Monday, April 29, 2024

হে মার্কেট স্কোয়্যার – সেদিন আর আজ

‘মে দিবসের ইতিহাস’ বলতেই সবচেয়ে আগে ১৮৮৬ সালে যুক্তরাজ্য আমেরিকার শিকাগোর ঘটনাগুলো চোখের সামনে চলে আসে। আর সে ঘটনাগুলো মোটামুটি অনেকেই জানে। কিছুটা আমিও জানতাম এবং তাই কৌতূহল জেগেছিল জানার যে সেই হে-মার্কেট স্কোয়্যারটা কী হলো? আছে, তেমনই? কোনো স্মারক নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছে! কেমন দেখতে সেই স্মারকটা? এই সব ভাবতে ভাবতেই ইন্টারনেট ঘাঁটতে শুরু করেছিলাম আট বছর আগে। যা পেয়েছিলাম সে তথ্যগুলো একটা হিন্দি লেখায় সাজিয়ে ট্রেড ইউনিয়নের বন্ধুদের দিয়েছিলাম। সে লেখা থেকে মে-দিবস এবং আট ঘন্টা কাজের দিনের জন্য লড়াই ইত্যাদি প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুধু হে-মার্কেটের কথা যেটুকু জানতে পেরেছি সেটুকু বলছি।

বলার কারণ, স্মৃতি রক্ষা করা আজ অনেক বড় একটা বৈপ্লবিক দায়িত্ব। উত্তর-সোভিয়েত যুগের লুটেরা আন্তর্জাতিক পূঁজি যেমন যেমন সঙ্কটের সম্মুখীন হচ্ছে, মানব সমাজে আরো একটা দিনও অস্তিত্বে থাকার ন্যূনতম বৈধতা হারিয়ে ফেলছে তাদের পূঁজিবাদ, তেমন তেমন তারা প্রত্যেকটি দেশের প্রতিক্রিয়ার সবচেয়ে নিচুতলার শক্তিগুলোকে শাসকশক্তি হিসেবে বসাবার উদ্যোগ নিচ্ছে – আর সেই উদ্দেশ্যে গড়ে তুলছে ইতিহাসহত্যাকারী বিকৃত আখ্যানসমূহ।

মানুষের দেড় শতাব্দীর বৈপ্লবিক ইতিহাসের বহু স্মৃতিচিহ্ন আছে রোজকার চলার পথের আশে পাশে। সেগুলো তাদের বিকৃত আখ্যানকে সত্য বলে প্রচারে বাধা সৃষ্টি করে। তাই সেই স্মৃতিচিহ্নগুলো লোপাট করার ষড়যন্ত্র চলে প্রতিদিন। লেনিনের মূর্তি ভাঙা হয়, আম্বেদকর ও পেরিয়ারের মুর্তি ভাঙা হয়। জালিয়াঁওয়ালাবাগের দেয়ালে গুলির দাগ মুছে ফেলা হয়। রবীন্দ্রচৌককে হঠাৎ একদিন অটলচৌক করার প্রস্তাব নেওয়া হয়। যেটা আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল এক চৌমাথা, অনেক ঘটনার সাক্ষী, পথনির্মাণ বিভাগের হঠাৎ নেওয়া প্রস্তাবে তার ওপর দিয়ে উড়ালপুল নিয়ে যাওয়ার সময় চৌমাথাটা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। অনেক দিন পরে কারো খেয়াল হয়, আরে ওখানে একটা স্মৃতিফলক ছিলো না? কোথায় গেলো? … অনেক গানের কথা হারিয়ে গেছে, সুর হারিয়ে গেছে, গাইতে জানা মানুষ হারিয়ে গেছে … আন্তর্জালিক তথ্যের ভিড়ে চাপা পড়ে গেছে এমনকি অনেক বোধ, রোমাঞ্চ, বিস্ময়!

আর তাই, স্কুল বইয়ের পাতায় যেমন, আশে পাশের মাটিতেও তেমন, এক একটি স্মৃতি ও স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা করা আজ অনেক বড় একটা বৈপ্লবিক দায়িত্ব। হে-মার্কেট স্কোয়্য্যারের স্মৃতি নিয়ে সংগ্রামের কথায় আসার আগে বলে নিই শহীদদের সমাধিতে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করারও একটা লড়াই ছিলো।

শহীদদের মৃতদেহ কবরস্থ করা হয় ১৮৮৭তে। তার ছয় বছর পর ১৮৯৩এ তৈরি হয় স্মৃতিস্তম্ভ। তাও সরকারি নয়, শহীদদের পরিবারবর্গকে সাহায্য করার জন্য তৈরি হওয়া এক নাগরিক সংগঠন উদ্যোগ নেয়। শ্রমিক ও সহানুভুতিশীল নাগরিকদের মাঝে চাঁদা তুলে অ্যাালবার্ট ওয়েইনার্ট নামে এক ভাস্করকে দিয়ে তৈরি করানো হয় স্মৃতিস্তম্ভটি, যার নিচে লেখা আছে, কোর্টে স্পাইসের সেই বিখ্যাত উক্তি, “সেদিন আসবে, আজ যে কন্ঠস্বরগুলোকে তোমরা রোধ করছো, তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হবে সে কন্ঠগুলোর নীরবতা” (The day will come when our silence will be more powerful than the voices you are throttling today)।

হে-মার্কেটের ঘটনায় মামলার রায় বেরুবার পর থেকেই সারা আমেরিকায় ও ইয়োরোপে অভিযোগের ঝড় উঠেছিলো যে মামলা সাজানো হয়েছে, অভিযুক্তদের সঙ্গে ন্যায় করা হয় নি। মামলা যে ষড়যন্ত্র ছিলো সে আভাস খোদ ১৮৯৩এর স্মৃতিস্তম্ভের পিছনেই লেখা আছে। পিছনে শহীদ ও জেলে মৃতদের নামের সূচির নিচে তখনকার ইলিনইস (শিকাগো ইলিনইস রাজ্যেরই শহর) গভর্নর জন পিটার আল্টগেল্ডের উক্তি উদ্ধৃতঃ

“এই অভিযোগগুলোর প্রকৃতি ব্যক্তিগত, এবং সেকথাটার আভাস আমার সামনে রাখা কাগজপত্রে আর মামলার বিবরণীতে থাকায় বোঝা যায় সে মামলাটা ন্যায্য ছিলো না। তবুও আমি ঐ মামলার বৈশিষ্টগুলো নিয়ে আর আলোচনা করতে চাই না, কেননা তার প্রয়োজন নেই। আমি নিশ্চিত যে আগে বলা কারণ অনুসারে পদক্ষেপ নেওয়া আমার কর্তব্য। আর তাই স্যামুয়েল ফিল্ডেন, অস্কার নীবে আর মাইকেল শোয়াবকে আজ ২৬শে জুন ১৮৯৩এ আমি সম্পূর্ণ মার্জনা প্রদান করছি।”

মজার কথা, এত সব সত্ত্বেও সরকারের তরফ থেকে সেখানে কোনো ফলক লাগানো হলো না। সেটা লাগাতে পেরিয়ে গেলো প্রায় একশো বছর। ১৯৯৭ সালে এই হে-মার্কেট শহীদ স্মারক ইউএস ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিসের হিস্টোরিক ল্যান্ডমার্ক ঘোষিত হলো। তখন সেখানে বসানো হলো সে-সম্পর্কিত ফলক।

কিন্তু কীভাবে হলো?

আসুন, গোরস্তান থেকে বেরিয়ে আগে শহরে হে-মার্কেট স্কোয়্যারে গিয়ে পৌঁছোই।

আপনারা জানেন যে যুক্তরাজ্য আমেরিকার, পূঁজিবাদের আগের কোনো ইতিহাস নেই। আগের যে ইতিহাস, সেটা সাধারণ মানসে এখনো এতদূর অব্দি অস্বীকৃত যে মার্লন ব্রান্ডোর মতো বড়ো মাপের অভিনেতাও তাতে লজ্জিত হন, অস্কার আনতে নিজে না গিয়ে রেড ইন্ডিয়ানদের প্রতিনিধি এক মহিলাকে পাঠিয়ে দেন, আর তার মুখ দিয়ে মঞ্চে পড়ান তাঁর লিখিত ক্ষুব্ধ বয়ান। এবং নানান ভূরাজনৈতিক কারণে আমেরিকার পূঁজিবাদ উনিশ শতকের শেষে একটা বেশ স্বচ্ছন্দ বিকাশের নকশা দিতে থাকে। তাই পূঁজিবাদের মুক্ত দানবশক্তি হে-মার্কেট মামলার রায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটাকেই একটা নৈতিক অপরাধ সাব্যস্ত করে, ইলিনইসের গভর্নর আল্টগেল্ডের বিরুদ্ধে নির্বাচন প্রচারে কাজে লাগায়। পূঁজিপতিদের সমর্থক প্রশাসনের বক্তব্য প্রথম থেকেই ছিলো যে ১৮৮৬ সালের ৪ঠা মে, হে-মার্কেট স্কোয়্যারে, কয়েকজন ‘নৈরাজ্যবাদী’ জমা হয়েছিলো। তারাই বোমা ফেলেছিলো, তারাই দাঙ্গা করেছিলো যার পরিণামে ‘অসহায়’ এক পুলিসকর্মী শহীদ হয়। তাই হে-মার্কেট স্কোয়্যারের মাঝে, এক পুলিসের ৯ ফুট উঁচু ব্রোঞ্জের প্রতিমা বসিয়ে দেওয়া হলো। প্রতিমা তৈরি করানোর পয়সা দিলো কারখানামালিকদের ইউনিয়ন লীগ ক্লাব,আগামি ৪১ বছর অব্দি ঐ প্রতিমা ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

কিন্তু যতোই এ্যাটলান্টিকের ওপারে থাকো, পূঁজিবাদের সঙ্কট তোমায় ধরেই ফেলবে। যতোই গুন্ডা আর পিঙ্কারটন গার্ড লাগিয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে বুটের তলায় পিষে ফেলো, কম্যুনিস্ট, সোশ্যালিস্টদের বিরুদ্ধে পূঁজিবাদী ঘুষে পোষা মিডিয়া আর মধ্যশ্রেণীকে লেলিয়ে দাও, শেষ অব্দি পার পাবে না। মানুষের ভিতরের রাগ, ঘেন্না কোনো না কোনো রকম ভাবে বেরুবেই।

১৯২৯এর মহামন্দার দুবছর আগে, ৪ঠা মে ১৯২৭এ (তারিখটা লক্ষ্য করবেন) একটা ট্রামগাড়ি নিজের লাইন থেকে লাফিয়ে নেমে বেরিয়ে পুলিসের প্রতিমাটাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। চালক গ্রেপ্তার হলো। নির্বিকার! একবারও বললো না যে ব্রেক ফেল করেছিলো, বা স্টিয়ারিং পিনে গলদ ছিলো বা ভুল হয়ে গেছে মাপ করবেন হুজুর! কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নির্বিকার ভাবে বললো, “হাত উঁচিয়ে থাকা পুলিসটাকে দেখতে দেখতে বমি পেতো রোজ।”

১৯২৮ সালে পুলিস বিভাগ প্রতিমাটা আবার তৈরি করালো কিন্তু এবারে আর হে-মার্কেট স্কোয়্যারে বসালো না, ইউনিয়ন পার্কে রেখে দিলো। ১৯৫০এর দশকে এসে গেলো উড়ালপুলের জমানা। পুরোনো হে-মার্কেট স্কোয়্যারের আদ্ধেক অংশে খাম্বা বসিয়ে বেরিয়ে গেলো কেনেডি এক্সপ্রেসওয়ে। সেই সুযোগে ইউনিয়ন পার্ক থেকে পুলিসের মুর্তিটা উঠিয়ে আবার ঐ হে-মার্কেট স্কোয়্যারে (বেঁচে থাকা অংশটায়), এক্সপ্রেসওয়ের লাগোয়া একটা বেদি তৈরি করে বসিয়ে দেওয়া হলো।

১৯৬৮ সালে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সৈন্য-হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ চলছিলো। সে বছর, ঠিক ঐ ৪ঠা মে-তেই, অর্থাৎ হে-মার্কেটের ঘটনার ৮২তম বাৎসরিকে, পুলিস আর বিক্ষোভকারীদের মধ্যে হাতাহাতির সুযোগে কেউ গিয়ে প্রতিমাটায় কালো রঙ মাখিয়ে দিয়ে এলো। আবার পরের বছর, অর্থাৎ ৬ই অক্টোবর ১৯৬৯ তারিখে কে বা কারা যেন, প্রতিমাটার হাঁটুর মাঝে বোমা ফাঁসিয়ে, প্রতিমাটা উড়িয়ে দিলো। পরে এক বামপন্থী সংগঠন ঘটনাটার দায় নিলো।

এবার আবার ঠিক ঐ ৪ঠা মে-তেই, ১৯৭০ সালে নতুন প্রতিমা বানিয়ে বসানো হলো। কিন্তু দুদিন পর, ৬ই মে-তে, সেই আগের সংগঠনটাই, ঐ একইভাবে বোমা ফাঁসিয়ে প্রতিমা উড়িয়ে দিলো।

প্রতিমা আবার তৈরি হলো। আবার বসানো হলো। স্থানীয় মেয়র সাহেব এবার ২৪ ঘন্টা পুলিশ পাহারা লাগিয়ে দিলো। কিন্তু শেষে ক্লান্ত হয়ে পুলিস কর্তৃপক্ষ প্রতিমাটাকে উঠিয়ে সেন্ট্রাল পুলিস হেডকোয়ার্টার্সের উঠোনে বসিয়ে দিলো, ১৯৭৬এ সেটা চলে গেলো সেন্ট্রাল পুলিস আকাডেমিতে।

১৯৯২ সালে একটা নতুন ব্যাপার হলো। বোধহয় সোভিয়েত ইউনিয়নে ও পূর্ব ইয়োরোপে সমাজবাদকে পরাজিত করতে পারার আনন্দে সরকার শ্রমিকদের কিছু একটা দিয়ে নিজেদের বদান্যতা দেখাতে চাইছিলো। তাই হে-মার্কেট স্কোয়্যারের ঠিক সেই জায়গাটায় যেখানে শ্রমিক নেতারা একটা হাতগাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলো, একটা কাংস্যফলক লাগানো হলো। তাতে লেখা হলো, “শ্রম আর শিল্পের মাঝে এক দশক ধরে চলতে থাকা কলহের পরিণামে এখানে সাক্ষাৎ যুদ্ধ হয় যাতে শ্রমিক ও পুলিস, দুয়েরই মৃত্যু হয়। ৪ঠা মে ১৮৮৬ সালে ক্রেনের গলির মুখে শ্রমিক সমাবেশে শ্রোতারা একত্রিত হয়েছিলেন। দ্য প্লেইন স্ট্রিট ধরে আসতে থাকা পুলিসবাহিনীর ওপর গলির দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করা হয়। পরিণামে আটজন কর্মীর ওপর মামলা চলে। সেই মামলা পুরো বিশ্বের শ্রমিক আন্দোলনের নজর কাড়ে। ফলে অনেক শহরে ‘মে-দিবস’এর শ্রমিক সমাবেশ শুরু হয়।” [২৫শে মার্চ ১৯৯২ সালে মেয়র রিচার্ড এম ড্যালি কর্তৃক সমর্পিত]।

এই কাংস্যফলক বসানোর ১২ বছর পর, ১৪ই ডিসেম্বর ২০০৪এ, সেই মেয়র ড্যালি সাহেব, শিকাগো পুলিস ইউনিয়নের অধ্যক্ষ এবং অন্যান্য সঙ্ঘের নেতাদের হাতে, হে-মার্কেট স্কোয়্যারের ঐতিহাসিক স্থানে ব্রোঞ্জের এক স্মারক প্রতিমার অনাবরণ হলো। সেই স্মারক-প্রতিমা একটা হাতগাড়ি, যার ওপর দাঁড়িয়ে এক শ্রমিক নেতা ভাষণ দিচ্ছে, আরো দুজন পাশে দাঁড়িয়ে। আরেকজন প্রায় হামাগুড়ির অবস্থায়, নিচের ভিড়কে কিছু বোঝাচ্ছে। নিচে, মাটি থেকে আদ্ধেক বেরুনো চারজন, তারা হাতের জোরে হাতগাড়িটাকে সোজা করে রেখেছে কেননা গাড়ির পেছনের চাকাদুটো মাটিতে নেই। – অবশ্যই কিছুটা বিমূর্ত, আমার বিশেষ পছন্দও নয়। আমাদের দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরি থাকতে এসব পছন্দ করতে যাবো কেন? তবুও, মেরী ব্রগারের তৈরি করা এই প্রতিমা স্থাপনের পর, হে-মার্কেট স্কোয়্যার অন্ততঃ তার ইতিহাস ফিরে পেয়েছে।

ওখানে এখন একটা শ্রমিক পার্ক প্রস্তাবিত, যে পার্কের ভিতরে একটি আন্তর্জাতিক স্মৃতি-প্রাচীর গড়ে তোলা হবে, ভিতরের হাঁটাপথের পাশে পাশে ফলক থাকবে, একটা উঁচু সাংস্কৃতিক মিনার থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এতো পরিচিত মানুষ শিকাগো যায়, ফেসবুকে ছবি আপলোড করে, কাউকে হে-মার্কেট স্কোয়্যারের কোনো ছবি পোস্ট করতে দেখি নি। যাই হোক, ভালো লাগে ভাবতে, আট ঘন্টা কাজের দিনের লড়াই, মে-দিবসের লড়াইয়ের ঐতিহাসিক স্মৃতিকে শেষ পর্য্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছে আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণী এবং বিবেকসম্পন্ন মানুষেরা।       

Saturday, April 20, 2024

উত্তরাধিকার

এমনও থাকে কিছু ব্যথা,
কাটিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে না
যেন একটু খুঁড়িয়ে চলাই আমার
নায়কোচিত চলন, অন্ধকার ফুঁড়ে ঢুকে
ভীতিসঞ্চার করি খলনায়কের অহমিকায়
দুধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে
পাশে দাঁড়ানো বাচ্চাটার ঝাঁকড়া চুলে
বুলিয়ে হাত
প্রেয়সীর গলির দিকে উঠে যাই
ক্যামেরা পিছু নেয়
 
অনেক না-পাওয়া না-পারা আমার ব্যথার
উত্তরাধিকার
সে অসহায়তা চলবে
উত্তরাধিকার খোয়াবো না
যেমন লাহোরের পাড়ায় রাতে দশবাড়ির
জোড়াছাতে মায়েদের মজলিস
যেমন গোয়ালন্দের ভেজা জেটিতে কাদায়
পিছন থেকে ডাক
যেমন মৃত্যুর পাহাড়গুলো
 
যেমন সেদিন ওই বীভৎস মৃত্যু আসিফার
যেমন অন্যায়ের জনসভা প্রতিদিন
যেমন লাঞ্ছনার কীর্তিগান আসমুদ্রহিমাচল
 
অবসন্ন নই
বস্তুত এই খুঁড়িয়ে চলা, একটু হাঁপানো
বা হয়তো চোখের কালসিটে, ঘাড়ে কাটা দাগ
এসবকেই নায়কোচিত করে তোলার
অনুশীলন করছি ওদের প্রতিটি চিত্রনাট্যে
 
২০.৪.২৪

 

অবসাদ

অবসাদের যে কতো রূপ!
কয়েক বছর ধরে দেখছি পুরো পাড়াটার অবসাদ
গলির মুদির দোকানে জিনিষের
দাম হয়ে ঢুকছে!
আবার দেখলাম পাড়ার মন্দিরে
আশার উপদেষ্টা হয়ে বসছে অবসাদ।
চল্লিশ বছর আগে পাড়াটায় বিয়ে হয়ে আসা
অনেক বৃদ্ধার চোখে দেখেছি, সকালে,
মেন লাইনের প্যাসেঞ্জার ট্রেন হয়ে অবসাদ
পেরিয়ে যাচ্ছে পুরোনো মসজিদ, যাযাবর বস্তি।
আকাঙ্খাকে দেখেছিলাম সুন্দরী কিশোরী হয়ে
কোনো নতুন ভাড়াটে বাড়িতে ঢুকতে।
আজকাল তার ফেস-ওয়াশ হয়েছে অবসাদ।
কিছু বয়স্ক পুরুষাঙ্গসমষ্টি
নজরে রাখে তাকে। 
অবসাদ ভালোবাসাও হয় জানি।
কিছু রাত আগে সে আমায় 
আধ-কান্না আধ-সমকামী হয়ে টলতে টলতে
ধাক্কা মেরেছিলো।
এখনো খারাপ লাগে তাকে কাছে টানতে পারিনি।
 
১৯.৪.২৪

Wednesday, April 17, 2024

দর

পরিস্থিতি স্বাভাবিক মুনাফার দর!
অস্বাভাবিক বলতে, আরো বেশি দর!
মারি-খরা-বন্যা-যুদ্ধ! শুভ, শুভ, শুভ!
দরে রং ছড়ায়, রাষ্ট্র-মুকুট-কৌস্তুভ!  
জলজঙ্গলজমিতে মুনাফার রথ,
গ্রামসভা ভাঙে, পোষে আইনআদালত!
সংবাদে-সম্প্রচারে সময় স্বাভাবিক
বলার খেলায় ঘোরে বড় জয়স্টিক।

দেশ নাকি মা! ধর্মাতুঁড় করে আলো,
মাতৃধর্ষক করাল প্রজাতি জন্মালো!
নিজেদেরি গণতন্ত্র উলঙ্গ নামিয়ে
খুললো দাসবাজার স্বপ্নে ঠোনা দিয়ে!
আনন্দশিহরণ জাগায় উন্নয়নকথা
ঘেয়ো কোমরে বেড়ির স্বর্ণশীতলতা।
 
৬.৪.২৩

Monday, April 15, 2024

লেনিন আছেন

লেনিন আছেন প্রতিমুহূর্তে আমার তোমার পাশে,
লেনিন আছেন সময়টা নিয়ে সন্দেহে বিশ্বাসে,
মিছিলে এগোতে, মনে রাখি যেন, বুকের আড়ালে তাঁকে
নিয়ে পৌঁছোলে শুরু হবে ক্লাস সন্ধ্যার অবকাশে!
 
প্রথম প্রশ্ন তিনি করবেন, কোত্থেকে শুরু বলো।
মনে আছে তো, সোভিয়েতরাজ, প্রথম কিসে পিছোলো?
কঠিন যুদ্ধে ভুল ক্ষমাহীন! তবু সে বিশ্ব-নজির
নতুন শতকে কাজে চেতনার আঁধার গুঁড়িয়ে চলো!
 
যেমন মায়ের কোলে মুখ রাখা আদর চাওয়ার রীতি,
মানুষের পাশে বসা, দায় নয় মাথার, জীবনগীতি!
পৃথিবীকেই যে ধ্বংস করছে মুনাফাবাজির লোভ,
তার শাসনের শেষ চাই! সেটা বলবে কম্যুনিস্টই!
 
লেনিন আছেন শ্রমজীবীদের ঐক্য গড়ার তাড়ায়,
বিভ্রান্তির প্রত্যহে ভালো বন্ধুর কড়া নাড়ায়।

১৫.৪.২০২৪ 

 

Friday, April 12, 2024

বাবাসাহেব

জানি এটা ঠিক কবিতা নয়। মগজের খিল, তা' খুলবো! 
ব্যক্তিগত আমায় বলে নি কেউ – মগটা ছুঁবি না, হাত পাত্‌!
আম্বেদকরকে এমনকি সহ্য করতে বুক ফাটে ওদের!
ওই যারা পদবী লুকিয়ে বলে স্মার্ট  আমরা মানিনা জাত!
 
সমাজটা সোজা নয়; বিদ্যাসাগরী মাটিতেই, তবু স্বতন্ত্র
বিদ্যালয় খুললেন গুরুচাঁদ!  বুঝেছিলেন রবিঠাকুর!
নবোন্নয়ন কৌলিন্য খোঁজে, কুলগর্ব, বর্ণভেদ আম্বানির
লন্ডনে কেল্লার লোভ; হায়দ্রাবাদে ভেমুলার নিঃশ্বাসে ক্ষুর। 
 
ব্যানারের নিচে দেখে ভিড়, চৌখস মুখের, গুলিয়েছি দেশ।
দেরিতে পৌঁছেছি তার কাছে, মিছিলে যার মুখের প্রয়োজন!  
কাটিয়েছি একঘেয়েমি অনেক, ঐক্যগানে, তবু ঘনিয়েছে
জাত-ধনের মৌরসীপাট্টা ধরে  রামনামে কম্পানি-শাসন!
……
ভেবেছিলো ঢুকতেই দেবে না। যোগেন মন্ডলেরা ঢোকালেন।
মুক্তি না হোক, সংবিধানে তিনি যুদ্ধের কবচ বানালেন।  

১২.৪.২০২৪

আউটপোস্ট

সৈনিক সে!
তাকে ভালোবাসি!
যুদ্ধে এগোতে জানে
নিশ্চয়ই।
তবে তার চেয়ে অনেক
বড় সত্য, সে
শান্তি গড়তে জানে।
 
আটার র‍্যাশন নিয়ে
শিবিরে পৌঁছে
পুরোনো ভাঙা ফিল্ডগানের
গা থেকে খুলে আনে
দুটো স্টিলপ্লেট,
নদির জলে ধুয়ে
আউটপোস্টের পিছনের
পড়ন্ত বেলার দিকে তাকিয়ে
ভাবে,
একটা হল তাওয়া
আরেকটা হল চাকি
ভাঙা পাইপটা হোক
বেলন
দুটো পাথরের ফাঁকে
শুকনো কাঠে-ঘাসে
ধরানো আগুনে
তার রুটিতে ধরে রঙ;
 
ছুটির বেলায়,
\ঝাঁটার দুটো কাঠি দিয়ে
উল বোনে সে!
লড়াইগুলো থামে না;
অনুক্ষণ যোঝার স্পর্ধায়
প্রৌঢ়ত্ব খিলখিলিয়ে ওঠে
রোদে মায়ের ছোঁয়ায়
 
সে জানে, সে একা নয়।
কেউ একা নয়,
কোথাও।
 
ব্যাঙ্গালোর, ২০১৯

Tuesday, April 9, 2024

অঘোরকামিনী দেবী

[বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া ভারতের হাজার হাজার মহীয়সী নারীদের একজন, ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের মা অঘোরকামিনী দেবী। তাঁর জীবন সম্পর্কে তথ্য যোগাড় করার একমাত্র আকর-বই, স্ত্রী বিয়োগে শোকাকূল তাঁর স্বামী প্রকাশচন্দ্র রায়ের লেখা স্মৃতিচারণ ‘অঘোর-প্রকাশ’। ‘অঘোর-প্রকাশ’ এক অসামান্য প্রেমগাথা। সে প্রেমগাথায় কর্মই সাধনা এবং যুগ্ম সাধনাই প্রেম। সে বইয়ের বাইরে, ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের বাবা-মায়ের জীবন সম্পর্কে, অন্ততঃ তাঁর জন্মের আগে অব্দিকার ঘটনাবলি সম্পর্কে আজ যে বইয়েই কোনো তথ্য থাকুক, তার উৎস ও আকর ওই একটিই বই। এখানে আমিও সে বইয়েরই সাহায্য নিয়েছি। ]

অঘোরকামিনী দেবীর জন্ম বাংলার পুরোনো ২৪ পরগণা জেলায়, শ্রীপুর গ্রামে। জন্মতারিখ জানা যায় না, তবে ইংরেজি ১৮৫৬ সালের এপ্রিল বা মে মাসে (বাংলা হিসেবে বৈশাখে), এক জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল। (কন্যাসন্তান এবং গ্রাম্য বলেই যে জন্মতারিখ জানা যায় না, প্রকাশচন্দ্রের এ আক্ষেপ উপরুল্লিখিত বইটাতে আছে।) তাঁর পিতার নাম বিপিনচন্দ্র বসু। মায়ের নামও একই কারণে, অর্থাৎ স্ত্রীজন্মের কারণে জানা যায় না। জমিদার পরিবারের বিষয়-আশয় যা ছিল, ছিল, বিপিনচন্দ্র নিজেও ঠিকেদারী করে উপার্জন করতেন। গ্রামেরই রায় পরিবারের ছেলে প্রকাশচন্দ্রের সাথে তিনি তাঁর বড় মেয়ে অঘোরকামিনীর বিয়ে দেন। অঘোরকামিনীর পর তাঁর আরো তিন সন্তান ছিল জানা যায় – অঘোরকামিনীর পরে দুই বোন (একজনের নাম যামিনী) এবং এক ভাই (জ্ঞান)। মা বাড়ির অন্যান্য সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হতেন তাই বালিকা অঘোরকামিনীর আশ্রয়স্থল ছিলেন বড়পিসী। 

প্রকাশচন্দ্র গ্রামের ছেলে হলেও গ্রামে থাকতেন না। তাঁর পিতা প্রাণকালী রায় বহরমপুর কালেক্টরিতে কাজ করতেন। সেখানেই প্রকাশচন্দ্রের জন্ম এবং প্রাথমিক স্কুলজীবন কেটেছিল। পিতার মৃত্যুর পর স্কুলের পড়া চালিয়ে যেতে তিনি কিছুদিনের জন্য কলকাতা যান। প্রবেশিকার পর আবার বহরমপুরে ফিরে এসে কলেজের পড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই গ্রাম থেকে বিয়ের জন্য ডাক আসে।

১৮৬৬ সালে যখন অঘোরকামিনীর বিয়ে তখন তাঁর বয়স ছিল দশ বছর আর বর প্রকাশ্চন্দ্রের আঠেরো বছর। উপরে উল্লিখিত বইয়েই প্রকাশচন্দ্রের স্মৃতিচারণে অঘোরকামিনীর শৈশবের যে বিভিন্ন ঘটনাগুলো জানা যায়, তাতে বোঝা যায় যে শৈশবে নিরক্ষর থেকে যাওয়া মেয়েটির ভিতরে কী অদম্য কৌতূহল অথচ বালিকাবয়সে বিরল চপলতাবিরুদ্ধ স্বভাব, মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং শিক্ষার প্রতি আগ্রহ জন্ম নিচ্ছিল। তারই সঙ্গে বেড়ে উঠছিল সেবাভাব এবং হাল ধরার ক্ষমতা।      

কয়েকটি গল্প আছে।

বসু পরিবার আর রায় পরিবারের বাড়ি গ্রামে কাছাকাছিই ছিল। এমন যে এক বাড়ির ছাত থেকে আরেক বাড়ির উঠোনের কিছু অংশ বা একটা ঘরের জানলা দেখা যায়। তখনকার নিয়মে বিয়ের আগে বর বৌয়ের দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ থাকত না। প্রকাশচন্দ্র গ্রামেই বড় হলে নাহয় খেলার মাঠে বা পথে দেখা হতে পারত। কিন্তু সে আজন্ম বহরমপুরের ছেলে। তাই বাবার মুখে নিজের বিয়ের সিদ্ধান্ত শোনার পর এক দিন বালিকা অঘোরকামিনী ছাতে চলে গেলেন – রায়বাড়ির উঠোনে উঁকি মেরে দেখবেন তাঁর বরটিকে দেখতে পাওয়া যায় কিনা। উঠোনটা ভালো করে দেখতে গিয়ে খেয়াল থাকল না কখন ছাতের বাইরে। ধড়াম করে সোজা আছাড় খেলেন নিচে। যদিও বেশি আঘাত পেলেন না কেননা ঠিক সেখানেই নিচে গাছের কাটা ডালপাতা জমা করে রাখা ছিল। যদিও প্রকাশচন্দ্র নিজের ভাবী বৌটিকে বিয়ের ক’দিন আগে একবার গ্রামের পথে দেখেছিলেন।

বিয়ে হল। শ্বশুরবাড়ি এলেন। বিয়ের রাতে হোক বা পরের দিন শ্বশুরবাড়ি হোক, দু’তিনদিনে একটা কথা বললেন না বরের সাথে। যখন নাকি যুবক বরটি সুযোগ সুবিধে মত বার বার কাছে আসছিলেন একটিবার বৌয়ের মুখে কথা শোনার জন্য। অথচ এমন নয় যে বিয়ে পছন্দ হয় নি। নইলে, বাপের বাড়ি যাওয়ার আগের রাতে গম্ভীরভাবে বলতেন না, “কাল আমি চলে যাব!” ওটুকুতেই বরটি কৃতার্থ। ওই যে বললাম, ভিতরে ভিতরে কৌতূহল থাকলেও, বালিকাবয়সে বিরল, চপলতা-বিরুদ্ধ স্বভাব হয়ে গিয়েছিল, বয়সের তুলনায় একটু বেশি গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। হয়ত বাড়ির বড় মেয়ে হওয়ার জন্য। ভাইবোনদের দেখাশোনার কাজে ব্যাপৃত থাকার কারণে।

বিয়ের কিছুদিন পরেই গ্রামে বসন্ত রোগ ছড়িয়েছিল। বিপিনচন্দ্র বসু বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। তখন প্রকাশচন্দ্রও গ্রামে নেই; কলেজের ক্লাস করতে বহরমপুরে ফিরে গেছেন। অঘোরকামিনী একাই শ্বশুরবাড়ী থেকে ছুটে বাবাকে দেখতে চলে এলেন। ছোঁয়াচে রোগের তোয়াক্কা না করে বাবার মৃতদেহ জড়িয়ে ধরলেন। ফলে তাঁকেও বসন্ত রোগে ধরল। বোন যামিনী এবং ভাই জ্ঞানেরও বসন্ত হল। দুই বোন সেরে উঠলেও ভাইকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি পড়ে গেল। সেই দশ বছর বয়সে অঘোরকামিনী নিজের দায়িত্বে ভাইকে নিয়ে ভবানীপুরে দিদার বাড়িতে চলে এলেন। সেবা শুশ্রূষায় তাকে বাঁচিয়ে তুললেন; যদিও সে একটা চোখ হারাল রোগে।

সে সময়কার আরো একটি গল্প প্রকাশচন্দ্র শুনিয়েছেন। অল্পবয়সেই অঘোরকামিনী রান্নার কাজে পটু হয়ে উঠেছিলেন। গ্রামে কুটুমদের বাড়িতে কোথাও বড় কাজ হলে তাঁর ডাক পড়ত। একবার এক বাড়িতে গেছেন। রান্না হয়ে গেলে উঠোনে এসে দেখলেন, যে সব মহিলারা ভালো জামাকাপড়, গয়না-টয়না পরে আসছেন তাঁদের খুব যত্ন-আত্তি হচ্ছে। অথচ যাঁরা সাধারণ জামাকাপড়ে, গয়না ইত্যাদি না পরে আসছেন তাঁদেরকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। খাওয়ার সময়েও একই ব্যাপার দেখতে পেলেন। খুব আঘাত পেলেন অঘোরকামিনী। প্রকাশচন্দ্র বলছেন, “ধনের প্রতি এত সমাদর? এ কি অন্যায়! সেই দিনই তোমার সংকল্প হইল, তুমি যথাসাধ্য দুঃখীর সহায়তা করিবে।”

নিজেদের বাড়িতে কোনো রকম আর্থিক অভাব ছিল না। আর্থিক অভাব শ্বশুরবাড়িতেও ছিল না কিন্তু প্রাণকালী রায়ের মৃত্যুর কিছুদিন পর প্রকাশচন্দ্রের বড়দাদা আর সেজদাদার মধ্যেকার কলহে সম্পত্তি বিক্রি হওয়া শুরু করল। একদিন অভাব আর দুশ্চিন্তা, কোর্টকাছারির হাঙ্গামা ঘিরে ধরল পরিবারটাকে। এদিকে বালিকা বধু অঘোরকামিনীর আপন বলতে কেউ নেই। বাবা আগেই গত হয়েছেন, মা নিরুপায় আর বর বহরমপুরে। তা সত্ত্বেও পরিবারের ছোট বউ অঘোরকামিনীর চেহারায় ভাঁজ পড়ল না। মুখ বুজে সংসারের সব কাজ করে যেতে লাগলেন, ভুল করলে গঞ্জনাও সহ্য করতেন।

এরই মধ্যে কিছুদিনের জন্য বরের সঙ্গে থাকার সুযোগ হল। প্রকাশচন্দ্রের সেজদা তাঁর নতুন বউয়ের সাথে বহরমপুর থেকে কলকাতা চলে গেলেন। এদিকে প্রকাশচন্দ্র এফ এ পরীক্ষার পর, বাড়ির দুরবস্থা এবং মানসিক অবসাদের কারণে বিএ পরীক্ষা আর দিতে পারেন নি। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং কোথাও চাকরিও জোটে নি। তাই ফিরে এলেন শ্রীপুর, নিজেদের গ্রামে। রাতে বৌকে নিয়ে বসতেন লেখাপড়া শেখাতে। সংসারের কাজ তো ছিলই। তবু তারই মধ্যে অঘোরকামিনী রাতে বরের কাছে লেখাপড়া শেখা শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যে বর্ণমালা, প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ শেষ করে ফেললেন। ভাষা শেখানোর সাথে সাথে সদ্য ব্রাহ্ম মতে দীক্ষিত প্রকাশচন্দ্র বৌকে ধর্মজ্ঞান, নৈতিক মূল্যাদির পাঠ ইত্যাদি শেখাতে লাগলেন।

তাঁদের প্রথম সন্তান, সুসারবাসিনীর জন্ম শ্রীপুরেই হল। এ নিয়েও একটা গল্প আছে। প্রথম সন্তানের জন্মের সময় অঘোরকামিনীকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আট মাসের গর্ভ নিয়ে অঘোরকামিনী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রকাশচন্দ্রও সে সময় পাশে নেই। ওদিকে শ্বশুরবাড়িতে কিছু সমস্যাও চলছিল। কলকাতা থেকে সেজবৌদির  মারা যাওয়ার খবর এসেছিল। অঘোরকামিনীর জ্বর এত বেশি হল রাতে যে ডাক্তার এসে বললেন প্রসূতির প্রাণ বাঁচাতে গর্ভ নষ্ট করতে হবে। সে কাজে গ্রামের ডাক্তারকে সাহায্য করার জন্য টাকী থেকে বড় ডাক্তার ডাকা হল। কিন্তু রাতে নদীতে ঝড় উঠল, বড় ডাক্তার আসতে পারলেন না। অঘোরকামিনী সবকিছু নিয়ে অত্যন্ত বিচলিত ছিলেন। তীব্র জ্বরের মধ্যেও মনে মনে সংকল্প করেছিলেন যে গর্ভ নষ্ট করতে উনি কাউকে দেবেন না। সন্তানের জন্ম দেবেনই। সে ঝড়ের মধ্যেই রাত দুটোয় ব্যথা উঠল। কোনো শব্দ না করে, কাউকে না ডেকে অঘোরকামিনী দোতলা থেকে নেমে নিচে সেই ঘরটায় পৌঁছে গেলেন যেটাকে পরিষ্কার করে পরের দিনের গর্ভপাতের অপারেশনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। সেখানেই রাতে একা অঘোরকামিনী সাধারণ প্রসবে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন। সকালে যখন ডাক্তার পৌঁছোলেন হতবাক হয়ে গেলেন। দেখলেন বাড়িতে আনন্দের হাওয়া। যে শিশুটিকে বধ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল নবজাত সে শিশুটি কাঁদছে আর তার মা, জ্বরের মধ্যেও হাসছে। এও ঘটনাতেও অঘোরকামিনীর দৃঢ় মনোবলের পরিচয় পাওয়া যায়।

আরেকটি প্রসঙ্গ এখানেই বলে নিতে হয়। ইতিমধ্যে প্রকাশচন্দ্র ঈশ্বরে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নানারূপ সঙ্কট পেরিয়ে শেষে বহরমপুরেই ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন। ১৮৭০ সালের শীতের ছুটিতে গ্রামে গেছেন। স্ত্রী ব্রাহ্ম নন, ব্রাহ্মধর্মের বিন্দুবিসর্গও জানেন না। প্রথম বরের মুখে সেসব কথা শুনে হাসাহাসি করতেন। শেষে প্রকাশচন্দ্র কষ্ট পাচ্ছেন দেখে চুপ করে যেতেন। ধীরে ধীরে প্রকাশচন্দ্র স্ত্রীকে ব্রাহ্মধর্মমত বোঝাতে শুরু করলেন। বিশেষ পড়াশোনা না থাকলেও, স্বামীর ধর্মই স্ত্রীর ধর্ম এই মনোভাবে স্বামীর কথাগুলো গ্রহণ করতেন। স্বামীর সঙ্গে প্রার্থনায় বসতেন।

পরের বছরের শুরুতেই প্রকাশচন্দ্রের ভাইঝির বিয়ের তোড়জোড় শুরু হল। সে এলাকার নিয়মানুসারে বিয়ের আগের দিন জলসওয়া বলে একটি অনুষ্ঠান হত। পাঁচ বাড়ি থেকে জল ভিক্ষা করে এনে সে জলে কন্যাকে স্নান করাতে হত। জলভিক্ষার কাজে বাজনদারেরা বাজনা বাজাত এবং বৌরা গ্রাম্য গান গাইত। সে গান সদ্যব্রাহ্ম প্রকাশচন্দ্রের ‘কুৎসিত’ মনে হত। তাই তিনি স্ত্রীকে এ কাজে যোগ দিতে বারণ করলেন। স্বামীর কথা অঘোরকামিনী মেনে নিলেন। এর পরের ঘটনা ‘অঘোর-প্রকাশ’এ প্রকাশচন্দ্র ভাইঝি বসন্তের লেখা পরবর্তীকালের কোনো স্মৃতিচারণ (সূত্র অপ্রাপ্য) থেকে উদ্ধৃত করেছেন, “আমার বিবাহ ১২৭৭ সালে ১৬ই ফাল্গুন সোমবার হয়। আমার বয়স তখন ১১ বৎসর। জলসওয়ার জন্য কাকিমাকে অত্যন্ত নির্য্যাতন সহ্য করিতে হইয়াছিল। বিবাহের পূর্বদিন রাত্রে জলসওয়া এবং সকালে বড়ি দেওয়া ও ক্ষীর করা হয়। ঐ দিন ঠাকুর মা কহিলেন, ‘বসন্তর মা নাই এবং এখানে অন্য খুড়ী জেঠাই নাই; শাস্ত্রের সমুদয় তোমাকেই করিতে হইবে। যদি না কর, তাহা হইলে বাড়ী হইতে দূর হও। যদি কন্যার কোন অমঙ্গল হয়, জানিতে পারিবে।‘ এই সময় সেজ জেঠাইমাও আসিলেন, ও বলিলেন, ‘ছিঃ তোমার লজ্জা হয় না? আঘাটায় যাইয়া গলায় কলসী বাঁধিয়া ডুবিয়া মর,’ ইত্যাদি। এত নির্য্যাতনেও কাকিমার বিশ্বাস অটল রহিল। সেদিন সমস্ত দিন কাঁদিয়া অনাহারে কাটাইয়াছিলেন। কাকিমা কেন এরূপ সকলের অবাধ্য হইয়াছিলেন, তখন কিছুই বুঝিতাম না। রাত্রে যখন জলসওয়ার সময় হইল, প্রথমে সকলেই তাঁহাকে ডাকিল। তিনি যাইতে অস্বীকার করিলে সকলে বলপূর্ব্বক টানিতে টানিতে লইয়া চলিল।” অর্থাৎ, অঘোরকামিনীকে দিয়ে বলপূর্বক করান হল। ফল কী হল? প্রকাশচন্দ্র সে রাতে নিজের স্ত্রীকে ঘরে ঢুকতে দিলেন না। পরে অবশ্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন। ‘অঘোর-প্রকাশ’এ লিখেছেন, “আমি আমার মনের ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করিবার অন্য উপায় না পাইয়া আমার ঘরের দ্বার বন্ধ করিয়া রহিলাম, রাত্রিতে যখন তোমাকে লইয়া সকলে ঘরে ফিরিলেন, আমি আর তোমাকে ঘরে আসিতে দিই নাই। তোমার দোষ ছিল না, আমি আর সকলের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করিতে না পারিয়া তোমাকেই আরো একটু কষ্ট দিলাম।”  

১৮৭২ সালের এপিল মাসে যখন অস্থায়ী পোস্টমাস্টারের চাকরি পেয়ে প্রকাশচন্দ্র বর্দ্ধমান গেলেন, তখন অঘোরকামিনীও মেয়েকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে ঘর করতে গেলেন। কিন্তু কয়েক মাস পর সে অস্থায়ী চাকরিটার মেয়াদ শেষ হল। প্রকাশচন্দ্র আবার চাকরি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বৌ আর মেয়েকে আবার গ্রামে রেখে এলেন। যদিও প্রকাশচন্দ্রের মা ছিলেন গ্রামের বাড়িতে, চাকরি ছিল না বলে সে সময়টা তাঁর স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে সেজদার আয়ে আশ্রিত হয়ে কাটাতে হয়েছিল। দ্বিতীয় কন্যাসন্তান সরোজিনীরও জন্মও শ্রীপুরেই, অঘোরকামিনীর বাপের বাড়িতে হল। এক বছরের বেশি সময় অঘোরকামিনীর শ্বশুরবাড়িতে কাটল। দুই মেয়ের দেখাশোনা ছাড়া – প্রকাশচন্দ্র নিজেই স্ত্রীএর জীবনকাহিনী ‘অঘোর-প্রকাশ’এ লিখছেন – “কুলবধুর সমুদয় কার্য, চিঁড়ে কোটা, গরুর জাব কাটা, এ সকলই তোমাকে করিতে হইত। সকালে উঠিয়া বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, গোবর দেওয়া, এ সকল তোমার নিত্য কর্ম ছিল।”

তবুও, এটা বলতেই হয় যে স্বামীর প্রতি তাঁর আনুগত্য নিছক পরম্পরাগত ছিল না, তার পিছনে ছিল তাঁর চরিত্রের শক্তি, ভালোবাসার একটা জোর। ছাপাখানার কাজ করার সময় একদিন নিজের মনের গ্লানিতে ভরা প্রকাশচন্দ্রের চিঠি পেয়ে অঘোরকামিনীর মনে হল স্বামী সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে কোথাও চলে যাবেন। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির কাজের লোককে ডেকে বললেন প্রকাশচন্দ্রকে বাড়ি নিয়ে আসতে। কাজের লোক বেণীদাদাও মানা করলেন, কিভাবে আসবেন এখন বাবুজি, কলকাতায় কাজকর্ম করছেন, বাড়িতেই বা পয়সা কই যে বেণীদাদা কলকাতায় যাবেন। শুনে গলার হারটা খুলে দিয়ে বললেন, যাও, যেমন করে হোক ডেকে নিয়ে এস। প্রকাশচন্দ্র এসে সব শুনে অবাক। মজাও পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তিনি সন্ন্যাসী হয়ে গেলে অঘোরকামিনী কী করতেন? অঘোরকামিনী নির্বিকারভাবে বললেন, ঘর ছাড়তাম! গেরুয়া পরতাম, ছাই মাখতাম আর দেশে দেশে ঘুরতাম, যদ্দিন দেখা না পেতাম তোমার!   

মাঝে স্বামী প্রকাশচন্দ্র একটা কাজ পেয়েছিলেন বটে, অংশীদার হিসেবে এক বন্ধুর ছাপাখানা চালানর কাজ, কিন্তু লাভের পয়সা মূলধনে যোগ হবে এই কড়ার ছিল বলে বাড়িতে এক পয়সাও পাঠাতে পারতেন না। গ্রামে স্ত্রী-কন্যার দুরবস্থার খবর পেতেন। শেষে বন্ধুকে বলে ছাপাখানার কাজ ছেড়ে দিলেন। বগুড়ায় পোস্টমাস্টারের কাজ পেলেন, সেটাও ছেড়ে দিলেন। শেষে ১৮৭৩ সালের ডিসেম্বরে হরিণাভির (২৪ পরগণা) উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শিক্ষকের কাজ পেলেন। কিছুদিন সেই বিদ্যালয়ে ব্রাহ্মধর্মের খ্যাতিমান আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রীও প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। প্রকাশচন্দ্রও তাঁরই বাসস্থানে থাকার ব্যবস্থা করে নিলেন। ফলে অঘোরকামিনী নিজের দুই সন্তানকে নিয়ে আবার প্রকাশচন্দ্রের সঙ্গে থাকার সুযোগ তো পেলেনই, শিবনাথ পরিবারের সাহচর্যও পেলেন। 

হরিণাভিতে থাকতে থাকতেই প্রকাশচন্দ্র মোতিহারিতে দুর্ভিক্ষের রিলিফ সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাজ পেলেন। সরকারি কাজ, বেতন বেশি, উন্নতিরও সম্ভাবনা আছে। শিবনাথ শাস্ত্রী মশাইও বললেন কাজটা নিয়ে নিতে। প্রকাশচন্দ্র মোতিহারি পাড়ি দিলেন। আবার অঘোরকামিনীর একা জীবন কাটান শুরু হল। প্রথমে কিছুদিন বাদুড় বাগানে সেজ ভাশুরের বাড়িতে রইলেন। সেজভাশুর কিছুদিন পরেই তাঁকে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে বললেন। অনেক কাকুতিমিনতি করে কলকাতায় পড়ে রইলেন যে মোতিহারি থেকে এসে প্রকাশচন্দ্র নিয়ে যেতে চাইলে সুবিধে হবে। শেষে গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে কিছুদিন ভবানিপুরে পিসেমশাইয়ের বাড়িতে গিয়ে রইলেন। ওদিকে প্রকাশচন্দ্র আসতে পারছেন না, কেননা দুর্ভিক্ষের কাজ, স্থায়ীও হয় নি তখনও। তাই অবশেষে ভবানিপুর থেকেও বেরিয়ে সেই গ্রামেই ফিরে যেতে হল অঘোরকামিনীকে। ৫ই এপ্রিল ১৮৭৪এ লেখা অঘোরকামিনীর চিঠি প্রকাশচন্দ্র উদ্ধৃত করছেন, “তোমার পত্র পাইলাম। তুমি কোথায়! আমাকে ফেলে তুমি কোথায় গেলে? আমি যে অন্ধকার দেখছি। আমার যে আর কেহ নাই। তুমি কই? … সর্বদা ঈশ্বরকে ডাকিও, যেন একটুও ভুলিও না। … মতিহারি জায়গা কেমন, বন্ধু কেমন? সমাজ আছে কিনা? ধর্ম্মবন্ধু আছেন কিনা? তোমাকে শিবনাথবাবুর মত কেহ স্নেহ করিবার লোক আছেন কি না, শুনিতে বড় ইচ্ছা করে। তোমার যে কষ্ট হইবে সমুদয় আমাকে দিও; আমি তাহলে বড়ই সুখী হইব।”

এই রকম মাতৃস্বরূপ আশ্বাস যখন স্বামীকে দিচ্ছেন ঘন ঘন দীর্ঘ চিঠি লিখে, তখন নিজে কেমন দিন কাটাচ্ছেন গ্রামে? শ্বশুরবাড়ির আর সমস্ত কাজ ছাড়া, সেটা ধান ভানার সময় ছিল বলে ধান ভানতেন। তার ওপর নিশ্চিন্তে এক জায়গায় থাকতেও পারতেন না। কাজ না থাকলে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা পাঠিয়ে দিত বাপের বাড়ি – ওখানেই অন্ন ধ্বংস করুক! আর কাজ পড়লে যেমনই অবস্থা হোক, একবেলাও সময় চাইলে পেতেন না। তক্ষুনি ছুটতে হত। এতে তাঁর মা কিছু বললে তার জন্যও তাঁকেই গঞ্জনা শুনতে হত। একটাই স্বস্তি ছিল। প্রকাশচন্দ্রের ধর্মবন্ধুরা সান্ত্বনা দিয়ে চিঠি পাঠাতেন এবং দরকার বুঝলে অর্থসাহায্যও পাঠাতেন। এই সহানুভুতি অত্যন্ত মূল্যবান ছিল সে দিনগুলোয়।

শেষে প্রকাশচন্দ্রের চাকরিটা পাকা হল। আগে যে ভাইঝি বসন্তের কথা আছে, সেই ভাইঝি আর তার স্বামী রামলাল দত্তের সঙ্গে অঘোরকামিনী ও তাঁর দুই শিশুকন্যা কলকাতায়, প্রকাশচন্দ্রের এক ধর্মবন্ধু কেদারের বাসায় এসে উঠলেন। তারপর সেখান থেকে তারা সবাই রওনা দিলেন মোতিহারি। সেটা ১৮৭৫ সাল, অঘোরকামিনীর বয়স উনিশ বছর। ওই স্বল্প দেখাতেও অভিভুত হয়ে বন্ধু কেদার পরে চিঠিতে প্রকাশচন্দ্রকে লিখেছিলেন, “প্রকাশ তুমি জান না অঘোর কি রত্ন।”

এখান থেকে অঘোরকামিনী দেবীর বিহার-বাসপর্ব শুরু হল।

যেমন প্রকাশচন্দ্রের বয়ানে বোঝা যায়, মোতিহারিতে অঘোরকামিনী গুছিয়ে সংসার করা শুরু করলেন, প্রকাশচন্দ্রের আয় কম হওয়া সত্ত্বেও, অঘোরকামিনীর মিতব্যায়িতা এবং কুশল গৃহিণীপনা কখনো সমস্যা হতে দিত না। সঙ্গে সঙ্গে, যেহেতু বাড়িতেই সমাজ(ব্রাহ্ম) স্থাপন করা হল, তিনিও অন্যান্য নারীদের সঙ্গে নিয়ে নিয়মিতভাবে সামাজিক উপাসনায় অংশগ্রহণ করতেন। দানশীলতা তাঁর মধ্যে ছিলই। সে সময় দক্ষিণপূর্ব বাংলায় বড় ঝড় হল, অনেক লোক মারা গেল, অন্নকষ্ট শুরু হল। কলকাতায় ব্রাহ্ম আচার্য কেশবচন্দ্র সেন যে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন সে আবেদন মোতিহারিতে প্রকাশচন্দ্র ধর্মতত্ত্বচর্চার সময় সবাইকে পাঠ করে শোনান। সাহায্যের আবেদন শুনে সে রাতেই অঘোরকামিনী নিজের হাতের সোনার বাজু খুলে দিয়ে দিলেন। যখন নাকি সেটা তিনি বাপের বাড়ি থেকে পরে এসেছিলেন। আগে, গ্রামে থাকার সময় দেশী ধুতি পরতেন। কলকাতায় থাকার সময় ছোপান শাড়ি এবং বিলেতি ধুতি পরতেন। মোতিহারিতে সেসব কিছুই জুটত না। তাই থান কিনে নিয়ে এসে তাতে নীলের ছোপ দিয়ে শাড়ি বানিয়ে নিতেন নিজের হাতেই, তাই পরতেন। শেষে তাও আর পরতেন না। স্থানীয় গরীব মানুষেরা যে ‘মটিয়া’ পরত, উনিও তাই পরতেন। সে কাপড়েই বিভিন্ন জায়গায় যেতেন নিঃসঙ্কোচে। হাতে নোয়া না থাকলে স্বামীর অকল্যাণ হয়, এধরণের কুসংস্কার ছিল না বলে, ব্রাহ্ম সাধিকার নিয়মানুসারে নোয়া, শাঁখা, চুড়ি সব খুলে খালি হাতে থাকতেন। ব্রাহ্মিকারা নোয়া না খুললে তিনি রীতিমত তিরস্কার করতেন তাঁদের। একজন শ্রদ্ধেয়া ব্রাহ্মিকার নোয়া তিনি জবরদস্তি খুলিয়ে দিয়েছিলেন, কেননা মিথ্যে ভড়ং তিনি সহ্য করতে পারতেন না।

একটা ফুলকপির গল্প আছে। সে সময় মোতিহারির দিকে ফুলকপি হত না এবং মোতিহারি অব্দি ট্রেন ছিল না বলে বাইরে থেকেও বড় একটা এসে পৌঁছোত না। একদিন প্রকাশচন্দ্রের পাটনাবাসী এক বন্ধু একটা ফুলকপি দিয়ে গেলেন। ফুলকপি পেলে সবাই খুশি হবে ভেবে প্রকাশচন্দ্র বললেন চার-পাঁচ ঘর পড়শিদেরকে একটু একটু ভাগ করে দিতে। অঘোরকামিনী প্রথমে আপত্তি করলেন বটে, “ছোট কপি, পাঁচ জনার বাড়ীতে দিলে তারাই বা কি খাইবে, আমরাই বা কি খাইব?” কিন্তু শেষে টুকরো টুকরো করে সবাইকে দিলেন। তারপর থেকে, প্রকাশচন্দ্র লিখছেন, “তুমি গৃহের সামান্য সামান্য ভাল বস্তুও সকলকে একটু একটু করিয়া না দিয়া গ্রহণ করিতে না। ক্রমে ক্রমে তোমার দিবার প্রবৃত্তি তোমার ক্ষুদ্র দানশক্তিকে অনেক অতিক্রম করিয়া চলিয়া গিয়াছিল।”

এক মদ্যাসক্ত বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তারের পরামর্শে হাওয়া বদলাতে তাঁকে ছুটি নিয়ে বাইরে যেতে হল। তাঁর স্ত্রীকে অঘোরকামিনী নিজের সাথে বাড়ি নিয়ে এলেন। বোনের মত রাখলেন। বাড়িতে তিনটে ঘরের মধ্যে একটাতে থাকতেন প্রকাশচন্দ্রের ভাইঝি বসন্ত ও তার স্বামী রাম। আরেকটা ঘর সেই মহিলাকে দিয়ে দিলেন। বাকি একটা ঘরেই নিজেদের শোয়ার এবং সবার খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন।

মোতিহারিতেই ১৮৭৬ সালের ৫ই মে অঘোরকামিনীর প্রথম পুত্রসন্তানের জন্ম হল। যদিও ডাক্তার ডেকে আনা হয়েছিল কিন্তু কোনো অঘটন ঘটল না (সুসারের জন্মের সময় ধুম জ্বর, সরোজিনী জন্মের সময় সমানে রক্তপাত …), সাধারণ প্রসব হল। সে সময় এক নামকরা সাধু অঘোরনাথ এসে পৌঁছোলেন মোতিহারিতে। তিনিই ছেলের নাম রাখলেন সুবোধচন্দ্র। তিনি আবার ধর্মোপদেশ দেওয়ার সময় উদাহরণ দিয়ে বোঝাতেন অনাসক্তি বিনা পরিত্রাণ নাই। প্রকাশচন্দ্রও তেমনটাই চেষ্টা করতে লাগলেন। আলাদা শোবেন, স্ত্রী-সন্তানের সাথে শোবেন না। থাকতে পারতেন না। ফিরে ফিরে আসতেন, আবার চেষ্টা করতেন। অঘোরকামিনী সে চেষ্টাতেও স্বামীকে সাহায্য করলেন। কখনো নালিশ করতেন না একা থাকতে হয় বলে।

ওদিকে ভাইঝি বসন্ত গর্ভবতী হলেন। ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটি-প্রসঙ্গ ঘটে গেল। একটাই ঘটি ছিল বাড়িতে। সেটা বসন্ত নিজের প্রয়োজনে নিজের ঘরে রাখতে চাইলেন। অঘোরকামিনী আপত্তি করলেন। বসন্ত, বয়সে ও সম্পর্কে ছোট হয়েও কড়া কথা শুনিয়ে দিল। অঘোরকামিনীও জবাব দিলেন। প্রকাশচন্দ্র শুনে অঘোরকামিনীকে বসন্তের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে বললেন। অঘোরকামিনী প্রথমে আপত্তি জানালেন কিন্তু প্রকাশচন্দ্রের মর্য্যাদা রাখতে নিজের আত্মমর্য্যাদা ত্যাগ করলেন – পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলেন স্বামীর ভাইঝির কাছে। পরে এক সময় চিঠিতে লিখেছিলেন, “সেই দিন যে কি কষ্টে ক্ষমা চাহিয়াছিলাম তাহা অন্তর্যামী জানেন, আর তুমি জান।” প্রকাশচন্দ্র বইয়ে লিখছেন, “তুমি বয়সে ও সম্পর্কে বড়, এবং তোমার দোষও ছিল না … কিন্তু ভালোবাসার খাতিরে তুমি আত্মমর্য্যাদা বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হইলে। … আমি তোমার আত্মজয় দেখিয়া ধন্যবাদ দিলাম। এই যে ত্রুটি-স্থলে অবনত হইতে শিখিলে, পরবর্ত্তী জীবনে এই শিক্ষা কখনো বিস্মৃত হও নাই। ব্যক্তিগত জীবনে আমরা রোজ এই ঘটনা শুধু প্রত্যক্ষ করি না, নিজেরাও ঘটিয়ে থাকি। নিজের সন্তান, স্ত্রী বা প্রিয়জনকে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করতে, ভুল না থাকা সত্ত্বেও পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নিই, কখনো রাষ্ট্রশক্তির কাছে, কখনো দুর্বৃত্ত পাড়াপড়শির কাছে। নিঃসন্দেহে অবস্থার ফেরে তাৎক্ষণিক ভাবে আত্মমর্য্যাদা বিসর্জন দেওয়াও একটা শিক্ষা, যদি সেটা বৃহত্তর ও মহত্তর উদ্দেশ্যে কাজে লাগে। অঘোররকামিনীর কাছে সেটা যে শুধু ‘ভালোবাসার খাতিরে’ ছিল না, বোঝা যায়। তবে কি শুধু গৃহশান্তি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ছিল? নাকি ব্রাহ্মিকা হিসেবে আত্মিক ক্রমোন্নতির উদ্দেশ্যে ছিল? নাকি ভবিষ্যৎ সমাজকল্যাণী, সেবা ও শিক্ষাব্রতী জীবনের বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছিল ভিতরে?

আরো একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন প্রকাশচন্দ্র। যে বাড়িতে ছিলেন সে বাড়িটা জর্জর হয়ে গিয়েছিল বলে একটি অন্য বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন তাঁরা। প্রকাশচন্দ্রের এক বন্ধু মনস্থ করলেন সে বাড়িতে তিনিও থাকবেন। সবাই নিজের নিজের ঘর পছন্দ করে নিয়ে নেওয়ার পর পায়খানার পাশের ঘরটা পেলেন অঘোরকামিনী। তার কিছুদিন পর প্রকাশচন্দ্রের সেজদা এলেন, তিনিও থাকবেন। তিনি বাইরের ঘরটা নিলেন। তার ওপর নতুন পদে নিয়োগ-সংক্রান্ত (আবগারি ইন্সপেক্টর) সরকারি আদেশ পেয়ে প্রকাশ চন্দ্র চলে গেলেন পাটনায়। ওদিকে ব্রাহ্ম সমাজে উৎসবের সময়। সেজ ভাশুরের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও অঘোরকামিনী আর বসন্ত গেলেন সে উৎসবে। ফলে নিজেরই বাড়িতে অঘোরকামিনী একঘরে হলেন। একার রান্না করে ঘরে বসে খেতেন।   

অঘোরকামিনীর কষ্ট দেখে প্রকাশচন্দ্র তাঁকে প্রথমে গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু সেখানেও কষ্ট বুঝে অবশেষে পাটনায় নিয়ে এলেন।

পাটনায় প্রথমবার আসার পর কিছুটা সময় খুবই দুর্বিপাকের মধ্যে কাটল। ছেলে সুবোধচন্দ্রের খুব অসুখ চলছিল। অফিসের কাজে প্রকাশচন্দ্রের মোতিহারি যাওয়ার ছিল। তিনি অঘোরকামিনী ও সুবোধকে নিয়েই মোতিহারি গেলেন যে হাওয়াবদলে আর সঙ্গে রাখলে সুবোধ ভালো হয়ে যাবে। কিছুদিনে সুবোধ ভালো হয়ে উঠল কিন্তু অঘোরকামিনী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সে অসুখ কিছুতেই ছাড়ে না। প্রকাশচন্দ্রের আবার পাটনা ফেরার ছিল। তাই অঘোরকামিনীকে কলকাতায় রেখে এলেন। কিন্তু চিকিৎসা বলতে চলছিল কবিরাজি। কোনো লাভ হচ্ছিল না। উল্টে কবিরাজমশাই বলে দিয়েছিলেন এ রোগ সারবে না। শেষে এক পরিচিত সাধু এলেন দেখতে। তিনিই বললেন অনেক টাকা তো খরচ করলে, এবার আরেকটু খরচ করে সাহেব ডাক্তার দেখাও। তখন এক সাহেব ডাক্তারকে দেখান হল। তিনি বললেন, কোথাও তো কিছু নেই! টিউমার আছে, কিন্তু উনি সন্তানসম্ভবা। এতদিনে এইটুকু কথা একজনও ডাক্তার, কবিরাজ বলতে পারেনি।

ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে অঘোরকামিনীকে পাটনায় নিয়ে আসা হল। বাঁকিপুরে মুন্সেফ ছিলেন কেদার নাথ রায়। তাঁরই বাড়িতে রইলেন অঘোরকামিনী। একটাই ঘরে ভাঁড়ার, শয়ন, উপাসনা … তবু সৌদামিনী দেবীর স্নেহশুশ্রুষায় অঘোরকামিনী ভালো হয়ে উঠলেন। প্রকাশচন্দ্র সেদিন গেছেন সীতামাঢ়ি, অঘোরকামিনী দ্বিতীয় পুত্র সাধনচন্দ্রের জন্ম দিলেন। টিউমার-ফিউমার কিছু বোঝাই গেল না।

সৌদামিনী দেবী শিক্ষিতা কিন্তু নিরহঙ্কারী, স্নেহশীলা নারী ছিলেন বোঝা যায়। নিকট বন্ধুর মত অঘোরকামিনীকে তিনি কাছে টেনে নিলেন। মাঝেমধ্যে গাড়িতে করে সৌদামিনী অঘোরকামিনীকে নিয়ে শহরে বেড়াতে বেরুতেন। নতুন শহরের মানুষজন, শিক্ষিতা নারীর বন্ধুসঙ্গ ইত্যাদির খুব ভালো প্রভাব পড়ল অঘোরকামিনীর জীবনে। তার ওপর স্বামী প্রকাশচন্দ্রের কাজের পরিসরটা বদলে গিয়েছিল। বার বার তাঁকে ট্যুরে যেতে হত। সেসব জায়গায় প্রকাশচন্দ্র কখনো কখনো স্ত্রীকে নিয়ে যেতেন। একবার ডুমরাঁও যাওয়ার বর্ণনা করেছেন তিনি। ট্রেনে সেসময় সেকেন্ড ক্লাসে মহিলা কামরা চালু হয়েছিল। প্রকাশচন্দ্র স্ত্রীকে সেই কামরাতেই একলা যেতে বললেন। স্টেশন এলে নেমে গিয়ে দেখে আসতেন। অঘোরকামিনী প্রথমে আপত্তি করলেও একলা সফরে তাঁর সাহস বাড়ল। সঙ্গী মহিলা যাত্রীদের সঙ্গে কথাও হয়ে থাকবে।

প্রকাশচন্দ্র নিজেই লিখছেন, “বাহিরে আসিয়া তোমার মনের স্বাধীনভাব বাড়িতে লাগিল, সাহস বাড়িতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে নারীজাতির অধিকার বিষয়ে, নারীজীবনের আদর্শ বিষয়ে চিন্তার স্রোত খুলিয়া যাইতে লাগিল। যতই তুমি বাহিরের জগত দেখিতে লাগিলে, ততই বুঝিতে পারিলে, এদেশে নারীর অবস্থা কত হীন, এবং তাহার উন্নতির পথে পদে পদে কত বাধা – ততই তোমার মনে ক্লেশও হইতে লাগিল।”

ব্রাহ্মসমাজে প্রথম থেকেই শিক্ষার প্রসার এবং নারীমুক্তির সাধনা ছিল। প্রথম থেকেই মানবকল্যাণের সঙ্গে ধার্মিকতার যোগ প্রদর্শিত হয়েছিল। প্রকাশচন্দ্র বলছেন, “বুঝিলাম, বাহিরের জনসমাজের সেবা না করিলে ঘরের ধর্মও ঠিক থাকে না; আর বাহিরের জগত দেখিয়া মনটা বড় না হইলে, ভালো লোকের সঙ্গে মিশিয়া আত্মা উন্নত না হইলে, ব্রাহ্মধর্ম সাধন করা যায় না।” আচার্য কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ‘নববিধান’ সমাজে সম্ভবতঃ এই উপলব্ধিটা আরো বেশি গভীরভাবে হয়েছিল। তিনি নিজেও সচেষ্ট হয়েছিলেন যাতে অন্তঃপুরবাসিনী নারীরা সাধনসমাজে ও শহরে পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঘোরে। অঘোরকামিনী যেন সেই ডাকে শামিল হয়েই মুক্তির পথ খুঁজছিলেন। উপাসনাস্থলে সময় মত উঠে দাঁড়াবার ডাক পড়লে পুরুষেরা উঠে দাঁড়াতেন। নারীরা বসে থাকতেন। কিন্তু অঘোরকামিনী উঠে দাঁড়াতেন। এর জন্য তাঁকে নিন্দা আর ভর্ৎসনাও সহ্য করতে হয়েছে। একবার গয়ায় গিয়ে কোন ধর্মোৎসবে দেখলেন পুরুষেরা সমবেতভাবে হরিগুণ কীর্তন করছে। নারীরা দোতলায় দাঁড়িয়ে দেখছে। তিনি ওই দোতলা থেকেই সবাইকে শুনিয়ে বললেন, “ভগবান, তোমার পুত্র সন্তানদের জন্য এত করিলে, ভালই হইল, তোমার কন্যাদের জন্য কি করিলে? তাহাদের মুখপানে কে চাহিবে? তাহাদের উন্নতি কিরূপে হইবে?”

১৮৮১ সালের শেষে সপরিবারে প্রকাশচন্দ্র মুন্সেফ কেদারনাথ রায়ের বাড়ি ছেড়ে অন্য একটি বাড়িতে উঠে গেলেন। কেননা, প্রকাশচন্দ্রের ছোট ভাই প্রবোধ তাঁর পরিবার নিয়ে দাদার সংসারে থাকতে এলেন। আবার মোতিহারির মত অঘোরকামিনীকে  গৃহিণী হয়ে স্বতন্ত্রভাবে সংসারের দায়িত্ব হাতে নিতে হল। এ বাড়িতে আসার পর অঘোরকামিনী একা একা পায়ে হেঁটেই রাস্তায় বেরুনো শুরু করলেন, যে সে সময় বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে অভাবনীয় ছিল। দিব্যি যেতে লাগলেন অন্যান্য বাড়িতে ধর্মোৎসবে।

সাধনপথ

১৮৮২ সালের ১লা জুলাই বিধানচন্দ্রের জন্ম হয়। পঞ্চম সন্তানের জন্মের আগে থেকেই প্রকাশচন্দ্রের মনে একটি গ্লানির উদয় হচ্ছিল। অঘোরকামিনী তাঁর সমস্যার কথা বলতেন। দুই মেয়ে, দুই ছেলেকে তো বাড়িতে দাসির জিম্মায় রেখে বেরুতেন ধর্মের কাজে, কিন্তু গর্ভস্থ শিশুকে কোথায় রেখে যাবেন? সাধনের সময় সে শিশুটির নড়াচড়া আরো ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। তাঁর সাধনসঙ্গিনী স্ত্রী শুধু তাঁদের ক্ষণিক শারীরিক মিলনেচ্ছার দুর্বলতার ফলে এভাবে ক্ষয়ে যেতে থাকবেন? – প্রকাশচন্দ্র ভাবতেন। তাই বিধানের জন্মের পর তাকে কোলে নিয়ে দুজনে প্রতিজ্ঞা করলেন যে আর সন্তান হবে না। সে সময় প্রকাশচন্দ্রের বয়স ৩৫, অঘোরকামিনীর ২৬; যে কোনো ক্ষণে দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। তাই, সারা জীবনের সঙ্কল্প একবারে না নিয়ে, আপাততঃ ছ’মাস ছ’মাস করে আত্মিক মিলনের ব্রত নেওয়া অর্থাৎ শরীরের সম্পর্ক না রাখার প্রতিজ্ঞা করা শুরু করলেন। আগেও বেশ কয়েকবার সপ্তাহ, মাস ধরে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেন নি। এবার পারলেন। তাই এক ধর্মোৎসবে অবশেষে দুজনে অনন্ত আত্মিক মিলনের ব্রত গ্রহণ করলেন।

এ ব্রত সহজ ছিল না। কাজ, আরো বেশি কাজ, মানুষের সেবা ও একাগ্র উপাসনা ছাড়া শরীরের স্বাভাবিক ইচ্ছাকে রোধ করা সহজ ছিল না। অঘোরকামিনীর জন্য আরও কঠিন ছিল সে পরীক্ষা। কেন না, উদাসীন হয়ে যাওয়ারও উপায় ছিল না, স্বামী দুর্বল হয়ে পড়লে মায়ের মত স্নেহের শক্তি দিয়ে তাঁকে সামলাতে হত। সংসারের যাবতীয় ভার নিজের কাঁধে নিয়েও তিনি সারা দিন, নিজের বাড়ি ছাড়াও পরিচিত জনের বাড়িতে উপাসনার কাজ, ধর্ম আলোচনা, নামগান, অসুস্থদের সেবা, সন্তানদের প্রতিপালন … কিছুতে ত্রুটি রাখতেন না। আর তারই সঙ্গে দিন প্রতিদিন বেড়ে চলেছিল তাঁর চেতনার প্রসার যার ফল ছিল একাধারে মনের বৈরাগ্য ও সবার প্রতি গভীরতর ভালোবাসা। প্রকাশচন্দ্র লিখছেন, “বাঁকিপুরে আসিয়া আমাদের চেষ্টা হইল, যে কিসে আমাদের জীবন ঘরের সীমা অতিক্রম করিয়া বাহিরেও ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে। এখন তোমার আত্মা এত জাগিয়া উঠিল, যে তাহার সকল আকাঙ্খার তৃপ্তি কিসে হইবে সেজন্য আমাকেও ব্যস্ত হইতে হইল। পরসেবার জন্য তুমি অধিক ব্যাকুল হইতে লাগিলে। দেখিলাম, যতই প্ন্যকে ভালবাসিতে পারা যায়, শুদ্ধতার পথও ততই সহজ হয়। তুমিও তাহা বুঝিলে।”

১৮৮৪ সাল আসতে আসতে অঘোরকামিনী এতদূর দৃঢ়চেতা হয়ে উঠলেন যে প্রকাশচন্দ্রের প্রতিনিধি হয়ে, দেড় বছরের বিধানচন্দ্রকে কোলে নিয়ে একাই গেলেন ভাগলপুর সমাজের উৎসবে, অংশগ্রহণ করলেন। মনে ইচ্ছে নিয়ে ফিরলেন যে ভাগলপুরের মত পাটনাতেও ব্রাহ্মোপাসক পরিবারদের নিয়ে সুন্দর একটি পাড়া রচনা করবেন।

বড় মেয়ে সুসারের বিয়ের প্রশ্ন উঠল। পয়সার অভাবে সুসারকে কলকাতায় রেখে লেখাপড়া করান যায় নি। পাটনার স্কুলে মেয়েদের পড়াবার ভালো ব্যবস্থা নেই বলে তাকে বাড়িতে গৃহশিক্ষক রেখে লেখাপড়া করান হয়েছিল। গৃহশিক্ষক ছিলেন বৃন্দাবনচন্দ্র সুর। সচ্চরিত্র, ভালো ছেলে, ব্রাহ্মসমাজেরই একজন। সুসার ও তাঁর মাঝে ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল। সুসারকে যখন মা জিজ্ঞেস করলেন তার কাউকে পছন্দ কিনা, সুসার বৃন্দাবনচন্দ্রের নাম লিখে দিলেন। বাবা, মা রাজি হলেও পাটনার সাধারণ বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ খড়্গহস্ত হয়ে উঠল। তাদের মধ্যে ব্রাহ্মরাও ছিলেন। কেননা মেয়ে কুলীন কায়স্থ আর ছেলে মৌলিক সদ্গোপ। ধনীও নয়, বিলেতফেরতও নয়। সমাজে যাঁরা বন্ধু ছিলেন তাঁরাও বললেন ভুল হচ্ছে। কিন্তু অঘোরকামিনী একা লড়ে গেলেন। মেয়ের ইচ্ছেয় বিয়ে হচ্ছে, এটাই বিধাতার ইঙ্গিত, আর কিছু দেখার নয়। স্বামীর প্রশ্রয় নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু বিয়ের দিনগুলোয় এক হাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে মেয়ের বিয়ে দিলেন। বিয়ের লুচিটাও নিজের হাতে ভাজলেন। এমনকি স্ত্রী-আচারের দিনে, সমাজের বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে বস্ত্র বা দানসামগ্রীর জায়গায় “বর ও কন্যাকে গেরুয়া ও একতন্ত্রী দিয়া সাজাইলে। কেননা গেরুয়াই তোমার চক্ষে সর্বাপেক্ষা বহুমূল্য বস্ত্র, ও একতন্ত্রী তোমার বিচারে সর্বাপেক্ষা মিষ্ট বাদ্য যন্ত্র।” আশীর্বাদ করার সময় নারীরা একত্র হলে তিনি দাঁড়িয়ে বর ও কন্যার কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করলেন।

ফল হল যে প্রকাশচন্দ্র ও অঘোরকামিনীর পরিবারকে একঘরে করে দেওয়া হল। সামাজিক অনুষ্ঠানে আগে তাঁদেরও নেমন্তন্ন করা হত। সে সব বন্ধ হয়ে গেল। শেষ যে নেমন্তন্নে ডাক পেয়েছিলেন সেখানে প্রকাশচন্দ্রকে আলাদা একটা কামরায় খেতে বসান হয়েছিল। স্বনামধন্য আইনজীবী গুরুপ্রসাদ সেন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনিই প্রতিবাদ করলেন। … লোকে ব্রাহ্মসমাজকে চাঁদা দেওয়া বন্ধ করল। ওদিকে ঘরে, প্রকাশচন্দ্রের মা রেগে বিয়ের আগেই ছোট ছেলে প্রবোধচন্দ্র ও তার বৌকে নিয়ে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। যাহোক, সেখানে তর্কবিতর্কের ফলে প্রবোধচন্দ্র আবার বিয়ের সময় চলে এসেছিলেন।

২৭শে মে, ১৮৮৪ সুসারের বিয়ে হল। আর সে বছরই পাটনার নয়াটোলা পাড়ায় প্রকাশচন্দ্রদের নিজেদের বাড়ি হল। ১৫ই নভেম্বর গৃহ প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠান করলেন অঘোরকামিনী। চেষ্টা করছিলেন বাড়িটাকে একাধারে উপাসনাস্থল, ভালোবাসার আশ্রয় ও সেবাশ্রম হিসেবে গড়ে তুলতে। টাকাপয়সার অভাব সামলাতে পাচককে ছাড়িয়ে দিয়ে নিজেই রান্নাও সামলাচ্ছিলেন মাঝে মধ্যে। এমন সময় প্রকাশচন্দ্র ডেপুটি কালেক্টরের পদে নিযুক্ত হলেন।  আবার মোতিহারি জেলায় যোগ দেওয়ার নির্দেশ পেলেন। ৫ই আগস্ট ১৮৮৫তে তাঁরা পাটনার বাসা ছাড়লেন।

মোতিহারিতে আগের বার প্রকাশচন্দ্র একটি বাড়ি কিনেছিলেন। সে বাড়িতে অন্য একজন থাকতেন। তিনি বাড়িটা কিনতে চাইছিলেন কিন্তু কম দাম দিচ্ছিলেন। অঘোরকামিনীর কথায় সেই কম দামেই প্রকাশচন্দ্র বাড়িটা বিক্রি করে দিলেন। অঘোরকামিনীর সেবাকর্ম মোতিহারিতেও একই রকম চলছিল। নিজের দ্বিতীয় মেয়ে সরোজিনীর জন্য বিলেত ফেরত পাত্র পাচ্ছিলেন। সরোজিনীর বয়স কম বলে তারা অপেক্ষা করতেও রাজি ছিল। কিন্তু অঘোরকামিনীর অন্য একটি বিবাহযোগ্যা পাত্রীর নাম নিয়ে প্রশ্ন করলেন ‘অমুকের’ সাথে বিয়ের কথা ভাবছেন না কেন? ও-ও তো সরোজিনীরই মত, আমারই মেয়ে। বরং আগে ও … তারপর সরোজিনী। পাত্রপক্ষ রাজি হয়ে গেল এবং সেই মেয়ের সঙ্গেই পাত্রের বিয়ে হয়ে গেল।

এ সময়কার ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে দিয়ে অঘোরকামিনীর দৃঢ়তা ও বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায়। এমনও দিন গেছে, প্রকাশচন্দ্র মোতিহারিতে চাকরি করছেন, সঙ্গে রয়েছে বড় ছেলে সুবোধচন্দ্র, শরীর অসুস্থ বলে অঘোরকামিনী সাধনচন্দ্র আর বিধানচন্দ্রকে নিয়ে মোকামায় তাঁদের পরিচিত অপূর্বকৃষ্ণ পালের বাড়িতে চলে গেছেন। ওদিকে পাটনা থেকে খবর এল যে দেওর প্রবোধচন্দ্রের ছেলেটি মারা গেছে। দুই ছেলেকে মোকামায় ছেড়ে অঘোরকামিনী অন্য একজন মানুষকে নিয়ে গেলেন পাটনা। সে মানুষটিও বলছে, ট্রেনে চড়া, নামা, ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করা সব নিজেই করছেন অঘোরকামিনী । আরেকবার, মোতিহারি থেকে পাটনায় এসেছেন স্বামীর সাথে উৎসবে, ওদিকে মোতিহারি থেকে খবর এসেছে সুবোধচন্দ্রের কলেরা হয়েছে, প্রকাশচন্দ্র দ্বিধায় পড়েছেন, অঘোরকামিনী স্থির – উৎসব শেষ করে তবেই ফিরলেন।

দ্বিতীয়বার মোতিহারিতে থাকাকালীন আরেকটি ঘটনা উল্লেখ্য। জামাই বৃন্দাবনচন্দ্র সুসারকে পরিত্যাগ করতে উদ্যত হলেন। তাঁর নাকি ব্রাহ্মমতাবলম্বন আর ভালো লাগছে না। জামাইয়ের মনটা পরিষ্কার করতে দার্জিলিং যাওয়া স্থির হল। জামাইয়ের মন তো পরিষ্কার হল না, দার্জিলিং থেকে ফিরে এসে তিনি সুসারকে পরিত্যাগ করে চলেই গেলেন, কিন্তু অঘোরকামিনীর মনটা পাহাড়ে গিয়ে ভালো হয়ে গেল। বরফঢাকা পাহাড়চুড়ো, জঙ্গল, রাস্তার চড়াই-উতরাই, হাঁটতে হাঁটতে শিশুর মত পথ থেকে হাজারটা জিনিষ কুড়িয়ে বেড়াতেন … তার ওপর সে সময় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও দার্জিলিংএ ছিলেন। তাঁর সাথে দেখা করে এলেন একদিন। খুব পরিতৃপ্ত হল মন।

১৮৮৭ সালের অক্টোবরে তাঁরা মোতিহারি থেকে আবার পাটনায় ফিরে এলেন। পাটনায় ফিরে অঘোরকামিনী ব্রাহ্মিকা সমাজের কাজ শুরু করলেন। মন থেকে আসক্তি সরাতে দামি কাপড়জামা, গয়না ইত্যাদি তো ত্যাগ করেই ছিলেন, একদিন মাথার চুলটুকুও কেটে বিসর্জন দিলেন। বাকি ছিল স্বামী-ধন, তাঁকেও “প্রার্থনাপূর্বক ভগবানের শ্রীকরে অর্পণ” করলেন। আকাঙ্ক্ষা করলেন যে স্বামী “আসক্তির বস্তু থাকিবেন না, কেবল ধর্মপথের সহায় হইবেন।”

ছোট ছোট অনেক ঘটনা আছে এ সময়কার যা পড়লে অঘোরকামিনীর ত্যাগ, সেবা ও উপাসনায় ডুবে যেতে চাওয়া মনটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তেমনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর মনের নির্মলতা। একইভাবে তিনি খৃস্টান পরিবারের সাথেও বন্ধুত্ব পাতাচ্ছেন, তাদের বাড়িতে এক পাদ্রী নিজেদের দেশের নিয়ম অনুযায়ী হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় তিনিও হাত বাড়িয়ে শেক-হ্যান্ড করছেন। পরে অবশ্য সাবধান থাকতেন, আগেই জোড়হাত করে প্রণাম সারতেন। কিন্তু সাহেবের সাথে, বা পরপুরুষের সাথে হ্যান্ড-শেক করা নিয়ে কোনো গ্লানিবোধ ছিল না। আবার এটাও বোঝা যায় যে তিনি সবসময় ভালোটা মেনে নিতে প্রস্তুত। যেমন, পারিবারিক সংস্কারে তিনি বিধবাবিবাহের প্রবল বিরোধী ছিলেন। কিন্তু যখন শুনলেন যে একটি বিধবাবিবাহ হবে যাতে আচার্য্যের কাজ করবেন তাঁর স্বামী, আর বিয়েতে সাহায্য করারও কেউ নেই, তখন তিনি বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলেন। অনেক রাত অব্দি বিয়ে বাড়িতে থেকে সব কাজ সম্পন্ন করলেন। বর ও বৌয়ের কল্যাণকামনায় প্রার্থনাও করলেন।

আরো একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আছে। একদিন বাড়িতে এক বন্ধুপত্নী চিকিৎসা ও হাওয়াবদলের জন্য তাঁদের বাড়িতে এসে উঠলেন। এই বন্ধুপত্নী সম্পর্কে প্রকাশচন্দ্রের বোন হতেন, কিন্তু দূরসম্পর্কের। তাঁর বিয়ের আগে এবং পরেও, প্রকাশচন্দ্র তাঁকে লেখাপড়ায় সাহায্য করতেন এবং সেই সূত্রে ঘনিষ্ঠতা জন্মেছিল। প্রাক্তন ছাত্রীর পীড়ায় একটু বেশি সমব্যথী হয়ে প্রকাশচন্দ্র নিজেই তার সেবা করতে উদ্যত হলেন। অঘোরকামিনী অসন্তুষ্ট হয়ে স্বামীকে তা করতে দিলেন না, কিন্তু সে নারী ও তার স্বামী ওই বাড়িতেই রইলেন। অঘোরকামিনী তার সেবার ভারও নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। এমনকি সেই বন্ধুদম্পতির মেয়েও যখন ভয়ানক রোগে পীড়িত হল আর বড় ডাক্তার এসে বলল, বড়, খোলামেলা বাড়িতে নিয়ে যেতে, অঘোরকামিনী নিজের বাড়ি ছেড়ে সেই বাড়িতে গিয়ে তার সেবায় রত রইলেন। রোগিনীর জন্য শোণ নদীর জল, কলকাতার মাগুর মাছ … সব ব্যবস্থা করলেন। নিজের হাতে তার মলমুত্র পরিষ্কার করতেন। একদিন নয় ছয় মাস। যদিও মায়ের অসুখ সারল না, মেয়েটি বস্তুতঃ অঘোরকামিনীর সেবাতেই সুস্থ হয়ে উঠল। 

একজন ওনাকে নাম দিয়েছিলেন ‘মৈত্রেয়ী। নাম ও তার অর্থটা প্রকাশচন্দ্রেরও খুব পছন্দ ছিল। তাই যখন একদিন খ্যাতিমান ব্রাহ্ম নেতা, সাংবাদিক ও সম্পাদক উমানাথ গুপ্ত বাড়িতে এসে ঘরের অগোছালো অবস্থা দেখে এক রকম ভাবে গৃহিণীর তিরস্কার করলেন, প্রকাশচন্দ্রের ভালো লাগল না। ‘অঘোর-প্রকাশ’এ তিনি লিখছেন, “উমানাথবাবুর কথা তোমাকে বলিলাম, তুমি চেষ্টা করিতে লাগিলে। কিন্তু যেরূপ যত্ন করিলে সংসারের সব বস্তুর পূর্ণ ব্যবহার হয় ও কিছু অপচয় না হয়, সেরূপ যত্ন করিতে পারিতে না। যখন বর্দ্ধমানে একাকী ঘরকন্না করিতে, ধর্ম্মের কোন ধার ধারিতে না, তখন অল্প জিনিষে ও অল্প ব্যয়ে চালাইতে, ও সর্ব্বদা দ্রব্যাদির প্রতি দৃষ্টি রাখিতে; এখন আর তাহা হইবার নয়। এখন যদি তোমাকে সংসারী করিবার চেষ্টা কইতাম, তাহা হইলে হয়তো তোমার মৈত্রেয়ীর ভাবটুকু পলায়ন করিত। সুতরাং তুমি মৈত্রেয়ীই রহিলে।”

 ইতিমধ্যে ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে চাকরিক্ষেত্রে প্রকাশচন্দ্রের উন্নতি হয়েছিল। কয়েকটি প্রসঙ্গ আছে ভ্রমণের। তীর্থ ভ্রমণ হিসেবে এবং স্বামীর কাজের সফরে সঙ্গিনী হিসেবে। কাছাকাছিতে রাজগীর, গয়া, মসৌঢ়ি, পুনপুন ইত্যাদি যেমন আছে তেমনই দূরের সিমলাও আছে। ভ্রমণ সবারই মন বদলায়। অঘোরকামিনীর মনটাও ভালো হয়েছিল। সব সময় সবার আগে সাতসকালে বেড়াতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিতেন। সাধিকা! সাজগোজ, ভালো জামাকাপড়ের শখ তো ছিল না! একটা ব্যাপার উল্লেখ্য। আজকাল রাজগীরে গিয়ে, মখদুমকুন্ডে যাওয়ার পথনির্দেশিকার কাছে কোনো স্থানীয় বাসিন্দাকে প্রশ্ন করলে সে বলবে ওটা মুসলমানদের জন্য। হয় তখন এরকম ছিল না, অথবা হতে পারে ব্রাহ্মসমাজী বলে, গোঁড়া হিন্দুরা প্রধান কুন্ডগুলোতে এঁদের প্রবেশ নিষেধ করে রেখেছিল। অঘোরকামিনী, প্রকাশচন্দ্র এবং পুরো দলটা মখদুমকুন্ডে গিয়েই স্নান, উপাসনাদি সম্পন্ন করেছিল। দুবার যাওয়ার বর্ণনা আছে; দুবারই।

শিক্ষাব্রত

স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক মিলনে লিপ্ত না হওয়ার, এমনকি স্পর্শসুখের ইচ্ছেকেও প্রতিহত করার সংকল্পের দশ বছর হয়ে গিয়েছে। তাঁরা সে সংকল্প পালন করছেন।  এবার দুজনেই নিজেদের মধ্যে আধ্যাত্মিক বিবাহ অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁরা দুজনেই ব্রাহ্ম ছিলেন এবং আচার্য কেশবচন্দ্র সেন প্রবর্ত্তিত ‘নববিধান’ ধারার অনুযায়ী ছিলেন। কেশবচন্দ্র সেন রচিত ‘নবসংহিতা’য় আধ্যাত্মিক বিবাহ অনুষ্ঠানের বিধান দেওয়া আছে। তিনি লিখছেন, “যখন স্বামী ও স্ত্রী পবিত্রতর সখ্যবন্ধন জন্য পবিত্রাত্মা কর্তৃক প্রেরিত ও আহূত হবে তখন তাহারা সেই আহ্বানের অধীন হইবে।” ২৭শে জানুয়ারি রাজগীরে ভোরবেলায় প্রকাশচন্দ্র নিজ হাতে অঘোরকামিনীর মস্তক মুন্ডন করলেন। তারপর নাপিত এসে প্রকাশচন্দ্রের মস্তকমুন্ডন ও ক্ষৌরকর্ম করল। উপাসনার পর নবসংহিতা অনুসারে দুজনের আধ্যাত্মিক বিবাহ সম্পন্ন হল। অঘোরকামিনীর দিব্য রূপ সবাইকেই প্রভাবিত করেছিল। প্রকাশচন্দ্র লিখছেন, “শ্রদ্ধেয় প্রচারক মহাশয় … বলিলেন, জগতে মহাপুরূষ অনেক আসিয়াছেন, কিন্তু মহানারী অদ্যাবধি আসেন নাই। এইবার তাঁহার আগমন হইল।” পরে দুজনেই, এই আধ্যাত্মিক বিবাহের দিনটাকেই নিজেদের জন্মদিন হিসেবে পালন করা শুরু করেছিলেন।

এবার অঘোরকামিনী নিজের জীবনের প্রধান কাজে মন দিলেন। ১১ই ফেব্রুয়ারি ১৮৯১ তারিখে নয়াটোলায় নিজেদের বাড়িটিতে বোর্ডিং স্থাপন করলেন। সেদিন থেকে বাড়ির নাম দিলেন ‘পরিবার’। পরিবার অর্থে শুধু পারম্পরিক স্বজন নয়, শিক্ষার্থী ও সেবার্থীরাও। পরিবার বলতে একাধারে শিক্ষাসদন ও সেবাসদন। শুরু হল দুইটি কন্যাকে নিয়ে। মোকামায় থাকতেন পূর্বোল্লিখিত অপূর্বকৃষ্ণ। অঘোরকামিনী সেটিকে নিজের বাড়ি মনে করতেন আর বলতেন, পূবের ঘর। তেমনি দানাপুরে থাকতেন ষষ্ঠিদাস, তেমনই আপন। তাঁর বাড়িটিকে বলতেন, পশ্চিমের ঘর। তিনি অনুভব করতেন, এধরণের গরীব ব্রাহ্মরা কলকাতায় নিজেদের মেয়েদের পাঠিয়ে লেখাপড়া করাতে পারবে না। অথচ পাটনায় মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার তেমন ব্যবস্থা নেই। তা, এই পূবের ঘর আর পশ্চিমের ঘরের দুই কন্যাকে নিয়ে অঘোরকামিনী তাঁর বোর্ডিং শুরু করলেন।

কিন্তু লেখাপড়া শেখানো আর সেবাশুশ্রূষা করা ভিন্ন কাজ। শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ চাই। তাই কঠোর সিদ্ধান্ত নিলেন, সুদূর লখনউয়ে গিয়ে কিছুকাল থেকে, মিস থোবার্ন প্রতিষ্ঠিত উইমেন্স কলেজে মন্টেসরি প্রশিক্ষণ নেবেন, সঙ্গে, সম্ভব হলে ইংরেজিও পড়বেন। যাবেন তো যাবেনই। কোন বাধা তাঁকে আটকাতে পারল না। স্বামীর প্রশ্রয় অবশ্যই ছিল। নইলে, স্বামীকে, ছেলেমেয়েদেরকে খাবার কে দেবে, লখনউয়ে গিয়ে থাকার, পড়ার খরচ কোত্থেকে আসবে, এসব চিন্তা না করে বেরিয়ে যেতে পারতেন না। যদ্দিন লখনউয়ে থাকবেন, ততদিনের জন্য তাঁর বালিকাবিদ্যালয় খগৌলে ষষ্ঠিদাসের বাড়িতে উঠে গেল। ভাই ষষ্ঠিদাস তার ভার নিলেন। স্বামী বাড়িতে একা রইলেন। তিন ছেলেকে রাখলেন দেওর প্রবোধচন্দ্রের বাড়িতে। আর তিন মেয়েকে (নিজের দুটি এবং ভাই জ্ঞানের একটি) নিয়ে, অনেকের গঞ্জনা, ঠাট্টাতামাশা আর কয়েকজনের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে অঘোরকামিনী ২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৮৯১ তারিখে লখনউ রওনা হলেন।

সে সময় তাঁর বয়স ৩৫ বছর, বিবাহিতা, পাঁচ সন্তানের জননী। স্বাভাবিক ভাবেই মিস থোবার্ন তাঁকে অন্য চোখে দেখতে শুরু করলেন। অন্যান্য ছাত্রীদের মত নিয়মশৃংখলার আগলে তাঁকে রাখতে চাইতেন না, বন্ধুর মত, বোনের মত ব্যবহার করতেন। কিন্তু অঘোরকামিনী জানতেন, স্বেচ্ছায় নিয়মের আগলটা না পরলে তাঁর উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। তাই তিনি নিজের জন্য নিয়ম গড়ে নিলেন –  ভোর সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটা অব্দি উপাসনা; পাঁচটা থেকে ছ’টার মধ্যে খাওয়া, জামাকাপড় পরা, ঘর পরিষ্কার করা; ছ’টা থেকে সাড়ে দশটা অব্দি স্কুল; সাড়ে দশটা থেকে বারোটার মধ্যে স্নান, আহার ও বিশ্রাম; বারোটা থেকে অপরাহ্ন সাড়ে পাঁচটা অব্দি পড়া; সাড়ে পাঁচটা থেকে ছ’টার মধ্যে আহার; ছ’টা থেকে সাতটা অব্দি নামপাঠ ও গান; সাতটা থেকে রাত দশটা অব্দি পাঠ; সাড়ে দশটা থেকে এগারটার মধ্যে গান ও শুয়ে পড়া। এমনকি মিস থোবার্ন যখন বললেন, প্রতিদিন একটু খেলাধুলোও করতে হবে, শরীরের জন্য দরকার, তাঁর দেখাদেখি অঘোরকামিনীও মাথায় রুমাল বেঁধে খেলাধুলো শুরু করলেন। পাটনায় ফিরে এসেও নিজের স্কুলের মেয়েদের সঙ্গে একই উৎসাহে খেলা করতেন।

লখনউ থেকে প্রকাশচন্দ্রকে লিখেছিলেন, “বাধ্যতা যে কি, বাল্যকালে তাহা কেহ শেখায় নাই। গোপনে সেই জন্য নিজেই কষ্ট পাইয়াছি। বাধ্যতাতে যে এত সুখ, তাহা জানিতাম না। মনে হইত, বাধ্য হইয়া চলিতে হইলে কেবল দুঃখসাগরে ভাসিতে হইবে। এখন দেখিতেছি সে আমার ভূল। এই এক নুতন জিনিষ দেখিতেছি, যাহাকে তিক্ত বলিয়াছিলাম, সেই হইল মিষ্ট, আর যাহাকে মিষ্ট বলিয়াছিলাম, এখন তাহাকে তিক্ত বলিয়া পরিহার করিতে বাধ্য হইয়াছি।”

লখনউয়ে বোর্ডিং স্কুলে থাকাকালীন নানান ঘটনা আছে, যেগুলো বিশদে জানলে বোঝা যায় কিভাবে অঘোরকামিনী নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বিভিন্ন ধরণের মানুষের সঙ্গে মিশে সামাজিক অভিজ্ঞতা যেমন বাড়ছিল, তেমনই আপন-পর ইত্যাদি ভেদাভেদ থেকে উত্তীর্ণ হচ্ছিলেন সবাইকে একভাবে আপন করার সাধনায়। সাথে সাথে সেসবকিছু থেকে আত্মিক বিযুক্তিও ঘটাচ্ছিলেন নিজের সেই ঈশ্বরের প্রয়োজনে যিনি জীবের সেবাতেই সেবিত হন। স্বামীর সঙ্গে চিঠি লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছিলেন স্বামীরই কথায়। নইলে সারাটা দিন মন বার বার বিচলিত হয়ে উঠত চিঠির আশায় এবং সাধনে ব্যাঘাত ঘটাত। তার বদলে শুরু করেছিলেন দিনলিপি।

পরে সেই দিনলিপি পড়েই প্রকাশচন্দ্র জানতে পেরেছিলেন অঘোরকামিনীর, লখনউয়ে কাটানো দিনগুলোর কথা। সেসব তিনি ‘অঘোর-প্রকাশ’ বইটিতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। আজ আমরা সেই বই পড়েই জানতে পারি এই মহীয়সী নারীর কথা।

অদ্ভুত অদম্য সাহস ছিল এই নারীর। পাটনায় থাকার সময়কার এমন ঘটনাও আছেঃ খবর পেলেন কেউ কোথাও অসুস্থ, ঘরে স্বামীও অসুস্থ, মাঝরাতে লন্ঠন হাতে এক পরিচারককে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন কয়েক মাইল, অসুস্থ মানুষটাকে উঠিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন, সেবাশুশ্রূষায় ভালো করে তুললেন। একবার তো শহরে সার্কাস এসেছিল। ফেরার সময় দলটা একজন গুরুতর অসুস্থ কর্মীকে শহরে ছেড়ে গেল। অঘোর কামিনী জানতে পেরে তাকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। তার শুশ্রূষা করাও তাঁর কাজ হয়ে গেল।

‘অঘোর-প্রকাশ’ বইটাতে উল্লেখ আছে, “এই সময় তোমার সাহসও বৃদ্ধি পাইতেছিল। প্রতি রবিবার তিনটি মেয়েকে লইয়া সন্ধ্যার সময়ে অযোধ্যা ব্রাহ্মসমাজে যাইতে। ফিরিয়া আসিতে রাত্রি দশটা বাজিত। একা তিনটি বয়স্ক কন্যা লইয়া যাইতে হইত। তুমি একাকী, নূতন সহর; যদি কোন নূতন বিপদ উপস্থিত হয় ……”

যদি মিস থোবার্ন কলেজের এখনকার ঠিকানাও ধরি, তাহলেও আমিনাবাদ এলাকায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা, তাও রাতে! … নিজের লক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টির স্থৈর্যে এমনটাই বেপরোয়া ছিলেন তিনি।

 

লক্ষ্ণৌয়ে মিস থোবার্নের কলেজের হস্টেলে সময় নিজের দুই মেয়ে ছাড়া স্থানীয় আরেকটি মেয়েকে সঙ্গে রাখার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। একদিন সেই মেয়েটির বাবার সঙ্গে হওয়া কথাবার্তার নিম্নরূপ উল্লেখ আছে ‘অঘোর-প্রকাশে’। লক্ষ্ণৌয়ে অঘোর কামিনীর জীবনের এ ধরণের কথোপকথনের বৃত্তান্তগুলো প্রকাশচন্দ্র রায় লিখিত ‘অঘোর-প্রকাশে’ স্বাভাবিকভাবেই, অঘোর কামিনীর নিজস্ব দিনলিপি থেকে অনুলিখিত হয়েছে। আগে কথোপকথনটা উদ্ধৃত করি –

“ইহার পর একদিন তোমার ভবিষ্যৎ কার্য্যক্ষেত্র বিষয়ে ঐ কন্যার পিতা যদুবাবুর সঙ্গে এইরূপ আলাপ হয়।

“যদুবাবু – আপনারা নাকি বাঁকিপুরে স্কুল করিতেছেন?

“তুমি – ইচ্ছা তো আছে, তবে জানি না।

“যদুবাবু – টাকা কোথায়? 

“তুমি – তাহা জানি না; অবশ্যই লোক আসিবে। আর স্বয়ং মা-ই লোক। শ্রদ্ধেয় অ-বাবু এ বিষয়ে খুব উৎসাহী, তিনি কিছু করিতে পারেন।

“যদুবাবু খুসী হইয়া বলিলেন, তিনি বেশ লোক। কত টাকা খরচ হইবে মনে করেন?

“তুমি – জানি না, কিছুই তো ঠিক নাই। মনের ইচ্ছা যে একটা স্কুল হয়। তাই মনে হয় মাসিক এক শত টাকার কমে চলিবে না।

“যদু বাবু – মেয়েদের নিকট কত ক’রে লওয়া হইবে?

“তুমি – এ সকল কথা কিছু স্থির হয় নাই। তবে মনে হয় গরিবেরা কম দিবেন। ধনীরা সেই স্থান পূর্ণ করিয়া একটু বেশি দিতে ইচ্ছা করিলে দিবেন।

“যদুবাবু – মেয়ে কোথায় পাইবেন?

“তুমি – কিছুই জানি না।

“যদুবাবু – এ বিষয়ে আপনাদের সহানুভূতি করিবার কেহ আছেন?

“তুমি – ভগবান, আর এ পৃথিবীতে শ্রদ্ধেয় অমৃত বাবু।

“যদুবাবু – এ বড় কায, হাতে লইলে লোকের গালি খাইতে হইবে।

“তুমি – তা জানি। কোন্‌ কায কোন্‌ দিন কে বিনা গাল খাইয়া করিতে পারিয়াছেন, যে সে আশা আমরা করিব?

“যদুবাবু – (খুসী হইয়া) তবে আমি কিছু বলি। (১) ঈশ্বর ছাড়া আর কাহারও ওপর নির্ভর করিবেন না। (২) বিলাস একেবারে থাকিবে না। (৩) আপনারা দুইটিতে একেবারে সেই জন্য প্রাণ দিবেন। পৃথিবীর গালি ও নিন্দাতে ভয় করিবেন না।     

“তুমি – ইচ্ছা তো তাই।

“যদুবাবু – এইরূপ করিলে আপনাদিগকে কন্যা দিয়া নিশ্চিন্ত হইতে পারি।

“আর এক দিন গোপাল বাবুর বাটীতে তোমার নিমন্ত্রণ হইল। সে দিন আবার যে কথা বার্ত্তা হইল তাহার সার অংশ এই।

“তুমি – কিসে মেয়েরা সত্য খাঁটি উপাসনা শিখিতে পারেন, কিসে পরলোক বিষয় জানিতে পারেন, পুরুষেরা এই সকল বিষয় মেয়েদের ভাল করিয়া শিখাইয়া দিন। মেয়েদের মন অতি দুর্ব্বল জ্ঞান অতি কম। বিশেষ যত্ন না করিলে মেয়েরা এ ধন লাভ করিতে পারিবেন না। আর তাই যদি না পারেন কি শোচনীয় অবস্থা দেখুন দেখি? অনেক সময় পুরুষেরা মেয়েদের সামান্য কিছু সাহায্য করিয়াই বলিয়া দেন, ‘যাহা বলিলাম তাহাই এখন হজম কর।’ দুর্ব্বলা নারী হয় তো এমনই হজম করিয়া ফেলিলেন যে আর তাহার চিহ্নই পাওয়া গেল না। হতাশ হইয়া কেহ কেহ বলেন, ‘মেয়েদের কিছুই হইবে না।’ একবার কোনও বিষয় না বুঝিতে পারিলেই বলেন, ‘আর কি করিব?’ মা জননী যদি পুরুষদের প্রতি এইরূপ ব্যবহার করিতেন, কি হইত?

“যদুবাবু – পুরুষেরা এখনও কিছু পান নাই, নারীকে কি দিবেন।

“তুমি – যাহা পাইয়াছেন তাই দিন। এখনকার মত তাহাই অনেক হইবে। আবার দিতে দিতে যে বাড়ে।

“যদুবাবু – যাঁহারা দিতে আসিয়াছেন (অর্থাৎ প্রচারকেরা) তাঁহারাই দিন।

“তুমি – তাঁহারা দিন, কিন্তু আমার মনে হয় আপন স্বামী, ভাই, বাপ যদি দেন, তাহাতে বেশি ফল হইবে।”

দুটো ব্যাপার লক্ষণীয়। যদুবাবুর প্রশ্নগুলোর আপাত-উদ্দেশ্য কিন্তু অর্থসাহায্য নয়। সে তিনি পরে করেও থাকতে পারেন, কিন্তু আপাততঃ তিনি নিশ্চিন্ত হতে চান যে অঘোর কামিনীর বিদ্যালয়ে তিনি নিজের মেয়েকে দিতে পারেন কিনা। ব্যাপারটা কৌতুহলোদ্দীপক কেননা, ঘরের মেয়েদের বাড়ি থেকে বার করে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসার জন্য এই ধরণের দীর্ঘ জেরার (ইংরেজিতে যাকে গ্রিলিং বলে) সম্মুখীন, অঘোর কামিনীকে নিশ্চয়ই বহুবার হতে হয়েছিল। এর প্রায় চার দশক আগে খোদ কলকাতায় বিদ্যাসাগরকে হতে হয়েছিল, তারও কিছু আগে মহারাষ্ট্রে সাবিত্রীবাই ফুলেকে হতে হয়েছিল আর অঘোর কামিনীর দুই দশক পর আবার কলকাতায় মুসলমান পরিবারে বেগম রোকেয়া হুসেনকে হতে হয়েছিল। আজ এত বছর পরেও ভারতে সমস্যাটা পুরোপুরি মিটে যায় নি।

দ্বিতীয় ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক শিক্ষা সংক্রান্ত, কিন্তু মূলতঃ মেয়েদের যে কোনো কিছু শেখাতে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের অনাগ্রহের সমালোচনা। এই প্রবৃত্তিটা আজও আমরা দেখতে পাই। 

প্রথম প্রথম ছোট ছোট ব্যাপার নিয়ে তাঁকে উপেক্ষা ও অপমান সহ্য করতে হত হস্টেলে। মিস থোবার্ন তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন নিঃসন্দেহে, কিন্তু সবকিছুর খবর তিনি রাখতে পারতেন না। সব সময় তিনি থাকতেনও না। কখনো রাতের আলোর জন্য তেলের দরকার পড়ল, কখনো ভাঁড়ার থেকে অন্য কোনো জিনিষ চাইতে গেলেন, মাঝে মধ্যেই তাঁকে মুখঝামটা খেতে হত। যেমন এক রাতে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পেটে এমন ব্যথা উঠল যে মনে হল তাঁর দিন ঘনিয়ে এসেছে। দিনলিপিতে লিখলেন, "একটু আগে পেটে একরকম বেদনা উপস্থিত হইয়াছিল। শয়ন করিতে পারিতেছিলাম না। দেখিতে দেখিতে বেদনা বড় কষ্ঠকর হইয়া উঠিল। অমনি বলিলাম, ‘মা, প্রকাশ, আমি প্রস্তুত, – যদি এখনই যাইতে হয়’। চুপ করিয়া মাকে ও তোমাকে দেখিবার জন্য বসিয়া রহিলাম।”

ভালোবাসার ঐশী শক্তি যে কী তীব্র ও তেজোময় ছিল, তা বইটিতে অঘোরকামিনীর চিঠির অংশগুলো পড়লে বোঝা যায়। তাঁর লখনউ প্রবাসকালেই প্রকাশচন্দ্র স্ত্রীকে সম্বোধন করে ‘অঘোর-প্রকাশ’ বইটা লেখা শুরু করে ছিলেন। একটা খাতা ভরে যেতে সেটা পাঠিয়ে দিলেন লখনউ। খাতাটা পড়ে অঘোরকামিনী দিনলিপিতে লিখলেন, “অঘোর-প্রকাশের জীবন-পুস্তকে লেখা থাকিবে যে মহাত্যাগেই মহা সুখ।” 

লখনউ থেকে ফিরে আসার আগের দিনগুলোয় লিখলেন, “এই তো কাজের বুনিয়াদ পড়িল। কত কাজ যে করিতে হইবে বলিতে পারি না। কেমন করিয়া হইবে তাহাও জানি না; কিন্তু করিতেই হইবে। একটি উপাসনা গৃহ, একটি মেয়েদের স্কুল, একটি পীড়িতাশ্রম, একটি ছাত্রাশ্রম স্থাপন করিতে হইবে। স্কুলটি তো অতি শীঘ্র করিতে হইবে। খরচ আপাততঃ মাসে প্রায় ১০০ টাকা করিয়া লাগিবে। একটি বড় বাটির প্রয়োজন। ৩০/৩৫ টাকা হইলে … বাবুর কন্যা, যিনি এন্ট্রান্স পাশ করিয়াছেন, আসিতে পারেন। এখন বুঝিতেছি, জ্ঞানের কত প্রয়োজন। কত মেয়ে এই জ্ঞানের অভাবে ব্রাহ্মসমাজে জড়ের মত আহার নিদ্রায় দিন কাটাইতেছেন। টাকার জন্য আমরা কোন দিন ভাবি নাই, ভাবিও না। যদি সত্য মায়ের* কাজ অঘোর-প্রকাশ করিতে পারে, নিশ্চয় কোন অভাব থাকিবে না।”

[* ব্রহ্মসমাজের ঈশ্বর-ধারণায় যে মাতৃরূপ, এখানে সেই মায়ের কথা বলছেন।]

লখনউয়ে থাকাকালীন অঘোরকামিনীর ব্যক্তিত্ব কলেজের কর্ত্রীদের এতদূর প্রভাবিত করেছিল যে তাঁরা অঘোরকামিনীকে ছাত্রী থেকে বেশি একজন সহশিক্ষিকা হিসেবে দেখতে শুরু করেছিলেন। খ্রিস্টান কলেজ, অঘোরকামিনী ব্রাহ্ম, আবার তর্কও করেন যে তিনি ‘ঈশা-পুত্র’এর কাছে নয় ‘ঈশ’এর কাছে নিজেকে নিবেদন করেন, তা সত্ত্বেও ছাত্রীদের মাঝে ঘোষিত ছিল যে মিসেস রায়, অন্যান্য শিক্ষিকাদের মতই প্রয়োজনে তাদের উপদেশ দিতে পারবেন। যদি কোনো মেয়ে কোন দোষ করে, তাকে শিক্ষা দেবেন।

লখনউয়ে ন’মাস অনবরত লেখাপড়া, রোজকার সাধন, মিস থোবর্নের অনুপস্থিতিতে তাঁরই নির্দেশে বিদ্যালয়ের দেখাশোনা, সামাজিক দায়দায়িত্ব সারতে এদিক ওদিক যাওয়া এবং নিজের খাওয়াদাওয়া নিয়ে অনিয়ম – এসবের চাপে শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছিল। এরই মধ্যে মেয়ে সুসারের বর সুসার থাকতেও অন্য একটা বিয়ে করল। তার যন্ত্রণা যেমন সুসারকে সহ্য করতে হয়েছিল, তার মাকেও সহ্য করতে হয়েছিল। হ্যাঁ, কিন্তু স্কুল খোলার জন্য তৈরি হয়ে ফিরলেন। শিশুদের দেখাশোনা, প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে খেলা আবার প্রয়োজনে শাসন, ব্যবস্থাপনা, ইংরেজির জ্ঞান, মাঝে মধ্যে শিশুদের মত সারল্যের সঙ্গে আশ্চর্যবোধক ‘ওহ মাই!’ বলে ওঠা, বাইরে কাজে যাওয়ার সময় জামাকাপড়ে ফিটফাট থাকা, মাথায় ঘোমটা দিয়ে কাজ করা সম্ভব নয় বলে নানদের মত করে, রুমাল দিয়ে তৈরি একটা আবরণ মাথায় দিয়ে রাখা …

মিস থোবর্ণের স্কুল থেকে শেষ বারের মত বিদায় নিয়ে লখনউ থেকে দুই মেয়ের সঙ্গে একাই অযোধ্যা গেলেন। সেখানে তাঁর স্বামী প্রকাশচন্দ্র রায়ও পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে দুজনে কানপুর, আগ্রা, মথুরা ইত্যাদি ঘুরে এলাহাবাদ, মোগলসরাই, কাশী, খগৌল হয়ে পাটনায় ফিরলেন ১৬ই ডিসেম্বর ১৮৯১।

এক বাঙালি ব্রাহ্ম গৃহবধু মিস থোবর্ণের স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের শহরে বিদ্যালয় শুরু করতে ফিরে আসছে শুনে শহরের বাঙালিরাও কম আনন্দিত হয় নি। ‘অঘোরপ্রকাশ’ বইটা পড়লে আন্দাজ করা যায় যে বর্তমান খাজাঞ্চি রোডের উত্তর দিকে অশোক রাজপথের মুখ থেকে এখন যেটা ‘অঘোর প্রকাশ শিশু সদন’, সেই বাড়িটা অব্দি আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। অর্থাৎ তাঁরা সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরেছিলেন। তাঁরা ফিরতেই শঙ্খধ্বনি ও বাজনা বেজে উঠেছিল।   

বিদ্যালয় নির্মাণ

‘অঘোর প্রকাশ’ বইটিতে তিনটে বিচ্ছিন্ন সূত্র আছে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। একটি সূত্রঃ লখনউ যাওয়ার আগে অঘোরকামিনী নিজের বাড়িতে শুরু করা বিদ্যালয়টির ভার খগৌলে বাসরত ভ্রাতৃপ্রতিম ষষ্টিদাসকে দিয়ে গেলেন। দ্বিতীয় সূত্র, লখনউ থেকে ফিরে এসে  ১লা জানুয়ারি ১৮৯২ সালে “ভাই পরেশের সহিত মিলিয়া” “বাঁকিপুরের গঙ্গাতীরের নিকটবর্তী Boilard সাহেবের বাঙ্গলা ভাড়া” নিলেন। আর তৃতীয় সূত্রঃ “বাঁকিপুরের বালিকাবিদ্যালয়টি তখন উঠিয়া যায় যায় হইয়াছিল। … এমন সময় স্বর্গগত গুরুপ্রসাদ সেন মহাশয় আমাদিগকে স্কুলের ভার লইতে বলিলেন।”

বইয়ের এই তিনটি সূত্রের পর আছে ১৯০৭ সালে প্রকাশিত Patna District Gazetteers (by L. S. S. O’Mailey)। তাতে লেখা আছে, “The premier institution for the education of girls is the Bankipore Female High English School, which was founded in 1867 by some of the leading Bengalis of Patna. … a private home, where some of the girls live, is attached to the school.”   এসব এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ থেকে আন্দাজ হয়, (১) অঘোরকামিনী ফিরে এসে ষষ্ঠিদাসকে দিয়ে যাওয়া বিদ্যালয়ের কর্তৃত্বভার নিজের হাতে নেন; (২) গুরুপ্রসাদ সেন তার আগেই ১৮৬৭ সালে পাটনায় কোথাও একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিন্তু সেটা চলছে না দেখে তারও কর্তৃত্বভার অঘোরকামিনীকে দিয়ে দিলেন (১৮৬৭ সালে অঘোরকামিনী বাংলায়, সদ্যবিবাহিতা)।

‘অঘোর-প্রকাশে ব্যাপারটা আরো বিশদে লেখা আছে, “বাঁকিপুর বালিকাবিদ্যালয়টি তখন উঠিয়া যায় যায় হইয়াছিল। নবেম্বর মাসে শিক্ষয়িত্রী পরলোক গমন করিয়াছেন, সেই হইতে আর স্কুলের কায হয় নাই। দশটি অল্প বয়স্কা কন্যা তখন স্কুলের ছাত্রী। স্কুলের আয় ছিল মাসিক ৪৮ টাকা মাত্র, কিন্তু চাঁদা প্রায়ই পাওয়া যাইত না। এমন সময় স্বর্গগত গুরুপ্রসাদ সেন মহাশয় আমাদিগকে স্কুলের ভার লইতে বলিলেন। আমি বলিলাম, ‘মেয়েদের থাকিবার জন্য স্কুলে স্থান দেওয়া হউক, আর মিসেস রায়কে স্কুলের সম্পূর্ণ ভার দেওয়া হউক।’ তিনি বলিলেন, ‘মিসেস রায় কায করিতে থাকুন, আপনিই তিনি সমুদয় ভার পাইবেন।’”  

আর (৩) বাসাবদল করে বইলার্ড সাহেবের বাংলোয় অঘোরকামিনী সপরিবারে (এবং ভ্রাতৃসম পরেশের পরিবারও) থাকা শুরু করলেন আর ‘অঘোর-পরিবার’ বাড়িটি (বর্তমান অঘোর প্রকাশ শিশু সদনের পরিসর) পুরোটাই বোর্ডিং স্কুলে রুপান্তরিত হল। পরে উল্লেখ আছে যে ‘মেডিকেল স্কুলের কাছে’ অঘোরকামিনীর বাড়িটা ‘বাংলোবাড়ি’, অর্থাৎ সেটা সেই বোইলার্ড সাহেবের বাংলো এবং মনে হয় অশোক রাজপথ পেরিয়ে বর্তমান পাটনা মেডিক্যাল কলেজের পাশে কোথাও ছিল।

তাহলে শেষমেশ দাঁড়াচ্ছে যে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকর্ত্রী অঘোরকামিনী নন, সম্ভবত গুরু প্রসাদ সেন, তবে সে বিদ্যালয়ে প্রাণপ্রতিষ্ঠাকর্ত্রী নিঃসন্দেহে অঘোরকামিনী (১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৮৯২ সালে, আজকের খাজাঞ্চি রোড, নয়াটোলা, পাটনায়, ‘অঘোর-পরিবার’ নামাঙ্কিত তাঁদের বাড়িতে সে বিদ্যালয়ের প্রারম্ভ হয়েছিলো)। সে বিদ্যালয়ই আজ গোলঘরের সামনে অবস্থিত বাঁকিপুর গার্লস হাই স্কুল।

বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হল এবং অঘোর কামিনী দেবী বিদ্যালয়টাকে দাঁড় করাতে পুরোদমে কাজে নেমে পড়লেন। ওপরে উদ্ধৃত গুরুপ্রসাদ সেন মহাশয়ের সঙ্গে কথোপকথন-প্রসঙ্গের পর প্রকাশচন্দ্র রায় লিখছেন, “বাস্তবিক তাহাই হইল। তুমি ১৫ই ফেব্রুয়ারী হইতে ভার লইয়া পুনরায় স্কুলের কায আরম্ভ করিলে। সে কিরূপ ভার! টাকা নাই, তুমি যেখান হইতে পার, টাকার যোগাড় করিবে, না পারিলে নিজে দিবে। বালিকা নাই, বাড়ি বাড়ি গিয়া, দেশে বিদেশে ঘুরিয়া ছাত্রীসংগ্রহ করিবে। শিক্ষক নাই, শিক্ষকের বন্দোবস্ত করিবে, ও নিজেও পড়াইবে।” একটু প্রসঙ্গান্তরের পর আবার বিদ্যালয়-সম্পর্কিত একটা তথ্য আছে, “মার্চ মাসের শেষে বিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা ২৯ হইল। এছাড়া ১৫টি হিন্দুস্থানী মেয়ে আসিতে লাগিল।”

আরেক জায়গায় আছে, “স্কুলের কায হাতে লইয়া তোমাকেও অনেক শিখিতে হইল। প্রতিদিন শত কাযের মধ্যেও খানিকক্ষণ পাঠ করিতে হইত। এই কাযটি নিয়মিত রূপে করিতে। একবার স্কুলে ভূগোল পড়াবার প্রয়োজন হইল। ভূগোল তুমি জানিতে না। তোমার প্রধান মন্ত্রী আমি, আমাকে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলে, কি করিবে। মন্ত্রী বলিলেন, ‘একটু পড়িয়ে লও না!’ তুমি তাহাই করিলে, এবং স্কুলে গিয়া পড়াইলে। অঙ্কও জানিতে না। যখন অঙ্ক শিখাইবার প্রয়োজন হইল, তখনও ঐরূপে নিজে শিখিলে ও তারপর শিখাইলে। একটি কথা তুমি খুব বুঝিয়াছিলে; তাহা এই, যে মেয়েদের লেখাপড়ার দিকে অধিকাংশ লোকের মনোযোগ নাই; অথচ তাহারা যাহাতে সংসারের রান্না বান্না প্রভৃতি কায করিবার উপযুক্ত হয় সে দিকে অনেকেরই দৃষ্টি আছে। তাই তুমি লেখাপড়া শেখার দিকটাতেই বেশি জোর দিতে। একদিন আমি বলিলাম, ‘মেয়েদের রান্না শেখা হইতেছে না।’ তুমি বলিলে, ‘এখন যে সময় আছে তাহা পড়িতেই কুলায় না; তাহা হইতে রান্নার জন্য সময় কাটিলে চলিবে না। ৭/৮ বৎসর মাত্র মেয়েরা পড়িতে পায়, তাহা হইতে যদি রান্না শিখিতে সময় কাটিয়া লওয়া যায় তবে কিছুই শিক্ষা হইবে না। আমি ১৫ দিনের মধ্যে মেয়েদের রান্না শিখাইয়া দিব।’ যখন তুমি এই কথাগুলো বলিতেছিলে, তোমার ব্যাকুলতা চোখে মুখে যেন আঁকা দেখিতে পাইয়াছিলাম। … …

স্কুলে উপস্থিত হওয়া ও স্কুলের কায করা সম্বন্ধে তোমার নিয়ম দেখিয়া বেতনভোগী শিক্ষকেরাও আপনাদিগকে নিয়মিত করিতেন। শরীর অসুস্থ থাকিলেও সহজে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করিতে না। অনেক দিন আহার করিয়া যাইতে পারিতে না। কখনও কখনও তোমার খাদ্য স্কুলে লইয়া যাওয়া হইত, কিন্তু সে শুষ্ক অন্ন গলাধঃকরণ করা কঠিন হইত। অবকাশের (টিফিনের ছুটির) সময় বিদ্যালয়ে গিয়া দেখিয়াছি, মেয়েদের সঙ্গে তুমি প্রাঙ্গণে দৌড়িতেছ, কিরূপে খেলিতে হয় তাহা শিখাইতেছ। তুমি এ সময়ে কিন্ডারগার্টেন প্রণালীও অল্প অল্প শিক্ষা করিয়া লইয়াছিলে।

এ সকল তো স্কুলের সময় করিতে। তারপর আর একটি কায ছিল, সেটি বাড়ি বাড়ি গিয়া মেয়ের মা-দের সঙ্গে দেখা করা। অনেক খোসামোদ করিয়া তবে এক একটি মেয়ে যোগাড় করিতে।”

এখানেই মনে হয় একটা উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক হবে। একটু দীর্ঘ। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল কে. পি. থমাস রচিত ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের জীবনী। তার দ্বিতীয় অধ্যায়ে (পৃ ২৬-২৮) তিনি লিখছেনঃ

“অনেকে জেনে অবাক হবেন যে অঘোর কামিনী, পাঁচ সন্তানের জন্মের পর নিজের প্রথমজাত দুই কন্যাকে নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা শুরু করেন। বস্তুতঃ এক বছর তিনি তাঁর মেয়েদেরকে নিয়ে লক্ষ্ণৌয়ের ইসাবেলা থোবার্ন কলেজে থাকেন। ইংরেজি ভাষা শেখার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালাবার দক্ষতাও অর্জন করেন। লক্ষ্ণৌ থাকাকালীন তিনি বিখ্যাত ধর্মপ্রচারক নারী মিস ইসাবেলা থোবার্নের শ্রেষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। তাঁর জন্য গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান ছিল মিস থোবার্নের মনে।

মিস থোবার্ন তাঁর সঙ্গে ছাত্রীর মত নয় একজন সঙ্গীর মত আচরণ করতেন এবং নানা ধরণের সমস্যায় তাঁর পরামর্শ চাইতেন। লক্ষ্ণৌয়ের প্রশিক্ষণের পর অঘোর কামিনী বাঁকিপুর, পাটনায় একটা ছোটো স্কুল খোলেন এবং কন্যা-শিক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। স্বামীর সামান্য সঞ্চয়টুকু ছাড়া তিনি আর কোনো রকম আর্থিক সাহায্য পান নি। এ এক অনন্য কৃতিত্ব ছিল। অতিমানবিকও বলা যেতে পারে। অঘোর কামিনী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে ১৮৯৩ সালের ২রা এপ্রিল ‘ইন্ডিয়ান স্পেক্টেটর’ আবেগদীপ্ত সম্পাদকীয় প্রশংসায় লিখেছিল –

[এই সম্পাদকীয় মন্তব্যটি মূল ইংরেজিতে ‘অঘোর-প্রকাশ’ বইটাতেও আছে। খুব সম্ভব থমাস সাহেবও সেখান থেকেই নিয়েছেন। ‘অঘোর-প্রকাশ’এ লেখক নিজেই মন্তব্যটির বাংলা অনুবাদও করেছেন। আমি সেই বাংলা অনুবাদটাই উদ্ধৃত করলাম।]

………. কিন্তু বাঁকিপুরের সর্বাপেক্ষা দর্শনীয় প্রতিষ্ঠান একটি সাদাসিধে রকমের বোর্ডিং; একটি ব্রাহ্ম মহিলা ও তাঁহার দুই কন্যা এটিকে চালাইতেছেন। মিসেস রায়ের স্বামী গভর্ণমেন্টের একটি উচ্চ কার্য করিয়া থাকেন, তাঁর আর্থিক অবস্থাও ভাল। ৩৫ বৎসর বয়সে ইঁহারা স্বামী স্ত্রী উভয়ে ব্রহ্মচর্য্য ব্রত গ্রহণ করেন, এবং আজ পর্য্যন্ত উভয়ে তাহা নিষ্ঠার সহিত পালন করিয়া আসিতেছেন। স্বামীর পূর্ণ অনুমোদন প্রাপ্ত হইয়া মিসেস রায় কন্যাদুটিকে লইয়া লক্ষ্ণৌ নগরীতে মিস থোবর্ণের কলেজে পড়িতে গিয়াছিলেন। কন্যাদ্বয়ের মধ্যে একটির বয়স ২৪, অন্যটির অনেক কম। জ্যেষ্ঠা কন্যাটি বিবাহিতা …… কিন্তু তিনি এখনও পিতামাতার কাছেই থাকেন, ও তাঁহাদের সকল মঙ্গল অনুষ্ঠানে সাহায্য করেন। কনিষ্ঠা কন্যাটি একটি মুক্তা বিশেষ। কুমারী হইয়াও তিনি ছোট একটি মায়ের মতন বোর্ডিঙের শিশুগুলিকে যত্ন করেন, আবার বোন হইয়া কেমন করিয়া ভালবাসিতে হয়, আত্মবলিদান করিতে হয়, তার দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করেন। মিসেস রায় দ্রুত ইংরেজি বলিতে পারেন; তিনি বেশ সুশিক্ষিতা।

“প্রত্যুষে কন্যারা সরল ভাবে আপনার আপনার প্রার্থনা করে। বাঁধা প্রার্থনার ব্যবহার নাই; শিশুদের কোমল বিবেকের উপর একটুও চাপ দেওয়া হয় না। বড় বড় মেয়েদের প্রত্যেকের উপর ছোট একটি দুটি মেয়ের ভার দেওয়া রহিয়াছে। প্রত্যেকের একখানি ছোট ডায়েরি আছে, তাহাতে সে প্রতিদিনের দুর্ব্বলতা ও ত্রুটি কিছু থাকিলে তাহা লিখে। মেয়েরা মিসেস রায়ের পরিদর্শনে পরিচালিত বিদ্যালয়টিতেই পড়ে; বাড়ীতে মিসেস রায় ও তাঁহার কন্যাদ্বয় মেয়েদের পড়া বলিয়া দেন। পড়ার ও খাওয়া থাকার খরচ মাসে সাত টাকার কিছু বেশি পড়ে। শিশুগুলিকে দেখিয়া বেশ প্রফুল্ল ও আনন্দপূর্ণ মনে হয়। উপদেশে ও দৃষ্টান্তে উহাদের যে পবিত্রতা, আত্মচেষ্টা ও আত্মত্যাগের শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহা উহাদের ভবিষ্যৎ জীবনে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করিবে বলিয়া বোধ হয়। লাভের জন্য এ বোর্ডিং খোলা হয় নাই। বস্তুতঃ বোর্ডারদের কাছে যা লওয়া হয়, তাতে খরচ কুলায় না। যেটা কম পড়ে তা মিঃ রায় পূর্ণ করিয়া দেন। তাঁর পত্নী ও কন্যাদের কাযে তাঁহার গভীর সহানুভূতি আছে।”

স্বামী প্রকাশচন্দ্র রায় এই উচ্ছসিত প্রশংসা পড়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে ঠাট্টার ছলে লিখেছিলেন, “দেখিলে? ৪ খানা ইংরাজি পুস্তক পড়িয়া কি প্রশংসা পাইলে? দু’একটা কথা বুঝি একটু তাড়াতাড়ি বলিয়াছিলে। বিদ্বান হীরানন্দ তাহাতেই ভুলিয়া গেলেন, ও বলিলেন, তুমি দ্রুত ইংরাজি বলিতে পার। কিন্তু কি জানি কোন্‌ মন্ত্রে মুগ্ধ হইয়া বলিলেন যে তুমি well read, অনেক পুস্তক পাঠ করিয়াছ!” এই ঠাট্টাটা করার অধিকার স্বামীর ছিল কেননা তিনিই জোর করে ঠেলে ঠেলে স্ত্রীকে হাতে খড়ি করিয়েছিলেন, বই ধরিয়েছিলেন, শিক্ষা, সাধন ও স্বাধীন চিন্তাপথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। আর ‘বিদ্বান হীরানন্দ’ বলেছেন কেননা, ‘অঘোর-প্রকাশ’এ প্রকাশচন্দ্রের বয়ান অনুযায়ী ইনি সে সময় বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে স্ত্রীশিক্ষার হালহকীকৎ জানছিলেন। যেহেতু উনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে সারা ভারতে স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে ব্রাহ্মসমাজের অগ্রণী ভূমিকা ছিল, তাই হীরানন্দ (সিন্ধিভাষী) ব্রাহ্মসমাজেরও খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।

থমাস সাহেব তার পর লিখেছেন –

“মার্চ ১৮৯৬তে বিদ্যালয় পরিদর্শনে এসেছিলেন মিঃ বোল্টন, সরকারের তৎকালীন মুখ্য সচিব। প্রতিষ্ঠানটি দেখে তিনি মন্তব্য করলেন, ‘বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে আমি খুব খুশি হলাম। ভারতে এবং ইংল্যান্ডে অবিবাহিত নারী এবং বিধবারা এই সমস্ত কাজ করছে। কোথাও আমি এক নারীকে তাঁর স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে এমন কাজে হাত দিতে দেখিনি।‘

“অঘোর কামিনী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের সাথে জবাব দিলেন, ‘আমরা ধন্য যে রাণী সম্রাজ্ঞীর প্রতিনিধি হিসেবে আপনি এতটা সময় আমাদের ক্ষুদ্র বিদ্যালয়টির পর্যবেক্ষণে দিলেন এবং পুরোপুরি সন্তুষ্ট হলেন।‘

“সেই ছোট্ট প্রারম্ভ থেকে আজ বিদ্যালয়টি বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এটি এখন ভারতের বৃহত্তম বিদ্যালয়গুলির একটি – বিহার সরকারের পরিচালনাধীন ‘বাঁকিপুর গার্লস হাই স্কুল’। বাঁকিপুরে অঘোর কামিনীর নামে এখন আরেকটি বিদ্যালয় আছে।”

ইন্ডিয়ান স্পেক্টেটরে প্রকাশিত সম্পাদকীয় মন্তব্যে দুধরণের ভুল বোঝার অবকাশ আছে। এটা ঠিক যে অর্থের অভাবটা তাঁরা দুজনে (অঘোর কামিনী ও প্রকাশচন্দ্র) নিজেদের কষ্ট বাড়িয়ে, অভুক্ত থেকে মিটিয়ে নিতেন। কিন্তু সংখ্যালঘু ব্রহ্মসমাজীদের মধ্যে, বিশেষ করে ‘নববিধান’ অংশে তাঁদের প্রতি সমর্থন ছিল, আর গুরুপ্রসাদ সেন নিজে যেচে না হোক, গেলে পরে তাঁদেরকে সাহায্য যে করতেন; সে উল্লেখ অঘোর-প্রকাশেও আছে। তবে স্বাধীনচেতা ছিলেন বলেই বিদ্যালয়ের জন্য পারতপক্ষে কারুর কাছে তাঁরা হাত পাততেন না। আরেক ধরণের ভুল বোঝার অবকাশ, সনাতন বর্ণহিন্দু সমাজের অনুল্লেখ থেকে আসতে পারে। সে সব বাড়িতে বস্তুতঃ এঁদের প্রবেশনিষেধ ছিল। কোনো অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হলে উঠোনের এক কোনে অঘোর কামিনীকে একা বসিয়ে দেওয়া হত সে কথা আগেই বলেছি। একই সঙ্গে, স্ত্রীশিক্ষার বিরুদ্ধাচারী মধ্যবিত্ত বাঙালি-অবাঙালি সবারই নানা রকমের লাঞ্ছনা ও ভর্ৎসনা দুজনেই সহ্য করতেন। প্রকাশচন্দ্র উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক ছিলেন বলে সেই আচরণটার খুব বেশি সামনাসামনি হতে হত না, সহ্য করতে হত অঘোর কামিনী দেবীকে, সারাক্ষণ।

গুরুপ্রসাদ সেন সম্পর্কিত আরেকটি প্রসঙ্গ আছে ‘অঘোর-প্রকাশ’এ। প্রসঙ্গটা উদ্ধৃতিযোগ্য কেননা স্কুলের ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক সক্রিয়তা নিয়ে ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনার উল্লেখ আছে সেখানে।

“১৮৯৪ সাল হইতেই তুমি মাঝে মাঝে পরলোকগত গুরুপ্রসাদ সেন মহাশয়ের বাটিতে যাইতে। এইরূপে তাঁহাদের সহিত আত্মীয়তা স্থাপিত হইতেছিল। তুমি তাঁহার বৃহৎ প্রাসাদে যখন তোমার সেই বেহারের সাড়ী পরিয়া যাইতে, তোমায় বেশ দেখিতে লাগিত। প্রথম প্রথম উহারা কেহ তোমার সঙ্গে দেখা করিতে তোমার বাড়ি আসিতেন না। কিন্তু তুমি তাহাতে কিছুই দুঃখিত হইতে না। কারণ তুমি সাংসারিক ভদ্রতায় চলিতে না, বা অহঙ্কারমূলক আত্মসম্মানবোধেরও ধার ধারিতে না। পরে যখন উঁহাদের বাড়ির মহিলারা তোমার পরিবারকে ভালবাসিতে আরম্ভ করিলেন, ও যখন তোমার বিদ্যালয়ের সংস্রবে মাঘোৎসবের সময় Tableau vivant (ট্যাবলো অভিনয়) করিবার কথা হইল, তখন উঁহারাও ঘন ঘন তোমার বাড়িতে যাতায়াত করিতে লাগিলেন। এইরূপে উঁহাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়িয়া গেল।

“এত বড় একটি ব্যাপার সম্পন্ন করিতে সঙ্কল্প করিলে, কিন্তু তোমার নিজের তো সব জানা ছিল না যে কি করিয়া কাকে সাজাইতে হইবে ও শিখাইতে হইবে। পরলোকগত গুরুপ্রসাদ সেন মহাশয়ের জ্যেষ্ঠা পুত্রবধু তোমার প্রধান সহায় হইলেন। শেখান, সাজান, সব সুন্দররূপে চলিতে লাগিল। ক্রমে তোমাদের উৎসাহ বাড়িতে লাগিল তাহাদেরও খুব উৎসাহ হইল। দেখা গেল, সাজ সজ্জা, গান ও আবৃত্তি অতি সুন্দর হইবে। অবশেষে অভিনয় দেখাইবার দিন আসিল। সে দিন তোমাদের কি ব্যস্ততা, কতই উৎসাহ, কতই আনন্দ! শুধু আনন্দ নয়, ইহার সঙ্গে কিছু কিছু মানসিক উত্তেজনাও ছিল, কারণ এক শ্রেণীর লোকে ইহা পছন্দ করিতেছিলেন না। তাঁহারা তোমার উচ্চ উদ্দেশ্য বুঝিলেন না, এসব করা বাঞ্ছনীয় নয় বলিয়া সমালোচনা করিতে লাগিলেন।” [এরপর পুরো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বর্ণনা ও অঘোর কামিনীর খাটাখাটনির কথা বলে] “বাহিরের অনেকে তো তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেনই, অবশেষের তোমার স্বমন্ডলীভুক্ত এক ভাই বলিলেন, তোমার সকল কাযেই বাড়াবাড়ি, ও তোমার আচরণ বাজারের স্ত্রীলোকের সঙ্গে তুলনীয়। সেদিন তুমি রাত্রিতে আসিয়া আমার বক্ষে মাথা রাখিয়া অনেক ক্রন্দন করিলে। … “

এই রকমেরই সাহসী পদক্ষেপের কথা আরেক জায়গায় আছে। “৮ই মার্চ [১৮৯৬] মেয়েদের স্কুলের প্রাইজ হইল। সকলের নিমন্ত্রণ হইয়াছিল। যাঁহাদের চরিত্র খুব ভালো নয়, তাঁহারাও আসিয়াছিলেন, এর জন্য অনেকে চটিলেন। একটি বালিকা আবৃত্তি করিয়াছিলেন, তাহাতেও অনেকের আপত্তি। তুমি কিন্তু ইহাতে দমিলে না। তুমি লখিলে, ‘যতই বকুন, কায কখনও ছাড়িব না, এই প্রতিজ্ঞা।’

আরেকটি উদ্ধৃতি দিয়ে এই অংশের ইতি টানবো। পূর্বোদ্ধৃত কে. পি. থমাস সাহেবেরই বই থেকে। যেহেতু তাঁর বইটা বিধান রায়ের জীবনী তাই লিখেছেন বিধান রায়ের শৈশব প্রসঙ্গে। কিন্তু তা থেকেই অঘোর-প্রকাশ দম্পতির মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা আমরা জানতে পারি।

“বিধান ছোটোবেলাতেই বুঝে গিয়েছিলেন যে তাঁর বাবা ধনবান নন, যদিও পরিমিত একটা বেতন তিনি পান। বাড়িতে বিধান ও তাঁর ভাইবোনেরা ছাড়া অন্যান্য অনেক শিশু ছিল, বেশির ভাগই অনাথ। বাস্তবিক যারা পরিবারের সদস্য, ঐ শিশুদের সঙ্গে কোনোভাবেই তাদের থেকে ভিন্ন আচরণ করা হত না। ফলে বাড়িতে আত্মীয়তা এবং বন্ধুত্বের একটা বোধ ও আবহাওয়া ছিল যা ক্রমে ক্রমে বিকশিত হয়েছিল। বিধান এবং তাদের ভাইদের খাবার, জামাকাপড় এবং অন্যান্য জিনিষ একটা সর্বজনীন ভাঁড়ার থেকে আসতো। যদিও তারা উচ্চপদে কর্মরত সরকারি গেজেটেড পদকর্তার সন্তান ছিল, তারা কখনো ভাবে নি যে তারা বাড়ির অন্যান্য শিশুদের থেকে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র কেউ। সবাইকে নিয়েই পরিবার ও বাড়িটার নাম ছিলো ‘অঘোর-পরিবার, অর্থাৎ অঘোরের পরিবার। খুব ছোটো বয়স থেকে বিধান এবং তার ভাইদের উপলব্ধি করানো হয়েছিলো যে পরিবারে তাদের কোনো বিশেষ বা উচ্চতর স্থান নেই। এভাবে বিধানকে তার মা ও বাবা শিখিয়েছিলেন যে পরিবার শুধু রক্ত-সম্পর্ক দিয়েই তৈরি হয় না, বিভিন্ন মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসা ও বুঝদারিতে বেঁচে থাকে …।“  

শেষের বছরগুলো

ধীরে ধীরে একদিকে সাধন-সম্পর্কে অঘোর কামিনী ও প্রকাশচন্দ্র হয়ে উঠছিলেন আত্মিক ভাই-বোন! দৈহিক সম্পর্ক নেই, স্পর্শসুখটুকুও নেই, কখনো একে অন্যেকে আলিঙ্গনও করেন না, অথচ সাধন-উদ্দেশ্যে এক, একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল! পারস্পরিক বাৎসল্যময় সম্বোধন ছিল ‘ঘোরী’ আর ‘পিকু’। অদেখায় একে অন্যেকে চিঠি লেখাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন দুজনে। শুধু ডায়েরি লিখতেন। সেখানেই এই প্রিয় সম্বোধনদুটো দুই ডায়েরিতে ফিরে আসে বার বার। অন্যদিকে সেই সাধনপথে একাকী অঘোর কামিনী পুরো বাঁকিপুর এলাকায় হয়ে উঠেছিলেন মাতা ঠাকুরানী। স্বামী তো সরকারি চাকরিসুত্রে সারাদিন অফিসে, অন্যত্র, কখনো ট্যুরে পার্শ্ববর্তী জনপদগুলোয় – মনের, ফতুহা, বিহারশরিফ, রাজগীর, বিহটা বা অন্য কোথাও। অথচ মেডিক্যাল স্কুলে (আজকের পিএমসিএইচ) বলা ছিল, কোনো অসুস্থ রোগী বা রোগিনীকে যদি কেউ দেখভাল করার না থাকে, মাতা ঠাকুরানীকে খবর দেবে। কোথাও সাহায্যের কোনো আশা না থাকলে মাতা ঠাকুরানীর কাছে যাবে। কেউ কষ্টে থাকলে মাতা ঠাকুরানী দেখবেন। ‘অঘোর-প্রকাশ’এ লেখক বলছেন –

“তোমার দৈনিক পড়িলে বুঝা যায়, এই সময়ে তোমার কায কত বাড়িয়া চলিল। একদিনের কতকগুলি কাযের তালিকা এই। (১) ছেলেদের আহার দেখা, (২) পাঠ, (৩) উপাসনা, (৪) রোগীর সেবা, (৫) স্কুলে যাওয়া, (৬) ধোপার বস্ত্র লওয়া ও দেওয়া, (৭) দেখা করা, (৮) লেপ প্রস্তুত করা, (৯) নূতন বন্ধুর বাটির সংবাদ লওয়া, (১০) জুতার বন্দোবস্ত করা, (১১) এস্টিমেট করা ও বেতন দেওয়া।” এগুলো হল আগে থেকে ভেবে রাখা কাজ। এরপর ছিল আকস্মিক এসে পড়া কাজ। কিছুই নয়, যেহেতু তিনটে মাটির হাঁড়ি একে অন্যের ওপর বসিয়ে জলের ফিল্টার তৈরি করতে শিখে নিয়েছিলেন, কোনো পড়শি আবদার করে গেল ফিল্টার তৈরি করে দিতে হবে – গিয়ে করে দিয়ে এলেন। মেডিকেল স্কুল থেকে এক ডাক্তারবাবু খবর দিলেন এক রুগ্নাকে দেখার কেউ নেই – গিয়ে তাকে বাড়িতে তুলে নিয়ে এলেন। এসবেরও বাইরে ছিল অর্থসাহায্য। নিজেদেরই অভাবের সংসার চলে, এমনকি একবার ছাত্রী বা বোর্ডারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা মাসিক সাত টাকার তহবিল থেকেও টাকা ধার নিতে হয়েছিল। পরে ফিরিয়েও দিয়েছিলেন কিন্তু তা নিয়ে নিজের কাছেই যারপরনাই লজ্জিত হয়েছিলেন। কেননা সেটা তাঁরই তৈরি করা নীতির বিরুদ্ধে ছিল। তবুও কেউ সাহায্য চাইলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা করতেন। ‘অঘোর-প্রকাশ’ বইটাতে বেশ কয়েকটা এমন চিঠি উদ্ধৃত করা আছে যাতে ভিন্ন শহরবাসী সাহায্যপ্রার্থী সাহায্য পেয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছে। এতেও থামতেন না। আসাম থেকে একটি ছেলেকে কোনো অপরাধে ধরে এনে জেলে পোরা হল। অঘোর কামিনী লোকমুখে শুনে ও তারপর জেলে গিয়ে কথা বলে বুঝলেন ছেলেটি নির্দোষ। ব্যস, উঠে পড়ে লাগলেন তাকে জেল থেকে ছাড়াতে। আসানসোলে এক নারীর ওপর হওয়া অত্যাচারের খবর পেলেন। তার প্রতিকারার্থে চিঠি লিখে পাঠালেন সরকারকে। দুঃখের কথা যে এই নারীর পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখা আজ প্রয়োজনীয় তথ্যাদির অভাবে অত্যন্ত কঠিন।

লক্ষ্ণৌ প্রবাসের ছয় মাসে শরীর খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিলো। ফিরে এসেই এমন কাজে মেতে গেলেন যে সে শরীর আর সেরে ওঠার সুযোগ পেলো না। তার ওপর শুধু স্কুল আর ঘরে থেকে সেবার কাজই তো নয়, ব্রাহ্মসমাজেরও কাজ করতে হবে এবং সেই কাজে নিজে এগিয়ে নারীদের এগিয়ে আসার বার্তা দিতে হবে। বস্তুতঃ এই শেষের কাজটাই তাঁর শরীর ও মনকে কিছুটা চাঙ্গা হয়ে ওঠার সুযোগ দিয়ে দিতো। পাহাড়ে, জঙ্গলে, নদীর ধারে ঘুরে আসার একটা ইতিবাচক প্রভাব তো সবার শরীরে- মনে পড়ে! কিন্তু কাজের প্রচন্ড চাপ, কিছুটা অভাবজনিত আর কিছুটা তপস্বিনীস্বভাব-জনিত অপুষ্টি, অব্যক্ত থাকলেও বড় মেয়ের জন্য মনোকষ্ট (ছোটো মেয়ের বিয়ে হল ১৮৯৪ সালে), দাম্পত্যের স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে জীবনযাপনে ক্ষণিক হলেও দ্বন্দ্বের জ্বালা … সব মিলিয়ে এই মহীয়সী নারীর জীবনের শেষ ঘনিয়ে আনছিলো।

স্কুল শুরু হওয়ার সাত মাসের মধ্যে তাঁর ডায়েরিতে ধরা পড়েছে সাংসারিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার চাপ নিয়ে দুশ্চিন্তা। “৯ সেপ্টেম্বর ১৮৯২ (পাটনা, নবাবের বাঙ্গালা)। প্রার্থনা – গঙ্গার নৌকা দুরকমে চলে। এক, অনুকূল বাতাসে; মাঝিরা বসিয়া আছে, নৌকা আপনি চলিতেছে, খুব বেগে। আর রকমে, নৌকা প্রতিকূলে যাইতেছে, তাহাতে পাল দিয়া, চেষ্টা করিয়া মাঝিরা পালের দড়ি সাবধানে ধরিয়া বসিয়া আছে; যাইতেছে খুব শীঘ্র, কিন্তু ভয় আছে, দড়ি ছিঁড়িলে নৌকা মারা যাইবে। আমার অবস্থাও তাই। ভিক্ষা করি মা, শীঘ্র শীঘ্র অনুকূল বাতাসে আমার জীবন-নৌকাকে নিয়ে ফেল।”

বিদ্যালয় শুরু হওয়ার পর অঘোর কামিনীর চার বছরের নিরলস প্রয়াসে অনেক কিছু বদলে গেলো। ‘অঘোর-প্রকাশ’এ লেখক স্ত্রী-র ৩১শে মার্চ ১৮৯৬এর ডায়েরি থেকে উদ্ধৃত করছেন, “আজ স্কুল কমিটিতে কথা হইল, গবর্ণমেন্টকে বলা হইবে স্কুল হাতে লইতে। আজ গাড়ির খরচের জন্য গবর্ণমেন্ট (special grant) ১৬৮ টাকা দিলেন। স্কুল যখন আরম্ভ করিয়াছিলাম তখন লিস্টে ৫টি মেয়ে। কেবল প্রার্থনা ভরসা ছিলো। আজ সেই প্রার্থনার ফলে স্কুলে প্রায় ৪০টি মেয়ে। অপরিচিত বাবুরা আসিয়া কার্যভার লইয়াছেন। আমাদের অবসর দিতে চান; টাকা অনেক; এখন স্কুল ধনী।”

১৮৯৬ সালের ৫ই জানুয়ারি ছোটো মেয়ে সরোজিনীর শিশুপুত্রটি কিছুদিনের রোগভোগের পর মারা গেল। বস্তুতঃ অসুস্থ শিশুর সেবায় তার মায়ের থেকে বেশি তার দিদাই ব্যস্ত থাকতেন। তাকে সঙ্গে করে সকালের প্রার্থনায় যেতেন। শিশুমুখে সূর্যের আলো পড়লে ঈশ্বরের মুখ যেন প্রত্যক্ষ করতেন। অঘোর কামিনী খুব বড় ধাক্কা খেলেন এই মৃত্যুতে।

স্বামী প্রকাশ চন্দ্রও ব্যথিত হয়েছিলেন। মনোকষ্টে কিছুদিন নানা ব্যাপারে দুজনের মধ্যে মনের অমিল হত। মনোকষ্ট দূর করতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের একটা গুরুত্বপূর্ণ অন্তরঙ্গ অভিব্যক্তি দৈহিক ঘনিষ্ঠতা, আলিঙ্গন, একে অন্যের কাঁধে মাথা রাখা। সেটাকে অতিক্রম করে বা এড়িয়ে গিয়ে, দুর্বলতা মনে করে আত্মিক, সাত্বিক বা পারলৌকিক ঘনিষ্ঠতার সন্ধান সম্ভব কিনা জানি না। কিন্তু তাঁদের যুগ্ম জীবনকাহিনী ‘অঘোর-প্রকাশ পড়ে মনে হয় তার আরো খারাপ প্রভাব পড়তে লাগলো অঘোর কামিনীর শরীরে ও মনে।  একদিন স্বামীর মুখে (হয়তো সেই দৈহিক উদাসীনতা আনার জন্য বলা) রুঢ় কথায় অঘোর কামিনী নিজের ডায়েরিতে লিখলেন, “আজ যে কথাটা স্বামীনের মুখে শুনিলাম, এই ভাবটি আজ কয়মাস হইতে একটু বুঝিতেছিলাম। যাহাই হউক, আজ আমার কি ভয়ানক ঘন পরীক্ষা! আজ প্রায় ত্রিশ বছর একত্র বাস। যাঁহার সঙ্গে চলিব বলিয়া মা, বাপ, ভাই, বোন, দেশ, আহার, পরিচ্ছদ, পৃথিবীর সকল বিষয় হইতে আপনাকে বঞ্চিত করিয়াছি, আজ সেই মুখে আমার এই অবনতির কথা শুনিয়া মনে হয় সেই সময় একটু জ্ঞানহারা হইয়াছিলাম। আর তো কোনো উপায় নাই। সকল দুঃখের কথা যাঁহার নিকট বলিয়া শান্তি পাইতাম, তাঁহার মুখে যখন এই কথা শুনিলাম, তখন সেই অগতির গতির নিকট গিয়া এক ঘন্টা কাঁদিয়া প্রার্থনা করিলাম। বুঝিলাম, তিনি বলেন নাই; মা আমায় শাসন করিলেন।”

কিছুদিন পর - প্রকাশচন্দ্র সে সময় বাইরে কোথাও ছিলেন – অঘোর কামিনী তাঁকে চিঠিতে লিখলেন, “ব্রহ্মপুত্র, তোমার আশীর্ব্বাদপূর্ণ পত্রখানি পাইয়া আপনাকে ধন্য মনে করিলাম। কারণ আমি অনুপযুক্ত। তোমার আশীর্ব্বাদ পূর্ণ হউক, মাকে আমি পাই, তোমার আত্মাকে ক্রয় করি, মা শীঘ্র এই করুন। কারণ, আমার যে আর কোনো কায হবে না যদি তোমার আত্মাকে ক্রয় করিতে না পারি। আমার জন্য সর্ব্বদা প্রার্থনা করিও। আশা করি তুমি মার কোলে ভালই আছ। তোমার মন ভাল আছে জানিয়া সুখী হইলাম। দুঃখ হয়, আমি অনেক সময় তোমার এই সুখের ব্যাঘাত হই, নিজের স্বার্থের জন্য। মা আশীর্ব্বাদ করুন, আমার এই রোগ যেন না থাকে। কেমন করিয়া গৃহে ব্রহ্মকে রাখি, তুমি বাহির হইতে আসিয়া গৃহে ব্রহ্মদর্শন করিয়া শান্তি লাভ করিতে পার, এ বিষয়ে কিছু বলিও। আমার শরীর মন ভাল; আর সব ভাল। এখন আমি জীবব্রহ্মে বেষ্টিত হইয়া এই দুকলম লিখিলাম। আমার চারিদিকে চারখান বেঞ্চ। তাহাতে আমার মায়ের আদরের ২৫টি ছোট জীবন-ধন, মধ্যে আমি। যাহা করি প্রতিদিন তাহা সত্য হউক; ব্রহ্মে নিয়োজিত হউক।”

স্পষ্ট দেখা যায় যে নানারকম জ্বালা-যন্ত্রণা ও আত্মিক দ্বন্দ্বের মধ্যে তাঁর একমাত্র শান্তির জায়গা ছিল বিদ্যালয়, এবং সর্বপ্রধান আর্তি ছিলো, “যাহা করি প্রতিদিন তাহা সত্য হইক”!

ধীরে ধীরে শরীর আরো খারাপ হয়ে আসছিলো। প্রকাশচন্দ্রও বুঝতে পারছিলেন, কিন্তু সরকারি কাজের দায়িত্ব আর তার সঙ্গে নিজেদের আধ্যাত্মিক সঙ্কল্পে অনড় থাকার প্রয়াস! অঘোর কামিনী ব্যথা-মেশানো মস্করা করে ডায়েরিতে লিখছিলেন যে মা তাঁকে খুব ভালোবাসেন বলেই অসুস্থ করেছেন। স্বামী দূরে গঙ্গার কূলে সুখে আছেন, শুয়ে শুয়ে যাতে স্ত্রী স্মরণে সেই সুখের ভাগ নিতে পারেন তাই তাকেও শুইয়ে দিয়েছেন। একদিন লিখলেন, “ … ১০ বৎসর বয়সে যে ব্রত মা জননী অজানিত রূপে আমাকে দিয়াছিলেন, সে ব্রত যেন আমার উদযাপন হয়। পিকু তুমি অবশ্যই জান, আমি আর কোন আশা রাখি না। একটি লোক আপনাকে হারাইয়া কেমন করিয়া অন্যের সহিত মার নামে মিশিতে পারে, এই আমার কায। মা কবে সেদিন দেবেন! তাহারই জন্য এত বহন করা। যখন উদ্দেশ্য ভুলিয়া যাই, তখন শরীর মন ক্লান্ত হইয়া পড়ে। মনে হয় যেন আর চলে না। আবার যিনি চিরদিন আশা দেন, তাঁহার দ্বারা চালিত হইয়া আমি বল পাই। যাক, তুমি যে এত সুখে দিন কাটাইতেছ, শুনে বড়ই সুখ হইতেছে। তোমার সুখে আমার সুখ। মা বুঝি চান না যে আমাদের শারীরিক সুখ হয়, তোমার সঙ্গে আমার শারীরিক সম্বন্ধ থাকে, তাই হয়ত এইরূপ ঘটনা করিতেছেন। এক ঘন্টার পথে থাকিয়াও তুমি আমার শারীরিক কোন অবস্থা বুঝিতেছ না। মন বড়ই ব্যস্ত হইয়াছে চিন্ময় যোগের জন্য। একটা কিছু না হইলে মন শান্ত হইতেছে না। কাল ৫টা হইতে রাত্রি ৯টা পর্য্যন্ত তোমাকে দেখিবার জন্য বড়ই প্রাণ কেমন করিতেছিল, কেন তা জানি না। পত্র পাইলে বুঝিলাম, ঐ সময় তুমিও আমাকে স্মরণ করিতেছিলে। অজানিত রূপে দুটি আত্মা দুটি আত্মাকে আকর্ষণ করিতেছিল, তাই ওরূপ হইতেছিল বুঝি।”

অঘোর কামিনীর মৃত্যুর পর যখন প্রকাশচন্দ্র ‘অঘোর-প্রকাশ’ লিখতে শুরু করেন তখন তিনিও দৌহিত্রের মৃত্যুর প্রভাবটা আরো ভালো করে বুঝতে পারেন। চত্বারিংশ পরিচ্ছেদের নামই দেন ‘মৃত্যুচ্ছায়াময় উপত্যকা’ এবং শুরু করেন, “খোকা যেন তোমার জীবনে পরলোকের ছায়া ফেলিয়া দিয়া গিয়াছিল। ১৮৯৬ সালের যে কয়েক মাস তুমি দেহে ছিলে, দেহের সহিত সংগ্রাম কিরূপে করিতেছিলে তাহা এই পরিচ্ছেদে বলিতেছি। শরীর তোমাকে মুক্তি দিবার পূর্ব্বে আর একবার যেন শেষ দেখা দিয়া গেল; আর একবার তোমার দৃষ্টির সম্মুখে নিবিড় অন্ধকার রচনা করিল।

স্ত্রী অঘোর কামিনীর মানসিক দ্বন্দ্বে স্বামী প্রকাশচন্দ্রের মনেও কম কষ্টের ঝড় ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁদের সঙ্কল্পে নিজের দিক থেকে অনড় ছিলেন। এই অধ্যায়ে এক জায়গায় একসঙ্গে ঘুরে আসার প্রসন্ন বর্ণনার পর লিখছেন, “ইহার পর ২৫শে ফেব্রুয়ারী আমি এই ব্রত লইয়াছিলাম যে কোনও কারণেই তোমার শরীর স্পর্শ করিব না। তাহাতেও যদি ভালোবাসা থাকে তবেই বুঝিব যে স্থায়ী ভালোবাসা হইয়াছে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝিতে পারিলাম যে তোমার শরীর এমন ভগ্ন হইয়াছে যে এখন আর এ ব্রত রক্ষা করা কঠিন হইবে। ২৬শে ফেব্রুয়ারী তোমার পেটে একটা ব্যথা হইল। সেদিনের বিষয় তোমার দৈনিকে লিখিয়াছ, ‘আজ পেটে বড় বেদনা উঠিয়াছিল। স্বামীন সন্তানদের ডাকিয়া সাহায্য করিতে বলিলেন, তাহা নিলাম না। কারণ সংসারের সুখে দুঃখে একজনেরই সাহায্য নেব বলেছিলাম। তাই যদি ভগবান মানা করিলেন তবে তিনি ছাড়া আর কাহারও সাহায্য নেব না। ১১টা পর্য্যন্ত যন্ত্রণার পর নিদ্রা আসিল। মায়ায় পড়িবার ভয়ে স্বামীন জিজ্ঞাসা করিলেন না।’ কেহ যদি আমার দৈনিক পাঠ করেন, তাহা হইলে তিনি দেখিতে পাইবেন, সচেতন হইয়াও সে রাত্রিতে আমি অচেতন পাথরের মত পড়িয়াছিলাম। …”

১৫ই জুন ১৮৯৬ বেলা ২টা ১২য় অঘোর কামিনী দেবীর প্রয়াণ হল। কারণ হিসেবে বইটাতে দুটো ইংরেজি শব্দ লেখা আছে – এন্ডোকার্ডাইটিস এবং রিউম্যাটিজম অফ দ হার্ট। মৃত্যুকালীন যন্ত্রণাময় সে দু’সপ্তাহের প্রসঙ্গে না গিয়ে তাঁর ভালোবাসার মানুষটার মনের বিস্ময়োক্তির কয়েকটি পংক্তি ব্যবহার করেই শেষ করি –

“দেবি, চিরজীবন … বীরনারীর মত মায়ের আহ্বান শুনিয়া চলিয়াছিলে। এ সংগ্রামে কত ক্ষত বিক্ষত হইয়াছ, কেমনে দেহের শোণিত শুষ্ক করিয়া, সুখ ও আরাম বলিদান দিয়া, বিশ্বাসের, সেবার ও চিন্ময় যোগের পতাকা ধরিয়া রহিয়াছ …!”

অবশ্যই তা ভারতীয় নারীর সংগ্রামের এক অমর কাহিনী। নিজের ডায়েরিতে একটি ঘটনায় নিজের প্রতিক্রিয়া লিখতে গিয়ে স্পষ্ট লিখেছেন, “আমার জীবনে নারীকে নিজস্থানে স্থান দিবার জন্য প্রাণপণ।”

অঘোর কামিনী দেবী সত্যিই এক স্বল্পালোচিত বিস্ময়-ব্যক্তিত্ব।  

_____________________________________________________________________________________________

১- “By far the most notable Institution, however, at Bankipur is an unpretentious Boarding House, managed by a Brahmo lady and her two daughters. Mrs. Prakash Chandra Rai is the wife of a gentleman who holds a respectable Government appointment and who is in well-to-do circumstances. At the age of thirty-five, she and her husband took the vow of Brahmacharya and both have religiously observed it up to date. With her husband’s full consent, Mrs. Rai (perhaps I should spell ‘Ray’) went with her two daughters to Lucknow to study at Miss Thoburn’s Institution there. One of the daughters is now twenty-four, the other is much younger. The elder is married, but … … continues to live with her parents and to help them in their beneficent works. The younger girl is a pearl. She is unmarried and looks after the children in the Boarding House with a little mother’s care and sets there the example of true sisterly love and self-sacrifice. Mrs. Ray speaks English fluently and is well read.

“Early in the morning the children in her home offer their prayers in their own simple way, for no set prayers are used and no compulsion is put upon their tender conscience. Each of the elder boarders is in charge of one or two of the younger ones and each keeps a small diary in which she notes down every day her failings and backslidings, if any. The boarders attend the female school conducted under Mrs. Ray’s supervision and are helped in their studies at home by her and her daughters. The whole cost of education and boarding amounts to Rs. 7 and odd per month. The children look blithe and lively and the lessons of purity, self-help and self-sacrifice taught to them by example and precept are likely to have an enduring influence on their after-life. The Boarding House is not kept for profit; indeed, the amount charged to the boarders is much less than the actual cost. The deficit is made up by Mr. Ray who takes the deepest interest in the work of his wife and daughters.”

[Dr. B. C. Roy by K. P. Thomas, 1955]

 

২ – বর্তমান ‘অঘোর প্রকাশ শিশু সদন’, ১৯৪৯ সালে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত।

৩ – “Bidhan realised from early life that his father was not rich, though he earned a modest salary. There were quite a number of other children in the house, mostly orphans, who were not treated in any way different from the actual members of the family. As a result, a feeling of comradeship and kinship grew and existed in the house. Their food, clothing and other things came from a common pool and Bidhan and his brothers, though they were the children of a well-placed Government gazetted officer, never felt that they were in any way distinct or separate from the rest of the little ones in the house, which was named ‘Aghore Paribar’, meaning Aghore family. From very tender age Bidhan and his brothers were made to realise that they had no special position or superior status in the family. Thus, it was shown to Bidhan by his parents that a family was not necessarily composed of blood relations only, but that it could exist on mutual love and understanding among different people,….

[Dr. B. C. Roy by K. P. Thomas, 1955]