেন ছ-সাত দিন পর।
কিন্তু গেটের মুখেই যখন দারোয়ান শোনালো তাঁর ঢোকা মানা তখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন
না। বয়সটাও তখন জোয়ান। “শালা পয়সার সাথে
পয়সা, বাপের সাথে বেটি মিলে গেল আর আমাকে ফেলে দিল দুধের মাছির মতো ছুঁড়ে! শালা সব
দেখা কেচ্ছা আমি ভাঙব বাইরে …” শেষ হুমকিটা হাওয়াবাজি ছিল কেননা বস্তুতঃ কোনো কেচ্ছা সে দেখে নি।
শুধু যা হয়, চাকরদের খোশগল্পে শুনেছিল জোয়ান ছেলেমেয়েদের ব্যাপারস্যাপার।
ডঃ ইকবাল রশিদের ভুরুটা ঈষৎ কুঁচকে গেল ঘটনাটা
মনে পড়ায়। দারোয়ান এসে জানিয়েছিল। খেয়াল হল ডাইনিং টেবিলে স্ত্রী অপেক্ষা করছেন, খাবার
ঠাণ্ডা হচ্ছে। তবু মানবিকতা বলে কথা।
- চিকিৎসা চলছে?
বড়ো ছেলে নীরবতা
ভাঙল, “অনেক খরচ ডাক্তারসাহেব,
চিকিৎসা কিকরে করাবো?” ইয়াসিন উত্তেজনায়
কাঁপল, “চুপ কর! চুপ কর!
… না ছোটো সাহেব,
চিকিৎসা এ রোগের হবে না, আপনিই ভালো জানেন। আর আজ এসব কথা বলে পাপের বোঝা বাড়াবো না।
আজ শুধু ক্ষমা চাইতে এসেছি হুজুর!” ইয়াসিনের চোখ দিয়ে ময়লা জল গড়িয়ে পড়ে, “মরার আগে শুধু ক্ষমা চেয়ে যেতে চাই – অনেক কথা বলেছিলাম সেদিন, অনেক খেলাপ করেছি
নেমকের; দোজখের আগুন দেখতে পাচ্ছি আমি …।”
ইয়াসিনের কথায় বিব্রত বোধ করেন ডঃ ইকবাল রশিদ।
কিছু বলতে যান। তার আগেই ইয়াসিন চোখের জল মুছে প্রশ্ন করেন, “দিদি কোথায়?”
- কে? ও, রুকসানা? এ শহরেই আছে।
তার ঠিকানা বলে ডঃ
ইকবাল বড়ো ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “এঁর তো মনের অবস্থা ভালো নয়। এখন কিছু বলাও যাবে না। আজ বিকেলে বা
কাল দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে ক্লিনিকে একবার এস। ওনার প্রেসক্রিপশন, রিপোর্ট ইত্যাদি
নিয়ে এস।” তারপর ইয়াসিনের
দিকে তাকিয়ে বলেন, “আপনি আমার কাছে ক্ষমার
কথা বলে আমাকে বিব্রত করছেন। তখন যা হয়েছিল, তখনই হয়েছিল। আর আমি তো ছোটো ছিলাম। আমাকে
আপনি স্কুল থেকে আনতেন, আমার সঙ্গে খেলতেন … সেভাবেই আমি আপনাকে জানি। আমার কাছে আপনার ক্ষমা চাওয়ার কিচ্ছু
নেই। আল্লার কাছে দুয়া চাইব যাতে আপনি ভালো হয়ে ওঠেন। এখন বাড়ি যান।” বলে পকেট থেকে দু’শো টাকা বার করে বড়ো ছেলেকে দিতে যাবেন তখনই
ইয়াসিন আবার হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “না না হুজুর! ওটা দিয়ে আমাকে আবার এহসানমন্দ করবেন না। … এবার অনুমতি দিন। আদাব …।” ডঃ ইকবাল ধমক দিয়ে টাকাটা ছেলের পকেটে গুঁজে দিতে পারতেন কিন্তু
ইয়াসিনের উত্তেজনা দেখে সাহস করলেন না। শুধু মনে করিয়ে দিলেন, “রিপোর্টগুলো নিয়ে এস কিন্তু।” বাবাকে নিয়ে দুই ছেলে বেরিয়ে গেল।
পরের দিন ইয়াসিন
গেলেন রুকসানার বাড়ি। রুকসানা নিজে কলেজে শিক্ষকতা করেন এবং স্বামী গিরিজাশঙ্কর মূলতঃ
সাংবাদিকতা এবং ঈষৎ রাজনীতি করেন। বাড়িতে প্রথম গিরিজাশঙ্করের সঙ্গেই দেখা হল। তিনি
চিনতে পারলেন না। ইয়াসিনকেই মনে করাতে হল প্রায় তিন দশক আগেকার দিনগুলো। গিরিজাশঙ্কর
নিজের ভিতরকার একটা ছোট্টো অমানবিক উল্লাসের ভাবটাকে সজোরে চাপতে গিয়ে মাত্রাধিক তেতো
হয়ে গেলেন। ভাগ্যিস, পাশে বসে থাকা বন্ধুটি তাঁর খুবই অন্তরঙ্গ – তাঁর এই ছোট্টো মনোবিকলন কাল কফিহাউজের খবর
হয়ে যাবে না। মাত্রাধিক তেতোভাবেই প্রশ্ন করলেন, “ও আচ্ছা! তা, এতদিন পর … কী মনে করে? আজ আবার কী চান? … কিন্তু তারপরেই সামলে নিজের স্বাভাবিক সমাহিত ভাবে ফিরে আসেন,
“বসুন, বসুন আগে।
এত রোদ্দুরে এসেছেন। আপনাকে তো খুবই অসুস্থ মনে হচ্ছে। একটু জিরিয়ে নিন। আমি একটু কাজগুলো
সেরে নিই।”
বন্ধুকে ইংরেজিতে
সংক্ষেপে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে, হেসে একটা সিগরেট ধরান। তারপর টেবিলে ছড়িয়ে রাখা কাজটা
শেষ করতে মনোনিবেশ করেন। বস্তুতঃ লোকটির আসার উদ্দেশ্য আন্দাজ করার চেষ্টা করতে থাকেন।
কাজ শেষ হয়। কাগজ
গুছিয়ে রাখতে রাখতে মুখ তুলে তাকান গিরিজাশঙ্কর, “এবার বলুন ক্যয়সে ক্যয়সে আনা হুয়া।”
ইয়াসিনের বাস্তবিক
অবস্থা এবং আসার উদ্দেশ্যটা জেনে তিনি পাণ্ডিত্যসুলভ সারল্যে বললেন, “আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন ইয়াসিন সাহেব? আপনি
কারো হয়ে কাজ করেছিলেন। যা করতে বলা হয়েছিল তাই করেছিলেন। আর সেটাও এতদিন আগেকার কথা।
তবে আপনি রুকসানার সঙ্গে দেখা করে নিন। হয়তো আপনার মনটা হাল্কা হবে। আপনার আল্লা আপনার
সঙ্গেই আছেন। আপনি কোনো পাপের ভাগী নন।” বলে নিজের ভিতরে হাল্কা অনুভব করলেন যে মৃত্যুপথযাত্রী একটা মানুষের
মনকে শান্তি দেওয়ার চেষ্টা করতে পেরেছেন।
রুকসানা খবর পেয়ে
নেমে এলেন দোতলা থেকে। সবসময় তিনি সবাইকার প্রিয়পাত্র এবং দ্রুত হস্তক্ষেপে যে কোনো
সমস্যার সমাধান করতে জানেন।
- ইয়াসিনচাচা, আপনি! এত বছর পর? ইস, কী চেহারা হয়েছে! আসুন, আসুন,
ভিতরে আসুন!
হাত ধরে টেনে নিয়ে
গেলেন ভিতরে। কার্পেটে বসালেন। নিজেও বসে পড়লেন সামনে।
- কী ইয়াসিনকাকা? এত দিন কোনো কথা মনে রাখতে হয়? একবারও আর দেখা করতে
এলেন না? সেদিন রাগের মাথায় কী বলেছিলাম; বাড়ির সবাইও আমাকে ভালোবেসে আমার কথা মেনে
নিল। কত ভালো লাগছে আপনাকে দেখে! এ দুজন আপনার ছেলে?
ইয়াসিন এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে ছিলেন। এবার হু হু
করে কেঁদে ফেললেন। বহুক্ষণ লাগল তাঁর কান্না সামলাতে। “দিদি, দিদি, তুমি আমাকে আর পাপের ভারে নুইয়ে
দিও না দিদি! আমাকে ক্ষমা চাইতে দাও!”
- আরে দূর! নিকুচি করেছে ক্ষমার। দেখুন তো বাইরে বসে আছে মানুষটা,
কেমন দশাসই। সেদিনের মার খাওয়ার পর থেকেই ওর গায়ের জোর বাড়তে শুরু করে দিয়েছিল। তবেই
তো বিয়েটা হল। আপনাদের দুয়ায় এখন ছেলেপুলে নিয়ে সংসার করছি।
রুকসানা এখনও সুন্দরী এবং বয়সে মোটা হয়েছে।
ওর হাসিঠাট্টার জৌলুষে ধন্ধ লেগে গেল ইয়াসিনের। আর সেই ধন্ধের ঘোরে কখন শরবত এল, সে
এবং ছেলেরা খেল, আর কখন রুকসানা তিনশো টাকা বড়ো ছেলে হানিফের পকেটে গুঁজে দিল সে টের
পেল না।
- কিচ্ছু হবে না ইয়াসিনকাকা! আপনি ভালো হয়ে যাবেন। ভালো করে চিকিৎসা
করান।
একটা বিষম ধাক্কা
খেয়ে দুই ছেলের সাথে বেরিয়ে এল ইয়াসিন।
২
বাড়িতে রাগে চিৎকার করছিল হানিফ, “আর যাবো না, কিছুতেই যাবো না। চিকিৎসার পয়সা
নেই। আর ওনাকে নিয়ে এখন এই তীর্থযাত্রা চালিয়ে যেতে হবে। ‘না না, পয়সা আমি নেব না, পাপের ভাগী হব না’ … তা নিও না! হয়ো না! কে বলেছে বাড়ি বাড়ি ঘুরে এই ক্ষমা চাওয়ার নাটক
করতে?”
- চুপ কর! আপা তিনশো টাকা দিল আর তুই নিয়ে নিলি। মুখে যোগালো না, যে
না, নেব না। আমাকে আরো পাপের ভাগী করলি। আমি বেচলাম আমার ইমান। উঃ …!
ইয়াসিন হাঁপাতে থাকেন।
তারপর শুয়ে পড়েন। সাতদিন পেরিয়ে গেছে। শরীরটা দুদিনের ধকলেই জবাব দিয়ে দিয়েছিল। আবার
উঠেছেন আজ। কিন্তু গলার কষ্ট আর সারা শরীরের দপদপানি বেড়ে চলেছে হু হু করে। কিচ্ছু
খেতে ইচ্ছে করে না। খেতে পারেনও না। তবু আজ সকাল থেকে জিদ ধরেছেন, বেরোবেন। বেরোলেনও।
ছোটো ছেলে মজিদ বিশেষ কথা টথা বলে না। তবে বাপকে ভালোবাসে। তার কাঁধেই ভর দিলেন ইয়াসিন।
বাধ্য হয়ে বড়ো ছেলেও অন্য হাতটা কাঁধের ওপর নিল। মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা মানুষটাকে
আর কতো আঘাত করা যায়! এমনিতেও, কোনো চিকিৎসা তো কিছু করতে পারছে না, অন্ততঃ মনটা শান্তি
পাক! আর শেষ যুক্তিটা বাপের দিকে তাকিয়ে নিজের মনের ভিতরে চাপা দিল হানিফ – যদি অনুগ্রহ না নেওয়ার এই বর্তমান পাগলামিটা
কমে তাহলে – বড়ো বড়ো মালদার
পার্টিগুলোর সঙ্গে পরিচয় – চিকিৎসার খরচ, ভবিষ্যতে
একটা কোনো রোজগারের ব্যবস্থা … আর ভাবতে চায় না হানিফ। দর্জির কাজ শিখে আজকাল একটা ছোটো দোকান
দিয়েছে ক্যানালের বাঁকটায়; ছোটোখাটো কাজ আসে। মজিদের পড়াশোনাও চালানো যায় নি। যেমন
করে হোক সংসারটা দুর্লক্ষ্য আশায় আশায় চলছে।
ইয়াসিন আজ শিকদার
সাহেবের বাড়ি গেলেন। নরেন্দ্রনাথ শিকদার। এখনও অব্দি কাগজে কলমে ইয়াসিন যে ডিস্ট্রিবিউটার
কম্পানির চাপরাশি তার প্রাক্তন এরিয়া ম্যানেজার। তিন বছর আগে অবসর গ্রহণ করেছেন। শিকদার
সাহেব শিল্পী মানুষ। এস্রাজ বাজান। চিত্রকর্ম, নাট্যকর্ম প্রভৃতিকে উৎসাহ দেন। বস্তুতঃ
তাঁর বাড়ির একদিকের গ্যারাজটা বহুকাল ধরে একটি নাট্যদলের রিহার্সাল রুম হিসেবে ব্যবহৃত
হয়। তাঁর বাড়িটা অফিসপাড়ার ঠিক পিছনে একটা শান্ত পরিচ্ছন্ন গলিতে। এক সময় এই এলাকায়
গণ্যমান্য ব্যক্তিরা থাকতেন। এখন এখানকার প্রতি ইঞ্চি জমির গুরুত্ব ব্যবসার দৌরাত্ম্যে
বেড়ে গেছে। একের পর এক বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে দপ্তর, বাণিজ্য এবং আবাস প্রকল্প।
শিকদার সাহেবের বড়ো
ভাই বীরেন শিকদার বহুকাল যাবৎ প্রবাসী। এই বাড়িতে আদ্ধেক ভাগ তাঁরও তবে তাঁর কোনো প্রয়োজন
নেই। তাই পুরো বাড়িটার মালিক বা ভোগস্বত্বাধিকারী কার্যতঃ ছোটো ভাই নরেন্দ্র বা পরিচিতদের
নীরুদা।
গোল বেধেছিল একবারই।
ছ’বছর আগে। একজন প্রমোটার
পুরো জমিটা নেওয়ার তালে ছিল। ছোটোভাইয়ের অনমনীয় ভাব দেখে সে গিয়ে ধরল বড়ো ভাই বীরেন
শিকদারকে, দিল্লিতে। দাদা ছোটো ভাইকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার দায়ে অভিযুক্ত
করলেও, প্রথমে এ ব্যাপারে ছোটো ভাইয়ের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করতে রাজি হন নি। কিন্তু
প্রমোটার নিজের কাজ করতে জানে। সে চারদিক থেকে প্রভাবের পরিবেশ গড়ে তুলল। প্রথমে বীরেন
শিকদারের বৌ আর ছেলেকে ভাঙালো। তারপর বীরেন শিকদারকে। পুজোর ছুটিতে বীরেন শিকদার সপরিবার
এলেন। কথাবার্তা প্রমোটারের আশানুরূপ বচসায় রূপান্তরিত হল। এবং বীরেন শিকদার ছেলে আর
বৌয়ের রাগারাগিতে সম্পত্তি ভাগাভাগির কথা বলে ফেললেন। ছোটোভাই হতভম্ব হয়েও রাজি হয়ে
গেলেন। কিন্তু সেটা তো প্রমোটার চায় নি। তার পুরোটা দরকার। কাজেই ভবিষ্যতের অনুকূলতর
পরিস্থিতির আশায় সে দৃশ্যের নেপথ্য থেকে সরে গেল। আর, দুই ভাইয়ের মধ্যে গড়ে উঠল একটা
কালো দেয়াল যার একদিকে গ্লানি এবং অন্যদিকে অভিমান।
এই রকম মুহূর্তেই
ছোটোভাইয়ের শিল্পীবন্ধুরা এবং নাট্যদলের ছেলেরা বীরেন শিকদারকে ধরল। ভাইকে বলে ফেলা
কথাটার দায় থেকে অব্যাহতি দিতে তাঁকে তোয়াজ করতে শুরু করল যে ছোটো ভাই তো এ শহরেই আছেন,
কিন্তু বড়ো ভাইই তো এ শহরের প্রবাসী নান্দনিক পৃষ্ঠপোষকদের অন্যতম। তিনি যদি রাগ করে
দিল্লি ফিরে যান তাহলে তাঁদের জমিতে গ্যারেজে রিহার্সাল চালানো দলটির পক্ষে কঠিন হয়ে
যাবে। বীরেন শিকদার একই সঙ্গে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার দীর্ঘশ্বাস নিলেন এবং তাতে আত্মশ্লাঘারও
সুবাস পেলেন। বললেন, “না না, সে কি? রিহার্সাল
বন্ধ করবেন কেন? …”
ইয়াসিন তখন সাহেবের
কম্পানিতে চাকরির সুবাদে এ বাড়ির ঘরের লোকের মতো। অফিসের কাজ সেরে এবং ছুটির দিনে তিনি
নরেন্দ্রনাথ শিকদারের এবং তাঁর স্ত্রীয়ের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব নেন। শিকদার সাহেব সরকারি
সাহেবদের মতো নন। ইয়াসিনকে দিয়ে বাড়িতে যা কাজ করান তার জন্য একটা মূল্য ধরে হাতে দেন।
তাঁর স্ত্রীও ইয়াসিনকে কখনো খাবার না খাইয়ে ছাড়েন না। বাড়ির বাগানটার দেখাশোনাও ইয়াসিন
করেন।
একদিন, রিহার্সাল শুরুর একটু আগে। প্রবীণ হীরেন
ভট্টাচার্য (তিনি দলটির অন্যতম নাট্যপরিচালক) এবং একটি স্বনামধন্য হিন্দি নাট্যদলের
প্রধান বিজয় চৌধুরি গ্যারাজে অর্থাৎ রিহার্সাল রুমটায় এসে ঢুকলেন। ছেলেদের কয়েকজন ওদিকে
একজনের হাতে ধরা তালিকার সঙ্গে প্রপ্সগুলো মিলিয়ে সাজিয়ে রাখছিল। কিছুদিন পরেই শো।
ইয়াসিন গ্যারাজের সামনে পোঁতা নতুন রাবার প্ল্যান্টটার মাটি তৈরি করতে করতে ফুট কাটলেন
–
- আপনারাও তাজ্জব লোক!
“কেন? কী হল?” বলে ছেলেদের দল থেকে জয়দীপ এগিয়ে এল, “তার আগে একটা বিড়ি ছাড় দেখি!” ইয়াসিন বিড়ির বান্ডিল, লাইটার এগিয়ে দিতে
দিতে বলল, “বাড়িতে ভাইয়ে ভাইয়ে
কথা বন্ধ, পরিবারে পরিবারে লড়াই লেগে গেল, আর আপনারা এরই মধ্যে নিজেদের গান, বাজনা,
ড্রামা চালিয়ে যাচ্ছেন?”
-
তো? শোকসভা করব?
-
আপনাদের মুখ চেয়েই সাহেব, ভালো মানুষ, বড়ো
ভাইয়ের কথাও মানলেন না। বড়ো ভাই তো গুরুজন!
-
সেসবে আর আমরা কী বলব? … পরিবারের ভিতরকার ব্যাপার। আমরা তো বীরেনদার
কাছ থেকেও অনুমতি নিয়েছি, তবে রিহার্সাল করছি। আর এসব তো আজকাল সবজায়গাতেই হচ্ছে। প্রমোটার
হারামজাদাগুলো বাড়িতে বাড়িতে ভালো মানুষ সেজে ঢুকে টাকার লোভ দেখাচ্ছে। বৌ, ছেলেমেয়ে
পটে গেলেই কাজ হাসিল! তবে ইয়াসিন ভাই, সবার কাছেই তো আর পয়সার ফিকিরটাই বড়ো ফিকির নয়!… আর দু’ভাইএর কারোরই তো আর অভাব নেই!
-
অভাব? সম্পত্তি তার নিজের স্বভাবে চলে হুজুর!
বলুন তো কতো লাখ টাকার লোকসান?
-
তোকেও ঐ প্রমোটার পয়সা দিয়েছে না কি রে?
- ইয়াসিন পয়সার ভুখা নয়। যা বলার, নিজের ইমান থেকে, মুখের ওপর বলে।
আপনাদের এখন কিছুদিন এখানে আসা উচিৎ ছিল না। আর কী করেন এসব? গান, বাজনা, ড্রামায় সময়
কাটিয়ে?
হীরেনবাবু আর বিজয়বাবুও কথোপকথনটা শুনছিলেন। এ ধরণের অযাচিত
আর ধৃষ্ট উপদেশ কারোরই হজম হল না। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা নরেন্দ্রনাথ শিকদারের কানে
ওঠালেন। ‘একজন অতিথির সামনে’ বলে, হিন্দি নাট্যদলের বিজয় চৌধুরির উপস্থিতিটাকে
গুরুত্ব দেওয়া হল। নরেন্দ্রনাথ ইয়াসিনকে ডেকে পাঠালেন। যা স্বভাব ছিল ইয়াসিনের। সাহেবের
গম্ভীর ধমক শুনেও চুপ থাকলেন না, ভুলও স্বীকার করলেন না। উল্টে সাহেবকেও উপদেশ দিয়ে
দিলেন। বড়ো ভাই পিতৃতুল্য, নাটক-গানবাজনা করা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পরিচয় নয় ইত্যাদি
নীতিবাক্যও শোনালেন।
নরেন্দ্রনাথ বেশি
কিছু না বলে বাড়িতে তার আসা বন্ধ করে দিলেন। তারপর অফিসে তাকে খুব কঠোর কিন্তু সংযত
ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন যে ইয়াসিন অধস্তনেরও অধস্তন কর্মচারি। অফিসে তাঁর আসাযাওয়ার সময়,
মাঝেমধ্যে পরবে মদ খাওয়ার অভ্যাস এবং না বলে ছুটি নেওয়ার ওপর কড়া নজরদারি চলতে লাগল।
চাকরি থেকে বার করে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হল তাকে। এমনভাবেই চলছিল ইয়াসিনের অসুখ ধরা
পড়া অব্দি।
শুধু একদিন তাঁর
ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। এক শীতের দিনে দুপুরেই মদ খেয়ে আউট হয়ে ঢুকে পড়েছিলেন অফিসে,
শিকদার সাহেবের কামরায়। বাছা বাছা ‘ইংরেজি’ বাক্যাংশ দিয়ে তাঁকে
ভূষিত করেছিলেন। তখন বাকি সবাই তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে লাঞ্চরুমে মাথায় জল ঢালে।
তাঁর হয়ে শিকদার সাহেবের কাছে ক্ষমা চায়।
ইয়াসিন আজ দুই ছেলের
কাঁধে ভর দিয়ে শিকদার সাহেবের বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে নিজের হাতে পোঁতা রাবার প্ল্যান্টটার
দিকে তাকালেন। তার পিছনেই গ্যারাজ, বা রিহার্সালের ঘর। এখন বন্ধ। কলিং বেলের শব্দে
শিকদার সাহেবের মেয়ে দরজা খুললেন।
ইয়াসিনকে শিকদার
সাহেবের মেয়ের না চেনার কথা নয়। এবং সেটা তার না চেনার ভঙ্গিতে বোঝা গেল। ইয়াসিনের
আদাবের কোনো জবাব না দিয়ে সে ভিতএ দিকে হাঁক দিল, “বাবা, তোমার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে।” বলে ভিতরে চলে গেল। এতে এটাও বোঝা গেল যে
উপেক্ষা বা তাচ্ছিল্যটা ব্যক্তিবিশেষের প্রতি নয়, সহজাত।
ইয়াসিনকে তার দুই
ছেলে বারান্দার ধারে থামে ভর দিয়ে বসালো। ইয়াসিন তাঁর নিজের হাতে একসময় পরিচর্যা করা
বাগানটার দিকে চেয়ে রইলেন। এখনও হয় নি, তবে আরো কিছুক্ষণ পর বাগানটা তৃষ্ণার্ত হয়ে
উঠবে। পছিয়ার ধুলো হাওয়ায় ধুসর রঙ ধরবে সবুজে।
শিকদার সাহেব বেরিয়ে
এলেন, “কী খবর ইয়াসিন? কেমন
আছো? তোমার কাগজপত্র তো হেড অফিসে মুভ করে দিয়েছি। আর এই হানিফকে তোমার জায়গায় রাখার
জন্য রিকমেন্ড করেও দিয়েছি। এখন ওখান থেকে কী আসে তা দেখার অপেক্ষা। তোমার চিকিৎসাপত্র
ঠিক মতো চলছে তো? আমি যদি আরো কিছু সাহায্য করতে পারি তো বল!”
ইয়াসিনের কন্ঠস্বর
এমনিতেও ফ্যাঁসফ্যাঁসে হয়ে গিয়েছিল। আরো বুঁজে এল, “না হুজুর, আর কোনো এহসান নিতে আসি নি। আর এরা আশ্বস্ত করলেও আমি
জানি যে আমার মৃত্যু আগতপ্রায়। আর কয়েকটা দিন বাঁচব। … আমি … আমি আপনাদের সবাইকার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। জীবনে ভুলচুক হয়েই
যায়। আপনারা যে ভালোবাসা দিতেন তাতে আমি নিজের অওকাত ভুলে মনে করতাম আই আপনাদের সমান
সমান। আর সেই ভুলের সুযোগ নিয়েই শয়তান বসে পড়ত আমার জিভে! … সেসবেরই মাফি চাইতে এসেছি।”
শিকদার সাহেব সৌম্যভাবে
হাসলেন, “আহা হা, এভাবে নিজেকে
কষ্ট দিও না। আমরা সবাই সমান। মানুষই তো আমরা। তবে হ্যাঁ, সমাজ, পরিবার, কিছু আদবকায়দা
তো থাকেই। সবসময় থাকবে। আর সেসব তো যখনকার কথা তখনই শেষ হয়ে গেছে। আমি বা কেউই, ক্ষমা
করার কে?” কে বস্তুতঃ ক্ষমা
করে, ঈশ্বর না সময়, তা ঠিক করতে না পেরে শিকদার সাহেব চুপ করে গেলেন।
দাদার সাথে সেদিন
মনোমালিন্য হলেও এখন শিকদার সাহেব প্রায় তৈরি হয়ে গেছেন বাড়ি, জমি বিল্ডারকে দিয়ে দিতে।
যেমন দিনকাল, তেমনই চলতে হবে। ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবলেন মানুষ কতরকম
ভাবে নিজের স্বার্থে আপোষ করতে জানে। এই ছুতোয় লোকটা নিজের ছেলের চাকরির জন্য তদ্বির
করে গেল ঘুরিয়ে। যাতে সাহেব মনে কোনো রাগ না পোষেন। যাক! হয়ে গেলে ভালোই। হেড অফিসে
তো ভালোভাবেই রেকমেন্ড করেছেন।
৩
নিজের প্রথম মনিব,
বিহারশরিফের আলুর আড়তের মালিকের কাছে যেতে গিয়ে ইয়াসিন ট্রেনে মারা গেলেন। মৃত্যুকালে
তাঁর বয়স ছিল আটান্ন বছর আর তার মধ্যে চল্লিশ বছর তাঁর সঙ্গী বলতে ছিল সাইকেল, আকাশী
নীল কিম্বা ছোটো-চেকের শার্ট (আগেকার ডিজাইনেঃ হাফ হাতা, গলা থেকে বুক অব্দি বোতাম,
নিচে দুপাশটা দুদিক থেকে গোল কেটে জোড়া), সাদা পাজামা, চটি, কাঁধে গামছা, সততা এবং
তেমনই কিছু নৈতিক মূল্যে দৃঢ় থাকার গর্ব আর ছোটো ছোটো পাপের অনুতাপ। বলার অর্থ, তিনি
বিশ্বাস করতেন ‘মানুষ একলা এসেছে
এই দুনিয়ায়, একলাই যাবে’। সকাল পাঁচটা থেকে
আটটা অব্দি বাড়িতে এবং তারপর রাত আটটা অব্দি মনিবদের দপ্তরে কিম্বা বাড়িতে পরিশ্রম
করা – এই ছিল তাঁর দৈনন্দিন।
বিহারশরিফেরই একটু আগে তাঁর শেষনিঃশ্বাস পড়ল
তাই তাঁর শরীর বিহারশরিফেই নামানো হল। রেলপুলিস ইত্যাদির হুজ্জত থেকে বেরিয়ে বিভ্রান্ত
হানিফ আর মজিদ শোকের মধ্যেও বুদ্ধি খাটালো। যেটুকু পয়সাকড়ি ছিল, লাগিয়ে অটো ভাড়া করে
বাপের শরীর নিয়ে গেল আলুর আড়তের মালিকের কাছে। বললও যে আব্বু তাঁর কাছে মাফি চাইতে
আসছিলেন।
-
কিসের মাফি?
- তা তো জানি না। গত এক মাস ধরে এভাবেই ঘুরছিলেন নিজের সব মনিবদের
বাড়িতে বাড়িতে।
আড়তদার এইরকম পরিস্থিতিতে
স্বভাবতই একটু অস্বস্তি, একটু দুঃখ এবং একটু স্মৃতিসুখ অনুভব করলেন। তবে সবচেয়ে বেশি
যেটা অনুভব করলেন সেটা ছিল ভয়। না, ইয়াসিনের মৃত শরীরটাকে নয়, অতীতকে। বস্তুতঃ অতীত
মনে পড়লে মানুষের মনে ঝড় উঠতে থাকে। হিসেব গোলমাল করে দিতে চায়। একটা বৈরাগ্যের ভাব
ঘিরে ধরে। অতীতের বোঝা বওয়া চাট্টিখানি কথা নাকি!
আর এই ইয়াসিন, তাঁর
বাপের আমলের লোক – কেন যে সেসময় মা
একে শুধু কাজছাড়া নয়, শহরছাড়া করার জন্য জিদ ধরেছিলেন তা তাঁর নিজেরও ভালো করে জানা
নেই। তিনি তখন বেশ ছোটো। আজও মা যখন জানতে পেয়ে অন্দরমহল থেকে বাইরে এলেন মৃত ইয়াসিনের
শরীরটা দেখতে, হঠাৎ ছেলেকে একটা বেমক্কা হুকুম দিলেন, “বৌয়ের মাদুলিটা আজ বিকেলেই করিয়ে নিয়ে আসবি,
বলে দিলাম!” আড়তদার কথাটা এই
মুহূর্তে বলার কোনো মানে খুঁজে পেলেন না।
যাই হোক, ইয়াসিনের
শরীরটা একটা গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা তিনি করে দিলেন। গাড়িটা প্রথমে গেল শহরের
সেই পাড়ায় যেখানে এক সময় ইয়াসিনের ছোটোবেলা কেটেছিল এবং এখনও তাঁর দূর সম্পর্কের জ্ঞাতিরা
থাকেন। তারপর পাটনার দিকে রওনা দিল।
x
x x
x
হানিফ আজকাল মজিদকে
নিয়েই দোকান খুলে বসে। গত দেড় মাসে মাঝে মাঝেই দোকান বন্ধ থাকায় প্রচুর লোকসান হয়ে
গেছে। গ্রাহকের ভরসাটাই চলে গেছে যে দোকান কখন খোলা থাকবে আর কখন বন্ধ থাকবে। এরপর
আবার যদি সত্যিই শিকদার সাহেব ডেকে পাঠান! বাপের কম্পানিতে একটা চাকরি যদি সত্যিই হয়ে
যায়! … তার আগে মজিদটাকে
পাকাপোক্ত করে দিলে সে-ই চালাতে পারবে। আর, একান্তই না পারলে কাউকে দিয়ে দিতে হবে,
কেননা মজিদ অন্যরকম ছেলে।
মজিদ সত্যিই অন্যরকম।
দর্জির দোকানে ছোটোখাটো কাজ ভালোমতই আসে। মজিদ টাকাপয়সার হিসেব রাখে। দাদা কাটিং করে
দাগ দিয়ে দিলে মেশিনও চালায় কখনো কখনো।
কিন্তু মাঝেমধ্যেই
সে চলে যায় এদিক ওদিক। খালের ধারে গিয়ে বসে থাকে। চায়ের দোকানে বসে শহরের হালচাল কান
পেতে শোনে। তারপর চলে যায় বাড়ি। মায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়ে।
একদিন বলল, “আচ্ছা আম্মি! আব্বু তোমার প্রতি কোনো অন্যায়
করে নি? অন্যায় কথা বলে নি? আমিই তো দেখেছি! তার জন্য কখনো ক্ষমা চেয়েছিল?”
-
কী বলিস তুই? উনি তো আমার শওহর ছিলেন! আমার
কাছে আবার ক্ষমা চাইবেন কেন?
-
ঠিকই বলেছ। আসলে, যারা আপন নয়, তাদেরকে আপন
মনে করাটাই ভুল। আর তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে যাওয়া মানে আবার তাদের সেই আপনই মনে করা!
বাবা কি সত্যিই বুঝত না এই সহজ কথাটা?
-
মরা মানুষের বিষয়ে কটু কথা বলতে নেই, তবু বলছি
তোর বাপ ছিল অহঙ্কারী আর ভীতু। অন্যায় করেও থাকি তো তার বোঝা মাথায় নিয়ে মরব! যে কষ্ট
সহ্য করল মানুষটা এক বছর ধরে, নরকের আগুন কি তার চেয়ে বেশি কিছু? … কী এমন কারোর মনে রাখার মতো জীবন বাঁচি আমরা
যে মনের ভিতর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এসব দৈনন্দিন ব্যাপারে ন্যায়-অন্যায়, ভুল-ঠিকের প্রশ্ন
তুলব? আর তুললামও তো এই? অন্যায় কী, তা বোঝা এত সহজ? বুঝলে পর, উদয়াস্ত পরিশ্রম আর
অপমানের একটা জীবন কেউ হাসিমুখে বেঁচে যেতে পারে?