পরিচিত কাউকে না
পেয়ে ব্রাঞ্চের পিছনে টয়লেটের দিকে চলে গেলেন বসুমল্লিক। সব গ্রাহকই যায়; ওটাই একমাত্র
টয়লেট। কাজেই কেউ ঘুরে তাকালো না। অপরিচিত একজন বুড়ো মানুষ কোনো কাউন্টারে বা টেবিলে
কাজের জন্য না থেমে আস্তে আস্তে ঈষৎ অন্ধকার দিকটায় এগোতে গিয়ে দেখলেন বাঁদিকে একটা
ছেলে হিটারে চা করে কাপে কাপে ঢালছে। কী মনে হলো, তাকেই জিজ্ঞেস করলেন, ইউনিয়ন-ওয়ালে
সুমনজি কোথায় বসেন। ছেলেটি হিন্দিতে বলল, তাঁর তো বদলি হয়ে গেছে, সত্যনারায়ণজি আছেন,
ঋণ বিভাগে, দেখা করতে পারেন।
বসুমল্লিক টয়লেটে
ঢুকে বেসিনে এক আঁজলা জল চোখেমুখে দিলেন। রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে ঋণ বিভাগের নতুন ফলকটা
দেখে ঘরে ঢুকলেন। সত্যনারায়ণজি কে? – জিজ্ঞেস
করে সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
- নমস্কার!
- বলুন!
- সুমনজি কোন ব্রাঞ্চে গেছেন বলতে পারেন? চায়ের
ছেলেটা বলল তাঁর নাকি বদলি হয়ে গেছে!
- উনি তো রিটায়ার করে গেলেন!
- এ্যাঁ! কবে?
- এই তো, গত মাসে।
- আসেন না আর?
- আসবেন না কেন? মিটিং-ঠিটিং থাকলে আসেন।
- আগের মতো বুধবারে বসেন না আপনারা?
- বসি তো! (চোখ তুলে তাকায়) আপনি কে? আরে! অজয়
বসুমল্লিক দাদা যে!
- আপনি চেনেন আমায়?
- কেন চিনব না? আপনি তো কারেন্সি চেস্টে ছিলেন।
(মুখে রসিকতার ভাব ফুটে ওঠে) অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন একবার, মনে আছে?
- (বসুমল্লিক লজ্জা পেয়ে যান) আপনি কোথায় ছিলেন
তখন?
- আমি তো সোনোয়াঁ থেকে এসেছিলাম রেমিটেন্সে!
ব্রাঞ্চে বসে গল্প করছিলাম, হঠাৎ দেখি চিফ ম্যানেজার দৌড়োচ্ছে, অফিসাররা দৌড়োচ্ছে … কী …না, চেয়ারম্যানের
ভিজিট হবে শুনে বসুমল্লিকসাহেব ফ্ল্যাট।
- আরে না, সেসব ব্যাপার ছিল না। আপনারা … হ্যাঁ, কিছু নার্ভাস প্রব্লেম আছে আমার। আর ওয়র্কলোডও তো, জানেনই!
- তা আজ তো সোমবার, পরশু আসুন! একবার সুমনভাইয়াকে
ফোনও করে দেবেন।
- ফোননম্বর …
- লিখে নিন – নাইন …
বসুমল্লিক মোবাইলের
ফোনবুক বার করে টিপতে থাকেন।
তিনি চলে যাওয়ার
পর পাশের টেবিলে বসে থাকা কুমুদ প্রশ্ন করে সত্যনারায়ণকে, “বেহোশ হয়ে গেছিলেন, বলছিলেন না? কেন?
- আরে, ভীতু লোক। কেউ কেউ হয় এরকম। ইনি একটু
বেশিই ছিলেন, চাপে পড়লেই পাগল পাগল দিশেহারা ভাব।
- হ্যাঁ, অনেকে যেমন থাকে শুনেছি। সব সময় ভয়
পায়, ভাবে কেউ না কেউ তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে …।
- বাট, ভেরি অনেস্ট। কাজেকর্মেও, মানে বিশেষ
করে পেপারওয়র্কে নিখুঁত ছিলেন। তবে এধরণের মানুষদেরকে দিয়ে এডমিনিস্ট্রেশন চলে না।
- তখন তো সব কাজ ম্যানুয়াল ছিল। তাই হয়তো কঠিন
ছিল এডমিনিস্ট্রেশনের কাজ।
- তা না। কাজের ধরণধারণ পাল্টেছে। জায়গার … মানে
- ওয়র্কস্পেসের …
- হ্যাঁ, তার ধারণাটা পাল্টেছে কিন্তু হায়ারার্কিও
এক আর সমাজটাও সেই এক। চাপগুলোও এক। সেদিনই তো আপনি বলছিলেন, ম্যানেজার নিজে না গিয়ে
আপনাকে ওম্বাডস্ম্যানের কাছে পাঠাচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে … কী করবেন, কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলবেন!
- সে তো … তিন বছর চাকরি হয়েছে, এখনো ম্যানেজারি করি নি। ওম্বাডস্ম্যান … রিজার্ভ ব্যাঙ্ক … ভয় করবে
না?
- ছাড়ুন, এখানে দেখান, কী করব (কম্পিউটারের স্ক্রিনে
একটা একাউন্ট থেকে ঋণশোধের কিস্তি কেটে নেওয়ার স্ট্যান্ডিং ইন্সট্রাকশন ঢোকাবার জায়গা
খোঁজে)।
তখনি কুমুদের মোবাইলে
চিফ ম্যানেজারের কল আসে। আসছি বলে, গায়ের উড়নিটা ঠিক করতে করতে বেরিয়ে যায়।
চিফ ম্যানেজারের
চেম্বারে ঢুকে দেখে সেই লোকটিই বসে চা খাচ্ছে যে একটু আগে সত্যনারায়ণজির কাছে গিয়ে
কারোর বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছিল, ফোন নম্বর লিখছিল। আশ্চর্য! আগে এখানেই আসতে পারত! ব্রাঞ্চে
ঢুকে প্রথমেই তো চিফ সাহেবের ঘর। আগে চায়ের ছেলেটার কাছে কারোর খোঁজ নিয়ে, সত্যনারায়ণজির
সঙ্গে দেখা করল। এমনভাবে বেরোলো যেন এবার বুধবারেই আসবে সেই কারোর সঙ্গে দেখা করার
জন্য আর তারপর! সোজা চিফের চেম্বারে বসে! … একটু বেশি
রকম ভেবে চিন্তে পা টিপে টিপে এগোনো মানুষ! সেই অজ্ঞান হওয়াটাও নাটক ছিল না তো? সত্যনারায়ণজি
যেটার গল্প বলছিল?
- হ্যাঁ স্যার!
- শোনো কুমুদ, স্যার আমাদেরই সিনিয়র, রিটায়ার্ড।
বলছেন, রিটায়ারাল বেনিফিট থেকে এডজাস্ট করে ওনার হাউজিং লোন একাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া
হয়েছিল, কিন্তু ডকুমেন্টগুলো উনি ফেরত নেন নি। একবার দেখ তো! যদি ক্যাবিনেটে পাও, ওনাকে
দিয়ে দাও। আর একাউন্ট বন্দ হয়ে গেছে বলে যদি মৃণালিনী ম্যাডাম অন্য কোথাও রেখে দিয়ে
থাকেন তাহলে তিনি এলেই (বসুমল্লিকের দিকে তাকিয়ে) আপনি পাবেন। একাউন্ট নম্বরটা মনে
আছে?
- না। বা, হয়তো (ব্যাগ থেকে পাসবুক বার করেন)
এই পাসবুকে থাকবে। কিস্তি তো এই একাউন্ট থেকেই যেত। (কুমুদের দিকে এগিয়ে দেন)।
কুমুদ পাসবুক খুলে
একাউন্ট নম্বরটা বার করে। চিফ ম্যানেজারের চেয়ারের পিছন দিয়ে ডান দিকে পৌঁছোয়। কম্পিউটার
অনই ছিল। চিফ স্যার পাসওয়ার্ড আর বায়োমেট্রিক দিয়ে খুলে দেন। কুমুদ মেনুতে গিয়ে একাউন্টের
স্ট্যাটাস আর তারিখটা নোট করে বসুমল্লিককে পাসবুক ফিরিয়ে দেয়।
- আপনিও চলুন না স্যার। আপনি বেটার চিনবেন; নিজেই
খুঁজে নেবেন।
- (ইতস্তত করে) না না, ঠিক আছে। আমি এখানেই আছি।
আপনিই একটু খুঁজুননা, পেয়ে যাবেন।
কুমুদ চলে যাওয়ার
পর সত্যনারায়ণ, কমরেড সুমনজি মানে সুমন ঘোষকে ফোন করেছিল। সুমন এই সেদিন অবসর নিল।
সত্যনারায়ণের অবসর দেড় বছর পর। কুমুদ যখন ফিরে এল তখনও সত্যনারায়ণজি ফোনে কথা বলছেন।
ক্যাবিনেটে পুরোনো ফাইলের গাদাটা মৃণালিনীদি চিনিয়ে রেখেছিলেন। সেই গাদাটাতেই খুঁজতে
শুরু করল। ওদিক থেকে সত্যনারায়ণজির জোরালো আওয়াজ ভেসে আসছিল। তবুও তাকে শুনিয়েই বলল
কুমুদ, “আপনার ওই লোকটা মোটেই অনেস্ট নয়।”
সত্যনারায়ণ ফোন কানে
রেখেই মুখটা একটু সরিয়ে বলল, “কেন?”
- ভীতু কখনো সৎ হতে পারে না। লোকটা ভীতু-ও, ব্যাঁকা-ও।
- কী হলো কী?
- বলছি। এই ফাইলটা খুঁজে দিয়ে আসি।
- (ফোনে মুখ রেখে, শুনে) হবে কিছু! … আপনি সেই আপনাদের সময়কার অরোড়াজির কথা বলছিলেন না? (কুমুদের দিকে
আড়চোখে তাকিয়ে আর শুনিয়ে) তিনিও কি ভীতু আর ব্যাঁকা ছিলেন নাকি?
- যাক। আপনি আসুন তাহলে কাল। … না না, বসুমল্লিকজির জন্য বলছি না, উনি আসবেন না আসবেন, সেটা তাঁর
ব্যাপার … আপনি আসুন।
বুধবারের বৈঠকে আজকাল
সবাই একটু দেরি করে আসে। কোর ব্যাঙ্কিং হওয়ার পর থেকেই কর্তৃপক্ষের রোয়াবও বাড়ছে, কাজের
চাপও বাড়ছে। তার ওপর, অনেকেই এখন ক্যাশের দায়িত্বে আছে, সব বন্ধ করে আসতে আসতে দেরি
হয়ে যায়। কাজেই বৈঠকের মেয়াদটা কমে গেছে – এক কাপ চা
আর সঙ্গের বিস্কুট বা সিঙাড়াটা পাওয়া আর খাওয়া অব্দি। আগের মতো খবরের কাগজ ছড়িয়ে মুড়ি-বাদামের
পাহাড় খাওয়া ক্কচিৎ কখনো হয়।
এখনো সবাই আসে নি।
যারা এসেছে তাদের মধ্যে তিনজন অবসরপ্রাপ্ত আর দুজন শিগগিরই অবসর পাবে। তাই কিছুক্ষণ
স্মৃতি রোমন্থন চলে।
এরই মধ্যে ঢুকে পড়েন
বাল্মিকী রায়। ইনি বসে থাকা সবার চেয়ে বেশি সিনিয়র। ম্যানেজার ছিলেন। তার ওপর এ ব্যাঙ্কের
বাতাবরণে জাতটারও কুখ্যাতি ছিল এক সময়। কিন্তু বাল্মিকীবাবুর কখনো কোনো এলিটিজম ছিল
না। তাই তাঁর একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ায় কেউ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।
কথা হচ্ছিল সততা
বনাম প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে।
বাল্মিকীবাবু নিজের
মতো করে বললেন, প্রশাসনিক দক্ষতাও সততা আর সততাও দক্ষতা, জীবনটা বাঁচার; আর দুটোরই
ভিত্তি হল জ্ঞান।
রবিন্দর পাশ থেকে
আস্তে ফোড়ন কাটল, “সঠিয়া গয়া হ্যয় বুঢ়ওয়া! জ্যাদা পঢ় লিয়া ধরমগ্রন্থ।
অব বকৈতি ঝাড় রহা হ্যয়!”
আফরোজ ওদিক থেকে
জিজ্ঞেস করল, “ই কা ঘোরমট্ঠা কর দিয়ে সর? কুচ্ছো বুঝইবে
নহিঁ কিয়া।”
বাল্মিকীবাবু হেসে
বললেন, “দেখ, ধরো তুমি একটা ব্রাঞ্চের ম্যানেজার হলে।
হয়ে গেলে। ব্যাঙ্কের প্রমোশন পলিসি আছে, পরীক্ষা দিলে, পাশ করলে, ইন্টারভিউ দিলে, পাশ
করলে, একটু ট্রেনিং নিলে – বিভিন্ন ধরণের ডেইলি,
উইকলি, মান্থলি এবং ইয়ারলি রুটিন, ম্যানেজমেন্ট, হিউম্যান বিহেভিয়ার, সাইকোলজি … – সব হল। কিন্তু ঐ, শর্টকাটে, ম্যানেজ দিয়ে দিয়ে। তারপর যখন সত্যি
সত্যি কাজের ভিতর ঢুকলে, পড়লে অথৈ জলে। কিকরে হবে কাজগুলো?”
সুমন শুনছিল। হেসে
বোঝার মত করে বলল, “তিন ধরণে!”
বাল্মিকীবাবু চোখ
ঘুরিয়ে তাকালেন, “আরে, সুমনজি! নমস্কার! দেখে হি নহীঁ আপকো।
ইধর আইয়ে ভাই! অর্সে কে বাদ ভেঁট হো রহী হ্যয়।”
সত্যনারায়ণ – হ্যাঁ। এখানে বসুন। আর বলুন তিনটে ধরণ বলতে কী কী।
- পিপিপি। প্যয়সা, পাওয়ার আর পেইন। প্যয়সা, তাকত
আওর দর্দ, কমর কা, মাথে কা, মানে কাম কে বোঝ কা। পয়সা মতলব ফর্জি ভাউচর সে পয়সা দেনা।
তাকত মতলব ম্যানেজরি কা তাকত। কেউ দেখবে এন্তার পয়সা খরচা করে কাজ করাচ্ছে। কেউ দেখবে
দিনরাত কড়া কড়া অফিস অর্ডার দিচ্ছে, একে ওকে তাকে শোকজ দিচ্ছে, ম্যানেজার্স মিটিংএ
শুধুই নালিশ – কর্মচারিদের বিরুদ্ধে। আর কেউ দেখবে ভালো
মানুষ, আদ্ধেক হওয়া কাজের রেজিস্টার আর ফাইল নিয়ে রাত আটটায় বাড়ি ফিরছে, সেখানেও চলছে
কাজ!
- তিনটেই তো একসঙ্গে চলে।
- চলতেও পারে। তবে জেনেরালি দেখা যায় তিন ধরণের
লোকের তিন ধরণে ম্যানেজারি। ওই যে সেদিন অরোড়াজির কথা জিজ্ঞেস করছিলে না? উনি ছিলেন
তৃতীয় ধরণের। যে যেটুকু পারছে করছে, উনি কাউকে কিছু বলছেন না, সব বাকি কাজ নিজে করছেন।
- কিন্তু উনি তো ড্রাই অনেস্ট ছিলেন। একেবারে
সৎ মানুষদেরই ওরকম দুর্ভোগে পড়তে হয়।
- তা হয় কিছুটা। আবার এটাও ঠিক, যে উনি যা পেতেন
তা আর কেউ কখনো পায় নি।
বাল্মিকীবাবু বললেন,
“সেটা ঠিক। আজও লোকে তাঁর নাম নেয়। এত শ্রদ্ধা
করে সবাই। আমাদের মতো যে ছেলেগুলো সেসময় ইয়ং ছিল, অতো বুঝত না কাজের গুরুত্ব, ইউনিয়নবাজি
বলতে মনে করত কাজে ফাঁকি, তারা আপসোস করে।”
- তবে অনেকের কাছ থেকে অতিরিক্ত কাজ আর সহযোগিতাও
তিনি পেতেন। অন্য কোনো ম্যানেজার সেরকম সহযোগিতাও পায় নি।
আফরোজ চিৎকার করল,
“আরে আপনারা কোথায় ফাঁসিয়ে দিলেন ব্যাপারটাকে।
স্মৃতিচর্চা বন্ধ করুন। আপনি বলুন বাল্মিকীস্যর, দোনো হি ইমানদারি ক্যয়সে হ্যয় অওর
দোনো কা বুনিয়াদ জ্ঞান … মতলব ক্যা!”
কুমুদ ঋণ বিভাগ থেকে
বেরিয়ে নেট ব্যাঙ্কিংএর কিওস্কে বসে থাকা প্রীতির টেবিলের সামনে বসে চা খাচ্ছিল। প্রীতির
পেটের দিকে তাকিয়ে বলল, “মুটিয়ে যাচ্ছিস।
এখনই সাবধান হ’।”
- কী করব? সারাদিন বসে বসে কাজ। স্কুটি চালিয়ে
বাড়ি, তারপর রান্নাঘরের কাজ। ভেবেছিলাম অন্ততঃ রোববারে হাঁটব, তাও হয়ে উঠছে না। আর
ঐ মৃণালিনীদির মতো যোগা-ফোগা আমার হয় না।
- ভুগবি গ্যাস্ট্রিকে।
- ভুগতে শুরু করে দিয়েছি।
তখনই আফরোজের জোরালো
আওয়াজ শুনে দুজনেই উৎকর্ণ হয়ে মন দিয়ে কথা শুনতে শুরু করল।
বাল্মিকীবাবুর মুখভরা
পুরোনো বসন্তের দাগ। আগে আরো বেশি দেখা যেত, এখন বেশি বয়সের রক্তাল্পতায় একটু কম স্পষ্ট।
বললেন, “আমি জ্ঞান বলেছি ভায়া, লেখাপড়া, ডিগ্রি বলি
নি কিন্তু। নিরক্ষর লোকেরও জ্ঞান থাকতে পারে যথেষ্ট। আর আমি যে জ্ঞানের কথা বলছি সেটা
সচরাচর নিরক্ষর লোকেদেরই বেশি থাকে।”
- কোন জ্ঞান?
- হিউম্যান নেচর কা জ্ঞান! মানবপ্রকৃতির জ্ঞান।
মানুষকে এক নজরে চিনতে পারার ক্ষমতা। আবার সেই নিরিখে নিজেকেও চিনতে পারার ক্ষমতা।
যদি মানুষকে চিনতে পারো, তাহলে তুমি প্রশাসনে দক্ষ হবে, আর দক্ষ হলেই নিজের দায়িত্বপালনে
সততা রাখতে পারবে। আর নিজেকে চিনতে পারলে, সঠিকপথে জীবনটা বাঁচার (ঈষৎ শ্লেষের একটা
হাসি ফুটল মুখে) দক্ষতা অর্জন করবে, তাহলেই সৎ থাকতে পারবে।
আফরোজ মাথা চুলকে
বলল, “বহুতে হাই ফিলসফি সুনা দিয়ে সর!
ততোক্ষণে কাঁচাপাকা
চুলওয়ালা একজন বেঁটে মতো লোক বাল্মিকীবাবুর কাছে এগিয়ে এসে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম
করল। লালবাগ ব্রাঞ্চের হেডক্যাশিয়ার, সাধারণতঃ সে সবচেয়ে দেরি করে আসে। তাকে দেখে সত্যনারায়ণ
বলল, “চলিয়ে, আপ ভি আ হি গয়ে!” তার উসখুস দেখে বাল্মিকীবাবুও বুঝতে পারলেন কারণটা। উঠতে উঠতে আফরোজের
দিকে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা অব হাই ফিলসফি
ছোড়িয়ে, আপকে সবলোগ আ গয়ে হ্যঁয়, মিটিং কিজিয়ে অপনা – হম চলেঁ।”
সত্যনারায়ণ লৌকিকতায়
বলল বটে, “আপ ভি রহ সকতে হ্যঁয় সর, বইঠিয়ে ন!”
- নাঃ, কথা বলো তোমরা। আমার থাকাটা শোভনীয় নয়।
ওদিকে কুমুদও উঠে
চলে গেল ঋণ বিভাগের ঘরে, নিজের টেবিলে। কম্পিউটারটা অফ করল। নিজের ব্যাগ নিল। আলমারি
বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। আজ সে এঘরে একা অফিসার, মৃণালিনীদি ছুটিতে। বেরোবার সময় ইউনয়নের
মিটিংটার কাছে গিয়ে সত্যনারায়ণজির দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। পাশে বসে থাকা সুমন হাতে
হাল্কা চাঁটি মেরে সত্যনারায়ণের চোখ ফেরালো সেদিকে। “ওকে!” হাত তুলে বিদায়
জানালো সত্যনারায়ণ।
স্কুটি চালিয়ে ফিরতে
ফিরতে কুমুদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল কথাগুলো। কারণটা অবশ্যই তার নিজের স্বার্থ। কিছুদিনের
মধ্যেই কোথাও না কোথাও ম্যানেজারির দায়িত্ব পাবে সে। মেয়ে বলে খুব দূরের গ্রাম না হলেও,
ছোটো ব্রাঞ্চ বলে একদম শহরের মাঝখানে তো হবে না। তাকেও সামলাতে হবে সবদিক। ‘পয়সা, পাওয়ার, পেইন’! কোথাও গাফিলতি
হলে আলাদা ঝঞ্ঝাট। … ঠিক আছে। যখন যাবো, ভাবব। মানুষজনই তো! কেউ
দাদা, কেউ কাকা কেউ দিদি, মাসি … এদেরকে নিয়েই তো
একসাথে কাজ করা! হয়ে যাবে’খন।
রাত সাড়ে আটটায় স্টেশনে
প্রতিদিনই ভিড় থাকে। আজ যেন একটু বেশি। সুমন উল্টে ভেবেছিল যে আজ সারাদিন শহরে হাঙ্গামা
চলেছে, ভিড় হয়তো কম হবে। এসে শুনল দুটো ট্রেন ক্যান্সেল্ড। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে খাবার
জল ভরার জায়গাটার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, তখনই সত্যনারায়ণ, রবিন্দর, আফরোজ এবং
আরো কয়েকজন চলে এল। সবার গন্তব্য ভাগলপুর। সম্মেলন। কোনো এক সময়ে সুমনের নেতৃত্বেও
সম্মেলন হয়েছে। সে খাতিরটা কমে নি। তবু, এবারের সম্মেলনে সে ‘পুরানে নেতা’ – অতিথি।
হঠাৎ নারীকন্ঠে সজোরে
‘স্যার’ ডাক শুনে
পিছনে তাকালো। সবাই তাকিয়েছিল। দেখল, কুমুদ এবং লালবাগ ব্রাঞ্চের সরোজ (দুজনেরই সোজাসুজি
স্কেল ওয়ানে, তিন বছর আগে জয়েনিং) তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
সত্যনারায়ণ অবাক
হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কোথায় …?”
- আমাদের ট্রেনিং দিয়েছে এক সপ্তাহের। কোলকাতায়।
- বাঃ, যাইয়ে, মস্তি কিজিয়ে! আপনাদের ট্রেন তো
এই প্ল্যাটফর্মেই আসবে। আমাদের যেতে হবে তিন নম্বরে।
- কোন ট্রেন? কোথায় যাচ্ছেন? অনেকে আছেন দেখছি!
- হ্যাঁ, তাই তো এখানে মিট করতে বলেছিলাম। ভাগলপুরের
ট্রেন ধরব। সবাই এসে গেলে যাবো। … আপনাদের ট্রেনিং
দিয়েছে মানে এর পর ইন্ডিপেন্ডেন্ট চার্জ দেবে।
- হ্যাঁ, তাই নিয়েই তো চিন্তা!
- চিন্তা কিসের? তোমাদের তো আর দূরে পাঠাবে না!
এদিক ওদিক যাবে রুরালে …।
- না না, সেটা নয়। সেই গত বুধবারে আপনাদের মিটিংএ
যে বললেন – পয়সা, পাওয়ার …
সুমন হেসে ওঠে হো
হো করে। “আরে না কুমুদজি! ওটাই শেষ কথা নয়। খুদ সহি
রহিয়ে, দুনিয়া সহি দিখেগি। লোগ সহি দিখেঙ্গে। মানুষেরাই তো কাজ করবে আপনার নিচে। কেউ
লেখাপড়া জানা, কেউ নিরক্ষর, কেউ আপনার থেকে বড়ো, কেউ সমবয়সী, কেউ ছোটো। কেউ হয়তো কমপ্লেক্সে
ভুগছে সে হতে পারল না, আপনি কিকরে হয়ে গেলেন! হয়তো আপনার উঁচু মহলে তদ্বির আছে …
- না, বিশ্বাস করুন!
- সে বলতে হবে না। সত্যনারায়ণের পাশে বসে বসে
আপনাকে আমি চিনি।
- সেদিন বাড়ি যেতে যেতে আমিও ঠিক ওই কথাই ভাবছিলাম
জানেন? যে সবাই তো মানুষ – দাদা, কাকা, দিদি,
মাসিদের মতো … করেই নেব কাজ। (হেসে) ওই তিন পি-এর চক্করে
পড়তে হবে না।
এদিকে ইউনিয়নের সবাই
জুটে গিয়েছিল। রবিন্দর তাড়া দিচ্ছিল। বিদায় নিয়ে সবাই এগোলো ওভারব্রিজের দিকে।
ওভারব্রিজের সিঁড়ি
ভরে অসংখ্য জোয়ান ছেলেমেয়ে বসে আছে। বয়স্করাও আছে। তবে তরুণতরুণীদের সংখ্যা বেশি। জায়গাই
নেই ওপরে ওঠার বা নিচে নামার। সবাই টেন ধরবে। কাল রোববার, নিশ্চয়ই নানান চাকরির পরীক্ষা
আছে বিভিন্ন শহরে। আরো অনেক শহরে কাজের ব্যবস্থা হওয়ার ভরসা আছে। যুবদের সঙ্গে সঙ্গে
বয়ষ্কদের একটা বড়ো অংশ নিজেদের ছেলেমেয়েদের জন্য দৌড়োচ্ছে – কলেজে ভর্তি করাতে, চাকরি হলে পৌঁছে, থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করে আসতে
…। একসময় ছিন্নমূল হওয়াটায় কেমন ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির
ছোঁয়া থাকত, সুমন ভাবল, এখন বর্বর নগ্ন, পূঁজিবাদ সবাইকেই ছিন্নমূল হয়ে বেঁচে থাকার
যেন অভ্যাস করিয়ে দিচ্ছে! খুব জোরে একটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার ইচ্ছে থাকলেও, নিঃশব্দে
হাল্কা হেসে, সিঁড়িতে পা রাখার জায়গা খুঁজে উঠতে লাগল।
- তবে একটা এ্যাডভান্টেজ আছে এদের, সুমনদা।
- কী? কাদের?
- ওই কুমুদ বা আরো সমস্ত ছেলেমেয়েদের কথা বলছি।
- কিসের এ্যাডভান্টেজ?
- আগে ছিল বেশির ভাগ ফার্স্ট জেনারেশন চাকুরে।
তাও আবার এই বিহারের শহরগুলোয়, জাতপাতের ঠোকাঠুকিতে ভরা; ফিউডাল ইগো; ইংরেজ ম্যানেজারের
যেমন, পরবর্তী হিন্দুস্তানি ম্যানেজারেরও তেমন – সামনা করত ভয় ও চক্রান্ত নিয়ে, চুরি আর পায়ে-পড়া বিশ্বস্ততা নিয়ে
…
- অত ভারি ভারি শব্দ বোলো না, দেখেছ, কেমন হাঁপাচ্ছো,
এই কটা সিঁড়ি উঠে? … হ্যাঁ, বুঝলাম, তাদের সামলানো বেশি কঠিন ছিল।
আর এখন সব চাকুরের পরিবার চাকরিতে অভ্যস্ত, কায়দাকানুনগুলো জানে …
- ওই যেমন মেয়েটি বলল সবাই আমার দাদা, কাকা,
দিদি, মাসি … আগে এত সহজে ফিলিংটা আসত না।
- আগে তো ওই বয়সে ওধরণের পরিবারের মেয়েই আসত
না!
- হ্যাঁ … । দাঁড়ান একটু। ট্রেন আসতে দেরি আছে। একটু হাওয়া খেয়ে নিই। একটা
সিগরেট খেলেও আজকাল সবার অসুবিধে।
তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম
দেখা যাচ্ছিল ওভারব্রিজ থেকে – খালি, ইয়ার্ড থেকে
গাড়ি এখনো ঢোকে নি। তেমন কিছু হাওয়া না দিলেও গুমোটটা এখানে কম। তাদের মতো আরো অনেকেই
দূরে ইয়ার্ডের দিকে লক্ষ্য রেখে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমনকি যে বোর্ডটায় লেখা আছে,
ব্রিজে দাঁড়াবেন না, সেটাও ঢাকা পড়েছে অপেক্ষারত যাত্রীদের চাপে।
- আগেকার কমপ্লিকেশনগুলো কমেছে হয়তো, কিন্তু
একটা বড়ো ব্যাপার, যেটা থাকার কথা ছিল, আজ আর নেই।
- কী?
- গুড ফেথ! আমরা যখন চাকরিতে এসেছিলাম আমাদের
কানে বার বার ঢোকানো হয়েছিল ব্যাঙ্কের কামকাজের সবচেয়ে বড়ো নীতি – আর্টিকল অফ গুড ফেথ। আর এখন? প্রধান নীতি, কাউকে বিশ্বাস কোরো না।
প্রাণের বন্ধুকেও না। রুলস আছে, প্রোটোকলস আছে, ব্যস। মেনে চলো। শুধু নিজেরটুকু দেখে
চলো … (একটু দম নিয়ে) শুধু ব্যাঙ্কে বলে নয়। পুরো
সমাজে পুঁজিবাদী অর্থনীতি তৈরি করছে একা নিঃসঙ্গ ব্যক্তি, ফুল অফ ইনসিকিওরিটিজ! এটা
ঠিক যে তার প্রভাবে পুরোনো কমিউনিটি সেন্স … জাত বা ধর্ম
বা অঞ্চল, ভাষা যাই হোক … অনেকটা দুর্বলও
হয়ে পড়ছে। কিন্তু সেই পূঁজিবাদীদেরই নতুন রাজনীতি তো আবার ফিরিয়েও আনছে পুরোনো কমিউনিটি
সেন্স, ঐ যাকে আইডেন্টিটি পলিটিক্স বলে আজকাল!
- সে কথাও ঠিক। আরো টক্সিক। তবে সেটা সামাজিক
জীবনে বেশি সক্রিয়। ব্যাঙ্কের কাজেকর্মে আগেকার মতো তার প্রভাব … অন্ততঃ এখনো দেখি নি। তাদের আসল রাজনৈতিক লক্ষ্য তো ‘সত্তা মেঁ হিস্সেদারি’। আর বাম
রাজনীতি, ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রেণীসংগঠনে ভাঙন ধরানো … সেসব এমনিতেই এখন দুর্বল, সোভিয়েত সঙ্ঘ পড়ে যাওয়ার পর …
এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে
কোলকাতার ট্রেনটা এসে গিয়েছিল। ওদিকে তাকিয়ে বলল সুমন, “তবে তোমার ওই কুমুদ বলে মেয়েটি ভালো। ও এগোবে। … আসলে কী জানো? ঐ যে বাল্মিকীবাবু সততার কথা বলছিলেন না … সততার সাহসে বাস্তবের মুখোমুখি হওয়ার একটা মেজাজ মেয়েটির মধ্যে
আছে। ওর মতো মানুষদের তিনটে পি-এর দরকার পড়বে না। চাকরিতেও না, জীবনেও না।
- অজ্ঞান হওয়ারও দরকার পড়বে না। (হো হো করে হেসে
উঠল দুজনেই) বসুমল্লিকদাদা সেদিন গেছিল আপনার সঙ্গে দেখা করতে?
- হ্যাঁ।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে
জবাব দিল সুমন। আসলে নিজেই সে নিজের কথাটার ধরণে অবাক হয়ে পড়েছিল। এধরণের নীতিশাস্ত্রমূলক
কথা – ‘সততার সাহসে
বাস্তবের মুখোমুখি হওয়ার মেজাজ’ – তো সে বলে না! কিভাবে বলল? সত্যিই, আরো বেশি বয়সে গিয়েও কি আদৌ
এরকম থাকবে ওই অফিসার মেয়েটি? আর ওর সৎ বা সাহসী বা কর্মোৎসাহী থাকা না থাকার সঙ্গে
তার কী?
সে নিজে সৎ ছিল কেননা
সেটা তার জীবনের রুচিবোধ – ভয় বা সাহস কোনোটার
সঙ্গেই জুড়ে সে ব্যাপারটা ভাবেই নি কখনো। প্রয়োজনও হয় নি। সারা জীবন তো এওয়ার্ডস্টাফের
ইউনিয়ন করল, এখনও তারই সম্মেলনে যাচ্ছে, ম্যানেজার, ম্যানেজমেন্ট, এডমিনিস্ট্রেশন সৎ
হোক আর চোর হোক, তাদের নিজেদের ইস্যুগুলো নিয়েই কাজ … ! প্রয়োজনে কোথাও ঘুষ দিতে বা দেওয়াতে, বা, এমনকি চোরকে তোয়াজ করতেও
তার কখনো বাধে না। কাজগুলো হাসিল হওয়া উদ্দেশ্য। আর নতুন জমানাতে এওয়ার্ডস্টাফের সংখ্যা
যেমন ক্ষীণ হচ্ছে, তাদের ইউনিয়নগুলোর লড়াইয়ের ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে – সেটাই প্রধান চিন্তা, তার এবং সবার!
অথচ কেন যেন ওভারব্রিজের
সিঁড়িতে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর পাশ দিয়ে, মাঝেমধ্যে তাদের কাঁধে ভর দিয়ে উঠতে উঠতে
তার মনটা অব্যক্ত এক প্রতিশ্রুতিতে ভরে উঠছিল …
আফরোজের চিৎকারে
চমক ভাঙল, “দাদা, নিচে চলিয়ে, ট্রেন ঘুস রহা হ্যয়!”
১৪.৩.২৫
No comments:
Post a Comment