বাংলায় রাহুল সাংকৃত্যায়ন কোনোভাবেই অপরিচিত নাম নয়। গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের জনপ্রিয় বইগুলোর বাংলা অনুবাদ, তার নতুন সংস্করণ, পুনর্মুদ্রণ এবং আবার অনুবাদ হয়ে চলেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের জন্ম ও প্রারম্ভিক শিক্ষা উত্তরপ্রদেশে হলেও তাঁর রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্র বিহারের কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন এবং কম্যুনিস্ট পার্টির আন্দোলন। তিব্বত ও শ্রীলঙ্কা থেকে আনা তাঁর নানান বৌদ্ধ স্মারক পাটনা মিউজিয়ামের ‘রাহুল কক্ষ’এ সংরক্ষিত রয়েছে। বিহারেরই জেলে বসে তিনি তাঁর মহান গ্রন্থগুলো রচনা করেছেন। তাই বিহারের সাংস্কৃতিক ও ভাবধারাগত সংগ্রামে তিনি আজও বামপন্থার সবচেয়ে বড় ইউথ আইকন।
কিছুদিন আগে বিখ্যাত মার্ক্সবাদী দর্শনবেত্তা
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের একটা দীর্ঘ ভিডিও (৪ পর্ব), পাভলভ ইন্সটিট্যুট থেকে ইউটিউবে
আপলোড হয়েছে। “মার্ক্স এলেন ভারতে” শীর্ষক বক্তৃতামালায় তিনি চারজন বিদ্বানকে নিয়ে
আলোচনা করেছেন – ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, দামোদর ধর্মদত্ত কোসাম্বি
এবং রাহুল সাংকৃত্যায়ন। অবশ্যই মার্ক্সের জীবনী এবং সমাজবাদ সম্পর্কিত লেখালিখি তার
আগেই কিছু এসে গিয়েছিলো; কম্যুনিস্ট পার্টির উদ্ভবের ঘটনাটার গুরুত্ব তো ছিলোই। কাজেই
মার্ক্সবাদের সঙ্গে ভারতীয় মানসের প্রথম পরিচয় হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এই চারজন ভারতে
জ্ঞানচর্চায় মার্ক্সবাদের ব্যবহারে পথিকৃৎ, এটাই রামকৃষ্ণবাবুর বক্তব্য।
এই চারজনের মধ্যে একমাত্র রাহুলেরই পারিবারিক
প্রেক্ষাপট গ্রামীণ ও কৃষিভিত্তিক। একমাত্র রাহুলই হিন্দিভাষী। যাকে ইংরেজিতে বলে প্রলিফিক,
সেই জাতের লেখক ছিলেন তিনি (রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বলেছেন ‘দুহাতে লিখতেন’ – সত্যিই তাই!)।
আর প্রায় এক ডজন ভাষা জানা সত্বেও, দুয়েকটি সংস্কৃত, পালি বা দরকারে ইংরেজি লেখা ছাড়া
গ্রন্থের পর গ্রন্থ হয় হিন্দিতে লিখে গেছেন অথবা হিন্দিতে অনুবাদ করে গেছেন। তাই স্বাধীনতা-পরবর্তী
ভারতে, বিশেষ করে যে এলাকাটি ‘গো-বলয়’ বলে চিহ্নিত, সেখানে রাহুলের জীবন ও কাজের গুরুত্ব
অপরিসীম।
বাকি তিনজনের মত রাহুল কিন্তু জ্ঞানচর্চার
জগতের মানুষ ছিলেন না। বাড়ি থেকে পালানো ছেলে, পালাবার প্রবৃত্তি থেকে ভবঘুরে হয়ে উঠলেন;
সেই ভবঘুরেমির পথে এল সাধুসঙ্গ – বৈষ্ণবসঙ্গ, আর্যসমাজ-সঙ্গ, (পরোক্ষে নিজের জন্মের
তথাকথিত ‘ব্রাহ্মণত্ব’ ত্যাগ), বৌদ্ধ-সঙ্গ (বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন
নামগ্রহণ) এবং মার্ক্সবাদ-সঙ্গ (কৃষক-শ্রমিক সংগ্রামের পথে মার্ক্সবাদে দীক্ষা) এবং
এই পথেই ধরলেন জ্ঞানচর্চা – রামকৃষ্ণবাবুর ভাষায় তিনি হলেন ‘জ্ঞানভিক্ষু’। আর তাই,
জ্ঞানচর্চার পথে গিয়েও তাঁর লেখায় মুখ্য ধ্যেয় হয়ে উঠলো ‘যতটা পারো সহজ করে মানুষকে
বোঝাও; সহজভাবে বোঝাও’!
তাঁর যে এই মানবদরদী স্বভাব, তার একটা নির্মিতি
পাঠকেরা ‘আমার জীবনযাত্রা’ (প্রথম ভাগ)এ, উত্তরপ্রদেশের আজমগড় জেলায় অবস্থিত তাঁর মাতৃগ্রাম
পন্দহায় (তাঁর জন্মস্থান) এবং পিতৃগ্রাম কনৈলায় কাটানো তাঁর বাল্যজীবনের বর্ণনায় খুঁজে
পাবেন। তবে একটা বর্ণনা গুরুত্বপূর্ণ তাই আলাদা করে উল্লেখ করছি। কোনো না কোনো দুষ্টুমি
করলে বা কাজে ভুল করলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া শুরু করেছিলেন চোদ্দ বছর বয়স থেকে।
আর প্রথমবার পালিয়েই এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে পৌঁছে গেলেন কলকাতা। ১৯০৭ সালের কলকাতা। গিয়েই
ঐ বিশাল মহানগরে কিছুটা কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়েও আরো সব বাড়ি থেকে পালানো ছেলেদের সঙ্গে
বন্ধুত্ব পাতালেন, একসঙ্গে থাকা শুরু করলেন জোড়াসাঁকো পাড়ায় আর কাজ খোঁজা শুরু করলেন!
“একবার হাওড়ায় বার্ন কোম্পানিতে কাজের খোঁজ
পেলাম। ঠিকাদারেরা কুলিদের কাজে ভর্তি করত। ঠিকাদার আমাকে কাজ দেয়। কাজ ছিল যেখানে
গাড়ি রাখা হত সেখানে মালগাড়ির চক্রনেমির এধার ওধার তেল ও ছেঁড়া কাপড় দিয়ে রগড়ে ঝকঝকে
করা। ঐখানে টিনের ছাদের নিচে কয়েকশ’ লোহার মজুর কাজ করত। জায়গায় জায়গায় পাইপ থেকে হাওয়া
বেরিয়ে আসত যাতে পাথর কয়লার উনুন জ্বলত। ছোট হাতুড়ি আর বড় হাতুড়ির আওয়াজে টিনের ছাদ
ঝনঝন করত। …” এতেই বাড়ি থেকে দূরে অজানা জায়গায় কপর্দকশূন্য হলেও যে বেঁচে থাকার চেষ্টা
করা যায়, এই সাহসটা তৈরি হয়েছিলো। ভবঘুরে হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিলো।
(কেমন অবাক লাগে না? একই পাড়ায় তখন ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ! সে বছরই তিনি একটু আগে
বা পরে মুঙ্গের গেছেন এবং ছোট ছেলে শমীর মৃতদেহ সৎকার করে ফিরেছেন!)
প্রত্যেক মহান ব্যক্তির আত্মসংগ্রামের নিজস্ব
বৈশিষ্ট্য থাকে। সেই আত্মসংগ্রামের কাহিনীতে চেনা যায় দেশ, বিশ্ব। তাই আমরা জীবনী পড়ি,
আত্মজীবনী লেখা হয়ে থাকলে আরো আগ্রহ সহকারে পড়ি। সংক্ষিপ্ত পরিসরের এই লেখায় কেদারনাথ
পাণ্ডের রাহুল সাংকৃত্যায়ন হয়ে ওঠার যে বর্ণাঢ্য, বৈচিত্রময় আত্মসংগ্রাম, বা তাঁর পরিব্রাজন
পথের বৃত্তান্তে চিত্রিত দেশ ও বিশ্বের জীবনচিত্র, তার সামান্যতম আভাস দেওয়াও কঠিন।
যে রাহুলকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল
দশকগুলোয় আমরা পেয়েছি বিশ্বভবঘুরে মহাপণ্ডিত হিসেবে, মূল্যবান বহু বৌদ্ধ আকরগ্রন্থের
দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপিগুলোর সংগ্রাহক হিসেবে, মেহনতী মানুষের সংগ্রামে সক্রিয় কর্মী
হিসেবে এবং বিরাট মাপের লেখক হিসেবে, সংস্কৃতি ও ভাবধারার জগতে তিনি আমাদের একই সঙ্গে
দু’ধরণের অস্ত্রের যোগান দিয়েছেন।
(১) মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভারত ও বিশ্বকে
বোঝার, বোঝাবার চেষ্টা করেছেন; পূঁজিবাদী সমাজে মানুষের ক্ষয়কে চিহ্নিত করেছেন; মেহনতী
মানুষকে এই অন্যায়পূর্ণ দুনিয়াটা বদলে দেওয়ার আহ্বান করেছেন। মার্ক্স, লেনিন, স্টালিন,
মাও-সে-তুঙের জীবনী, ‘পালিওনা, দুনিয়াটা বদলাও, ‘তোমাদের ক্ষয়’, ‘সাম্যবাদই কেন’ ইত্যাদি
রচনার সঙ্গে সঙ্গে ‘ভোল্গা থেকে গঙ্গা’, ‘কনৈলার বৃত্তান্ত’ ইত্যাদি সভ্যতার বিকাশের
আখ্যানগুলো লিখে বস্তুবাদী ইতিহাসদৃষ্টিকে সহজবোধ্য রূপে রেখেছেন।
(২) বৌদ্ধধর্মের মহান আকরগ্রন্থগুলোকে অনুবাদ
করে, বৌদ্ধমত-বিষয়ক নানান গ্রন্থ রচনা করে দেখিয়েছেন যে মূল বৌদ্ধমত ভারতীয় নিরীশ্বরবাদ
ও প্রাচীন বস্তুবাদের ধারাবাহিকতায় এক বৈপ্লবিক অগ্রগতি (প্রথম বোধহয় ইয়োরোপীয় ভারততত্ত্ববিদেরা
নিরীশ্বরবাদের এই ধারাবাহিকতা ভারতের প্রাচীন দার্শনিক মতগুলোর কয়েকটিতে চিহ্নিত করেছিলেন;
বাংলায় অক্ষয় কুমার দত্ত নিজের ‘ভারতীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থের উপক্রমণিকাতে সেই
যুক্তিবিন্যাস অনুসরণ করেছিলেন, কিন্তু হিন্দিতে সেই ধারাবাহিকতা এবং বিশেষকরে বৌদ্ধমতের
বিশদ ব্যাখ্যা রাহুল সাংকৃত্যায়নই করলেন)। শুধু তাই নয়, দিগ্ঘনিকায়, মজ্ঝিমনিকায়,
ধম্মপদ ইত্যাদি গ্রন্থগুলোর হিন্দি অনুবাদ করে তিনি হিন্দির অন্যান্য লেখকদেরও ঐ পথে
এগোবার পথটা সহজ করে দিলেন। তিনি এটাও দেখালেন যে বৌদ্ধদর্শনের সঙ্গে মার্ক্সীয় দর্শনের
এক আশ্চর্য মিল আছে!
যত সহজে বলে দিলাম ব্যাপারটা তত সহজ নয়। তাঁর
রচনার বিষয় বিবিধ, ক্ষেত্রও বিশাল। উপরুল্লিখিত দুই ধারা ছাড়াও আরো বহু বই, ভ্রমণকাহিনী,
স্মৃতিচারণ, ‘বিশ্বকোষ’ ধরণের কিছু গ্রন্থ, যেমন ‘দর্শন-দিগদর্শন’, ‘সংস্কৃত কাব্যধারা’,
‘শের-ও-শায়েরি’, দেশের রাজনৈতিক নেতাদের জীবনীসংগ্রহ … সেগুলো আয়তনেও বড়। অনেকগুলো
ইতিহাস এবং ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাস এবং আখ্যানমালা। আরো কিছু জীবনী। প্রচারধর্মী প্রবন্ধমালা।
অনবরত লিখে গেছেন এবং হিন্দিভাষাকে সহজ লৌকিকতায় সমৃদ্ধ করে গেছেন। প্রত্যেকটি সৃজনকর্মে
নিজের বস্তুবাদী দৃষ্টির ছাপ রেখেছেন।
রাহুলের একটি সংস্কৃত প্রবন্ধ আছে – ‘বুদ্ধমার্ক্স্যোর্বাদসাম্যম্’।
বা হয়তো বক্তৃতা। বারাণসীর সম্পূর্ণানন্দ সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি গ্রান্টের
টাকায় ১৯৮৫ সালে ‘বৌদ্ধদর্শন ও মার্ক্সবাদ’ বিষয়ক একটি আলোচনাচক্রের আয়োজন করে। সেই
উপলক্ষে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিলো। তাতে প্রথম সঙ্কলিত প্রবন্ধ ছিলো রাহুলের
উপরুল্লিখিত লেখাটি এবং তার হিন্দি অনুবাদও ছিলো তার সঙ্গে। সেই অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত
করছিঃ
“বুদ্ধ এবং মার্ক্স দুজনেরই অভিপ্রেত ছিলো
মানুষের সাম্য। মানুষের প্রতিভায় ভেদ থাকতে পারে। এক বাড়িতে বাপ-মা এক হলেও সন্তানদের
বুদ্ধিতে বৈষম্য দেখা যায়। তা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে হীন বা উত্তম হওয়ার ভাবনা থাকে
না। তাদের মধ্যে এক বাপ-মায়ের সন্তান হওয়ার বোধ, বন্ধুত্ব, ও স্নেহ থাকে; ভোগের অধিকারও
সবার সমান থাকে। মার্ক্স সব মানুষের মধ্যে পারস্পরিক এই ধরণের আচরণ চান। বুদ্ধও তাই
চাইতেন। কিন্তু তৎকালীন সমাজে এই আচরণকে ব্যবহারিক রূপ দেওয়া সম্ভব নয় জেনে সমাজের
একটি অংশেই ভোগের সাম্য প্রচলিত করলেন, যাকে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সঙ্ঘ বলা হয়। তাঁর আশা
ছিলো যে সাম্যের ভাবনা-ভিত্তিক সঙ্ঘ-জীবন দেখে মানুষ আকৃষ্ট হবে। বুদ্ধের যুগে যেটা
অসম্ভব ছিলো, মার্ক্সের যুগে সেটা সম্ভব। তাই মার্ক্স সম্পূর্ণ মানবজাতির আর্থিক সাম্যের
তত্ত্ব প্রসারিত করলেন।” লেখাটিতে পর পর আরো কয়েক দিক থেকে দুটি ভাবধারার মিল দেখানো
হয়েছে। সবশেষে বৌদ্ধদর্শনে দ্বান্দ্বিকতা এবং মার্ক্সীয় দ্বান্দ্বিকতার মিলও দেখানো
হয়েছে।
মূলতঃ তিনি যে ভবঘুরে
সেটা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন। ভবঘুরে হতে যুবকদের উৎসাহিত করতে বইও লিখেছেন ‘ঘুমক্কড়
শাস্ত্র (ভবঘুরে শাস্ত্র)’। বাইরের অর্থাৎ মানুষের মাঝে চলার যাত্রাপথটাই ক্রমে শিক্ষার,
পঠনের, জ্ঞানের ও চেতনার ও সবশেষে সৃজনের যাত্রাপথে তাঁকে এগিয়ে দিয়েছিলো। আর ফিরিয়ে
এনেছিলো আবার মানুষেরই কাছে, সংগ্রামী রূপে! শৈশব থেকে তাঁর কানে বাজতো মাদ্রাসায় পড়া
শে’র – ‘সৈর কর দুনিয়া কী, গাফিল জিন্দগানী ফির কাহাঁ / জিন্দগী গর কুছ রহী তো নৌজবানী
ফির কাহাঁ!’
২৯.৩.২০২৪
(৭ই এপ্রিল 'কালান্তর'এ প্রকাশিত)
No comments:
Post a Comment